You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৩ই সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, ২৭শে ভাদ্র, ১৩৮১

রপ্তানি বৃদ্ধি এবং কাঁচামালের মূল্য নির্ধারণ

জুলাইয়ের রপ্তানি মৌসুম শুরু হলেও আজ পর্যন্ত দেশের রপ্তানি নীতি ঘোষণা করা হয়নি। শোনা যাচ্ছে এ মাসের শেষাশেষি তা ঘোষণা করা হবে। রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নাকি স্থির করা হয়েছে তিনশ পঞ্চাশ কোটি টাকা। এর মধ্যে একমাত্র পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত হবে তিনশ এক কোটি টাকা, বাকি উনপঞ্চাশ কোটি আসবে চা, চামড়া, কাগজ, মশলা ইত্যাদি রপ্তানির মাধ্যমে।
অন্যান্য বারের মতো এবারও রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ অধিকার করে আছে পাট ও পাটজাত দ্রব্য। গত মৌসুমে রপ্তানি খাতে অর্জিত ২৯৯ কোটি ৯৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার মধ্যে একমাত্র পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে আমরা পেয়েছিলাম প্রায় ২৬০ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। এবার গতবারের তুলনায় ওই একই পণ্য রপ্তানি করে প্রায় ৪০ কোটি ৭০ লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে।
গতবারের তুলনায় কিন্তু এবার পাট সে হারে বৃদ্ধি পায়নি। বরং পাট উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায়। গত ২৩ শে ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তদানীন্তন পাটমন্ত্রী এ মৌসুমে পাটের উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন ৭০ লক্ষ বেল। বলা হয়েছিল এই ৭০ লক্ষ বেলের মধ্যে পাটকলগুলো তে ব্যবহৃত হবে ৩৬ লক্ষ বেল। কাঁচাপাট বিদেশে রপ্তানি করা হবে বাকি ৩৪ লক্ষ বেল। ওই একই সম্মেলনে তিনি গত মৌসুমের উদ্ধৃত পাটের হিসেব দিয়েছিলেন ১৬ লক্ষ বেল। কিন্তু সরকারের ভ্রান্ত নীতির ফলে পাটমন্ত্রী সে আশা পূরণ হয়নি। চাষিরা পাটের চাইতে ধান উৎপাদনে বেশি আগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। খুলনায় গত জুন মাসে দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এ মৌসুমে গত মৌসুমের চাইতে প্রায় অর্ধেক উৎপন্ন হবে। গত মৌসুমে পাট উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৫৫ লাখ বেল।
এবার পাট উৎপাদক সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান যাদের আছে তারা কেউই মনে করেন না যে এ মৌসুমে পাট খুব বেশি হলেও ৪০ লাখ বেল এর অধিক উৎপন্ন হবে। এর মধ্যে যদি পাটকলগুলোর চাহিদা পূরণ করতে হয় তবে তাতেই লেগে যাবে ৩৬ লক্ষ বেল। বাকি ৪ লক্ষ বেলের সঙ্গে গত বছরের উদ্বৃত্ত যদিও তার অস্তিত্ব আছে বলে অনেকেই মনে করেন না, যোগ করলে মোট রপ্তানিযোগ্য কাঁচা পাটের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ লক্ষ বেল। উৎপাদন যেখানে গত বৎসরের তুলনায় এমনি হার এ হ্রাস পেয়েছে সেখানে কত বছরের চাইতে বেশি মুদ্রা কি করে রপ্তানির মাধ্যমে আয় করা সম্ভব হবে তা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য।
এছাড়া রয়েছে রপ্তানির অন্যান্য সমস্যা । জাহাজ নেই, বিদেশি জাহাজে স্থান সংকুলান হয় না। এমনই নানা ধরনের অভিযোগ বহুদিন হয় চলে আসছে। গত ১১ ই সেপ্টেম্বর ‘বাংলার বাণীতেই’ এ সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, জাহাজের অভাবে চট্টগ্রাম, চালনা এবং দেশের বিভিন্ন বন্দরগুলোতে রপ্তানি অপেক্ষায় দশ কোটি টাকারও বেশি পাট পড়ে আছে। শিপিং কর্পোরেশন জাহাজগুলোতে বটেই এমনকি বিদেশি জাহাজ গুলো এসকল পাঠ পরিবহনে মন্থর গতিতে অগ্রসর হচ্ছে।
এ সমস্যাগুলো বহুদিনের। পাট আমাদের রপ্তানি আয়ের অধিকাংশ ‘কভার’ করে। বলা চলে এই একটিমাত্র আইটেমের উপরে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন নির্ভরশীল। অথচ এই পাট রপ্তানি তথা এর মাধ্যমে অধিকতর মুদ্রা আয় তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
পাট রপ্তানি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে পাটের মূল্য নির্ধারণ এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এতদিন কাঁচা পাট রপ্তানিতে আমাদের ছিল এক আধিপত্য। তথাভিজ্ঞ মহল মনে করেন, আমাদের করে থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য প্রতিশোধ প্রতিযোগী দেশ যে মূল্য লাভ করেছেন আমাদের কর্মকর্তারা উচ্চমানের পাট বিক্রি করেও সে মূল্য পাননি।
নতুন বাজার খুঁজে বের করার ব্যাপারেও পাট রপ্তানি কর্পোরেশন একই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন: ব্রাজিল পূর্বে আমাদের দেশ থেকে সরাসরি পাট আমদানি করতো। গত মৌসুমের ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পাট উচ্চ মূল্যে ক্রয় করে। অনেকের অভিযোগ পাট রপ্তানি কর্পোরেশনের এক শ্রেনীর কর্মকর্তা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের এই মুনাফা অর্জনের সহযোগিতা প্রদান করে।
পাট রপ্তানি এবং সে থেকে অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পাট রপ্তানি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বব্যাপী তৈল সংকটের মুখে যখন সিনথেটিক উৎপাদন হ্রাস পেয়েছিল এবং তার উৎপাদন খরচ ও পূর্বের চাইতে অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছিল তখন পাটের উচ্চ মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ এরা গ্রহণ করেননি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের গড়িমসি আমাদের ক্ষতিকর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এপ্রিল-মে মাসের দিকে যদিও প্রাইস এ্যাডভাইজারী কমিটি বৈদেশিক বাজারে পাটের উচ্চ মূল্য নির্ধারণের একটা সুপারিশ করেন। তবুও সে গোপনীয় সিদ্ধান্তটিও বাইরে প্রকাশ হয়ে যায় এবং বিদেশি ক্রেতারা আগে পূর্ব নির্ধারিত মূল্যে বহু পরিমাণ পাট কিনে ফেলেন। এমনি করে এক শ্রেণীর আমরা তাদের অভিজ্ঞতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে গড়িমসি এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়। পাটের মাধ্যমে আমরা তাই যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হতাম তা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে আসছি গোড়া থেকেই। অবশ্য একটি পণ্য রপ্তানির ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হয়ে থাকা কোন জাতীয় অর্থনীতির পক্ষেই সুলক্ষণ নয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই পাটের ব্যাপারে যেমন অন্যান্য রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ব্যাপারেও ঠিক সেই একই প্রকার গাফিলতি এবং কারচুপি চলে আসছে। চা-চামড়া রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি রপ্তানির জন্য নতুন আইটেম খুঁজে বের করা। বরং এবছর রপ্তানির তালিকা থেকে কিছু পণ্যের নাম বাদ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকের আশঙ্কা।
বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বাড়লেও কাঁচামালের দাম তেমন বাড়েনি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশ সমূহ বিভিন্ন প্রস্তুত দ্রব্য আমদানি ও রপ্তানি করে শুধু কাঁচামাল সংকটে যে প্রতিক্রিয়া উন্নত দেশ সমূহের অর্থনীতিতে পড়েছে তা তারা পুষিয়ে নিতে চায় উন্নয়নশীল দেশসমূহের নিকট থেকে প্রস্তুত দ্রব্যসামগ্রীর জন্য অধিক মূল্য হেঁকে। আমরা তাদের সেই কারসাজি শিকার মাত্র। বেশি মূল্যে আমাদের দ্রব্য আমদানি করতে হয় কিন্তু রপ্তানি করে মেলে কম টাকা। কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ গুলো যদি ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের কাঁচামালের মূল্য নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয় তবে এই সমস্যা মোকাবেলার একমাত্র উপায় অধিক পণ্য রপ্তানি করা। আমাদের এই দুটোই অনুসরণ করতে হবে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি করতে যেমন অন্যান্য উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। তেমনি বৃদ্ধি করতে হবে রপ্তানিযোগ্য কর্ণের সংখ্যা এ ব্যাপারে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে জাতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলায় রপ্তানি বৃদ্ধি অপরিহার্য। অধিকাংশ দ্রব্যসামগ্রীর জন্য যেখানে আমাদের আমদানির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় সেখানে রপ্তানি বাড়িয়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল অবশ্যই ভরাট রাখতে হবে। শুধু প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই নয়, দেশের শিল্পায়নের জন্যও এটির প্রয়োজন রয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!