You dont have javascript enabled! Please enable it!
রাজশাহী যুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক পটভূমির ও ঐতিহাসিক অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের বিশ্লেষণে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোন আকস্মিক ঘটনা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ ছিল না। একটি আধা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা থেকে শােষিত জনপদের সর্বাত্মক সংগ্রাম ইতিহাসের ধারাক্রমে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চের কালােরাতে বাঙালি জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য গণহত্যার আদেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করল। আর কুখ্যাত টিক্কা খান বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিল ঃ “Kill the Bengalis, rape their women; loot their valuables and burn their properties. “বাঙালিদের হত্যা কর—তাদের মেয়েদের ধর্ষণ কর—তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট কর এবং তাদের ঘর-বাড়ি সহায়-সম্পত্তি জ্বালিয়ে দাও।” এই অঘােষিত যুদ্ধে সকল স্তরের জনগণ স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দিক্ষীত শহীদ তিতুমীর, সূর্যসেন ও বাঘা যতীনের উত্তরসূরী বংশধর, লক্ষ লক্ষ মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ দুর্জয় আক্রোশে রুখে দাঁড়াল বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে, গ্রামে গঞ্জে গড়ে উঠল সশস্ত্র প্রতিরােধ।  জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী এলাকার সাহসী জনগণের নির্ভীক ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। জাতির মহাদুর্যোগময় দিনে রাজশাহীতে অবস্থানরত বাঙালি সৈনিকেরা, রাজশাহীর বুদ্ধিজীবীগণ, শিক্ষকবৃন্দ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা, কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। | রাজশাহী শহরে ইপিআর (বর্তমানে বিডিআর) সেক্টর সদর দফতর অবস্থিত ছিল। সেক্টর সদর দফতরে সেক্টর কমান্ডার, এ্যাডজুটেন্ট, সুবেদার মেজর সবই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী। একাত্তরের ২৫শে মার্চ সেক্টর সদর দফতরে সৈন্য সংখ্যা ছিল দু’টি নিয়মিত প্লটুন, একটি সাপাের্ট প্লাটুন ও অফিসে নিয়ােজিত বাইরে থেকে কিছু সৈন্য। এই সেক্টরের ৬ নং উইং অবস্থিত ছিল চাপাইনবাবগঞ্জে এবং ৭ নং উইং ছিল নওগাঁতে। 
রাজশাহীতে উপশহর এলাকায় পাকবাহিনীর সেনানিবাস ছিল। এখানে ২৫তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা অবস্থান করছিল। কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল শাফকাত বেলুচ হজব্রত পালন করতে গিয়েছিলেন। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় দেশে ফিরে হেলিকপ্টারে চড়ে তিনি রাজশাহী আসেন। বাঙালি হত্যায় একমত না হওয়ায় তাকে পরে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেয়া হয়। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হল। কোয়ার্টার গার্ড ও অন্যান্য স্থানে বাঙালি সৈনিকদের সরিয়ে অবাঙালিদের নিয়ােগ করা হল। শুধু মাত্র অবাঙালি সৈনিকদের অস্ত্র দেয়া হল আর বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র রাখা হল। ২৬শে মার্চ রাতে সেনাবাহিনী রাজশাহী শহরে টহল দিতে শুরু করল। ২৬শে মার্চ পুশিল, ছাত্র-জনতা মিলে রাস্তায় বেরিকেড দিতে শুরু করল। কিছু সংখ্যক ইপিআর বাঙালি সৈন্য বেসামরিক পােশাকে উত্তাল জনতার সাথে মিশে গেল এবং বাকি বাঙালি সৈন্যরা সদর দফতরে বন্দি হল।  ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় পাকসেনারা পুলিশ লাইনের কাছে গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। বাঙালি পুলিশেরা পুলিশ লাইনের ভেতর থেকে পাল্টা গুলি ছুঁড়লে উভয়পক্ষের গােলাগুলি শুরু হয় এবং বেশ কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশেরা বিক্ষিপ্তভাবে সারা রাত গুলি চালায়। পাকসেনারা অগ্রসর না হয়ে উপ-শহরে ফিরে যায়। ২৭শে মার্চ সকালে পাকবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা পরিলক্ষিত হল। তারা আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সারা শহর টহল দিতে থাকে। ইপিআর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে ও পুলিশ লাইনের সামনে পাকসেনারা প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করতে শুরু করল। পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনী বিভিন্ন স্থানে বাঙ্কার করে নিজেদের অস্ত্র নিয়ে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিল।
২৭শে মার্চ রাজশাহী পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সামরিক বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলােচনা করে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। কিন্তু পাকসেনারা আপােষ ভঙ্গ করে ২৭শে মার্চ দুপুরে পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক নওগাঁতে অবস্থানরত ইপিআর উইং-এর সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ও অন্যান্য বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের সাথে যােগাযােগ করার জন্য সচেষ্ট হন। ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার) এক সাক্ষাৎকারে বলেন ঃ ২৭শে মার্চ পুলিশ অয়্যারলেসে রাজশাহীর ডিসি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তার সঙ্গে কথা হল, তিনি বললেন, রাজশাহী পুলিশ লাইনের চতুর্দিকে পাক-সেনারা ঘেরাও করে আছে এবং পুলিশদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু কেউই আত্মসমর্পণ করতে রাজী নয়। আমি এবং এসপি পুলিশ বাহিনীর সাথে আছি। যদি সম্ভব হয় ইপিআর বাহিনীকে আমাদের সাহায্যে পাঠান। আর আধঘন্টার মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে সেনাবাহিনী পুলিশ লাইনের ওপর আক্রমণ চালাবে। কথা শেষ হওয়ার আগেই রাজশাহীর জেলা প্রশাসক রিসিভার ছেড়ে দেন। অনুমান করা যায়—ঠিক সেই সময়ই পাকবাহিনী পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। নওগাঁ থেকে রাজশাহী প্রায় ৬০ মাইল কাঁচা রাস্তা। আধ ঘন্টায় অতিক্রম করে পুলিশ বাহিনীর সাহায্যে আসা সম্ভব হয়নি। পাকসেনার সাথে পুলিশ লাইনের একই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ প্রায় তিন ঘন্টা স্থায়ী হয়। পাকবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে পুলিশ বাহিনী টিকে থাকতে পারেনি। বহু পুলিশ নিহত হয়। যারা প্রাণে বাঁচতে পেরেছিল তারা নানাস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ লাইন পাকসেনারা দখল করে নেয়। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় ইপিআর সেক্টর সদর দফতরের সমস্ত অবাঙালি সৈন্যরা যাবতীয় অস্ত্র-গােলাবারুদসহ উপ-শহরের সামরিক ছাউনিতে চলে যায়। সেক্টর সদর দফতরের অস্ত্রাগার থেকে সকল অস্ত্রও তারা নিয়ে যায়। অবাঙালি ইপিআরদের অনুপস্থিতিতে বাঙালি ইপিআর সৈনিকেরা সামান্য যা অস্ত্র ছিল সেগুল হস্তগত করে। এইসময় পাকসেনারা আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে।
পাকসেনারা সেইদিনই রাজশাহী বেতারকেন্দ্র ও সেক্টর অস্ত্রাগারে আগুন লাগিয়ে সেক্টর সদর দফতরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। বাঙালি ইপিআর সৈনিকেরা পরবর্তীকালে নওগাঁ নবাবগঞ্জে অবস্থিত বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজশাহী উপশহরে অবস্থিত পাকসেনাদের ছাউনি আক্রমণ করে। পাবনা থেকে পলায়নরত ২৫তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আনুমানিক ১০০ জনের মতাে সৈন্য পাকিস্তানী অফিসার মেজর আসলাম এবং ক্যাপ্টেন ইসহাকের নেতৃত্বে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ২৯শে মার্চ গােপালপুরে তাদেরকে মুক্তিযােদ্ধারা এ্যাম্বুশ করে। সারদা থেকে ক্যাপ্টেন রশীদের বাহিনী এবং নওগাঁ থেকে অগ্রসরমান ইপিআর সৈনিকেরা পাকসেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইসহাকসহ ৫০ জন পাকসৈন্য নিহত হয় অপর পক্ষে ১২ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। নওগাঁতে ইপিআর-এর ৭নং উইং সদর দপ্তরে মেজর নাজমুল হক (বাঙালি) উইং কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সহকারী উইং কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী (বাঙালি), ক্যাপ্টেন নবীদ নামে একজন পাঞ্জাবী অফিসারও এখানে কর্মরত ছিল। পাঁচটি কোম্পানীও একটি ভূমিকা পালন করে। পাঁচবিবি থানার কুড়িয়াতে একটি কোম্পানী, রাজশাহী জেলার খনজনপুর ও চারঘাটে একটি করে কোম্পানী, জলকরা পুলডাংগা এবং মনাকষা ও গােদাগাড়ি এলাকায় একটি করে কোম্পানী অবস্থান করছিল। ক্যাপ্টেন গিয়াস মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে পরামর্শ করে অস্ত্রাগার থেকে অবাঙালিদের সরিয়ে বাঙালি সৈনিকদের নিয়ােগ করলেন। ২৩শে মার্চ রােহনপুর থেকেই এই এলাকায় সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়। এই রাতে এক পাকবাহিনীর অবাঙালি ক্যাপ্টেন গােয়েন্দা অফিসার কিছু পাকসেনাসহ রােহনপুর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হলে বাঙালি ইপিআর সৈন্যরা গুলি করতে শুরু করে। সম্ভবতঃ আসন্ন আক্রমণের আশংকায় বাঙালি সৈনিকেরা গুলি ছোঁড়ে। পরদিন এই ঘটনা তদন্ত করতে গেলে তদন্তকারী অফিসার নিহত হয়। 
এই আকস্মিক সংঘর্ষের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সীমান্ত এলাকায় নিয়ােজিত ইপিআর সৈনিকেরা সতর্ক হয়ে যায়। ২৫শে মার্চ পাকবাহিনীর পীলখানা, রাজারবাগ ও বিভিন্ন স্থানের আক্রমণের খবরে ২৬শে মার্চ সকালের মধ্যেই নওগাঁয় ইপিআর এর অস্ত্রাগারে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ইপিআর এর বাঙালি সৈনিকেরা যথাযযাগ্য মর্যাদায় এই পতাকাকে অভিবাদন জানায়। আকস্মিকভাবে অবাঙালি কলােনী থেকে বেলা সাড়ে বারােটার দিকে উইং সদর দপ্তরের দিকে গুলি আসে। এই গুলির ফলে বাঙালি সৈনিকেরা অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াস মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত ছিলেন এবং সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই ঘটনার পর তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হল। উইং সদর দপ্তরে অপারেশনাল হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে ২৪ ঘণ্টা অয়ারলেস খােলা রেখে ১৭টি ইপিআর উইং-এর খবর মনিটর করার ব্যবস্থা করা হল। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক জনতার মধ্য থেকে মুক্তিবাহিনী জনাব বরকতুল্লাহ ও আবদুল জলিলের সঙ্গে যােগাযােগ করা হল। অবিলম্বে সদর দপ্তরের চারদিকে প্রতিক্ষা ব্যুহ রচনা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত ৬নং উইং-এর সঙ্গে যােগাযােগ করা হল। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সীমিত অস্ত্র দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৮শে মার্চ ইপিআর কোম্পানী নাটোর রােড হয়ে সারদা ক্যাডেট কলেজের এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রশীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রংপুর রাজশাহী সড়ক বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই বাহিনী ক্যাপ্টেন রশীদের নেতৃত্ব ঢাকা ও রংপুর থেকে আগত পাকনেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলে। ক্যাপটেন রশীদ পুঁঠিয়া নন্দন গাছি রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পাবনা-রাজশাহী সড়ক এবং ঈশ্বরদী-রাজশাহী ট্রাফিক পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় প্রতিরক্ষা বৃহ্য রচনা করেন।

২৮শে মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন গিয়াস তার সৈন্যদের নিয়ে বগুড়া অভিমুখে অগ্রসর হন। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বিকেলে এই বাহিনী বগুড়া পৌঁছয়। জনমানবহীন বগুড়া শহরকে একটি ভৌতিক শহর বলে মনে হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন গিয়াস পুলিশ লাইনে অবস্থান নেন। এই সময় পুলিশ লাইনে আনুমানিক ২০০ পুলিশ ও একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর ছিলেন। পুলিশ বাহিনী যােগ দেয়ায় ক্যাপ্টেন গিয়াসের বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি হয়। পুলিশের সদস্যদের কাছে থেকে পাকবাহিনীর অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে ক্যাপ্টেন গিয়াস জানতে পারেন। এই সময় পাকবাহিনীর আর্টিলারী রেজিমেন্টের ৬০ জন সৈন্য এবং এ্যামুনিশন ড্রাম্ব রক্ষার জন্য একজন ক্যাপ্টেন সহ ২৫ জন পাকসেনা ছিল। ২৯/৩০শে মার্চ রাতে ক্যাপ্টেন গিয়াস পাকবাহিনীদের এ্যামবুশ করে। পাকসেন| গ্রাম এলাকায় জোর করে ফিরছিল। এই এ্যামবুশে ২৩জন পাকসেনা নিহত হয়। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলা বারুদ মুক্তিযােদ্ধারা দখল করে নেয়। বাকী পাকসেনারা রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এই বিজয়ে মুক্তিবাহিনীর মনােবল বেড়ে যায়। এই অপারেশনের পর ক্যাপ্টেন গিয়াস নওগাঁ ফিরে যান। এদিকে ৩০ মার্চ আড়ানী রেলওয়ে স্টেশনের কাছে। পাবনা থেকে পলায়নের পর পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। অপর দিকে ক্যাপটেন রশীদ রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন এবং ক্যাপ্টেন গিয়াস চাঁপাইনবাবগঞ্জ ইপিআরদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় অবাঙালি সৈনিকেরা পরিবারসহ রাজশাহী রওনা হল। বাঙালি ইপিআর সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এবং অবাঙালি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ৩০শে মার্চ গােদাগাড়িতে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীর উপরে জঙ্গী বিমান হামলা চালায়। পাকসেনারা বাঙালি ইপিআরদের এই অবস্থানের উপরে সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। আক্রমণ শেষে পাকসেনারা রাজশাহী ফিরে যায়। ৩১শে মার্চ ক্যাপ্টেন গিয়াস এই বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হন। কানাইডাংগা নামক স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হয়। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে ইপিআর আনসার, পুলিশছাত্র-জনতা মিলে প্রায় ১০০০ সৈন্য এবং নওগাঁ থেকে সারদা হয়ে প্রায় ১০০০ সৈন্য ২রা এপ্রিলের মধ্যে রাজশাহী শহর উপকণ্ঠে সমবেত হয়।
সারদা থেকে আগত ক্যাপ্টেন রশীদ তার বাহিনী নিয়ে পূর্ব দিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিলেন। উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে ক্যাপ্টেন গিয়াস দক্ষিণ দিকে ডিফেন্স নিলেন। তিন দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিকল্পনা ছিল মূল বাহিনী দক্ষিণ দিক থেকে তীব্র গতিতে শত্রুর প্রতিরক্ষা ভেদ করে দখল করবে। এই সময়ে ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর সঙ্গে ক্যাপ্টেন গিয়াসের যােগাযােগ হয় কিন্তু কোন সাহায্য পাওয়া যায়নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ই এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় বাহিনী প্রবলবেগে পাকসেনার ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। চার ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধের শেষে পাকসেনারা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে রাজশাহী উপশহরের সামরিক ছাউনিতে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী রাজশাহী শহর দখল করে উপশহরস্থ পাকসেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত হয়।
রাজশাহী শহরে জনতার বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের মনে সৃষ্টি হয় অদম্য। সাহস ও উদ্দীপনা। | পাকসেনারা উপশহর ছাউনির চারিদিকে মাইন পুঁতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চারদিকে বসিয়ে প্রতিরক্ষা দৃঢ় করে। এই সময় ৩০০ পাকসেনা এখানে। ১০ই এপ্রিল মুক্তিবাহিনী পাক অবস্থানের ৪০০ গজের মধ্যে চলে আসে। এই সময় একটি পাকিস্তানী ব্রিগেড স্থল পথে টাকা থেকে নগরবাড়ি হয়ে রাজশাহী ও কুষ্টিয়া আসার চেষ্টা করে। পাকবাহিনী সকল বাধা অগ্রাহ্য করতে থাকে। এই বিপুল সংখ্যক পাকসেনার আগমণ সংবাদে মুক্তিযােদ্ধারা দুশ্চিন্তায় পড়ে। এছাড়া পাকবাহিনী রাজশাহীর বেসামরিক আবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা পাকসেনাদের ব্যাপক প্রতিরােধের মুখে আর অগ্রসর হতে পারেনি।
১১ই এপ্রিল রাজশাহী থেকে মুক্তিবাহিনীর ২টি কোম্পানী নগরবাড়ির দিকে পাকসেনার গতিরােধ করার জন্য অগ্রসর হয়। মুলাডুলীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক সংঘর্ষ হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছনে সরে আসে। ১২ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন গিয়াস এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়। মাত্র ১০ মাইল অতিক্রম করার পর ক্যাপ্টেন গিয়াস পাকসেনার মুখােমুখি হন। মুক্তিবাহিনী রাজশাহী ও সারদা রােডের মােড়ে ডিফেন্স নেয়। ঐদিন পাকসেনারা প্রবলভাবে আক্রমণ করে এবং সারারাত ধরে প্রবল যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক এ কি সিদ্দিক ও বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। পাকসেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয় এবং রাজশাহী শহরের উপরে গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। এই সময়ে অবিরাম বিমান হামলা চালানাে হয়।
১৪ই এপ্রিল পাকসেনারা সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের মূল দলটি চাপাইনবাবগঞ্জের দিকে সরে যেতে থাকে। ক্যাপ্টেন গিয়াস গােদাগাড়িতে ৩০০০ সৈন্য নিয়ে প্রতিরক্ষা নেন। রাজশাহী শহর পাকবাহিনী দখল করে নেয়। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী একই সঙ্গে গােদাগাড়ি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। বিমান হামলা যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। ২১শে এপ্রিল পাকসেনারা নবাবগঞ্জ দখল করে নেয়। ক্যাপ্টেন গিয়াস তার বাহিনী নিয়ে পদ্মা নদীর চরে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন রশীদ চারঘাটা এলাকা থেকে তার দল নিয়ে পদ্মা নদী অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেন। পরবর্তীকালে দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত হয় সাত নম্বর সেক্টর। লেঃ কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। এই এলাকাকে নিম্নলিখিতভাবে ন’টি সাব সেক্টরে বিভক্ত করা হয় । | এক—লাল গােলা সাব সেক্টর—মেজর গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার) সাব সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। দুই—মেহেদীপুর সাব সেক্টর : বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সাব সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। তিন—হামজাপুর সাব সেক্টরঃ ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সাব সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। চার—ভােলাহাট সাব সেক্টর : লেঃ রফিকুল ইসলাম( বর্তমান নিবন্ধের লেখক)) সাব সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। পাঁচ-মালন সাব সেক্টর ও সুবেদার সাব সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ছয়—শেখপাড়া সাব সেক্টর ঃ মেজর রশীদ সাব সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। সাত-তপন সাব সেক্টর : একজন সুবেদারের নেতৃত্বে এই সব সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। আট—ঠোকরাবাড়ি সাব সেক্টরঃ
সুবেদার মােয়াজ্জেম সাব সেক্টর কমাণ্ডার ছিলেন। নয়— আঙ্গিনাবাদ সাব সেক্টর : একজন সুবেদার এই সাব সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। অপর দিকে এপ্রিল মাসে যখন ১৬ ডিভিশনকে বিদ্রোহ দমন করতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হয় তখন থেকেই মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ এখানে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৬ ডিভিশনকে নিম্মলিখিতভাবে নিয়ােজিত রাখা হয় ?  এক— হিলিতে চতুর্থ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, সদর দফতর ২৫ ব্রিগেড বগুড়াতে অবস্থিত ছিল। ব্রিগেডিয়ার এর অধিনায়ক ছিলেন।
দুই—২৩ ব্রিগেড। অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আনসারী। সদর দফতর ছিল রংপুরে।  তিন—৩৪ ব্রিগেড। অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নাঈম। সদর দফতর ছিল রংপুরে।
চার—সেপ্টেম্বরে গঠিত অস্থায়ী ব্রিগেড পদ্মা নদী পথে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অবস্থিত ছিল রাজশাহীতে ।।  পাঁচ-২৯ ক্যাভালরির ট্যাঙ্কবহর এই তিন ব্রিগেড ভাগ করে দেয়া হয়। বােদাঠাকুরগাঁ রােডে এক স্কোয়াড্রন, নওগাঁতে (বালুরঘাট সীমান্তে) এক স্কোয়াড্রন এবং হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সন্নিকটে স্কোয়াড্রন, ট্যাঙ্ক মােতায়েন করা হয়।  চূড়ান্ত যুদ্ধে মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে লালগােলা সাব সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১০ই ডিসেম্বর বারঘরিয়া এলাকায় মহানন্দা নদী অতিক্রম করে নবাবগঞ্জ আক্রমণ করে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পাকবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করেন। শক্রর প্রতিটি বাঙ্কার চার্জ করার সময় আকস্মিকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপটেন জাহাঙ্গীরের নাম অনুসারে নবাবগঞ্জের নাম করা হয় জাহাঙ্গীরবাদ। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে শাহপুরের বাঁশবনের মধ্যে বসে যিনি আমাদেরকে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধের পরে বাংলাদেশ ছেড়ে না গেলে যুদ্ধ করার জন্য বেঁচে থাকতে উপদেশ দিয়েছিলেন নিয়তির নির্মম পরিহাসে তাঁকে শহীদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
একটি দুর্ধর্ষ মুক্তিযােদ্ধার দল লেঃ রফিকের (বর্তমান নিবন্ধের লেখক) নেতৃত্বে মহানন্দা অতিক্রম করে রােহনপুর, আমনুরা নাচেল, নবাবগঞ্জে রেখা বরাবর অগ্রসর হয়। অন্য একটি দল লেঃ রশিদের নেতৃত্বে গােমস্তাপুর হয়ে নবাব অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। তপন ও হামজা’ সাব-সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নেতৃত্বে বগুড়া দখল করে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পদ্মা পার হয়ে রাজশাহী আক্রমণ করে এবং মেজর রশীদ পাবনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। লেঃ রশীদ গােমস্তাপুর হয়ে আমনবরা পথে এবং লেঃ রােহনপুর, নাচোল, আমনবরা হয়ে নবাবগঞ্জের পথে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানী পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেঃ জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের নির্দেশ দানের পর ১৬ ডিভিশনের সদর দফতর নাটোরে স্থানান্তরিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর সকালে। ১৭ই ডিসেম্বর বেলা ১১টায় নাটোর সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পরাজিত পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করে। রাজশাহী সার্কিট হাউজে মেজর গিয়াস সদর দফতর স্থাপন করে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা শুরু করেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের উদ্ভবে এই বিশাল এলাকার জনপদ প্রচন্ড বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। এইদিন বিকেল চারটার সময় রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশে মুক্তিবাহিনীকে গণসম্বর্ধনা দেয়া হয়। রাজশাহী শহর এক বিজয় মিছিলের শহরে পরিণত হয়। মেজর গিয়াস এই সম্বর্ধনা সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে আত্মবলী দিতে হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্ক বিভাগের প্রধান ডাঃ হাবিবুর রহমান, সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুম, প্রখ্যাত আইনজীবী বীরেন সরকার ও রাজশাহীর অনেককেই স্বাধীনতার বলী হতে হয়েছিল। এক চিরন্তন শােষিত জনপদের মুক্তির মহাসংগ্রামে এসব শহীদের হাড়ের পলিমাটির ওপরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে আজকের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!