You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.01 | সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট - সংগ্রামের নোটবুক
সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট

সাক্ষাৎকার ঃ লেঃ কর্নেল শাফায়াত জামিল ১৯৭১ সনের ১লা মার্চ তারিখে আমি আমার চতুর্থ বেঙ্গলের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসি। আমার সাথে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আর একটা কোম্পানী ছিল যার কমান্ডার ছিল একজন পশ্চিমপাকিস্তানী সিনিয়ার মেজর। আমাদের পাঠানাের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণ মােকাবেলা করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে প্রতিরক্ষাব্যুহ্য তৈরি করা। এখানে বলে রাখা দরকার যে, চতুর্থ বেঙ্গলে আমিই বাঙালিদের মধ্যে সিনিয়র মােস্ট ছিলাম। আমরা চলে আসার পর কুমিল্লা সেনানিবাসে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরাে দু’কোম্পানী সৈন্য থেকে যায়।  ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমি সব সময় কুমিল্লা সেনানিবাসের দুই কোম্পানীর সাথে যােগাযােগ করতাম। এ ব্যাপারে আমি সুবেদার আবদুল ওহাবকে ব্যবহার করতাম।  মার্চের এক তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত কুমিল্লা সেনানিবাসের অস্বাভাবিক ঘটনাবলীঃ

১। আমাদের ইউনিট লাইনের চারিদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এবং জেসিওদের, বিশেষ করে আর্টিলারী বাহিনীর লােকদের অস্বাভাবিক গতিবিধি বা চলাফেরা।
২। রাতের বেলায় মেশিনগান আমাদের ইউনিট লাইন, অফিসারদের বাসস্থান, অস্ত্রাগার এবং কোয়ার্টার গার্ডের দিকে পজিশন থাকত। তাছাড়াও আমাদের ইউনিট লাইনের চারিদিকে উঁচু পাহাড়ে পরিখা খনন করে। জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘আমরা ট্রেনিং করছি।’
৩। ইউনিট লাইনে ব্রিগেড কমান্ডার ও ব্রিগেডের অন্যান্য অফিসারদের অপ্রত্যাশিত পরিদর্শন।
৪। আমাদের খেলার মাঠে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসার ও জেসিওদের সাথে ব্রিগেডের অফিসার ও জেসিওদের দৈনিক খেলাধুলার প্রতিযােগীতা (যেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ছয় মাসে একবার, দুবার হয়)। খেলার মাঠ রক্ষার জন্য অন্য রেজিমেন্টের প্রটেকশন পার্টিকে অস্ত্রশস্ত্রসহ নিয়ােগ করা।
৫। যদিও সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণের জন্য আমাদের পাঠানাে হয় তথাপি অস্বাভাবিকভাবে আমাদের উপর ছুটি ব্যাপারে কোন বাধানিষেধ আরােপ করা হয়নি। বরং চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার ও ব্রিগেড কমান্ডার জোয়ানদেরকে বলেন, যার যার ইচ্ছানুযায়ী ছুটি নিতে পারে। 
৬। মার্চ মাসের ১৮/১৯ তারিখে ইউনিট লাইনে রাত প্রায় বারােটার সময় গােলন্দাজ বাহিনীর একজন বাঙালি এসে খবর দেয় যে সেনানিবাসে আজ রাতে চতুর্থ বেঙ্গলের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা হামলা চালাবে। এ খবর পাওয়া মাত্রই ক্যাপ্টেন গাফফার, লেটেন্যান্ট মাহবুব, লেফটেন্যান্ট কবীর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের দু’কোম্পানী (যারা সেনানিবাসের ভেতর ছিল) নির্দেশ দেয় যে, সব জোয়ান নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র অস্ত্রাগার থেকে নিয়ে যেন নিজেদের কাছে রাখে। চতুর্থ বেঙ্গলের সৈন্যদের দেখাদেখি সেনানিবাসের অন্যান্য পাকিস্তানী ইউনিটও অস্ত্রশস্ত্র সহকারে তৈরি থাকে। সে রাতে কোন হামলা হয়নি। ২০শে মার্চ ভােরে সবাই আবার অস্ত্রাগারে অস্ত্র জমা দেয়। রাতে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র বের করার জন্য কারাে কাছে কোন কৈফিয়তও চাওয়া হয়নি। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার নিজে জেনেও উপরােল্লিখিত অফিসারদের কাছে কোন কৈফিয়ত চাননি।
৭। ব্রিগেড কমান্ডার, ব্যাটিলয়ন কমান্ডার সপ্তাহে একবার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিতেন, যেটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।
৮। ১০ই মার্চ, (১৯৭১) ১৭টি গাড়ি (রসদপত্র, তেল বােঝাই) কুমিল্লা থেকে সিলেট পাঠানাে হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের একজন সুবেদার সামসুল হক এবং দশজন (বাঙালি) লােককে এই কনভয়ের প্রটেকশনে পাঠানাে হয়। এই রসদপত্র ৩১, পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সিলেটের খাদিমনগরের উদ্দেশ্যে পাঠানাে হয়। এই কনভয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যও ছিল। দুই দিনে এই কনভয় কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আসে। রাস্তায় বেরিকেড ছিল । ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এই কনভয়কে নিয়ে সিলেটে পৌছাবার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড অতিক্রম করে খাদিমনগরে পৌঁছতে আমার তিন দিন লাগে। ১৫ই মার্চ আমি খাদিমনগরে পৌঁছি ও নির্দেশ মােতাবেক ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু আমাকে বলা হয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাকে ৩১ পাঞ্জাবের সাথে থাকতে হবে। এ খবর পাবার পর আমি কুমিল্লায় টেলিফোন করলাম। বাঙালি অফিসাররা বিশেষ করে ক্যাপ্টেন গাফফার, লেফটেন্যান্ট কবীর, লেফটেন্যান্ট মাহবুব এবং জেসিওরা কমান্ডিং অফিসারকে আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেন। ১৭/১৮ তারিখে আমি ও আমার চতুর্থ বেঙ্গলের অন্যান্য সৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমার কোম্পানীতে ফিরে আসি।  উপরােল্লিখিত ঘটনাবলীতে আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। আমি সুবেদার ওহাবের মাধ্যমে কুমিল্লা সেনানিবাসে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জেসিওদের কাছে খবর পাঠাতাম যে, কোনাে পরিস্থিতিতেই তারা যেন আত্মসমর্পণ না করে। যদি প্রয়ােজন হয় অস্ত্র নিয়ে তারা যেন বেরিয়ে আসে।
এই সন্দেহ এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি হবার পর আমার কোম্পানী এবং মেজর সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর উদ্বৃত্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আনা হয়। | ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা ওয়াপদা কলােনী সংলগ্ন স্থানে তাঁবুতে দুকোম্পানী থাকি। আমার আশংকা ছিল, এই দুকোম্পানী সৈন্যকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্রসমর্পণ করতে বাধ্য করবে। এই সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য আমি আমার কোম্পানীর এবং সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর জেসিওদের নির্দেশ দেই, যেন তারা আত্মরক্ষার জন্য আমাদের ক্যাম্পের চারিদিকে পরিখা খনন করে রাখে। আর যদি প্রয়ােজন হয় তবে ঐসব পরিখা থেকে আক্রমণ প্রতিহত করা যেতে পারে।
আমার এই সমস্ত কাজ খুব সাবধানে ও হুঁশিয়ারের সাথে করতে হয়। কেননা, মেজর সাদেক নেওয়াজ সব সময় আমাকে চোখে চোখে রাখত। সে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করত, পরিখা খনন করা, পজিশন নেয়া—এগুলাের উদ্দেশ্য কি? আমি বলতাম, ডিড়িং প্র্যাকটিস এবং পজিশন নেয়ার প্রশিক্ষণ রিভাইজ করা হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন কাজ এবং বিভিন্ন জেসিওদের সাথে যােগাযােগ, প্রভাবান্বিত করা এবং সতর্ক করার কাজে লেফটেন্যান্ট হারুন আমাকে সর্বতােভাবে সাহায্য করেন। সে এসব কাজে উৎসাহী ছিল এবং অন্যান্য লােকদের প্রেরণা যােগাত। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, কুমিল্লার সাথে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্যাম্পের যােগাযােগ। ছিল একমাত্র টেলিফোনের মাধ্যমে এবং একটি সিগন্যাল সেট যেটা অস্বাভাবিকভাবে কুমিল্লা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সাথে যােগাযােগ রাখত। এ সময় আমি খুব অস্বস্তিকর পরিবেশে ছিলাম। আমি সব সময় চিন্তা করতাম যে, কুমিল্লাতে অবস্থিত জুনিয়র। অফিসাররা যদি সময়মতাে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারে তাহলে হয়ত ব্যাটালিয়ানের অর্ধেক অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ এবং সৈনিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
 ২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় আমরা দেখতে পেলাম কুমিল্লার দিক থেকে ৮টা গাড়ির আলাে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ক্যাম্পের প্রটেকশন পার্টি পরিখাতে অবস্থান নেয়। গাড়ি কাছাকাছি আসার পর বুঝতে পারি, মেজর খালেদ মােশাররফ তার কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১২০ মাইল দূরে সমশেরনগরে নকশালপন্থী এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করার জন্য আসছেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে, মেজর খালেদ মােশাররফ যিনি আমার থেকে বাঙালিদের। মধ্যে সিনিয়র সেদিনই ব্যাটালিয়নে ঢাকা থেকে এসে যােগদান করেন এবং একই দিনে তাঁকে কুমিল্লা থেকে ১৭০ মাইল দূরে সমশেরনগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর চতুর্থ বেঙ্গলের একটি রাইফেল কোম্পানী আর হেডকোয়ার্টার কোম্পানী কুমিল্লা থেকে যায়।
সেই রাতে মেজর খালেদ মােশাররফ লেঃ মাহবুবকে সঙ্গে নিয়ে আসেন এবং তার কোম্পানী আমাদের ক্যাম্পে থাকে। মেজর সাদেক নেওয়াজের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির জন্য আমরা খােলাখুলি আলাপ আলােচনা করতে পারিনি। শুধু আভাসে, ইঙ্গিতে এটুকু বুঝাতে সক্ষম হই, যে কোনাে পরিস্থিতির মােকাবেলা করতে আমরা প্রস্তুত। সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন আমি আর লেফটেন্যান্ট হারুন খুব খুশি হই এই ভেবে যে, আমাদের পরিচালনার জন্য একজন পুরােনাে অভিজ্ঞ অফিসার চতুর্থ বেঙ্গলে যােগ দিয়ে কুমিল্লা থেকে আরাে একটি কোম্পানীকে মরণ ফাঁদ থেকে কনটেশনের আগেই বের করে নিয়ে এসেছেন।
মেজর খালেদ মােশাররফের নিকট একটা সিগন্যাল সেট ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার দিয়ে দেয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমার সেট এবং খালেদ মােশাররফের সেট যেন একই ফ্রিকুয়েন্সিতে যােগাযােগ করতে সক্ষম হয়। ২৪/২৫ তারিখ সকালে তিনি তার কোম্পানী নিয়ে সমশেরনগরের দিকে রওয়ানা হয়ে যান।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যাবেলায় কুমিল্লা থেকে নির্দেশ আসল যে, আরাে লােক আসছে। তাদের থাকার ও খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা থাকার ও খাবার ব্যবস্থা করেছি কিন্তু আমরা জানতাম না কারা আসছে। রাত আটটার সময় দেখলাম যে লেঃ কর্নেল মালিক খিজির হায়াত খান কুমিল্লায় অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাকি কোম্পানীগুলাে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে উপস্থিত হয়েছেন। এসে তিনি বললেন, যুদ্ধ আসন্ন। সেজন্য ব্রিগেড কমান্ডার তাঁকে কুমিল্লা থেকে চতুর্থ বেঙ্গলের প্রায় সব লােক নিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছেন। খিজির হায়াত খানের আসার পর চতুর্থ বেঙ্গলের অবস্থান নিম্নরূপ ছিল ।
(ক) এক কোম্পানী সমশেরনগরে–যার কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ।
(খ) তিন কোম্পানী—হেডকোয়ার্টার কোম্পানী আর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।
(গ) ৭০/৮০ জন লােক কুমিল্লায় ইউনিট লাইনের প্রহরায় নিয়ােজিত। 
(ঘ) এক প্লাটুন কুমিল্লার জাঙ্গালিয়া বিদ্যুৎগ্রীড স্টেশনের প্রহরায়। এর কমান্ডার ছিল নায়েব সুবেদার এম এ জলিল।
 খিজির হায়াত খান ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেই ২৫শে মার্চ রাত এগারােটায় আমাকে হুকুম দিলেন যে, আমি যেন আমার কোম্পানীর সৈন্য নিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে ১৩ মাইল দূরে শাহবাজপুর পুলের কাছে প্রতিরক্ষাব্যুহ্য তৈরি করি। রাত দু’টোর সময় রওয়ানা হয়ে তিনটায় শাহবাজপুরে পৌছি।
সকাল ৬টার সময় (২৬শে মার্চ) আবার খবর এল, কোম্পানী ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ফেরত যেতে হবে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। সকাল সাতটায় রওয়ানা হয়ে দশটায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছি। দশ মাইল আসতে তিন ঘন্টা লাগে; কেননা জনসাধারণ বড় বড় গাছ রাস্তার উপরে ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পৌছে দেখি সেখানে সান্ধ্য আইন জারী করা হয়েছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছার সাথে সাথে খিজির হায়াত খান আমাকে পুলিশ লাইনে গিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্র করার নির্দেশ দিলেন। আমি তাঁকে বললাম যে, নিরস্ত্র করতে গেলে খামাখা গন্ডগােল, গােলাগুলি হবে। তার চেয়ে আমি নিজেই গিয়ে পরদিন ওদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসার অঙ্গীকার করলাম। খিজির হায়াত খান প্রথমত চেয়েছিলেন যে, মেজর সাদেক নেওয়াজ গিয়ে প্রয়ােজনবােধে শক্তি প্রয়ােগ করে পুলিশদের নিরস্ত্র করুক।
আমি অনর্থক রক্তপাত এড়ানাের জন্য খিজির হায়াত খানের কাছে এক থ্যা অঙ্গীকার করলাম যে, আমি নিজে গিয়ে পরদিন ওদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে আসব। তিনি আমার কথায় রাজী হলেন। ২৬শে মার্চ বেলা বারােটার সময় চতুর্থ বেঙ্গলের সিগন্যাল সেসিও নায়েব সুবেদার জহীর আমাকে বললেন যে, তিনি অয়ারলেস ইন্টারসেন্ট করে দুটো স্টেশনের মধ্যে এই কথােপকথন শুনেছেন। তাকে খুব চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।
ইন্টারসেপ্টেড মেসেজগুলাে ছিল ঃ (1) Send tank ammunition, (2) Send hiliopter to evacuate casualties (3) 50 boys of East Bengal Regimental Centre have deserted mental Centre have deserted some with weapon and some without weapon. এ সমস্ত মেসেজ পেয়ে আমার জুনিয়র অফিসারগণ লেঃ হারুন, লেঃ কবীর, লেঃ আখতার খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন আমি সিগনাল সেটে গিয়ে মেজর খালেদ মােশাররফের সাথে যােগাযােগ করি এবং অল্প চেষ্টায় তাঁর সাথে আমার যােগাযােগ হয়ে যায়। আমি তাঁকে চোস্ত ঢাকাইয়া বাংলায় ঐ মেসেজগুলাে শােনাই এবং তাঁর মতামত জানতে চাই। আমি তাকে বলি যে, আমরা তৈরি এবং তাঁকে তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোম্পানী নিয়ে আসার জন্য অনুরােধ করি। আমার সাথে যখন খালেদ মােশাররফের কথােপকথন চলে তখন সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ এবং খিজির হায়াত খান আমাকে খুব তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল। সেই জন্য খুব বেশি কথাবার্তা চালানাে সম্ভব হয়নি এবং তিনিও সমশেরনগর থেকে বেশি কথা বলেননি। শুধু বলেছিলেন যে, তিনি রাতের অপেক্ষায় আছেন।
তারপর থেকেই আমার জুনিয়ার অফিসাররা তাড়াতাড়ি যে কোন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করছিল। আমি ব্যাটালিয়ানের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন জুনিয়র অফিসারের মতামতের অপেক্ষায় ছিলাম। কেননা, সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত সময়ােপযােগী না হলে সবকিছু পন্ড হয়ে যাবে এবং একজন জেসিওকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সারারাত সময় দিই। সন্ধ্যার সময় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সৈনিকদের ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আমাকে দেখামাত্রই কয়েকজন সৈনিক যাদের মধ্যে কয়েকজন এনসিও ছিলেন, আমাকে ঘিরে ধরেন এবং বলেন যে, স্যার দেশের মধ্যে যে কি হচ্ছে তা আপনারা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল বােঝেন। আমরা অফিসারদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আপনাদের যে কোন নির্দেশে আমরা জীবন দিয়ে পালন করতে প্রস্তুত। আপনারা যদি বেশি দেরি করেন তবে হয়ত আমাদের কাউকে পাবেন না। আমরা আগামীকালের পরেই যে যার বাড়ির দিকে রওয়ানা হব। কিন্তু সঙ্গে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাব। সৈন্যদের এই মনােবল ও সাহস দেখে আমি খুব গর্বিত ও আশান্বিত হলাম এবং দু’একজন অফিসার ও জেসিও’র দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আমাকে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা থেকে বিরত করতে পারেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, আমার চেষ্টা সত্বেও দুপুরের পরে খালেদ মােশাররফের সাথে কোন যােগাযােগ করতে পারিনি।
২৬শে মার্চ সন্ধ্যার পরে ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণ শুনে আমার বাঙালি জুনিয়র অফিসাররা আরাে উত্তেজিত এবং ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল এবং আমাকে তক্ষুণি অস্ত্র হাতে তুলে নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। আমি রাতে আমার তাঁবুতে অবস্থান করলাম। সারারাত সাদেক নেওয়াজ এবং লেঃ আমজাদ আমার তাঁবুর ১০০/১৫০ গজ দূর থেকে আমাকে পাহারা দিচ্ছিল। আমার অজ্ঞাতেই তিন চারজন এসসিও (শহীদ হাবিলদার বেলায়েত হােসেন, শহীদ হাবিলদার মইনুল, হাবিলদার শহীদ মিয়া এবং হাবিলদার ইউনুস) সারারাত আমাকে পাহারা দেয়—যাতে ঐ দু’জন পাঞ্জাবী অফিসার আমার উপর কোন হামলা করতে না পারে। পাঞ্জাবী অফিসাররাও সারারাত সজাগ ছিল।
২৭শে মার্চ সকাল সাতটায় আমি লেঃ আখতারকে সাদেক নেওয়াজের কক্ষে পাঠাই এবং তাকে বলা হয় যখন সাদেক নেওয়াজ মেসে আমাদের সাথে নাস্তা করতে আসবে তখন যেন তার স্টেনগান এবং ৮ ম্যাগাজিন গুলি অন্যত্র সরিয়ে রাখা হয়। আমার উদ্দেশ্য ছিল রক্তপাতহীন একটা এ্যাকশন পরিচালনা করা। কিছুক্ষণ পর আমি, লেঃ হারুন আর লেঃ কবীর দু’জন এনসিও সাথে করে অফিসার মেসের দিকে যাই। অফিসার মেসে পাঞ্জাবী অফিসারদের সাথে আমরা ব্রেকফাস্টে মিলিত হই। এনসিও দের নির্দেশ দেই যে, আমাদের রক্তপাতহীন এ্যাকশনের সময় যদি কোন বাঙ্গালি বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে তাকে যেন গুলি করে হত্যা করা হয়। আমরা সকাল ৭-২০ মিনিটে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছি। এমন সময় একজন জেসিও খিজির হায়াত খানকে বলল যে, সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীতে এক্ষুণি যেতে হবে। একথা শােনামাত্র খিজির হায়াত সাদেক নেওয়াজের কোম্পানীর কাছে যেতে উদ্যত হল। আমি তাকে বাধা দিলাম এবং বললাম যে, পরিস্থিতি না জেনে এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না। সুতরাং প্রথমে আমরা অফিসে যাই। ওখানে আলাপ-আলােচনার পর আমরা সকলেই সাদেক নেওয়াজ কোম্পানীতে যাব। খিজির হায়াত এতে রাজি হলেন। সাদেক নেওয়াজ তখন তার স্টেনগান আনার জন্য তার কক্ষে যেতে উদ্যত হয়। আমি আবার বাধা দিই এবং বলি যে আমার স্টেনগানটা সে যদি চায় তবে সে সঙ্গে নিতে পারে।
এতে সে আশ্বস্ত হয় এবং আমরা সকলেই অফিসে যাই। একটা তাবুতে অফিস করা হয়েছিল। তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার তাঁবুতে ঢােকা মাত্রই লেঃ কবীর আর লেঃ হারুন তাঁবুর দু’পাশে গিয়ে দাঁড়ান এবং আমি আমাদের সকলের আনুগত্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ঘােষণা করি এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তাদেরকে বলি যে, তারা আমাদের বন্দি। তদানুসারে তাদের জীবনের দায়িত্ব আমাদের এবং তারা যেন কেউ কোন বাঙালি অফিসার, জেসিও এনসিও এর সাথে কোন কথা না বলে। বলাবাহুল্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানী ১২/১৫ জন সৈনিক যারা চতুর্থ বেঙ্গলএর সাথে ছিল আমার নির্দেশের অপেক্ষা না করেই প্রায় একই সময়ে তাদেরকে বন্দি করে এক জায়গায় জমা করে রাখা হয়। বিনা রক্তপাতে আমাদের এ্যাকশন সম্পন্ন হয়। এবং চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় সব কটা কোম্পানী তার সম্পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, যানবাহন, রসদপাত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। | ২৭শে মার্চ সকাল দশটার দিকে প্রায় ১০/১৫ হাজার উল্লসিত জনতা আমাদের ক্যাম্পে চলে আসে এবং ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানায়। অস্ত্র ধারণ করার পর দেখতে পেলাম আমার বেশ কয়েকজন অফিসার জেসিও এবং এনসিও একটু অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছিলেন এই অল্প সময়ের মধ্যে জীবনের এই বিরাট পরিবর্তনে। কয়েকজনের ক্ষণিকের মধ্যে ১০২-১০৪ ডিগ্রি জ্বর পর্যন্ত হয়েছিল। কয়েকজন আবােল-তাবােল বকছিল। দুজন অফিসারকে বেশ কয়েকদিন আর চোখে পড়েনি। আমি নিজেও একটু অস্থির প্রকৃতির হয়ে পড়েছিলাম।
সকাল ১১টার দিকে আমি সব কোম্পানীকে নির্দেশ দিলাম। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের চার পাশের গ্রামগুলােতে যেন অবস্থান নেয় যাতে করে পাকিস্তানী বিমান হামলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আমাদের ব্যাটালিয়ান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারিপার্শ্বে গ্রামে গােপনে অবস্থান নেয়। বেলা আড়াইটার সময় মেজর খালেদ মােশাররফ তাঁর কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছেন। রাস্তায় হাজার হাজার বেরিকেড অতিক্রম করে আসার ফলে তাঁর আসতে দেরি হয়েছিল। তিনি আসা মাত্রই আমি চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্ত এলাকা তাঁর কাছে হস্তান্তর করি এবং তাঁর নির্দেশে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লােক ছিল তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করা আমাদের সম্ভব হয়নি। সুতরাং তাদেরকে ২৭শে মার্চ বলতে পারিনি যে, আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছি। যা হােক, কর্নেল খালেদ মােশাররফ ২৯শে মার্চ জাঙ্গালীয়াতে আমাদের প্লাটুনের সাথে যােগাযােগ করতে সক্ষম হন এবং তাদেরকে আমাদের সংগ্রামের কথা জানান এবং নির্দেশ দেন জাঙ্গালীয়া থেকে বেরিয়ে এসে ব্যাটালিয়নে যােগদান করতে। আমরা পরে জানতে পেরেছি যে কুমিল্লা সেনানিবাসে আমাদের যে সমস্ত লােকজন ছিল তারা ২৯শে মার্চ আমাদের সংগ্রামের কথা জানতে পেরেছিল। কিন্তু নেতৃত্বের অভাবে তারা কোন এ্যাকশন নিতে পারেননি।

৩১শে মার্চ বিকাল চারটার সময় সেনানিবাসে অবস্থিত চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৭০/৮০ জন সৈনিকের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীরা চারিদিক থেকে হামলা করে এবং প্রায় ছয় ঘন্টা যুদ্ধের পর আমাদের চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইউনিট লাইন দখল করে। এই যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের ৮/১০ জন জোয়ান শহীদ হন। এই যুদ্ধে নায়েব সুবেদার এম এ সালাম অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। জাঙ্গালিয়াতে যে প্লাটুন ছিল সেটা ২৯শে মার্চ বের হয়ে মুক্তিসংগ্রামে যােগ দেয় এবং কুমিল্লা-লাকসাম রােডে নায়েব সুবেদার এম. এ. জলিলের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি সাফল্যজনক এ্যামবুশ করে।

(সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড।)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত