You dont have javascript enabled! Please enable it!
ছাতক অপারেশন
হিলি সীমান্তে বাঙলাপাড়া নামক স্থানে ক্যাপ্টেন আনােয়ারের (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) নেতৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তৃতীয় ব্যাটালিয়নের (থার্ড বেঙ্গল) আনুমানিক ১৭৫জন সৈন্য অবস্থান করছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানকালে থার্ড বেঙ্গল পাকিস্তানী সৈন্যদের কর্তৃক আক্রান্ত হয়। বিদ্রোহ করে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বাঙলাপাড়া ক্যাম্পে সমবেত হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল) শাফায়াত জামিলকে থার্ড বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে পদস্থ করা হয়। কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রােডে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে মেজর শাফায়াত জামিলকে ক্ষতিগ্রস্থ থার্ড বেঙ্গলের অবশিষ্ট সৈন্যদের সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্থ থার্ড বেঙ্গলকে সংগঠিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। মেজর শাফায়াত জামিল বাঙলাপাড়ায় এসে থার্ড বেঙ্গলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। এই সীমান্ত এলাকায় প্রায় বিশটি যুব শিবির থেকে তিনি ১২০০ তরুণ মুক্তিযােদ্ধা, প্রাক্তন ইপিআর সৈন্য ও আনসার সংগ্রহ করেন। একমাসের কঠোর প্রশিক্ষণের শেষে পাঁচটি রাইফেল কোম্পানী সমন্বয়ে থার্ড বেঙ্গল পূর্ণগঠনের কাজ সমাপ্ত হয়। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে হিলি থেকে ৮০০ মাইল দূরে তেলঢালায় থার্ড বেঙ্গলকে স্থানান্তর করার নির্দেশ আসে। ১০ই জুন বিশেষ ট্রেন যােগে থার্ড বেঙ্গল তেলঢালার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে এবং ক্রমাগত চারদিন ভ্রমণের পরে ১৪ই জুন তেলঢালা পৌঁছায়। এইস্থানে প্রথম অষ্টম ও থার্ড বেঙ্গলকে নিয়ে লেঃ কর্নেল জিয়ার (পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল ও রাষ্টপতি) নেতৃত্বে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স গঠিত হয়।
থার্ড বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আনােয়ার। ‘বি’ কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল, সংসদ সদস্য ও এককালীন রাষ্ট্রপতি জিয়ার মন্ত্রীসভার অন্যতম মন্ত্রী)। সি’ কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মহসিন (পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার, রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযােগে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত)। ‘ডি’ কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন লেঃ নুরুননবী খান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) এবং ‘ই’ কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন ৯ই অক্টোবরে কমিশনপ্রাপ্ত লেঃ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর) মনজুর আহমেদ। থার্ড বেঙ্গল রৌমারী, বাহাদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ বাজার ও বকসীগঞ্জে সফল অভিযান চালানাের পরে ১০ই অক্টোবর (অস্পষ্ট) এক সুবিশাল কনভয়ে তােরা থেকে ৪০০মাইল দূরবর্তী শেলাপাহাড় এলাকায় আসে। মেজর শাফায়াত জামিল তেলঢালা থেকে গৌহাটি, গৌহাটি থেকে শিলং এবং শিলং থেকে শেলায় এসে পৌঁছান ১২ই অক্টোবর সন্ধ্যায়। শেলাপাহাড় এলাকা মেজর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেনারেল ও সংসদ সদস্য) মীর শওকতের ৫ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন। চেরাপুঞ্জি থেকে পঁচিশ মাইল পশ্চিমে শেলাপাহাড় অবস্থিত। ক্যাপ্টেন হেলাল (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল) শেলা সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। শিলং-এর সন্নিকটে বাঁশতলা ক্যাম্পে থার্ড বেঙ্গল অবস্থান গ্রহণ করে। সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত থার্ড বেঙ্গলকে ছাতক আক্রমণের নির্দেশ দেন। ঐ দিনই সমস্ত এলাকা রেডি করা হয়। এবং দিবাগত রাতে ছাতকের উপকণ্ঠে মহড়াটিলা দখল করা হয়। বামপাশে ক্যাপ্টেন আকবর জয়নগর টিলায় প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি টের পায় এবং তৎক্ষণাৎ সংঘর্ষ শুরু হয়। এখানে পাকিস্তানীদের একজন কর্নেল আহত, দু’জন অফিসার নিহত ও বহুসংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়।
ছাতক আক্রমণ করা হয় ১৩ই অক্টোবর রাত ৯টায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ছাতক অপারেশন মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহস ও বীরত্বের বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সিদ্দিক মালিক রচিত “witness to Surrender” গ্রন্থে ছাতক অপারেশনের সবিশেষ উল্লেখ ও মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পারদর্শিতার সাক্ষর পাওয়া যায়। সিদ্দিক মালিক তাঁর উল্লেখিত গ্রন্থে ১৬৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন – As elsewhere, the enemy had been active of this border since 15th October, when 85 Indian Border security force, supported by a battery of field guns and a battalion (3 East Bengal) of Mukti Bahini attack Chatak, with the apparent aim of capturing the town and the cement factory there. The paramilitary troops guarding this path left their froward position but held on the towns. A company of regular troops and two gun were sent from Choirkhaai to stablise see this position, Later, a company of 30 Frontier force was borrowed to counter attack and throw back the intruders. (এই মন্তব্য পাকিস্তানী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা, তারিখও সঠিক নয়)। ক্যাপ্টেন মহসিনের নেতৃতে এইচ কোম্পানীকে দাওরাবাজারে অবস্থিত ফ্রন্টিয়ার ফোর্স পাকসৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য পাঠানাে হয়। দাওরাবাজার সুরমা নদীর অপরতীরে অবস্থিত। সুতরাং আক্রমণ করতে হলে সুরমা নদী অতিক্রম করতে হবে। দাওরাবাজার থেকে ছাতক পর্যন্ত কাঁচা রাস্তা ধরে ছাতক অভিমুখে আরাে সৈন্য সমাবেশ করাই দাওরাবাজার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল। শেলা থেকে সুরমা নদীর তীর পর্যন্ত সমগ্র এলাকা হাওর, কাদাপানিতে প্লাবিত। ক্যাপ্টেন নবী ‘ডি’ কোম্পানীকে নিয়ে ছাতক কাট অফ পার্টি হিসেবে অবস্থান গ্রহণ করেন। সিলেট থেকে সম্ভাব্য পাকিস্তানী সৈন্যদের (Reinforcement) ছাতক অভিমুখের সাহায্যে অগ্রসর হিসেবে অবস্থান গ্রহণের লক্ষ্য।
ক্যাপ্টেন আনােয়ার ও ক্যাপ্টেন আকবর যথাক্রমে ‘এ’ কোম্পানী ও ‘বি’ কোম্পানী এবং পাঁচ নং সেক্টরের তিনটি এফএফ কোম্পানী মূল অভিযান ছাতক আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। লেঃ মনজুর ‘ই’ কোম্পানীসহ ডাউকি সীমান্তে রাধানগরের বিপরীতে অবস্থান করছিলেন। ১৩ই অক্টোবর রাতেই সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত লড়াই গ্রাম ও সিমেন্ট কারখানা মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয় এবং সেখানে ক্যাপ্টেন আনােয়ার প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তােলেন। ১৪ই অক্টোবর সকালে পাকিস্তানীদের একটি লঞ্চ ছাতক যাচ্ছিল। মুক্তিবাহিনী রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে এই লঞ্চটি ডুবিয়ে দেয়। ফলে ৯ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কিছু রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ১৪টি রাইফেল মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। তিনজন মুক্তিযােদ্ধা আহত হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা সিমেন্ট কারখানা ছেড়ে পালিয়ে ছাতকে চলে যায়। ক্যাপ্টেন আনােয়ার সিমেন্ট কারখানার ভেতর ঢুকে পড়ে। ক্যাপ্টেন আকবর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যসহ জয়নগর টিলায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছিল। অপরদিকে ক্যাপ্টেন মহসিন অনেকগুলাে দেশী নৌকা যােগে রাতের অন্ধকারে দাওরাবাজার আক্রমণের উদ্দেশ্যে সুরমা নদী পাড় হচ্ছিল। দাওরাবাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যরা টের পেয়ে আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ক্যাপ্টেন মহসিন ও মুক্তিযােদ্ধা বহনকারী নৌকাগুলাে তখন মাঝনদীতে। পাকিস্তানীদের গুলিবর্ষণের ফলে নৌকা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা মাঝ নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। এর ফলে ১৮জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন এবং বহু হতাহত হন। সকলেই ভেবেছিলেন ক্যাপ্টেন মহসিন আর জীবিত নেই। তাঁর সলিল সমাধি হয়েছে ভেবে গায়েবানা জানাজাও পড়া হয়েছিল। কিন্তু দু’দিন পরে ক্যাপ্টেন মহসিন ও এই ছত্রভঙ্গ কোম্পানীর জীবিত সৈন্যরা শেলায় ফিরে আসে।
গােবিন্দগঞ্জেও অনুরূপভাবে পাকিস্তানীদের প্রবল আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ক্যাপ্টেন নবী ডাউকি সীমান্তের দিকে সরে যান। ক্যাপ্টেন আনােয়ারের ‘এ’ কোম্পানীর ওপরে ১৪ই ও ১৫ই অক্টোবর দু’দিন ধরে পাকিস্তানী গােলন্দাজ প্রবলভাবে অনবরত গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন আনােয়ার অন্যান্য কোম্পানীদের সঙ্গে যােগাযােগ হারিয়ে ফেলেন। ক্যাপ্টেন মহসিনের কোম্পানী ও ক্যাপ্টেন নবীর কোম্পানীর পেছনে সরে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল তার সম্পূর্ণ অজানা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৩১পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কণষ্টিবেলার দাওরাবাজার থেকে ছাতক সিমেন্ট কারখানার প্রতি আক্রমণ (Counter attack) করে। গভীর রাতে ক্যাপ্টেন আকবর হাওর সাঁতরিয়ে সিমেন্ট কারখানায় এসে ক্যাপ্টেন আনােয়ারকে প্রকৃত অবস্থা জানান। ক্যাপ্টেন আনােয়ার ও তাঁর কোম্পানীর অবস্থান পাকিস্তানীদের আক্রমণের মুখে আত্মহত্যার সামিল হত। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সারা রাত বিলের মধ্য দিয়ে হেটে ক্যাপ্টেন আনােয়ার তাঁর কোম্পানী নিয়ে টিলাগাঁও ফিরে আসেন। পরে বলুয়া হয়ে বাঁশতরা ক্যাম্পে হাজির হন। পাঁচ দিনের এই ভয়াবহ ছাতক অপারেশনে ১২ জন নিহত ও প্রায় চার শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়। পঁচিশজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন ও অনেকে আহত হন। ছাতক অপারেশন অনন্য সাধারণ সাহস ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!