You dont have javascript enabled! Please enable it!
ডেইল গুড ও ডরিন গুড
১৯৭২ সালে যখন ডেইল এবং ডরিন গুড বাংলাদেশের যুদ্ধশিশু বাথলকে দত্তক নেন, ডেইল তখন মাস্টার ফিল্স-এর অন্টেরিওর হ্যমিলটন শহরের কাছে কোপটাউন শাখার ম্যানেজার। তার স্ত্রী ডরিন তখন নিবন্ধীকৃত নার্স এবং খন্ডকালীন টিচিং অ্যাসিসট্যান্ট হিসাবে হ্যামিলটনের সেইন্ট জোসেফ’স হসপিটালে কর্মরত ছিলেন। তাদের দত্তক নেবার বাসনার উদ্রেক হয় ডরিনের নাসিং-এর প্রশিক্ষনের সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে যখন তিনি নার্সারিতে কাজ করতেন। অনেক নবজাত শিশুকে হাসপাতালে জন্মদাত্রী মায়েরা দত্তকের জন্য রেখে চলে যেতেন পরিবার গঠনের জন্য শিশুকে দত্তক নেবার ভালােবাসা দম্পতির মাথায় বিয়ের সময় থেকেই ছিল। তাহলে সে শিশুকে কেন বাড়ি নিয়ে যায় না কেউ, যেখানে তাকে তার জন্মদাত্রী মা রেখে যায় দত্তকের আসায়?” ডরিন অনেকবার এভাবে ভেবে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করতেন।
গুড দম্পতিরা প্রথম যখন দত্তক বিষয়ে জানতে স্থানীয় চিলড্রেন্স এইড সােসাইটি-তে (সি এস এস) খোঁজখবর নেন, তাদের বলা হয়, তাদের ডাক্তারি পরীক্ষা করে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম প্রতিপন্ন হতে হবে । তারপর তারা দত্তক নেবার উপযােগী বিবেচিত হবেন। আরও বলা হলাে, অন্টেরিও প্রদেশে একটি লম্বা, তালিকাভুক্ত সম্ভাব্য দত্তকে ইচ্ছুক মা-বাবা রয়েছেন। একই সময়ে গুডসরা একটি সাপ্তহিক ম্যাগাজিনে পড়েন মন্ট্রিয়লস্থ ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন (এফ এফ সি)-এর মাধ্যমে ভিয়েতনামী অনাথ দত্তক নেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এফ এফ সি কর্মীদের বিশ্বাস ও নিজেদের কাজের প্রতি একাগ্রতা তাদের বিশ্বের প্রতিবন্ধী শিশুদের দত্তক নেয়া এবং তাদের সংস্থান যােগানাের সাফল্য গুডসদের চোখ খুলে দেয় এক ঝক আশার উদ্দীপক সম্ভাবনার বিষয়ে। গুডসরা বার্লিংটন শহরে হেলকে ফেরির সঙ্গে যােগাযােগ করেন। হেলকে তখন এফ এফ সি’র অন্টেরিও শাখার মুখপাত্র ছিলেন। অবাক হবার কিছু নেই, হেলকে গুডসদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। আরও অনেক দম্পতি। তাদের সঙ্গে ছিলেন, সকলে মিলে তারা অন্টেরিও সরকারকে দত্তক প্রক্রিয়া তরান্বিত করার জন্য লবি করেন। আমরা সেটা ইতােমধ্যে তৃতীয় অধ্যায়ে পড়েছি।
গুড দম্পতিদের দুসন্তান, রায়ান (ঢাকাতে দেয়া নাম বাথল বদলায়ে তারা এ নামটি রাখেন) এবং রাশােনা। রায়ান আসে ১৯৭২ সালে আর রাশােনা আসে ১৯৭৫-এ যখন ওর বয়স ছিল ১০ সপ্তাহ। ডরিন তার ছেলের সঙ্গে বাঁধন এমন তাৎক্ষণিকভাবে দৃঢ় করে নেন যে নতুন করে সন্তান গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিলেও আর এর চেয়ে সুদৃঢ় সম্পর্কে তৈরি করতে পারব বলে মনে হয় না,” লিখেছিলেন ডরিন লেখকের চিঠির উত্তরে । তিন বছরের মাথায় রায়ান ও রাশােনাকে পেয়ে গুডসরা তাদের পরিবারকে আর বড় করবেন না ঠিক করলেন । তারা অবশ্য সন্তান ধারনের সক্ষমতার জন্য যে টেস্টে যাওয়ার কথা ছিল, সেদিকে এগােননি। নতুন পুত্র এবং কন্যাকে নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলন যে অন্ন সব কিছু তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল প্রথম কয়েক বছরগুলােতে।
গুড দম্পতি দীর্ঘ এবং অনির্দিষ্টকাল বাংলাদেশ থেকে রায়ানের আসার অপেক্ষা করেছিলেন। অন্টেরিওতে আন্তজাতিক দত্তক ব্যবস্থা তখনও নতুন ব্যাপার । হােমস্টাডি করার দায়িত্ব যাদের ওপর, মিনিষ্ট্রি এব কমিউনিটি এন্ড সােস্যাল সার্ভিসেস বিষয়টি সম্পন্ন না করে বিভিন্ন অজুহাতে কাজটি পিছিয়ে দিচ্ছিলেন। আন্তর্জাতিক দত্তকের পক্ষে গুডসরা সামনের সারির সাত পরিবার এখন একত্রিত হয়ে চাপের সৃষ্টি করেন। তারা যেন তাদের নিজ পছন্দমতাে পৃথিবীর যেখান থেকে ইচ্ছা যেখান থেকে যে কোনাে অনাথ শিশুকে দত্তক গ্রহনের মাধ্যমে। তাদের পরিবারে নিয়ে আসার লবিং করতে থাকেন। যখন রায়ান শেষ পর্যন্ত এলাে, গুড দম্পতিরা তখনই প্রথমবারের মতাে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন ।
এ ককেশীয় দম্পতির দাম্পত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলাে, তাদের সত্তার গভীরে তারা ভিন্ন জাতের ও সংস্কৃতির একটি শিশুকে দত্তক নেবার স্বপ্ন দেখতেন। জাতগােত্রের দিক থেকে আলাদা রায়ান ছিল তাদের সে স্বপ্নের শিশু। “বিশ্ব পরিস্থিতির জন্য এটুকুতাে আমরা করতেই পারি।” কথাটি ডরিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রায়ান ওদের বাড়িতে আমার দুমাস পর ।
গুড দম্পতির অশ্বেতকায় শিশুদের জন্য আকঙ্খার বিষয়ে জানার পর স্থানীয় সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদক গুড দম্পতিদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তিনি যা দেখেন তাতে তিনি বিস্মত ও মুগ্ধ হন । নয় সাপ্তাহের শিশু রায়ান দত্তক নেয়া মা ডরিনের কোলে, যাকে দেখে তার মনে। হয়েছিল কানাডাতে নতুন বাড়িতে সে সম্পূর্ণরূপে সুখী। “পৃথিবীতে শিশুকে ভালােবাসা সবচেয়ে কঠিন কাজ নয় এবং গাঢ় রং-এর ত্বক এবং নরম ভাজ দূর প্রাচ্যের একটি শিশুকে কী অপূর্ব সুন্দর যে লাগে,” স্বচক্ষে শিশু ও মাকে দেখে প্রতিবেদক এ মন্তব্য করেছিলেন । (Wentworth Marketplace 6 September 1972)
গুড দম্পতিরা তাদের স্মৃতিচারণে বলেন তারা অনেক সময় রাস্তাঘাটে এমন লােকদের সাথে দেখা পেতেন যারা তাদের পরিবার দেখে বলত, তাদের পরিবার তাে খুব সহজভাবে গড়া, অর্থাৎ সন্তান গর্ভে ধারণ করে সন্তানের জন্ম দিতে হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে প্রতিবারই বলতে হতাে, “না প্রক্রিয়াটি অত সহজ হয়নি মােটেই। বস্তুতপক্ষে, শারীরিক অসুবিধা, বেদনা এগুলাে এড়ানাে গেলেও ভাবাবেগের চাপ, উল্কণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, এসবের যে কষ্ট সেগুলাে তাে তাদেরকে পেতেই হয়েছে। “প্রসব তাে সবাই করে, তবে দত্তক নেয় কেউ কেউ,” গুড দম্পতিরা সাধারণত এভাবেই মন্তব্য করতেন। তারা এখনও মনে রেখেছেন সে সময়গুলাে – রায়ানের দত্তক নেবার সময় অপেক্ষার যেন আর শেষ নেই মনে হয়েছিল। বলা যেতে পারে, সেটা যেন নয় মাসের গর্ভধারণকালের চেয়েও বেশি ও দীর্ঘতর সময় ছিল । পেছনের দিকে তাকিয়ে ডরিন বলেন সে সময়ে তাদেরকে যেন গাদা গাদা দালিলিক কাগজ বগলদাবা করে উজানে সাঁতরে উঠতে হয়েছিল।
দত্তকগ্রাহী বাবা-মায়েদের নেটওয়ার্ক ক্যানাডপ্ট- এর অংশ হিসাবে তারা পরিচিত হন। একদল বাবা-মায়ের সাথে যারা তাদের মতই আন্তবর্ণীয় সন্তান দত্তক নিয়েছিলেন। (বর্তমানের অধ্যায়ে ডেল উলসি ও ডনা উলসির বিবরণীতে ক্যানাডণ্ট-এর সম্পর্কে আরও জানবাে)। আমরা ইতােমধ্যে জেনেছি কানাডাতে ১৯৭২ সালে মিশ্রবর্ণের শিশুদের দত্তক নেয়ার প্রচলন অত বেশি ছিল না।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারা আরও বলেন প্রতিবেশি এবং স্থানীয় জনগােষ্ঠীর মধ্যে মিশ্র বর্ণের ও সংস্কৃতির সন্তানদের বিষয়ে ঔৎসুক্য ও আগ্রহ দেখা গিয়েছিল এটা ঠিক, বিশেষ করে রায়ান যখন ছােট ছিল। ব্যাপারটা বেশ তুঙ্গে পেছাত যেহেতু ডরিন স্বর্ণকেশি শ্বেতাঙ্গ নারী হয়েও একটি ভিন্ন ত্বকের ও রং-এর একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ঘুরতেন। প্রায়ই তাকে বিপনি কেন্দ্র বা ওষুধের দোকানের সামনে থামতে হতাে, কারণ কেউ না কেউ তাকে থামিয়ে দিয়ে কোলের বাচ্চা রায়ানকে কাছ থেকে দেখতে চাইত। তারা বলত, “আসলেই এক আকর্ষণীয় শিশু ছেলে!” অনেকেই এক পলকে রায়ানকে ভালােবেসে ফেলতেন, যেহেতু গুড দম্পতিরা ছােট জনগােষ্টীতে বাস করতেন, এ রকম ছেলে বা মেয়ে ছিল বিরল। যেখানে। অধিকাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ ছিলেন । ডরিনের স্মরনে আছে অনেকেই জিজ্ঞাসা করতেন, “ওর বাবার রং কী? অথবা, ও কাকে বিয়ে করবে?” এবং “ও কী ভাষায় কথা বলবে?”
শুরু থেকেই গুড দম্পতিরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে খােলাখুলি কথাবার্তা বলতেন, বিশেষ করে তাদের জন্মের ইতিহাস ও অতীত বিষয়ে। এখনও তারা মনে রেখেছেন তারা তাদের সন্তানদের বলেছিলেন, “তােমাদের বাদামি ত্বক গাঢ় রঙের চুল, কালাে চোখ তােমাদের চেহারায়, তােমাদের বাবা-মায়ের চেহারায় যে সুন্দর আকর্ষণ ও পার্থক্য এনেছে, সে জন্য আমরা তােমাদের সহজে ভালােবেসে ফেলেছি। জাতিগত পৃথক শিশুদের পরিবারের জন্য জীবনের এক সত্য।”
ডরিন বলেন তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বাঙালি ঐতিহ্যের ছোঁয়া দেবার চেষ্টা করেছেন, চেষ্টা করেছেন বাঙালি জীবনযাত্রার বিষয়ে মূলধারার তথ্য যােগাতে । কিন্তু সন্তানরা বড় হতে লাগল তারা পরিষ্কারভাবে কনাডীয় ভালােবাসায় উদ্বুদ্ধ হয় যা মূলত বহু সাংস্কৃতিক চরিত্রের অবাক হবার কিছু নেই। তাদের সন্তানেরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলাে, তারা সুনির্দিষ্টভাবে জানল যে রায়ান বাংলাদেশি যুদ্ধশিশু এবং রাশােনা এক অনাথ শিশু, যুদ্ধশিশু নয় । দম্পতি তাদের দত্তক নেবার কাহিনী খবরের কাগজে যেমন বেরিয়েছিল এবং সে সময় তাদের জন্মদেশে রাজনৈতিক অবস্থা যেমন ছিল, সে বিষয়ক খবরের কাগজের কাটিং সংরক্ষণ করেছিলেন যাতে সেগুলাে প্রয়ােজন মতাে যে কোনাে পরিস্থিতিতে প্রমান হিসবে যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সামনে উপস্থাপন কর যায়।
একথা স্বীকার্য যে অনেক দিক দিয়েই গুড দম্পতিরা আরও দশজনের মতাে ছিলেন না। অনেক দত্তক নেয়া মা-বাবা তাদের সন্তানদের উৎস সন্ধানে অস্বস্তিবােধ করেন বলে বিষয়টিকে কখনাে এড়িয়ে যান নি । গুড দম্পতিরা তার পরিবর্তে রায়ানকে উৎসাহে দেন; যেন সে তার জন্ম ইতিহাস অনুসন্ধান করে । যখন সে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিল, তারা সেটাকে নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক কাজ বা উদ্যোগ হিসাবে দেখেন। তাদের মনের মধ্যে কোনাে সংশয় না থাকায় তারা রায়ানকে সর্বদা উৎসাহ দিয়েছেন, তার জন্মবৃত্তান্তের তথ্য সন্ধানে। ১৯৮৯ সালে ক্যানাডপ্ট বাংলাদেশে থেকে দত্তক নেয়া ছেলেমেয়েদের জন্য একটি ট্রিপের আযােজন করে (যে সম্পর্কে আমরা সপ্তম অধ্যায়ে পড়ব)। গুড দম্পতি তাদের দুটি সন্তান নিয়ে তাতে যােগ দেন। তাদের মতে, পরিবারের পক্ষে এটা এক সুবর্ণ সুযােগ ছিল যা ক্যানাডপ্ট সংগঠিত করেছিল । গুড দম্পতি মনে রেখেছেন সপ্তাহব্যাপী সে হৈ চৈ করা যুদ্ধশিশুদের প্রথম সফর আপন জন্মদেশে।
স্মৃতিচারণে তারা বলেন রায়ান ও রাশােনার প্রতিক্রিয়া তাদের জন্য পুরস্কার পাওয়ার মতাে মনে হয়েছিল – তাদের জন্মদেশে যাবার পরিকল্পনার শুরু থেকেই । সেটা এ দম্পতিকে সবচেয়ে বেশি ছুঁয়েছিল, সন্দেহ নেই। তারা দেখেছিলেন, কীভাবে তাদের সন্তানেরা অনুভব করে যে, তাদের কী ভাগ্য যে তারা আজ কানাডার অধিবাসী। তারা ভাবতেও পারে না যে কীভাবে তারা অনাথ আশ্রমে পালিত শিশুদের একটি অংশ ছিল। তাদের কেউ দত্তক এর মাধ্যমে বাইরে যেতে না পারলে হয়তাে অনাথ আশ্রমেই অবহেলিত হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে হতাে। অথবা রাস্তায় ভিক্ষা করত অথবা চৌর্যবৃত্তিতে জড়িয়ে যেত । ডেইল ও ডরিন বলেন তাদের একটা সময়ােচিত সুযােগ দিয়েছিল ঐ সফরটি। অনুকূল পরিবেশে বাংলাদেশের সত্যিকারের অবস্তা বােঝার একটা সুযােগ আমাদের জীবনে কী হতে পারত যদি তারা বাংলাদেশে বড় হতাে।”
৩৬ দম্পতিদের ঘূর্নিায়ুর মতাে বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে সংবাদপত্র প্রতিবেদক ইভােন রেনােল্ড লেখেন, কীভাবে তিনি ওদের সঙ্গে ঘুরেছিলেন ঢাকাতে। তিনি তখন সবাইকে বলেছিলেন, “টের পেয়েছি বিশ্বর ওপাশের ঐ লােকজনের অবস্থান, তাদের শক্তি কত বুঝেছি, তাদের প্রয়ােজন আর অভাব কত বিশাল আর ব্যাপক, তাও।” (Focus 3) May 1989)। বাংলাদেশ থেকে কানাডা ফিরে এসে গুড দম্পতিরা কয়েকদিন কেবল চিন্তা ভাবনা করেন, “কী তারা দেখলেন। কী তাদের অভিজ্ঞতা।” (Focus 30 May 
এ কথা স্বীকার্য যে, এক অর্থে গুড দম্পতিরা নিজেদেরকে অনেকটা অপরাধী বলেই ধরে নিয়েছিলেন কারণ তারা পৃথিবীর মধ্যে বিশাল সমৃদ্ধশালী দেশ কানাডাতে বাস করেন এবং তারা সেদেশের নাগরিক। ১৯৭৫ সালে The Mennonite Reporter এর এক সাক্ষাৎকারে গুড দম্পতিরা বলেন,“তারা এমন কাউকে বাড়ির আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন, যার কোনাে বাড়িঘর নেই ।”১৩ সময় যতই অতিবাহিত হতে থাকে, আস্তে আস্তে তারা হৃদয়ঙ্গম করেন। যে, যেসব সন্তানদের তারা দত্তক নিয়েছেন সে সব সন্তানই যেন তাদের বাবা-মায়ের জীবন। আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের ছেলেমেয়েরা জীবনে তাদেরকে দিয়েছে “এক নতুন উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং অর্থ।” গুড দম্পতিদের জন্য কোনাে পদক (মেডেল) বা পুরস্কার নয়, একটি পুত্র বা কন্যার সমান আনন্দ আর কিছুতে তাদের নেই। ডরিন এবং ডেইল দুজনেই বলেন যে তাদের সন্তানেরা যে আনন্দ দেয়, তা জগতে অন্য কিছু থেকে তারা কখনাে পাননি।
রায়ান ও রাশােনা দুজনেই দয়ালু, বিবেচক ও সত্যানুষ হিসাবে বড় হয়েছে তাদের তত্ত্বাবধানে। তাদের দুসন্তানই আজ সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে – তাই অবসরপ্রাপ্ত দম্পতি এতে অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও গর্বিত। তাদের দুটি সন্তানই বিবাহিত। রায়ানের বিশদ জীবনালেখ্য নিচে বিধৃত। রাশােনা, একজন আত্মবিশ্বাসী মনস্তাত্তিক নার্স । বিয়ে করেছে। মেক্সিকান মার্ক মেজাকে। তাদের এক টিন এজ ছেলে (মার্ক-এর আগের পক্ষের) জ্যাক। ওরা থাকে ক্যালােফরনিয়ার লস এঞ্জেলেস-এ।
ডেইল এবং ডরিন বর্তমানে একাই বাস করছেন। কাছে থাকে বলে রায়ান এবং তার ছেলেমেয়েরা দাদা-দাদির সঙ্গে বেশি সময় কাটানাের সুযােগ রয়েছে। রাশােনা দূরে থাকে তাই কম সময়ের জন্য অনেক দিন পরপর আসে। গুড দম্পতিরা অপেক্ষায় থাকেন কবে ক্যলিফোর্নিয়ায় কন্যার বাড়িতে বেড়াতে যাবেন । ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিকে নিয়ে। আনন্দের শেষ নেই।
বাথল
২৭ জন ১৯৭২ তারিখে মাদার তেরেসার ঢাকাস্থ শিশু ভবনে বাথলের জন্ম । জন্মের সময়। তার ওজন ছিল ২.৫ কেজি। তিন সপ্তাহ বয়সে শিশুটি যখন কানাডা আসে পৌঁছায়, তার ওজন তখন ২.৩ কেজি। আনাথ আশ্রমের কতৃপক্ষ ছেলেটির নাম রেখেছিলেন বাথল। তার জন্মদাত্রী মা আর কোনাে তথ্য দিতে চাইনি এবং সেসব চাওয়া হয়নি। কারণ ওটা জবরদস্তি মূলক গর্ভধারণের ব্যাপার ছিল। তাই শিশুটির জন্মের পরপরই তার মা প্রসূতি সদন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
বাথলের দত্তক নেয়া বাবা-মা তার নাম বদলে রাখেন রায়ান; পরিবারের নাম গুড যােগ দেন তার সাথে । বাথল নামটি প্রথম ও শেষ নামের মাঝে মধ্য নাম হিসাবে রেখে দেন। এভাবে শিশুটির নাম হলাে: রায়ান বাথল গুড়। সে বড় হয় অন্টেরিও প্রদেশের ছােট শহর কোপটাউন-এ। স্কুলের ছাত্র ছিল, হ্যাগারসভিল (১৯৭৮-১৯৮২); সাউথ পার্ক সেন্টেনিয়েল স্কুল । কাকটন (১৯৮২-১৯৮৬); সাউথ হিউরন ডিস্ট্রিক্ট হাই স্কুলে (১৯৮৬-১৯৯১)। তারপর সে ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত পড়াশােনা করে পরিবেশ ও সম্পদ বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি নেয়। হাই স্কুলে থাকতেই ১৯৮৯ সালে রায়ান আরও অন্যান্যদের সাথে বাংলাদেশে ভ্রমনে যায় যেটা আমরা সপ্তম অধ্যায়ে বিশদভাবে দেখব যুদ্ধশিশুদের প্রথম বাংলাদেশে সফর শিরােনামে । বাড়ি আসার ব্যাপারটি তার জীবনে ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করে। এতে রায়ানের বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশিদের বিষয়ে আরও আগ্রহ ও ঔৎসুক্য তৈরি করে। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় যখন রায়ানের বয়স অল্পই ছিল, তখন সে ভবিষ্যতে আবার বাংলাদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । বলা যেতে পারে যে, প্রথমবার বাংলাদেশে গিয়ে তার যে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্তে যেন এ অনুভূতির নিবৃত্তি ঘটে। রায়ান আবার বাংলাদেশে ফেরে তার বন্ধু ব্রেন্ট জিনজারিক-এর সঙ্গে। ১৯ বছর বয়সে তখন তার রক্ত টগবগ করে ফুটছিল।
এক অন্তরীণ আকাক্ষায়, তার জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে দেখা করার উদগ্র বাসনায়। শিশু ভবনের কর্মীদের ভাষ্যমতে, রায়ানের মা ছিলেন বরিশালের মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে রায়ান ঠিক করে যে করেই হােক তাকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। রায়ানের জন্য এ বিপদসঙ্কুল ডাক যেন ওর অন্তরের আরেকজনকে ডাকা । বিশ্বের উন্মাদনা নিয়ে রায়ান কালক্ষেপন না করে ছুটে যায় বরিশালের উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে ২০০ কিমি দূরে বরিশাল শহর । অন্য কোনাে তথ্য না থাকায় ঘােরাফেরাই সারা হলাে। এ সফরে এক নতুন বাস্তবতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠায় রায়ানকে অসাধারণ কিছু ভাবাবেগ সামলাতে হয়। তারপর সে ছুটে যায় ভারতের কলকাতাস্থ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির হেড অফিসে খোঁজ নিতে । সব জায়গা থেকে তার প্রশ্নগুলাে ফিরে এলাে, কিন্তু কোনাে উত্তর পাওয়া গেল না। অতীত আর বর্তমানের মধ্যে আসা যাওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯ বছর বয়সের রায়ানের মাথায় ঢুকল যে, ও যা খুঁজছে, তা পাওয়ার কোনাে প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি বাংলাদেশে বর্তমান নেই।
বাস্তব পরিস্থিতিতে ফিরে মানসিকভাবে ক্লান্ত রায়ান হৃদয়ঙ্গম করে যে অনামিকা নারীটিকে সে কখনাে খুঁজে পাবে না। কারণ যিনি তাকে এ পৃথিবীতে এনেছিলেন তিনিই তাকে পরমুহূর্তেই পরিত্যাগ করেছিলেন। রায়ান তখন নিজেকে বলে যে জন্মদাত্রী মাকে না পাওয়া গেলেও জন্মদেশ সম্পর্কে আরও জানলে ক্ষতি কী! অনেক ভেবেচিন্তে কয়েকটি প্রশ্নের, যেমন- সে কে? কোথা থেকে এলাে? তার জন্মদাত্রী মা কে ছিলেন, যিনি তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন? ইত্যাদির উত্তর পেয়ে যায়। সে জানতে পারে যে, জুলাই ১৯৭২ এ যে ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে কানাডা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে সে (রায়ান) একাই শুধু তিনবার। বাংলাদেশে এসেছে। তার তৃতীয় সফরের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ ও দেশের মানুষদের চেনা। এবং জানা, তখন সে নিজেকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছে “কোথায় বাংলাদেশ?”* জবাবে কোনাে সন্তোষজনক উত্তর সে পায়নি। ২৬ বছর বয়সে সাহসী রায়ান তার নিরাপদ কানাডীয় জীবন পেছনে রেখে বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন জ্ঞান আহরণ এবং অজানা জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে জানতে সামান্য কিছু হৃদয়ঙ্গম করে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে যতবেশি লােকের সঙ্গে মেলামেশা করবে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার জ্ঞান নিশ্চিতভাবে বাড়বে । বাংলাদেশে তরতাজা তরুণ রায়ান নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়ন সঙ্কল্পে নিশ্চিত। সে আরও বেশি। করে জানতে নির্ভীকভাবে তৈরি। তখন ওর মনে হয়েছিল সারা পৃথিবীটাই যেন তার হাতের কজির মধ্যে। দৃঢ়সংকল্প নিয়ে রায়ান তখন অসীম সাহসে, ষাড়ের সঙ্গে লড়াই যেমন- বিপদ মােকাবিলা করতে প্রস্তুত । ঢাকা থাকা অবস্থায় রায়ান তার বাবা-মাকে সবসময় ই-মেইলের মাধ্যমে সব কিছু সম্পর্কে অবগত রেখেছে। যা যেখানে করে বেড়াত, তার সবই জানিয়ে । তাতে ছােটখাট বিষয়ও বাদ পড়েনি। প্রথমেই রায়ান লিখেছিল যে তার চিঠি পড়ে তারা আগের ৩০ দিনের তথ্য এবং বিনােদনে দুটোই পাবেন। বাংলাদেশে রায়ান বাংলাদেশি সংস্কৃতি কাছে থেকে, সবচেয়ে ভালােভাবে দেখার সুযােগ পেয়েছিল। রায়ানের নিয়মিত ইমেইল পড়ে মনে হতাে তার মা-বাবার সঙ্গে যেন তার কথাবার্তা চলছে। যেন বা তারা একই বাড়িতে রয়েছেন, ডাক দিলেই একে অন্যের গলা শুনতে পান। ডেইল ও ডরিন রায়ানের ইমেইলগুলাে পড়ে বিশদ্ধ তথ্য ছাড়াও মজা পেতেন, অনেক হাসতেন। ১৯৮৯ সালে সফরে নিজেরা বাংলাদেশের যা দেখেছিলেন, সেটাও তাদের মনে পড়ত।
শুরুতে রায়ান তার একটি ই-মেইল এভাবে লিখেছিল: “তারিখ টাইপ করার আগ পর্যন্ত বুঝিনি আজ Halloween-এর রাত। এক পাগলামি অভিযানে ঢুকেছি, ইতােমধ্যে আমার পশ্চিমা ‘trick or treat’-এর জ্ঞান মনে হয় হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ঢাকায় রায়ান আরেকজন বাংলাদেশির সাথে তার এপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকত। তার নাম রায়ানের স্মরণে নেই। তবে তাকে বন্ধু বলে ডাকত। রায়ান তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তার। এপার্টমেন্টের বর্ণনা দেয় এভাবে: ‘সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমাদের রান্নাঘর হলাে একটা তাক বা শেলফ, তার উপরে স্টোভ; একটি পানির কল, মেঝেতে একটা সিমেন্টের জলবার অর্থাৎ সিঙ্ক । বাথরুমের মেঝেতে আমাদের কাপড় ধােয়ার যন্ত্র ।
তারপর সে বর্ণনা করে কীভাবে রােজ শুতে যায় বিছানায়ঃ একদিক বাদ রেখে নেটের (মশারির) বাকি তিন দিক তােষকের নিচে পুঁজে, পাঁচ থেকে দশ মিনিটে নেটের (মশারির) ভেতরে মশা মেরে । মশাদের কামড়ানাের কোনাে সুযােগ দিতে রাজি ছিল না সে। রায়ানের বিবরণ এত বিশদ যে সেগুলা পড়ে যে কেউ কল্পনা করতে পারতেন কীভাবে রায়ান খাঁচায় আবদ্ধ (মশারির ভেতরে ঢােকার জন্য) জীবের মতাে মশাদের বংশ ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। “শেষে বিছানার চারপাশ জোরেসােরে চাপড় দিতে হবে যাতে ওর নিচে যেসব পােকামাকড় চুপ করে লুকিয়ে আছে, তারা থেতলে মারা যায়, বেরিয়ে আসতে না পারে।”
এরপর রায়ান তার বাবা-মাকে আবারও লিখে যে এখানেই তার কাহিনীর শেষ নয়, আরও আছে। তাকে চুপ করে বসে, চারিদিকে কমপক্ষে এক মিনিট ভালাে করে তাকিয়ে দেখতে হবে আর কোনাে মশা অথবা পােকামাকড় মশারির ভিতরে উড়ে বেড়াচ্ছে কিনা। তখন তারপর তাকে ‘মশারির ভেতর থেকে নেমে আসতে হবে খুব সাবধানে যাতে আর কোনাে মশা ঢুকতে না পারে।” তারপর সে বাতি নিভিয়ে বিছানায় মশারির ভেতরে ঢুকে যেত । শুধু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার যে প্রস্তুতির চিত্র বর্ণনা ছিল সেটা কানাডাতে তার বাবা-মা ও বন্ধুরা খুব উপভােগ করেছে তার পাঠানাে ই-মেইলগুলাে পড়ে। অনেকেই তখন কল্পনা করত যেন রায়ান রাজার মতাে বিছানায় ঘুমােতে যায়। যারা মশার সাথে পরিচিত ছিলেন না তারাও শীঘ্রই তার লেখা চিঠি পড়ে মশা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং চিঠিগুলাে পড়াটা খুব উপভােগ করেছিলেন।
ঢাকাতে থাকাকালীন রায়ান সে বিখ্যাত প্রবচনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে: “যখন রােমে যাবে, রােমানরা যা করে তাই করবে।” বেশিদিন লাগেনি রায়ানের যখন সে বাধা-বিপত্তি, ঘুরানাে পথ, বিকল্প বাস এবং দীর্ঘতর ভ্রমণ সময়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । ঢাকা শহর এবং শহরবাসীর কথা বলতে গিয়ে রায়ান তার বাবা-মাকে বলে কীভাবে সে জনতার অংশ হয়ে যায়, অন্যরা যা করে, সে তাই করতে কখনাে দ্বিধা করেনি। এক সপ্তাহ বা তার আগে আমি রাস্তার ধারে ময়লা পয়ােনালিতে প্রস্রাব করছিলাম। তখন রাত ৯টা । হঠাৎ প্রাণান্তকর চিৎকার । ফিরে দেখলাম একজন নারী দৌড়াচ্ছে। আমি আমার প্যান্টের চেইন লাগানাের আগেই কানের। তালা ফেটে যাবার শব্দ হলাে, আরও বােমা ফাটল দুইবার এবং একটি পাথরের টুকরাে। আমার মুখ ঘেঁষে প্রচন্ড বেগে উড়ে গেল। তারপর ভীষণ হৈ চৈ।” রায়ান আক্ষেপের সাথে আরও জানায় যে আক্রমণাত্মক হিংসা এবং নারীদের হয়রানি ঢাকার রাস্তায় অহরহ ঘটছে।
ঢাকাতে আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সংবাদ মাধ্যম রায়ান সম্পর্কে জানতে পেরে তাকে নানা রিপাের্টাররা অনুসরণ করতে শুরু করে। ১৯৯৭ এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রায়ান যুদ্ধশিশু হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে সংবাদপ্রত্রের মাধ্যমে। সবাই তাকে বিস্মিত হয়ে দেখে, প্রথমবারের মতাে যুদ্ধশিশু হিসাবে রায়ান আত্মপরিচিতি প্রতিষ্ঠা করে। পরের দিন তাকলাগানাে শিরােনামে খবর দেখে রায়ান ভাবে এতে নিশ্চয়ই জনসাধারণের সচেতনতা বাড়বে। সত্যি বলতে কি, সে উৎসাহিতবােধ করেছিল হঠাৎ প্রচারণার ফলে বাংলাদেশিদের মনে তার জন্য জায়গা তৈরি হয়েছে এবং মনােযােগ আকর্ষিত হয়েছে বুঝতে পেরে সে খুব খুশি হয়েছিল। সে আরও বুঝতে পেরেছিল যে প্রয়ােজনের অতিরিক্ত মনােযােগ পাবে এবং তাকে নিয়ে প্রচন্ড হৈ চৈ হবে। এসব ভেবে রায়ান এত উত্তেজিত হয়ে যায় যে সে সাথে সাথে সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। জনসাধারণের ১৯৭১ সস্পর্কে ভাবনা বিসয়ে সে নিজেও বিশদ জানার চেষ্টা করতে লাগে । এ সম্পর্কে সে কানাডাতে তেমন কিছু জানত না। যখনই সে যা নতুন কিছু জানতে পারে সে তার বাবা-মায়ের কাছে তখনই সেটা লিখেছে তার নিজ দৃষ্টিকোণ থেকেঃ “স্বাধীনতা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যম্ভাবী ঘটনা ছিল । আর যুদ্ধের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের দখলদারি সৈনিকের নেয়া লুটতরাজ, নির্বিচারে বাঙালি সম্পত্তি লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, সেটা ছিল অনিবার্য।”
মজার ব্যাপার, কানাডীয় পাঠকদের জন্য বাঙালিদের ধর্মকর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে লেখাগুলাে। যেমন আগ্রহ উদ্দীপক তেমনি শিক্ষাপ্রদ ছিল। রায়ান বাংলা সংস্কৃতির টানাপােড়েন সম্পর্কে যেমন দেখেছে এবং যা সে ভেবেছে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে, তাই সে তার বয়স এবং বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে লিখে জানাবার চেষ্টা করেছে। তার এক চিঠি শুরু করে মুসলমানদের নামাজের আযান ব্যাখ্যার মাধ্যমে: “আযান মুসলমানদের জন্য নামাজের ডাক। এর থেকে রেহাই নেই । অপরিচিত ও ভিন্ন সংস্কৃতির অভিঘাতের প্যারেডে আযান নিঃসন্দেহে উপর থেকে প্রথম পাঁচটি বিকম্পনের মধ্যে জায়গা করেনিয়েছে। এটা বলাবাহুল্য যে, আযানের সম্মােহন সরল অসন্দিহান কোনাে অতিথিকে এড়াতে পারবে না।”
পবিত্র রমজান মাসের শুরুতে “যখন মুসলমানরা বিশ্বের সর্বত্র উপবাস পালন করেন তখন। বাংলাদেশি মুসলমানরাও তাদের ধর্মীয় দায় অভ্যাস করেন,” রায়ান তার বাবা-মাকে লিখে। আবার কোনাে বুদ্ধিবৃত্তিক ভান না করে রায়ান রােজা মাস সম্পর্কে যা জেনেছে তাই বলে: “রমজানে লােকজন ভাের ৫টায় উঠে খেতে আরম্ভ করে, সূর্যোদয়ের আগে সাইরেন বাজলে খাওয়া বন্ধ, খাবারের গ্রাস হাত থেকে মুখে দেবার মুহূর্তে যদি সাইরেন বাজে, খাবারের গ্রাস মুখে যাবে না। সূর্যাস্তের আগে তারা আর কিছু খাবে না । রমজানের শেষে যখন বাংলাদেশি মুসলমানরা ঈদ-উল-ফিতর উদয়াপনের জন্য তৈরি, তখন মাসব্যপী উপবাস শেস হয়, উপবাস ভঙ্গের উৎসব ঈদ।” রায়ান আবারও লিখে যে, সে যতটুকু বুঝতে পেরেছে, সে ততটুকুই ঈদ সম্পর্কে লিখছে: “যদিও আমার এখনও, কোনাে অভিজ্ঞতা হয়নি, তবুও এটা আমাদের বড়দিনের মতােই। একই রকম আনন্দের আমেজ কমিউনিটিতে সবার মধ্যে দেখা যায়। সব দেকানে জিনিস দিয়ে ঠাসা। লােকজন প্রচুর টাকা খরচ করছে । আকাশে বাতাসে আনন্দ উড়বে । আমি মজার উৎসবে ডুবে যাচ্ছি। আগের বড়দিনে আমি কিছু অনুভব করিনি। এখন ঈদে আমার বড়দিনে যেমন লাগার কথা তেমন লাগছে। ক্রিসমাস, ক্রিসমাস।
রায়ানের বর্ণনায় বােঝা যায় সে মুসলমানদের ঐতিহ্যর সাথে পরিচিত হতে পেরেছে; কিন্তু কানাডাতে খ্রিস্টীয় পরিবেশে লালিত পালিত হওয়াতে স্বভাবতই রায়ানের পরিচিতি খ্রিস্টীয়। ধর্মের সাথে । বাংলাদেশের রীতিনীতি তার নিজের নয়, কারণ সে সর্বক্ষণই উপলব্ধি করে যে সে কানাডীয় । তার বােধােদয়, হয় যে সে বিদেশি, বাংলাদেশি নয়। তার পরক্ষণে সে এটাও উপলব্ধি করে যে তার জন্ম বাংলাদেশে। তার জন্য সে গর্বিত।
২৬ বছর বয়সে রায়ানের বুদ্ধিমত্তা তাকে সহজেই বুঝিয়ে দেয় যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্ধ প্রায় সব বিষয়েই এখানে কমপক্ষে দ্বিমত পােষণ করেন। ১৯৯০ দশকের স্কুলবুদ্ধি ও কট্টরপন্থী রাজনীতিকরাও যে চাতুর্যের রাজনীতিতে নেমেছিলেন তাতে রায়ানের সন্দেহ ছিল না। তাদের প্রতারণাপূর্ণ ব্যবহারের সীমাহীনতা দেখে সে যেন আকাশ থেকে পড়ত। রায়ান অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিকে একটি অন্যরকম লেন্সের মধ্য দিয়ে দেখেছে। সে দেখে অবাক হয়েছে কীভাবে ভয়ানক সব কিতর্ক দেশপ্রেমের উন্মত্ততা, সস্তা নাটক, গুন্ডাদের কবজি মােচড়ানাে আর সুযােগসন্ধানীর স্বর্গরাজ্যে ঘােলাপানিতে মাছ ধরার মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে।
আবার হরতাল বিষয়ে লিখতে গিয়ে রায়ান প্রথমেই তার বাবা-মাকে হরতালের সম্পর্কে তার ধারণা ব্যক্ত করার চেষ্টা করে। সে লিখে, হরতাল বলতে সাধারণত ধর্মঘটকে বােঝানাে হয়। যা এক বা একাধিক বিরােধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সরকারের কোনাে নীতির প্রতিবাদে ডাকা হয়। যারা বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত নয় তাদের জন্য। রায়ান এক মূর্তিমান বাংলাদেশের ছবি আঁকে। “হরতাল একটি সাধারণ অস্থিরতা, এটি কোনাে বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নয়,” বিষয়টি এভাবে রায়ান ব্যাখ্যা করে । কখন, কীভাবে এবং কী কী ঘটলে এরকম হরতাল ডাকা হয় দেশের বড় বড় শহরে। ঢাকা শহরে যেমন কয়েক সপ্তাহ পরপর ডাকা হয়। সঙ্গে জনসাধারণের জামায়েত । এখানে দলছুটদের অভাব নেই। রায়ান তার যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করে রাজনীতিকদের কার্যকলাপে, তাদের প্রতারণা অতি সাধারণ ও তুচ্ছ বিষয়ে চিন্তা চাতুরী ও অসৎ উপায় অবলম্বন, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অপ্রয়ােজনীয় বক্তৃতা যেগুলােতে তারা অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছেন। তাদের এসব বড় বড় ধ্বনি আর তার সাথে রয়েছে অসংযত আবেগের বিস্ফোরণ ।
চোখ-কান খােলা রাখা রায়ান দেখতে পায় সমাজের নানাধরনের বিভ্রন্তি যা তার মতে অন্যায় এবং হিংসার জন্ম দেয়। আদর্শ মূল্যবােধের খোজে সাদাসিধা ও ছলাকলাহীন রায়ান বর্তমান রাজনীতির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে বলে, এটা নীতির নৈরাজ্য। মাদকের অপব্যবহার ঢাকায় এক বড় সমস্যা এবং মারাত্মক এ সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর আকারে ছড়াচ্ছে। এ ব্যাপারটা বােঝা যায় কারণ যুব শক্তিকে কাজে লাগাবার কোনাে কৌশল বা পরিকল্পনা আপাতত কারােরই নেই,” বলে রায়ান তার বাবা-মাকে বাংলাদেশের একটি সামাজিক সমস্যার চিত্র তুলে ধরে।
কিছুদিন পর রায়ান খুব মনমরা হয়ে যায় যখন দেখে কেমন করে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার জন্য গদি আঁকড়ে ধরে থাকেন, বিরােধী দলীয়রা এদিকে যা পাচ্ছে না তাই নিয়ে খেয়ােখেরি করছে। একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ভালােবাসার বদলে ঘৃণার সাথে যুক্তি তর্ক চলছিল অশালীন ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকের রাজনীনিতি নিজের চোখে দেখে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেন রায়ানের আশায় ছাই ঢেলে দেন। প্রত্যেক রাজনীতিবিদরাই যার যার পুঁজি বাড়ানাের লক্ষ্যে ব্যস্ত ছিলেন।
রায়ান যতই বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের ভন্ডামি এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কথা ভেবে হয়রান হতে লাগে, ততই সে চারিদিকে কেবল অন্ধকারের রাজত্ব বেড়ে যেতে দেখে, কোথাও আলাে দেখতে পায়নি। যদিও বাংলাদেশি সমাজে সে নবাগত চুনােপুঁটি, সে বাংলাদেশি। রাজনীতিবিদদের ন্যাক্কারজনক ভাঁওতাবাজি ঠিকই সনাক্ত করতে পেরেছিল । রাজনীতিবিদেরা, রায়ানের মতে, দারিদ্রের আশা ভরসার তােয়াক্কা না করে দরিদ্র মানুষের প্রতিটি পয়সা তাদের কাছ থেকে ছলে-বলে-কৌশলে ছিনিয়ে নেবার উদ্ভাবনে ব্যস্ত। অথচ এ দরিদ্র জনগােষ্ঠী সাম্য ও সুবিচারের জন্য লড়ছে বারবার। এরাই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে;” রায়ান কথাগুলাে তার উপসংহারে উল্লেখ করে । রায়ানের বুঝতে কষ্ট হয়নি যে বাংলাদেশের জটিল রাজনীতি বুঝতে তার আরও সময় লাগবে। ইতােমধ্যে তার দাবি, বর্তমান রাজনৈতিক ভন্ডামির অবসান হােক।
রায়ানের মনে হয়েছে দুর্নীতি বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিটি সেক্টরে এত গভীরভাবে প্রথিত হয়ে স্থায়ীভাবে জায়গা করেনিয়েছে যে এর থেকে আবালবৃদ্ধবনিতার আর নিস্তার নেই । তার মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মূল কারণ তার সর্বব্যাপী দুর্নীতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। “আমি এ ভয়ঙ্কর কার্যকারণে বিশ্বাস করি: আমার এ বিশ্বাস আমার মিশনের লক্ষ্যকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এখন আমার অবস্থানকেও নেতিবাচক প্রমাণিত করেছে। রায়ান তার আদর্শের কারণে অন্ধ হয়ে গিয়ে আশা করেছিল আমলারা দেবে আর নেবে মিলিবে’ । সে বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবে। সে আশা করেছিল তারা সংঘাত নয়, সম্প্রীতির পতাকা উড়িয়ে বন্ধুদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে। তার চিন্তাভাবনা, ধারণা এবং কাজকর্ম সমুদ্রের ঢেউয়ের মতাে আসছিল আর যাচ্ছিল। শেষে দেখা গেল মাঝে মাঝে সে তার বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবনায় পড়ে যাচ্ছিল। আবার পুরাে সময়টুকুতে মাঝে মাঝে তার মনে হতাে, তার কাজ করার সক্ষমতা, মনােনিবেশ করার ক্ষমতা, তার মেজাজ এবং মর্জি আংশিক রােগমুক্ত হয়েছে, সে কর্মক্ষম হয়েছে কিন্তু সে কখনাে এগুতে পারেনি।
যখন রায়ান ঢাকা থেকে বাংলাদেশের অন্য জেলাগুলিতে যাতায়াত করে তখন সে সাবধানে অস্থিরতা লক্ষ্য করেছে, লুটপাট দেখেছে, দস্যুতা প্রত্যক্ষ করেছে। তার মনে কোনাে সন্দেহ থাকেনি যে সমস্যাগুলাে একটুও কমেনি, ওগুলাে বােধ হয় থাকবেই। “ভােরবেলায় ঢাকা বিমান বন্দরে উপস্থিত হয়ে আমি দুজন গুন্ডার দ্বারা এক বেবি ট্যাক্সির মধ্যে আটকা পড়লাম । আমি একজনের মাথায় পদাঘাত করে ছাড়া পেলাম খুব খারাপ লেগেছিল, যদিও আমার কিছু হয়নি। একদল দুষ্কৃতির হাতে পড়ে কীভাবে রেহাই মিলল শেষে – এভাবেই সে ব্যাপারটা বর্ণনা করেছিল, তার বাবা-মায়ের কাছে তার নানাবিধ সমস্যা নিয়ে ।
রায়ান চাদাবাজ বা মাস্তানদের কথাও বলেছে, সে জানে বাংলাদেশে দুষ্কৃতিদের মাস্তান বলে অনেকে । “বাংলাদেশে মাফিয়াকে মাস্তান বলে ওরা। তারা সর্বত্রই আছে এবং সব স্তরে সব রাস্তা থেকে উপরে সব জায়গায় ওদের পাবেন, যখনই দরকার । ওরা বেশি বিপজ্জনকও হতে পারে। আমি প্রতিদিন সংবাদপত্রে মাস্তানদের কাজকর্ম সম্পর্কে পড়ি। তারা বাড়িতে তৈরি বােমা অথবা এসিড, ধারালাে অস্ত্র এবং যত রকম আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে, ব্যবহার করে থাকে।”
সরকারের কেউ জাতীয় ইস্যুগুলির ব্যাপারে কোনাে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে রায়ান বাংলাদেশিদের স্বাধীনতা বিষয়ক চিন্তাভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। সব শুনে তার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছিল যে স্বাধীনতা ওদের
জন্য মায়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পায়নি। এবং স্বাধীনতা পাবেও না যতদিন না এ দেশের মানুষ বিজিত এবং পরাভূতদের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবে এবং সে পার্থক্যটি দূর করতে সক্ষম হবে। রায়ান নিজ চোখে দেখে যা ভেবেছে, সেটাই সে তার চিঠিতে লিখে ।
স্মৃতিচারণে রায়ান বলে আনুষ্ঠানিক নানা সভায় তার কথা বলার সুযােগ হয়েছিল “বাংলাদেশে আগত প্রথম যুদ্ধশিশু হিসেবে। এ ধরনের জমায়েতে রায়ান উৎসাহিত, উদ্দীপিত ও গর্ববােধ করত নিজের অবস্থান বিষয়ে। বাংলাদেশের অন্যান্য সব যুদ্ধশিশুর কথা
পারি যে আমি একজন যুদ্ধশিশু। আমার জন্মদাত্রী মাকে পাকিস্তানি সেনা ধর্ষণ করেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ধর্ষণের ফলশ্রুতিতেই আমার জন্ম। এ রূঢ় সত্যটি আমি। হৃদয়ঙ্গম করেছি।” রায়ানের অঙ্গীকার, সে সামনের দিকে এগুবে।
বাংলাদেশের মানুষ তাদের জীবনে প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা একজন প্রকৃত যুদ্ধশিশু রায়ানের কথা শুনে যেন বিষ্ময়ে শিলিভূত। দেশের জন্মের সঙ্গে তার নিজের জন্মের সংশ্লিষ্টতা থাকায় রায়ান নিজেকে বীরের মতাে সম্মানিত অনুভব করে। সে সময়ে বাংলাদেশের প্রতি গভীর ও নিরন্তর ভালােবাসা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে। তার জীবনের বিনীত প্রারম্ভের উল্লেখ করে ভাবেগাপুত রায়ান অতঃপর আরও বিশেষভাবে বলে কেমন করে বাংলাদেশ এবং যুদ্ধশিশুরা রক্তে স্নান করে উঠেছে “এক মর্মবিদারী বিয়ােগান্তক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের গর্ভ থেকে। বাঙালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং রক্তস্নানের। পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত রায়ান তার শ্রোতামন্ডলীদের এক অবিস্মরণীয় ভাষায় বলে; “এক ভয়ানক রক্তস্নানের পর বাংলাদেশ – তােমার আর আমার উত্থান । যারা তাদের জীবন ও জীবিকা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই।” রায়ান তারপর তার শ্রোতাদের নিকট সনির্বন্ধ আবেদন। করে: “আসুন, আমরা একসঙ্গে বড় হই এবং কষ্ট করে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজি: কোথায় বাংলাদেশ?
শ্রোতারা চমকৃত হয়ে পিন পতন নীরবে শােনেন রায়ানের বিষাদময় এবং বিষ্ময়কর জন্মকাহিনী । যদিও আগ্রহী এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান, শ্রোতারা উপলব্ধি করেন রায়ানের উভয়সংকট – তার দন্দের স্বরূপ, বাংলাদেশ থেকে তাকে দিয়ে দেয়া আর কনাডার পক্ষ থেকে তাকে নিয়ে নেয়া।” বাংলাদেশে সে জন্মছে আবার কানাডাতে লালিত পালিত হয়েছে। কানাডাতে সে পেয়েছে শিক্ষা, বাড়ি-ঘর, বাবা-মা, ভাইবােন। এ দুদেশের প্রতি আনুগত্যের টানাপােড়নের মধ্য দিয়ে সে এক সাংঘর্ষিক অবস্থার সম্মুখীন হয়। একবার কানাডা তাকে কোলে তুলে নেয় । আরেকবার বাংলাদেশ তাকে জড়িয়ে ধরে, অভিনন্দন জানায়। ওর মতাে একজন যুদ্দশিশুকে প্রথমবারের মতাে দেখতে পেয়ে দর্শকরা অত্যন্ত। রােমাঞ্চিত । তারা তার একাকিত্ব দেখে, তার মনােকষ্টের কথা শুনে সহানুভূতিশীল হন। তারা বুঝতে পারেন বাংলাদেশে রায়ান বস্তুতপক্ষেই একাকি, এক ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় ।
পরের কয়েকদিন ঢাকার সংবাদ মাধ্যম রায়ানের উপর অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপায়। অধ্যাপক মনােয়ারা ইসলাম বাড়িতে নিজে রান্না করে রায়ানকে খাওয়ানাের নেমন্তন দেন। রায়ান সে ডিনার খুব উপভােগ করেছিল । ইসলাম এখনও মনে রেখেছেন কীভাবে রায়ান তাকে নেমন্তন করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিল । অধ্যাপক ইসলাম সে রাতে অনুপ্রাণিত হয়ে রায়ানকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন যেটা তিনি সকল যুদ্ধশিশু ও তাদের জন্মদাত্রী মায়েদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন তাদের সবাইকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে। স্থানীয় সংবাদপত্রে ওটা প্রকাশিত হয়েছিল । হারুন হাবিব, মুক্তিযােদ্ধা এবং সাংবাদিক, রায়ানের সঙ্গে দেখা করে তার সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছিলেন যা হাবিবের এক গদ্য সংকলনে প্রকাশিত হয় । সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং আরও অনেকে রায়ান সম্পর্কে কবিতা, গান ও নাটক লিখেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দেখা গেল মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রাথমিক উত্তেজনার ফেনা। থিতিয়ে যায়। সে সময়ে রায়ান নিজেও অনেকটা হতাশ হয়ে নিষ্ফলতা অনুভব করছিল। যেহেতু নিপীড়ক ব্যক্তিদের বিচরের ব্যবস্তা কিছুই হয়নি, রায়ান অবাক হয়ে ভাবে আসলে স্বাধীনতার কতটুকু অর্জিত হয়েছে। যুক্তি এগিয়ে দিয়ে রায়ান বলে, যদি কারাে অত্যাচারীকে নিশ্চিত না করা হয়ে থাকে অথবা শাস্তি বিধান না করা হয়ে থাকে, তাহলে নিপীড়ককে পরাভূত করা হয়নি ধরে নিতে হবে।” যে আঙ্গিকে রায়ান বিষয়টি পর্যালােচনা করে, সেটা থেকে সে ধারণা করে যে হয়তাে বা জুলুমবাজদের শাস্তি মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। রায়ানের চিন্তাভাবনা যেভাবে এগুচ্ছিল, তাতে অত্যাচারীদের বিচারের ব্যবস্থা না হওয়ার অর্থ ছিল, বাংলাদেশিরা যেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আমলে যে অত্যাচার হয়েছিল (মুলত ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানে, অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর যে তান্ডব চলেছিল) সেটা মেনে নিয়েছে। নিদারুণভাবে মর্মপীড়িত রায়ান নৈরাজ্যের চরমে পৌঁছে মনে মনে ভাবে যে মাত্র দুচারজন মানুষ ছাড়া আর কেউ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ ইস্যুর দিকে মন দিতে প্রস্তুত নন। ঢাকাতে থাকাকালীন রায়ান যখন এসব যুদ্ধ অপরাধীদের সম্পর্কে কথা বলেছিল তখন সে নানা অঙ্গিকে পুরাে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করেছে। পেছনের দিকে তাকিয়ে রায়ান আবারও বলে যে ১৯৯৮ সালে সে যখন বাংলাদেশে ছিল তখন তার কাছে মনে হয়েছে অত্যাচারীদের বিচার ছাড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও তার সুপ্ত শক্তির বিষয়ে তার অনেক প্রশ্ন রয়েছে যেগুলির উত্তর সে খুঁজে পাচ্ছিল না। রায়ান অবশ্য ২০১০ সালে কানাডা থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে যে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তন আসার দরুণ বর্তমান সরকার একটি আন্তর্জাতিক ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে গঠন করেছেন অধিকৃত বাংলাদেশে মানবিকতার বিরুদ্ধে যে সব অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার বিচার ও শাস্তি বিধানের লক্ষ্যে।
রায়ান এসব খবর সম্পর্কে অবহিত ছিল । অবাক হলেও সত্য যে, ২০১০ সালে আন্তজাতিক ট্রাইবুন্যাল রায়ানের সাথে যােগাযােগ করলেও সে এ বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ব্যাপারটি একটু বিশদ করে বলার অনুরােধ করলে সে স্পষ্ট ভাষায় বলে যে সে যতটুকু বুঝতে পারে, এ ট্রাইব্যুনালে অংশ গ্রহণ করার মতাে তার কোনাে ভূমিকা পালনের সুযােগ নেই । অতঃপর সে ট্রাইব্যুনালকে “all the best” কামনা। করে তার অপারগতা জানায় কানাডা থেকে । অবাক হবার কিছু নেই, ১৯৯৮ সালে রায়ানের ঢাকার জীবনে ফিরে গেলে আমরা দেখতে পাই মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই রায়ানের বাংলাদেশে বাস করার ইচ্ছায় ভাটা পড়ে আসে। তার অসন্তোষ ও হতাশা উত্তরােত্তর বেড়েই চলে। পরবর্তী সময়ে যেসব সমস্যা দেখা দেয় তার তুলনায় প্রথম দিককার অসুবিধা ও বাধাসমূহকে তার কাছে বরং হাল্কা মনে হয় । “বাংলাদেশে এত কিছু বলার রয়েছে, এত কম সময়, এত অল্প ধৈৰ্য, এত অল্প, সক্ষমতা। আমার জন্য এতসব বােঝা সম্ভব কিনা সে বিষয়েই প্রশ্ন চলছে আমার ভাগ্যে এ পাগলাদেশ বাংলাদেশ”, আশাহীনতার এক বিশেষ পর্যায়ে এসে হতাশাগ্রস্ত রায়ান তার বাবা-মাকে এভাবে লিখেছিল।
নতুনভাবে চর্চা করা বাংলাদেশ বিষয়ক জ্ঞান নিয়ে রায়ান তার জন্মভূমিকে নতুন করে ভালােবেসে যখন বাংলাদেশে আসে, তখন সে আশা করেছিল দেশটাকে নতুন আলােতে আবিষ্কার করবে। সে ভেবেছিল তার মনশ্চক্ষে সে বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও দৃষ্টিপথ খুঁজে পাবে। নতুন করে বাস্তবতার ওপর আলাে পড়ায় রায়ান সে আলােতে তার কাজগুলােকে পুনরায় ভাগ করে নেবে । সে দরিদ্র ছেলেমেয়েদের দারিদ্র এবং অপচয়ের আড়াল থেকে বের করে এনে ওদেরকে অন্যের ওপর নির্ভরতার প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেবে । কিন্তু রায়ানের দুর্ভাগ্য যে তার উৎস সন্ধানরে অভিযানে শিকড় অনুসন্ধানের ভিন্ন যাত্রায় বাংলাদেশে কিছুকাল কাটাবার সুবাদে সে ভিন্নমাত্রার রূঢ় বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করে দ্ব্যর্থহীনভাবে এক ধরনের অসহায়তা অনুভব করে। সে এত নির্দিষ্টভাবে অভিজ্ঞতা শােষণে ব্যস্ত থাকে যে সে সময়ে দৈনন্দিন ঘােরাফেরাতেও তার অসুবিধা হয় । অসন্তোষ তার মনের মধ্যে অস্থিরতার জন্ম দেয়, তাকে পীড়া দেয় যখন সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে আশা আকাঙ্ক্ষা মেলাতে না পারে। সামাজিক লােকাচারে বিভ্রান্ত ও অপ্রস্তুত রায়ানের ভ্রান্তি নিরসন হয় যখন সে নিষ্ঠুর বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। বাস্তবিকপক্ষে রায়ান কখনাে বাংলাদেশর নিত্যদিনের বিক্ষোভ, আন্দোলন, তুমুল বিশৃঙ্খলা আর কোলাহলের সাথে একদমই খাপ খাওয়ায়ে নিতে পারেনি, অন্তত শেষের কয়েকটি মাস। দিনের পর দিন নৈরাশ্য ও বিমর্ষতা রায়ানের অস্তিত্বকে গ্রাস করেনিতে লাগে ক্রমশ । তাতে | সে আরও অস্থির ও হতাশ হয়ে পড়ে। রায়ান এমনই একজন লােক যে তার মস্তিস্ককে বিশ্রাম দিত না। সে আন্তরিকভাবে তার বিশাল জ্ঞানের সংগ্রহ এবং পশ্চিমা বিশেষ জ্ঞান” তার জন্মদেশকে দিতে চেয়েছিল, “কিছু ফেরত দেবার, কিছু একটা করবার তীব্র বাসনায়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, রায়ানের প্রচেষ্টা ফলবতী হয়নি বলে রায়ান আরও দমিত ও মর্মপীড়িত হয়ে ভেঙে পড়ে। মাঝখানে আটকে গিয়ে ঘটনাবলি যেমন প্রকাশ পেল, তাতে কেবল বিরক্তির উদ্রেক লক্ষণীয় ছিল। তার মনের এক অংশ বলে: “কিন্তু রায়ান তুমি জানাে যে জীবন হলাে অনেকগুলাে ঝড় ও বিভ্রান্ততার সংযুক্তি । তুমি আগে রােদ, বৃষ্টি, ঝড় • নিরাপদে অতিক্রম করেছ, এখন পারছ না কেন?
কিন্তু, মনে রেখ, প্রত্যেকটা ঝড়ই যে আলাদা ধরনের  কখনাে কখনাে তােমার নৌকা চলে গেলে আর ফিরে আসে না।” আবার, হতাশার এক বিশেষ মুহূর্তে তার উদাসীন মনের আরেক অংশ তাকে পুনর্বার চিন্তা করতে বলে: “আমি জানি না আমার বিবেক সকল যুক্তির সহায়তা দিয়ে আমার যে পরিবর্তন প্রয়ােজন সেটা ঘটাতে পারবে কি? কিন্তু আমার অভিসন্ধি কল্যাণকর। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি দৃষ্টান্তভাবে নৈতিক, মানবিক এবং পরিবেশ বিষয়ক উদ্ধৃষ্টতা অর্জন করতে পেছনের দিকে তাকিয়ে প্রায় ১৭ বছর পরে রায়ান বলে, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ তার পুরাে বছরটা ছিল সংঘাতময় । যদিও আগাগােড়াই বাংলদেশে ভালাে কিছু কাজ করার ইচ্ছা ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে কোনাে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার মতাে জ্ঞান বা শক্তি তার ছিল না। বাস্তবমুখী, সুনির্দিষ্ট এবং ব্যবহারযােগ্য মানবিক উন্নয়ন লক্ষ্যের একটি উদ্যোগও রায়ান নির্বাচন করতে পারেনি যার ভিত্তিতে উন্নয়ন কাজ করা যেত। নিঃস্বন্দেহে রায়ান মনেপ্রাণে অন্তরের অন্তস্থল থেকে চেয়েছিল তার জন্মভূমিতে “একটা কিছু করতে; কিন্তু প্রতিবারই সে যেন এক রূপকশােভিত দেয়ালে মাথা খুঁড়ে অসহায়ের মতাে ফিরেছে। আর সে থেকেই রায়ানের স্বপ্নভঙ্গ: স্বপ্নের সংঘর্ষ বনাম বাস্তবতা, কঠোর বাস্তবতার প্রাধান্য যেখানে ছিল অনেকাংশে বেশি।
বস্তুতপক্ষে রায়ান বাংলাদেশের জন্য যে স্বপ্ন দেখেছিল সে সেটা ধারণাবদ্ধ করতে পারেনি। এমনকি এটা যে কেমন হবে তার রূপরেখাও টেনে দেখায়নি। আমরা দেখেছি জন্মদেশ সম্পর্কে তার একটা হাসিখুশি ভালাে লাগা ছবি আঁকা ছিল মনের কোথাও। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে স্বপ্ন আবার কোনাে কোনাে বিবেচনায় অতি সংক্ষিপ্ত । তার নিজের স্বপ্নিক দৃষ্টিপথ এবং সরকারের নিজস্ব দূরদৃষ্টি দানা বাঁধতে পারেনি, ফলে সে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। প্রায়ই ওটা রায়ানকে অলস ভাবনায় ডুবিয়ে রাখে। অনেকটা নাটকীয়ভাবেই যেন হ্যামলেটের দীর্ঘসূত্রিতায় তাকে ভুগিয়েছে। ভাগ্যহীন রায়ান অসহায়ে একটা কিছু করার অপেক্ষায় থেকেছে দিনের পর দিন। বাংলাদেশে কয়েক মাস কাটানাের পরে রায়ান অনুধাবন করে যে, যদিও বহু ভালাে মানুষের আনাগােনা ছিল তাকে ঘিরে যেহেতু লােকজনগুলােও তার মতাে দেখতে, পরিবেশটা কিন্তু সবসময় ছিল সংঘাতপ্রবণ । মানুষের মধ্যে মনস্তাত্তিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য ছিল বিকট।
 নৈরাশ্যের সে সময়গুলাের স্মৃতিচারণে রায়ান আরও বলে, বাংলাদেশে প্রথম দৃষ্টিতে তাকে সবাই ধরে নেয় যে, সেও তাদের মতােই একজন ওরা যেন পরস্পর আত্মীয়। কিন্তু বাস্তবের চেহারা ও তার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চলা-ফেরা যে কত ভিন্ন সেটা তাদের কারােরই বােধগম্য হয়নি। স্বভাবতই নিজের সচেতন তার তাগিদে রায়ান নিজেকে আরেকজন বহিরাগত হিসেবেই দেখেছে। তখন সে এক অসহনীয় অবস্থায় পেয়ে ইচ্ছা করেই যেন নিজেকে গুটিয়ে নেয় । শান্তি ও স্বস্তির বদলে সে অন্তরে তােলপাড় অনুভব করে। “জনারণ্যে আমি আরও দশজনের মতােই। বাংলাদেশে আমাকে স্থায়ীয় মানুষ হিসাবে সব জায়গাতেই তারা তাদের একজন ভাবে। আমার বংশানুগতির উপাদান (genus) বাঙালি, মস্তিস্ক (brain) কানাডীয় । আমি পূর্ব পশ্চিম দুদিকের বিরূদ্ধেই অবরুদ্ধ । এ সত্যকে মেনে নিয়ে ও মানিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া বাস্তবিকপক্ষে কঠিন,” কথাগুলাে রায়ান তার বাবা-মায়ের কাছে এভাবেই ব্যক্ত করেছিল । একেক সময় তার মনে হয়েছে সে যেন তার কানাডীয় সক্ষমতা এবং সংস্কৃতি, দুটি যেন হারিয়ে ফেলতে চলেছে । ঐ সব সময়ে সে যেন আরও বেশি বাঙালি হতে চেষ্টা করত।
রায়ানের সমস্যার কোনাে ঘাটতি ছিল না। প্রত্যেক মাসেই ওর স্বাস্থ্য এবং মানসিক অবস্থার অবণতি ঘটতে তাকে। যখন বাংলাদেশে তার এক বছর হয়ে আসছে, ২৬ বছরের রায়ান আবারও তার বাবা-মাকে তার স্বাস্থ্যের দুর্গতি সম্পর্কে জানায়: “প্রত্যেক মাসেই আমাকে একটা কিছুর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। এটা যদি ঠান্ডা না হয়, তাহলে নির্ঘাত ত্বকের নিচে কিছু | একটা ঠেলে উপরে উঠছে। যা হােক, আমার মনে হয় মা তােমরা আমার স্বাস্থ্যের লম্বা
সমস্যার লিস্ট শুনতে অত আগ্রহী হবে” । স্পষ্টত ভগ্নহৃদয়ের এক চরম মূহুর্তে রায়ান চিঠিটা। লিখেছিল।
দিন যত যেতে থাকে রায়ানের মনে হতে লাগে যেন সে সেক্সপিয়ারের একটা বিয়ােগান্তক। নাটকের চরিত্র যে ছটফটানি, অস্থিরতা ও পদচারণ করে কিছুই অর্জন করতে পারেনি। রায়ান নিজেকে জিজ্ঞাসা করে: “আমি এখানে কী করছি ? আমার মনে হয় আমি অন্ধ হয়ে। যাচ্ছি। আমি রােমান্টিক শান্তি চাই । অথচ আমি বিয়ােগান্তক নায়কের মতাে অনুভব করছি। আমার বিশ্ব হলাে একটি মঞ্চ । আমিই অভিনেতা । আমি, এত একা!” অনেকবার রায়ান এক রকম ভয়ানক একাকিত্ববােধ করেছে যখন তার চারদিকে অসংখ্য মানুষ। আবার সে যতই বাংলাদশের বাস্তবতাকে বুঝবার জন্য আপনাকে নিযুক্ত করেছে, ব্যাপারটা ততই তার কাছে। বাের্ধতীত মনে হয়েছে। অতিরিক্ত দায়বদ্ধতা থেকে সেবাসুলভ কঠোর শৃঙ্খলাবােধের মধ্য দিয়ে আসার পরও রায়ানের মনে হয়েছে যে, সে যতই চেষ্টা করুক না কেন কোনােভাবেই সে সফল হবে না । সে তার বুদ্ধি খাটাতে খাটাতে শেষ সীমায় পৌছেছে। এক সময়ে সে। দেখে যে সে অত্যন্ত বিচলিত এবং হতভম্ব। সে বলে সে অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কিছুতেই। কিছু হয়নি। এমনও হয়েছে যে সে নিজেই শক্তি সঞ্চারের মাধ্যমে সজিব হওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের সাথে কথা বলেনিজেকে উদ্দীপ্ত করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনাে কাজ হয়নি। যদিও সবচেয়ে লম্বা সফরেরও শুরু হয় একটি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে প্রবচনটির সাথে । রায়ানের পরিচিতি ছিল, তবুও সে তার অভিজ্ঞতার আলােকে বুঝতে পারে যে সেটা সম্ভব হবে না । বাংলাদেশে পুরাে বছরটা মধ্যে রায়ান মাঝে মাঝেই নিজেকে স্মরণ করাতে চেষ্টা করত তার। কানাডীয় মনােভাব “আমি ব্যক্তিগতভাবে সবই করতে পারি” এ কথাটি উচ্চারণ করে । আরেক রায়ান যার জন্ম ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পরপরই সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে তার জন্মদেশে একটা কিছু করতে। কিন্তু সে যতই চেষ্টা করুক, শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে সক্ষম হয় যে, সে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে পুরােপুরি ধারণ করতে পারেনি; এবং কখনাে পারবে না । তারপর রায়ান মােটামুটিভাবে অনুধাবন করে যে এ পর্যন্ত বৃথাই তার কানাডাতে শেখা। পশ্চিমা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কঠোর বাস্তবতায় কাজে লাগানাের চেষ্টা করেছে। বছর শেষ। হতে না হতেই প্রাণােচ্ছল রায়ান মর্মাহত হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সে যতই ভাবুক না । কেন, বাংলাদেশে কী ঘটেছে এবং ঘটছে সে ততই বাংলাদেশের লােকের থেকে দূরে সরে  যাচ্ছিল, “আমার জ্ঞান এবং দক্ষতা এত অল্প এবং সামন্য যতটুকু থাকুক না কেন, আমি দৌড়াই, আমি লুকাই। স্কুলে ফেরত যাই। আরও অভিজ্ঞতার কাছে যাই । জ্ঞানের উৎসের। কাছে যাই”।
অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন এবং বিপদের মধ্য দিয়ে রায়ান বাংলাদেশে একটানা এক বছর। অবস্থান করেছিল । নিষ্ঠুর বাস্তবতা ছিল তার অভিলাষের বিপরীত এক অবর্ণনীয় নিরাশার মানুষের পরস্পরবিরােধী যুক্তি, অসঙ্গতি এবং কপটতা দেখে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমি এত অসুস্থ মনে হয় সারা বিশ্ব অসুস্থ” । স্পষ্টবাদী রায়ান কথাগুলাে লিখেছিল তার বাবা-মাকে জানানাের জন্য এ আশায় যে তাতে হয়তাে তার মনােজ্বালা কিছুটা লাঘব হবে।
নিঃসঙ্গতা আর নিরানন্দের সাথে কোনাে একসময় কাটানাের মূহূর্তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিন্তু | প্রচন্ডভাবে অসন্তোষ্ট রায়ান উপলব্ধি করে যে সে যেন সামনেই, অতি নিকটে, অশুভ সংকেত দেখতে পাচ্ছিল। আমি ভবিষ্যৎ দেখেছি। যা দেখেছি আমার ভালাে লাগে নাই। সামনে দুঃস্বপ্নের রাত্রি । নাকি এসে গিয়েছে?
যখন রায়ানের নানা কিছু করার অন্তদৃিষ্টি ছিল, তখন প্রকৃতপক্ষে তার নিজস্ব কোনাে সম্পদ, পদ্ধতি বা বাস্তব জ্ঞানও ছিল না। তবে হ্যা, তার মনের মধ্যে ধারণা ছিল যে সে কিছু | একটা করতে চায় । রায়ানের প্রকল্পটা যে অবাস্তব, সেটা অনেকটা অতি পরিচিত প্রবচন | অনুযায়ী “গাছের অন্বেষণে বন দেখতে না পাওয়ার মতাে।” আনুপুঙ্গিক বিষয় খুঁজতে গিয়ে সম্পূর্ণ বিষয়টি দৃষ্টিগােচরে আনতে পারেনি। সে কি উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপালাে? সে | কি ভুল পথ অবলম্বন করল? অনিশ্চিত রায়ান নিজেই প্রশ্ন করে দিনের পর দিন । বিলম্ব হলেও সে শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল যে, সে সুস্পষ্টভাবে তার দৃষ্টিপথের রূপরেখা তৈরি করতে পারেনি । এমতাবস্তায় রায়ান একটি ধারণা নিতে চায় যে তার (অবাস্তব) প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হলে ক্ষতির পরিমান কতটুকু হবে। তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে তার পরিণতি কী। হবে। বিপুল প্রতিভার অধিকারী হয়েও সে সময়ে এক উভয়সংকটে পড়ে ভাগ্যহীন রায়ান যে। কোনাে সিদ্ধান্তেই সহজে উপনীত হতে পারেনি।  আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, রায়নের কথাগুলাের মধ্যে কিছুটা সামঞ্জস্যতাহীনতা রয়েছে। অনেকবার হতাশাগ্রস্ত হয়ে সে বলেছে যে, বােধহয় কখনই বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে  সে বিলীন হতে পারবে না; এবং সেক্ষেত্রে তার কোনাে অবদানও থাকবে না। কিন্তু আমরা | একই সাথে দেখতে পাই যে, সে দৃঢ়সংকল্প নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যায় সামনের দিকে | এগুনাের জন্য। সাধারণের চেয়ে উপরে উঠবার জন্য সে পরিশ্রম করে চলছে – বর্তমান | পরিস্থিতির সব বাধা অতিক্রম করে তার লক্ষ্যে পৌছাবার জন্য। রায়ান তার অবচেতন মনে ও দেহে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা করে। কিন্তু দেখা গেল অগ্নিগর্ভ রায়ানও তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রায়ান যে কীভাবে প্রতি পদক্ষেপে কষ্ট পাচ্ছিল সেটা রায়ানের ই-মেইল-এ | প্রতিফলিত হয়েছে। সে খেয়াল করে যে তার নিজের ক্ষমতার সে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি। আর দেশটা এমন যেন গল্পের চেয়েও আজবতর। সে নিজেকে প্রবােধ দিয়ে বলে যে, তার জন্মদাত্রী মা বাংলাদেশের মেয়ে, এমন দেশ যার ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি ঋদ্ধ বলে | খ্যাতি রয়েছে অঞ্চলে। তথাপি মনের গভীরে সে অনুভব করে যে বিচিত্র জনতার থেকে বহু দূরে কোথাও তার স্থান। পুরাে অবস্থাটা কানাডীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে রায়ান বারবার | নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছে: কেমন করে সে নিজের জন্য একটি কাজের ভূমিকা তৈরি করতে পারে এদেশে?
তার চিঠিগুলাে পড়লে সহজেই মনে হবে যে, এত হতাশা সত্ত্বেও রায়ান তার করতে পারি। দৃঢ়সংকল্পে অটল থাকার চেষ্টা করেছে সর্বক্ষণ। একপর্যায়ে দেখা গেল হতভাগা রায়ান কেবল তার আত্মপীড়নকে এক নাটকীয় অবস্থায় নিয়ে আসে। অনেকটা স্ববিরােধী মনে। হলেও বিষয়টি মােটেই সত্যবর্জিত নয় এজন্য যে, একদিকে রায়ান যে পরিস্থিতিতে পড়েছিল তাতে নিদারুণভাবে হতাশ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে সে অঙ্গীকার করেছিল যে সে কখনাে হাল ছেড়ে দেবে না। একের পর এক বিপদ গেলেও রায়ান কখনাে হাল ছাড়েনি।
বাংলাদেশি শিকড়ের সঙ্গে বােঝাপড়া করতে এসে কানাডাতে বড় হয়ে ওঠা রায়ানকে দেখে মনে হয়েছিল তখন তার জীবনটা যেন অনেকগুলাে নগরে ঝুলে আছে। প্রথম এবং সবচেয়ে মজবুত বাঁধন হলাে ডরিন ও ডেইল গুডের শর্তহীন ভালােবাসা যা তাকে এবং তার বােন। রাশােনাকে জীবনে কঠোরতম কষ্টের ভেতর দিয়েও অনায়াসে চলে যাবার প্রশিক্ষণ ও শক্তি দিয়েছে (যেন তাদের নিজের ছেলেমেয়ে)। সে ভালােবাসা ও বন্ধন এমনই গভীর যে, তার। বাংলাদেশ অভিযানে চরম হতাশার মধ্য দিয়ে যাবার সময় সে তার বাবা-মায়ের কাছে লিখেছে তার সমস্যাদির কথা। অন্য কারাের কাছে লেখার কথা ভাবেনি। সারাজীবন যাদের সাথে কাটিয়েছে তাদেরকেই সে জানে তার বাবা-মা হিসেবে। যেহেতু গুড দম্পতি কানাডীয় সমাজ জীবনে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীভূত, তাদের ছেলে হিসাবে রায়ানও উপলব্ধি করে যে সে তাদেরই মতাে প্রগাঢ়ভাবে সমীভূত। শেষ পর্যন্ত যেহেতু গুড দম্পতিরা তাকে বাংলাদেশ। উৎস অনুসন্ধান করার জন্য যাবতীয় সুযােগ করে দিয়েছেন, এর পর শিক্ষা আর অপূর্ণ থাকে কি? নিজেকে আবিষ্কারের জন্য কলম্বাসের মতাে রায়ান বিশ্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার বাড়ি (কানাডা) ফিরে গেল ।
রায়ান যে নিজের জন্য জায়গা খুঁজে পেল না বাংলাদেশে, তাতে কোনাে কিছু প্রমাণ হয় না। বাংলাদেশের জন্য রায়ানের ভালােবাসা কমে গেল, এটা মনে করারও কোনাে কারণ নেই। রায়ান এক বছর বাংলাদেশে থাকার সময় তার ভালােবাসা প্রমাণ করেছে আনুষ্ঠানিকভাবে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার মাধ্যমে, যেটা সে না নিলেও পারত । ঐ সময় তাকে বলা হয়েছিল জন্ম সনদে তার মধ্য নামের বানানটি ভুল। সেটা ছিল বাথল যেটা হওয়া উচিত। ছিল বাদল । রায়ান মনে রেখেছিল বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নেবার সময় । তখন রায়ান ওর নামের ভুল বানানটি (বাথল) শুদ্ধ করে বাদল করে নেয়।
রেমন্ড প্রভঁশের-এর বিখ্যাত ২০০৩ সালের ডকুমেন্টারি ওয়্যার বেবিজ-এ রায়ান একটি চরিত্র । রায়ান মার্টিন নামের ফরাসিভাষী ককেশীয় মেয়েকে বিয়ে করেছে। ওদের দুটি সন্ত নি, ক্যালিন ১২ এবং ক্যাডেল ৯, ওরা সকলেই কিচেনার অন্টেরিও’তে বাস করে। বিগত বছরগুলিতে রায়ান কিচেনার এলাকায় কাজ করেছে। ওখানে তার একটি পানশালা রয়েছে নাম ‘চেইনস’। আর একটি প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। ৪০ জন কর্মী তার সঙ্গে কাজ করে। মার্টিনের ফরাসিদেশীয় শিকড় এবং আরও কিছু অনন্য গুণাগুণ ওদের পরিবারের আর্কষণ বাড়িয়েছে। মার্টিন যে তাদের পরিবারের বৈচিত্রতা নিয়ে এসেছে সেজন্য মাটিনকে রায়ান ও তাদের বাবা-মা সাদরে গ্রহণ করেছেন। আজ তারা এক উচ্ছল জীবন ভােগ করছে। কানাডার মাটিতে তবে রায়ান অনেকবারই বলেছে যে, সে কখনাে বাংলাদেশ ভুলেনি, ভুলতে পারবে না ।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!