You dont have javascript enabled! Please enable it! দুঃসাহসিক উলান অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
দুঃসাহসিক উলান অপারেশন

অপারেটর রুমের বারান্দায় একজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ। ইজিচেয়ারের উপর কাত হয়ে ঝিমুচ্ছে। গাজী দস্তগীর (গফুর) এবং মতিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গাজীর হাতে স্টেনগান। পাওয়ার ষ্টেশনের গেটের পাশে প্রাঙ্গণে আরাে কয়েকজন পুলিশকে হ্যাণ্ডস আপ অবস্থায় লাইনে দাঁড় করিয়ে ষ্টেনগান হাতে পাহারা দিচ্ছে নীলু। দলের সব রয়েছে অন্যান্য অবস্থানে। নিঃশব্দে সব কাজ চলছে। অপারেটর রুমের ভেতরে কয়েকজন লােকের সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বারান্দার লােকটির দিকে ষ্টেনগান তুলে অনুচ্চ কণ্ঠে গাজী বলল, হ্যাণ্ডস আপ’।  জোরে চেঁচিয়ে কথা বললে অন্যরা টের পেয়ে যাবে তাই তারা এমনি অনুচ্চকণ্ঠে, বলা চলে প্রায় ফিসফিস করে কথা বলে গেটের কাছে পুলিশকে হ্যাণ্ডস আপ করিয়েছে।বারান্দায় প্রহরীটি কিন্তু কোনাে দিকে খেয়াল নেই। অর্ধনিমীলিত চোখে গাজী দস্তগীরের দিকে সে একবার তাকিয়ে আবার ঝিমােতে শুরু করল। গাজী আবার বলল। চোখ দুটো তেমনি ঢুলুঢুলুভাবে গাজীর দিকে বারেকেরে জন্যে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আবে যা যা মজাক মাত কর’ গাজী দস্তগীর ও মতিন হতবুদ্ধি। ব্যাপার কি? লােকটি কি তাদেরকে নিজের লােক মনে করছে? নাকি এটা কোনাে ট্রাপ? প্রহরীটি কি চালবাজি করছে? চারধারে কি কেউ কোথাও লুকিয়ে রয়েছে? প্রহরীটি কি মনে করে ইজিচেয়ারের উপর নড়েচড়ে বসল। তেমনি ঢুলু ঢুলুভাবে ষ্টেনগানের নলের উপর হাত রাখল। এবার সে চোখ দুটো টেনে মেলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল গাজীর দিকে। হাত দিয়ে চোখ দুটো কচলে নিল। ভয়ে-বিস্ময়ে তার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে। হঠাৎ সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতাে ইজিচেয়ার থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দু’হাত উপরে তুলে বলল, ‘হাম কোই কসুর নহী কিয়া সাব।

হামকো ছােড় দিজিয়ে। গুলি মাত কিজিয়ে সাব।’ প্রহরীর হাউমাউ আর চেঁচামেচি শুনে অপারেটরন রুম থেকে দু’জন লােক এগিয়ে এল বারান্দার দিকে। গাজী ও মতিনকে দেখেই তারা পেছন ফিরে ঘরের ভেতরে ছুটে পালাতে চাইল। গাজী বলল, “খবরদার! দৌড় দিলে গুলি করব।’ তারপর বারান্দার সেই প্রহরীসহ তিনজনকে ষ্টেনগানের নল উঁচিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ঘরের ভেতর। অপারেটর রুমে গিয়ে গাজী ও মতিনের চোখ ছানাবাড়া। চারদিকে সুইচ আর সুইচ! ঘরের মধ্যে তাকাতে গিয়ে দেখতে পেল এককোণে একজন লােক জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। নামাজে দাঁড়ান অবস্থায়ই সে ঘাড় ফিরিয়ে গাজী ও মতিনের দিকে তাকাল। তারা কিছু না বলতেই সে নীরবে জায়নামাজের উপর দাড়ান অবস্থায় হ্যাণ্ডস আপ’ করল। দু’হাঁটুতে তখন তার কাঁপন জেগেছে। গাজী জিজ্ঞেস করল ট্রান্সফর্মারের কাছে যাওয়ার রাস্তা কোন দিকে? কর্মচারীদের একজন কোণের একটি দরজা দেখিয়ে বলল, ওদিকে! আমার সাথে আসেন স্যার।  মতিনের হাতে একটি রেস্কিনের ব্যাগে রয়েছে বিস্ফোরক সামগ্রী। গাজী ও মতিন সেই চারজন লােককে নিয়ে এগিয়ে গেল উলান পাওয়ার স্টেশনের ৩০/৪০/৫০/ এম ভি এ পাওয়ার ট্রান্সফর্মারের দিকে। দলের আর চারজন সহযােগী গেরিলা বা বিচ্ছ তখন উলান পাওয়ার স্টেশন প্রাঙ্গণ ও ভবনের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে রয়েছে, আগলে রেখেছে পাওয়ার স্টেশনে প্রহরারত পুলিশ ও দারােয়ানদের। উলান পাওয়ার স্টেশনে গেরিলাদের অপারেশনের বৃত্তান্ত দিতে গেলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হয়।
৪ ক্র্যাক প্লাটুন
ওরা ছিল অধিকৃত ঢাকা নগরীতে কর্মরত ক্র্যাক প্লাটুন’-এর গেরিলা বা বিচ্ছ। আর সবাইর মতাে তাদেরও উদ্দেশ্য হানাদার পাকবাহিনীর সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গ রাজধানী ঢাকা নগরীতে মুক্তিবাহিনীর অস্তিত্ব ঘােষণা। প্রথম দফায় এসে তারা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সমুখের গাড়িসমূহে, ওয়াপদা গেট, পুরানা পল্টন, বিভিন্ন সিনেমা হল ইত্যাদি জায়গায় হাতবােমা নিক্ষেপ করে। এরপর তারা চলে যায়। অধিক সংখ্যায় বিভিন্ন ধরনের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র নিয় তারা আবার কিছুদিন পর ঢাকায় প্রবেশ করে। তাদের এ পর্যায়ের কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম হল অধিকৃত ঢাকা নগরীতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাওয়ার-স্টেশনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়া। ঢাকার মােট ৫টি পাওয়ার স্টেশন ঃ (১) উলান পাওয়ার স্টেশন ( একটি ট্রান্সফর্মার ১৩২/৩৩ কেভি; ৩০/৪০/৫০ এম ভি এ) (২) খিলগাও পাওয়ার সাব-স্টেশন (গুলবাগ পাওয়ার সাব-স্টেশন নামে পরিচিত। ৩৩/৩১. কেভি। দুটি ট্রান্সফর্মার-৫ এমভিএ করে); (৩) কমলাপুর পাওয়ার সাব-স্টেশন’ (৪) শাহবাগের পেছনে ধানমণ্ডী পাওয়ার হাউস এবং (৫) তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে পাওয়ার হাউস।
একই রাতে, একই সময়ে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু এর মধ্যে প্রথম দুটি ছাড়া বাকী তিনটি মিশন নানা কারণে সফল হতে পারেনি।ঢাকা নগরীকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেয়ার জন্যে গেরিলারা পরিকল্পনা নিয়েছিল বেশ আগে থেকেই। প্রথমে পাওয়ার লাইন ও কেবল লাইন উড়িয়ে দেয়ার তৎপরতা শুরু হল। কিন্তু দেখা গেল এক-দেড়দিনের মধ্যেই তা খানসেনারা ঠিক করে ফেলেছে। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা তাদের অপারেশন চালানাের পরিকল্পনা প্রস্তুতি পর্বে দু’জন ইঞ্জিনীয়ারের সহযােগিতা ও সাহায্যে নিলেন। এজন ছিলেন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ার জনাব নজরুল ইসলাম। পর তিনি শাহাদত বরণ করেন।  তারা বললেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী যে ৬টি লাইন ঢাকায় ৬টি স্টেশনে এসে যেখান থেকে অন্যান্য পাওয়ার স্টেশনের মাধ্যমে বিতরিত হচ্ছে সেই ৬টি পাওয়ার স্টেশন ও তার ট্রান্সফর্মারগুলাে উড়িয়ে দিতে পারলে পুরাে ঢাকা নগরী অন্ধকারের নিমজ্জিত হবে। বন্ধ হবে নগরীর কর্মপ্রবাহ। এই দু’জন ইঞ্জিনিয়ার বিভিন্ন ট্রান্সফর্মারের ছবি ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের সরবরাহ করলেন। কিভাবে এই ট্রান্সফর্মার নষ্ট করা যাবে তা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরা ডায়াগ্রাম এঁকে বুঝিয়ে দিলেন।
ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা বেশ কয়েকবার বৈঠকে মিলিত হবার পর ঠিক করল যে, ৬টি পাওয়ার স্টেশনে অপারেশন করার মতাে লােকবল তাদের নেই। তাই তারা ৫টি পাওয়ার স্টেশনে ৫টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু এই পাওয়ার স্টেশন নির্বাচনে তাদের কিছুটা ভুল হয়ে গেল। আসলে উলান, খিলগাঁও বা গুলবাগ এবং কমলাপুর পাওয়ার সাব-স্টেশন ছাড়া তাদের নির্ধারিত বাকী দুটি পাওয়ার স্টেশনের কোনটাই সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে চলে আসা মূল লাইনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত ট্রান্সফর্মার বিশিষ্ট সাব-স্টেশন ছিল না। উল্লেখযােগ্য, প্লাটুনের বিশিষ্ট সদস্য সামাদ সাহেবের নিউ ইস্কাটনের বাসা এবং ধানমী ২৭ নম্বর রােডে চুলু সাহেবের বাসায় এসব প্রস্তুতি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বর্জনের জন্যে আহ্বান জানানাে ঢাকা বাের্ডের এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগের রাতে এই অপারেশন করার সিদ্ধান্ত প্রথমে নেয়া হয়েছিল। পরে অপারেশনের দিন ধার্য হয় ১৯শে জুলাই। ঠিক হয় যে রাত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নয়টার মধ্যে সবক’টি অপারেশন করা হবে।
উলান অপারেশনের জন্যে নির্বাচিত হন গাজী দস্তগীর (গফুর), মতিন নম্বর এক, মতিন নম্বর দুই, জিন্না, নীলু ও হাফিজ। এর মধ্যে হাফিজ পরবর্তীকালে শহীদ হন। অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়া হয় গাজীর হাতে। ট্রান্সফর্মার উড়ানাের জন্যে ২০ পাউণ্ড পিকে ও ১৫ ফুট প্রাইমা কর্ড বা কর্ড-এক্স, প্রায় তিন মিনিট মেয়াদী সেফটি ফিউজ ওয়ার এবং ডেটোনাের লাগানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঠিক হয় দশ পাউণ্ড করে পিকের দুটি চার্জ প্রাইমা কর্ড দিয়ে সংযােজিত করে ট্রান্সফর্মারের দু’পাশে ফিট করা হবে। রামপুরা এলাকায় মঞ্জুর নামে একটি ছেলের বাসা নির্দিষ্ট হয় আর ভি’( যেখানে থেকে অপারেশন মিশনে যাত্রা শুরু করা হয়) হিসেবে। কাজের দায়িত্ব ভাগ হয় এভাবে—(১) গাজী ও নীলুর হাতে থাকবে ষ্টেনগান। অপারেশন কার্যক্রমে তারা হবে অগ্রবর্তী দল । (২) এক নম্বর মতিন ট্রান্সফর্মারের গায়ে চার্জ বসাবে, দুই নম্বর মতিন টেলিফোনের লাইন কেটে দেবে। ষ্টেনগানের সাথে আরাে নেয়া হয় গ্রেনেড-৩৬।
কথা ছিল, সন্ধ্যা সাতটায় হাফিজ ভাইরের বাড়ি থেকে হাফিজ ভাইয়ের ফিয়াট গাড়িতে চড়ে তারা রওয়ানা হবে উলান পাওয়ার স্টেশনের দিকে। রামপুরার অদূরে একটি বাড়িকে করা হয়েছে ‘আর ভি’ । সেখান থেকে ঐ ফিয়াটে চেপে নিদিষ্ট সময়ে তারা যাত্রা শুরু করবে মূল অপারেশনের জন্যে। কিন্তু হঠাৎ অপারেশনে রওয়ানা হবার আগে মুহূর্তে গাড়ি গেল বিগড়ে। রাত আটটা বেজে গেল। কিন্তু গাড়ি ঠিক হল না। তখনও বিস্ফোরক অর্থাৎ পিকে চার্জ বাঁধা হয়নি। সাড়ে আটটা বেজে গেল। এর মধ্যে বিস্ফোরক চার্জ বেঁধে নেয়া হয়েছে। রেক্সিনের একটি ব্যাগের ভেতরে ওগুলাে তুলে দেয়া হল। আর ভি’ থেকে যখন বেরােবে তখন তারা শুনতে পেল দূর থেকে ভেসে আসছে গুলির শব্দ। চাইনীজ এমএমজির ব্রাসের শব্দ। নীলু বলল, “কোথায় জানি অঘটন ঘটে গেছে।’ হ্যাঁ, তাই। কারণ ওদের প্রতি নির্দেশ ছিল পরাতপক্ষে তাদের কোন গ্রুপই যেন গুলি না ছেড়ে।  গুলির শব্দে আতংকগ্রস্ত হয়ে আশেপাশের লােকজন যে যার বাসায় ঢুকে পড়েছে। বাড়ির লাইট নিভিয়ে দিয়েছে। এস্তগতিতে বন্ধ করে দিচ্ছে ঘরের জানালা। গলি থেকে ওরা বেরিয়ে এল রামপুরা ডি. আইটি রােড। এমনিতেই ওখানে তখন কোন ষ্ট্রীট লাইট নেই। তারা তিনটি রিকশা ভাড়া করল। প্রথম রিকশায় উঠল গাজী ও নীলু। তাদের পায়ের আড়ালে ভঁজ করে লুকানাে রয়েছে ষ্টেনগান।
রামপুরা ডিআইটি রােড থেকে রিকশা পথ নিল উলান। রাস্তায় আলাে নেই। অসমান কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে রিকশার চাকা গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কেমন একটা শব্দ হচ্ছিল। আশেপাশের বাড়ি-ঘরের জানালা বন্ধ। দু’য়েকটি জানালার ফাঁক গলিয়ে দেখা যাচ্ছে আলাের ইশারা । সামনের রাস্তাটি গলির মধ্যে কিছু দূর যাওয়ার পর নীলু পেছন দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আরে! বাকী রিকশা দুটো কোথায় গেল?’ থামানাে হল রিকশা। গাজী দস্তগীর ও নীলু ভয় পেয়ে গেল। পেছনের ওরা আবার কোনাে ঝামেলায় পড়ল না তাে? নীলু রিকশা থেকে নেমে গেল হদিস নিতে। আর সব অপারেশনের মতাে উলানের বেলায় পুরােপুরি রেকি ওয়ার্ক করা সম্ভব হয়নি। বিপত্তি ঘটেছিল সে কারণেও। পেছনের রিকশার সাথীরা পথ ভুল করে সােজা এগিয়ে গিয়েছিল রামপুরা টেলিভিশন ট্রান্সমিশন কেন্দ্রের দিকে। রামপুরা টিভি স্টেশনে ছিল পাকসেনাবাহিনীর পুরাে এক কোম্পানী সৈন্যের দেখে তাদের একজন বলল, ‘আরে! গেট ছেড়ে চলে আসলা যে! কি ব্যাপার? কিন্তু তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না। দেখতে পেল কোথেকে যেন দুটো ষ্টেনগানের নল তার সামনে ছিটকে এসে দাঁড়াল। অপরিচিত কণ্ঠে চাপাস্বরে কে যেন বলল, হ্যাণ্ডস আপ। খবরদার চিৎকার করাে না।’ পুলিশট নিজেই হ্যাণ্ডস আপ’ বলে দু’হাত উপরে তুলে ধরে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, ‘লাইলাহা ইল্লা–।’ অপর পুলিশটি সটান উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে।  ষ্টেন হাতে গাজী ছুটে গেল ঘরের মধ্যে। সেখানেও নিঃশব্দে কাজ হল। সবক’টি পুলিশ বিনা বাক্যব্যয়ে হাত তুলে দাঁড়াল। পুলিশ ও দারােয়ানদের সবাইকে নিয়ে গেটের পাশে লাইন দিয়ে দাঁড় করান হল। ষ্টেন ও রাইফেল নিয়ে তাদের পাহারায় রইল নীলু ও দুই নম্বর মতিন। পুলিশ ও দারােয়ানদের বলা হল, ‘এক্ষুণি ব্যাণ্ডের বাজনা শুনতে পাবে। তার আগে যদি ছােটাছুটি করে পালাতে চাও তাহালে বেঘােরে মারা পড়বে। তারপর গাজী ও এক নম্বন মতিন এগিয়ে গেল ট্রান্সফর্মারের দিকে।
ট্রান্সফর্মার এলাকাটি ছিল তার-কাঁটার বেড়া দিয়ে ঘেরা। অপারেটর রুমের মধ্যে দিয়ে ওখানে যাওয়া যায়। অপারেটর রুমের বারান্দার প্রহরী ও রুমের তিনজন কর্মীকে নিয়ে গাজী ও মতিন পৌছল সেখানে। প্রায় দোতলা সমান উঁচু বিরাট ট্রান্সফর্মার। চারপাশে ইলেকট্রাড করার জন্যে পাথর বসান। সে এক এলাহী ব্যাপার! মতিন বলল, গফুর, ২০ পাউণ্ডে হবে তাে ভাই, হবে বাবা! এ যে দেখে পেল্লায় ব্যাপার! আর এই পাথরগুলাের আড়ালে মাইন টাইন বসান আছে কিনা কে জানাে?
গাজী দস্তগীরের মনেও একই প্রশ্ন। মতিন বলল, যা হবে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। মশলা (পিকে চার্জ) লাগিয়ে ফেলি। তার আগে একটু টেস্ট করা দরকার। স্টেশনের কর্মী ও পুলিশ চারজনকে জিজ্ঞেস করা হল ঃ ইলেকট্রিফায়েড করা নেই তাে? ওরা বলল না, নেই।’ গাজী বলল- যদি না থেকে থাকে তবে চারজন গিয়ে ট্রান্সফর্মারের চারপাশে দাঁড়িয়ে ওটার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে আসুন।  ওরা তাই করল। কোন বিপদ নেই জেনে মতিন এবার ট্রান্সফর্মারের গায়ে চার্জ বসাতে গেল। একটি চার্জ বসাল মতিন, বাকী চার্জটি বসানাের জন্যে দেয়া হল-অপারেটর রুমের একজন কর্মীর হাতে। চার্জ বসানাে হচ্ছে এমন সময় গুলবাগের দিক থেকে ভেসে এল বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আওয়াজ। খানিকটা পরই দেখা গেল আগুনের লেলিহান শিখা। এর কয়েক মিনিট পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল রামপুরা এলাকা। ধ্বংস হয়ে গেল ৩০/৪০/৫০ এমভি এ ট্রান্সফর্মারটি। ক্ষতির পরিমাণ ১৫ লাখ টাকা। এবং সেই ক্ষতিগ্রস্ত ট্রান্সফর্মারটি মেরামতেরও অযােগ্য হয়ে গেল।
অপারেশনের পর ফেরার পথে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা এক নতুন সংকটে পড়ল। স্টেশনের সমুখের কাঁচা রাস্তা দিয়ে তারা যখন ‘রিট্রিটি’ করছে তখন দেখল স্টেশনের পাহারাদার পুলিশরা ডিআইটির রাস্তার দিক থেকে ফিরে আসছে। তারা এসে বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে। ওদিকে আপনারা যাবেন না। রামপুরা টিভির মিলিটারীরা রাস্তার উপর পজিশন নিয়ে বসে গেছে।’ বলতে না বলতেই শােনা গেল এলএমজির টাটা-টা-টা শব্দ। এখন উপায়! বেরিয়ে যাওয়ার তাে এটাই একমাত্র পথ। পেছনে বিল। গেরিলাদের হাতে নিজেদের অস্ত্র ছাড়াও রয়েছে পুলিশদের কাছ থেকে ছিনেয়ে নেয়া রাইফেল। ঠিক হল বিল সাঁতরেই পালিয়ে যেতে হবে। চারদিকে অন্ধকার। বিলের পাড়ে এসে একটি গােপন স্থান বেছে স্টেন ও রাইফেলগুলাে পানির মধ্যে লুকিয়ে রাখা হল ( গেরিলারা পরে তা আবার উদ্ধার করতে পেরেছিল)। তারপর সবাই কাপড় চোপড় খুলে ফেলে দিগম্বর হয়ে ওগুলাে পানির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বিলের পানিতে। কখনাে বুক সাঁতার, কখনাে চিত সাঁতারে চলল। অপরিচিত বিল। অন্ধকার রাত, দিক ঠিক নেই। গাজীও কাছাকাছি থেকে সাতঁরে চলছিল। অনেক দূরে যাওয়ার পর তারা আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি দেখতে পেল। বাড়ির পায়খানার কাছে গিয়ে তারা উঠল। লােকজনকে ডাকাডাকি করায় প্রথমে কেউ সাড়া দিল না। পরে যখন বুঝতে পারল এরা মুক্তিবাহিনীর লােক তখন সবাই ছুটে এল। পানির মধ্যে ডুব দাড়িয়ে থাকা মতিন বলল, ‘ভাই, দু’টো লুঙ্গী দিন’।  সেই বাড়ির লােকেরাই বাকী তিনজনকে খোঁজ করে নিয়ে এল। (সূত্র : ঢাকায় গােরিলা অপারেশন, হেদায়েত হােসেন মােরশেদ)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত