You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন সাহেব পাড়া - সংগ্রামের নোটবুক
অপারেশন সাহেব পাড়া
সবাই আজ যোদ্ধা। অলি-গলি, প্রান্তরে প্রতিরােধ। পাকবাহিনীর ঠাহর করতে পারছে না কারা মুক্তিযােদ্ধা। বাংলার আকাশ-বাতাস প্রতিটি বালিকণা বলছে কুকুরের দলকে তাড়াতেই হবে। স্বাধীনতা প্রত্যাশী বীর মুক্তিযােদ্ধারা সুযােগের প্রতিক্ষায়। সুযােগ পেলেই হানছে আঘাত। মরণঘাতি আঘাতের চোটে পশ্চিমা বর্বরের দল খুঁজে নিচ্ছে মৃত্যুর ঠিকানা। মুক্তিযােদ্ধা বিচ্ছুদের বুদ্ধির কৌশলের নিকট বর্বরের দল হা-পিত্যেস করে মরেছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়। মুক্তিযােদ্ধাদের চট্টগ্রাম শহরে বিচরণ বেড়ে গেছে। শহরের প্রতিটি অঞ্চলে তাদের আবাস বাড়ছে তাে বাড়ছেই। প্রতিটি ঘর এখন প্রতিরােধের দূর্গ। সদরঘাট গােপন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসেছেন একজন গেরিলা যােদ্ধা। উদ্দেশ্য সতীর্থের সাথে যােগ দেয়া। সকাল প্রায় ১০টা। রাস্তায় নেমে দেখে নিলেন তার পার্শ্বিক অবস্থা। পথ চলছেন শান্ত সুবােধ বালকের মতাে। চলার গতি দ্রুত। কারণ সঠিক সময়ে তাঁকে পৌছতেই হবে দলীয় অধিনায়কের কাছে। দু’জন বসে ঠিক করবেন একটি বিশেষ অপারেশন প্ল্যান। সদরঘাট গােপন আশ্রয় কেন্দ্রটি কর্ণফুলীর কোলে ঘেঁষে। এখানে অবস্থান ছিল রেডিওর নিউজ এডিটর সুলতান আলী সাহেবের। স্বাধীন বাংলা বেতার চালু ও মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা দেয়ার পেছনে তার ভূমিকা ছিল। সদরঘাট বার্মা ইষ্টার্ণ (বর্তমান পদ্মা অয়েল কোম্পানী )-এর বিপরীতে রেল লাইনের দক্ষিণে ছিল সুলতান সাহেবের বাসা। তাঁর বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন মুক্তিযােদ্ধা রহমান। তিনি দেরাদুন থেকে ট্রেনিং নিয়ে (বিএরএফ এর ২য় ব্যাচ) প্রথমে প্রবেশ করেন বৃহত্তর নােয়াখালী অঞ্চলের ফেনীতে।
সেখানে তিনি অংশ নেন বেশ কটি বড় অপারেশনে। এর অন্যতম ছিল আলােড়ন সৃষ্টিকারী শুভপুর ব্রীজ অপারেশন নেতৃত্বে ছিলেন বীর মুক্তিযােদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের। শুভপুর অপারেশনের সম্মুখ সমরে পাকবাহিনী সম্পূর্ণ রূপে পরাস্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ক’জন পাকসেনাকে জীবন্ত ধরে নিয়ে আসেন। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করে। পরে মফিজুর রহমান চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে আজিজুল হক আজিজের দলে। এ দলে যােগ দিয়ে তিনি বেশ ক’টি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। হােটেল আগ্রাবাদ অপারেশন, জাম্বুরী মাঠের ট্রান্সফরমার, ফজলুল কাদের সভা পন্ড, দালাল মােহাম্মদ আলীর বাড়ি অপারেশন, একরাতের যৌথ অপারেশনসহ আরাে বেশ ক’টি অপারেশনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। অবশ্য ৩০শে নভেম্বর ‘৭১ মুগলটুলী আবদুর রহমানদের বাড়িতে আজিজের শেল্টার থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় কবির তােরণের প্রায় ২০০ গজ উত্তরের পুকুর পাড় থেকে তাকে পাকবাহিনী গ্রেফতার করে। তখন তার কাছে ছিল একটি রিভলবার। তিনি তখন যাচ্ছিলেন দলীয় নির্দেশ মতাে লালদিঘীর পাড়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীর সভা ভন্ডুল করতে। পাকবাহিনীর একজন দোসর বােরহান উদ্দিন বিপুল মহিলার পােষাক পরে বােরখা গায়ে দিয়ে পাক জীপ থেকে মফিজুর রহমানকে ধরিয়ে দেয়। অনেক নির্যাতন ভােগ করে তিনি বিজয় দিবসের দিন বের হয়ে আসেন মুক্ত বাংলার মাটিতে। সদরঘাটের গােপন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসতেই দেখেন একজন পাকসৈনিক একমনে নিষিদ্ধ পল্লীর দিকে তাকিয়ে। তাকে দেখে তার সন্দেহ হতেই পিছিয়ে আসলেন। একটি গলির মুখে লুকিয়ে দেখলেন কিছু সময়।
তখন পাকসেনাটি ঐদিকে তাকিয়ে। তার কোমরে ঝুলছে একটি রিভলবার। মুক্তিযােদ্ধা মফিজুর রহমানের চোখ পড়ল তার ঝুলন্ত রিভালবার টির দিকে। কারণ এ সময় শহরে অবস্থানরত গেরিলা যােদ্ধাদের রিভলবার। জাতীয় অস্ত্রের প্রয়ােজন বেশি। পাকসেনার রিভলবারটি পেতে তার মন আনচান করছে। অনেক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করে ফলাফল পাওয়া গেল। অর্থাৎ একজন পাকসেনা প্রবেশ করেছে সাহেব পাড়ার নিষিদ্ধ পল্লীতে। সে বেরিয়ে এলে এ সেনাটি প্রবেশ করবে। মুক্তির সেনা মফিজুর রহমান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সুযােগ হাত ছাড়া করা যাবে না। ভাবছেন কিভাবে পাকসেনাটিকে পরাস্ত করে কোমরের ঝুলন্ত রিভলবারটি দখল করা যায়। কেটে গেল কিছু সময়। মুক্তির সেনাটি চারদিকে দেখে নিলেন। তার নজরে পড়ল একটি লাকড়ির দোকানের প্রতি। অনেক লাকড়ি থরে থরে সাজান। এগিয়ে এলেন। দোকানের সামনে। প্রবেশ করলেন ভিতরে। দোকানে কেউ নেই। লাকড়ীর দোকান। থেকে পাকসৈনিকটির দূরত্ব বেশি নয়। ২০/২৫ গজ। পাকসৈনিকটির কোনাে দিকে খেয়াল নেই। এক দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ পল্লীর গলির মুখের দিকে তাকিয়ে।
রাস্তার পাশ দিয়ে মানুষজন চলাচল করছে। পাকসৈনিক দাড়ান দেখে মানুষজন ভীত। যানবাহন ছুটছে রাস্তা দিয়ে। পাক সৈনিকটি দাঁড়িয়ে থাকার কারণে রাস্তার মানুষজন কমে এসেছে। মুক্তির সেনাটি কিন্তু এতক্ষণে বেছে নিয়েছে একটি গােলগাল শক্ত লাকড়ির তিনহাত লম্বা টুকরাে। অত্যান্ত কৌশলে এগুচ্ছ পাকসেনাটির দিকে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। মুক্তির সেনাটি চলছে। পাকসেনাটি টের পেলে মৃত্যু অবশ্যাম্ভবী। আঁকা বাঁকা গলির পথ পেরিয়ে খানসেনার ঠিক পেছনে গিয়ে থামল। দূরত্ব মাত্র ৫/৭ গজ। চোখ মুখ বন্ধ করে পেছনে থেকে সজোরে আঘাত করল তার মাথায়। চোখের পলকে পাকসেনাটি ঢলে পড়ে গেল মাটিতে। মুক্তিযােদ্ধা মফিজুর রহমান অতিদ্রুত পাকসেনাটির কোমর থেকে রিভলবারটি ছিনিয়ে গলির পথ দিয়ে পালিয়ে গেলেন। খানসেনাটি মাটিতে পড়ে রয়েছে। তার এ অবস্থা দেখে ছুটছে মানুষজন। রাস্তা ঘাট সম্পূর্ণ ফাকা। নিষিদ্ধ পল্লী থেকে বের হয়ে এল আরাে দু’জন খানসেনা। তারা রাস্তার উপর পতিত সতীর্থের অবস্থা দেখে ভয় পেল। আশে পাশে মুক্তিযােদ্ধে আছে জেনে উপরের দিকে গুলি ছুঁড়ল।
রাস্তা তখন জনশূন্য। নিষিদ্ধ পল্লীর গলিমুখে দু’জন খানসেনা আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ধারণা মুক্তিযােদ্ধারা আশে পাশে লুকিয়ে রয়েছে। রাস্তার ওপর তখন পড়ে রয়েছে সেই পাকসৈনিকটি। প্রচন্ড আঘাতে সে জ্ঞান হারিয়েছে। জীবিত কি মৃত বুঝা গেল প্রায় দু’ঘন্টা পর। ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল একটি আর্মি জীপ। দেখল একজন পাকসৈনিক রাস্তার ওপর পড়ে রয়েছে। তারা নেমে এসে দেখল সৈনিকটিকে। তাকে গাড়িতে তুলতেই নিষিদ্ধ পল্লীর গলি থেকে বের হয়ে এল বাকী দু’জন খানসেনা। সেই সৈনিকটি মারা গেছে। জীপের পাকসৈনিকরা দু’জন খানসেনার সাথে কিছু সময় পরে দ্রুত তাদেরকে জীপে তুলে পালিয়ে গেল। তাদের দেখে মনে হল আর্মিরাও ভীষণ ভয় পেয়েছে। রাস্তার পাশের বড় বড় গাছগুলােতে অসংখ্য কাক। কাকের জটলা দেখে খানসেনারা অন্য কিছু মনে করেছে। সেদিকে গুলি ছুড়ে তারা চলে গেল। (সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত