অপারেশন চট্টগ্রাম কলেজ
শিক্ষাঙ্গন পবিত্র স্থান। এর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব সকলের। শিক্ষাঙ্গন কোন বিশেষ দল। বা গােষ্ঠীর একক সম্পদ নয়। এটি সার্বজনীন। কিন্তু একাত্তরের সেই দিনগুলােতে। পাকহানাদার গােষ্ঠী শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা রক্ষা করেনি। সে দিন বাংলার অনেক। শিক্ষাঙ্গনকে পাকবাহিনী ব্যাবহার করেছে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে। শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র। অঙ্গনকে তারা করেছে কলঙ্কিত। বর্বরের দল জানে না শিক্ষাঙ্গন জ্ঞান অর্জনের তীর্থ ক্ষেত্র। ‘ ঐতিহ্যের সুমহান স্বাক্ষর চট্টগ্রাম কলেজ। বহু প্রজন্মের আনন্দাশ্রু ও বেদনা। বিধুরতায় সিক্ত এ পবিত্র অঙ্গন। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এর কিছু সুযােগ্য ছাত্রশিক্ষর্ক পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাকহানাদারবাহিনী চট্টগ্রাম শহর দখল করার। পর শহরে স্থবিরতা দেখা দেয়। পাকসরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে খুলে দেয়। বিশ্ববিবেককে ধোঁকা দেয়ার জন্য এ প্রতরণার কৌশল অবলম্বন করা হয়। শিক্ষা। প্রতিষ্ঠানগুলাে খুলে দেয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকের উপস্থিতি ভীষণ ভাবে কম। তখন চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫০০ জন। উপস্থিতির সংখ্যা ছিল প্রায় একশত জন্তু। আর মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের রাজনৈতিক কর্মী। ছাত্রী হাতে গােনা ক’জন। কলেজের আশে পাশে যাদের অবস্থান সে সব ছাত্রীরাইআসতে শুরু করে। শিক্ষকদের শতকরা ১৫ জন উপস্থিত ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের এ ধরনের উপস্থিতিতে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে পারে না। তারপরও পাকবাহিনীর নির্দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খােলা রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কলেজে সে সময় ২০/২৫ জন ছাত্রী আসতে শুরু করেছে। কলেজে এলে। তারা কমনরুমে বসতাে। ক্লাশ শুরু হলে শিক্ষকদের পেছন পেছন শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করত। মেয়েরা ক’জন বােরকা পরে আসত। মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলাে বন্ধ করে দেবে। সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলােতে রেকি শুরু করেছে কিভাবে অভিযান চালিয়ে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে আতংক সৃষ্টি করা যায়। এ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করে অনেক মুক্তির সৈনিক। সেদিন ২৪ শে নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধা করিম ছাত্রের মতাে হয়ে এলেন চট্টগ্রাম কলেজে। ঘুরলেন বিভিন্ন বিভাগে। দেখলেন সব। পরখ করলেন প্রতিটি অঙ্গনকে। ফলেজের পূর্ব দিকের রাস্তার মুখে একটি খাবার দোকান ছিল। সেখানে সিংগারা, সমােসা। ইত্যাদি বিক্রি হ্রত ছাত্র-ছাত্রীরা এ দোকানে বসে খেত । করিম দেখুল দ্রাট যুবক বসে খাচ্ছে। সেও তাদের পাশে বসল। অর্ডার দিল সিঙ্গারার। খেতে খেতে যুবক দু’জনের কথা শুনতে লাগল। খুব আস্তে আস্তে তারা আলাপ করছে। শুধু বুঝা গেল কমনরুম ও মেয়েটি’। আরাে মনােযােগ দিয়ে শুনল। এবার বুঝতে পারল তাদের আলােচনার বিষয়।
যুবক দু’জন পাকবাহিনীর দোসর। তাদের কাজ হল পাকবাহিনীকে মেয়ে সরবরাহ। করা। অথবা সুন্দরী মেয়েদের ঠিকানা সংগ্রহ করে দেয়া। এ দুটি ছেলে কলেজের ছাত্র, নয়। তারা চট্টগ্রাম কলেজে প্রতিদিন আসে। আড়াল থেকে সুন্দরী মেয়েদের প্রত্যক্ষ করে। তাদের পেছনে পেছনে গিয়ে বাসা চিনে নেয়। সেদিন তারা টাগের্ট করল রসায়ন বিভাগের একটি মেয়েকে। পরিকল্পনা করল এভাবে—মেয়েটি যখন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরবে তখন পাকবাহিনীর জীপে তুলে নিয়ে যাবে। এ মেয়েটিকে মেজরের নিকট পৌছাতে পারলে মেজর সাহেব খুশি হবে। একথা শুনে করিমের দেহ থেকে ঘাম বেরিয়ে এল। সে নিজেকে সংযত করে চলে এল। পাকদোসর দু’জন ঠিক করেছে আগামীকাল পঁচিশে নভেম্বর তারা যথা সময়ে প্যারেড গ্রাউন্ডের কোণে জীপ নিয়ে অপেক্ষা করবে। মেয়েটি যাওয়ার সময় অস্ত্রের মুখে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে। এই হল তাদের সিদ্ধান্ত। করিম মনে মনে ঠিক করল এর পূবেই সে চট্টগ্রাম কলেজে একটি অপারেশন সম্পন্ন করবে। হাতে সময় নেই আর মাত্র একদিন। কোন মেয়েটি তাদের টার্গেট এটা জানলে মেয়েটিকে সাবধান করে দেয়া যেত। যেহেতু মেয়েটিকে চেনা যাবে না তাই অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করত হবে।
করিম ফিরে এল কলেজে। তার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আজই সম্পন্ন করবে অপারেশন। কারণ আজ যদি অপারেশন সম্পন্ন করা যায় তাহলে কাল থেকে কোন মেয়ে কলেজে আসবে না। দু’যুবকের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। অন্ততঃ মেয়েটি রক্ষা পাবে । চারদিক লক্ষ্য করে সে প্রবেশ করল মূল ভবনের টয়লেটে। প্যান্টের ভিতর থেকে বের করে। আনল একটি গ্রেনেড। পিন খুলে নিয়ে রেড বিল্ডিং এর পাশে দিয়ে এসে দাঁড়াল। পশ্চিম গৈইটে ৪জন পাকসৈনিক ডিউটি দিচ্ছে। তাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে প্রবেশ করল, মেয়েদের কমনরুমে। ছয়জন মেয়ে বসে বসে আড্ডা মারছে। চোখের পলকে মেয়েদের ভয় দেখিয়ে বের করে দেওয়া হল কমনরুম থেকে। মেয়েগুলাে ভয়ে পালাল। মেয়েরা চলে এল রেড বিল্ডিং এর জিওগ্রাফী ডিপার্টমেন্টেশমনসুখনই করিম চার্জ ঔরল গ্রেনেডটি। তীব্র শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল। সবাই পালাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক সবাই। প্রধান গেইটের রক্ষীরা ইন্টারমেডিয়েট কলেজের দিকে পালাল। ততক্ষণে করিম চলে এসেছে পূর্ব দিকের পথ পেরিয়ে চকবাজারের মােড়ে। মাত্র ক’মিনিটের মধ্যে। কলেজ আঙ্গিনা খালি হয়ে গেল। তারপর থেকে ছাত্রী তাে দূরের কথা, একজন ছাত্রও কলেজ আসেনি। এমন কি ইসলামী ছাত্রসংঘের ছাত্ররাও কলেজে আঙ্গিনায় পা দেয়নি। দু’জন পাকদোসর যুবকের ছাত্রী অপরহণের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।
(সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত