You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন সদর ঘাট পাক-প্রেমিক ডাক্তারের চেম্বার
অতি উৎসাহী হয়ে ক’জন সহযােগী হয়েছে পাকহানাদারদের। আসলে হানাদার বাহিনীও তাদের পছন্দ করে না। তাদের দিয়ে অপকর্ম করিয়ে নিচ্ছে। স্বদেশীদের বিরুদ্ধে কাজ করে ভিনদেশীদের সহযােগিতা হাস্যকর ব্যাপার। এ ধরনের সুবিধাভােগী জাতি উৎসাহী বাঙালিদের চরম শিক্ষা দিতে এগিয়ে এলেন স্বদেশী প্রাণত্যাগী যােদ্ধারা। যুদ্ধের ভয়াবহ সময়ে মুক্তির সৈনিকরা জনতার সমুদ্রে অবস্থান নিয়ে বর্বর পাকবাহিনীর সখের ঘরে আগুন দিয়ে চলেছে। এ আগুন স্বাধীনতার জন্যে, মুক্ত বিবেকের জন্যে।
মুক্তিযােদ্ধারা তখন ভীষন অর্থ কষ্টে। প্রশিক্ষণ শেষ করে এসেছেন অনেকে। এছাড়াও স্থানীয় ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে শহরে প্রতিনিয়ত অপারেশন করে যাচ্ছে। মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিমিত অর্থে আর কুলচ্ছিল না। তাই ক’জন মুক্তিযােদ্ধা ঠিক করলেন অর্থ সংগ্রহ করতে হবে এবং কাজের গতি আরাে বাড়াতে হবে। চিন্তা করলেন কোথায় গেলে টাকা পাওয়া যাবে। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন কোন ব্যাপক অপারেশন করা যাবে না। কারণ আমেরিকান ব্যাংক অপারেশন করার কারণে সব ব্যাংকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা হয়েছে জোরদার আর প্রতি ব্যাংকে সিভিল ড্রেসে আর্মি পাহারায় রয়েছে। সন্দেহ হলেই তারা চেক করে বসে। তাই ব্যাংকের চিন্তা বাদ দিতে হল। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল স্থানীয় কোন পাকবাহিনীর দোসরের বাড়িতে হানা দিতে হবে। খুঁজতে লাগলেন কে এমন ব্যক্তি! মাত্র দু’দিন খুঁজতেই পেয়ে গেলেন একজনকে। মফজল পেশায় চিকিৎসক।
সদরঘাটে তার চেম্বার। লােকটি প্রকাশ্যে পাকবাহিনীকে সহযােগিতা করছে। তার আচরণ ডাক্তার সুলভ নয়। অত্র অঞ্চলের মানুষদের তাকে সমীহ করে চলতে হয়। কারণ পাকবাহিনীর সহযােগী হিসেবে তিনি ইতিমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন। তার দম্ভ দেখলে গা জ্বালা শুরু হত। মনে হচ্ছিল তিনিই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ইয়াহিয়া, ভুট্টো তার বাবা। ইয়াহিয়া, ভুট্টোর প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। আর বঙ্গবন্ধু একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী। মােটা মাথার মানুষ। ইয়াহিয়া, ভুট্টোর নিকট মুজিব একটি পতঙ্গ মাত্র। এ ধরনের কথাবার্তা তিনি প্রতিনিয়ত বলেই যেতেন। কিন্তু এ দোষরের জানা ছিল না তার এলাকায় প্রায় সবাই স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষ। বিশেষ অবস্থা ও পরিস্থিতির কারণে তারা মুখ খুলছেন না। ডাক্তার সাহেবের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে এলাকাবাসী ক্ষুদ্ধ। কিন্তু কেউ কিছু প্রকাশ্যে বলতে পারছে না। সময় গড়াল। মানুষের সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেল। এলাকাবাসী ক’জন মিলে সিদ্ধান্ত নিল তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ভাবতে লাগল শিক্ষাটা কোন ধরনের হবে। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল মুক্তিযােদ্ধাদের মাধ্যমে তাকে শিক্ষা দিতে হবে। যথাসময়ে খবর পৌছে দেয়া হল মুক্তিসংগ্রামীদের নিকট। আর যায় কোথায়! মুক্তিযােদ্ধারা তাে এই সংবাদই খুঁজছিল। সংবাদ আসার পর আলােচনা হল সতীর্থদের সাথে। হাই কমান্ড থেকে এল ইতিবাচক সংকেত। দায়িত্ব এসে পড়ল ডাঃ সাইফুদ্দিন আহমেদ, ফয়েজুর রহমান, জাফর উল্লাহ বােরহান ও গরীবউল্লাহের ওপর । দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা ভাবলেন কোন পদ্ধতিতে এ অপারেশন সার্থক করা যাবে। দু’দিন সূক্ষ্ম ভাবে রেকি করা হল। চেম্বার আর বাসা একই। সাথে। সামনে চেম্বার, পেছনে বাসা। সিদ্ধান্ত হল রাত ৮টার দিকে অপারেশনে যেতে হবে। ঐ সময় চেম্বারে রােগি থাকে না।
শীতের রাত। তখন কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। রাস্তাঘাট প্রায় নির্জন। একেতাে পাকসৈনিকদের ভয় আবার অন্য দিকে শীতের রাত। দু’টো মিলিয়ে সদরঘাট এলাকা প্রায় নির্জন। ডাক্তার সাহেব চেম্বারে বসে আছেন। পত্রিকায় তার দৃষ্টি আটকে আছে। খুব মনােযােগী হয়ে তিনি পত্রিকা পড়ছেন। তার চেয়ারের পেছনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক পােষাক পরিহিত বড় একটি ছবি। যত্ন করে ডাক্তার সাহেব বাধিয়ে রেখেছেন। মনে হচ্ছে প্রতিদিন তিনি ছবিটিকে পূজো করেন। পাশে আছে কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের ছবি। তার চেম্বারে বাংলাদেশের কোন নেতার ছবি নেই। বাংলার সন্তান হলেও তিনি মনে প্রাণে পাকিস্তানী আদর্শে বিশ্বাসী।  হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক তাঁদের প্রতিও তার শ্রদ্ধা ভক্তি নেই। ভাসানী, মুজিবের কথা বাদই দিলাম। ডাক্তার মাথা নিচু করে পড়েই চলেছে। এমন সময় তার চেম্বারে এল এক রােগি। পেটের ব্যথায় ভীষণ কাতরাচ্ছেন। রােগিকে ভিতরে ঢুকানাে হল। ডাক্তারের পড়ার প্রতি মনোেযােগ ছিন্ন হল। উঠে এসে রােগি দেখছিল। এমন সময় তার বুকে ঠেকল ৯ এম এম বােরাের রিভালবার। রােগি ডাঃ সাইফুদ্দিন আহমেদ তিনি দাঁড়ালেন ডাক্তারের সামনে। আসলে তিনি রােগির অভিনয় করেছিলেন। ডাক্তার সাহেব এতক্ষণে বুঝতে পারলেন তিনি কার পাল্লায় পড়েছেন। প্রথমে ডাকাত ভেবেছিলেন। পরক্ষণেই বুঝতে পারলেন ওরা ডাকাত নয়, মুক্তির সৈনিক। তাকে দিয়েই তার চেম্বারের সব ছবি নামান হল।
ইয়াহিয়া, টিক্কার আর্শীবাদ পুষ্ট ডাক্তার সাহেব তখন ভয়ে কাপছেন। ছবিগুলাে খুলে মুক্তিযােদ্ধারা তার কাছে তথ্য ও টাকা দাবি করলেন। তখন তিনি ড্রয়ার খুলে ২০-৩০ টাকা দিলেন। বললেন তার কাছে টাকা নেই। এ ২০ টাকাই সম্বল। এ কথা মুক্তিযােদ্ধাদের বিশ্বাস হয়নি। তারা তাকে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। তীব্র চাপের মুখে ডাক্তার ঘরে গেলেন। ঘরের অনেক জায়গায় খোঁজা হল। না, তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ঘরের ভিতর অনেক সম্পদ রয়েছে। কেউ কোন জিনিস স্পর্শ করেনি। তাদের প্রয়ােজন টাকা। অবশেষে ডাক্তারকে বাধ্য করা হল কাপড় ভর্তি একটি আলমিরা খুলতে। কাপড় সরিয়ে তিনি দেখালেন কাপড় ছাড়া কিছুই নেই। মধ্যম তাকের কাপড় একটা টানতেই ডাক্তার কৌশলে একটি প্যাকেট আড়াল করে মাটিতে ফেলে দিলেন। কারাে চোখে তা পড়েনি কিন্তু ডাঃ সাইফুদ্দিনের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি সেই প্যাকেটটি আস্তে করে তুলে নিলেন। ডাক্তার সাহেবের চোখ বড় হয়ে গেল। সবার সামনে এ প্যাকেট খােলা হল। দেখা গেল কায়েদ-এ আজমের ছবিযুক্ত বেশ কিছু ৫০০ টাকার নােট। অনেক সােনা দানা ছিল তার ঘরে। মুক্তিযােদ্ধারা কোন কিছুকে স্পর্শ না করে টাকার প্যাকেটটি নিয়ে এল। তার ঘরের আসবাবপত্র, সােনা দানা, ক্রোকারিজ দেখে সকলের সন্দেহ হয়েছে। এত জিনিস একজন সাধারণ ডাক্তারের ঘরে এল কি করে? তার সূত্র পাওয়া গেল। এপ্রিলের প্রথমদিকে যখন পাকবাহিনী চট্টগ্রামে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনল তখন স্থানীয় দালাল ও অবাঙালিরা মানুষ জনের বাড়িঘর লুট করেছে এবং মানুষ অর্থ কষ্টে পড়ে বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রয় করেছে। ডাক্তার কমমূল্যে লুট করা দ্রব্য অসহায় মানুষের নিকট থেকে ক্রয় করে নিজের ঘর ভরিয়েছেন। একটি টেবিল ফ্যান তিনি কিনেছে ১০/১৫ টাকায়, ক্রোকারিজ সেট কিনেছেন ২৫ টাকায়।
মুক্তিযোেদ্ধারা তাদের অপারেশন শেষ করে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে আসার পূর্বে ডাক্তারকে কঠোর হুঁশিয়ার করে দেয়া হল যেন চিৎকার না দেয়। তারপরও বিশ্বাস ও নেই। ফয়েজুর রহমান, জাফর উল্লাহ বােরহান ও গরীবউল্লাহসহ ডাঃ সাইফুদ্দিন সুকৌশলে বাইরে অপেক্ষমান টেক্সীতে উঠে পড়ল। চোখের পলকে টেক্সী ডাক্তারের চেম্বার থেকে দূর চলে এল। আশে পাশে মানুষ তেমন ছিল না। যে দু’একজন ছিল সবাই মনে করেছেন রােগি হবে, ডাক্তার দেখিয়ে চলে যাচ্ছে। মুক্তিযােদ্ধারা চলে যেতেই ডাক্তার চেম্বারে এসে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আশেপাশের দু’একজন এল। দেখ তার দেয়ালে সখের টাঙ্গানাে ছবিগুলাে নেই। সবগুলােকে ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যাপার কি জানতে চাইলে ডাক্তার সাহেব কাঁপতে কাঁপতে বল মুক্তি…. মুক্তি। তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। মানুষজন জড়াে হল। ততক্ষণে সবাই বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা কি। ডাক্তার সাহেবের ঘরে ঢুকে মানুষ দেখে কিছুই হয়নি, ঘরের সব কিছু ঠিক। কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। বার বার ডাক্তার মাথা ঠুকাচ্ছে। আর বলছে, আমার সব নিয়ে গেছে, আমাকে ফকির বানিয়ে দিয়েছে। বিলাপের সুরে কান্না জুড়ে দিল। মানুষজন। দেখল ছবিগুলাে ভাঙ্গা ছাড়া মুক্তিযােদ্ধারা ঘরের কোন কিছু ক্ষতি করেনি। পরে ডাক্তার বলল, আলমিরাতে ১২০০০ টাকা ছিল তারা ঐগুলাে নিয়ে গেছে। অনেক লােক জমে গেছে চেম্বারের সামনে। মানুষজন যারা এল মনে মনে সবাই খুশি হয়েছে। যদিও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। তাদের চোখের আকারে ইঙ্গিতে বােঝা গেল। অনেকে ছবিগুলাের জন্য ব্যঙ্গ করে দুঃখ প্রকাশ করল।

মানুষজনের জটলা দেখে একটি টহল জীপ এসে থামল। নেমে এল ৮ জন পাকসৈনিক । মানুষ পাকসৈনিক দেখে ভয়ে পালাল। তারা জীপ থেকে নেমেই চারদিক ভাল করে পরখ করে প্রবেশ করল চেম্বারে। ডাক্তার তখনও মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে রয়েছে। চেম্বারের ভেতরে ভাঙ্গা কাচ দেখে পাকবাহিনী জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কি? ডাক্তার এবারও বলল, মুক্তি মুক্তি !’ পাকসৈনিকদের দেখে তার কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। মুক্তি-মুক্তি শুনে পাকসৈনিকরা চঞ্চল হয়ে উঠল। তারা দ্রুত বাড়ির চারদিকে পজিশন নিয়ে ফেলল। ঘরে প্রবেশ করে খাটের নিচ থেকে শুরু করে পুরাে ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজল। এবার তারা ঘরের সব জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলল। বারে এলােপাথাড়ী গুলি ছুড়তে শুরু করল। এলাকাবাসী ভয়ে ভীষণ অস্থির। বহু দূরে থেকে একটি গুলির শব্দ ভেসে এল। পাকবাহিনীরা মনে করেছিল মুক্তিযােদ্ধারা সম্ভবতঃ আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে। দল নেতা বাঁশি বাজাল। সবাই ছুটে এল। জীপে উঠে বসল সবাই। দু’জন পুনরায় নেমে ডাক্তার সাহেবের ঘরে প্রবেশ করে। সাজিয়ে রাখা টুইন-ওয়ানটি নিয়ে বের হয়ে যায়। ডাক্তার সবই দেখেছে কিছু বলার সাহস হয়নি। পাকসৈনিকদের দলটি চলে যেতেই উকি ঝুঁকি মেরে যারা দেখছিল তাদের ক’জন এগিয়ে এল। চেম্বারে প্রবেশ করে দেখে ডাক্তার বিহ্বলের মতােই বসে রয়েছে। এবার তার মুখে কথা নেই। এলাকাবাসী ক’জন তাকে সান্ত্বনা দিল। সৈন্যরা ঘরে প্রবেশ করে পুরাে ঘর তছনছ করেছে। অনেক ক্রোকারিজ ভেঙ্গে গেছে। এ মানুষজনই কতক্ষণ আগে দেখেছিল ঘরের কোনাে পরিবর্তন হয়নি আর এখন সম্পূর্ণ বিপরীত। সবাই মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। ক’জন তরুণ বলল, এবার সত্যিই ডাকাত এল। সাধের পাকবাহিনী তাকে রক্ষা করল না। পাকবাহিনীর জন্য ডাক্তার কি করল আর তারাই তার টু-ইনওয়ানটি নিয়ে চলে গেল। আসলে দালালদের কেউ পছন্দ করে না। শুধু তাদের ব্যবহার করে।

( সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!