রূপসার ঘাটভােগ ইউনিয়ন একটি হিন্দু অধ্যুসিত এলাকা। এলাকার বড় বাজার হল আলাইপুর বাজার। আঠারবাকী নদী তীরে অবস্থিত আলাইপুর বাজারকে কেন্দ্র করে লােকজনের জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে। কাজদিয়া বা পালের হাট হয়ে রাস্তা পথে আলাইপুর যাতায়াত করা যায়। আঠরবাকী নদীপথে খুলনা ও তেরখাদা ঘােষের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযােদ্ধা দল গড়ে ওঠে, যাদের রাজনীতির মূল কথা ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে কমিউনিজম কায়েম করা। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে আর একই নীতি আদর্শের অনুসারী জীবন মুখার্জীর কমিউনিষ্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদীদের খেলা বলে আখ্যায়িত করে লড়াই থেকে দূরে থাকে। তারা বাগেরহাটের রফিক বাহিনী ও মানস ঘােষকে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ থেকে বিরত রাখার সকল রকম পদক্ষেপ গ্রহণের পরও ব্যর্থ হয়। রফিক বাহিনী ও মানস ঘােষের বক্তব্যে পাকবাহিনীকে হানাদারবাহিনী হিসেবে চিহ্নিত করে এদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানান হয়। আর জীবন মুখার্জীর দল এটাকে তাদের দলীয় চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সাম্রাজ্যবাদী দুই কুকুরের লড়াই’ (আমেরিকা ও সােভিয়েট ইউনিয়ন) বলে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ জীবন মুখার্জী, রফিক এবং মানস ঘােষ দীর্ঘ দিনের রাজনীতিতে একই পথের পথিক ছিলেন। কিন্তু এ সময়ে তাদের মধ্যে তাত্বিক দ্বন্দ্বের ফলে বিভক্তি আসে। ইতিমধ্যে এসব এলাকায় রাজাকারদের অপতৎপরতায় বহু লুটপাট ও জীবনহানী ঘটেছে। টি এস বাহরদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুনসুরুল হক মূলত মুসলীম লীগের ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন, বিশেষ করে যখন ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর হল না, তখন তিনি প্রকাশ্যে স্বাধীনতার পক্ষে যােগ দেন এবং এলাকার লােকজনের জানমাল ইত্যাদির নিরাপত্তার জন্য প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন।
কিন্তু এলাকার শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা তার এ আচরণ সহ্য করতে পারেনি, ফলে চেয়ারম্যান মুনসুরুল হককে রাজাকাররা প্রকাশ্য বিদালােকে হত্যা করে, এমন কি তার শালাকেও তারা হত্যা করে। কাজদিয়া হাই স্কুলের শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মাস্টার কালিপদ পালকেও তারা স্কুল থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। পীঠাভােগ গ্রামের পাগল সমাদ্দার, এ অঞ্চলের এককালের জমিদারের নায়েব মতিলাল দত্ত ও একজন গরীব দিনমজুর আলাইপুরের তারাপদ পালকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। তারাপদের অপরাধ ছিল সে রাজাকারদের নির্দেশ মানেনি। অর্থাৎ রাজাকাররা তারাপদের স্ত্রীকে তাদের ক্যাম্পে গিয়ে কাঠ চেরাই ও আনুষঙ্গিক কাজকর্মের জন্য তাকে রাজাকার ক্যাম্পে পাঠাতে বলেছিল। কিন্তু তারাপদ নিজে কাঠ চিরাই ও অন্যান্য কাজ করে দিতে চেয়েছিল। কারণ তারাপদ তার যুবতী স্ত্রীকে বড় ভালবাসত, তাই ওদের আওতায় তাকে পাঠাতে তার মন চায়নি। রাজাকারদের সাথে এ তর্কের শাস্তি হল তারাপদ পালের মৃত্যুদণ্ড। গুলি করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আলাইপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান ও পীঠাভােগ গ্রামের মহাদেব দাসসহ অন্যান্যদের সামনে এই হত্যাকান্ড ঘটে। ৩১শে ভাদ্র, অনেকেই তখন বিশ্বকর্মা পূজা নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময় দেখা গেল নক্সাল নেতা মানস ঘােষ তার মুক্তিবাহিনীসহ আলাইপুর বাজারের পাশে অবস্থান নিচ্ছে। মানস ঘােষ এলাকায় নক্সাল নেতা হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। এ এলাকার লােকজন তাকে ভালবাসত এবং সহযােগিতা করত।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত