You dont have javascript enabled! Please enable it!
সাটিয়াচড়ার যুদ্ধ
টাঙ্গাইল শহর তখনও মুক্ত অঞ্চল। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের জেলায়, শহরে ও গ্রামাঞ্চলে প্রতিরােধের সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় বেতার মারফত রক্তপিপাসু পাকসৈন্যদের হিংস্র আক্রমণ আর বাংলাদেশের সগ্রামী মানুষদের গৌরবময় প্রতিরােধের কাহিনী প্রচারিত হয়ে চলেছে। হামলাকারীর দল তখনও টাঙ্গাইল জেলায় এসে পৌছতে পারেনি। টাঙ্গাইল শহরে মুক্তির উৎসব চলেছে। রাজপথের দু’ধারে প্রতিটি ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সগৌরবে উড়ছে। জয় বাংলা সঙ্গীতে সারা শহর মুখরিত। কিন্তু সমস্ত আনন্দ-উৎসবের পেছনে এল বিপদে কাল ছায়া। শহরের মানুষ হাসতে গিয়েও প্রাণখােলা হাসি হাসতে পারে না। আকাশবাণী নিত্য নতুন দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে, মুক্ত শহরগুলি একের পর এক পাকসৈন্যদের অধিকারে চলে যাচ্ছে। তারপর সেই হিংস্র জল্লাদের দল সেই সমস্ত শহরের অদিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে। এখনও ওরা ময়মনসিংহ জেলা ও টাঙ্গাইল জেলা থেকে দূরে আছে কিন্তু ক’দিন তারা এভাবে থাকতে পারবে! দু’দিন আগেই হােক আর পরেই হােক ওরা এখানে এসে হামলা করবেই। সেদিন টাঙ্গাইলের মানুষ কেমন করে ওদের প্রতিরােধ করবে? কেমন করে নিজেদের। স্বাধীনতা রক্ষা করবে?
আজ সারা বাংলাদেশের মানুষের মন স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত। সারা দেশের মানুষ কখনও এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে ওঠেনি। টাঙ্গাইলের মানুষ—অতি সাধারণ মানুষও তাদের বাইরে নয়, তারাও তাদের সঙ্গে একতালে পা মিলিয়ে যুদ্ধের জন্য উন্মুখ। কিন্তু সেই প্রস্তুতি কোথায়? কোথায় অস্ত্র, কোথায় চালনার শিক্ষা ব্যবস্থা ? কামান-বন্দুকের বিরুদ্ধে তাে আর লাঠি-সােটা বর্শা বল্লম নিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। প্রতিরােধের দায়িত্ব সামনে আসতেই এই প্রশ্নটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবু তাদের যেটুকু সম্বল তাই নিয়ে তারা প্রতিরােধের জন্য তৈরি হচ্ছে। তাদের সামনের সারিতে আছে কিছু সংখ্যক ইপিআর বাহিনীর যােদ্ধা। স্থানীয় ছাত্র ও যুবকেরা তাদের কাছ থেকে রাইফেল চালনার ট্রেনিং নিচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র বলতে ইপিআর বাহিনীর সৈন্যদের হাতে কিছু রাইফেল আছে। আর আছে গুটিকয়েক পুরানাে ধরনের মেশিনগান। এই নিয়েই তারা আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত, সুশিক্ষিত পাকসৈন্যদের সাথে লড়াই করবে। এই দুই অসম শক্তি-সংঘর্ষের পরিণতি কি হতে পারে, সেটি কি তারা অনুমান করতে পারে না? পারে বই কি। কিন্তু তার পরিণতি যা-ই হােক না কেন, প্রতিরােধ করতেই হবে। বিনা প্রতিরােধে তারা তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারবে । সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে প্রতিরােধের সংগ্রাম চলছে তারাও তার সঙ্গে সামিল থাকবে।  অবশেষে সেই আশঙ্কা একদিন সত্যসত্যই প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে দেখা দিল। নিছক জনবল নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শােনা গেল পাকসৈন্যদল ট্রাকের পর ট্রাক বােঝাই করে টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে আসছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের দু’ধারে গ্রামগুলি তাদের হামলার ফলে বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত।
পাকসৈন্যরা এই সমস্ত গ্রামের নিরীহ অধিবাসীদের ঘরে ঘরে গিয়ে হানা দিচ্ছে, তাদের গরু-বাছুর কেড়ে নিয়ে এসে নিজেদের ভােজের উৎসব চালাচ্ছে। খাদ্যসশ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে আসছে। ঘরের মেয়েরাও তাদের লুণ্ঠনরত হাত থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না।  গ্রামের মানুষ প্রাণের ভয়ে আর মান-ইজ্জতের ভয়ে যে যেদিকে পারে ছুটে পালাচ্ছে।

এইভাবে মানুষনামধারী, এই হিংস্র পশুগুলি বিভীষিকা ছড়াতে ছড়াতে চলে আসছে। ওরা ওদের রক্তাক্ত থাবা উদ্যত করে ছুটে আসছে টাঙ্গাইলের দিকে। টাঙ্গাইলের মানুষ হুঁশিয়ার। দেশপ্রেমিক সন্তানগণ, শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরােধের জন্য তৈরি হও—সংগ্রাম পরিষদের প্রচার-ভ্যান ঘুরে ঘুরে মাইকযােগে উদ্দীপনাময়ী বাণী ছড়াতে লাগল। আক্রমণকারী পাকসৈন্যবাহিনী প্রথম বাধা পেল নাটিয়াপাড়া গ্রামে। ইপিআর বাহিনীর সৈন্যরা পাঁচটি ট্রেঞ্চ কেটে তার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। পথের দু’ধরে ঝােপঝাড়েরর আড়ালে রাইফেলধারী ছাত্র ও যুবকেরা পজিশন নিয়ে দাড়িয়েছিল। পাকসৈন্যরা এর আভাসটুকুও পায়নি। তারা নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে আসছিল। এখানে যে কোন ভয়ের কারণ আছে তা তারা ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ তাদের চমকে দিয়ে কতকগুলি মেশিনগান ও রাইফেল গর্জে উঠল। বৃষ্টির মতাে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির ঘায়ে অপ্রস্তুত পাকসৈন্যরা ধরাশায়ী হয়ে পড়তে লাগল। নির্জন ও শান্ত পল্লীপথ এক মুহূর্তে রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল।
প্রতিরােধকারী দেশভক্তেরা বিপুল সংখ্যক শত্রুসৈন্যের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই করে চলেছে। বেশ কিছুকাল এই লড়াই চলেছিল। হামলাকারী পাকসৈন্যরা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে কঠিন প্রতিরােধ পেয়ে একটু পেছনে হটে গেল। ইতিমধ্যেই তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে পেছন থেকে আরও অনেক সৈন্য পৌছে গেছে। এবার কামান-মর্টারে সজ্জিত ছাব্বিশটি ট্রাক বােঝাই সৈন্য সামনে এগিয়ে এল। মুক্তিযােদ্ধাদের দিকে লক্ষ্য করে তারা অবিরলধারায় গােলাবর্ষণ করে চলল। তারা ভাবতেও পারেনি যে, মাত্র তেইশ জন ইপিআর-এর যােদ্ধা ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে তাদেরকে প্রতিরােধ করে চলেছে। তাদের সম্বল ছিল মাত্র দুটি হালকা মেশিনগান, আর কিছু রাইফেল। তাই দিয়েই তারা কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। সত্যেন সেন রচিত প্রতিরােধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ আগস্ট ১৯৭১, কলিকাতা থেকে সংকলিত। জায়গাটি আসলে নাটিয়াপাড়া । ভুলক্রমে সাটিয়াচড়া বলে উল্লেখিত হয়েছে।  জীবনপণ করে তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল কিন্তু সেই প্রবল গােলাবষর্ণের মুখে এরা তাদের কতক্ষণ ঠেকিয়ে রাখবে! প্রতিরােধ যখন চুরমার হয়ে ভেঙ্গে গেল, তখন ট্রেঞ্চের এই তেইশ জন যােদ্ধার মধ্যে একুশ জন নিহত হয়েছে। কোথায় ছিল এদের বাড়িঘর কে জানে! কোথায় ছিল এদের বাপ-মা ভাই-বােন স্ত্রী আর ছেলেমেযেরা ! এরা। কোথায় কিভাবে প্রাণ দিল, সেই বীরত্বপূর্ণ কাহিনী কোন দিন এদের কাছে পৌঁছবে কিনা, তাই বা কে জানে!
লড়াই থেমে গেছে। এদের কামানগুলি কিন্তু তখনও গােলাবর্ষণ করেই চলেছে। এবার এদের আক্রমণের লক্ষ্য নাটিয়াপাড়া, গােড়াই আর তার আশপাশের গ্রামগুলি। তাদের রকেটের আগুনে সেইসব গ্রামে ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হতে লাগল। এরপর গােলাবর্ষণ থামিয়ে ওরা ঘরে ঘরে চড়াও হয়ে হত্যালীলা চালিয়ে যেতে লাগল। সামনে যাদের পেল তাদের কাউকে রেহাই দিল না। তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্রামের লােকেরা যে যেদিকে পারে প্রাণ নিয়ে ছুটে পালাল।  নাটিয়াপাড়া গ্রামটি আমার কাছে অপরিচিত নয়। এই গ্রামের আমার সহকর্মী ও বন্ধু। বাকী সাহেবের (কৃষক নেতা খন্দকার আবদুল বাকী) বাড়ি। এই গ্রামে যারা সেদিন পাকসৈন্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে এই প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন বাকী সাহেব তাদের অন্যতম। হামলাকারীরা বাকী সাহেবের বাড়িতে ঢুকে তাঁর আশি বছর বয়সের বৃদ্ধ পিতাকে বন্দুকের এমন আঘাত করল যে, তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। বাড়িতে আর যারা ছিল, এরা তাদের সবাইকে হত্যা করল।
(সূত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!