You dont have javascript enabled! Please enable it!
গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন আক্রমণ

বিদ্যুৎ চমকের মতাে এক ঝলক আলাে। তারপর প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে আরেকটি। তারপর নিকষ কালাে অন্ধকারের মধ্যে লক লক করছে আগুনের শিখা। দেখতে দেখতে আগুনের ফণা মাথা তুলে দাঁড়াল অদূরের তেতলা বাড়িটিরও অনেক উপরে। খানিকটা ধোঁয়াটে ধরনের লালচে আগুন। ওতে অন্ধকারের ডুবে যাওয়া পথ আলােকিত হয়নি। বাতাসে ট্রান্সফর্মার কয়েলের পােড়া গন্ধ।  রাত আটটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। ঠিক দু’মিনিট আগে পৌনে ন’টায় এই বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়েছে গােটা গুলবাগ, শান্তিবাগ, মালীবাগ, খিলগাওঁ, শান্তিনগর ও মগবাজার এলাকা। বিধ্বস্ত হয়েছে ওয়াপদার ৩৩/৩১ কেভি খিলগাও পাওয়ার সাব-ষ্টেশন (যা গুলবাগ পাওয়ার ষ্টেশন নামে পরিচিত)। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ এমভি -এ বিশিষ্ট ট্রান্সফর্মার। ইন্দ্রপুরী পুকুরের কোণায় রেল সড়ক অভিমুখী রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওরা আটজন—পুলু, সাঈদ, জুয়েল (পরবর্তী পর্যায়ে শহীন হন), হানিফ, মুখতার, মােমিন, মালেক ও বাশার। এর মধ্যে কয়েকজন চলে গেল মালীবাগ চৌধুরী পাড়ায় সাঈদের বাসায়। বাকী চারজন রেল সড়ক ধরে রওয়ানা হল শাহজাহানপুরের দিকে। চারদিকে অন্ধকার। গুলবাগ ষ্টেশনের আগুনের দিকে তাকিয়ে ওদের একজন বলল, ‘বিস্ফোরণের এত বড় শব্দ হবে ভাবতেও পারিনি। বাপরে বাপ! কি আগুন!’ আরেকজন বলল, ‘ট্রান্সফর্মারটি ছিটকে গিয়ে বােধহয় একটি বাড়ির উপর পড়েছে। কি হল কে জানে। গুলবাগ স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় হানিফ একটি ৫ ব্যাটারীর টর্চ নিয়ে এসেছিল। অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে সে বলল, চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ এই আলাে দেখে আশপাশের লােক বােধহয় ভাবছে যে ভূত যাচ্ছে।

এমনি সময় তারা শুনতে পেল দূর থেকে ঝড়ের মতাে ধেয়ে আসা প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ। ওদের একজন বলল, ‘এবার উলান গেল।’ ওরা ছিল গুলবাগ পাওয়ার ট্রান্সফর্মার উড়ানাের নায়ক। এই অপারেশনে ব্যবহৃত হয়েছিল ৪০ পাউণ্ড পিকে। দুটো ট্রান্সফর্মারের জন্যে বানানাে হয়েছিল ২০ পাউণ্ড পিকে, এর দুটি চার্জ। দুটো ট্রান্সফর্মারের গায়ে দুটো চার্জ বেঁধে সংযােগ করা হয়েছিল ২৪ ফুট প্রাইমা কর্ড বা বিস্ফোরক কর্ড এক্স । কর্ডের দৈর্ঘ্যের ঠিক মাঝ বরাবর বসানাে হয়েছিল ডেটোনেটর ২৭ ফিউজ। ওয়্যার দেয়া হয়েছিল ১ মিনিটের।  অপারেশনে অংশগ্রহণকারী ক্র্যাক প্লাটুন’-এর গেরিলাদের হাতে অস্ত্র ছিল—-হানিফ ও জুয়েলের হাতে দুটি ষ্টেনগান, মুখতার ও সাঈদের হাতে দুটি ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) শরীফুল হকের বাড়ি ধানমন্ডী ২৮ নম্বর রােডের একটি বাসা থেকে গেরিলারা এই আরভি’ তে আসে।  আর-ভি’ থেকে গেরিলাদের একজন এলেন ফাইনাল রেকি ওয়ার্ক’ করতে। সে গিয়ে জানাল, পাওয়ার স্টেশনের গেটে ভেতরের দিকে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ চেয়ারের উপর বসে মজাসে দাঁত খিলান করছে। তার রাইফেলটি দুই-তিন হাত দূরে রাখা। পাওয়ার স্টেশনের পাশে একটি বাড়ির প্যাসেজ দেয়াল ঘেঁষে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। ও জায়গাটি অন্ধকার। তবে একটি অসুবিধা রয়েছে। স্টেশনের গেটের লাগােয়া ওপাশে যে পান ও মুদী দোকানটি রয়েছে তার সামনে চার-পাঁচজন লােক বসে আড্ডা মারছে।
অবস্থা অনুসারে পরিকল্পনা ঠিক হল। আর ভি’ থেকে সবাই বেরিয়ে এল। মুখতার, সাঈদ, জুয়েল, হানিফ ও মােমিন তৈরি হল অপারেশনের প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্যে। বাকী সবাই গা-ঢাকা দিয়ে রইল সেই বাড়ির পাশে অন্ধকার। প্যাসেজে।।  প্রথমে এগিয়ে গেল মুখতার ও সাঈদ কম্যাণ্ডো নাইফ নিয়ে পুলিশকে নিরস্ত্র ও কজা করার জন্যে। দোকানের সামনের লােকগুলাে চুটিয়ে আড্ডা মারছে। দোকানদার দেখল দু’জন খদ্দের এসেছে। সে জিজ্ঞেস করল- কি নেবেন ভাই। কোনাে জবাব এল না; শুধু আলােয় চক চক করে উঠল দুটো নাইফ বা বেয়নেট। আড্ডা দেয়া লােকগুলাে কাণ্ডকারখানা দেখে হতবাক। এর মধ্যে একজন ছুটে পালাতে চাইল। জামার কলার টেনে ধরে তাকে থামানাে হল। বলা হল, হল্লা করলে সবাইকে শেষ করে দেব। আমরা গুণ্ডা, ডাকাত নই। আমরা মুক্তিবাহিনীর লােক, তােমাদের ভাই। ভেতরে চল।’ সুড় সুড় করে সবাই গিয়ে ঢুকল গেটের ভেতরে । দোকান তেমনি ভােলা পড়ে রইল। গেটের কাছে ভেতরে প্রহরারত পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশটিকে হ্যাণ্ডস আপ করাল জুয়েল। ষ্টেনগান হাতে একটি তরুণকে হঠাৎ ভেতরে ঢুকতে দেখে সে মুকুত বলে চিল্লিয়ে উঠেছিল। কিন্তু জুয়েলের ধমক খেয়ে সে আর সাড়াশব্দ করেনি। হ্যাণ্ডস আপ করে সে শুধু একবার বলেছিল-লেকিন, ষ্টেশন কি আরমে তাে কারফিউ হ্যায়।’ এই সময় হানিফ স্টেশনের অপারেটর রুমে গিয়ে অন্যান্য কর্মচারীদের হ্যাণ্ডস আপ করল। গেট থেকে জুয়েল সেখানে পুলিশটিকে নিয়ে এল। তারপর সবাইকে নিয়ে ঢােকানাে হল পাশের একটি কক্ষে। এদিকে মােমিন ততক্ষণে কাটার দিয়ে ষ্টেশনের টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে।
স্টেশনের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার আসার পর শুরু হল দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। দলের বাকী সবাই এসে স্টেশনে প্রবেশ করল। ট্রান্সফর্মারে চার্জ ফিট করতে লেগে গেল পুলু। সাথে রয়েছে বাশার। গেটের ভেতরে পুলিশ যেখানে ডিউটিতে ছিল সেখানে চলে গেল মােমিন। দোকানের কাছে অবজারভেশনের জন্যে চলে গেল সাঈদ। স্টেশনের ভেতরে ষ্টেনগান নিয়ে পাহারা দিতে লাগল জুয়েল। এদিকে এক মজা হয়েছে। একজন খদ্দের এসেছে দোকানে পান সিগারেট কিনতে। দোকান খালি, দোকানী নেই, সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপরিচিত এক লােক। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অধৈর্য হয়ে অপরিচিত লােকটিকে জিজ্ঞেস করল, দোকানদার তাে এখান এল না। আপনি তাে বললেন পাওয়ার হাউজের ভেতরে গেছে। এতক্ষণ কি করছে সেখানে?’ সাঈদ বলল, “ওই তাে গেটের ওপাশেই রয়েছে। আমাকে বলে গেছে দোকানের দিকে লক্ষ্য রাখতে। আপনার খুব বেশি দরকার থাকে তাে গেটের কাছে গিয়ে ডাক দিন না।’  ফাঁদে পা দিল খদ্দেরটি। মূল গেটের পাশে দাঁড়াতেই বেয়নেই বের করে সাঈদ বলল, চেঁচমেটিচ করবেন না, ভেতরে ঢুকে পড়ন লক্ষী ছেলের মতাে। থতমত খেয়ে যাওয়া লােকটি ভেতরে ঢুকতেই মােমিন বলল, “আসুন, আরেকটু কষ্ট করুন। ও ঘরে গিয়ে একটু আরাম করুন। এই তাে ব্যাপার্টির বাদ্য শুনলেন বলে।
এমনি করে আরাে একজনকে ভেতরে ঢােকানাে হল। এদিকে প্রথমবার চার্জ ফিট করার পর পুলু দেখল যে ভাবে ফিট করা হয়েছে তাতে ট্রান্সফর্মার বিধ্বস্ত হবে, বেস বার’ উড়ানাে যাবে না। তাই সে নতুন পজিশনে চার্জ বসাল। তারপর সবাইকে জানিয়ে দিল ‘ওকে সিগন্যাল। কক্ষের মধ্যে আটক করা লােকদের হুকুম দিল হানিফ, দু’হাতে কান চেপে মেঝেতে সটান উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন। মাথা তুলবেন কি গুলি করব।  সবাই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল হানিফ। স্টেশনের ভেতর থেকে পুলু ও জুয়েল ছাড়া বাকী সবাই গেটের কাছে চলে গেল। স্টেনগান হাতে জুয়েল কাভার দিতে লাগল পুলুকে। আটটা চুয়াল্লিশ মিনিটে পুলু করল ইগনাইট। তারপর সেই প্রচণ্ড ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ । ছিটকে উড়ে গিয়ে একটি ট্রান্সফর্মারের মুণ্ডু পড়ল পাশের এক বাড়ির টিনের চালের উপর। গেরিলাদের ধারণার বাইরে এবং তাদের অনুতাপের নিঃশ্বাস নিয়ে মারা গেল একটি বালিকা। কিন্তু একটি জীবনের বিনিময়ে এই বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিল অধিকৃত ঢাকা নগরীর হানাদারদের, বাড়িয়ে দিল জনগণের মনােবল।
রেলওয়ে সড়ক ধরে যারা শাহজাহানপুর বাজারের দিকে যাচ্ছিল তারা পরে এক মজার ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে তারা এগিয়ে চলছে। এই বুঝি মিলিটারী তাদের দেখে ফেলে! শাহজাহানপুর বাজারের কাছে এসে তারা চিন্তায় পড়ল, যাত্রাবাড়ী যাবে কি করে (যাত্রাবাড়ীতে তখন তাদের ক্যাম্পে)। হঠাৎ দেখতে পেল একটি মােটরসাইকেল আসছে। তাকে থামানাে হল। বলা হল, আমাদেরকে মােটরসাইকেলটি দিতে হবে। আরােহী দ্রলােক বললেন, বারে বা, মামার বাড়ির আবদার নাকি। বার করা হল ষ্টেনগান। আরােহী দ্রলােক বললেন, ‘ও বুঝেছি। গাড়ি যখন নেবেনই তখন নেন। গাড়িতে চেপে বসল চারজন গেরিলা। যখন স্টার্ট দিয়েছে তখন ভদ্রলােক বললেন, ‘আরে শােনেন। ভুলে গেছি। গাড়ির মধ্যে হরলিক্স আছে। গাড়ি নেবেন তাে নেন, কিন্তু আমার হরলিক্স দিয়ে যান। (সূত্র : ঢাকায় সােরিলা অপারেশন, হেদায়েত হােসেন মােরশেদ)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!