গড়ইখালী রাজাকার ক্যাম্প দখল
সময়টা ছিল জুন মাসের শেষ সপ্তাহ। আমি তখন আমিরপুর গ্রামে। কারণ, আমিরপুরের মনােরঞ্জন বাবুর বাড়ি আমাদের একটা অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পে বসে গড়ইখালীর সােহরাবের কাছে চিঠি দেই। চিঠিতে তাকে জানাই যে, আমিসহ আমার সহযােদ্ধারা তাদের গ্রামের আশেপাশেই অবস্থান করছি। ঐ চিঠিতে সােহরাবকে আরাে জানাই যে, খুলনা থেকে ট্রেনিং নিয়ে একদল রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ গড়ইখালী এলাকায় ২/১ দিনের মধ্যেই ক্যাম্প ফেলবে। আমি চিঠিতে আমার সাথে এ বিষয়ে সােহরাব যেন সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রাখে সে কথা লিখে জানালাম। আমার চিঠির আগাম অশনি সংকেত সত্যি সত্যি বেজে উঠল। আমি চিঠি পাঠানাের কয়েক দিন পরেই সদ্য ট্রেনিং প্রাপ্ত একদল রাজাকার গড়ইখালী ইউনিয়ন কমিউনিটি সেন্টারে ক্যাম্প করে বসল। আমার চিঠি পাওয়ার পর সােহরাব তাছের আলী গাজী সাহেবের বাসায় আশ্রয় নেয়। এই সুবিধার্থে যে, কমিউনিটি সেন্টার থেকে খুব নিকটে ছিল সােহরাবের আশ্রয়স্থল। মুক্তিযােদ্ধা বনাম রাজারকারের একটা সশস্ত্র সংঘর্ষ বাধলে পাশ্ববর্তী এলাকায় ব্যাপক জানমালের ক্ষতি হবে এই আশংকায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করলে তারা সােহরাবকে পরামর্শ দিলেন যে, রাজাকার প্রধানের সাথে পরামর্শ করে সংঘর্ষ এড়ানাে যায় কিনা। সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ সােহরাবকে দিলেন। সােহরাব তাছের আলী গাজীর ঘরে রাজাকার উপ-প্রধানের সাথে আলাপে বসে। শিবসাহ মিনহাজ নদীর মােহনায় দাকোপ ও পাইকগাছা সীমান্তে গড়ইখালী বাজারের অবস্থান। তাই সামরিক দিক থেকে গড়ইখালী বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গা রাজাকাররা নিয়ন্ত্রণ করবে তা হয় না। তাই রাজাকারদের বিরুদ্ধে আমাদের এই অভিযান।
গড়ইখালীর জনাব মােবারক আলী বিশ্বাস (সাবেক ইপিআর), গাজী সাহেব নিজে ও তমিজউদ্দিন জোদ্দার আলােচনায় উপস্থিত ছিলেন। রাজাকার উপ-প্রধানের মনে ভীতির সঞ্চার করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ভারী মেশিনগানসহ বহু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে ও যােদ্ধার সংখ্যা কমপক্ষে হাজারখানেক হবে—এটা প্রকারান্তরে ব্যক্ত করে সােহরাব। মুক্তিযােদ্ধারা যে কোন মুহূর্তে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করতে পারে, শুধু সােহরাবদের হস্তক্ষেপের ফলে তা করছে না এটাও রাজাকারদের বােঝানাে হয়। সােহরাব লক্ষ্য করল তার ঔষধে কাজ হয়েছে। রাজাকার উপ-প্রধানের চোখে উৎকণ্ঠার চিহ্ন এবং রাজাকাররা বুঝল যে তারা ইচ্ছা করলেও সহজে আর গড়ইখালী এলাকা থেকে পালাতে পারছে না। কারণ এটা সত্যি যে, সােহরাবরা যেখানে আলাপে বসেছিল সেটা মুক্তিবাহিনী প্রধানের এবং মুক্তিযােদ্ধাদের নিরাপত্তা বিধানসহ রাজাকাররা যাতে এখান থেকে কৌশলে পালাতে না পারে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক তার ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, রাজাকার প্রধান মােঃ নওশের আলী ইতিমধ্যেই আলােচনায় যােগ দিয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের কথায় রাজাকারদের মানসিক ভীতি আরাে বেড়ে গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে আলােচনায় বসলে যাতে কোন হামলা রাজাকারদের উপর না আসে সেজন্য সােহারাবকে তারা পীড়াপীড়ি করলে সােহরাব মুক্তিবাহিনী অধিনায়ক হিসাবে সরাসরি আমার সাথে আলাপে বসার পরামর্শ দেয়। তারা আশ্বস্ত হয়ে এ পরামর্শ মেনে নেয়। সােহরাবের উপর দায়িত্ব আসে বৈঠক অনুষ্ঠানের। স্থানীয় গড়ইখালী হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার সময় সােহরাব স্কুলের নিচতলার যে কক্ষে থাকত সেই কক্ষেই ব্যবস্থা করা হল বৈঠকের। পূর্বের সিদ্ধান্ত মােতাকেব বৈঠকের দিন রাত ১১ টায়। উভয়পক্ষ নিরস্ত্র অবস্থায় আলােচনায় বসবেন। আমি মনােরঞ্জন বাবুর বাড়ি দলবলসহ ছিলাম। কারণ, সেখানে আমাদের একটা অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে বৈঠকের দিন রাত পৌনে এগারােটায় রফিক, কালামকে নিয়ে সােহরাবের কক্ষে উপস্থিত হলাম। রাজাকাররা আলােচনায় বসার পর যাতে কোন ক্ষতি করতে না পারে সে জন্যে পূর্ব থেকেই আলােচনা স্থানের চতুর্পাশ্বে মুক্তিযােদ্ধা মােতায়েন করা হয়েছিল। যােদ্ধারা সব কিছুর উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। রাজাকারদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার দায়িত্ব ছিল মােবারক আলী বিশ্বাস ও গাজী আইয়ুব আলীর উপর। রাত বাড়েছে— আমরা প্রচণ্ড স্নায়ুচাপে ভুগছি, রাজাকারদের কোন খোজ নেই, ইতিমধ্যে জনাব তাছের আলী, গাজী ও তমিজ উদ্দিন জোদ্দার এসে পৌছান। তাদের সাথে রাজাকার উপ-প্রধান মফিজ উদ্দিন মােল্লা। মফিজ মােল্লার বাড়ি দাকোপ থানার গড়ইখালী গ্রামে। রাজাকার প্রধান কোন একটা অপারেশনে গেছে এই অজুহাতে বৈঠকে অনুপস্থিত। আমার সুস্পষ্ট প্রস্তাব ছিল নিঃশর্ত অস্ত্র সমর্পণের। রাজাকার উপ-প্রধান কাচুমাচু করতে থাকে। তখন তাদের স্পষ্ট বলে দেই অস্ত্র সমর্পণ করলে তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হবে না। আর তা না করলে এ মুহূর্তে রাজাকার ক্যাম্প ধূলিস্মাৎ করে দেয়া হবে।
যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে অস্ত্র আমাদের চাই। তারা বার বার শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের প্রস্তাব দেয়। এলাকায় তারাও থাকবে, আমরাও থাকব। কিন্তু এ প্রস্তাব কোন মতেই আমাদের পক্ষে গ্রহণযােগ্য ছিল না। রাজাকার প্রধানের উপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে আমার গােপন নির্দেশে গড়ইখালী রাজাকার ক্যাম্পের তিন দিক থেকে গােলাগুলি শুরু করে। ক্যাম্পের উত্তর দিকে মিনহাজ নদী, তাই ঐ দিক ফাঁকা রাখা হয়। এই চাপে কাজ হয়— তারা বিনা যুদ্ধে আমাদের নিকট অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজী হয়। রাজাকার উপ-প্রধান তখন গাজী সাহেব ও জোদ্দার সাহেবকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পে যেয়ে অস্ত্র এনে আমাদের হাতে দেওয়ার কথা বলে। আমরা তাতে রাজী না হয়ে বরং রাজাকার উপ-প্রধানকে জিম্মি হিসাবে আটক রেখে জোদ্দার সাহেবের সাথে আমাদের বড় ভাই বীরযােদ্ধা আজিজ সানাকে রাজাকার ক্যাম্পে পাঠানোের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। আজিজ ভাই রাজাকার ক্যাম্প থেকে ঘন্টা খানেকের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলা বারুদ নিয়ে আসেন। অস্ত্রগুলাে গুণে সংখ্যা মেলানাের পর ধৃত রাজাকার উপ-প্রধানকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গুণে দেখা গেল তখন ৫টি অস্ত্র আমাদের হিসাব মতাে রাজাকারদের কাছে রয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হলে পুনঃ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে। যােদ্ধারা ছােটখাট একটা আক্রমণ করে হামাগুড়ি দিয়ে রাজাকার ক্যাম্পের ধার থেকে ফিরে এসে জানাল বাকী ৫টি অস্ত্রসহ তারা পালিয়েছে। সারা দেশের কথা জানি না, তবে খুলনা জেলায় এটাই ছিল প্রথম রাজাকারদের কাছে থেকে অস্ত্রপ্রাপ্তি। আনন্দের আতিশয্যে উপস্থিত মুক্তিযােদ্ধারা সে কি উল্লাস করতে লাগল! রাতের আকাশ বিদীর্ণ করে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে বিজয়ের বার্তা সকলের কানে পৌছে দিলাম।
সেদিনের এই অপারেশনে আমার সাথে যারা শরীক হয়েছিল তাদের সবাই হলেন সানা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক মােঃ রুহুল আমীন, মরহুম (সাবেক ইপিআর) সােহরাব আলী সানা, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক মােঃ রুহুল আমিন, মরহুম আইয়ুব আলী গাজী, মনােরঞ্জন, শ্ৰীকণ্ঠপুরের মােহাম্মদ আলী, গড়ইখালীর মােঃ মেছের আলী, কপিল মােড়ল, কপিল মুনীর আঃ লতিফ, লক্ষীখােলার আরশাদ আলী এদের সাহসিকতার তুলনা হয় না। আমার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ যুদ্ধ মনে অনেক দাগ কেটেছে। কারণ ঐ সময় আমাদের কাছে মাত্র ১১টা আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। পক্ষান্তরে শত্রু পক্ষের অস্ত্রসজ্জা ছিল আমাদের থেকে বেশি। বলা যায় খােদাতালার রহমত আর আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবলই এ যুদ্ধকে সফল করেছিল।
(সূত্র স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত