ফরিদপুরে প্রাথমিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
বাংলাদেশের অবস্থা যখন চরম আকার ধারণ করল, প্রশাসন ব্যবস্থা যখন সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল, বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া খান আবার ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশ আহ্বান করার কথা ঘােষণা করলেন। ১৬ই মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ আলােচনা করে একটা সমঝােতায় পৌছানাের জন্য ঢাকা এলেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে আলােচনা শুরু হল দুই পক্ষের মধ্যে। এদিকে সমঝােতার নামে চলল আলাপ আলােচনার প্রহসন। আর অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করে বাঙালি সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করে এবং ওখান থেকে পাঞ্জাবী, বেলুচ ও পাঠান সৈন্যদের বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে সমাবেশের ব্যবস্থা চলল। পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল পশ্চিমা কুচক্রিমহল।
২৩ শে মার্চ। সামরিক ছাউনীগুলি ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ল। ইয়াহিয়া খানের সামনে ছাত্রলীগের ছেলেরা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়। বাংলার বিভিন্ন শহরে পশ্চিমা সৈন্য ও নিরস্ত্র বাঙালিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে খন্ডযুদ্ধ শুরু হল। শত শত লােক শহীদ হল। বাংলার মুক্তিকামী জনগণ মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। অনেকের ধারণা ছিল একটা কিছু সুফল ফলবে। যদিও আমরা বুঝতাম অনুকূলে কিছুই হবে না। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী বাঙালিদের কণ্ঠস্বর চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য চরম আঘাত হানল।
নেমে এল ২৫শে মার্চের ভয়াল কাল রাত। বঙ্গবন্ধু পূর্ব হতেই বুঝেছিলেন ঐ রাতে পশ্চিমা হায়ানাবাহিনীর কুত্তাগুলি আক্রমণ চালাবে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর। রাত ১১ টার সময় বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও বহু কর্মী উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাদেরকে সম্ভাব্য নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নিতে বললেন।
রাত ১২ টার সময় পশ্চিমা পশুবাহিনী নিরীহ ও নিরপরাধ বাঙালিদের উপর মেশিন গান, মর্টার, কামান ইত্যাদি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করতে লাগল। ঢাকা শহরের সর্বত্রই আগুনের লেলিহান শিখা লক লক উঠল।
আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসতে লাগল নর-নারী ও শিশু, বৃদ্ধের মরণ চিৎকার। যেন রােজ কিয়ামত সৃষ্টি করল ইয়াহিয়া সরকার। যাকে যে অবস্থায় পেল গুলি করে হত্যা করা হল। বস্তিতে বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পলায়নরত ভুখা নাঙ্গা মানুষকে মেশিন গানের ব্রাসে খতম করা হল। ঢাকা সদরঘাটের টারমিনাল শত শত গরীব মানুষের রক্তে লাল হয়ে গেল। বুড়ীগঙ্গার পানিও রক্তে লাল হল। ঢাকার শাঁখারী পট্টি ধ্বংস হল। সেখানে হিন্দু যুবতী মেয়েদের উপর চালানাে হল অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার। মেয়েদের উপর ব্যাভিচার করে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। স্বামীর সামনে স্ত্রীর ও মাবাবার সামনে যুবতী মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচার করে লাইন করে সবাইকে গুলি করে হত্যা করেছে। চেঙ্গিস হালাকু খানের উত্তরসূরি, বিংশ শতাব্দীর মানব সভ্যতার ঘৃণ্যতম ব্যক্তি ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেয়া কুকুরগুলি না করেছে এমন কোন জঘন্য কাজ নেই। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। | প্রথমে পাকমিলিটারীরা রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর হেড কোয়টারে অতর্কিতভাবে আক্রমণ চালায়। এখানে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর সাথে হানাদারবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। শত শত লােক মারা গেল। এই রকম বিভিন্ন স্থানে চলতে থাকে খন্ড যুদ্ধ। ইকবাল হলে ছাত্ররা গড়ে তােলে প্রতিরােধের দূর্গ। কিন্তু সশস্ত্র হানাদার বাহিনীর নগ্ন হামলার সম্মুখে টিকতে না পেরে শত শত মায়ের বুক খালি করে শত শত যুবক ছেলেরা ঢলে পড়ল মৃত্যুর তুহীন সাগরে। | রােকেয়া হলে আক্রমণ করে অবস্থানরত যুবতী মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালান হয় এবং অনেক মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় পশ্চিমা পশুবাহিনী। জগন্নাথ হলেও বহু ছেলেকে হত্যা করে। পরে গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। লক্ষ লক্ষ অসহায় নিরীহ ও নিরস্ত্র জনতা ঢাকা নগরীতে খান সেনাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনাছাউনীতে ২৫শে মার্চ রাতে একই সময়ে আক্রমণ করে পশ্চিমা হায়ানাবাহিনী। হাজার হাজার পুলিশ, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা শাহাদত বরণ করলেন। জয়দেবপুর বেঙ্গলরেজিমেন্টের সৈন্যরা পূর্বেই আক্রমণ বার্তা পেয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। এখানে পাকমিলিটারীরা আক্রমণ করলে তাদের প্রভূত ক্ষতি সাধন হয়। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলে। অবশেষে টিকতে না পেরে বাঙালি সেনারা অস্ত্রসহ গ্রামের দিকে রওয়ানা হয়। ঢাকার অদূরে জিঞ্জিরা একদিন পাকসেনাদের অতর্কিত হামলায় হাজার হাজার লােক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ঢাকা মহানগরী বাঙালি শূন্য হয়ে পড়ে। দূর দূরান্তরের লােকজন যে কত কষ্ট করে পায়ে হেঁটে নিজ নিজ বাড়িতে পৌছেছিল তা অবর্ননীয়। যে সকল লােকজন কোনদিন রাস্তায় পায়ে হেঁটে দূরে যায়নি তারাও মাইলের পর মাইল পথ পায়ে হেঁটে রিক্ত হস্তে যারপর নাই কষ্ট করে গন্তব্য স্থলে পৌছেছে। পথে-ঘাটে, হাটে-মাঠে এই সব অসহায়
লােকদের ক্লান্তি লাঘব করার জন্য গ্রামের চাষী-মজুররাও যে যা পেরেছে টাকা পয়সা, খাদক ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে। ঐ ঘােরতর বিপদের দিনে এটুকু সাহায্যের মূল্য ছিল অনেক বেশি। মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ অনুমান সকাল ১০ টায় চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র হতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে ইংরাজিতে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। ঐ ঘােষণা মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। ইংরেজিতে প্রদত্ত ঘােষণাপত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ The Government of the severeign state of Bangladesh on behalf of our Great Leader, the supreme Commander of, Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, We hereby Proclaim the independence of Bangladesh. And that the Government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. it is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sheikh Mujibur Rahman is sole leader of the elected representative of seventy five million people of Bangladesh, and that Goverment headed by him is the only legitmata government of the people of the independent Sovereign State of Bangladedh, Whicn is legally and constitutionally formed, and is worthy of being recognised by all the governments of the world, we therefore, appeal on behalf of Great Leader Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the democratic countries of the worled, specially the big powers and the neighbouring countries to recognise the ligal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the aweful genocide that has been carred on by the army of occupation from Pakistan.
The guiding principle of the new state we will be first neutrality, second peace and third friendship to all and enemity to none. May Allah help us. joy Bangla. | বাংলার বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি সৈন্য, ইপিআর পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর লােকেরা প্রতিরক্ষামূলক প্রতিরােধ গড়ে তুলল। ঢাকা শহর ছাড়া বাংলার বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন বাংলার পতাকা পৎ পৎ করে উড়তে লাগল। জোয়ান, বেসামরিক লােক ও ছাত্রদের মধ্যে শুরু হল ব্যাপক সামরিক ট্রেনিং। আওয়ামী লীগ, এমএনএ ও এম পিএ এবং নেতারা স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় বেসামরিক প্রশাসন চালাতে আরম্ভ করেন। ২৯শে মার্চ কেএম ওবায়দুর রহমান ফরিদপুরে আসেন।
| গােয়ালন্দ ও নাড়ার ট্যাকে বেঙ্গলরেজিমেন্ট, ইপিআর আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে উপযুক্ত ডিফেন্স ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নেতৃবৃন্দ কুষ্টিয়া ও অন্যান্য জায়গায় লােক পাঠিয়ে উন্নত ধরনের হাতিয়ার আনার ব্যবস্থা করেন। ফরিদপুরে শৃঙ্খলার সাথে বসে কাজকর্ম চলছিল। বিভিন্ন থানা হতে আনসার সংগ্রহ করে যশােরে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানাে হয়। জয়দেবপুর থেকে হেমায়েত সাতজন্য সৈন্য ও অস্ত্রসস্ত্রসহ ফরিদপুর এসে ওবায়দুর রহমানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং প্রতিরক্ষামূলক কাজে সাহায্য করতে
থাকেন। আওয়ামী লীগ কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাঁদা তুলে মুক্তিযােদ্ধাদের রসদের জন্য ফরিদপুরে এনে দিতে লাগল। ফরিদপুরের ব্যবসায়ী মহল টাকা পয়সা ও খাবার জিনিস দিয়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছিলেন। পালিয়ে আসা আর্মী, ইপিআর এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত লােকদের খুঁজে এনে মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিয়ােগ করা হয়। ফরিদপুর স্টেডিয়ামে যুবক ছেলেদের সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রত্যেক থানায় থানায় অনুরূপ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। | জনাব ইমাম উদ্দীন আহম্মদের বর্ণনা ক্রমে, ২৬শে মার্চ ১৯৭১, ভাের সাড়ে পাঁচটায়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার সংবাদ প্রথম টেলিফোনে পাই। ২৬শে মার্চ সকাল হতেই ছাত্র যুবকগণ গােয়ালচামট আঙ্গিনা ব্রীজের পার হতে রাস্তার জায়গায় জায়গায় বড় বড় গাছ ইত্যাদি ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। যাতে গােয়ালন্দ হয়ে স্থল পথে পাকসেনারা শহরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সকাল ৯টার সময় ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে জাতীয় পরিষদ সদস্য ব্যারিষ্টার সালাহউদ্দীন আসেন। আওয়ামী লীগ অফিসে গােলজার দুলাল, নাসির মুসাসহ ছাত্র যুবক যারা উপস্থিত ছিল তাদের নিয়ে ব্যারিস্টার সালাহউদ্দীন তৎকালীন ডিসি ও এসপির সাথে দেখা করেন এবং চাপ প্রয়ােগ করে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ান। ২৭শে মার্চ সকালে ইমামউদ্দীন আহম্মদ, সামসুদ্দিন-মােল্লা, মােশাররফ হােসেন, নূরুন্নবী হায়দার হােসেন প্রভৃতি জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ডিসি ও এসপির সাথে দেখা করে স্বাধীনতার এই বাণী শহরময় প্রচারের ব্যবস্থা করেন। ২৬শে মার্চেই জেলা পরিষদ সাইক্লোস্টাইল মেশিনে বঙ্গবন্ধু কতৃক স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী ছেপে বিভিন্ন থানায় প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। জেলা প্রশাসককে আওয়ামী লীগের নির্দেশ মতাে কাজ পরিচালনার জন্য বলা হয়।
ফরিদপুরে ডিসি অফিসসহ সকল সরকারী, আধা সরকারী ও স্কুল কলেজে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। সমগ্র ফরিদপুর তখন পূর্ণ স্বাধীন এলাকায় পরিণত হয়। কার্যত ফরিদপুর জেলা প্রশাসন তখন হতেই আওয়ামী লীগের নির্দেশমতে চলতে থাকে। ফরিদপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন তখন নুরুল মােমেন খান। তিনিও পুলিশ প্রশাসন নিয়ে সব রকম সহযােগিতা করতে থাকেন। দুদিন পর ওবায়দুর রহমান ঢাকা থেকে এসে ঝিলাটুলীস্থ জেলা পরিষদ ডাকবাংলায় উঠেন এবং ঐ ডাকবাংলাকে তখন হতেই হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে ফরিদপুরের প্রতিরক্ষা কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রণের জন্য কন্ট্রোল রুম হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যােগাযােগের সুবিধার জন্য প্রত্যেকের বাসায় বাসায় ডিসির নির্দেশে টেলিফোন দেওয়া হয়। ফরিদপুর স্টেডিয়ামে প্রাক্তন সৈনিক মােঃ শাহজাহান ও গাজী আঃ হাকিমের তত্ত্বাবধানে যুবক ছেলেদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ওবায়দুর রহমান তৎকালীন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। সেই কারণে তাকে কেন্দ্র করেই ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের নির্দেশ মতাে সংগ্রাম পরিষদ ও প্রতিরক্ষা সমন্বয় পরিষদ সংগঠিত হয়। এই প্রতিরক্ষা সমন্বয় কাজে সার্বক্ষণিকভাবে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ এবং সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের যেমন আদেল উদ্দীন আহম্মদ, এমএনএ, শামসুদ্দীন মােল্লা, এমএনএ, ইমাম উদ্দীন, এমপিএ, মােশাররফ হােসেন, এমএ সৈয়দ হায়দার হােসেন এমপিএ, এসএম নূরুন্নবী, গেটর চন্দ্র বালা এমপিএ, আমিন উদ্দীন আহম্মদ এমপিএ, ডাঃ আফতাব উদ্দীন আহম্মদ এমপিএ, মজিবর রহমান খান, ফিরােজার রহমান, কাজী খলিলুর রহমান, লিয়াকত হােসেন, আঃ হাই, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, সফি পরামানিক ও আয়নাল হক প্রমুখ এবং বামপন্থী নেতা মােখলেছুর রহমান ও ননী মােল্লা প্রভৃতিও আন্তরিকভাবে সহযােগিতা করছিলেন। প্রতিরক্ষা কাজে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে বিভূতি ঘােষ, বদিউজ্জামান চৌধুরী, কে এম মামুনুর রশিদ, মনােরঞ্জন সাহা, শরীফ আফজাল হােসেন, নাসির উদ্দীন মুসা, শাহ মােঃ আবু জাফর, সৈয়দ কবিরুল আলম মাও, খােন্দকার আতাউল, নাজমুল হাসান নসরু, সালাহউদ্দিন আহম্মদ, সমীর বােস, মােয়াজ্জেম হােসেন (বেলা), আবু সঈদ খান, সুলতান উদ্দীন বকু, পিযুষ বন্দোপাধ্যায়, মনতােষ কর্মকার, গােসাই, এটিএম সােলায়মান, জ্যোতিষ, বিনয়, তপন ও মজনু প্রভৃতি এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতা চিত্ত ঘােষ ও আতিয়ার রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দও সহযােগিতা করছিলেন।
ছাত্রলীগ কর্মী ও সমর্থক জুনিয়র গ্রুপের মধ্যে যেমন শাহরিয়ার রুমী, হায়দার আলী, খলিফা কামাল, বিপুল ঘােষ, ফয়েজ হাফিজুর রহমান, হাসিবুল হাসান লাভলু, সুশান্ত সাহা, আঃ হালিম, সইফুল আহাদ, সেলিম, সৈয়দ মাসুদ হােসেন, শহীদুল ইসলাম নিরু, মেজবাহ উদ্দীন নফেল, কাজী সালাউদ্দীন, আবুল হাসেম ও নির্মল প্রভৃতি তৎকালীন তাদের বয়স অনুপাতে কমবেশী প্রতিরক্ষা কাজে তৎপর ছিল। ঐ সময় ঝিলাটুলী পাড়ার শহীদ সুফী ক্লাবের একদল জঙ্গী যুবক ছেলে, যারা তখন আওয়ামী লীগের ঝটিকা বাহিনীর মতাে আওয়ামী লীগের উপর প্রতিপক্ষের হিংসাত্মক যে কোন হামলাকে প্রতিরােধ করতে ছুটে যেত, তারা হল গােলজার দুলাল, আশরাফুজ্জামান মজনু, মােজাম, খােন্দকার সেলিম, মিলন, নিমাই, বাবলু, রশিদ, নূর আলম, কাজী মঞ্জু, আমু, আলাউদ্দীন, দীলিপ ও চর কমলাপুরের সেন্টু। এবং সেলিম। এইসব যুবক ছেলেদের তখনকার চলাফেরা ও নেতৃবৃন্দের সাথে বিভিন্ন জায়গায় যখন যেত তাদের মধ্যে সব সময় একটা যুদ্ধংদেহী ভাব পরিলক্ষিত হত। এছাড়া ফরিদপুরের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রফেসর, শিল্পী-সাহিত্যিক ও ব্যবসায়ী মহল প্রভৃতি সর্বস্তরের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তখন প্রতিরক্ষা কাজে যে কোন ধরনের সাহায্য সহযােগীতা করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। এমন কি জামাত, মুসলিম লীগ ও পিডিপির জেলা পর্যায়ের নেতারা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করে প্রতিরক্ষা কাজে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিল। যদিও তারা হানাদার বাহিনী ২১শে এপ্রিল ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করলে তাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ ভূমিকায় ন্যাক্কারজনকভাবে অংশ নিয়েছিল।
সম্ভবত ২৯শে এপ্রিল সকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহম্মদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম ফরিদপুরে ইমাম উদ্দীন আহম্মেদের বাসায় আসেন। তিনি তখন বাসায় ছিলেন না। হাসী ভাবী (পরবর্তীকালে ইশান গালর্স স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা) তাদেরকে বাসায় রেখে ইমাম ভাইয়ের খোঁজে বের হন। ছায়াবাণী সিনেমা হলের নিকট আঃ রব বকুলের ঘরে আওয়ামী লীগ অফিসে ইমাম ভাইকে পেয়ে তাকে বাসায় নিয়ে যান। তিনি বাসায় গিয়ে তাজউদ্দীন আহম্মদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামকে দেখতে পেয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘লিডার কোথায়? তাজউদ্দীন আহম্মদ বলেন, “শান্ত হন, নেতা নিরাপদেই আছেন।’ অতঃপর জনাব তাজউদ্দীন আহম্মদ ভারত যাওয়ার ব্যাপারে সহযােগিতার কথা বলেন। ইমাম ভাইয়ের এক প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন সাহেব বলেন, ভারত যাও, সেখানে গেলে যুদ্ধ সংগঠিত ও পরিচালনার বিষয়ে ভারত সরকারের সাহায্য সহযােগিতা পাবা। সব ব্যবস্থা আছে। আমি ভারত গিয়ে কমান্ডাে আকারে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার ব্যবস্থা করব। ফরিদপুরে আপনারা শেষ মুহুর্তে পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ কাজে নিয়ােজিত থাকবেন। ঐ দিনই বিকালে ইমাম ভাই, সুলতান উদ্দীন বকুকে তাদের সাথে গাইড হিসেবে পাঠিয়ে জনাব তাজউদ্দীন আহম্মদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামকে মাগুরার আওয়ামী লীগ নেতা সােহরাব হােসেনের নিকট পৌছে দেন। মাগুরা থেকে সােহরাব হােসেন তাদেরকে ইন্ডিয়ান বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছার ব্যবস্থা করেন।
পরবর্তী যুদ্ধকালীন সময়ে ফরিদপুর শহরে যে সব ছেলেরা যাদের মধ্যে ভারত গিয়ে অনেকেই এফ এফ ট্রেনিং নিয়ে এসে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে তৎপর ছিল তারা হল : সালাউদ্দীন মনি, মাসুদুল হক, ডাঃ রুনু, গােয়ালচামটের আবুল হােসেন, হরেন্দ্রনাথ মানিক, গােসাই, শামসুদ্দীন, আবু বকর, ভােলা মাস্টার, ফয়েজ, মােকাররম হােসেন, হায়দার আলী, মনু আনন্দ ও আজহার আলী প্রভৃতি। গােয়ালন্দ ঘাটে প্রতিরক্ষা কাজে ব্যবহারের জন্য হাই পাওয়ার বােমা তৈরি করার সময় বিস্ফারিত হয়ে হরেন্দ্রনাথ মানিকের দুটি হাতের কবজাই সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। তরুণ ছেলে সৈয়দ মাসুদ হােসেন ও মিলন জেলা স্কুলে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক পরীক্ষা কেন্দ্রে সাহসিকতার সহিত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রেনেড চার্জ করে এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই ঘটনার পরে রাতে মিলনকে ধরার জন্য পাকসেনার তার বাসায় যায়। তাকে না পেয়ে তার ভাই শহিদুল হাসান, ডাঃ জাহিদ হাসান ও বিমানকে ধরে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং পড়ে ছেড়ে দেয়।
আরও যেসব ছেলেরা মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর লােক হিসেবে কাজ করেছে, তারা হল ঃ শহীদ মঞ্জু, সূৰ্য্যা, দ্ৰনাথ, মাহবুব খান, মিরাজ খান, রওশন, সােলায়মান, পাগলা বাবলু, বিনয় কুমার নাথ, খােন্দকার গওহার ও রাজা প্রভৃতি। শাহ জাফরের সাথে বােয়ালমারীর পাগলা বাবলু থাকত এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে সঙ্গীত পরিবেশন করত। নগরকান্দা থানায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে মােয়াজ্জেন হােসেন সাহেব, কবির, কলিমুল্লাহ ও কাশেম প্রভৃতি কাজ করেছে। চান্দহাট এলাকায় ডাঃ খলিলুর রহমান, চান ফকির, আছমত, খবির মােল্লা, আবদুল হাই প্রভৃতি আজিজ মােল্লার দলের সহিত নানা ভাবে মুক্তি যুদ্ধের কাজে সহযােগীতা করেছে। (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ফরিদপুর, মােঃ সােলায়মান আলী )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত