You dont have javascript enabled! Please enable it!
ধর্মগড় অভিযান
সবেমাত্র এস ফোর্স সংগঠিত এখনও প্রবেশন এবং প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। এ সময়ে তাদেরকে দিয়ে ধর্মগড়-ইটাখােলা সড়ক মুক্ত করার কথা চিন্তা করি। ধর্মগড় হচ্ছে পাকিস্তানবাহিনীর একটি সুরক্ষিত ফাঁড়ি। আমাদের নিজস্ব তথ্যসংগ্রহ অনুযায়ী, এখানে একটি শক্তিশালী নিয়মিত প্লাটুন রয়েছে। এছাড়াও তাদেরকে অধিকতর জোরদার করার জন্য রয়েছে আরও এক কোম্পানী রাজাকার। ১১ তম ইস্টবেঙ্গল এখনাে পূর্ণমাত্রায় গড়ে ওঠেনি। সৈন্যদেরকে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্যে অস্ত্রসজ্জিত করা হচ্ছে। আক্রমণ পরিচালনায় সমর্থ এবং উপযােগী হচ্ছে একমাত্র ২য় ইস্টবেঙ্গল। আমি তাদের প্রশিক্ষণ মান এবং কাজের ধরন বােঝার জন্যে একটি মহড়া অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগ্রহ বােধ করি।
বিশেষত তাদের গেরিলা রণকৌশলের প্রেক্ষাপটে। ধর্মগড়সহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় হামলাসহ ক্ষুদ্র ধরনের কয়েকটি আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করেছেন ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া। কয়েক মাস হল, এই অফিসার আমাদের সাথে এসে যােগ দিয়েছেন। একটি ব্যাটালিয়ন কমান্ড করার মতাে যথেষ্ট সিনিয়র তিনি। অতএব তার কমান্ডের যােগ্যতা দেখার জন্য তাকে হামলাকারী কোম্পানীর কমান্ডার হিসাবে মনােনয়ন দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেই। দুটি প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে হামলা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিই। একটি পূর্ব দিকে। আরকেটি পশ্চিমে। উত্তরে মীরপুর বাজারে ব্লক বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবেন ক্যাপ্টেন মতিন এবং ক্যাপ্টেন নাসিম। আহমেদপুরে পশ্চিম দিকে লেঃ মােরশেদ। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী দক্ষিণ দিক থেকে মালঞ্চপুর সীমান্ত অতিক্রম করবে এবং পশ্চিম দিক থেকে শত্রু অবস্থানের ফাড়ির ওপরে হামলা করবে। আক্রমণের দিন বা ডি-ডে’ হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ এবং এইচ-আওয়ার’ বা আক্রমণের চূড়ান্ত সময় রাত ৩টা। ভারতীয় মাউন্টেইন ব্যাটারি থেকে গােলন্দাজ সহযােগিতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
২৮শে থেকে ৩০শে আগস্ট পর্যন্ত আক্রমণ-পূর্ববর্তী পর্যবেক্ষণ করে সুবেদ আলী তার প্লাটুন কমান্ডারদের নিয়ে। আক্রমণ করার পূর্বে সৈন্যদেরকে প্রয়ােজনীয় বিশ্রাম গ্রহণের সুযােগ দেয়া হয়। নির্ধারিত দিনের পূর্বদিন অর্থাৎ ২রা সেপ্টেম্বর সৈন্যরা বসে রাত ১০ টায় মনতলা থেকে মােহনপুরে পৌঁছে। সীমান্তের কাছে মােহনপুর ছিল এসেমজি এরিয়া বা সমাবেশস্থল , রাত প্রায় সাড়ে দশটায় এখান থেকে সৈন্যরা মার্চ করে FUP (Forming up place) অর্থাৎ আক্রমণের পূর্বে একত্রিত হওয়ার জায়গার দিকে এগিয়ে যায়। দূরত্ব প্রায় দু’মাইল। তদারকির কাজে আমি সেখানে গমন করি। তখন ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী আক্রমণকারী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধকালীন পর্যায়ক্রম বলছেন ?
“লেঃ বদিউজ্জামানের ৪ নম্বর প্লাটুন রয়েছে অগ্রবর্তী অবস্থানে। সিনিয়র জেসিও সুবেদার চান মিয়া তার সাথে রয়েছেন। এর পরে থাকছে সুবেদার শফিউল্লাহর ৬ নম্বর প্ল্যাটুন। তারপর রয়েছি আমি। সাথে রয়েছে আমার হেড কোয়ার্টারস্ কোম্পানী । আমার পেছনে থাকছে সুবেদার তৈয়বের ৫ নম্বর প্ল্যাটুন।”  গভীর কালাে রাত। ১০ ফুটের বাইরে কাউকে দেখা যায় না। এসেজি এরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করার সময় প্রচন্ড বৃষ্টিপাত শুরু হয়। নির্ধারিত স্থান পর্যন্ত সবকিছু মােটামুটি ভালই চলছিল। কিন্তু তারপরই হচ্ছে বিপত্তির সূত্রপাত। নেভিগেটরকে সামনে নিয়ে অগ্রবর্তী প্লাটুন সময়সূচি অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু নাইট নেভিগেশনের ত্রুটির ফলে এটি মূল কলাম বা বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুবেদার শফিউল্লার প্ল্যাটুন তা বুঝতে পেরে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীকে অবহিত করে।
ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী কলামকে থামিয়ে দিয়ে অগ্রবর্তী প্ল্যাটুনের খোঁজে চারদিকে সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু প্ল্যাটুনটির কোনাে চিহ্ন নেই। এদিকে সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্ল্যাটুনটি ছাড়াই নির্ধারিত অভিযান অব্যাহত রাখার ব্যাপারে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে লেঃ বদিউজ্জামান নিজেও বুঝতে পারে যে, ওরা ভুল পথে এগিয়ে চলেছে। সময়ের এতটুকু অপচয় না করে সে সমাবেশস্থলে প্রত্যাবর্তন করে। আমি তাকে তৎক্ষণাৎ তার কোম্পানীর সাথে যােগাযােগ করার জন্যে নির্দেশ দিয়ে বেতারযন্ত্রের সাহায্যে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীকে সে কথা জানিয়ে দিই।  রাত ৩ টা ১৫ মিনিটে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী আমাকে জানায় যে, তার সৈন্যদল এফইউপি-তে পৌঁছে গেছে। ৩টা ২০ মিনিটে সে আমার নিকটও গােলন্দাজ সদর দফতরে সংকেত প্রেরণ করে। এর অর্থ হল, সে লক্ষ্যস্থলের দিকে এগিয়ে চলেছে। এখন গােলন্দাজ বাহিনী তাকে গােলাবর্ষণের মাধ্যমে সাপাের্ট দেয়া শুরু করুক। আমাদের গােলন্দাজ বাহিনীও টাইম পােগ্রাম মতাে গােলা ফায়ার শুরু করে। গােলন্দাজ বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠার সাথে সাথে পাকিস্তানীরাও পাল্টা গােলাবর্ষণ শুরু করে। একেবারে আমাদের অবস্থানে। সে কী এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। তদুপরি অঝােরে বৃষ্টিপাত । এফইউপি থেকে লক্ষ্য স্থলের দূরত্ব প্রায় এক হাজার গজ। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে ২০ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। রাত ৩টা ২০ মিনিটে সৈন্যরা এফইউপি ছেড়ে লক্ষ্যস্থলের দিকে রওয়ানা হয়। মেনে নিচ্ছি, রাতের অন্ধকারে বৃষ্টি এবং সৈন্যদের ক্লান্তির কারণে সময়ের কিছুটা অপচয় হয়েছে। তবুও ৪ টায় লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিল। অথচ ৫ টায়ও ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী সেখানে পৌছেনি।
তাই আমার সন্দেহ ওরা সত্যিই ফর্মিং আপ প্লেসে ৩টা ১৫ মিনিটে পৌছেছিল কিনা। যদিও ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী আমাকে জানিয়েছিল যে তারা এফইউপিতে পৌছে গেছে। কিন্তু আমি এখন মনে করি যে তারা তখনাে এফইউপি থেকে অনেক দূরে ছিল এবং সেখানে পৌঁছার পূর্বেই নিশাবসানে দিনের আলাে আগত। ৩টা-২০ মিনিট থেকে গােলন্দাজ বােমাবর্ষণের ফলে শক্ররা সতর্ক হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ্যস্থলে না পৌঁছার কারণ এবং লক্ষ্যস্থলে সৈন্যরা পৌছার অনেক আগে গােলান্দাজ গােলাবর্ষণ করার ফলে ওরা যথেষ্ট সময় পেয়ে যথাযথ অবস্থানে যেতে সক্ষম হয় এবং তাদের ওপরে যে কোনাে আক্রমণ প্রতিহত করার মতাে সুযােগ পেয়ে যায়। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী গােলন্দাজ ফায়ার সাপাের্ট দেয়া হয় কিন্তু সে সাপাের্ট অনির্দিষ্টকাল ধরে অব্যাহত থাকার কোনাে নিশ্চয়তা ছিল না। অতএব আমার সৈন্যরা যখন লক্ষ্যস্থলের সন্নিকটে এবং যখন তারা গােলাবর্ষণের প্রয়ােজনীয়তা প্রচন্ডভাবে উপলব্ধি করছিল তখন তা তাদেরকে যােগান দেয়া সম্ভব হয়নি।
ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী আরাে ফায়ার সাপাের্ট-এর জন্যে বার্তা পাঠাতে থাকে কিন্তু তা পায়নি। সন্নিকটে গােলা নিক্ষিপ্ত না হওয়ায় এবং পাকিস্তানবাহিনীর প্রচন্ড গােলাগুলি বর্ষণের মুখােমুখি হওয়ার ফলে আমার সৈন্যদের অগ্রসর হয়ে লক্ষ্যস্থলে হামলা চালান অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাই হামলা প্রত্যহার না করে অন্য কোনাে বিকল্প ছিল না। যদি এ বিষয়ে আরাে আলােকপাত করতে হয় তাহলে নিম্নোক্ত বিষয়াবলী চিহ্নিত করতে হয়। যথা ঃ এক, আক্রমণ অভিযান পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হয়নি; দুই, সৈন্যরা উন্মুক্ত অবস্থানে থাকায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা; তিন, তাদেরকে ওই পরিস্থিতি থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসার সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছিল; চার, হামলাকারী সৈন্যদের চাহিদা মতাে গােলন্দাজ ফায়ার সাপাের্ট দেয়া সম্ভব হয়নি।
এই কোম্পানীর অধিকাংশ মুক্তিসেনা সবেমাত্র সংগৃহীত এবং ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী যেভাবে তাদের আক্রমণ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল এর সাথে আমি আপােষ করতে পারছিলাম না, যদিও বেশ কিছু প্রতিকূল অবস্থায় আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়েছে তবুও ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীর কর্মতৎপরতা সন্তোষজনক ছিল না এবং এর প্রতিক্রিয়ায় সৈন্যদের মনােবল ভেঙ্গে যায়।
এ অভিযানের পরপরই পাকিস্তানবাহিনী ঐ ফাঁড়িটিতে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে। ফাঁড়িটি পুনরায় আক্রমণ করার কথা চিন্তা করি। প্রাপ্ত তথ্য এবং আমার নিজস্ব মূল্যায়নে বুঝতে পারি, ফাঁড়ি থেকে শক্রদেরকে হটিয়ে দিতে হলে একটি ব্যাটালিয়ন প্রয়ােজন হবে। কিন্তু ভারতীয় উর্ধ্বতন কয়েকজন কমাণ্ডার বিষয়টি ভিন্নতর দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেন। তাদের ধারণা, সর্বাধিক দুটি কোম্পানীর সাহায্যেই এলাকাটি শত্রুমুক্ত করা সম্ভবপর। সুতরাং ১৮তম রাজপুত একই ধরনের পরিকল্পনাসহ দু’কোম্পানী সৈন্য নিয়ে বর্ণিত কার্যক্রম গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় আক্রমণের দিন হিসাবে ২৮শে সেপ্টেম্বরকে ধার্য করা হয়। ২য় ইস্টবেঙ্গল দুটি পূর্বনির্ধারিত স্থানে প্রতিবন্ধক স্থাপন করবে। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলীকে ন্যস্ত করা হয় ভিন্নতর দায়িত্বে। সে বিজয়নগরের দিক থেকে লক্ষ্যস্থলের দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি ভিন্নমুখী করে তােলার জন্য ভুয়া আক্রমণ পরিচালনা করবে। আক্রমণের সময় ভাের ৫টা । মূল অভিযান উত্তরে মীরপুর বাজার থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ব্যাপক গােলন্দাজ সহযােগিতার ব্যাপারেও নিশ্চয়তা দেয়া হয়। সময়সূচি অনুযায়ী সৈন্যরা যার যার অবস্থান নেয়। প্রি এইচ আওয়ার বা আক্রমণপূর্ব বােমাবর্ষণ শুরু হয় আমাদের মাথার ওপর দিয়ে শক্ত অবস্থানের ওপরে। একই সময়ে পাকিস্তানবাহিনী পাল্টা বােমাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী অগ্রবর্তী সেনাদলের সামনে স্থাপিত তিনটা ভারী মেশিনগানের গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে ১৮ তম রাজপুত রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানী পাকিস্তানীদের অবস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মেশিনগানের সামনে রাজপুত ব্যাটালিয়নের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। সকাল ১০ টা পর্যন্ত প্রচন্ড হতাহত হওয়া সত্ত্বেও উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শেষাবধি হামলা অভিযান আরাে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে তা প্রত্যাহার করা হয়। এই অভিযানে ভারতীয়দের ক্ষয়ক্ষতি ছিল বেশ। এই আক্রমণে তাদের একজন অফিসারও মুত্যুবরণ করে।
(সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বীর উত্তম।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!