You dont have javascript enabled! Please enable it! বৈকালীর যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
বৈকালীর যুদ্ধ

মুজিব-ভূট্টো বৈঠক ব্যর্থ, মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক ব্যর্থ, পাকিস্তানী এমএনএরা সব ঢাকা ছেড়ে চলে গেল। বাংলাদেশে সর্বত্র চলছে দূর্বার প্রতিরােধ, ২৫শে মার্চের কাল রাত্রিতে পাকহানাদারবাহিনীর আক্রমণ ঢাকাকে করেছে তছনছ আর রক্তাক্ত । সর্বত্র একই কথা, একই শ্লোগান-বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর; পাকিস্তানে লাথি মারাে বাঙলাদেশ স্বাধীন কর, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি। ইতিমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্নস্থানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর শহর শাখার প্রধান মির্জা খায়বার হােসেন ও তার বাহিনী দিনরাত পরিশ্রম করছে। খায়বার হােসেনের নিজস্ব জীপখানা এই সময় অত্যন্ত কাজে লাগে। জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী অবিরাম পরিশ্রম করে ঢাকার নির্দেশ মতাে শেখ কামরুজ্জামান টুকু গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী এক বাহিনী। এসব ছাড়াও আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র-শ্রমিক, দোকানদার, রিক্সাওয়ালা, মুটে-মুজুর সবাই আজ একদল, একপ্রাণ-আর নয় অধীনতা, এবার চাই স্বাধীনতা। খুলনা শহরের অদূরে বয়রা। বয়রায় তখন ব্যাপক প্রস্তুতি, যশাের রােড দিয়ে যদি পাকসেনারা কুলনাভিমুখে অগ্রসর হয় তবে প্রতিরােধ করবে। বয়রা তখন আওয়ামী লীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্রলীগের দুর্গে পরিণত হয়েছে। ২৭ মে মার্চ হঠাৎ খবর এল যশাের সেনানিবাস থেকে বিরাট এক কনভয় খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সাথে সাথে নােয়াপাড়া, ফুলতলা ও দৌলতপুরের সাথে যােগাযােগ করে তাদের প্রতিরােধ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।

নােয়াপাড়া থেকে সেনাবাহিনী যাতে কোন প্রকারে খুলনা শহরে প্রবেশ করতে না পারে তজ্জন্য যশাের রােডের উপর গাছ কেটে ফেলা হল, ইট যােগাড় করে ব্যারিকেড দেয়া হল এবং দু’তিন জায়গায় কালভার্ট ভেঙ্গে গাছপালা দিয়ে ঢেকে দেয়া হল। নােয়াপাড়ার ছাত্র-শ্রমিক-জনতা মিলে যে ব্যারিকেড দিয়েছিল সেনাবাহিনীর কনভয় সে সব উপেক্ষা করে রাস্তার ব্যারিকেড পরিষ্কার করে চলে আসে ফুলতলায়। এ্যাডভােকেট কাজী আবদুস সালাম, কাজী তাবারক হােসেন (তাবু কাজী), থােকন কাজী সহ অন্যান্য শত শত লােক একত্রিত হয়ে বেজের ডাঙ্গা সরদার বাড়ির কাছে ফুলতলা বাজার থেকে বালিকা বিদ্যালয় পর্যন্ত ব্যারিকেড দিয়েছে। ইতিমধ্যে ফুলতলা থানার ওসি হাবিবুর রহমান কাজী আঃ সালাম ও তাবু কাজীর নিকট ৩০টা রাইফেল ও কয়েক বাক্স গুলি দিয়ে দেন। সেনাবাহিনী ক্রেন সহ ফুলতলায় আসে, শুরু হয় যুদ্ধ। ফুলতলা ব্যাংকের একজন দারােয়ান বন্দুক দিয়ে গুলি চালাতে থাকেন এবং তারই গুলিতে তিনজন খানসেনার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিন্তু খানসেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে এই বীর মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। থানার ওসি হাবিবুর রহমান ও তাঁর পুলিশ বাহিনী এবং যুগনী পাশারু মুসা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে। কিন্তু সেনাবাহিনীর উন্নত অস্ত্রের কাছে প্রতিরােধ ভেসে যায়। ফুলতলার মন্দিরে ঢুকে তারা ভরত ফার্মেসীর মালিক ডাঃ মনিন্দ্রনাথকে হত্যা করে এবং গুলি করতে করতে খুলনাভিমুখী রওয়ানা হয়।
অধ্যাপক আবু সুফিয়ান দৌলতপুরের রেলী গেটে তখন আর এক শক্তিশালী ব্যারিকেড গড়ে তুলেছেন। আবু সুফিয়ান তখন দৌলতপুরের অবিসংবাদিত নেতা। তার নেতৃত্বে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা গড়ে তুলেছে আর এক প্রতিরােধ দুর্গ। কিন্তু পাককনভয় নােয়াপাড়া ও ফুলতলায় বাধাগ্রস্ত হয়ে অতি সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল, তারা ফুলবাড়ি গেট অতিক্রম করে ধীর গতিতে আসছিল। কিন্তু দৌলতপুরের প্রবেশদ্বারে রেলী গেটে(বর্তমানে আবু সুফিয়ান গেট) এসে ব্যারিকেড দেখে নেমে পড়ে এবং ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলে ফের রওনা হয়। দৌলতপুর মােড় অতিক্রমকালে দৌলতপুরের এক তরুণ হিডি এই কনভয়ের উপর ২২ বাের রাইফেল দিয়ে এক দালানের ছাদ থেকে পর পর কয়েকটি গুলি করে, আহত হয় পাকসেনাদের কয়েক জন, শত্রুর রক্তে দৌলতপুরের রাস্তা রঞ্জিত হয়। এদৃশ্য ও ঘটনা দৌলতপুর তথ খুলনাবাসীর মনে বেশ অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। হিডির এ সাহসী আক্রমণ যুবকদের আরাে সাহসী করে তােলে। বৈকালীর মােড়ে মল্লিক সুলতান আহমেদ দাঁড়িয়ে। এমন সময় ১৩জন রিজার্ভ পুলিশ অস্ত্র নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে তার সাথে দেখা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানতে পারেন যে, তারা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে নেমেছেন। তখন তিনি আলােচনাক্রমে তাদের পূর্ণ সাহায্য সহযােগিতার আশ্বাস দিয়ে বৈকালী সিনেমা হলের ভিতর ৫জন, পাবলিক লাইব্রেরীর কাছে ৪ জন ও অন্য ৫ জনকে আরেক স্থানে পজিশন দেন। মল্লিক সুলতান আহমদের নির্দেশক্রমে বেবীট্যাক্সি ড্রাইভার মােসলেম বৈকালী সিনেমা হলের তালা ভেঙ্গে রিজার্ভ পুলিশের থাকারও ব্যবস্থা করেন।
প্রায় বেলা ১২টার দিকে পাকসেনাদের কনভয়ের ৩/৪ টা গাড়ি গােয়াল খালি অতিক্রম করলে, নগর আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান মীর্জা খায়বার হােসেন খবর পেয়ে সকলকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। এক দল আশ্রয় নেয় বৈকালী সিনেমা হলের ভেতর, অন্যদল খুলনা বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরীর ভেতর। মীর্জা খায়বার হােসেন, এ্যাডভােকেট মঞ্জুরুল আলম, শেখ দবিরুল ইসলাম, মীর্জা আফজাল হােসেন, তবারক মােল্লা, আবু জাফর জফা, শেখ হিসাম উদ্দীন, শেখ কুতুব উদ্দীন, শেখ সালাম উদ্দীন, শেখ সারােয়ারু উদ্দীন, মুজাম্মির, খিজির আলী, দুলু কাজী, হাবিবর রহমান, খবীর জিন্না, বাবু খােকন, শেখ নূর মােহাম্মদ, ওয়াদুদ, মােহাম্মদ আলম , শেখ আব্দুল গাফফার, কালিপদ, মাে: নুরুল হক, পুলিশের সিপাহী মুফাজ্জল মুন্সি, পুলিশ ও আর্মির প্রাক্তন সদস্যসহ ৫০/৬০ জন মিলিত ভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে পাককনভয়কে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইতিমধ্যে পাকসেনাদের তিন চারটি গাড়ি এসে যায়। সাথে সাথে শুরু হয় রাইফেল ও বন্দুকের গুলি। পাকসেনারা বিপদ দেখে যশাের রােডের পূর্ব দিকে দ্রুত নেমে পড়ে পজিশন নেয় এবং বৈকালী সিনেমা হল লক্ষ্য করে শুরু করে ব্যাপক গােলাবর্ষণ। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও কম যায় না, তারাও বেপরােয়া হয়ে গােলাগুলি আব্যাহত রাখে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকসেনারা মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে বৈকালী সিনেমা হলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকসেনাদের একমাত্র টার্গেট তখন বৈকালী সিনেমা হল। কারণ, ওখান থেকেই বেশি গােলাগুলি তাদের দিকে আসছিল। পাকসেনারা বৃষ্টির মতাে গুলি করতে থাকে। ফলে সিনেমা হলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পক্ষে আর কোন মতে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাবলিক লাইব্রেরী ও বয়রা গার্লস কলেজের ভিতর থেকে তখন শুরু হয় আক্রমণ।
খানসেনারা তখন পাবলিক লাইব্রেরী ও মহিলা কলেজের দিকে আক্রমণ শুরু করে, খানসেনাদের লক্ষ্যে অনেক বােমা ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সেগুলাে তেমন কাজে আসেনি। ঐ সময় একজন স্বেচ্ছাসেবক এক ঝুড়ি বােমা মাথায় করে বিড়ি খেতে খেতে দ্রুত এ্যাডভােকেট মঞ্জুরুল আলমের নিকট আসে। মঞ্জুরুল আলম তাকে বিড়ি খেতে দেখে ধমক দিলেন, কারণ আগুনে নিজেদেরই বিপদ হতে পারে। এলােপাথাড়ী বােমার লক্ষ্যহীন আক্রমণ চলে।  বয়রা মহিলা কলেজের সামনে ছিল প্রচুর ইটের গাদা, সি এন্ড বির এই ইটের ঢিবির পিছন থেকে একদল তরুণ কয়েকটা আক্রমণ চালায়। খানসেনাদের একজন নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। এই সময় পুলিশের সিপাহী মুন্সি মুজাম্মেল হক এক ইটের গাদা থেকে অন্য এক ইটের গাদায় যাওয়ার সময় পাকসেনাদের এক জোয়ান তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। নিশানা ছিল অব্যর্থ, তাই সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ে এই অকুতােভয় যােদ্ধা। বিকেল ৪টা পর্যন্ত দু’পক্ষ ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। খানসেনাদের আরাে ২০/২৫ টি গাড়ি চলে আসে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটে যায় আর খানসেনারা চলে যায় খুলনা শহরে। এই যুদ্ধে এইচ এন্ড পুদ্দার কোম্পানীর একজন শ্রমিকও মারা যায়। তার নাম মুন্সি রাঙ্গা মিঞা। যুদ্ধ শেষে আজকের যুদ্ধের বীর শহীদ বয়রা রিজার্ভ ক্যাম্পের সিপাহী পি আর এফ নাম্বার ১৩৪, মুন্সি মােফাজ্জল হককে যথারীতি বাজারে দাফন করা হয়। এই শহীদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার মুকছেদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে। তার আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে বয়রাবাসী স্মরণ করবে।
বয়রা যুদ্ধের পরদিন ২৮শে মার্চ খুলনা থেকে কয়েক গাড়ি মিলিটারী এসে বয়রা এলাকায় ব্যাপক জ্বালানাে-পেড়ানাে শুরু করে। স্থানীয় জনসাধারণের অনুরােধে এলাকার ক্ষয়ক্ষতি ও জানমালের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রতিরােধ না করে পিছু হটে যায়। তারা ফুলতলায় যায় এবং আবু কাজী ও খােকন কাজীর বাড়ি লুট করে, পুড়িয়ে দেয়। এই সময় পাকসেনাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় সরাে মােল্লা, হাবিবুর রহমান। (পরবর্তীতে রাজাকার কমান্ডার), সৈয়দ মােল্লা, ওহাব মহলদার প্রমুখ। বয়রা যুদ্ধের ফলাফল যা-ই হােক না কেন, এই যুদ্ধ এতদ্বঞ্চলের লােকজনের দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সামান্য ক’টা বােমা, রাইফেল, বন্দুক নিয়ে দুর্ধর্ষ খানসেনাদের গতিরােধ করা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বৈকালীর যুদ্ধ তাই খুলনার স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। মীর্জা খায়বার, এ্যাডভােকেট মঞ্জুরুল আলম, মল্লিক সুলতান আহমেদ, শেখ দবিরুল ইসলাম, নূর মােহাম্মদ সহ অন্যান্য যযাদ্ধারা সেদিন যে সাহসিকতার নজির স্থাপন করেছে গােটাজাতির জন্য তা গর্বের বস্তু।
(সূত্র ঃ স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত