You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.01.22 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
২২শে জানুয়ারী, ১৯৭৩, সোমবার, ৮ই মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট মহলসমূহের তৎপরতা দেশবাসীর মনে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গত শনিবার নির্বাচনী বিধি ঘোষণা করেছেন। তাদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটা বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের দু্ই বৎসরের মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের রচনায় বিগত নির্বাচন অনুষ্ঠান নিছক অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। বিপ্লবোত্তর স্বাধীন দেশে সরকার এমন একটা নির্বাচনের আয়োজন করেছেন বলে কোন নজীর নেই। এবং নজীরবিহীন সেই অসাধ্যকে সাধন করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কিছু করার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সরকার নিশ্চিন্তে সেই চ্যালেঞ্জকেই গ্রহণ করেছেন। পুরো বিশ্ববাসীর মনে আওয়ামী লীগ সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনে সদ্য স্বাধীন এই দেশের এই মহতী প্রচেষ্টা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করার জন্য আসছেন দেশ বিদেশের প্রতিথযশা সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক।
নির্বাচনের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ করতে অবাধ ও স্বাধীনভাবে জনগণের রায় গ্রহণের দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের একথা ভাবলে ভুল হবে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিককরণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের উপর দায়-দায়িত্ব রয়েছে সীমিত সামর্থের মধ্যেও তাদের সে দায়িত্ব পালনে যে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন তা সরকারের এহেন কট্টর সমালোচকেরও অস্বীকার করবার নয়। ইতিমধ্যেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কখনো কখনো নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থার উপর সরকারী হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনা হয়। আমাদের দেশ তেমন অভিযোগের অবকাশ নেই। এই সেদিনও প্রধান নির্বাচনী কমিশনার স্বয়ং ঘোষণা করেছেন, তাদের ক্রিয়াকর্মে কোন প্রকার সরকারী হস্তক্ষেপ করা হয়নি। সম্পূর্ণ স্বাধীন ও মুক্তভাবে তাঁরা তাদের কর্মপরিচালনা করছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা কিছু কর্তব্য তা সরকার করছেন। বিদ্বেষের ঠুলি না এঁটে সাদা চোখে নিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের দিকে লক্ষ্য রাখছেন তারাই এ কথা স্বীকার করবেন। এরপরে যতটুকু দায় দায়িত্ব তা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের। অবাধ এবং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানে বলা যেতে পারে এই রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের ভূমিকাই মুখ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তেমন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি। অস্ত্রের হুঙ্কার, সরকারী দল আওয়ামী লীগ কর্মীদের হত্যা, নানা কুৎসা রটনা ও কোন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচী উপস্থাপিত না করে প্রকারান্তরে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই চরম অজ্ঞতার ও হঠকারিতা দেশে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সহায়তা করেছে। হিংসার অপদেবতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবার চেষ্টা করেছে।
নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে বাহাতঃ সেই হঠকারী মানসিকতা কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। নির্বাচনে সম্ভাব্য পরাজয়ের কথাটাই বড় করে না ভেবে বরং সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা গড়ে তোলার বৃহত্তর স্বার্থে বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অধিকতর দায়িত্ব সচেতন হওয়া উচিত। জনগণের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতি তারা যত বেশী শ্রদ্ধাশীল হবেন, জনগণের কল্যাণের স্বার্থে তত বেশী গঠনমূলক ভূমিকা তারা গ্রহণ করবেন ততই তারা জনগণের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হবেন। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনে সেই সৃষ্টিশীল গঠনমূলক বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিকাশ অপরিহার্য। আমরা সেই সুদিনের প্রত্যাশায় প্রহর গুণছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে অগ্রযাত্রাকে সুনিশ্চিত করে যতদিন না বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, যতদিন না স্বাধীনতার সুবর্ণ ফসল গরীব মেহনতী মানুষের দুয়ারে গিয়ে পৌঁছছে ততদিন পর্যন্ত এ সংগ্রামের, এ আশার মশাল প্রজ্জ্বলিত থাকবে। সেই মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে আবার আমরা আহ্বান জানাচ্ছি সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে, শান্তিকামী শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকল মানুষের কাছে—আসুন গঠনমূলক মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সুর্যোদয়ের এই মহান লগ্নকে আমরা বরণ করি। হানাহানি বা অস্ত্রের হুঙ্কার নয় জনগণের রায়ই আমাদের চলার পথ নির্ধাণ করুক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন