অপারেশন ইপিআরটিসি বাস ও নিউমার্কেট চত্বর
ভেতাে বাঙালি নেমেছে ইতিহাস সৃষ্টির পথে। বিশ্ব দরবারে মুক্তিযােদ্ধারা আজ আলােচনার শীর্ষে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রণনীতি, রণকৌশল, গেরিলাযুদ্ধ বাঙালি যােদ্ধাদের নিকট প্রশ্নের সম্মুখীন। এ কি সম্ভব? পাকবাহিনীর মতাে নিয়মিত যােদ্ধাদের সাথে বাচ্চা ছেলেদের প্রাণঘাতি যুদ্ধ! বিস্ময়ের ব্যাপার। শুধুমাত্র প্রচন্ড মনােবল নিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে গেরিলাদের হালকা অস্ত্র ও বিস্ফোরকের আক্রমণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার। গেরিলা বিচ্ছুদের আচমকা আক্রমণ জমদূতের মতাে। এতদিন পাকবাহিনী বুঝেছে ভেতাে বাঙালি কতাে প্রচন্ড মনােবলের অধিকারী। বিশ্ব বিবেক থমকে আছে। হেমন্তের সকাল। সূর্যের সােনালী আভা ছড়িয়ে রয়েছে। নিউমার্কেট চত্বর এখনও জমে ওঠেনি। মানুষ জন আছে সামান্য। বাসের প্রতীক্ষায় ক’জন দাঁড়িয়ে। একটি ফিয়েট গাড়ি এসে থামল ইপিআরটিসি বাস ষ্ট্যান্ডের সামনে। যাত্রীরা দাঁড়িয়ে রইল। সকাল ৭টা। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখল না সঠিক সময়ে আসছে না। সময়ের হেরফের হয়েছে। অপেক্ষা করার সময় নেই। গাড়ি না পেয়ে তারা ফিরে চলেছেন। লাভ লেনের মাথায় আসতেই দেখেন সেই বাসটি পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নিচ্ছে। পথেই তারা সিদ্ধান্ত নিল । গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এল আবার নিউমার্কেট চত্বরে। বর্তমান জলসা সিনেমা হলের বিপরীতে। পাঁচজন ওরা ড্রাইভারসহ। ড্রাইভার ফিরােজ তাদের নামিয়ে দিয়ে চলে এলেন পােষ্ট অফিসের সামনে (বর্তমান প্রধান ডাকঘর নিউ মার্কেটের পেছনে) ইতিমধ্যে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আহমেদ উল্লাহ জাকারিয়া, আহমেদ মিনার, প্রবীর রাস্তার পাশে দাড়িয়ে যাত্রী বেশে। তবে অবস্থান একটু দূরে। আটাশে অক্টোবর, একাত্তর। সকাল ৭.২০ মিনিট। ইপিআরটিসির বাস এল।
থামল নিউমার্কেট চত্বরে। যাত্রী তেমন নেই। পাকবাহিনী দেশের অবস্থা স্বাভাবিক দেখানর জন্য পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থাকে চালু করেছে। গাড়ি নিউ মার্কেট থামতেই মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও আহমেদ যাত্রীর বেশে বাসে উঠে বসলেন। প্রবীর ও জাকারিয়া একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে দাড়ালেন। জিন্নার সাথে চোখের মিলন হল। ইঙ্গিত পেলেন। একজন চলে গেলেন বাসের সামনে। বাসে কন্ট্রাক্টর যাত্রীদের নিকট থেকে ভাড়া তুলছিলেন। এখানে প্রতিদিনই বাস কতক্ষণের জন্য অপেক্ষা করে। নিয়ম অনুযায়ী আজও করছে। ড্রাইভার পান, সিগারেট খেতে নেমে গেলেন। দু’একজন করে যাত্রী আসছে, বসছে সিটে। কন্ট্রাক্টরের উদ্দেশ্য বাসে মানুষ ভর্তি করা। ৭.৩০ মিনিট। বাস ড্রাইভার উঠলেন গাড়িতে। বসলেন ষ্টিয়ারিং ধরে । কন্ট্রাক্টরের সাথে কথা বলে নিলেন । চোখের পলকে মােহাম্মদ আলী জিনাহ ষ্টেনগান বের করে ধরলেন। গাড়ির বাইরেও দু’জন ষ্টেনগান ধরে দাঁড়িয়ে গেল। আহমেদ উল্লাহর ষ্টেন যাত্রীদের প্রতি। ড্রাইভার থেকে চাবি নিয়ে নেয়া হল। যাত্রীদের অভয় দেয় হল। তবে কেউ চিৎকার করলে হত্যা করা হবে। হুমকি এল গাড়ির সামনের ষ্টেনটি ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে তাক করে রেখেছে। প্রবীর ও জাকারিয়া ষ্টেন নিয়ে বাইরে দাঁড়ান। বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝতে পারছেন কি হচ্ছে এখানে। যাত্রীদের লাইন করে গাড়ি থেকে নামানাে হল। সারিবদ্ধভাবে সবাই দাঁড়িয়ে। তাদেরকে ষ্টেনের মুখে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কন্টাক্টরকে নামানাে হয়নি । ড্রাইভার ও কন্ট্রাক্টর গাড়ির মধ্যেই রয়েছে।
মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও আহমেদ উল্লাহ গাড়ির ভেতরে প্রয়ােজনীয় কাজ সারছেন। গাড়ির ভেরতে পেট্রোল ছিটানাে হল। প্রচুর পােট্রাল ছিটিয়ে গাড়ির অভ্যন্তর ভাগকে ভিজিয়ে দিলেন। ড্রাইভার ও কন্ট্রাকটর সব বসে বসে দেখলেন। ভয়ে তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে। তাদেরকে অভয় দেয়া হল। তাদের কোন ক্ষতি হবে না। সময় হতেই আহমেদ উল্লাহ জিন্নাহকে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বললেন। অপারেশরে উত্তেজনায় জিন্নাহ মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু আহমেদ উল্লাহ কিছুতেই আগুন দিতে পারছেন না কারণ গাড়ি থেকে না নামলে আগুন দেবেন কি ভাবে? চারজন যােদ্ধার কাছে রয়েছে ৪টি গ্রেণেড়, ৪টি ষ্টেন, ৪টি শােক বােম, ৪টি লােডেড ম্যাগাজিন, ৪টি ফসফরাস বােম। অবশেষে দলনেতা জিন্নাহ তীব্র হুংকারে ফসফরাস বােম দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। ড্রাইভার ও কন্ট্রাকটরকে বের করেও আনা হল। কিন্তু আগুনের তীব্র শিখায় জিন্নাহর দুটি পা পুড়ে গেল। তিনি মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে আগুন নেভালেন। এতক্ষণে যাত্রীরা সবাই ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। কোর্ট বিল্ডিং-এর উপর থেকে পাকবাহিনী আগুন দেখে গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। গাড়ি জ্বলছে ভীষণ ভাবে। আশপাশের সবাই পালাচ্ছে। গুলির মধ্যেই চারজন মুক্তির সৈনিক দৌড়ে চলে এলেন পােষ্ট অফিসের সামনে যেখানে ফিরোজ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায়। আশেপাশের সবাই বুঝে গেছেন মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশন। তিন দিক থেকে পাকবাহিনী আসছে নিউ মার্কেটের দিকে। মহাবিপদের মুখে মুক্তিযোেদ্ধারা। অয়ারলেসের মাধ্যমে সর্বত্রই খবর হয়ে গেল। ড্রাইভার ফিরােজ গাড়িতে স্টার্ট নিতেই দেখে স্টার্ট হচ্ছে না। অবশেষে চারজন ঠেলে গাড়ি দাড় করাল। গাড়ি কোতয়ালীর মােড়ে আসতেই দেখে অনেক পুলিশ প্রস্তুতি নিচ্ছে। বুঝতে তাদের অসুবিধে হয়নি সবাই নিউমার্কেটের সামনে যাবে। দ্রুত গতিতে গাড়িটি দেখেই সিগনাল দিল দাঁড়াতে। কোন উপায় নেই, দাড়ান মানেই মৃত্যু।
গাড়ির গতি বাড়ল। দলনেতা জিন্নাহ ঘােষণা দিলেন কোন মৃত্যু নয়। ওরা সবাই বাঙালি পুলিশ। কৌশলে আঘাত হানতে হবে। গাড়ি কোতােয়ালীর মাজার বরাবর আসতেই চারজন স্টেন থেকে ব্রাশ ফায়ার করলেন। পুলিশের ঝাঁকের মধ্যে নয়, উপরের দিকে লক্ষ্য করে। পুলিশের জল-আচমকা আক্রমণে সরে গেল ড্রাইভার ফিরােজ দক্ষতার সাথে গাড়ি চুকিয়ে দিলেন:ডেল রােডের ভেতরে। মুক্তিযােদ্ধারা যখন ব্রাশ ফায়ার করলেন স্টেট ব্যাংকের (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) সামনে থেকে পাল্টা ব্রাশ ফায়ার হল। ততােক্ষণে মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়িটি চলেছে বান্ডেল রােডের অলিগলিতে। কেউ এবার তাদেরকে সন্দেহ করতে পারছে না। সবাই অস্ত্র লুকিয়ে ফেলেছে। শান্ত যুবকের বেশে গাড়িতে বসে আছে সবাই। তবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে চলেছেন। এ অপারেশনের বর্ণনা দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ বলেন, তিনি তখন পুলিশ বিভাগে চাকুরীরত ছিলেন। পােষ্টিং ছিল কোতােয়ালীতে। তাকে নােয়াখালি থেকে জোর করে আনা হয়েছে। বাঙালি বলে উন্নত অস্ত্র দিত না। সেদিন তিনি মেছ থেকে দেখেন একজন হাবিলদার চিৎকার দিচ্ছেন। উর্দুতে বলছেন মুক্তিরা আক্রমণ করেছে, সবাই হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হও। ততক্ষণে একটি গাড়ি থেকে ব্রাশ ফায়ার করতে করতে তারা চলে গেছে। ষ্টেট ব্যাংকের সামনে থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্রাশ ফায়ারের জবাব দিতে পাকসৈনিকরা পাল্টা ব্রাশ ফায়ার করেছে। এতে কোতােয়ালীতে অবস্থানরত পুলিশ ও পাকবাহিনী মনে করেছিল সেদিক থেকেও মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেছে। এতে কোতােয়ালীর সবাই ভীষণ ভয় পায়।
কোর্ট বিল্ডিং থেকে পাকআর্মি তুর্তি একটি লরি নিউমার্কেট যাওয়ার পথে উল্টে যায়। এতে ৫ জন পাকসৈনিক গুরুতর আহত হয়। তিন জনের হাত ও পা ভেঙ্গে যায়। দ্রুত মােড় কাটতে গিয়ে পাকসৈন্য ভর্তি এ গাড়ি উল্টেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের ফিয়েট গাড়িটি বান্ডেল রােডের এ পথ- ও পথ দিয়ে চলে আসে খাতুনগঞ্জে। সেখানে তারা নেমে চলে এল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের ভিপি ইব্রাহীমের বাড়িতে। জনাব ইব্রাহীম অল্প কতক্ষণের মধ্যেই তাদের সাথে বহন করা অস্ত্রগুলাে সংরক্ষণ করেন। এতক্ষণ পর জিন্নাহ বুঝতে পারলেন তিনি গুরুতর আহত হয়েছেন। আগুনে তার দুটো পা ঝলসে গেহেঁ। ডাক্তার ডাকা হল গােপনে। চিকিৎসা। চলল বেশ কিছুদিন। মুক্তিযােদ্ধাদের এ অপারেশন ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করেছে। শহরবাসী আনন্দিত হয়েছে। পাকবাহিনীর চোখের ডগায় এ অপারেশন পাকবাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে এ অপারেশনের কথা প্রচার করা হয়েছে। বিশেষ করে ‘চরম পত্রে’ সুন্দর করে বলেছে। শহরের অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণ ভরে আনন্দ করেছে। এ আনন্দের রেশ ধরে আরাে বেশ কটি ছােট বড় অপারেশন সংগঠিত হয়েছে। এ অপারেশনের পর ডালিম হােটেলের অত্যাচার ক’দিনের জন্য দমেছিল। তারা তাদের নিরাপত্তার জন্য পাকসৈন্য পাহারায় বসিয়েছিল। পরে অবশ্য সেই ডালিম হােটেলে অত্যাচার বেড়ে গেছে তীব্র গতিতে । নিউমার্কেট অপারেশন সম্পন্ন হয়েছিল চকবাজার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে এসে। এ অপারেশনের পর প্রায় একসপ্তাহ নিউমর্কেটের আশেপাশের দোকান বন্ধ ছিল। গাড়ি চলেছে কম। ইপিআরটিসির বাসে মানুষ উঠত না ভয়ে। বাস তারা পাকসৈন্য বসিয়ে চালিয়েছে, তবে যাত্রী পায়নি। ( সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত