অপারেশন আইস ফ্যাক্টরী রােড
আমাদের বাংলাদেশ সবুজাভ সৌন্দর্যের এক প্রাণবন্ত প্রকাশ। সুদীর্ঘ সংগ্রামের বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য নিয়ে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে আর দু’লক্ষ মা, বােনের সতীত্ব আমাদের পতাকার দৃপ্ত অহংকার। যে সব মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি। আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা সেই সব সাহসী সন্তানরা আমাদের অবহেলা-অযত্নে আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে হয়ে যাচ্ছে অচেনা অতিথি। আমাদের মুক্তির জন্য, আমাদের স্বাধীনতার জন্য, আমাদের জাতি সত্ত্বার মর্যাদার জন্য যারা স্বাধীনতার যুপকাষ্ঠে নিজেদের জীবনকে বলি দিয়ে আত্মােৎসর্গের ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন এবং যারা মৃক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতিকে বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন, জাতির সে সব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য এ প্রয়াস। সম্মানিত পাঠক, তথ্যগত ত্রুটি থাকা বিচিত্র নয়—ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এছাড়াও এ অপারেশনটি বিছিন্ন একটি ঘটনা। কারণ মূল অপারেশন ব্যর্থ হওয়ার ফলে তাদের উচিত ছিল পরবর্তী নির্দেশের। তা না করে কমান্ডের নির্দেশ ছাড়া অপারেশন করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে রফিককে। আহত হতে হয়েছে অনেককে। লােকবল, অস্ত্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও শহীদ রফিককে স্মরণীয় করে রাখতে চাই। ছােট্ট ফিয়েট গাড়ি। চলছে দ্রুত বেগে এঁকেবেঁকে শহরের সর্পিল পথ দিয়ে। স্টিয়ারিং সিটে এক তরুণ। বয়স কত হবে ? বিশ কি বাইশ। শক্ত সমর্থ গঠন। অভিজ্ঞ হাতে ধরেছে স্টিয়ারিং। গাড়িতে যাত্রী সেসহ মােট পাঁচজন। সবাই সমবয়সী। দেহের প্রতি অঙ্গে যৌবনের উষ্ণতা। বসে আছেন গাড়িতে একান্ত সুবােধ বালকের মতাে। পােশাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে আয়েশী যুবক। দামী পােষাকের মানানসই সেন্টের ব্যবহার চমৎকার। গাড়ি চলছে আনগতিতে। সকলের দৃষ্টি বাইরে।
উষ্ণতার ছোঁয়া তাদের চোখে-মুখে। ঝিরঝিরে বাতাস। ডিউটিরত একজন খানসেনা এগিয়ে এল। যুবকদের মুখমণ্ডলে কঠিনতার ছাপ ফুটে উঠল। দ্রুত মুছে ফেলল সেই কঠিনতার ছাপ— স্বাভাবিক হল। সৈনিকটি জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে ভিতরে দেখে নিল। যুবকদের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। হাত তুলে চলে যেতে বলল। হাফ ছেড়ে বাঁচল সবাই। গাড়ি সােজা চলে এল স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক)-এর সামনে। সকাল তখন দশটা। গাড়ি দু’বার ব্যাংকের সামনের পথ দিয়ে এল-গেল। কোন সংকেত যুবকরা পেল না। সকলে চিন্তিত। এমন তাে হওয়ার কথা নয়! অবশেষে সবাই বুঝতে পারল সংগৃহীত তথ্য ও সময়ের হেরফেরে অপারেশন ভন্ডুল হয়েছে। সেদিন ছিল ১লা নভেম্বর, একাত্তর। শীতের সকাল। সকাল হতেই কমান্ডের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এগুলাে পাচজন তরুণ। মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের ধারা পুরাে দেশে জোরদার হয়েছে। তাই পাকসরকার সীমান্তে পাহারা জোরদার করেছে। ওপাড় থেকে সব ধরনের সরবরাহ কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চট্টগ্রাম শহরের কয়েকশ মুক্তিযােদ্ধা দারুণ অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রয়ােজন প্রচুর টাকা। সে অনুপাতে টাকা পয়সা সংগ্রহ করা যাচ্ছিল না। অবশেষে হাই কমান্ডের সিদ্ধান্ত এল। সরকারী তহবিলের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। গােয়েন্দা মারফত খবর এল নভেম্বর একাত্তর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক) চট্টগ্রাম শাখা হতে কাষ্টম হাউজে ষ্টাফদের বেতনের অনেক টাকা একটি মাইক্রোবাসে করে কাষ্টম হাউজে নিয়ে যাবে। সেই উদ্দেশ্যেই তরুণ পাঁচ মুক্তিযােদ্ধা ছােট্ট ফিয়েট গাড়িতে করে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের সামনে এসেছিলেন। কিন্তু তথ্যগত ত্রুটি ও সময়ের হেরফেরের কারণে অপারেশনটি হয়নি। এতে তরুণ সৈনিকরা হতাশ হয়নি তবে বিক্ষুব্ধ হল । গাড়িতে বসেই সিদ্ধান্ত নিল যে কোন একটি অপারেশন না করে তারা শেল্টারে ফিরবে না।
মুক্তিযােদ্ধা রফিক আহম্মদ, শফিউল বশর, অমল মিত্র, ফজলুল হক ও স্টিয়ারিং সিটে বসা ভােলানাথের নেতৃত্বে গঠিত স্কোয়াডটির নিকট ছিল ২টি গ্রেনেড, ২টি সাব মেশিনগান, ৪টি রিভালবারসহ আরাে কিছু প্রয়ােজনীয় গােলাবারুদ। তারা আন্দরকিল্লাস্থ জুবিলি রােড ঘুরে এল নিউমার্কেটের সামনে—খুঁজছে শিকার। এগিয়ে এল সিটি কলেজের দিকে। একটু এগুতেই দেখে সিটি কলেজের মােড়ে আইডিয়াল বুক স্টল। সেখানে দাঁড়িয়ে উর্দু পত্রিকা উল্টাচ্ছে একজন খানসেনা অফিসার। কোমরে ঝুলছে একটি রিভলবার। চেহারা দেখেই মুক্তি সৈনিকরা তাকে চিনে ফেলল । অসংখ্য মা-বােনের ইজ্জত হরণকারী কুকুর এরা। এই বর্বরদের বিকৃত রসনা তৃপ্তির জন্য সার্কিট হাউজে গড়ে উঠেছিল একটি কক্ষ। প্রতিদিন পাকসেনারা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে যুবতী মা-বােনদের ধরে নিয়ে এসে তার বিকৃত যৌন ক্ষুধা নিবারনে নিয়ােজিত থাকত। এছাড়াও সেই বর্বররা সাধারণ মানুষদের সন্দেহ হলে ধরে নিয়ে আসত এবং সার্কিট হাউজে অমানুষিক অত্যাচার করত। তাদের হাতে মরেছে অসংখ্য মানুষ। বর্বর এ হানাদারকে দেখা মাত্রই মুক্তি যােদ্ধাদের মাঝে প্রতিশােধের স্পৃহা জেগে উঠত। তড়িৎ সিদ্ধান্ত, নিকটতম দূরত্ব থেকে তাকে ঘায়েল করে ছিনিয়ে নিতে হবে রিভালবারটি। গাড়ি এগিয়ে এল কালীবাড়ি পর্যন্ত। ঘুরে এল অপারেশন টার্গেটের পঞ্চাশ গজ দূরে। গাড়ি রেখে রফিক আহমদ ও শফিউল বশর বুক ষ্টলের দিকে এগিয়ে যায়। নিকট দূরত্ব থেকে রফিক সেনা অফিসারটির দিকে গুলি ছােড়েন। কুখ্যাত পাকসেনাটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শফিউল বশর দ্রুততার সাথে রিভালবারটি ছিনিয়ে নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই ভীত। রাস্তার পূর্ব কোণে দাড়ানাে ছিল ৩/৪ জন খানসেনাসহ একটি আর্মি জীপ। তারা ফায়ারিং শুরু করল। দু’পক্ষের গােলাগুলিতে মারা পড়ল একজন পুলিশ সার্জন। শফিউল বশরের ডান পায়ে বিদ্ধ হল গুলি। রফিক ও শফিউল বশর দ্রুত উঠল গাড়িতে। আইস ফ্যাকটরী ধরে চলছে গাড়ি। ভােলানাথ সাহসিকতার সাথে চালাচ্ছে। পাকসেনারাও তাদের অনুসরণ করছে গুলিবর্ষণ করতে করতে।
পাকসেনাদের সাথে যুক্ত হল নৌবাহিনীর আরাে একটি জীপ। অসম সাহসী মুক্তিযােদ্ধারাও পাল্টা শত্রু সেনাদের প্রতি গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যান। পাকসেনাদের অস্ত্রবল অনেক। হঠাৎ গাড়ি চালক ভােলানাথ পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আহত ভােলানাথ কৌশলে লাফ দিয়ে গলিতে ঢুকে পড়েন। ফজলুল হক সাব মেশিনগান হাতে তুলে নিয়ে প্রবল বর্ষণে পাকসেনাদের প্রতি গুলি ছুড়তে শুরু করেন। রফিক আহমদ, অমল মিত্র ও গুলিবিদ্ধ শফিউল বশর ফজলুল হকের মেশিনগানের কাভারিং-এ গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। অমল মিত্র পাশ্ববর্তী বড় ড্রেনে নেমে পড়েন। শফিউল বশর আবার পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। ফজলুল হকের ম্যাগজিন শূন্য হয়ে পড়ে। টের পেয়ে মারাত্মক আহত শফিউল বশর তার হাতের সাব মেশিনগান দিয়ে শক্রর উদ্দেশ্যে গুলি চালাতে থাকেন যাতে ফজলুল হক নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে রফিক আহমদ শত্রুর বুলেটের আঘাতে শহীদ হন। আহত শফিউল বশর শত্রু সৈন্য দ্বারা ধৃত হন। শহরের অনেক অলিগলি পেরিয়ে আহত ভােলানাথ পৌছে পানওয়ালা পাড়ায়। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল। মুক্তিযােদ্ধা নেতৃবৃন্দকে ঘটনার বিবরণ দিল। তাকে নিয়ে আসা হল আগ্রাবাদ ছােট পুলস্থ মুক্তিযােদ্ধা নূর মােহাম্মদ মিন্টুর বাড়িতে। স্থানীয় ডাঃ পি সি সরকারকে দিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। ভােলানাথের পিঠের বুলেট বের করার মতাে প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। পরে একান্ত বাধ্য হয়ে ডাঃ সরকার একটি সাধারণ ব্লেড দিয়ে অপারেশন করলেন কিন্তু তারপরও গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। তবে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। ভােলানাথ আজ পিঠে বহন করে চলেছেন কালের সাক্ষী বুলেটটি। এটি তার পিঠে কাত হয়ে রয়েছে।
এ অপারেশনের নেপথ্যে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ, ইঞ্জিনিয়ার আফসার উদ্দিন, আবু সাঈদ সরদার, ডাঃ মাহফুজ, মােঃ হারিস, জালাল উদ্দিন, ডাঃ জাফর, আব্দুল্লাহ আল হারুন, ফকির জামাল, মুকুল দাশ, দোস্ত মােহাম্মদসহ আরাে অনেকে। স্বাধীনতার সেই শুভদিন ১৬ই ডিসেম্বর মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগ থেকে শফিউল বশরকে উদ্ধার করা হয়। শহীদ রফিক সময়ের সাহসী সন্তান। বুকের রক্তের বিনিময়ে দেশ করেছে স্বাধীন। আমরা তাকে ভুলতে বসেছি। আসুন, তাঁকে স্মরণীয় করে রাখি। রফিক যেখানে শহীদ হয়েছেন সেই আইস ফ্যাক্টরী রােডের নাম তার নামকরণে হওয়া উচিত নয় কী? রফিকের মৃতদেহ দীর্ঘক্ষণ ধরে পড়েছিল। এ প্রসঙ্গে এডভােকেট শামসুল ইসলাম বলেন, শহীদ রফিকের মৃতদেহ পূর্ব পশ্চিমে লম্বা হয়ে রাস্তায় উপর পড়েছিল। তিনি তখন ছিলেন কোর্টে। এসে দেখেছেন রফিকের মৃতদেহ। এডভােকেট শামসুল ইসলাম তারপরই পাকবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে ডালিম হােটেলের নির্যাতন কক্ষে চলে যান। মৃত্যুর রূপ দেখেছেন, অত্যাচার কাকে বলে তাও দেখেছেন। তার সাথে ছিল আরও একজন তরুণ ফুটবল মুক্তিযােদ্ধা সালাহউদ্দিন (হাজী পাড়া জালাল কমিশনার ও আলাউদ্দিনের ছােট ভাই)। (সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত