বাংলার বাণী
ঢাকা : ৭ই মার্চ, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ২৩শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
মুক্তিকামী মানুষের পরম প্রার্থিত দিন ৭ই মার্চ
মহাসংগ্রামের আহ্বানের দিন আজ সাতই মার্চ। তিন বৎসর কেন মহাযুগ যার আবেদনকে এতটুকু ম্লান করতে পারবেনা। ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত একটি জাতির মহা আকাঙ্ক্ষার দিন এই সাতই মার্চ। এ শুধু আহ্বান নয়, নিপীড়িত নির্যাতিত একটি জাতির আকাঙ্ক্ষিত পথনির্দেশ। মুক্তি আর স্বাধীনতার আহ্বান একই আবেদন নিয়ে যুগে যুগে সোচ্চার হয়ে উঠেছে জাতীয় মুক্তির দিশারী মহানায়কদের কন্ঠে।
তিন বৎসর আগে একাত্তরের সাতই মার্চ। নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের রায় জানিয়ে দিয়েছে। ঔপনিবেশিক শক্তির সকল কৌশলী পদক্ষেপই একের পর এক গণপ্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়ে চলেছে। ক্ষমতা লাভের সমঝোতা বিভ্রান্ত করতে পারেনি আদর্শকে। গণরায়ের প্রদীপ্ত মশাল হাতে মুজিব ধীর, স্থির, অচঞ্চল। প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে মানুষ। এক, দুই, তিন….। এমনি করে সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিরোধ জোরদার হচ্ছে। শাঠ্য ষড়যন্ত্র তার মোকাবেলায় মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলার পবিত্র মাটিতে।
জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক তাঁর লক্ষ্য অর্জনে একের পর এক সোপান অতিক্রম করেছেন। মাহেন্দ্রক্ষণ সার্তই মার্চ। সংসদের অধিবেশন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। গণরায়ের কাছে মাথা নত করার পরিবর্তে তার মোকাবেলায় শক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। রেসকোর্সে সেদিন মানুষের ঢল। বজ্রের স্বর কন্ঠে ধারণ করে মহানায়ক সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন আহ্বান জানালেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সে সংগ্রামের রূপরেখাও তিনি ঘোষণা করলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতীক্ষিত সত্তার কাছে, ‘তোমাদের যা কিছু আছে আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ গ্রামে গঞ্জে নগরে বন্দরে মহল্লা মহল্লায় প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন মহানায়ক মুজিব।
এলো স্বাধীনতা। সাতই মার্চের সেই বজ্রদৃপ্ত আহ্বানে বাঙালী পরলো সৈনিকের বেশ। প্রতিটি বাঙালী শপথের সূর্যদীপ্ত সেনা। এক রক্তের সাগরে পাড়ি জমিয়ে তারা ছিনিয়ে আনলো স্বাধীনতা। ছিনিয়ে আনলো তাদের বীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে। এক যুদ্ধের শেষ; আর এক যুদ্ধের শুরু। স্বাধীনতার পর অনাহার, অশিক্ষা, দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানালেন, নতুন করে দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
তিন তিনটি বছর। সেই বজ্রকন্ঠ ঘোষণার পর তিনটি বছর অতিক্রান্ত। সংগ্রামের বিজয়রথকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চালিকা শক্তি সেই বীর মহানায়ক; যার পেছনে লৌহকঠিন একতা নিয়ে সংঘবদ্ধ গোটা জাতি।
সাতই মার্চ বাঙালীর মুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত পথ নির্দেশের একটা তারিখ মাত্র নয়, ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত বিশ্বের যেকোনো জাতির পরম প্রার্থিত দিন। সাতই মার্চ মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা।
ক্ষেতের বেড়া যাতে ফসল না খায়
রেলের দুর্ঘটনা তো এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে। রেল যাত্রীদের স্বাভাবিকভাবেই তাই নিরাপত্তা নেই। কিন্তু যাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে যে এবারে মালামালের নিরাপত্তাও যেতে বসেছে।
বর্তমানে রেলে মাল বুক করে নিশ্চিন্তে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে রেলে মাল বুক করে ঘরে বসে ‘আল্লা আল্লা’ জপতে হয়। যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে মাল সময়মতো পৌঁছুবে নয়তো হাওয়া হয়ে যাবে।
মালামাল হাওয়া হয়ে যাবার এমনি একটি সংবাদ গতকাল স্থানীয় দু’টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
গত ২১শে ফেব্রুয়ারী জুড়ির জনৈক ব্যক্তি ৫ হাজার টাকার মোটর গাড়ীর যন্ত্রাংশ রেলযোগে চট্টগ্রাম থেকে জুড়ি পাঠিয়েছিলেন। মাল এসে পৌঁছুলো ঠিকই তবে আসল মাল নয়—মালশূন্য বাক্স। মাল কেন এলো না তার জবাব স্টেশন মাস্টারের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব হয়নি।
সিলেটের সাহবাজপুর থেকে একটি ওয়াগন কাঠ বোঝাই করে জনৈক কাঠের ব্যবসায়ী পাঠিয়েছিলেন চাঁদপুরে। খোঁজ নিয়ে জানলেন তাঁর ওয়াগন আজো পর্যন্ত সেখানে পৌঁছেনি।
বড়লেখার জনৈক ওষুধ বিক্রেতার ভাগ্যেও একই ব্যাপার ঘটেছে।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, রেলে মাল বুক করা মালগুলোর পাখা গজায় এবং সেগুলো পাখায় ভর করে শূন্যে মিলিয়ে যায়। তারা মাল বুক করেন তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়না মালগুলো কোথায় যায়। কিভাবে যায়। স্টেশন মাস্টার থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মচারী পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখে তালা দিয়ে বসে থাকেন।
রেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু মাল হাওয়া হয়ে যাওয়ার নয়। আরো আছে। যথা মালের বদলে ইট, পাথরের খন্ড থাকাটাও বিচিত্র নয়। ওগুলো থাকে। এবং একশ্রেণীর রেল কর্মচারী মেহেরবানী করে মালের বাক্স খালি না রেখে ইট, পাথর ভরে দেন। যাতে বাক্সটা একেবারে খালি না যায়।
প্রশ্ন হলো, এমন অবস্থা বিদ্যমান থাকলে রেলের দুয়ারে মাল বুক করতে ব্যবসায়ীরা যাবেন কি? এটা তো স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, একবার মাল হারানোর পর দ্বিতীয় বার মাল বুক করার আগে একটু চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন যেকোনো ব্যবসায়ী।
আমরা যতদূর জানি, রেলওয়েতে ওয়াচ এন্ড ওয়ার্ড বলে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। যাদের একমাত্র কাজ হলো রেলের মালামালের প্রতি লক্ষ্য রাখা অর্থাৎ ওয়াচ করা। তারা রেলের মালামাল কতটুকু ওয়াচ করেন সেটাই ভাববার বিষয়। অবশ্য এটা ঠিকই যে ‘লাগে টাকা দেবে গৌরীসেন’ এর মতো অবস্থা যখন রেলওয়েতে বিদ্যমান তখন আর চিন্তা-ভাবনার কি আছে। ব্যবসায়ীরা যদি যথাসময়ে মালের বদলে ইট বা পাথর পান অথবা শূন্য বাক্স পান আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে খেসারত দাবী করে ক্ষতিপূরণের টাকা (যদিও সব সময়ে পাওয়া যায় না) পেয়ে যান তাহলে তা তো যাবে সরকারী তহবিল থেকে। সুতরাং চিন্তার কি আছে। চিন্তার কিছু নেই ঠিকই তবে এমন একটা সময় আসবে যখন দেখা যাবে যে, রেল বিভাগ ‘লাল বাতি’ নামক বস্তুটি জ্বলছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করেন কিনা জানি না।
যাইহোক, কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলবো, দয়া করে একটা কিছু করুন। রেলের একশ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীর জন্যে রেল বিভাগে লাল বাতি জ্বলবে এমন তো হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়। ‘ওয়াচ এন্ড ওয়ার্ড’ নামক অচল বিভাগটিকে সচল করে তোলার দিকে নজর দেওয়া হোক। আর তা হলে হয়তো ক্ষেতের বেড়া ফসল খাওয়ার সুযোগটা পাবেনা। ব্যবসায়ীরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় রেলে মাল বুক করতেও পারবেন।
রোগাক্রান্ত আলু—
প্রতিবছর লেট ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা মূল্যের গোল আলু ও টমেটো বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে সম্প্রতি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সংগৃহীত এক তথ্যে জানা গেছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্যে পরিসংখ্যান ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কয়েক বছর যাবত বাংলাদেশের আলু ও টমেটো চাষীদের জন্য এই রোগ দারুণ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। চলতি মৌসুমে দেশব্যাপী প্রতিকূল আবহাওয়া বিশেষ করে বৃষ্টিপাত, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ও কুয়াশাচ্ছন্নতা এই রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ও বিস্তৃতির সহায়ক হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, সংগৃহীত তথ্য দেশের চাষী ও সংশ্লিষ্ট সরকারী মহলকে আলু ও টমেটোর লেট ব্লাইট রোগজনিত ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে সজাগ হতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সাহায্য করবে।
বস্তুতঃ কৃষি অর্থনীতি ভিত্তিক আমাদের এই দেশে আলু একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। প্রতিবছর যদি লাখ লাখ টাকা মূল্যের আলু এভাবে বিনষ্ট হয় তবে তা জাতীয় অর্থনীতিতে এক বিরাট অপচয় বলেই পরিগণিত হতে বাধ্য। এমনিতেই আজকের দিনে আমাদের দেশে বীজ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধার অভাবে আলু চাষ বিপর্যয়গ্রস্ত। তার উপর যদি আবার রোগাক্রমণ হয় তাহলে অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। এমতাবস্থায় আলু চাষকে সংকটহীন ও আলুকে রোগাক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে সার্বিক তৎপরতা নেবার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন