চুয়াডাঙ্গা কুষ্টিয়ার প্রতিরােধ যুদ্ধের বিবরণ
সাক্ষাৎকার : লে: কর্নেল এম. এ. ওসমান চৌধুরী.৩১-১-১৯৭৪ . মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ইপিআর, ৪র্থ উইং-এর ভার গ্রহণ করার পূর্ব থেকেই চুয়াডাঙ্গায় ছিলেন আরও দু’জন ক্যাপ্টেন সহকারী উইং কমান্ডার হিসাবে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বাঙালি। নাম তার ক্যাপ্টেন এআর আজম চৌধুরী । দ্বিতীয়জন ছিলেন অবাঙালি, তার নাম ক্যাপ্টেন মরহুম সাদেক। এই উইং-এর অধীনে ছিল ৫টি কোম্পানী। ১টি কোম্পানী ছিল চুয়াডাঙ্গা হেডকোয়ার্টারে, অন্য চারটি ছিল সীমান্ত এলাকায়। উইং-এর সীমান্ত এলাকা ছিল দক্ষিণে মাসলিয়া বিওপি থেকে উত্তরে মহেশকুণ্ডি বিওপি পর্যন্ত। প্রত্যেকটি কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিল একেকজন সুবেদার । মােট সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫০ জ’। তার মধ্যে আনুমানিক অবাঙালি সেনার সংখ্যা ছিল ১৫০ জন।
২০শে মার্চ ১৯৭১ সন, চট্টগ্রাম । আমার ব্যক্তিগত গাড়িটি সড়ক পথে চুয়াডাঙ্গা এসে পৌছল। ২৪শে মার্চ সকাল ১০টায় ঐ গাড়ি করেই আমার স্ত্রী, কন্যাদের নিয়ে মেহেরপুরের পথে কুষ্টিয়া রওনা হই। আমার পরণে ছিল ইপিআর পােশাক। সাথে চলল ইপিআর জীপে চড়ে ৪জন সশস্ত্র ইপিআর সৈনিক। উদ্দেশ্য ছিল, আমার সরকারী বাড়ি মেরামত করার হিসাবে কৃষ্টিয়ার ডিসিভ’র কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা। ইচ্ছা ছিল, ঐ দিনই কাজ সেরে কুষ্টিয়া রাত্রি যাপন করার পর ২৫মে মার্চের পূর্বাহ্নেই চুয়াডাঙ্গা ফেরত আসার। কিন্তু মেহেরপুরে গিয়েই গাড়িটা আমার নষ্ট হয়ে গেল। কিছুতেই দোষ খুঁজে পেলাম না। জীপ ফেরত পাঠিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে মেকানিকস আনলাম। গাড়ি ঠিক হতে হতে বিকেল ৩টা বেজে গেল। আবার রওন হলাম কুষ্টিয়া অভিমুখে। আরাে ১৫ মাইল যাবার পর আবার গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আশেপাশের বাড়ি থেকে পাটের রশি সংগ্রহ করে জীপের পিছনে গাড়ি বেঁধে কুষ্টিয়া পৌছলাম। উঠলাম কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে। পরদিন ২৫শে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টায় ডেপুটি কমিশনার সাহেবের অফিসে গেলাম। ডেপুটি কমিশনার ছিলেন জনাব শামসুল হক। তাঁর অফিসে ও বাসস্থান ছিল একই।
তিনি এলেন, কথাবার্তা হল, চায়ের পর্ব শেষ হল। তারপর পিয়নের মারফত ডাকলেন ল্যান্ড এ্যাকুইজিসন অফিসারকে। এলএও সাহেব এলেন, সব শুনলেন, তারপর গেলেন অফিসে প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র ও চেকবুক আনবার জন্য। অসহযােগ আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতা সেরে আমাকে চেক ইস্যু করতে করতে ঠিক বেলায় উঠান গেল না। চুয়াডাঙ্গায় এমন কোন জরুরি অবস্থা ছিল না তাই টাকা সাথে করে নিয়ে যাব মনে করেই ২৫শে মার্চ ভাের ছটায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পেলাম অল্প দূরেই রাস্তার উপর মিলিটারী জীপে করে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর লােক টহল দিচ্ছে আর জানিয়ে দিচ্ছে ৩০ ঘন্টার জন্য কারফিউ । কুষ্টিয়ার জনসাধারণ ঘরে বসেই দরজা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। ব্যাপারটা কেমন যেন ঘােলাটে মনে হল। ডিসিকে টিলিফোন করে জেনে নিতে চাইলাম ব্যাপার কি? কিন্তু টেলিফোন উঠিয়ে এটার কোন সাড়াই পেলাম না। বুঝতে পারলাম লাইন কেটে তথা জিলা স্কুলে করেছে তাদের সদর দপ্তর। এই বিভ্রান্তকর অবস্থাতেই কেটে গেল তিন ঘন্টা। রেডিও লাগান ছিল ঢাকা বেতারের নিয়মিত প্রােগ্রামটা শুনে যাচ্ছিলাম। তা থেকে শুভাশুভ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সাড়ে ৮টা কি ৯টার দিকে হঠাৎ ঘােষণা করা হল নতুন নতুন মার্শাল ল’ আইন। লুফে নিল আমাদের ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা থাকা সমীচীন মনে করলাম না। জীপের পিছনে আবার গাড়িটাকে বেঁধে এবার।
উল্টাদিকে অর্থাৎ ঝিনাইদহের দিকে যথাসম্ভব তীব্র গতিতে চালিয়ে দিলাম। ভাগ্য ভাল কুষ্টিয়ার সার্কিট হাউস ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে। খুব বেশি সময় লাগেনি। দূর থেকে ইপিআর-এর পােশাক পরা অবস্থায় আমাদের দেখেও আমাদের কিছুই ওরা বলেনি। কেন বলেনি সেটা পরে যতবার ভেরেছি, ততবারই ওদের বােকামি ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারিনি। তবে আমি মনে করি এটা বােধহয় আল্লারই মহিমা। বেলা ১১টায় ঝিনাইদহ পৌছে দেখি শহর লােকে লােকারণ্য। আমার জীপকে আসতে দেখে তারা রাস্তা ছেড়ে দিল। এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, চুয়াডাঙ্গার ইপিআর-এর ৪র্থ উইং-এর ইতিহাসে আমি ছিলাম প্রথম বাঙালি কমান্ডার। আমার বা আমার পরিবারের কারও গায়ের রঙ দেখে স্থানীয় লােক বিশ্বাসই করতে পারেনি যে আমরা বাঙালি। তাছাড়া এই স্বল্প সময়ে জনসাধারণের সাথে পরিচয় করাও সম্ভব হয়নি। স্থানীয় লােকজনের সাথে পরিচয় করার একটা সুবর্ণ সুযােগ মনে করে আমি গড়ি থেকে নেমে বাঙলা ভাষায় লােকনজকে ডাকলাম। লােকজন সবাই দৌড়ে এল। পরিচয় পেয়ে উৎসাহিত হল। আমার আহ্বানে সমস্ত সহযােগিতার আভাস ছিল। আমি তাদেরকে প্রস্তুত থাকবার উপদেশ দিয়ে সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে রওনা দিলাম। আনুমানিক বেলা ১ টায় চুয়াডাঙ্গা আমার সদর দপ্তরের সামনে রাস্তায় পৌছলাম । আমার গাড়ি দাঁড়াবার সাথে সাথেই আমার বাঙালি উইং হাবিলদার-মেজর মজিবর রহমান এসে অভিবাদন করে ঢাকার ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিল। আরও জানাল যে, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর কোনরকম নির্দেশ ছাড়াই উইং হেডকোয়ার্টরের সমস্ত সরিয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রেখেছে।
হাবিলদার মেজর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটা দূরভিসন্ধির খবরও আমাকে জানাল। সেটা হল যে, ২৫শে মার্চ বিকেল বেলা হঠাৎ করে যশাের থেকে তৎকালীন ইপিআর সেক্টরের উপ-অধিনায়ক অবাঙালি মেজর সরদার আবদুল কাদের চুয়াডাঙ্গা এসেছিল যশােরে একটা জরুরি মিটিং-এর অজুহাতে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু যখন শুনল আমি চুয়াডাঙ্গায় নেই তখন সে ক্যাপ্টেন সাদেকের বাসায় রাত্রি যাপন করে ২৬শে মার্চ ভাের ৪টার সময় ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার পরিবারবর্গকে নিয়ে যশােরে পালিয়ে যায়। | যা হােক, হাবিলদার মেজরের কাছ থেকে আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা জানতে পেরে আমি মনে মনে একট সিদ্ধান্তে প্রায় পৌছতে পারলাম। তবুও তাদেরকে সেখানে গিয়েই আমি আমার অফিসার ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ডাঃ আসহাবুল হক ও স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, বেসামরিক কর্মচারী প্রমুখদের জরুরিভাবে তলব করে পাঠালাম। ডাঃ আসহাবুল বােধহয় তৈরিই ছিলেন আমার অপেক্ষায়। ৫ মিনিটের মধ্যে তিনি এসে উপস্থিত হলেন। অন্যান্য সবাই আসার পর আমি তাদেরকে নিয়ে একটা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলাম। ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর থেকে তখন পর্যন্ত ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গার আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা ও দূর্ঘটনা নিয়ে আলােচনা করলাম।
সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা গেল যে, এ অন্যায় আমরা সইব না। শপথ নিলাম আমর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, এবং যেমন করেই হােক নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও মাতৃভূমিকে এই পশুশক্তির কাল হাত থেকে রক্ষা করব। সবাই আমাকে সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কার্যকলাপের প্রধান বলে মেনে নিলেন। আমিও নির্দেশ জারী করলাম যে, সেই থেকে আমার নির্দেশ মতােই সবাইকে আপন আপন কাজ সমাধা করতে হবে। সমস্ত সিদ্ধান্তের পর আমি সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সমভিব্যাহারে আমার উইং-এর কোয়ার্টার গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা সসম্মানে উত্তোলন করে ওটাকে জাতীয় অভিবাদন দিলাম। এটা যে একটা কত বড় জীবনের ঝুঁকি, বিশেষ করে যখন কোনরকম সংযােগবিহীন অবস্থায় বিনা নির্দেশে এবং আর কেউ বিদ্রোহ করেছে কিনা, সেটা না জেনেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মতাে একটা এতবড় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, বিজ্ঞজন মাত্রেই তা অনুধাবন করতে পারবেন। | তারপর আমি আমার সৈন্য ও ভারী অস্ত্র নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করানাে এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা ইত্যাদি সামরিক ও বেসামরিক নির্দেশ দানে কাটাই। প্রায় অর্ধরাত অতিবাহিত করি। ইতিমধ্যে আয়ারলেস মারফত সীমান্তের আমার সৈন্যদেরকেও অবস্থা বর্ণনা করে সজাগ থাকতে নির্দেশ দিই। এইভাবে অতিবাহিত হল ২৬শে মার্চ।
২৭মে মার্চ সকাল ৭ ঘটিকায় মাসলিয়া বিওপি কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার আবদুল মজিদ মােল্লা আয়ারলেস মারফত জানালেন যে, ক্যাপ্টেন সাদেক তিনজন সৈনিকসহ যশাের থেকে সীমান্ত রাস্তা দিয়ে মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করেছে। আমি তাকে ক্যাপ্টেন সাদেকের উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ দিলাম। খবরটা পেয়ে আমি অনুমান করেছিলাম যে, হয়ত বা ২৬শে মার্চ ভাের ৪টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া থেকে আসতে পারিনি লক্ষ্য করেই বােধহয় ক্যাপ্টেন সাদেক ভেবেছিল যে, সীমান্তের সৈন্যদেরকে নিশ্চয় কোন রকম সজাগ থাকার আদেশ দেওয়া হয়নি। তাই তার মাসলিয়া যাবার উদ্দেশ্য সৈন্যদেরকে চতুরতার সাথে নিরস্ত্র করা।
যা-ই হােক, প্রায় ১০ মিনিট পর সুবেদার মজিদ মােল্লাহ জানাল যে, ক্যাপ্টেন সাদেক আদেশ পালন না করার অপরাধে একজন বাঙালি সিপাই-এর উপর পিস্তলের গুলি করে যশাের অভিমুখে জীপে করে পালিয়ে যায়। অবশ্য, এরপর আমার নির্দেশ অনুসারে পরবর্তী বিওপিতে খবর দিয়ে গুলির বিনিময়ে তাদের গতি রােধ করা হয়। গােলাগুলিতে ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার সঙ্গীরা মারা যায়। কিছুক্ষণ পর সুবেদার মজিদ মােল্লা অত্যন্ত ভীতস্বরে আয়ারলেসে আমাকে এ খবর জানায়। আমি তাকে অভয় দিয়ে মৃতদেহগুলি পুঁতে ফেলার আদেশ দিই। এইখানেই শুরু হল আমার এলাকায় পদ্মার ওপারে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হনন পর্ব। এখানেই বুঝতে পারলাম—I am in a point oPfJ no return I have to kill the enemy or get killed’. কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পরিকল্পনা ও ডাঃ আসহাবুল হক সাহেবকে খবর দিলাম । দু’কমরেড মিলে ছক আঁকলাম—কুষ্টিয়া আমাকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। পরিকল্পনা করলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সীমান্তের সৈন্যবাহিনীকে জরুরি ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গায় জমায়েতে হবার নির্দেশ দিলাম। ফিলিপনগর কোম্পানীকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে সমবেত হবার পর পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলাম। এই কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন সুবেদার মােজাফফর আহমেদ (বর্তমানে লেঃ, ইপিআর)। দু’কমরেড মিলে ঐ এলাকার নামকরণ করলাম সাউথ ওয়েস্টার্ন কমান্ড দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন।’ কমাণ্ডার হলাম আমি মেজর মােহাম্মদ আবু ওসমান চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)।
এখানে কুষ্টিয়ার শক্রর সৈন্য সংখ্যা ও তাদের শক্তির উপর কিছুটা আলােকপাত করা দরকার। যশাের ব্রিগেড থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেন্ট তথা রিকনাইসেন্স ও সাপাের্ট ব্যাটেলিয়নের এক কোম্পানী অর্থাৎ প্রায় ২০০ সৈন্য কুষ্টিয়া অধিকার করে ২৫/২৬ শে মার্চ রাত দেড়টায়। তাদের সাথে ছিল পর্যাপ্ত সংখ্যক ১০৬ এমএমআর আর (জীপে সংস্থাপিত) চীনা এইচএমজি, এলএমজি, এসএমজি ও অটোমেটিক রাইফেলসমূহ। তার সাথে প্রচুর পরিমাণ গােলাবারুদ, গাড়ি ও বেতারযন্ত্র ছিল। তুলনামূলকভাবে সমপরিমাণ আক্রমণের সমস্ত আয়ােজন সম্পূর্ণ, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, চলাচল ব্যবস্থার অসুবিধার জন্য ও একটা গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পতিত হওয়ার দরুন সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানী নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমি আক্রমণের দিন ও সময় ২৪ ঘণ্টা পিছিয়ে দিই। অর্থাৎ আক্রমণের নতুন দিন ও সময় স্থির করি ৩০শে মার্চ ভাের ৪টায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, ২৬শে মার্চ সকাল ১০ টায় আমার মাসলিয়ায় অবস্থানরত কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার মজিদ মােল্লা আয়ারলেসে খবর পাঠালেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ান, যারা সিনিয়র টাইগার নামে পরিচিতি, তাদের সমস্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সহকারে বাঙালি কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল রেজাউল জলিলের নেতৃত্বে চৌগাছায় অবস্থান করছে। এই ব্যাটালিয়ান নাকি ২৪শে মার্চ তারিখে বাৎসরিক ফিল্ড এক্সাসারসাইজের জন্য চৌগাছায় এসেছিল যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে। খবর শুনে আমার মনে বিরাট একটা ভরসা আসে। আমি আয়ারলেসে সুবেদার মজিদ মােল্লাকে দিয়ে আমার তরফ থেকে খবর লিখে পাঠালাম লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে। ঐ খবরে আমি লিখেছিলাম যে, দেশের ও বিদেশের লােকের নিরপত্তা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত, মা, বােনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত, জ্ঞানী-গুনী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। আর কে কি করেছে জানি না, কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে। আপনি আসুন, অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুন। আমরা সম্মিলিত ভাবে। এদের হনন করতে সক্ষম হব।’ সুবেদার মজিদ মােল্লা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ানে গিয়ে এ সংবাদ তার কাছে পৌছায়। কিন্তু অনেক অপেক্ষা করেও তার কাছ থেকে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আমাকে এ খবর দেয়ার পর ২৮শে মার্চ আবার এই মর্মে চিঠি লিখে দানেশ নামক এক বিশেষ মুক্তিযােদ্ধাকে তার মােটার সাইকেলে করেই লেঃ কর্নেল জলিলের কাছে পাঠাই। চিঠি তার হতে পৌছানাে হয়, কিন্তু নিষ্ফল সব আশা।
তিনি কোন রকম আশ্বাস দেয়া দূরের কথা, আমার কার্যকলাপকে আদৌ গুরুত্ব না দিয়ে সেদিনই বিকেল বেলা যশাের ক্যান্টনমেন্টে তাঁর জীপে করে চলে যান এবং ২৯শে মার্চ পত্রবাহক মারফত ব্যাটালিয়ানের কাছে সংবাদ পাঠান যে, যশাের ক্যান্টনমেন্টে কোন রকম গােলমাল নেই এবং তার আশঙ্কাও নেই, তাই পুরাে ব্যাটালিয়ান যেন যশাের ক্যান্টনমেন্টে সেদিনই ফেরত আসে। তদনুযায়ী এই ব্যাটালিয়ান ২৯শে মার্চ বিকেল পর্যন্ত যশাের ক্যান্টনমেন্টে ফেরত গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে আপন আপন কাজে লিপ্ত হয়। শুনেছি, বিগ্রেডিয়ার সরদার আব্দুর রহিম দূররানী নাকি রাত্রেই তাদের অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করে। পরদিন ৩০শে মার্চ সকাল ১০টায় এই ব্যাটালিয়নের অস্ত্রবিহীন সৈন্যদের উপর চতুর্দিক থেকে আক্রমণ ও গােলাগুলি বর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সৈন্যই নিরীহ ভাবে মারা যায়। শুধু লেঃ হাফিজউদ্দিন (বর্তমানে ক্যাপ্টেন) ও ১৪৮ জন জেসি ও এবং অন্যান্য সাধারণ সৈন্য জীবন নিয়ে পালিয়ে এসে আবার ঐ চৌগাছা এলাকায় সমবেত হয়। তাদের অস্ত্র নেই, খাবার নেই, পরণে কাপড় নেই। তারা বহুকষ্টে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর লােকজনের সাথে যােগাযােগ করে খাদ্য সংগ্রহ করে।
এদিকে কুষ্টিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনা হল, ২৮ শে মার্চ রাত থেকে ২৯শে মার্চ রাত পর্যন্ত অত্যন্ত গােপনীয় ভাবে আমাদের সৈন্যদের কুষ্টিয়া শহর থেকে অদূরে মাঠে ময়দানে ও জঙ্গলে অবস্থান করতে হয়। সুবেদার মুজফফরের কোম্পানি নির্দিষ্ট জায়গায়। পৌছতে সক্ষম হয় ২৯শে মার্চ ভােরবেলা। নিয়মিত যােগাযােগ করে তাদেরকে আক্রমণের পরিকল্পনা সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং যথারীতি অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, ঔষধপত্র ও বেসামরিক লােক সরবরাহ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০শে মার্চ সকাল ৪টায় তিন দিক থেকে অতর্কিতভাবে কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। আক্রমণের সাথে সাথে অনুসরণকারী জনগণের গগনবিদারী জয়ধ্বনিতে বােধহয় শত্রুপক্ষের মনােবল ভেঙ্গে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পুলিশ লাইন ও আয়ারলেস কেন্দ্রের ভেতর ঢুকে পড়ে শক্র হনন করতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে সামান্য সংখ্যক শত্রুসৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে তাদেরই সদর দপ্তরের দিকে পালিয়ে যায়। পালাবার প্রাক্কালেও অনেকে নিহত হয়। পুরােদিনের যুদ্ধে একমাত্র তাদের সদর দপ্তর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ব্যতীত সমস্ত শহরই আমাদের হস্তগত হয়। আমার সৈন্যরা শত্রুদেরকে ৩০শে মার্চ সারারাত চতুর্দিকে থেকে ঘিরে রেখে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি সহকারে গােলা বর্ষণ করতে থাকে। শত্রুরা আয়ারলেসে যশােরের কাছে আরাে সৈন্য পাঠাবার আবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হয়। আমাদের আয়ারলেস সেটের মারফত শত্রুপক্ষের আয়ারলেস আবেদন মনিটরিং করে যশােরের দেওয়া প্রত্যুত্তর আমাদের হস্তগত হয়। যশােরের gures 1697—’Reinforcement not possible. Try to live on your own’. (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত