দাকোপের খাটালিয়া-লক্ষ্মীখােলা
রাজাকার ঘটিদখল অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ, মনােরঞ্জন ক্যাম্প, অর্থাৎ হাতিয়ার ডাঙ্গায় খবর এল দাকোপ থানার চালনা ইউনিয়নের খাটালিয়া-লক্ষ্মীখােলা গ্রামের রাজাকার বাহিনী চরম বাড়াবাড়ি করছে। সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার, লুটপাট, নারী ধর্ষণের বহু ঘটনা তখন এলাকার জনসাধারণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এই রাজাকার ঘাঁটি আমাদের অবস্থান থেকে প্রায় ৩০/৩৫ কিলােমিটার দূরে এবং নদীপথে যােগাযোেগই একমাত্র ভরসা। প্রায় ৬০/৬৫ জন মুক্তিযােদ্ধা জনাব রহমত উল্লাহ দাদুর নেতৃত্বে রওনা হয়ে যায়। তিনটা নৌকা নিয়ে গড়ইখালি থেকে রওনা হলেন এ দল। রাত ১০ টার দিকে শিবসা নদী পার হয়ে নৌকাগুলাে ঢাকীর মধ্যে প্রবেশ করল দাদুর কড়া নির্দেশ, সকলকেই সদা সজাগ থাকতে হবে। কারণ পাকনৌবাহিনীর গান বােট চলাচলের রাস্তা এই ঢাকী নদী । তারা দূরে আলাে বা সার্চ লাইট না দিয়ে চুপ করে বসে থাকে শিকারের আশায়। সুতরাং সদাজাগ্রত অবস্থায় এই বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে হবে। দুপুর রাতে মুক্তিবাহিনীর একদল লক্ষ্মীখােলা গ্রামে পৌঁছে যায়। রাজাকার ক্যাম্পটা ছিল ঐ গ্রামের ডাঃ আবু বকর শেখের একতলা বাড়িতে। রাতের বেলা কয়েকজন ছাদে সেন্টি দিচ্ছিল। আগে থেকে রেকির মারফত দাদুর কাছে প্রয়ােজনীয় যাবতীয় খবর ছিল। তাই বেশি অপেক্ষা না করে তিনি এককভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন যে, চারটা গ্রুপে ভাগ হয়ে এই ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে এবং কোন মতে ওদের পালিয়ে যেতে দেয়া হবে না। আর মুখােমুখি যুদ্ধে তারা মুক্তিবাহিনীর সামনে টিকতে পারবে না।
অতি সন্তর্পনে সবগুলাে উপদলই পজিশন নিল। তারপর দাদুর নির্দেশ শুরু হল আক্রমণ। রাজাকাররাও গুলি শুরু করে। ঘুমন্ত গ্রাম জেগে উঠল, চারদিক দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি; লােকজন ভীতবিহ্বল। যদিও রাজাকাররা পাকা দালানে মজবুত ডিফেন্সে এবং মুক্তিবাহিনী বাঙ্কার, ট্রেন্স ছাড়াই বিভিন্ন স্থানে পজিশন নিয়েছে। তবুও মনােবল ছিল মুক্তিবাহিনীর মূলশক্তি আর মানসিক দিক থেকে রাজাকাররা ছিল অতি দুর্বল। আধাঘন্টা পর দাদু বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ দিলেন, সব শালা রাজাকার এক্ষুণি আত্মসমর্পণ কর, নইলে সকলকে জীবন দিতে হবে, দালান ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে।’ এরপরও তারা কিছুক্ষণ গােলাগুলি করল। অতঃপর দাদু তাদেরকে শেষ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দশ মিনিট সময় দিলেন এবং বলে দিলেন এরপরই তাদের সমূলে ধূলিস্মাৎ করে দেয়া হবে। প্রবল গােলাগুলির আওয়াজে গ্রামবাসী জেগে উঠে কয়েকজন মুরুব্বী এগিয়ে এলেন। তারা একটা আপােষ-আলােচনা চালানাের জন্য দাদুর নিকট আরাে দশ মিনিট সময় চাইলেন। অতঃপর অধিনায়ক দাদু তাদের দাবী মেনে নিলেন। তবে শর্ত একটাই, পুরাে অস্ত্র দিয়ে আত্মসমর্পণ।
ওরা আলাপ-আলােচনার নামে সময় কাটাতে লাগল। কোন সিদ্ধান্তেই তারা উপনীত হতে পারছে না। তারা বিভিন্ন রকম প্রস্তাব দিচ্ছে, কিন্তু অস্ত্র দিতে রাজী নয়। সময় পার হয়ে গেছে, আরাে দশ মিনিট গেল, রাত শেষ হতে যাচ্ছে। সুতরাং আর ওদের অন্যায় দাবী আর আব্দার শােনার সময় নেই। দাদুর নির্দেশ এল চালাও গুলি, বুঝুক ব্যাটারা মুক্তিবাহিনী কি চীজ’! মাত্র পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই কাবু হয়ে পড়ল, মুক্তিবাহিনী তখন দালানের একদম নিকটে চলে এসেছে এবং কি ভাবে ভবনে ঢােকা যায় তার ছক আঁকছে। গুলিও অবিরত চলছে—তখন ওদের কমান্ডার বলে উঠল, ‘আমরা আর যুদ্ধ করতে চাই না, আত্মসমর্পণ করতে চাই, আমাদের জীবন বাঁচান। দাদুর নির্দেশ, ‘ওদের কথা বিশ্বাস কর না, আক্রমণ চালাও।’ দু’তিন মিনিট গুলি চললে তারা অস্ত্র ফেলে দিয়ে মাফ চাইতে থাকে। আর নিরস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ঠিক না। অতএব তারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করল। ইতিমধ্যে গ্রামের অধিকাংশ লােকজন এসে জমা হয়েছে দাদুর পাশে, স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাকুতি-মিনতিতে কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়া হল—বাকীদেরকে ধরে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে আনার সিদ্ধান্ত হল। এদের অত্যাচার আর ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে উপস্থিত জনতা শ্লোগান দিল, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় মুক্তিবাহিনী। ভােরের আলাের ছটায় মুক্তিবাহিনীর সকল বিজয় অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ল। দাদুর স্বার্থক সঠিক পরিকল্পনায় এ বিজয় সহজ হয়েছিল; এ যুদ্ধের স্মৃতি চির অম্লান থাকবে।
(সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত