You dont have javascript enabled! Please enable it!
রােবের্তো এবং মার্গো কার-রিবেইরাে
দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া থেকে আগত রােবের্তো এবং তার স্ত্রী মার্গো, ফরাসি কানাডীয় – দুজনেই Canadian International Development Agency (CIDA)-তে ১৯৬০ থেকে ২০০০ দশক পর্যন্ত কাজ করেছেন। অন্য দত্তক নেয়া দম্পতি যাদের বিষয়ে আমরা এখনে আলােচনা করেছি, তাদের মতাে রিবেইরােরাও এমন সব জাতিগতভাবে বিভিন্ন অনাথদের দত্তক নিতে গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন যাদের বাড়ির দরকার ছিল খুব; অথচ যাদের দত্তক শিশু হিসাবে বাড়ি দেয়া কঠিন প্রস্তাবনা ছিল । রিবেইরােরা আরও পাঁচটা সাধারণ দম্পতির মতাে নয়, যারা স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়া শিশুদের সমাহারে পরিবার তৈরিতে বিশ্বাসী। তারা দত্তক নেবার মাধ্যমেই সন্তান নিতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন, সেটাকে তারা মনে করতেন পরিবার গঠনের আরেক উপায় ।গড়পড়তা প্রজননক্ষম দম্পতিদের সঙ্গে রিবেইরােদের এখানেই তফাৎ । তাদের প্রথম সন্তান ম্যারি হেলেন-এর জন্মের পর রিবেইরেরা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা আর একটি সন্তান নেবেন। সময়টা ১৯৭১ সালের শেষদিকে; তারা পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে জানতেন। একই সময়ে তার Families for Children (FFC)-এর সঙ্গে স্বেচ্ছাশ্রমের কাজে জড়িত হওয়ার কারণে রােবের্তো সংস্থার বিভিন্ন কল্যাণকর কাজের খবর রাখার সঙ্গে এর বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের রক্ষা করার যে প্রস্তাবিত প্রকল্প তারও খবর রেখেছিলেন।

রিবেইরাে পরিবার পাঁচ সন্তানের সমাহারে তৈরি । প্রথম ঔরসজাত মেয়ে ছাড়া বাকি চারজনকে নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, হাইতি ও কলম্বিয়া থেকে । স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দেশ থেকে ছেলেমেয়েদের দত্তক নেবার সঙ্গে সঙ্গেই তাে পরিবারটি বহুজাতিক হয়ে গিয়েছিল, যদিও ফরাসিই পরিবারে কথ্য ভাষা হিসাবে চালু রয়েছে। CIDA-তে কাজ করার সুবাদে রিবেইরাে ছেলেমেয়েরা একই সময়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার সংস্পর্শে আসে । ছেলেমেয়েরা যাতে সত্যিই কানাডীয় হয়ে বেড়ে ওঠে সে লক্ষ্যে তারা তাদের বহুজাতিক ছেলেমেয়েদের বড় করার সময়ে কানাডীয়তার ওপর জোর দিতেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, তাদের ছেলেমেয়েরা বস্তুতপক্ষে কানাডীয় হয়ে উঠবে। আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তক নেবার সময় রিবেইরােরা যুদ্ধশিশু সমর-এর নামকরণ করেছিলে। মার্টিন। তখনকার সে অস্থির দিনগুলাের কথা মনে করে মার্গো বলেন, “ব্যাপারটা অনেকটাই সন্তান প্রসবের আগের ব্যথার মতােই,” যে বিষয়ে তিনি “জনসমক্ষে কথা বলতে নারাজ। যদিও রােবের্তো লেখকের সঙ্গে কথা বলেন কিন্তু তিনি চুপ করে থাকেন যখন তাদের বহুজাতিক ছেলেমেয়ে বড় করে তােলার অভিজ্ঞতা বিষয়ে দুটি কথা বলতে অনুরােধ করা হয়। তারা জনসমক্ষে ব্যক্তিগত গল্প-কাহিনী নিয়ে কোনাে আলােচনা করতে চান না। দম্পতির সাথে আলাপ করে জানা যায় যে, যেহেতু পরিবারটি কানাডার বাইরে অনেকগুলো। বছর কাটিয়ে এসেছে বিশেষ করে যখন ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছিল, রিবেইরােরা তখন অন্যান্য দত্তকগ্রাহী পরিবারের সঙ্গে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করার তেমন সুযােগ পাননি। ক্যাপুচিনােদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে দম্পতির চিঠিপত্রের কিছু নমুনা সংরক্ষিত আছে। বােঝাই যায়, মার্গো বনি ক্যাপুচিনাে এবং সিস্টার মার্গারেট ম্যারির সঙ্গে বাংলাদেশে যােগাযােগ রেখেছিলেন তাদের ছেলে মার্টিন আসার পর পর।
রােবের্তোর ভাষ্য অনুসারে, প্রথমদিকে মার্টিন সহজ সরল ছেলে, মুখে একগাল হাসি নিয়ে বড় হচ্ছিল। যার চটজলদি বন্ধুবান্ধব জুটে যেত। কিন্তু শীঘ্রই পরিবারের সদস্যরা মার্টিনের স্বভাব চরিত্রে জটিলতা লক্ষ্য করতে শুরু করেন। এটা তারা ওর যখন বয়স অল্প তখনই টের পেয়েছিলেন, ভেবেছিলেন, হয়তাে পরে ঠিক হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে ব্যাপারটা বুঝতে চাইলেন, যাদের মধ্যে চিকিৎসক, বিশেষ প্রশিক্ষক এবং কাউন্সেলরও ছিলেন। মার্টিন যখন বড় হচ্ছিল, তারা মনােবিজ্ঞানীদের উপদেশ থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে যেসব শিশুর কোনােরকম অসুবিধা হয়, তাদের অতিরিক্ত সহায়তা প্রায়ই দরকার হয় কষ্টের জায়গাগুলাে পার হতে । রিবেইরােরা নানা পন্থা অবলম্বন করে এ ধরণের সহযােগিতা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। মার্টিনের যে সব জায়গায় শিক্ষা গ্রহণে খামতি বােঝা যেত, চিকিৎসক ও কাউন্সেলররা তাকে আলাদা করে সেখানে বিশেষ পারদর্শিতার লাভের চেষ্টা করেন।
যদিও দম্পতি একদমই কিছু নিয়ে আলাপ করতে চাইনি, তবুও কথা প্রসঙ্গে জানা যায় যে, মার্টিন যখন বড় হচ্ছিল ওর মা-বাবা এমন অনেক বিষয়ে চিন্তা করতেন যার ওপরে তাদের কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যেমন, জন্মদাত্রী মায়ের নিমমানের খাবার এবং অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পুষ্টির অভাব, অবহেলা এবং প্রাক-প্রসব যত্নের অভাবে ক্ষতি হওয়া, ইত্যদি। সেদিক দিয়ে দেখলে বলা যেতে পারে যে, মার্টিনের যন্ত্রকারীদের অন্য কোনাে দুর্বলতার কারণে মার্টিনের বুদ্ধিবৃত্তির আশানুরূপ বিকাশ ঘটেনি। তাদের শুনতে ভালাে না লাগলেও শুনতে হয়েছে, মার্টিনের উন্নয়ন অত্যন্ত ধীরে ধীরে হচ্ছে।
মার্টিন যে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সেটা বুঝতে পেরে পরিবার সবসময় বিশেষজ্ঞদের উপদেশ শুনে এগুচ্ছিলেন। তারা কখনাে আশা ছেড়ে না দিয়ে তাদের নির্দেশাবলী মেনে চলেছিলেন। সেটা করতে গিয়ে পরিবরের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল পরিবারের ভেতরে, বিশেষ করে ভাইবােনের ভেতর তার গ্রহণযােগ্যতাকে কাঁধে নেবার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন । পরিবারের সম্পর্কগুলির একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল যে, রিবেইরাে ছেলেমেয়েদের জন্য তাদের একের প্রতি অন্যের ভালােবাসা প্রদর্শন করা । রিবেইরােরা সর্বক্ষণ চেষ্টা করেছেন মাবাবার ভূমিকা পালনে সর্বোক্তৃষ্ট দক্ষতা দিয়ে ও সবাইকে সম্পৃক্ত করে নতুন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে । দম্পতি সব ছেলেমেয়েদের এমনভাবে ভালােবাসতেন, আদর যত্ন করতেন যে, কেউ মনে করতে পারেনি তারা অন্যের চেয়ে অবহেলিত। মার্টিনের যত্ন ও আদর সম্পর্কে রিবেইরােরা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে এমনভবে সম্পৃক্ত করেছিলেন যে, পরিবারের প্রতিটি সদস্য বুঝতে পেরেছিল বাড়িতে একটি শিশু রয়েছে যার বিশেষ যত্ন ও খেয়ালের প্রয়ােজন।
সমর।
কানাডাতে আসার পর সমরের মা-বাবা তার নাম দেন মার্টিন রিবেইরাে । বাংলাদেশে দেয়া নাম সমর তারা বাদ দিয়ে দেন। বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুর মতাে মাটিন অল্প ওজন নিয়ে ঢাকার শিশুভবনে জন্মগ্রহণ করেছিল। সে তার মায়ের গর্ভধারণ মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই ৭ এপ্রিল ১৯৭২ তারিখে মাত্র ১ কেজি ওজন নিয়ে জন্মেছিল। কানাডা যখন এসে পৌছায়, মার্টিনের বয়স তখন তিন মাসের চেয়ে একটু বেশি এবং ওজন দুই কেজি’র নিচে। তার মা-বাবার প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের ছেলেকে যথেষ্ট পরিমানে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানাে এবং দ্রুত ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। সৌভাগ্যক্রমে যত সময় যেতে লাগে, মার্টিনের ওজন বাড়তে থাকে এবং সে একসময় তার বয়সী শিশুদের মতােই সক্রিয় হয়ে উঠে।
একটু বয়স হলে সে তার বয়সী অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মতাে কিউবেকের হাল শহরের স্থানীয় এলিমেন্টারি স্কুলে যেতে শুরু করে। ঐ সময়েই তার মা-বাবা তার মধ্যে কিছু “অস্বাভাবিকতা” অথবা “অনিয়মতা” লক্ষ্য করেন। এতে তারা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। এটা ছিল তাদের জন্য একধরনের লাল পতাকা – বিপদসঙ্কেত। তারা বুঝতে পারেন যে, শীঘ্রই মার্টিন লেখাপড়ার বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মােখমুখি হবে। কী করে তার পিছিয়ে থাকা বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে সে সামনে এগােবে? এ প্রশ্নটি দম্পতি অনেকবারই নিজেদের করেছেন। মার্টিন দেখতে যদিও সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক ও সুস্থ ছিল, পরিবারের অনেকেই ওর পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি লক্ষ্য করেন । রােবের্তোর ভাষ্যানুযায়ী তারা বুঝতে পেরেছিলেন, চতুপাশ্বের পরিবেশ থেকে তথ্য হেঁকে নিয়ে বাছাই করতে মার্টিনের কী অসুবিধাই না হতাে! বাবা-মা হিসাবে তাদের কষ্ট হতে দেখে যে, মার্টিনের সমস্যার কারণে ইতােমধ্যে তার ব্যবহার এবং কথাবার্তাও বদলে যাচ্ছিল। অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাফেরায় তার খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। তাল কেটে যাচ্ছিল ছন্দ ভেঙে যাচ্ছিল ।
রিবেইরাে দম্পতির একটি বিশেষ গুণ যে, অসুবিধাগ্রস্ত মার্টিনের শিক্ষণীয় বিষয়ে ধীরগতিতে উন্নতি যদিও নিঃসন্দেহে হৃদয়বিদারক, তবুও তারা পুরােপুরিভাবে নিরাশ হননি। তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল মার্টিনের চিকিৎসার প্রয়ােজন’- সে বিষয়টি নানাভাবে বিশ্লেষণ করা এবং প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা । চাপের মুখে পড়ে তারা অবস্থার সার্বিক মূল্যায়ন করেন। যেমন, মার্টিনের বুদ্ধিবৃদ্ধিক সক্ষমতাসমূহ এবং তাদের নিহিতার্থ বনাম তার ভাইবােনদের ভাবভঙি এবং পারস্পরিক সম্পর্ক যতদূর বােঝা সম্ভব। তাদের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া ছিল, প্রথমে নিজেদেরকে মার্টিনের অসুখের ধরন সম্পর্কে কিছু জ্ঞানলাভ করা, যাকে বলে “হােম ওয়ার্ক”। সমস্যাটি যদি তারা ভালােভাবে বুঝতে পারেন তবে তারা সহযােগীতার হাত বাড়াতে পারবেন। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, জন্মের সময় অক্সিজেনের সরবরাহ কম হওয়ার কারণে মার্টিনের শিক্ষণে অসুবিধা দেখা দিয়েছিল । কালক্ষেপণ না করে পরের পদক্ষেপ ছিল সহায়তার খোঁজ করা, অসুস্থতার চিকিৎসা করা, যাতে ইতিবাচক পার্থক্য সৃষ্টি করা যায়। দেখা গেল, সত্যি সত্যি মার্টিনের অসুস্থতার রহস্য দূরীভূত করার দুরতিক্রম্য কোনাে সংগ্রাম ছিল না। সে জন্য নৈরাশ্যবাদিতার পথ থেকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়, এবং স্বাভাবিকভাবে তখন অভিযােজনের কর্মকৌশল রপ্ত হওয়ার তাগিদ বেড়ে যায়।
যখন তারা গভীরে ঢুকেন মা-বাবা দুজনেই সমস্যাগুলাে আরও বিশদভাবে জানতে পারেন, যেমন- সংক্রমণ, গর্ভধারণকালের জটিলতা ইত্যাদি। আবার বংশানুগতির নিয়ন্ত্রক উপাদানঘটিত কারণে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। যেহেতু তার কোনাে বিশদ চিকিৎসা সংক্রান্ত নথি বা অতীত তথ্য সংরক্ষিত নেই। মার্টিনের মা-বাবা তার জন্ম ইতিহাস খোঁজার বৃথা চেষ্টা না করে রােগ নির্ণায়ক সম্ভাব্য যা তথ্যাদি তখন ছিল, সেটার সাহায্যে কাজ চালিয়ে যাবার উপর গুরুত্ব দেন। তার ব্যাপারটা যা দাঁড়াল, সেটাই শক্তি ও সাহসের সঙ্গে মেনে নিয়ে লড়াইয়ে ব্রতী হলেন মার্টিনের মা ও বাবা। নিজেদের মানসিক আঘাত ও অবাক হওয়ার ধাক্কা সামলে নিয়ে তারা সম্মুখের যুদ্ধের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত হলেন।
কোনাে কাজে মাটিন ব্যর্থ হলে কখনাে পারিবারিক সদস্যরা বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রদর্শন করেনি অথবা আরও ভালােভাবে কাজ করার জন্য কখনাে চাপ দেয়নি। দম্পতিটির এখনও মনেআছে মার্টিনের উপর তখন বাইরে ও ভিতর থেকে যে শক্তি কাজ করছিল, সেগুলােই পরিবারকে মার্টিনের অবস্থা সমন্বিতভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। তার ফলশ্রুতিতে সবাই মিলে সামনে এগুনাে সম্ভব হয়েছিল । মােটামুটিভাবে সবাই একপর্যায়ে এসে বুঝতে পারেন। যে, মার্টিন আসলেই অন্য রকম। এ বাস্তবতার সঙ্গে একমত হতে কারাে বেশিদিন লাগেনি। সৌভাগ্যবশত সময়ের সাথে সাথে মার্টিনের অবস্থা আগের তুলনায় লক্ষণীয় উন্নতি ঘটেছিল। এতদিনে মার্টিনের মা-বাবা বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন এটুকু জেনে, কখন এবং কীভাবে ওকে ওর পড়াশােনার বিষয়ে উৎসাহ দিতে হবে, উন্নতির জন্য প্রশংসা করতে হবে এবং তার খামতি সম্পর্কে পরিবারের অন্য সদস্যরা বিশেষ করে সব ভাইবােনেরা মানিয়ে নেবে।
মার্টিনের বাংলাদেশের প্রতি অনাগ্রহের বিষয়ে রােবেতো বলেন, মার্টিন তার শিক্ষণের অসুবিধায় ভােগার কারণে তার জন্মদেশের সম্পর্কে নিরুৎসাহিত, অর্থাৎ সে কোনাে আগ্রহ দেখায়নি কখনাে । যে দেশে সে জন্মগ্রহণ করেছে, যে দেশে সে তার জীবনের প্রথম নব্বই দিন অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু অবাক হলেও সত্য যে মার্টিনের সে বিষয়ে কোনাে জিজ্ঞাসা নেই। সােজা কথা, মাটিন বাংলাদেশ সম্পর্কে কখনাে কিছুই জানতে চায়নি। এটা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন যে, মার্টিন তার বাংলাদেশি ঐতিহ্যের বিষয় সম্পর্কে কিছু না। ভেবে বড় হয়েছে অথবা জন্মসূত্রে বাংলাদেশি কিন্তু বর্তমানে বিদেশি জনগােষ্ঠীর অংশ সে বিষয়ে সে উদাসীন । রােবের্তো বলেন, তিন মাস বয়সে দত্তক হিসাবে গৃহীত এবং ককেশীয় বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের সঙ্গে মেলামেশার ফলশ্রুতিতে সে কখনাে উপমহাদেশীয় বংশােদ্ভূত কানাডীয়দের সঙ্গে মেলামেশার কোনাে সুযােগই পায়নি। স্বভাবতই মার্টিনকে কথনাে ভিন্ন একটি পরিচিতি অথবা একাধিক পরিচিতির মুখােমুখি হতে হয়নি, যেমনটি কানাডার অন্যান্য জাতিগতভাবে পৃথক সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর বেলায় হয়ে থাকে। মার্টিনের মা-বাবার মতে, মার্টিনের আগ্রহের অভাব তার জীবনের প্রথমদিকে শিক্ষণে যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, সে কারণের জন্যই। সে আলােকে দেখে এবং তার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে তার বাবা-মা কখনাে তাকে বেশি চাপের মুখে ঠেলে দিতে চাইনি । কারণ তাতে তার দুঃখ কষ্ট বাড়বে বৈ কমবে না। এটাই বাবা-মায়েরা আশঙ্কা করেছিলেন। প্রথমদিকে তাদের চোখে না পড়লেও তারা কখনাে মার্টিনের উপর অতিরিক্ত বােঝা চাপাতে চাননি – বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাবলি, তার জন্মকে ঘিরে বিয়ােগান্তক যে কাহিনী, ত্যাগ ও কানাডাতে দত্তক আসার বিষয়াদি। মার্টিন পঙ্কিারভাবে জানে না সে কোথা থেকে কীভাবে এসেছে, ইত্যাদি; তাই সে বিব্রতবােধ করে এবং বিষয়টি সেজন্য এড়িয়ে যায় । তিনমাস বয়স থেকে কিউবেক-এ বসবাস করায় মার্টিনের নিকট বাংলাদেশ একটি দূরবস্থিত। দেশ, স্বভাবতই বাংলাদেশ বা বাংলাদেশিদের বিষয়ে কখনাে কোনােরকম আবেগীয় সম্পর্ক গড়ে উঠেনি।
এ জায়গায় এসে মার্টিন তার সঙ্গে যেসব যুদ্ধশিশু কানাডায় এসেছিল তাদের থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যরা যেখানে তাদের জন্মদেশ হিসাবে বাংলাদেশের ওপর নানা বই পড়েছে, অনেক কিছুই জেনেছে বা জানতে চেয়েছে, মার্টিন কখনাে একটা পুস্তিকা বা ইতিহাসের বই যা স্কুল-কলেজের পাঠ্যও পড়েনি। স্বভাবতই মার্টিন বাংলাদেশের মানুষদের সঙ্গে কখনাে কোনাে কাল্পনিক যােগাযােগও স্থাপন করেনি। সে কনাড়ায় যাকে বলে শিকড় চালিয়ে | দিয়েছে, যে দেশকে সে ‘হােম’ বলে। মার্টিনের সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধাসমূহ এবং শিক্ষণে বাঁধা যা সে অল্প বয়সে বুঝতে পেরেছিল। তা সত্ত্বেও সে বছরের পর বছর পার করেছে সবসময় আশাবাদী হিসেবে। প্রতিবন্ধকতা পার হতে হতে পিছিয়ে পরা মার্টিন কিন্তু মায়ের স্কার্টের পেছনে লুকানাে ছেলেটি হয়ে ওঠেনি। জীবনে সামনে এগুতে যে সব মৌলিক দক্ষতা (basic life skill) প্রয়ােজন সেগুলাে সে শিখেছে। সেগুলাের উপর ভিত্তি করে এগিয়েছে যতটুকু সম্ভব। নিঃসন্দেহে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, পরিশ্রম ও পরিবারের সহায়তায় সে আত্মনির্ভরতার উচ্চতম পর্যায়ে পৌছাতে পেরেছিল।
লেখক বহুদিন যাবত রােবের্তোর কাজের জায়গার আশেপাশে কফির কাপ সামনে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলােচনায় একটু একটু করে টুকরাে টুকরাে তথ্য সংগ্রহ করেন। কফি খেতে খেতে সংক্ষিপ্ত আলােচনায় মাটিন সম্পর্কে যতদুর জানা যায় সেটা হলােঃ দিনের শেষে মাটিন আবেগীয় স্বাস্থ্য এবং কুশলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল যদিও তাকে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার হতে হয়েছে। মার্টিনের মা-বাবা এ কথা জানতেন যে প্রকৃতির গতি যদিও মানুষের কাছে বেশি অচেনা, সযত্ন লালন ও পরিবেশ সব কিছুর পরও হয়তাে ইতিবাচক কিছু ঘটাতেও পারে। সব রকমের বাধা সত্ত্বেও একের পর এক বাধা এবং বিপত্তি পেরিয়ে মাটিন শেষ পর্যন্ত স্বাবলম্বীর পথে অনেকদূর যেতে পেরেছিল।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বহু জটিল বাধা অতিক্রম করে নানাভাবে পিছিয়ে পড়া মাটিন বেশ বড় বড় সফলতা পেয়েছে। হাই স্কুলের লেখাপড়া শেষ না করলেও মার্টিন একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে যে চাকরি করতাে সে আয় নিয়ে মার্টিন স্বাচ্ছন্দে দিন চালিয়ে নেয়। রােবের্তো বলেন, কয়েক বছর আগে সে বিয়ে করে এবং তার নিজস্ব পরিবার গড়ে তুলেছে। এক অর্থে নিজেকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটানাে স্বাধীন মাটিন সর্বদাই তার অর্জন নিয়ে গর্বিত ছিল । দুর্ভাগ্যের কথা, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, হঠাৎ মার্টিন এক বড় রকমের হৃদযন্ত্রের বৈকল্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এবং সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে । ওর পরিবার এ বিষয়ে কোনাে কথা বলতে চায়নি। যদিও লেখক ওর বােন ম্যারি হেলেন-এর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। ম্যরি হেলেন কেবল ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, সদ্যমৃত ভাই সম্পর্কে সে কোনাে কথা বলতে অনিচ্ছুক। যতবারই লেখক রিবেইরােদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, তারা এটা পরিষ্কার বলেন যে, মার্টিনের দত্তক নেয়ার বিষয়টা একান্ত ব্যক্তিগত । তাদের মতে, এটা সম্পর্কে প্রকাশ্যে আলােচনা করা ঠিক নয়। মার্টিনের অকস্মাৎ মৃত্যুর খবর শুনে লেখকের অশ্রুপাত ঘটে। কারণ তিনি মার্টিনকে খুবই জীবিত অবস্থায় মনশ্চক্ষে দেখতে পান। মার্টিন এবং লেখক অৰ্লিন্স-এ একই পাড়ায় বাস করতেন। লেখকের সঙ্গে তার প্রায়ই বাসে দেখা হতাে। মাটিনের মা-বাবা লেখককে অনুরােধ করেছিলেন মার্টিনের সাথে কোনাে যােগাযােগ না করতে। তাই লেখক বাসে মার্টিনের কাছাকাছি বসলেও কখনাে কথা বলার চেষ্টা করেননি।
যা স্কুল-কলেজের পাঠ্যও পড়েনি। স্বভাবতই মার্টিন বাংলাদেশের মানুষদের সঙ্গে কখনাে কোনাে কাল্পনিক যােগাযােগও স্থাপন করেনি। সে কনাড়ায় যাকে বলে শিকড় চালিয়ে | দিয়েছে, যে দেশকে সে ‘হােম’ বলে। মার্টিনের সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধাসমূহ এবং শিক্ষণে বাঁধা যা সে অল্প বয়সে বুঝতে পেরেছিল। তা সত্ত্বেও সে বছরের পর বছর পার করেছে সবসময় আশাবাদী হিসেবে। প্রতিবন্ধকতা পার হতে হতে পিছিয়ে পরা মার্টিন কিন্তু মায়ের স্কার্টের পেছনে লুকানাে ছেলেটি হয়ে ওঠেনি। জীবনে সামনে এগুতে যে সব মৌলিক দক্ষতা (basic life skill) প্রয়ােজন সেগুলাে সে শিখেছে। সেগুলাের উপর ভিত্তি করে এগিয়েছে যতটুকু সম্ভব। নিঃসন্দেহে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, পরিশ্রম ও পরিবারের সহায়তায় সে আত্মনির্ভরতার উচ্চতম পর্যায়ে পৌছাতে পেরেছিল।
লেখক বহুদিন যাবত রােবের্তোর কাজের জায়গার আশেপাশে কফির কাপ সামনে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলােচনায় একটু একটু করে টুকরাে টুকরাে তথ্য সংগ্রহ করেন। কফি খেতে খেতে সংক্ষিপ্ত আলােচনায় মাটিন সম্পর্কে যতদুর জানা যায় সেটা হলােঃ দিনের শেষে মাটিন আবেগীয় স্বাস্থ্য এবং কুশলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল যদিও তাকে অনেক প্রতিবন্ধকতা পার হতে হয়েছে। মার্টিনের মা-বাবা এ কথা জানতেন যে প্রকৃতির গতি যদিও মানুষের কাছে বেশি অচেনা, সযত্ন লালন ও পরিবেশ সব কিছুর পরও হয়তাে ইতিবাচক কিছু ঘটাতেও পারে। সব রকমের বাধা সত্ত্বেও একের পর এক বাধা এবং বিপত্তি পেরিয়ে মাটিন শেষ পর্যন্ত স্বাবলম্বীর পথে অনেকদূর যেতে পেরেছিল।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বহু জটিল বাধা অতিক্রম করে নানাভাবে পিছিয়ে পড়া মাটিন বেশ বড় বড় সফলতা পেয়েছে। হাই স্কুলের লেখাপড়া শেষ না করলেও মার্টিন একটি সিকিউরিটি কোম্পানিতে যে চাকরি করতাে সে আয় নিয়ে মার্টিন স্বাচ্ছন্দে দিন চালিয়ে নেয়। রােবের্তো বলেন, কয়েক বছর আগে সে বিয়ে করে এবং তার নিজস্ব পরিবার গড়ে তুলেছে। এক অর্থে নিজেকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটানাে স্বাধীন মাটিন সর্বদাই তার অর্জন নিয়ে গর্বিত ছিল । দুর্ভাগ্যের কথা, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, হঠাৎ মার্টিন এক বড় রকমের হৃদযন্ত্রের বৈকল্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এবং সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে । ওর পরিবার এ বিষয়ে কোনাে কথা বলতে চায়নি। যদিও লেখক ওর বােন ম্যারি হেলেন-এর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। ম্যরি হেলেন কেবল ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, সদ্যমৃত ভাই সম্পর্কে সে কোনাে কথা বলতে অনিচ্ছুক। যতবারই লেখক রিবেইরােদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, তারা এটা পরিষ্কার বলেন যে, মার্টিনের দত্তক নেয়ার বিষয়টা একান্ত ব্যক্তিগত । তাদের মতে, এটা সম্পর্কে প্রকাশ্যে আলােচনা করা ঠিক নয়। মার্টিনের অকস্মাৎ মৃত্যুর খবর শুনে লেখকের অশ্রুপাত ঘটে। কারণ তিনি মার্টিনকে খুবই জীবিত অবস্থায় মনশ্চক্ষে দেখতে পান। মার্টিন এবং লেখক অৰ্লিন্স-এ একই পাড়ায় বাস করতেন। লেখকের সঙ্গে তার প্রায়ই বাসে দেখা হতাে। মাটিনের মা-বাবা লেখককে অনুরােধ করেছিলেন মার্টিনের সাথে কোনাে যােগাযােগ না করতে। তাই লেখক বাসে মার্টিনের কাছাকাছি বসলেও কখনাে কথা বলার চেষ্টা করেননি।
লয়েড ও স্যাভ্রা সিমসন
লয়েড পেশায় নির্মাণ এস্টিমেটর এবং স্যান্ড্রা সমাজকর্মী কিউবেক-এর পয়েন্ট ক্লেয়ার-এ তাদের বিয়ের বছর ১৯৬৫ সাল থেকে বসবাস করে আসছেন। দম্পতির দত্তক নিয়ে পরিবার গড়ার যে দায়বদ্ধতা বিশেষ করে ভিন্ন জাতগােত্রের অনাথদের সহায়তা যােগানাে আজও সমুন্নত। ভিয়েতনামে বিদেশি সৈন্যদের ধ্বংসলীলা চালানাে এবং অনাথদের মর্মবিদারী। দুরবস্থা দেখার পর দম্পতি আরও দুটি সমমনা দম্পতির সঙ্গে হাত মেলান, তারা ছিলেন হার্ব ও নেওমি ব্ৰনস্টাইন এবং ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে । যুদ্ধে অনাথদের কষ্ট ও মৃত্যুবরণ করতে দেখে তারা সম্মিলিতভাবে অনুভব করেছিলেন যে তারা কিছু একটা করবেন ঐ হাজার হাজার মিশ্রজাতের অনাথদের জন্য । যৌন সহিংসতা থেকে যাদের জন্ম, সে সময় অনেককে তাদের মা-বাবা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; সমাজ তাদের পরিত্যাগ করেছিল, ওরা ভিয়েতনামে। ধানক্ষেতে পড়েছিল ।
ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে ঐ তিন দম্পতি পথ খুঁজে বের করতে লাগলেন – মানবিক সংকটের আবর্তে পড়া শিশুদের রক্ষা করার জন্য কী করা যায় যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছিল। তখন উত্তর ভিয়েতনামের সৈন্যবাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনামে ঢুকে গিয়ে মৃত্যু ও ধ্বংসলীলা চারদিকে ছড়িয়ে দিচিছল। কিন্তু সিমসন দম্পতি নিজ দায়বদ্ধতায় তাদের বিশ্বাসে অটল থাকেন । সিমসনেরা ভিনদেশের অবহেলিত অনাথদের দত্তক নেয়ার বিষয়ে যে প্রচার অভিযান চালিয়েছিলেন সে কাজে তারা সে সময়ে ঝাপিয়ে পড়েন। তারা অনাথদের আদর যত্ন করা ছাড়াও তারা কানাডীয় বাড়িতে তাদের দত্তক নেয়ার ব্যাপারে সরাসরি সহায়তা করতেন।
ঐ যুদ্ধে অনাথদের বাঁচানাের জন্য উপযুক্ত তিন দম্পতি অস্ট্রেলীয় রােজম্যারি টেইলর-এর সঙ্গে যােগাযােগ করেন প্রথমে ভিয়েতনাম হাে চি মিন সিটি, (আগে যার নাম ছিল সাইগন) ডাইরেক্টর অব অপারেশনস পদে কাজ করছিলেন। প্রত্যেক দম্পতি ভিয়েতনাম থেকে কমপক্ষে একজন যুদ্ধ অনাথকে দত্তক নেবার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানান। ১৯৬৯ সাল নাগাদ সিমসনরা তাদের প্রথম সন্তান মাই লিয়েনকে দত্তক নেন, যার জন্ম হয়েছিল ভিয়েতনামে । মাই লিয়েন ১০ মাস বয়সে Friends for All children-এর মাধ্যমে তাদের পরিবারে যােগ দেয় । সিমসনরা সবসময় টেইলরের সঙ্গে যােগাযােগ রেখে এক হাতে অন্যের সাহায্য ছাড়াই দক্ষিণ ভিয়েতনামের অনাথ আশ্রমে কর্মীদের এবং অনাথ শিশুদের সহায়তা প্রদান করেন । ততদিনে ১৯৭১-এ সিমসন, কাপুচিনাে এবং ব্ৰনস্টাইন দম্পতিদের উদ্যোগে ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে আন্তর্জাতিক দত্তক নেয়া দেয়ার ইস্যুগুলাে সংবাদ মাধ্যমে গুরুত্ব পেতে আরম্ভ করে ।
বিগত বছরগুলােতে ১৯৭১ থেকে অলাভজনক ও অসাম্প্রদায়িক সংস্থারূপে এফ এফ সি। তার ভূমিকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে গুয়াটেমালা, ভারত ও বাংলাদেশে ‘হােম’ প্রতিষ্ঠা করে। টরন্টো ও মন্ট্রিয়ল শহরে অফিস বসিয়ে স্যাভ্রা সিমসন এফ এফ সি’র প্রেসিডেন্ট হিসাবে আজও কাজ করছেন। তিনি উত্তর আমেরিকার মা-বাবাদের’ দ্বারা শিশুদের জন্য ব্যয়ভার বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন।
জুলাই ১৯৭২-এ যখন ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলেন বাংলাদেশেরে সরকারের সঙ্গে কয়েকটি যুদ্ধশিশু দত্তক নেবার বিষয়ে আলােচনা ও বাছাই করতে, সিমসনরা | তখন তাদের চারদিকে দুদেশের নথিপত্রের স্তুপের মাঝে ডুবে কাজ করছেন। তারা যে কেবল এফ এফ সি’র দূর্গ সামলাচ্ছিলেন তা নয়, তারা একই সঙ্গে তাদের মেয়ে মাই লিয়েন-এর দেখাশােনাও করছিলেন। তার তখন বড় ধরনের শল্য চিকিৎসা চলছিল। অত্যন্ত সমর্থ ও আশাবাদী স্যান্ড্রা একই সঙ্গে অন্টেরিও সরকারকে অন্টেরিওর দত্তকে উচ্ছুক  আবেদনকারীদের হােমস্টাডির কাজ দ্রুত শেষ করার জন্য লবি করে যাচ্ছিলেন। আমরা সেটা তৃতীয় অধ্যায়ে পড়েছি। স্যান্ড্রা বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেবার মতাে সম্ভাব্য আবেদনকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন এবং অচলাবস্থা দূর করার জন্য কিছু কর্মকৌশলও নির্ধারণ করেন।
ক্যাপুচিনােরা জুলাই ১৯৭২-এ কানাডাতে যে ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে নিয়ে আসেন তাদের মধ্যে  সিমসনদের দত্তক নেয়া ছেলে রাজিবও ছিল। স্যাভ্রার অন্টেরিও সরকারের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা এখনও মনে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, তারা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সে হৃদয়খোড়া যুদ্ধকাহিনী পুনর্ব্যক্ত করেন লেখকের সাথে আলাপকালে । জাতিগত পার্থক্যের কারণে ভিন্ন অনাথদের প্রতি স্যাভ্রার যে অপার মমতা, কিছু করার তীব্র ইচ্ছা এবং তার নিরলস সংগ্রাম ওদের জীবন রক্ষার লক্ষ্যে সেটার জন্য অনেকে স্যান্ড্রাকে অস্ট্রেলিয়ার | রােজম্যারি টেইলরের কানাডীয় সংস্করণ নামে ডাকেন যার অত্যুৎসাহী ও সাহসী কাজের জন্য মানুষ তাকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখেছে।
১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকের পুরাে সময়টা জুড়ে স্যান্ড্রা শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সব | সংস্থা যেমন, সােস্যাল সার্ভিস এজেন্সি, শিক্ষক সম্প্রদায়, বিভিন্ন পেশার কর্মী এবং অন্যান্য | দত্তক সমর্থনকারী এবং কমিউনিটি গ্রুপের মিটিং-এ কথা বলার জন্য সময় বের করেনিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। বিশেষ করে ওপেন ডাের সােসাইটি (ও ডি সি)-র মিটিং-এ উপস্থিত থাকার ব্যাপারে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যেখানে তিনি দত্তক বিষয়ে কথা বলতেন, প্রয়ােজনে তিনি কানাডাতে বহুজাতিক শিশুদের প্রবেশ আরও উদার ও খােলাখুলি করার জন্য আহবান জানাতেন। অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে তারা আগেও যেমন ছিলেন এখনও বহুজাতিক কানাডীয় শিশুদের বিদেশে দত্তক পাঠানাের জন্য “Official Clearing House” হিসাবে কাজ করে আসছেন।
তাদের এত সন্তানের কথা তারা খুব সহজাতভাবে বলেন – কেন এবং কীভাবে তাদের  উনিশটি ছেলেমেয়ে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। লয়েড-এর ভাষ্যমতে তিনি কখনাে বড় পরিবার পালন করতে চাইনি। তথাপি আসলে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যখনই তারা ভেবেছেন আরেকটি অনাথের জন্য তারা বাড়ির ব্যবস্থা করতে পারবেন, তখনই তাদেরকে আরও একটি শিশু দত্তক নিতে হয়েছে। তাদের যখন নয়টি ছেলেমেয়ে তারা তখন সন্তানদের ভালাে শিক্ষা দেবার কথা ভেবেছিলেন, যা তখনকার সময়ে বেশ খরচবহুল ব্যাপার হয়ে | দাড়িয়েছিল। একটি শিশুকে ভালাে শিক্ষাসহ বড় করে তােলার যে বিরাট খরচ শুধু কথা ভেবে তারা আর শিশু দত্তক নেবেন না ভেবেছিলেন । তথাপি লয়েড এবং স্যান্ড্রা আরও আরও অনাথ বাড়িতে নিয়ে আসার যুক্তি খুঁজে খুঁজে বের করেছেন । “শিক্ষা না পেলে শিশুর কী এসে যায় বলুন?” জিজ্ঞাসা করছিলেন স্যান্ড্রা তার আরেকটি শিশুর চাহিদাকে জোরদার করার প্রচেষ্টায় ।
মজার কথা হলাে, একই ধরনের যুক্তি তুলে ধরে লয়েডও মনে মনে তার সিদ্ধান্ত বদলিয়েছেন। যখন তারা আরেকটি অনাথ শিশুকে খুঁজে পান। সে শিশুটি তাদের দশম সন্তান হয়েছিল । “আরে ঠিক আছে, একটির জায়গা হয়ে যাবে,” (The Canadia, The Weekend Citizen, 24 February, 1979) বলে লয়েড তার সিদ্ধান্তটিকে সহজ করতে চেয়েছিলেন। দত্তক নেয়ার বিষয়ে সর্বদা স্থিরপ্রতিজ্ঞ লয়েড বলতে গেলে সে সময়ে মােটামুটিভাবে আরেকজন অনাথ শিশুর ব্যাপারে ইতােমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, যদিও স্যান্ড্রার সমর্থন। তখনও নেয়া হয়নি। এরপর বেশিদিন লাগেনি তাদের অন্তর্গত ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে আরও সন্তান দত্তক নিতে। দুর্দশাগ্রস্ত অনাথদের কষ্ট সহ্য করার অপারগতার বিষয়ে বলতে গিয়ে স্যান্ড্রা সংবাদমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: “আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে শিশুদের কষ্ট দেখতে পারব না,” (The Canadian, The Weekend Citizen, 24 February, 1979)। অনাথ শিশুদের সম্পর্কে স্যান্ড্রার সাধারণ মন্তব্য এখানে প্রণিধানযােগ্য: “যেহেতু ওরা সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, কাজেই তাদের পাওনা সবচেয়ে ভালােটা” (The Canadian, The Weekend Citizen, 24 February 1979)। সময়ের সঙ্গে দম্পতি একই প্রক্রিয়ায় আবার কাজ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত আরও ১০টি সন্তান দত্তক নিয়েছেন। একের পর আরেক মােট ১৯টি শিশু বছর দুয়েকের মধ্যে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু রাজিবও ছিল। তাদের ১৯টি ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র চারটি সন্তান ঔরষজাত অর্থাৎ পরিবারে জন্মেছিল। বাকি সবাই ইকুয়েডর, ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশের জাতক জাতিকা। আজ তাদের বয়স ৪২ থেকে ৬০ বছর ।
যখন সন্তানেরা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে তখন সিমসন দম্পতি ১৯ জন সন্তান নিয়ে সংসার বাড়িঘর পরিচালনার একটি কেতা বা স্টাইল অনুসরণ করেন। দম্পতি জানতেন সহজেই। অমন পরিস্থিতিতে সব ওলট পালট হতে পারে যদি না প্রাধিকার আরােপের ব্যাপারগুলাে ঠিক রাখা যায়। যে সব ব্যাপারে পরিবারের ওপর চাপ কম থাকে, সেগুলাে তারা নিজেরা সামলাতেন যেমন, ছােটদের নােংরা বা অকথ্য ভাষা ব্যবহার কমানাে; কথায় কথায় একজন অন্যকে দাবিয়ে দেয়াকে নিরুৎসাহিত করা, সব ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে একই সঙ্গে মনােযােগ দেয়া; এবং প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে আলাদা করে কিছু সময় দেয়া। তাদের মতে, প্রত্যেক শিশুকে ব্যক্তিগত এবং একান্ত সময় দেয়া প্রয়ােজন রয়েছে। বিভিন্ন বয়সে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নানা কাজে বাইরে যাওয়া এবং তাদের সঙ্গে নানাবিধ সমস্যা নিয়ে। আলােচনার প্রয়ােজনে প্রাধান্য দিতেন।
সিমসনরা বলেন, এসবের ফলে স্বাভাবিকভবেই ছেলেমেয়েরা সব সময়েই পরিবারের প্রতি। আসক্তবােধ করেছে। শুধু তাই নয়, তারা এটা বিশ্বাস করে বড় হয়েছে যে, তাদের মা-বাবা ঘনিষ্ঠভাবে তাদের প্রয়ােজনের খবর রাখেন; এবং যখন যা দরকার সেটা যােগানাের জন্য। তার সর্বদা প্রস্তুত । প্রতিদানে ছেলেমেয়েরাও জানত মা-বাবা তাদের কাছে কি প্রত্যাশা করেন। তারা শৈশব থেকে দেখে আসছে কেমন করে তাদের মা-বাবা পরিবারের হাল ধরে বসে আছেন পরম আদর আর ভালােবাসার পশরা নিয়ে। তাদের জন্য তাদের মা-বাবা সর্বদাই তৈরি ছিলেন (এবং এখনও রয়েছেন) – এটাই তাদের সবচেয়ে স্বস্তির বিষয়। গ্রহণযােগ্যতা ও আশ্বস্ততা এ দু’টি মৌলিক ধারণার সাথে তারা ছােটবেলা থেকেই পরিচিত। ১৯৮০-এর দশকে সিমসন দম্পতি তাদের বিশেষ কার্যক্রমের জন্য সংবাদ মাধ্যমে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেন। বাস্তবিকপক্ষে ততদিনে বহুজাতিক সিমসন পরিবার সংবাদ মাধ্যমের চেষ্টায় মন্ট্রিয়ল পেরিয়ে পুরাে কানাডাতে পরিচিতি লাভ করেন। তখন এমন একসময় গিয়েছে যখন সারা দেশ তাদের দিকে তাকিয়েছিল।
যখন ডেমিয়েন সিমসনদের বাড়িতে ১৯৭২ সালে সায়গন থেকে এসে পৌছল, সে সময়ের সংবাদ প্রতিবেদনগুলাে প্রণিধানযােগ্য। সিমসনদের বহুজাতীয় পরিবারের উপর লেখা প্রতিবেদন ছাড়া আরও অনেক লেখনী ছাপা হয়েছিল, যেমন- ককেশীয় কানাডীয়দের। বাড়িতে ভিন্ন জাতের শিশু দত্তক আনার নতুন লক্ষণীয় প্রবণতা। এটাও একই সঙ্গে সংবাদে উঠে আসে। “দশটি শিশুর মধ্যে একজন ক্ষুদে ভয় পাওয়া ভিয়েতনামী অনাথের কণ্ঠ কি আমরা শুনতে পাবাে?” একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী লিখেছিলেন, ১৯৭০ দশকের গােড়ায় সিমসনদের বাড়িতে গিয়ে ১০ জন শিশুর দেখা পেয়েছিলেন (The Gazette, 13 October, 1972)। সিমসন পরিবারের বৈচিত্র্য চারদিকের মানুষের মনােযােগ এড়ায় নি। সিমসনদের চার শােবার ঘরবিশিষ্ট বাড়িকে “বিশ্বের ঝামেলার ক্যালাইডােস্কোপ” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল যেখানে সিমসনরা অনাথদের তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছিলেন (The Gazette, 13 October, 1972)। সিমসনরা যে চমৎকার পরিবেশ বান্ধব বাড়িতে ১৯ জন ছেলেমেয়েদের লালন-পালনের করেন সংবাদ মাধ্যম তার ভূয়সী প্রশংসা করে। স্বাভাবিকভাবেই তখন প্রায়ই কানাডাতে নতুন ধারা বা প্রবণতার উদাহরণ হিসাবে সিমসনদের পরিবারকে খবর প্রদর্শনীতে। দেখানাে হয়েছে বেশ কয়েক বছর ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসাধারণ উপায়ে এসে এক পরিবারে মেলার ফলে সিমসন পরিবার এককভাবে বৈচিত্রের মাপকাঠিতে কানাডীয় হিসাবে আলাদাভাবে সবার দৃষ্টিগােচরে আসেন। যদিও পরিবারটির মা-বাবা ককেশীয়, তাদের সন্তানেরা এত বিচিত্র এবং বহুজাতিক যে, কেউ ওদের কখনাে শ্বেতাঙ্গ পরিবার” হিসাবে দেখেনি।” “এর কারণ হলাে,” বলেন স্যাম্ৰা, “শ্বেতাঙ্গ সদস্যরা আমাদের পরিবারে সংখ্যালঘু । আরেকটি লক্ষণীয় দিক সিমসন পরিবারে বৈচিত্র্য এত উচ্চকিত যে এর ফলে ভাইবােনেরা একে অন্যের সঙ্গে যারপরনাই ঘনিষ্ঠ। “পরিবার একসঙ্গে থাকতে চেয়েছে যেহেতু, সদস্যরা খেলাধুলা ভালােবাসে তারা একটি বেইসবল টিম গড়েছিল, একটি হকি দলও,” স্যান্ড্রা। অতীত স্মৃতিচারণ করে বলেন এটা সিমসন পরিবারকে একদম পুরােপুরি বৈশিষ্ট্যসূচকভাবে বলা যেতে পারে কানাডীয়; যে কানাডাতে বাংলাদেশে জন্মানাে রাজিব বাস করেছে শৈশব থেকে এবং বড় হয়েছে একজন কানাডীয় হিসেবে।
এফ এফ সি’র প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্যান্ড্রা প্রতি তিনমাসে একবার ভারত ও বাংলাদেশে এফ এফ সি’র হােমস পরিদর্শনে যেতেন। ভারতে তিনটি এবং বাংলাদেশে তাদের একটি হােম আছে । ভারত ও বাংলাদেশে এফ এফ সি ৫০০-এর বেশি শিশুকে আশ্রয় দিয়েছে যাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুরা পােলিও-এর শিকার, অন্ধ অথবা এক চোখে দেখে এমন শিশু জন্ম থেকে বিকলাঙ্গ এবং হার্টের অসুখজনিত । বর্তমানে শিশুদের সমর্থন এবং স্বপক্ষ নিয়ে কথা বলে যিনি অনাথদের বন্ধু বলে গণ্য, সে স্যাভ্রাকে প্রায়ই তার অভিজ্ঞতা ভাগ করেনিতে সম্ভাব্য একক পরিবার ও সংস্থায় আমন্ত্রণ জানানাে হয় । দত্তকের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকায় সিমসনেরা দৃঢ়ভাবে সত্যিই বিশ্বাস করেন যে, অনাথ হিসাবে কোনাে বাড়িতে স্থানান্তরিত করার জন্য “কেবল পুরনাে পরিবার হলেই সেটা যথেষ্ট নয়” (The Gazette, 13 October, 1972)। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলােকে স্যান্ড্রা বলেন, দত্তকের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলাে পরিবারের পরিবেশ | দত্তকগ্রাহী মা-বাবার ভালােবাসা এবং তাদের দায়বদ্ধতা যাদের কাছ থেকে পােষ্য অনাথরা সবচেয়ে ভালাে আচরণ আশা করে (The Gazette, 13 October, 1972)
সিমসনেরা কানাডাবাসীর মনে যে বিষয়ে দাগ কাটতে পেরেছেন সেটাই তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন তাবৎ কানাডার ভেতরে আন্তর্জাতিক এবং আন্তবর্ণীয় দত্তক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ।। বিগত বছরগুলিতে সিমসনেরা তাদের জন্য একটি কাঠামাে নির্মাণ করেছেন। যেটা কাঠামাে অনুসরণের মাধ্যমে সহজচিত্তে যে কোনাে ব্যক্তি অথবা সংঘ আন্তর্জাতিক এবং আন্তবর্ণীয় দত্তক গ্রহণের বিষয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সফলতা লাভ করতে পারেন। অসাধারণ কর্মস্পৃহা ও সক্ষমতা থাকার কারণে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে সিমসনেরা কানাডাতে তাদের ঈর্ষণীয় নেতৃত্বের গুণে আন্তবর্ণীয় দত্তকায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্যের নজির রেখে। প্রভূত প্রশংসা অর্জন করে। অনাথ শিশুদের দত্তকায়ন এবং আন্তবর্ণীয় পরিবার সম্প্রসারণে অগ্রপথিক হিসাবে পরিগনিত হয়েছেন ।
১৯৭১ সালে Montreal Citizenship Council স্যান্ড্রাকে Outstanding Citizen Award প্রদান করে। আবার ১৯৮৩ সালে স্যান্ড্রা Order of Canada লাভ করেন এশিয়ার দুঃস্থ, পীড়িত ও বিকলাঙ্গ শিশুদের রক্ষা করার সুবাদে। একই বছরে স্যাজ্জ্বা Ontario Medal (অন্টেরিও মেডাল) লাভ করেন। দম্পতির মেয়ে কিম্বার্লি, যে স্যান্ড্রার সঙ্গে পরামর্শক্রমে ঢাকা অনাথ আশ্রম চালাত, Jaycee Award লাভ করেন কানাডার পাঁচজন। বিশেষ তরুণ Citizen of the Year-এর একজন হিসেবে।
সিমসনের সন্তানেরা কানাডা ও আমেরিকার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। সব পারিবারিক সদস্য এখনও একসঙ্গে হন এবং একে অপরকে সাহায্য করেন যেহেতু তারা মহান সিমসনদের একজন – যা তাদের প্রত্যেককে গর্বিত করে। মাই লিয়েন তার মাকে টরন্টো হােম অফিসের স্পন্সরশিপ-এর কাজে সাহায্য করেন। কিম্বারলি এফ এফ সি ইউ এস এ ফাইন্যান্স-এর কাজ করে তার বাড়ি এ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্য থেকে। তাদের সন্তান সন্ততি ও নাতি নাতনি যারা বিভিন্ন পশ্চাদপটের – তাদের অভিজ্ঞতার আলােকে নতুন নতুন কাজ সম্পন্ন করে। এসব কাজ তাদের জীবনে আরও উদ্দেশ্য যােগায়, আরও উত্তেজিত করে তাদেরকে যেন শ্বাসরােধ করে, তাদের ব্যস্ত রাখে কাজে। যখনই ছেলেমেয়েরা ও নাতি নাতনিরা আসে এবং তাদের সঙ্গে থাকে, তখনই সিমসনদের বাড়িতে ছােটখাটো পারিবারিক পুনর্মিলন হয়। সব শিশুরা না থাকলেও যারা উপস্থিত থাকে, তারা উপভােগ করে পুরােপুরি সময়টি।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!