অপারেশন ডি সি অফিস
বাংলার প্রতিটি বালিকণা মুক্তি সংগ্রামের প্রতি একাত্ম। বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধে মুক্তিসংগ্রামীরা পথ চলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় হানাদার নিধনে। বাংলার প্রকৃতি জয় বাংলার সুরে আন্দোলিত হয়। নিসর্গ পথ দেখিয়ে দেয় বীর সংগ্রামীদের। পাকবাহিনী কুকর্মের সংবাদ নিসর্গের মৃদুমন্দ সমীরণের ওপর ভর করে পৌছে যায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিকট। পাকবাহিনীর চোখের সামনেই ঘটেছে সব। কিন্তু বর্বরের দল কিছুই বুঝতে পারছে না। পারবে কেমন করে? তাদের মন তাে মজে রয়েছে অপকর্মের দিকে। সৈনিকের মর্যাদা কি তারা রক্ষা করতে পেরেছে? সম্মানিত পাঠক বর্বরের বর্বরতা ইতিহাসের পাতায় এভাবেই তাে স্থান পাবে। তাই তাে তারা সমস্ত বিবেককে বিসর্জন দিয়ে অপকর্মের জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। শীতের সকাল। রবি শশীর উষ্ণ আমেজ কাটতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং তখন জমে ওঠেনি। মানুষ আসতে শুরু করেছে। পুরাে চট্টগ্রামের মানুষ আসে এখানে মামলা মােকদ্দমাসহ প্রশাসনিক কাজ সম্পন্ন করার জন্য। সেই বৃটিশ যুগে তৈরি হয়েছিল এ ভবন।। চুন সুরকির এ লাল ভবনটি শতাব্দীর তিলক চিহ্ন হয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের বুকে। ন্যায় বিচার ও পবিত্র অঙ্গন চট্টগ্রাম কের্টি বিল্ডিং। পাকহানাদারদের হিংস্র পরশে ও অপকর্মে হারিয়েছে অতীত ঐতিহ্য এবং পবিত্রতা। এখানে বসেই নির্দেশিত হচ্ছে বাঙালি নিধন যজ্ঞের মহাপরিকল্পনা। মা, বােনদের ইজ্জত হরণের মহাউল্লাস। সব কিছুই হচ্ছে শান্তি সৌহার্দের ছদ্মাবরণের তলে। একশ্রেণীর স্থানীয় কুলাঙ্গার সহযােগিতা দিচ্ছে পাকহানাদারদের। ইতিহাসের বিচারে সুস্পষ্ট প্রমাণিত পাকহানাদারদের সহযােগীরা ছিল রক্ত পিচ্ছিল পথের জন্মদাতা। সকালের সােনালী রােদের অবসান হল।
তাপের তীব্রতা বাড়ল। কোর্ট বিল্ডিং চত্বরে মানুষের আগমনও বাড়ল। পশ্চিমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলেন দু’জন তরুণ। অনেকের মাঝে এদের কে খবর রাখে। সকাল তখন দশটা। তরুণ দু’জন সােজা উঠে এলেন তিন তলায়। দু’জনের হাতে দুটি ফাইল। দেখলে যে কেউ বলবে মামলার কাজে এসেছে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ঢিলেঢালা জ্যাকেট। দু’জনের দেহে অতি সাধারণ পােষাক। তবে একজনের গায়ে বাড়তি একটি চাদর রয়েছে। তিনতলায় দাঁড়িয়ে দেখছেন নিচের দিকে। অনেক সৈন্য নিচে। সবার হাতে অস্ত্র । নেমে এলেন দোতলায়। দোতলার সিঁড়ির মুখে দেখলেন ক’জন সৈনিক অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে। ডিসি অফিস পাহারা দিচ্ছে। এখানেই বসবে শান্তি কমিটির সভা। আবার উঠে এলেন তিনতলায়। একে অপরের সাথে নিচু স্বরে পরামর্শ করে নিলেন। কোনাে অবস্থাতেই ডিসি অফিসে অপারেশন করা যাবে না। তিনতলায় উঠে এদিকে ঘুরলেন। এসে দাঁড়ালেন বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সামনে। এখানে মানুষজন কম। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। সবাইকে পরিস্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে। তরুণ দু’জন ঠিক করলেন এখান থেকেই গ্রেনেড ছুড়ে মারতে হবে নিচে। বাঁশির শব্দ হল। মানুষজনের চাপ নিচে। পাকবাহিনীর সৈনিকরা বাঁশির শব্দের সাথে সাথে সােজা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চারদিকে সাজ সাজ রব। উধ্বর্তন সামরিক কর্তারা আসছেন।
সাইরেণ ধ্বনি দিয়ে এসে থামল একটি সামরিক জীপ। নেমে এল একজন তরুণ সামরিক অফিসার। সে একজনের সাথে কথা বলে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে গেল। কোর্ট বিল্ডিং-এর উপস্থিত সবাই দেখছে পাকসামরিকবাহিনীর কার্যক্রম। নিচে মানুষের চলাচল
আপাততঃ করতে দেয়া হয়েছে। একজন সামরিক অফিসার বাঁশি বাজাল। সবাই এটেনশান পজিশন হল। সাইরেণের ধ্বনি তীব্র হল। অনেকগুলাে সামরিক মটর সাইকেল সুশৃঙ্খল ভাবে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। পেছনে দামী গাড়িতে বসে আছে উর্ধ্বতন কর্তারা। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে প্রথম এল সামরিক অফিসার আনসারী। তাতে তরুণ দু’জনের মাথায় রক্ত উঠে গেল। এই সেই আনসারী। কুখ্যাত নারী নির্যাতকারী। অসংখ্য মা, বােনের ইজ্জত হরণকারী কুকুর। আনসারীর হাতে মরেছে অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষ। আনসারী গাড়ি থেকে নেমেই এল একটি সামরিক গাড়ির নিকট। স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল। নেমে এল এক সেনা অফিসার। কি তার নাম জানা যায়নি। অন্যান্য গাড়ি থেকে নেমে এসে অফিসাররাও তাকে স্যালুট করল। বিমান ও নৌ বাহিনীর উর্ধ্বতন অফিসাররাও তার সাথে করমর্দন করল। এমনি সময় পাকিস্তানী পতাকা উড়াতে উড়াতে এল স্থানীয় শান্তি কমিটির ক’জন উর্ধ্বতন নেতা। কোর্ট বিল্ডিং-এর দোতলা ও তিনতলা থেকে লােকজন হুমড়ি খেয়ে দেখছে। তরুণ দু’জন বুঝে নিলেন। এই মােক্ষম সুযােগ। দ্রুত ঢুকে পড়লেন একটি কক্ষে। জ্যাকেট ও চাদরে ভিতর থেকে বের করলেন গ্রেনেড। পিন খুলে নীরবে এসে দাঁড়ালেন। নিচে তাকালেন আরও একবার। সবাই ঐ অফিসারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন কেউ দেখছে কিনা। সবার দৃষ্টি নিচে।
ছুড়ে মারলেন গ্রেনেড দুটো। সামরিক বাহিনীর সামনে রাস্তায় পড়ে বিস্ফোরিত হল প্রচন্ড শব্দে। কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। মানুষজন মনে করেছিল সামরিক বাহিনীর তােপধ্বনি। যারা আওয়াজ বুঝল তারা ছুটতে শুরু করল। ছুটছে সবাই। যে যে দিকে পারছে। নিচে পাকবাহিনী তীব্র ভাবে বাঁশি বাজাচ্ছে। মুক্তির সৈনিকরা ততক্ষণে পৌছে গেছে নিউমার্কেটের সামনে। ডিসি অফিসের সংবাদ সর্বত্রই পৌছে গেছে। মানুষের সাথে স্থানীয় উধ্বতন দালাল শান্তি কমিটি সদস্যরাও লেজ তুলে পালাল। পন্ড হল ডিসি অফিসের শান্তি কমিটির যৌথ বৈঠক। এ অপারেশনের পেছনে যার সবচেয়ে বেশি দান তিনি হলেন তৎকালীন ডিসি অফিসের পিয়ন মােহাম্মদ আলী। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। এ সভার বিভিন্ন তথ্য তিনি সরবরাহ করেছিলেন। কিন্তু অপারেশনের সংবাদ এবং অপারেশন প্রক্রিয়া তাকে জানান হয়নি। কারণ হিসেবে মুক্তিযােদ্ধা গবীর উল্লাহ বলেন, তার থেকে সব তথ্য নিয়েছি সত্য কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে অপারেশনের তারিখ বলিনি। সে তথ্য না দিলে এ অপারেশন হত না। এ অপারেশন সম্বন্ধে গােপনীয়তা রক্ষা করতে হয়েছে। অপারেশনের পর মােহাম্মদ আলী সবই জেনেছিলেন। ডিসি অফিসের শান্তি কমিটির সভা পন্ড করতে ভূমিকা পালন করছিলেন ফয়েজুর রহমান ও গরীব উল্লাহ। অবশ্য পূর্ব পরিকল্পনা তেমন ছিল না অপারেশনের ব্যাপারে। এ সভাপড হওয়াতে সামরিকবাহিনী স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতাদের বিশেষ গুরুত্ব দিত না। এতে স্বাধীনতা বিরােধীরা মনােবল হারিয়ে ফেলে। (সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত