You dont have javascript enabled! Please enable it!
ড. রবিন ও বারবারা মরাল

 

১৯৭২ সাল নাগাদ মরালদের বিবাহিত জীবনের দৈর্ঘ্য যখন আট বছর তখন তাদের এক সন্তান জন মরাল-এর জন্ম হয় ১৯৬৯ সালে। রবিন মরাল বায়ােলজির অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব সাসকাচিওয়ান-এর স্যাসকাটুন শহরে। তার গৃহকর্মী স্ত্রী বারবারা ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এ সময়টায় তারা দ্বিতীয় একটি সন্তানের কথা ভাবছিলেন, জনের জন্য একটি বােন। তারা ভাবলেন পরের সন্তানটি হবে দত্তকের মাধ্যমে। ১৯৬০-এর দশকে কানাডাতে যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটছিল তাতে দত্তক নিয়ে পরিবার বড় করা অনেকেরই পছন্দ ছিল। সে সময়ে সামাজিক বিপ্লবের দরুণ অনেক বিষয়ে, বিশেষ করে, মাতৃত্বের বিষয়টি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল, নানা বিবেচনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মরাল দম্পতি তাদের স্মৃতিচারণে বলেন, এক Weekend Magazine ২০ নভেম্বর ১৯৭১-এ ললি গন্ট এর লেখা একটি প্রতিবেদন পড়েন। সেটার শিরােনাম ছিল “A family is a child’s best gift”। তাতে কানাডীয় পরিবারে ভিয়েতনামী শিশু এবং অনাথ শিশু প্রতিপালনের কাহিনী বর্ণিত। হয়েছিল যা পড়ে মরালদের অন্তর ছুঁয়েছিল । “আমরা লােকসংখ্যার বিস্ফোরণে চিন্তিত এবং অনাথ আশ্রমে শিশুদের সংখ্যা জানার পর আমাদের আর নিজেদের পরিবার সে অর্থে তৈরি। করার প্রয়ােজন দেখিনি,” বলেন বারবারা।

আমরা কী করতে পারি? এ প্রশ্নটি মরালরা নিজেদের করেছিলেন পরপর কয়েকদিন। এ একটি লেখা তাদের মনের আবেগকে এমনভাবে মথিত করতে লাগে যে, তাদের মনের ট্রিগার টিপে আন্তর্জাতিক দত্তক নেবার বিষয়ে তারা দুজনেই সাথে সাথে আর কিছু না ভেবে রাজি হয়ে যান। ১৯৭১ সালের শেষের দিকে মরালরা জানলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে (যেখানে বাঙালি পূর্ব পাকিস্তানিরা তখন স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে) কিছু সংখ্যক যুদ্ধশিশু আনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তারা ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)-এর তদানীন্তন সেক্রেটারি ও প্রেসিডেন্ট ফ্রেড এবং বনি কাপুচিনােদের সাথে তখন থেকেই যােগাযােগ স্থাপন করেন। তারা ক্যাপুচিনােদের সাথে যােগ দেন বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধশিশু দত্তকের সম্ভাবনার জানালাটিও আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে ।
সে সময়ে যদিও তারা ভিয়েতনাম থেকে দত্তক নেবার জন্যই চিঠিপত্র লিখছিলেন এবারে তারা তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেবেন। লক্ষণীয় যে, দম্পতি তাদের আবেদনপত্রে সুনির্দিষ্টভাবে ছেলে বা মেয়ে সেটা ইঙ্গিত করেননি। যদিও তাদের একটি পুত্রসন্তান রয়েছে। প্রথম থেকেই মরালরা অত্যন্ত খােলাখুলি মনের ছিলেন। তাদের প্রার্থিত সন্তানের অনুসন্ধান করার সময় তারা কখনাে কোনাে পূর্বশর্ত দেননি যে, সন্তানটি ছেলে বা মেয়ে হয়। স্মৃতিচারণে বারবারা বলেন তাদের দত্তক নেবার সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে বেশ কয়েকদিন তারা নিজের সিদ্ধান্তকে মনে মনে ঘুরে ঘুরে নিজেই দেখেছেন আর ভেবেছেন, তারা কি উপযুক্ত মা-বাবা হতে পারবেন একটি বিদেশি ছেলে বা মেয়ের?
মরালরা আবেগীয়ভাবে দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণের জন্য ইতােমধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন – একটি বাংলাদেশি যুদ্ধশিশুকে দ্বিতীয় সন্তান হিসেবের বড় করে তুলতে ঢাকা থেকে বনি। কাপুচিনো মরালদের একটি হাতে লেখা পােস্ট কার্ডে শুভ সংবাদ লিখেছিলেন যে, তারা মালদের জন্য একটি শিশু কন্যা খুঁজে পেয়েছেন। সে কার্ডটি দম্পতিরা এখনও স্বযত্নে রেখেছেন। তার চিঠিতে বনি সাড়ে তিন মাস বয়সী শিশুটিকে একটি সুন্দর শিশু কন্যা যার মাথায় কড়কড়ে কাল চুল এবং একটি সুন্দর মুখ,” বলে সংক্ষেপে বর্ণনা করেছিলেন। বারবারা এবং রবিন দুজনেই খবর পেয়ে যে এত উল্লসিত হয়েছিলেন সে কথা তারা আজও ভুলেন নি সে খবরের সঙ্গে যে আনন্দ, আশা আর সাথে কী হয়, কী হয় ভেবে একধরনের উৎকণ্ঠা ছিল। যে শিশু ভবন থেকে তাদের এ মেয়েটিকে নিয়ে আসা হয়েছিল সেখানে মরাল দম্পতি নিয়মিত টাকা কড়ি শিশু ভবনের ঠিকানায় পাঠাতে শুরু করেন ইতােমধ্যে । যেখানে শিশুকে দেখাশােনা করত আয়ারা (ধাই, যারা শিশুদের যত্ন করত), সেখানের উদ্দেশ্যেই টাকাগুলাে পাঠানাে হয়েছিল । সামান্য টাকা হলেও তারা এটা অনেক বছর যাবত। পাঠিয়েছিলেন, তাদের মেয়ে কানাডা চলে আসার পরও। বনির চিঠি পাবার পর থেকে এর মাঝের দিনগুলাে কেটেছিল উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে যে তাদের কন্যাটির আসতে হয়তাে অহেতুক দেরি হতে পারে। এত দীর্ঘ যাত্রার ঝাকি সে সামলাতে পারবে কিনা। অপুষ্ট যুদ্ধশিশুদের মৃত্যুর হার এত বেশি যে সে ব্যাপারেও ঘােরতর সংশয় দেখা দিয়েছিল। ২০ জুলাই ১৯৭২ তারিখে তাদের মেয়েটি অবশেষে পৌছাল। রবিন সেদিন বাড়িতে ছেলে জনের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন এবং মেয়েকে সাদর অভ্যর্থনা জাননাের অনুষ্ঠান সংগঠন করছিলেন। বারবারা একাই উড়ে টরন্টো গিয়েছিলেন তাদের মেয়েকে আনার জন্য । তিনি একটু দেরি হলেও রাতের শেষ ফ্লাইটে মেয়েকে নিয়ে সাসকাটুনে পৌছবেন ঠিক। করেছিলেন। এ আশায় যে রাতে দেরি করে ফিরলে সাংবাদিকদের ভিড় এড়ানাে যাবে । কিন্তু সংবাদ মধ্যম সেদিনই খবরটার সম্পর্কে অবগত হয়ে গিয়েছিল। তাদের শিশুটি আরও। ১৪ টি যুদ্ধশিশুর সঙ্গে ঢাকা থেকে নয়া দিল্লি ও নিউ ইয়র্ক হয়ে টরন্টো এসে পৌছতে না পৌছতে খবরটি তাবৎ কানাডার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছড়িয়ে পড়ে।
পরদিন সন্ধায় মরালদের অবাক করে দিয়ে স্থানীয় দৈনিক The Star Phoenix একটি খবর প্রচার করে যার শিরােনামে ছিল কানাডামুখী শিশুদের কথা। বারবারা বলেন, তারা তাদের মেয়ের আগমন নিয়ে কোনাে হৈ চৈ করতে চাইনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল রানীর খবর। স্থানীয় ও জাতীয় খবরে ছাপা হয়। রানীকে নিয়ে প্রথম কদিন তাদের বেশ ব্যস্ততার মধ্যে কাটে। এর ফাঁকেও সময় করে বারবারা বনি কাপুচিনােকে চিঠি লিখে জনিয়েছিলেন তারা কেমন “পরিপূর্ণভাবে আনন্দিত হয়েছেন যে রানী তাদের মেয়েরূপে পৌছেছে।” সে সময়গুলাের কথা বলতে গিয়ে মরালদের মনে হয় রানীর স্বাস্থ্য নিয়ে তাদের উদ্বিগ্নতার কথা । কারণ তাদের কাছে তাদের মেয়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোনাে তথ্যই ছিল না । রাণী যখন কানাডা পৌছয় তখন তার ওজন খুবই কম ছিল। বারবারার এখনও মনে পড়ে, কীভাবে রানীর দিনের পর দিন কেটে যেত কোনাে খাবার না খেয়ে, যা হলে যে কোনাে মাবাবাই চিন্তায় পড়ার কথা। পরে রানী নিশ্চিতভাবে সাড়া দিয়েছিল এবং বড় হয়ে উঠেছিল স্বাস্থ্যবতী তরুণী হিসেবে। কিন্তু তখন তারা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না তাদের আগামী বছরগুলােতে কী মর্মান্তিক ঘটনাই না ঘটবে!
রাণী মরাল পরিবারের একজন হিসাবে বড় হয়ে উঠছিল তার অতীত বিষয়ে খুব বেশি মাথা ঘামিয়ে । রানীর জন্মকে ঘিরে অন্য কোনাে বানানাে গল্পও চালু করেনি কেউ। অনেক চেষ্টা করে মরাল দম্পতি ঠিক সুস্পষ্টভাবে মনে করতে পারেননি কবে থেকে রানী তার পশ্চাদপট নিয়ে জটিলতা বা চিন্তাভাবনায় জড়িয়ে পড়ে। তারা ঠিক কখন ব্যাপারটা ঘটেছিল বলতে পরেন না।
রাণীর দত্তকের ব্যাপারটা পরিবারের আর দশটা ঘটনার মতাে রানীর জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। বারবারার ভাষ্যমতে, রানী তার দত্তক গ্রহণের কাহিনী প্রথম দিন থেকেই যা জানবার, যতটুকু বুঝবার, সেটা নিশ্চয় জানত, যদিও দত্তক শব্দের পুরাে অর্থ তার বয়সের কারণে হয়তাে সে বােঝেনি। পরিবার বিশ্বাস করে রানী বড় হয়েছে তার জন্ম ইতিহাসের সামান্য যেটুকু নথিবদ্ধ রয়েছে সেইটুকু জেনে। রানী অবগত ছিল যে, এর চেয়ে বেশি। কোনাে তথ্য ছিল না কানাডা বা বাংলাদেশে। নথিতে ছিল, তার জন্ম বাংলাদেশে, তার জন্মদাত্রী তাকে পরিত্যাগ করেন এবং তাকে দত্তক গ্রহণের মাধ্যমে কানাডাতে নিয়ে আসা। হয়েছে। ঢাকার অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবার সম্পর্কে কিছু জনেন না।
মরালরা বলেন, রানী যখন বড় হয়ে উঠছিল, সব বিষয়ে সে অত্যন্ত সচেতন ছিল তারা। লক্ষ্য করেন বহিরাঙ্গনে খেলতে যাবারও তার খুব ঝোক ছিল। “রাণী বন্ধুত্ব করে ফেলত এক মিনিটে, কারণ সে সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারত, লােকে তাকে পছন্দও করত, মরালরা বলেন । রানী যখন বেশ ছােট, সে সময়ে দম্পতিরা তাদের মেয়েকে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যতটুকু সম্ভব ঘনিষ্ঠ পরিচয় করিয়ে তারা সাসকাটুনের আশেপাশে বাঙালি ও পূর্ব ভারতীয়দের তারা খুঁজে বের করে তাদের সাথে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ এর প্রথমদিকে সাসকাটুনে মােটে কয়েকজন বাঙালি বাস করতেন। শুরু থেকে মরালরা সরকার পরিবারের সঙ্গে মিশতেন। ড. অসিত সরকার বাংলাদেশি কানাডীয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে রবিনের সহকর্মী ছিলেন। তার স্ত্রী ইলা সরকার ছিলেন সমাজকর্মী। সরকারদের মেয়ে তানিয়া রানীর চেয়ে বয়সে একটু বড় হলেও সে ছিল রানীর শৈশবের বন্ধু । পরিবারটি খুঁজে খুঁজে অনেক পূর্ব ভারতীয় জনগাষ্ঠী বের করেছিলেন যাতে উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির জনগােষ্ঠীর সঙ্গে বেশি করে মেলামেশার সুযােগ করে নেয়া সম্ভব। হয় ।
অশৈশব কানাডাতে বড় হলেও রানী বিশেষভাবে ভারতীয় কিছু ব্যাপারে নিজেকে বেশি করে জড়াতে পছন্দ করত । বারবারা বলেন, মিসেস লালের বাড়িতে যে প্রাইভেট নাচের ক্লাসে রানী নাচ শিখতে যেত, সেটা সে খুবই পছন্দ করত । বারবারা কোনােভাবেই মিসেস লালের প্রথম নামটি মনে করতে পারেননি। তবে তিনি বলেন ভারতীয় বংশােদ্ভূত কানাডীয়কে মিসেস লাল নামে সবাই তাকে চিনত। মিসেস লাল শিশুদের ভারতীয় নাচ শেখাতেন। রবিন এবং বারবারা দুজনেই বেশ আত্মতৃপ্তির স্বরে বলেন মিসেস লালের কাছে শিখে রানী পারফর্মিং শিল্পকলা এবং ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যে বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিল।
যখন রানী কোনাে নৃত্য পরিবেশন করত অথবা কোনাে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত, হাতের কাছে যেসব গহনা পেত তাই পরত, প্রায়ই তার বন্ধুদের মায়েদের গহনা ধার করেনিয়ে পরত । তারপর সে অভিযােগ করত তার যথেষ্ট গহনা নেই বলে: “আমার বন্ধুদের মায়ের মতাে গহনা আমার মায়ের নেই কেন?” বারবারা রানীর কথা মনে করে রানীর অভিযােগটি উচ্চারণ করেন। মাঝে মাঝে কোনাে কোনাে উপলক্ষে রানী ভারতীয় শাড়ি পরে, ভারতীয় নারীর অলঙ্কারাদি পরে, ভারতীয় মেয়ের সাজে সাজত । বিশেষ কোনাে উপলক্ষে, বারবারা রানীকে দারুন সব ঝকঝকে ভারতীয় পােশাক কিনে দিতেন, যাতে রানী সাংস্কৃতিক চর্চায় উৎসাহিত হয়। বারবারা বলেন, ভারতীয় কমিউনিটির মাধ্যমে তারা নিজেরাও ভারতীয় সংস্কৃতি ও খাবারের ব্যাপারে বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সাংস্কৃতিক পরিচয় ছাড়াও তার বাবা-মা নিশ্চিত করেছিলেন যে রানী যেন অল্প বয়সে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষাও গ্রহণ করে। তারা রানীকে রবিবারে নক্স ইউনাইটেড চার্চে নিয়ে যেতেন; অন্যান্য খ্রিস্টীয় অনুষ্ঠানে গির্জায় যাওয়ার অভ্যাস তৈরি করেছিলেন । রানীকে ১২ বছর বয়সে গ্রোভেনর পার্ক ইউনাইটেড চার্চে ১৯৮৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অক্ষুদীক্ষিত (baptize) করা হয় বর্ধিত পরিবারের সব সদস্যদের উপস্থিতিতে। তাদের জীবনটি রানীকে ঘিরেই ছিল।
মরালরা সে সময় অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের সঙ্গে তাদের যােগাযােগ রাখা প্রয়ােজন যারা রানীর সঙ্গে একই সময়ে বাংলাদেশ থেকে কানাডা এসেছিল। রানী আসবার পর প্রথম কয়েক বছর তারা অন্টেরিওর অন্যান্য দত্তকগ্রাহী পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রেখেছিলেন । তাছাড়া ক্যাপুচিনাে ও স্যান্ড্রা সিমসনের (ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন) সঙ্গেও মন্ট্রিয়লে যােগাযােগ রেখেছিলেন। এ পর্যন্ত রানী কোনাে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েনি। ওকে দেখে। স্বাভাবিক, সক্রিয় তরুণী মেয়ে মনে হতাে। সে যা হােক, ১৯৮৭ নাগাদ যখন রানীর বয়স ১৫ বছরে পড়ল, মরালরা লক্ষ্য করেন রানী যেন কিছু কিছু অপ্রকৃতিস্থ মনের পরিচয় দিতে থাকে। মরালদের জন্য এটা বড় মানসিক আঘাত ছিল, যা তারা চেষ্টা করেও ভুলতে পারেননি কখনাে। তারা হঠাৎ রানীর ব্যক্তিত্বে চোখে পড়ার মতাে পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। তারা দেখলেন, বহির্মুখী হাসিখুশি রানী কেমন করে অন্তর্মুখী, একা মানুষ হয়ে গেল হঠাৎ! ওর তাবৎ বন্ধুরা যখন বহির্মুখী, রানী তখন ঠিক তাদের উল্টোমুখি হয়েছিল । কেউ তখন কোনােভাবেই বুঝতে পারেননি রানীর দুঃখের কী কারণ। বাবা-মা তখন উদ্বিগ্নের সাথে লক্ষ্য করেন যে, রানীর মানসিক অবস্থা এত দ্রুত খারাপ হচ্ছিল যে, রানী নিজে সেটা বুঝতে পারছিল না। তারা যদিও ঠিক বুঝতে পারেননি বিষয়টি তবুও এতটুকু বুঝেছিলেন যে, এটা একটা বিপদ সংকেত । বারবারা ঐ সময় রানীকে একজন মনস্তত্ত্ববিদের সঙ্গে দেখা করতে রাজি করান। পরবর্তী সময়ে সে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাকে ইয়ুথ। সার্ভিসেস ফ্যাসিলিটিতে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিয়ে যাওয়া শুরু করেন। মরাল দম্পতি খুব ভারাক্রান্ত মনে বলেন সে সময়ে রানী তার মনের ভেতরের ভাবনা চিন্তা বিষয়ে কাউকে বলত কঠোর গােপনীয়তা পালন করত, যার ফলে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাকে কোনাে রকমের কিছু সহায়তা প্রদানে অক্ষম ছিলেন ।
এটা কি পরিচিতি সংকট? বারবারা নিজেকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছেন। কিন্তু কোনাে জবাব মেলেনি যেহেতু রানী নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। চটপটে, প্রাণবন্ত, স্বাধীন এবং যােগ্য তরুণীর কথা ভেবে বারবারা মনশ্চক্ষে দেখছিলেন, রানী কি একেবারে নতুন কিছু ভাবছিল? এমন কী হতে পারে, রানী জিজ্ঞাসা করছিল আমি কোথা থেকে এলাম? কেমন করে এত সব হলাে? মা-বাবার ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানী রবিনও একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন রানীর দ্রুত খারাপ হতে থাকা মানসিক সমস্যা নিয়ে। তারা তখন ভাবতে লাগেন তবে কি রানী তার দত্তক অবস্থানের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি? নিঃসন্দেহে, ব্যক্তিগত কল্পকাহিনীর (যুদ্ধশিশু হিসেবে) সাথে তার বাস্তব অবস্থান খাপ খাওয়াতে রানী হিমশিম খাচ্ছিল।
মরালরা যতই পেছনের দিকে তাকান, ততই তারা হৃদয়ঙ্গম করেন যে তারা রানীর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে। রানীর সমস্যাগুলি নতুন সমস্যা নয়। বাস্তবিকপক্ষে সেগুলাে লক্ষণীয় ছিল বেশ আগে থেকে  বারবারা এবং রবিন এতদিনে এতটুকু বুঝেছিলেন যে রানীর একটি সমস্যা (যা আরও দত্তক ছেলেমেয়েদের হয়েছে) হলাে যে, সে তার উৎসের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না । তারা অনুভব করেছিলেন যে, হয়তাে বাংলাদেশে একবার গেলে, ঘুরে এলে রানী তার। জন্মদেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে  যদিও তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে অতীত না থাকায় রানীর কোনাে ভবিষ্যৎও নেই। এ বিশ্বাস মাথায় রেখে মরালরা রানীকে বাংলাদেশ ভ্রমণে যেতে বলেন।
বাংলাদেশে যাবার কথা শুনে রানী সােৎসাহে রাজি হলে তার মা-বাবাও সাময়িকভাবে খুশি হন । মরালরা ভেবেছিলেন যে, এ ভ্রমণে রানী তার জন্মদেশ দেখা ছাড়াও তার মনে যে অশান্তি বাসা বেঁধে আছে সেটাও দূরীভূত হতে পারে। তারা লক্ষ্য করেন রানী কীভাবে বাংলাদেশে যাবার প্রস্তাবে পরমানন্দে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। সে আবার আগের মতাে বাকপটু হয়ে ওঠে প্রায় এক বছরকাল অস্বাভাবিক আচরণের পর । ঐ একই সময়ে। কাকতলীয়ভাবে, যুদ্ধশিশু আমিনার মা ডনা উলসি বাংলাদেশে যাবার জন্য একটা পূর্ণাঙ্গ ট্রিপের ব্যবস্থা করছিলেন। তিনি ওটা করছিলেন বাংলাদেশ থেকে আসা কিছু যুদ্ধশিশু ও অনাথ ছেলেমেয়েদের জন্য। মরালরা উলসিদের ১৯৮৯ ট্রিপে যােগ দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন, সে সফরের বিশদ বর্ণনা সপ্তম অধ্যায়ে রয়েছে।
কয়েক সপ্তাহব্যাপী প্রস্তুতির পর গ্রুপটি যখন ঢাকা, বাংলাদেশে পৌছল, মরালরা প্রথমেই লক্ষ্য করেছিলেন রানীর মানসিক অবস্থা  সে উৎসাহ উত্তেজনায় থৈ থৈ করছিল। সেটা দেখে তারা নিজেরাও অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। প্রত্যেক দিন ঢাকা এবং আশেপাশে তিনটি অনাথ আশ্রমে তাদের আউটিং, কর্মসূচি এবং অনাথদের সঙ্গে তারা সময় কাটিয়েছিলেন । ষােলাে বছর পর আদি স্টাফ সদস্য ও শিশু ভবনের পুরনাে কর্মীরা রানীকে। দেখে আনন্দে আত্মহারা । মা-বাবা মনে করেন বাংলাদেশ ভ্রমণটি রানীর জীবনে বােধহয় সবচেয়ে সুখকর ব্যাপার ছিল।
মরাল দম্পতির মতে, সুনির্দিষ্টভাবে বললে অনাথ আশ্রম প্রাঙ্গনে পা দেবার পরই রানী যেন তার জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। অন্য অনেক দত্তকায়িত ছেলেমেয়েরা যদিও অনেক সময় বিশ্বাস করে যে তাদের দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েরা তাদেরকে তাদের জন্মদাত্রী মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন, রানী সেটা বিশ্বাস করেনি । সে ছােটবেলা থেকেই জানত যে তার জন্মদাত্রী মা তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন জন্মের পরপরই । এটা জানার ফলে রানীর মনে তার দত্তকগ্রাহী মা-বাবার বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ ছিল না; বরং তাদের নিঃশর্ত ভালােবাসা তাকে সর্বদাই তাদের একমাত্র মা-বাবারূপে সহজাতভাবে দেখে আসছে। কিন্তু বয়স ১৭ হতে না হতেই নিজের সম্পর্কে নতুন জ্ঞান লাভের পর রানীকে দেখে মনে হতাে যেন নতুন অভিজ্ঞতার আলােকে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং চেতনাও বদলাতে শুরু করেছে। সে যেন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তার জন্মস্থানটি দেখার পর। শৈশবে দত্তকায়নের মাধ্যমে কানাডা এসে বড় হয়ে ওঠা; আবার জন্মের পরপরই জন্মদাত্রী। মায়ের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়া; তখন সে যেন দুটি বিষয়েই আলাপে প্রস্তুত। মরালরা আরও দেখতে পাচ্ছিলেন, রানী কীভাবে দেখেছে তার দত্তকগ্রাহী পিতামাতার সাথে কোনাে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তারা এভাবে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে, ভালােবাসা ও আদর দিয়ে, সবসময় সত্য বােঝাবার জন্য তৈরি ছিলেন। রানীর অবস্থানের বাস্তবতা তারা সর্বদা বুঝতেন। তারা বিশ্বাস করতেন তার মা-বাবার সঙ্গে নিরাপদ সন্তান বাবা-মা সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু বিধিবাম! এ সুখ বেশিদিন সইলাে না। বাংলাদেশ থেকে ফেরার কিছুকাল পর আবার বিষন্নতা বাসা বাঁধে। রানী যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলাে, মরালরা দেখলেন, রানী ধীরে ধীরে মানসিকভাবে যেন ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়। যথেষ্ট স্থিতিস্থাপকতা এবং শাস্তভাব বজায় রেখে রবিন ও বারবারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেন রাণীক সাহায্য করতে যাতে সে নিজেকে ফিরে পায়। কিন্তু অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতা যেন তাকে ডুবে যেতে দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেল।
একজন মানুষের মানসিক উন্নয়নে এবং আত্মকৃতির দানা বাঁধতে অনেক শক্তি কাজ করে, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির জটিল সময়টিতে । মরালরা রানীর কুলে ভেড়বার তাগিদ বুঝেছিলেন এবং সেজন্য হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল বিপরীত শক্তিগুলি ওকে পরিবারের নিরাপত্তা রেখে বাইরে টেনে নিয়ে যায় অন্য জগতে। সে তার অচেনা জন্মদাত্রী মাকে চেনার জন্য উদগ্রিব হয়ে পড়ে। রানীর এ ধরনের আচরণ দেখে মাল দম্পতি নিজেরা দত্তক বিষয়ে আরও পড়াশােনা শুরু করেন শুধু উপলব্ধি করার জন্য যে রানীর মনের মধ্যে কী ধরনের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল সেটা জানার এবং তার প্রতিকারের জন্য। রবিন বলেন, সাধারণত দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েরা সারা জীবন যুদ্ধ করে, যাতে তাকে অবাঞ্ছিত আখ্যা না দেওয়া হয় । কিন্তু অনেকেই এত দুর্ভাগা যে তারা কেউই “অপ্রার্থিত” নামের ছাপ মুছে ফেলতে পারেন না। রানী তার চরমাবস্থা থেকে মুক্তি পাক সেটা বাবা-মা কায়মনােবাক্যে চেয়েছিলেন। তারা সব ধরনের পেশাজীবীর সহায়তা নিয়েও ওকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। বােঝা গেল, সব যুদ্ধশিশুর মধ্যে রানীর ছিল সবচেয়ে বিপর্যস্ত মন। সে দুই মায়ের সঙ্গে লড়াই করেছে – যে মাকে সে কোনােদিন দেখেনি এবং যে মা তাকে লালন পালন করেছেন। আমরা জানি না রানী তার আসল জন্মদাত্রী মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল কিনা ।
আমরা রানীর থেকে এতটুকু জানি যে, সে তার কানাডীয় মাকে ভীষণ ভালােবাসত । কিন্তু হঠাৎ করে রানী উপলব্ধি করা শুরু করে যে তার জন্মদাত্রী মাও যেন তার চারপাশে ঘুরছেন। এমতাবস্থায় রানী চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হয়েছিল, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে ফিরার পর  বাবা-মায়ের নিঃশর্ত ভালােবাসার পরও রানী তার বাবা-মাকে (যাদের সে একমাত্র বাবা-মা হিসাবে দেখে বড় হয়েছে)। বলতে পারেনি তার কী হচ্ছিল । রানী মনে করে তার চতুস্পর্শে তার কখনাে-না-দেখা” অদৃশ্য জন্মদাত্রী মা ঘােরাফেরা করছেন। রানী তখন এ দুজনকে ঘিরে এক সাংঘর্ষিক অবস্থার সম্মুখীন হয়।
মরালরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, রানী আত্মমর্যাদা এবং পরিচিতি চরিতার্থতার বিষয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। কোলে পিঠে মানুষ করার পরও বাবা-মায়েরা বুঝতে পারেননি রানীর মর্মপীড়া ও অন্তর্দাহ । তারা বিস্মিত হয়ে দেখেন যে বড় হয়ে উঠে রানী নিজের সঙ্গেই নিজের বােঝাপড়া হবার দরকার মনে করে। হাজার চেষ্টার পরও মরালরা কখনাে জানতে পারেননি। রানীর উল্কণ্ঠার প্রধান উৎস কী ছিল।
১৯৯০ সালে কিংস্টন, অন্টেরিও-এর কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে নাসিং প্রােগাম-এ ভর্তি হয় । দ্বিতীয় বছর অত নির্বিঘ্নে যায়নি। ১৯৯২-এর জুন নাগাদ বিষন্নতার কারণে রানীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলাে। বারবারা উড়ে এলেন কিংসটনে এবং তাকে সাসক্যটুনে মনস্তাত্ত্বিক ওয়ার্ডে বদলি করেনিয়ে গেলেন। ১৯৯২-কে মরালরা এক ভয়ঙ্কর বছর হিসাবে। দেখেন। রানীকে চিরদিনের জন্য লেখাপড়া পেছনে রেখে সাসকাটুনে ফিরে যেতে হয় ।
এতদসত্ত্বেও একসময় তারা আশা করছিলেন যে রানী সুস্থ হয়ে উঠবে এবং নার্সিং-এ তার পড়া শেষ করবে। কিন্তু রানীর বিশাদগ্রস্ততা আরও গাঢ় হলাে। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস! রানী এবং তার মানসিক চিকিৎসার রােলার কোস্টার থেকে আর নামতে পারেনি পরের সাত বছরে । তখন রানী নতুন নতুন প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল। রবিন বলেন, তখন যেসব চিকিৎসা হয়েছিল (যেমন, মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা এবং রাতের ঘুমানাের বন্দোবস্ত ইত্যাদি) দেখে প্রথমে তাদের কাছে মনে হয়েছিল হয়তােবা চিকিৎসা ফলপ্রসূ হচ্ছিল। কিন্তু দেখা গেল প্রায় সাথে সাথেই সে পুনর্বার মারাত্মক বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। কেমন যেন বিষাদী মন নিয়ে একা বসে থাকতে পছন্দ করত  আবার অনেক সময় বেশি কথা বলত এবং অহেতুক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করত যার জন্য তাকে কড়া নজরে রাখতে হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, কিছুদিন অতি উহ্ল সময়টার পরই আসত একটি বিষন্ন সময়কাল । এরকম বারবার হওয়ায় মনস্তাত্ত্বিকরা কেউ কেউ ভাবতেন সে bi-polar disorder (এক ধরনের বিশেষ বিষাদগ্রস্ততা)-এ ভুগছে। এটা হলে রােগী কিছুদিন ক্ষিপ্ততা প্রদর্শন করে। আবার কিছুদিন পরে স্বাভাবিক মনমর্জি প্রদর্শন করে। সে সময় কোনাে অস্থিরতা বিরাজ করে না। আবার কিছুদিন অবকাশের পর শুরু হয় প্রচন্ড ক্ষিপ্ততা। রানীকে বহুবার মানসিক চিকিৎসা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। সে সময়ে মাঝে মাঝে সে আত্মহত্যার ঝোক প্রকাশ করেছে। তখন মা-বাবার সঙ্গে রাখা অথবা ব্যক্তিগত যত্নে কোনাে আশ্রয়ে রাখা তারা নিরাপদবােধ করেননি। মরালরা তখন অবাক হয়ে দেখেন যে, সৃষ্টিশীল রানীর জীবনে যেন তার অভ্যন্তরীণ অনুভূতির বিষয়ে প্রকাশ করার উপায় হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কি দেখা গেল তাতেও তার মানসিক স্বাস্থ্য ভালাে থাকেনি। সময়ের সাথে সাথে দেখা গেল শেষের দিকে রানীকে কোনােভাবেই তার মানসিক ব্যাধির প্রকোপ থেকে বাইরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না।
রাণী যখন কেবল প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠছে, মরালরা লক্ষ্য করেন রানী তার উৎস সন্ধান করতে এবং তার জন্মলগ্নের কিছু ঘটনাবলি তাকে আরও বিষন্ন করে তুলেছিল। মরাল। অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখেন কীভাবে সে ক্রোধ এবং অবুঝপনার এক দুর্মদ ক্ষতিকর চ• আটকে যাচ্ছে, সেখান থেকে বেরিয়ে স্বস্তিতে আসতে পারছিল না। একদিকে বাংলাদেশ। ভ্রমণ তথ্যের চাহিদা যা ছিল তার সেটা পূরণ করেছিল, যার ফলশ্রুতিতে তার মন ও প্রাণের গভীরতম স্তরে ছুঁয়েও ছিল। অন্যদিকে এটা তার অভ্যন্তরের অস্থিরতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক গুণে এবং শেষ পর্যন্ত যখন যে প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন গভীর বিষন্নতা, নিরাশা ও অসহায়তায় নিমজ্জিত হয়, তার জন্মদাত্রী মায়ের হয়তাে যেমন হয়েছিল ।
রাণীর এ আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়া দেখে হৃদয়ে ব্যথা পেলেও মরালরা তার মা-বাবা হিসাবে তাদের দয়িত্ব পালনে কোনাে ত্রুটি দেখতে পাননি। তারা জানতেন যে প্রত্যাখ্যান এবং পরিচিতি বিষয়ক তালগােল পাকানাে সকল পােষ্য ছেলেমেয়েদের বেলাতেই কম বেশি ঘটে। তারা শেষ পর্যন্ত এটুকু বুঝতে পারেন যে, বিষয়টি এতই জটিল যে, রানীর সমস্যাটি বুঝতে পারলে সে বেঁচে যাবে, ব্যাপারটা অত সােজা নয়। কারণ বিষয়টি অত্যন্ত দুর্বোধ্য। তারা। যতদূর বিষয়টি বুঝতে পারেন সেটা অনেকটা এরকমঃ যে রানীর সমস্যাগুলাে বুঝলেই বিষয়টি সমাধান হবে না; বরং অনেক আবেগ-অনুভূতি প্রদর্শন করে তাকে প্রত্যক্ষভাবে দেখাতে হবে যে, তারা তাকে ভালােবাসেন এবং তারা তার বিশেষ খেয়াল নিতে প্রস্তুত। সেজন্য বারবারা রানীর এ দুঃসময়ে তার সর্বক্ষণের সাথী হয়ে দিন অতিবাহিত করেন। রানীর যে জীবন বিষন্নতা, প্রত্যাখ্যান, নৈরাশ্য এবং নিয়ন্ত্রণহীনতায় টলমল, তারা রানীর সে পশ্চাদপটকে উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না; বরং যতটুকু সম্ভব তারা চেষ্টা করেছেন রানীর সঙ্গে খােলাখুলিভাবে কথা বলে তাদের ভালােবাসার সম্পর্ক অটুট রেখে আরও গভীর করতে।
যদিও রানী সারা জীবনই কাটিয়েছে তাদের সাথে তবুও তারা ভেবেছিলেন রানীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে হবে। সেটা হয়তাে তাকে অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। মরালরা সবসময় নিশ্চিত ছিলেন যে, তাদের প্রতি রানী কোনাে ধরনের উভয়বলতা ছিল না। যদিও তারা দেখেছেন মাঝে মাঝে রানী তার জন্মদাত্রী (অপরিচিত) মায়ের বিষয়ে বিভাের থাকত। কিন্তু তারা দেখেছেন রানী বারবারাকে আগাগােড়া তার একমাত্র মা মনে করেছে যার কাছ থেকে সে নিঃশর্ত ভালােবাসা পেয়েছে। এ বিষয়ে তাদের কোনাে সন্দেহ ছিল না যে, রানী বারবারাকে তার একমাত্র মা মনে করে বড় হয়েছে, তার কোলে পিঠে থেকে। এমতাবস্থায় রানী অন্য কাউকে মা বলে ঘূণাক্ষরেও ভাবেনি। কিন্তু মরালরা তখন লক্ষ্য করলেন রানী যেন ভাবতে শুরু করে তার অতীত, যে সময়টুকুতে তাকে।
তার জন্মদাত্রী মা বাধ্য হয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, ভবিষ্যতেও সে আবার হয়তাে প্রত্যাখিত হবে। এ ধরনের সংশয় রানীকে আরও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয় । অবশেষে রানীর একটানা অসুস্থতা ও তার দ্রুত অবনতি দেখে মরালরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, রানীর অসুখের চিকিৎসা তাদের কারাের জানা নেই। অসুখ যেদিকে মােড় নিয়েছিল। তাতে তারা খুব সংশয়ে ছিলেন সে নিশ্চিতভাবে নিজের ক্ষতি করতে বা আত্মহত্যা করতেও কোনাে দ্বিধাবােধ করবে না। যে শক্তি ও প্রাকৃতিক স্থিতিস্থাপকতা থাকলে মানুষ কোনাে ধরনের আত্মঘাতী বা ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে দূরে থাকে, সেগুলাের অনুপস্থিতিতে রানী কখন যে কী করে বসবে সে বিষয়ে তারা অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন। তারা তখন অন্ধকারে আলাে খুঁজতে থাকেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মরালরা জানলেন যে, তাদের অতি আদরের মেয়ে রানী আর কুলে ফিরতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পৃথিবী ছেড়ে গেল যেখানে সে বাঁচতে পারেনি। রানী কখনাে এ ব্ৰহ্মান্ড ছেড়ে যেতে চায়নি।
রাণীর শেষকৃত্যে এসেছিলেন তার আত্মীয়, রানীর বন্ধু, বারবারা ও রবিনের বন্ধু ও বেশ সংখ্যক সহকর্মী । অনেক বছর আগে থেকে যারা রানীর টাইকোন ডু ক্লাবের সদস্য তারাও এসেছিলেন। অন্তেষ্টিক্রিয়া পরিচালনা করেন শ্রদ্ধান্বিত রন ম্যাককনেল, কেন মােন এবং বিল শ্যাঙ্ক । রানীর সংক্ষিপ্ত জীবনের স্মৃতিচারণ করেন রবিন, বারবারা, জন এবং কিম মরাল (ছেলের বউ)। সংগীতের মধ্যে রানীর পছন্দের গান ছিল: “Here I’m Lord,” “In the Bulb there is a Flower,” “Precious Lord, Take My Hand” be eff যেগুলাে রানীকে মৃত্যুর আগে সাত বছর অনেক শান্তি ও স্বস্তি দিয়েছিল। শােকাহত রবিন রানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী (১৯৭২-১৯৯৯) পড়ে শােনান: “রাণীর বিয়ােগান্তক ও অসময়ের মৃত্যু এমন এক দুর্ঘটনা যা আমরা আগেই অনেক বার টের পেয়েছি। আমরা সবাই যেন যতদিন পারি রানীকে মনে রাখি, রানী আমাদের স্মৃতিতে থাকবে।” রবিন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এমন সব স্মৃতির কথা বললেন, তাদের মনে আছে যখন রানী বিপদজ্জনকভাবে। উদাসীনতায় আক্রান্ত, তা সত্ত্বেও তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন এটুকু ভেবে যে রানী নতুন কোনাে চিকিৎসায় সাড়া দেবে। পরবর্তীকালে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে সেদিন অনেকে রানী। সম্পর্কে অনেক সুখস্মৃতিচারণা করেন।
রাণীর অসুস্থতার সময় যারা তার পাশে ছিলেন তাদের সবার কাছে মরাল পরিবার আজও কৃতজ্ঞ। তারা রানীর পরিবারের সবাইকে আত্মিক শক্তি ও সমর্থন যুগিয়েছিলেন। এতে পরিবারের সবাই অবাক হয়েছিলেন, তাদের মনে ছোঁয়া লেগেছিল, রানীর শেষ কাজে এত মানুষ এসেছিলেন দেখে । সহানুভূতির এত বাণী তারা পেয়েছিলেন, শােকাভিভূত অত মানুষ তাদের বাড়িতে এসেছিলেন যে, রানী প্রায় ১৫ বছর আগে তাদেরকে ছেড়ে গেলেও রানীকে মনে রেখেছেন ১৯৭২ সালে যেভাবে তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। পেছনের দিকে। তাকিয়ে মরাল দম্পতি বলেন, সে সংকটময় ও অসহায় সময়ে সবার উপস্থিতি তাদের অনেক শান্তি ও স্বস্তি যুগিয়েছিল। গােটা পরিবার এখনও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে সচেতন। পরিবারের বড় ইচ্ছা ছিল, রানীর ভস্ম নিয়ে বাংলাদেশে যাবেন । দুঃখের বিষয়, সেটা হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি তারা আলােচনা করছিলেন, ছাই সাসকার্টনে নদীর ধারে বিশেষ বিমানে করে ছড়িয়ে
দেবেন।
মরালদের জন্য রাণীবিহীন জীবন কখনওই এরকম হয়নি। বারবারা সাধারণ শােক পালন। করেন বেশ দীর্ঘকাল; কিন্তু তার সৌভাগ্য যে তার একটি সমর্থন যােগানাের মতাে মামা আছেন, ঘনিষ্ঠ অনেক বন্ধু রয়েছেন যারা তাদের দুঃখের সহায়ক হয়েছিলেন। রানীর মৃত্যুজনিত যে আঘাত, সেটা সত্ত্বেও রবিন ও বারবারার জীবন চলে যাচ্ছে। তাদের অন্য সন্ত নি জন এবং তার স্ত্রী কিম প্রিন্স অ্যালবার্ট-এ বাস করেন, তারা অত্যন্ত সক্রিয় জীবনযাপ। করেন। তাদের চার ছেলে মেয়ে, বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছরর মধ্যে। চোখের সামনে তাদের নাতি-নাতনিদের বড় হতে দেখে এবং তাদের সাথে সময় কাটিয়ে দম্পতি বেশ আনন্দ পান। তবে রানীর কথা তারা কখনাে ভুলতে পারেননি। এখনও তার স্মৃতি তাদের মনে ভেসে উঠে।
রাণী
রাণী তার মায়ের গর্ভে মেয়াদের পুরাে মাস ছিল না । গর্ভের মেয়াদ পূর্ণ হবার আগেই রানীর জন্ম হয় ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ মাদার তেরেসার শিশু ভবনে। তার জন্মের সময় ওজন ছিল মত্র ১ কেজি । তার নাম রানী হিসেবেই শিশু ভবনের রেজিস্টার বই-তে তালিকাভুক্ত করা হয়। তার জন্মদাত্রী মা তার জন্মের পর তাকে অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষের হাতে সঁপে দিয়ে অন্তর্হিত হন। রানী ২০ জুলাই ১৯৭২ তারিখে কানাডা এসেছিল মরাল পরিবারে যােগ দিতে । রানীর দত্তকগ্রাহী মা-বাবা মেয়ের নাম বদলে রাখেন রানী জয় মরাল । পরিবারের ভাষ্য অনুসারে, রানীর মধ্য নাম জয়, দ্বৈত অর্থ বহন করে । ইংরেজিতে জয় অর্থ আনন্দ । আবার তাদেরকে বলা হয়েছিল বাংলা অর্থ বিজয় । মরালরা বলেন, তাদের কাছে রানীর সুদূর কানাডাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে আসাটা এক রকমের বিজয় ছিল বটে। প্রকৃতপক্ষে তাদের পরিবারে তাদের মেয়ে হিসাবে রানীর আগমন ছিল তাদের জন্য বিশ্বের তাবৎ আনন্দ নিয়ে আসা একটি ঘটনা। মরালদের নিকট রানীর মধ্য নাম প্রতীকি ও সত্যিকার অর্থে জয়ই ছিল, যদিও সে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি।
রাণী সাসকাচিওয়ান প্রদেশের সাসকাটুন শহরে বড় হয়েছে । সাসকাচিওয়ান শহরের লােক সংখ্যা ১৯৭০-এর প্রথম দিকে ছিল প্রায় আনুমানিক ১,২০,০০০। আবার ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫-এ যখন রানীর বয়স প্রায় দুবছর তার বাবা তখন ইউনিভাসিটি অব সাসকাচিওয়ান-এ অধ্যাপক ছিলেন। তিনি পঠন পাঠনের উদ্দেশ্যে (যাকে ইংরেজিতে বলে sabbatical) ফ্রান্সের ডিজন শহরে তার পরিবারসহ যান। সাব্যাটিক্যাল থেকে ফিরে পরিবার সাসকাটুনে আবার বসবাস করছেন একই বাড়িতে । রানীর ছােটবেলার কথা বলতে গিয়ে মরালরা জানান। যে, রানী প্রথম থেকেই সঙ্গীতে বেশি আগ্রহী ছিল । সে তিন বছর বয়সে সুজুকি বেহালার ক্লাসে যেতে আরম্ভ করে  ১৯৭৬ সালে, রানী সাসকাটুন ফরাসি মাধ্যমের স্কুলে যাওয়া শুরু করে। সেখানে সে মিশ্র সংস্কৃতি ও মিশ্র বর্ণের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেশে যা তাকে কানাডীয় বহু সংস্কৃতিবাদের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় অল্প বয়সেই। বারবারার মনে পড়ে রানী খুব উজ্জ্বল মেয়ে ছিল, যেমন- জীবন্ত ও তেজিয়ান । রানীর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার বড় ভাই জনের সঙ্গে। ওরা দুজনেই খেলত আবার ঝগড়া করত, ওই বয়সের ছেলেমেয়েরা যা করে আর কি! ১৯৮১ সালে মরালরা আবার পঠন পাঠনের উদ্দেশ্যে ফ্রান্সে যান। এবার সেখানে তারা আরেক বছর কাটান। কানাডীয় অনেক ছেলেমেয়ের মতাে রানী আবার ভালােভাবে ফরাসিতে কথা বলতে ও বানান করতে শিখে ।
রাণী ১৯৮৬ সালে বিশপ জেমস ম্যাহােনি হাই স্কুলে ভর্তি হয় । ওর বয়স তখন ১৪ বছর । সে তখন সৃজনশীল চারুকলা ও নানা বিষয়ে অধ্যয়ন করে। হাই স্কুলের বছরগুলিতে রানী সাসকাটুন ইয়ুথ অর্কেস্ট্রায় বেহালা বাজাত । সে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাঁশি বাজাতে শিখে । পরবর্তীতে সে অত্যন্ত চমৎকার বাঁশি বাজাত । রানী খুব কম বয়স থেকে গান লিখত এবং হাই স্কুলের ছন্দের মাস্টার হিসাবে আখ্যা পেয়েছিল। বারবারা বলেন, যারা রানীর লেখা পড়েছেন, তাদের মতে অল্প বয়সে লেখা এবং গানে রানীর অন্তরতম চিন্তাভাবনার ইঙ্গিত রাণীর বন্ধুরা ছিল বিচিত্র পটভূমির – ইউরােপীয়, আফ্রিকান, চৈনিক, ভারতীয় এবং আরও অন্যান্য দেশিয় । ১৯৮০-এর দশকে এমন একটা সময় ছিল যখন কানাডীয় বহুসাংস্কৃতিক আন্দোলন এক চুড়ান্ত পর্যায়ে। স্বভাবতই রানীর চারপাশে নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের নানা সব গ্রুপের অস্তিত্ব ও কর্মকান্ড রানীকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে যার ফলশ্রুতিতে রানীর বিশ্বজ্ঞানের প্রসার ঘটতে থাকে। বস্তুতপক্ষে রানীর হাই স্কুলে কয়েকটি বছর যেমন তার পক্ষে ক্রিয়াশীলতার মানদন্ডে উচু ছিল, তেমনি তার মানসিক উল্কর্ষেও অর্জন ছিল। কিন্তু রানীর বাবা-মায়েরা লক্ষ্য করেন সে যখন ১৫ বছর বয়সে পা দেয় তখন সে একটি বড় চ্যালেঞ্জ মােকাবিলা করে। সে খােলাখুলি একজন দত্তকায়িত্ব সন্তানের পরিচিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা ইতােমধ্যে পড়েছি রানী কেমন করে ১৬ বছর বয়সে রানী অল্প সময়ের জন্য উদাসীন হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, রানী প্রচন্ডভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তার চারদিকের লােকজনের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। বারবারার ভাষ্যমতে, যদিও তারা রানীর সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তারা পুরােপুরি বুঝতে পারেননি রানী তখন কী অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল – ভয়, ভীতি, নীরবতা এবং দুঃশ্চিন্তা তাকে এত দমিত করে রাখে যে, সে সম্পূর্ণরূপে নিরুত্সাহিত হয়ে পড়ে। রানী চেয়েছিল জন্মভূমিতে পৌছেই তার জন্মদাত্রী মার সম্পর্কে জানতে পাবে (হয়তােবা দেখতে পাবে, তা যত অসম্ভবই হােক না কেন)। মরালরা রানীর উচ্ছাস লক্ষ্য করেছিলেন যখন রানী তার বাড়িতে, অর্থাৎ শিশু ভবনে একসাথে গিয়েছিলেন।
যে মুহূর্তে রানী নিজের নামটি রেজিস্টার বই-তে দেখে, তখনই তার ভাবাবেগ যেন এক নতুন উচ্চতায় উঠে । নিজের নাম, জন্মের তারিখ এবং জন্ম স্থানের নাম নিজের চোখে দেখা এ অভিজ্ঞতা রানীর মনের ভেতরে একধরনের সচেতনতা সৃষ্টি করে। সে অনুভূতির ফলে যেন মুহুর্তের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে এক যােগাযােগ স্থাপন করে নেয়। রানী যেন সম্পূর্ণরূপে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করে যা এ যাবত পর্যন্ত কখনাে ঘটেনি তার জীবনে। এটা এমন এক অভিজ্ঞতা যা বৌদ্ধ ঐতিহ্যে satori (সাতােরি) বলা হয়। ‘সাতােরি’ শব্দের অর্থ হঠাৎ আলােকপ্রাপ্ত হওয়া বা হঠাৎ জেগে ওঠা । রানী শিশু ভবনে কর্মকর্তাদের থেকে জানতে পারে কোনাে পরিস্থিতিতে তার জন্ম হয়েছিল, তাকে কখন তার মা পরিত্যাগ করেছিলেন, তাদেরকে কীভাবে কানাডা পাঠানাে হয়েছিল যেখানে তার কানাডীয় মা-বাবা দত্তক নিয়েছিলেন। কিছুক্ষণের জন্য রানী যেন একদম শিলীভুত। কয়েক মিনিট পরে সে যখন তার সহজাত চেতনায় ফিরে এলাে, সে সময়ে সে যেন প্রথমবারের মতাে জন্মবৃত্তান্তের কাহিনীর সপ্রমাণতা খুঁজে পায় । ঠিক যেমন তার দত্তকগ্রাহী মা-বাবা তার কাছে বর্ণনা করেছিলেন ছােটবেলায়, এখন যেন সে অনুভব করছে এবং দেখেছে তার জন্মদাত্রী মায়ের উপস্থিতি। যেন সে তার সাথে তাৎক্ষণিকভাবে যােগাযােগ স্থাপন করেনিয়েছে।
বাংলাদেশ সফরের পর রানী যখন কানাডা ফিরে আসে রানীর তখন বােধ হলাে তার সত্ত্বার নবায়ন ঘটেছে, তার নিজের সঙ্গে নিজের বােঝাপড়া হয়েছে এখন থেকে সে প্রাপ্ত বয়স্ক হবার দায় ধীরে ধীরে সামলাতে পারবে। বাবা-মায়েদের কাছে তখন মনে হয়েছিল রানী তার বাকি বাংলাদেশি ও কানাডীয় পরিচিতিগুলির সঙ্গে একে একে একধরনের শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করত সক্ষম হবে। রানী দু’বিশ্বের সেরা অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে পুরে নিতে ব্যস্ত ছিল – কানাডার বিশ্ব যেখানে সে বাস করে, যেখানে তার বিদ্যার্জন, রুটি-রুজি; এবং বাংলাদেশের বিশ্ব যেখান থেকে সে জন্মের পর পরিত্যক্ত । সে তার পােষ্যক মা-বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কের মূল্যায়ন করে। তার বিশ্বাস ছিল সে তখন এমন একটি শিশু ছিল যাকে তারা। “চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সে জানে তার কানাডীয় মা-বাবা তাকে নিরন্তর স্নেহ ভালােবাসা দিয়ে মানুষ করেছেন।
মরালরা মনে করেন যে রানী তার উত্স খুঁজতে গিয়ে যে তথ্য স্বচক্ষে দেখেছিল সেটা তাকে তার পরিচিতি সম্পর্কে এক ধরনের নতুন অনুভূতি যােগায়। সেটা হয়তাে ক্ষণিকের জন্য লালনকারী মায়ের শূন্যস্থান পূরণ করতে সহায়ক হয়েছিল। সে মুহূর্তে সে যেন তার জন্ম। মায়ের সম্পর্কে জানার পর যে শূন্যতার বেদনায় ভুগছিল তা যেন কিছুক্ষণের জন্য দূরীভূত হয়েছিল। সাধারণত জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি ক্রোধ ও অসন্তোষ পােষ্য সন্তানদের, অনেক সময় থাকে কিন্তু রানীর বেলায় ছিল তার ব্যতিক্রম। সে তার জন্মদাত্রী মাকে কাছে থেকে। “দেখতে পেয়েছে মনে করে তাকে আলিঙ্গন করেছে ভালােবাসা, সহানুভূতি ও ক্ষমাশীলতা দিয়ে। সাধারণত দেখা যায় দত্তকায়িত ছেলেমেয়েরা লজ্জিত বােধ করে এটা ভেবে যে তাদের জীবনের কিছু বিষয়ের গােপনীয়তা তাদের জীবনবৃত্তান্তের নথিপত্রে লিখিত অবস্থায় রয়ে যায় আজীবন। অবশ্য যতদুর রানীর বাবা-মা দেখেছেন তারা কখনাে মনে করেননি যে, রানী তার অতীত নিয়ে বিব্রত । তার জন্মের যে কাহিনী সূতাে ছেড়া অবস্থায় মনের অজান্তে ভেসে বেড়াত সে সূতােকে রানী তার কানাডীয় মা-বাবার সাথে সংযুক্ত করেনিয়েছিল সহজেই । তার জন্য তার বাংলাদেশি ও কানাডীয় জীবনে তার জন্মবৃত্তান্ত একীভূত করতে পেরেছিল।
কিন্তু তবুও দেখা গেল এক সময়ে রানী নিজেকে তার কানাডা ও বাংলাদেশের পশ্চাদপটের উপাদান নিয়ে এক টানাপােড়েনের মধ্যে পড়ে যায় । রানীর মা-বাবা রানীকে এ অস্তদ্বন্দ্ব পেরিয়ে আসতে যথাসাধ্য সহায়তা প্রদান করেন। তার ক্রোধ ও হতাশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে রানী কখনাে বা রাগে ফেটে পড়ত; আবার কখনাে সে আত্মধ্বংসী আচরণ প্রদর্শন করত। আবেগী রানী মানসিক অবস্থাকে আরও শিল্পসম্মত উপায়ে প্রকাশ করতে চাইত বৈকি! যখন তার মা-বাবা তাকে প্রয়ােজনীয় আবেগী সমর্থন যােগাতেন তখন সে গান ও কবিতা লিখত। রানীর অগণিত কবিতার মধ্যে একটি ছিল অত্যন্ত হৃদয়াবেগপূর্ণ যেটাতে রানীর মনের অসহনীয় অবস্থার প্রতিফলত হয়েছে। নদীর সনত্মান নামের কবিতাটিতে রানী দুদেশের (অর্থাৎ তার জন্মদেশ ও বড় হয়ে ওঠা দেশ) প্রতি তার সে সময়ের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছে।
মর্মস্পর্শী এ কবিতাটিতে রানী তার জীবনের বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তুলে ধরেছে তার দত্তকায়িত জীবনে গােলকধাঁধা অভিজ্ঞতা, তার শিকড়ের অনুসন্ধান। সংক্ষেপে বলা যায়, কবিতাটিতে রানী তার জন্মদাত্রী মায়ের সম্পর্কে তার যে ভাবনা সেটা বর্ণনা করে সে বলে, সে কোথা থেকে এসেছে । রানী মায়ের জন্য যে অপরিসীম ভালােবাসা প্রকাশ করেছে, সেটা অপরিমেয় । তার জন্মকে ঘিরে তার অন্তরের সংঘাত, নিজেকে পুনআবিষ্কারের জন্য তার বাংলাদেশে যাওয়া। ফলে বাংলাদেশে সে যে শান্তি লাভ করেছিল যখন সে তার ব্যক্তিগত ইতিহাসের সঙ্গে ঐকমত্যে পেীছননার প্রক্রিয়ায়। এখানে সে অনাথ আশ্রমে যাওয়াকে বিশেষভাবে স্মরণ করেছে; সে অনাথদের সঙ্গে দেখা করেছে, যাদের সঙ্গে সে সহজেই নিজেকে চিনেছে; সে সময়ে অনাথ আশ্রমের রেজিস্টার বই-তে তার নাম থাকার অন্তর্নহিত। অর্থ তার নিকট প্রতিপন্ন হয়েছে।
সে সময়ে রানী তার জন্মদাত্রী মায়ের অনুপস্থিতিতে তার যে ক্ষতির অনুভূতি সে ব্যাপারটাকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলেছে। অনাথ আশ্রমের যারা তার যত্ন নিয়েছিলেন তাদের সে তার প্রথম মা” বলে সম্বােধনে করে। তার একাধিক মা থাকাতেও সে অখুশি ছিল না। রানীর সবচেয়ে বিজয় হয়েছে তার অনাথ আশ্রমে বেড়াতে যাওয়ায় তার বর্তমান কানাডীয় মার মাধ্যমে অতীতের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিল। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, বাংলাদেশে তার বেড়াতে যাওয়া তাকে আশা দিয়েছিল – নিজের দেশের সৌন্দর্যের প্রশংসা করার মাধ্যমে। সবচেয়ে।
সুন্দর যে দেশ সবুজে আর শ্যামলে, চারদিকে যার জলরাশি, আর প্রশংসার মাঝে সে কানাডাতে তার বর্তমান আবাস খুঁজে পায় । কৃতজ্ঞার সাথে রানী জানায় তার (কানাডীয়) মা-বাবা তাকে বুকে তুলে নিয়ে আশৈশব লালন করেছেন, তারা সেখানে তাকে নিরাপদ রেখেছেন। রানী কখনাে অন্যান্য পােষ্যদের মতাে। তার জন্মদাত্রী মা এবং জন্মদাতা বাবাকে ঘিরে অলীক গল্প তৈরি করেনি। প্রকৃতপক্ষে, রানীর ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো ব্যাপারটি ঘটেছে বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার পর থেকে। রানী তার। কানাডীয় বাস্তব জীবনকে ঘিরে কল্পনার শৈশবে তার মাথা গুঁজে। ফলে, তার সুন্দর বর্তমানকে ছেড়ে রানী কাল্পনিক শৈশবে আশ্রয় নিতে গিয়ে এক সাংঘর্ষিক অবস্থায় পড়ে। সে তার দত্তকগ্রাহী মা-বাবার সঙ্গে তার অতীতের কিছু তথ্যাদি স্বচক্ষে দেখার জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিল। সে অর্থে রানীর ক্ষেত্রে বংশবৃত্তান্ত বিষয়ে বিহ্বল হওয়ার কিছু ছিল না। কারণ রানী ছােট বেলাতে মা-বাবার কাছ থেকে শুনেছিল তার জন্মদাত্রী মা কীভাবে তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং দত্তকায়নের মাধ্যমে তাকে কীভাবে কানাডাতে নিয়ে আসা হয়েছিল ।
প্রকৃতপক্ষে এ কবিতাটিতে রানী আন্ত্রিকভাবে তার জন্মদাত্রী মাকে হারানাের শােকে মর্মপীড়িত, সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে। প্রথম বয়সে মনে হয়েছিল রানী তার জীবন কাহিনী বিষয়ে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল। বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিন্তু বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসার পর সে যেন অসহনীয় অবস্থার সম্মুখীন হয়। ভৌগােলিকভাবে, বাংলাদেশ ছােট্ট একটুখানি ভূখন্ড যেখানে রয়েছে নদীর অফুরন্ত পানি যা প্রবাহিত হচ্ছে। তীরবর্তী বেলাভূমিতে – দেশটি যেন নদীরই শিশু। এখানে রানী বাংলাদেশের মতােই নিজেকে নদীর জাতিকা হিসাবে সনাক্ত করেছে।
অন্যান্য যুদ্ধশিশু (যেমন, আমিনা, রায়ান, ল্যারা এবং রাজিব) যারা ঐ ট্রিপে গিয়েছিল এবং যাদের কম বেশি অতীতের স্মৃতিচারণের সুযােগ হয়েছিল, তাদের থেকে রানীর অভিজ্ঞাতা অনেক আলাদা। নিজ নিজ নাম শিশু ভবনের রেজিস্টারে দেখে অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের কেউ রানীর মতাে প্রতিক্রিয়া দেখায় নি, বিশেষ করে অনবরত, নিরস্তর অভিঘাত বিষয়ে। তারা let bygones be bygones’ (অতীত হতে দাও) বলে অতীতকে নিচের তাকে ফেলে রাখতে চায় । রানী তার আগে জন্মদাত্রী মাকে তার জীবনে যথাযােগ্য স্থানে সমারূঢ় দেখতে চেয়েছিল। যেহেতু বস্তুতপক্ষে মা ধারেকাছে কোথাও নেই, যদিও রানী দৃঢ়ভাবে মনে করেছিল তার মা চারপাশে রয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে সে জন্য স্বাভাবিকভাবে এক কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন হয়। এখানেই তার নতুন সংকটের শুরু। রানীর মা-বাবা অসহায়ভাবে শুধু দেখলেন রানী নতুন করে তার “কখনাে-না-দেখা” মাকে হারানাে আর বেদনায় কষ্ট পাচ্ছে, জন্মদাত্রী মায়ের কথা ভেবে তার চোখে অশ্রু বাবা-মায়েরা মনে করেছিলেন রানীর তখন দরকার ছিল অতীত পেরিয়ে যাওয়া, পরিচিতির যে শূন্যতা সেটা পূরণ করা। রেজিস্টার বইতে তার নাম দেখার পরপরই সে তার অলীক জন্মদাত্রী মাকেও জীবন ও স্মৃতির মধ্যে নিয়ে আসে। রানীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তার “কখনাে-না-দেখা” জন্মদাত্রী মাকে তার কানাডীয় বাস্তব জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা।
রাণীর জন্য এটা পরম পরিহাসের বিষয় যে কানাডাতে সে সব পেয়েছে কিন্তু সে জানে যে, সে তার জন্মদাত্রী মাকে সে সব দেখাতে পারেনি। অনেক দত্তকায়িত শিশুর এ রকম ধারণা হয় যে তাদের পােষ্যক মা-বাবা তাদের জন্মদাত্রী মা ও জন্মদাতা বাবার কাছ থেকে নানা কৌশলে শিশুদের সরিয়ে নিয়ে যান যেন এক ধরনের অপহরণের মতাে আমরা দেখেছি। তবে মরালরা জানতেন যে রানী কখনাে এ ধরনের কোনাে অমূলক চিন্তা করেনি। রানী। বুঝতে পেরেছিল কেন তার জন্মদাত্রী মা তাকে ছেড়ে গিয়েছিলেন জন্মের পরপরই । সে জন্য কানাডীয় মা-বাবার বিরূদ্ধে কোনাে অভিযােগ ছিল না কিংবা তাদের যে অপরিসীম। ভালােবাসা রানীর জন্য সেটা নিয়ে তার মনে কোনাে প্রশ্ন ছিল না। রবিন ও বারবারা যতই পেছনে তাকান ততই যেন দেখতে পান, রানীর বর্তমান সমস্যার শুরু হয় বাংলাদেশ সফরের পর থেকেই। এটা যেন এক পর্যায় থেকে প্রক্রিয়ায় আরেকটা সূত্রে লাফ দিয়ে যাওয়া। তার বর্তমান পরিচিতির মধ্যেই আরেকটি দিক খুঁজে পাবার বাসনা।
১৯৯০ সালে গ্রেইড ১২ বাইলিংগুয়াল ডিপ্লোমা নিয়ে রানী গ্রাজুয়েট হয়। তারপর আমরা দেখেছি সে অন্টেরিওর কিংস্টনস্থ কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্সিং পড়তে গেল। প্রথম বছরের পড়া সে সহজেই শেষ করে। তার মা-বাবার জীবনালেখ্যতে যেমন আমরা দেখেছি, ১৯৯২ সলে নার্সিং-এ দ্বিতীয় বছরের পড়াশােনার সময় রানীর স্নায়ুদৌর্বলতায় ভেঙে পড়ে। ঐ সময় তার বাবা-মা লক্ষ্য করেন রানী কিশাের অবস্থায় যেমন আচরণ করত, ২০ বছর বয়সেও তার আচরণে কোনাে পরিবর্তন আসেনি। রানী এত বিচলিত হয়ে পড়ে যে তার অনুভবের জগৎ আর দৈনন্দিন কাজের মধ্যে যেন কোনাে সময় ছিল না, কেবল সংঘাত প্রতীয়মান হতাে। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে রানী অত্যন্ত অস্থির মন নিয়ে সাসকটুনের বাড়িতে ফিরে এলাে। ১৯৯২ এর গ্রীষ্মকালে রানীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল আর মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে এক লম্বা একটানা লড়াই শুরু হলাে।
সাসকাটুন-এর বাড়িতে রানী আবার এত বিষন্নতায় আক্রান্ত হয় যে সে প্রায় সব ধরনের কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন প্রশংসনীয়ভাবে। তারপর রানীকে একের পর এক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হলাে। তারা নানা পরীক্ষা করে দেখেন, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে রােগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন, মনােবল ভেঙে যাওয়া রানীর বিষন্নতা আরও বেড়ে যায় আর তার সাথে বাড়ে তার একাকিত্বতা – কারণ রানী স্বেচ্ছায় সবার সাথে কথা বলা ছেড়ে দেয়। রানীর অসুস্থতার ধরন কেমন ছিল? রানীর মা-বাবা কিংবা ডাক্তাররা কেউ বলতে পারেননি রানীর কী হয়েছে। সবচেয়ে সম্ভাব্য। রােগ নির্ণয় করা শেষ হলে তাদেরকে জানানাে হয় যে, রানীর এক ধরনের bi-polar disorder দেখা দিয়েছে, যা আমরা ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি।
পরিবারের ভাষ্য অনুসারে, রানী নিজেও শেষ পর্যন্ত অসুখের গুরুত্বটা বুঝেছিল । কিন্তু রানী অথবা পরিবারের অন্য কেউ তার অসুখের কোনাে কারণ নির্ধরণ করতে পারেননি। ওটা কি জন্মমুহুর্তে পরিত্যক্ত হয়েছিল বলে? রানীর বাবা রবিন অবশ্য বলেন, রানীর যা অবস্থা ছিল তাতে ওর পশ্চাদপটের কারণে এ রকম নাও হয়ে থাকতে পারে। কারণ বিষাদগ্রস্ততা একটা অত্যন্ত সাধারণ অসুখ। বারবারা বলেন যে, রানীর অসুস্থতা তার আবেগী প্রয়ােজন ও হতাশার কারণে জটিল হয়েছিল আর এসবের বিপরীতে ছিল রানীর উৎসের সন্ধান – তার জন্ম ও পরিত্যাগকে ঘিরে অস্বাভাবিক ঘটনাবলি । দুজনেই বিশ্বাস করেন যে, রানীর যে বিষন্নতার রূপে পুনরাভিযান ঘটেছিল, তার পেছনে ছিল রানীর জন্মদাত্রী মায়ের বিষয়ে একাগ্র ভাবনা বা ধ্যান ধারণা যে কারণে তার অভিনিবেশ গাঢ় থেকে এত গৃঢ় হয় যে সে মনে করে যেন জন্মদাত্রী মাকে দেখতে পেয়েছিল বাংলাদেশে। তার বাবা-মায়েদের বিশ্বাস যে, রানী নিজে যখন তার নাম অনাথ আশ্রমের রেজিস্টারে বই-এ যখন দেখে তখন রানী প্রকৃতপক্ষে অনুভব করেছিল তার জন্মদাত্রী মায়ের শারীরিক উপস্থিতি – যেন রানীর নিজের ভাষায় সে তার মাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল।
রাণীর জন্মদাত্রী মাকে তার কাছে এত বাস্তব মনে হয়েছিল যে, সে তার কবিতায় তার “কখনাে-না-দেখা মার সাথে কথােপকথনের মাধ্যমে এক বিশেষ মানসিক চিত্র তুলে ধরে। সে সময়ে রানী এতই আবেগপ্রবণ ছিল যে, সে একমুহূর্তে অপেক্ষা করছিল তার মায়ের সঙ্গে মিলবে, আবার পরমুহূতে সে রীতিমতাে বিশ্বাস করেছিল যে ইতােমধ্যে জন্মদাত্রী মায়ের সাথে দেখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার অচেনা, অজানা ও অদেখা জন্মদাত্রী মায়ের সাথে তার যেন তাৎক্ষণিকভাবে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রানীর সবচেয়ে বাস্তব মায়ের সম্পর্ক ছিল বারবারার সঙ্গে, তার দত্তকগ্রাহী মা যিনি তাকে লালন পালন করেছেন শিশুবেলা থেকে। রানীর মনে দুটি বিশেষ উপাদান তাকে আরও বেশি বিভ্রান্তকর করে রেখেছিল। তার বংশবৃত্তান্ত আর তার দত্তকগ্রাহী মা-বাবার মধ্যে রানী যেন এক ধরনের সংযােগহীনতা অনুভব করে। যেহেতু সে তার জন্মদাত্রী মাকে কাছে থেকে দেখেছে” বলে সে বিশ্বাসে অটল, তার জীবনে নতুন করে একধরণের অসংলগ্নতা অনুভব করে। সে মর্মব্যথা তাকে আমৃত্যু যন্ত্রণাবিদ্ধ করে।
রাণীর পরিবারের সদস্যদের মতে, ঢাকায় আসার আগে রানীর যত মানসিক অশান্তি থাকুক। কেন, ঢাকা সফরের পর থেকে রানী একটি সুনির্দিষ্ট বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। রানীর ভাগ্য এত অপ্রসন্ন সে তার বিষাদের ঘাের থেকে আর কোনােদিন বেরােতে পারেনি। আমরা দেখেছি রানী তার জীবনকথা একটি সরল সােজা বর্ণনায় আনতে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা করছিল শেষের দিনগুলিতে! আমরা এও দেখেছি কীভাবে মরালরা রানীকে শর্তহীনভাবে ভলােবাসা, নিরাপত্তা ও পথনির্দেশ যুগিয়েছেন জীবনভর। মরালরা এখনও বুঝতে পারেন না যে রানী কি জীবনভর বিষন্নতায় ভুগেছিল নাকি তার বাংলাদেশ ভ্রমণের পর থেকে ওই উপদ্রবের শুরু।
রাণীর মানসিক পরিস্তিতি এমনই এক পর্যায়ে পৌছে যে সে বিষন্নতার স্বরূপ বর্ণনা করার মতাে ভাষা কারাে জানা ছিল না। তার কষ্ট কমাবার মতাে কিছু করার বা বলার কারাের কোনাে সুযােগ ছিল না। এরকম সময়ও ছিল যখন রানী চুপ করে বসে কেবল কাঁদত । নানা ধরনের দুঃশ্চিন্তা তার মনকে এমনভাবে আবিষ্ট করে রাখত যে সব একের পর এক তার মনােজগতে দখল নিত । ফলে তাকে যেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে পীড়া দিয়েছিল যে, কেউ সেখানে। প্রবেশাধিকার পেত না। বারবারা বলেন, রানীর দরকার ছিল এমন কাউকে যিনি রানীকে।
সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারতেন এবং আফ্রিকভাবে যেন রানীর কল্পনার অভিজ্ঞতাকে হৃদয়ঙ্গম কতে পারতেন। বিষয়টি এতই জটিল হয়ে দাড়ায় যে রানী দৃঢ়ভাবে অনুভব করে তার মা তার সঙ্গে রয়েছেন, সে যেন তাকে দেখতে পায়, কিন্তু সত্যিকারের অর্থে সেটা ছিল ঠিক উল্টো। তিনি তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন জন্মের পরপরই ।
মালরা তখন বিস্মিত হয়েছিলেন যে এত কিছুর পরও মানসিক ভারসাম্য হারানাে অবস্থায় অসুস্থতার মধ্যখানে তখনও আশার আলাে তার ভেতরে জ্বলছিল। অপরের প্রতি স্বভাবত বানী সর্বদা সহানুভূতিশীল এবং মমতাময়ী নারী ছিল। রানীর জীবন দর্শন এমনই ছিল যে সে বিশ্বাস করত জীবনে শুধু ভালাে থাকা নয়, ভালাে কিছু করারও প্রয়ােজন রয়েছে । সে অন্যদের দেখত মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে। জীবন যতই বিপদসংকুল হােক না কেন সর্বদাই সম্মুখগামী হওয়া উচিত যা সহজেই হবে প্রতিপাদনীয়। এটাই ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গি। কুইনস ইউনিভার্সিটিতে যখন ছাত্রী তখন সে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের আশ্রমে সময় ও সেবা প্রদান করেছে। তার জন্য রানী অনেক প্রশংসাও কুড়িয়েছে এবং পুরস্কারাদি পেয়েছে । অন্যদের সহায়তা করার মধ্য দিয়ে রানী নিজে তার হৃদয়ে জায়গা তৈরি করেনিত তার মতাে মানুষিক ব্যাধিতে যারা ভুগছে তাদেরকে নিয়ে । ১৯৯৬ সালে রানী তার একটি কবিতায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে লেখে: ভাগ্যের পরিহাস যে, রানী নিজে কষ্টের উর্ধ্বে যেতে পারেনি। যে অবিশ্বাস্য উৎকণ্ঠা তার পেছনে ঘুরেছে বছরের পর বছর, সে একটা কালবােমা, যে কোনাে সময়েই বিস্ফোরিত হতে পারে। আস্তে আস্তে রানীর অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, যখনই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতাে, তখনই সে আবার পালিয়ে আসত। রানীর ধ্বংসাত্মক আচরণ তার আত্মবিশ্বাসকে এমনভাবে দমিয়ে রেখেছিল যে ক্রোধ, অসন্তোষ এবং ক্ষিপ্ততা যেন তার জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাঝে মাঝে মনে হতাে সে যেন কিছুটা সময় আলাদা করেনিত যেন তার আত্মিক ও মানসিক শক্তিগুলােকে পুনর্বিন্যাস করার লক্ষ্যে। কিন্তু সে সব গুছিয়ে শান্ত, সুবিন্যাস্ত, নিয়মনিষ্ঠ জীবনে আর ফিরে যেতে পারেনি। সে নিজের হাতে নিজের জীবনের অবসান ঘটায় ১৯৯৯ সালের ৭ জুন বেলা ১২:৩০ মি: । তার বয়স হয়েছিল ২৭ বছর ।
বিখ্যাত মনােবিজ্ঞানী Erick Erickson তার বই Identify: Youth and Crises-এ বলছেন যে, পােষ্য সন্তানের পরিচিতির বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কেননা মনােবিজ্ঞানের পশ্চাদপট এটি ব্যক্তির বংশবৃত্তান্ত সম্পর্কে যে ধারণা দেয় তারই সঙ্গে সেটা বর্তমান ও অতীতের সূত্রে গাঁথা। এরিকসনের তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যক্তির অতীতের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় সম্পর্কে অজ্ঞতা বা জ্ঞান না থাকা মানসিক ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন করে, যার ফলে ব্যক্তির পক্ষে, বিশেষ করে তার বয়ঃস্বন্ধিকালে প্রাপ্তবয়স্ক হবার প্রক্রিয়ায় বাধা পড়ে। ২৫ রানীর বেলায় এরিকসনের যুক্তি ও তত্ত্ব প্রযােজ্য। কিন্তু আমরা এটাও দেখেছি যে, অন্য চারজন যুদ্ধশিশু, যারা রানীর সঙ্গে একই সফরে ঢাকা এসেছিল, তাদের ক্ষেত্রে খাটে না। রানী তার জন্মদাত্রী মাকে কোনােদিন দেখেনি কিন্তু সে বিশ্বাস করত সে তাকে দেখেছে, তার সাথে কথা বলেছে এবং তার জন্য শােক যাপনও করেছে।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!