You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুক্তিযুদ্ধে ফেনী
এপ্রিলের প্রথমভাগেই নােয়াখালীর ফেনী শহরে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন এই বাহিনীর সংগঠক ও নায়ক। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ও ইপিআর বাহিনীর জওয়ানরা, পুলিশ, আনসার, ছাত্র, সাধারণ মানুষ এরা সবাই এই বাহিনীর সামিল হয়েছিল। হাতিয়ার বলতে এদের ছিল কিছু রাইফেল আর বন্দুক। তাছাড়া বর্শা, বল্লম, লাঠিসােটা ইত্যাদিও ছিল। এই অস্ত্র সম্বল করে, সবকিছু জেনেশুনেও তারা কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য তৈরি হয়েছিল। তখন তারা ভাবতেও পারেনি যে, এর চেয়েও মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে ওরা তাদের উপর হামলা করবে। কিন্তু যখন সে সময় এল, তখন তাতেও পেছ-পা হয়নি তারা।  মুক্তিবাহিনী প্রস্তুতি নেবার জন্য বেশি সময় পায়নি। এপ্রিলের প্রথম দিকেই আক্রমণকারী পাকসৈন্যের একটা দল ফেনী শহর দখল করার জন্য মার্চ করে এগিয়ে এল। কিন্তু কাজটাকে যত সহজ বলে মনে করেছিল তা ঠিক নয়, কার্যক্ষেত্রে সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। ওরা ফেনী শহরে এসে পৌছবার আগেই মুক্তিবাহিনী তাদের পথ রােধ করে দাঁড়াল। যাকে বলে মুখােমুখি লড়াই তা নয়, মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা নিজেদের আড়ালে রেখে নানা দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে শত্রপক্ষকে এমনভাবে অস্থির করে তুলল যে, শেষপর্যন্ত ওরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পেছনে হটে যেতে বাধ্য হল। এই গেল প্রথম রাউন্ড। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই জয়-পরাজয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল না। এরপর দু’পক্ষের মধ্যে পরপর কয়েকবার সংঘর্ষ ঘটল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে আক্রমণকারীদের মুখ চুন হয়ে গেল। এই দুর্গম পথে, এই জীবনপণ করা দুর্ধর্ষ মুক্তিযযাদ্ধাদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ কথা নয়, তা করতে গেলে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। এই সত্যটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ওরা তখনকার মতাে স্থলপথে আক্রমণের কাজটা স্থগিত রাখল।
এইভাবেই মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ সংগ্রামের প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ মেজর জিয়াউর রহমান এবং তাঁর সহযােদ্ধারা একথা ভালভাবেই জানতেন, যুদ্ধের এইখানে ইতি নয়, সূচনা মাত্র। ওরা শীঘ্রই শক্তি বৃদ্ধি করে ফিরে আসরে। আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই, এবার প্রবলতর আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু সেজন্য ভয় করলে চলবে না। শত্রু যতই প্রবল হােক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েই যেতে হবে, আত্মবিশ্বাসে উদ্দীপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা এই দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করেছে। ফেনী শহর ও নিকটবর্তী গ্রামঞ্চলে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড লাঠির ঘায়ে পিছিয়ে গিয়ে জঙ্গীবাহিনীর নেতারা ফেনী শহরকে আক্রমণ করার জন্য এবার এক নতুন পরিকল্পনা তৈরি করল।  এপ্রিল মাসের মধ্যভাগ। একদিন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে দু’টো বিমান প্রচন্ড গর্জন তুলে সারা শহরটাকে প্রদক্ষিণ করে চলল। ওরা শুধু অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেই আসেনি, বােমারু বিমান দুটো ঘুরে ঘুরে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুর উপর বােমা ফেলে চলেছে। বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে সারা শহর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। সাধারণ মানুষ এমন একটা আকস্মিক ঘটনার জন্য একেবারেই প্রস্তত ছিল না। তারা উদভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। কিছু কিছু লােক হতাহতও হল। এই ভাবে কিছুক্ষণ বােমা ফেলে বিস্ফোরণ ঘটাবার পর সেই হিংস্র যন্ত্র-দানবগুলি স্বস্থানে ফিরে গেল।
পরদিন আবার ওরা এল। এসেই আগের দিনের মতােই বােমা ফেলে চলল। কিন্তু একটি দিনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শহরের সাধারণ মানুষ অনেক বেশি সাহস সঞ্চয় করেছে। বােমা বিস্ফোরণের মধ্যে কি করে আত্মরক্ষা করতে হয় সেই কৌশলটাও তারা কিছুটা আয়ত্ত করে নিয়েছে। তারা দিগ্বদিক্ জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতাে ছুটোছুটি করছিল , অথবা বহু লােক এক জায়গায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে ওদের হাতে আক্রমণের সুযােগ তুলে দিচ্ছিল না, তারা ঠান্ডা মাথায় আত্মরক্ষা করে চলেছিল। আর মুক্তিযােদ্ধারা? মুক্তিযােদ্ধারা কি করছিল? সেই ধ্বংসলীলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মেজর জিয়া নির্ভীক কণ্ঠে তেঁকে উঠলেন, মুক্তিবাহিনীর জওয়ান ভাইরা, আমরা মরবার জন্য তৈরি হয়েই এই দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছি, তবে আর আমাদের ভয় কি! কুছপরওয়া নেই, আমরা ঐ বিমান দুটোকে পাল্টা আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে ছাড়ব। মুক্তিযােদ্ধারা বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আমাদের হাতে তাে এন্টিএয়ারক্রাফ্ট কামান নেই, আমরা কেমন করে এই বিমানগুলােকে ধ্বংস করব?  হ্যাঁ, এন্টিএয়ারক্রাফ্ট থাকলে আমরা আগেই ওদের দফা রফা করে দিতে পারতাম। কিন্তু নাই বা থাকল তা, আমাদের রাইফেল তাে আছে। এই রাইফেল দিয়েই আমরা ওদের এমন শিক্ষা দেব, যা ওরা কোন দিন ভুলতে পারবে না। জওয়ান ভাইসব, শহরে যে সমস্ত উঁচু দালান আছে, তাদের উপর উঠে ওদের তাক করে গুলি চালাতে থাক। ভিয়েতনামের মুক্তিযােদ্ধারা এইভাবে শত শত মার্কিন জঙ্গী বিমান ফেলে দিয়েছে, আমরাই বা কেন পারব না? এক মুহুর্ত দেরি নয়, জওয়ান ভাইরা, ছুটে চল সবাই।
শুধু নির্দেশ দেওয়া নয়, মেজর জিয়া সবার আগে নিজেই রাইফেল বাগিয়ে ছুটলেন। রাইফেলধারী যােদ্ধারা ছােট ছােট দলে ভাগ হয়ে ছুটতে ছুটতে শহরের উঁচু উঁচু দালানগুলির ছাদে উঠে পড়ল। এই দালানগুলি যে কোন সময় বােমার আঘাতে ধসে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেজন্য মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই, বিন্দুমাত্র ভয় নেই। সবাই একমনে বিমান দুটোকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে চলেছে। তাদের এভাবে আক্রান্ত হতে হবে, বিমান চালকরা একথা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই তারা নিশ্চিন্ত মনে রাইফেলের নাগালের ভিতরে এসে গিয়েছিল। তারা জানত যে, সেক্ষেত্রে তারাই শুধু আক্রমণকারী। কিন্তু তারাও যে আক্রান্ত হতে পারে, এটা তাদের জানা ছিল না। কয়েকটা দালানের ছাদের উপর থেকে প্রায় একই সঙ্গে এক ঝাঁক রাইফেলের গুলি ছুটল। আর একই সঙ্গে সমস্ত মুক্তিযােদ্ধারা উল্লাসধ্বনি করে উঠল। একটা বিমানে আগুন ধরে গেছে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। জলন্ত বিমানটার অবস্থা দেখে অপর বিমানটা উধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল, দেখতে দেখতে আকাশ পথে মিলিয়ে গেল। গুলিবিদ্ধ বিমানটা উল্কার মতাে জ্বলতে জ্বলতে পূর্বদিকে ছুটল। ওটা একটু বাদেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। পরে জানা গিয়েছিল। জ্বলন্ত বিমানটার ধ্বংসাবশেষ ত্রিপুরার সীমান্তে গিয়ে পড়েছিল। জয়, মুক্তিবাহিনীর জয়! জয় স্বাধীন বাংলার জয়! বিজয়গর্বে উদ্দীপ্ত হাজার হাজার জনতার জয়ধ্বনিতে ফেনী শহর মুখরিত হয়ে উঠল। সবাই মেতে উঠল উৎসবে। মুক্তনগরীর বুকে স্বাধীন বাংলার পতাকা পপত্ করে উড়েছিল। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!