You dont have javascript enabled! Please enable it! পাক সেনা কর্তৃক চরযােশহরদী গ্রাম - সংগ্রামের নোটবুক
পাক সেনা কর্তৃক চরযােশহরদী গ্রাম
 
অপারেশন ৩০শে এপ্রিল অনুমান সকাল ৭ ঘটিকায় প্রায় ৭৫ জন পাকসৈন্য নিয়ে ভাঙ্গার সদরদী গ্রামে কুখ্যাত পাকসেনা সহযােগী মুন্ন মিয়া, কোটন মুন্সী, হালিম মুন্সি ও টুকু ভাঙ্গা হতে প্রায় ৪ মাইল দূরবর্তী নগরকান্দা থানাধীন চরযােশহরদী গ্রামের নেপাল সাহার বাড়ি আসে। ভাঙ্গা থানা হেড কোয়ার্টারে পাকসেনারা আসার পর কাছাকাছি ২/১ মাইলের যাতায়াত ব্যবস্থাও দূর্গম, সেখানে কেন গেল এর কারণ খুঁজলে সহজেই বুঝা যাবে যে এটা ব্যক্তিগত আক্রোশ বা স্বার্থসিদ্ধির জন্য করা হয়েছিল। | সকাল ৭টার সময় হঠাৎ পাকসেনাদের আগমন দেখে ঐ বাড়ির লােকজনসহ গ্রামের অন্যান্য সব ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে দিক-বেদিক দৌড়ে পালাতে শুরু করে। সে যে কি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তারা পাকসেনাদের দেখেই কামুর নদীর পাশ দিয়ে দৌড়ে নদীর ওপাড় বাহাড় গ্রামে চলে যায়। পাকসেনারা নেপাল সাহার বাড়ি পৌঁছে প্রথমে বাড়ি লুট করিয়ে দেয়। হানাদারবাহিনীর সাথে বাঙালি দোসরদের দেখে, ওখানকার যারা স্বাধীনতা বিরােধী ছিল তারা সাহস করে এগিয়ে আসে এবং লুটপাটে অংশগ্রহণ করে। অতঃপর পাকসেনারা অগ্নিসংযােগ করে ঐ বাড়ির সব ঘরগুলিই জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। তৎকালীন মূল্যের প্রায় ৭ লক্ষ টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যায়। ঐ গ্রামে বাবুর আলী মাতুব্বর একজন দরদী লােক ছিলেন। তার বাড়িতে বহু হিন্দু তাদের মালামাল গচ্ছিত রেখেছিল। স্থানীয় পাক দালালরা জানত এ বিষয়। তাই তারা  পাকসেনাদের জানায় যে, ঐ গ্রামের বাবুর আলী মাতুব্বরের বাড়িতে বহু আশ্রয় নিয়েছে, সেখানে যেতে হবে। পাকসেনারা তাদের দোসরদের পরামর্শ মতাে বাবুর আলী মাতুব্বরের বাড়ি আসে। সেখানে কোন হিন্দুকে না পেয়ে ঐ বাড়ি লুট করিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। হিন্দুদের গচ্ছিত সব মালামালও লুটকারীরা লুট করে নেয়। এই ঘটনায় বাবুর আলী মাতুব্বর খুব মুষড়ে পড়ে। লােকের ধারণা কিছুদিন পরে সে এই শশাকেই মৃত্যু বরণ করে। পাকসেনারা নবদ্বীপ চন্দ্র কুন্ডু, রামকৃষ্ণ রায়, মাখন চন্দ্র বৈরাগী, কল্যাণেশ্বর রায়, শতিশ্বর রায়, মালিন মাঝি ও রামকৃষ্ণ রায়ের জামাতাকে গুলি করে হত্যা করে।
অতঃপর পাকসেনারা নিকড় মাটির কুমার নদীর সাকো পার হয়ে বাটিকামারী বাজারে যায় এবং বাজারের ঘর জ্বালাতে শুরু করে। কিন্তু ইতিমধ্যে মুক্তিফৌজ কমান্ডার আজিজ মােল্লা তার বাহিনী নিয়ে আসছে দালালদের মুখে এই সংবাদ শুনে সেখানে তারা বেশিক্ষণ দেরি না করে ভাঙ্গা অভিমুখে দ্রুত চলে যায়। ঐ দিন সকাল ১০ টার সময় আমার এক চাচাত ভাই এসে খবর দিল দক্ষিণ দিকে আগুনের ধোয়া দেখা যাচ্ছে। আমরা সন্ত্রস্তভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম, আগুন কোন জায়গাটায় হতে পারে। কিছুক্ষণ পরে খবর পেলাম আমাদের ইউনিয়নে চরযােশহরদী গ্রামে পাকসেনা ও দালালরা অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন, নরহত্যা প্রভৃতি নগ্ন হামলায় মেতে উঠেছে। কমান্ডার আজিজ মােল্লা অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়লেন। আমাদের দলের লােকজনকে ডেকে একত্রিত করতে বললেন। আরও বললেন, ‘আমরা পাকসেনাদের আক্রমণ করব, যদি ওদের এই নাশকতামূলক কাজে বাঁধা না দেই তবে ওদের সাহস বেড়ে যাবে। গ্রামে গ্রামে অত্যাচারের সীমা থাকবে না। কাজেই আক্রমণ করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি তখনই কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে চরযােশহরদী গ্রামের দিকে রওয়ানা হলেন। আমাকে বাদবাকী মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পেছনে পেছনে আসতে বললেন। আমি গ্রামের জনসাধারণ ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিত বিরাট বাহিনী। নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে রওয়ানা হলাম। মােল্লা সাব অনেক আগেই চলে গেছেন। আমরা চার পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করে যখন মােকপুট্টি গ্রামে গেলাম তখন ভীষণ বেগে ঝড় আসে। আর অগ্রসর হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না। নিকটেই একটা প্রাইমারী স্কুলে আশ্রয় নিলাম। ঝড় বৃষ্টি থামলে আমরা আবার যেতে শুরু করলাম। নিকড়হাটি গ্রামে গিয়ে জানতে পারলাম পাকসেনারা বৃষ্টির পূর্বেই চলে গেছে। আজিজ মােল্লা এসে ধরতে পারেননি।
আরও কিছুদূর যাওয়ার পর আগামী দলের সাথে মিলিত হলাম। এ অঞ্চলের সর্বহারা জনগণ আমাদের দেখে জমায়েত হল আর বলল এখানকার রাঙ্গা মিঞা ও তার সাগরেদরা পাকসেনাদের সাহায্যে অগ্নিসংযােগ ও লুটতরাজ করেছে। একথা শুনে মুক্তিযােদ্ধাদের রক্ত টগবগিয়ে উঠল। আমরা রাঙ্গা মিয়ার বাড়ি গেলে তার ছেলে ওদূদ মিঞার সাথে দেখা হল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাকে ধরে লুট করার অভিযােগে পিটাতে শুরু করে দিল। ওদূদ হাউমাউ করে কেঁদে মাফ চাইতে লাগল। অনেক বলে-কয়ে ছেলেদেরকে ঠেকান হল। এমন সময় ত্ৰিভাগদির ইসরাইল কিছুসংখ্যক ছেলে সহ জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে আমাদের কাছে এল এবং পাগলে মতাে চরযােশহরদী গ্রামে পাকসেনাদের নৃশংস হত্যাকান্ড ও লুণ্ঠনের কথা জানাল। আমরা পুনরায় বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। দলের ছেলেরা মৌঃ আঃ ওদূদকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এল। ওদের গুলি করে মারতে নিষেধ করলাম। দলের পুরােভাগে ছিলাম আমি। পেছনে রাইফেলের শব্দ শুনলাম। জানলাম ওদূদকে গুলি করেছে, কিন্তু গুলি কে করেছে তা কেউ স্বীকার করল। রাত প্রায় ১০টার সময় আমরা দশখারদিয়ার চাঁদ মিঞার বাড়িতে উঠলাম। আজিজ মােল্লা লােকজন নিয়ে ওখানে রাতে থাকলেন কিন্তু আমি বাড়ি চলে গেলাম। দলের ৫০/৬০ জন লােককে চাদ মিঞা খুব আদরের সাথে খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করলেন। (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ফরিদপুর, মােঃ সােলায়মান আলী )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত