You dont have javascript enabled! Please enable it!
অপারেশন গােসাইলডেঙ্গা পেট্রোল পাম্প
আজ সর্বত্রই নীরবতা। মার্চের উত্তাল তরঙ্গের আন্দোলন থেমে গেছে। পুরাে জাতি নির্জীব হয়ে আছে। মহা হতাশা সবার মুখাবয়ব জুড়ে। ইতিমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতে ট্রেনিং শুরু করেছে। এখনও তারা দেশে ব্যাপক হারে প্রবেশ করেনি। দেশবাসী তাদের প্রতীক্ষায়। চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের আনাগােনা শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখনও বুঝতে পারছে না কিছুই। জ্ঞানীজনরা বুঝে নিয়েছেন নীরবতা বিপ্লব থেকে ভয়ংকর। পাক সৈনিকদের রাজত্ব সর্বত্রই। আপন রাজ্যে তারাই যেন রাজা। যা ইচ্ছা তাই করছে। কেউই বাধা দিতে আসছে না।  মে একাত্তর চট্টগ্রাম শহর মুক্তিযােদ্ধা শূন্য। সবাই পাড়ি দিয়েছে উচ্চতর প্রশিক্ষণের আশায়। ওপারে চলছে ট্রেনিং। অল্প ক’দিনের মধ্যেই তাদের একটি অংশ এসে যাবে। তখনও শুরু হবে গেরিলা যুদ্ধ। চট্টগ্রাম শহরে তখন অবস্থান করছেন সর্বজনাব মৌলভী সৈয়দ আহমদ, মােহাম্মদ হারেস, আবদুল মােনাফ, আবু সাইদ সরদার, মীর সুলতান আহমেদ, আবদুর রউফ, শেখ দেলােয়ারসহ ক’জন সংগঠক। তারা স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঝান্ডাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পবিত্র কোরান হাতে শপথ নিয়েছেন। এপ্রিলের প্রথম দিক থেকেই স্বাধীনতাকামীদের কার্যক্রম কমে যায়। কিছুদিন তারা নীরব ছিলেন। প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। ওপাড়ে তরুণদের পাঠাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন। পাশাপাশি জনগণের মাঝে চেতনা জাগরুক রাখার জন্য স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ছােট ছােট অপারেশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
অবশ্য ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীর আলম ও সাত্তারের (ক্যাপ্টেন) নেতৃত্বে দুটি দল শহরে প্রবেশ করেছে। এবং জাহাঙ্গীর আলম ১৮ই মে চকবাজারে প্রথম সফল অপারেশন সম্পন্ন করছেন। এটাই চট্টগ্রাম শহরের প্রথম সফল অপারেশন। ঊনত্রিশে মে, একাত্তর। চট্টগ্রাম শহর সম্পূর্ণ পাকসেনাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তারা শহরে কায়েম করেছে ভীতির রাজত্ব। অত্যাচারের স্টীম রােলার চালাচ্ছে জনগণের উপর। মায়ামমতার শেষ চিহ্নটুকু তারা বিসর্জন দিয়েছে। বিবেকবুদ্ধি তাদের লােপ পেয়েছে। তার লেশমাত্র নেই তাদের মাঝে। হিংস্রতা, বর্বরতার যতগুলাে খারাপ বিশেষণ আছে সবগুলােই তাদের জন্য প্রযােজ্য। নিত্যদিনই তারা ঘটাচ্ছে নতুন নতুন ঘটনা। রাস্তাঘাটে যাকে দেখছে তাকে চার্জ করছে। সন্দেহ হলে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। অত্যাচার চালাচ্ছে। প্রশ্ন করার কেউ নেই। এমন কি বিবস্ত্র করে হিন্দু না মুসলমান। পরীক্ষা করছে। কলেমা জিজ্ঞেস করে মানুষের মুসলমানীত্ব পরীক্ষা করছে। প্রতি এলাকায় তারা হানা দিচ্ছে নিয়মিত আর মা, বােনদের ইজ্জত হরণ করছে। যুবতী মা, বােনদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ক্যাম্পে। এমনি একটি নারকীয় অবস্থায় তখন চট্টগ্রামবাসীর।
সেদিন বিকেলে এল একটি আর্মি জীপ আগ্রাবাদ সিজিএস কলােনীতে। সামরিক বাহিনীর পাড়ি দেখে যে যেদিকে পারছে পালিয়েছে। গাড়ি এসে থামল হাসপাতালের সামনে। স্থানীয় অবাঙালি যুবক পাকবাহিনীর দোসর আবদুল আজিজ গাড়িতে উঠল। গাড়ি উত্তর দিকে এগিয়ে গেল। দালালের ইঙ্গিতে গাড়ি এসে থামল একটি বিশেষ বিল্ডিং-এর সামনে। পাকসৈনিক তিনজন গাড়ি থেকে নামল। সােজা উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়। বাসাটি সরকারী কর্মচারী আবদুল বাতেনের। তিনি দু’কন্যা, স্ত্রীসহ বসবাস করেন। ভদ্রলােক ও তার স্ত্রী ভীষণ পরহেজগার। নামাজী ও এবাদতী হিসেবে তাদের বেশ সুনাম রয়েছে। পাকবাহিনীর তিন সদস্য তাঁর ঘরে প্রবেশ করল। অস্ত্রের মুখে বাতেন সাহেবেকে বেঁধে ফেলল। অন্যজন অস্ত্র হাতে ঘরের ভিতরের রুমে প্রবেশ করল। তৃতীয়জন ভদ্রলােককে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে শুরু করল। মেয়েরা কোথায় জিজ্ঞেস করল। ভদ্রলােক শত নির্যাতনেও কিছুই বলেনি। রাইফেল উঁচিয়ে ধরেছে মেরে ফেলার জন্য। আল্লাহর কি রহমত তখনই ঘটল একটি ঘটনা। বাইরে প্রচন্ড একটা বিস্ফোরণ হল। পাকবাহিনীর তিন সদস্য ভীষণ ভীত হয়ে নিচে নেমে এল। গাড়িতে যারা অবস্থান করছিল তারা গাড়ি ছেড়ে ছুটতে শুরু করল। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে গেল। আসলে এ বিস্ফোরণ মুক্তিযােদ্ধারা ঘটায়নি। ঐ বিল্ডিং-এর কোণায় ছিল বিদ্যুৎ-এর ট্রান্সফরমার। একটি কাক বসেছে তারে।
কাকের সাথে সংঘর্ষে সম্ভবত শট সার্কিট হয়েছে। ফলে ট্রান্সফরমার প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের শব্দে পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। যে ঘরে পাকবাহিনী ঢুকেছিল সে ঘরে সুন্দরী দু’বােন ছিল। তারা তখনও কলেজে পড়তেন। স্থানীয় অবাঙালি দালাল আজিজ ক’দিন থেকেই দু’বােনকে ডিস্টার্ব করছিল। সেদিন বিকেলে দু’বােন বেলকনিতে বসে চা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখেন পাকআর্মির একটি জীপ আসছে। সামনের সিটে সেই বদমাইশ আজিজ বসে আছে। দু’বােনের সন্দেহ হল। ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে চাইলেন কিন্তু ততক্ষণে ওরা সিঁড়ির গােড়ায় এসে গেছে। তারপরও দু’বােন তড়িৎ গতিতে মাকে জোর করে নিয়ে উঠে গেল তিন তলায়। তাই পাকবাহিনী তাদের পায়নি। অবশ্য সেই রাতেই তারা এ বাসা ছেড়ে চলে এল আগ্রাবাদ বেপারী পাড়ায়।
পাকহানাদারদের এ সংবাদ চলে এল পানওয়ালা পাড়ায় সবুজবাগের গােপন শেল্টারে। মুক্তিযুদ্ধের ক’জন সতীর্থ যােদ্ধা উত্তেজিত হল। ঠিক করলাে পাকহানাদারদের ভয়ের মধ্যে রাখতে হবে। সিদ্ধান্ত নিল সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বে একটি অপারেশন করবেই। তখনও মুক্তিযােদ্ধাদের কার্যক্রম কোন ছকের মধ্যে আসেনি। তারপরও দু’জন তরুণ বেরিয়ে এল। পৌছল কায়েদে আজম রােডের পাশে জিআরকে উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে। একটু উত্তর দিকে এসে দেখেন একজন পাকসৈনিক স্কুল সংলগ্ন পেট্রোল পাম্পের সামনে। তখনও সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তারা পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে এসে বসল। পাকসৈনিকসহ দু’জন খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলছে। মুক্তিযােদ্ধা আবু সাঈদ সরদার ও মােহাম্মদ শাহজাহান দু’জন দুটি গ্রেনেড ছুড়ে মারলেন। গাড়ি চলাচল বন্ধ হল। আশেপাশের বাড়িঘরের দরজা দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তায় মানুষজন এমনিতেই নেই । কারণ সেই মার্চের শেষ থেকেই পাক সামরিক সরকার সন্ধ্যায় কারফিউ ঘােষণা করেছিল। তখনও কেউ মানেনি। এপ্রিলে তারা শহর দখল করার পর কারফিউ তীব্র ভাবে মানছে। অন্ধকারের মধ্যেই আবু সাঈদ সরদার ও মােহাম্মদ শাহজাহান দৌড়ে এলেন জাম্বুরী মাঠে। তারপর উচ্ছাস নিয়ে এলেন সবুজবাগের গােপন আশ্রয়ে। এ অপারেশন মুক্তিযােদ্ধার পরীক্ষা। এলাকাবাসী ভয় পেলেও খুশি হয়েছে। পাকবাহিনী বুঝতে পারল মুক্তিযােদ্ধারা নীরব রয়েছে—থেমে যায়নি। তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে পাকবাহিনী বুঝতে পারল।

(সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!