You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.04 | রাধানগর কমপ্লেসের লড়াই - সংগ্রামের নোটবুক

রাধানগর কমপ্লেসের লড়াই

বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে সকল সুদৃঢ় ঘাঁটি ছিল, ডাউকি থেকে পাঁচ মাইল অভ্যন্তরে জাফলং চা বাগানের সন্নিকটে রাধানগর কমপ্লেক্স তাদের অন্যতম। রণ কৌশলগত কারণে রাধানগরের অবস্থান ছিল অতিশয় গুরুত্ত্বপূর্ণ। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সীমান্তে শিলং-ডাউকি সিলেট সড়কের দু’দিক থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল। রাধানগরের পশ্চাতে ছােটখাল, তারপর গােয়েনঘাট, অল্প দূরেই অবস্থিত সারুটিকর বিমান বন্দর ও সিলেট শহর।  রাধানগর হাইস্কুলকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানীরা চারিদিকে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। পাকা কংক্রিট কুংকারগুলাের মধ্যে কমান্ড পােষ্টের যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। বেতার যন্ত্র, টেলিফোন সংযােগ ছাড়াও ক্রলিং ট্রেন্ডের সাহায্যে এক ব্যাংকার থেকে অন্য ব্যাংকারে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানীদের গােলন্দাজ সাহায্য (Artillery Support) ছিল প্রায় সুনিশ্চিত। এক কোম্পানী পাকিস্তানী সৈন্য ও কিছু রাজাকার রাধানগর স্কুল এলাকা, সুলতান মেম্বরের বাড়ি, ইসলামপুর বস্তি, মুরা বস্তি, কুমিল্লা বস্তি, কাফউরা ও ছােটখাল গ্রামে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বৃহ্য রচনা করে। ছােটখলা গ্রামেই ছিল পাকিস্তানীদের কমান্ড পােষ্ট তিন ইঞ্চি মর্টারের অবস্থান।  প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, মেজর শাফায়ত জামিলকে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল) মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হিলি সীমান্তের বাঙালপাড়ায় অবস্থানরত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে পদস্থ করা হয়। এখানে ক্যাপ্টেন আনােয়ার (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলের মাত্র ১৭৫ জন্য সৈন্যসহ অবস্থান করছিলেন। এছাড়া হিলি থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত প্রায় বিশটি যুব শিবির কাজ করছিল। কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রােডে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর রক্ষক মেজর সাফায়াত জামিলকে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল পূর্ণগঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়।

প্রায় একমাস কঠোর প্রশিক্ষণের পর মেজর শাফায়াত জামিল ১২০০ মুক্তিযােদ্ধা সমন্বয়ে পাঁচটি রাইফেল কোম্পানী গঠন করেন। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে হিলি থেকে প্রায় ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত তেলঢালায় যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। তেলঢালায় প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে লেঃ কর্নেল জিয়ার (পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল ও রাষ্টপতি) নেতৃত্বে ‘জেড ফোর্স’ গড়ে ওঠে। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ‘জেড ফোর্সের একটি ব্যাটালিয়ন হিসাবে রৌমারী’ বাহাদুরাবাদ, দেওয়ানগঞ্জ ও বক্সীগঞ্জে সফল অভিযান চালানাের পরে ১০ই অক্টোবর ৫৯টি ট্রাকে করে তােরা থেকে ৪০০ মাইল দূরবর্তী শেলাতে স্থানান্তরিত হয়। মেজর শাফায়াত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে তেলঢালা থেকে গৌহাটি হয়ে শিলং এবং শিলং থেকে শেলাপাহাড় এলাকায় এসে পৌঁছান ১২ অক্টোবর সন্ধ্যায়। চেরাপুন্দি থেকে ২৫ মাইল দূর শেলা পাহাড় এলাকা অবস্থিত। এই এলাকার পাঁচ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল) মীর শওকত আলীর আওতাধীন। ক্যাপ্টেন হেলাল ছিলেন শেলা সাব সেক্টর কমান্ডার। মেজর মীর শওকতের নির্দেশে ১৩ই অক্টোবর ছাতক আক্রমণ করা হয়। ছাতক অপারেশনের পরে ক্যাপ্টেন মুহসিন (পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার ও প্রখ্যাত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযােগে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত) ও ক্যাপ্টেন আকবরকে (পরবর্তীকালে লেঃ কর্নেল ও মন্ত্রী) শেলা সাব সেক্টর এলাকায় স্ব স্ব কোম্পানীসহ অবস্থানের নির্দেশে দিয়ে মেজর শাফায়াত জামিল ক্যাপ্টেন নুরুননবীকে (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) সঙ্গে নিয়ে রাধানগর কমপ্লেক্স আক্রমণ করে দখল করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭১। মেজর শাফায়াত জামিল ডাউকি সীমান্তে এসে পৌছলেন। এখানে রাত্রিযাপনের পরে সকালে ক্যাপ্টেন নুরুননবীকে তার কোম্পানী ও হেডকোয়ার্টার কোম্পানীকে লুনি গ্রামে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। লেঃ মনজুরকে আলফা কোম্পানী নিয়ে কাফাউরা গ্রামের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছেন। এখানে ইপিআর-এর সুবেদার মােশাররফের নেতৃত্বে আগেই মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এছাড়া লেঃ (অবঃ) মতিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি এফএফ কোম্পানী জাফলং চা বাগানের অপরদিকে পাকিস্তানীদের অবস্থানের মুখােমুখি প্রতিরক্ষা নিয়ে আছে। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন ফারুকের অধীনে এক কোম্পানী মুক্তিবাহিনী কাফাউরার বিপরীতে অবস্থান করছিল।

মেজর শাফায়াত ঐ রাতেই সমগ্র এলাকা রেকি করেন এবং রাতের অন্ধকারে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মােতাবেক ভােরের আগেই বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নেয়া হল। পরদিন বিকেল তিনটায় পাকিস্তানীদের একটি পেট্রোল পার্টি মুক্তিবাহিনীর এই অবস্থানের সম্মুখ দিয়ে সুরাগ্রামে যাচ্ছিল। পাকিস্তানীরা যখন মাত্র ৫০ গজ দূরে তখন সম্মুখের বাংকার থেকে মাখন ও সিপাই মুজিব উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলে, হ্যান্ডস আপ। পাকিস্তানী সৈন্যরা দ্রুত পাশের পায়ে হাঁটা রাস্তার ওপারে অবস্থান নিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। মাখন ও মুজিব গুরতরভাবে আহত হয়। এই ঘটনার পরে দুই পক্ষের গুলি বিনিময় চলতে থাকে। লুনিগ্রামে চারদিন অবস্থানের পরে ক্যাপ্টেন নবী দুয়ারী খেল, ছাত্তারগাঁ ও গােরাগ্রামে প্রতিরক্ষা বৃহ্য রচনা করেন। জাফলং চা বাগানের সম্পূর্ণ এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সূদৃঢ় হয়। এ সময় সি কোম্পানীর একটি প্লাটুন সুবেদার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং ই কোম্পানীর একটি প্লাটুন হাবিলদার সিদ্দিকের নেতৃত্বে। ক্যাপ্টেন নবীর সাথে যােগদান করে। ছাত্তারগাঁকে রক্ষা করার দায়িত্ব আলী আকবরকে দিয়ে ক্যাপ্টেন নবী শিমুলতলা গ্রামের ওপরে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হন। শিমুলতলা গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে গােয়েন ঘাট-রাধানগর সড়ক। সুতরাং এখানে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান পাকিস্তানীদের জন্য ছিল বিপদজনক। ২৬শে নভেম্বর রাতে ক্যাপ্টেন নবী শিমূলতলা গ্রামে রাধানগর-গােয়েনঘাট সড়ককে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। ঐ রাতেই ভারতীয় ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট রাধানগর আক্রমণ করে।
রাধানগরের পশ্চাতে ছােট খালে গুর্খাদের একটি কোম্পানী আক্রমণ চালায়। সুবেদার বদিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণে অংশগ্রহন করে। ভাের হয়ে আসছে—আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনী গােলাবর্ষণ শুরু করে। গুর্খাদের একটি কোম্পানী রাধানগর স্কুলে পাকিস্তানী সেনাদেরর অবস্থানে আক্রমণ করে। অপর কোম্পানিটি মুক্তিবাহিনীসহ ছােট খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে গুর্খা রেজিমেন্ট ও মুক্তিবাহিনী ছােট খাল দখল করে নেয়। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১৭ জন নিহত হয় এবং বহু সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। কিন্তু মাত্র ছয় ঘন্টা পরেই পাকিস্তানীরা প্রতি হামলা (Counter attack) করে। পৃথিবী বিখ্যাত গুর্খাদের পরাজয়ের পরে গােরা শিমুলতলা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর বারবার আক্রমণ আসতে থাকে। ২৭শে নভেম্বরেও পাকিস্তানীরা আক্রমণ চালায় কিন্তু মুক্তিবাহিনী নিজ অবস্থান অটল রাখে। সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত ছােট খাল আক্রমণ করার জন্য মেজর শাফায়াত জামিলকে নির্দেশ দেন। মেজর শাফায়ত জামিল ক্যাপ্টেন নবীর অবস্থানে এসে পৌছালেন। একই বাংকারে বসে ক্যাপ্টেন নবীর সঙ্গে যুদ্ধ পরিকল্পনা করেন। স্বাভাবিক কারণেই এই যুদ্ধ ছিল বাঙালি যােদ্ধাদের মান সম্মানের ব্যাপার। মাত্র একদিন আগে সাহসী যােদ্ধা হিসাবে খ্যাত গুর্খা রেজিমেন্ট পরাজিত হয়েছে। সুতরাং বাঙালিদের প্রমাণ করার সুযােগ এসেছে যে, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত। রাত তিনটা। বাংকারে বাংকারে যুদ্ধের আদেশ পাঠানাে হল। পূর্ব নির্ধারিত স্থানে সঠিক সময়ে সকল প্লাটুন ও পাকিস্তানীদের মােকাবিলা করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা হাজির হল। কামান্ডিং অফিসার স্বয়ং শাফায়াত জামিল এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন, সর্বাগ্রে তিনিই থাকবেন, একথা জানবার ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল শতগুণ বেড়ে গেল। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল।
২৮শে নভেম্বর রাতে এই ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বীর মুক্তিবাহিনী একসারিতে পাকা ধানক্ষেতের উপর দিয়ে চুপিসারে ৭০০/৮০০ গজ দূরে অবস্থিত শত্রুর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। মেজর শাফায়াত বাম দিকের অংশে মাঝামাঝি এবং ক্যাপ্টেন নবী ডান দিকের অংশের মাঝামাঝি থেকে নেতৃত্ব দেন। শত্রুর অবস্থান আর ৩০০ গজ সামনে। এমন সময় শাফায়াত জামিলের জয় বাংলা’ যেন সহস্রী এক কন্ঠ হয়ে উচ্চারিত হল। মুক্তিযােদ্ধারা অমিতবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানীদের ওপরে। গােরাগ্রামের ২টি মেসিনগান ও ১টি রিয়েলেস রাইফেল গর্জে উঠল। এক একজন মুক্তিযােদ্ধা যেন অশরীরী শক্তির অধিকারী হয়ে উঠল। পাকিস্তানীদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধ করে মুক্তিযােদ্ধারা ছােট খাল দখল করে নিল। * চারদিকে তখন রাক্তের স্রোত, পাকিস্তানীদের লাশের স্তুপ ও ফেলে যাওয়া অস্ত্র গােলাবারুদ। বিজয়ের আনন্দে দিশেহারা হয়ে ফেলে যাওয়া একটি নতুন স্টিল হেলমেট মাথায় দিয়ে দেখানাের জন্য মেজর শাফায়াতের কাছে দৌড়ে গেলেন। মেজর শাফায়াত আনন্দে হাসলেন, ঠিক এসময়ই হৃদয় বিদারক ঘটনাটি ঘটে গেল। ঘরে আগুন ধরানাে অত্যন্ত ভুল হয়েছিল, এটা বােঝা গেল যখন পাকিস্তানীদের গুলিবর্ষণে মেজর শাফায়াত কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সামান্য ভুলের জন্য এভাবেই খেসারত দিতে হয়।
মেজর শাফায়াতকে তােরা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আহত অবস্থায়ও তিনি তাঁর কর্তব্য ভােলেননি। ক্যাপ্টেন নবীকে পাকিস্তানীদের বিতাড়িত করার জন্য তিনি চিঠি লিখলেন। সৈন্যদের উৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়ে এই পত্রে পাকিস্তানীদের যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। সুরা বস্তি, ইসলামপুর বস্তি, কুমিল্লা বস্তি ও রাধানগর স্কুল দখলের জন্য আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। ৩০শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে গােয়ালঘাট পালিয়ে যায়। সমগ্র রাধানগর কমপ্লেক্স মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। মুক্তিবাহিনীর সব কোম্পানী কমান্ডারগণ তখন রাধানগর ব্রীজের ওপরে দাঁড়িয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে বিজয়ের গভীর আনন্দে। গুর্খা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধারা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল। আর এভাবেই এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী প্রচন্ড যুদ্ধের পরে পাকিস্তানী দুর্ভেদ্য ঘাঁটি রাধানগর কমপ্লেসের পতন হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত