You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন কলেজিয়েট স্কুল এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র
মিথ্যা নিলজ্জ মিথ্যা পাকসরকার প্রচার করেই চলেছে। তাদের মিথ্যা কথা শুনে বিশ্বের বিবেকবানরা থমকে গেছে। অপপ্রচার করছে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা হচ্ছে বিছিন্নতাবাদী। তারা পূর্ব-পাকিস্তানী জনগণের উপর অত্যাচার করছে। পাকবাহিনী পূর্বপাকিস্তানী জনগণকে রক্ষার জন্য বিছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে অথচ ঘটনা পুরাে উল্টো। মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ গড়েছে হায়নার হাত থেকে স্বদেশীদের বাঁচাতে। বিশ্বব্যাপী প্রচার করছে পূর্ব-পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক। তাই তাে মুক্তিযােদ্ধারা বাস্তব অবস্থা প্রচারে নেমেছে পথে। পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষা। মার্চ একাত্তরে এ পরীক্ষা স্থগিত হয়েছিল। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক দেখানর জন্য খুলে দিয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। ঘােষণা দিয়েছে এসএসসি পরীক্ষার তারিখ। ক’দিন থেকে পাক নিয়ন্ত্রিত রেডিও পরীক্ষার বিষয়ে বিশেষ ঘােষণা প্রচার করছে। অবশ্য কেউ তাদের ঘােষণা মানছে বলে মনে হচ্ছে না। পরীক্ষা কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। এদিকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা বর্জনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।  সকাল ৯.৩০ মিনিট। দু’জন তরুণ এসে নামল টেক্সী থেকে। উদ্দেশ্য, পরীক্ষা কেন্দ্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ। কেন্দ্রের সামনে দুটি ট্রাক লাগালাগি করে দাড়ান দু’ট্রাকে। ভর্তি করে কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রের গেইটে দাঁড়িয়ে প্রায় ২০ জন কম বয়স্ক মিলিশিয়া। কাল পােষাক পরেড়িয়ে রয়েছে। সবার হাতে অস্ত্র। তরুণ দু’জন প্রবেশ করল কেন্দ্রের ভৈতরে। পথেই চেয়ার নিয়ে বসে আছে এক সেনা অফিসার। তার দু’পাশে দু’জন অস্ত্রধারী সেন তাকে পাহারা দিচ্ছে। তিনিই কেন্দ্রের প্রধান রক্ষাকর্তা। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সামান্য। সমসংখ্যক অভিভাবক কেন্দ্রের বিভিন্ন অংশে পায়চারি করছে।
বেরিয়ে এল ওরা। মিলিশিয়া তরুণদের দেখে দুঃখ হল। কচি মুখগুলােকে মিথ্যার। আশ্রয়ে এখানে আনা হয়েছে। গেইটে আসতেই দেখে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। বয়স চল্লিশের কোঠায়। জড়তা তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। দাঁড়িয়ে আছেন মিলিশিয়া তরুণদের পাশে। অপেক্ষায় সম্ভবত টেক্সীর। ডাক দিলেন একটি টেক্সীকে কিন্তু সে থামেনি। ট্রাকের উপর দাড়ান পাকসৈনিকরা মহিলাকে লক্ষ্য করে বিশী অঙ্গভঙ্গী করছে। মহিলা সবই দেখছেন কিন্তু না দেখার ভান করে আছেন। এ ভাবে কেটে গেল কমিনিট । হঠাৎ ট্রাকের উপর থেকে মহিলাকে লক্ষ্য করে ছােড়া হল বিশ্রী এক বক্তব্য, সাথে পাথরের একটা টুকরাে। পাথরটি এসে পড়ল মহিলার বুকে। মিলিশিয়া তরুণরা প্রত্যক্ষ করল সব  প্রতিবাদী হল এবার মহিলা মুখ খুললেন খাটি উর্দুতে কথা বলতে শুরু করলেন। সুন্দর ভাষা প্রয়ােগ করে সাহসের সাথে গালমন্দ করলেন পাকবর্বরদের। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই নির্বাক। মহিলার প্রাঞ্জল উর্দু কথার্বাতা শুনে ট্রাক থেকে নেমে এল দু’জন সৈন্য। মহিলার পরিচয় পেল। এ মহিলার আবাস ফিরােজ শাহ কলােনীতে স্বামী উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। অবাঙালি রমণী বলেই সাহস করে এসেছেন ছেলেকে নিয়ে। কেন্দ্রে এসে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন তাই পথে টেক্সীর অপেক্ষায় পাকসৈন্যরা মনে করেছিল বাঙালি রমনী তাই কিছু রঙ্গলীলা সম্পন্ন করতে চেয়েছিল কিন্তু শেইম সাইড হয়ে গেল। মুক্তিযােদ্ধা দু’তরুণ ফয়েজুর রহমান ও গরীবউল্লাহ চলে এলেন মসজিদ পার হয়ে স্টেশন কলােনীতে সিদ্ধান্ত নিল পাক ট্রাক দুটোর উপর আঘাত হানার ট্রাক দুটোর অবস্থান খুবই ভাল, গ্রেনেড ছােড়ার আওতার মধ্যে। ট্রাকের পেছনে ষ্টেশন কলােনীর দেয়াল। একটু দূরে দেয়ালের পাশে ড্রেনে দু’জন প্রস্রাবের ভান করে বসেছে। কোনমতে। রক্ষিত গ্রেনেড হাতে তুলে নিলেন। আড়াল থেকে খুলে দিলেন পিন।
এগিয়ে এলেন। দেয়ালের কাছে। দু’জন দু’ট্রাক লক্ষ্য করে আস্তে করে ছুড়ে মারলেন গ্রেনেড দু’টি। প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল। রাস্তার মানুষজন ছুটছে। মিলিশিয়া বাহিনী দৌড়াচ্ছে। এসে। প্রবেশ করল কলেজিয়েটে স্কুল মাঠে। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে পরীক্ষা কেন্দ্র প্রায় শূন্য হয়ে গেল। ট্রাকের উপর আহত নিহতরা পড়ে রয়েছে। পীচ ঢালা পথ রক্তাক্ত হয়েছে। মুক্তির দুই সৈনিক সবার অলক্ষ্যে স্টেশন কলােনী স্কুল পেরিয়ে চলে এলেন রিয়াজ উদ্দিন বাজারে। শুনতে পেলেন অনেক কাহিনী। কেউ বলছে মুক্তিযােদ্ধারা কলেজিয়েট স্কুলের সামনে ৫০ জন পাকসৈন্য হত্যা করেছে। কেউ বলছে কলেজিয়েট স্কুল উড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়িয়ে গেছে। এমনি সময় ভেসে এল এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। ৪ টি এ্যাম্বুলেন্স ছুটছে। তাঁরা দুজন চলে এলেন অর্পনা চরণ স্কুল কেন্দ্রের সামনে। সেখানে সামান্য সংখ্যক ছাত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে। বিকেলে ঘটল সুন্দর ঘটনা। প্রথম পত্রের পরীক্ষা শেষ। দু’টো থেকে শুরু হবে ২য় পত্রের পরীক্ষা। সময় হয়ে এল কিন্তু পরীক্ষার্থীদের আগমন ঘটছে না। ঘন্টা বেজে গেল। হল খালি। অর্থাৎ কলেজিয়েট স্কুলের ঘটনা শুনে চট্টগ্রাম শহরের প্রত্যেক হলের পরীক্ষার্থীরা ভীত হল। তাই প্রায় সবাই বিকেলের পরীক্ষায় অংশ নিতে আসেনি। শুধু ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, অনেক কেন্দ্রে শিক্ষকরাও আসেনি।
খুবই সল্প সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।  পাকবাহিনীদের প্রতি এ আক্রমণ ছিল অপ্রত্যাশিত। তারা কখনাে ভাবেনি এ ধরণের আক্রমন হতে পারে। সন্ধ্যায় মুক্তিযােদ্ধারা বসেছে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতে। কারণ বিপ্লবী বেতার থেকে পরীক্ষা বর্জনের ঘােষণা দিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার থেকে সংবাদ এ ঘােষণা দিল মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে চট্টগ্রামে ৭জন ও কুমিল্লা জেলা স্কুল, কেন্দ্রে ৪ জন পাকহানাদার গ্রেনেডের আঘাতে মারা যায়। চট্টগ্রামে আহতের সংখ্যা ১১ জন বিবিসি পাকসরকারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা। স্বাভাবিক নয়। এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র অপারেশনেরপর্বে কলেজিয়েট স্কুল বন্ধের জন্যে। আরাে একবার অপারেশন চালান হয়েছিল পাকসরকার দেশের অবস্থা স্বাভাবিক দেখানর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। স্কুল বন্ধের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা সচেষ্ট হল। ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের নেতৃত্বে কলেজিয়েট স্কুলের বাইরে গ্রেনেড চার্জ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য। ছিল ছাত্র, শিক্ষক যেন স্কুলে না আসে। এ অপারেশনে ছিলেন আমিন, সৈয়দসহ ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের দলের আরাে ক’জন। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে চট্টগ্রামের প্রায় স্কুলে এ অপারেশরে সংবাদ চলে যায়। ফলে ছাত্র শিক্ষকের উপস্থিতি হত নগণ্য। স্কুলের দরজা খুলে রাখা হত কিন্তু ছাত্র, শিক্ষকবিহীন ভাবে চলত স্কুল। (সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!