You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.01 | মার্চ ৭১-এ চট্টগ্রাম শহর - সংগ্রামের নোটবুক
মার্চ ৭১-এ চট্টগ্রাম শহর
পাকসামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রেডিও ঘােষণার মাধ্যমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেছেন। তার এ ঘােষণা পূর্ব পাকি স্তানের জনগণ মেনে নেয়নি। নেমে পড়ে রাজপথে। প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে চট্টগ্রামে। ১লা মার্চে ইয়াহিয়ার ঘােষণার পর চট্টগ্রামের জনপদ কি রূপ গ্রহণ করেছিল তার আংশিক চিত্র তৎকালীন শহর আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ডায়রীর সৌজন্যে প্রাপ্ত। অবশ্য ঢাকায় অবস্থানরত চট্টগ্রামের মুক্তিযােদ্ধা রবিউল হােসেন কচি সম্পাদিত বাংলাদেশ আমার সাধনার দেশ’ নামক বইতে প্রকাশিত ডঃ এ আর মল্লিক রচিত একাত্তরের কিছু উল্লেখযােগ্য ঘটনা থেকেও মুদ্রিত। কিছু তথ্য অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন এক সময় ছাত্র নেতা। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সাথে গড়ে তােলেন সখ্য। জহুর আহমদ চৌধুরীর রাজনৈতিক পরশে তিনি নিজেকে গড়ে তােলেন। চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সাথে ছিল তাঁর সম্পর্ক। ‘৭১-এর উত্তপ্ত দিনগুলােতে তিনি পালন করেছিলেন বিশেষ ভূমিকা। সিটি আওয়ামী লীগের অফিস ছিল রেষ্ট হাউজের ২৩ নম্বর কক্ষে। এখানে বসে অফিস চালাতেন জহুর আহমেদ চৌধুরী। এ অফিসের দুটি টেলিফোন ছিল ৮৩৭১৬, ৮০৫৫২ নম্বরের। এ ফোন সেদিন পালন করেছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। অপর দিকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের অফিস ছিল ১২০, আন্দরকিল্লাতে। সেখানে বসতেন এম এ আজিজ।
অবশ্য ১০ই জানুয়ারী ‘৭১ তিনি মারা গেলে এ দপ্তরের দায়িত্ব হাতে নেন এম আর সিদ্দিকী ও এম এ হান্নান। জেলা আওয়ামী লীগের ফোন নম্বর ছিল ৮৫১০৯। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সিটি আওয়ামী লীগের রেষ্ট হাউজস্থ ২৩ নম্বর কক্ষ এবং জেলা আওয়ামী লীগের ১২০, আন্দরকিল্লাস্থ অফিস পালন করেছিল ঐতিহাসিক দায়িত্ব। চট্টগ্রামের দিনলিপির আংশিক সংরক্ষণ করতে পেরেছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। পাকবাহিনী কর্তৃক চট্টগ্রাম দখলের পর তিনি চলে যান মুক্তাঞ্চলে। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন সশস্ত্র যুদ্ধের। মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে দেশের সেবা করেন।
১লা মার্চ, ‘৭১ ঃ ইয়াহিয়ার ঘােষণার প্রতিবাদে সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলমের নের্তৃত্বে ছাত্র মিছিল বের হয়। চট্টগ্রাম কলেজ, কমার্স কলেজ, মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ইনষ্টিটিউট, ছাত্রলীগ আগ্রাবাদ আঞ্চলিক শাখা, পাহাড়তলী আঞ্চলিক শাখা, ডক শ্রমিক লীগ, জেলা ছাত্রলীগসহ পুরাে শহরে প্রায় একই সময় মিছিল বের হয়। ঐ দিনের একটি মিছিল ছিল সকলের দৃষ্টিতে ভিন্ন। পূর্ব মাদারবাড়ী রেলগেইটের পার্শ্বে অবস্থিত মেথরপটি থেকে মেথর কালী চরণের নেতৃত্বে মিছিল। তারাও ছিল প্রতিবাদী। 
২রা মার্চ, ‘৭১ ঃ চট্টগ্রাম শহরে লাগাতার হরতাল। সকাল ৮টায় মিছিল। বিকেল ২টায় নগর ছাত্রলীগের উদ্যোগে লালদীঘিতে সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তৃতা করেন এস এম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ আহমেদ, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ইদ্রিস আলম, আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান প্রমুখ। সে সভায় পাকিস্তানী পতাকা পােড়ানাে হয় এবং চট্টগ্রামের সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানাের সিদ্ধান্ত হয়।  একটি বিরাট মিছিল শহরের প্রধান অঞ্চল প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন সুলতানুল কবির চৌধুরী ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। মিছিল রেষ্ট হাউজে এসে শেষ হয়।
৩ মার্চ, ‘৭১ ঃ সকাল ৯টার পর পাহাড়তলী ওয়ারলেস কলােনীতে বাঙালি মিছিলের উপর অবাঙালিদের হামলা। বোমরিক পােষাকে পাকসৈন্যরা অবাঙালিদের সাথে মিশে এ হামলা চালায়। বাঙালিদের বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিহতের সংখ্যা ২৫০ জনের অধিক। আহত হয় ৪০০ থেকে ৫০০ জন বাঙালি। বেলা ২টায় প্রতিবাদ মিছিল। লালদীঘিতে শােক সভা। পাহাড়তলী থেকে ক’টি লাশ এনে জানাজা এবং স্টেশন রােডস্থ কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন।
৪ঠা মার্চ, ‘৭১ : ওয়ারলেস কলােনীতে অবাঙালিদের তান্ডব। সকাল ১১টায় লালদীঘিতে গায়েবী জানাজা। দুপুর ১টায় এসপি’র সাথে ছাত্র নেতাদের বৈঠক। বৈঠকে ছিলেন ইদ্রিস আলম, মৌলভী সৈয়দ আহমদ, নূরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ ক’জন। এ বৈঠকে এসপি শামসুদ্দিন ইঙ্গিত দেন পাকবাহিনীর সাথে পুলিশের বিরােধ এবং সংঘর্ষ আসন্ন। পাকবাহিনী পরে তাকে হত্যা করে। বিকেল ৪টায় সিটি আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে নিয়ে পাহাড়তলী ও ওয়ারলেস কলােনীতে ক্ষতিগ্রস্থতের দেখতে যান।
৫ই মার্চ, ‘৭১ ঃ সকাল ২টা পর্যন্ত হরতাল। বিকেল ৪টায় সার্কিট হাউজে চট্টগ্রাম সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এম আর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক মিয়া, এম এ হান্নান, এম এ মান্নান, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মােখতার আহমেদ, সাবের আহমেদ আজগরীসহ আরাে অনেকে। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার এ সভা আহ্বান করেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ এম আর সিদ্দিকীকে একটি শান্তিকমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। | রাত ৯টায় চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবে শহরের সব রাজনৈতিক দল ও তাদের গণ্যমান্য নেতাদের আহ্বান করা হয়। সকলে কমিটি গঠনে একমত হলেও পাকসরকার ও তার সেনাবাহিনীর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে এম এ হান্নান শান্তি কমিটি গঠনের বিরােধিতা করেন। তিনি সকলকে বুঝাতে চান পাকসরকার ও তার সামরিক বাহিনীর সাথে আমাদের সম্পর্ক প্রায় শেষ। তাদের শান্তি স্থাপনের আর কোন সম্ভাবনা নেই। তারপরও এম আর সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শান্তি কমিটি।
৬ই মার্চ, ‘৭১ ঃ হরতাল চলছে লাগাতার। পাকসরকারের অতি উৎসাহী বন্ধু এবং অবাঙালিরা গােপন সামরিক সহযােগিতা পেয়ে হিন্দুদের কৈবল্যধাম মন্দির লুণ্ঠন করে। তাদের নিকট থেকে টাকা পয়সা স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। পাকিস্তান জিন্দাবাদ শ্লোগান তুলে এ লুণ্ঠন কার্য পরিচালিত হয়। স্থানীয় পুরােহিত ও হিন্দুদের অমানুষিক নির্যাতন করে।
৭ই মার্চ, ‘৭১ ঃ হরতাল চলছে। পুরাে শহরে মিছিল আর মিছিল। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে শুরু হয়েছে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ ও
রাজনৈতিক ক্লাশ। রাজনৈতিক ক্লাশের প্রশিক্ষক সাবের আহমদ আজগরী আর অস্ত্র প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক ফাহিম উদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে ভারতে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষক), সংগঠক ডাঃ মাহফুজুর রহমান। সেদিন আয়ােজনে ছিলেন ডাঃ গােফরানুল হক, আ ই ম জাকারিয়া চৌধুরী, রাখাল চন্দ্র বণিক, আব্দুল্লাহ-আল-হারুন (ছাত্রনেতা)। প্রথম দিনের ট্রেনিং-এ উপস্থিত ছিল ৮০ জন। অবশ্য পরে সংখ্যা বেড়ে কয়েক শ’ হয়।
৮মার্চ ‘৭১ : পবিত্র হজ্বব্রত পালন শেষে জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী চট্টগ্রাম আসেন। এম আর সিদ্দিকীর বাসায় গুরুত্বপূর্ণ সভায় যােগ দেন। বিকেলে রেস্ট হাউজের ২৩ নম্বর কক্ষে সভা করেন। এক সপ্তাহের কর্মসূচী ঘােষণা করেন। রাতে পাহাড়তলীতে অসহায় আহত ও নিহত পরিবারবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আবুল ফজলের বাসভবনে শিল্পী-সাহিত্যিকদের সভা বসে। গঠিত হয় শিল্পী-সাহিত্যিক প্রতিরােধ সংঘ। এ সভার আয়ােজন করেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব। আগ্রাবাদ কলােনী স্কুল মাঠ ও আগ্রাবাদ জাতিতাত্ত্বিক যাদুঘরের সামনে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ শুরু।
৯ই মার্চ ‘৭১ ঃ অসহযােগ আন্দোলন চলছে। রেস্টহাউজে একটি অভিযােগ কেন্দ্র খােলা হয়। কেন্দ্রের দায়িত্ব দেয়া হয় লােকমান মাহমুদকে। তিনি অতিনিষ্ঠার সাথে এ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। পরে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে চলে যান।
শুরু হয় গণসংগীতের মহড়া চট্টগ্রাম শিল্প-সাহিত্য পরিষদের চট্টেশ্বরী রােডস্থ কার্যালয়ে, বর্তমান আর্ট কলেজে।
১০ই মার্চ ‘৭১ : গঠিত হয় এ্যাকশান কমিটি। চট্টগ্রাম সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা হলেন সর্বজনাব জহুর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক মােহম্মদ খালেদ, এম আর সিদ্ধিকী, এম হান্নান ও এম এ মান্নান। তাঁদের বিভিন্নজনের দায়িত্ব ছিল ভিন্ন ভিন্ন। অর্থাৎ চট্টগ্রামের পুরাে প্রশাসন তাদের নির্দেশে পরিচালিত হত। তখনাে ব্যাংকে ১০০০ টাকার বেশি উত্তোলন করা যেত না। উত্তোলন করতে হলে সংগ্রাম পরিষদের লিখিত অনুমতি নিতে হত। আজকে শুরু হয় অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ লিখিত এবারের সংগ্রাম নাটকের মহড়া।
১১ই মার্চ ‘৭১ গভর্ণর হিসেবে টিক্কা খানকে বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী শপথ বাক্য পাঠ করাননি। ফলে চট্টগ্রামের সর্বত্র আনন্দ মিছিল। বিকেল ৩টায় জে এম সেন হলে মহিলা আওয়ামী লীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন নুরুন নাহার জহুর। প্রথম মহিলাদের মিছিল বের হয়। নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা, রাশেদা, জাহানারা আঙ্গুরসহ আরাে ক’জন মহিলা। 
১২ই মার্চ ‘৭১ ঃ সন্ধ্যায় শহরে দুটি মিছিল। একটি বান্ধবী সংঘের উদ্যোগে, আরেকটি শিল্পী-সাহিত্যিকদের উদ্যোগে। নেতৃত্বে ছিলেন কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল। 
১৩ই মার্চ ‘৭১ ঃ চট্টগ্রাম শহরের সব সরকারী-আধাসরকারী অফিসের কর্মচারীদের সভা লালদীঘিতে অনুষ্ঠিত হয়। এ ব্যাপারে এম এ হান্নানের সাথে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন আগ্রাবাদ কলােনীর অধিবাসী শ্রমিক কর্মচারীদের নেতা মােহাম্মদ খােদাদাদ (যুদ্ধ শুরু হলে তিনি শহরে থেকে আগ্রাবাদ অঞ্চলের বিভিন্ন বিভাগের চাকুরীরত স্বাধীনতাকামী মানুষের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে গােপন পথে প্রবাসী সরকারের নিকট টাকা পাঠাতেন এবং স্থানীয়দের অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন)।
১৪ই মার্চ ‘৭১ ও শিল্পী-সাহিত্যিক প্রতিরােধ সংঘের সভা শিল্প-সাহিত্য পরিষদের কার্যালয়ে। ছাত্র কর্তৃক চট্টগ্রাম শহরের বন্দুকের দোকান ও অস্ত্রের দোকান দখল।
১৫ই মার্চ ‘৭১ ঃ লালদীঘি ময়দানে শিল্পী-সাহিত্যিক প্রতিরােধ সংঘের জনসভা। আবুল ফজলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন ডঃ আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আলী আহসান, সাবিহ উল আলম, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন, মােহাম্মদ শাহ কোরেশী প্রমুখ। রাতে গণসংগীত ও নাটক ‘এবারের সংগ্রাম’ মঞ্চস্থ হয়। হাজার হাজার মানুষের শ্লোগানে মুখরিত ছিল লালদীঘি ময়দান। পুরাে মাঠে জ্বলছিল মশাল। মশালের আলােতে আলােকিত লালদীঘির পুরাে অঞ্চল। থেকে জিয়ার প্রত্যাবর্তন, অল্পের জন্য প্রাণরক্ষা। ভূমিকা পালন করেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান।
১৬ই মার্চ ‘৭১ঃ সেন্ট প্লাসিড উচ্চ বিদ্যালয়ে খ্রিস্টান মহিলাদের সমাবেশ। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধরনের সভা এই প্রথম। মেরী সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে এ সভার আয়ােজন হয়। মুসলমান মহিলা-পুরুষদের সহযােগিতা। এবং সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ সভা সফল হয়।
১৭ই মার্চ ‘৭১ ঃ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে সর্বস্তরের ডাক্তার, নার্সদের যৌথ মিছিল। প্রায় ৪ ঘন্টা ব্যাপী এ মিছিল শহরের আনাচে-কানাচে প্রদক্ষিণ করে। সবার মুখে ছিল স্বাধীনতার শ্লোগান।। 
১৮ই মার্চ ‘৭১ ঃ জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের যৌথ সভা ১২০, আন্দরকিল্লায় অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন এম আর সিদ্দিকী ও এম এ হান্নান। সন্ধ্যায় আগ্রাবাদ কলােনী স্কুল মাঠে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মার্চ পাষ্ট অনুষ্ঠান। সালাম গ্রহণ করেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মােখতার আহমেদ। একই সময় আগ্রাবাদ জাতিতাত্ত্বিক যাদুঘরের সামনে প্রশিক্ষণরত স্বেচ্ছাসবেকদের সালাম গ্রহণ করেন তােহা গাজী ও আ ই ম জাকারিয়া চৌধুরী।
১৯শে মার্চ ‘৭১ ঃ খােন্দকার মােশতাক আহমদ ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর চট্টগ্রাম আগমন। সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর জরুরি তার পেয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ। জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিতে ২০ জন বাঙালির প্রাণহানীর প্রতিবাদে ছাত্রলীগের প্রতিবাদ সভা। বক্তব্য রাখেন সাবের আহমদ আজগরী, আয়ুব বাঙালি, ডাঃ গােফরানুল হক, শফি উল্লাহ প্রমুখ।
২০শে মার্চ ‘৭১ ঃ ক্যাপ্টেন রফিকের বিশেষ তৎপরতা। সাংকেতিক সংবাদ প্রেরণ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে গােপন যােগাযােগ। চট্টগ্রামের সকল কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিরােধ প্রস্তুতি। চট্টগ্রাম কলেজ হােস্টেলে গােপন বৈঠক।
২১শে মার্চ ‘৭১ ঃ পাড়ায় পাড়ায় জনসভার কর্মসূচী ঘােষণা। এম এ হান্নান ও এম এ মান্নান পালাক্রমে জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে প্রতিরােধ আন্দোলন সম্বন্ধে সচেতন করতে শুরু করেন। জনগণকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানাতে থাকেন।
 ২২শে মার্চ ‘৭১ ঃ বন্দর এলাকায় শ্রমিক জনসভা। বিকেলে বিরাট শ্রমিক মিছিল। ট্রাক মিছিল জিন্নাহ রােড (বর্তমানে শেখ মুজিব রােড) হয়ে পুরাে চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে।
২৩শে মার্চ ‘৭১ : পুরাে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। সকালে হল প্রভাত ফেরী। লালদীঘির মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর মহড়া সকাল ৯টায়। সেদিন ছিল পাকিস্তান দিবস। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজ ও কোর্ট বিল্ডিং ছাড়া কোথাও পাকিস্তানী পতাকা উড়েনি—উড়েছিল বাংলাদেশের পতাকা।
 ২৪শে মার্চ ‘৭১ ঃ এম এ হান্নানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বন্দরে সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে প্রতিরােধ। বন্দর, আগ্রাবাদ, বাদামতলীর মােড় থেকে সেনানিবাস পর্যন্ত পুরাে অঞ্চলে প্রতিরােধ তীব্র হয়। রাতে চট্টগ্রাম কলেজ প্যারেড মাঠে শিল্পী-সাহিত্যিক প্রতিরােধ সংঘের উদ্যোগে নাটক স্বাধীনতার সংগ্রাম। সােয়াতা জাহাজের সংবাদ পেয়ে প্যারেড ময়দান থেকে ত্রিশ হাজার মানুষের মিছিল বন্দরে প্রতিরােধে অংশ গ্রহণ করে। ক্যাপ্টেন রফিক (মেজর রফিক)-এর নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী কর্তৃক চট্টগ্রামের সকল সীমান্ত চৌকি দখল এবং সকল অবাঙালি সৈন্য বন্দি। বিকেলে আগ্রাবাদ বাদামতলী মােড়
২৫শে মার্চ ‘৭১ : মেজর রফিকের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী কর্তৃক রাত ৮টায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত যুদ্ধ ঘােষণা। চট্টগ্রাম শহর দখল এবং ইপিআরের ৪০০ জন অবাঙালি সৈন্য বন্দি। ছাত্র-জনতা কর্তৃক রাইফেল ক্লাব ও পুলিশের (ডিবি পাহাড়ের) অস্ত্রাগার ও গােলাবারুদ দখল। রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পাকসৈন্যরা বেরিয়ে এলে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। রাতে এম আর সিদ্দিকীর বাসভবনে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের সভা বসে। রাত ৯টায় এম আর সিদ্দিকীর বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ। সর্বশেষ নির্দেশ গ্রহণ। নিরাপত্তার কারণে সভা জানে আলম দোভাষের ফিরিঙ্গী বাজারে স্থানান্তর। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা চট্টগ্রাম পৌছে। শহরে স্বাধীনতার ঘােষণা মাইকে প্রচার করা হয়।
২৬শে মার্চ ‘৭১ ঃ আজ সকাল ১০টায় আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন জুপিটার হাউজে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। স্বাধীনতার ঘােষণা বেতার মাধ্যমে প্রচারের সিদ্ধান্ত। অবশ্য পূর্বরাতেও জানে আলম দোভাষের বাড়ির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ষােলশহর গেইটে তীব্র প্রতিরােধ গড়ে উঠে। পাকবাহিনী সেনানিবাস থেকে বের হতে চাইছে। দুপুরে এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে বেলাল মােহাম্মদ ও আরাে ক’জনের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বেতারের দ্বিতীয় অধিবেশন চালু হয়। রাত ১০.৩০ রঙ্গ লাল দেব চৌধুরী ও মাহমুদ হােসেনের নেতৃত্বে। স্বাধীন বাংলা বেতারের ৩য় অধিবেশন চালু হয়। এই অধিবেশনে ইংরেজী সংবাদ ও বুলেটিন প্রচার করা হয়।
২৭শে মার্চ ‘৭১ ঃ সকাল ১০টায় স্বাধীন বাংলা বেতারের আজকের প্রথম অধিবেশন এবং বেতারের ৪র্থ অধিবেশন চলে। বেতারের ৫ম অধিবেশন এবং আজকের ২য় অধিবেশন চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পত্র পাঠ করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে আটককৃত (২৪ তারিখ থেকে) প্রায় শতাধিক বাঙালি সৈনিককে ১৭ নং জেটির প্লাট ফরমে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়।
২৮শে মার্চ ‘৭১ : ঈদগাঁ কাঁচা রাস্তার মাথায় রেডিও স্টোরের সামেন ইপিআর কর্তৃক প্রতিরােধে ৮০ জন পাক নৌসেনা খতম। পরে ইপিআর বাহিনী তীব্র যুদ্ধের পর কৌশলগত পশ্চাদপসারণ। এই প্রতিরােধে ৩ জন ইপিআর সৈন্য শহীদ হন।
৩০শে মার্চ ‘৭১ : পুরাে চট্টগ্রাম শহর পাক হানাদার কর্তৃক দখল হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের উদ্দেশ্যে সংগ্রামীরা চলে যান ভারতে। উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে অভ্যন্তরে এসে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। কেউ দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেন। এই দিন দুপুরের পর কালুরঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্রের উপর পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানের আক্রমণ হয়। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার বন্ধ হয়ে যায়।
(সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত