You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২১শে এপ্রিল, সোমবার, ৮ই বৈশাখ, ১৩৮১

পরিত্যক্ত সম্পত্তিঃ কারা দখল করে আছে

শুধুমাত্র ঢাকা শহরে যে পরিত্যক্ত বাড়ি ঘর রয়েছে তার সহকারী হিসেবে ছ’হাজার একশ আটত্রিশ। আরো হয়তো আছে যার হিসাব সরকারের ঘরে গিয়ে পৌঁছেনি। ঢাকা ছাড়া সারা দেশে এমনই আরো কত যে হাজার পরিত্যক্ত বাড়ি ঘর রয়েছে তার সঠিক হিসেব আজ আর কেউ বের করতে পারবেন কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এমনকি ইতিমধ্যে যে সকল বাড়িঘর পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে তার ক’টির ওপর সরকারি দাবি এখন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই এমনটি বলা যায় না।
সরকার ঢাকা শহরেই পরিত্যক্ত ঘর-বাড়ির যে হিসেব তৈরি করেছেন মন্ত্রিসভার সদস্য স্বীকারোক্তি অনুসারে তার অনেকগুলো ওপরে তারা আজ পর্যন্ত দখলী স্বত্ব কায়েম করতে পারেননি। পারেননি এমনকি দখলিস্বত্ব পাওয়া বাড়ি গুলোরও অনেকটি থেকে নির্ধারিত ভাড়া আদায় করতে। এসব তথ্য যদি আমরা লিখতাম তবে হয়তো তাকে ‘উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার’ বলে সরকারি ‘হ্যান্ড আউট’ মারফত উড়িয়ে দেয়া হতো; কিন্তু উপরোক্ত তথ্যগুলো জানিয়েছেন পূর্ত দপ্তরেরই ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং। স্বাধীনতার পর থেকেই এক শ্রেণীর লোক যে নির্লজ্জভাবে এই সকল পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে তা সকলের চোখে লেগেছিল। ক্ষমতার মদমত্ততায় তখন সেই মানুষগুলোর তোয়াক্কা করেনি। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা হলো, সরকারি একটা কাঠামো তৈরি হলো, শুরু হল হুমকি-ধামকি। তখন অবশ্য বর্তমান মন্ত্রী মহোদয় এই দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন না। তিনি এলেন; কঠোর হুঁশিয়ারি জানালেন, তারপরও প্রায় এক বৎসর যেতে বসেছে।
তার এই নতুন দায়িত্বভার গ্রহণের পর তাকে এই পরিত্যক্ত বাড়ির দখলদারদের সম্বন্ধে আমরা সতর্ক করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম বন ও পশুপালন দপ্তর এ (যে দপ্তরের দায়িত্বে তিনি ছিলেন) তাকে যে ঘন অরণ্যরাজীর মধ্যে হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের খবরদারি রাখতে হত শহুরে এই দখলদার লোকগুলো। তাদের চাইতে খুব একটা শ্রেষ্ঠ নয়। তাদের মোকাবিলায় তাই তাকে প্রথম থেকে কঠোরতম মনোভাব গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম আমাদের সেই আহবানের ফল কি দাঁড়িয়েছিল আমরা এতদিন তা জানতে না পারলেও তার সাম্প্রতিক তথ্য থেকে বেশ বুঝতে পারছি তিনি ওদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। তাই এক হাজার আটশ’ বিরাশিটি বাড়ির দখল এখনো তিনি সরকারের নানা যন্ত্রের সহায়তা নিতে পারেননি। যেগুলো তাদের দখলে এসেছে তার মধ্যেও ভাড়া সংগ্রহ করেছেন শুধু তিন হাজার ন’শ বায়ান্নটি বাড়ি থেকে। পূর্তমন্ত্রী বলেছেন এর ফলে সরকারের প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা ক্ষতির শিকার করতে হচ্ছে। যেসব বাড়ির দখল এখনো সরকার পায়নি সেগুলো ভাড়া বাবদ সরকারকে যে প্রতি মাসে আরো কতো হাজার টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে তার হিসেব আর কে রাখবে?
শহরে কার্ফু জারি করে পরিত্যক্ত ঘর বাড়ি উদ্ধারের অভিযান চালানো হয়েছিল বেশ ঢোল-শহরত পিটিয়েই। অমুক এলাকায় তিনটি বা দুটি বাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে-এমন সব খবর খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল কিন্তু সব শেষে সেই অশ্বডিম্ব। ক্ষমতার দাপটের ওপর হাত গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি সেই বাঘা বাঘা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সমূহের। আর্মিও নামানো হয়েছিল এই কাজে। কিন্তু সেই একই অবস্থা। ছেড়ে যাব না, ছেড়ে দেব না-দখলদারদের এক কথা। এসব তো গেল ঘর বাড়ির কথা। পরিত্যক্ত সম্পত্তির এটি একটি অংশ বিশেষ। এছাড়া রয়েছে পরিত্যক্ত শিল্প-কারখানা, জমি, গাড়ি আরো অনেক কিছু। এসবেরও অনেক কিছু এখন দখলদারদের আওতায়। ঘরবাড়ির মত পরিত্যক্ত অন্যান্য সম্পত্তি কোন হিসেব সরকারি খাতায় রয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। সেই সকল সম্পত্তির ওপর সরকার তার দখলিস্বত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছেন তা কোন দপ্তর থেকে আজ পর্যন্ত জানান হয়নি। অনেকের ধারণা শিল্প-কারখানা এবং ঘরবাড়ি একটা এলোমেলো হিসাব ছাড়া অন্য কিছুই সরকারের হাতে নেই। এগুলো উদ্ধারের প্রচেষ্টাও আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
সরকার এগুলো উদ্ধার করবেন না ক্ষমতা (অস্পষ্ট) দাপটের কাছে মাথা নত হয়ে থাকবেন তা সরকারের ব্যাপার। কিন্তু জনসাধারণের অধিকার রয়েছে বাস্তব অবস্থা জানার। আসলে কত পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি, গাড়ি, শিল্প কারখানা, জমি সম্পত্তি রয়েছে? তারা সরকারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি প্রদর্শন করে এই সম্পত্তিগুলো ভোগ দখল করছে? তারা এই সেই মহাশক্তিধর প্রভু যারা কারো তোয়াক্কা করার প্রয়োজনটুকু অনুভব করে না।
এ সম্পত্তি গুলোর হিসাব দরকার। এর একটা তালিকা দরকার। যে গুলির দখল সরকার পেয়েছেন তা কোন ভাগ্যবানদের নামে ‘এ্যলোট’ করা হয়েছে তা আমাদের জানা দরকার। জানা দরকার সরকারের ঘর থেকেই নথিপত্র বের করে ভুয়া মালিক সৃষ্টি করে কারা পরিত্যক্ত সম্পত্তি গুলো নিজেদের নামে লিখিয়ে নিচ্ছেন? এমন বেচাকেনা কত হয়েছে তা জানা দরকার। সরকার এই বেচাকেনা অনুমোদন দেবেন না বলে মন্ত্রী মহোদয় ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সেই অনুমোদনের প্রয়োজন কতটুকু পড়বে, ভুয়া দাপটে তা তলিয়ে যাবে না এমন আশ্বাস কি সরকার দিতে পারেন?
আসলেই অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পড়ে যে হিসেবগুলো তৈরি করা অনেক বেশি সহজ সাধ্য ছিল আজ তা আর তেমন অবস্থায় নেই। স্বাধীনতা-পূর্ব কালের স্ট্যাম্প দলিল করা যায় গত দু’বৎসরে বিক্রি হয়েছে সে খবর সরকারি যন্ত্র সম্ভবতঃ রাখেন না। দলিল রেজিস্ট্রির কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মচারীরা ‘ব্যাক ডেট’ দিয়ে এক একটা সই করে কত টাকা কামিয়েছেন তা জানলেও সরকার সে ব্যাপারে মুখ খুলবেন না। পরিত্যক্ত সম্পত্তির পরিমাণ কমেছে, একের পর এক গ্রাস করেছে গুটিকয় লোক। এদের পরিচয় জানা দরকার, সম্পত্তির সঠিক হিসেব করা দরকার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!