বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৮ই নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৪, ২রা অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
ইসরাইলের রণসজ্জা
প্যালেস্টাইনী জনগণের বিজয় যাত্রায় মুখে ইসরাইল আবার মরিয়া হয়ে উঠছে। গোলান মালভূমি এলাকায় অস্বাভাবিক সামরিক সমাবেশ এবং ইসরাইলী নেতৃবৃন্দের মনোভাব থেকে খুব শীঘ্রই মধ্যপ্রাচ্যে আর একটি যুদ্ধের আশঙ্কা কূটনৈতিক মহলে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পি.এল.ও প্রধান ইয়াসির আরাফাত, মিশরের রাষ্ট্রপ্রধান আনোয়ার সাদাত এমনকি পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলও বিগত দিনগুলোতে বার বার মধ্যপ্রাচ্য সংঘর্ষের ব্যাপারে আগাম আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন। ইসরাইলের সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম এশিয়ায় আর একটি যুদ্ধ এড়ানোর জন্য জরুরী আলোচনা শুরু করেছে বলে যে খবর বেরিয়েছে তা সেই আশঙ্কাকেই দৃঢ়তর করে তুলছে। মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীগুলোতে ইতিমধ্যেই নাকি জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দিক থেকে প্যালেস্টাইনীদের অব্যাহত বিজয় এবং অক্টোবর যুদ্ধের পর আরব রাষ্ট্রসমূহের স্বপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে নয়া ভারসাম্য ইসরাইল এবং তার মদদদাতার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করে তুলেছিল। তৈল সম্পদের উপর আরব রাষ্ট্রসমূহের কড়া নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলের স্বপক্ষ শক্তি পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রসমূহের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজেই আরব দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী প্রণয়ন এবং অব্যাহতভাবে তৈলাস্ত্র প্রয়োগের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। মার্কিন পত্র-পত্রিকায় আরবদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়। এমতাবস্থায় ইসরাইল যদি সত্যি সত্যিই সিরিয়া অথবা লেবানন আক্রমণ করে বসে তবে তা করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, উস্কানি এবং সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসের উপর নির্ভর করেই।
ক’দিন আগে রাবাতে অনুষ্ঠিত আরব শীর্ষ সম্মেলনে পি.এল.ও-কে প্যালেস্টাইনী জনগণের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতিদান, জাতিসংঘে পি.এল.ও প্রতিনিধিদলের নেতা ইয়াসির আরাফাতের ভাষণ সর্বশেষে বিশটি আরব দেশ কর্তৃক স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব সমর্থন ইসরাইলী সমরনায়কদের বেসামাল করে তুলে থাকবে। শুধু আরব রাষ্ট্রসমূহই নয় প্যালেস্টাইনী জনগণের পেছনে রয়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা আরো বহু দেশ এবং বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষের সমর্থন। এমনকি ইসরাইলী রাজনীতিকদেরও একটা অংশ সরাসরিই তাদের আগ্রাসনী সম্প্রসারণবাদী নীতির সমালোচনা করছেন। মন্ত্রীসভার মধ্যেও রয়েছে মতানৈক্য। এমতাবস্থায় দেশে-বিদেশে জনমতকে বিভ্রান্ত এবং হুমকি দিয়ে আরবদের বশ করার নীতিতে উৎসাহী হয়ে যদি জেরুজালেমের যুদ্ধবাজরা মধ্যপ্রাচ্যে আর একটি যুদ্ধের দাবাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে তবে বিস্মিত হবার কিছু থাকবেনা। আরবরা আগের চাইতে অনেক বেশী শক্তিশালী এবং সংঘবদ্ধ। সামরিক এবং রাজনৈতিক সমর্থন তাদের আরো বেড়েছে। গত যুদ্ধের পর বেড়েছে তাদের মনোবল। এ সব কিছু হিসেবে না এনে যদি পঞ্চমবারের মতো ইসরাইল আরব রাষ্ট্রসমূহ আক্রমণ করে বসে তবে তা পরিণতিতে ভয়াবহ এবং ব্যাপকতর যুদ্ধকেই শুধু ডেকে আনবেনা বরং তা সম্প্রসারণবাদী সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক স্বার্থের ধ্বংস্তূপের উপর গড়ে তুলবে এক নতুন দেশ : প্যালেস্টাইন।
ভয়াবহ লঞ্চ ডাকাতি
শুক্রবার রাতে মেঘনাবক্ষে ঢাকা থেকে বাগেরহাটগামী লঞ্চ ‘সাঁতারুতে’ এক ভয়াবহ ডাকাতি হয়। প্রায় চারশ’ যাত্রী নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে লঞ্চটি বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে মুন্সীগঞ্জ ত্যাগ করার পর পরই প্রায় ২০/২৫ জন জলদস্যু আকস্মিকভাবে লঞ্চের পাহারারত ৬ জন আনসারের উপর হামলা চালায় এবং তাদের কাছ থেকে ৬টি রাইফেল ও যাবতীয় গুলী ছিনিয়ে নেয়। ডাকাতরা আনসার কম্যান্ডারকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়, পাহারারত একজন আনসার নিহত ও চারজন মারাত্মকভাবে আহত হন। যাত্রীদেরও তারা মারধর করে এবং প্রায় ৫ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল লুন্ঠন করে চাঁদপুরের কাছে চর সুরেশ্বরে লঞ্চটিকে জোরপূর্বক ভিড়িয়ে ডাকাতরা নেমে যায়।
প্রতিবেদনটি মর্মান্তিক এবং লজ্জাজনক বটে। মর্মান্তিক এইজন্য যে, এই লঞ্চ ডাকাতিতে দু’টি অমূল্য জীবন নষ্ট হয়েছে, অসহায় যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল খোয়া গেছে ও কিছু যাত্রী সহ চারজন আনসার মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। লজ্জাজনক এই জন্য যে, একটি লঞ্চে প্রায় চারশ’ যাত্রী নেওয়া হয়েছে যা বেআইনী এবং অপরাধমূলক কাজ এবং এত বড় ডাকাতি করতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে—অতটা সময়ের মধ্যে জল পুলিশের পাত্তা পাওয়া যায়নি কিংবা নেওয়া যায়নি কোনো নিরাপত্তামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা। প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, আমাদের দেশে স্থল পথের চেয়ে জল পথেই সাধারণ মানুষ বেশী যাতায়াত করে থাকে। নৌকা ও লঞ্চ পরিবহনই তার মধ্যে প্রধান বাহন তাদের। এক্ষেত্রে অহরহ যদি লঞ্চ ডাকাতি বা লঞ্চ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েই চলে তাহলে ঐ সাধারণ নিরীহ মানুষগুলো জান ও মালের নিরাপত্তা কোথায়? অথচ ঘটনা এমনই যে জলপথে তাদের যাওয়া আসা করতেই হবে তার আর কোনো বিকল্প নেই।
একেতো জল পরিবহনযোগ্য লঞ্চের পরিমাণ স্বাধীনতার আগের তুলনায় এখন অনেক কমে গেছে। আগে প্রায় চার হাজার যাত্রীবাহী লঞ্চ নদীপথে চলাচল করতো। অথচ সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী এখন সারাদেশে মাত্র ছয় বা সাত শত যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে। তবে সার্ভে রিপোর্ট ছাড়াই প্রায় দু’হাজার লঞ্চ এখন দেশের নদীপথে চলছে বলে অভিযোগও রয়েছে। সবটা মিলে এই যে একটা জগাখিচুরী অবস্থা এর জন্য দায়ী কে বা কারা? উত্তরটা তাদেরই দিতে হবে।
এ কথা না বলে উপায় নেই যে, লঞ্চ ডাকাতি বা লঞ্চ দুর্ঘটনার মূলে যে কারণই থাক জল পুলিশের স্বল্পতা এবং সতর্কতামূলক তৎপরতার অভাব তার মধ্যে অগ্রগণ্য। কারণ স্থল পথ পরিবহনের যেমন কতকগুলো নিয়মকানুন আছে, জলপথ পরিবহনেরও তেমনি কিছু নিয়মকানুন থাকা অবশ্য বাঞ্ছনীয়। সেক্ষেত্রে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া হচ্ছে কি না, লঞ্চটি ভাঙ্গাচোরা কিনা বা আদৌ পরিবহনযোগ্য কিনা ইত্যাদি চেক করা জলপুলিশেরই কাজ। লঞ্চের যাত্রীদেরও তারা প্রয়োজনবোধে চেক করবেন। এবং লঞ্চগুলোর সঙ্গে জলপুলিশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও হতে হবে কার্যকরী ও দ্রুতগামী। তাহলে লঞ্চ ডাকাতির ক্ষেত্রে জলপুলিশকে খবর দেওয়া এবং দ্রুত তাদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অত নির্বিঘ্নে লঞ্চ ডাকাতি করা তাহলে সম্ভব হবে না।
অপরপক্ষে জল পুলিশের পর্যাপ্ততা শুধু নয় তাদের সঙ্গে দ্রুতগামী জলযানও থাকতে হবে। যেন সকল প্রকার আকস্মিক দুর্ঘটনায় পতিত লঞ্চগুলো জল পুলিশের সাহায্য ও সহযোগিতা পেতে পারে। আবার বলতে হয় জল পরিবহন যখন এদেশে উঠিয়ে দেয়া সম্ভব নয় তখন যাত্রী সাধারণের নিরাপত্তার ভার তো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের নিতেই হবে। আর সার্ভে রিপোর্ট ছাড়া যে সব লঞ্চ চলাচল করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায় সে ব্যাপারে গভীর তদন্ত করাও সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।
এ কথা সত্য যে, আকস্মিক দুর্ঘটনার তবু একটা শেষ সান্ত্বনা থাকে, কিন্তু মানুষের সৃষ্ট অপকর্ম ও দুষ্কর্মের কোনো দোহাই সহ্য করা পর্যন্ত যায় না। জলপরিবহনের ক্ষেত্রে সকল প্রকার গাফিলতি ও ঔদাসীন্য ঝেড়ে ফেলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবার বাধ্যতামূলকভাবে জলপরিবহনে আরোহণকারী যাত্রীসাধারণের জান ও মালের নিরাপত্তা বিধানের পবিত্র কাজে চিন্তার বিন্যাস রাখুন—এই আমরা চাই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক