You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুকুন্দপুর শত্রুমুক্ত
ধর্মগড় অভিযানের পরে প্রশিক্ষণে মনোেযােগী হওয়ার জন্যে আমি আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের পরামর্শ দিই। আমি এ কথাও বলি যে, হামলা চালানাের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানের ওপরে বিশেষ নজর দেয়া উচিত এবং অনুপ্রবেশের মাধ্যমে হামলা করা শ্রেয়। ধর্মগড়ে দ্বিতীয়বার হামলার ক্ষেত্রে ১৮ রাজপুত-এর সুশিক্ষিত সৈন্যদল ব্যর্থ হওয়ায় আমি আমার সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করি এবং এও অনুভব করি যে শক্তিশালী অবস্থানসমূহে হামলা চালানাে একান্ত জরুরি। নভেম্বরে প্রথম দিকে ২য় ইস্টবেঙ্গলের প্রশিক্ষণে কিছুটা বিপত্তি দেখা দেয়। ১ নম্বর সেক্টর এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের বেরােনিয়া দখল করার প্রচেষ্টা আরাে জোরদার করার জন্যে আমাকে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠাতে হয়েছে। এটি আমার সৈন্যদের বাস্তব প্রশিক্ষণে প্রয়ােজনীয় বিবেচনায় ইচ্ছা করেই উক্ত কোম্পানীকে দেবলােনিয়া অভিযানে অংশ গ্রহণের জন্যে প্রেরণ করেছি। বেলােনিয়া অভিযান চলাকালে আমার সৈন্যদের অভিজ্ঞতা অর্জনসহ আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তােলার উদ্দেশ্যে কয়েকটি ক্ষুদ্র হামলা পরিচালনা করি। মুকুন্দপুর গ্রাম এবং রেলস্টেশন এলাকা পাকিস্তান বাহিনীর কবলে। একটি পদাতিক প্লাটুন নিয়ে মুকুন্দপুর সীমান্ত ফাড়িটি মুকুন্দপুর গ্রাম এবং রেলস্টেশনের মাঝামাঝি সীমান্ত এলাকার অদূরে অবস্থিত। | নভেম্বরের প্রথম দিকে উক্ত এলাকায় আমরা জোরদার তৎপরতা শুরু করি। এর ফলে পাকিস্তানীরা ব্রিত হয়ে ওঠে। আমার সৈন্যরাও আগেই এলাকাটি মুক্ত করার জন্যে অস্থির, যাতে উত্তরে অবস্থিত ধর্মগড়ে ওরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি নিজেও উপলদ্ধি করি যে, এ হচ্ছে আঘাত হানার মােক্ষম মুহূর্ত।
১১ তম ইস্টবেঙ্গল এখনও প্রশিক্ষণ গ্রহণে ব্যস্ত। এ ধরনের অভিযানের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি নেই। আমি মােরশেদের কমান্ডে ২য় ইস্টবেঙ্গলের একটি কোম্পানী বেলােনিয়া অভিযানে অংশগ্রহণের জন্যে পাঠিয়েছিলাম। মুকুন্দপুর হামলার জন্যে একটি কোম্পানী ব্যতীত ২য় ইস্টবেঙ্গল আমার হাতে রয়েছে। ১৮তম রাজপুত উক্ত পরিকল্পনায় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সুতরাং মুকুন্দপুর দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করার ব্যাপারে আমি একটি সহজ পরিকল্পনায় নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছি। স্থির হয়, ১৮তম রাজপুত রেজিমেন্ট উত্তরে জলিলপুরে রেল লাইন ধরে প্রতিবন্ধক তৈরি করবে। এবং দুটি কোম্পানী বাদে ২য় ইস্টবেঙ্গল দক্ষিণে কলাচ্ছড়া নদীর এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করবে। লেঃ সাঈদ এক কোম্পানী সৈন্যসহ মুকুন্দপুরে হামলা চালাবে। ১৮ নভেম্বর রাতে হামলা শুরুর সময় বা ডি ডে হিসাবে নির্দিষ্ট হল। পরিকল্পনা মতে পশ্চিম দিক থেকে খুব ভােরে হামলা শুরু হবে।  লক্ষ্যস্থলের উত্তরে ১৮তম রাজপুত এবং দক্ষিণে ২য় ইস্টবেঙ্গল প্রতিবন্ধকতার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সেঃ লেঃ সাঈদ তার কোম্পানীসহ ছােট্ট ছােট্ট দলে বিভক্ত হয়ে মুকুন্দপুরের দক্ষিণে একটি ফলের বাগানে সমবেত হবে। এটি হচ্ছে পাকিস্তানীদের অধিকৃত এলাকা। গ্রামের দক্ষিণ ধারে এফইউপি বা ফর্মিং আপ প্লেস বা ব্যুহ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ স্থানটি সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে ৮০০ গজ দূরে। সামগ্রিক তৎপরতা হামলা শুরুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যতটা সম্ভব গােপনে চলতে থাকে। গােলান্দাজ সেনাদল সতর্কবস্থায় রাখা হয়, অথাৎ হামলাকারী কমান্ডার আক্রমণ ধ্বনি শুরু হলে অথবা যখন তারা চান তখনই কেবল গােলন্দাজ গােলাবর্ষণের সহযােগিতা দেয়া হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ভালভাবে এগােয় এবং ১৯শে নভেম্বর প্রভাতকালীন হামলা শুরু হয়। পাকিস্তানীরা তাদের ফাঁড়ি থেকে বেপরােয়া গতিতে আমাদের হামলা প্রতিরােধ করে। অদূরবর্তী ফাড়িসমূহ থেকে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য আক্রান্ত ফাঁড়ির সাহায্যে আসার জন্যে চেষ্ট চালায়। কিন্তু প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়ােজিত আমাদের সৈন্যরা তাদেরকে প্রতিরােধ করে। অপরাহ্ন পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত সেঃ লেঃ সাঈদ মুকুন্দপুর দখল করে। আমাদের বাহিনীর কেউ কোনাে মারাত্মক আঘাত পায়নি। পাকিস্তানী বাহিনীর ৩১ জন আমাদের হাতে বন্দি হয়। হস্তগত হয় ২৭টি রাইফেল, ২টি স্টেনগান, ২টি এলএমজি এবং ১x৩ ইঞ্চি মটার। মকুন্দপুর বিজয় হচ্ছে এক মস্ত বড় বিজয়। এবং এর ফলে পরবর্তীকালে অভিযানসমূহের ক্ষেত্রে আমরা মুকুন্দপুরকে একটি উন্মুক্ত অবস্থান হিসাবে ব্যবহার করার সুযােগ লাভ করি।
( সূত্র ও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বীর উত্তম)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!