You dont have javascript enabled! Please enable it! ফার্মগেট অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
ফার্মগেট অপারেশন
গাড়ি থেকে নেকড়ের মতাে নিঃশব্দে অথচ ক্ষিপ্রগতিতে নামল পাঁচজন গেরিলা। এক মিনিটের মধ্যে তারা পজিশন নিল। চারজনের হাতে স্টেনগান। একজনের হাতে চাইনীজ এলএমজি। অর্ডার হল ও ফায়ার। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলল পুরাে এক মিনিট ব্রাশ ফায়ার। কাটা কলাগাছের মতাে মাটিতে পড়তে লাগল ঢাকা নগরীর ফার্মগেট চেক পােষ্টের রাজাকার ও মিলিটারী পুলিশগুলাে। ঠিক এক মিনিট পর কমাণ্ড দেয়া হলরিট্রিক। বিশ থেকে পঁয়ত্রিশ সেকেণ্ডের মধ্যে গাড়িতে উঠে পড়ল গেরিলারা। তারপর সা করে বেরিয়ে গেল সবুজ রঙের টয়ােটা করােনা গাড়িটি। পৌনে তিন মিনিটের কম সময়ের মধ্যে অপারেশন শেষ। আর এতে মারা গেল হানাদার বাহিনীর ৫ জন মিলিটারী পুলিশ ও তাদের ৬ জন সহযােগী রাজাকার।  আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা নগরীর লােকজন বেশ উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। হানাদার বাহিনীর বৃহত্তম ছাউনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট অপারেশন হেডকোয়ার্টার, এমটিএ হােষ্টেল এবং তৎকালীন দ্বিতীয় রাজধানী এলাকার অদূরবর্তী শক্তিশালী চেকপােষ্ট। ফার্মগেটের ট্রাফিক আয়ল্যাণ্ডের মধ্যে দুটো টে-ট খাটিয়ে করা হয়েছিল খানসেনা ও তাদের সহযােগীদের সার্বক্ষণিক থাকার সুব্যবস্থা। ট্রাফিক আয়ল্যাণ্ডের লাগােয়া ফুটপাথে ব্রাইফেল ও লাইট মেশিনগান নিয়ে রয়েছে চেকষ্টের প্রহরী ।
এই চেকপােস্টে হামলা চালানাে এবং হানাদার খতম করা সম্ভব ভেবে গেরিলারা অংশ নেয়।  এই অপারেশনে মােট ৬ জন গেরিলা অংশ নেয়। এদের একজন সামাদ ভাই। তিনি ছিলেন গাড়ি ড্রাইভিং-এর। বাকী ৫ জন হল জুয়েল, বদিউজ্জামান, আলম, পুলু ও স্বপন। এরা সবাই ক্র্যাক প্লাটুন’-এর জুয়েল ও বদি পরবর্তীকালে শহীদ হয়। এদের মধ্যে আলমের কাছে ছিল চাইনীজ এলএমজি, বাকী সবাইর হাতে স্টেনগান। জুয়েল ও। পুলুর হাতে ছিল এছাড়া একটি ফুসফরাস গ্রেনেড ও একটি গ্রেনেড-৩৬। সামাদ চাইয়ের হাতে ছিল রিভলভার। এ ঘটনার দিন সকাল বেলা সামাদ ভাই ফার্মগেট এলাকা দিয়ে আসছিলেন। তখন তিনি দেখতে পেলেন একদল রাজাকারকে নিয়ে একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল। কি ব্যাপার! রাজাকার পােষ্টিং হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এমনিতে চেকপােষ্টে এদ্দিন ছিল পুলিশ ও মিলিটারী। এবার দেখি বাড়তি উদ্ৰব! চেকপােষ্টের ওপাশে ব্যাংকের কাছে দাঁড়িয়ে তিনি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলেন। দেখলেন বিছানাপত্তর বোচকা ইত্যাদি নিয়ে রাজাকাররা আয়ল্যাণ্ডের টেন্টের ভেতরে ঢুকছে।
 নিউ ইস্কাটনের বাসায় ফিরে এসে তিনি খবর দিলেন অন্যান্য গেরিলা বন্ধুদের। সবাইকে নিয়ে বৈঠক হল। ফার্মগেট চেকপোেষ্ট্র হামলা করার পরিকল্পনা তাদের অনেক দিনের। শুধু সুযােগের অপেক্ষায় তারা দিন গুণছিল। বৈঠক স্থির হল, আর দেরি নয় । আজকেই হামলা চালাতে হবে। এক ঢিলে তিন কিসিমের চিড়িয়া বধের এমন সুযােগটি ছাড়া উচিত নয়। তাছাড়া রাজাকারদের উপদ্রব বড়ড় বেড়ে গেছে। ওদের কিছু সবক দেয়া দরকার। অপারেশনের সময় ঠিক হল ঃ রাত আটটা থেকে আটটা পাঁচ মিনিট। দুপুর বেলা হল প্রথম দফা রেকি’। এসময় দেখা গেল ফার্মগেট ও গ্রীন রােডের সঙ্গমস্থলের বা পাশে নির্মীয়মাণ সিনেমা হলটির ছাদে একটি লাইট মেশিনগান নিয়ে পাহারা দিচ্ছে একজন খানসেনা। এই রেডি ওয়ার্কের পর ঠিক হল, মূল এয়ারপাের্ট রােডের উপর থেকে অপারেশন করতে গেলে লাইট মেশিনগানের নলের মুখে তারা পুরােপুরি এক্সপােজড় থাকবে। তাই ঠিক হল, গেরিলারা গিয়ে পজিশন নেবে আয়ল্যাণ্ডের পেছন দিকে অর্ধচক্রাকারে। অর্থাৎ উত্তরে ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং কর্পোরেশনের ব্যাংকের কোণা থেকে দক্ষিণে মেহেরবান রেষ্টরেন্টের কোণা অবধি তারা দাড়িয়ে পড়বে। গাড়ি থাকবে হলি ফ্যামিলি কলেজের গলিমুখে। অপারেশনের পর সুবিধা মতাে পথে তারা পালিয়ে যাবে।
 
সন্ধ্যা সাতটায় একটি ফোক্স ওয়াগন গাড়িতে করে ফাইন্যাল রেকি’ করে এল। আলম ও সামাদ। তারা দেখল পরিস্থিতি ও অবস্থান আগের মতােই রয়েছে। শুধু মিলিটারীরা নেই। চেকপােষ্টে রয়েছে মিলিটারী পুলিশ্র ও রাজাকার আয়ল্যাত্তের দক্ষিণে “অবাঙ্গালি মালিকানাধুনি রেস্তোরাঁয় মােটামুটি লােকজন ও ক্রেতার ভীড় রয়েছে। রাস্তা দিয়ে। -মিলিটারী জীপ ও কনভয় আগের মতােই হরদম আসা-যাওয়া করছে। নির্মীয়মাণ। প্রেক্ষাগৃহে এলএমজি নিয়ে খানসেনাও রয়েছে প্রহরারত। ঠিক হল, গাড়ি থেকে নেমে পজিশন নেয়ার পর ওপেনিং কমাণ্ড দেবে বদি। এক *মিনিট ব্রাশ ফায়ারের পর স্বপন দেবে পালিয়ে যাওয়ার ক্লোজিং কমাণ্ড। পালিয়ে যাওয়ার। আগে জুয়েল ও পুলু ছুঁড়ে দেবে আগুনে ফসফরাস বােমা ও গ্রেনেড-৩৬। ঠিক ৭-৫০। মিনিটে নিউ ইস্কাটনের সামাদ ভাইয়ের বাড়ি থেকে একটি গাড়িতে গেরিলারা রওয়ানা হল। এবার আর আগের ফোক্সওয়াগনটি নেওয়া হল না। এবারকার গাড়ি একটি সবুজ। টয়ােটা। গাড়ি ফার্মগেট দ্বিতীয় রাজধানী সংযােগস্থলের গােল ট্রাফিক ষ্ট্যাণ্ডটি ঘুরে এগিয়ে। ‘গেল । ভাবখানা এই যে তেজগাঁও শিল্প এলাকার যাচ্ছে। বেশ ধীরগতিতে চারদিকে দেখতে দেখতে গাড়িটি এগােচ্ছিল। হলিক্রস কলেজ অভিমুখী গলির কাছে এসে গাড়িটি চট করে গলির মধ্যে ঢুকে গেল। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর গাড়িটি আবার পিছু ফিরে ফেলে আসা পথের পানে যেতে লাগল। গলিমুখ থেকে খানিক দূরে থাকতেই গাড়ির। ইঞ্জিন বন্ধ করে গীয়ার নিউট্রাল করে দেয়া হল। নিভিয়ে দেয়া হল হেডলাইট। তারপর। নিঃশব্দে ইঞ্জিনের জমানাে শক্তিতে গাড়িটি গিয়ে থেমে পড়ল গলিমুখে।
নিঃশব্দে গাড়ির সবকটি দরজা খােলা রাখা হল। ড্রাইভিং আসনের কাছে দরজার মুখে রিভলভার উচিয়ে দাড়িয়ে পড়ল সামাদ ভাই। তার ঠিক এক মিনিট অর্থাৎ আটটা। এক মিনিটের সময় কমাণ্ড হল-ফায়ার’। এক মিনিট পয়ত্রিশ সেকেণ্ড পর পালিয়ে যাওয়ার আগে ছুঁড়ে দেয়া হল গ্রেনেড ও ফসফরাস। কিন্ত ওগুলাে ফুটল না। ভলে ও দু’টোতে ডেটোনেটর ফিউজই লাগান হয়নি। ফার্মগেট অপারেশনের পর ঐ এলাকার হালত পরবর্তী কয়েকদিন কেমন ছিল তার বিবরণ স্থানীয় এক বাসিন্দার জবানীতেই শুনুন । ঐ এলাকায় ভদ্রলােকের একটি সিমেন্টের। দোকান রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বাপরে বাপ! কাণ্ড দেইখ্যা তাে আমার চুল খাড়া। বুঝলেন, বড় জব্বর সাব্বাসির কাম কইরা গেছে। এগারােডা লাশ রাইতকা আইয়া খানেরা সরাইল। আর হেই কাম করনের লাইগ্যা বড় বড় নলঅলা বন্দুক লাগানাে জীপ লইয়া মরদেরা আইল। বালতি বালতি পানি ঢাহল রক্ত ধুইল। আমার তাে মনে কইবার লাগছে যে মরদেরা তহনও ঠ্যাঙ্গে ঠ্যাঙ্গে বাড়ি খাইতাছিল। পরদিন সকালে গেরিলাদের একজন রেকিতে গিয়ে দেখল, এলাকার দোকানপাট  বন্ধ, ব্যাংক খােলেনি, চেকপােষ্টে খানসেনা গরহাজির। (সূত্র : ঢাকায় নােরিলা অপারেশন, হেদায়েত হােসেন মােরশেদ)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত