You dont have javascript enabled! Please enable it! ইউএফডি ক্লাব আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
ইউএফডি ক্লাব আক্রমণ

খুলনা খানজাহান আলী রােডে আলীয়া মাদ্রাসার সম্মুখে অবস্থিত কবীর মঞ্জিল। এই বাড়ির অন্যতম মালিক জনাব হুমায়ুর কবীর আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। তিনি যেমনি সাহসী, তেমনি উদ্যোগী এবং আসন্ন মুক্তিসংগ্রামে যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত অথচ চেহারা, ছবি ও লেবাসে প্রথম দর্শনে তাকে জামাতের কর্মী বলে মনে হবে। তাই এই স্থানে গােপন বৈঠকের এক পরিকল্পনা করলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। আরাে সুবিধা, এখানে টেলিফোন ছিল, বিনা বাধায়, বিনা বিলে টেলিফোন যােগাযোেগ এক মস্ত বড় সুবিধা। কবীর মঞ্জিলে’ তাই আমাদের বৈঠকের আদর্শস্থান বলে সকলে অভিমত ব্যক্ত করল । কবীর মঞ্জিল আগামী দিনগুলােতে বিপ্লবী পরিষদের সদর দপ্তর হিসেবে বিবেচিত হবে। ২৭শে মার্চ সকালে অতি সতর্কতার সাথে একে একে টুকু ভাই, কাইয়ুম আমি সহ অন্যান্যরা মিলিত হলাম এবং আলাপ আলােচনার মাধ্যমে ঠিক হল যুদ্ধ। অনিবার্য। যুদ্ধ করার জন্য প্রয়ােজন অস্ত্র, রসদ, পরিকল্পনা, অর্থ ইত্যাদি। কিন্তু কে কিভাবে এই যুদ্ধ পরিচালনা করবে? তখনই প্রস্তাব হল নিয়মতান্ত্রিকভাবে সবকিছু পরিচালনার জন্য একটা Revolutionary council বা বিপ্লবী পরিষদ করা হােক। তখন সর্বসম্মতিক্রমে শেখ কামরুজ্জামান টুকুকে চেয়ারম্যান, ডাঃ আসিফুর রহমান, কে এস জামান, জাহিদুর রহমান জহিদ, শেখ আব্দুল কাইয়ুম ও আমাকে সদস্য করে এই বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হল। আরাে সিদ্ধান্ত হল যে, এই পরিষদ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সর্বোচ্চ পরিষদ হিসেবে বিবেচিত হবেন। এই পরিষদের সিদ্ধান্ত হবে চূড়ান্ত।

২৭ শে মার্চ সন্ধ্যায় হঠাৎ শেখ কামরুজ্জামান টুকু সিদ্ধান্ত নেন যে, খুলনা সার্কিট হাউজে ও তৎসন্নিকটস্থ ইউএফডি ক্লাবে পাকসেনাদের তাবুতে তিনি এক আক্রমণ পরিচালনা করবেন। আমরা তেমন কেউ ঐ সময় তার কাছে না থাকায় শেখ আব্দুল কাইয়ুম, ডালিম, জ্যোতিষ, বিনয়, তপনসহ তিনি এই দুঃসাহসিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উল্লেখ থাকা আবশ্যক যে, তপন, জ্যোতিষ ও বিনয় আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের তেমন সক্রিয় কর্মী না হলেও দেশ মাতৃকার এই প্রয়ােজনীয় সময়ে তারা আত্মদানের প্রস্তুতি নিয়ে টুকু ভাইয়ের সাথে যােগ দেয় এবং তারা শীঘ্রই শক্তিশালী বােমা, মলােটভ ককটেল প্রভৃতি অতি প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। সামান্য ১টা ২২ বাের রাইফেল, গােটা দুয়েক দেশি বন্দুক আর ওদের তৈরি বােমা ও ককটেল নিয়ে তিনি এ অভিযান পরিচালনা করেন খুলনা শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের এই সেনা ছাউনীতে। হাজী মহসীন রােড ও আলতাপােল লেন হয়ে দু’দলে বিভক্ত হয়ে দুটি দল ঠিক রাত ৮টায় মিলিটারীদের নৈশ ভােজের সময় এই ঝটিকা আক্রমণ চালান। ইউএফডি ক্লাব যশাের রােডের অতি নিকটে অবস্থিত হওয়ায় প্রথমে বােমা ও মলােটভ ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানাে হয় এবং পরে ২২ বাের রাইফেল এবং দেশি বন্দুক দিয়ে দমাদম গুলি করা হয় সার্কিট হাউজ ও ইউএফডি ক্লাবের খানসেনাদের ছাউনিতে। মুহূর্তের মধ্যে এলাকা একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পাকসেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে হাজার হাজার গুলি বর্ষণ করা হয়।

এই সময় যশাের রােডের এই অংশ দিয়ে দিয়ে কোন যানবাহন বা লােকজন চলাচল করত না কারণ খানসেনাদের শিবির এলাকা সবাই এড়িয়ে চলত তাই রাস্তাঘাট থাকত ফাঁকা। হাজী মহসীন রােডের বড় পাকা ড্রেনকে আশ্রয় করে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিট একাধারে গুলি চালাতে তেমন কোনই অসুবিধা হল না। কিন্তু এই ব্যাপক গােলাগুলির ফলে এলাকার জনগণ আতঙ্কিক ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে অস্ত্রশস্ত্রের চেয়ে দেশপ্রেম এবং সাহসিকতাই ছিল এই আক্রমণের মূল হাতিয়ার। অতর্কিত এই আক্রমণের জন্য খানসেনারা আদৌ প্রস্তুত ছিল না। ফলে বহু খানসেনা এই হামলায় আহত হয়। তাদের খাওয়া-দাওয়া ভন্ডুল হয়ে যায়, আর তাদের আর্ত চিৎকার বহু দূর থেকেও শােনা যাচ্ছিল। টুকু ভাইয়ের দেয়া সঙ্কেতের পর সবাই নিরাপদে ফিরে আসে। খুলনায় পাক মিলিটারীদের উপর এটাই ছিল প্রথম গেরিলা আক্রমণ।

(সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত