You dont have javascript enabled! Please enable it! অনিল-যুদ্ধশিশু - সংগ্রামের নোটবুক
রে এবং এলিজাবেথ মৌলিং

মৌলিংরা ১৯৭১ পর্যন্ত অন্টেরিওর টরন্টো এলাকায় বাস করেন, যেখানে তারা তাদের প্রথম সন্তান লােরাকে দত্তক নিয়েছিলন। তারপর তারা কিউবেক-এর মন্ট্রিয়লের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে বসবাস শুরু করেন । মন্ট্রিয়লে তারা অনিল, পানু এবং কেটিকে দত্তক নেন । দম্পতি পরিবার আবার ১৯৭৬-এ অন্টেরিও-তে ফেরত আসেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের শুরু থেকেই মৌলিংরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অনাথদের নিজেদের সন্তানরূপে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। এ গ্রুপের অন্যান্য দত্তক দম্পতিদের মতাে এরাও কানাডার বাইরে থেকে দত্তক নেবার উপযুক্ত সন্তানদের খুঁজছিলেন | দম্পতি তাদের চোখ খােলা রেখেছিলেন ঐসব অনাথদের যারা সাধারণত ছিল অসুস্থ অথবা বিকলাঙ্গ । কাজেই তাদের দত্তক নেবার মতাে মা-বাবাও খুঁজে পাওয়া ছিল ভার।

মন্ট্রিয়লে বাস করার সময় মৌলিংরা আন্তর্জাতিক দত্তকের মতাে একাধিক প্রচেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৭১ সালে মন্ট্রিয়লে আসার সঙ্গে সঙ্গে দম্পতি মন্ট্রিয়লের পশ্চিমে প্রান্তে বসবাসকারী এক গ্রুপ পরিবারের সঙ্গে জোট বাঁধেন। তখন এলিজাবেথ সাধারণ সচিব ছিলেন Terre Des Hommes (TDH)-এর মন্ট্রিয়ল শাখার । এটা একটি জেনেভান্থ দত্তক এজেন্সি যেটা বিশ্বব্যাপী শিশুদের মঙ্গলাকাঙ্খী। এ সংস্থা আরও যেসব কাজে জড়িত ছিল। তার মধ্যে ছিল ১৯৭০ দশকে কানাডাতে ভিয়েতনামী অনাথদের জন্য চিরস্থায়ী বাড়ি খুঁজে পাওয়া এবং সেসব বাড়িগুলােতে অনাথদের স্থানান্তরিত করা। সে সময়ে মৌলিংরা ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)’তে যােগ দেন। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি মৌলিং দম্পতি আরও তিনজন মন্ট্রিয়ল দম্পতি, যেমন: স্যান্ড্রা ও লয়েড সিমসন, ফ্রেড ও বনি কাপুচিনাে এবং হার্ব ও নেওমি ব্ৰনস্টাইন-এর সঙ্গে যােগ দেন। ইতােমধ্যে এ দম্পতিদের সকলেই মিশ্র জাতির ভিয়েতনামী, ক্যাম্পুচিয়ান অথবা কোরিয়ান অনাথ শিশুদের দত্তক নিয়েছিলেন এবং পরিকল্পনা করছিলেন আরও দত্তক নেবার ।
১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সলের মধ্যে মৌলিংরা চারটি ছেলেমেয়ে দত্তক নেন। “আমাদের প্রথম দত্তক একটি মিশ্র জাতির শিশু এবং ওকে দিয়েই চক্র শুরু,” বলেন রেই মৌলিং লােরার। নাম উল্লেখ করে । সে এক কানাডীয় শিশু, যে আইরিশ ও পশ্চিম ভারতীয় (ত্রিনিদাদীয়ান পিতৃমাতৃত্যের); অনিল, যুদ্ধশিশু, বাংলাদেশের; তৃতীয় পুত্র পানু হলাে হাইতিও এবং চতুর্থ সন্তান কেটি ভিয়েতনামের । বাইরে থেকে দেখতে ছেলেমেয়েরা যেমন একজন অন্যজনের থেকে আলাদা, তেমনি তাদের ককেশীয় মা-বাবার থেকেও তারা পৃথক। চার সন্তানের পর মৌলিংরা তাদের সংসার আর বড় করতে চাইনি এ বিশ্বাস থেকে যে, আরও সন্তান নিলে তাদের সঠিক যত্ন করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমরা তৃত্বীয় অধ্যায় যেমন দেখেছি, জুলাই ১৯৭২ সালে যখন এফ এফ সি টিম বাংলাদেশে আসে সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে এবং যুদ্ধশিশু দুএক ডজন বাছাই করার জন্য, এলিজাবেথ বাকি সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে যােগ দেন এবং কানাডীয় টিমের একজন সদস্য হিসাবে তিনি নিজের বিমান ভাড়া নিজেই দেন।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, যে কোনাে দম্পতির পক্ষে একটি শিশুকে পছন্দ করে আলাদা। করা বেশ কঠিন কাজ। কারণ প্রত্যেকেই সবচেয়ে স্বাস্থ্যল ও সুন্দর শিশুটিকে বেছে আলাদা করেনিতে চান। কানাডীয় টিম তখনকার সুপিরিয়র, মিশনারিজ অব চ্যারিটি এবং যুদ্ধশিশুদের সংবিধিবদ্ধ অভিবাক সিস্টার ম্যাগারেট ম্যারির সাথে আলাপের পর বুঝতে পারেন যে, তখনকার ভঙ্গুর নবজাতকদের মধ্যে অনেকের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তিনি আশাবাদী। ছিলেন না । যুদ্ধশিশুদের কারাে কারাে স্বাস্থ্যের অবস্থা বিষয়ে তার বিশেষ মনােযােগ ও শঙ্কা। ছিল। যেহেতু এলিজাবেথ ওখানে দলের সঙ্গে ছিলেন, তিনি নিজের জন্য একটি ছেলে বেছে । রাখতে পেরেছিলেন। ছেলেটির নাম ছিল অনিল । “ও ছিল বেশি রােগাদের মধ্যে একজন। ও চোখ দুটি গভীর, জ্ঞানী মানুষের।”ী সে সময়ের স্মৃতিচারণে এলিজাবেথ বলেন, প্রথম দর্শনেই তিনি ছেলেটির শান্ত দৃষ্টি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। শিশুটি যেন তার । মুখভঙ্গিতে বলছিল তিনিই (এলিজাবেথ) তার ভবিষ্যৎ মা) অন্য বিশেষ কেউ নন। যদিও শিশুটির শরীর অবিশ্বাস্য রকমের স্বাস্থ্যহীন ও দুর্বল ছিল, তিনি অনিলকে তাদের ছেলে। হিসাবে মনােনীত করতে একটুও দ্বিধার সম্মুখীন হননি।
এলিজাথের আর কিছু মনে নেই, কেন অন্য শিশুদের তুলনায় ওই নাজুক নিস্তেজ শিশুটি তাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। যেটুকু তার মনে আছে তা হলাে, ছেলেটি তার “গভীর কালাে চোখে” তার “পানে তাকিয়ে ছিল। সে সময়ে এলিজাবেথ নিজেকে অনাথ আশ্রম প্রাঙ্গনে দেখেনিজের ভাগ্যকে প্রশংসা করেছিলেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী একটি সন্তন হলেই হতাে, ছেলে অথবা মেয়ে হােক না কেন। তাদের দলকে জানানাে হয়েছিল যে ছেলেটি অসম্ভব। রােগা এবং তারপরও তিনি তাকে বেছে নিয়েছিলেন । এলিজাবেথের জন্য ওটা ছিল সঙ্গে। সঙ্গে শিশুটির প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতাে ঘটনা। সে মুহূর্তে তিনি সব শিশুর মধ্য থেকে দুর্বল রােগাটে শিশুটি তুলে নেবার জন্য মনস্থির করেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন হঠাৎ করে । তিনি যেন শিশুটির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাৎক্ষণিক মা” হিসাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন চোখের পলকের সাথে  যদিও অনেকগুলাে বছর গড়িয়েছে এলিজাবেথের মনে আছে, ঢাকার পুরনাে জীর্ণ অনাথ। আশ্রমগুলি এবং অন্য বাড়িঘরকে জরুরিভিত্তিতে সেবা সদনে রূপান্তরিত করে দুস্থ নারী ও শিশুদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে সরকারের কি প্রাণান্তকর প্রয়াস! সেসব ছিল ভয়ঙ্কর। দৃশ্যাবলি! চোখে দেখে মাথা ঠিক রাখা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। অত অত শিশু, চারদিকে। অনেকেই মারা গিয়েছিল । যা হােক, অনেক শিশুরই মায়ের গর্ভে মৃত্যু ঘটেছিল আবার অনেকের জন্মের অল্পক্ষণ পরেই । এলিজাবেথের মনে আছে, কীভাবে তারা অবাক হয়ে। ছিলেন অনাথ আশ্রমের কর্মীদের অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করতে দেখে, সামান্য অথবা কোনাে ওষুধ। তাদের সঙ্গে না থাকলেও, শিশুদের আসা যাওয়ার বিরাম ছিল না।
বাংলাদেশ থেকে ফেরত এসে এলিজাবেথ বাংলাদেশের অনাথদের জন্য তহবিল সগ্রহের। কাজ চালিয়ে যান। রেই তাদের প্রতিবেশিদের অনেকের মাঝে ইতিবাচক সাড়া জাগাতে পেরেছিলেন । এফ এফ সি’র নিয়মিত মিটিং-এ এলিজাবেথ গর্বের সঙ্গে প্রতিবেদন উপস্থাপন। করেন যে, এফ এফ সি-র স্থানীয় সদস্যদের বাংগালি পরিবারদের সহায়তায় পকেটে হাত। ঢােকাতে বলা হয়েছিল।” দম্পতি কঠোর পরিশ্রম অব্যাহত রাখেন। ১৯৭০-এ মাঝামাঝি সময়ে কর্মশক্তিপূর্ণ এলিজাবেথ প্রচারণা ঋদ্ধ অপারেশন বেবী লিফট-এর দ্বারা ১৯৭৫ সালের বসন্তে ভিয়েতনাম ও ক্যাম্পুচিয়া থেকে অনাথ শিশুদের তুলে পাইকারি হারে বিমানে করে আমেরিকায় আনা হয় তখন মানুষ তার কর্মকান্ড সুপ্রত্যক্ষ করেন। যার জন্য তিনি প্রাধান্য অর্জন করেন ।
মৌলিংরা তাদের সন্তানদের সম্পর্কে সর্বিক সমম্বিত এক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে নিতে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন – যা তাদের সব বয়স হলে এক ধরনের নিরাপত্তাবােধ দেবে অবিচ্ছেদ্যভাবে। তাদের পরিচিতি দেবে জীবনভর যখন যেমন প্রয়ােজন। তারা সচেতন ছিলেন যে, অনেকে বিশ্বাস করেন যে পরিবারের জন্য জাতিগত পার্থক্য এবং সংস্কৃতি ভুলে যাওয়া সহজ ব্যাপার । শিশুর সঙ্গে এমন আচরণ করেন ও যেন বাবা-মায়েদের মতােই শ্বেতাঙ্গ শিশু। এ বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করে মৌলিংরা বলেন, এটা বরং একধরনের সমস্যা সৃষ্টিকারী উপাদান, কারণ এতে শিশুকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার সমান। শুধু তাই নয়, তারা চেষ্টা করেছেন ছেলেমেয়েদের নিজেদের বর্ণ ও গােত্রের লােকদের সাথে মেলামেশা সুযােগ করে দিতেন। যাতে করে তাদের সন্তানেরা নানা বৈচিত্রতা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয় ।
ছেলেমেয়েদের বয়স যখন ৫ থেকে ৭ বছর, এলিজাবেথ এবং রেই ১৯৭৭ সালে আলাদা। হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘ ২১ বছর বিবাহিত জীবনযাপন করার পর ১৯৮১ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। দম্পতি বিশ্বাস করেন, তারা তাদের সন্তানদের জন্যই এতদিন একসঙ্গে ছিলেন । এলিজাবেথ চার সন্তান নিয়ে যাকে বলা হয়, single mother হােন। সে সময় থেকে শুরু হয় তার জীবনে সবচেয়ে ব্যস্ত ১০ বছর। এলিজাবেথ এবং রেই দুজনই বলেন, তাদের সন্তানেরা ঐ বিবাহ বিচ্ছেদে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, অনেকে যেমন শুনেই ধরে নিতে পারেন যে, সন্তানেরা ক্ষগ্রিস্থ হয়েছিল। পরিবর্তে, যা হলাে তা একেবারে উল্টো। দম্পতি তাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি সম্পর্কই দায়বদ্ধ থাকেন। উষ্ণ ভালােবাসার সম্পর্ক বজায় রেখে সকলে সকলের যত্ন নিতেন। মা-বাবা দুজনেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সপ্তাহান্তিক ছুটির দিন কাটাতেন কোনাে কোনাে সময় একসঙ্গে দুজনকে নিয়ে। তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আর্থিক ব্যয়ের বােঝা বিষয়ক সমস্যা দেখা। দেয়নি কখনাে, কারণ দম্পতি ওটা এমন ভাবে ঠিক করেনিয়েছিলেন যে, তারা যার যার দায়িত্ব পালন করবেন। মৌলিং-এর চার সন্তানেরা এলিজাবেথের মিসিসা বাড়িতে মায়ের সঙ্গে বাস করে। সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে আগত জ্যাকি ছিল তাদের আয়া । সে এলিজাবেথের বাড়িতে থাকত। জ্যাকি চার সন্তানের দেখাশােনা করত এবং সে সাথে সংসারের বাজার ঘাট কেনা কাটা সবই করে দিত। এলিজাবেথ জ্যাকির কথা বলতে গিয়ে প্রশংসা ভিন্ন অন্য কিছু বলেননি। ছেলেমেয়েরা জ্যাকির সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। মৌলিংরা স্থানীয় সংবাদপত্রে সত্যিকারের বহু সাংস্কৃতিক পরিবার হিসাবে হাততালি পেয়েছে বিভিন্ন উপলক্ষে ।
আরও মজার কথা, সংবাদ মাধ্যম মৌলিংদের প্রশংসায় এজন্য আরও হাততালির সুযােগ খুঁজত যে, ওদের চারটি ছেলেমেয়ে চারটি পৃথকদেশের প্রতিনিধি যেন। মৌলিংরা দত্তক নেবার ক্ষেত্রে যা ভালাে করার ছিল, তাই করেছেন। একটি স্থানীয় কাগজ মৌলিংদের। বাড়িকে বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিল – মেডােউভেইল এলাকায় একটি বাড়ি হাসি খুশি আর আনন্দে উপচে পড়ছে, চারটি উজ্জ্বল ছােট্ট শিশুর হাসি, সবারই বয়স এক কিন্তু আলাদা। পশ্চাদপট”। আট বছর পর single Imother এলিজাবেথের বাড়িতে সব ছেলেমেয়েদের বড় হতে দেখে আরেকটি স্থানীয় কাগজ এলিজাবেথকে মাদার্স ডে-র শুভাশীষ জানিয়ে লিখে “পল্লি মা একেবারে স্বীকৃত ও অধিসম্পাদী মর্যাদাসম্পন্ন” যে কিনা “মেডােভেইল গাঁয়ের ভালােবাসাপূর্ণ সুন্দর পরিবার।”২৯ ১৯৭৭ এবং ১৯৮৬-এর মধ্যে এলিজাবেথ একা আয়া জ্যাকির সাহায্যে তার ছেলেমেয়েদের বড় করে তােলেন। এলিজাবেথ একা হলেও তিনি পরিবারের গুরুত্বের উপর জোড় দিয়ে বলেন: “আমার মতাে অন্যান্য বাবা-মায়েরা তাই ভাববে যে, একটি শিশুর বড় হবার জন্য একটি পরিবার দরকার ।” এলিজাবেথ আরও মত পােষণ করেন যে, “অনাথ আশ্রমে সবচেয়ে ভালাে এবং যত্ন থাকলেও সেখানে একজনের সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক (যেটাকে ইংরেজিতে বলে bonding) হয় না, সে কারণে একটি শিশুকে থাকতে হয় তার মায়ের সঙ্গে অথবা বাবার সঙ্গে একই পরিবারে।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে এলিজাবেথ বলেন, যখন তিনি বড় বড় হাড়িতে রান্না করতেন। স্প্যাগেটি (সেমাইজাতীয় ইতালীয় খাদ্যবিশেষ) সস এবং চিলি (শুকনাে লঙ্কার গুড়াে) তখন তিনি খুব মজা পেতেন। শিশুদের ভাগ্য, জ্যাকিকে সবাই পছন্দ করত এবং তাদের কাছে জ্যাকি খুব জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল । এলিজাবেথ সেজন্য কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত ছিলেন এটুকু ভেবে যে, তার ছেলেমেয়েদের অন্তত একজন সাথী রয়েছে সর্বক্ষণ নিজ বাড়িতে । এলিজাবেথের এখনও মনে পড়ে: “রাতে প্রতিটি শিশু তার প্রিয় গান শুনতে চাইত। সবাই। বেশ গুছিয়ে বসত, যদিও আমি খুব ক্লান্ত থাকতাম। ওরা সবাই আলাদা আলাদা গান ভালােবাসত । তখন সবচেয়ে এবং সবার বড়’র মধ্যে পার্থক্য ছিল মাত্র ১৮ মাস।
অবসর গ্রহনের পরে কাজ করবে বলে এলিজাবেথ ফিরে গিয়েছিল ভােকেশনাল হাই স্কুলে পড়াতে। সে সব দিনে এলিজাবেথ বাড়ি ফিরতেন তার ছেলেমেয়েদের মতাে প্রায় একই সময়ে – প্রচুর ড্রাইভিং, স্কুল, সুইমিং ক্লাস, ব্রাউনিজ, মার্শাল আর্টস, গ্রোসারি শপিং। এলিজাবেথের সবচেয়ে বড় দক্ষতা ছিল তার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করা, খােলাখুলি তাদের দিকে তাকানাে, যা তাদের অনুসরণ করতে হতাে। পরিবারের সাপ্তাহিক মিটিং হতাে যখন ছেলেমেয়েকে বলা হতাে কীভাবে তাদের কেমন দিন চলছে। তারা কি কোনাে কিছুর পরিবর্তন চায়? অথবা তাদের কি কিছু বলার আছে, ইত্যাদি নিয়ে আলাপের। জন্য । তেরাে বছর না হওয়া পর্যন্ত এলিজাবেথ এভাবেই ওদের বড় করে তুলেছেন।
১৯৮৬ সালে যখন তার দ্বিতীয় স্বামী তাদের সঙ্গে যােগ দেন, পরিবেশ একটু বদলায়, ভালাের দিকে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সত্ত্বাবা জন এবং তার সন্তানরা খুব সহজাতভাবে বেশ ঘনিষ্ট হয়ে যায় একে অন্যের সাথে । এলিজাবেথ যে স্কুলে পড়াতেন, জনও সে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সৌভাগ্যবশত ওখানে আর কোনাে সমস্যা ছিল না। যেমনটা অনেক সময় কিশাের-কিশােরীদের বেলায় হয়ে থাকে। এদিকে সন্তানদের বাবা রেই পূনরায় বিয়ে করেন ১৯৮১ সালে। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে একটি ছেলে রয়েছে। সবকিছুই ভালােভাবে চলে এবং পালাক্রমে ছােট্ট ছেলেটিও বেশ কথা বলে। রেই বলেন “আমার ছােট ছেলেটি বলে যে, সে আমার বড় ছেলেমেয়েদের ভাই, যাদেরকে সে দত্তক নিয়েছে। এর কিছুকাল পরেই এলিজাবেথ শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে মনােস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক হিসাবে কাজ শুরু করেন। ২৪ বছর তিনি মনােরােগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন, ২০০০ সালে তিনি অবসরে যান।
এলিজাবেথ বলেন, অনেক সময় অতিবাহিত হলেও অনিলের সম্পর্কে এখনও অনেক ঘটনা। তার স্মরণে আছে। অক্টোবর ১৯৭১ নাগাদ তারা যুদ্ধশিশুদের খবর শুনেছিলেন, যারা বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের ঔরসে। তারা আরও শুনেছিলেন এই নবজাতকদের ভালােবাসার মতাে পরিবার অথবা কোনাে ভবিষ্যৎ তাদের জন্মদেশে পাবে না। স্বাভাবতই নানা ধরনের কূপমন্ডুকতার জন্য । শুরুতে মৌলিংরা জানতে পেরেছিলেন যে, এ ধরনের অনাথ শিশুদের অবাঞ্ছিত’ অখ্যা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে কাজেই নিজেদের দেশে তারা কলঙ্কিত এবং ‘অপ্রার্থিত, তাদের জন্মকে ঘিরে যেসব ঘটনা রয়েছে সেসবের জন্য । এই শিশুদের গ্রহণ করে নেয়ার মতাে কোনাে পরিবার সে দেশে পাওয়া যাবে না। কানাডীয় মূল্যবােধের প্রেক্ষাপটে সামাজিকভাবে এ ধরনের শিশুদের কেউ অন্যদৃষ্টিতে এখন আর দেখে । কাজেই মৌলিংদের কাছে এটা কোনাে সমস্যা ছিল না।
এলিজাবেথ তার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে গর্বিত। কারণ তিনি জীবনের সিংহভাগ সময় দিয়ে তাদের বড় করেছেন। প্রথম স্বামী রেই-য়ের সঙ্গে কিছুকাল দাম্পত্য জীবনযাপন এবং তার পর বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে দ্বিতীয় বিবাহ করার পর দ্বিতীয় স্বামী জনের সঙ্গে অনেক বছর কাটিয়েছেন। মােটকথা, শুরু থেকে এ যাবৎ পর্যন্ত তিনিই তাদের লালন পালন করেছেন। এলিজাবেথ বলেন, প্রথম থেকে যখন তারা মা-বাবার ভূমিকায় শিশুদের সঙ্গে সংসার করতে নামেন, তাদের ডাক্তার প্রায়ই বলতেন, “ওই শিশুটা এত মারাত্নক আঘাত পেয়েছে, ওকে। দত্তক না নিলেই পারতেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের অভিজ্ঞতাটি ছিল ঠিক উল্টো। প্রত্যেক ক্ষেত্রে ছয় মাস অন্তর অথবা তার কাছাকাছি সময়ে ঐ একই শিশুর অগ্রগতি দেখে ডাক্তাররা। অবাক হয়েছেন।
এলিজাবেথ বর্ণনা করেন, তারা কীভাবে নিজেদের তৈরি এক একটি ঐতিহ্য তাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বজায় রেখেছেন। যখন তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছিল তখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কীভাবে প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের জন্মদিন পালন করবেন: “আমরা প্রত্যেক সন্তানের দুটি জন্মদিন পালন করতাম। একদিন তার প্রকৃত জন্মদিনটি উদযাপিত হতাে কেক এবং উপহারাদি সহকারে এবং সাধারণত একটি পার্টি সহযােগে। দ্বিতীয়টি, যেদিনে সে এ সংসারে এসেছিল সেদিনটিতেও আমরা একটি কেক সহযােগে পালন করতাম”। শুধু তাই নয়, তারা ছেলেমেয়েদের কীভাবে তাদের দত্তক নেয়া হয়েছিল এবং কীভাবে তারা তাদের জন্মদেশ থেকে কানাডা এসেছিল সে সব গল্প বলতেন। যেহেতু অন্য সবাই দূর দেশ থেকে বিমানে ভ্রমণ করে এসেছিল, তাদের বড় মেয়ে লােরা নালিশ করত যে, অন্য ভাইবােনেরা সব বিমানে এসেছিল, কিন্তু সে এসেছিল গাড়িতে তার কারণ। লােরাকে মলিংরা এনেছিলেন টরন্টো শহর থেকে  এলিজাবেথ প্রতি রবিবার তাদের ছেলেমেয়েদের স্থানীয় ইউনিটারিয়ান চার্চে নিয়ে যেতেন।
কিন্তু বাবা-মা দুজনই ধর্মীয় ব্যাপারে একদম খােলামেলা এবং স্থিতিস্থাপক থাকতে চাইতেন। তারা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন ছেলেমেয়েরা সৃষ্টিকর্তার শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে উঠুক; একক। মানুষের বিশ্বাস করবার যে অধিকার তারা সে অধিকারের রীতিনীতিগুলাে সম্পর্কে জানুক উপরন্তু ব্যক্তিগত সত্ত্বার একাগ্রতা, অভঙ্গুরতা রক্ষা করার সম্পর্কে জানুক এবং নিজস্ব অখন্ডতা বজায় রেখে সত্যের অনুসন্ধান করার পথ খুঁজে পাক। মৌলিং পরিবারের আরেক আগ্ৰহ উদ্দীপক দিক হলাে: বছরের পর বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু মৌলিং ছেলেমেয়েরা। সকল সদস্যদের সঙ্গে এমন ভাবে শক্ত বাঁধনে বাঁধা পড়েছে যে আজ পর্যন্ত ওদের সে সব বাঁধনটুকু রয়েছে। ওদের বড় করে তােলার সময় যে সব প্রশ্নের মুখােমুখি হয়েছিলেন। সেগুলাে ছিল জাতি, সংস্কৃতি, ও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা আত্মপরিচিতি সকল। পেছনে তাকিয়ে এলিজাবেথ বলেন, তিনি অতীত জীবন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। যেহেতু দত্তক নেবার সময় তাদের শিশুরা বিভিন্ন জাতের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিল স্বভাবতই এলিজাবেথ শিশুদের অতীত জীবন সম্পর্কে দত্তক নেবার সময় তেমন কিছু জানতেন না। উনি কেবল জানতেন বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন গােত্র ও সংস্কৃতির শিশুর জন্ম হয়েছে এবং তাদেরই কয়েকজনকে দত্তক নিয়ে এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এলিজাবেথ স্বাভাবিকভাবেই গর্ববােধ করে বলেন, তিনি লক্ষ্য। করেছিলেন তাদের সন্তানেরা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের নিজেদেরকে দেখত বা সংজ্ঞায়িত করত। “তারা দেখত না যে তারা নানা বর্ণের মানুষ এক জায়গায় একত্রিত হয়েছে। তারা একে অন্যকেই শুধু দেখত শুধু ভাই ও বােন হিসাবে গ্রহণ করে। তারা কখনাে একসঙ্গে খেলেছে, কখনাে বা খেলনার দখল নিয়ে ঝগড়া করেছে, একে অন্যের উপর গােসল করার সময় বাথটাব থেকে সাবান-জল ছিটিয়েছে। ভাই অথবা বােনের নাকের আকার যেমন তাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তেমনি তাদের গায়ের রং কেমন সেটা নিয়ে তারা একটুও ভাবেনি।” তাদের ছেলেমেয়েদের বড় করে তুলতে এলিজাবেথকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে। জাত, সংস্কৃতি ও পরিচিতি সংক্রান্ত নানাবিধ প্রশ্ন শুনে উত্তর দিতে হয়েছে।
তাদের অনেক সময় এমনও হয়েছে বাইরের কোনাে শপিং মলে অথবা পার্কে যখন তাদের সঙ্গে তাদের নানা পশ্চৎপটে ছেলেমেয়েরা ছিল, লােক জন তাদের দিকে ঔৎসুক্যের দৃষ্টিতে তাকাত। বিগত বছরগুলিতে মৌলিংরা একটি প্রশ্ন তাদের নানা পশ্চাদপটের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে অনেকবার শুনেছে। তােমাদের কয়টি ছেলেমেয়ে? অর্থাৎ, পরিবারের নিজস্ব সন্তান। কয়টি? স্বাভাবিকভাবেই অজস্রবার শােনার পর এতে আর আশ্চর্যের কি আছে যে, শান্ত দ্র এলিজাবেথ চটজলদি উত্তর দিতেন; “এ সবই আমার নিজের সন্তান।
মা হিসাবে এলিজাবেথ বিশ্বাস করেন যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার মনে রাখা দরকার কোনাে সন্তান দত্তক নিতে হলে তাকে পুরােপুরি সব কথা খুলে বলতে হবে। বাবা মা এবং শিশু দুই পক্ষেই এতে ভালাে অনুভব করতে হবে এবং আলােচনা করতে হবে । বহুজাতিক শিশু লেও আলাপ আলােচনা কম করলে হবে না। অন্যদিকে তাকে নিরাপদ বােধ করতে সহায়তা করতে হবে, যে বর্তমান বাড়িটি স্থায়ী বাড়ি।” মৌলিংদের ভাষ্যমতে, একজনের •ার পটভূমি সংস্কৃতি ও নিজের দেশ সম্পর্কে জ্ঞান ইতিবাচক আত্মমর্যাদা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। এটা একজন শিশুর পক্ষে তার জাতির সম্পর্কে গর্বিত হতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, সে এ বিষয়ে নিজের গভীরে ভালাে বােধ করুক। শিশুটির জাত, দেশ, সংস্কৃতি এবং যে সে দত্তক নেয়া শিশু এ বিষয়গুলি সম্পর্কে শিশুর মাবাবার ভালাে অনুভব করতে হবে বৈকি” (হােমমেকার, নভেম্বর ১৯৭৫, পৃ: ১২)।
আজ ল্যারা একজন শিল্পী এবং শিল্পশিক্ষক, যে দীর্ঘস্থায়ী কান্তিরােগের সঙ্গে ভুগছে বর্তমানে কাজ করতে পারে না। সে শিখতে ভালােবাসে, সেটা তার নানারকম মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুনলেই বােঝা যায় । সে তার ত্রিনিদাদীয় জন্মদাত্রী মা, সহােদর ভাই এবং তিনজন মামাতাে ভাইকে খুঁজে পেয়েছে টরন্টো এলাকায়। পানু ভ্যাঙ্কুভারে থাকে, সিনেমা। শিল্পের যােগ দিতে গিয়েছে। সে একজন সফল অভিনেতা। অন্য তিনজনের মতাে পরিবারের সঙ্গে তেমন যােগাযােগ রাখে না। সে তার বােন কেটিকে জন্মদিন উপলক্ষে ফোন করে । কেটি এমনই এক ব্যক্তিত্ব যে সবার মন ছুঁয়ে যায়। এক অর্থে কেটি অপেক্ষাকৃতভাবে পড়া ও শেখার ব্যাপারে পূর্ণমাত্রা সক্রিয় নয়। কাজেই যে কোনাে কিছু তার শিখতে সময় লাগে। সে এক ফরাসি বেকারিতে কাজ করে এবং কাজটি সে ভালােবেসেই করে । এখানে। তার বেশ কয়েক বছর হলাে। স্পর্শকাতর স্বভাবের জন্য ওকে সবাই পছন্দও করে। সে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে থাকে, সাপ্তাহিক নির্দষ্ট ভাতা পায় তার মাসিক আয় সম্পূরণ করার জন্য। সেটা দিয়ে সাপ্তাহিক বাজার (গ্রোসারি) বিল মেটানাে, সামান্য বিনােদন, যেমন লাইন ডানসিং ও সাঁতার এবং বাইরে যাবার খরচাদি মােটামুটিভাবে চালিয়ে নেয়। যদিও এ কথা সত্যি যে, ছেলেমেয়েরা তাদের বাড়ি ছেড়েছে এবং চারদিকে ছড়িয়ে বাস করছে, মৌলিংরা তারপরও একসূত্রে গাথা যা অনুভব করতে করতে তারা বড় হয়েছে । এই শক্তিটা তাদের সব ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে ধরে রেখেছে জীবনের মূলস্রোতে। তার সব উজান ভাটির সঙ্গে।
অনিল
জন্ম ২৩ মে ১৯৭২-এ, মাদার তেরেসার শিশু ভবনে, ঢাকা, বংলাদেশে। শিশুটির জন্মের সময় ওজন ছিল ৩ কেজি। অন্য যুদ্ধশিশুদের মতাে ওর জন্মদাত্রী মা অনাথ আশ্রমে ছেড়ে গিয়েছিলেন, নিজের নাম-ঠিকানা না দিয়ে। অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ তার নাম রেখেছিলেন। অনিল । যখন অনিল কানাডাতে পৌছল তখন তার বয়স আট সপ্তাহের কম । তার ওজন তখন ২.৩ কেজি, কারণ জন্মের পর অপুষ্টিতে ভুগে ওজনের একাংশ হারিয়ে ফেলে। রােগাটে ছেলেটির যে ইতিবাচক বৈশিষ্ট হলাে, তাকে রােগা দেখাত ঠিকই কিন্তু তার কোনাে রােগ ছিল না। অন্যসব বিচারে ডাক্তার অনিলকে স্বাস্থ্যবান ছেলে হিসেবেই বিবেচনা করেন।
এলিজাবেথ বলেন, পরিবারে তার আগমনের পর অনিল খুব চেঁচামেচি করত। এই দম্পতি স্মৃতি রােমন্থন করে বলেন কয়েক মাস শিশুটি খুব চেঁচাত। পরের দিকে মৌলিংরা জানতে পেরেছিলেন যে, অনাথ আশ্রমে ওরা শিশুদের যে দুধের ফরমূলা খাওয়াত, সে দুধের প্রতি অনিল বিরূপভাবাপন্ন ছিল। অর্থাৎ অনিল তাতে অ্যালার্জিক ছিল । অনিলকে যখন সয়া দুধ খাওয়া শুরু করলেন তখন থেকে তার চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে যায় । অবাক হওয়ার কিছু নেই, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওর ওজন বৃদ্ধি পেতে লাগে । অনাথ আশ্রমে ওকে যে নাম দিয়েছিল, সেটা তার মধ্য নাম হিসাবে রাখা হয়। মৌলিংরা প্রথম নাম হিসাবে মার্ক যােগ করেন এবং আনুষ্ঠানিক দত্তক নেবার সময় পরিবারের বংশ নাম মৌলিং সংযােগ করেন। এভাবে তার নাম হলাে মার্ক অনিল মৌলিং।
অনিল পড়াশােনা করে মেডােভেইল পাবলিক স্কুলে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত। তারপর সে ব্র্যাম্পটন শহরে জে, এ, টানার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে ১৯৯০ সালে গ্রেইড ১৩ শেষ করে। তারপর অনিল ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন পড়াশােনা করে ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত । শুরুর বছরগুলােতে সে টরন্টোর ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনােবিজ্ঞানে লেখাপড়া চালিয়ে যায়। সে হলিস্টিক আরােগ্য পদ্ধতির কৌশল বিষয়ে বেশ কয়েকটি কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ কোর্স নেয় । হলিস্টিক বলতে অনিল যা বােঝে সেটা হলাে: অস্তিত্বের বিষয়ে একধরনের মতবাত যা বাস্তাবতাকে শুধু অংশ হিসাবে গণ্য না করে সামগ্রিকভাবে সকল মৌলিক। উপাদানগুলাে অন্তর্ভুক্ত ও সমর্থন করা। অনিল আবার Open Way Institute-এ Graciella Damewood-এর অধিনে পড়াশুনা করে। তাকে সে শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রেখেছে। অনিলের মতে, ডেইমউডের দৃষ্টিভঙ্গি অনিলের ভাবাবেগ ও আধ্যাত্নিকতার সফরে সহায়তা যুগিয়েছে, নিজের সম্পর্কেও অন্যদের বুঝতে জানতে সহজ হয়েছে ।
অনিলের বয়স তখন ঠিক কত ছিল ওর মনে নেই, যখন সে দত্তক শব্দের অর্থ জানতে পারে, যদিও মৌলিং পরিবারে দত্তক একটি সাধারণ শব্দ ছিল যেটা সবাই ব্যবহার করত, যে পরিবারের চারটি সন্তানের আগমনই দত্তকের মাধ্যমে। অনিলের মনে আছে তার মা তাকে। তার জন্ম ইতিহাস খােলাখুলিভাবে বলেছিলেন। এলিজাবেথের মতে, তার ছেলের জন্য এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে কোনাে পরিবেশে তাদের মা তাদেরকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তাদের জন্মের সময় কী ঘটেছিল, তাদেরকে ত্যাগ করেছিলেন কে, কোন্ পরিবেশে এবং কীভাবে দত্তক নেয়া হয়েছিল। অনিলের ব্যাপারে জানার দরকার ছিল কেমন করে তাকে বাংলাদেশ থেকে ক্যানডায় নিয়ে আসা হয়েছিল, এসব নানা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। পেছনে তাকিয়ে অনিল বলে, তার মা-বাবা তাকে যতটুকু তথ্য তার জন্মবৃত্তান্ত বিষয়ে দিয়েছেন তার সবটাই বয়স অনুসারে দেয়া হয়েছিল। প্রাকৃতিকভাবে মাথায় ওটা রেখে তারা তাদের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের জন্য সাবধানে তথ্য যুগিয়েছেন। রেই বলেন, প্রথমদিকে তাদের দুজনেরই কিছুটা স্নায়ুবিক দৌর্বল্যগ্রস্ততা ছিল যদিও তারা ভেবেছিলেন সাবধানতার সাথে ছেলেমেয়েদের জন্মবৃত্তান্তের কাহিনী বর্ণনা করবেন। কিছুদিন পরে তারা তেমন বিচলিত হননি । পেছনে তাকিয়ে অনিল বলে, সে সুখী যেভাবে তার জন্মবৃত্তান্ত বিষয়ে তার বাবা-মার কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে।
বিগত কয়েক বছরে অনিল ভেবেছে তার পেশা নিয়ে সে বেশ কয়েকটা প্রচেষ্টা চালাবে । এক সময়ে সে পুলিশবাহিনীতে যােগ দেবার কথা ভাবে। এটা তার মাথায় কিছুদিন ছিল, তারপর এ বিষয়ে তার আগ্রহ এবং স্পৃহা দুটিই কমে যায়। আরেকবার সে থাইচি- তে আগ্রহী হয় এবং ইনস্ট্রাকটর পর্যায় পর্যন্ত প্রশিক্ষণ শেষ করে। সে সময়ে সে থাইচি সম্পর্কিত আরও কিছু কোর্সে প্রশিক্ষণ নেয় । গত কয়েক বছরে অনিল তার কাজ বদলিয়েছে বেশ কয়েকবার । সে অনেক জায়গায় অনেক ধরনের কাজ করেছে। কর্মহীন হয়ে পড়লে সে কখনাে হতাশ হয় ; সে কাজ খোজে সময় নষ্ট না করে।
অনিলের সাথে আলাপচারিতার পরে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, অনিল মানুষের সঙ্গে মেলামেশার যে দক্ষতা রাখে সেটা তাকে তার কাজের জায়গা তৈরি থাকতে সহায়ক ভূমিকা। রাখে। স্বভাবত সে একটু আশাবাদী, এমনকি যখন সে বিরূপতার সঙ্গে লড়াই করে সমান। জায়গা ছেড়ে বেশ কিছুটা উপরে ভারসাম্য অনেকটা হারিয়ে দোদুল্যমান । অনিলের বড় গুণ। সে কখনাে নিজেকে নৈরাশ্যের মধ্যে ফেলে না। অনিল যে ক্রমাগতভাবে পড়াশােনা ও চাকুরি বিষয়ে মন পাল্টাতে অভ্যস্ত সেটা থেকে ধরে নেয়া যায় যে সে যেন আরও দশজন কানাডীয় জাতিস্বরূপ দৃষ্টান্ত – সেও তাদের মতাে তার ব্যক্তি স্বাধীনতা ভােগ করতে আগ্রহী, সেটাকে সে প্রাধান্য দেয়। পড়া শুরু করেই সে অনুভব করে যে, তার পরিকল্পনায় পরিবর্তন করতে হবে । সে শান্তভাবে বলে যে, জীবনে সবারই ভুল হয় । অনিল জিজ্ঞাসা করে, কেউ কি কখনাে নিখুঁতভাবে একবারেই ফাঁদ পেতে ইদুর ধরতে পারে? তার পেশাজীবী মায়ের (এলিজাবেথ) সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মানসিক রােগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে সে এক মিনিটের জন্যও নিজেকে বাস্তবতাবিরােধী মনে করেনি; অথবা তার এমন মনে হয়নি যে। লক্ষ্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছে সেখানে সে পৌঁছতে পারেনি।
মনােবিকলন শেখা এবং পেশা হিসাবে মানসিক রােগীর চিকিৎসার দায়িত্ব নেবার মাধ্যমে অনিল আপন ভাবাবেগের সন্তুষ্টিবিধান ও মূল্যবান হৃদয়বৃত্তির সুষ্ঠু লালন পালন করতে চায় । সে স্বভাবে উষ্ণ ও স্বতঃস্ফুর্ত মেজাজের মানুষ হওয়ায় তার সামাজিক ইত্যাকার দক্ষতা তাকে তার ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্রের উপযােগী করে তুলেছে। যতবার সে পরিকল্পনা বদল করেছে, ততবারই নিজেকে বলেছে যখন সময় আসবে তখন সে সেসব সমস্যার কথা ভাববে । আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, আগেই বলেছি যখন সে হতাশার চরমে, তখনও সে নিরাশ হয়নি। অনিলের ব্যাপারটা হলাে, সে নিজেকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম এবং এ মূল্যায়নের প্রক্রিয়ায় সে নিজের ভুলগুলাে বিবেচনা করে তার সক্ষমতা ও সদগুণাবলির হিসাব রাখে। সে তার সম্ভাবনার বিষয়েও আশাবাদী এবং সর্বোপরি সে আকাশচারী নয় । সে মাটিতে দুপায়ে শক্তভাবে পঁড়িয়ে কর্ম পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে, বদল করে আবার কাজে লেগে যায় ।
এখানে এটুকু বলা প্রয়ােজন, মা-বাবার স্বাভাবিক দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা থাকলেও অনিলের মাবাবা কখনাে তাদের ছেলেমেয়েদের নিজ চিন্তা ভাবনা বা কাজকর্মে বাধা দেননি। বরং সব ধরনের সহায়তা করেছেন, যাতে তারা ভালােভাবে জেনেশুনে কার্যকরি সিদ্ধান্ত নিতে পারে । অনিল যখন এটা ওটা ভাবে, কর্মপরিকল্পনার বদল ঘটায়, তারা তাকে অনাকাক্সিক্ষত উপদেশ দেননি, বরং অপেক্ষা করেছেন, দেখেছেন ও কী করতে চাচ্ছে। এলিজাবেথ এবং রেই-এর বর্ণনা থেকে এটাও বেরিয়ে আসে যে, তারা চেয়েছিলেন তাদের ছেলেমেয়েদের ভিতরে যেন স্বাধীনতার একটা আবহ চালিয়ে যাক, সেটা তারা চেষ্টা করেছেন শেষ পর্যন্ত।
অনিল এটা জানে এবং স্বীকার করে যে, সে তার পেশার লক্ষ্য এতবার বদল করেছে যে বর্তমানে হয়তাে ঠিকমতাে সেগুলাে বর্ণনা করতে আগপিছু করে ফেলবে। সে বলে, তারপরও তার দুঃখ করার কিছু নেই। বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার পর অনিল বর্তমানে টরন্টো এলাকায় ক্যাডিলাক ফেয়ার ভিউতে কাজ করছে। অবসর সময়ে সে কয়েকটি সিকিউরিটি কোম্পানির (যেমন, ডেলটা সিকিউঅরিটি) জন্য প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে। যারা অনিলকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনে, তারা জানেন কেমন করে অনিলের তীক্ষ্ম ও সমন্বিত বুদ্ধি এবং সহজাত সৌম্য দৃষ্টিভঙ্গি তাকে দ্রুত পরিস্থিতির সামাল দেবার উপযুক্ত ও স্মার্ট অভিধায় অভিষিক্ত করে। স্বভাবত সে অত্যন্ত উষ্ণ হৃদয়াবেগের অধিকারী এবং মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় সূর্ত। বহুসংস্কৃতি ও বহুজাতি পরিবেশে অনিল আদর্শ হােস্ট। আত্মপরিচিতি অথবা আত্মমর্যাদা বিষয়ে অনিল কখনাে কোনাে জটিলতা উপলব্ধি করেনি। পরিচিতি সংকট দত্তকের বেলায় মাঝেমধ্যে অনেক পােষ্যদের কিছু সমস্যায় ফেললেও অনিল মনে করে কিশাের বয়সে যে কোনাে কিশাের বা কিশােরীই এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পার। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনিল মনে করে সে কানাডাতে খুবই দৃঢ়সংহত মানুষ হিসাবে বড় হয়ে উঠেছে। সে জানে তার জন্ম বাংলাদেশে, সে বড় হয়েছে কানাডাতে, কানাডাই তার বাড়ি। মৌলিং দম্পতিই তার মা-বাবা।
অনিল বলে যে, এ বিষয়ে ক্রোধান্বিত হবার কোথাও কিছু নেই। কেউ ক্রোধান্বিত হলে তার মনের ভেতর ইতিবাচক নিরাপত্তাবােধ তৈরি এবং মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্যের উপস্থিতিতে অনিল নিজেকে একজন ব্যক্তি হিসাবে দেখে । যে জানে তার পশ্চাৎপট বাংলাদেশি কিন্তু একই সাথে সে এটাও মনে করে, অধিকাংশ নৃতাত্ত্বিক গােষ্ঠী থেকে সে পৃথক । এমনকি যখন কিশাের বয়সে এ ধরনের পােষ্য সব কিছুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখনও অনিল আশ্চর্যভাবে ঠান্ডা মাথায় সেসব প্রশ্নের মােকাবিলা করে ।
অনিল জোর দিয়ে বলে যে, কানাডাতে বড় হয়ে ওঠার সময় তার স্মৃতি ভান্ডারে এমন। কোনাে কিছু ছিল না সেখান থেকে কিছু স্মৃতি মুছে ফেলতে হয়। কোনাে কিছুই তাকে ভুলতে হয়নি। অনিল বলে, একটু বেশি বয়সের দত্তকায়িত ছেলেমেয়ে যারা অন্যান্য সংস্কৃতি ও দেশ থেকে আসে, তাদের বেলায় সে ব্যতিক্রম ঘটতে দেখেছে। ঢাকার অনাথ আশ্রমে তার জীবনের প্রথম ছয় সপ্তাহ তার জীবনে আদৌ কোনাে ছাপ রাখেনি। স্বভাবত বাংলাদেশ অনিলের জন্য একটি দূরের দেশই বটে। অনিলের ভাষ্য অনুসারে যখন সে বাংলাদেশের কথা ভাবে, তখন তার কোনাে পরিবার বা জন্মদাত্রী মা অথবা জন্মদাতা বাবার কথা মনে হয় । “তখন সে বাঘের কথা ভাবে, ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাঘাট ও গরমের কথা ভাবে,”তই ব্যস ঐ পর্যন্তই।
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অনিল ধীরে ধীরে বড় হয়েছে এ কথা ভেবে যে, সে একজন কানাডীয় যার জন্য হয়েছিল বাংলাদেশে। সে অর্থে অনিল পৃথক কোনাে সাংস্কৃতিক পরিচিতি নিজের জন্য। খোঁজেনি। বিবেচনা করেছে জাতিগত পরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য বিচারে । সে নিজেকে কোনাে ধরনের বিদ্যানুরাগী অথবা বহুভাষিক হিসাবে পরিচিত হতে চায়নি। সে বরং নিজেকে বিশ্বের জনগােষ্ঠীর একজন সদস্য মনে করে। সে কখনাে ভাবেনি, কানাডাবাসী অন্য মানুষেরা তাকে কীভাবে দেখছে। অন্য যে সব যুদ্ধশিশু আমরা দেখেছি, অনিল নিজেকে তার শ্বেতাঙ্গ বন্ধুর থেকে পৃথক করে দেখে, কিন্তু খুব সহজাতভাবে অনিল তার শ্বেতাঙ্গ মাবাবার চার সন্তানের এক সন্তান হিসাবে সব সংজ্ঞা অনুসারে নিজেকে কানাডীয়” মনে। করেই বড় হয়েছে। এতে সে কখনাে কোনাে সাংঘর্ষিক অবস্থার সম্মুখীন হয়নি।
অতএব, যতদূর সম্ভব অনিলের অতীত অভিজ্ঞতাসমূহ তাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে এবং তদানুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। মজার ব্যাপার, সে নিজেকে অন্য নৃতাত্ত্বিক গ্রুপের কারাে সঙ্গে তুলনা করতে রাজি না, যদিও তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার প্রশ্ন বয়ঃসদ্ধিকালে তার মনে জাগরুক ছিল । সে কারণে তার জীবনে কোনাে শূন্যতা ছিল না এবং এখনও নেই । অন্য অনেক দত্তক নেয়া শিশুর মতাে পরিচিতি ও জন্মের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামালেও অনিল তার নিজের সম্পর্কে আরও একটু ভালােভাবে বােঝার তাগিদ অনুভব করে যখন সে ছিল ১৭ থেকে ১৯ বছরগুলিতে পরে যখন তার বয়স ২০ থেকে ২২ তখন সে বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেবার বিষয়ে কেন এবং কীভাবে এসেছিল সেসব কিছু প্রশ্ন তুলেছিল। অনিল বলে, তার স্পষ্ট মনে আছে তার মা তাকে বাংলাদেশে জন্মের সময় ঘিরে যে ঘটনাবলি বিরাজমান ছিল, সেসব বলেছিলেন। কিন্তু সে ঐসব কাহিনী শােনার পর সে বিষয়ে আর গভীরে কখনাে যেতে চায়নি। নানা আঙ্গিকে, নানা দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করে অনিল নিজেকে সংশ্লিষ্ট করে কানাডীয় সংস্কৃতিতে । সে পুরােপুরিভাবে নিজেকে অন্যান্য দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবে দেখে না। সে বিশ্বাস করে যে, সে প্রকৃতপক্ষে আলাদা। তার গায়ের ত্বক তার। বাবা-মায়ের এবং স্কুলের বন্ধুদের থেকে অন্য রকম। সে বলে তার শ্বেতাঙ্গ কানাডীয় বাবামায়ের ছেলে হিসাবে বড় হয়েছে।
অনিলের বর্ণনা থেকে এটা উঠে আসে যে, সে পরিপক্ক মস্তিষ্ক ও ঠান্ডামাথার ছেলে। এটা অনিলের জন্য কোনাে অস্থিরতার বিষয় ছিল না। সে অর্থে, অনিল আগেও কখনাে অনুভব করেনি, এখনও করে না, তার অতীত খুঁড়ে তার জন্মের ইতিহাস নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে । সে বলতে দ্বিধা করে না যে, সারা জীবন সে যেটাকে দত্তক জগতের পরিভাষায় বলা হয়, “নন সার্চার” অর্থাৎ সে তার জীবনবৃত্তান্ত না খোজাদের দলে ছিল। এ বিষয়ে অনিল কখনাে বিচলিত হয়নি। সে বলে, তার বেঁচে থাকা ও তার সুখ কখনই তার জন্মদাত্রী ও জন্মদাতা বাবা-মাকে অথবা তারা কোথা থেকে এসেছেন, সেটা জানার উপর নির্ভর করে না। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এও বলে যে, যখন সে বড় হচ্ছিল তখন মাঝে মাঝে তার জন্মনথির সাহায্যে বংশানুগতি সম্বন্ধে কিছু তথ্যাদি উদ্ধার করার সম্ভাবনার নিয়ে ভাবত ঐসবের হয়তাে ভবিষ্যতে কোনাে প্রয়ােজন হলেও হতে পারে। এমনও সময় গিয়েছে, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কিছু কিছু অসুখ বিসুখের দুশ্চিন্তা তাকে অহেতুক ভাবিয়েছে। কোনাে কোনাে সময়ে অনেক নাছােড়বান্দা নীরব প্রশ্নে তার মনের ভেতরে জেগে থেকেছে। তারপর সে নিজেই মনে মনে বলত যে, ঐসব অকিঞ্চিঙ্কর নথি থেকে কোনাে তথ্য উদ্ধারের সম্ভাবনা মমাটেই নেই । অনেকে না পারলেও অনিল সহজেই ঐ ধারণা ত্যাগ করে জীবনের পথে কোনাে চাপ না নিয়ে এগিয়েছে। চলার পথে সামাজিক জীবনে অনিল কখনাে অনুভব করেনি। যে, সে বিচ্ছিন্ন বা পৃথক।
একাকীত্বের কথা বলতে গিয়ে অনিল বিষয়টি বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করে। তার অভিজ্ঞতার আলােকে সে বলে, যে একাকিত্ব এমনই জিনিস যা তার মনে “বােধ হয়েছে দত্তক নেবার জন্য নয়; বরং অন্যদের থেকে পৃথক অনুভব করা এবং অন্যদের মতাে চিন্তাভাবনা না করার ফলে ।” অনিল মানবিক মূল্যবােধের দাম দেয় এবং নিজেকে এমন একজন ব্যক্তিরূপে দেখে যার কোনাে নির্দিষ্ট সংস্কৃতি এবং নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের উপর নির্ভর করে না। অনিলের এ অবস্থানে প্রশ্ন জাগতে পারে: এটা কী সামাজিক বাস্তবতা যা তাকে ঘিরে রয়েছে যেটা সে অস্বীকার করে? অথবা, এটা কি ব্যক্তির নিগুঢ়তম অনুভূতি এবং চিন্তা ভাবনাকে অস্বীকার করা? অনিল নিজেই প্রশ্নগুলাের উত্তর দেয় । Dan Milliman-এর The Way of the Peaceful Warrior বইটির কথা উল্লেখ করে অনিল বলে, বইটির বক্তব্য তার জীবনের মােড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তার মা তাকে বইটি উপহার দিয়েছিলেন। ওটা একটা সময়ােচিত উপহার ছিল । “তখন ওটার খুব দরকার ছিল। আমরা প্রত্যেকে পৃথিবীতে একটা জায়গা খুঁজি। আমার একটা কিছুর সঙ্গে নিজেকে মেলানােটা দরকার ছিল” । যদিও অনিল তখন ২০ বছরে পা দেয়নি, সে বইটা বারবার পড়ছে, কারণ ওটা পড়তে অসাধারণ লেগেছিল। সে নিজের জীবন ও বাস্তবতার সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে পেরেছিল।
অনিল তার জন্মদাত্রী মায়ের কথা বলতে গিয়ে তার অন্য এক বিশেষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয় । যদিও প্রকৃতপক্ষে সে তার জন্মদাত্রী মার সঙ্গে মিলিত হবার কখনাে কোনাে তাগিদ অনুভব করেনি, তবুও শিশু হিসাবে অনেক ধরনের মজার মজার স্বপ্ন দেখেছে । “ছেলেবেলার স্বপ্নগুলাে আমার উদ্ধারের গল্প নয়, বাড়ি ফেরার গল্প,” অনিল বলে । সে বাড়ি কেমন ছিল? কোথায় ছিল? একটা স্বপ্নই সে দেখেছে একটানা রাতের পর রাত একই স্বপ্ন অবিশ্রান্তভাবে চলেছিল যেন এক রাতের বিরতির পর আবার সে গল্পের অনুবর্তন। স্বপ্নটি প্রায় দুবছর অবিরাম দেখেছে । অনিলের মনে আছে আরও পাঁচজন ছেলেমেয়ের সঙ্গে একটা মলে “সবাইকে পৃথিবীর একটা জায়গা থেকে উঠতে হবে, আমাদের সৌরজগতের উৎসে, আমাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। অনিলের ভাষ্যানুসারে, তাদের ভ্রমণের বাহন নির্দিষ্ট সময়ে ওড়ার ক্ষমতা ছিল । ব্যবস্থা এমন, কেউ একজন তাদের ওই উপহার যান। কোনাে একসময় ব্যবহার করতে দেবেন নির্দিষ্ট জায়গায়। সেসময় তারা অপেক্ষা করবেন। যাতে বাড়ির লােকেরা যােগাযােগ রক্ষা করতে পারে।
যদিও অবাক লাগবে শুনতে, অনিল কখনাে ওর জন্মদাত্রী ও জন্মদাতা বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখেনি। কিন্তু পেছনের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ওটা হয়তাে তাদের অর্থাৎ জন্মদাতা বাবা ও জন্মদাত্রী মার একটি প্রতিনিধিত্ব । তার স্বপ্নে সে দেখত অন্য গ্রহের সে এক বিচ্ছিন্ন ও বিদেশি শিশু। অবশ্য এসব কিছু ঘটেছিল যখন সে ছিল ছােট শিশু। এখন সে পরিপক্ক হয়েছে এত বছরে, সে বাস্তববাদী মানুষ হয়েছে এবং ব্যাপারটির অসম্ভাব্যতা সম্পর্কে জানে। অনিল যখন মনে করে যে, বাংলাদেশে তার জন্ম এবং সেখানে সে পরিত্যক্ত হয়েছিল তখনই সে গভীরভাবে তার মা-বাবার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে । সুদূর বাংলাদেশ থেকে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে তাদেরকে কানাড়াতে নিয়ে আসার জন্য। বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, তারা সে সময় খুব সহজেই কানাডা থেকে একটি শিশু দত্তক নিতে পারতেন।
বয়ঃসন্ধিকালে অনিলকে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে যেগুলাে তার মতে বৈশিষ্ট্যমূলকভাবে তার জীবনবৃত্তান্তের কাহিনীর সাথে সংযুক্ত নয়। অনিল বলে, “আমার জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবাকে জানার কোনাে বাসনা হয়নি সত্য, কিন্তু অন্যান্য অনেক ব্যক্তিগত ইস্যু ছিল যেগুলাের সাথে আমাকে মুখােমুখি হতে হয়েছিল। আমার ভেতরে সংঘাতের সঙ্গে আমার রফা হবার পরই কেবল আমি আমার মা-বাবা সম্পর্কে জানার জন্য তৈরি হবার কথা ভেবেছিলাম। অনেক পােষ্য সন্তানদের জন্য বয়ঃসন্ধিকাল সাধারণত অস্থির সময় এবং স্বল্প আত্মমর্যাদা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যকর ঘটনায় পরিপূর্ণ। সৌভাগ্যবশত যুদ্ধশিশুদের কারাে শৈশব ওরকম তুচ্ছভাবে কাটেনি। অনেক দত্তক নেয়া ছেলেমেয়ে উৎকণ্ঠা, বিষন্নতা, স্বল্প আত্মমর্যাদা এবং মেয়াদি অসুস্থতায় ভােগে প্রাপ্তবয়স্ক হয়, যুদ্ধশিশুরা কিন্তু তা করেনি । খুব খােলাখুলি তারা কথা বলায় অভ্যস্থ হওয়াতে অনিল বলে: “আমি মনে করি আমার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার ছবি কখনাে আমার মনের ভেতরে ধরে। রাখতে পারিনি। কারণ সে ব্যাপারে আমি ছিলাম সম্পূর্ণভাবে নিরুৎসাহী । আমি অনেক সময় আমার মাকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখতাম । সুতরাং তার মুখচ্ছবি আমার দৃষ্টিগােচরে আসেনি। আমার বাবাকে আমি সামরিক পােশাকে চিত্রায়িত করেছি আমার জন্মের ইতিহাস যেটুকু শুনেছি তার উপর ভিত্তি করে।
অনিল এটা বােঝে যে অনেক সময় দত্তকায়িত ছেলেমেয়েরা তাদের জন্মদাত্রী মায়েদের বিরুদ্ধে অভিযােগের আঙুল তােলে যথাযােগ্য কারণ থাক বা না থাক। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনিল বিষয়টিকে দেখে এভাবেঃ একজন জন্মদাত্রী মা যতই মমতাময়ী ও যত্নশীল হােন না। কেন প্রকৃতপক্ষে তিনিও একসময় পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। বাংলাদেশের প্রসঙ্গে সে সময়ের সামাজিক পরিবেশে “অপ্রার্থিত” শিশুদের কোনাে গ্রহণযােগ্যতা ছিল না। কাজেই অনিল এ সত্যকে সহজেই মেনে নিয়েছে যে, তার জন্মদাত্রী মায়ের তাকে পরিত্যাগ করা ছাড়া কোনাে উপায় ছিল না । সংক্ষেপে বললে, অনিলের নির্যাতিতা অপরিচিতা মায়ের জন্য তার অসীম মমতা ও সহানুভূতি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আরও যেসব মায়েদের জীবন এভাবে বিনষ্ট হয়েছে তাদের সকলের জন্য রয়েছে তার অশেষ করুণা।
এভাবে পুনর্মিলনের বিষয় যা নাকি দত্তকদের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ ঘটনা অনিলের বেলায় অনুপস্থিত। পাকিস্তানি সৈন্যদের যৌন সহিংসতার কাহিনী শােনার পর অনিল তার জন্মদাত্রী মার সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, যাকে সে একজন অসহায় নির্যাতিতা হিসাবে দেখে । অনিলের | চোখে তার ভাগ্যহীনা মা ছিলেন না স্বার্থপর না মমতাহীনা। স্বাভাবিকভাবেই সে তার জন্মদাত্রী মায়ের বিষন্নতা অনুমান করতে পারে। কারণ সে জানে তার মা ধর্ষণের শিকার। এবং সমাজের দ্বারা পরিত্যক্ত। অনিলের মতে, শিশুকে ত্যাগ করায় মাকে শাস্তি তাে দেয়ার। প্রশ্নই ওঠে না, বরং সে তার মাকে কেবল মনে মনে ধন্যবাদ দেয়। তিনি যা ভালাে তাই করার চেষ্টা করেছিলেন। অনিল তাকে আবার ধন্যবাদ জানায় তাকে ত্যাগ করার জন্য, যখন সে জানতে পারে তার জন্মদাত্রী মা কখনই তাকে রাখতে পারবেন না বাংলাদেশি সমাজে।
অনিল তার অনেক বাসনার নিবৃত্তিকল্পে তার মায়ের (এলিজাবেথ) সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলত । এ কথা অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে যে বস্তুতপক্ষে অনিল এবং অন্যান্য যুদ্ধশিশুরা মা বলতে কানাডীয় মাকে বােঝে। সে জন্য সবসময় তাদের মায়ের কথা উল্লেখ করলে প্রথমেই তারা জিজ্ঞাসা করে তার কোনাে মা, অর্থাৎ তার মা নাকি তার জন্মদাত্রী মার কথা বলা হচ্ছে। অনিল তার (কানাডীয়) বাবা-মাকে তাদের প্রাপ্য কৃতিত্ব দিতে এতটুকু কুণ্ঠা করে
। কারণ তারাই তাকে এবং অন্যান্য ভাইবােনকে ছেলেবেলা থেকে লালন পালন করে বড় করে তুলেছেন। যখন তাদের মা-বাবার বিয়ে ১৯৭৭ সাল থেকে আইনের সিদ্ধান্ত অনুসারে রদ হয়ে যায়, তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর । আমরা ইতােমধ্যে মৌলিংদের বিবরণীতে দেখেছি কিন্তু তাদের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান রয়েছে  ঐ বিচ্ছেদের জন্য অনিল ও তার ভাইবােনদের ওপর কোনাে ক্ষতিকর অভিঘাত পড়েনি।
মৌলিংদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেজন্য তারা শুরুতে নিশ্চিত করেছিলেন যে, তাদের বিচ্ছেদের পূর্বকালে থেকে (যখন থেকে তারা আলাদা থাকা শুরু করেন) ছেলেমেয়েদের প্রাধিকার হবে তাদের প্রধিকার । অনিলের মন্তব্য ঐ কথাকেই প্রমাণসিদ্ধ করে কীরকম বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মা-বাবা দুজনেই তাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে ভেবেছিলেন এবং প্রত্যেক ছেলেমেয়েদের তাদের মা অথবা বাবার সাথে প্রতি দুসপ্তাহে একবার দেখা করার বন্দোবস্ত করেছিলেন। অনিল এ বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে আরেকটি মূল্যবান মন্তব্য রাখে যে, বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের নানাবিধ সমস্যাগুলাে যে কোন দম্পতির বেলায়ই জটিল হতে পারে। অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের সমস্যাগুলাে সহজাত বাবা-মা অথবা দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়ের জন্য একই ধরনের । অনিল আরও পরিষ্কারভাবে তার কথাটি ব্যক্ত করে এভাবে, সন্তানরা দত্তকায়িত। হােক বা ঔরষজাত হােক, কিশাের বয়সে বাবা-মাদেরকে অনেক সমস্যায় ফেলতে পারে ।

১৯৭২ সালে অনিল কানাডা যাওয়ার পর আর বাংলাদেশে কখনাে আসেনি। ওর বয়স তখন আট সপ্তাহও পূর্ণ হয়নি, যখন সে প্রথম কানাডাতে যায়। অনিলের মতে, সে যে কখনাে বাংলাদেশে আর আসবে না এমন কথা সে বলতে রাজি না। যদিও সে কোনাে সফরের পরিকল্পনা করেনি এ যাবৎ, সে তেমন কোনাে সম্ভাবন আসবে সে এখনও জানে না, বাস্তববাদী অনিল এ ধরনের বাসনার নিবৃত্তির জন্য অন্য পথ । ধরতে দেরি করেনি।

অনিল নানা বিষয়ে কাজ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। তার নিজের ভাষায়: “কানাডাতে আমার চারপাশের মানুষের জন্য আমি নানা সেবা ও শুভেচ্ছা যুগিয়ে আসছি” অনিল এখানেই থেমে থাকেনি। সে আরও বলে, “আমার পথ হলাে নারী ও পুরুষের সম্মান ও সম্পর্ককে রক্ষা করা এবং অন্যদের ওরকম করতে সহায়তা যােগাননা যদি তারা তৈরি থাকে । স্পষ্টভাবে বলতে গেলে আমি বলব, আমি নারী ও পুরুষকে যৌন আক্রমণাত্মক শারীরিক নিগ্রহ প্রতিরােধের প্রশিক্ষণ দিই। সে কারণে আমি নিজেকে Nemesis বা নিয়তি বলে পরিচয় দিয়েছি।
যৌন আগ্রাসনের অসহায় শিকার যারা, তাদের যাতে ভালাে হয়, সেরকম কিছু করার উপায় হিসাবে Martial Arts বা যুদ্ধশিল্প চর্চার সিদ্ধান্ত নেবার পর অনিল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সত্যিকার অর্থে একটি কাজের মতাে কাজে হাত দিয়েছে। আবার, বিষয়টি যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ সেটা উল্লেখ করতে না করতে অনিল অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলে, “আমার জন্মের অর্থ জানার বহু আগে থেকে অথবা আমার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার অতীত বিষয়ে জানার আগে আমি যুদ্ধশিল্প চর্চা শুরু করি। শুধু তাই নয়, আমি তখনই ধর্ষণ প্রতিরােধ বিষয়ক কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করি । আমার সেরা শিক্ষকদের একজন Grascila Damewood এবং Dan Milliman, দুজনেই বলেছেন, “যা হবার তাই হবে।
দিনের শেষে, সব কিছু যখন বলা এবং করা শেষ, উদাসীন অনিল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের সম্পর্কে অনাগ্রহী । যদিও সে তার বাংলাদেশি শিকড় কখনাে অস্বীকার করে। ওর যদি কোনাে বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় খুব ভালাে। ব্যাপারটা হলাে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদি তার সঙ্গে কোনাে বাংলাদেশি অথবা পাকিস্তানির দেখা হয় বা না হয়, তাতে তার কিছু আসে যায় না।
বাংলাদেশের ব্যাপারে অনিল তেমন আগ্রহী না হলেও মজার বিষয় যে, অনিলের নাম কেউ ভুল উচ্চারণ বা বানান করলে অনিলের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, অনিল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং যে দেশে সে জন্মেছিল সে জন্মভূমি হিসাবে। বাংলাদেশের বিষয়ে অতটা আবেগাপুত হয় না। কিন্তু সে নিশ্চিতভাবেই রেগে যায় যখন কেউ তাকে যে নামে অনাথ আশ্রমে সিস্টাররা ডাকতেন ওর মায়ের ভাষা অনুসরণ করে, ভুল উচ্চারণ করেন। মন ভােলা স্বভাবের মানুষ অনিল বলে, যখনই কউে তাকে পশ্চিমা উচ্চারণে অনিলের পরিবর্তে অ’নীল (0′ Neil) বলে ডাকে তখন সে দৃশ্যত বিরক্তবােধ করে। কেউ যদি তাকে সম্বােধন করে বা লেখে 0′ Neil মৌলিং হিসাবে Onil-এর পরিবর্তে তাতেও সে বিরক্ত হয়।
অনিলের মা-বাবা অনিল নামটি বাংলাদেশের অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষের সম্মানেই রেখেছিলেন তার মধ্য নাম হিসেবে। তাই অনিলের নাম অন্যভাবে উচ্চারণ করলে বা লিখলে মৌলিংরাও আসবে সে এখনও জানে না, বাস্তববাদী অনিল এ ধরনের বাসনার নিবৃত্তির জন্য অন্য পথ । ধরতে দেরি করেনি।
অনিল নানা বিষয়ে কাজ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। তার নিজের ভাষায়: “কানাডাতে আমার চারপাশের মানুষের জন্য আমি নানা সেবা ও শুভেচ্ছা যুগিয়ে আসছি” অনিল এখানেই থেমে থাকেনি। সে আরও বলে, “আমার পথ হলাে নারী ও পুরুষের সম্মান ও সম্পর্ককে রক্ষা করা এবং অন্যদের ওরকম করতে সহায়তা যােগাননা যদি তারা তৈরি থাকে । স্পষ্টভাবে বলতে গেলে আমি বলব, আমি নারী ও পুরুষকে যৌন আক্রমণাত্মক শারীরিক নিগ্রহ প্রতিরােধের প্রশিক্ষণ দিই। সে কারণে আমি নিজেকে Nemesis বা নিয়তি বলে পরিচয় দিয়েছি।
যৌন আগ্রাসনের অসহায় শিকার যারা, তাদের যাতে ভালাে হয়, সেরকম কিছু করার উপায় হিসাবে Martial Arts বা যুদ্ধশিল্প চর্চার সিদ্ধান্ত নেবার পর অনিল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সত্যিকার অর্থে একটি কাজের মতাে কাজে হাত দিয়েছে। আবার, বিষয়টি যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ সেটা উল্লেখ করতে না করতে অনিল অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলে, “আমার জন্মের অর্থ জানার বহু আগে থেকে অথবা আমার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার অতীত বিষয়ে জানার আগে আমি যুদ্ধশিল্প চর্চা শুরু করি। শুধু তাই নয়, আমি তখনই ধর্ষণ প্রতিরােধ বিষয়ক কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিতে আরম্ভ করি । আমার সেরা শিক্ষকদের একজন Grascila Damewood এবং Dan Milliman, দুজনেই বলেছেন, “যা হবার তাই হবে।
দিনের শেষে, সব কিছু যখন বলা এবং করা শেষ, উদাসীন অনিল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের সম্পর্কে অনাগ্রহী । যদিও সে তার বাংলাদেশি শিকড় কখনাে অস্বীকার করে। ওর যদি কোনাে বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়ে যায় খুব ভালাে। ব্যাপারটা হলাে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে যদি তার সঙ্গে কোনাে বাংলাদেশি অথবা পাকিস্তানির দেখা হয় বা না হয়, তাতে তার কিছু আসে যায় না। বাংলাদেশের ব্যাপারে অনিল তেমন আগ্রহী না হলেও মজার বিষয় যে, অনিলের নাম কেউ ভুল উচ্চারণ বা বানান করলে অনিলের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, অনিল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং যে দেশে সে জন্মেছিল সে জন্মভূমি হিসাবে। বাংলাদেশের বিষয়ে অতটা আবেগাপুত হয় না। কিন্তু সে নিশ্চিতভাবেই রেগে যায় যখন কেউ তাকে যে নামে অনাথ আশ্রমে সিস্টাররা ডাকতেন ওর মায়ের ভাষা অনুসরণ করে, ভুল উচ্চারণ করেন। মন ভােলা স্বভাবের মানুষ অনিল বলে, যখনই কউে তাকে পশ্চিমা উচ্চারণে অনিলের পরিবর্তে অ’নীল (0′ Neil) বলে ডাকে তখন সে দৃশ্যত বিরক্তবােধ করে। কেউ যদি তাকে সম্বােধন করে বা লেখে 0′ Neil মৌলিং হিসাবে Onil-এর পরিবর্তে তাতেও সে বিরক্ত হয়।
অনিলের মা-বাবা অনিল নামটি বাংলাদেশের অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষের সম্মানেই রেখেছিলেন তার মধ্য নাম হিসেবে। তাই অনিলের নাম অন্যভাবে উচ্চারণ করলে বা লিখলে মৌলিংরাও সত্যিকারভাবে বিরক্ত হতেন। যারা তার নাম বাংলা রেখেছিলেন অনিলের অসন্তোষ হয়তাে তাদের প্রতি সম্মান ও ভালােবাসারই প্রতিফলন। সে যা হােক, তার বাংলা নাম এবং আংশিক বাংলা অথবা পাকিস্তানি ঐতিহ্য সত্ত্বেও অনিল কানাডা ও কানাডীয়দের সঙ্গেই নিজেকে মেলাতে পছন্দ করে। অনিলের বক্তব্য হলােঃ “আমি সাধারণত বাংলা রীতিনীতি অথবা স্বাধীনতা উৎসব পালন করার বাস্তবতা থেকে বহু দূরে অবস্থান করি । তবে হ্যা, সে কানাডীয় জাতীয় উৎসব যেমন Canada Day (১ জুলাই), Remembrance Day (১১ নভেম্বর) ইত্যাদিতেও তেমন আগ্রহ নেয় না।
সম্প্রতি অনিল মেলিসা বার্টেলাে নামে এক ইতালীয় পশ্চাদপটের কানাডীয়ের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়। মেলিসার জন্ম টরন্টো শহরে । সে বড় হয়েছে বল্টন-এ টরন্টো’র। কাছের এক ছােট্ট শহরে। মেলিসা একজন নিবন্ধীকৃত নার্স, বর্তমানে সে একটি স্থানীয় হাসপাতালে ক্যান্সার কেয়ার ইউনিটে কাজ করে। ২০১২ সালে একটি বিশেষ পানঘরে তাদের প্রথম দেখা। সে দেখা থেকে তাদের কথাবার্তা বলা, আন্তরিকতা এবং প্রীতিপূর্ণ। সম্পর্ক। “যখন দেখলাম আমরা দুজনেই গভীরভাবে প্রেমে আসক্ত, আর কালক্ষেপণ না করে আমরা প্রচলিত আচার অনুযায়ী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই ২০১৪ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি ।
অনিল টরন্টোয় বাস করে, তার মা-বাবা মিসিসাগায়। অনিল তার মা-বাবার কাছ থেকে কেবল একটি ফোন কলের দূরত্বে অবস্থান করে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে সর্বদাই তৈরি, যারা তাকে এবং তার ভাইবােনদের দারুণ ভালােবাসা ও সমর্থনপুষ্ট পরিবেশে বড় করেছেন। অনিল তার ভাইবােনদের সঙ্গে ভালােবাসার বাঁধনে আটকে রয়েছে, যদিও আজ তারা বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ওদের গল্প। সবাই সে একই মায়ার বাঁধনে আটকে পড়া গল্পের মতাে। অনিল ওদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা। করে এবং তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সময় কাটায়।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী