সশস্ত্র প্রথম প্রতিরােধ ঈদগাঁ
পাকসামরিক সরকার চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রপূর্ণ জাহাজ এনেছে। সেই সােয়াত জাহাজে রয়েছে বাঙালি নিধনের হাতিয়ার। মুক্তিপাগল বাঙালিরা সব বুঝে নিয়েছে—রক্ত দিয়ে প্রতিরােধ করেছে। বাঙালি শ্রমিকরা অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ২০জন শ্রমিকের রক্ত রাজপথকে রঞ্জিত করেছে। তাই বাঙালিরা গড়ে তুলেছে প্রতিরােধ। এবার আর খালি হাতে নয়। বাঙালিদের সাথে যােগ দিয়েছে দেশ প্রেমিক ইপিআর। যৌথ প্রতিরােধের মুখে পাকবাহিনী থমকে গেছে। মেজর রফিকুল ইসলামের (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) নির্দেশে হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীন স্বদেশভূমির জন্য ৭ই মার্চের পর থেকে কাজ শুরু করেছেন। তাঁর কমান্ডের সৈনিকদের তিনি চরম আঘাত হানার প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। সাংকেতিক শব্দের মাধ্যমে তিনি শহরের বাইরেও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের বার্তা পাঠিয়েছেন। স্বাধীনতার ঘােষণা পাওয়ার সাথে সাথে তিনি পাকহানাদারদের প্রতিরােধের ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেন। পুরােপুরি শহর তখনাে বীর বাঙালিদের দখলে। শহরে দু’একটি অঞ্চল পাকনিয়ন্ত্রিত সৈন্যদের দখলে। শহরে তাদের মুখ্য অবস্থান চট্টগ্রাম বন্দর। ২৮শে মার্চ মেজর রফিকুল ইসলামের কমান্ডের ইপিআর সৈনিকরা ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তার মাথায় বালুরমাঠে রেডিও স্টোরের সামনে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। সে দিনের যুদ্ধ পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরােধ। সেদিন ছিল রবিবার। পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য ইপিআর-এর বাঙালি যােদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে ঈদগা কাঁচা রাস্তার আশে-পাশে।
অবস্থানস্থল রেডিও স্টোর, নাহার মঞ্জিলসহ আশেপাশের কয়েকটি এলাকা। ইপিআরের সাথে যােগ দিয়েছে প্রচুর সংখ্যক বাঙালি বীর জনগণ। অবশ্য ৭ই মার্চের পর থেকেই ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তার মাথায় বালুর মাঠে ইপিআর-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে মােজাহিদ বাহিনী। ইপিআরএর সৈনিকরা উন্মুক্ত মাঠে ঐ মােজাহিদ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতেন। বিশেষ করে নাহার মঞ্জিলের মালিক কাজী জয়নুল আবেদীনের ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ও ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ভিপি। ছাত্রাবস্থায় তার সাথে সখ্যা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। তাঁর সান্নিধ্যে থেকে তিনি পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। একাত্তরের প্রথম থেকেই তিনি স্বাধীনতার স্বপক্ষে নিজেকে জড়িত করেন। নিজের ক্ষমতা, মেধা, বুদ্ধি, বিবেক দিয়ে একক প্রচেষ্টায় ঈদগাঁ অঞ্চলকে গড়ে তােলেন প্রতিরােধের দূর্গ হিসেবে। পাকবাহিনী কর্তৃক চট্টগ্রাম দখল করার পর তিনি চলে যান মীরশ্বরাই। সেখানেও তিনি গড়ে তােলেন মুক্তিযােদ্ধাদের এক বিরাট দল। তাঁর দলের যােদ্ধারা দিনে ছদ্মবেশ ধরে কৃষি কাজের সাথে জড়িত থাকতেন আর রাত হলেই নেমে পড়তেন হানাদার নিধনের অপারেশনে। যুদ্ধের মাঠে তার সাথে সম্পর্ক হয় মেজর জিয়ার। ২৮শে মার্চ দুপুর গড়াল। বন্দর এবং টাইগারপাস নৌবাহিনী ক্যাম্প (বখতিয়ার নৌঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল) থেকে ৭টি জীপ ও ট্রাক ভর্তি করে প্রায় ৮০ জনের একদল নৌসেনা এগুলাে ঢাকা ট্রাংক রােড ধরে। দেওয়ানহাট হয়ে এল ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তার মুখে। উদ্দেশ্য ট্রাংক রােড ধরে শুভপুরের দিকে যাওয়া।
কারণ তখন কুমিল্লা থেকে পাককনভয় চট্টগ্রামের দিকে আসছিল। তাদের সাথে যােগ দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। ইপিআর বাহিনী এখানে এ্যাম্বুস করেছিলেন তা তারা বুঝতে পারেনি। বিকেল ৩টায় তারা এ পথ দিয়ে যেতেই ত্রিমুখী ইপিআর বাহিনীর হামলার শিকার হয়। এলােপাথাড়ি গােলার মধ্যে পড়ে পাকবাহিনী দিশেহারা। তাদের ৭টি জীপ সামনেও এগুতে পারছে না, আবার পিছাতেও পারছে না। একঘন্টা তীব্র যুদ্ধ চলে। একসময় দেখা যায় পাকনৌবাহিনীর ৭৫ জন ঐ স্থানেই মারা যায়। তিনজন ইপিআর জোয়ান রেডিও স্টোরের অফিসে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। পাকবাহিনীর ৭৫ জনের মধ্যে ত্রিশ ছিল অফিসার। ক’জন বেঁচে যায়। তারা ড্রেনের ভিতর দিয়ে পালিয়ে যেত সক্ষম হলেও পথে অবশ্য তিনজনকে মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সে দিনের প্রতিরােধে ইপিআর বাহিনী নাহার মঞ্জিলকে বিশেষভাবে ব্যবহার করেছিল। নাহার মঞ্জিল এবং রেডিও স্টোর থেকে ইপিআর বাহিনী পাকনৌবাহিনীকে আঘাত হেনেছিল। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকেই নাহার মঞ্জিল ছিলাে স্থানীয় স্বাধীনতাকামীদের কন্ট্রোল রুম। বিশেষ করে ইপিআর বাহিনী ২৮ তারিখের যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত নাহার মঞ্জিলকে কন্ট্রোল রুম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পাকবাহিনী শহর দখল করার পর বিহারীরা কাজী জয়নুল আবেদীনের বাসভবন নাহার মঞ্জিলকে লুটপাট করে নিয়ে যায়। যুদ্ধের পুরাে সময় এলাকাবাসী অনেকে এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকবাহিনীর দোসরদের কারণে এলাকার আবদুল হক মেম্বারের বাড়ি পাকবাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। রামপুরের ইয়াকুব মুন্সির বাড়িতে পাকবাহিনী প্রবেশ করে ১১জনকে হত্যা করে। পার্শ্ববর্তী চান মিয়ার বাড়িও বর্বরের দল জ্বালিয়ে দেয়। ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তার মাথার দু’পাশের সব দোকানপাট আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে পাকবাহিনী অঞ্চলটিকে বীভৎস করেছিল।
প্রতিরােধ যুদ্ধের পর ইপিআর বাহিনী এ এলাকা থেকে সরে যায়। সময়ের অভাবের কারণে অনেক সাথীর লাশ দাফন করা সম্ভব হয়নি। এ প্রতিরােধে ইপিআর বাহিনীর মাত্র তিনজন জোয়ান শহীদ হয়েছিলেন। তারা হলেন নায়েক মনু মিয়া (৮৩৫২), ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার (১২০৬৭), সিপাহী বাচ্চু মিয়া। তাঁরাই চট্টগ্রামের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরােধের প্রথম শহীদ। পাকবাহিনী অঞ্চলটি দখল করার পরও এদের লাশ রেডিও স্টোরে পড়েছিল। পরে বর্বর কুকুরের দল লাশগুলােকে রশি দিয়ে বেঁধে ক’দিন লটকিয়ে রাখে। পরে অবশ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে রেডিও স্টোরের সামনে বালুর মাঠে সমাহিত করা হয়। বিডিআর-এর ১১ উইং শহীদের কবরের উপর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। এ ব্যাপারে জায়গার মালিক পালন করেছিলেন বিশেষ ভূমিকা। জায়গার মালিক হেদায়েত উল্লাহ ও আবদুল গফুর অনুমতি দিয়ে বীরদের সম্মান দেখিয়েছিলেন। কাজী জয়নুল আবদীন ও ফাহিম উদ্দিন ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২৮শে মার্চের প্রতিরােধে পাকবাহিনীর হাতে এলাকার দু’জন পুরুষ ও একজন মহিলা মারা যান। এ প্রতিরােধের পর দীর্ঘদিন এলাকাবাসী এলাকায় ছিল না। পাকবাহিনী রেডিও স্টোর দখল করে রেডিও স্টোরের আটকে পড়া বাঙালি কর্মচারীদের দিয়ে লাশ পরিস্কার করায়। ৭৫জন পাকনৌসেনার লাশও তাদের দ্বারাই সরানাে হয়। গােলার আঘাতে রেডিও স্টোর আঁঝরা হয়ে যায়। পরে অবশ্য পাকবাহিনী বিদেশীদের দেখানাের জন্য রেডিও স্টোর ভবনটি মেরামত করে । যেন বিদেশীরা বুঝতে পারে এখানে তেমন কিছুই হয়নি।
(সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত