বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৭ই আগস্ট, বুধবার, ২১শে শ্রাবণ, ১৩৮১
রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন জনপদ
বন্যা নাগিনীর ক্রুদ্ধফনা প্রসারিত হয়েই চলেছে। দেশের ১৯টি জেলার মধ্যে এখন ১৮টি জেলায় আক্রান্ত বন্যা পরিস্থিতির এহেন ক্রমাবনতির মুখে গত সোমবার ৫ ই আগস্ট থেকে রাজধানীর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পত্রিকান্তরে এর মাধ্যমে বিশেষ প্রতিবেদনে সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে, নগরবাড়ি ঘাট থেকে কাশিনাথপুর পর্যন্ত প্রায় দুই মাস পর দুই থেকে তিন ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় জাতীয় সড়কের পাবনা-নগরবাড়ী অংশ যান চলাচলের অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়। ফলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ এর ক্ষেত্রে এক নিদারুণ সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
বিশেষ প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে যে, আরিচা থেকে নগরবাড়ী ঘাটে এসে প্রায় ৬০টি গাড়ি আটকা পড়েছে। এই সূত্রের তথ্যেই জানা যায়, পাবনা জেলার সুজানগর থানায় (গত ৫ই আগস্ট পর্যন্ত) ৩০০ ঘরবাড়ি প্লাবনে ভেসে গেছে। অসংখ্য মানুষ বন্যা দুর্গত অঞ্চলে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে প্রাণ ধারণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা অসহায় ভাবে প্লাবনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে এবং যমুনার জলস্ফীতি এই হারে বাড়তে থাকলে যেকোনো মুহূর্তে সিরাজগঞ্জ-জগন্নাথগঞ্জ উত্তরাঞ্চলীয় জেলা গুলির মধ্যে রেল যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
এছাড়াও রাজধানীর সঙ্গে বর্তমানে আটটি জেলার সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গোয়ালন্দ-ফরিদপুর রাস্তার কিয়দংশ ৬ ফুট পানির তলায় চলে গেছে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাহলে ফরিদপুর, যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়ায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
ইতিপূর্বে দাউদকান্দি-কুমিল্লা সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকার সাথে কুমিল্লা, নোয়াখালী চট্টগ্রাম ও সিলেটের সাথে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল সড়ক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ময়মনসিংহের সাথে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এবং ইতিমধ্যেই বহু স্থানের রেল সড়ক বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় রাজধানীর সঙ্গে রেল যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে । ফলে বন্যা বিপর্যস্ত দেশের ত্রাণ কাজের চূড়ান্ত অসুবিধা দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে রাজধানীর সঙ্গে উত্তরবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ওই অঞ্চলের বন্যা তাদের কাছে ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ করার কাজ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ নগরবাড়ি ঘাট এরপর যে সড়ক মূলতঃ সেই শুরু থেকেই উত্তরবঙ্গের সকল জেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষিত হয়। বগুড়া, কুষ্টিয়া-পাবনা, রংপুর-দিনাজপুর, খুলনা-যশোর, রাজশাহী জেলায় যেতে হলে নগর বাড়ীর সড়ক পথ অতিক্রম করতেই হবে। এককথায় যমুনার ওপারের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র পথেই হলো নগর বাড়ি পাবনা সড়ক। বন্যার করালগ্রাসে সেই সড়কও নিমজ্জিত।
একথা সত্য যে, জল প্লাবিত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্যার সাহায্যার্থে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেবার মতো পর্যাপ্ত জলযান আমাদের হাতে নেই। যদিও বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যাপক সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে, তবু সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে যে বিপুল সামগ্রী একদফায় পরিবহন করা যায়-তার অভাব পূরণ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। অতএব সুপরিকল্পিত উপায় বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় নামতে হবে।
দুরন্ত বন্যা আরো যে কত গ্ৰাস করবে আমরা জানি না। কিন্তু দুর্গত অঞ্চলে অসহায় মানব সন্তানরা আজ উৎসুক হয়ে আছে এক কণা ত্রাণ সামগ্রী তথা খাদ্য ও পানীয় প্রাপ্তির আশায়। বন্যা দুর্গত অঞ্চলে ইতিমধ্যেই বন্যার দোসর মহামারী ও নানাবিধ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। সেইসব অঞ্চলে অবিলম্বে চাহিদানুযায়ী ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া আবশ্যক। বন্যা পীড়িতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাবার তৎপরতাও চলছে কোন কোন অঞ্চলে। সেখানে যদি এমন ভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে আর তো মানুষ গুলোর দুঃখ-কষ্ট যে মর্মান্তিক হারে বাড়বে সে কথা বলাই বাহুল্য। অথচ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এত বড় নিষ্ঠুর লীলার প্রতিরোধই আমরা করি কি ভাবে?
এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই সার্বিক পরিবহন এর অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিরও দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দেবে। সুযোগসন্ধানীরা মজুদদারির দিকে আকৃষ্ট হবে। জীবন ধারণের উপযোগী দ্রব্যাদির দাম বাড়বে হু হু করে। এমন খবর পাওয়াও যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের সীমা পরিধি ছাড়িয়ে স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রায় স্তব্ধ হয়ে যাবে। সেদিকেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হুঁশিয়ারি দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। আরো এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, পদ্মা নদীর উপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। এই ব্রিজ নষ্ট হয়ে গেলে উত্তরবঙ্গের বিশেষ অঞ্চলের রেলযোগাযোগ ভয়াবহরূপে ব্যাহত হবে। এবং একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পক্ষে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়াও অপরিকল্পনীয়। অতএব ঐ সব অঞ্চলের নদীর ভাঙ্গন রোধ করার জন্য তৎপরতার মাধ্যমে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। একাজে শৈথিল্য প্রদর্শন করলে জাতীয় অর্থনীতির ধ্বংসাত্মক কাজ হবে।
এতদসত্ত্বেও বন্যার্তদের ত্রাণের কাজ চালাতেই হবে। অতএব বিচ্ছিন্ন যোগাযোগের দোহাই না দিয়ে আর্তমানবতার সাহায্যে কেমন করে এগিয়ে যাওয়া যায়, তাদের কাছে খাদ্য-পানীয়, ওষুধ কেমন করে পৌঁছে দেয়া যায় তার বাস্তব পথ অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজন বোধ হয় জল পরিবহনের সংখ্যা বাড়িয়ে রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তরাঞ্চলে বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে ত্রাণকাজকে অব্যাহত রাখতে হবে। নইলে ওদের বাঁচার কোন পথ নেই।
সাম্প্রদায়িকতাকে সম্বল করে
সাইপ্রাসের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সেখানকার সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটিই এত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল যে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে শত চেষ্টা করেও তা দমানো যায়নি। বারবার তার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে আর তার সুযোগ গ্রহণ করেছে বহিঃশক্তি। কখনো তুর্কি সাইপ্রিয়টদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের ধুয়া তুলে তুরস্ক সাইপ্রাসের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে, কখন আবার গ্রীস সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে সেখানকার জনগণের নিরাপত্তা রক্ষার নাম করে। সাইপ্রাসের জনগণের ভাগ্য তার দুই সম্প্রদায়ের সূত্র ধরে বাঁধা পড়ে গেছে বিদেশী শক্তির সাথে।
ম্যাকারিয়াস নিজেও ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা বাস্তব অবস্থার চাপে সাম্প্রদায়িক চেতনার কাছে মাথানত করেছিলেন। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের উত্তর সাইপ্রাস বাসীদের ঐক্যবদ্ধ একটা প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে পারেননি। ক্ষমতা লাভের পর যে ‘এওকা আন্দোলনের’ বিরুদ্ধে তিনি বিষেদাগার করেন সেই এওকা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর এককালীন সম্পৃক্ততা এবং দেশের সঙ্গে সাইপ্রাসের একত্রীকরণ প্রশ্নে তার ভূমিকা সর্বজন বিদিত। স্বাধীনতা-পূর্ব কালে গ্রিক সাইপ্রিয়দের দ্বারা পরিচালিত এওকা আন্দোলনের সঙ্গে তুর্কি সাইপ্রিয়টরা একাত্মতা বোধ করতে পারেনি। স্বাধীনতার প্রশ্নে একমত পোষণ করেও তাই ম্যাকারিয়াসের নেতৃত্বাধীন একা আন্দোলন এবং তুর্কিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম কখনো সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। পারেনি মনেপ্রাণে সাইপ্রিয়ট হতে।
এই সাম্প্রদায়িক চেতনাই সাইপ্রাসবাসীদের মনে দুটি জাতিসত্তার জন্ম দিয়েছে। দৃঢ়চেতা মোকাবিলা করার অভাবে সেই অশুভ চেতনা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তুরস্ক এবং গ্রীষ্মের প্রখর সাইপ্রাসের তুর্কি এবং গ্রিকদের মনে দুটি বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের অনুরোধ এমনকি আনুগত্য বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে সাইপ্রাসে যখন গ্রীক সেনারা অভ্যুত্থান ঘটে তখন গ্রিক সাইপ্রিয়টরা উল্লাসিত হয়ে ওঠে আর তুর্কি সাইপ্রিয়টদের নিরাপত্তায় তুর্কি সেনাবাহিনী নিকোসিয়া দখল করে তখন তাদের মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। কোন সম্প্রদায়ের মনেই বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ধিক্কার সোচ্চার হয়ে ওঠে না।
সাম্প্রদায়িকতার এমন ঘৃণ্য শিকার অন্য কোন দেশ হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। সাইপ্রিয়টদের এই উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে সম্ভব করে শুধু তুরস্কর গ্রিসই নয় বরং আন্তর্জাতিক চক্রান্তও মুনাফা লুটতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী যখন সাইপ্রাসের দুটি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সরকার গঠনের প্রস্তাব রাখেন অথবা ক্ষমতাচ্যুত ম্যাকারিয়স যখন অভিযোগ তোলেন যে তুরস্ক এবং গ্রিস সাইপ্রাসকে বিভক্ত করেছে তখন তা শুধু আমরা এই দেশের নিজস্ব পরিকল্পনা বলে মেনে নিতে পারি না, বরং এর পিছনে বৃহৎ শক্তির স্বার্থ জড়িত রয়েছে বলে আমাদের ধারণা বদ্ধমূল হয়। সাইপ্রাস সমস্যা মূলতঃ সাম্প্রদায়িকতা থেকে উদ্ভূত হলেও তা এখন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাইপ্রাসের দেশপ্রেমিক জনসাধারণকে এটা উপলব্ধি করতে হবে এবং তাদের সমস্যা সমাধানের সেদেশের জনগণের স্বাধীন মতামত এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতিই গুরুত্ব দিতে হবে। সেখানকার সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে সম্বল করে তুরস্ক, গ্ৰীস, গ্রেট ব্রিটেন অথবা অন্য কোন রাষ্ট্র যদি কোন সমাধান চাপিয়ে দেন তবে তা দেশপ্রেমিক সাইপ্রিয়টদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক