You dont have javascript enabled! Please enable it!
পাইকগাছা হাইস্কুল অপারেশন

পাইকগাছা এলাকা মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ডে মুখর, আমাদী হাতিয়ার ডাঙ্গাস্থ বাছাড়বাড়ি মনােরঞ্জন ক্যাম্প-নবম সেক্টর অধীন অন্যতম সাব সেক্টর সদর দপ্তর। পাকহানাদারবাহিনী বার বার এখানে হানা দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়— কারণ এর ভৌগলিক অবস্থান ছিল মুক্তিবাহিনীর পক্ষে, চারিদিকে বাঁধ ভাঙ্গা ছিল। ফলে জোয়ারে পানি আসত আর ভাটিতে নেমে যেত, রাস্তাঘাটের কোন অস্তিত্ব ছিল না। চারদিকে নদী, সুতরাং গানবােটও হামলা করতে পারছে না। রাজাকারদের বুকে এত সাহস ছিল না যে, মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প হামলা করবে। হাতিয়ার ডাঙ্গার পাশেই ছিল গড়ইখালি ইউনিয়নের পাতড়াবুনিয়া গ্রাম। এই গ্রামের রায় সাহেব পরিত্যাক্ত বিরাট বাড়িতে খুলনা জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু খুলনা জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান সদর দপ্তর স্থাপন করে। খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত মুজিব বাহিনীর মূল পরিকল্পকার তওফিক বিভিন্ন সময়ে টুকু ভাইয়ের অবর্তমানে ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মুজিববাহিনী গ্রামে গ্রামে সংগঠন, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কর্মসূচীর সাথে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

আর এই সিদ্ধান্তের ফলই হচ্ছে পাইকগাছা থানা সদরে পাইকগাছা হাই স্কুলের রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ। দক্ষিণ খুলনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাইকগাছা হাই স্কুল অপারেশনের অন্যতম কামরুজ্জামন টুকু, শেখ শাহাদাৎ হােসেন বাচ্চু ও গাজী আকবর আলীর নেতৃত্ব পাইকগাছা হাই স্কুলের রাজাকার ঘাঁটি অপারেশন করা হয়। এই অপারেশনে অংশগ্রহণকারী যােদ্ধারা পাতড়াবুনিয়া রায় সাহেবের বাড়ি ক্যাম্প থেকে রওনা হয় নৌকায়। ৭টায় পাইকগাছার বহু লােকজনদের সাথে তাদের দেখা হয়, অনেকেই বাজার থেকে ঘরে ফিরছে। শেখ শাহাদাৎ হােসেনের রক্তে তখন যেন আগুন ধরেছে; তার পিতা মাহাতাব উদ্দীনকে এই রাজাকাররাই হত্যা করেছে। সুতরাং তার প্রতিশােধ নিতে হবে। এবং পাইকগাছাকে। হানাদার মুক্ত করতে হবে। রাত ৯টায় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করা হয়। সমবেত মুক্তিযােদ্ধা সর্বমােট ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে যার যার জায়গায় পজেশন নেয়। আক্রমণকারী গ্রুপের নেতৃত্ব দেন কামরুজ্জামান টুকু। কভারিং ক’ গ্রুপের একটির নেতৃত্ব দেন গাজী আকবর আলী। স্কুল ছাত্রাবাসের উত্তর-পশ্চিম দিকে কভারিং ‘খ’ গ্রুপের নেতৃত্ব দেন শেখ শাহাদাৎ হােসেন বাচ্চু ও মুড়ােগাছার সুজায়েত গােলদার এবং কভারিং ‘গ’ গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন বটিয়াঘাটার বিনয় বাবু। তার সঙ্গে ৪জন সহযােগী ছিল। রাত নটা এক মিনিট। কামরুজ্জামান টুকুর ফায়ার উদ্বোধন করার কথা। কিন্তু রাজাকাররা কেমন করে যেন মুক্তিযােদ্ধাদের আগমনী বার্তা পেয়ে যায়। যার ফলে তারাই প্রথম গুলি ছােড়ে। সেই কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের পুরাে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
তবুও অদম্য সাহস নিয়ে কভারিং গ্রুপ ব্যপক গুলি ছুড়তে শুরু করে চারিদিক থেকে এবং ডেমােলিসিং গ্রুপ স্লাব লাগিয়ে বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমের কক্ষের ব্যপক ক্ষতি সাধন করে। স্লাব বাষ্ট হওয়ায় প্রচন্ড শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়। রাজাকাররা যেভাবে হৈ চৈ শুরু করে তা মনে রাখার মতাে, আর সি এল ফায়ার করে তা ব্যর্থ হয়। আর সি এল ফায়ার করতে গিয়ে অশােকের হাতের তিনটা আঙ্গুলের আগা উড়ে যায়। একজনের চোখে লেগে চোখ নষ্ট হয়ে যায়। টুকু ভাই প্রাণপণ চেষ্টা করে যুদ্ধ করতে থাকেন। মুস্তাফিজ, কামরুল, আকবর গুলিবর্ষণ করেই চলে। রাজাকাররাও ব্যাপক গুলি করতে থাকে। তাদের কেউ কেউ আত্মসমর্পণ করার কথা বলেন আবার অধিকাংশ রাজাকার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আগ্রহী। ইতিমধ্যে ৩ ঘন্টা যুদ্ধ হয়ে গেছে। রাজাকারদের বা রাজাকার ঘাঁটির পতন ঘটানােও আর সম্ভব নয়। তাই অধিনায়ক টুকু ভাই প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু বাচ্চুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে মুস্তাফিজ আরাে দু’জনসহ বাছুর পিতা শেখ মাহাতাপ উদ্দীনের কবরের নিকটে উপস্থিত হয়ে দেখাল সে কবরের উপর পড়ে আছে। তাকে তুলে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে সকল মুক্তিযােদ্ধারা পূজামন্ডপে এসে একত্রিত হয়। তারপর ফিরে যায় রাডুলী ইউনিয়নের কাটিপাড়া গ্রামে। এই যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকার আহত হয় এবং পরে তারা পাইকগাছা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। (সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!