You dont have javascript enabled! Please enable it! ষ্টেটব্যাঙ্ক অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
ষ্টেটব্যাঙ্ক অপারেশন
পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর তৎকালীন বালাখানা ঢাকার মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকার ষ্টেট ব্যাংক ভবন। সকালে, দুপুরে, বিকেলে, রাতে পাহারা বদল। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছে ব্যাংকের সবকটি প্রবেশ দ্বার। ব্যাংকের একপাশে ব্যাংকার। তার আড়ালে রয়েছে পাহারাদার পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ। ব্যাংকের ভবনের গা ঘেঁষে রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশের দু’দুটো ক্যাম্প। তাদের চোখ গলিয়ে একটি মাটি ঢােকারও জো নেই। সেই দুর্ভেদ্য দুর্গের প্রহরা আর হানাদার পাকিস্তানী শাসকচক্রের দম্ভকে খান খান করে দিয়েছিল দু’দুটো প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। একটি বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্যাংকের প্রবেশদ্বার। অপর বিস্ফোরণে টুকরাে হয়ে ছিটকে পড়েছিল ব্যাংকের ছ’তলার জানালা দরজা আর তার কাচ। ব্যাংকের এ ছতলায় ছিল হানাদারদের গৌরব কমাণ্ডোবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান। হানাদার শাসনচক্রের তৎকালীন এই বালাখানায় হানা হয় আগষ্ট মাসের একেবারে শুরুতে। পিআইএতে বাঙালি বিরােধী অঘটনের নায়ক এস ইউ দূররানী ঢাকায় আসছেন। এবার তার নয়া পদ, নয়া দায়িত্ব। তিনি নিযুক্ত হয়েছেন ষ্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গর্ভনর। ঢাকায় আসছেন ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধান কর্মনিৰ্বাহকদের চারদিনব্যাপী এক সম্মেলনের উদ্বোধন করতে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের ঋণদান ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করে সমস্যা দূরীকরণ সম্পর্কে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে কার্যকর করে তােলার ব্যাপারে আলােচনা ও পন্থা নিরূপণ ।
প্রেটার চার্জ
একটি প্লেটার চার্জ ঘটাল বিস্ফোরণ। ওতে ছিল ২০ পাউণ্ড পিকে এবং ৭ সের ইসপিলিনটার। ঘটনার নায়ক ছিল ৫ জন। সবাই ক্র্যাক প্লাটুনে’র। তারা হল সিরাজ, মুজিব, আজহার, হাবীব ও খালেদ। অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি স্টেনগান ও দু’টি হ্যাণ্ড গ্রেনেড।
ঘটনার দিন বেলা বারােটায় রেকি করল আজহার ষ্টেট ব্যাংকের একজন পিওনের সহায়তায় । কমলাপুরের কোন এক বাসায় ছিল ওদের ক্যাম্প। সেখান থেকে সন্ধ্যা ছটায় তারা রিকশায় চেপে রওয়ানা হল। ঠিক হল সিরাজ, আজহার বিস্ফোরক প্লেটারটি নিয়ে গিয়ে ব্যাংকের উত্তর দিকের গেটে পুলিশদের বাংকারের পাশে বসবে। মুজিবর বসবে নিচে লম্বালম্বি হাতের আড়ালে ষ্টেনগান লুকিয়ে রেখে ওদেরকে কভার’ দেওয়ার জন্য। হাবীব ও খালেদ গ্রেনেড নিয়ে তৈরি থাকবে অদূরে গ্লাক্সোর দফতর ভবনের কাছে।
 সিরাজ ও আজহারের রিকশা এসে দাঁড়াল বাংকারের ঘেঁষা রাস্তায়। ওপাশে ছােট্ট এক চিলতে খাল। লােকজন সেই খাল পেরিয়ে সব সময় যাতায়াত করে। ওরা এমনভাবে নামল যেন মনে হল ওরাও ওপথের যাত্রী। বাক্সটি বা পাত্রটি বেজায় ভারী তাই বয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আর হ্যা, প্লেটার চার্জটি দেখতে খানিকটা অদ্ভুত! ও পাশে পাহারারত ক্যাম্পের পুলিশরা সন্দেহ করল। তারা এগিয়ে এল। বেগতিক দেখে সিরাজ ও আজহার দূরে সরে গেলেন। অদ্ভুত বস্তুটি দেখার জন্যে পুলিশের সাথে সাথে পথচারী কিছু লােকজনও জুটে গেল। এ সময় বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এল মুজিবর। ও ভাবল, আমাদের সুযােগ হারালে চলবে না। এই প্লেটার বানাতে আড়াইশাে টাকা খরচ হয়েছে। এবং তা জোগাতে কম বেগ পেতে হয়নি।
মুজিবরের পেছনে খানিক দূরে এসে আবার অবস্থান নিলেন নিরস্ত্র সিরাজ ও আজহার। বিদ্যুৎবেগে মুজিবর ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে চার্জকে ইগনাইট করল একটি জলন্ত সিগারেট দিয়ে। তারপর তেমনি বিদ্যুতগতিতে পালিয়ে গেল। লােকজন ভ্যাবাচাকা। ঘটনাটা গুরুতর অনুমান করে পুলিশরা তখন ক্যাম্প ও বাংকারের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের দেখে লােকজনও পালাতে শুরু করল। তার খানিক পরই কেঁপে উঠল মতিঝিল। অক্টোবরের কুড়ি  দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে অক্টোবরের কুড়ি তারিখ। এর নায়ক ছিলেন ৫ জন। এদের। মধ্যে ৪ জন হলেন নজমুল গ্রুপের বিছু সাদেক, আমান, জসীম, নজমুল এবং অপর ব্যক্তিটি হলেন ষ্টেট ব্যাংকেরই একজন কর্মচারী। ব্যবহৃত হয়েছিল ৮ পাউণ্ড পিকে। অফিসের সেই সহায়ক বন্ধুটি কাছ থেকে প্রথমে খবর মিলল যে, ব্যাংকের ছতলায় টয়লেট রুমের পাশের কক্ষে এসে আস্তানা গেড়েছে কয়েকজন ‘হায়ার ট্রেইনড কমাণ্ডো’। পরিকল্পনা করা হল। উদ্দেশ্য হানাদার কমাণ্ডোদের মুক্তিবাহিনীর বিচ্ছুদের শক্তি দেখিয়ে দেয়। পর পর দু’দিন রেকি হল। তারপর ঠিক হল, বিস্ফোরণটি ঘটান হবে দুপুরে। কারণ, কমাণ্ডোরা সবাই তখন ঘরে থাকে। একটি ব্রীফ কেসে সাজান হল পিকে চার্জ । এর সাথে দেয়া হল সাত মিনিটের ফিউজ এবং একটি গ্রেনেড-৩৬।
সাদেক, আমান ও জসীম নির্দিষ্ট সময়ে ষ্টেট ব্যাংকের সম্মুখের রাস্তায় গাড়িতে করে বিস্ফোরকটি নিয়ে এল। সেখানে অপেক্ষা করছিল সহায়ক বন্ধুটি। তিনি ব্রীফ কেস নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। গাড়ির মধ্যে দুটি ষ্টেনগান নিয়ে ওরা বিস্ফোরণের শব্দ শােনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। এদিকে লুংগী, পাঞ্জাবী, পাম্পসু পড়া নজমুল খানিক আগে থেকেই গেটের অদূরে অপেক্ষা করছিল। তার কাছেও লুকানাে রয়েছে ষ্টেনগান। সহায়ক বন্ধুটি বাথরুমে গিয়ে পরিকল্পনা মতাে ব্রীফ কেসটি যথাস্থানে স্থাপন করে কেস থেকে বেরিয়ে আসা ফিউজ ওয়্যারে ইগনাইট করলেন। তারপর চট করে বেরিয়ে এলেন প্যান্টের বােতাম লাগাতে লাগাতে। ফিউজওয়্যার সেবার একটু গড়বড় করেছিল। মাত্র চার-পাঁচ সেকেণ্ডেই তা পুড়ে গিয়ে ঘটল বিস্ফোরণ। তবে কমাণ্ডো ঘায়েলে গড়বড় হয়নি। তাদের দু’জন আহত হয়েছিল। (সূত্র : ঢাকায় গােরিলা অপারেশন, হেদায়েত হােসেন মােরশেদ)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত