পাইকগাছা থানা অপারেশন
জুলাই মাস, ৫ তারিখ। সহকারী কালাম, রফিক, অশােক ও মুজিবরসহ বৈঠকে বসলাম। কাজলনগর অর্থাৎ হেতালবুনিয়া ক্যাম্পের নাম রেখেছিলাম টাউন শ্রীপুর যুদ্ধের অন্যতম বীর শহীদ কাজলের নামে। আমাদের এই ক্যাম্প আশাশুনি থানার বড়দল ইউনিয়নের বিলের মাঝে হেতালবুনিয়া গ্রামে পরিত্যাক্ত একটি দোতলা বাড়ি। অস্ত্রাগারে বসে আমরা আলােচনা করি এ মাসের প্রথম ভাগে অনুষ্ঠিত গড়ইখালী অপারেশনের পর কিছু অস্ত্র পেলেও আরাে অস্ত্র প্রয়ােজন। তাই আজকের এই বৈঠক। কোথা থেকে অস্ত্র পাওয়া যাবে এ প্রশ্নে বৈঠকে উপস্থিত দুঃসাহসী বীরযােদ্ধাদের একটাই কথা, অস্ত্র চাই, এটাই জানি, কোথা থেকে আনতে হবে আপনি হুকুম করবেন, আমরা জীবন দিয়ে তা পালন করবাে। আমি তাদের কথায় আনন্দ প্রকাশ করে পাইকগাছা থানা আক্রমণ ও দখল করে অস্ত্র সংগ্রহের কথা বলি। এবারও সবার একই কথা। আপনি হুকুম দিবেন, আমরা তা তামিল করব, এর বেশি আমাদের বলার কিছুই নেই। আমাদের অস্ত্র চাই। যুদ্ধ ময়দানে সহযােগী যােদ্ধাদের এ ধরনের সমর্থন এবং আস্থা যে কোন কমান্ডারের জন্য গর্বের বিষয়। আমিও এমন গেরিলাদের নেতৃত্ব দিচ্ছি যারা আমার উপর অতিমাত্রায় আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাশীল– যা আমার জীবনের একটি বড় অহঙ্কার। অতঃপর কোথ ইনচার্জ ইউসুফের দেয়া সামান্য লাল চা আর বিস্কুট তৃপ্তির সাথে খেয়ে সভা ভঙ্গ করলাম এবং অতি শীঘ্রই এ অভিযানের জন্য সকলকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিলাম। দু’জন গােয়েন্দা পাঠালাম পাইকগাছা থানার ও পুলিশের পুরােপুরি খোজখবর নিতে এবং থানা প্রতিরক্ষা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তারা ফিরে আসবে। ৭ই জুলাই বিকেলে সব খবর পেয়ে গেলাম।
তাই বিকেলে পুনঃ কালাম, রফিক, অশােক, মুজিবুরকে নিয়ে কোথে (অস্ত্রাগার) বসলাম এবং ৮ই জুলাই বিকেলে ৪৫ জন মুক্তিযােদ্ধাসহ পাইকগাছা থানা আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলাম। ওদের সাথে আলাপ করে ৪৫ জনকে ৩ দলে বিভক্ত করলাম। প্রথম দলের নেতৃত্বে ২০জন যােদ্ধা ১টি এলএমজি, ১টি এসএলআর, বাকি রাইফেল এবং যথেষ্ট পরিমাণ গুলি। এরা সবার আগে থানার পশ্চিম দিকে অবস্থান নেবে এবং আমার যে কোন নির্দেশ মুহূর্তের মধ্যে কার্যকরী করবে। অনুরূপ অস্ত্র ও নির্দেশ সহ দ্বিতীয় দলের নেতৃত্বে থাকবে গাজী রফিকুল ইসলাম। তার দলে থাকবে ২ জন যােদ্ধা। রফিক ও আমি এই দুই দল সহ থানার সম্মুখে ওয়াপদা রাস্তার নিচে পজিশন নেব এবং পজিশন নেয়ার পর আমিসহ ৩ জন থানায় ঢুকব। আত্মঘাতী দলের দায়িত্ব হল থানায় ঢুকবে এবং চোখের নিমেষে ক্ষিপ্র গতিতে থানা দখল করতঃ পুলিশবাহিনীকে নিরস্ত্র করে সর্বপ্রথম সকল প্রকার অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আনবে। কালাম, রফিক, অশােক, মুজিবর এরা অতি অকুতােভয়, বিশ্বস্ত এবং পারদর্শী সৈনিক। তাই এদের নিয়ে এই বিপদজনক আত্মঘাতী অভিযান। আবুল কালাম আজাদ এবং আইনুদ্দীন আমার সাথে থাকবে। প্রত্যেকের কাছে এক একটি এসএমজি। প্রথম দল ও দ্বিতীয় দলের প্রথম কাজ হবে আমরা যে আত্মঘাতী দল থানায় ঢুকব, আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। আমরা দুপুরে খেয়ে বেলা ২টার দিকে চাঁদখালী ইউনিয়নের কাটাখালী বাজারে এলাম। এই এলাকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি জালাল সরদারকে খোঁজ করলাম। তিনি মূলত মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামে আমাদের প্রতি তার এবং তার পরিবারের সমর্থন ছিল অতুলনীয়।
দুই এক ঘন্টার নােটিশে তিনি মুক্তিবাহিনীর ৪০/৫০জন ছেলেদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। ভাবীও আমাদের খাইয়ে যেন তৃপ্তি পেতেন। তাই সময়-অসময়ে আমরা তার বাড়িতে উঠতাম এবং তিনি বা তার পরিবারের সদস্যরা কোন সময় বিরক্ত বােধ করতেন না। আরাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা এই যে, পাইকগাছা থানায় তিনিই সর্বপ্রথম আমাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। আজ প্রয়ােজনের মুহূর্তে তাই তাকে খোঁজ করার আরাে একটা কারণ ছিল যে তিনি এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও প্রথম জীবনে তিনি পুলিশের লােক ছিলেন। তাই পুলিশের চলাফেরার খবরও তার কাছে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাকে পেলাম না। আর তার বাড়ি একটু দূরে হওয়ায় আর বেশি চেষ্টাও করলাম না। এখানে পুলিশের একটা ফাঁড়ি ছিল। কিন্তু সেখানে কোন পুলিশ থাকে না। ঘটনাক্রমে পেলাম পুলিশের এক সেপাহী আওলাদ হােসেনকে। বাড়ি গােপালগঞ্জ, তাকে ধরে আনা হল এবং আমাদের এ দুর্ধর্ষ অভিযানে একটা ভূমিকা পালন করার জন্য বলা হলে সে অস্বীকার করল। তখন কষে তার গালে দিলাম একটা চড়। সাথে সাথে রাজী। আমরা কয়েকটা নৌকা যােগে থানা থেকে একটু দূরে যখন নামলাম তখন বেলা ৪টা, নদীতে ভাটা। প্রথমে অশােকের দলকে পজিশনে পাঠালাম এবং ২/৩ মিনিটের মধ্যেই রফিকের দলের সাথে তৃতীয় দলও থানার সামনে গিয়ে পজিশন নিল। রফিককে পিঠ চাপড়ে সতর্ক করে দিয়ে মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করে সিংহবিক্রমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে থানার সামনে পৌঁছে আকাশ পানে ফাকা একটা ব্রাশ করে হুঙ্কার দিলাম, ‘পুরাে থানা মুক্তিবাহিনী ঘিরে ফেলেছে, যারা বাঁচতে চাও আমি ৩০ পর্যন্ত গােণার সাথে সাথে মাঠে এসে হাজির হও, নতুবা সকলকে গুলি করে হত্যা করা হবে। আর কেউ পালানাে বা গুলি করার চেষ্টা করলে কঠিনভাবে সাজা দিয়ে মারা হবে। ১-২-৩-৪-৫-৬–। আর যায় কোথায় সবাই বিনা বাক্যে মাঠে এসে দাঁড়াল। দু’তিনজনের কেবলমাত্র জাঙ্গিয়া পরা। থানার ফ্লাগ পােস্টে পাকিস্তানী পতাকা উড়ছিল, একজনকে দিয়ে পতাকা নামিয়ে তা পােড়ালাম এবং দ্বিতীয় দল থেকে ৫ জনকে এনে পুরাে থানার ঘর অনুসন্ধান করালাম। ১৯ টা রাইফেল পাওয়া গেল। আর আছে ৫৭টা বন্দুক। কিন্তু সেগুলাে ছিল স্ট্রং রুমে। ওগুলাে আমাদের বড় প্রয়ােজন।
পাশেই পেলাম শেখ রফিউদ্দিনকে, বজ্র কণ্ঠে জলদি তাকে কয়েকটা কুড়াল আনার নির্দেশ দিলাম। কুড়াল তাড়াতাড়ি এল, স্ট্রং রুম ভেঙ্গে বন্দুক বের করে নিলাম। অপারেশন যখন শেষ করলাম তখন মাগরেবের আজান হয়। দুঃসাহসিক এ অভিযান পুরােপুরি সফল হওয়ায় সকলকে বাঁশী বাজিয়ে প্রত্যাহারে নির্দেশ দিলাম। ইতিমধ্যে লঞ্চ ঘাটে কপিলমুনির দিক থেকে এল বনকন্যা লঞ্চ। ভাবলাম, হয়ত মিলিটারী রাজাকার এসেছে—চালাও ২০ রাউন্ড গুলি’ নির্দেশ দিলাম। গুলি চলল সাথে সাথে। কোন জবাব তাে এলই না বরং লঞ্চখানার সারেং ভয় পেয়ে হয়ত হাল ছেড়ে গেছে। তাই লঞ্চখানা স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে গেল। আমরা সবাই বজ্র কণ্ঠে শ্লোগান দিলাম—“জয় বাংলা’। এই অপারেশনে অন্যানদের মধ্যে অংশ নেয় আরশাদ, মান্নান, কে এম খলিলুর রহমান, আনিস, রশীদ, আব্দুল মান্নান, আক্কাস আলী, মােকছেদসহ আরাে অনেকে। হঠাৎ খেয়াল হল সােবহান ভাইকে পাঠিয়েছি ওয়ারলেস সেটের কাছে, যাতে কেউ খুলনায় যােগাযােগ করতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে। এই যােগাযােগ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কয়েকজন রওয়ানা হলাম ওয়ারলেস অফিসের দিকে।
আফজালুর রহমান এই সময় পাইকগাছা পিসিওর দায়িত্বে ছিল। মানসিক দিক থেকে আমাদের পক্ষে থাকলেও জীবনের ভয় ও চাকুরীর মায়ায় ইতস্ততঃ করছিল। জোরে হুমকি দিলে তিনি আর বাধা দিলেন না। অতএব অতি সহজেই ওয়ারলেস সেট তুৱে আনলাম। নৌকাযােগে মহানন্দে ফিরে এলাম কাজলনগরে। খুলনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাইকগাছা থানা অপারেশনের ঘটনা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কাজলনগরে ফিরে এলে কালাম, রফিক, অশােক, মুজিবরসহ আমাদেরকে নিয়ে আনন্দে কি জড়াজড়ি আর নাচানাচি। আর ইতিমধ্যে যেন দরবার আর তদ্বির শুরু হয়ে গেছে যারা অস্ত্র পায়নি তারা কে কি অস্ত্র পাবে তাই নিয়ে। এ সময় সুবােল বড়দা অস্ত্র আনতে মুজিবনগরে ছিলেন, তাই এই অপারেশনে অংশ নিতে না পারায় দুঃখ তার সারা জীবনের।
(সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত