সশস্ত্র প্রতিরােধ ময়মনসিংহ
বিগত ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে আমি আমার ইপিআর-এর ‘সি’ কোম্পানীসহ ২নং উইং হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহ ছিলাম। ২৫শে মার্চ তারিখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগ, টিক্কা খানের রেডিও ভাষণ ও আদেশ এবং পাকসামরিক বাহিনীর পিলখানা, রাজারবাগ আক্রমণের খবর ময়মনসিংহ পৌছার সাথে সাথে ময়মনসিংহের ইপিআর-এর বাঙালি যুবকেরা তাদের ভবিষ্যৎ বুঝিতে পারে। অন্যদিকে তকালীন ২নং ইপিআর উইং-এর কমাণ্ডার ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের জোয়ানদিগকে আরাম করার আদেশ হতে পরিস্থিতি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে বাঙালিদের ভাগ্যাকাশে ঘনঘটার ছায়া জুড়ে বসেছে। ২৭-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস আমাকে অফিসে ডাকিয়ে আদেশ দেন যে, আপনারা প্রায় এক মাস যাবৎ স্ট্যাণ্ডবাই ডিউটি করছেন, এখন স্ট্যাণ্ডাডাউন করে আরাম করুন। তাতে আমি তার সাথে একমত না হওয়ায় দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। সেময় একটি জীপে করে বেশ কিছু এ্যুনিশন ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় নিয়ে যাওয়ার সময় আমার মনের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যে, আমাদের উপর হামলা হবে। তারপর আমি উইং হেড-কোয়ার্টারের কয়েকজন বাঙালি এনসিও, যথা হাবিলদার আরিফ, হাবিলদার সিরাজ, হাবিলদার আহম্মদ মিয়া ও হাবিলদার আঃ হাকিমকে নিয়ে একটি গােপন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিই যে, হাতিয়ার দেব না।
এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কোত হতে হাতিয়ার এমুনিশন আরও যা ছিল বের করে জোয়ানদের মধ্যে তিবরণ করে দিই এবং যে কোন পরিস্থিতির মােকাবেলার জন্য হুকুম দিই। সমস্ত বাঙালি জোয়ানরা নতুন করে শপথ নিয়ে মরণ পর্যন্ত হাতিয়ার দেবে না বলে আমাকে আশ্বাস দেয়। সারাদিন দু’পক্ষের লােকদের মধ্যে একটা অবর্ণনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। ইতিমধ্যে অবাঙালি ফোর্স, যাদের মধ্যে ইপিআর এয়ার ফোর্স, জিডি ট্রপস, আর্মি সিগন্যাল, মুজাহিদ ইন্ট্রাক্টর এবং আর্মি সিকিউরিটি মিলে প্রায় ১৩৮ জন ছিল। তারা একটা গােপন বৈঠক করে। এই খবর পেয়ে বিকাল অনুমান ৪টার দিকে আমি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানী, যা খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে ছিল, তার কমাণ্ডার তৎকালীন মেজর নূরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলােচনা করি। সমস্ত গােপনীয় সংবাদ, যা আমার জানা ছিল, তাঁকে অবগত করাই এবং আগে আমাদের এ্যাকশনের জন্য পরামর্শ করি এবং তাঁর সহযােগিতা কামনা করি। তারপর অনুমান সাড়ে ছটার সময় ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে সাথে নিয়ে আমার বাঙালিদের ফল-ইন করতে হুকুম দেন, কিন্তু আমি অল্প কিছু লােক যারা সামনে ছিল তাদেরকে একত্র করে মেজর সাহেবক আলাপ করতে দেই। মেজর সাহেব বলেন যে, একটি কোম্পানী বা একটি উইং কি করে পাকআর্মির বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে অথবা বাঁচার জন্য তৈরি হতে পারে ?
যা হােক, মেজর সাহেব আমাদেরকে অভয় দেন যে, কোন বিপদ হবে না, ভুল চিন্তা করবেন না। কিন্তু ঐ সময় আমি দেখেতে পাই যে, অবাঙালি ২০/২৫ জন মুজাহিদ কোতে ঢুকে ডিউটি শুরু করেছে। অন্যদিকে, তাদের কিছু জেসিও মেসে, কিছু অফিসের ভেতর, কিছু ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় এবং অন্যদিকে ২৫/৩০ জনের একটি গ্রুপ পেট্রোল ডিউটি আরম্ভ করেছে। তখন কয়েকজন বাঙালি জোয়ান দৌড়ে আমার নিকট নিতে চায় যে, আমরা কি করব। অবস্থা খুবই খারাপ দেখে আমি ওদেরকে নিজের জায়গায় থাকতে আদেশ দেই এবং যে কোন মূল্যে কোয়ার্টার গার্ড নিজেদের আয়ত্বে রাখতে হুকুম দেই। অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী যা পুকুর পারে ছিল তাদের মধ্যে নায়েক সুবেদার বড়ুয়া এবং নায়েক সুবেদার মােশাররফ হােসেনকে (দু’জনই বাঙালি) ডাকিয়ে অবস্থা তাদেরকে জানাই এবং তাদের মনােভাব অতি সতর্কতার সহিত অনুভব করি, যেহেতু তারাও আর্মি। এইভাবে রাত্রি সাড়ে নটার সময় আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, আমাদের উপর হামলা হবে। তাই আমি পরিস্থিতি সম্বন্ধে মেজর নূরুল ইসলামকে ডাক বাংলােয় খবর পাঠাই। কিন্তু কোন উত্তর পাওয়ার আগেই রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারােটার সময় অবাঙালিদের তরফ হতে প্রথম ফায়ার আসে যাতে বাঙালি একজন জোয়ান আহত হয়। অমনি দু’দিক হতে তুমুলভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শুরু হয়। এই যুদ্ধ ২৭ তারিখ রাত্রি এগারােটা হতে পরদিন বিকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকা পর্যন্ত চলে। ইপিআর হেডকোয়ার্টারের দু’দলের আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনে সারা ময়মনিসংহ কেঁপে ওঠে।
এই দীর্ঘ আঠার ঘন্টা যুদ্ধে বাঙালিরা সংখ্যায় ছিল প্রায় ২২০ জন আর অবাঙালিরা ছিল ১৩৮ জন। সারারাত যুদ্ধ চলে। সকালের দিকে শহর ও গ্রাম হতে প্রায় ১০/১৫ হাজার বাঙালি সিভিল লােক বাঙালিদেরকে খাবার, পানীয় ও অন্যান্য যথাসম্ভব সাহায্য করে। অবাঙালিদের মধ্য হতে ১২১জন মারা যায় এবং বাকী সতেরজন আমার নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যারা আত্মসর্পণ করেছিল তাদের মধ্যে সুবেদার জিন্নত খা, নায়েক সুবেদার হজরত খাঁ, নায়েক সুবেদার সুবেদার খান বাহাদুর, হাবিলদার গােলাম হায়দার, হবিলদার নাজির বাদশাহ প্রমুখ ছিল। যারা মারা যায় তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস, একজন এয়ারফোর্সের অফিসারও ছিল। বাঙালিদের মধ্যে সিপাই দেলওয়ার, সিপাই রাজ্জাকসহ কয়েকজন আহত হন। দেলওয়ার পরে মেডিক্যাল কলেজে মারা যায়। প্রকাশ থাকে যে, আমি সকাল সাড়ে আটটার দিকে উক্ত উইং-এর অধীনে বর্ডারে থাকা কোম্পানীগুলিকে একটি অয়ারলেস মেসেজ দ্বারা হেডকোয়ার্টারের পরিস্থিতি জানাই, কোম্পানীগুলি ছিল (১) সুবেদার হাকিম সাহেবের সাথে নকশী, (২) সুবেদার জিয়াউল হক সাহেবের সাথে করইতলী এবং (৩) সুবেদার আজিজুল হকের সাথে লেংগুরায়। আমি মেসেজে তাদেরকেও জরুরি ভিত্তিতে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেবার অনুরােধ জানাই, যা তারা করেন। | এই যুদ্ধের পর আমি মােজাহিদ অস্ত্রাগার দখল করি এবং কোতে থাকা ১৪৭২টা রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বেশ কিছু স্টেনগান, এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, প্রায় ছত্রিশ হাজার ৯ এমএম গুলি এবং আরও যুদ্ধসরঞ্জাম দখল করি, যা পরে তৎকালীন মেজর বর্তমানে মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ সাহেবকে দেই।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি-কোম্পানীর সাহায্য আমি চাইলে সিনিয়র জেসিও বড়য়া বলেন যে, মেজর সাহেবের বিনা হুকুমে সে আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। তারপর নায়েক সুবেদার মােশাররফ হােসেন সকাল প্রায় নটার দিকে কিছু লােক নিয়ে আমার সাথে যােগ দেয়, কিন্তু ঘন্টাখানেক পর আবার বিরত হয়ে যায়। অন্যদিকে মেজর নূরুল ইসলাম ও তার সঙ্গী লেফটেন্যান্ট মান্নান সাহেবের কোন খোজ পাওয়া যায়নি। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছটার দিকে যখন আমি উইং-এর লােকেশন বদলী করার জন্য পুলিশ লাইনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আমরা ৪/৫ জন লােক মেজর সাহেবকে আমার সঙ্গে ঐ জায়গায় দেখা করালে জানতে পারি যে, মেজরসাহেব ব্ৰহ্মপুত্র নদের ওপারে চলে গিয়েছিলেন। আমি মেজর সাহেবকে ঘটনা পুরাপুরি বললে তিনি আমাকে বলেন যে, তাহার ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার জয়দেবপুরে অয়ারলেসে আলাপ করার পর আবার আমার সঙ্গে দেখা করবে।
রাত্রিতেই আমি পুলিশ, সিভিল ও আওয়ামী লীগের লােকজনের সাহায্যে আমি উইংএর লােকেশন বদলী করে রাবেয়া হাইস্কুল নিয়ে যাই। কারণ আমি অনুমান করি যে পরের দিন পাকবাহিনী খবর পেলে হয়ত কোন এয়ার এ্যাকশন নিতে পারে। সিভিল লােকদের মধ্যে যারা অগ্রভাগে কাজ করে আমাকে সাহায্য করেন তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন এমএনএ (বর্তমান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট) জনাব রফিকউদ্দিন ভুইয়া, বর্তমানে লণ্ডনে এ্যামব্যাসেডর জনাব সৈয়দ সুলতান সাহেব, বর্তমান এমপি হাতেম আলী তালুকদার সাহেব প্রমুখ। পরের দিন ২৯-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা আমি রাবেয়া হাইস্কুলে ইপিআর-এর লােকসহ বাংলাদেশ পতাকাকে গার্ড অব অনারের সাথে সালাম দিয়ে পতাকা ছুঁয়ে নতুন করে শপথ নিই যে, আমরণ যুদ্ধ করব। উল্লেখযােগ্য যে, পতাকা তুলেছিল হাবিলদার নিয়াজ। কারণ এখন আর গত্যন্তর নাই। অনুমান বেলা ১১টার দিকে যখন আমি খাগডহর-এর দিকে যাচ্ছিলাম, নতুন বাজারের মােড়ে একজন লােক সাদা পােশাকে আমাকে পরিচয় দেয় যে, তিনি বেলুচ রেজিমেন্টের একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন এবং আমার সঙ্গে যােগ দিতে চান।
কিন্তু আমি তাকে বিশ্বাস করতে না পারায় পরে দেখা করতে বলি, প্রচার হয়েছিল যে, একটি বিরাট মুক্তিবাহিনী দল নরসংিদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা ভাঙ্গা হতে পরপর দু’দিন ও রাতে আক্রমণাত্মক এ্যাকশন চালালে পাকফোর্স তার ডেমরা ঘাঁটির শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে বলে সংবাদ পাই আরও জানতে পারি যে, আমাদের বেইসের উপর আক্রমণ করবে। কিন্তু আমাদের ২২জন লােকের একটি দল গেরিলা পদ্ধতিতে ঢাকার তৎকালীন পাকমােটর বর্তমানে বাংলা মােটরে ৪-৪৭১ তারিখের রাতে এবং ঢাকা-ডেমরা রােডে ৫-৪-৭১ এর রাতে দু’জায়গায় সরকারী গাড়িসহ বেশ কিছু পাকফোর্সকে নিহত করে। এই দুটো সফল অপারেশনে অংশ গ্রহণ করেছিল হাবিলদার হাকিম, সিপাই নানু মিয়া, সিপাই আফতাব, সিপাই ক্লার্ক মান্নান।
৩-৪-৭১ তারিখে বেলা অনুমান ১১/১২ টার সময় আমি একজন সিপাই-এর মারফত সংবাদ পাই যে, ঢাকায় বহু ইপিআর মারা পড়েছে। এবং প্রায় ১০০ লােক ঢাকার জিঞ্জিরায় সুবেদার গনি সাহেবের সাথে আছে। আমি একজন লােক মারফত চিঠি দিয়ে গনি সাহেবকে আমার যােগদানের অনুরােধ জানাই। ৬-৪-৭১ তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সুলতান-এর মারফত জানতে পারি যে, সুবেদার গনি সাহেব নরসিংদীতে লােক নিয়ে পৌঁছলে ঐ জায়গায় বিমান আক্রমণ হয়। এবং তারা আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এবং অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী নিয়ে ক্যাপ্টেন সাইগল ঢাকা-নরসিংদী রাস্তার প্রতিরােধ ব্যবস্থা ছেড়ে নরসিংদী পার হয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। এই সংবাদ শুনে আমার লােকজনের মনােবল কমে যায়। আমার ২০/২২ জন লােক তখনও ভাঙ্গা বেইস হতে ঢাকায় অপারেশনে ছিল। অন্যদিকে ২-৪-৭১ তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সিরাজ-এর নেতৃত্বে ৪০ জন লােকের একটি প্লাটুন ঘােড়াশাল রেল স্টেশন এরিয়া প্রতিরক্ষার জন্য পাঠাই। ৬-৪-৭১ তারিখে বেঙ্গল রেজিমেন্ট চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আমি তাদেরকে আমার সঙ্গে পাঁচদোনায় ফেরত পাঠিয়ে নিজে বাঙ্গার লােকজনসহ পাঁচদোনার শীলমন্দি নামক গ্রামে প্রতিরােধ ব্যবস্থা করি, অর্থাৎ ডিফেন্স লাগাই। অন্যদিকে খবর পাই যে, পাকফোর্স ডেমরায় জমা হয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
৭-৪-৭১ তারিখ রাতে জানতে পারি যে, পাকফোর্স সকালবেলা আমাদের উপর হামলা করবে। তাই পাঁচদোনার আগে১২/১৪ জন লােক দিয়ে একটি এ্যামবুশ পার্টি লাগাই যাতে সিপাই নানু, মান্নান, হাকিম ছিল। ঠিক ৮-৪-৭১ তারিখ সকাল আনুমানিক সাড়ে ছয়টায় পাকফোর্স অগ্রসর হতে থাকলে এ্যামবুশ পার্টি একযােগে ৪টি এলএমজি দ্বারা আক্রমণ চালায় যাতে পাকফোর্সের প্রায় ১৫৫ জনের মতাে লােক হতাহত হয় এবং কয়েকটি গাড়িও নষ্ট হয়। পাকফোর্স ঐ দিন আর অগ্রসর হয়নি।
৯-৪-৭১ তারিখে অনুমান নয়টার সময় পাকফোর্স এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হয়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। অনুমান এক হতে সােয়া ঘন্টা যুদ্ধের পর পাকফোর্সযাতে ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট ছিল-আক্রমণ ছেড়ে দিয়ে পাঁচদোনা হতে পিছে চলে যায়। যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে বেলা অনুমান ৫ঘটিকার সময় পাকফোর্স আবার আমাদের উপর এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থনপুস্ট হয়ে দ্বিতীয়বার হামলা চালায়। এই যুদ্ধে পাকফোর্স এবারও যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করে আক্রমণ ছেড়ে দিয়ে সন্ধ্যার সময় গােপালদী বাজারে চলে যায়। এদিকে দু’বারের আক্রমণে আমাদের কিছু হাতিয়ার খারাপ হয়ে যায়। যা হােক, সন্ধ্যার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা এই অবস্থান ছেড়ে ভৈরবের দিকে এগিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মিলিত হব। আশুগঞ্জে গিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাওয়া যায়। এবং সেখান হতে কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ ১৩-৪-৭১ তারিখে রামনগর পুলের নিকট আর একটি প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। কিন্তু ১৪-৪-৭১ তারিখে সূর্যাস্তের আগে হতেই এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হয়ে পাকফোর্স হামলা চালায় এবং দুপুর ১২ টার আগেই ঐ ডিফেন্স নষ্ট হয়ে যায় এবং এখানকার লােকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে। যায়। কিছু লোেক মেঘনা পার হয়ে সিলেট জেলার ভেতর চলে যায়।
আমি কিছু সংখ্যক লােকসহ কিশােরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহে যাই। কারণ আমার ছেলেপেলে ঐখানে ছিল। তারপর ১৫-৪-৭১ তারিখ বিকালবেলা আমি মুক্তাগাছা হয়ে ময়মসিংহ জেলার মধুপুরে জিয়াউল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করলে জানতে পারি যে, টাঙ্গাইলের আগে জামুর্কী এলাকায় নায়েক সুবেদার হারিসের নেতৃত্বে ইপিআর দলের সঙ্গে পাকফোর্সের তুমুল যুদ্ধ হয় এবং দু’দিকেরই ভীষণ ক্ষতি হয়। তাতে প্রায় ২০/৩০ জন ইপিআর মারা যায়।
পরদিন ১৭-৪-৭১ তারিখে খুব সকাল হতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের ৪টি জঙ্গী বিমান ভীষণভাবে ময়মনসিংহ শহর ও অন্যান্য এলাকায় আক্রমণ চালায় যাতে কিছু সিভিল লােক শম্ভুগঞ্জ ঘাটে মারা যায় এবং কয়েকটি বাস ও দোকানঘর পুড়ে যায়। অন্যদিকে গফরগাঁয়েও বেশ কিছু সিভিল লােক মারা যায় এবং অনেক জায়গা পুড়ে যায়। তাছাড়া মধুপুর ও জামালপুরেও বিমান আক্রমণ হয়েছে বলে সংবাদ পাই। তারপর আমরা আমাদের অবস্থানে যে কয়েকজন লােক ছিল তাদের নিয়ে বর্ডারে করইতলী হেডকোয়ার্টারে ফুলপুর ও হালুয়াঘাটের মাঝামাঝি সায়চাপুর ঘাটে ডিফেন্স তৈরি করি। কিন্তু ২২/২৩ তারিখে পাকফোর্স আবার এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হয়ে আক্রমণ চালায় সকালের দিকে। সেখানে আমরা অতি অল্প সময় টিকতে পারি। ২৩-৪৭১ তারিখে আমি আমার সঙ্গী লােকসহ করইতলী ক্যাম্পে থাকাকালীন সুবেদার হাকিম সাহেব আসেন তাকে উইং-এর ভার দিয়ে আমি আমার ফ্যামিলীসহ হিন্দুস্থানের ভেতর দিয়ে গছুয়াপাড়া হতে ডালু হয়ে আবার বাংলাদেশে ঢুকি। বহু কষ্টে আমার ফ্যামেলী বাড়ি পৌছে দিয়ে আগরতলা কোনাবন বর্ডার দিয়ে ঢুকে পুরানাে ফোর্সের সাথে ৩নং সেক্টরের অধীনে বেলচরা সাবসেক্টরে যােগদান করি। সেখানে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সাহেব ছিলেন। তারপর ঐ সাব সেক্টরেই ১৬-৫-৭১ হতে যুদ্ধে লিপ্ত থাকি। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র অষ্টম খণ্ড)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত