You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন আমেরিকান এক্সপ্রেস
পাকবাহিনীর আন্তর্জাতিক দোষর আমেরিকা। সভ্যতার দাবীদার আমেরিকার সরকার বর্বর পাকবাহিনীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে ইতিহাসে লজ্জাজনক স্থানে নিজেদের স্থাপিত করেছে। তারা অস্ত্র, অর্থ এবং সমর্থন দিয়ে হয়েছে বাংলার সহজ সরল মানুষকে হত্যার সক্রিয় অংশীদার। আন্তর্জাতিক দরবারে তারা পাকিস্তানের বর্বরতার পক্ষে মুরুব্বীয়ানা করেছে। সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণের মনােবল ভাঙতে চাইছে। অপর পক্ষে মার্কিন জনগণ ও বেশ ক’জন সিনেট সদস্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে। আমেরিকার রাস্তায় জনগণ নেমেছে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তাদের সরকারকে ধিক্কার দিয়ে । সিনেটর কেনেডি এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন আমাদের অসংখ্য শরনার্থীর মাঝে। চট্টগ্রাম শহরে তখন অনেক মুক্তিযােদ্ধার আগমন ঘটেছে। তাদের খাওয়া-পরা ও আনুষাঙ্গিক কাজের জন্য প্রয়ােজন হয়েছে অনেক টাকার এছাড়াও তাদের ক’জন সতীর্থ যােদ্ধা পাকশিবিরে বন্দি। এদের উদ্ধার করতে হবে। পাকবাহিনী তাদের দোষরদের মাধ্যমে ঘুষ খেতে শুরু করেছে। এ সুযােগ মুক্তিযােদ্ধারাও গ্রহণ করে। তাই তাদের প্রচুর টাকার প্রয়ােজন পানওয়ালা পাড়ার সবুজ বাগের মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন কেন্দ্র ইতিমধ্যে অনেকের নিকট পরিচিত হয়ে উঠেছে। তাই মৌলভী সৈয়দ আহমেদ ভাবলেন বিকল্প কেন্দ্র গড়ার তিনি তথ্য পেলেন মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলামের নিকট থেকে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত আমেরিকান ব্যাংক আক্রমণ করে প্রয়ােজনীয় টাকা সংগ্রহ করতে হবে। সভায় বসলেন সবাই। সভায় পৌরহিত্ব করলেন মৌলভী সৈয়দ আহমেদ। সভায় উপস্থিত রয়েছেন কে সি আই, কে সি টু দলনেতাসহ মােহাম্মদ হারেস, জালালউদ্দিন আহমেদসহ মুক্তির সৈনিকরা। অনেক আলােচনা হল । অর্থের প্রয়ােজনীয়তা ও সতীর্থদের মুক্তির জন্য সবাই কৌশলী হলেন।
সিদ্ধান্ত হল আক্রমণ করতে হবে আমেরিকান এক্সপ্রেসকে। কারণ আমেরিকা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বিরােধীতা করছে এবং তারাই পাকহানাদারদের প্রয়ােজনীয় অস্ত্র-টাকা পয়সাসহ আন্তর্জাতিক সমর্থন দিচ্ছে। আমেরিকার ন্যাক্কার জনক ভূমিকায় মুক্তিযােদ্ধারা ভীষণ ভাবে ক্ষুদ্ধ। ইয়াহিয়া, ভুট্টো এ দু’জন মার্কিনীদের পদলেহন করে চলেছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করে দিতে। আর মার্কিনীরাও তাদের দু’জন পাকচামচা পেয়ে আনন্দে নাচতে শুরু করেছে। তাদের বর্বর সমর্থনে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ঘর ছাড়া, লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর সাগরে পাড়ি। দিয়েছে। অসংখ্য মা, বােন নির্বিচারে ইজ্জত দিচ্ছে। পাকহানাদারদের বর্বরতার সচিত্র সংবাদ যখন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলােতে স্থান করে নিয়েছে তখনই মার্কিন সরকার এ সংবাদকে তামাশা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। আর জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বলছে বিপথগামী এক আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে তথাকথিত স্বাধীনতা পন্থীরা। আমেরিকার লজ্জাজনক এ ভমিকায় বাংলার দামাল মক্তিযােদ্ধারা আহত হল এবং সুতীক্ষ্ণ জেদ নিয়ে জ্বলে উঠল। পাকবাহিনীর উপর তাদের গেরিলা আক্রমণ তীব্র ভাবে শানাল। এ সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল অন্য কোন ব্যাংক নয়। সেই আমেরিকান ব্যাংককেই আঘাত হানতে হবে। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অপারেশন। তাই সবাই ঠিক করল বাণিজ্যিক এলাকার কোন সুবিধাজনক স্থান থেকেই সব আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হল হােন্ডা প্যালেসই যথার্থ স্থান। আব্দুল্লাহ আল হারুন প্রতিদিন এখানে আসেন। তারপর চলে যায় রেকির কাজে।
আমেরিকান এক্সপ্রেসের আশেপাশের অবস্থান খুব সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন কখন ব্যাংকের ভিতরে গিয়ে, কখন বাইরে থেকে। ব্যাংকের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের চাল-চলন, আচার-আচরণ গভীর মনােযােগের সাথে জেনে নিলেন। নিরাপত্তা বেষ্টনী কেমন তাও প্রত্যক্ষ করলেন। হােতা প্যালেসের নুরুল ইসলাম তিনি একজন মুক্তিযােদ্ধা তাঁর অফিস মূলত গড়ে উঠেছে মুক্তিযােদ্ধাদের যােগাযােগের কেন্দ্র হিসেবে। পাকহানাদার নিয়ন্ত্রিত আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার কেন্দ্রবিন্দুতে হােন্ডাপ্যালেস। প্রতিদিন শত শত পাকহানাদার এ পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করে। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র গােলাবারুদ প্রায়ই এ অফিসে রাখা হত। বাণিজ্যিক কেন্দ্র বলে কেউ সন্দেহ করত না। উপরে দোতলায় ছিল ছােট্ট একটি কক্ষ। সেখানে মুক্তিযােদ্ধারা সময়ে সময়ে এসে আলাপ আলােচনা করত। অপারেশনের প্রয়ােজনে বসে যুক্তি পরামর্শ করত। আমেরিকান এক্সপ্রেস অপারেশনের পূর্বে একদিন জনাব নুরুল ইসলাম তার অফিস কক্ষে বসে আছেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন একটি জীপ এসে থামল তার অফিসের সামনে। কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরের সব কিছু দেখা গেল। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। মুখ তার শুকিয়ে গেল। কারণ তখনই ভেতরে বসে ক’জন মুক্তিযােদ্ধা বিস্ফোরক তৈরি করছিলেন। বিস্ফোরক ও অস্ত্রশস্ত্র নৌকায় করে নদীর ওপাড়ে পাঠানাে হবে। জনাব নূর মােহাম্মদ মিন্টুকে পাঠানাে হল কর্ণফুলী মার্কেটে কিছু তরিতরকারী ও ভূষি ক্রয় করে আনতে। তারিতরকারী ও ভূষির ভেতরে করে ঠেলা গাড়ি দিয়ে সে জিনিষপত্রগুলাে পাঠানাে হবে নদীর ঘাটে। এমনিতর সময়ে পাকঅফিসার সহ জীপটি থামতেই দ্রুত সংকেত দিয়ে জনাব নুরুল ইসলাম স্বাভাবিক ভঙ্গী নিয়ে অফিসের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। পাকসৈনিকটির কাঁধের স্টার দেখে তিনি তার পদবি বুঝে ফেললেন। লক্ষ্য করলেন ক্যাপ্টেন এ দিক-ও দিক কি যেন খুঁজছে। সাহসের উপর ভর করে তিনি ক্যাপ্টেনকে পরিস্কার ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ পাকঅফিসার বললেন, ‘আপনার হােল্ডিং নং হল ৮০ আর আমি খুঁজছি ৮১ নম্বর হােল্ডিং।
তখন ইসলাম সাহেব বলেন, ‘দুঃখিত আমার হােল্ডিং ৭০। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাইনবাের্ডের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জা পেলেন। পাকঅফিসারটিও বুঝতে পারল ইংরেজীতে অবশ্য ৭০ আগ্রাবাদ বা/এ লেখা রয়েছে। তারা চলে যেতে চাইলে ভদ্রতার বশে তিনি পাকঅফিসারটিকে চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু তিনি সময়ের অভাবের কারণে এলেন না। মৃদু ঘাম বেরিয়ে এল ইসলাম সাহেবের দেহ থেকে। অফিসের পার্টিশানের ভেতরে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অস্ত্র নিয়ে পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য তৈরি হয়েই ছিলেন। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ইতিমধ্যে নৌকমান্ডােদের কিছু অস্ত্র এসে গেল। রাখার জন্য জায়গা খুঁজে পেলেন না। অবশেষে ঠিক হল বেপারী পাড়ায় জনাব ইসলামে নানার বাড়িতে রাখা হবে। কিন্তু সমস্যা নানা ও নানী। ইসলাম সাহেব নানার সাথে আলাপ করলেন। জবাব শুনে সবাই স্তম্ভিত নানা তালেব আলী উত্তর দিলেন, তুই অস্ত্র গােলাবারুদ আর ঘরত লই আইসা। আঁই সামালি রাইখখুম। আঁরা দু’জন বুড়া, বুড়ি আঁরার এন্ড পাঞ্জাবিরা আইসতােন, আইলে আঁরারে মারি ফালইবাে, কি অইবাে? কি অইবাে? আঁরা এনেও মরনের পথে।’ এ কথা শুনে উদীপ্ত হল সূৰ্য্য সৈনিকরা। বাকী অস্ত্রগুলাে হাজীপাড়ায় মুক্তিযােদ্ধা জালাল উদ্দিন আহমেদ, সালাহ উদ্দিন, আলাউদ্দিনের বাড়িতে রাখা হল। এ বাড়ির সবাই মুক্তিযােদ্ধা বিশেষ করে সবার দাদী মরহুমা সকিনা বেগম ছিলেন বিদুষী মহিলা  মুক্তির সূর্য সৈনিকরা ইতিমধ্যে পূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আগস্টের মাঝামাঝি সময়। ঠিক হল সকাল ৯.৩০ মিনিটের মধ্যে সবাই চলে আসবে ব্যাংকের আশেপাশে। বিভিন্ন জনকে আসতে হবে বিভিন্ন গােপন শেল্টার থেকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক হল অপারেশনের দায়িত্বে থাকবেন এনামুল হক দানু। তিনি এক সময় মােনায়েম খানকে উদ্দেশ্য করে সেন্ডেল ছুড়ে মেরেছিলেন।
আবদুল্লাহ আল হারুন, আজিজ, ডাঃ জাফর, অমল মিত্র, শফিউল বশর, ফজলুল হক ও মনি। বাহনের জন্য তারা কোন যান পেলেন তাই ঠিক হল তারা এ অপারেশনে যাবেন। সকাল ঠিক নয়টায় দুটো টেক্সীতে করে দু’দল যােদ্ধা ভিন্ন পথে এলেন আমেরিকান ব্যাংকের সামনে। তাদের সবার নিকট প্রয়ােজনীয় অস্ত্র, গােলাবারুদ রয়েছে সাধারণের মাঝে তারা মিশে গেলেন। আবদুল্লাহ আল হারুন একটি জীপ হাইজ্যাক করে উপস্থিত হলেন ব্যাংকের দোর গােড়ায়। ব্যাংকের টেলিফোন লাইন কৌশলে কেটে দেয়া হল। সকাল তখন ৯.৫৫ মিনিট। সবাই ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালেন। সংকেত এল আর অপেক্ষা নয়। ব্যাংকের প্রধান ফটকে পাহারায় অস্ত্রধারী দারােয়ান। মুক্তিযােদ্ধারা চোখের পলকে তাকে কাবু করে ফেলল। ভিতরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে অস্ত্রের মুখে বসিয়ে রাখা হল। কেউ আঁচ করতে পারেনি ব্যাপার কি। এত তড়িৎ গতিতে কাজ হয়েছে যে কেউ মুখ খুলতে পারেনি। অবকাশ পায়নি কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার। সবাই মনে করেছিল ডাকাত পড়েছে।
ক’সেকেন্ড পরেই সবাই বুঝতে পারল ডাকাত নয়, ওরা মুক্তিযােদ্ধা। ক’জন কর্মচারীর চোখের অবস্থা দেখে মনে হল তারা খুশি হয়েছে। অন্যান্যরা ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। অভয় দেয়া হল। কেউ চিৎকার না করলে কাউকে কিছু করা হবে না। একজন কাউন্টারের ভিতরে প্রবেশ করল। ব্যাংকের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্বন্ধে কেউই অভিজ্ঞ ছিল না। তাই মূল টাকার কেন্দ্রে আঘাত করতে পারেনি। খুঁজে পেলেন ১৭,০০০ টাকা। মাত্র ১১ মিনিটে সব কাজ শেষ হল। অপারেশন শেষ করে তারা বেরিয়ে এলেন নিরাপদে। মানুষজন বাইরে পথ চলছে। কেউ কিছু বুঝার আগেই সব শেষ। মুক্তিযােদ্ধারা আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার প্রাণকেন্দ্রে আঘাত হেনে টেক্সী যােগে চলে গেলেন। আগ্রাবাদ হােন্ডা প্যালেসে তখন পায়চারী করছেন জনাব মৌলভী সৈয়দ। তিনি শুধু ঘড়ি দেখছেন আর পায়চারী করছেন। তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন জনাব নুরুল ইসলাম। এক সময় খবর এল অপারেশন সাকসেস। দু’জন গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন। মুক্তির সেই বীরসৈনিক মৌলভী সৈয়দ আহমেদ ‘জয় বাংলা’ বলে বেরিয়ে এলেন হােন্ডা, প্যালেস থেকে। মিশে গেলেন জনারন্যে। পাকবাহিনীর হৃৎপিন্ডের উপর এ অপারেশন সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। মুক্তিযােদ্ধারা তখন প্রতিদিন অপারেশন করছে দাপটের সাথে। তাদের দাপটের চোটে পাকবাহিনী ও তার দোসরদের হৃদকম্প শুরু হয়েছে। এ অপারেশনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিলেন মােহাম্মদ হারেস, আবদুল মেনাফ ও জালাল উদ্দিন আহমেদ। মুক্তিযােদ্ধারা হাইজ্যাক করা গাড়িটি আগ্রাবাদ সিডিএ কলােনীতে ফেলে রেখে চলে এসেছে। এ টাকা দিয়ে পরবর্তীতে দু’টি টেক্সী কিনেছিলেন কাজের সুবিধার্থে। ( সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!