You dont have javascript enabled! Please enable it!
জন ও ডরােথি মরিস

১৯৬৮ সালে জন ও ডরােথি মরিস যখন বিয়ে করেন, তার অনেক আগে থেকেই তারা পরস্পরকে চিনতেন, জানতেন, দেখা করতেন এবং এক সাথে গল্পগুজব করে অনেক সময় কাটিয়েছেন। এমনকি দত্তক নেবার বিষয়েও কথা বলতেন দুজনে। দুজনেই কেবল দত্তকের সমর্থনে নানা কাজ করা নয়, সন্তান দত্তক নিয়ে নিজেদের সংসার বড় করার পক্ষপাতী ছিলেন। যুদ্ধে অনাথ শিশুদের সম্পর্কে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে Weekend Magazine-এ এক লেখা পড়ে মরিস দম্পতি দত্তক বিষয়ে বেশ কিছু জানতে পারেন । মজার ব্যাপার হলাে, মরালরাও ওই একই ম্যাগাজিনে ওই প্রতিবেদন পড়ে যুদ্ধশিশুদের। দত্তক নেয়ার বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন । জন-এর উপর পরিবারের রুটি রােজগার ভাগের কাজ ছিল অন্টারিও ব্র্যান্টফর্ডে একটি কাস্টমস ব্রোকারেজ হাউস-এ যেটা তিনি চালাতেন। তিনি সে ব্যবসাটি ১৯৮২ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত চালু রেখেছিলেন। ডরােথি প্রাথমিকভাবে গৃহ পরিচালনা ও ছেলেমেয়েদের দেখােশানা করতেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫-এ পাঁচ বছরের মধ্যে মরিস দম্পতি তাদের চারটি সন্তান কোলে তুলে নেন, যার মধ্যে তিনটি তারা বিভিন্ন দেশ থেকে দত্তক নেন । যখন বেথ, তাদের একমাত্র ঔরসজাত সন্তানের বয়স দুবছর, দম্পতি বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু জরিনাকে দত্তক নেন। দম্পতি ভিয়েতনাম থেকে আরও একটি ছেলে অ্যারন জানুয়ারি ১৯৭৫ এবং আরেকটি মেয়ে টুইয়েটকে এপ্রিল ১৯৭৫-এ দত্তক নেন। দত্তক নেবার সময় জরিনার বয়স ছিল নয় মাস । অ্যারনের বয়স ছিল ১৩ মাস যখন সে মরিসের বাড়ি আসে ১৯৭৫ সালে, যদিও মরিসরা দত্তক প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন যখন ওর বয়স কয়েক দিন ।

জনের প্রথম সংসার থেকে আরও ছেলেমেয়ে ছিল তাই এদের কয়েকটি সৎ ভাইবােন অন্টেরিও এবং অ্যালবার্টা প্রদেশে বাস করত। মরিসরা শিশুদের বিষয়ে কোনাে ইতরবিশেষ করতে অভ্যস্ত নয়, তা সে তাদের ঔরসজাত বা পােষ্য সন্তানই হােক। দম্পতি সব সময়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এক রকমের আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন । সব ছেলেমেয়েরা তাদের কাছে প্রিয় যাদেরকে তারা স্নেহ-ভালােবাসা দিয়েছেন, যাদের তারা বিশ্বাস করেছেন, শক্তি যুগিয়েছেন এবং তাদের সবাইকে শর্তহীনভাবে ভালােবাসেছেন। মরিস দম্পতি দত্তকের মাধ্যমে তাদের পরিবার গড়তে চেয়েছিলেন এ বিশ্বাসে যে, পৃথিবীতে ইতােমধ্যে অনেক পরিত্যক্ত শিশু রযেছে যাদের জন্য প্রয়ােজন ছিল নিরাপদ বাড়ি ও স্নেহশীল বাবা-মা। তারা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন কয়েকটি অনাথ শিশুকে নিয়ে আসবেন দত্তকায়নের মাধ্যমে । হৃদয়ের অন্তঃস্থলে তারা এটাও বিশ্বাস করতেন যে, তাদের দত্তক নেওয়ার ফলে তারা কমপক্ষে স্থায়ীভাবে একটা কিছু করতে সক্ষম হবেন, যদিও অনাথদের সংখ্যা অনুযায়ী এটা খুব অল্পই হবে, তবুও এটা ছিল তাদের সামান্য প্রচেষ্টা। এটা এমনি একটি বিষয় যা হৃদয়ঙ্গম করার ফলে মরিস দম্পতি দৃঢ়ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ঐকান্তিক দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের অনাথ শিশুদের জীবনে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাবার লক্ষ্যে মরিস দম্পতি এ দুই দেশে নিয়মিতভাবে কয়েক বছর সাহায্যের জন্য টাকা পাটিয়েছেন সেখানকার আশ্রমগুলােতে।
মরিস দম্পতি আবেগসহকারে দত্তক সমর্থন করলেও তারা ওদের ক্রিয়াশীল সারা জীবনে এও জানতেন যে, আন্তর্জাতিক ও আন্তবর্ণীয় দত্তক প্রথাকে কানাডার ভিতরে এবং বাইরে অনেকে সমর্থন করেন না। বরং এটাকে তারা দেখেন ব্যক্তির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতির ধ্বংস হিসেবে। নেতিবাচক মন্তব্যে কর্ণপাত না করে মরিস দম্পতি নিজ শক্তি ও সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস রেখে সেটা তাদের কর্তব্য ভেবে করেছিলেন।
জরিনার আগমন তাদের ব্র্যান্টফর্ডের বাড়িতে নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। তখন পর্যন্ত এলাকায় অল্প কয়েকটি অশ্বেতাঙ্গ পরিবার দেখা যেত। স্বাভাবিকভাবেই একটি “শ্বেতাঙ্গ” বাড়িতে এক বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুর আগমন যেন একটা মজার খােশগল্পের বিষয় হয়ে উঠেছিল পুরাে শহর জুড়ে। সে সময়ে মরিসদের মেয়েটিকে নিয়ে আরও কিছু সাড়া জাগানাে খবরও শােনা যায় ।
এক সংস্করণে ছিল: শিশুটি অনাথ আশ্রমে জন্মেছিল এবং তার জন্মদাত্রী মা তাকে ত্যাগ করে চলে যান। আবার আরেকটি সামান্য বাঁকানাে গল্প ছিল: এসােসিয়েটেড প্রেস এবং রয়টার্স। নিউজ এজেন্সির সংবাদ ভাষ্য অনুসারে জরিনাকে পাওয়া গিয়েছিল পানিতে ভাষা পরিত্যক্ত পাকিস্তানি একটি গানবােটে পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্থন করার পর ডিসেম্বরে ১৯৭১ সালে । গানবােটে একটিও সৈন্য ছিল না সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। নবজাত শিশুটি একাধারে কাঁদছিল। মেয়েটিকে তখন উদ্ধার করে মুক্তিযােদ্ধারা অনাথ আশ্রমে নিয়ে যায় ।
কানাডীয় দম্পতি জরিনাকে কোলে নিয়ে এত উত্তেজিত হয়েছিলেন যে, সে সময়ে তারা সংবাদ মাধ্যমের কারাে সঙ্গে কথা বলতে চাইনি। জরিনার আগমনের দিন ডরােথি ও জন। এয়ারপাের্টেই অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কোনাে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে। দম্পতিরা বলেছিলেন; “তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা আগেই মেয়েটিকে দত্তক নিয়েছি।” (The Glob and Mail, ২১ জুলাই ১৯৭২)। কিন্তু নাছােড়বান্দা সাংবাদিকরা একের পর এক প্রশ্ন করে যান। তারা তখন দম্পতিকে বারবার প্রশ্ন করেনঃ “জরিনাকে নাকি পাকিস্তানি নেভী বােট থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল?” সে সময়ে ডরােথি আর চুপ করে বসে থাকতে পারেননি। তার চটপটে উত্তর ছিলঃ “আমদের বলা হয়েছিল, তাকে শিশু সদনে আনা হয়েছিল, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না।” (The Kitchener-Waterloo Record ২১ জুলাই, ১৯৭২)।
বস্তুতপক্ষে সে সময়ে মরিস দম্পতির প্রথম প্রাধিকার ছিল রুগ্ন শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া, যেহেতু জরিনা অত্যন্ত দূর্বল ছিল। যুদ্ধশিশুদের অধিকাংশই ছিল ওজনে কম এবং মেয়াদের আগে জন্মানাে । ডাঃ ফেরি ব্যক্তিগত আগ্রহে বারবার শিশুদের পরীক্ষা করে দেখেন। শিশু জরিনার ফোড়া সম্পর্কে একটু চিন্তিত ছিলেন। তিনি দম্পতিকে লিখেন জরিনার জন্য জরুরিভিত্তিতে কী কী চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। কয়েকটি ওষুধ লিখে দিয়ে ডাঃ ফেরি তার হাতে লেখা নােট এভাবে শেষ করেনঃ “আমি আপনাদের ডাক্তারকে ফোন করতাম। আমাকে কখনাে দরকার হলে এ নম্বরে ফোন করবেন ৬৩৭-৯৩৩৯। একটি প্রেসক্রিপশনও রইল যতক্ষণ না তাকে পান। নার্সিং এর জন্য কোনাে প্রকারের সাহায্য লাগলে ভি ও এন (ভিক্টোরিয়ান অর্ডার অব নার্সেস) অথবা পাবলিক হেলথ নার্স এর সাথে।
যােগাযােগ করবেন।” নানা ব্যাস্ততার মধ্যে থেকেও ডাঃ ফেরি যে উপদেশমূলক চিঠিটা। লিখেছিলেন তাতে মরিসরা অত্যন্ত খুশি হন। ডাঃ ফেরির লেখা অনুসারে জরিনার জন্য যা করার দরকার সেটা তারা করেছিলেন। যেসব সংবাদপত্রের প্রতিবেদকরা দ্বিতীয়বারের মতাে মরিসদের বাড়িতে আসেন জরিনার সম্পর্কে খবর নেয়র জন্য তারা স্বচক্ষে দেখতে পান শিশুটির পরিবর্তন। ভালােবাসা ও জীবনুনাশক ঔষধ মিলে শিশুটির স্বাস্থ্য দিন দিন ভালাে হচ্ছ। পেছনের বছরগুলাের দিকে তাকিয়ে মরিসরা আশ্চর্যজনকভাবে দেখেন যে, “কয়েক মাসের মধ্যে ভগ্নস্বাস্থ্য রােগাভােগা মেয়েটি শুধু যে বেঁচেই রয়েছে তা নয়, স্বাস্থ্যহাস্যে-খুশিতে যেন টগবগ করে ফুটছে সকলে মুগ্ধ একেবারে ।” মরিসরা এখনও মনে রেখেছেন সে দিনগুলাের মানসিক চাপা উত্তেজনার কথা যখন তারা দিনরাত একটু কিছুতেই ডাক্তারের কাছে ছুটতেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাত তুলে প্রাণ ভিক্ষাও চেয়েছিলেন হাড্ডিসাড় মেয়েটিকে বাড়ি আনার পর ।
এ ছাড়া অন্য স্মৃতির মধ্যে মরিস দম্পতির কিছু তিক্ত মধুর স্মৃতি রয়েছে; সেগুলাে মূলত জরিনাকে কানাডাতে নিয়ে আসার সংগ্রাম ও আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তক গ্রহণের প্রক্রিয়া ঘিরে । এসব স্মৃতি বিশেষ করে মনে রয়েছে, যেগুলি হাতড়ালেই উঠে আসে তাদের স্মৃতিপটে। তারা অবশ্য কখনাে চাইনি এসব ঘটনা স্মরণ করতে । তবে হ্যা, মরিসদের যতটুকু ধৈৰ্য্য ধারণ করার ছিল, দত্তক নেবার বেলায় তারা তার চেয়ে বেশি ধৈর্য্য ধরেছিলেন, বলতে হবে । যেদিন মরিসরা জানলেন যে, ক্যাপুচিনােরা তাদের জন্য একটি কন্যা পছন্দ করেছেন, মরিস তখনই তাদের মনে মেয়ের একটি ছবি এঁকে নেন । সাথে সাথে তাদের মনে হয় মেয়েটি যেন তাদের নিজের যদিও মেয়েটিকে তারা তখনও দেখেননি । সেদিন থেকেই ঐ মেয়েটি তাদের হয়ে যায় ।
ডরােথির ভাষ্য মতে, কেউ কেউ হয়তাে এরকম ভাবতে প্রলুদ্ধ হতে পারেন যে, অত্যন্ত ঢিলেঢালাভাবে বিলম্বিত সময়ের দৈর্ঘ্যগুলাে যদি যদি যােগ করা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের কাজের জন্য, তখন দেখা যাবে বাংলাদেশের অনাথ আশ্রম থেকে কানাডা পৌছতে যে সময়টুকু লেগেছিল, ধরে নেয়া যেতে পারে সেটা একটি শিশুর গর্ভধারণকালের সময়ের মতাে। মরিস দম্পতি বলেন; তাদেরকে যে নানা ধরনের অগ্নি পরিক্ষা পার হতে হয়েছিল সেগুলাে পুনরাবৃত্তি করার আর কোনাে ইচ্ছা নেই ।
সময়ের সঙ্গে শিশুটি (ল্যারা) যখন সুন্দর একটি মেয়েতে পরিণত হয়, দম্পতি তখন অন্য বিষয়ের ওপর মনােযােগ দেবার সুযােগ পান। তখন তারা জরিনাকে কোথায় এবং কোনাে পরিস্থিতিতে পাওয়া গিয়েছিল জানতে পারেন। খবরের কাগজ থেকে কাটা ক্লিপিং এর সংবাদে তারা জানালেন, “সিস্টার মার্গারেট ম্যারি জরিনাকে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেঘনা নদীর তীরে পান।” আবার সে সময়ে মেয়ের জন্ম সনদপত্রে লেখা ছিলঃ ঢাকা, বাংলাদেশে ২৩ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখে জরিনার জন্ম । সনদ-এ স্বাক্ষর করেন সুপিরিয়র, মিশনারিজ অব চ্যারিটি, এবং যুদ্ধ শিশুদের সংবিধিবদ্ধ অভিভাবক।
দম্পতি সিস্টার ম্যারিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে জরিনার সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে চেয়েছিলেন। সিস্টার ম্যারি সঙ্গে সঙ্গে ওদের চিঠির উত্তরে দম্পতিকে জানান যে, সৌভাগ্যের কথা, ‘৭১-এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনাে এক দিন তিনি দেখেন একজন দৃশ্যত অসুস্থ মানুষ একটি মৃতপ্রায় শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে নদীর পাশে। সে লােকটি তাকে। বলেছিলেন যে, তার পক্ষে শিশুটির দায়িত্ব নেয়া সম্ভব না। সিস্টার যখন তাকে বললেন যে, তিনি নিজে শিশুটির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত, তখন লােকটিকে দেখে মনে হলাে তিনি ভারমুক্ত হয়ে শিশুটিকে সাথে সাথে সিস্টারের হাতে সপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন।
সিস্টার শিশুটিকে অনাথ আশ্রমে নিয়ে এলেন। শিশুটির ওজন তখন ৩ কেজি, দেখে মনে হচ্ছিল ওর রক্ত আমাশয় হয়েছে এবং তার গায়ে অনেক ঘা ছিল। সিস্টার ম্যারি তখন শিশুটির জরিনা নামকরণ করেন এবং অনুমাননির্ভর একটি আনুমানিক জন্মতারিখ ও জন্মের ওজন দেন। তিনি দম্পতিকে আরও জানান যে, জরিনা জানুয়ারি ১৯৭২-এ অনাথ আশ্রমে আনা প্রথম যুদ্ধশিশু ছিল । তথ্যটি সিস্টার মরিস দম্পতিকে লেখা একটি অ্যারােগ্রামে দেয়া আছে। চিঠির তারিখ ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৩। দম্পতি চিঠিটি তাদের পবািরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল রূপে সংরক্ষণ করেছেন। সন্তানের দত্তক নেবার প্রাথমিক দলিল হিসেবেও চিঠিটি উল্লেখযােগ্য।
আপাতদৃষ্টিতে অন্যান্য অনেকের মতে মরিসরাও জানতেন যে, অনেক যুদ্ধশিশুর আত্মীয়রা নবজাতককে নিয়ে সরকারের অনাথ আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে জানাতেন যে, শিশুর মা-বাবা মৃত অথবা এত দরিদ্র যে সে শিশুর যত্ন নিতে অপারগ। এ ধরনের গল্পের ধারা, যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় Storyline, প্রায় সবাই কম বেশি জানতেন। সবাই এটাও জানতেন যে, ঐ শিশুদের যুদ্ধশিশু বলে চিহ্নিত করলে তাদের জন্মের কাহিনীতে আরও কালিমা লেপন করা হবে। সেজন্য ঐ নবজাত যুদ্ধশিশুদের অনাথ আশ্রমে আনা হতাে এটা ভেবে যে, ওরকম একটি কাহিনী যেখানে বাবা-মায়ের একজন মৃত এবং অন্যজন তাকে লালন-পালনে অক্ষম” জানালে সমাজ তাকে যুদ্ধশিশু ভাববে না, বরং কিছুটা করুণাভরে সে অনাথ শিশুকে বাঁচার একটা উপায় করেও দিতে পারে।
মরিসদের অবশ্য এ ধরনের Storyline-এর কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। যদিও সংবাদ মাধ্যম বিষয়টি নিয়ে একটু হৈ চৈ করার চেষ্টা করেছিল, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের যৌন সহিংসতার বিষয়ে জানতেন। তারা এটাও জানতেন যে, জবরদস্তিমূলক গর্ভধারণ, যুদ্ধশিশু প্রসব ও পরিত্যাগ বাংলাদেশে ও ভিয়েতনামে সাধারণ ঘটনা ছিল । ক্যাপুচিনোেরা দম্পতিদের ইতােমধ্যে অবহিত করেছিলেন যে, বিয়ােগান্তক ঘটনাবলির মাঝে যুদ্ধশিশুদের জন্ম ও তাদের মায়েদের দ্বারা যুদ্ধশিশুদের পরিত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল এমনকি দত্তকের জন্য শিশুদের বেছে নেওয়ার আগে কানাডাতে তাদের শিশুকে পরিবারের স্নেহের ছায়ায় নিয়ে যাবার জন্য যে অল্প স্বল্প বাধা ছিল, সেগুলাে পার হয়ে শিশুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি আনা হয়েছে, স্নেহশীলা ডরােথি বলেন।

যখন ছেলেমেয়েরা ছােট ছিল, তখন দম্পতি তাদের সমস্যাগুলােই সদয়ভাবে সাবধানতার সাথে পরিচালনা করেন । যখন তাদের সন্তানরা বড় হতে লাগে, দম্পতি তাদেরকে নিজেদের বিচার বুদ্ধি ব্যবহারের মাধ্যমে চলতে দেয়ার সুযােগ দেন। তারা যে তাদের সন্তানদের ভালােবাসেন এটা তাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ছেলেমেয়েরা বুঝুক তারা যেন নিজেরাই দায়িত্বভার বুঝে নিতে পারে। যদি কখনাে তারা কোনাে কাজে বাধা দিয়ে থাকেন, সেটা বিশ্বাস না থাকার কারণে নয়, তারা ভেবেছিলেন তাদের বাধা না এলে এরা বিপদে পড়বে। সন্তানদেরকে তারা শিখিয়েছেন দয়ালু হতে, মায়া-মমতা দেখাতে এবং সবসময় হৃদয়টা খুলে বিবেচনা করে দেখতে। নানা পরিমাপ, রঙ আর জাতের সংস্কৃতির মিশ্র পটভূমির প্রেক্ষিতে মরিসরা তাদের সন্তানদের বহুসাংস্কৃতিক ও বহুজাতিক কানাডাতে কানাডীয়রূপে প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বে বড় করে তােলার চেষ্টা করেছেন। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মরিস পরিবার স্থিতিস্থাপক পরিবারের এক উদাহরণ হয়ে থাকবে আজীবন। কথাটি এ অর্থে যে, ঐতিহ্য ও আগুপিছু করে নমনীয়তার সাথে দুটির সমস্বয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করেছিলেন। নিঃসন্দেহে কঠোর পরিশ্রমের ফলে দম্পতি একটি টেকসই ও নিরাপদ জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হন। যেখানে সকল পরিবার সদস্য একে অপরকে ঠাঁই দিয়েছিলেন, প্রয়ােজনে সেখানে একে অন্যকে ভালােবেসেছেন, বিশ্বাস করেছেন এবং শ্রদ্ধা করেছেন। তাদের বড় মেয়ে বেথ এখন রেজিস্টার্ড নার্স । হ্যামিলটন হেলথ সায়েন্সেস এডমিনিস্ট্রেশনের অফিসে কাজ করে । ওদের দ্বিতীয় কন্যা টুইয়েট বিবাহিত, দুটি সন্তানের মা এবং কাস্টমস। ব্রোকারেজ কম্প্যানিতে ডাটা এন্ট্রি ক্লার্কের কাজ করে।

যুদ্ধশিশু জরিনার বিশদ তথ্য “জরিনা” উপশিরােনামে দেয়া হলাে। ছেলে অ্যারন বর্তমানে টরন্টোতে থাকে। নানা ধরনের কাজ করছে আবার কখনােবা পড়ছে। মরিসরা সকলেই ব্ল্যান্টফর্ডে ছিলেন। ২০০৬ সালে। হঠাৎ জন মৃত্যুবরণ করেন। জনের মৃত্যু পরিবারের কেউ সহজভাবে নিতে পারেনি। ওরা। সবাই নিজেদের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে, জনের চিরতরে চলে যাওয়ায় সবার জন্যই বাঁধনটা হঠাৎ যেন ঢিলে হয়ে গিয়েছিল । এখন ডরােথি বেথের সঙ্গে একটা ঘর নিয়ে থাকেন, যেটাকে বলা হয় granny suite। বাড়িটা ব্র্যান্টফর্ড শহরে। সেখানে সবাই ডরােথিকে দেখতে আসেন । মরিসরা বহুদিন আগে বেথকে নিয়ে ঠাট্টা করে বলতেন, বেথ হলাে ওদের একমাত্র হােম-মেড সন্তান। জন এবং ডরােথি সবসময় বলতেন যে তারা অত্যন্ত সুখী। কারণ তাদের নানাবণীয় সন্তান সন্তনাদিই পরিবারের বৈচিত্রতা এনে দিয়েছে। তাদের জীবনকে ঋদ্ধ করেছে। মরিসরা কখনাে স্মারক অথবা পুরষ্কার মনে মনেও চাইনি। এজন্য চাইনি যে, তারা মনে করেন ছেলেমেয়েদের জন্য তারা বিশেষ কিছু করেননি। কিন্তু প্রতিবেশিরা মরিসদের বীরের সম্মান দিয়েছেন এটুকু দেখেই যে, তারা অতদূর দেশ (ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ) থেকে অনাথ শিশু এনে তাদের স্নেহ আদরে লালন পালন করে মানুষ করেছেন। আবার অনেক সময়ে স্থানীয় সংবাদ প্রচারের সময়ে দম্পতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাদের নিঃস্বার্থ শিশু সেবার প্রংশসা করেছেন । ব্র্যান্টফর্ডের মানুষ মরিসদের ভােলেননি। তারা আজও উদারদাতা। | হিসাবে কমুনিটিতে পরিচিত। তারা তাদের পরিবারের শিশুদের জন্য সর্বদা সবচেয়ে সেরা কাজটি করেছেন – নিঃশর্ত ভালােবাসা দিয়ে ।

জরিনা
শােনা গিয়েছিল যে, জরিনা ঢাকার নিকটবর্তী একটি গ্রামে ২৩ অক্টোবর ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং তাকে শিশু ভবনে ডিসেম্বরে সিস্টার ম্যারির নিকট নিয়ে আসা হয় । | ফলে, স্বাভাবিকভাবেই জরিনা যখন জুলাই ১৯৭২-এ অন্যান্য যুদ্ধশিশুর সঙ্গে কানাডা পেীছয়, তার বয়স তখন নয় মাস যদিও সে অত্যন্ত রুগ্নস্বাস্থ্য শিশু ছিল। আনুষ্ঠানিক রেজিস্ট্রেশনের সময় মরিস দম্পতি ওকে ঢাকা শিশু সদনে যে নাম দেয়া হয়েছিল সেটা বাদ দেননি। তারা মেয়েটার নাম (প্রথম নাম) রাখেন ল্যারা আর মধ্য নাম জারিনা, যদিও  বাংলাদেশে তার জন্মসনদে তার নাম ছিল জরিনা । ফলে শিশু মেয়েটির নাম হলাে: ল্যারা জারিনা মরিস ।
অন্টেরিও প্রদেশের ব্র্যান্টফর্ড শহরের নর্থ পার্ক কলেজিয়েট ও ভকেশন্যাল স্কুল থেকে হাই স্কুলের পাঠ শেষ করে ল্যারা ব্যারি শহরে জর্জিয়ান কলেজে ভর্তি হয় । ওখান থেকে অনার্স | ডিপ্লোমা করে ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট-এ ১৯৯৩ সালে। জর্জিয়ান কলেজে অধ্যায়নকালে | ল্যারা একটি দলের সঙ্গে কাজ করে একটি অ্যাকশ্যান প্ল্যান তৈরি করে ফ্যাকালটি পুরস্কার লাভ করে এবং ট্রাভেল এ্যান্ড ট্যুরিজম রিসার্চ ইন্টারন্যাশন্যাল এ্যাসােসিয়েশন অব কানাডা থেকে দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করে। কয়েক বছরে ল্যারা অনেকগুলাে কোর্স শেষ করে। তার | মধ্যে ছিল অন্টেরিওর ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট প্রােগ্রাম (ও এম ডি পি) এ্যান্ড লিডারশিপ স্কিলস, অন্টেরিওর হ্যামিলটনস্থ মওহাক কলেজ থেকে।
মওহাক কলেজ থেকে ২০১০ সালে Human Resources Certificate-এর সনদ পেয়ে Human Resources Professonal Designation-এর প্রার্থী হয় । ল্যারা বেশ কয়েকটি কাজ করেছে। ১২ বছরের বেশি সময় (ও এল জি) Casino Brantfod টেবিল গেমস  ইন্সপেক্টর পদে কাজ করেছে। অনেক বছর বাইরের কাস্টমারদের সেবা প্রদানের পর হিউম্যান রিজোউর্সেস-এর ডিপার্টমেন্টে সময়সূচি রক্ষক হিসাবে কাজ করেন  ব্র্যান্টফুড ফর | থট নামক স্থানীয় অলাভজনক সংস্থাতেও সেক্রেটারির পদে কাজ করেন। এ ছাড়া সে আরও কয়েকটি অলাভজনক সংস্থায় কাজ করেন।
ল্যারার বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনাে কিছু মনে পড়ে না। ল্যারাকে তার বাংলাদেশের অনাথ | আশ্রমে বাস করার সময় যে জীবন ছিল, সে বিষয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন। তার জন্ম কাহিনীর একটি গল্প এরকম আছে যে, তার জন্মদাত্রী মা এবং ভাই মারা গিয়েছিল তার অনাথ আশ্রমে যাবার আগেই, ইত্যাদি। আরেকটি গল্প আমরা ইতােমধ্যে শুনেছি, পরিত্যক্ত | একটি নৌবাহিনীর জাহাজে সে পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা পরিত্যক্ত হয়েছিল। তার মা-বাবার
মতাে ল্যারারও এতে কিছু যায় আসে না তার গল্প যাই হােক না কেন – কারণ সে বড় হয়েছে মরিসদের বাড়িতে, মরিসদের একমাত্র মা-বাবা জেনে। সে এটাও জানে, তার মা-বাবার মাধ্যমে কেমন করে অনাথ আশ্রমের এক সন্ন্যাসিনী তাকে উদ্ধার করেছিলেন। তার মা-বাবা তাকে কখনাে তার জন্মবৃত্তান্ত আরও বিশদভাবে জানতে বাধা দেননি; বরং তার তাকে। উৎসাহিত করার চেষ্ট করেছেন। ল্যারা নিজেই সেদিকে বেশি এগােয়নি।
তার মা-বাবা তাকে একটি পরিপূর্ণ জীবন দিয়েছেন। সেখানে সকল সুযােগ ও অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা রয়েছে যা তার বাংলাদেশি জীবনে সম্ভব হতাে না। আমি আমার কানাডীয় বাবামাকে সেজন্য ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনি। অনেকগুলাে শিশুকে বঞ্চিত করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, নইলে আমি কখনাে কানাডাতে ওই অসাধারণ পরিবারে সদস্য হতে পারতাম না,”২২ ল্যারা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে কথাটি বলে । অল্প বয়সে বাবা-মায়ের এত আদর যত্নে লালিত পালিত হয়ে সে যে জন্মের পর পরিত্যক্ত সে কথা ভাবতে পারেনি।
“আমাকে মা-বাবা এমনভাবে ভালােবেসে আদর করেন যে, আমি তাদের ভালােবাসায় কখনা কোনাে কিছুর ঘাটতি লক্ষ্য করিনি,” বলে ল্যারা তার মতামত ব্যক্ত করে। সে আরও বলে, মা-বাবা আমাকে কখনাে আমার ভাইবােন থেকে (যাদের মধ্যে দুজন ছিল ভিয়েতনামের) আলাদা চোখে দেখেননি। তারা আমাদের সবাইকে যার যা দরকার সব কিছু, যেমনঃ বাড়িঘর, খাবার-দাবার, পােশাক-আশাক, টাকা-পয়সা, শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক কাজকর্ম ও সবার। সাথে মেলামেশার সুযোেগ দিয়েছেন। এছাড়াও দিয়েছেন আদর ভালােবাসা যা ছিল। আমাদের পরিবারের আবহ ৩ ভাইবােনের মধ্যে ভাইয়ে ভাইয়ে বা বােনে বােনে হিংসা বা রেষারেষির ছােটখাটো ঝগড়া বিবাদ ছাড়া, তাদের পরিবারে আর কোনাে ইস্যু ছিল না। ওরা বেড়ে উঠেছিল অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে, হাসি আর কান্নার মধ্যে, অন্য আর দশটা পরিবারের মতাে । কানাডাতে আর দশটা। যুদ্ধশিশুর মতাে, ল্যারা তার দত্তকগ্রাহী মা-বাবার বহুজাতিক পরিবারে এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে সে নিজেকে তাদের চেয়ে ভিন্ন হিসাবে ভাবতেও পারেন না। ফলে অন্যরা তার সম্পর্কে কী ভাবছে সে বিষয়ে তার চিন্তার অবকাশ হয়নি। যেহেতু কানাডাতে সবাই কোনাে কোনাে বাইরের দেশ থেকে এসেছেন, ল্যারার মনে পড়ে না যে তাকে কখনাে কেউ। বহিরাগত হিসাবে দেখেছে । ল্যারা বলে, সে কখনাে জাত, গােত্র, ধর্ম বা সংস্কৃতির পটভূমি বিচার করে সংসর্গ নেবে বা কারাে সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবে না সেটা বিচার করে না। বরং সে “মানুষকে মানুষ হিসাবে গণ্য করে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এসেছে এ পর্যন্ত ।
১৯৮৯ সালে যে পাঁচজন যুদ্ধশিশু বাংলাদেশে গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে ল্যারাও ছিল – তখন ১৭ বছর বয়স ওর । সপ্তম অধ্যায়ে যুদ্ধশিশুদের জন্মদেশে প্রথম সফর এ শিরােনামে আমরা ঐ ভ্রমণের বিশদ জানতে পারব। ল্যারা দাবি করে তার জন্য “১৯৮৯ সালের বাংলাদেশ সফর ছিল জীবনের একবারই ঐরকম ভ্রমণ,” যেটা বাকি সারা জীবনে তার স্মরণ থাকবে। এ সফরে আমি বুঝতে পারি আমার জীবন কেমন হতাে যদি না আমায় দত্তক নিয়ে না আসা হতাে” বলে ল্যারা । বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ল্যারা বলে, আমার যেন “বুক ফেটে যাচ্ছিল। অনাথ শিশুদের ছেড়ে যেতে । ভবিষ্যৎ ওদের জন্য কী রেখেছে, আমাদের ওদের জন্য কিছু করার নেই এটা অনুভব করে। যদিও ল্যারার জীবনের প্রথম নয় মাস অনাথ আশ্রমে তার সঙ্গে কে কী করেছিল সে কথা তেমন মনে নেই, তবুও তার যতদূর মনে পড়ছিল, ওখানে সে যেন তার ছােট ভাইবােনদের ফিরে পেয়েছিল। ওই অতগুলি বছর পর অতীতের সে ভুলে যাওয়া দিনগুলি যেন উপস্থিত হয়েছিল ল্যারার সঙ্গে পুনর্মিলনের আনন্দে। “আমি ভীষণভাবে অনুভব করেছিলাম আমার (দত্তকগ্রাহী) মা-বাবা এ অভিজ্ঞতা যদি আমার সঙ্গে ভাগ করতে পারতেন,” শিশু ভবনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে ল্যারা সে সময়ের ভাবাবেগের কথাটি এ ভাবেই ব্যক্ত করে। এখানে মনে রাখা দরকার, যেহেতু ল্যারার বাংলাদেশ সংক্রান্ত কোনাে স্মৃতি নেই, তার জন্মদাত্রী মা অথবা যার ঔরসে মায়ের গর্ভধারণ সে বাবার অনুপস্থিতিতে, তার মনের ভেতরে তেমন কোনাে অভিঘাত হয়নি।
“যদিও এটা আমার বর্তমান পরিকল্পনায় নেই, আমি বিশ্বাস করি আমি একদিন বাংলাদেশে ফিরব, যেখানে হয়তাে কিছু দান করব।” কথাটি ল্যারা খুব সহজভাবে ব্যক্ত করে । বাংলাদেশে আসলে সে স্বেচ্ছাসেবার কাজ করবে। ১৯৮৯ সালে তার বাংলাদেশে আসার প্রায় ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু এ সম্পর্কে সে আজও কোনাে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। করেনি; আবার কোনােদিনও যে সে কিছু করবে না, এমন বলেনি।
মেয়েবেলা থেকে ল্যারা কমিউনিটিতে নানা ধরনের কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে জড়িত। | নিঃসন্দেহে ল্যারা অনেককিছুই অর্জন করেছে এ যাবৎ। ড্রাম ও রণ শিঙ্গা বাজিয়ে এবং উইন্টার কালার গার্ডে সে অন্টেরিও ও কিউবেকে ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বহুবার অনেক পুরস্কৃত হয়েছে। তা ছাড়া ক্যাসিনাে নায়াগ্রা এবং ক্যাসিনাে ব্র্যান্টফর্ড-এ টেবিল গেমস। ইনস্পেক্টর হিসাবে কাজ করে প্রশংসাপত্র পেয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় খবরের কাগজে গ্রুপ এবং একক পারফর্মেন্সে Brantford Expositor তাকে নিয়ে কয়েক বার আকর্ষনীয় প্রতিবেদন লিখেছে; The London Free Press-এ তাকে নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছে। ওর প্রথম বাংলাদেশ ট্রিপেও ওকে খবরের কাগজ অনুসরণ করে বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছে ।
Romper Room, Tiny Talent Time নামের এক চিত্তবিনােদনমূলক এক অনুষ্ঠানে ল্যারা অংশগ্রহণ করেছিল। তাছাড়া the Sesame Street movie Follow That Bird চলচিত্রেও ল্যারা অভিনয় করেছে। ল্যারা আজ পর্যন্ত তার মা-বাবার পরিবারের খুব কাছের। মানুষ । পরিবারের সকলে সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করে চলে। বুদ্ধিদীপ্তা ল্যারা তার উজ্জ্বলতা দিয়ে ধারে কাছের সবাইকে ছুঁয়ে যায় । ওর ভাই অ্যারন ছাড়া সবাই নিয়মিত যােগাযােগ রাখে, সপ্তাহান্তে পারিবারিক ডিনার ও ‘গেমস নাইটে’র জন্য সবাই একত্রিত হয়ে। এবং তার নিজেরা সে সময়গুলাে একান্তভাবে উপভােগ করে।
কেনেথ ও মিটুজি ম্যাককালা শেষ পর্যন্ত এটি একমাত্র দম্পতি যাদের কোনাে হদিস পাওয়া যায়নি বহু চেষ্টার পরও। নােভা স্কোশিয়ার সসাস্যাল সার্ভিস সংস্থাসমূহ ১৯৭২ সালে দম্পতির সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিল, বিশেষ করে ওরা যখন হ্যালিফ্যাক্স শহরে বাস করছিলেন। তারপর থেকে তাদের কোনাে নতুন ঠিকানা কেউ দিতে পারেনি।
নানা অনুসন্ধানের পর যতটুকু জানা গেল সেটা হচ্ছে এরকম: যারা ম্যাককালাদের চিনতেন, তারা বলেন যে, ম্যাককালারা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিলেন। আবার সেখানে ফেরত চলে যান। যতদূর জানা যায়, এ দম্পতি কখনাে পােষ্যক পিতামাতাদের নেটওয়ার্কে নাম লেখাননি। কানাডীয় আর্কাইভস-এর রেকর্ড অনুযায়ী যখন কেনেথ ও মিটজি ম্যাককালা ১৯৭২ সালে প্রবীরকে দত্তক নিয়েছিলেন তখন তারা নােভা স্কোশিয়ার হ্যালিফ্যাক্সে বাস করতেন। তারা ছেলেটিকে কোলে তুলে নেবার আগেই তার নামকরণ করেন ম্যাথিউ ম্যাককালা। নতুন ছেলেকে নিয়ে মিটুজি তার হ্যালিফ্যাক্সে ফ্লাইট ধরার জন্য বিমানে উঠার ঠিক আগে তার ছেলের নামকরণ বিষয়ে এক রিপাের্টারের প্রশ্নের উত্তরে বলেন: “আমরা ভেবেছিলাম প্রদীপ শুনতে কেমন জলখাবারের মতাে শােনায়, আমাদের শুনতে মজা লেগেছিল। আমাদের মনে হলাে সবাই সারা জীবন ওকে নিয়ে হাসাহাসি করবে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমাদের ছেলের নাম ম্যাথিউ রাখব” (The Gazette 21 July 1972)।
ম্যাককালারা ক্যাপুচিনােদের সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিলেন তাদের ছেলে আসার পর কিছু দিন পর্যন্ত  বাস্তবিকপক্ষে ম্যাককালারা নিজেরা আগ্রহ নিয়ে ক্যাপুচিনােদের লিখেছিলেন প্রবীরকে পাওয়ার পরে তাদের আনন্দের কথা বর্ণনা করে। সে সুখময় সময়ের কোনাে কোনাে উত্তেজক মুহূর্তে ক্যাপুচিনােদের সাথে বেশ কয়েকবারই লিখেছেন তাদের ছেলের বিষয়ে। অবগত করার উদ্দেশ্যে। তাদের ছােট ছেলেটির ক্ষিপ্রতা, ঔৎসুক্য, বেড়ে ওঠা, আত্মবিশ্বাস এবং মেলামেশা করার সক্ষমতা, নতুন পরিবেশে নতুন পরিচিতদের সঙ্গে ওঠা বসার বিষয়ে লিখেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, দম্পতি এত আনন্দ পেয়েছিলেন যে ক্যাপুচিনােদের মাধ্যমে তারা অন্যান্য দত্তকগ্রাহী পরিবারের সবাইকে জানাতে অনুরােধ করেন। তাদের শেষ চিরকুটটিতে লিখেছিলেন তারা কী তীব্রভাবে সংযুক্তবােধ করেন তাদের ছেলের সাথে। তারা যে তাদের ছেলের স্বাস্থ্য ও খাবারের দ্রুত অগ্রগতিতে উল্লসিত হয়ে সেগুলাে লক্ষ্য করতেন, সে কথাও ক্যাপুচিনােদের লিখেছিলেন। তারপর হঠাৎ করে ক্যাপুচিনােদের সাথে তাদের চিঠি পত্রের আদান প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাপুচিনােদের সাথে তাদের যে চিঠিপত্র লেখালিখি হয়েছিল, সেসব চিঠি ক্যাপুচিনােদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। যেহেতু ম্যাককালাদের কোনাে হদিস পাওয়া যায়নি বর্তমানের ক্ষেত্রে তাদের বিষয়ে অতিরিক্ত তথ্যাদি যােগাড় করা। সম্ভব হয়নি।

 

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!