You dont have javascript enabled! Please enable it!

Previous

করা হ’ল। তারা বাজারে জিনিসপত্র কিনতে গেলে তাদের ব্যঙ্গ করা হ’ত ও তাদের উপর থুথু ফেলা হ’ত। কোন দোকানদারই তাদের কাছে কোন কিছু বিক্রি করত না। শীঘ্রই তাদের খাদ্যের মান অতি সস্তার ডাল-রুটির পর্যায়ে নেমে এল এবং কোন কোন সময় তা-ও আসত করাচী থেকে, মাংস ও শাক সবজি আসত বিমান বাহিনীর মালবাহী বিমানে ক’রে।
ঐ সব কষ্টের দিনগুলোর কথা কথা স্মরণ ক’রে কুমিল্লাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীতে কর্মরত জনৈক পাঠান আমাকে বলেছে যে, তাদের একটি দলকে কি ভাবে একদল বিক্ষোভকারী ছাত্র রাস্তায় পাকড়াও করেছিল। ‘আমাদের প্যান্ট খুলে উলঙ্গ ক’রে তারা আমাদেরকে ক্যান্টনমেটের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল।’ সে আরো বলল, ‘সৌভাগ্যক্রমে আমাদের অনেকেরই পরনে জাঙ্গিয়া ছিল। নতুবা আমাদের লজ্জাকর অবস্থা হ’ত আরো ভয়ানক।’
[ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৩]

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন
আসলে বঙ্গবন্ধুর ‘নির্দেশাবলী’ বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ছিল ‘বাইবেলের বাণীর মতই পবিত্র’। কারণ জনগণের কাছে এ বিষয়ে আর বিন্দু মাত্র সন্দেহ ছিল না যে, নিয়মাতান্ত্রিক উপায়ে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সশস্র সংগ্রামের, আর বর্তমান অসহযোগ আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামেরই প্রস্তুতিপর্ব। অসহযোগ আন্দোলনের এই চরম মুহূর্তেই ১৫ই মার্চে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় এলেন। কয়েকদিন আগেই সরকারী সূত্রে, ‘রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানকল্পে’ তাঁর এই আগমনের কথা জানানো হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ সম্পর্কে নতুন ক’রে আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা বিশ্ববাসী জানেন, তাঁর এই আগমনের মূলে কি জঘন্য উদ্দেশ্য এবং হীন মনোবৃত্তি নিহিত ছিল।
২৫শে মার্চের সেই কালোরাত্রির পর পুরো নয়টা মাস ধরে যে বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে ৩০ লাখ নিরীহ লোককে হত্যা করা হয়েছে, তারই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন তিনি এই সময়ের মধ্যে। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ ক’রে সাদা পোশাকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও ভারী
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮২

ভারী অস্ত্র এনেছেন তিনি। হানাদার পশুদেরকে উপযুক্তভাবে তালিম দিয়েছেন এই সময়ে। এই সুপরিকল্পিত অভিযান চালানোর নির্দিষ্ট সময়ও তিনি স্থির করে রেখেছেন—২৫শে মার্চ, ১৯৭১। প্রকাশ্যে যে দিনটিতে তিনি বেতার ভাষণ দেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন।

মুজিব-ইয়াহিয়া প্রথম বৈঠক
শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলতে রাজী হয়েছিলেন, কেননা আকস্মিকভাবে মারাত্মক ঝুঁকি নিতে তিনি চান নি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মতলব সম্বন্ধে তিনি যে অসচেতন ছিলেন, তা’ নয়। তবুও চরম একটি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাঁরও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল, ৭ই মার্চের বক্তৃতায় তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রতি গ্রামে মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেড তৈরী করা হয়েছে। প্রাক্তন সৈন্যরা তাঁর নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে স্বেচ্ছাসেবক ব্রিগেডের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন। চরম মুহূর্তের মোকাবিলার জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়োজন এর জন্য বঙ্গবন্ধু যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তা’ছাড়া শেষ মুহূর্তেও যদি ইয়াহিয়ার সুমতি হয়, সে আশাতেও তিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। পরদিন ১৬ই মার্চে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা শুরু হয়। বৈঠক বসবার পূর্বে সকালে বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার কক্ষে মিলিত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা প্রথম বৈঠকে প্রায় ১৫০ মিনিট ধরে অনুষ্ঠিত হয়। পরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ পুনরায় নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মিলিত হন।
মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠকের প্রতি সারা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। দেশী-বিদেশী শত শত সাংবাদিক এ খবর সংগ্রহের জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বৈঠক শেষে সবাইকে নিরাশ ক’রে শেখ মুজিব তাঁদের আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান। প্রথম দিনের বৈঠক সম্পর্কে খবরে বলা হয়ঃ
“সাড়ে সাত কোটি মুক্তি-সংগ্রামী বাঙালীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৩

মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় নীতি ও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্ন সম্পর্কে দেড়শ’ মিনিট কাল স্থায়ী এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। … … …
আলোচনা শেষে বাংলার নায়ক প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করলে বহিদ্বারে অপেক্ষমান দেশী-বিদেশী সাংবাদিক বাহিনীকে জানান যে, রাজনৈতিক ও অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা উভয়ে আলোচনা করেছেন। জনৈক বিদেশী সাংবাদিক আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, আলোচনা চলছে এবং আরো চলবে। এর বেশী তাঁর কিছু বলার নেই। আরেক বিদেশী সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে, উভয়ের আলোচনা কি পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তাকে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বলা চলে কি-না? শেখ সাহেব মুহূর্তকাল থেমে স্পষ্ট জবাবে বলেন যে, সাংবাদিকদের কাছে যতটুকু তিনি বলেছেন তার বেশী কিছু আর বলার নেই। এ সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন করবেন না। পরে তিনি বলেন যে, আলোচনা অব্যাহত থাকবে এবং এ ব্যাপারে বেশ সময়ের প্রয়োজন। বিষয়টি এক-দুই মিনিটের নয়। আরেক সাংবাদিক তাঁর ৪-দফা শর্ত ছাড়াও আলোচনায় অন্য কোন প্রশ্নও তিনি তুলেছেন কি-না এই প্রশ্ন করলে শেখ সাহেব আর কোন মন্তব্য করতে অসম্মতি জানান।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ই মার্চ, ১৯৭১]

ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্ক কর্তৃক কেন্দ্রীয় কর আদায়
এ সময় শেখ মুজিবের নির্দেশ মোতাবেক ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাঙ্কের সকল শাখা কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার ট্যাক্স আদায় করার জন্য বিশেষ একাউন্ট খুলেছিল। এ ট্যাক্সের মধ্যে ছিল শুল্ক কর, আবগারী কর, বিক্রয় কর ইত্যাদি। পরদিন প্রকাশিত সংবাদপত্রে জানা যায় যে, এ সকল কর স্টেট ব্যাঙ্কে জমা দেয়া হয় নি। ঐদিন একটি অস্ত্র বোঝাই জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছলে ডক কর্মীরা জাহাজটি খালাস করতে অস্বীকার করেন। অন্যদিকে প্রায় ৮০ হাজার বাঙালী সৈন্যকে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দেবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ ক’রে দেয়।
পরদিন বুধবার, ১৭ই মার্চ। ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের দ্বিতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উভয়ের মধ্যে আলোচনা এক ঘন্টা ধরে স্থায়ী
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৪

হয়। আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদেরকে বলেন যে, লক্ষ্য উপনীত না হওয়া পর্যন্ত বাঙালীর সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

শেখ মুজিবের জন্ম দিবস
ঐদিন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫১তম জন্মদিন। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাংবাদিকরা তাঁকে যখন তাঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান, তখন তিনি দুঃখ-ভারাকান্ত কণ্ঠে বলেন, “আমি আমার জন্মদিনে উৎসব করি না, এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কি, আর মৃত্যুদিনই বা কি? আপনারা বাংলাদশের অবস্থা জানেন। এ-দেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই কোন মহিমা। পশ্চিমাদের ইচ্ছা মত আমাদের প্রাণ দিতে হয়। বাংলাদেশের জনগনের জীবনের কোন নিরাপত্তা তারা রাখে নি। জনগণ আজ মৃত প্রায়। আমার আবার জন্মদিন কি? আমার জীবন নিবেদিত আজ জনগণের জন্যে। আমি যে তাদেরই লোক ……..।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৮ই মার্চ, ১৯৭১]

দুঃখিনী বাংলাকে যে তিনি কতখানি ভালোবাসেন এই উক্তি থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

তদন্ত কমিশন গঠনঃ শেখ মুজিব কর্তৃক প্রত্যাখ্যান
ঐ দিন লেঃ জেঃ টিক্কা খান এক ঘোষণায় জানান যে, ২রা মার্চ থেকে ৯ই মার্চ পর্যন্ত কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সামরিক বাহিনী তলব করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি কমিশন গঠন করেছেন। ঘোষণা অনুযায়ী চেয়ারম্যান হবেন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের একজন বিচারপতি। পরদিন এক বিবৃতিতে শেখ মুজিব এই তদন্ত কমিশন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, “এ ধরনের কমিশন দিয়ে কোন ফায়দা পাওয়া যাবে না। এ ধরনের তদন্ত আদৌ কোন প্রকৃত তদন্ত হবে না, সত্যেও উপনীত হওয়া যাবে না। বরং এটা হবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার একটি কৌশল মাত্র।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ই মার্চ, ১৯৭১]

তিনি আরো বলেন যে, “বাংলাদেশের মানুষ এ জাতীয় কমিশনের সাথে কোন প্রকারেই সহযোগিতা করবে না। কারো পক্ষেই এই কমিশনের সদস্য মনোনীত করা বা সদস্যরূপে কাজ করা উচিত হবে না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ই মার্চ, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৫

উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে যে চার-দফা দাবীর কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল—অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্তের ব্যবস্থা করা। কিন্তু সরকার জনগণকে ভাঁওতা দেয়ার জন্যই কতিপয় তাঁবেদারকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি দাবী পূরণ করার অপচেষ্টা চালান। এই তদন্ত কমিশন যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ হতে পারে না, তা’ এর পূর্বে প্রকাশিত সরকারী প্রেসনোটেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যা হোক, শেখ মুজিব নিজেই একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। মওলানা ভাসানীর অনুরোধক্রমে চট্টগ্রামে গুলীবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও জাতীয় পরিষদ সদস্য আবেদুর রেজা খানকে সেখানে পাঠান। ঐদিন শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে বৈঠকের বিরতি ছিল। ইতিমধ্যে সংক্ষুদ্ধ জনতা শেখ মুজিবের বাসভবনে গিয়ে তাঁকে বৈঠক পরিত্যাগ ক’রে রাজপথে নেমে আসার জন্য আহ্বান জানায়।

জয়দেবপুরে গুলীবর্ষণ
পরদিন শুক্রবার ১৯শে মার্চ। ঢাকা শহর থেকে বাইশ মাইল দূরে অবস্থিত জয়দেবপুরে চীন নির্মিত অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীর একটি দলকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করলে মারাত্মক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। স্থানীয় জনগণও এই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পাকসৈন্যগণ নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করে। ফলে কমপক্ষে ২০ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়। সরকারী হিসেব মতে ২ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়। পরদিন প্রকাশিত সংবাদপত্রে কমপক্ষে ৩ ব্যক্তি নিহত হওয়ার খবর প্রচারিত হয়। ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেনঃ “ঢাকা থেকে বাইশ মাইল দূরে অবস্থিত জয়দেবপুর বাজারে গতকাল শুক্রবার অপরাহ্নে সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে। অপরাহ্ন পৌনে চারটা থেকে সোয়া ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষে সেনাবাহিনীর গুলীতে জনতার ৩ জন নিহত এবং ১৬ জন আহত এবং সেনাবাহিনীর ৩ জন আহত হয়েছে বলে জয়দেবপুর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। বেসরকারীভাবে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী সেনাবাহিনীর গুলীতে দশ/বারজন নিহত
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৬

এবং বহু আহত হয়েছেন। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে জয়দেবপুরে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে যে, গতকাল দুপুর বারটার দিকে ঢাকা থেকে পাঁচটি ভ্যানে একদল সেনা জয়দেবপুরে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ছাউনিতে পৌঁছায়।
অপরাহ্ন পৌনে চারটার দিকে সেনাবাহিনীর দলটি উক্ত ছাউনি থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করলে জনতা জয়দেবপুর বাজারে ব্যারিকেড সৃষ্টি ক’রে তাদের বাধাদান করে। এতে সেনাবাহিনী গুলীবর্ষণ করে। জনতার পক্ষ থেকেও পাল্টা গুলীবর্ষণ করা হয়। তবে জনতার অধিকাংশই লাঠি-সোটা নিয়ে সজ্জিত ছিল।
গুলীবর্ষণের সময় থানাতেও গুলী এসে লাগতে থাকে। এতে থানার পুলিশকে নিরাপত্তার জন্য দরজা বন্ধ ক’রে থাকতে হয়েছে।
সেনাবাহিনীর গুলীবর্ষণে নিহত ব্যক্তিদের মৃতদেহ সেনাবাহিনী নিয়ে গেছে। এছাড়া পুলিশ ও এম্বুলেন্সকে ঘটনাস্থলে যেতে দেয়া হয় নি বলে জানা গেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা জয়দেবপুর রেল স্টেশনের নিকট রেল লাইন তুলে ফেলেছেন।…”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ২০শে মার্চ, ১৯৭১]

বঙ্গবন্ধুর ক্ষোভ
এই সংবাদে শেখ মুজিব ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তার বাসভবনে আগত বিক্ষুদ্ধ বিজ্ঞান কর্মচারীদের সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি সরকারের এই উস্কানিমূলক কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করে বললেন, “বাঙালীর ফিনকি দেয়া রক্তের দাগ শহরে বন্দরে ছড়িয়ে আছে। জয়দেবপুরের মাটিও আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বুলেট আর বেয়নেট দিয়ে বাঙালীর মুক্তির আন্দোলন স্তব্ধ করা কোন শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়।” তিনি আরো বলেন যে, “যারা এ ধরনের দুরাশা মনে মনে পোষণ করেন, তাঁরা ‘বেওকুফের স্বর্গেই বাস করছেন’।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ২০শে মার্চ, ১৯৭১]

মুজিব-ইয়াহিয়া ৩য় দফা বৈঠক
১৯শে মার্চ উপদেষ্টাসহ শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথে ৯০ মিনিটব্যাপী ৩য় দফা বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৭

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, কামরুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা কালে বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি সর্বদা ভালোটা আশা করি, কিন্তু আবার খারাপের জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকি। আমার ভূমিকা বিশ্ববাসীর কাছে সুস্পষ্ট রয়েছে।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২০শে মার্চ, ১৯৭১]
অধিবেশনে যোগদানের জন্য ভুট্টোর নিকট প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ
একই দিনে শেখ মুজিবের ৩ জন উপদেষ্টার সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের ৩ জন উপদেষ্টারও দুই ঘন্টাব্যাপী এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জুলফিকার আলী ভুট্টো ও সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব হামুদুর রহমানকে ঢাকায় আসার জন্য এক জরুরী তারবার্তা করেছিলেন। তার জবাবে ১৮ই মার্চ করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানান। তিনি বলেন যে, তিনি ১৬ই মার্চে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে গোপন আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট কয়েকটি বিষয়ের ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার দিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা না পাওয়ায় তিনি ঢাকা যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশেষে মার্চের ২০ তারিখে প্রেসিডেন্টের আরেকটি আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে জনাব ভুট্টো সদলবলে ঢাকায় যাবার কথা ঘোষণা করেন।
তাড়াহুড়ার মধ্যে আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো এ প্রসঙ্গে বলেন যে, ইয়াহিয়ার কাছ থেকে তিনি ‘সন্তোষজনক’ জবাব পেয়েছেন। ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার সওয়াল-জবাবের বিষয় অজ্ঞাত থাকলেও তা’ অনুমান করতে আমাদের কষ্ট হয় না। পরবর্তীকালে তাঁদের কার্যকলাপ থেকে আমরা একথা খুব জোরের সঙ্গেই বলতে পারি যে, ২৫শে মার্চের ঘটনার বীজ ঐ ‘সন্তোষজনক’ জবাবের মধ্যেই নিহিত ছিল। ইয়াহিয়ার সাথে পূর্বে একবার পাঁচঘণ্টা বৈঠকে দু’জন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৮

প্রায় একরূপ ঠিকঠাক করেই রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে এ সম্পর্কে আভাস দিয়েছিলেন। এখন সেই কর্মপন্থার পাকাপাকি বাস্তবায়ন হবে। সুতরাং ভুট্টোর নিকট ইয়াহিয়ার জবাব সন্তোষজনকই হবার কথা।

ভুট্টোর ঢাকা আগমন
যা হোক, মার্চের ২১ তারিখে ভুট্টো সাহেব ১৩ জনের এক প্রতিনিধি দল সহ ঢাকায় এলেন। ঢাকায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। কড়া সামরিক নিরপত্তায় তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পৌঁছেন। এ সম্পর্কে সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করে দৈনিক পাকিস্তান বলেছেন, “কড়া সামরিক প্রহরাধীনে জনাব ভুট্টোকে বিমান বন্দর হ’তে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে আসা হয়।
হোটেল প্রাঙ্গণে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকশ’ লোক ভুট্টো-বিরোধী শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
সামরিক বাহিনীর লোকজন জনাব ভুট্টোকে চারিদিক ঘিরে হোটেলের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। হোটেলের অভ্যন্তরেও একটি ক্ষুদ্র দল প্লাকার্ডসহ তাঁকে বিক্ষোভ জানায়। এসময় সামরিক বাহিনী সাংবাদিকদেরও জনাব ভুট্টোর কাছে ঘেঁষতে দেয় নি। জনাব ভুট্টোর গাড়ীর সামনে ও পিছনে সব মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কয়েকখানা সামরিক বাহিনীর গাড়ী ছিল। জনাব ভুট্টোর গাড়ীতেও তাঁর দু’পাশে সাদা পোশাক পরিহিত স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী দু’ব্যক্তি আসীন ছিলেন। তাঁরা গাড়ীর জানালা দিয়ে দু’দিকে রাইফেল তাক ক’রে বসে ছিলেন। জনাব ভুট্টোকে এ সময় অত্যন্ত বিমর্ষ ও চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছিল।” ইত্যাদি ইত্যাদি।
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২২শে মার্চ, ১৯৭১]

ভুট্টো সাহেব বরাবর নিজেকে ‘জাতীয় নেতা’ হিসেবে জাহির ক’রে এসেছেন। অথচ সেই জাতির শতকরা প্রায় ষাটজন মানুষ যারা বাঙালী তাঁদেরকে এবং এই বৃহত্তর জনগণের যিনি একচ্ছত্র নায়ক তাঁকে তিনি নিদারুণ ভয় করেন। ভয় করেন, কেননা তাঁর আশা যে বড়ই গগনচুম্বী। তিনি প্রধানমন্ত্রী হ’তে চান, অথচ শতকরা ষাটজন লোক তাঁকে সমর্থন করেন না। সে কারণেই সেই জনগণের শক্তিকে এবং জনগণের মহানায়কের
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৮৯

গণশক্তির গর্বকে তিনি নির্মূল করতে চান। তার জন্যই ইতিহাসের এক জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের জাল তাঁকে বিস্তার করতে হয়।
ঢাকায় পৌঁছেই প্রথমে ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা ক’রে উভয়ে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে তিনি বলেন যে, ‘সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে।’
ঠিক হয়ে যাবে, কেননা ইয়াহিয়া খানের রক্তাক্ত পরিকল্পনায় তাঁর সমর্থন আছে, আর ভুট্টোর ক্ষমতা হস্তগত করার সকল কারসাজিতেও ইয়াহিয়ার সমর্থন আছে। দু’জন দু’জনকে প্রয়োজনের তাগিদেই আবিষ্কার করেছেন, উভয়ে সুহৃদ হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করবে যে, ভুট্টোকে ইয়াহিয়া অধিকদিন ব্যবহার করতে পারেন নি। তিনিই ব্যবহৃত এবং অন্তিমে পরাজিত হয়েছেন।

মুজিব-ইয়াহিয়ার অনির্ধারিত বৈঠক
যা হোক, ঐদিন মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যেও ৭০ মিনিটব্যাপী এক অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সমাপনান্তে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর আলোচনার ফলাফল জানাতে তিনি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
এর আগের দিন অর্থাৎ ২০শে মার্চ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রায় সোয়া দুই ঘন্টা ধরে আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদেরকে বলেছিলেন যে, আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর উক্তিতে ও হাবভাবে একথা সুস্পষ্ট হয়েছিল যে, ধুম্রজাল কাটে নাই-কাটবার সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল নয়।
ইয়াহিয়া সুচতুর পন্থায় সময় যাপন করে যাচ্ছিলেন। আঘাত হানবার প্রস্তুতিপর্ব তখনো শেষ হয় নি। কিন্তু বাইরের দিক থেকে তিনি তা’ বুঝতে দেন নি। বাহ্যতঃ ইয়াহিয়ার কথার মধ্যে কোন অসঙ্গতি ধরা না পড়লেও ভুট্টোর আগমনের পর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর যে গোপন বৈঠক হয়, সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের মনে যাতে কোনরূপ সংশয়ের উদয় না হতে পারে একারণেই ২১ তারিখে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের নিকট ইয়াহিয়ার এই দুরভিসন্ধি খুব সুস্পষ্টভাবে তখনো ধরা পড়ে নি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯০

মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়ার বৈঠক
২২শে মার্চ ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের ৭৫ মিনিটব্যাপী এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর এই প্রথম তিনজনের মধ্যে ত্রি-পক্ষীয় আলোচনা বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আলোচনায় অগ্রগতি সাধিত না হ’লে আমি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি কেন?’ অবশ্য তিনি একথাও বলেন, বাংলাদেশে এখনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে। এদেশবাসীকে সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত
একই দিনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্রের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতৈক্যে উপনীত হবার সুযোগ দানের জন্য পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ২৫শে মার্চ এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। এই অধিবেশন আবার যে কবে বসবে তা’ জানানো হয় নি। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে একটি সংক্ষিপ্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়ঃ
“In consultation with leaders of both the wings of Pakistan and with a view to facilitating the process of enlarging areas of agreement among the political parties, the President has decided to postpone the meeting of the National Assembly called on March 25.
[ The Pakistan Times, Lahore, March 23, 1971]

মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে বৈঠকের পর সকলেই এর সফলতা সম্পর্কে আশা পোষণ করতে লাগলেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র এইদিন ‘বাংলার স্বাধিকার’ শীর্ষক এক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করলেন। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক এক সম্পাদকীয়তে লিখলেনঃ

“সংকট নিরসনের পথে”
সোমবার ঢাকায় এই মর্মে আভাস পাওয়া গিয়াছে যে, রাজনৈতিক সংকট নিরসনের পন্থা চূড়ান্ত করার পদক্ষেপ হিসাবে প্রেসিডেন্ট দুই একদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের এক যৌথ বৈঠকে মিলিত করার চেষ্টা করিতে পারেন। সম্ভবতঃ সেই উদ্দেশ্যেই
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯১

তিনি কাইয়ুম খানকে তলব করিয়া আনেন। অন্য পশ্চিমাঞ্চলীয় গণপ্রতিনিধিত্বশীল নেতারা বর্তমানে ঢাকায় রহিয়াছেন। এদিকে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জনাব ভুট্টো আলোচনায় অগ্রগতি হইতেছে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। চারি দফা পূর্ব শর্ত পূরণ করা না হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে যোগ দিবে না বলিয়া ঘোষণা করিয়া এ ব্যাপারে শেখ সাহেব যে আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন, ইয়াহিয়া ও ভুট্টো উহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইয়াছেন বলিয়া অনুমিত হইতেছে। সম্ভবতঃ সেই কারণেই অর্থাৎ সামরিক আইন এবং গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরসহ বঙ্গবন্ধুর দাবী পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তই ভুট্টোর উপস্থিতিতে শেখ সাহেবের সঙ্গে বৈঠক চলাকালেই সোমবার প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। যদি শেষ মুহূর্তে ব্যক্তি-বিশেষের কারণে অতিনাটকীয় কিছু না ঘটে তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহৃত এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর ব্যবস্থা গৃহীত হইতে যাইতেছে। আরো জানা গিয়াছে যে, শেখ মুজিবের দাবী অনুসারে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরই নয়া সরকারের রূপরেখা নিদিষ্ট হইবে। ইতিমধ্যে শেখ সাহেব সোমবার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলিয়াছেন যে, আমাদের আন্দোলন চলিতেছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে। তিনি আরো বলিয়াছেন, বাংলার মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু উহা না হইলে সংগ্রামের মাধ্যমেই তাঁহারা লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছিবে।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে মার্চ, ১৯৭১]

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে পূর্ব বাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, একথা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। এমন কি ২২শে মার্চ তারিখেও তিনি সাংবাদিকদের বলেছেনঃ
That the stage is now set for our elected representatives to work together for the common goal which would accommodate both East and West wings in a smoothly working harmonious system. … … … … I have no doubt that we shall succeed in dissolving the current political crisis.
[ The Pakistan Times, Lahore, March 23, 1971]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯২

প্রেসিডেন্টের সাথে ভুট্টোর যে একটি গভীর সংযোগ ছিল, সে কথাও আজ বিশ্ববাসীর নিকট সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। ২২শে মার্চ তারিখে জনাব ভুট্টো বললেন যে, তিনি শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তা’ পরীক্ষা ক’রে দেখেছেন এবং তিনি অত্যন্ত আশাবাদী। তিনি বললেনঃ
I had a fruitful and satisfactory meeting with Sheikh Mujibur Rahman this morning. I would welcome another meeting.
[ Dawn, Karachi, March 23, 1971]

২৪ তারিখে ভুট্টো ইয়াহিয়ার সাথে সুদীর্ঘ আলাপ করেন এবং বলেনঃ We are making some progress.
[ ডন, করাচী, ২৫শে মার্চ, ’৭১]

২৫শে মার্চে জনাব ভুট্টো একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বললেনঃ
“While I supported in principle the four point preconditions of Sheikh Mujibur Rahman, my party is trying to come close to six points.”
[ The Pakistan Times, March 26, 1971] |

শুধু জনাব ভুট্টোই নন, পশ্চিমা স্বার্থবাদী মহলের আর এক নায়ক মিয়া মমতাজ দৌলতানাও এক উজ্জ্বল আশার কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেনঃ
I am hopeful about the talk.
[ The Morning News, March 25, 1971]

মুজিব এবং ইয়াহিয়ার আলোচনায় যে একটি আপোষ হতে যাচ্ছে, এ সম্পর্কে লাহোরের পাকিস্তান টাইমস লিখলেনঃ
To Mujib he (President) indicated that there were no serious objections to the four point proposals and that an interim constitution could be worked out by the respective advisers accordingly. The basic points on which an agreement was reached were: (i) lifting of martial law and transfer of power to a civilian government by a presidential proclamation, (ii) transfer of power in the provinces to the majority parties, (iii) Yahya to remain the President and in control of the Central Government
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯৩

and (iv) separate sitting of the National Assembly members from East and West Pakistan preparatory to a joint session of the house to finalise the constitution. The last suggestion in fact came from Yahya to accommodate Bhutto.
[ The Pakistan Times, March 23, 1971]

সুতরাং, এ কথা স্পষ্ট যে, চারটি স্বীকৃতির ভিত্তিতে মুজিব ও ইয়াহিয়ার আলোচনা রাজনৈতিক অচলাবস্থা অবসানের পথে এগোতে থাকেঃ (১) সামরিক শাসন তুলে নিয়ে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, (২) প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা দেয়া হবে, (৩) কেন্দ্রীয় সরকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতেই আপাততঃ থাকবে, (8) প্রদেশ দু’টোতে পৃথক পৃথকভাবে গণপরিষদের সদস্যগণ বসবেন এবং পরবর্তীকালে যাতে দুই প্রদেশ থেকে সমগ্র সদস্যগণ একত্রে বসে অনুমোদন করতে পারেন এমন একটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করবেন।
দেশের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রেখে বঙ্গবন্ধু এই শর্তগুলোতে সম্মত হয়েছিলেন। তা’ ছাড়া তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এভাবে শান্তিপূর্ণ পথে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা একদিন না একদিন বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করবে। সারাজীবন তিনি নিয়মতান্ত্রিক পথে সংগ্রাম ক’রে এসেছেন—সশস্ত্র সংগ্রামে তিনি সহজেই যেতে চান নি। কিন্তু আসলে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র সব নিয়মতান্ত্রিক পথকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে ঠেলে দিয়েছিল। মুজিব শেষ পর্যন্ত সেই পথে দৃপ্ত পদবিক্ষেপেই যাত্রা করেছেন।
শেখ মুজিব শেষ অবধি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ের পথে বিশ্বস্ত ছিলেন। এদিকে ভেতরে ভেতরে যা নির্দেশ দেবার তা’ তিনি সবাইকেই দিয়েছিলেন। একদিকে যদিও ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ-এর ভাষণে তিনি প্রকাশ্যেই বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তথাপি শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পথই এই শান্তিকামী, মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মহানায়কের কাঙ্খিত পথই ছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯৪

এমন কি প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের মধ্যে চারটি সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে যে সমঝোতা হয়েছিল তার বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক বিলম্ব দেখে বঙ্গবন্ধুর মনে সন্দেহের উদ্রেক হলেও তিনি আশা হারিয়েছিলেন না। সামরিক বাহিনীর বর্বরগুলো এদেশবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার পূর্ব পর্যন্ত প্রদত্ত তাঁর সর্বশেষ বিবৃতিতে তিনি দুঃখ ক’রে একথার উল্লেখ করেছেন। ‘ডন’ পত্রিকা থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উদ্ধৃত হ’লঃ
The arrival of the President in Dacca and his subsequent talks led the people to expect that there was a realization that this grave crisis engulfing the country could only be resolved politically. It was for this reason that I met the President. The President affirmed that there could only be a political solution of the crisis. Upon that promise, certain fundamental principles on which such a solution would be based were accepted by the President. Subsequently my colleagues sat with the President’s advice is to work out those principles. We have thus done our duty and contributed our utmost efforts towards the attainment of a political solution. There is no reason or justification for any delay. If a political solution is desired by those concerned, they should realize that it is for them to take matters immediately to a conclusion, and that to delay this would expose the country and its people to grave hazards. It is, therefore, unfortunate that there is a regrettable delay in resolving the crisis politically. Indeed, the critical situation already prevailing is being aggravated by renewed military activities, the pace of which, according to reports from different parts of Bangladesh, is being stepped up. This is all the more regrettable at a time when the President is in Dacca for the declared purpose of resolving the crisis politically. After last week’s firing at Joydevpur, reports of atrocities are pouring in from Rangpur, Saidpur, where curfew has been imposed. From Chittagong, there are reports of heavy firing on the civilian population (emphasis added).
[ Dawn, Karachi, March 26, 1971]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯৫

এ সম্পর্কে একজন প্রখ্যাত লেখক লিখেছেনঃ “While Awami Leage ledears were anxiously awaiting a call from General Peerzada for the final session, which never materialized, it was learnt that Ahmed had suddenly left for Karachi on the morning of 25 March without any warning to the Awami League. No one knew what transpired in the private meetings between Yahya and Bhutto at Dacca, but a consensus between the two must have been reached.
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৯]

দুইজনের এই মতৈক্য বা consensus between the two যে কি ব্যাপারে তা’ বিশ্ববাসীর কাছে অবিদিত নেই। গণহত্যা, রক্তপাত, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ধ্বংস এ সবই সেই মতৈক্যের ফসল—এক কোটি মানুষের স্বদেশ ত্যাগ, ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবনাবসান, অসংখ্য নির্যাতন সবই সেই ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি। বিখ্যাত সাংবাদিক Peter Hazelhurst এ সম্পর্কে চমৎকার তথ্য প্রদান করেছেনঃ
Yahya and Mujib had agreed to an interim settlement providing (i) immediate withdrawal of martial law by a presidential proclamation, (ii) immediate restoration of power at the provincial level, and (iii) the interim Central Government to be administered by the President until the constitution was framed. Bhutto opposed the scheme stating that if martial law was withdrawn, and power transferred to the provinces, Pakistan would be broken up into five sovereign states. ‘It was Bhutto who finally brought the President to take the decision which set East Bengal on fire … … … Taking events to their logical conclusion there is no doubt that the present holocaust was precipitated by President Yahya Khan when he postponed the Assembly without consulting the Bengalis, but even more so by Mr. Bhutto’s deliberate decision to boycoott the Assembly on 3 March.
[ The Manila Chronicle, July 5, 1971]
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯৬

ঘটনার ঐকান্তিক বিশ্লেষণ
সুতরাং ঘটনার ঐকান্তিক বিশ্লেষণে একথা সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার যৌথ ষড়যন্ত্রে ও সম্মতিতে পূর্ব বাংলার ওপর গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ আরোপিত হয় এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে বাংলার মাটিতে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সুদক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যে অবহিত ছিলেন না, তা’ নয়। তাঁর গণনায় যে ভুল হয়েছিল, এমন কথাও সত্য নয়। তিনি বিশেষ সতর্ক ছিলেন বলেই ৭ই মার্চ তারিখের ঐতিহাসিক ভাষণে মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে জনগণকে সজাগ ক’রে দিয়েছিলেন—জনমনকে তিনি সম্পূর্ণ তৈরী থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর প্রায় প্রত্যেক দিনই তিনি জনগণকে সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন, প্রস্তুতির ডাক দিয়েছেন। ২৩শে মার্চ তিনি বলেছেন যে, বাংলার মানুষ কারো করুণার পাত্র নয়—আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতার বলেই তারা মুক্তি ছিনিয়ে নিয়ে আসিবে। আজীবন তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রনায়ক—বহু ভাষণে ও বিবৃতিতে তিনি একথা বলেছেন যে অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বিশ্বাসী নন। তিনি তাই বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিয়মতান্ত্রিক পথেই অগ্রসর হতে সর্বশক্তি ও সাধনা নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু যখন বর্বর পশুশক্তি আঘাত হেনেছে—যখন নিয়মতান্ত্রিক পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ হয়েছে, তখনই তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ২৫শে মার্চ রাত্রি বারোটার পর তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন এবং দেশবাসীকে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান। তাঁর সে আহ্বানে সাড়ে সাত কোটি মানুষ বাঁধভাঙা সমুদ্র কল্লোলের ন্যায় ছুটে এসেছে, যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে এবং দেশকে স্বাধীন ক’রে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর গণনায় ভুল হয় নি। তিনি যে ইয়াহিয়ার ওপর আস্থা রেখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তার অর্থ এই নয় যে, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্র এবং এর পরিণতি তিনি ধরতে পারেন নি—এর কারণ এই যে, তিনি নিয়মতান্ত্রিক পথের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত ছিলেন—সে পথে বিপদ ও বাধা যত বড় ও গুরুতরই হোক না
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯৭

কেন। তিনি তা’ পেরেছেন, কেননা তাঁর প্রত্যয় ছিল জনগণের শক্তির ওপর এবং ন্যায়ের সুনিশ্চিত বিজয় সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ আস্থা ছিল। এই ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করতে হ’লে শেখ মুজিবের সারা জীবনের অটল আত্মবিশ্বাস, অপরিসীম মনোবল এবং গণতান্ত্রিক অদম্য চেতনার সাথে একাত্ম হওয়া দরকার। অন্যথায়, যারা বলবেন যে, শেখ মুজিবের গণনায় ভুল ছিল, তাঁদের নিজেদেরই গণনায় ভুল হবার সম্ভাবনা থাকবে বলে আমার আশঙ্কা হয়। আমার উল্লেখিত বিশ্লেষণের প্রমাণ বহু ঘটনায়, বহু বিবৃতিতে ছড়িয়ে রয়েছে। বেশী দূরে যেতে হবে না ২৩শে মার্চ-এ তিনি যে সব কথা বলেছেন তার মধ্যেই এই সত্য জাজ্জ্বল্যমান হতে দেখা যায়। তিনি বলেছেন, ‘মনে রাখবেন সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহসালার।’ আবার বলেছেন, ‘মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছিবই, বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করিয়া রাখা যাইবে না।’
বস্তুতঃ ঘটনাগুলো ভাসাভাসাভাবে বিচার করলে মনে হতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু সংগ্রামের প্রস্তুতি না নিয়েই সমগ্র দেশকে সংগ্রামের পথে ঠেলে দিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, দু’জন জাঁদরেল সেনানায়কের শাসনামলেই বাংলাদেশের সমগ্র সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্ব ও সাফল্যের পর্যায় অতিক্রান্ত হয়েছে। আর দু’জন সেনানায়কেরই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এই একজন গণনায়কের ওপর। তাঁর পক্ষে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়া সহজ ছিল না। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করেই তাঁকে বারবার কারাগার বরণ করতে হয়েছে এবং পরিণামে দেশদ্রোহী হিসেবে আগরতলা ষড়ষন্ত্র মামলার শিকার হতে হয়েছে। সুতরাং যে পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন, তার চেয়ে প্রকৃষ্টতর অন্য কোন পথ বোধ করি বেছে নেয়া সমীচীন ছিল না, সমীচীন হ’তও না।
অবশ্য একাত্তরের মার্চ মাসের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধুর যাত্রাপথে দুটো প্রধান গতি সঞ্চারিত হয়েছে। একদিকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে সংগ্রামের প্রস্তুতি। পঁচিশ দিনের ঘটনাপঞ্জী। বিচার করলে দেখা যাবে যে, তিনি সমগ্র দেশকে একটি পুঞ্জীভূত আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত করেছেন—যে কোন সময় যেন আহ্বান
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯৮

করলেই অগ্নুৎপাত ঘটতে পারে। তাঁর সুদীর্ঘ কালের নিয়মতান্ত্রিক অথচ সংগ্রাম-সচেতন সাধনার ফলশ্রুতি ঘটেছে সত্তরের নির্বাচনের পর থেকে সামগ্রিক ঘটনারাশিতে—বিশেষ ক’রে মার্চ মাসের পঁচিশ দিনে। তাঁর এই সাফল্যের ফলেই ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রির পর তিনি যখন স্বাধীনতার ও সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন, সে ডাক বৃথা যায় নি। ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল—এই ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে মুজিবের অবদান বিস্ময়কর। আগ্নেয়গিরি তিনিই নির্মাণ করেছিলেন—অগ্নুৎপাতও ঘটিয়েছেন তিনিই।
যা হোক, আবার ঘটনার বিবরণে ফিরে আসা যাক। ঘটনার পূর্বাপর বিবরণই আমার বিশ্লেষণের সত্যতা প্রমাণ করবে।

মীরজাফরদের পোশাক বদল
ইতিমধ্যে ঘটনার নানারূপ নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। বাংলার মীরজাফরেরা তাদের পোশাক বদল করতে আরম্ভ করে দেয়। তারা তাদের পূর্ববর্তী কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ ক’রে বাংলাকে মুক্ত করার সংকল্প জ্ঞাপন করতে লেগে যায়।

প্রতিরোধ দিবস
এলো ২৩শে মার্চ। এই দিনটি বরাবর পাকিস্তানের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। কিন্তু এবারের ২৩শে মার্চ নতুন এক তাৎপর্যমণ্ডিত। বঙ্গবন্ধু আগে এক ঘোষণায় এই দিনটিতে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন এবং প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ডাকে এ-দিনটি বাংলাদেশব্যাপী ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।
এই দিন বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারী ও বেসরকারী অফিস-ভবনসমূহে, বাড়ীঘরে, ও যানবাহনে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়।
ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সদস্যরা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথের এই গানটি গাইবার পর আনুষ্ঠানিকভাব বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। এ সম্পর্কে পরদিন প্রকাশিত খবরে বলা হয়ঃ “গতকাল প্রতিরোধ
পৃষ্ঠা নং ~ ৭৯৯

দিবস পালন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় গণজীবনে গণআন্দোলনের সাগরে ভরা কোটালের জোয়ার দেখা দেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যবস্থাপনায় আউটার স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছাত্র-ছাত্রীরা যে বীরোচিত কুচকাওয়াজ পরিবেশন করেন, স্বাধিকার পিপাসু হাজার হাজার নরনারী আনন্দ উজ্জ্বল কিন্তু বজ্রকঠোর দ্যুতিতে দীপ্ত এক অপূর্ব পরিবেশে তা’ অবলোকন করেন। বাংলার তরুণদের এই কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়া গতকাল আকাশে বাতাসে বাঙালীর মানুষের মত মরিবার ও বাঁচিবার আত্মপ্রত্যয়ের যে অনির্বাণ স্বাক্ষর রচনা করা হইয়াছে তাহা অতুলীয়, অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব। সকাল হইতে রাত পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বীর বাঙালীর অগণিত মিছিল শুধু কামনা বাসনা ও আকাক্ষার ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করিয়া গিয়াছে অবিশ্রান্ত জলধারার মত। মিছিলে মিছিলে সভা-সমিতিতে জনতার কণ্ঠ যেন কেবলি বলিতে চাহিয়াছেঃ
শুকনো গাঙ্গে আসুক
জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক
ভাঙ্গনের জয়গান গাও
জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক
আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈঃ মাভৈঃ
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪শে মার্চ, ১৯৭১]

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের প্রাঙ্গণেও আনুষ্ঠানিকভাবে সকাল বেলায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। সন্ধ্যায় তা’ আবার আনুষ্ঠানিকভাবে নামিয়ে ফেলা হয়। পতাকা উত্তোলনের সময় গান গাওয়া হয়—‘জয় বাংলা জয় বাংলা মাতৃভূমি বাংলার জয়’।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগ বাহিনী তাঁকে অভিবাদন জানায়। অভিবাদন গ্রহণকালে তিনি ঘোষণা করেন যে, ‘মূল সমস্যার প্রশ্নে কোন আপোষ নেই।’ সংবাদে বলা হয়ঃ “বিক্ষুব্ধ বাংলার দশদিগন্তে সর্বাত্মক মুক্তি আন্দোলনের পটভূমিকায় নয়া আঙ্গিকে আবির্ভূত তেইশে মার্চের অবিস্মরণীয় দিনে (মঙ্গলবার) বন্যার স্রোতের মত সমাগত জনতার উদ্দেশ্যে স্বীয় বাসভবনে ভাষণ দান কালে স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় বলেনঃ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০০

সংগ্রাম’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। যতদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হইবে, যতদিন একজন বাঙালী বাঁচিয়া থাকিবে, এই সংগ্রাম আমাদের চলিবেই চলিবে। মনে রাখিবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করিতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহসালার। তাই বাংলার জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ, সংগ্রাম চালাইয়া যান। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, সংগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপরই ছাড়িয়া দিন।’ শেখ সাহেব তাঁহার ভাষণে বলেনঃ ‘বাংলার দাবীর প্রশ্নে কোন আপোষ নাই। বহু রক্ত দিয়াছি, প্রয়োজনবোধে আরও রক্ত দিব, কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌঁছিবই, বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করিয়া রাখা যাইবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি তা’ সম্ভব না হয়, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাঁচিয়া থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলিতেই থাকিবে। এই সংগ্রামের পন্থা কি হইবে উহা আমিই ঠিক করিয়া দিব, সে ভার আমার উপর ছাড়িয়া দিন। শোষক কায়েমী স্বার্থবাদীদের কিভাবে পর্যুদস্ত করিতে হয়, আমি জানি।’ তিনি বলেন,
‘অতুলনীয় ঐক্য, নজিরবিহীন সংগ্রামী চেতনা আর প্রশংসনীয় শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দিয়া বাংলার মানুষ প্রমাণ করিয়া দিয়াছে যে, শক্তিরজোরে তাঁহাদের আর দাবাইয়া রাখা যাইবে না।’
কাকডাকা ভোর হইতে রাজপথ, জনপথ প্লাবিত করিয়া শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন দিক হইতে দশ ঘন্টা সময়ে ৬টি মহিলা মিছিল সহ অন্ততঃ ৫৫টি ছোট-বড় মিছিল গতকাল শেখ সাহেবের বাসভবনে আগমন করিয়া মহান জাতির মহান নেতার প্রতি অকুণ্ঠ আস্থার পুনরাবৃত্তি ও সংগ্রামের দুর্জয় শপথের স্বাক্ষর রাখিয়া যায়। সেই মিছিল-সমুদ্রের হাতে হাতে লাঠি, বল্লম, বন্দুক; চোখে মুখে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্য আর কণ্ঠে কণ্ঠে নয়া দিনের, নব জাতির, নতুন দেশের বিজয় গাথা, কোটি প্রাণের অমোঘ সঙ্গীত ‘জয় বাংলার’ সাধন মন্ত্রে গর্জিয়া উঠিতে থাকে। তেইশ বৎসর ধরিয়া বাংলার দশদিগন্তে যে পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়াছে, যে পাকিস্তান দিবস পালিত হইয়াছে, যে ভাবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় সভা সমিতি হইয়াছে, আর সেই সব অনুষ্ঠানে রাজপথে, জনপথে অধিকার বঞ্চিত গণমানুষ ক্ষ্যাপা
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০১

পাগলের মত পাকিস্তানে তাদের স্বাধীনতা খুঁজিয়া বেড়াইয়াছে, গত কালের দিনটি তাহার তমসাবসানের সূচনা করিয়া জনতাকে নব সূর্যের আলোকে নয়া পতাকার দিকনির্দেশে প্রাণের টানে টানিয়া নিয়াছে জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। আর বাম হাতে বাংলাদেশের পতাকা ঊর্ধে তুলিয়া ডান হাত জনতার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মার স্পন্দনকে একত্রে জড়ো করিয়া গর্জিয়া উঠেছেনঃ ‘বাংলার মানুষ কাহারো করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতার বলেই তাহারা মুক্তি ছিনাইয়া আনিবে। জয় বাংলা, বাংলার জয় অনিবার্য।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩শে মার্চ, ১৯৭১]

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের সমাধি রচিত হয়। পাকিস্তান দিবস-এর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে যায়। বাংলার জনগণ নিজেদের অস্তিত্বের স্পন্দন অনুভব করে। উপলদ্ধি করে, এ আরেক দেশ-পাকিস্তানের কবরের ওপর নতুন দেশের উত্থান ঘটেছে, এ দেশের নাম বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু তখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন নি; কিন্তু তাঁর বক্তব্যে একথা কারো আর বুঝতে বাকি ছিল না। বাংলার মানুষ যে শোষক ও প্রবঞ্চক-শক্তিচালিত দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে পারে না, একথা তিনি প্রকারান্তরে শাসকগোষ্ঠীকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর সেই জন্যই তিনি বলেছেন যে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয়, তা’ হ’লে বাংলাদেশের মুক্তি কিভাবে আনতে হয় তা’ তিনি দেখিয়ে দেবেন।
বঙ্গবন্ধু তা’ সত্যি দেখিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ববাসীই জানেন যে, তিনি নিজে হানাদারের হাতে ধরা দিয়েও শুধু ব্যক্তিত্বের অসাধারণ শক্তিতে কিভাবে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পরিচালিত ক’রে পশুদের কবল থেকে বাংলাদেশের শোষিত মানুষকে মুক্ত করেছেন।
২৩শে মার্চের ‘পাকিস্তান দিবস’ উপলক্ষে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ দেবার কথা ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণবশতঃ তা’ বাতিল হয়ে যায়। তবে তিনি এক বাণীতে বলেন যে, শাসনতান্ত্রিক অবস্থা দূর করার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০২

জন্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, ঐ দিন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে দু’ দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানেও সমঝোতার কথাই বিশেষভাবে বলা হয়। সমঝোতার নামে যে ভাওতা একথা বুঝতে দেয়া হয় না। জনাব ভুট্টোও পুরোপুরি দাবার চাল চেলে যাচ্ছিলেন। ইয়াহিয়াকে কাজে লাগাতে হবে এবং তিনি সার্থকভাবে সে কাজে এগোচ্ছিলেন। জনাব ভুট্টো আরো কিছু সময় অতিবাহিত করছিলেন। তাঁর বক্তব্যে বুঝা যায়, অভিষ্ট সময় এখনো আসে নি। ইয়াহিয়াও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা ক’রে আলোচনার পথ প্রশস্ত করতে চেয়েছেন। লোক দেখানো এই চাওয়ার পশ্চাতে ছিল বিরাট ষড়যন্ত্র। আমরা জানি, সে প্রশস্ত পথ বেয়ে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার কর্মসূচী আসে নি, এসেছে ট্যাঙ্ক আর কামানের গর্জন। সে চাওয়ার পথে কামনার স্নিগ্ধ পুষ্প ঝরে নি—ঝরেছে রক্তের প্রবাহ, অশ্রুর বন্যা। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, আসন্ন ২৫শে মার্চের ঘটনার প্রতি ভুট্টোর অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। ভুট্টো তাঁর এই সমর্থনকে নীরবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি; তিনি কূটবুদ্ধির আশ্রয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে ইয়াহিয়ার কার্যকলাপকে উৎসাহ দিতে থাকেন। আর সেজন্যই দেখা যায় যে, এক মহানায়কের প্রকাশ্য নির্দেশে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলার জনগণের মরণপণ সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেও তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপোষে অনীহা প্রকাশের স্পর্ধা দেখান। শেখ মুজিব ৬-দফার একটি দফাও যে ছেড়ে দেবেন না, তা’ জনাব ভুট্টো ভাল করেই জানতেন, তবু আলোচনার অজুহাত দেখিয়ে রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তার নজীর বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ইয়াহিয়া সৈনিক, তাঁর পক্ষে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত ছিল না—কিন্তু রাজনীতিবিদ ভুট্টো যা করলেন তা’ সত্যি অচিন্ত্যনীয়। এদিকে সেনাবাহিনী প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। উপযুক্ত সময় আঘাত হানার পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য তারা তাদের অনুচরদেরকে উস্কানি দিতে থাকে। এতে বিভিন্ন জায়গায় বাঙালী-অবাঙালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০৩

চট্টগ্রামের সংঘর্ষের কথা আগেই বলা হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অবস্থা স্বাভাবিক রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।

সেনাবাহিনীর উস্কানি
২৩শে মার্চ রাতের বেলায় রংপুর জেলার সৈয়দপুর ও ঢাকার মীরপুরে বাঙালী-অবাঙালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বেধে যায়। সামরিক সরকারের অনুচরেরা মীরপুরে লুটতরাজ, অগ্নিকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ড চালায়। সৈয়দপুরে অবাঙালীরা নিরীহ বাঙালীদের ওপর আক্রমণ চালায়। বাঙালীরা রুখে দাঁড়ালে নেপথ্য থেকে বিনা তলবে সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে এবং গুলীবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং কয়েক শ’ জন আহত হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এর তীব্র নিন্দা ক’রে এক বিবৃতি দেন। তিনি বলেন যে, এইসব ঘটনা রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনাকে বিপন্ন ক’রে তুলছে। তিনি বলেনঃ It is unfortunate that while a political solution is being pursued in talks with President Yahya, the atmosphere is being vitiated by these untoward incidents.”
[ The Morning News, March 25, 1971]
শেখ মুজিবের হুঁশিয়ারী
বঙ্গবন্ধুও জনগণকে হুঁশিয়ার ক’রে দিয়ে বলেন যে, আন্দোলন নস্যাতের চক্রান্ত চলছে। সেদিন তাঁর বাসভবনের সামনে আগত মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, কিছুসংখ্যক লোক আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করছে। বঙ্গবন্ধু এসব ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে বলেন, “তাঁদের বহু কিছু আছে এবং তাঁরা বানরের পিঠা ভাগের মত আবার এসে বসার জন্য বাংলাদেশে গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করছে।” বঙ্গবন্ধু সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং বারবার সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি সৈয়দপুরের ঘটনার উল্লেখ করেন। এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণের প্রতি নির্দেশ দেন। তিনি জনগণকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “আমার মাথা কেনার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০৪

শক্তি কারো নেই। বাংলার মানুষের সাথে, শহীদদের রক্তের সাথে আমি বেঈমানী করতে পারবো না।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৪শে মার্চ, ১৯৭১]

শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক
তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন—‘জয় বাংলা-ই থাকবে, আর কেউ ক্ষয় বাংলা করতে পারবে না।’ ঐ দিনই আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ এবং ডক্টর কামাল হোসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উদেষ্টাদের সাথে দু’ঘন্টা স্থায়ী এক বৈঠকে মিলিত হন। ‘রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে মূলনীতি সংক্রান্ত যে সমঝোতা হয়েছে তদনুযায়ী বিশদ পরিকল্পনা’ তাঁরা সমবেতভাবে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে পেশ করেন। উল্লেখযোগ্য যে, ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি মিঃ কর্নেলিয়াস, লেঃ জেঃ পীরজাদা, কর্নেল হাসান ও পরিকল্পনাবিদ কুখ্যাত এম. এম. আহমদ।
ঐদিন ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ থাকে। টেলিভিশন কেন্দ্রে প্রহরারত কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে কর্মচারীরা একযোগে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অসহযোগ আন্দোলনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্রও শেখ মুজিবের নির্দেশাবলী পালন করতে থাকে। আন্দোলনের সমর্থনে অনুষ্ঠান-সূচী প্রচার করা হয়। এমনকি ‘রেডিও পাকিস্তান’ ঢাকা এর পরিবর্তে তা’ ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ বলেও ঘোষণা করা হতে থাকে।

পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের ঢাকা ত্যাগ
যা হোক, পরদিন ২৫শে মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্টের ‘জাতির’ উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেবার কথা। বাংলাদেশের জনগণের মনে এরকম একটা আশাও উঁকি মারলো যে, হয়তো ইয়াহিয়া তাঁর ওয়াদা পালন করবেন—সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবেন। বিশেষ ক’রে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের উক্তি সে ধারণাকে উজ্জীবিত করল। ২৪শে মার্চে মিয়া মমতাজ দৌলতানা নেতৃবৃন্দের বৈঠকের ফলাফলে আশাবাদ প্রকাশ করলেন। একই দিনে জনাব ভুট্টোও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০৫

পর বলেছেন, ‘We are making some progress.’ ফলে সেদিনকার মত আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ল। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় নেতৃবৃন্দ খান আবদুল ওয়ালী খান, খান আবদুল কাইয়ুম খান, সর্দার শওকত হায়াৎ খান, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, মওলানা মুফতী মাহমুদ প্রমুখ পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করতে লাগলেন। এই নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের পন্থা উদ্ভাবনে সহায়তার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। এঁদের কেউ কেউ দফায় দফায় শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনাতেও মিলিত হয়েছিলেন, ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কার্যকলাপের সমালোচনা ক’রে, এঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা প্রদানের জন্য জোর সুপারিশও করেছিলেন। তথাপি আসল কাজ সমাধা হবার পূর্বেই আকস্মিকভাবে তাঁদের ঢাকা ত্যাগকে জনগণ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারল না।

২৫শে মার্চ
পরদিন ২৫শে মার্চ। ভোর থেকেই মিছিলের পর মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিণ করতে লাগলো। প্রত্যেকটি মিছিলেই জনতা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল।
শ্লোগানে তারা প্রত্যেক বাঙালী নেতাকে বারবার হুঁশিয়ার ক’রে দিতে লাগলো। এইদিন বঙ্গবন্ধু জনগণকে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য পুনরায় অনুরোধ জানান। তিনি বলেন যে, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, সেদিকে সকলকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
সেদিনও সকালে জনাব ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৪৫ মিনিট ধরে কথা বলেন। পরে তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘শেখ মুজিবের ৪-দফা দাবীর ব্যাপারে তাঁর দলের নীতিগতভাবে কোন আপত্তি নেই। দেশের উভয় অংশেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক, এটাই তাঁদের কাম্য।’ তিনি আরো বলেন যে, শেখ মুজিব যে স্বাধিকার দাবী তুলেছেন, তা’ স্বাধীনতারই নামান্তর। তিনি সরাসরি শেখ সাহেবের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, অথচ শেখ মুজিব তাতে রাজী হন নি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ভুট্টোর উক্তিতে অশুভ ইঙ্গিত
ক্ষমতালোভী ভুট্টো নির্লজ্জভাবে তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন। গণতান্ত্রিক আইনে পৃথিবীতে কোথাও সংখ্যালঘিষ্ঠ দল ক্ষমতার অধিকারী হয়—এ ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু ভুট্টো অবৈধভাবেই তা’ পাওয়ার জন্য যে অস্বাভাবিক অস্থিরতা প্রকাশ করেন, তার ফল দেশের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০৬

জন্য ভয়াবহ হয়েছে। শেখ মুজিব তাঁর ৬-দফা দাবী থেকে একটুও নড়বেন না এবং তাতে ব্যর্থ হ’লে যে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হবে সে কথা জেনেও জনাব ভুট্টো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতার লোভে শেখ মুজিবের নিকট থেকে অন্যরূপ বিবেচনার প্রত্যাশা করতে থাকেন। সে কথা আবার নির্লজ্জভাবে প্রকাশ করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি।

সামরিক বাহিনীর তৎপরতা
যা হোক, প্রেসিডেন্ট তাঁর বেতার ভাষণে এ ব্যাপারে একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করবেন—এ আশায় সবাই প্রতীক্ষা করতে লাগল কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, সামরিক বাহিনী আবার বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। বিশেষ ক’রে রংপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে তারা নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ১১০ জন নিহত হবার সংবাদ পাওয়া যায়। এই সংবাদে বঙ্গবন্ধু ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি এর প্রতিবাদে ২৭শে মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। কিন্তু সে হরতাল আর পালন করা সম্ভব হয় নি। তার আগেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। যে ২৫শে মার্চে ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন, সে তারিখেই তিনি ঘোষণা করলেন বাঙালীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ। বাংলার নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষের ওপর চালানো হ’ল মানবেতিহাসের নিষ্ঠুরতম ও ভয়াবহতম গণহত্যা। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের আকস্মিক ঢাকা ত্যাগের কারণ এখন আর কারো নিকট অজ্ঞাত থাকলো না। ২৫শে মার্চের কালো রাত্রি নেমে এলো। এই রাত্রির বারোটার পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম লগ্নেই বাঙালীর অবিসম্বাদিত প্রাণপ্রিয় মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকতাবে ঘোষণা করলেন। তাঁর সেই ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করবার জন্য বাংলার ঘরে ঘরে জ্বলে উঠলো রক্তলাল মশালের লেলিহান শিখা।

।। মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক তৎপরতাঃ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ।।

২৫শে মার্চের রাতে তাঁর ধানমণ্ডীস্থ বাসভবন আক্রান্ত হবার পূর্বে রাত্রি বারটার পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০৭

ঘোষণা করেন। অতঃপর তিনি তাঁর সহকর্মীদের ও দেশবাসীর উদ্দেশে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার আহ্বান জানান। তিনি ২৫শে মার্চের মধ্যরাত্রিতে সহকর্মী ও দেশবাসীর নিকট ঘোষণা করেনঃ ‘আজ থেকে (অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম লগ্ন) বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। একে যেমন করেই হোক শত্রদের হাত থেকে রক্ষা করতেই হবে।”
বঙ্গবন্ধু এই ঘোষণা বাংলার বীর জনগণের নিকট পৌঁছিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। প্রথমে ঢাকা বেতারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু বেতার কেন্দ্র পাক হানাদারগণ অবরুদ্ধ ক’রে রাখায় তা’ সম্ভব হয় নি। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শেষ পর্যন্ত ওয়ারলেসে তিনি খবরটি পৌঁছে দিতে সমর্থ হন। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা জারী করেছিলেন তা’ চট্টগ্রামের বেতারের নিকট এবং জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য তাঁরই বিশিষ্ট সহকর্মী জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী ও জনাব এম. আর. খানের সাথেও তিনি টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে জারীকৃত তাঁর এই স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তার অনুলিপি গণভবনে রক্ষিত দলিল থেকে নিম্নে উৎকলিত হ’লঃ
Declaration of War of Independence Pak Army suddenly attacked E.P.R. Base at Pilkhana, Rajarbag Police Line and killing citizens. Street battle are going on in every street of Dacca-Chittagong. I appeal to the Nations of the World for help. Our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, E. P. R., Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight. No compromise. Victory is ours. Drive out the last enemy from the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. My Allah bless you. Joy Bangla.
SK, MUJIBUR RAHMAN
সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবার জন্য ওয়ারলেসের মাধ্যমে যাদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০৮

হয় তাঁদের নাম ও ঠিকানা নিম্নে প্রদত্ত হ’ল। গণভবনে রক্ষিত ইংরেজীতে লিখিত উক্ত ঘোষণাপত্রে যেভাবে তাঁদের নাম ও ঠিকানা লিখিত আছে তার অনুলিপি নিম্নে দেয়া গেলঃ
1. Management and guidance by: A. K. S. M. A. Hakim, A. E. W.
2. Received and transmitted by: Md. Jalal Ahmed, (T. T. R.) E. S. W.
3. Aided by: Gulhashuddin, Ex. E. P. R.T.T. R.
4. Aided by: Md. Shafiqul Islam, E. S. W.
5. Aided by: Abul Kashem Khan, T.T.R.
6. Aided by: Abul Fazal, Cashiar.
এই ছ’য় জনের কোন ব্যক্তি কি ব্যবস্থা করেছেন, কে ঘোষণাটি গ্রহণ ক’রে ট্রান্সমিট করেছেন, কে কে সাহায্য করেছেন উক্ত দলিলে তা’ কালের সাক্ষী হিসেবে লিখিত রয়েছে।
জনৈক রাজনৈতিক সহকর্মী যিনি প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ মুজিবের সাথে ছিলেন, তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে আমি যে তথ্য পেয়েছি তাও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তিনি বলেন যে, স্বাধীনতা ঘোষণার একটি খসড়া তৈরী ক’রে সেটি সুন্দর ক’রে লিখে শেখ মুজিবের হাতে দেয়া হ’লে প্রথমে তিনি সেই ঘোষণায় সই করতে মৃদু আপত্তি করেন—কারণ তখনো পর্যন্ত তাঁর সহ কর্মীরা তাঁর বাসভবন থেকে চলে গেছেন কিনা এ সম্পর্কে তাঁকে নিশ্চিত হতে হবে। যখন তিনি জানলেন যে, এখন প্রায় সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন তখন তিনি সেই ঘোষণাপত্রে সই করলেন। সই করার পর সেটি সর্বত্র প্রচারের যথাযোগ্য ব্যবস্থাও তিনি সম্পন্ন করলেন।
“বাংলাদেশ—সার্বভৌম স্বাধীন-পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কথা তাদের বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮০৯

রাজারবাগে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর উপর হঠাৎ আক্রমণ চালায়। বহু নিরস্ত্র মানুষ নিহত। ঢাকা শহরে এবং ঢাকার অন্যান্য অঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশের সঙ্গে পিণ্ডির সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাঙালী শত্রুর সঙ্গে বীরের মত যুদ্ধ করছে।
আমি মুজিব বলছিঃ বাংলাদেশের কোণায় কোণায় দুশমনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আল্লাহ আপনাদের সহায় হউন, শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করুন।
জয় বাংলা।”
[ অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১]

বঙ্গবন্ধুকে কখন কিভাবে গ্রেফতার করা হয় তার বিবরণ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা সহধর্মিনী বেগম মুজিবের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যাবে। সাক্ষাৎকারটি নিম্নে উদ্ধৃত হ’লঃ
“বেগম মুজিব বলেন, প্রথম থেকেই ইয়াহিয়া পশুটাকে আমি বিশ্বাস করতাম না। গত বছরের এই দিনের স্মৃতি চারণ করতে গেলে প্রথমেই আমার মন কেঁদে উঠে। সেই ভয়াল ২৫শে মার্চের কালো রাত থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দেশের পরিজনহারা লাখো লাখো পরিবারের কথা ভেবে অশান্ত হয়ে ওঠে মন। তাই পৃথক ক’রে হিংস্র ঐ রাতটার কোন কথা বলতে বা ভাবতে আমার মন সায় দেয় না—বল্লেন শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব।….গত বছর ২৫শে মার্চের সকাল থেকে বাড়ীর অবস্থা ভার ভার লাগছিল। দুপুর তখন প্রায় সাড়ে ১২টা, আমাদের বাসার সামনে দিয়ে সৈন্য বোঝাই দু’টো ট্রাক চলে গেল। দোতলা থেকেই ট্রাকগুলো দেখে আমি নীচে চলে এলাম। শেখ সাহেব তখনও আগত লোকদের সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত। তাঁকে ভেতরে ডেকে মিলিটারী বোঝাই গাড়ী সম্বন্ধে বলতেই দেখলাম পলকের তরে মুখটা তাঁর গম্ভীর হয়ে গেল। পরক্ষণেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। সমস্ত দিনটা কেটে গেল থমথমে ভাবে। এলো রাত—সেই অশুভ রাত! রাত সাড়ে আটটায় তিনি সাংবাদিকদেরকে বিদায় দিলেন। আওয়ামী লীগ সহকর্মীদেরও কিছু কিছু নির্দেশ দিয়ে দ্রুত বিদায় দিলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১০

রাত প্রায় ১০টার কাছাকাছি। কলাবাগান থেকে এক ভদ্রলোক এসে শেখ সাহেবের সামনে একেবারে আছড়ে পড়লেন। তাঁর মুখে শুধু এক কথা—“আপনি পালান, বঙ্গবন্ধু পালান।” ভেতর থেকে তাঁর কথা শুনে শঙ্কিত হয়ে উঠলো আমারও মন। বড় মেয়েকে তার ছোট বোনটা সহ তার স্বামীর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলাম। যাবার মুহূর্তে কি ভেবে যেন ছোট মেয়েটা আমাকে আর তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। শেখ সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু বললেন, ‘বিপদে কাঁদতে নেই মা’। শেখ সাহেব তখন ভীষণ ব্যস্ত। স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারেই সম্ভবতঃ তিনি সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তখন চারিদিকে সৈন্যরা নেমে পড়েছে। ট্যাঙ্ক বের করেছে পথে। তখন অনেকেই ছুটে এসেছিল ৩২নং রোডের এই বাড়ীতে। বলেছিলো, বঙ্গবন্ধু আপনি সরে যান। উত্তরে দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে তিনি বলেছিলেন, না, কোথাও যাব না। সাড়ে সাত কোটি মানুষকে রেখে কোথাও যাব না আমি। রাত ১১টা থেকেই গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। দূর থেকে তখন গুলির শব্দ ভেসে আসছিল। দেখলাম প্রতিটি শব্দ-তরঙ্গের সাথে সাথে শেখ সাহেব সমস্ত ঘরটার মাঝে পায়চারী করছিলেন। অস্ফুটভাবে তিনি বলছিলেন, এভাবে বাঙালীকে মারা যাবে না। বাঙালী মরবে না।
আনুমানিক রাত বারটা সাড়ে বারটার পর থেকেই গুলীর শব্দ এগিয়ে এলো। ছেলেমেয়েদের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখতে পেলাম পাশের বাড়ীতে সৈন্যরা ঢুকে পড়েছে। স্পষ্ট মনে আছে, এ সময় আমি বাজের মতই ক্রুদ্ধ গর্জন শুনেছিলাম, গো অন চার্জ। সেই সাথে সাথেই শুরু হ’ল অঝোরে গোলা বর্ষণ। এই তীব্র গোলাগুলির শব্দের মধ্যেও অনুভব করলাম সৈন্যরা এবার আমার বাড়ীতে ঢুকেছে। নিরুপায় হয়ে বসেছিলাম আমার শোবার ঘরটাতে। বাইরে থেকে মুষলধারে গোলাবর্ষণ হ’তে থাকলো এই বাড়ীটা লক্ষ্য ক’রে। ওরা হয়ত এই ঘরটার মাঝেই এমনিভাবে গোলা বর্ষণ ক’রে হত্যা করতে চেয়েছিল আমাদেরকে। এমনভাবে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল যে, মনে হচ্ছিল সমস্ত বাড়ীটা বোধহয় ধ্বসে পড়বে। বারুদের গন্ধে মুখ চোখ জ্বলছিল। আর ঠিক সেই দুরন্ত মুহূর্তটাতে দেখছিলাম ক্রুদ্ধ সিংহের মত সমস্ত ঘরটার মাঝে অবিশ্রান্তভাবে পায়চারী করছিলেন শেখ সাহেব। তাঁকে এভাবে রেগে যেতে কখনো আর দেখি নি আমি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১১

আনুমানিক রাত প্রায় সাড়ে বারোটা একটার দিকে ওরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে উপরে উঠে এলো। এতক্ষণ শেখ সাহেব ওদের কিছু বলেন নি। কিন্তু এবার অস্থিরভাবে বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সামনে। পরে শুনেছি সৈন্যরা সে সময় তাঁকে হত্যা ক’রে ফেলত যদি না কর্নেল দু’হাত দিয়ে তাঁকে আড়াল করতো। ধীর স্বরে শেখ সাহেব হুকুম দিলেন গুলী থামাবার জন্য। তারপর মাথাটা উঁচু রেখেই তিনি নীচের তলায় গেলেন। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। আবার তিনি উঠে এলেন উপরে। মেজো ছেলে জামাল এগিয়ে দিল তাঁর হাতঘড়ি ও মানিব্যাগ। স্বল্প কাপড় গোছানো সুটকেস আর বেডিং তুলে নিল সৈন্যরা। যাবার মুহূর্তে একবার শুধু তিনি তাকালেন আমাদের দিকে। পাইপ আর তামাক হাতে নিয়েই বেরিয়ে গেলেন তিনি ওদের সাথে। সোফার নীচ থেকে, খাটের নীচ থেকে, আলমারীর পাশ থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকজন দলকর্মী। ওরা আস্তে আস্তে বল্লো, মাগো, আমরা আছি—আমরা আছি। ওদের সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে সে রাতে কেঁদে ফেলেছিলেন বেগম মুজিব। বলেছিলেন, খোদার কাছে হাজার শুকুর, তোদের অন্ততঃ ফেরত পেয়েছি। তোরা অন্ততঃ ধরা পড়িস নি।” এ পর্যন্ত বলেই তিনি শেষ করলেন সেই রাতটার কথা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন
সামরিক বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এবং জীবন রক্ষার্থে লক্ষ লক্ষ লোক নিজের বাসভূমি ত্যাগ ক’রে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণের প্রায় সবাই ভারতে আশ্রয় নেন। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের গণপ্রতিনিধিগণ বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা তথা মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও ত্বরান্বিত এবং রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার জন্যে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ গঠন করেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে অন্যূন ৫০ জন বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে এক বিপুল জনসমাবেশে প্রকাশ্যে এই নবজাত রাষ্ট্রের মন্ত্রী পরিষদের নাম ঘোষণা করা হয়।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫২]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১২

এতে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান মনোনীত করা হয়। উপ-রাষ্ট্রপ্রধানরূপে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীরূপে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সরকারের কার্যভার পরিচালনার দায়িত্ব পান। তবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়াও তাঁদেরকে সাহায্যের জন্য জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমদ (আইন, সংসদীয় ও পররাষ্ট্র দফতর), জনাব কামরুজামান (স্বরাষ্ট্র দফতর) এবং জনাব মনসুর আলী (অর্থ দফতর) অন্যতম মন্ত্রী হিসাবে মনোনীত হন। বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চের পূর্বেই কর্নেল এ. জি. এম. ওসমানীকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। তিনি তাঁর স্বপদেই বহাল থাকলেন।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র
ঐ দিন বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে অধ্যাপক ইউসুফ আলী (তৎকালীন জাতীয় পরিষদের চীফ হুইপ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। উক্ত ঘোষণাপত্রটি ছিল এইরূপঃ
“যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারী পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ উক্ত অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭টি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিলেন; যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বে-আইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সাথে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১৩

অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করছে এবং এখনো বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ক’রে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব ক’রে তুলেছে; যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাঁদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সেই হেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যাণ্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যাণ্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন ক’রে বাংলাদেশের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করবার উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ গঠনের কথা ঘোষণা করছি এবং এই ঘোষণা দ্বারা আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বে যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, সেই পবিত্র ঘোষণাকে অনুমোদন করছি এবং এতদ্বারা আমরা আরও অনুমোদন করছি ও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এবং জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে কাজ করবেন; রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন; রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজনবোধে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ করতে পারবেন।
তাঁর কর ধার্য ও অর্থ ব্যয় এবং গণপরিষদ অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবী ঘোষণার ক্ষমতা থাকবে। তিনি বাংলাদেশের জনসাধারণের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১৪

জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও অধিকারী হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর কর্তব্য ও প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালনে যদি তিনি অক্ষম হন তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা’ যথাযথভাবে আমরা পালন করব।
আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য আমরা অধ্যাপক মুহম্মদ ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে ও নিয়মানুগ উপায়ে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ ক’রে তাঁকে এই কাজের জন্য নিযুক্ত করলাম।”
স্বাক্ষর—
এম. ইউসুফ আলী
বাংলাদেশ গণপরিষদের পক্ষ থেকে।
(অনূদিত এবং সংক্ষেপিত)
[ (ক) বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, পররাষ্ট্র দফতর, নয়াদিল্লী, সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, পৃঃ ২৮১-৮২।
(খ) The Sunday Standard, ১৮ই এপ্রিল, ১৯৭১।
(গ) সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৯-৫১]

স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠের পর অধ্যাপক ইউসুফ আলী নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপ্রধান এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের শপথ- গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। দেশী-বিদেশী শত শত সাংবাদিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১৫

সেদিন এ দৃশ্য উপভোগ করেন। বিভিন্ন বেতারকেন্দ্র থেকেও এই বর্ণনা প্রচার করা হয়।
আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনের বৈধতা
আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ বৈধ; কেননা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতানুসারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট যদি ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয় এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করা হয় তা’ হ’লে সে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জনগণের ইচ্ছানুসারে ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে পারে।
[সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৩]

জাতিসংঘের ১৯৬০ সালের ১৪ই ও ১৫ই ডিসেম্বর-এ গৃহীত ১৫১৪ (XV), ১৫৪১ (XV) নং প্রস্তাবে উপনিবেশবাদকে তীব্রভাবে সমালোচনা করা হয়েছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে স্বীকার ক’রে নে’য়া হয়েছে; প্রস্তাবের ৫নং অনুচ্ছেদে জনগণের ইচ্ছানুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের নিকট বিনা শর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা স্পষ্ট উল্লেখিত হয়েছে।
প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইনজীবী কুইন্সি রাইট (Quincy Wright)-এর মতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লবের আশ্রয় নিতে পারে এবং জাতিসংঘের সনদেও এর যাথার্থ স্বীকৃতি হয়েছে। গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ পূজারী আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট জেফারসন (Jafferson) ১৭৭৬ সালের ৪ঠা জুলাই তারিখে তাঁর ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণায় যে কথা বলেছিলেন তা’ থেকে আমরা আলোকপ্রাপ্ত হ’তে পারিঃ
“When in the course of events, it becomes necessary for one people to dissolve the political bonds which have connected them with another, and to assume among the powers of the earth, the separate and equal station to which the laws of nature and of nature’s God entitle them, a decent respect to
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১৬

the opinions of mankind requires that they should declare the causes which impel them to the separation.”
[ Henry Steele Commager, ed, Living Ideas in America, N. Y., 1951, p. 125]

জেফারসনের এ ঘোষণার আলোকে এবং যে কোন গণতান্ত্রিক সংজ্ঞায় ও মানবাধিকারের স্বীকৃত নীতিতে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ও এই দেশের সরকার গঠন সম্পূর্ণরূপে বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত। মনে রাখতে হবে, আমেরিকার জনগণ ব্রিটেনের সম্রাট তৃতীয় জর্জের স্বৈরাচারী শাসনের নির্যাতন মাত্র ১৬ বছর সহ্য করেছিলেন। আমরা পূর্ব বাংলার জনগণ দীর্ঘ ২৪ বছর পর্যন্ত স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করেছি। আমাদের সহনশীলতা কম ছিল না। সহ্যশক্তির সব সীমা শেষ হ’লে পর আমরা যখন আমাদের ন্যায্য মানবাধিকার পাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা নিঃশেষ হতে দেখেছি, এমন কি সামরিক চক্র তাদের নির্মম পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ যখন আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, তখনই আমরা পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাষ্ট্র ও সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়েছি। এই পথ যে কোন নিরপেক্ষ বিচারে যথার্থ ও ন্যায়সঙ্গত পথ।
স্পষ্টভাবে একথা তাই প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গণপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক সামরিক শাসকচক্র তথা ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের হাত থেকে মুক্তিলাভ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা, প্রেসিডেন্ট জেফারসনের ঘোষণা, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের রাজনৈতিক দর্শন, কুইনসি রাইটের মন্তব্য ও আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের সনদের সাথে অথবা অপর সকল মানবতাবাদী নীতিসমূহের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত।

তাজউদ্দিন আহমদের ঘোষণা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের সপক্ষে বিশ্ব-জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করার জন্য বিবৃতি-বক্তৃতার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। বাংলাদেশ
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১৭

সরকার গঠন করার অব্যবহিত পরেই প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশ আজ এক মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। বর্বর পাক বাহিনী বাংলাদেশে যে নিষ্ঠুর গণহত্যা চলিয়েছে, তার ফলে বাংলাদেশের জনগণের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া খানের বোঝা উচিত, বাংলাদেশে সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালিয়ে তিনি পাকিস্তানেরই কবর খুঁড়েছেন। তাঁর এ হত্যাযজ্ঞ একটি জাতির একতা ও সংহতি রক্ষার্থে চালানো হয় নি; বরং এটা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে এক জঘন্যতম অপরাধ, বাঙালী জাতিকে ধ্বংস ক’রে দেওয়াই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। সেনাবাহিনী তাদের চিরাচরিত রীতিনীতি ভঙ্গ ক’রে যে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসলীলায় লিপ্ত রয়েছে তা’ বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। যে সমস্ত বৃহৎ শক্তিবর্গ এ গণহত্যার প্রতি উদাসীনতা প্রকাশ করেছে, তাদের উপলদ্ধি করা দরকার, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে ইয়াহিয়া খান হত্যা করেছে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ আজ এক বাস্তব সত্য। কেননা সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রত্যহ তাদের তাজা রক্ত দিয়ে এই শিশু রাষ্ট্রকে সঞ্জীবিত করছে। পৃথিবীর কোন শক্তিই এই নতুন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে পারবে না এবং আজ হোক কাল হোক বিশ্বের ছোট বড় সমস্ত রাষ্ট্রকে বাংলাদেশের এ বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবেই। সুতরাং, বিশ্বরাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থে বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়া খানের উপর প্রভাব বিস্তার করা, যেন তিনি তাঁর হত্যাকারীদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমাদের এ নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি এবং মুক্তি সংগ্রামে বৈষয়িক ও নৈতিক সাহায্য দানের জন্য বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমি আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু ও বাংলাদেশের সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, কালবিলম্ব না ক’রে এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১৮
চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন। বিশ্ববাসীর নিকট আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হ’তে পারে না, কেননা আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করে নি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করে নি।”
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৯১-৯৮]

সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ
ঐদিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামও এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “আজ এই মুজিব নগরে একটি নতুন স্বাধীন জাতি জন্ম নিল। বিগত ২৪ বছর যাবৎ বাংলার মানুষ তার নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীরা কখনই তা’ হ’তে দেয় নি। তারা আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও তারা বাধার সৃষ্টি ক’রে আমাদের উপর চালালো বর্বর আক্রমণ। তাই আমরা আজ মরণপণ যুদ্ধে নেমেছি। এ যুদ্ধে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করবোই। আজ না জিতি, কাল জিতবো; কাল না জিতি পরশু জিতবোই। বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রবর্গ আজ যে নীরবতা অবলম্বন করছেন, তার জন্য তিনি গভীর দুঃখ প্রকাশ ক’রে তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করেন—লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করাকে ইসলাম অনুমোদন করে? মসজিদ, মন্দির বা গীর্জা ধ্বংস করার কোন বিধান কি ইসলামে আছে? তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মাটিতে আর কোন সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করছে। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা ক’রে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যাবে না। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সংযোজন হ’ল, তা’ চিরদিন থাকবে। এমন কোন শক্তি নেই যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে পারে।”
[ আব্দুল গফুর, ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়বাংলা’, ঢাকা, ১৯৭২, পৃঃ ১৮৫-৮৬]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮১৯

তাজউদ্দিনের ভাষণ
১১ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনা এবং বিশ্বজনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে সকলের নিকট আবেদন জানানঃ “বাংলাদেশে যুদ্ধরত বিভিন্ন সেক্টরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত করেছে তা’ পরিদর্শনের জন্য বিদেশী সাংবাদিক, কূটনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের তিনি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা আমাদের বন্ধুদেশসমূহ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে আবেদন জানাচ্ছি। মানবিক সাহায্য ছাড়াও আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হ’ল অস্ত্রের। আমরা বৃহৎ শক্তিবর্গকে হানাদার বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্যে আবেদন করছি। যে সমস্ত দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ক’রে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, আমরা তাঁদের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি। সোভিয়েট ইউনিয়ন ও ভারত সরকার ইতিপূর্বেই গণহত্যার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ ক’রে পাকিস্তানকে এ কাজ থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রেট ব্রিটেন আগ্রহের সাথে বাংলাদেশের ঘটনাসমূহ লক্ষ্য করছেন। বার্মা ও সিংহল বিশ্বজনমতের ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানী বিমানে (planes) জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বেশীদিন চালিয়ে যেতে হবে না, কেননা দিন দিন আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিশ্বজনমত আমাদের অনুকূলে আসছে। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী।”
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৮২-৮৬]

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ঘোষণা
বাংলাদেশ-সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পূর্বাঞ্চল শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এটাই একমাত্র আইনানুগ সরকার। তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষ থেকে বিশ্বের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের কাছে নবজাত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সাহায্য দেওয়ার জন্য উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান। তিনি জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২০

সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিবর্গকে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এবং এ ব্যাপারে তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও বাংলাদেশ সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণের আবেদন জানান। ভারত এবং রাশিয়াসহ যে সমস্ত শান্তিকামী গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়েছেন, তিনি তাঁদের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন।”
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৯৮-৯৯]

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আবেদন
১৯৭১ সালের ২১শে এপ্রিল চীনপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জাতিসংঘের সেক্রেটারীর জেনারেল মিঃ উথান্ট-এর কাছে এক আবেদনে বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর যে নির্মম হত্যালীলা চালাচ্ছে তা’ বন্ধ করার জন্য পাক সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের আহ্বান জানান। বাংলাদেশের জনগণ যাতে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে, সেজন্য পাক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেও তিনি উথান্টকে অনুরোধ করেন। এছাড়া উক্ত আবেদনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে লুণ্ঠন, প্রজ্জ্বলন ও গণহত্যা প্রভৃতি চালান হচ্ছে তা’ দেখার জন্য পর্যবেক্ষকদল পাঠানোরও অনু্রোধ করা হয়। এছাড়া, চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং ও প্রধান মন্ত্রী চৌ-এন-লাই এর কাছে পাঠানো এক তারবার্তায় মওলানা ভাসানী বলেন যে, “সমাজতন্ত্রের আদর্শ হ’ল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। কিন্তু আপনারা যে সমস্ত আধুনিক মরণাস্ত্র পাকিস্তানকে দিচ্ছেন, সে সমস্ত অস্ত্রের সাহায্যে পাক সেনারা বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছে এবং এই দুর্দিনে আপনারা যদি আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ান তবে বিশ্ববাসী ভাববে যে, আপনারা নির্যাতিত জনগণের বন্ধু নন।” অন্য একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার কম্যুনিষ্ট পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল মিঃ ব্রেজনেভ, প্রেসিডেন্ট পদগর্নী এবং চেয়ারম্যান কোসিগিনের কাছে মওলানা ভাসানী এক আবেদন বার্তা পাঠান। আবেদনে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে মিঃ ব্রেজনেভ যে বিবৃতি দিয়েছেন তার প্রশংসা ক’রে এই
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২১

রক্তক্ষয়ী ধ্বংসলীলা বন্ধ করার জন্যে এবং পাক সামরিক সরকারকে সর্ব প্রকার সাহায্য বন্ধ ক’রে দেওয়ার জন্য তিনি তাঁদের নিকট অনুরোধ জানান। তা’ ছাড়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্যও তিনি তাদেরকে আহ্বান জানান।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সনের কাছে এক আবেদনে ভাসানী বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন যে সমস্ত সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানকে দিচ্ছে সে সমস্ত অস্ত্র দ্বারা ইয়াহিয়া-চক্র বাংলাদেশে জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা করছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বপ্রকার সাহায্য ও পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ ক’রে দেওয়ার জন্য তিনি আকুল আবেদন জানান। তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মিঃ পম্পিডু, যুক্তরাজ্যের প্রধান মন্ত্রী মিঃ এডওয়ার্ড হীথ, যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এর কাছেও অনুরূপ আবেদন জানান। আরব লীগের সেক্রেটারী জনাব আবদুল খালেক হাসুনিয়া ও আফ্রিকার ঐক্য সংস্থার সেক্রেটারী জেনারেল মিঃ ডিয়ালো টেলীর কাছে পাঠানো এক বার্তায় বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টি এবং বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য দানের জন্যও মওলানা ভাসানী একটি আবেদন প্রেরণ করেন।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ১ খণ্ড, পৃঃ ২৯৯-৩০৩]

সৈয়দ নজরুল ইসলামের আবেদন
মুসলিম রাষ্ট্রবর্গের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামিক সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক জনাব টেংকু আবদুর রহমানের কাছে প্রেরিত এক তারবার্তায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে অনুরোধ জানান। সম্মেলনে অংশ গ্রহণকারী বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে পাকবাহিনী ইসলামের নামে বাংলাদেশে যে নৃশংস গণ-হত্যা, নারী ধর্ষণ, মসজিদ ধ্বংস, ইমাম হত্যা ও পবিত্র কোরানের অবমাননা করছে সে সম্পর্কেও তিনি অবহিত করেন।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৩০]

আবদুস সালামের আবেদন
পূর্ব-পাকিস্তান কমুনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারী, জনাব আবদুস সালাম ১৯৭১ সালের ৩রা মে বিশ্বের সমস্ত কম্যুনিষ্ট এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২২

ওয়ার্কারস পার্টির কাছে এক আবেদনে বলেন যে, প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী মহলের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদগণকে হত্যা করছে। বাংলাদেশের জনগণ বাধ্য হয়ে নিজেদের গণতান্ত্রিক ও আত্মিনিয়ন্ত্রণাধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভাড়াটে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করছে। প্রতিক্রিয়াশীল-চক্র ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে এই স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বিশ্ব কম্যুনিস্ট আন্দোলন এবং বিশ্বের সমস্ত কম্যুনিষ্ট পার্টির সমর্থন পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। জনাব সালাম দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দানের জন্য বিশ্বের কম্যুনিষ্ট পার্টির কাছে আকুল আবেদন জানান। আবেদন বার্তায় তিনি উল্লেখ করেন যে, সাম্রাজ্যবাদী এবং মাওবাদী চীনের সমর্থনপুষ্ট বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ চলছে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩০৭-১৭]

রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নে ভাসানী
১৯৭১ সালের ২রা জুন মওলানা ভাসানী কয়েকজন স্থানীয় ও বিদেশী সাংবাদিকের সাথে বংলাদেশের কোন এক মুক্ত এলাকায় এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের সাথে কোনরকম রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। পূর্ববাংলার জনগণের মতামত যাচাই করার জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ববাংলায় গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য জনাব ভাসানী দাবী জানান। খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়াতে তিনি ভারত সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সামরিক জান্তার সাথে চীনের দহরম-মহরমের সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে,—এটা এক অদ্ভুত রাজনীতি। তিনি অবশ্য বলেন যে, অচিরেই চীন তার ভুল বুঝতে পারবে। এ সময় কেউ কেউ জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিচ্ছিলেন। মওলানা ভাসানী এর বিরোধিতা ক’রে বলেন যে, এটা করা হলে ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হবে ও ফলে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আর কোনদিন এক হ’তে পারবে না।
[বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩২৩-২৪]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২৩

তাজউদ্দিন আহমেদের আবেদন
বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার জন্য আবেদন জানান। আরব দেশগুলোকে উদ্দেশ্য ক’রে তিনি বলেন যে, এককালে আরবরা তাঁদের স্বাধীনতার জন্য তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতির যুদ্ধও অনুরূপ। তিনি আরব দেশগুলোকে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য ও সমর্থন করার জন্য আবেদন জানান। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহকেও তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করে জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, তারাই সামরিক অস্ত্র ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে পাকিস্তানে আমলাতন্ত্র, পুঁজিবাদ এবং সামরিক চক্রকে শক্তিশালী করছে। ভারতীয় সরকার ও জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতার তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। ইয়াহিয়া খানের সমর্থনপুষ্ট হয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ ক’রে প্রধান মন্ত্রী বলেন যে, এই দুরভিসন্ধি কোনদিন সাফল্যমণ্ডিত হবে না এবং বাংলাদেশের জনগণ জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩২৫-২৮]

নিক্সনের নিকট সৈয়দ নজরুলের আবেদন
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সনের কাছে এক তারবার্তায় দুঃখ ক’রে বলেন যে, আমেরিকা নতুনভাবে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করছে। পাক সরকার ঐ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশে গণহত্যার কাজে ব্যবহার করছে। তিনি পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেবার জন্য প্রেসিডন্ট নিক্সনের প্রতি আবেদন জানান।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তখন ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার অবস্থার স্বাভাবিকতা প্রমাণের জন্য বেসামরিক সরকার গঠনের এক প্রহসন চালাতে থাকেন। ডাক্তার এ. এম. মানিককে পূর্ব পাকিস্তানের (তাঁদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২৪

ভাষায়) গভর্নর পদে বসিয়ে এবং তাঁর সাহায্যে একটি অস্থায়ী পুতুল মন্ত্রিপরিষদ গঠন ক’রে এই প্রহসনের অভিনয় চালানো হয়। এই অভিনয়কে আরো জমকালো করার জন্য প্রেসিডেন্ট পূর্বাঞ্চলে উপনির্বাচনেরও ব্যবস্থা করেন। বলা বহুল্য যে, এই উপ-নির্বাচনের সবক’টি আসনই ছিল আওয়ামী লীগের সদস্যদের। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আওয়ামী লীগ বে-আইনী ঘোষিত হলে কতিপয় পরিষদ-সদস্য (আওয়ামী লীগ দলীয়) হানাদারদের সঙ্গে হাত মিলানোর ফলে স্বপদেই বহাল থাকলেন এবং অবশিষ্ট কেন্দ্রগুলোতে উপ-নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হ’ল।
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব খোন্দকার মুশতাক আহমেদ বিভিন্ন সময়ে তাঁদের ভাষণে দৃঢ়তা প্রকাশ করেন এবং এই ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে বাঙালীর বিজয় সুনিশ্চিত বলে মন্তব্য করেন।
এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ইয়াহিয়া খান বিচার করার কথা ঘোষণা করেন। এতে বিশ্ব-বিবেক প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে। ৯ই আগস্ট বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এই বিচার-প্রহসন সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন যে, এর পরিণতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে। তিনি বিশ্বের সকল দেশের কাছে এই বিচার-প্রহসন বন্ধ করার জন্যও আবেদন জানান।
[বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৪২]
১৩ই আগষ্ট জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে ঘোষণা করেন যে, যদি তাঁকে হত্যা করা হয় তা’ হলে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এক মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হবে। তিনি জানান যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচার করার ক্ষমতা স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নেই। তিনি এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র থেকে ইয়াহিয়াকে নিবৃত করবার জন্য বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আকুল আবেদন জানান।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৪৩-৪৪]
১৯৭১ সালের ২২শে অক্টোবর সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগ কার্যনির্বাহী কমিটির এক জরুরী বৈঠকে ইয়াহিয়া-চক্র কর্তৃক পূর্ব বাংলায় উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রহসনের ধৃষ্টতাকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২৫

সমুচিত জবাব দেয়ার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করা হয়। এক প্রস্তাবে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানকে বিশ্বজনমতের প্রতি ধোঁকাবাজি বলে বর্ণনা করা হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ বরদাশত করা হবে না।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৫৯]

পাকিস্তান বর্বর বাহিনীর ক্রমাগত পরাজয়ের ফলে মুক্তি-বাহিনীর প্রতি বাংলাদেশের জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থন দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। যুদ্ধের শুরুতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তি-বাহিনীকে সার্বিক সমর্থন দিয়ে আসছিলেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের সর্বমতের জনগণের অংশ গ্রহণকে নিশ্চিত করার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস দল নিয়ে সর্বদলীয় এক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে দল-মত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের যে একতা ও সহযোগিতা ছিল, এই পদক্ষেপ তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬৩]

বাংলাদেশের মুক্তি-বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও জাতীয় পরিষদ সদস্য কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে বেতার থেকে এক ভাষণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের জনগণ অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জাতীয় পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য জনগণ যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে শেষ হানাদার সৈন্যাকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত বাঙালীদের এই যুদ্ধ ক্ষান্ত হবে না। সুযোগ্য বাঙালী সামরিক অফিসারগণ মুক্তিবাহিনীকে দ্রুত সুসংগঠিত ক’রে নিয়মিত সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকদের সমন্বয়ে একটি সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত করেছেন। এ জন্যই বাংলাদেশ বাহিনীকে “মুক্তি ফৌজের” পরিবর্তে
পৃষ্ঠা নং ~ ৪২৬

‘মুক্তি-বাহিনী’ বলা হয়ে থাকে। প্রধান সেনাপতি বলেন যে, শত্রুর ওপর মুক্তি-বাহিনীর আঘাত দিন দিনই তীব্রতর হচ্ছে। অন্যদিকে দিশেহারা শত্রুবাহিনী নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা ক’রে বীরত্ব দেখাচ্ছে। প্রধান সেনাপতি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, জনগণের জয় অবধারিত।
[ অধ্যাপক আবদুল গফুর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৮-৫৯]

স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
রাজনীতিবিদ ছাড়াও বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশে যুব সমাজ, বিশেষ করে ছাত্র-সমাজকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য মানসিক ও নৈতিক দিক দিয়ে প্রস্তুত করে তুলতে তাঁরা অনেকেই বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক দর্শনও তাঁরা শরণার্থীদের নিকট ও মুক্তিবাহিনীর নিকট বারবার বিশ্লেষণ করেছেন। যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ডঃ সারোয়ার মোর্শেদ, সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, ডঃ রেহমান সোবহান, ডঃ মোশাররফ হোসেন, ডঃ আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, ডঃ অজয় রায় প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের একজন নগণ্য সেবক হিসেবে স্বাধীনতা আন্দোলনে আমার নিজেরও যৎসামান্য ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে ও অপারেশন ক্যাম্পে আমাকে নিয়মিত থাকতে হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘দৃষ্টিপাত’ নামক কথিকা প্রচার করতে হয়েছে। এছাড়া ভারতের মধ্যপ্রদেশ, দিল্লী, কেরালা, পশ্চিম বাংলা প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে জনমত গঠনে আমাকে নিরলস পরিশ্রম করতে হয়। এই সমস্ত কারণে বর্বর সরকার আমাকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য—অন্যথায় অনুপস্থিতিতে বিচারের হুমকি প্রদর্শন করে। আমার সঙ্গে যে সব বুদ্ধিজীবীর প্রতি এই হুমকি প্রদর্শন করা হয় তাঁরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডঃ মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক,
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২৭

ডঃ সারোয়ার মোর্শেদ ও জনাব আবু জাফর শামসুদ্দিন। আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয় এবং আমার অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
১৯৭১ সালের ৮ই জুন রয়েল কমনওয়েলথ সোসাইটিতে সুধীসমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যে ভাষণ দান করেন তা’ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই ভাষণ বিশ্বজনমত গঠনে ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিপদগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষকে প্রেরণা দানে সাহায্য করে।
[ ফজলুল কাদের কাদেরী, বাংলাদেশ জেনোসাইড ও ওয়ার্লড প্রেস, পৃঃ ১০৬-১২]

১৯৭১ সালের ২১শে জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য জনাব আজিজুর রহমান মল্লিক কোলকাতার রবীন্দ্র সদনে সমবেত বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের উদ্দেশে এক ভাষণে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এবং জনগণকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগের আহ্বান জানান।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭১]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ছাত্র-সমাজের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ। বিগত ১০ বছর যাবৎ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পথ প্রস্তুত করেছিলেন এই ছাত্র-সমাজ। এবারেও প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তাঁরাই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আঃ সঃ মঃ আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রমুখ ছাত্র নেতা যুব শক্তিকে একত্র ক’রে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করেন। তাঁরা বিবৃতি-বক্তৃতার মাধ্যমেও বাংলার জনগণকে মুক্তি-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ রাখতে প্রচেষ্টা চালান। এ সময় উক্ত ছাত্রনেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতিতে মাতৃভূমির মুক্তি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২৮

ত্বরান্বিত করার জন্য জনগণের রায় মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের পেছনে কাতারবন্দী হওয়ার উদ্দেশ্যে দেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজের প্রতি আকুল আবেদন জানান। তাঁরা বলেন, “বাঙালী জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত ও নির্দেশে পরিচালিত মুক্তি-সংগ্রামে আমাদের যোদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানের চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশের বীর ছাত্রসমাজের একটা মহান ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে দেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজকে আজ এগিয়ে এসে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে,বর্বর ইয়াহিয়া-চক্রকে চীন সরকার ও মার্কিন সামাজ্যবাদীরা মদদ দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, আমাদের প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে। তাঁরা আরো বলেন, ‘মাতৃভূমির মুক্তি অর্জনে প্রাণ দেওয়ার মত গৌরবজনক কাজ আর পৃথিবীতে কিছুই নাই।’ আমাদের বিজয় অবধারিত।”
[ অধ্যাপক আবদুল গফুর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯৮-৯৯]

তাছাড়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিব-বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুজিব-বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমদ, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান এবং আবদুর রাজ্জাক। দেশপ্রেমিক যুবক ও ছাত্রদের দিয়ে মুজিব-বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য এই সমস্ত তরুণরা নিজেদের অমূল্য জীবনকে আত্মোৎসর্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। শেখ মুজিব তাঁদের কাছে শুধু একজন ব্যক্তিই নন, একটা জীবন্ত রাজনৈতিক দর্শন, যে দর্শনকে পরবর্তীকালে তাঁরা ‘মুজিববাদ’ বলে আখ্যায়িত করেন। ছাত্র লীগের সংগ্রামী অংশ মুজিব-বাহিনীতে যোগ দেয়। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যে ‘বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়েছিল মুজিব-বাহিনী তার উত্তরসূরী ছিল।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৫-৫৬]

বাংলাদেশে পাক-বাহিনীর নৃশংসতা বিদেশে পাকিস্তানের দূতাবাসের বাঙালী-কূটনীতিক ও কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮২৯

বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালী কর্মচারীদের অনেকেই বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকেন। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা যুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনাবলীকে ঐ সমস্ত দেশের সরকার ও জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার জন্য ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, লণ্ডন, সুইডেন, হংকং, দিল্লী এবং কলকাতায় বাংলাদেশ-মিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘টাইম’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় যে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান দূতাবাসের ১৩০ জন বাঙালী কূটনীতিবিদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। এই সমস্ত বাঙালী কূটনীতিবিদরা পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ ক’রে দেয়ার ব্যাপারে এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭০-৭১]

।। বাঙালীর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।।
২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে পাক সেনাবাহিনীর বর্বর তৎপরতা শুরু হয়। আওয়ামী লীগ কর্মী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র এবং শ্রমিকসহ হিন্দু জনগণকে হত্যা করাই ছিল এই তৎপরতার প্রাথমিক লক্ষ্য। একই সঙ্গে বাঙালী সৈন্য, ই. পি. আর. ও পুলিশ বাহিনীর তরফ থেকে প্রতিরোধ আসতে পারে ভেবে পাক বাহিনী তাদেরকে নির্মূল করার জন্য হামলা চালায়। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে তারা নির্বিচারে বেসামরিক লোকজনের উপরও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে, তবে সামরিক লোকদের ক্ষেত্রে তার কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সেখান থেকে প্রচণ্ড বাধা আসে। সেনানিবাস, সীমান্ত ফাঁড়ি ও পুলিশ লাইনগুলোতে কোথাও সরাসরি হামলা চালিয়ে পাক বাহিনী বাঙালীকে নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করে, অস্ত্রাগারগুলো দখল ক’রে নেয় এবং বাঙালী সশস্ত্র লোকদেরকে গুলী করে হত্যা করতে থাকে। কোথাও আবার আক্রমণের শিকার হয়ে বাঙালীরা পাল্টা আক্রমণ
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩০

চালায়। ২৫ তারিখ রাত্রি থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে এবং সকল বাঙালী সশস্ত্র সেনাই এই প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
প্রসঙ্গত বলা যায় যে, ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সেনাবাহিনী ই. পি. আর. এবং পুলিশ বাহিনীর প্রায় সমস্ত বাঙালী আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এই সমস্ত লোক তাদের পাকিস্তানী সহকর্মীদের সঙ্গে বাঙালী-স্বার্থ সম্পর্কিত প্রশ্নে প্রকাশ্যে বাকবিতণ্ডার সূত্রপাত করতেন। ১৯৭১ সালে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রান্ত যখন জনগণের কাছে ক্রমশঃ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং জনগণ সুস্পষ্টভাবেই উপলদ্ধি করছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশ ভিন্ন বাঙালীদের স্বার্থ সংরক্ষণের অন্য কোন বিকল্প পথ নেই, তখন সশস্ত্র ব্যক্তিদের মধ্যেও এই উপলদ্ধির ব্যতিক্রম ঘটে নি। এই সময় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই. পি. আর. বাহিনীর অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের মধ্য থেকে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু, বিভিন্ন ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবার চেষ্টা করতেন।
[ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১৩৭৯৫ সিগন্যাল মুহম্মদ আশরাফ আলী সর্দার, বাংলাদেশ রাইফেলস্]

অসহযোগ আন্দোলনের সেই দিনগুলোতে জনগণ পাকিস্তানী শাসকচক্রের প্রতি যে সীমাহীন বিদ্বেষ ও ঘৃণায় ফেটে পড়েছিল আর বঙ্গবন্ধুর অগ্নিবর্ষী জলদগম্ভীর প্রত্যয়ী বাণীগুলো যে ভাবে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হচ্ছিল, তার অভিঘাত পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ব্যারাকের অভ্যন্তরে অবস্থিত বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ই. পি. আর-এর বাঙালীদের ভীষণভাবে আলোড়িত করে। একাত্তরের ২৩শে মার্চ তারিখে স্বাধীন-বাংলা ছাত্র-সংগ্রাম-কমিটি আহূত ‘প্রতিরোধ’ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত ই. পি. আর. সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টারগুলোতে ছাত্র-জনতা মিলে বাংলাদেশের মানচিত্র অংকিত পতাকা তুলে দিলে সেই সব স্থানে অবস্থানরত বাঙালী জোয়ান ও অফিসাররা বাধা না দিয়ে বরং শঙ্কামিশ্রিত আনন্দ অনুভব করেন।
[ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১৩৭৯৫ সিগন্যাল মুহম্মদ আশরাফ আলী সর্দার, বাংলাদেশ রাইফেলস্]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩১

এমনকি ২৩শে মার্চ তারিখে পিলখানাস্ত প্যারেড গ্রাউণ্ডের বটবৃক্ষের শীর্ষে বাঙালী ই. পি. আর-এর লোকেরা এই পতাকা উত্তোলন করেন।
[ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১৩৭৯৫ সিগন্যাল মুহম্মদ আশরাফ আলী সর্দার, বাংলাদেশ রাইফেলস্]

অবশ্য পাকিস্তানীরা এই পতাকা নামিয়ে ফেলে। ২৫শে মার্চের পূর্বেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সমস্ত সশস্ত্র ছাউনিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের আয়ত্তে আনবার প্রয়াস পায়। দেশের বিভিন্ন ই. পি. আর. সাব সেক্টর কোয়ার্টারগুলোতে বাঙালীর পরিবর্তে পাকিস্তানী কম্যাণ্ডিং অফিসার নিয়োগ, বিভিন্ন পদস্থ বাঙালী সেনাবাহিনীর লোকদেরকে পাকিস্তানে বদলী ইত্যাদি কার্যক্রম ছিল এই প্রয়াসের অংশ। ২৫শে মার্চের পূর্বেই সামরিক বাহিনীর লোকেরা ঢাকা বিমান বন্দরের সম্পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
[ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে. খোন্দকার]

পিলখানা, ই. পি. আর. হেড কোয়ার্টারে ২৫শে মার্চের পূর্বে ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের এক ব্যটেলিয়ান সৈন্য এনে রাখা হয়েছিল। ২৫শে মার্চ রাত্রে এরাই প্রথম বাঙালী ই. পি. আর-দের উপর হামলা চালায়।
[ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১৩৭৯৫ সিগন্যাল মুহম্মদ আশরাফ আলী সর্দার, বাংলাদেশ রাইফেলস্]

আগেই বলেছি, মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার অজুহাতে ইয়াহিয়া খান যে কালক্ষয় করেন তার উদ্দেশ্য ছিল প্রচুর সৈন্য নিয়ে এসে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। ঢাকা বিমান বন্দরকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবার পর মার্চের প্রথম থেকেই যাত্রীবাহী ও সামরিক বিমানের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিমান বন্দরের আকাশ-সেতু রচনা করা হয়। এই সব বিমানে শুধু সৈন্য আনা হয়। মার্চের প্রথম থেকে জলপথেও সৈন্য এবং সমর-উপকরণ আনার কাজ চলতে থাকে। ২৫শে মার্চের রাত থেকে যে বর্বর হামলা শুরু হয় তখন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা ছিল ১৮ ব্যাটেলিয়ান সমন্বিত ১ ডিভিশন। এর মধ্যে শুধু মার্চ মাসে পাকিস্তান থেকে নতুন আনা সৈন্যের পরিমাণ ছিল ১২ ব্যাটেলিয়ান। নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই এই তথ্য পরিবেশিত হ’ল।
২৫শে মার্চের রাত্রে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশের লোকেরা ও পিলখানার ই. পি. আর-এর জোয়ানরা অতর্কিত ট্যাঙ্ক ও ভারী সমরাস্ত্রের মুখে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩২

সার্থক প্রতিরোধ দিতে ব্যর্থ হন। এঁদের মধ্যে অনেকে নিহত এবং বন্দী হন। অবশিষ্টদের মধ্যে কেউ অস্ত্রসহ কেউবা বিনা অস্ত্রেই ঢাকার বাইরে ছিটকে পড়ে সংগ্রামী জনতার সঙ্গে মিশে যান। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের বাঙালী সৈন্য ও অফিসারদেরকেও নিরস্ত্র করবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রবল হামলার মুখে তৎকালীন মেজর খালেদ মুশাররফ তার ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদেরকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থেকে পাক-সেনাদের প্রতি অবরোধ-ব্যুহ রচনা করেন। কুমিল্লা শহর মুক্ত হয়। একইভাবে চট্টগ্রামের ষোলশহর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করবার চক্রান্ত চলে। কিন্তু তৎকালীন মেজর (বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়া ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল সৈন্যসহ কান্টনমেন্ট দখল করতে সক্ষম হন এবং বন্দরে অবস্থিত পাক-সেনাদেরকে অবরোধ ক’রে পাল্টা আক্রমণ চালাতে থাকেন।
[ মঞ্জুর আহমদ, ‘যে ঘোষণায় হানাদারদের বুক কেঁপে উঠেছিল’]

জয়দেবপুর সেনানিবাসে ২নং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন তৎকালীন মেজর (বর্তমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী-প্রধান মেজর জেনারেল) সফিউল্লাহ। ঢাকায় পাক-সেনাবাহিনীর বর্বরতার সংবাদ জানতে পেরে তাঁর সমস্ত সৈন্য রসদপত্র এবং যানবাহন নিয়ে ছাউনি থেকে ময়মনসিংহের পথে বেরিয়ে পড়েন। ময়মনসিংহে অবস্থানরত পুলিশ ও ই. পি. আর-এর লোকজন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষে ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। ঢাকার ঘটনা দ্রুত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাংলাদেশের সকল জেলা-শহর ও মহকুমা-শহরগুলোতেও বিচ্ছিন্নভাবে বাঙালী ই. পি. আর. ও পুলিশ বাহিনী জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁরা স্থানীয় এম. এন. এ. ও এম. পি. এ-দের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা প্রশাসন চালু করেন এবং সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ২৬শে মার্চ সকালেই নওগাঁর ই. পি. আর. উইং কম্যাণ্ডার শহীদ মেজর নজমুল হক ও তৎকালীন ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) গিয়াস স্বতঃস্ফূর্তভাবে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩৩

বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্যের শপথ নিয়ে বগুড়া ও রাজশাহী মুক্ত করবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। ২৫শে মার্চ রাত্রে রাজশাহী থেকে ঢাকার পথে পলায়নরত সেনাবাহিনী ২৬শে মার্চ সকাল থেকে পাবনা শহর আক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে পাবনার পুলিশ বাহিনী ও জনগণ প্রতিরোধ করে। এই সম্মিলিত শক্তি একজন ক্যাপ্টেন সহ প্রায় এক রেজিমেন্ট সৈন্য খতম করে। ২৭ তারিখ পাবনা শহর ও সমগ্র জেলাকে মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাবনার এই বিজয় বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।
চাঁপাই নবাবগঞ্জে ই. পি. আর. বাহিনীকে পাকিস্তানী কম্যাণ্ডিং মেজর নিরস্ত্র করতে চাইলে তাঁরা প্রতিরোধ ক’রে ২৮শে মার্চ পাক ছাউনী দখল করেন। ওদিকে ২৬ তারিখেই বরিশাল মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর বাংলাদেশের পক্ষে মেজর জলির প্রতিরক্ষা এবং নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এম. পি. বরিশালের প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এমনিভাবে আক্রমণ ও পাল্টা প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই. পি. আর. ও পুলিশের সশস্ত্র ব্যক্তিদের সঙ্গে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার সম্মিলিত ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়।
২৭শে মার্চ তারিখে তৎকালীন মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা প্রচার করেন। এই বেতার কেন্দ্র থেকে ৩০শে মার্চ তিনি পুনরায় ঘোষণা করেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বয়ং এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধের এমন সম্ভাবনাময় মুহূর্তে এই ঘোষণা সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামকে একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণায় সংহত সুদৃঢ় করে। এপ্রিলের প্রথম থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকা শহর, চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা ও কয়েকটি সেনানিবাস ছাড়া সমস্ত বাংলাদেশ মুক্ত ছিল।
[ The Sunday Statesman, New Delhi, April 18, 1971]
এপ্রিল মাসের মধ্যবর্তী সময় থেকে হানাদার বাহিনী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর সেনানিবাসগুলোর মধ্যে আকাশপথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয় এবং এই সমস্ত সেনানিবাস থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন ক’রে হামলা পরিচালিত করতে থাকে। সেনাবাহিনীর এই কাজে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩৪

বিমান বাহিনী পূর্ণরূপে ব্যবহার করা হয়। পদাতিক বাহিনী ভারী কামান ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে। স্বাভাবিকভাবেই এই অসম যুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিরোধ ব্যুহগুলো একের পর এক ভেঙে পড়ে। এইভাবে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাক-বাহিনী বাংলাদেশের জেলা ও মহকুমা শহরগুলো দখল ক’রে নিতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ বাহিনী এর ফলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু তথাপি একথা সত্য যে, জেলা ও মহকুমা শহর এবং কিছু কিছু থানা-শহর ছাড়া মধ্যবর্তী গ্রামাঞ্চল, অনেক থানা এবং ব্যাপক সীমান্ত এলাকায় হানাদার বাহিনী কখনই তাদের কর্তৃত্ব স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। ৩৭০টি সীমান্ত চৌকির ভিতর অক্টোবর মাস পর্যন্ত মাত্র ৯০টি চৌকিতে পাক-বাহিনী অবস্থান করতে পেরেছিল।
[ The Liberation War, Mohammed Ayoob K. Subramanyam, p. 155]

১০ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠন ক’রে ২৬শে মার্চে ঘোষিত স্বাধীনতাকে সমর্থন করা হয় এবং মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয়।
১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর থানার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করেন। এই সময় এই স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। একই অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনী হিসেবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেন। এবং জেনারেল ওসমানীর অধিনায়কত্বে তাঁরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ২১শে ডিসেম্বর, ১৯৭১]

বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান এবং মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়।
এর পূর্বে ৪ঠা এপ্রিল, প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কুমিল্লার তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর হেডকোয়ার্টারে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী শীর্ষস্থানীয় সামরিক অফিসারদের এক বৈঠক হয়। এই বৈঠকে তৎকালীন মেজর সফিউল্লাহ সহ যাঁরা উপস্থিত ছিলেন
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩৫

তাঁরা হলেন কর্নেল ওসমানী, তৎকালীন মেজর জিয়া, তৎকালীন মেজর খালেদ মুশাররফ, তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রাজা (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল), তৎকালীন মেজর নূরুল ইসলাম, তৎকালীন মেজর মইনুল হাসান চৌধুরী, তৎকালীন লেঃ কঃ আবদুর রব (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও গণপরিষদ সদস্য), পাক-সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর কাজী নূরুজ্জামান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল)। এই বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। পাকিস্তানী হামলার মুখে বিচ্ছিন্নভাবে যে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল এবং যে অবিন্যস্তভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছিল, সে পরিস্থিতিতে এই সমর-বিশেষজ্ঞরা একটি সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার প্রযোজন অনুভব করেছিলেন। একই সঙ্গে তাঁরা এমন একজন সিনিয়র অফিসারের অভাব অনুভব করেছিলেন, যার নেতৃত্বে সামগ্রিক যুদ্ধ পরিচালিত হতে পারে। এই বৈঠকেই সমবেত সামরিক অফিসারবৃন্দ কর্নেল ওসমানীকে সমগ্র যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নেবার অনুরোধ করেন।
[ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ]

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অবস্থান কালে কর্নেল ওসমানী সমগ্র সেনাবাহিনীতে নিজেকে একজন যোগ্য অফিসার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অপরদিকে সামরিক বাহিনীতে কার্যরত বাঙালী সৈন্যদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে এবং বাঙালী সৈন্যদের প্রতি পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের বিমাতা সুলভ আচরণের প্রতিবাদে তিনি সব সময় ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। ফলে, যোগ্যতা সত্ত্বেও তাঁকে মাত্র কর্নেল পদ থেকেই অবসর গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু অবসর গ্রহণ করলেও কর্মরত বাঙালী সৈন্যদের মাঝে তাঁর যে ইমেজ প্রতিষ্ঠিত ছিল তা’ তাঁকে একক সম্মান ও গৌরব দান করে। ধীরে ধীরে তিনি আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য হিসেবে তিনি এম. এন. এ. নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, যা একটি রাজনীতি-সম্পৃক্ত জনযুদ্ধ, সেনাপতি এমন এক ব্যক্তির হওয়া প্রয়োজন ছিল, যিনি একাধারে সৈন্য ও জনগণের আস্থাভাজন হতে পারেন। সুতরাং, সেনাবাহিনী-প্রধান হিসেবে তাঁর এই নির্বাচন সর্বত্র অভিনন্দিত হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩৬

বাংলাদেশ সরকার গঠন ও প্রধান সেনাপতি নিয়োগের পর মুক্তিবাহিনী দ্রুত সুসংগঠিত করা অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধ সুসংগঠনের প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন ছিল প্রথমতঃ যে সমস্ত সশস্ত্র বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই. পি. আর. পুলিশ, মোজাহিদ, আনসার বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন ক’রে একক কম্যাণ্ডে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়তঃ হানাদার বাহিনীর মনোভাব, শক্তি ও প্রকৃতি লক্ষ্য সাপেক্ষে যুদ্ধ স্ট্রাটেজী তৈরী করা। তৃতীয়তঃ মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী বিভিন্ন সামরিক অফিসারকে যথোপযুক্ত দায়িত্বে নিয়োগ করা এবং যুদ্ধ এলাকা নির্ধারণ করা। চতুর্থতঃ যে বিপুলসংখ্যক ছাত্র ও কৃষক-শ্রমিকের মধ্য থেকে যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আসছিল তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে নিয়োগ করা। পঞ্চমতঃ অস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধ-উপকরণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সজ্জিত করা।
এই সমস্ত প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখেই মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়। নিয়মিত সৈনিক ছাড়াও যারা মুক্তিবাহিনীর প্রধান অঙ্গ এবং অতি বীরত্বের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বহুসংখ্যক অনিয়মিত বাহিনী। বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক (গণবাহিনী), বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি এবং ছাত্র থেকে শুরু ক’রে শিল্প-কারখানার শ্রমিক ও কৃষক যুবক সহ সকল স্তরের ফৌজদের নিয়ে এই বাহিনী গঠন করা হয়।
[মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘জয়বাংলা’, ৪ঠা অক্টোবর, ১৯৭১]

মুক্তিবাহিনী সরকারী পর্যায়ে দুই ভাগে বিভক্ত ছিলঃ (১) নিয়মিত সেনাবাহিনী ও (২) গণবাহিনী। (১) বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই. পি. আর., পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর লোকদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। সরকারী পর্যায়ে এদের নামকরণ করা হয়েছিল এম. এফ. (মুক্তিফৌজ)। এই সৈন্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দশ হাজার।
[ Khushwant Singh, ‘The Freedom Fighters of Bangladesh’, Illustrated Weekly of India, 19th December, 1971, pp. 21-22]

এই বাহিনী নিয়মিত যুদ্ধ কায়দায় কখনো সম্মুখ যুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা ও প্রতিহত করত। কখনো বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩৭

দখলদার বাহিনীর রক্ষণব্যুহের অভ্যন্তরে প্রবেশ ক’রে রেড বা অ্যাম্বুশ ধরনের কম্যাণ্ডো তৎপরতা চালিয়ে নিজেদের ঘাটিতে ফিরে আসতো। আগস্ট মাসের শেষ দিকে শুধু নিয়মিত কায়দায় আক্রমণ পরিচালনা করবার জন্য ‘S’ ফোর্স, ‘K’ ফোর্স ও ‘Z’ ফোর্স গঠন করা হয়।
[ ব্যক্তিগত সাঃ, মেঃ জেঃ সফিউল্লাহ]

নৌবাহিনীর লোকদের নিয়ে একাত্তরের নভেম্বর মাসে নিয়মিত বাহিনীর অধীন নৌবাহিনী গঠন করা হয়। ৯ই নভেম্বর পাক-বাহিনীর নিকট থেকে দখল করা ছোট আকারের ৬টি নৌযান নিয়ে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু’ নৌবহরের উদ্বোধন করা হয়। এই বাহিনী দখলকৃত অঞ্চলের জলপথে কম্যাণ্ডো তৎপরতা চালাতে থাকে।
[ বাংলার বাণী, মুজিবনগর, ১২ই নভেম্বর, ১৯৭১]

বিমান বাহিনীর লোকদেরকে নিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে ‘বাংলাদেশ এয়ার ফোর্স’ও গঠন করা হয়। তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন (এয়ার ভাইস মার্শাল) এ. কে. খোন্দকারের ওপর এই বাহিনীর দায়িত্ব ছিল। ৩রা ডিসেম্বরের পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমাণ্ডের নির্দেশে এই বাহিনীর বিমান ঢাকায় ও চট্টগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা চালায়।
[ ব্যক্তিগত সাঃ, এয়ার ভাঃ মাঃ এ.কে. খোন্দকার]

(২) এফ. এফ. বা গণবাহিনী। এই বাহিনীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু ক’রে চাকুরে শ্রেণীর লোক, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর, —এক কথায় দেশের সর্বস্তরের কিশোর ও যুব শ্রেণীর লোকেরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে এঁরাই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এঁরা মূলতঃ দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা চালানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের অধীন সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ছাড়াই আরো কতিপয় গেরিলা বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (B. L. F) যা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে পরিচিত ছিল। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ এই চারজন নেতা যৌথভাবে ছিলেন উক্ত বাহিনীর হাই কমাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, আদর্শপ্রীতি এবং কর্তৃত্ব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩৮

বিভিন্ন রণাঙ্গনে এই বাহিনী যে সাফল্য অর্জন করে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ স্থানাভাবে এই গ্রন্থে দে’য়া সম্ভব নয়।
মুজিব বাহিনী মূলতঃ ছাত্রলীগের জঙ্গী মনোভাবাপন্ন সদস্যদেরকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশে পাকিস্তানী শাসকচক্রের দীর্ঘ দিনের চক্রান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যেভাবে এই ছাত্র-সমাজ বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে এসেছিল তার গৌরবোজ্জ্বল বিবরণ আমি ইতিপূর্বে একাধিক স্থানে উল্লেখ করেছি। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-সমাজ পূর্বেই ধারণা করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের মত একটি মানবতা বিবর্জিত ও হিংস্র ঔপনিবেশিক শক্তির মোকাবিলা ক’রে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হ’লে অবশ্যই দেশের জনগণকে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তা’ লাভ করতে হবে। তাই ’৭০ সালের নির্বাচনের পর পাক শাসকচক্রের চক্রান্ত সুস্পষ্ট ও পরিণত লক্ষ্যে প্রাগ্রসর হবার সাথে সাথে ছাত্রলীগের তরফ থেকেও ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এই শ্লোগান উত্থাপিত হয়। এই শ্লোগানের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিরোধ ও যুদ্ধ সম্পর্কে জনগণের মনকে পূর্বে থেকে প্রস্তুত করা ও নিজেদেরকে সেভাবে গঠন করা।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, সত্তরের মার্চ-এ অসহযোগ আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ কর্তৃক ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়েছিল। এবং ২৩শে মার্চ তারিখে এই পরিষদের দ্বারা প্রতিরোধ দিবস উদযাপনের সময় রেসকোর্স ময়দানে প্রাক্তন সৈনিক ও ছাত্রদের এক সম্মিলিত কুচকাওয়াজ ও যুদ্ধ-মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগের এই কার্যক্রমেরই পরিণতি হ’ল মুজিব বাহিনী। B. L. F.-এর সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সম্ভবতঃ এই কারণেই তা’ মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত ছিল।
মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ ছিল মূলতঃ গেরিলা যুদ্ধের। তবে এই বাহিনীকে যানবাহন ছাড়া বহনযোগ্য ভারী অস্ত্রেও সজ্জিত করা হয়েছিল।
মুজিব বাহিনী ছাড়াও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে আরেকটি গেরিলা বাহিনী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিল।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় বাহিনীর ব্যবস্থাপনা ও সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বে এফ. এফ. গেরিলাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৩৯

হয়। এই এফ. এফ-দের সংখ্যাতালিকা প্রকাশিত হয় নি, তাই নিশ্চিত ক’রে এর সংখ্যা বলা যায় না। এই প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় থেকে পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে মুক্ত অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর শিবিরগুলোতে এসে বহু যুবক বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ও ই. পি. আর-এর লোকদের নিকট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে দেশের হানাদার কবলিত অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আবার যে সব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করত তারা তাদের সহযোগীদেরকেও প্রশিক্ষণ প্রদান ক’রে রীতিমত দক্ষতার সাথে কাজ করেছিল। কাদের সিদ্দিকী ও আবদুল লতিফ মীর্জার বাহিনী যে বিস্ময়কর তৎপরতা প্রদর্শন করেন তা’ আমরা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে পারি। আনুমানিকভাবে বলা হয়ে থাকে যে, প্রায় এক লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করেছিল। সমগ্র দেশ ১১টি সেক্টরে বিভক্ত ছিল এবং শুধুমাত্র সেক্টর কমাণ্ডার তৎকালীন মেজর সফিউল্লাহর অধীনেই নভেম্বর মাসে ২৫ থেকে ২৬ হাজার গেরিলা যুদ্ধরত ছিল।
[ব্যক্তিগত সাঃ, মেঃ জেঃ সফিউল্লাহ্]

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত গেরিলা বাহিনী ও অন্যান্য গেরিলারা সবাই জনগণের নিকট মুক্তিফৌজ নামেই পরিচিত ছিল।
প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় নিয়মিত সেনাবাহিনীর লোকেরা বিপুল পরিমাণ হাল্কা অস্ত্র, গুলী ও অন্যান্য যুদ্ধোপকরণ হস্তগত করতে সক্ষম হয়। দেশের প্রায় সমস্ত পুলিশ লাইন ও ই. পি. আর. সাব-হেডকোয়ার্টারগুলোরও সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। প্রাথমিকভাবে এই সবের দ্বারাই মুক্তিবাহিনীকে সজ্জিত করা হয়েছিল। কিন্তু পাক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ক্রমবর্ধমান এক বিরাট সুসংগঠিত মুক্তি বাহিনীর জন্য এই অস্ত্র নিতান্তই অপ্রতুল ছিল। এ ব্যাপারে ভারত সরকার পূর্ণ মাত্রায় সহযোগিতা করেন। তদুপরি মুক্তিবাহিনী যুদ্ধের বিভিন্ন সময় দখলদার বাহিনীর নিকট থেকেও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাগুলী দখল ক’রে যুদ্ধে ব্যবহার করতে সমর্থ হয়।
২৫শে মার্চ তারিখের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করবার জন্য দখলদার বাহিনী নতুন নতুন প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটায়। এর একটি হ’ল দেশের সকল ক্ষমতাই যে সরকারের হাতে এ সম্পর্কে সর্বপ্রকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪০

অপপ্রচারণা। এপ্রিল মাসে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ও যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের প্রচার সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস যথার্থই বলেছেনঃ তখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের ফলে যে ইতিমধ্যেই ৫০,০০০ জীবন বিনষ্ট হয়েছে, সে কথার উল্লেখ থাকত না কিম্বা সংবাদপত্রগুলোতে একথারও উল্লেখ থাকত না যে, কেবল মাত্র এই দু’টো শহরেই কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাজ্ঞা প্রতিপালিত হচ্ছে, প্রদেশের বাকী অংশ বিদ্রোহী বাঙালীদের নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে গেছে। বাইরের প্রভাব থেকে সাফল্যের সঙ্গে জনসাধারণের চোখ ও কানকে মুক্ত ক’রে সরকার একটি উদ্ভাবনক্ষম প্রচারণা অভিযান শুরু করে। পূর্ব বাংলার প্রকৃত ঘটনাকে বিবৃত করে এবং ভারতের আসন্ন হুমকিকে সবচেয়ে বড় ক’রে দেখানোর কাজে সরকার প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। গোয়েবলস্ও একাজ ভাল ক’রে করতে পারত না।
[ বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, পৃঃ ১৪৩-৪৬]

এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় অবাঙালী ও এদেশীয় দালালদের সমন্বয়ে খাজা খয়েরুদ্দিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এদেরই আনুকূল্যে জুলাই মাসের প্রথম দিকে তৈরী হয় রাজাকার বাহিনী।
[ ১১ই জুলাই ’৭১ তারিখে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে, ১১ই, ১৮ই ও ২০শে জুলাই তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাজাকারদের চাঁদমারী অনুষ্ঠিত হবে।]
মূলতঃ গ্রামের অশিক্ষিত চাষী-মজুর শ্রেণীর লোকদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল এই বাহিনী। দু’ এক সপ্তাহের হাল্কা দু’ একটি অস্ত্রের ট্রেনিং দিয়ে গ্রামাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদেরকে প্রতিরোধের জন্য এদেরকে নিয়োগ করা হয়েছিল।
এদের কোন রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল না। তাই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ের দিকে অনেকেই মুক্তিবাহিনীর নিকট অস্ত্রসমেত আত্মসমর্পণ করেছিল। বিগত পঁচিশ বছর ধরে রাজনীতির নাম ক’রে যে সব এদেশীয় ব্যক্তি বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা ক’রে এসেছিল, সেই সব রাজনৈতিক দলের উদ্যোগেই শান্তি কমিটি তৈরী হয়। এরা গ্রাম ও শহরের বাংলাদেশপন্থী লোকের উপর সেনাবাহিনীর সাহায্যে নির্যাতন করতো। মুক্তিবাহিনীর লোকদের সংবাদ পাক-বাহিনীর নিকট সরবরাহ করতো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪১

শুধু জামাতে ইসলাম ও ইসলামী ছাত্র সংঘের লোকদের উদ্যোগে গঠন করা হয়েছিল আলবদর ও আলশামস বাহিনী। এদেরকে হাল্কা অস্ত্র শিক্ষা দে’য়া হয়েছিল। এরা মুক্তিবাহিনীর সংবাদ সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করতো। দেশ মুক্ত হবার পূর্ব-মুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের মূলতঃ এরাই হত্যা করেছিল।
দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, এটা প্রচার করার জন্য দেশে ও বিদেশে দখলদার বাহিনী তাদের পদলেহী কতিপয় বুদ্ধিজীবীকে ব্যবহার করেছিল।
[ দেশের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক আছে এবং বাঙালীদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই একথা ভিত্তিহীন, এই মর্মে ডঃ সাজ্জাদ হোসেন, ডঃ মোহর আলী কর্তৃক লণ্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় লেখা চিঠি সম্পর্কিত সংবাদ ৯ই জুলাই, ’৭১ তারিখের ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।]
ক্রমবর্ধমান আক্রমণের মুখে দখলদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে যে পুরষ্কার ঘোষণা করে সেটি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক।
দুষ্কৃতিকারীদের ব্যাপারে নিম্নহারে পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়ঃ
(ক) দুষ্কৃতিকারী গ্রেফতার অথবা দুষ্কৃতিকারীদের সাথে সফল মোকাবেলার খবর দেওয়ার জন্য ৫০০.০০ টাকা।
(খ) ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত দুষ্কৃতিকারী গ্রেফতারের জন্য ৭৫০.০০ টাকা।
(গ) রাইফেল, বোমা বা ডুপ্লিকেটিং মেশিন বা অপরাধ করে এমন অথবা অন্য কোন আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতারের জন্য ১০০০.০০ টাকা।
(ঘ) দুষ্কৃতি দলের নেতা গ্রেফতারের জন্য ২০০০.০০ টাকা। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার অথবা দুষ্কৃতি দলের নেতা গ্রেফতারের জন্য দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বড় অঙ্কের পুরষ্কার দেবার বিষয় বিবেচিত হতে পারে।
জেলা পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট এক হাজার টাকা পর্যন্ত মঞ্জুর করতে পারবেন। দুষ্কৃতিকারীদের কার্যকলাপ ও ব্যক্তিত্বের বিচারে শ্রেণীবিভাগ নিম্নরূপ হবেঃ
(ক) তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সদস্য, তথাকথিত মুক্তিবাহিনী ভর্তিতে সাহায্যকারী।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪২

(খ) স্বেচ্ছায় বিদ্রোহীদের খাদ্য, যানবাহন ও অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহকারী।
(গ) স্বেচ্ছায় বিদ্রোহীদের আশ্রয়দানকারী।
(ঘ) বিদ্রোহীদের বার্তাবাহক (Informer) রূপে যারা কাজ করে।
(চ) তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সম্পর্কিত নাশকতামূলক লিফলেট, প্যাম্পলেট প্রভৃতির লেখক বা প্রকাশক।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২৫শে নভেম্বর, ১৯৭১]

এইভাবে দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এদেশীয় দালাল সহযোগী সৃষ্টিতে তৎপর ছিল। বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এই সমস্ত দালাল সহযোগীদেরকে প্রতিরোধ ক’রে পাক-বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছেন।
সময়ানুক্রমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা চার পর্যায়ে ভাগ ক’রে বর্ণনা করা যেতে পারেঃ
প্রথম পর্যায়ঃ মে ও জুন মাস। গেরিলা তৎপরতার সূত্রপাত।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর। ঢাকা সহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের বিস্তৃতি।
তৃতীয় পর্যায়ঃ অক্টোবর থেকে ৩রা ডিসেম্বর। অভ্যন্তরভাগে গেরিলা যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি ও নিয়মিত সেনাবাহিনীর আক্রমণ।
চতুর্থ পর্যায়ঃ ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সাথে যৌথ আক্রমণ। বিজয় লাভ।
[ ব্যক্তিগত সাঃ, মেঃ জেঃ সফিউল্লাহ]

প্রথম পর্যায়ঃ মে মাস থেকেই গেরিলা অপারেশন শুরু হয়।
দখলদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী যে একটি অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই তা’ উপলব্ধ হয়। কেননা দখলদার বাহিনী বিমান, ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর এসমস্ত যুদ্ধোপকরণ ছিল না। এমনকি কোন কোন মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর বেপরোয়াভাবে বিমানের সাহায্যে মেশিনগানের গুলী ও বোমা ব্যবহার করা হয়েছে, অথচ মুক্তি-
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪৩

বাহিনীর নিকট বাধা দেবার মতো একটি বিমান বিধ্বংসী কামানও ছিল না। এসব ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, দারুণ ক্ষোভ ও উত্তেজনায় দাঁতে দাঁত চেপে কোন কোন যুবক, যে মাত্র দু’ এক দিন পূর্বে একটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে পেয়েছে, সে বারবার বৈরী বিমানের দিকে নিষ্ফল গুলী ছুঁড়ছে। সব প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়েই তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। সামনে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর বাণী, এই দুই প্রেরণাই ছিল তাদের শক্তির উৎস। তাদের বিশ্বাস ছিল, প্রতি ঘরে ঘরেই তো মুজিব আছে। আর আছে মুজিবের উদাত্ত বাণী, ‘আমরা তোমাদেরকে ভাতে মারবো, আমরা তোমাদেরকে পানিতে মারবো।’ সুতরাং, সেভাবেই মারতে হবে।
হাজার হাজার তরুণ প্রশিক্ষণ নিয়ে দখলদার বাহিনীর যোগাযোগ পথ বিচ্ছিন্ন, যোগাযোগ পথে মাইন পুঁতে রেখে দখলদার বাহিনীকে হত্যা করার নীতি গ্রহণ করে।
যুদ্ধে গেরিলা কৌশল গ্রহণ করা প্রসঙ্গে মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী বলেনঃ “যুদ্ধের প্রথম দিকে আমি আমার লোকদেরকে প্রথাগত পদ্ধতিতে খণ্ডযুদ্ধে নিয়োগ করেছিলাম। আমাদের আশা ছিল, বিদেশী শক্তিসমূহ এই অসম যুদ্ধে হস্তক্ষেপ ক’রে পাকিস্তানীদেরকে বাংলাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটাতে বলবে। কিন্তু তা’ যখন হ’ল না এবং পাকিস্তানীরা ট্যাঙ্ক, ভারী অস্ত্র এবং বোমারু বিমান সজ্জিত সাড়ে চার ডিভিশন (৪০,০০০) সৈন্য আনে, তখন আমি যুদ্ধ-কৌশল পরিবর্তন করলাম। গত মে মাসের প্রথম দিকে আমি আমার সৈন্যদেরকে পুনর্গঠিত করলাম এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলা দলে বিভক্ত ক’রে খণ্ডযুদ্ধের পরিবর্তে ‘গেরিলা পদ্ধতির’ অতর্কিত আক্রমণ পন্থা অবলম্বন করলাম। এতে ক’রে আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা হারালেও শত্রু বাহিনীকে বিস্তৃত ও বিক্ষুব্ধ গ্রাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করেছিলাম। আমরা তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ক’রে দিয়ে সব সময়ই তাদের বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলাম। প্রতিদিনই আমরা শ’খানেক ক’রে সৈন্য মারতাম আর তাদের কফিনে বিমান ভর্তি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান যেত।”
[ খোশওয়ান্ত সিং, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪৪

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর
জুলাই মাসের প্রথম দিকে মুজিবনগরে সেক্টর কমান্ডারদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ। এই সভায় কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে যুদ্ধ সম্পর্কে এক নতুনতর পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে গেরিলা ওয়ারফেয়ার চালানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১। সেক্টরের সীমানা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়।
২। গেরিলা তৎপরতা সুষ্ঠুভাবে চালাবার জন্য ভেতরে গেরিলা বেস তৈরী করতে হবে।
৩। ভেতরের গেরিলাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। নিয়মিত বাহিনীর লোকজন পরিচালনায় থাকবে।
8। খবরাখবর আনা-নেওয়ার জন্য ইন্টেলিজেন্স-চেইন তৈরী করতে হবে।
৫। প্রত্যেক গেরিলা বেস্-এ একজন ক’রে রাজনৈতিক উপদেষ্টা থাকবে যার উপদেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিত হবে।
৬। প্রত্যেক বেস-এ একটি ক’রে মেডিক্যাল টিম থাকবে।
৭। গেরিলা ওয়ারফেয়ারের সঙ্গে সঙ্গে Psychological warfare-ও চালিয়ে যেতে হবে।
৮। আমাদের সামরিক পরিকল্পনা (Tactical plan) এরকম হওয়া উচিত যাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
৯। এটা করবার পর তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
১০। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি যাতে ক’রে ঠিকভাবে চলাফেরা করতে না পারে সেজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ক’রে দিতে হবে।
১১। পাকিস্তান যেন বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল বা Finished products রফতানী ক’রে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন না করতে পারে সেজন্য দ্রব্যসামগ্রী ও সরকারী গুদাম ধ্বংস করতে হবে।
১২। কলকারখানা যেন চলতে না পারে সেজন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং পেট্রোল ইত্যাদির সরবরাহ বিধ্বস্ত করতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪৫

১৩। গাড়ী, রেল, বিমান, জলযান, ঠিকভাবে যেন চলতে না পারে। এক কথায় যোগাযোগ এবং যাতায়াত-ব্যবস্থা বিকল ক’রে দিতে হবে।
১৪। পাক সেনাবাহিনীর সাহায্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবং জনমত গড়ে তুলতে হবে।
১৫। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, বিদেশের নিকট এ ধরনের পাক প্রচারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করবার জন্য বিশেষ ক’রে ঢাকা শহরে অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
[ ব্যক্তিগত সাঃ, মেঃ জেঃ সফিউল্লাহ্]

এই যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত মেইন বেস-ক্যাম্পগুলো থেকে দখলদার বাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে ছড়িয়ে পড়ে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গড়ে ওঠে স্থায়ী ঘাঁটি। এইভাবে মহকুমা শহর থেকে জেলা শহরের অভ্যন্তর ভাগেও তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। উক্ত পরিকল্পনানুযায়ী সবাই তৎপর হয়ে ওঠে।
দেশে শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে এ কথা দেশে ও বিদেশে প্রচারণার জন্য পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এবার ‘মরিয়া হয়ে ওঠে’। কারণ পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যকারী দেশগুলি বাংলাদেশের পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সাহায্য দান বন্ধ করবার কথা ঘোষণা করেছিল।
৩১শে জুলাই তারিখে করাচীর এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পুনরায় বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের দাবী ক’রে বক্তৃতায় বলেন যে, সীমান্ত এলাকা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ৫ই আগস্ট, ১৯৭১]

কিন্তু পাক কর্তৃপক্ষের এই মিথ্যা প্রচারণা দেশী ও বিদেশী সবার নিকট বেফাস হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের গুলী আর বিস্ফোরণের তাণ্ডব কার্যকলাপে। মুক্তিযুদ্ধ চলছে—বিদেশীরা এ সম্পর্কে যাতে ক’রে জানতে না পারে তার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামেই সব চাইতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা নিয়েছিল হানাদার বাহিনী। তাই মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনায় অন্যতম লক্ষ্যস্থান নির্বাচিত হয়েছিল ঢাকা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে, জুন মাস
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪৬

থেকেই ঢাকা শহরে গেরিলাদের তৎপরতা আরম্ভ হয়েছিল। এবং একই উদ্দেশ্যে এই মাসে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সম্মুখে একই সঙ্গে তিনটি হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।
[ হেদায়েত হোসাইন মোর্শেদ লিখিত নিবন্ধঃ “মার্চ থেকে ডিসেম্বর, ১৯৭১। কারারুদ্ধ সংবাদ”, বিচিত্রা, জাতীয় দিবস সংখ্যা, ১৯৭৩।]

সেই সময় হোটেলে অবস্থান করছিলেন বিশ্বব্যাঙ্কের একটি দল এবং পাকিস্তানকে সাহায্য দানকারী কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান মিঃ কারগিল।
১১ই অগস্ট শেখ মুজিবের বিচার আরম্ভ করবার কথা প্রচারিত হবার প্রতিবাদে সেই দিনই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারিদিক কেঁপে ওঠে। এই সংবাদ হানাদার কবলিত সমস্ত পত্রিকায় ১২ই আগস্ট প্রকাশিত হয়। বলা হয়ঃ গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ল্যাভেটরীতে তিনটি বিস্ফোরণে তিনজন বিদেশী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।’
[ দৈনিক পাকিস্থান, ১২ই আগষ্ট, ১৯৭১]

দখলদার বাহিনী ও তার দালাল সহযোগীরা ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০শে আগষ্ট তারিখে ’৭১ সালের এস. এস. সি. পরীক্ষা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আর ১৯শে আগস্ট তারিখে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে মুক্তিযোদ্ধারা একই সঙ্গে উলাম পাওয়ার স্টেশন এবং খিলগাঁও পাওয়ার সাব স্টেশনটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেয়।
[ হেদায়েত হোসাইন মোর্শেদ লিখিত নিবন্ধঃ “মার্চ থেকে ডিসেম্বর, ১৯৭১। কারারুদ্ধ সংবাদ”]
পাক-বাহিনী দালাল সহযোগীদের সম্পর্কে ব্যবস্থা নেওয়া সম্পর্কিত কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় ১০ই আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, নিখিল পাকিস্তান মারকাজে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পাক দালাল মওলানা সাদানীকে ঢাকার মীরকাদিমে গেরিলারা গুলী ক’রে হত্যা করে।
[হেদায়েত হোসাইন মোর্শেদ লিখিত নিবন্ধঃ “মার্চ থেকে ডিসেম্বর, ১৯৭১। কারারুদ্ধ সংবাদ”]

এইসব সাফল্য ছাড়াও এই সময়ে অপর একটি বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাফল্য অর্জন করে। আগস্ট মাসের দিকে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর এলাকায় সমুদ্রগামী জাহাজগুলো ধ্বংস করবার জন্য মুক্তিবাহিনীর মধ্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪৭

থেকে একদল গেরিলা ফ্রগম্যান তৈরী করা হয়। ১৬ই আগস্ট এই মুক্তিসেনারা চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা এম. ভি. আরমাদ ও এম. ভি. আল আব্বাস নামক করাচী থেকে আগত অস্ত্রবাহী দু’টো জাহাজ ‘লিমপিট’ মাইনের সাহায্যে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেয়।
[ বাংলার বাণী, ১৬ই ডিসেম্বর, ’৭২ সাল, মেজর রফিকুল ইসলাম (অবসরপ্রাপ্ত) লিখিত “নিমজ্জনের সঙ্গীত” নিবন্ধ দ্রষ্টব্য] ।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ফগম্যানদের এটাই ছিল প্রথম তৎপরতা, এরপর থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিক পর্যন্ত সময়ে এঁরা প্রায় ২১টি পাকিস্তানীও বিদেশী জাহাজ বিনষ্ট করে ও ডুবিয়ে দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে তাদের ৬টি জাহাজ মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ও ডুবিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে।
[ বাংলার বাণী, মুঃ নগর, ১২ই নভেম্বর, ১৯৭১]

হানাদার কবলিত ঢাকার কাগজেও স্বীকৃতি দেখা যায়ঃ
“………এ. পি. পি’র এই খবরে প্রকাশ, সরকারী মুখপাত্র জানিয়েছেন যে ইউ. এস. এস. লাইটনিং নামের একটি খাদ্যশস্যবাহী মার্কিন জাহাজ সম্প্রতি চালনা বন্দরে লিমপিড মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
[ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

মুক্তিবাহিনীর এই সমস্ত সাফল্যের দাবী করতে গিয়ে কর্নেল ওসমানী অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে বলেনঃ “সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত আমরা হাজার পাকিস্তানী সৈন্য খতম করেছি, ২১টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছি, ধ্বংস ক’রে দিয়েছি প্রায় ৬ শো’র মত ব্রিজ ও কালভার্ট এবং রেল লাইন, সড়ক ও নৌপথে তৎপরতা চালিয়ে সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত ক’রে দিয়েছি। এর সত্যতা আপনারা যে কেউ যাচাই করতে পারেন। বাংলাদেশে এখন খুব অল্প ট্রেনই চলে এবং চালনায় কোন জাহাজ ভিড়তে পারে না। খুব শীঘ্রই চট্টগ্রাম বন্দরকেও আমরা ব্যবহার অনুপযোগী করে দেব।”
[ খোশওয়ান্ত সিং, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০]

জুলাই মাসের শেষ ও আগস্ট মাসের এই সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন আইন, সংসদীয় ও পররাষ্ট্র
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪৮

মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ বলেন, “……পাকিস্তানী সৈন্যরা যে সব স্থানে অবস্থান করে সে স্থানটুকুই তাদের দখলে থাকে। বাকী সমস্তই আমাদের। রাত্রে যেখানে তারা ঘুমায় সেই ব্যারাকগুলোই তাদের দখলে থাকে। আমাদের ছেলেরা (মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা) সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে। কেননা তাদের আছে ট্যাঙ্ক ও বিমান, আর আমাদের ছেলেরা শুধুমাত্র স্টেনগান, হ্যাণ্ডগ্রেনেড, রাইফেল আর মেশিনগান নিয়ে লড়ছে।”
[ খোশওয়ান্ত সিং, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১]

মুক্তিবাহিনীর এই ক্রমবর্ধমান সাফল্য বিদেশী সংবাদপত্রগুলোও স্বীকার করতে থাকে। Peter R. Cam ২৩শে জুলাই, ’৭১ তারিখে প্রকাশিত নিউইয়র্কের Wall Street Journal-এ লেখেনঃ An Army rule in being challenged by Bangali Garrilla forces (Mukti Bahini or Liberation army) that seem to have massive support among the Bangali population.
৩১শে জুলাই তারিখে Christian Science Monitor পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ Today, four months later the Pakistani Army controls the main cities of Bangla but not the countryside. Resistance is increasing. The Garrillas have been able twice to knock out the power stations serving Dacca, the capital. They frequently cut the rail links from Dacca to the other cities.
২রা আগস্ট News Week পত্রিকায় বলা হয়ঃ All over the country, the resistance is rapidly taking the earmarks of a classical garrilla warfare.
একই তারিখে প্রকাশিত Time Magazine-এ বলা হয়ঃ Resistance fighters already control the countryside at night and much of the day time.

এইসব পত্রিকায় ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা ক’রে বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধের অনুকূল প্রাকৃতিক অবস্থা ও বিপুল জনসমর্থনের কথা বর্ণনা করা হয়। বাংলাদেশের ধানপাটের ক্ষেতে এবং গাছপালা, ঝাড়-জঙ্গলের মাঝে গেরিলারা পাক বাহিনীকে আক্রমণ করবার চমৎকার সুযোগ পেয়েছে- এসবের এবং জনগণ কিরূপ যত্নের সাথে তাদেরকে আশ্রয় ও খাবার সামগ্রী
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৪৯

দিয়ে সাহায্য করছে তার নিখুঁত বর্ণনাও এই বিদেশী সাংবাদিকরা তুলে ধরেন।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৬১]

স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। দেশের অভ্যন্তরে জনগণের মনোবলকে জাগ্রত রাখতে এবং নতুন নতুন প্রেরণার খোরাক জোগাতে এই কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার একটি মহৎ উৎস ছিল এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর থেকে এবং যুদ্ধ-মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত অসংখ্য বুলেটিন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রভূত উপকার সাধন করে। জনগণের উদ্দেশ্যে বেসরকারী উদ্যোগে ‘বাংলার বাণী’ ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা ছাড়াও বহু পত্রিকা সীমান্ত অঞ্চলবর্তী ভারতীয় প্রেসে ছাপানো হ’ত। মুক্তিযোদ্ধারা এগুলো হানাদার কবলিত জনগণের মধ্যে গোপনে পৌঁছে দিত। বাংলাদেশের যুদ্ধ যে একটা জনযুদ্ধ এবং দুই অসম শক্তির মধ্যে লড়াই চললেও বিলম্বের মধ্য দিয়ে জনগণের জয়ই যে নিশ্চিত, একথা জনগণকে বুঝিয়ে দেবার প্রয়োজন ছিল। অন্যপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মপ্রত্যয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের আদর্শ ও দেশাত্মবোধের প্রেরণা জাগ্রত করা। এই কারণেই যুদ্ধ-পরিকল্পনায় প্রতিটি গেরিলা বেস-এ একজন ক’রে রাজনৈতিক কর্মী রাখবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম. এন. এ. ও এম. পি. সহ অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ এবং বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী সরকারী নির্দেশে এইসব গেরিলা বেস-এ অবস্থান ক’রে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানা ব্যাপারে প্রজ্ঞাবান ক’রে তুলবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমি নিজেও জুলাই ও আগস্ট মাসে জলঙ্গী, কেচুয়াডাঙ্গা, শিকারপুর, করিমপুর এবং বালুরঘাট ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করি এবং প্রশিক্ষণলিপ্ত যোদ্ধাদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে নিরলসভাবে কাজ করি। জলঙ্গী অপারেশন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠাতে নানাভাবে আমি সাহায্য করি। একবার এদের সাথে জুলাই মাসের শেষ দিকে নৌকাতে ক’রে আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিশ-পঁচিশ মাইল পর্যন্ত গিয়ে গেরিলা যুদ্ধের কয়েকটি স্থান নির্দেশ ক’রে এসেছিলাম।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫০

মুক্তিযুদ্ধকে দুর্বার ক’রে তুলবার প্রচারণার ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতারের যে ভূমিকা ছিল, অনন্তকাল ধরে বাংলার মানুষের মুখে মুখে তা’ হয়ত কিংবদন্তি হিসেবে বিরাজ করবে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম শহর হানাদার কবলিত হবার পূর্ব মুহূর্তে চট্টগ্রাম বেতারের টেকনিশিয়ান জনাব বেলাল, ইঞ্জিনিয়ার জনাব শাকের, স্টাফ ফারুক এবং আবদুল কাশেম নামক জনৈক অধ্যাপক মিলে এক কিলোয়াট শক্তি সম্পন্ন একটি ট্রান্সমিটার উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়ে আগরতলায় আসেন। এই ট্রান্সমিটারের সাহায্যে ১২ই এপ্রিল থেকে শর্টওয়েভে প্রথম অনুষ্ঠান প্রচার আরম্ভ হয়েছিল। ২৫শে মে থেকে মিডিয়াম ওয়েভে অনুষ্ঠান প্রচার আরম্ভ হয়। যুদ্ধ-পরিকল্পনা আওতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে বিন্যস্ত ও পরিচালনা করা হয়।
[ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে প্রথম থেকে জড়িত জনাব আমিনুল হক বাদশা এই তথ্য জানিয়েছেন।]

এই বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি বার বার প্রচার করা হত। উক্ত ভাষণের অংশবিশেষ ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে প্রচার করা হ’ত।
বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন নি, কিন্তু তাঁর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের অগণিত জনগণ জীবনপণ লড়াই করেছে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার কারার অন্তরালে থেকেও তিনিই এ স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। বন্দী অবস্থায় থেকেও তিনি পথ দেখিয়েছেন তাঁর বজ্রকণ্ঠের মাধ্যমে। তাঁর সে নির্দেশ বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় কিছু দালাল, ধর্মান্ধ ইসলাম ভক্ত, আলবদর, আলশামস ও রাজাকারের দল ছাড়া সৈনিক-অসৈনিক, যোদ্ধা-অযোদ্ধা, সবাই প্রতিপালনের চেষ্টা করেছে। তাঁর বজ্রকণ্ঠই ছিল সকল শক্তির উৎস। প্রত্যক্ষ সংগ্রামীদের ওপর সেই বজ্রকণ্ঠের প্রতিক্রিয়া কিরূপ জ্বলন্ত ছিল নীচের উদ্ধৃতি থেকে তা’ জানা যায়ঃ
মেজর আমিন আহমদ চৌধুরী বলেন, “আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু জেলে। বাইরের সাথে তাঁর কোন যোগসূত্রই থাকা সম্ভব নয়। তবু স্বাধীন বাংলা বেতারে তাঁর রেকর্ড করা ভাষণ বজ্রকণ্ঠ নাম দিয়ে আমাদের শোনানো হ’ত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫১

এই ভাষণটা শোনার পর মনে হ’ত যে বেতারে যেন কম্যাণ্ডারের আদেশ শুনছি। ইচ্ছা হ’ত এই মুহূর্তে ছুটে যাই রণাঙ্গনে। কয়েক দিন দৌড়ে বেরিয়েও এসেছি। হাতে একটা স্টেন, দেখতাম পিছন নিয়েছে অনেকে। পর মুহূর্তে মনে পড়তো, যেদিকে যাচ্ছি সেখানে তো বর্বরগুলোকে কালই খতম করেছি। আজ তো ওদিকে।”
বজ্রকণ্ঠ সম্পর্কে অপর একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বলেনঃ “ওটা শোনার পর মনে হতো, শিরা ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে। রাইফেল নিয়ে ছুটতে চাইতাম তক্ষুণি। নিরস্ত্র করতেন অফিসারেরা। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর একটি কথা, ‘শৃঙ্খলা ছাড়া কোন সংগ্রামে জয়লাভ করা যায় না।’ দাঁতে দাঁত চেপে শুধু ভাবতাম, রাইফেলটা পরিষ্কার করতে করতেই যেন ‘রেড’ করার আদেশটি আসে।”
এমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা ক’রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় করেছে, অপরদিকে দখলকৃত এলাকায় জনগণের মাঝে এনেছে প্রত্যয়। একই সঙ্গে হানাদার বাহিনীর সহযোগী দালালদের মনোবল এতে দুর্বল ও পঙ্গু হয়ে পড়ে। এই বেতার কেন্দ্রের অনেকগুলো অনুষ্ঠান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তার মধ্যে ‘চরমপত্র’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমি নিজেও ‘দৃষ্টিপাত’ নামে একটি কথিকা পাঠ করতাম। কথিকাটি বুদ্ধিজীবী মহলে সমাদৃত হয়।

তৃতীয় পর্যায়ঃ অক্টোবর থেকে ৩রা ডিসেম্বর
অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রামের গেরিলা তৎপরতা কেমন তীব্র আকার ধারণ করেছিল নীচের বিবরণ থেকে তা’ সহজেই অনুমান করা যাবে। অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখে মোনায়েম খান আহত হন এবং পরে তিনি মারা যান। ১৪ তারিখে টঙ্গী ও ধীরাশ্রমের মধ্যবর্তী রেল লাইন উড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৫ তারিখে ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার বান্দুরিয়ায় একটি সামরিক স্পীডবোট ছিনতাই করা হয়। ১৯ তারিখে মতিঝিলের ই. পি. আই. ডি. সি. ও হাবিব ব্যাঙ্ক ভবনের সামনে এক বিস্ফোরণে ৪টি গাড়ী বিধ্বস্ত ও দু’টি গাড়ীর ক্ষতি হয়। এই তারিখেই ডেমরার কাজলার পাড়ে এসোসিয়েটেড প্রিন্টার্স লিমিটেডের প্যাকেজিং কারখানাটি বিস্ফোরণের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫২

সাহায্যে বিধ্বস্ত হয়। ২১ তারিখে মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার কাছে রেল লাইনে বিস্ফোরণ হয়। একই তারিখে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতা মোজাফফর আহমদ মোখতারকে গুলী ক’রে মারা হয়।
২৪ তারিখে পোস্তাগোলার একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরীতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ২৫ তারিখে নারায়ণগঞ্জ কালির বাজারে বোমা বিস্ফোরণ হয়।
২৬ তারিখ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরস্থ চীনা রেস্তোরাঁয় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। একই তারিখ দিবাগত রাত্রে মতিঝিল সেন্ট্রাল গভঃ গার্লস্ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রীর বাসভবনে বিরাট এক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ২৭ তারিখে চট্টগ্রাম শহরের কনভেনশন মুসলিম লীগের সম্পাদক ও দখলদার বাহিনী কর্তৃক অনুষ্ঠিতব্য উপনির্বাচন প্রার্থী মোহাম্মদ বখতিয়ারকে গুলী করা হয়। একই দিনে চট্টগ্রামের চকবাজারে রাউজান থানার উরকির চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাহের চৌধুরীকে হত্যা করা হয়। ২৭ তারিখে ঢাকা রেল স্টেশনের অদূরে রেল লাইন উড়িয়ে দেওয়া হয়। ২৮ তারিখে ডি. আই. টি. ভবনের ৬ষ্ঠ তলার উপর একটি কক্ষে বিস্ফোরণ ঘটনো হয়। ২৯ তারিখে ‘মর্নিং নিউজ’-এর প্রবেশদ্বারে গ্রেনেড ফেলা হয়। ৩০ তারিখে অভয়দাশ লেনে অবস্থিত সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। একই তারিখে ঢাকা শহর কাঁঠাল বাগান শান্তি কমিটির সভাপতি আসাদুল্লাহ ও নারায়ণগঞ্জ শান্তি কমিটির সদস্য জনাব শাহজাহানকে হত্যা করা হয়। একই তারিখে চট্টগ্রামের জুবিলি রোডস্থ দাউদ পেট্রোলিয়ামের ‘এ্যাপোলো’ ১১ পেট্রোল পাম্পে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ৩১ তারিখে কাকরাইল পেট্রোল পাম্পে বিস্ফোরণ ঘটে। একই তারিখে পশ্চিম দেওঘর শান্তি কমিটির সদস্য ডাঃ হাবিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়।
নভেম্বর মাসের ১ তারিখে আজিমপুরস্থ আর্মি রিক্রুটিং কেন্দ্রে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ করা হয়। ২ তারিখে চট্টগ্রাম নিউমার্কেটে পুলিশ সার্জেন্ট আতিককে প্রকাশ্যভাবে গুলী ক’রে হত্যা করা হয়।
৩ তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরের গুপ্তখালি জেটিতে বার্মা ইস্টার্নের তেলবাহী জাহাজ মাহতাব জাবেদ ২নং-কে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। একই তারিখে সিদ্ধিগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের ৪টি জেনারেটর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৪ তারিখে সবুর
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫৩

খানের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ৫ তারিখে নটরডেম কলেজের সম্মুখে বিস্ফোরণের সাহায্যে টেলিফোন ক্যাবলের ক্ষতি করা হয়। ৭ তারিখে নারায়ণগঞ্জের (পি. ই. ১৯২, ঢাকা-২২ আসনে) দখলদার বাহিনীর কর্তৃত্বে প্রহসন-নির্বাচনে নির্বাচিত সুলতান উদ্দিন খান ও বন্দর থানার সোনাকান্দা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক হাজী সাহেব আলীকে হত্যা করা হয়। একই দিনে বন্দর থানার নবীগঞ্জে শান্তি কমিটির সদস্য হাজী আবদুল লতিফ সহ দুইজন দালালকে হত্যা করা হয়। একই তারিখে চট্টগ্রাম দেব পাহাড়ে ই. পি. ওয়াপদার একটি ভবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ৮ তারিখে নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।
৯ তারিখে ঢাকার বাওয়ানী একাডেমীতে বিস্ফোরণ ঘটে। ১০ তারিখে নারায়ণগঞ্জ জে. এম. সি’র একটি পাটের গুদাম ভস্মীভূত করা হয়। একই তারিখে আজিমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে এবং হলিক্রস কলেজে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১১ তারিখ বিকেলে বায়তুল মোকাররমের নিকট গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হয়। একই তারিখে সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ঐ দিন খুলনা আপেল জুট মিলে অগ্নিসংযোগ ক’রে কয়েক লক্ষ টাকার পাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ১০ তারিখে গ্রীন রোডে রেডিও ডেপুটি চীফ ইঞ্জিনিয়ারের অফিসের সামনে খুলনা কেন্দ্রের আঞ্চলিক ইঞ্জিনিয়ার বজলে হালিমকে হত্যা এবং রেডিও পাকিস্তানের ইঞ্জিনিয়ার জিয়াউর রহমান, মীর্জা নাসির উদ্দিন নামক দুই ব্যক্তিকে আহত করা হয়। ১৭ তারিখে চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক সহকারী পরিচালক জনাব আবদুল কাহারকে হত্যা করা হয়। ১৯ তারিখে ঢাকার শান্তিনগরে অবস্থিত পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের (ভি. এফ. পি.) স্থানীয় অফিস বিধ্বস্ত করা হয়। ২৫ তারিখে নারায়ণগঞ্জের দু’টো পাটের গুদাম ও ময়মনসিংহ জেলার নান্দিনায় জুট মার্কেটিং কর্পোরেশনের একটি গুদাম আগুন দিয়ে সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
প্রকাশ থাকে যে, উল্লেখিত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সংঘটিত এইসব তৎপরতার খবর সেই সময়ে প্রকাশিত দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫৪

সংবাদপত্র থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। এইসব খবরে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতির পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রেই কম দেখানো হয়েছে, কোন কোন সংবাদপত্রে খবর বেমালুম চাপা দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের সংবাদই মূলতঃ ছাপা হয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত খবর থেকে সমগ্র দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুমান করা মোটেই অসম্ভব নয়। সমগ্র দেশেই অনুরূপ অথবা আরো ব্যাপক তৎপরতা পরিচালিত হয়েছিল।
আগস্ট মাসের শেষের দিকেই মুক্তিবাহিনীর হাই কমাণ্ড থেকে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এবং এই কার্যক্রমের অধীনে ‘S’ ফোর্স, ‘K’ ফোর্স ও ‘Z’ ফোর্সের উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে।
তদুপরি এই কার্যক্রম অনুযায়ী ৯ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সেনায় কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারবৃন্দের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ তনয় শেখ কামাল এই অফিসারবৃন্দের একজন ছিলেন। শেখ কামাল একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
এর পূর্বে ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বলেনঃ “পদাতিক বাহিনী ছাড়াও আমাদের নৌ ও বিমান বাহিনীর বীর সৈনিকরা শত্রুর উপর আঘাত হানবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
[ জয়বাংলা, মুজিব নগর, ২৩শ সংখ্যা, ১৫ই অক্টোবর, ’৭১]

বস্তুতঃ হানাদার কবলিত অভ্যন্তর ভাগে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর করবার সঙ্গে সঙ্গেই সম্মুখ যুদ্ধে সীমান্ত অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সৈন্যেরা চাপ সৃষ্টি ক’রে চলেছিল। এই চাপ নভেম্বরের প্রথম থেকে আকমণাত্মক হয়ে ওঠে। এর ফলে নভেম্বরের প্রথম দিকে কুষ্টিয়া জেলার প্রায় ৮০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ওপর মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। মুক্তিবাহিনী জীবননগর পুলিশ স্টেশনটি দখল ক’রে নেয় এবং মহকুমা শহর মেহেরপুর দখল করবার জন্য যুদ্ধ চালাতে থাকে। যশোর খণ্ডে হরিনগর এবং মাজিয়াখালি এলাকায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয়। এই সময়ে দিনাজপুরের পঞ্চগড় দখল ক’রে বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল। রংপুর-দিনাজপুর খণ্ডে প্রায় ৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার স্থান মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫৫

সিলেটের শমসেরনগর বিমান বন্দরসহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। ময়মনসিংহের কমলপুরে পাক-বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রচণ্ড হয়ে ওঠে। এই সময় সিলেট, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, যশোর, দিনাজপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, খুলনা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি খণ্ডে পাক-বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এই আক্রমণের মুখে হানাদার বাহিনীর পক্ষে ব্যাপকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণে বাংলাদেশে পাক-বাহিনী দিশেহারা হয়ে ওঠে। একের পর এক সীমান্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে যেতে থাকে। ৩রা ডিসেম্বরের মধ্যে পঞ্চগড়, জীবননগর, চৌগাছা, কমলপুর, শমসেরনগর সাতক্ষীরা প্রভৃতি এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই সমস্ত এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক শাসন-ব্যবস্থা চালু করা হয়।
একদিকে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর হাতে যখন পাক-সেনাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে, তখন ভারতের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের সমর-নায়কেরা ৩রা ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় পশ্চিম খণ্ডে ভারতীয় বিমান ঘাঁটি অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর ও আগ্রার ওপর অতর্কিতে বিমান হামলা চালায় এবং বোমাবর্ষণ করে। ৩রা ডিসেম্বর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যখন কোলকাতায় ভিকটোরিয়া পার্ক ময়দানে স্মরণকালের সর্বাধিক সংখ্যক লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় এই আক্রমণ করা হয়। বক্তৃতা শেষে দ্রুত দিল্লী ফিরে গিয়ে সেদিনই গভীর রাতে তিনি এক বেতার ভাষণে বাংলাদেশের যুদ্ধকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন এবং পাকিস্তানের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

চতুর্থ পর্যায়ঃ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র-বাহিনীর যৌথ আক্রমণ ও হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ।
৪ঠা ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে পাক-সেনাদের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন ক’রে বাংলাদেশের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫৬

বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালাতে থাকে। বাংলাদেশের সাথে তখন পাকিস্তানের যোগাযোগ-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঢাকার আকাশে বিমান যুদ্ধে দু’টি পাক স্যাবর জেট ধ্বংস হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ ক’রে ঢাকা, লালমনিরহাট, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় হামলা চালিয়ে পাক-সেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। যুদ্ধে যৌথ বাহিনী বীরবিক্রমে বাংলাদেশের একের পর এক শহর-বন্দর দখল ক’রে মুক্ত করতে থাকে। ৫ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহের নিকট কমলপুরে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের ১৬০ জন সৈন্য তাদের কম্যাণ্ডার সহ যৌথ বাহিনীর নিকট আসমর্পণ করে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এই দিনই প্রথম নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের পাক-ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। আখাউড়া এবং লাকসাম এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এখানে পাক-বাহিনীর ২৫তম রেজিমেন্টের লেঃ কর্নেল বেগ সহ মোট ১২০ জন সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।
৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে পাকিস্তান-বিমান বাহিনী তাদের সবগুলো বিমান হারায়। ফলে পাক-বাহিনী তাদের আক্রমণে কোন বিমান সাহায্য পায় না। মুক্তিবাহিনী ৬ই ডিসেম্বর সাতক্ষীরা দখল ক’রে খুলনার দিকে এগোতে থাকে। অপরদিকে নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, টঙ্গী এবং জামালপুর মুক্ত ক’রে যৌথ বাহিনী ঢাকাকে অবরোধ করার চেষ্টা করতে থাকে। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ দখল ক’রে মুক্তিবাহিনী যশোরের দিকে অগ্রসর হয়।
৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষের এক আনন্দের দিন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বপ্রথম ভারত এই দিনটিতে স্বীকৃতি প্রদান করে। সকাল ১১টায় ভারতীয় লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এই স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার অভিযোগে পাকিস্তান ঐদিন দুপুর ২টায় ভারতের সাথে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
৭ই ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের মুখে পাক-বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বলে পরিচিত যশোহর ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫৭

এ ছাড়া সিলেট শহরটিও মুক্ত হয়। যশোর বিমান বন্দর এবং সিলেটের শালুটিকর বিমান বন্দরটিও যৌথ বাহিনীর দখলে আসে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এইদিন বিকাল চারটায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দেওয়া এক ভাষণে বাংলাদেশের মানুষকে চরম বিজয় মুহূর্তে শেষবারের মত সংগ্রামের আহ্বান জানান।
৮ই ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশ-সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণে কুমিল্লা শহরটি মুক্ত হয়। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টটি চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ ক’রে ফেলা হয়। চাঁদপুর ও দাউদকান্দি দখল ক’রে যৌথ বাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাংলাদেশে অবরুদ্ধ পাক-বাহিনীকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়ার জন্য সেনাধ্যক্ষ জেনারেল ম্যানেকশ পাক-সেনাদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানান।
৯ই ডিসেম্বরের মধ্যে পাক-বিমান বাহিনীর মোট ২৩টি বিমানের ২২টি বাংলাদেশের আকাশে বিধ্বস্ত হয়। ফলে পাক-সেনাদের প্রতিরোধ দুর্গ একেবারে বিধ্বস্ত হয়। বাংলাদেশ-বিমান বাহিনী ও ভারতীয় বিমান বাহিনী বিনা বাধায় বিমান হামলা চালিয়ে শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ঝিনাইদহ ও মাগুরা মুক্ত হয়। এই বাহিনী কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। অপর একদল বগুড়া-রংপুর রাস্তার মাঝখানে কালিগঞ্জ দখল করে।
১০ই ডিসেম্বর পাক-বাহিনী পিছু হটবার প্রাক্কালে ভৈরব সেতুটি ধ্বংস ক’রে দিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ভৈরব শহরটি মুক্ত করে। হেলিকপ্টারের সাহায্যে মেঘনা নদী অতিক্রম ক’রে তারা মেঘনার পশ্চিম তীরে অবস্থান করতে থাকে। এখান থেকে ঢাকা শহরটি আক্রমণের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঢাকায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস সংস্থা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং হলি ফ্যামিলী হাসপাতালকে নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষণা করে। বিদেশীদের এখানে নিরাপত্তা দেয়া হয়। বিদেশীদের ঢাকা থেকে সরিয়ে নেবার জন্য এই দিন সারাদিন ধরে ঢাকায় কোন বিমান হামলা চালানো বন্ধ রাখা হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫৮

১১ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহ এবং কুষ্টিয়া মুক্ত হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী পাকিস্তানে জেঃ ইয়াহিয়ার নিকট এবং জাতিসংঘের নিকট বাংলাদেশস্থ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জীবন রক্ষা করার জন্য আবেদন জানায়। ১২ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী ঢাকার মাত্র ৩০ মাইলের মধ্যে এসে পড়ে।
১৩ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত হয়। ১৪ই ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পাক-বাহিনী থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করতে থাকে।
এ দিকে ঐদিন জয়দেবপুরে অবস্থিত একজন ব্রিগেডিয়ারসহ এক দল পাক-সেনা আত্মসমর্পণ করে।
১৫ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ম্যানেকশ-এর জবাবে বাংলাদেশে হানাদার বাহিনী প্রধান লেঃ জেঃ নিয়াজী আত্মসমর্পণের স্বীকৃতির কথা জানায় এবং ১৬ই ডিসেম্বর সকাল নয়টায় আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করেন। ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স মাঠে এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই ৯মাস যুদ্ধের অবসান হয়।
হানাদার পাক-বাহিনী যৌথ কম্যাণ্ড মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ শত্রুর নিষ্ঠুর কবল থেকে মুক্তিলাভ করে।

॥ স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় রাজনৈতিক তৎপরতা ও জনগণের সাহায্য ॥
রাজনৈতিক তৎপরতাঃ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের ভূমিকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতীয় রাজনীতিবিদগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা নিয়ে সমগ্র পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন তা’ খুবই প্রশংসনীয়। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে বাংলাদেশের ঘটনাবলী লক্ষ্য করেছেন এবং ধীরে সুস্থে ও সাহসের সাথে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সামরিক বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে লক্ষ লক্ষ
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৫৯

শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। এটা ভারত সরকারের জন্য বিভিন্ন রকমের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করে।

মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা
এই বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হবার পর ভারতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কি ছিল তা’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৪শে ও ২৬শে মে এবং ১৫ই জুন তিনটি বক্তৃতায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণের মানবাধিকারকে পদদলিত করা হচ্ছে এবং তারা বাধ্য হয়ে নিজেদের ঘরবাড়ী ছেড়ে অসহায় অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু বৃহৎ শক্তিবর্গ এ-ব্যাপারে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সুপরিকল্পিত গণহত্যাজনিত উদ্ভূত শরণার্থী সমস্যা ভারত তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি এক মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আগমনে ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। কারণ এ সমস্যার সাথে ভারতের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিবর্গ এ-সমস্যা সমাধানের কোন গঠনমূলক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় ভারতের দায়িত্ব হ’ল শরণার্থীদের অস্থায়ীভাবে সাহায্য ও আশ্রয় দেয়া। যে পর্যন্ত বাংলাদেশে শরণার্থীদের জীবনের নিরাপত্তা, মান-সম্মানের নিশ্চয়তা এবং তাদের ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, ততদিন এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ভারত সরকার মানবিক কারণে শরণার্থীদের তাদের নিজের দেশে চলে যেতে দিতে পারে না। এই সমস্যার কোন সামরিক সমাধান সম্ভব নয়। এর একটা রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক সমাধানের অর্থই হ’ল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের সাথে আলাপ-আলোচনা করা। শ্রীমতি গান্ধী পুনরায় জোর দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশে শরণার্থী ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে নিজ বাসভূমিতে ফিরে যেতে বাধ্য করা যেতে পারে না।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৪-২৮]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬০

সমগ্র সমস্যার পর্যালোচনা ক’রে ভারত সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তা’ আন্তর্জাতিক আইন এবং শরণার্থী সংক্রান্ত আইনের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, যখন রুমানিয়া সরকার তার ইহুদী নাগরিকদের বিরুদ্ধে কতকগুলো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদেরকে আমেরিকায় যেতে বাধ্য করেছিলেন তখন আমেরিকার স্টেট সেক্রেটারী মিঃ হে মানবতার খাতিরে রুমানিয়া সরকারের জঘন্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ষষ্ঠ কমিটিতে ব্রিটেনের প্রতিনিধি মিঃ ফিটজ মরিস বলেছিলেন যে, যদি ‘ক’ রাষ্ট্র লক্ষ লক্ষ লোককে প্রতিবেশী ‘খ’ রাষ্ট্রে পাঠিয়ে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করে, তা’ হ’লে ‘খ’ রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তার জন্য ‘ক’ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩০]

ভারত সরকার লক্ষ লক্ষ আতঙ্কগ্রস্ত শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া ছাড়াও স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং স্বাধীনতাযুদ্ধকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন। ভারতের এই মহান নীতি জাতিসংঘের সনদ ও সমসাময়িক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্বলিত আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে তথা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত হস্তক্ষেপ করেন নি—ভারত যা করেছেন, মানবতার খাতিরে তা’ যে কোন দেশের পক্ষেই করা অপরিহার্য কর্তব্য। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ ‘লোকসভায়’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, “পূর্ব বাংলায় যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে ভারত সরকার সম্পূর্ণরূপে সচেতন। আজ পূর্ব বাংলায় এক নতুন ঘটনা-প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে জনগণ সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে উঠেছে। আমরা জনগণের এই জাগরণকে সমর্থন জানাচ্ছি। কিন্তু এটার অর্থ এই নয় যে, আমরা অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছি। কেননা, ভারত সরকার সব সময় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬১

করে থাকে। ভারত আশা করেছিল যে, পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এক নতুন পরিস্থিতি ও পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যার ফলে দু’ দেশ আরো কাছাকাছি আসবে; কিন্তু এটা আর হ’ল না। অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে পাকিস্তান নিজেকে আরো শক্তিশালী করার এক সুবর্ণ সুযোগ হারাল। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক, যাকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
পূর্ব বাংলায় শুধু একটা আন্দোলনকে দমন করা হচ্ছে না, সেখানে নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর ট্যাঙ্ক চালানো হচ্ছে। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় সদস্যদের আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, অত্যন্ত সচেতনভাবে পূর্ব বাংলার ঘটনা-প্রবাহের সাথে সব সময় সংযোগ রাখা হবে এবং ঠিক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। পূর্ব বাংলায় যে ব্যাপক গণহত্যা চলছে সে ব্যাপারে বিরোধী দলের সদস্যদের সাথেও তিনি আলাপ-আলোচনা করেছেন। ভবিষ্যতেও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবেন। ভারত সব সময় অত্যাচারিত ও নিপীড়িত জনগণকে সমর্থন করেছে; কিন্তু এই মারাত্মক পরিস্থিতিতে বেশী কথা না বলাই ভালো।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬৬৯-৭০]

ঐদিনই পার্লামেন্টে এক ভাষণে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ ক’রে ভারতের জনগণকে আশ্বাস প্রদান করেন যে, ভারত এই মানবিক ঘটনাবলী সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ।
ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক পার্লামেন্টে প্রস্তাব পেশ
১৯৭১ সালের ৩১শে মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে এক প্রস্তাব পেশ করেন। এভাবে বলা হয় যে, এই
সংসদ (হাউস) পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দমন করার জন্য সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান সরকার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না ক’রে একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত ঘোষণা করেছে। পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর বেয়নেট, মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারী ও বিমান বাহিনী দ্বারা নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি এই সমস্ত ঘটনাবলীতে ভারত সরকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬২

নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারে না। ভারতের জনগণ পূর্ব বাংলায় নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর এই অমানুষিক অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করছে। এই সংসদ পবিত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছে। এবং তাদের দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রকাশ করছে। এই সংসদ সেখানে নিরীহ জনগণকে হত্যা বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছে। তাছাড়া এই সংসদ সমগ্র বিশ্বের জনগণ এবং সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছে যে, তাঁরা যেন পূর্ব বাংলায় এই সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। এই সংসদ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এরূপ বিশ্বাস করে যে, পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ মহান সংগ্রামে জয়লাভ ক’রে তাদের ন্যায্য সংগ্রামে তারা ভারতের জনগণের সাহায্য এবং সহানুভূতি লাভ করবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬৭২] |

১৯৭১ সালের ২৪শে মে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে লোকসভায় আরেকবার ভাষণ দান করেন। তিনি বলেন যে, শরণার্থী সমস্যা ভারতের জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। গত ২৩ বছর ভারত পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে নি। আজ যেটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে দাবী করা হচ্ছে, সেটা ভারতের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং, আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে পাকিস্তানের যে সমস্ত কার্যকলাপ ভারতের শান্তিকামী লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন ক’রে তুলেছে, সে সমস্ত কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য পাকিস্তানকে বলার অধিকার ভারতের আছে। যদি বিশ্ব এ-ব্যাপারে উদাসীন থাকে, তা’ হ’লে ভারত তার নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬৭২-৭৫]

শেখ মুজিব সম্পর্কে শরণ সিং-এর উদ্বেগ
১৭ই জুন ওয়াশিংটন প্রেস ক্লাবে এক ভাষণে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং বলেন যে, বাংলাদেশের দুঃখজনক ঘটনা এই অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতি এক বিরাট হুমকি স্বরূপ। শেখ মুজিবের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬৩

জীবনের নিরাপত্তা সম্বন্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ক’রে সর্দার শরণ সিং বলেন যে, তিনি শুধু একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিবিদই নন, অধিকন্তু তিনি জনগণের অফুরন্ত ভালোবাসা লাভ করেছিলেন। তাঁর মুক্তির ব্যাপার আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের কার্যকলাপে উদ্ভূত পরিস্থিতি ভারতের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাই ভারত আশা করে যে, সমস্যার এমন একটি রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে যেটা পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৬৮৬-৮৯]

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট শ্রীমতি গান্ধীর বার্তা
১০ই আগষ্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এক বার্তায় বলেন যে, ইয়াহিয়া খান কর্তৃক গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের তথাকথিত বিচারের খবর শুনে ভারত সরকার ও জনগণ খুবই উদ্বিগ্ন। এই তথাকথিত বিচার-প্রহসন পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে ক’রে তুলবে এবং ভারতে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। সুতরাং, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণের ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত, যাতে এই বিচার বন্ধ করা হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং মহাশয়ও অনুরূপ এক বাণী জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে পাঠান।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৭১২]

৩০শে আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব শান্তি কাউন্সিলের সেক্রেটারী জেনারেল শ্রী রমেশচন্দ্রের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সংগ্রামকে নীতিগতভাবে সমর্থন করেন। অতঃপর শ্রীমতি গান্ধী বিশ্বের প্রধান প্রধান শক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাতে আলোচনার জন্য পাশ্চাত্য দেশগুলোর পথে রওয়ানা হয়ে যান।

সোভিয়েট রাশিয়ায় শ্রীমতি গান্ধী
২৮শে সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন কর্তৃক তাঁর সম্মানে প্রদত্ত এক ভোজসভায় বলেন যে, পূর্ব
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬৪

বাংলার জনগণ পাকিস্তান সরকারের সাথে এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে লক্ষ লক্ষ লোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। পূর্ব বাংলার ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে কিছুতেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেখানকার জনগণের কি তাদের নিজের দেশে বসবাস করার অধিকার নেই? বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এই সমস্থ লোককে আশ্রয় ও খাবার দেয়ার ক্ষমতা ভারতের নেই। শ্ৰীমতী গান্ধী জোর দিয়ে বলেন যে, এটা ভারত-পাকিস্তান সমস্যা নয়। এটা একটা অন্তর্জাতিক সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার প্রতি আন্তর্জাতিক সাড়া অত্যন্ত তুচ্ছ। শরণার্থীরা যাতে তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে, সে ব্যাপারে সাহায্য করা বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব বলে ভারত মনে করে। সোভিয়েট ইউনিয়ন সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য পাকিস্তানকে যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাতে ভারত খুবই আনন্দিত। ভারত আশা করেন যে, এই সব প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৩৭-৩৮]

‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শ্রীমতি গান্ধী
১৯শে অক্টোবর ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এক মারাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তিনি বলেন, ভারত কখনো যুদ্ধের জন্য উস্কানি দেবে না; কিন্তু সে তার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। ভারত বাঙালী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে, এই অভিযোগ শ্রীমতী গান্ধী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অস্বীকার করেন। নিক্সন প্রশাসনের সমালোচনা ক’রে তিনি বলেন যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ ক’রে চলছে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৪৮-৪৯]

ব্রাসেলসে শ্রীমতি গান্ধী
২৫শে অক্টোবর ব্রাসেলসে ‘রয়েল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স’-এ এক ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বলেন যে, পূর্ব বাংলার নব্বই লক্ষেরও বেশী লোক সামরিক সরকারের অমানুষিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬৫

নির্যাতনে টিকতে না পেরে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এতে ভারতের জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বহুলাংশে ব্যাহত হয়েছে। যারা গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোট দিয়েছিল, সামরিক জান্তা তাদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। ভারতের জনগণ ও সরকার চরম ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু ভারতের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার প্রতি এই সমস্ত ঘটনা এক বিরাট হুমকীরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সঙ্কটের মূল কারণ বের করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধান সমস্যার মূল কারণ দূরীভূত করতে পারবে বলে ভারতের বিশ্বাস। যারা বিশ্ব-শান্তিতে বিশ্বাস করেন, তাঁদের উচিত শরণার্থীরা যেন তাদের দেশে নিরাপদে এবং সসম্মানে বসবাস করতে পারে, সে ব্যাপারে চেষ্টা চালানো।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৫৩]

২৬শে অক্টোবর পশ্চিম জার্মান টেলিভিশনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম বলেন যে, ভারত কখনো যুদ্ধ চায় না। কিন্তু যুদ্ধ যদি চাপিয়ে দেয়া হয়, তা’ হ’লে সেই যুদ্ধ পাকিস্তানী ভূ-খণ্ডে পরিচালিত হবে। মুক্তিযোদ্ধারা যদি কোন এলাকা মুক্ত করে, সে জন্য ভারতকে দোষারোপ করা যায় না। ভারত ও পাকিস্তান দু’দেশই সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে। স্পটতঃই সীমান্ত পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাকর।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৫৩-৫৪]

জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী সমর সেনের ভূমিকা
২৭শে অক্টোবর জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্ৰী সমর সেন বিশ্ব নিরাপত্তা সম্পর্কে জাতিসংঘের প্রথম কমিটিতে ভারতের তরফ থেকে বাংলাদেশে যে সব ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটেই চলেছে তার বিশদ বর্ণনা প্রদান করেন। তিনি যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করেন যে, ব্যাপারটি এখন আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। জেনোসাইডজনিত পরিস্থিতির ফলে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী পাঠিয়ে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিকে বিশ্বসংস্থা এড়িয়ে যেতে পারেনা।
[ অধ্যাপক আবদুল গফুর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯২-৯৩]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬৬

অষ্ট্রিয়ান রেডিওর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শ্রীমতী গান্ধী
২৭শে অক্টোবর অষ্ট্রিয়ান রেডিওর সাথে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধী বলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান পূর্ব বাংলা সঙ্কট নিরসনের একমাত্র উপায় বলে ভারত বিশ্বাস করে। আজ ভারতের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা এক মারাত্মক হুমকীর সম্মুখীন হয়েছে। ভারত যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চায় না। কিন্তু ভারত তার জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তা রক্ষা করতে সব সময় সতর্ক থাকবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৫৪-৫৫]

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে শ্রীমতী গান্ধী
৫ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে এক ভাষণে শ্ৰীমতী গান্ধী বলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণ সামরিক সরকারের অধীনে থেকেও আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেছে। আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনার অজুহাতে সামরিক জান্তা বাংলাদেশে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। যে দিন আওয়ামী লীগ একটা আপোষের আশা করছিল, সেদিনই সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পূর্ব বাংলায় আজ প্রকৃত অর্থে গৃহযুদ্ধ চলছে না, সেখানে সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করছে। লক্ষ লক্ষ লোক ঘর-বাড়ী ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আগমন ভারতের অর্থনীতির ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করেছে। এটা একটা আন্তর্জাতিক বিরোধও নয়। প্রকৃতপক্ষে, এটা ভারত-পাকিস্তান বিরোধও নয়। ভারতকে বলা হচ্ছে যে, দু’দেশের সৈন্য মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা শান্তির প্রতি হুমকীস্বরূপ। কিন্তু যেখানে একটা জাতিকে নিশ্চিহ্ন ক’রে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে, সেটা কি শান্তির প্রতি হুমকীস্বরূপ নয়? ভারত সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। ভারত সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দকে জানিয়েছে যে, পূর্ব বাংলা সঙ্কটের সমাধানের একমাত্র উপায় হ’ল—শেখ মুজিব যদি বেঁচে থাকেন, তা’ হ’লে তাঁকে মুক্তি দেয়া এবং গণপ্রতিনিধিদের সাথে তাঁদের গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়া।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬৫-৬৭]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬৭

৬ই নভেম্বর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষণে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু ভারতের শান্তি ও স্থিতিশীলতা যদি হুমকীর সম্মুখীন হয়, তা’ হ’লে পাকিস্তানের কোন অংশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আসতে পারে না। আজ কোন কোন দেশ একজন সামরিক একনায়ককে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একজন লোকের সম্মানকে বাঁচাতে গিয়ে তারা সারা উপমহাদেশের শান্তিকে বিঘ্নিত করছে।
যে ব্যক্তিকে জনগণ নির্বাচিত করে নি, তাকে বাঁচাতে গিয়ে তারা পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। সীমান্ত এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে গেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এ কথা যারা ভাবছেন, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। সমস্যার মূল কারণগুলোকে দুরীভূত করতে হবে। ভারত কখনো যুদ্ধ চায় না। কিন্তু সে তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৭৩-৭৬]

পার্লামেন্টের অধিবেশনে শ্রীমতী গান্ধী
সোভিয়েট ইউনিয়ন, বেলজিয়াম, অষ্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানী সফর শেষ ক’রে এসে মিসেস গান্ধী ১৫ই নভেম্বর পার্লামেন্টে এক ভাষণে বলেন যে, এই সমস্ত দেশের সরকার ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন। এই আলাপ-আলোচনা অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়েছে এবং সমস্যার মূল কারণগুলো তাঁরা বুঝতে পেরেছেন।
অনেক দেশ এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধান এই সঙ্কট নিরসন করতে পারবে। অনেক দেশ শেখ মুজিবের মুক্তি দেয়া খুবই প্রয়োজনীয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। এই সফরের ফলে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, কোন দেশ বাংলাদেশের জনগণের ওপর কোন সমাধান চাপিয়ে দিতে পারবে না এবং কোন শক্তিই তাদের স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবোধকে দমন করতে পারবে না। কিন্তু ভারতকে এই সমস্ত দেশের ওপর নির্ভর ক’রে থাকলে চলবে না। ভারত এই সমস্ত দেশের সহানুভূতি, নৈতিক এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬৮

রাজনৈতিক সমর্থনের প্রশংসা করে। ভারত ও বাংলাদেশের জনগণকে সম্মিলিতভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। ভারতকে তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সব সময় সজাগ থাকতে হবে। যে পর্যন্ত না বাংলাদেশ পরিস্থিতির একটা সন্তোষজনক সমাধান হচ্ছে, সে পর্যন্ত ভারত তার সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার ঝুঁকি নিতে পারে না।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৯৩-৯৪]

ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান
ডিসেম্বরের ৩ তারিখে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ভারতও তার জবাব দানের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। তিনটি কারণের ওপর ভিত্তি ক’রে এই স্বীকৃতি দেয়া হয়ঃ
১। বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এবং সাফল্য এটাই প্রমাণ করেছিল যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে তার নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
২। বাংলাদেশ সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করেছে। প্রেসিডেন্ট জেফারসনের মতানুযায়ী বাংলাদেশ সরকার জনগণের সমর্থনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
৩। ৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে এবং ভারতের জনগণ তাদের ওপর আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য যুদ্ধ চালাচ্ছে। সুতরাং, একই কারণে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ যুদ্ধে লিপ্ত।
আগেই বলা হয়েছে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফরের সময় বিভিন্ন দেশের সরকার এবং নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশ সঙ্কটের একটা সুস্পষ্ট চিত্র তিনি তুলে ধরেছিলেন। তিনি বিশ্বের ছোটবড় শক্তিসমূহকে একথা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা দরকার। কিন্তু বিশ্ব এ-ব্যাপারে বিশেষ কোন গুরুত্ব দেয় নি। ফলে ভারতকে তার নিরাপত্তা ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৬৯

স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কম্যান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অভ্যুদয় ঘটে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। জয় বাংলা, জয় সোনার বাংলা।

জনগণের সাহায্যঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ভারতীয় জনগণের ভূমিকা তুলনাবিহীন। পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ যে সাহায্য সহানুভূতি, আন্তরিকতা-আতিথেয়তার হাত বাড়িয়ে বাংলার জনগণের জন্য এগিয়ে এসেছেন, তার সার্বিক চিত্র এই পুস্তকে স্থানাভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। বস্তুতঃ ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, মধ্যবিত্ত, কেরানী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, ইঞ্জিনীয়ার, ডাক্তার—এক কথায় আপামর জনসাধারণ আমাদের সাথে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যা করেছেন, বাংলার মানুষ তা’ শ্রদ্ধার সাথে চিরকাল স্মরণ করবে।
২৫শে মার্চের গণহত্যা আরম্ভ হবার পর থেকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যে বাস করতে থাকে। প্রতিরোধ-আন্দোলন গড়ে ওঠে সর্বত্র। এই আন্দোলন প্রায় সর্বত্রই সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম-পাক-সৈন্যদের অত্যাচারের ও আক্রমণের দুর্বারতা ক্রমেই বৃদ্ধি পায় এবং প্রতিরোধ-আন্দোলন ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। দলে দলে লোক শরণার্থী হিসেবে ভারত সীমান্তে আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকে। প্রতিরোধ-আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত ছিলেন, তাঁরাও ভারত সীমান্তে অস্ত্রের জন্য ভীড় জমাতে থাকেন। ভারতীয় জনগণ এবং জোয়ানরাও মুক্ত হস্তে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। যতই দিন যেতে থাকে, বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশার কারুণ্য যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে, ভারতীয় সাহায্যের পরিমাণ, সহানুভূতির উষ্ণতা ততই বৃদ্ধি পায়। এই সহানুভূতিতে ভারতীয় জনগণ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজীর একান্ত বিরল। সংক্ষেপে সরকারী পর্যায়ে রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। জনগণের পর্যায়েও তৎপরতা ছিল ব্যাপক এবং সর্বতোমুখী।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭০

প্রথম পর্যায়ে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে আসেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। প্রতিটি ব্যক্তি তার বাড়ির শোবার ঘর, বাইরের ঘর শরণার্থীদের জন্য ছেড়ে দেন। ক্রমে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, আশ্রম ইত্যাদি স্থানে তিল ধারণের ঠাই থাকে না। ঐ সব অঞ্চলের ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবী, বুদ্ধিজীবী পথে নেমে নানা সাহায্য-সামগ্রী সংগ্রহ ক’রে দুস্থ শরণার্থীদের আহারের ও থাকবার ব্যবস্থা করলেন। সেই সাথে শরণার্থী-শিবিরও গড়ে উঠতে দেখা গেল। প্রথম দিকে সীমান্তের নিকটবর্তী বেশ কিছু শরণার্থী-শিবির গড়ে ওঠে।
শরণার্থীদের জন্য স্থানীয় অঞ্চলের প্রত্যেকটি নাগরিক ঐকান্তিক নিষ্ঠার সাথে এগিয়ে আসেন। শিবিরগুলোর জন্য সেই সব অঞ্চলের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল, ডাল, তেল, নুন, নগদ অর্থ, বস্ত্র প্রভৃতি সংগ্রহ করে। শরণার্থী-শিবিরগুলো পরিচালনা করতে প্রতিদিন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হ’ত এবং প্রাথমিক ভাবে এই অর্থ সবই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সমাজসেবী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র-ছাত্রীরা সংগ্রহ করেছেন। ক্রমশঃ শিবিরগুলোতে জনতার ভীড় বাড়তে থাকে। এই ভীড়ের মোকাবিলা করা স্থানীয় লোকজনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তখন থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবী, ছাত্রনেতা ভারত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন শরণার্থীদের সাহায্য করবার জন্য। পরবর্তী পর্যায়ে ভারত সরকার সমস্ত শরণার্থী-শিবির সরকারী সাহায্যের আওতায় নিয়ে আসেন। লাঞ্ছিত, নিরাশ্রয় ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ক্রন্দনে ভারত সরকার ও ভারতের জনগণের সাড়া প্রমাণ করেছে যে, মানবতাকে অবমাননা থেকে রক্ষার জন্য এই দেশ তার যথার্থ দায়িত্ব পালন করেছে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই. পি. আর. (বর্তমানে বি. ডি. আর.), আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, কিছু ছাত্র এক একজন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন সীমান্তে আশ্রয় নেন। এই সমস্ত সেনাবাহিনীর তখন না ছিল আশ্রয়, না ছিল আহার-সামগ্রী। স্থানীয় লোকজন সবাই মুক্তহস্তে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। জনগণই প্রথম স্থানীয় সাহায্যে বিশেষ বিশেষ এলাকায় যুব-শিবির গড়ে তোলেন। এই
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭১

সমস্ত শিবিরে বাংলাদেশ থেকে আগত সব সৈনিক এবং যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক যুবকরা থাকতেন। যুব-শিবিরের যাবতীয় ব্যয় স্থানীয় লোকেরাই বহন করতেন। এই যুব-শিবিরগুলো পরে ভারত সরকার সরাসরি নিজেদের তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এই ক্যাম্পগুলোই ‘ইয়োথ ক্যাম্প’ ‘মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প’ ‘অপারেশন ক্যাম্প’ নামে পরিচিত হয়। যুব-শিবিরগুলো গঠনে জনগণের সাহায্য ও আন্তরিকতা সত্যি তুলনাবিহীন।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বেসরকারী পর্যায়ে নানা সাহায্য-সংস্থা গড়ে ওঠে। এই বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
এই সংস্থা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশ থেকে আগত ছিন্নমূল প্রাইমারী, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষককে বাঁচানো এবং তাঁদেরকে কাজে লাগানো, বাংলার সোনার ছেলেরা যারা জীবনকে বাজী রেখে মরণপণ লড়ছে, তাদেরকে সক্রিয় সাহায্য করা এবং বাংলাদেশে গণহত্যা তথা ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ বিশ্বের সকল দরবারে পৌঁছিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা এই ত্রিবিধ কাজেই মূলতঃ সহায়ক সমিতি আত্মনিয়োগ করে।
ছিন্নমূল শিক্ষকদের সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্য দেবার চেষ্টা এই সমিতি থেকে করা হয়েছে। আশ্রয়, অর্থ সাহায্য, জামা-কাপড় এবং তৎসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু শিক্ষকের নিয়োগের ব্যবস্থা করতেও এই সমিতির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
এ ছাড়া সমিতি থেকে প্রকাশ করা হ’ল ‘Bangladesh the Truth’, ‘মুক্তি যুদ্ধে বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি’, ‘Bleeding Bangladesh’, ‘Bangladesli through its Lens’—ইত্যাদি পুস্তক-পুস্তিকা। এই পুস্তক-পুস্তিকাগুলো সমগ্র ভারতে ও বিশ্বে জনমত গঠনে অত্যন্ত সাহায্য করেছে।
সহায়ক সমিতি ভারতের বিভিন্ন স্থানে চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল। এই চিত্রগুলোতে ছিল বাংলাদেশের গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, ধ্বংস ইত্যাদির বাস্তব ছবি।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭২

সমিতি মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিল। বিভিন্ন যুদ্ধশিবিরগুলোতে নানা খাদ্য, অর্থ, ওষুধ প্রভৃতি পাঠানো এবং আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রভৃতি সমিতির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সমিতি যার একনিষ্ঠ কর্মতৎপরতায় সাফল্য অর্জন করেছিল, তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শ্রী দিলীপ চক্রবর্তী। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক শ্রী জ্ঞানেশ পত্ৰনবীশ, অধ্যাপক শ্রী অনিল সরকার, অধ্যাপক শ্রী যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক প্রিয়দর্শন সেন শর্মা, ডঃ অনুরুদ্ধ রায়, ডঃ ধ্রুবজ্যোতি লাহিড়ী, শ্রী সৌরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক শ্রী অমিয় চৌধুরী, শ্রীমতী মৃন্ময়ী বসু, মানস হালদার প্রমুখ ব্যক্তি। এঁদের নিকট আমরা নানাভাবে ঋণী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি’ নামে অপর একটি সমিতির সাহায্যের কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। এই সমিতি বাংলাদেশের জনগণের জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, বুদ্ধিজীবীদের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। সহায়ক সমিতির সভাপতি তৎকালীন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় প্রাথমিক পর্যায়ে ২৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ ক’রে কাজ শুরু করেন। এই সমিতি মুখ্যতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই গঠিত হয়েছিল। সমিতির পক্ষ থেকে যুদ্ধরত বাংলাদেশের প্রত্যেকটি যোদ্ধাকে সাহায্য করবার ব্যবস্থা করা হয়।
মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি বাংলাদেশের সাধারণ জনমনে বিশেষ আসন দখল করেছিল। সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি ক’রে প্রশংসাপত্র দেয়া হয়েছিল। যে প্রশংসাপত্রের বলে কপর্দকশূন্য নিরাশ্রয় ছিন্নমূল মানুষ বাসে, ট্রামে, রেলগাড়ীতে সর্বত্র বিনা ভাড়াতে ভ্রমণ করতে পেরেছে। মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি ভারতবর্ষ তথা বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বেশ কিছু পুস্তক এবং পুস্তিকা প্রকাশ করেন এবং তা’ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। পুস্তিকাণ্ডলির মধ্যে ‘Birth of a Nation’ বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতির প্রতিটি কর্মী দিনরাত যে নিরলস শ্রম স্বীকার করেন, তার জন্য বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের নিকট কৃতজ্ঞ
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭৩

বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে অধিকাংশ শিল্পী ভারতের পশ্চিম বাংলাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শিল্পীদের বাঁচাবার জন্য এগিয়ে আসেন ভারতের বিশিষ্ট শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত ‘শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতি’। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন অমর কথাশিল্পী প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এর একজন নিরলস কর্মী ছিলেন কবি শ্রী সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
সমিতি ছিন্নমূল শিল্পীদের একত্র ক’রে বিভিন্ন স্থানে থাকবার ব্যবস্থা করেন। সমিতি শিল্পীদের ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তা’ ছাড়া শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা, সবার মনোবল অক্ষুন্ন রাখবার জন্য বাংলাদেশের শিল্পীদেরকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়।
‘ক্যালকাটা ইয়োথ কয়ার’ ভারতের সাংস্কৃতিক জগতে একটি বিশেষ নাম। এই কয়ারের সভাপতি বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক শ্রী সত্যজিৎ রায়। সম্পাদিকা বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী সু-গায়িকা শ্রীমতী রুমা গুহ ঠাকুরতা। ইয়োথ কয়ারের কার্যকলাপ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে নানাভাবে প্রেরণা দান করে।
এই প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠীর’ কথা কিছু বলা প্রয়োজন। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং খুলনা বেতার কেন্দ্রের বেশ কিছু সঙ্গীতশিল্পী পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্থানে অসহায়ভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন। তাঁদেরকে একত্র করলেন কলকাতার কিছু সমাজসেবী যুবক। ২৫/৩০ জন শিল্পীকে আশ্রয় এবং আহারের ব্যবস্থা করলেন। এঁদের সাহায্যেই বাংলাদেশ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানের সুযোগ লাভ করেন। কলামন্দির, রবীন্দ্র সদন, মহাজাতি সদন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়াম এবং আরো অসংখ্য স্থানে এই শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। বর্ধমান, দূর্গাপুর, টাটা, জামশেদপুর, চিত্তরঞ্জন সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এঁরা জনমত গঠনে বাংলাদেশ ভিত্তিক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জাতীয় সমন্বয় কমিটি কেবল একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকেই কাজ শুরু করে নি—এর সদস্যগণ অনেক আগে থেকেই বাঙালীদের জাতীয়তাবাদ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবার জন্য চেষ্টা ক’রে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭৪

আসছিলেন। এই কমিটি নানাভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল।
ভারতীয় জনগণের কথা বলতে গেলে ‘পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা সম্প্রীতি সমিতি’ সম্পর্কে দু’টো কথা একান্তভাবে বলা দরকার। এই সংস্থা ১৯৬৫ সাল থেকে বস্তুতঃ কাজ করেছে। সংস্থার মুখপাত্র ছিল ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’—সম্পাদক ডঃ দুলাল চৌধুরী। তখন থেকেই পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের লেখা সংগ্রহ ক’রে ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’ পত্রিকাটিতে ছাপা হ’ত। তখন থেকেই আমরা লক্ষ্য করেছি, পত্রিকাটি বাঙালী জাতীয়তাবোধ উজ্জীবনে বিশেষ সচেষ্ট। এই প্রসঙ্গে ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভবনের শ্রী বিনয় সরকার মহাশয়ের তৎপরতার কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। ১৯৭১ সালের মার্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হ’লে এই সংস্থার সদস্যগণ ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ ক’রে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সংস্থার নিরলস কর্মী অজিত রায় মহাশয়ের দান বাংলার জন্য অপরিশোধ্য।
এই প্রসঙ্গে পশ্চিম বাংলার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কথাও স্মরণ করতে হয়। সমিতি ব্যাপকভাবে বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মহলে বাংলাদেশের বাস্তব রূপটি তুলে ধরতে বিশেষ যত্নবান হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে গেলে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি’র কথাও বলা প্রয়োজন। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ অর্থদান করেছিল। তা’ ছাড়া দিল্লী সহ বিভিন্ন শহরে জনমত গঠনেও সংস্থার কর্মিগণ তৎপর ছিলেন। তাঁদের নিরলস সহযোগিতা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। এই সঙ্গে শ্রদ্ধেয়া শ্ৰীমতী মৈত্রেয়ী দেবীকেও স্মরণ করি। তিনি বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম সুহৃদ।
এখানে শুধু পশ্চিম বাংলার কয়েকটি সমিতি বা সংস্থার বা কিছু মহান ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের সকল অঙ্গরাজ্যে এমনি অসংখ্য সমিতি ও সংস্থা বাংলাদেশের জন্য গড়ে উঠেছিল। এই সমস্ত সংস্থার ভূমিকাও ছিল উজ্জ্বল ও প্রশংসনীয়। সংস্থাসমূহের কার্যকলাপের বিবরণ এতই ব্যাপক যে, এখানে তা’ উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭৫

।। পাকিস্তানের প্রশাসক ও রাজনীতিবিদ।।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান থেকে শুরু ক’রে সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসার এবং বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের উস্কানিমূলক বক্তৃতা, বিবৃতি ও কার্যকলাপ থেকে এটাই স্পষ্ট হয়েছিল যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান তাঁদের কাম্য নয়, বরঞ্চ ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের ফলে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু ক’রে বিশ্বের নিকট তাঁরা যে জঘন্যভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। তা’ ঢাকবার জন্য বিশ্বজনমতকে তাঁরা ধোঁকা দেবার চেষ্টায় ব্রতী হলেন এবং বাংলাদেশের ঘটনাবলী থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু করার হুমকী দিতে থাকেন। বাঙালী জাতির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেন এবং সামরিক আদালতে তাঁর বিচার করা হবে বলেও হুমকী দেন।

পাকিস্তান টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান
১৯৭১ সালের ৩রা আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশন থেকে প্রচারিত এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন,
অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পূর্ববর্তী নির্বাচনী ওয়াদা থেকে বিচ্যুত হয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন এবং তাঁর সমস্ত কার্যকলাপ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ও বিদ্রোহী ভাবাপন্ন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের কার্যকলাপে দুঃখ প্রকাশ ক’রে বলেন যে, একজন রাষ্ট্রদ্রোহীর যেভাবে সাজা হওয়া উচিত, শেখ মুজিবুর রহমানেরও সেভাবেই সাজা হবে।
১৭ই অক্টোবর ফ্রান্সের ‘লি মণ্ডে’ পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, যে পর্যন্ত না সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করবে, সে পর্যন্ত তিনি বিদ্রোহী শেখ মুজিবের সাথে কোন আলাপ-আলোচনা করতে পারেন না।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩১-৩২]

বি. বি. সি’র সাথে সাক্ষাৎকার
পূর্বে ২রা আগস্ট তারিখে ‘পাকিস্তান টাইমস’-এ প্রকাশিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বি. বি. সি. প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭৬

সাথে যুদ্ধ শুরু হবে বলে একবার আভাস দেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে যুদ্ধ যদি অব্যাহত থাকে তা’ হ’লে ভারতের সাথে যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। আমেরিকার ‘কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিসটেম’এর জনৈক মুখপাত্রের সাথেও এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অত্যাসন্ন। ১লা অক্টোবর ফ্রান্সের ‘লি ফিগারো’তে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিশ্ববাসীকে সতর্ক ক’রে দিয়ে বলেন যে, ভারত যদি পাকিস্তানের এক ইঞ্চি ভূমি দখল করার চেষ্টা করে, তা’ হ’লে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পিছপা হবে না।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৬-৩৭]

রহমান গুল ও নিয়াজী
১৮ই সেপ্টেম্বর সিন্ধুর গভর্নর লেঃ জেঃ রহমান গুল এক ভাষণে বলেন যে, ভারতের যে কোন প্রকার আক্রমণাত্মক অভিসন্ধির মোকাবিলা করতে পাকিস্তান প্রস্তুত এবং ভারত যদি পাকিস্তানের কোন ক্ষুদ্র এলাকাও দখল করার চেষ্টা করে, তা’ হ’লে ভারতের সে আক্রমণকে নস্যাৎ ক’রে দেয়া হবে। ৭ই অক্টোবর পূর্ব বাংলার তৎকালীন সামরিক প্রশাসক লেঃ জেঃ নিয়াজী সৈয়দপুরে এক ভাষণে বলেন যে, ভারত যদি পাকিস্তানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তা’ হ’লে ভারতের ভূখণ্ডেই এ যুদ্ধ পরিচালিত হবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৭-৩৮]

ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ
একাত্তরের ১২ই অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, যারা পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল, তারা একে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। গত ২৪ বছর যাবৎ পাকিস্তান ভারতের সাথে শান্তিতে বাস করতে চেয়েছে, কিন্তু ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কোন সুযোগই নষ্ট করে নি।
৮ই নভেম্বর ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভারত যদি পূর্ব বাংলা দখল ক’রে সেখানে পুতুল বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা’ হ’লে পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করবে।
[বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৮]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭৭

কাইয়ুম খান ও মুফতি মাহমুদ
পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান ২৮শে আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেন যে, পাকিস্তান ভারতের ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণবাদী নীতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ক’রে দিতে বদ্ধপরিকর। জমিয়তুল উলেমায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মওলানা মুফতি মাহমুদ ২৯শে আগস্ট লাহোরে এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পক্ষে তাঁর নিজের স্বার্থেই এখন ভারতকে সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৮-৩৯]

নূরুল আমীন ও অধ্যাপক গোলাম আযম
৭ই নভেম্বর করাচীর ‘ডন’ পত্রিকার এক সংবাদে পি. ডি. পি’র সভাপতি জনাব নূরুল আমীনের বরাতে প্রকাশ, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত ব্যক্তিদের ও অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রাজাকারের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। তাদেরকে আরো অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে। প্রেসিডেন্টের সাথে ৯০ মিনিটব্যাপী আলাপ-আলোচনার পর জনাব নূরুল আমীন সাংবাদিকদের বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট তাঁর সাথে একমত হয়েছেন যে, রাজাকাররা খুব ভালো কাজ করছে, তাদের কার্যকলাপ প্রশংসনীয়।
২৮শে নভেম্বর ‘পাকিস্তান টাইমস’-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জামাতে ইসলামের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম দেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য তিনটি প্রস্তাব দেন—ভারতকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আক্রমণ করা, পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিকদের যথাযথভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা এবং সে প্রদেশের দেশপ্রেমিকদের ওপর আস্থা রাখা।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৪০-৪১]

ভুট্টো ও খান আবদুল গাফফার খান
একাত্তরের ২৩শে সেটেম্বর ‘পাকিস্তান টাইমস’-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের আক্রমণকে নস্যাৎ করার ব্যাপারে পিপলস পার্টির সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেন। অন্যপক্ষে পাকিস্তানের
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭৮

ভূ-খণ্ডে বসবাস করেও ফ্যাসিস্ট সরকারের কার্যকলাপের সমালোচনা করার সৎসাহস যিনি প্রকাশ করেন তিনি খোদাই খিগমতগার নেতা ও সীমান্ত-গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান। তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এই বছরের ২২শে মে এক বিবৃতিতে তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশে পাঞ্জাবী সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধ করার দাবী জানান। জনাব খান বলেন যে, বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলছে তা’ আসলে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য নয়, বরং পাঞ্জাবী স্বার্থ রক্ষার জন্যই চালানো হচ্ছে। তিনি স্পষ্ট ক’রে বলেন যে, পাঞ্জাবের কয়েকজন সমরনায়ক ও পুঁজিপতির স্বার্থে এ যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। বাঙালী জনগণের একমাত্র অপরাধ তারা বিগত নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার দাবী করেছিল। বাঙালীরা পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য দায়ী নয়; এ জন্য যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকে, তাঁরা হলেন ভুট্টো, কাইয়ুম ও পাঞ্জাবী চক্র। পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা ক’রে খান সাহেব বলেন যে, ভারতের অন্য কোন প্রদেশে যখন মুসলিম লীগ সরকার গঠন হ’তে পারে নি, তখন বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম লীগ সরকার। বাংলাদেশের মুসলমানরা সেদিন পাকিস্তানের দাবী সমর্থন না করলে, পাকিস্তানের জন্মই হ’ত না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে, আজ সেই বাঙালীদের বিরুদ্ধেই তোলা হয়েছে পাকিস্তান ভঙ্গের অভিযোগ। তিনি আরো দুঃখ করেন যে, বাঙালী মুসলমানরা মনেপ্রাণে মুসলমান, আজ তাদেরই বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে যে, তারা ইসলামকে ধ্বংস করতে চায়।
আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচী পাকিস্তানের সংহতির পরিপন্থী বলে স্বার্থবাদী মহল যে বাজে অজুহাত খাড়া করেছে তার জবাবে জনাব খান বলেন, ছয়-দফা যদি পাকিস্তানের সংহতির পরিপন্থী হয়ে থাকে, তা’ হ’লে পূর্বাহ্নে তা’ নিষিদ্ধ করা হ’ল না কেন? অথবা আওয়ামী লীগকে ছয়-দফা ভিত্তিতে নির্বাচনে অবতীর্ণ হ’তে দেয়া হ’ল কেন? তিনি আরো জিজ্ঞাসা করেন, ছয়-দফা যদি পাকিস্তানের সংহতির পরিপন্থী হয়ে থাকে, তা’ হ’লে ছয়-দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইয়াহিয়া
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৭৯

খান অভিহিত করেছিলেন কেন? অথবা ছয়-দফা যদি পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী বা শেখ মুজিব যদি দেশদ্রোহী হয়ে থাকেন, তা’ হ’লে ইয়াহিয়া খান নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ মুজিব ও তাঁর দলকে অভিনন্দনই বা জানিয়েছিলেন কেন? এ প্রসঙ্গে খান আবদুল গাফফার খান বলেন যে, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু হয়েও বাংলাদেশের যদি এ অবস্থা হয়ে থাকে, তা’ হ’লে সিন্ধু সীমান্তের মত সংখ্যালঘুদের ভাগ্যে যে কি ঘটতে পারে তা’ সহজেই অনুমেয়। সীমান্ত-গান্ধী জানান যে, বাংলাদেশে যা ঘটছে সে ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে তিনি রাজী আছেন বলে ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সে প্রস্তাবে সাড়া দেন নি। সেজন্যেই বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশে বিলম্ব ঘটেছে বলে তিনি জানান। তিনি একথাও বলেন যে, তিনি তাঁর প্রস্তাবে অটল রয়েছেন এবং পাকিস্তান সরকার সম্মত থাকলে তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি নিয়ে বাংলাদেশে যেতে রাজী আছেন। বাংলাদেশের মানুষ এ-ব্যাপারে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। উপসংহারে সীমান্ত-গান্ধী বলেন, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে তা’ পাঞ্জাবের সেনাবাহিনী ও পুঁজিপতিদের স্বার্থে ও নির্দেশেই ঘটছে। এই সাথে বর্ষীয়ান নেতা ভুট্টোর যথার্থ পরিবর্তনশীল ও বিপরীতমুখী চরিত্রের বিশ্লেষণ করেন। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান একটি অনিষ্টকারী শিশু। তাকে একটা চড় না মারা পর্যন্ত সে ঠিক হবে না। বিশ্বরাষ্ট্রসমূহ এ-ব্যাপারটাকে একটা তামাসা ভেবে মজা দেখছেন। নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাদের কোন সহানুভূতি নেই। তিনি আরো বলেন, এ পৃথিবীটা পাপী আর স্বার্থান্বেষীতে ভরা। কিন্তু নিপীড়িত মানুষের জয় সুনিশ্চিত।
[ অধ্যাপক আবদুল গফুর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৮-৯, ২১৯-২০, ২২২]

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন এয়ার কমোডর কে. জাঞ্জুয়া লণ্ডনে একটি বিবৃতিতে বলেন যে, ভারতের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ যুদ্ধ করার ব্যাপারে ইয়াহিয়া জান্তার দু’টো উদ্দেশ্য আছে। প্রথমতঃ, এর ফলে বাংলাদেশ সমস্যা একটা আন্তর্জাতিক রূপ নেবে এবং সামরিক জান্তা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে ও মুক্তিবাহিনীর হাতে যে বিপুল
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮০

সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে তা’ চাপা দেয়া যাবে। দ্বিতীয়তঃ, তদ্দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও দমন করা যাবে।
[ অধ্যাপক আবদুল গফুর, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮৭-৮৮]

৬ই অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা জনাব মাহমুদ আলী এক ভাষণে ভারত-সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলে হুমকী প্রদান করেন।
৩রা ডিসেম্বর পাকিস্তানের আক্রমণের জবাবে ভারত পাল্টা আক্রমণ করলে জুলফিকার আলী ভুট্টো সদলবলে জাতিসংঘের বৈঠকে গমন করেন। যখন তাঁর চীৎকারে বিশেষ কোন ফল হ’ল না, তখন তিনি কাগজপত্র ছিঁড়ে একটি হাস্যকর দৃশ্যের অবতারণা ক’রে জাতিসংঘের বৈঠক ত্যাগ করেন।
পাকিস্তানের বহু কান্নাকাটি, বহু চীৎকার এবং অপপ্রচার সত্ত্বেও বিশ্ব-বিবেক বাংলাদেশের পক্ষেই সহানুভূতি জানিয়েছে। জাতিসংঘের অধিক সংখ্যক রাষ্ট্রের ভোট সত্ত্বেও ভারত যুদ্ধ বন্ধ করে নি। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশ শত্রু-কবল থেকে মুক্তিলাভ করেছে। অতঃপর ভারত যুদ্ধ বন্ধ করেছে—বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছে।

।। বাংলাদেশঃ বৃহৎ শক্তিবর্গের কার্যকলাপ ।।
বাংলাদেশ সমস্যার মূল কারণ কি এবং কি ভাবে এই সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান করা যেতে পারে, এই ব্যাপারে প্রথম দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোন সুস্পষ্ট মতামত ছিল না।
কোন কোন দেশ এই সমস্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে তাদের দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছে। আবার কোন কোন দেশ বাংলাদেশের জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। কিন্তু এই রাজনৈতিক সমাধানের কাঠামো যে কি রকম হবে, এ-ব্যাপারে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মতদ্বৈধতা ছিল। জাতিসংঘের সনদে মানবাধিকার ও জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রাম
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮১

জাতিসংঘে উপেক্ষিত হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট (ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী) আদম মালিক বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারের অজুহাতে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদে আলোচনার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
[ ‘দি হিন্দুস্তান স্ট্যাণ্ডার্ড’, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

অন্যদিকে পূর্ব বাংলার সমস্যা যে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, এ-ব্যাপারে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন মতৈক্যে পৌঁছেছিল। ২৯শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ভারত-সোভিয়েট যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে যথেষ্ট সাহায্য করবে বলে উল্লেখ করা হয়।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকা সফরে বের হন। বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দকে তিনি উপমহাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত করেন। সংবাদ প্রতিষ্ঠানের খবর অনুযায়ী বেলজিয়াম ভারতের সাথে একমত ছিল যে, বাংলাদেশের সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান করা উচিত, যাতে শরণার্থীরা নিরাপদে তাদের দেশে ফিরে যেতে পারে।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ২৬শে অক্টোবর, ১৯৭১]

ব্রিটেন পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে এক রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিল। [ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ১লা নভেম্বর ১৯৭১]
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মিঃ জর্জেস পম্পিডু পূর্ব বাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। [ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ৯ই নভেম্বর, ১৯৭১]
পশ্চিম জার্মানীও রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিল। বিশ্বের দুই বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে শুধু যে সমর্থন জানিয়েছিল তা’ নয়, অস্ত্র দিয়ে ঐ গণহত্যার মদদ জুগিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন শেষলগ্নে, পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধ যখন সমাপ্ত প্রায়, সেই সময় ১৫ই ডিসেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সনের কাছে প্রেরিত এক পত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, যদি বিশ্বের নেতৃবৃন্দ উপমহাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮২

উপলদ্ধি করার চেষ্টা করতেন এবং বাংলাদেশের জনগণের জাগরণের কারণ খুঁজে বের করার প্রয়াস পেতেন তা’ হ’লে দুঃখজনক পাক-ভারত যুদ্ধ এড়ানো যেত।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

নিম্নে বর্ণিত বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে বাংলাদেশ সমস্যার প্রতি ঐ সমস্ত দেশের মনোভাব সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়।

রাশিয়ার ভূমিকা
১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগনী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক চিঠিতে বলেন যে, ঢাকাতে রাজনৈতিক আলোচনা ভেঙে গেছে এবং সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই ঘটনাবলীতে সোভিয়েট ইউনিয়ন খুবই উদ্বিগ্ন। সাধারণ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য রাজনীতিবিদের গ্রেফতারের খবরে সোভিয়েট ইউনিয়নের জনগণ খুবই মর্মাহত। সোভিয়েট ইউনিয়ন সব সময় পাকিস্তানের সুখ ও সমৃদ্ধি চায়। পাকিস্তান আজ যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, তা’ কেবল রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা যায়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা ও রক্তপাত সমস্যাকে আরো জটিল ক’রে তুলবে, যা পাকিস্তানের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের ক্ষতি করবে।
সোভিয়েট ইউনিয়ন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন জানাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে দমননীতি ও রক্তপাত বন্ধ ক’রে সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যেন জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় মানবিক নীতিসমূহে উদ্বুদ্ধ হয়ে সোভিয়েট ইউনিয়ন এই আবেদন জানাচ্ছে।
[বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫১০-১১]

১০ই জুন সোভিয়েট কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘প্রাভদা’-তে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মিঃ কসিগিন বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তাতে সোভিয়েট ইউনিয়ন খুবই উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮৩

লক্ষ লক্ষ লোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। তারা সেখানে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছে।
যারা মানবিক রীতি-নীতিসমূহে বিশ্বাস করেন, তাঁরা অবশ্যই আশা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক অনকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক যেখানে শরণার্থীরা তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও মান-সম্মানের নিশ্চয়তা পাবে। আমরা পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এ-ব্যাপারে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এবং এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সমস্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত বলে সোভিয়েট ইউনিয়ন মনে করে। [ পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫১২]

পশ্চিম জার্মানীর ভূমিকা
২৩শে জুলাই পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলর উইলী ব্রান্ট এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং-এর সাথে আলাপ-আলোচনার পর তিনি পূর্ব বাংলা সমস্যা সম্বন্ধে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের সেক্রেটারী-জেনারেলের সাথে আলাপ করেছেন। এই আলোচনার ফলাফল এবং তাঁর নিজস্ব মত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সাথেও তিনি যোগাযোগ করেছেন ও চিঠি লিখছেন। তিনি এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। [ঐ, পৃঃ ৫১৫]
১৭ই জুন যুগোশ্লাভিয়ার একজন সরকারী মুখপাত্র এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, যুগোশ্লাভ সরকার ও জনগণ লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে। পাকিস্তানের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এই সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান যুগোশ্লাভ সরকারের একান্ত কাম্য। [ঐ, পৃঃ ৫১৯-২০]

সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডীর ভূমিকা
১লা এপ্রিল আমেরিকার সিনেটে এক ভাষণে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচারে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮৪

ও নিরীহ জনগণকে হত্যা করার খবর পাওয়া গেছে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। আমেরিকা যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানকে দিয়েছে, সেগুলো দিয়ে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন যে, আমেরিকান সরকারের এই হত্যাকাণ্ডকে নিন্দা করা কি উচিত নয়? তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, আমেরিকান সরকার এ-ব্যাপারে সক্রিয় মানবতাবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
[ পূর্বোক্ত পৃঃ, ৫২০-৫২১]

ইসরাইলের ভূমিকা
এমন কি যে ইসরাইল আগ্রাসন নীতির মাধ্যমে ও সাম্রাজ্যবাদ শক্তির সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে ও জোরপূর্বক অন্যদেশ দখল ক’রে রেখেছে, সেই ইসরাইলও চুপ ক’রে থাকে নি। ২৩শে জুন পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবা ইবান পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কার্যকলাপে ইসরাইল যে খুবই মর্মাহত একথা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে, বৃদ্ধ এবং শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে-লক্ষ লক্ষ লোক অসহায় অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। ভারত তার সীমিত সম্পদ দিয়ে শরণার্থীদের দেখাশুনা করছে। সমগ্র বিশ্বের এখন এই সব শরণার্থীর সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৫৪-৫৫]

১৫ই আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং-এর ইন্দোনেশিয়া সফর শেষে প্রকাশিত দুই দেশের এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয় যে, দু’দেশই শরণার্থী সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছে। দু’দেশই মনে করে যে, শরণার্থীদের তাদের নিজের দেশে ফিরে যাবার মত একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয়।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৫৮]

৫ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ভারত-নেপাল এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয় যে, দু’দেশই আশা করে যে, শরণার্থীরা যেন তাদের দেশে অতি সত্বর
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮৫

ফিরে যেতে পারে এবং সেজন্য সেখানে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার।
১৪ই সেপ্টেম্বর মস্কোতে আফগানিস্তানের রাজার সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় এক ভাষণে সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিঃ পদগর্নী বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটা ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক সমাধানের ওপর দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি বহুলাংশে নির্ভর করছে। ভারত-সোভিয়েট বন্ধুত্বমূলক ও সহযোগিতামূলক চুক্তির কথা উল্লেখ ক’রে তিনি বলেন যে, এই চুক্তি কোন দেশের বিরুদ্ধে করা হয় নি। এশিয়া তথা সারা বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আফগানরাজ এই বক্তব্য সমর্থন করেন।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৬১]

২৯শে সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সোভিয়েট ইউনিয়ন সফর শেষে প্রকাশিত এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয় যে, দু’দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলী থেকে উদ্ভূত ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
১৮ই অক্টোবর হাউস অব কমন্স -এ এক ভাষণে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে একটা রাজনৈতিক সমাধানের দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের ওপর। সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট ও প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের আবেদনে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ সরকার শরণার্থীদের জন্য সাহায্য পাঠাচ্ছে বলে তিনি আশ্বাস প্রদান করেন।
২০শে অক্টোবর যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর ভারত সফর শেষে প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে ঘোষণা করা হয় যে, দু’দেশই মতৈক্যে পৌঁছেছে যে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধানই এ এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে। দু’দেশ এ-ব্যাপারে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানায়। জনগণের ইচ্ছাকে পদদলিত করা হ’লে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে দু’দেশ বিশ্বাস করে। প্রেসিডেন্ট টিটো উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮৬

জন্য শেখ মুজিবের মুক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের শর্তহীন মুক্তির কথা পুনরায় উল্লেখ করেন।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৬৬]

২৭শে অক্টোবর অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রিসকি (Bruno Kriesky) এক বিবৃতিতে বলেন যে, বাংলাদেশ সঙ্কটের ওপর তাঁর নিজস্ব মতামত তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানাবেন। তিনি আরো বলেন যে, ভারতে আগত শরণার্থীদের তাদের নিজেদের দেশে নিরাপদে ফিরে যাবার নিশ্চয়তা থাকা উচিত। তিনি স্বীকার করেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে তিনি যে জবাব পেয়েছেন, তাতে সমস্যাকে ভ্রান্তিমূলকভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
৩রা নভেম্বর ওয়াশিংটন প্রেসক্লাবে এক বিবৃতিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমোহন (Mac Mohon) বলেন যে, শীঘ্রই পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের পক্ষে সমগ্র পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত।
৪ঠা নভেম্বর হাউস অব কমন্স-এ এক ভাষণে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সার আলেক ডগলাস হিউম পুনরায় বাংলাদেশ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটা রাজনৈতিক সমাধান তিনি কামনা করেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে একজন বেসামবিক গভর্নর নিযুক্ত করেছেন, উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেছেন এবং সাধারণ ক্ষমাও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও শরণার্থীদের মনে আস্থা ফিরে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
১৯শে নভেম্বর জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে এক ভাষণে চীনের প্রতিনিধি মিঃ ফুহাও যে সব উক্তি করেন তা’ প্রমাণ করে যে, বিশ্বের নিষ্ঠুরতম গণহত্যায় মানবতার ধ্বজাধারী চীনের কোন উদ্বেগ নেই। বরঞ্চ এই গণহত্যায় তাদের সক্রিয় সাহায্য রয়েছে। তিনি গলা ফুলিয়ে বলেন যে, চীনদেশের সরকার ও জনগণ সব সময় বিশ্বাস করে যে, কোন দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা সে দেশের জনগণই সমাধান করবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮৭

তথাকথিত শরণার্থী প্রশ্ন পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং পাকিস্তানই তা’ সমাধান করবে। কোন কোন দেশ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করাতে উপমহাদেশে বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন লোক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ বাংলাদেশ-সঙ্কট নিরসনের জন্য প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল হবার জন্য তাঁদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
১লা এপ্রিল মার্কিন সিনেটর হ্যারিস সিনেটে এক ভাষণে বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের দুঃখজনক ঘটনাবলী বিশ্ববাসী জেনে ফেলবে এই ভয়ে পাকিস্তান বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছে। সাংবাদিকদের বহিষ্কার এটাই প্রমাণ করে যে, পূর্ব বাংলায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা চলছে। এই দুঃখজনক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে বিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আশু কর্তব্য হ’ল, পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ ক’রে দেয়া। ৪ঠা এপ্রিল ব্রিটেনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য মিঃ লর্ড ফেনার ব্রকওয়াজ এক জনসমাবেশে অবিলম্বে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবী জানান। এ ছাড়াও তিনি সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি, পূর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং গণপরিষদের বৈঠক আহ্বানের দাবী জানান।
১৮ই এপ্রিল ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে মিঃ চেষ্টার বার্ডলস বলেন যে, আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্রে সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ-নিরস্ত্র জনগণের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের লোকজনকেও পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না এবং বিদেশী সাংবাদিকদের সেখান থেকে বের ক’রে দেয়া হয়েছে। আমেরিকার কনস্যুলেট জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখনও আমেরিকান সরকার বলছেন যে, পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁরা কিছু জানেন না। এই সংঘর্ষ বন্ধ করতে বিশ্বজনমত গঠন করার
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮৮

ব্যাপারে আমেরিকার নেতৃত্ব গ্রহণ করা উচিত। আমেরিকা কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্রের অপব্যবহার সম্বন্ধেও পাকিস্তানকে অবিলম্বে সতর্ক ক’রে দেয়া আমেরিকার কর্তব্য।
[ ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ১৮ই এপ্রিল, ১৯৭১]

২৭শে এপ্রিল বি. বি. সি’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস বলেন যে, পূর্ব বাংলায় যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, তার সাথে তুলনা করলে ভিয়েতনামের ঘটনাবলীকে “টি-পার্টি” বলে মনে হয়। ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন স্টাফ ও ছাত্রকে অত্যন্ত সুস্থ মস্তিষ্কে হত্যা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলকে বানচাল করার জন্য সামরিক জান্তা কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেছে। ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এই ব্যাপারে উদাসীন থাকা উচিত নয়।
১১ই জুলাই ‘দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের সদস্য মিঃ রোগন্যালড প্রেনটিস বলেন যে, শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধান পূর্ব বাংলার বর্তমান সঙ্কট নিরসনের একমাত্র উপায়। ইয়াহিয়া খানকে এ কথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে।
[ ‘দি সানডে টাইমস’, ১১ই জুলাই, ১৯৭১]
১৫ই সেপ্টেম্বর কলকাতার ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক এবং এককালীন ভারতবর্ষে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জে. কে. গলব্রেথ বলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকারকে স্বীকার ক’রে নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের মধ্যেই রয়েছে সকল উত্তেজনার নিরসন এবং বিবাদের মীমাংসা। জনগণের অধিকার বলতে বুঝায়, তারা নিজেরা নিজেদেরকে শাসন করবে এবং নিজেদের সরকার গঠন করবে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভাগ্য, জীবন-ব্যবস্থা ও রাজনীতির সম্পূর্ণ নিয়ন্তা হবে। এই সহজ সত্যকে আজ বিশ্ববাসীর এবং বিশেষ ক’রে আমেরিকাবাসীর স্বীকার করতে হবে।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৮৯

১৮ই মে মার্কিন সিনেটর মিঃ চার্চ সিনেটে এক ভাষণে বলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক, অধ্যাপক, নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মচারী, ডাক্তার, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী ও শিশুকে হত্যা করছে। উপমহাদেশে বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আমেরিকার উচিত অবিলম্বে পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ ক’রে দেয়া।
১৮ই জুন মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী পুনরায় সিনেটে এক ভাষণে বলেন যে, আমেরিকা কর্তৃক সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তান সামরিক জান্তা পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। কিন্তু আমেরিকান সরকার এই ব্যাপারে নিশ্চুপ এবং উদাসীন রয়েছেন। তিনি আরো বলেন যে, সামরিক বাহিনীকে সংযত করা না হ’লে শরণার্থীদের ভীড় আরো বেড়ে যাবে। এই ব্যাপারে নীরব থেকে আমেরিকান সরকার ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিবেকহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
২৯শে জুলাই কানাডিয়ান পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ এক বিবৃতিতে পূর্ব বাংলার সমস্যা সমাধানের নিম্নোক্ত সুপারিশ করেনঃ
১। কানাডার সরকার ও জনগণের শরণার্থীদের জন্য আরো বেশী সাহায্য দেয়া উচিত।
২। কানাডার সরকারের অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় এই প্রশ্নকে জাতিসংঘে আনা উচিত।
৩। পাকিস্তান সরকার এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান করা উচিত।
২৮শে জুলাই সিনেটর ফুলব্রাইট সিনেটে এক বিবৃতিতে বলেন যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছিল কম্যুনিজমকে প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু এই অস্ত্র বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন আবার পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ক্ষীণ প্রচেষ্টাকে ঐ অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। আমেরিকা পাকিস্তানকে যে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়েছে, পাকিস্তান সেই অর্থনৈতিক সাহায্যের অপব্যবহার করেছে এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯০

অধিকাংশ অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান সরকার নির্বিচারে সামরিক অভিযান চালিয়ে পূর্ব বাংলায় হিন্দু, বুদ্ধিজীবী ও বাঙালী নেতাদের হত্যা করেছে। হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে, কিন্তু এখনো আমেরিকা পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিচ্ছে। বিশ্বব্যাঙ্কসহ অন্যান্য সাহায্য প্রদানকারী দেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন করছে। যুক্তরাষ্ট্র যে নীতিতে বিশ্বাস করে সেই সমস্ত নীতির বরখেলাপ ক’রে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সমর্থন ক’রে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত যে পর্যন্ত না পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একটা সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হয়, সে পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনরূপ অস্ত্র বা অর্থ দিয়ে সাহায্য না করা। তিনি আরো বলেন, যদি নিক্সন-প্রশাসন এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তা’ হ’লে তিনি কংগ্রেসের সাহায্য নিতে বাধ্য হবেন।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৪০-৪২]

২৬শে আগষ্ট ওয়াশিংটন প্রেসক্লাবে এক ভাষণে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী পুনরায় বাংলাদেশের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন যে, গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর পূর্ব বাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ লোক ভারতে চলে এসেছে। হাজার হাজার লোক সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোক ভয়ভীতি, রোগ ও অনাহারের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু বিশ্ব এই দুঃখজনক ঘটনা এখনো বুঝতে পারে নি। কি কি কারণে এই ব্যাপক দূর্দশার উৎপত্তি হয়েছে, তা’ আমেরিকার জনগণের উপলদ্ধি করা উচিত। অতঃপর তিনি সমস্ত ঘটনার একটি আনুপূর্বিক ইতিহাস সংক্ষেপে ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, আমেরিকান সরকার পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিচ্ছে। আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র এই হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসলীলায় ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এখনো সামরিক সাহায্য অব্যাহত রয়েছে। মানবতার খাতিরে আমেরিকা ও জাতিসংঘের উচিত, শরণার্থীদের সাহায্য করা। কিন্তু এ-ব্যাপারে তাদের সাড়া নিতান্তই নগণ্য। অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য প্রেরণ বন্ধ করা আমেরিকার এখন নৈতিক দায়িত্ব।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯১

১৩ই এপ্রিল যুগোশ্লাভ লীগ এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থন করেন। লীগের মতে, বাংলাদেশে নরহত্যা একটি বাস্তব ঘটনা এবং এর নিরসন একান্ত কাম্য। যুগোশ্লাভ লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, এই লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে সমর্থন করে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যার সমাধানের জন্য সামরিক শক্তি যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, লীগের মতে তা’ বিশ্বশান্তির প্রতি মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
২২শে এপ্রিল রয়টার পরিবেশিত এক খবরে প্রকাশ, একদল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ এক বিবৃতিতে বলেন যে, ২৫শে ও ২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক, তাঁদের পরিবার ও অনেক ছাত্রকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। এই কমিটির মধ্যে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানী, ইটালী, জাপান, নেদারল্যাণ্ড, সুইডেন এবং ব্রিটেনের অধ্যাপকরা ছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ছিলেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন যে, যদিও তাঁদের দেশের সরকার এ-ব্যাপারে কোন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, তবুও সারা বিশ্বের মানুষ এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করছে। তাঁদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অতর্কিত আক্রমণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন ক’রে দেয়া।

বিশ্ব-শান্তি পরিষদের ভূমিকা
১০ই মে বিশ্বশান্তি পরিষদ উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের ওপর এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবে বলা হয় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে বা চালাচ্ছে, তা’ সমকালীন বিশ্বের এক ভয়াবহ দুঃখজনক ঘটনা। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়, অবিচার, অর্থনৈতিক শোষণ, সামরিক একনায়কত্ব এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এই রক্তপাত বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সম্মেলন
২৭শে মে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে পাকিস্তানের দুঃখজনক ঘটনাবলীতে গভীর
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯২

উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য রাজবন্দীর জীবনের জন্য আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তার সদস্য রাষ্ট্রদের কাছে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আবেদন জানায়। পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলর, সুইডেন, নরওয়ে ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীরা, পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার খ্যাতনামা সমাজতন্ত্রীরা এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
২৩-২৪ শে জুন দামেস্কে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশিয়ান গণ-সংহতি সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, সাম্রাজ্যবাদের ও শোষণের বিরুদ্ধে আফ্রো-এশিয়ান জনগণের সংগ্রামের ওপর এই সংস্থা গুরুত্ব আরোপ করে। তৃতীয় বিশ্বের জনগণের ওপর উপনিবেশবাদ নব্য উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শোষণের বিরুদ্ধে এই সংস্থা তীব্র নিন্দা জানায়।

আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন
১৪ই এপ্রিল আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন জেনেভা থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন যে, জুরিস্ট কমিশন রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুন্যালে বিচারের বিরোধিতা করে। যদি শেখ মুজিবুর রহমান অথবা অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা পাকিস্তানের আইনের আওতায় কোন অপরাধ ক’রে থাকেন, তা’ হ’লে তাঁদেরকে বেসামরিক আদালতের সামনে হাজির করা উচিত।

টরেন্টোতে বিশ্ব সম্মেলন
১৯-২১শে আগস্ট কানাডার টরেন্টোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সম্মেলনে এক ঘোষণায় বলা হয় যে, অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা উচিত। ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেয়া হয়। ঘোষণায় বিভিন্ন দেশের কাছে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ ক’রে দেয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়। এই সম্মেলনে ৩০ জন পণ্ডিত, সম্পাদক, পার্লামেন্টারিয়ান এবং প্রাক্তন কূটনীতিবিদ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধি এম. আর. সিদ্দিকী
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯৩

এবং ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালী অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম. এ. মুহিত এখানে উপস্থিত ছিলেন।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৭৭-৭৯]

১১ই সেপ্টেম্বর ব্যুরো অব সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল লণ্ডন থেকে এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতন বন্ধের আবেদন জানান। সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল অবিলম্বে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের শর্তহীন মুক্তি দাবী করেন। যে পর্যন্ত না সমস্যার একটা সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে, সে পর্যন্ত সাহায্যদানকারী কনসর্টিয়াম-এর নিকট পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের আবেদন জানানো হয়।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৮১]

১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে ২০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিশ্ব সম্মেলনের এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। প্রস্তাবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক মীমাংসার ওপর জোর দেয়া হয়। আর এক প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদন জানানো হয়।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৮৪-৮৫]

১২ই নভেম্বর আমেরিকান একাডেমিক কমিউনিটি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে এক আবেদনে বলেন, যে পর্যন্ত না পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের সাথে একটা রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে, সে পর্যন্ত পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ ক’রে দেয়া দরকার।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে বর্বর সেনাবাহিনীর অমানুষিক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য পাকিস্তান সামরিক জান্তা সমস্ত বিদেশী সাংবাদিককে পূর্ব বাংলা থেকে বহিষ্কার ক’রে দিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সমস্ত বিশ্বের সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ সামরিক বাহিনীর জঘন্য
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯৪

কার্যকলাপের কথা জানতে পারে। এই সমস্ত সংবাদপত্রের তালিকা এত বড় যে, তার উল্লেখ থেকে এখানে বিরত থাকা ছাড়া গত্যন্তর দেখছি না। বস্তুতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পশ্চাতে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকার চেয়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক মানবতামুখী, আর তাই সাংবাদিকদের নিকট আমরা সত্যি নানাভাবে ঋণী। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কম্যাণ্ডের প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হ’লে সারা বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন সংবাদসংস্থা এ-খবর ফলাও ক’রে প্রকাশ করতে থাকেন।

পাক-ভারত যুদ্ধঃ বিশ্ব-প্রতিক্রিয়া
১৯৭১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকায় এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মিঃ চার্লস ব্রে বলেন যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতীয় অনুপ্রবেশের ফলে আমেরিকা ভারতে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ ক’রে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৫ই ডিসেম্বর তারিখে প্রকাশিত ‘দি সান বাল্টিমোর’ পত্রিকায় এক বিবৃতিতে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের জনৈক উচ্চপদস্থ সরকারী মুখপাত্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবার জন্য ভারতের তীব্র নিন্দা ক’রে বলেন যে, সঙ্কট শুরু হবার প্রথম থেকেই ভারতীয় নীতির ফলেই সঙ্কট আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু করার জন্য ভারতই অধিকাংশে দায়ী।
[ ‘দি সান বাল্টিমোর’, ৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

ঐ দিনই অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ নিগেল এইচ. বোয়েন ‘দি ক্যানবেরা টাইমস’-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে অস্ট্রেলিয়ার নিরপেক্ষ ভূমিকার কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটের গোড়া থেকেই অস্ট্রেলিয়া উত্তেজনা প্রশমন ও রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টার সাথে যোগাযোগ রক্ষা ক’রে আসছে। অষ্ট্রেলিয়া যুদ্ধরত কোন দেশকেই অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে তিনি ঘোষণা করেন।
[ ‘দি ক্যানবেরা টাইম্‌স’, সিডনী, ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

৫ই ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘আল আইয়্যাম’ পত্রিকায় এক বিবৃতিতে সুদানের পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে ভারত ও পাকিস্তানকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকরী করার আবেদন জানান হয়। উক্ত বিবৃতিতে বলা হয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯৫

যে, সুদান পাকিস্তানের একতা এবং সার্ভভৌমত্বে বিশ্বাস করেন। সুদান মনে করেন যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ও জনগণের মধ্যে যা কিছু ঘটছে তা’ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
[ ‘আল আইয়্যাম’, খার্তুম, ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

৬ই ডিসেম্বর ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম হাউস অব কমন্স-এ এক ভাষণে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তাঁর সরকারের গভীর উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ৪ঠা ও ৫ই ডিসেম্বর বৈঠকে মিলিত হয়েছে। কিন্তু গোড়া থেকেই এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের যেকোন প্রস্তাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেটো প্রয়োগ করবে। ব্রিটেন এই সমস্ত অসুবিধা মোকাবেলা করার এবং যুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণের সমাধান খুঁজে দেখার চেষ্টা চালাচ্ছে
[ ‘দি টাইমস’, লণ্ডন, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

৭ই ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো এক বিবৃতিতে বলেন যে, যদি ভারত ও পাকিস্তান দুই যুদ্ধরত দেশ অনুরোধ করে, তা’ হ’লে ইন্দোনেশিয়া এই সংঘর্ষে মধ্যস্থতা করতে রাজী আছে।
[ ‘দি জাকার্তা টাইমস’, ৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

ঐ দিন ওয়ারশতে পোল্যাণ্ডের কম্যুনিস্ট পার্টির ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে এক ভাষণে মিঃ লিউনিদ ব্রেজনেভ আশা প্রকাশ ক’রে বলেন যে, বাইরের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বাস করে। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টাতেই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে।
[ ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’, নিউ দিল্লী, ৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

৮ই ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তুন আবদুর রাজ্জাক ভারত ও পাকিস্তানের কাছে মানবিক কারণে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার আবেদন জানান। ৯ই ডিসেম্বর চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ চি পেং ফি এক ভাষণে বলেন যে, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯৬

‘তথাকথিত’ বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত’ স্বীকৃতি দিয়েছে। এই কাজে ভারত সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য লাভ করেছে। চীনের সরকার ও জনগণ ভারতের এই সম্প্রসারণবাদী নীতির এবং সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতার রাজনীতি ও স্বৈরাচারী নীতির তীব্র নিন্দা করছে। ভারতকে অবশ্যই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ বন্ধ করতে হবে এবং শর্তহীনভাবে পাকিস্তানের ভূমি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ক’রে নিতে হবে। প্রতি-আক্রমণের জন্য যে সমস্ত সৈন্য ভারতে প্রবেশ করেছে পাকিস্তান সে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করবে বলে চীন বিশ্বাস করে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২১৮]

১০ই ডিসেম্বর সোভিয়েটের ‘ইজভেস্তিয়া’-তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয় যে, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত করার জন্যে চরম দমননীতি গ্রহণ করেছে। তারা সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করেছে। এই সমস্ত ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের জন্য দায়ী।
[ ‘ইজভেস্তিয়া’, ইউ. এস. এস. আর., ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]
পাক-ভারত যুদ্ধে জাতিসংঘের তৎপরতা
১২ই ডিসেম্বর ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার প্রতিনিধি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরদার শরণ সিং-এর এক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারে শরণ সিং বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে কোন ভূমি দখলের লোভ ভারতের নেই। ভারত পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায় না। ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন ঘিরে রাখার জন্য ভারতকে ব্যবহার করছে’—নিরাপত্তা পরিষদে চীনের প্রতিনিধির এ অভিযোগ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হ’লে শরণ সিং বলেন যে, ভারত ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল নয়। পূর্ব পাকিস্তান যদি স্বাধীন হয়, তা’ হ’লে চীন হস্তক্ষেপ করবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, তাঁরা চীনের হস্তক্ষেপের কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ এই সমস্যা হ’ল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের মধ্যে। আমেরিকার ভূমিকা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে বলা হলে শরণ সিং বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯৭

প্রয়োগ করলে এই সঙ্কট এড়ানো যেত। পরিশেষে বাংলাদেশে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হ’লে কি করা কর্তব্য, এ-প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রত্যাহার ক’রে নিতে হবে, যাতে করে বাংলাদেশের জনগণ নিজেরা তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার সুযোগ পায়।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩০০-৩০২]

১২ই ডিসেম্বর যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বেলগ্রেডে এক ভাষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমালোচনা ক’রে বলেন যে, পাক-ভারত সংঘর্ষ শুরু হবার পূর্বে ভারত যে সমস্ত অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল, তাঁরা তা’ অনুধাবন করেন নি। যদি জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহ এবং অন্যান্য দেশ এই যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টা না চালায়, তা’ হ’লে উপমহাদেশের ঘটনাবলী মারাত্মক পরিণতি লাভ করবে।
[ ‘Reuter Despatch, datelined Belgrade’, ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

১২ই ডিসেম্বর লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফী বলেন যে, জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহ পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এটা উপমহাদেশে বৃহৎ শক্তিবর্গের ঔপনিবেশিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার সুযোগ এনে দিয়েছে।
[ ‘দি হিন্দুস্থান টাইমস্’, নিউদিল্লী, ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৭১]

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সারা বিশ্বে তার বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হ’লে জাতিসংঘ তৎপর হয়ে ওঠে। বিশেষ ক’রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের শোচনীয় অবস্থার কথা চিন্তা ক’রে এ যুদ্ধ বন্ধের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এ-বিষয়ে ১৯৭১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র-সদস্য এক খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
প্রস্তাবে বলা হয় যে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধ-বিগ্রহ-লড়াই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকীস্বরূপ—অবিলম্বে এ যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানের নিকট আবেদন জানানো হয়। শরণার্থীরা যাতে স্বেচ্ছায় স্বদেশে ফিরে যেতে পারে, সে বিষয়ে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার সার্বিক প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ভারত-পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে আহ্বান জানানো হয়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯৮

প্রস্তাবে আরো বলা হয় যে, বিশ্বশান্তি যাতে বিঘ্নিত না হয়, এ-রকম কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিটি দেশের দৃষ্টি রাখা উচিত। ভারত ও পাকিস্তানকে সৈন্য প্রত্যাহার ক’রে নিজ নিজ সীমান্ত এলাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আহ্বান করা হয়। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার খাতিরে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের মধ্যস্থতার প্রতি সাড়া দে’য়ার জন্য ভারত ও পাকিস্তানকে আবেদন জানানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে খসড়া প্রস্তাব উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রও বিশ্বশান্তি বজায় রাখার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। ৪ঠা ডিসেম্বর বেলজিয়াম, ইটালী এবং জাপান নিরাপত্তা পরিষদে নিম্নলিখিত খসড়া প্রস্তাব আনয়ন করে। উক্ত প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করার জনা সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের কাছে আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশসমূহকে শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জোর প্রচেষ্টা চালানোর জন্যও আহ্বান জানানো হয়।
৪ঠা ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবে তাঁরা বলেন, যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধান আশু প্রয়োজন। পূর্ব পাকিস্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হিংস কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়। ঐ দিনই আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিওন ও সোমালিয়া নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাবে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে লড়াই শুরু হওয়াতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানকে আহ্বান জানান।
৫ই ডিসেম্বর আর্জেন্টিনা, বুরুণ্ডি, ইটালী, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিওন এবং সোমালিয়া নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ও পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থীদের ফিরে যাবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
৫ই ডিসেম্বর চীন নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার ক’রে বলা হয়, ‘ভারত
পৃষ্ঠা নং ~ ৮৯৯

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে এবং পাক-ভারত উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত করেছে।’
৬ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েট ইউনিয়ন আরেকটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। উক্ত প্রস্তাবে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও লড়াই বন্ধ করার আহ্বান জানান হয়।
একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান এবং সেখানকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুনরায় পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানানো হয়।
৭ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলজিরিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বুরুণ্ডি, ক্যামেরুন, চাদ, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, ঘানা, গুয়াতেমালা, হাইতি, হণ্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া, ইটালী, আইভরী কোস্ট, জাপান, জর্দান, লাইবেরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, নেদারল্যাণ্ড, নিকারাগুয়া, পানামা, প্যারাগুয়ে, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, স্পেন, সুদান, তিউনিসিয়া, উরুগুয়ে, ইয়েমেন, জেয়ারে এবং জাম্বিয়া পূর্ববর্ণিত খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
ঐ দিনই সোভিয়েট ইউনিয়ন সাধারণ পরিষদে পূর্বোল্লিখিত নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া প্রস্তাবের অনুরূপ আরেকটি প্রস্তাব পেশ করেন। একই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটা প্রস্তাব গ্রহণ করে। উক্ত প্রস্তাবে ‘ভারত ও পাকিস্তানকে অতি সত্বর যুদ্ধবিরতি কার্যকর ও সৈন্য প্রত্যাহার’ এবং ‘শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবার স্বাভাবিক ও অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে প্রচেষ্টা জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়’। প্রস্তাবে ‘বেসামরিক জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও আবেদন জানানো হয়’।
১৪ই ডিসেম্বর পোল্যাণ্ড নিরাপত্তা পরিষদে নিম্নলিখিত প্রস্তাব পেশ করেনঃ ‘পূর্বাঞ্চলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত’।
‘ক্ষমতা হস্তান্তরের অব্যবহিত পরেই সমস্ত এলাকায় সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে এবং ৭২ ঘন্টার জন্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে’।
যুদ্ধবিরতির প্রাথমিক পর্যায় শুরু হবার পর পরই পাকিস্তানকে তার সৈন্য প্রত্যাহার ক’রে নিয়ে যেতে হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০০

‘৭২ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হবার পর পরই যুদ্ধ বিরতি স্থায়ীভাবে কার্যকর করতে হবে। পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণ শুরু হবার পর পরই ভারতকে পূর্বাঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করতে হবে’।
‘অবশ্য এই সৈন্য অপসারণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করেই করতে হবে’।
১৫ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স নিম্নলিখিত খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন।
প্রস্তাবে ‘ভারত ও পাকিস্তানকে অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার’ ও ‘সংশ্লিষ্ট জনগণের আশা-আকাক্ষা অনুযায়ী নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সাথে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানানো হয়’।
‘উপমহাদেশে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পারে এইরূপ কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্যও সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আবেদন জানানো হয়’।
১৬ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে বলা হয় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি পালন করতে হবে। উপমহাদেশের তথা বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকীস্বরূপ কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে তৎপর থাকতে হবে; এবং আহত, রুগ্ন যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক জনগণের জীবন রক্ষার্থে ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে গৃহীত নীতিসমূহ পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রচেষ্টা চালাতে হবে’।
অতঃপর ১৬ই ডিসেম্বর পাক-বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় এবং ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। বিশ্ব-শক্তিসমূহকে আর প্রস্তাব ও পাল্টা প্রস্তাব পেশ করতে হয় না।

।। বিশেষ সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার-প্রসঙ্গ ও বিচার-সম্পর্কিত বিশ্ব-প্রতিক্রিয়া।।
ইয়াহিয়া খান ২৬শে মার্চ ’৭১ তারিখে রাওয়ালপিণ্ডি থেকে এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করলেন যে, শেখ মুজিব একজন দেশদ্রোহী। তাঁর এ ঘোষণার পেছনে অবান্তর যুক্তি উপস্থাপিত ক’রে তিনি বললেন, শেখ
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০১

মুজিব এবং তাঁর দল পাকিস্তানের শত্রু, এবং তারা চায় পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। প্রেসিডেন্ট আরো বলেন যে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে আক্রমণ করেছেন—এই অপরাধকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দে’য়া যায় না। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করবার পেছনে ইয়াহিয়া খান অন্যতম যুক্তি দেখান এই যে, এই দল অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল এবং শেখ মুজিব দেশে একটি বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের আরো একটি বড় অভিযোগ ছিল যে, তিনি দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছেন। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সার্বিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন উপস্থাপন নিশ্চয়ই কোন অপরাধ নয় এবং বিশ্বের কোন প্রচলিত নীতিও এই কাজকে কোন অপরাধ বলে স্বীকার করে না। এটা জনগণের সাধারণ অধিকার। আর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৬২৫ নং ধারা বিবরণীতে লিপিবদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনের নীতিতে এটা স্বীকৃত যে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কখনই বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত নয়।
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৬]

এই গ্রন্থে ইয়াহিয়া খানের কার্যকলাপের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। তিনি কিভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন, জনগণকে কিভাবে ভাওতার মাধ্যমে আশ্বাস দিয়েছিলেন, এ সব আমাদের জানা রয়েছে। তাঁকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দিতে হয়েছিল; না দিয়ে উপায় ছিল না। নির্বাচনের ফলাফল তাঁকে হতাশ করলো। দাবার ছকে ভুল হয়ে গেল। গণনায় তাঁর সাংঘাতিক গরমিল হয়ে গেল। হিসাব মিলাতে পারলেন না তিনি। তাই শুরু হ’ল ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ভানুমতির খেল। একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতামতই তাঁর কাছে প্রাধান্য পেতে থাকলো।
পূর্বেই বলেছি, লারকানায় পাখি শিকার করতে প্রেসিডেন্টকে তাঁর সেনাবাহিনী-প্রধান আবদুল হামিদ খান ও অপর জাঁদরেল প্রধান স্টাফ অফিসার পীরজাদাকে সঙ্গে নিতে হয়েছিল। আসলে পাখি শিকারের নাম ক’রে
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০২

মানুষ শিকারের ব্যাপক পরিকল্পনা গৃহীত হয় এই লারকানায়। ইয়াহিয়া, ভুট্টো, হামিদ খান ও পীরজাদা শিকারী হিসেবে কারো হাতই কম দক্ষ নয়। পরবর্তী ঘটনা তা’ প্রমাণ করেছে। প্রমাণ করেছে, ওরা পাখি নয়, ত্রিশ লক্ষ নিরীহ নিরপরাধ বাঙালী। ছলনার আশ্রয়ে ইয়াহিয়া খান সময় অতিবাহিত করতে লাগলেন।
প্রস্তুতিপর্ব শেষ হ’লে বাঙালীর স্বাধিকার আর স্বায়ত্তশাসনের ইচ্ছাকে চিরতরে উৎপাটিত করার মানসে, বাঙালীর মেরুদণ্ডকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেবার প্রয়াসে একাত্তরের ২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালী জনগণের ওপর লেলিয়ে দিলেন। বন্দী ক’রে নিয়ে গেলেন বাংলার অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবকে। সূত্রপাত ঘটলো জগতের জঘন্যতম গণহত্যার। হাজার হাজার ‘মাইলাই’ সংঘটিত হ’ল বাংলার শহরবন্দর-গ্রামগুলোতে।
ষড়যন্ত্রের শেষ এখানেই নয়। নরঘাতক ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে বন্দী করেই ক্ষান্ত হলেন না। তাঁকে সুপরিকল্পিত উপায়ে হত্যা করবার পথও প্রশস্ত করতে প্রস্তুতি নিলেন।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান অধুনা বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবের বিচারের কথা ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, শেখ মুজিবকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে আটক করা হয়েছে এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে তাঁর বিচার করা হবে।
[ ‘দি ডন’, করাচী, ৫ই আগষ্ট, ১৯৭১]

এই সময়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিব কখনই তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন না। তিনি শুধু দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ভার নিয়েছিলেন। কাজেই প্রথমাবস্থায়, রাজনীতিক শেখ মুজিবের কার্যক্রমে বাধা প্রদান করবার তাঁর কিছুই ছিল না।
ইয়াহিয়া খানের এই বিবৃতি অবশ্যই তাঁর পূর্ববর্তী ব্যবস্থাসমূহ এবং কথাবার্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; বরং পরস্পবিরোধী। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যেই যে এর অবতারণা করা হয়েছে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০৩

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে এক সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগের সঙ্গে ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার’ এক নতুন অভিযোগ আনয়ন করা হয়। এতে বলা হয়ঃ ‘অধুনা বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবকে ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’ এবং অন্যান্য অপরাধের জন্যে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। আগস্ট মাসের ১১ তারিখ থেকে গোপনে এ বিচার অনুষ্ঠিত হবে এবং বিচার সম্পর্কিত সবকিছু গোপন রাখা হবে।’
[ ‘দি ডন’, করাচী, ১০ই আগষ্ট, ১৯৭১]

এই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই সর্বপ্রথম শেখ মুজিব সম্পর্কিত তথ্য পরিবেশন ক’রে বলা হয়, তাঁকে মার্চ মাসের ২৬ তারিখ ভোরে তাঁর ধানমণ্ডীস্থিত বাসভবন থেকে বন্দী করা হয়। পরে, তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানারিত করা হয়েছে। কিন্তু, কোথায় তাঁকে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করা হয় নি। বরং সব সময়ই শেখ মুজিব সম্পর্কিত খবরাখবর সযতনে গোপন রাখা হয়েছিল।
শেখ মুজিবের বিচারের কথা প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে বিশ্বজনমত।
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ৮ তারিখে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের নিকট শেখ মুজিবের বিচার-প্রহসন বন্ধ করবার জন্য এক আবেদন পত্র প্রেরণ করেন। তিনি বলেনঃ ‘ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণ, সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় পার্লামেন্টও ইয়াহিয়া খান কর্তৃক শেখ মুজিবের বিচার-সম্পর্কিত বিবৃতিতে বিচলিত হ’য়ে পড়েছেন। ইয়াহিয়া খান এক গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু করতে যাচ্ছেন এবং (এই বিচারে শেখ মুজিবকে) কোন বৈদেশিক আইনজ্ঞের সহায়তা থেকে বঞ্চিত করেছেন। আমরা ধারণা করছি যে, তথাকথিত এই বিচার শেখ মুজিবকে হত্যা করবার একটা আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৮]
আগস্ট মাসের ৯ তারিখে ভারতীয় বৈদেশিক মন্ত্রী সরদার শরন সিং ভারতীয় লোকসভায় শেখ মুজিব ও তাঁর বিচার-সম্পর্কিত বিবৃতির
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০৪

সমালোচনা ক’রে বলেন যে, “তাঁর বিচার সম্পর্কে আমরা বিদেশের সরকারগুলোকে আমাদের অভিমত জানিয়েছি এবং এ-সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের ওপর তাঁদের প্রভাবকে কার্যকর করতে অনুরোধও করেছি। যদি শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার এবং তাঁর সহকর্মীদের কোন ক্ষতি করবার চেষ্টা করা হয়, তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে এবং এর জন্যে বর্তমান পাকিস্তানী সরকারই পুরোপুরি দায়ী থাকবেন।”
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৮]

শেখ মুজিবের বিচারানুষ্ঠানের সংবাদ বহির্বিশ্বে প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার ঝড় বয়ে যায়। আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে জার্মান ডেমোক্রাটিক রিপাবলিকের বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে এক বিবৃতি দিয়ে বলেনঃ “শেখ মুজিবের গোপন সামরিক বিচারালয়ে বিচার অনুষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে এই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে (এখনকার) বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্ব পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতার জীবন সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। কাজেই জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের জনগণ পাকিস্তান সরকারের কাছে মানবিক সহানুভূতি প্রদর্শন করতে এবং শেখ মুজিবকে তাঁর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরূপে সম্মান প্রদর্শন করতে আবেদন জানাচ্ছে।
[ ‘দি মর্নিং নিউজ’, ২৬শে নভেম্বর, ১৯৭১]

শেখ মুজিবের বিচার বন্ধ করবার অনুরোধ জানিয়ে আগস্ট মাসের ১৭ তারিখে জেনেভায় অবস্থানরত আন্তর্জাতিক জুরী কমিশনের সদস্যরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে এক তারবার্তায় বলেছেনঃ “বিশ্ব জনমত ধরে নিয়েছে যে, সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করবে। এ ধারণা যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে আন্তর্জাতিক জুরী-কমিশন আপনার কাছে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে নিবেদন করছে, এ দণ্ডাদেশকে বাতিল ক’রে দিয়ে আপনার মহানুভবতা ও বিজ্ঞতা প্রদর্শনের মাধ্যমে জিঘাংসা, সন্ত্রাস আর দুঃখ-কষ্টকে ব্যাপকতর আকার ধারণ করতে না দে’য়া।”
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৯-৩০]

অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে নিশ্চুপ ছিল না । আগস্ট মাসের ২০ তারিখে হেলসিংকি থেকে ‘বিশ্ব শান্তি সংস্থা’
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০৫

পাকিস্তান সরকারের কাছে শেখ মুজিবের গোপন বিচার বন্ধ ক’রে মুক্তি দেবার আবেদন জানান। আবেদনে বলা হয়ঃ মানবিকতার স্বাভাবিক ধর্মকে পুরোপুরি অস্বীকার ক’রে এবং বিশ্বজনমতের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করছে। এই মনোভাব ব্যক্ত ক’রে বিশ্বশান্তি পরিষদ তার সদস্যভুক্ত প্রতিটি জাতীয় সংসদকে শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে দাবী জানাতে আহ্বান জানান এবং এ-সম্পর্কে এক তারবার্তার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানকে (বিশ্বশান্তি পরিষদের সিদ্ধান্ত) অবহিত করেন।
সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখে যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন সেক্রেটারী অব স্টেট মিঃ আর্থার বটমলি কুয়ালালামপুরে কমনওয়েলথ পার্লিয়ামেন্টারী এসোসিয়েশনের অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতায় কমনওয়েলথ দেশভুক্ত রাষ্ট্রসমূহকে শেখ মুজিবের মুক্তির জন্যে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির উপদেশ দেন। এখানে তিনি শেখ মুজিবকে সমর্থন ক’রে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের পক্ষে একমাত্র শেখ মুজিবই কথা বলবার অধিকারী।’
[ ‘দি গার্ডিয়ান’, লণ্ডন, ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

কিন্তু শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করবার ধৃষ্টতার অভাব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভিতর পরিলক্ষিত হয় নি। বরং পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে এক প্রতিবাদলিপিতে বলেছিলেন, সেক্রেটারী জেনারেলের আগস্ট মাসের ১০ তারিখে প্রদত্ত শেখ মুজিবের বিচার-সম্পর্কিত বিবৃতি জাতিসংঘ চার্টারের নির্ধারিত নীতিমালা বহির্ভূত।
[ ‘দি ডন’, করাচী, ১৬ই আগষ্ট, ১৯৭১]

আগস্ট মাসের ৩১ তারিখে জাতিসংঘে অবস্থানরত পাকিস্তানী প্রতিনিধি নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের অপকর্মের সমর্থনে নির্লজ্জের মত বলেছিলেনঃ “পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে অনেকগুলো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, বিচার আগস্ট মাসের ১১ তারিখে শুরু হয়েছে এবং আগামী দু’সপ্তাহের ভিতরই তা’ সমাপ্ত
হবে।”
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০৬

তবে উক্ত সাক্ষাৎকারের সময় সাংবাদিকদের কাছে বিচারের স্থান প্রকাশ করতে তিনি অসম্মত হলেও একথা স্বীকার করেছিলেন যে, শেখ মুজিবকে তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পাকিস্তানের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ সাংবিধানিক আইনজ্ঞ মিঃ এ. কে. ব্রোহীকে নিযুক্তির অনুমতি দে’য়া হয়েছে।
[ ‘ডেইলী নিউজ’, করাচী, ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা ক’রে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসনই শুধু চালিয়ে যাচ্ছিলেন না, এই বিচারানুষ্ঠানকালে শেখ মুজিব সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করতেও তিনি সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেন নি। সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে ফরাসী পত্রিকা ‘লা ফিগারো’তে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারে তিনি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী জনগণের শত্রু বলে অভিহিত করেছিলেন। অক্টোবর মাসে ফরাসী দৈনিক ‘লি মণ্ডি’র সাংবাদিকের কাছে তিনি মুজিব সম্পর্কে মন্তব্য ক’রে বলেছিলেন, “আমি একজন বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতে পারি না।” উক্ত সাংবাদিক শেখ মুজিবের বিচার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে এই শক্তিমদমত্ত স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন যে, শেখ মুজিব একজন দুষ্কৃতিকারী। তাঁর দেশে এরকম অনেক দুষ্কৃতিকারী আছে, তাঁদের আইনানুসারে বিচারও হয়ে থাকে।
[ ‘দি ডন’, করাচী, ২রা অক্টোবর, ১৯৭১]

অর্থাৎ দেশের কর্ণধার হয়ে তিনি এমন একজন মহাপুরুষ হয়েছেন যে, শেখ মুজিব ও তাঁর সম্পর্কিত সংবাদ মাত্রই তুচ্ছ এবং এইসব সাধারণ খবরাখবর প্রেসিডেন্টের রাখবার কথা নয়। এমন ধৃষ্টতার নজীর মানবেতিহাসে বিরল।

বিচার শুরু হবার পর প্রতিবাদমুখর বিশ্ব-বিবেক
যাহোক, ১১ই আগস্ট তারিখে বিচার শুরু হলেও সেদিনই তা’ মুলতবী হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখ থেকে বিচার পুনরায় শুরু হয়। গোপন সামরিক আদালতে বিচার চলতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বজনমতের চাপে মিঃ এ. কে. ব্রোহীকেও তাঁর সহকারী হিসেবে মিঃ গোলাম আলী মেনন, মিঃ আকবর মীর্জা এবং মিঃ গোলাম হোসেনকে শেখ মুজিবের পক্ষে মামলা চালানোর অনুমতি দে’য়া হয়। বিচারের কার্যবিবরণী সম্পর্কে এক সামরিক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে, শেখ মুজিবের বিপক্ষে এ-পর্যন্ত ২০ জন সাক্ষীর জেরা করা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০৭

হয়েছে এবং সময়মত জনগণকে বিচারের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করান হবে। ইতিমধ্যে সরকার পক্ষ থেকে হুঁশিয়ার ক’রে দেয়া হয় যে, জনগণ যেন তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে যত্নবান হয়ে অপ্রাসঙ্গিক কোন কিছু না বলেন এবং এমন কোন কিছু ক’রে না বসেন যা আদালত অবমাননার পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়ে এবং বিচারের অগ্রগতিকে বিঘ্নিত ক’রে বসে অথবা বাদী বা বিবাদী পক্ষের প্রভাব বিস্তার ক’রে (ন্যায়) বিচারকে বাধা দেয়।
[ ‘দি ডন’, করাচী, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

কিন্তু দিন দিন মুজিবের পক্ষে প্রবলতর হয়ে ওঠে বিশ্বজনমত। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র মুজিবকে মুক্তি দেবার জন্যে ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকেন। এমন কি পাকিস্তানের (পশ্চিম) জনগণ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী উত্থাপন করতে শুরু করেছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসের ২৬ তারিখে ন্যাশনাল আওয়ামী দলের এক অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানীও শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী ক’রে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
নভেম্বরের ৫ তারিখে লাহোর থেকে পাঠানো রয়টারের সংবাদে জানা যায় যে, পাকিস্তানের বিভিন্ন স্তরের ৪২ ব্যক্তি এক সম্মিলিত আবেদনপত্রে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে শেখ মুজিবের আশু মুক্তির আবেদন জানিয়েছিলেন। এদের ভিতর ছিলেন রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ছাত্রনেতা, সমাজকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৬-২৭]

ক্রমবর্ধমান বিশ্ব-জনমত, আভ্যন্তরীণ জনমতঃ ইয়াহিয়ার মানসিক ভীতি
শেখ মুজিবের বিচার-সম্পর্কে বাইরের চাপ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও মুজিবের অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের দাম্ভিক মনোভাবকেও অবনমিত করেছিল। এর প্রমাণ বহণ করছে নভেম্বরের ৮ তারিখে প্রদত্ত তাঁর ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিনের সাংবাদিকের সঙ্গে এক ‘সাক্ষাৎকার-বিবৃতি।’ এতে তিনি বলেছিলেন যে, “আমাকে অনেকেই বিশ্বাস নাও করতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয়, যদি তিনি (শেখ মুজিব) পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান, তবে তাঁর নিজের জনগণই তাঁকে হত্যা করবে। (কেননা) তারা তাঁকেই (মুজিব) তাদের
দুঃখ-দুর্দশার
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০৮

জন্যে দায়ী করেছে। ……….. আমি খামখেয়ালীপনার আশ্রয় নিয়ে তাঁকে মুক্তি দিতে পারি না। এটা একটা বিরাট দায়িত্ব। কিন্তু, জাতি যদি তাঁর মুক্তি চায়, আমি তা’ হ’লে তাঁকে মুক্তি দিতে পারি।”
[ ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন, ৮ই নভেম্বর, ১৯৭১]

ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে ইসলামাবাদ থেকে ইউ. পি. আই-এর দেয়া সংবাদে জানা যায় যে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শেষ হয়েছে। তবে, এখনো কোন ‘রায়’ দে’য়া হয় নি। তাঁকে (এখন পর্যন্তও) ইসলামাবাদের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত লায়ালপুর জেলার বন্দীশালায় আটক রাখা হয়েছে।
আগষ্ট মাসের ১১ তারিখ থেকে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হলেও এবং ডিসেম্বরে এ বিচার সমাপ্তির কথা জানা গেলেও এর ‘রায়’ সম্বন্ধে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের কথা শোনা যায় নি। সম্ভবতঃ বহির্বিশ্বে শেখ মুজিবের অভাবনীয় জনপ্রিয়তা এবং বাঙালী জাতির ওপর তাঁর অসীম প্রভাব; এমন কি পাকিস্তানের সমাজেও বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের ‘চরম’ ব্যবস্থা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল।
ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই দেশের অভ্যন্তরে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে এবং বিশ্বজনমতের চাপে বাধ্য হয়ে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসের ৮ তারিখ সকালে বিলেতের উদ্দেশ্যে পি. আই. এ-র (ফ্লাইট নং ৬৩৫) এক বিশেষ বিমানে রাওয়ালপিণ্ডি ত্যাগ করেন। তবে শেখ মুজিবের লণ্ডন উপস্থিতির পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তাঁর গতিবিধি সম্পর্কে সমস্ত সংবাদ গোপন রাখা হয়েছিল। তাঁর রাওয়ালপিণ্ডি পরিত্যাগের বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে রেডিও পাকিস্তানি থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল, পাকিস্তান সময় ০৩.০০ (জানুয়ারী ৮, ১৯৭২) পাকিস্তান সরকারের বিশেষ ভাড়া করা এক বিমানে শেখ মুজিব রাওয়ালপিণ্ডি পরিত্যাগ করেছেন এবং তাঁকে বিদায় জানাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
শেখ মুজিবের বন্দী-জীবন এবং গোপন সামরিক আদালতে তাঁর বিচার-প্রহসন বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির প্রতি পাকিস্তানী সামরিক চক্র এবং
পৃষ্ঠা নং ~ ৯০৯

পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব ও জিঘাংসা ইত্যাদির স্বরূপকে বহির্বিশ্বে উন্মোচিত ক’রে দিয়েছিল। মানুষ শেখ মুজিব, রাজনীতিক শেখ মুজিব এবং দরদী শেখ মুজিবকে সারা বিশ্ব তাঁর বন্দী-দশা এব তাঁর বিচার-প্রহসন চলাকালে পুরোপুরিরূপে জানবার এবং বুঝবার সুযোগ পেয়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
এখন আমাদের বিচার্য বিষয় হ’ল, শেখ মুজিবের অপরাধ কি ছিল? আর তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সত্য হ’লে, তার জন্যে তিনি কতটুকু দায়ী ছিলেন? অথবা তাঁকে এ-ব্যাপারে অভিযুক্ত করা চলে কি না? অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ভুক্ত ক’রে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ও পাঞ্জাবী শাসকচক্র শুধু তাদের নির্বুদ্ধিতাকেই বিশ্বের সামনে বড় ক’রে তুলেছে। ইয়াহিয়া খান অবৈধভাবে শেখ মুজিবকে হত্যা করবার একটি বৈধ আবরণ সন্ধান করেছিলেন, কেননা কোন সভ্যদেশে প্রচলিত কোন আইনে, এমন কি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় আইনেও অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন কখনো রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ বলে পরিগণিত নয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনে তাঁর কাজের জন্য কোন অবস্থাতেই এবং কখনই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন না।
কিন্তু যখন তাঁকে একটা অভিযোগে অভিযুক্ত ক’রে বিচার করা হয়েছে, তখন দেখা যাক আন্তর্জাতিক আইনের আওতাভুক্ত কোন অপরাধে তিনি অপরাধী কি না? আমরা ধরে নিলাম, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদ করেছেন (অবশ্যই এটা সত্য কথা) কিন্তু কোন দেশের কোন অংশ যদি ন্যায়সঙ্গত কারণে (যেমন মৌলিক মানবিক অধিকার রক্ষার্থে) বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু ক’রে দেয়; তা’ কি আন্তর্জাতিক আইনের কোন ধারায় অবৈধ ব’লে স্বীকৃত হয়েছে? এ ধরনের কোন আইন আন্তর্জাতিক আইনের কোন ধারা-উপধারায় সংযোজিত হয় নি।
সুব্রত রায় চৌধুরী শেখ মুজিবের বিচার যে অবৈধ তার স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপিত করবার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কার্যবিবরণী ও জেনেভা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১০

কনভেনশনের বিভিন্ন ধারা-উপধারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, কোন ন্যায়নীতির দ্বারাই শেখ মুজিবের বিচার বৈধ হতে পারে না।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৪০-৪১]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা যে আইনসঙ্গত এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক সনদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, এ-সম্পর্কে যুক্তি দেখিয়ে সুব্রত রায় চৌধুরী প্রমাণ করেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনের কোন ধারা বা উপধারার পরিপন্থী নয়। শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ক’রে কোন অপরাধ করেন নি; বরং শেখ মুজিবকে অন্যায়ভাবে বন্দী ক’রে বিশেষ সামরিক আদালতে গোপনে বিচার পরিচালনা ইয়াহিয়া খানের অসাধু উদ্দেশ্যেরই আরও একটি উদাহরণ বিশেষ। সুতরাং, কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে ইয়াহিয়া খানকে, শেখ মুজিবকে নয়।
[ বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২০০-২০১]

বিচার চলাকালে বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো শেখ মুজিবের বিশ্ব-জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর বহন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় শেখ মুজিব, তাঁর বিচারের বৈধতা ও মুক্তি সম্পর্কে প্রকাশিত কতকগুলো মন্তব্য এখানে বাংলায় অনুবাদ ক’রে দেয়া হ’ল। এগুলোর মধ্যে পাকিস্তানী দু’-একটি পত্র-পত্রিকার মন্তব্যও আছে।

।। ১. মুজিবের গোপন বিচার ।।
“শেখ মুজিবুর রহমান নামে এমন একজনের গোপন বিচারানুষ্ঠান হতে যাচ্ছে, যাকে পাকিস্তান ফেডারেশনের অধিকাংশ জনসাধারণ পরোক্ষভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীদের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। এই ঘটনায় উভয় পক্ষীয় পারস্পরিক সমঝোতার যে ক্ষীণতম আশাটুকু ছিল, তাও নিঃশেষিত হ’ল।”
[ ‘ট্রাইবুন দি জেনেভা’, ১০ই আগস্ট, ১৯৭১]

2. UNDER SECRET SUMMARY PROCEEDING
“জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল মিঃ উ থান্ট এই বলে সর্তক বাণী উচ্চারণ করেন যে, গত নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে এবং তার অব্যবহিত
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১১

পরবর্তী কালের কলেরা মহামারীতে পূর্ব বাংলায় যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তার চেয়েও বহুগুণ ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসতে পারে, যদি দেশদ্রোহিতার অপবাদে পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা মুজিবুর রহমানের এমন ধরনের গোপন বিচারের প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকগণও উ থান্ট-এর সঙ্গে একমত হলেন। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই নেতা শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন, সে কথা স্মরণে রেখেই তাঁরা তাঁদের বক্তব্য রাখলেন……এই সময় ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন-সূত্র শেখ মুজিবুর রহমানকে যে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে সে কথা পর্যন্ত প্রকাশ করতে অস্বীকার করলো। তাঁরা শুধু এইটুকুই বললো যে, ‘পাকিস্তানেরই কোন এক জায়গায়’ তাঁর বিচার হবে। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালীরা যে-কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে (নিজেদের স্বার্থে) গ্রহণ করতে পারতো। কারণ—ঐতিহ্যের দিক দিয়ে তারা পশ্চিমপন্থী, কিন্তু তাদের প্রতিবেশী তো লালচীন। শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ভাবের চেয়ে কাজের প্রতিই বেশী অনুরক্ত, তিনি ঠিকই বুঝতেন যে, ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর মধ্যে এবং জনসাধারণের রায়ের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায় এবং কতটুকু।”
[ ‘লা নেশন’, বুয়ন্স আয়ার্স, ১৫ই আগষ্ট, ১৯৭১]

।। ৩. মুজিবের ‘দেশদ্রোহিতার’ প্রকৃতি।।
“আগস্ট মাসের ১১ তারিখে শেখ মুজিবের গোপন বিচার শুরু হ’ল। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ছিল ‘দেশ-দ্রোহিতা’। সুতরাং, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এ ‘দেশ-দ্রোহিতার’ প্রকৃতি ও ইতিহাস নিরূপণ করলে তবেই প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা সম্ভব।
১৯৬৬ সালে মুজিবুর রহমান যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে তাঁর ৬-দফা কর্মসূচীর কথা ঘোষণা করলেন, (যা আগের নির্বাচনে তাঁর অভূতপূর্ব সাফল্যের প্রধান কারণও ছিল), তখন থেকেই তিনি বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত হলেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে পড়লেন।
সরকার পক্ষীয় লোকেরাই এ-ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করলো এবং সাজানো মিথ্যা অভিযোগগুলো স্থগিত রাখা হলো।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১২

স্বায়ত্তশাসনের দাবীটি নতুন কিছুই ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির মূল সেই লাহোর প্রস্তাব-যার খসড়া জিন্নাহ স্বয়ং করেছিলেন, সেখানেই বলা হয়েছিল যে, ভারতবর্ষের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো এমনভাবে পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশে বিভক্ত হবে, যেগুলোর প্রত্যেক অঞ্চলই হবে স্বায়ত্তশাসিত এবং এর সবগুলো ‘স্টেট’ মিলেই অখণ্ড পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ পূর্বাঞ্চল কখনই তেমন স্বায়ত্তশাসিত ‘স্টেট’ বলে পরিগণিত হ’ল না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবর্গ পূর্বাঞ্চলকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে শাসন ও শোষণ ক’রে আসছে ——
স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনগণ এই প্রথম শেখ মুজিব ও তাঁর দলকে পাকিস্তান সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য এনে দিল———
শেখ মুজিব আবার বিশ্বাসঘাতকরূপে চিহ্নিত হলেন এবং শুরু হ’ল গণহত্যা —— মজার কথা এই যে, লাহোর প্রস্তাবে বর্ণিত সেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতিটুকুও শেখ মুজিব তাঁর ৬-দফাতে দাবী করেন নি। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দফতর রাখার ব্যাপারে তাঁর মত ছিল —————-।”
[ ‘দি সানডে টাইম্‌স’, জাম্বিয়া, ২২শে আগষ্ট, ১৯৭১]

।। ৪. অবশ্যই তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।।
“পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য একটি পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বিচারালয় নির্ধারণ করছে। সুপ্রীম কোর্টের বিচারক জনাব শফির কাছে এটা পূর্ব পরিজ্ঞাত যে, ‘অবশ্যই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।’
বাঙালী চরিত্র সম্বন্ধে অনুধাবন ক’রে বাংলাদেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস অষ্টাদশ শতাব্দীতে বলেছিলেনঃ ষাঁড়ের কাছে শিং, ব্যাঘ্রের কাছে নখরযুক্ত থাবা, মৌমাছির কাছে হুল ইত্যাদির মতই বাঙালীর কাছে কপটতা (অন্যতম অস্ত্রস্বরূপ) । বাংলার নতুন শাসক-সম্প্রদায় পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী সামরিক চক্রও তাঁদের পূর্ববর্তী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১৩

মত করেই বিজাতীয় সংস্কার গ্রহণ করেছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের দু’শ বছর পর তারা বাঙালীদের বিরুদ্ধে একটা আইনসিদ্ধ পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করেছে আর তা’ হ’ল- ‘কপটতা’।
বাংলাদেশের গঙ্গা-বিধৌত অঞ্চল থেকে দু’হাজার কিলোমিটার দূরে লায়ালপুরের জেলে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই বিচার শুরু হ’ল। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হ’ল এই যে, তিনি বাংলার ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন দাবী করেছিলেন। তাঁর অপরাধ হ’ল, অবাধ নির্বাচনে তিনি এবং দলগতভাবে তাঁর দল আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করেছে।
শাসন ও শোষণকারী পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের এই প্রাধান্য মেনে নিতে পারলো না। তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ক’রে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালো। অভিযোগ আনা হয়েছিলঃ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উস্কানিমূলক আচরণ।’
পাকিস্তানী রাষ্ট্রপ্রধান ইয়াহিয়া খান পূর্বাহ্নেই ‘এ-রকম একটা ধারণা’ ক’রে নিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি মিঃ কারগিল যখন জেনারেলকে প্রাণদণ্ড দানে বিলম্ব করতে অনুরোধ জানালেন, তার উত্তরে তিনি নিন্দা ক’রে বললেনঃ ‘চূড়ান্ত রাজদ্রোহিতার অপরাধে এই ব্যক্তি দোষী, তাঁকে অবশ্যই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হবে।’ এই বিচারের নির্দোষিতা দেখানোর জন্য ইয়াহিয়া খান অভিযুক্তকে তাঁর নিজস্ব কৌঁসুলি পছন্দ করবার সুযোগ দিলেন। শেখ মুজিব এ. কে. ব্রোহীকে স্বীয় কৌঁসুলিরূপে মনোনীত করলে তিনি ভয়ে ‘এ কাজ’ করতে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। অতঃপর দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’-এর নিন্দাসূচক ভাষ্য হ’লঃ ‘পাকিস্তানে তাঁকে সর্বোচ্চ পরিমাণ আইনগত সহযোগিতা দান করার অভিপ্রায় জানিয়ে এবং বিচারের নামে প্রহসন করার জন্য পাক-সরকার ব্রোহীকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থন করতে বাধ্য করলো।’
অপর পক্ষে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের বিচারক জনাব শফি শেখ মুজিবের ওপরকার সামরিক সিদ্ধান্তগুলো জানতেনঃ ‘অবশ্যই তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে এবং তারপর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মধ্যে দণ্ডদান স্থগিত থাকবে। এই চূড়ান্ত শাস্তি একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ও
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১৪

সামগ্রিক পাকিস্তানের আইনসিদ্ধ বিচারের (বৈধতার আবরণ) মুখ রক্ষা করবে। দণ্ডদান স্থগিত রেখে আমরা বিশ্বের কাছে সদিচ্ছা ও বিশ্বাসের অবকাশ সৃষ্টি করতে পারি।’
পাকিস্তান ভীষণভাবে বিশ্বের সদিচ্ছা কামনা করে, কিন্তু শেখ মুজিবের বিচার যেভাবে চলছে তারই ওপর পাকিস্তানের সুনাম নির্ভর করবে।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ বা নির্বাচিত ১৬৭ জন সদস্যের মধ্যে, বলা হয়, মাত্র ৮৮ জন পশ্চিমের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবার পক্ষে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
পূর্ব বাংলার আইন সভায় মুজিবের অনুসারী ২৮৮ জনের মধ্যে মাত্র ৯৪ জন উদ্ভূত এই নতুন পরিস্থিতিকে স্বীকার ও গ্রহণ করেছিলেন।
অন্য যারা শেখ মুজিব ও তাঁর দলের প্রতি বিশ্বস্ত রইলেন এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে অনমনীয় থাকলেন তাঁদেরকে নিজ নিজ জেলার সামরিক প্রশাসকের কাছে ২৬শে আগস্ট ৮টার মধ্যে হাজির হবার জন্য নির্দেশ দেয়া হ’ল। নিজেদের কৌঁসুলি মনোনয়নের সুবিধা না দিয়েই সামরিক বিশেষ বিচারালয় তাঁদের বিচার করার জন্য অপেক্ষা করছে।
যদি প্রকৃতই এইসব এম. পি. সামরিক বিচারকদের কাছে গিয়ে হাজির হ’ত, তা’ হ’লে কি হ’ত—সে সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানী মেজর ইফতেখার SPIEGEL-এর প্রতিনিধিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেনঃ “একজনের মাধ্যমে এমন ত্রাসের সঞ্চার করতে হবে, যেন পর পর তিন পুরুষও এর (মুজিবের) কথা সভয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হয়।
[ ‘দের স্পিগেল’, বন, ৩০শে আগষ্ট, ১৯৭১]

।। ৫. মুজিবকে মুক্তি দাও ।।
“পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সব কিছু মিটমাট করার ভান করলেন। বৃহস্পতিবারের পর পূর্ব পাকিস্তানে পুনরায় একজন দেশী গভর্নর নিযুক্ত করা হবে। তিনি হবেন একজন বাঙালী, এর চেয়ে বেশী (আর) কি চাই। পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেল টিক্কা খানকে বাঙালীরা ‘কসাই’ বলে, কারণ তার বাহিনী বিপ্লবীদের অত্যন্ত বর্বরোচিতভাবে হত্যা করছিল। এবার তিনি সামরিক কর্মকর্তা হবেন। এই পরিবর্তনে সেখানকার
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১৫

লোকেরা প্রভাবিত হবে কিনা কিংবা ২৬শে মার্চের পর থেকে যত ঘটনা ঘটে গেছে, তার প্রেক্ষিতে আদৌ সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত আছে কিনা, একথা ঠিক ক’রে বোঝা যায় নি।
সকল বিদেশী পরিদর্শক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দেখে একবাক্যে স্বীকার করেছে যে, ‘পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর’ প্রতি বাঙালীদের মনে তীব্র ঘৃণা আছে এবং তাদের সহযোগী যারা (বিশেষ ক’রে বিহারের অবাঙালী মুসলমান) তাদের প্রতিও তাদের ঘৃণা দৃঢ়মূল।
৬৬ বছর বয়স্ক ভূতপূর্ব কূটনীতিক নতুন গভর্নররূপী মালিক অতঃপর অবশ্যই তাঁর স্বদেশবাসীর কাছে গৃহশত্রু বলে বিবেচিত হবেন।
যদি বাঙালীর প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান শীঘ্র মুক্তি না পান, তা’ হ’লে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পুনর্মিলন বা মিটমাট ক’রে ফেলার সদিচ্ছাজনিত এই ভানেরও কোন মানে হয় না।”
[ ‘এ্যালেজমেইনি সাইতুং’, ২রা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

।। ৬. ক্ষমাকর এবং ভুলে যাও ।।
“প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক অপরাধীদের ব্যাপকভাবে ক্ষমার আদেশটিও অস্পষ্ট ছিল। তিনি যদিও সাধারণভাবে ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন, তবু এই ক্ষমা শুধু তাদেরই প্রতি প্রযোজ্য যারা ‘পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগের সময় গত ১লা মার্চ থেকে ৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপরাধমূলক কাজে জড়িত আছে।’ এখনো যারা বিপক্ষে কাজ করছে তাদেরকে বিশেষভাবে চিহিত করা হ’ল। এই ক্ষমা ঘোষণার ব্যাপারটি শুধুমাত্র একটা লিখিত বিবরণ হিসেবে রাখা হ’ল, না ক্ষমা-প্রার্থীদের সামনে একটা ব্যতিক্রমের নজির রাখা হ’ল, ঠিক বোঝা গেল না। এখানে একটা বিভ্রান্তি দেখা দিল, যেমন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যে মামলা, তা’ এখনো থাকলো কি না। কেউ জানেনা, এর যথাযথ আইন-সিদ্ধ ব্যাখ্যা কি হবে। কিন্তু একজন সাধারণ লোকের চোখে এমন যদি প্রতীয়মান হয় যে, বিচারাধীন কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি আইনের প্রয়োগ শুরু হয়ে থাকলেও প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সার্বিক ক্ষমা প্রদর্শনের পর তার আর কোন দোষ থাকতে পারে না, তা’ হ’লে তাকে নির্বোধ বলা সমীচীন হবে না। আমরা আশা করি, এ-সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা খুব শীঘ্রই
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১৬

এসে পড়বে। ইতিমধ্যেই এর পেছনে যে মনোভাব আছে, এবং যা মিটমাট ক’রে ফেলার একটা পদক্ষেপও বটে, তাকে স্বাগতম জানাই। সত্যিকাররূপে ভুলে যাওয়া এবং ক্ষমা করার উপরই জাতির ভবিষ্যত গঠিত হতে পারে।”
[‘পাকিস্তান টাইমস’, লাহোর, ৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

।। ৭. একটি পাকিস্তানী আইনসম্মত মতবাদ ।।
“পূর্বাঞ্চলের গোলযোগে জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সার্বিক ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানও কি ক্ষমা পেতে পারেন? এই প্রশ্ন এখানকার (করাচী) লীগ্যাল এক্সপার্ট ও স্থানীয় রাজনৈতিক চক্রকে উত্তেজিত করেছে।
সযত্ন বিশ্লেষণে দেখা গেল যে, সাধারণ ক্ষমার ব্যাপারে যে রাজনৈতিক ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে, তাকে সাধারণ ক্ষমা ছাড়া আর কিছুই বলা হয় নি। এই ঘোষণার প্রচলিত আইনসিদ্ধ ব্যাখ্যায় সম্ভবতঃ শেখ মুজিবুর রহমানও মুক্তি পেয়ে যান। অন্ততঃ পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিব-সমর্থক মহল থেকে এ-রকমই বলাবলি হচ্ছে।
অন্যপক্ষের মতে, এই সাধারণ ক্ষমার আওতায় কোনক্রমেই শেখ মুজিবুর বহমান এবং তথাকথিত জাতীয় সংসদ ও আইন সংসদের সদস্যরা, যাদের অপরাধী সাব্যস্ত ক’রে বিচার চলছে, তাঁরা পড়েন না। প্রায় ‘এইভাবই’ সমর্থন ক’রে প্রেস তথ্য সরবরাহ বিভাগের একজন মুখপাত্র লিখিত বিবরণী সহযোগে ব্যাখ্যা প্রদান করেন। যাই হোক, তথ্য সরবরাহ কেন্দ্রের এই ধরনের বাচনিক ব্যাখ্যাকে পর্যাপ্ত বলে মনে করা হয় নি।
এই সঙ্কটজনক ব্যাপারের পরিপ্রেক্ষিতে যথার্থ একটি ইশতেহার বা ঘোষণা আশা করা যাচ্ছে। তদুপরি মিঃ আতাউর রহমান খানকে বিচারের জন্য খোঁজা হচ্ছিল, তাঁকে মুক্তি দেবার ফলে উক্ত সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। কিছুসংখ্যক ‘লিগ্যাল এক্সপার্ট’ ‘সাধারণ ক্ষমা’ প্রদর্শনের ইশতেহারের কিছু কথা উল্লেখ ক’রে বলছে, ‘গোলযোগের সময় অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যারা জড়িত অথবা অপরাধমূলক কাজ যারা করেছে’ এই বাক্যে যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং যারা বিচারাধীন রয়েছে, তাদের সবার ওপরই সিদ্ধান্তটি প্রযোজ্য হবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১৭

তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ধারা এমন হতে পারতো, যাতে অপরাধের দায়ে যে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং যাদেরকে অপরাধীদের সঙ্গে জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, তারা সবাই এই সার্বিক ক্ষমা প্রদর্শনের সীমায় পড়ে।
করাচীর রাজনৈতিক এবং আইনজ্ঞ মহল অতঃপর অত্যন্ত অধীর চিত্তে শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের ব্যাপারে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসানমূলক একটা সরকারী বিজ্ঞপ্তি আশা করছে।”
[ ‘দি ডেইলি নিউজ’, করাচী, ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

।। ৮. সাধারণ ক্ষমা নির্বাচিত নেতাদের জন্য নয় ।।
“পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রয়াস পেতে হলে মহাপুরুষ হতে হয়। প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট এই বিপর্যয়ে লক্ষ লক্ষ লোক নিরাপত্তার জন্য ভারতে পালিয়ে গেল এবং এই বিভক্ত দেশের ভাঙ্গনের আশঙ্কা আরো বহুদূর বিস্তৃত হ’ল।
গণতন্ত্র রক্ষার খাতিরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একনায়কের ভূমিকা ত্যাগ করতে পারতেন। কারণ গত কয়েক মাসে তিনি যে ঘটনাগুলো সংঘটিত করেছেন, তা’ সংহতিকে ভয়ানকভাবে ব্যাহত করেছে।
প্রায় নয় মাস হ’তে চললো, শেখ মুজিবুর রহমান রাজদ্রোহিতার অপরাধে বিচারাধীন (বন্দী অবস্থায়) রয়েছেন এবং যদি দোষী প্রমাণিত হন, তা’ হ’লে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন, অথচ তিনি তাঁর নীতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিকের সমর্থন পেয়ে নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতেছিলেন।
এটা শেখ মুজিবেরই যুক্তি ছিল, প্রজাতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানকে কতকগুলো পশ্চিম পাকিস্তানী মিল-মালিকদের স্বার্থে উপনিবেশ ক’রে রাখার অবিরত চেষ্টা শোষণেরই নামান্তর।
বিপুল ভোটাধিক্যের সমর্থনের ভিত্তিতে তিনি স্বায়ত্তশাসনের একটা কর্মসূচী উপস্থাপিত করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের বিজয়ী নেতা ভুট্টোর (যদিও শেখ মুজিবের তুলনায় প্রায় অর্ধেক আসন পেয়েছেন) মতে মত মিলিয়ে তাঁর (মুজিবের) এই পরিকল্পনাকে প্রজাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে যাবার মহড়া বলে ব্যাখ্যা করলেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১৮

এই পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক শাসন জারী হ’ল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করলো এবং শেখ মুজিব অন্তরীণাবদ্ধ হলেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সার্বিক ক্ষমা ঘোষণার মধ্যে তিনি এই বিশ্বাস পোষণ করতে পারেন যে, সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কিন্তু এটা ঠিকও নয় এবং শান্তি রক্ষার আগ্রহও এতে নেই। কারণ, শেখ মুজিব সম্পূর্ণরূপেই তাঁর দয়ার বাইরে রয়ে গেলেন।”
[ সম্পাদকীয়, ‘ত্রিনিদাদ গার্ডিয়ান’, পোর্ট অব স্পেন, ৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১]

।। ৯. শেখ মুজিবের সময়োচিত মুক্তি ।।
“আমাদের মতে, শেখ মুজিবকে যদি যথাসময়ে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে তা’ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে একটা চূড়ান্ত পদক্ষেপেরই সূচনা করবে। আর এখান থেকেই ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর পারিষদবর্গ তাদের সযত্ন-লালিত এই সঙ্কটের (যা অনেকদিন ধরে চলছে) সমাধানের প্রচেষ্টা শুরু করতে পারেন।”
[ ‘ট্রিবিউন এ্যাফ্রিকাইনি’, কিনসাসা, ১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

।। ১০. পরিণাম সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের অজ্ঞতা ।।
“উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনবার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের ওপর অবশ্যই চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই রাজনৈতিক সমাধান বাস্তবায়িত করা সম্ভব হবে এবং তখনই পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলার জন্যে অতীব প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এখনো অখণ্ড পাকিস্তানের আদর্শে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাঁকে তাঁর কার্যকলাপের পরিণাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বলে মনে হয়। কথিত বিচারালয়, যা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের বিচার করছে, তা’ যদি তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে, তবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে যাবে।”
[ সম্পাদকীয়, ‘দি ক্যানবেরা টাইমস’, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৯১৯
।। ১১. অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়কে প্রতিরোধ কর ।।
“এই জটিল ও ভয়ানক পরিস্থিতিতে মনে হয়, মাত্র একজনই সমঝোতার সূত্রপাত ঘটিয়ে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাহায্যে দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। তিনি হলেন বর্তমানে বে-আইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যার দল গত ডিসেম্বরে দেশের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছিল।
২৫শে মার্চে সেনাবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তরীণ অবস্থায় রয়েছেন। দেশদ্রোহিতার অপরাধে তাঁকে গোপনে এক সামরিক আদালতে বিচার করা হয়েছে। প্রাণদণ্ডের হুমকী স্বরূপ সেই রায় এখন পর্যন্ত ঘোষণা করা হয় নি।
সম্ভবতঃ শেখ মুজিবই একমাত্র বাঙালী নেতা যিনি তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা দিয়ে এবং অনুগামীদের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাত্মক গোলযোগের ধারাকে বদলিয়ে দিতে সক্ষম। এমন কি, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোন বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণেও তাঁর পক্ষে তাঁর অনূগামীদের সমঝোতায় আনা, দেশের বর্তমান অবস্থায়, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাঁকে ছাড়া কোন রকম সমাধানের কথাই আজ চিন্তা করা যায় না।
নিশ্চিতরূপে বলা চলে, এমন কি এটা কোন সন্দেহের অবকাশই রাখে না যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার এই মুহূর্তে শেখ মুজিবকে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে আন্তরিকতাপূর্ণ আলোচনায় বসতে পারেন। প্রয়োজনীয় বিষয় হ’ল যে, বাঙালী নেতাকে বিচারে দণ্ডিত এবং তাঁর সম্ভাব্য হত্যাদেশকে কার্যকরী ক’রে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথ যেন পূর্বাহ্নেই সম্পূর্ণ বন্ধ ক’রে না দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইসলামাবাদ সরকারের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রিত প্রভাব বিস্তারের আশায় পাকিস্তানকে যে সাহায্য দিয়ে চলেছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের যতটুকু প্রভাবই থাক না কেন, চূড়ান্ত বিপর্যয়কে রোধ করতে হ’লে তা’ ব্যবহার করা উচিত।”
[ ‘দি ইভনিং স্টার’, ওয়াশিংটন, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১]

।। ১২. মুজিব পাকিস্তানী দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত জনমনের প্রতীক স্বরূপ।।
সামরিক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক কারাগারে নিক্ষিপ্ত নির্বাচন-বিজয়ী মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় প্রতীক স্বরূপ
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২০

দেশের পূর্বাঞ্চলের পৈশাচিক নিপীড়নের মহানতম বলী সন্ত্রস্ত জনগণের ভারত অতিমুখে পলায়ন, বাইবেলে বর্ণিত সেই মহাপ্রস্থানে যাত্রার সমতুল্য। রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত হবে ‘আওয়ামী লীগ’ নেতাকে মুক্তি দেওয়া। .. .. ..
পশ্চিম পাকিস্তানের বুর্জোয়া স্বভাবই পূর্ব পাকিস্তানকে অধীনস্থ ক’রে রেখেছে। এ কথা নিশ্চিত ক’রে বলা চলে যে, বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক-শ্রমিকদের অবস্থা অধিকতর শোচনীয়।
আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৩৩০টি আসনের ভিতর ১৬৯টি আসন দখল ক’রে জয়লাভ করেছিল। … …
পক্ষান্তরে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে ‘বিছিন্নতাবাদী’ বলে আখ্যায়িত করতেই অধিক উৎসাহ পেলেন এবং নির্বাচনী ফলাফলকে বাতিল ঘোষণা করলেন, দেশের পূর্বাঞ্চলের বিরুদ্ধে সত্যিকারের সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান সহ যে সমস্ত আওয়ামী লীগ নেতা পালিয়ে যেতে সমর্থ হন নি, সবাইকে গ্রেফতার করলেন।…
প্রকৃতপক্ষে মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতি পুরো সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক নির্বাচনী কর্মসূচীকে আশ্রয় ক’রে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। কর্মসূচীটি ‘ছয় দফা কর্মসূচী’ নামে পরিচিত। কিন্তু সত্য ক’রে এ কথা কে বলতে পারবে যে, বিরাট জাতীয় প্রশ্ন (রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক), স্বায়ত্তশাসন ও যুক্তরাজ্য গঠনের সমস্যা যা এতদিন পর্যন্ত সমাধান করা হয় নি, সেই প্রশ্নকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানে শান্তি রক্ষা এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা সম্ভব?
বিশ বছর মেয়াদী ভারত-সোভিয়েট মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি সম্পাদনের পর মুক্ত বিবৃতিতে যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছিল, তা’ বাস্তবের চেয়েও অধিক সত্য, প্রয়োজনীয় এবং জরুরী। এর জন্য সময়োচিত প্রথম অপরিহার্য পদক্ষেপ হ’ল, ভালবাসার মাধ্যমে শান্তিকামী জনগণ ও সরকারের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন, অঞ্চলগুলোর মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি এবং ফ্যাসীবাদ-বিরোধী বীর নায়ক আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তি প্রদান। তাঁর মুক্তির সেই দাবী উত্থিত হওয়া এবং দাবী আদায়ের ব্যবস্থা হওয়া উচিত।
[ ল’ উনিটা, রোম, ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭১]
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২১

।। বাংলাদেশে গণহত্যা ।।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিটলার লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র নিরপরাধ নরনারীকে হত্যা ক’রে মানব ইতিহাসে যে নজির স্থাপন করে, তা’ লক্ষ্য ক’রে বিশ্ব-বিবেক শিউরে উঠেছিল। সুপরিকল্পিত উপায়ে গণহত্যার এই নজির স্থাপন ক’রে হিটলার যেমন দেশের প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত আইন ভঙ্গ করেছিল, তেমনি আন্তর্জাতিক আইনকেও অগ্রাহ্য করেছিল।
স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশাসকদের হৃদয়হীন ক্রিয়াকাণ্ড যুগে যুগে নানা দেশে নানাভাবে শান্তিকামী জনগণের জীবন বিপন্ন করেছে। বিশ্ব-বিবেক ক্রমে ক্রমে এ সত্য অনুধাবন করেছে যে, রাষ্ট্রের জনগণ রাষ্ট্রশাসকদের খেয়ালখুশির বস্তু নয়। জনগণের নিরাপত্তা, কল্যাণ, বিভিন্ন অধিকার ইত্যাদি দেশ ও জাতি নির্বিশেষে রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়েও আন্তর্জাতিক আইন সংস্থার আওতাভুক্ত বিষয়। রাষ্ট্রশাসকরা তাদের খেয়াল-খুশি চরিতার্থের জন্য দেশের প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত আইন ভঙ্গ ক’রে জনগণের নিরাপত্তা বিপন্ন এবং অধিকার হরণ করলে জনগণের পক্ষে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার রয়েছে। এই সত্যবোধ থেকেই রাষ্ট্রশাসকদের রোষানল থেকে জনগণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক আইন ও সংস্থার উদ্ভব হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে সুগঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘ (League of Nations) এবং তৎপর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organisation) প্রতিষ্ঠা লাভের পর আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার বাস্তব প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হবার পর অসামরিক জনগণকে হত্যা এবং নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কঠোরভাবে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যার অপরাধে প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের ন্যুরেমবার্গ ও টোকিওতে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়েছিল।
[ ১৯৪৫ সালের ৮ই আগষ্ট সম্পাদিত এই আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র অনুসারে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া লণ্ডনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রধান যুদ্ধোপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করে। ১৯৪৬ সালের ১৯শে জানুয়ারী মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২২

টোকিওতে দূরপ্রাচ্যের প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সামরিক ট্রাইবুন্যাল গঠন ঘোষণা করেন।]

ন্যুরেমবার্গ সনদে যুদ্ধের পূর্বে ও যুদ্ধকালে হত্যা, অন্যায় আচরণ, দখলকৃত এলাকার অসামরিক জনসাধারণকে দাস হিসেবে ব্যবহার বা অন্য কোন কাজে নিয়োগ যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। অসামরিক জনগণকে হত্যা, সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নকরণ, দাস হিসেবে নিয়োগ, অন্যত্র চালান দেয়া কিংবা তাদের সঙ্গে অন্যান্য অমানুষিক আচরণ করাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলা হয়েছে। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার, শহর-নগর-গ্রাম খেয়ালখুশীমত ধ্বংস ক’রে দেয়া সনদে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও সনদ-ভুক্ত নীতিমালা অনুমোদন করে।
[Res. 95 (I), (II), December, 1946, Manual of Public International Law, p. 517]
সাধারণ পরিষদ অপর এক প্রস্তাবে নির্বিচারে গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অপরাধ বলে ঘোষণা করে। এরপর জাতিসংঘ গণহত্যা প্রতিরোধের জন্য যথোপযুক্ত আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ফলশ্রুতিস্বরূপ ১৯৪৮ সালে গণহত্যা সম্পর্কিত এক কনভেনশন (genocide convention) সম্পাদিত হয়। এই genocide convention-এ গণহত্যা সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যকলাপ ও আচরণাবলী সুপষ্টভাবেই উল্লেখিত হয়েছে এবং চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক গণহত্যার হোতা ও অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দানের সঙ্কল্প ঘোষণা করা হয়েছে। উক্ত কনভেনশনের ২ সংখ্যক ধারায় নরনারীর হত্যা, দৈহিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন, সুপরিকল্পিতভাবে অপর সংস্কৃতিকে একটি জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের সংস্কৃতির ধ্বংস সাধন, মানব-জন্ম রোধ করার জন্য বিধিনিষেধ আরোপ এবং জোরপূর্বক এক গোষ্ঠীর শিশুদেরকে অন্য গোষ্ঠীতে চালান ক’রে দেয়া প্রভৃতি আচরণ গণহত্যা পর্যায়ভুক্ত বলে বর্ণিত হয়েছে। ৩ সংখ্যক ধারায় গণহত্যাকেই কেবলমাত্র দণ্ডযোগ্য অপরাধ বলা হয় নি, গণহত্যার জন্য ষড়যন্ত্র, চেষ্টা, উত্তেজনা সৃষ্টি এবং গণহত্যায় সহযোগিতা করা ইত্যাদি আচরণও গণহত্যা পর্যায়ভুক্ত—এগুলোও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বর্ণিত হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২৩

৪ সংখ্যক ধারায় বলা হয়েছে যে, ৩ সংখ্যক ধারায় বর্ণিত গণহত্যা সম্পর্কিত শাস্তিযোগ্য আচরণকারী ব্যক্তি, তিনি রাষ্ট্রশাসক, সরকারী কর্মচারী, বা সাধারণ ব্যক্তি, যিনিই হোন না কেন, তাঁকে শাস্তি দেয়া হবে।
[United Nations, Year Book on Human Rights for 1948, U. N. N. Y., 1950, pp. 482-486: Quoted in Bangladesh, Ed. Dr. Subhash C. Kashyap: The Institute of Constitutional and Parliamentary Studies, New Delhi, 1971, p. 90]

বেসরকারী জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যা বন্ধ করার জন্য ১৯৪৯ সালে জেনেভা সম্মেলনে চারটি নীতি গৃহীত হয়:
The four conventions of 1949 relate to;
(a) The wounded and sick in the armed forces in the field.
(b) Wounded, sick and ship-wrecked members of the armed forces at sea,
(c) The treatment of prisoners of war, and
(d) The protection of civilian persons.
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৫]

১৯৪৮ সালে গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশনে গৃহীত নীতিমালা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৫৬–০ ভোটে গৃহীত হয়। পাকিস্তান এই কনভেনশনের পক্ষে ভোটদান করে। ১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনে যে চারটি চুক্তি গৃহীত হয়, পাকিস্তান ছিল তাতে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের অন্যতম। এমনকি ১৯৫১ সালে উক্ত কনভেনশনের চুক্তিপত্রে পাকিস্তান সাক্ষরও দান করেছিল। চুক্তি-পত্রাবলীতে চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর প্রতি নিম্নলিখিত বাধ্যবাধকতা অর্পণ করা হয়ঃ
The conventions impose a number of obligations upon a contracting party not only in respect of its own civilian population in a situation of armed conflict, but also with regard to the members of organized resistance movements, belonging to a party to the conflict and operating in or outside their own territory.
[ সুব্রত রায় চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৬]
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২৪

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালে সংঘটিত নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ভিয়েতনামের মাইলাইয়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং পাকিস্তানে বাঙালী নিধনযজ্ঞ মানব ইতিহাসের সব চাইতে জঘন্য ও বর্বরোচিত ঘটনাসমূহের অন্যতম।
বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই তিনটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত আইন ভঙ্গ ক’রে। হিটলার বিশ্বব্যাপী জার্মান জাতির আধিপত্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য জার্মানীর ভেতরে ও বাইরে ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করেছিল; জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামের মুক্তিকামী নরনারীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল; আর পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সুপরিকল্পিতভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে নির্মমভাবে একটি দাস জাতিতে পরিণত করবার জন্য হত্যালীলা চালিয়েছিল।

মানব ইতিহাসে বাংলাদেশে গণহত্যার স্থান
‘মাস্টার প্ল্যান’ অনুযায়ী টিক্কা-ইয়াহিয়ার নির্দেশে আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত দস্যু পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে অতর্কিতে নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর তখন থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশে বাঙালী নিধনযজ্ঞ। গণহত্যা বা জেনেসাইড-এর যে কোন সংজ্ঞানুসারে পাক-বাহিনীর এই হত্যালীলাকে জেনোসাইড বলা চলে। মধ্যযুগের বিশ্বত্রাস ফ্যাসিস্ট চেঙ্গিস পশ্চিম-এশিয়া ও ইউরোপের ছ’ থেকে সাত লাখ লোক হত্যা করেছিল। এ্যাটিলা দি হুন ইতালী, ফ্রান্স ও পীরেনীজের জনপদগুলো নরকঙ্কালের স্তুপে পরিণত করেছিল। বাগদাদ নগরবাসীর রক্তে তাইগ্রীস নদীকে লাল ক’রে দিয়েছিল হালাকু খান। নরপশু হালাকুর হাতে প্রাণ হারিয়েছিল তিন লাখ লোক। মাতাল নীরো সমগ্ৰ রোম নগরী পুড়িয়ে দিয়েছিল। বিশ থেকে পঁচিশ হাজার নরনারীকে হত্যা ক’রে জাম্বেসী নদীতীরস্থ বান্টু জনপদকে নিশ্চিহ্ন ক’রে দিয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চক্রের দখলদার সৈন্যরা। ঘাতক হিটলারের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল আট লক্ষ ইহুদী। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বর্বর সৈন্যরা মাইলাই গ্রামে একশত চারজন নিরপরাধ ভিয়েতনামীকে হত্যা করেছিল। বাষট্টি জন অশ্বেতাঙ্গ নরনারী হয়েছিল শার্পভিলের নরঘাতকদের নৃশংসতার শিকার।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২৫

বিশ শতকে হিটলারের ইহুদী-নিধন-যজ্ঞের পরই সবচাইতে ব্যাপক ভাবে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সুদীর্ঘ ন’ মাসব্যাপী নির্বিচার ও নিয়ন্ত্রিত অভিযানের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ বাঙালী নরনারী ও শিশুকে হত্যা করেছে, শত শত জনপদকে নিশ্চিহ্ন ক’রে দিয়েছে। মুক্তিকামী একটি জাতিকে নির্মূল করার জন্য তারা মানব ইতিহাসের সবচাইতে ভয়াবহ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছিল—গণহত্যার নজিরহীন পদ্ধতি অবলম্বন ক’রে বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানব সভ্যতার ইতিহাসে কালো অধ্যায় রচনা করেছিল।
“পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পরিকল্পিত গণহত্যার লক্ষ্য ছিল নিম্নরূপঃ
১। ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী সৈনিক, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর লোক, পুলিশ এবং অধা-সামরিক আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর লোক।
২। হিন্দু সম্প্রদায়।
৩। আওয়ামী লীগের লোক—নিম্নতম পদ থেকে নেতৃস্থানীয় পদ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের লোক, বিশেষ ক’রে এই দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকগণ।
৪। ছাত্র—কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তরুণের দল ও কিছু সংখ্যক ছাত্রী, যারা ছিলেন অধিকতর সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন।
৫। অধ্যাপক ও শিক্ষকদের মত বাঙালী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, যাঁরা সংগ্রামী বলে সেনাবাহিনী কর্তৃক যে কোন সময় নিন্দিত হতেন।
[ বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, পৃঃ ১৩৬]

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত্রি থেকে সুদীর্ঘ ন’ মাসব্যাপী বাংলাদেশে পরিকল্পিত গণহত্যার তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়ঃ
প্রথম পর্যায়ঃ প্রাথমিক সামরিক অভিযানে বেপরোয়া গোলাবর্ষণ ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ নিয়ন্ত্রিত অভিযানের মাধ্যমে সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ। (এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শহর ও গ্রামে অভিযান) ।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২৬

তৃতীয় পর্যায়ঃ সুপরিকল্পিত উপায়ে তালিকা প্রস্তুতের মাধ্যমে বেছে বেছে হত্যা করা। (বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সমাজসেবী, ডাক্তার ও রাজনৈতিক নেতা ইত্যাদি) ।
প্রথম পর্যায়ে সেনাবাহিনীর অভিযান, বেপরোয়া গুলীবর্ষণ এবং নির্বিচার গণহত্যার প্রধান ক্ষেত্র ছিল ঢাকা নগরী। সেনাবাহিনীর যুগপৎ হামলার পরিকল্পিত লক্ষণগুলো ছিলঃ
(ক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
(খ) রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার,
(গ) পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্ বাহিনীর পিলখানাস্থ সদর দফতর,
(ঘ) পুরাতন ঢাকার বিভিন্ন এলাকা,
(ঙ) আওয়ামী লীগ-প্রধান শেখ মুজিবরের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন,
(চ) পূর্ব বাংলার নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী সমাজ।
প্রথমে ঢাকার কথাই ধরা যাক। ২৫শে মার্চ রাত দশটার কিছু পূর্বে সাঁজোয়া, গোলন্দাজ এবং পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে তিন ব্যাটেলিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অতর্কিতে হামলা চালানোর জন্য সেনানিবাস থেকে ঢাকা নগরীর অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে শুরু করে। রাত্রি বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে গোলাগুলী বর্ষণ শুরু হয়। সৈন্যদের গতিরোধ করার জন্য সে রাতে তাড়াহুড়ো ক’রে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড নির্মাণ করতে যারাই এসেছিলেন, তাঁরাই নির্বিচারে গণহত্যার প্রথম শিকার হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এম-২৪ ট্যাঙ্ক নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি দল মধ্যরাতের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল এবং কোয়ার্টারগুলোতে অতর্কিতে হামলা শুরু করে। সৈন্যরা বিট্রিশ কাউন্সিল ভবন দখল ক’রে নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য এটিকে ফায়ারবেজ হিসেবে ব্যবহার করে। ইকবাল হলের (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ওপর সেনাবাহিনীর ক্রোধ ছিল সবচাইতে বেশী। কারণ, সরকার-বিরোধী ছাত্রদের প্রধান কেন্দ্র ছিল এই ছাত্রাবাসটি। বর্বর সৈন্যরা এই ছাত্রাবাসটির ওপর ভারী মর্টার নিক্ষেপ করে, মেশিনগানের গুলীতে ছাত্রদের কামরাগুলো ঝাঁঝরা ক’রে দেয় এবং ঘরে ঘরে ঢুকে ছাত্রদের নৃশংসভাবে হত্যা করে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২৭

সৈন্যরা অনেক লাশ সরিয়ে ফেলে, কিন্তু ইকবাল হলের বারান্দাগুলোতে যত রক্ত ছড়িয়ে ছিল, তা’ নিশ্চয়ই ৩০ জনের বেশী হবে।
[ সাইমন ড্রিং, ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’, ৩০শে মার্চ, ১৯৭১]

নীলক্ষেত রেল লাইনের দু’ধারের বস্তীগুলোতে সৈন্যরা আগুন ধরিয়ে দেয়। বই নরনারী এবং শিশু অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় এবং অসংখ্য ব্যক্তি মেশিনগানের গুলীতে হতাহত হয়।

জগন্নাথ হল
জগন্নাথ ছাত্রাবাসের হিন্দু ছাত্রদের ঘরে ঘরে তারা ঢুকে পড়ে। ছাত্র ও কর্মচারীদেরকে ধরে মাঠে টেনে নিয়ে এসে লাইন ক’রে দাঁড় করিয়ে
মেশিনগানের গুলী চালিয়ে হত্যা করে। সৈন্যরা মৃতদেহগুলো তাড়াতাড়ি গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর দিয়ে ট্যাঙ্ক চালিয়ে মাটি সমান ক’রে দেয়।
[ সাইমন ড্রিং, ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’, ৩০শে মার্চ, ১৯৭১]

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যাযজ্ঞ
এই অতর্কিত আক্রমণ এবং নির্বিচার হত্যা শুধুমাত্র ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষকও পাকিস্তানী নরপশুদের হাত থেকে রেহাই পান নি। এই নরঘাতকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের ঘরে ঘরে ঢুকে তাঁদেরকে নিষ্ঠুরভাবে গুলী করে এবং বেয়নেটবিদ্ধ ক’রে হত্যা করে। ২৫শে ও ২৬শে মার্চে যারা এই নির্বিচার হত্যার শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা হলেনঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর ফজলুর রহমান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ এ. এন. এম. মুনিরুজ্জামান, ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল মুকতাদির, অঙ্ক বিভাগের অধ্যাপক জনাব শরাফত আলী, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এ. আর. খান খাদিম, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিউটের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেক ও ডক্টর মুহম্মদ সাদত আলী এবং ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। ডক্টর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে নরপশুরা গুলীবিদ্ধ ক’রে রেখে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। সেনাবাহিনীর একটি দল রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টারে
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২৮

ঘুমন্ত পুলিশদের অতর্কিত আক্রমণ করে। ট্যাঙ্ক থেকে গোলা বর্ষণ, মর্টার নিক্ষেপ এবং মেশিনগানের গুলীতে বহু পুলিশ হতাহত হয়। রাজারবাগ হেড কোয়াটারে এগার শ’ পুলিশ ছিল। তাদের মধ্যে সামান্য সংখ্যক পুলিশ পালাতে সক্ষম হয়েছিল।
[ ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’, ৩০শে মার্চ ১৯৭১]

ট্যাঙ্ক, বাজুকা এবং স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা পিলখানাস্থ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনীর সদর দফতর আক্রমণ করেছিল। সৈন্যরা চারদিক থেকে রাইফেলস বাহিনীর সদর দফতরটি ঘিরে আক্রমণ চালিয়েছিল। রাইফেলস বাহিনীর অধিকাংশ বাঙালী পালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। ২৬শে মার্চ ভোরবেলা সেনাবাহিনীর লোকেরা রাইফেলস বাহিনীর একদল লোককে ট্রাকে ক’রে নিয়ে যায়। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল, তা’ বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের অবরুদ্ধ ক’রে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন ঢাকা নগরীর বুকে নির্বিচারে গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছিল, তখন ঈস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা শেখের সমর্থনে কেন্দ্র থেকে দশ মাইল দূরে শিল্প এলাকার দিকে চলে যাচ্ছিল।
সব চাইতে ভয়াবহ ধ্বংস-যজ্ঞ এবং বীভৎস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল পুরানো ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ওপর। এই এলাকা গুলোর মধ্যে ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নয়াবাজার, নাজিরা বাজার প্রভৃতি প্রধান। পুরনো শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোর অধিকাংশ অধিবাসী ছিল শেখ মুজিবের সমর্থক। সৈন্যরা এই এলাকার ঘরবাড়িগুলো পুড়িয়ে ছাই ক’রে দেয়। পুরনো শহরের বিভিন্ন এলাকার আঁকাবাঁকা অসংখ্য গলিতে প্রায় দশ লাখ লোকের বাস। ২৬শে মার্চ দুপুরবেলা সান্ধ্য আইন বিরতির সময় সৈন্যরা এই ঘনবসতিপূর্ণ গলিগুলোতে ঢুকে পড়ে। চারদিক থেকে তারা বাড়িগুলো ঘিরে ফেলে, আগুন ধরিয়ে দেয় এবং সাথে সাথে শুরু করে অবিরাম গুলীবর্ষণ।
সৈন্যরা অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। ওদের সাথে থাকতো গ্যাসোলিন ও পেট্রোলের টিন। বাড়িগুলোতে তারা পেট্রোল ছড়িয়ে দিতো, তারপর ছুঁড়ে দিতো ফ্লেম থ্রোয়ার। দাউ দাউ ক’রে আগুন জ্বলে উঠতো। যারা আগুনের ব্যুহভেদ ক’রে বেরিয়ে আসতো, মেশিনগানের
পৃষ্ঠা নং ~ ৯২৯

গুলীতে তারা লুটিয়ে পড়তো। যারা অসহায়ভাবে দাপাদাপি করতো, তারা জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যেত।
[ ‘টাইম’, ২রা মে, ১৯৭১]

ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ধ্বংস-যজ্ঞে এবং হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত সৈন্যরা ছিল বেপরোয়া। তারা লোকজনকে তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে এবং সোজাসুজি গুলী ক’রে তাদের হত্যা করে। অতঃপর তারা গোলাবর্ষণ ক’রে এলাকাটি ভূমিসাৎ ক’রে দেয়।
[ ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’, প্রাগুক্ত]

ঢাকা নগরীর কেন্দ্রস্থলে রমনা রেসকোর্স ময়দানে অবস্থিত কালীবাড়ি নামে হিন্দুদের প্রাচীন ক্ষুদ্র মন্দিরটি ২৮শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী নরপশুদের কবলিত হয়। তারা মন্দিরটি জ্বালিয়ে দেয়। মেশিনগানের গুলীতে সেখানকার হিন্দুদের হত্যা ক’রে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। শাঁখারী পট্টির অবস্থাও একই রূপ হয়েছিল।
এই নির্বিচার গণহত্যার শিকার শুধু বাঙালী হিন্দুরাই হন নি, ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান বাঙালী মুসলমানগণও পাকিস্তানী নরঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পান নি। শুক্রবারের নামাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন মুসল্লি নামাজ আদায় করা সান্ধ্য আইন মানার চেয়ে ফরজ মনে করেছিলেন। মসজিদে ঢুকেই তিনি সেনাবাহিনীর গুলীতে নিহত হন।
[ ‘টাইম’, ৩রা মে, ১৯৭১]

‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার পাকিস্তান প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, পুরনো ঢাকার কয়েকটি এলাকা নিশ্চিহ্ন ক’রে দে’য়ার সময় যে শত শত মুসলমানকে পাকড়াও করা হয়েছিল, তাদেরও কোন চিহ্ন পরে মেলে নি। সৈন্যরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে গোলাগুলী বর্ষণ করে এবং এতে একটি মসজিদ দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নয়াবাজার, রায়ের বাজার এবং বিভিন্ন বস্তীতে সৈন্যরা সান্ধ্য-আইন চলাকালে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে চারদিক থেকে ঘিরে অতর্কিতে আক্রমণ করে। অগ্নিসংযোগ ক’রে বস্তীগুলো ধ্বংস করে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিগণ বলেন যে, মহাখালী হাসপাতালের নিকটবর্তী বস্তীসমূহে ২১শে মার্চ ভোরবেলা সৈন্যরা আগুন লাগিয়ে দেয় এবং পলায়নপর বস্তীবাসীদেরকে ককুরের মত গুলী করে হত্যা করে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩০

২রা এপ্রিল ৪০ জন সৈন্যের একটি দল বিদেশীদের আবাসিক এলাকা গুলশান সংলগ্ন বাড্ডা নামে একটি ক্ষুদ্র থাম আক্রমণ করে। গ্রামের ছয় শত লোককে সৈন্যরা রাইফেলের নলের মুখে তাড়া করে। এদের মধ্যে ছিল ছাত্র, রাজনীতিবিদ এবং কর্মস্থল ত্যাগকারী বিভিন্ন লোক। সৈন্যরা পুরো একদিন রৌদ্রের মধ্যে তাদের ওপর নৃশংসতা চালায়। পরে তাদের পছন্দমত দশজনকে তারা ট্রাকে ক’রে অন্যত্র নিয়ে যায়।
২৫শে মার্চের রাতে সেনাবাহিনীর একটি দল নিউমার্কেটের নিকটবর্তী লেফটেন্যান্ট কম্যাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ীতে হানা দেয়। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নৌবাহিনীর প্রাক্তন অফিসার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী। এই হতভাগ্য কম্যাণ্ডারকে ঘর থেকে টেনে বের করা হয় এবং তাঁর ভীতসন্ত্রস্তা স্ত্রীর সম্মুখে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
[ ‘বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা’, পৃঃ ১৩৪]

২৫শে মার্চ রাত দেড়টায় সেনাবাহিনীর দু’টি জীপ ও কয়েকটি ট্রাক ৩২নং সড়কের বহির্ভাগে এসে থামলো। কয়েক মুহূর্ত পর পাক-সেনারা পঙ্গপালের মত বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর বাগানে সমবেত হ’ল। বাড়ীর ছাদ ও ওপরতলার জানালা লক্ষ্য ক’রে কয়েক রাউণ্ড গুলী ছোঁড়া হ’ল। সেনাবাহিনীর লোকেরা আক্রমণ করেনি, ভয় দেখাচ্ছিল মাত্র। তখন এই গোলমালের মধ্যে শেখ মুজিবকে তাঁর ওপর তলার শয়ন কক্ষ থেকে বলতে শোনা গেল, তোমরা অমন বর্বরের মত আচরণ করছ কেন? আমাকে তোমরা ডাকলেইতো তোমাদের কাছে নেমে আসতাম। পাজামার ওপর তামাটে লাল রঙের গাউন পরিহিত শেখ মুজিব সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন; সেখানে একজন তরুণ ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়েছিল। অফিসারটি ছিল বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের। সে দৃঢ় ও নীরস কণ্ঠে বললো, আসুন স্যার। তারপর সবাই গাড়ীতে উঠে চলে গেল।
[ ‘বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা’, পৃঃ ১৩৯]

প্রথম পর্যায়ে সেনাবাহিনীর বেপরোয়া গোলাবর্ষণ এবং ধ্বংস-যজ্ঞের লক্ষ্যস্থল হয়েছিল আওয়ামী লীগপন্থী ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘দি পিপল’ এবং আওয়ামী লীগ দলের মুখপত্র ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার অফিস দু’টো। সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হবার পর চার শ’ লোক ইত্তেফাক
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩১

পত্রিকার অফিসে আশ্রয় নিয়েছিল। ২৬শে মার্চ শুক্রবার বিকাল চারটায় চারটি ট্যাঙ্ক রাস্তায় দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাড়ে চারটার দিকে অফিসটি নরককুণ্ডে পরিণত হয়। পরদিন শনিবার ভোরবেলা অফিসের পেছনের কামরাগুলোতে কতকগুলো ভস্মীভূত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
[ ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’, ৩০শে মার্চ, ১৯৭১]

ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেলে সজ্জিত সেনাবাহিনীর একটি দল আওয়ামী লীগ পত্রিকা ‘দি পিপল’-এর অফিসে যায়। অফিসটি ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে অবস্থানরত দলবদ্ধ ভীত বিদেশী সাংবাদিকদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে অবস্থিত। সেনাবাহিনীর লোকেরা সঙ্কীর্ণ গলিতে গুলী ছোঁড়ে। পত্রিকা অফিসের কর্মচারিগণ পালাতে চেষ্টা করলে তাদেরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। দালানে যা অবশিষ্ট ছিল তাতে গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এভাবেই সেনাবাহিনী একটি ‘শত্রু’ নিধনযজ্ঞ সমাপ্তি করে।
[ বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা, পৃঃ ১৩৩]

সুপরিকল্পিত গণহত্যার দ্বিতীয় পর্যায়
১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরিকল্পিত গণহত্যার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্বিচারে গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারা সেনাবাহিনী লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয় নি। সামরিক জান্তার নিকট আত্মসমর্পণের পরিবর্তে পূর্ব বাংলার সর্বত্র বাঙালীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ফলে সেনাবাহিনী আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহর, বন্দর এবং অসংখ্য গ্রামের ওপর নিয়ন্ত্রিত অভিযান চালাতে শুরু করে। এই পর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা বিশ্ববাসীকে হতবাক ক’রে দেয়। মানব ইতিহাসের সকল কালের বর্বরতার নানা পদ্ধতি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার কাছে ম্লান হয়ে যায়।

হত্যার বিচিত্র পদ্ধতি
পাকিস্তানী জেনোসাইড বা গণহত্যা বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাসে একটি দিক থেকে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। হত্যার বিচিত্র পদ্ধতি বা Methods of killing উদ্ভাবনে তাদের বাহাদুরি স্বীকার করতে হয়। এমন বিচিত্র পদ্ধতিতে মানুষকে হত্যা করা, নির্যাতন করা বা ত্রাসের সৃষ্টি করা বোধ করি বিশ্বের কোন গণহত্যায় দেখা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩২

যায় না। প্রত্যেক সময়ে এই বর্বর নরপশুগণ নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, আর সেই পদ্ধতির নৃশংস প্রয়োগ করেছে। তারই কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবার লিপিবদ্ধ করা যাক।
দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রাথমিক স্তরে বাঙালীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম পর্যুদস্ত ক’রে দেবার জন্য সেনাবাহিনী বোমারু বিমান, নৌযুদ্ধ-জাহাজ, গানবোট এবং স্বয়ংক্রিয় সমরাস্ত্র ব্যবহার ক’রে এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্যাবর ও জেট জঙ্গী বিমানগুলো রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোহর, খুলনা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় বেপরোয়া বোমাবর্ষণ করে। চারটি স্যাবর জেট বিমান থেকে চুয়াডাঙ্গায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ১৪ই এপ্রিল, ১৯৭১]

৬ই এপ্রিল কুমিল্লা জেলার লাকসাম-এর নিকটবর্তী জনাকীর্ণ ‘নয়াবতী’ বাজারটির ওপর পাকিস্তানী বিমানের হামলায় দুই শত বেসামরিক ব্যক্তি নিহত এবং বহুসংখ্যক আহত হয়। ভারতে আশ্রিত শরণার্থীরা জানায়, শহর-বন্দরে এবং গ্রামের জনবসতিপূর্ণ স্থানগুলোতে পাকিস্তানী বিমানগুলো নিরাপরাধ জনগণের ওপর অবিরাম বোমাবর্ষণ করে। আশ্রয়স্থল ছেড়ে পলায়নপর বাঙালীদের খোঁজে বিমানগুলো উড়ে আসে এবং তাদের দেখা মাত্রই নীচে নেমে এসে বৃষ্টিধারার ন্যায় মেশিনগানের গুলীবর্ষণ করে।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ৭ই এপ্রিল, ১৯৭১]

কুমিল্লা, চট্টগ্রাম রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া এবং ছোট ছোট বিভিন্ন শহরের ওপর নির্মমভাবে অবিরাম বোমাবর্ষণ করা হয়। ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমা শহরের চারদিকে বোমারু বিমানগুলো বোমাবর্ষণ ক’রে সাত শত গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ২১শে এপ্রিল, ১৯৭১]

এপ্রিল মাসে শহর, বন্দর এবং গ্রামগুলোর ওপর বেপরোয়া বোমাবর্ষণের সময় ব্যাপক হত্যা এবং ধংস-যজ্ঞের জন্য বিমান বাহিনী নাপাম বোমা ব্যবহার করে। কুষ্টিয়া জেলার নূরনগর গ্রামের অধিবাসীদের ওপর নাপাম বোমা নিক্ষেপ করা হয়। সিলেট জেলার বেসামরিক লক্ষ্য-
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩৩

স্থলগুলোর ওপর নাপাম বোমাবর্ষণ ক’রে বহু জীবন এবং বিপুল সম্পত্তি ধ্বংস ক’রে দে’য়া হয়।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ৪ঠা এবং ১২ এপ্রিল, ১৯৭১]

সামরিক জান্তা বিমান বাহিনীকে শুধু জীবন ও সম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বাঙালীদের তীব্র খাদ্য সঙ্কটের সম্মুখীন করবার জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত-খামারে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক বোমাবর্ষণের নির্দেশও দিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ই এপ্রিলে প্রকাশিত পি. টি. আই-এর এক রিপোর্টে বলা হয় যে, আগামী মৌসুমের খাদ্য উৎপাদন ধ্বংস ক’রে দে’য়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গী বিমানগুলো পূর্ব বাংলার ধান ও পাট ক্ষেতসমূহে রাসায়নিক বোমাবর্ষণ করছে। ব্যাপকভাবে রাসায়নিক বোমাবর্ষণের ফলে বহু এলাকায় ধান ক্ষেতগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ৫ই মে আমেরিকার স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে স্বীকার করা হয় যে, চীনের আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রদত্ত আমেরিকার ট্যাঙ্ক ও জেট জঙ্গী বোমারু বিমানগুলো পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নির্মূল ক’রে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
[ এ. পি. রিপোর্ট, স্টেটসম্যান, ৬ই মে, ১৯৭১]

দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে গণহত্যার শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নৌযুদ্ধ-জাহাজ থেকে ভারী গোলাবর্ষণ করা হয়েছিল। গানবোটগুলো থেকে মংলা ও চালনার খালসমূহ এবং বরিশালের মধুমতী নদীর উভয় তীরস্থ গ্রামগুলোর উপর গোলাবর্ষণ ক’রে ভস্মীভূত ক’রে দেয়া হয়েছিল।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, ৮ই, ১৪ই, এবং ২৭শে এপ্রিল, ১৯৭১]

১৯৭১ সালের ৩রা ও ৪ঠা এপ্রিল খুলনার নিকটবর্তী এলাকাসমূহ এবং চালনা বন্দরের উপর গানবোট থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণের দৃশ্য জনৈক বিদেশী জাহাজের নাবিক প্রত্যক্ষ করেন।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, কলিকাতা, ৯ই এপ্রিল, ১৯৭১]

স্থলপথে নিয়ন্ত্রিত অভিযানগুলোতে পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা ছিল আরও ব্যাপক এবং ভয়াবহ। ইয়াহিয়ার নরঘাতক সৈন্যরা গণহত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষেত্রে যে নজীর স্থাপন করছে, কোন সভ্য দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষে তা’ সম্ভব হয়নি, এমনকি মানব ইতিহাসেও এরূপ নির্মম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার নজীর নেই। পাক-সৈন্যরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩৪

নর-নারী ও শিশুকে নির্বিচারে বুলেট ও বেয়নেট বিদ্ধ করেছে এবং জলন্ত আগুনে নিক্ষেপ ক’রে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। তারা নিয়ন্ত্রিত অভিযান চালিয়ে গ্রামগুলো ঘিরে ফেলতো, লোকদের তাড়িয়ে নিয়ে ধরতো এবং মেশিনগান এবং বেয়নেট বিদ্ধ ক’রে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করতো।
শহরের বিভিন্ন এলাকা এবং গ্রামগুলোর চারিদিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে সৈন্যরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, রাইফেলস্, পুলিশ বাহিনীর লোক, আওয়ামী লীগ কর্মী, সমর্থক এবং হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে বের ক’রে নৃশংসভাবে হত্যা করতো। বহু বিচিত্র পদ্ধতির মাধ্যমে বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের নিষ্ঠুরতা বিদেশীরা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং বহু বিদেশী পত্রিকায় এই লোমহর্ষক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১ সংখ্যায় উক্ত পত্রিকার প্রতিনিধি মার্টিন উলাকটের লিখিত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। উক্ত রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেছেন, ১১৯ জন বিদেশীকে নিয়ে ৫ই এপ্রিল ‘ক্ল্যান ম্যাকনেয়ার’ নামে একটি বিদেশী জাহাজ চট্টগ্রাম থেকে কোলকাতায় আসে। কোলকাতায় পৌঁছে জনৈক ইঞ্জিনীয়ার জানান যে, পাকিস্তানী সৈন্যদের দু’জন বাঙালীকে ধরে ট্রাকের পিছনে টেলবোর্ডে তাদের পা দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যেতে তিনি দেখেছেন। তিনি জানান, কয়েকজন বাঙালীর দ্বারা পাক-সৈন্যদের স্তূপকরে রাখা পাঁচটা মৃতদেহের জন্য তারা কবর খুড়িয়ে নিচ্ছিল। তারা নিজেদের কবর খুড়ছিল বলেও তাঁর মনে হয়েছিল। অপর একজন বিদেশী শরণার্থী জানান যে, সৈন্যদের ট্রাকগুলো এসে বাঙালীদের সামনে থেমে পড়ে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ ক’রে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলীবর্ষণ করে এবং সাথে সাথে এই হতভাগ্য মানুষগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বহু লোককে লোহার হেলমেট দিয়ে আঘাত ক’রে ট্রাকে তুলে নেয়া হয়। অপর একজন বিদেশী শরণার্থী জানান যে, জাহাজে ওঠার সময় তিনি আগুনে ভস্মীভূত শত শত ঘরবাড়ি দেখেছেন।

জীবন্ত কবর
জীবন্ত মানুষকে মাটি চাপা দিয়ে হত্যার দৃষ্টান্ত প্রাচীন ও মধ্যযুগেও ছিল। বিশ শতকে বাংলাদেশে এই ধরনের বর্বরতা ছিল আরো ভয়াবহ। শহর এবং গ্রাম থেকে তাড়িয়ে ধরা কিংবা নির্বিচারে বুলেট ও বেয়নেট-বিদ্ধ ক’রে নিহত বাঙালীদেরকে সৈন্যর একই গর্তে মাটি চাপা দিত। জীবন্ত বাঙালীদের মাটি চাপা দিয়ে হত্যার
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩৫

সময় তাদের চীৎকার, কান্না, মিনতি দেখে তারা আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করতো। সৌভাগ্যক্রমে জীবন্ত কবরস্থ হবার পর প্রাণ নিয়ে উঠে আসতে যারা সক্ষম হয়েছেন, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার উত্তর গোপালখাট্টা গ্রামের অধিবাসী মোহাম্মদ ছয়ফুল হক ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
[ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ফজলুর রহমান, মুক্তধারা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ ২৯]

আতুড় ঘরে সন্তানের মুখে লবণ দিয়ে মেরে ফেলার জনশ্রুতি আমরা শুনে থাকি। কিন্তু বর্বর সৈন্যরা বলিষ্ঠ যুবকদের ধরে এনে শুধু লবণ খাইয়ে হত্যার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
[ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ফজলুর রহমান, মুক্তধারা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ ২৮]

বাঘের খাঁচায় বাঙালী
সিংহের খাঁচায় মানুষ পুরে, ষাঁড়ে-মানুষে এবং পুকুরের জলে কুমীরের সাথে মানুষের লড়াই বাধিয়ে দিয়ে মধ্যযুগের সামন্ত ভূস্বামীরা আনন্দ উপভোগ করতো। বিংশ শতাব্দীতেও এই বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র সিরাজদ্দৌলা ও ঠাকুরগাঁ মহকুমার বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী শফিকুল আলম চৌধুরী। বর্বর সৈন্যরা তাঁদেরকে ঠাকুরগাঁতে দু’টি বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু বাঘ দু’টো তাঁদেরকে হত্যা না ক’রে কেবল আঁচড়ে কামড়ে দেয়। কারণ বাঘ দু’টোর মানুষ খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গিয়েছিল।
[ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ফজলুর রহমান, মুক্তধারা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ ২৮]

এমনকি বাংলার শকুনগুলো বেশী খাওয়ায় উড়তে না পেরে নদীগুলোর তীরে তীরে ভয়াবহ তৃপ্তিতে বসে আছে। মার্চ মাস থেকে পাঁচ লক্ষেরও বেশী নিহত বাঙালীকে তারা খাদ্য হিসেবে পেয়েছে।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, ১৩ই মে, ১৯৭১]

শরীর থেকে রক্ত শোষণ ক’রে হত্যা
এদিকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে বর্বর সৈন্যরা প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০০ বাঙালী যুবককে সেনানিবাসে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের দেহ থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বার ক’রে বেয়নেট বিদ্ধ ক’রে হত্যা করতো এবং বুড়ীগঙ্গা নদীতে মৃতদেহগুলো ভাসিয়ে দিতো। কখনো পিছনে হাত-পা বাঁধা যুবকদের মৃতদেহগুলো বুড়ীগঙ্গায় ভেসে যেতে দেখা গেছে। ঢাকায় অবস্থানরত কূটনৈতিক মহলের অনেকেই এই মর্মান্তিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩৬

করেছেন। বাঙালীদের দেহ থেকে রক্ত বার ক’রে নেবার পদ্ধতি বাংলাদেশের সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে বর্বর সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা যতই বাড়ছিল, সেনাবাহিনী ততই নিষ্ঠুরতম পদ্ধতিতে রক্তশোষণ তৎপরতা চালিয়েছিল।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, ১২ই জুন, ১৯৭১]

মৃত ও জীবিতদের জড়ো ক’রে পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে হত্যা
অন্য একটি বিবরণে প্রকাশ, নরঘাতক সৈন্যরা প্রায় দু’ হাজার পুরুষকে তাদের স্ত্রী-পুত্রদের কাছ থেকে ধরে নিয়ে আসে। তাদের উপর। মেশিনগানের গুলীবৃষ্টির ফলে ৮০০ লোক মারা যায়। যারা বেঁচে যায় তারা মৃতের ভান ক’রে পড়ে ছিল এবং ভেবেছিল যে, সৈন্যরা তাদের ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু সেনাবাহিনী বাচ্চাদের খেলাঘরের মত মৃত ও জীবিত সবাইকে একত্র ক’রে তাদের উপর পেট্রোল ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে তখন সন্ধ্যা হওয়ায় কিছু লোক জ্বলন্ত শরীর নিয়েই জঙ্গলে দৌড়ে পালায়।
[ ‘দি আইরিশ টাইমস’, ৭ই জুন, ১৯৭১]

শরীর থেকে চামড়া তুলে এবং পুড়িয়ে হত্যা
সুনিয়ন্ত্রিত অভিযানের মাধ্যমে ধৃত ছাত্রদের ওপর সৈন্যরা অমানুষিক নির্যাতন চালাতো এবং হত্যা করতো। বগুড়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফারুকের সারা শরীরে গরম লোহার সিক লাগিয়ে চামড়া উঠিয়ে নে’য়া হয়, ফলে তাঁর শরীরে দগদগে ঘা হয়, চামড়া পচে গিয়ে পোকা ধরে; সমস্ত শরীর বিকট দুর্গন্ধে ভরে যায়। ফারুক সম্পূর্ণ পাগল হয়ে যায়। এই অবস্থায় সৈন্যরা একদিন তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যায়। তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।
[ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ফজলুর রহমান, মুক্তধারা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ ৪৩]

শ্বাসনালী কেটে হত্যা
হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হবার পর ঢাকা নগরীতে যতগুলো বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল তন্মধ্যে অবাঙালী অধ্যুষিত মীরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকার বধ্যভূমি ছিল সব চাইতে বৃহৎ বধ্যভূমি। পশ্চিম পাকিস্তানী নরপশুদের সহায়ক বিহারী, রাজাকার, আল-বদর বাহিনী এবং জামাতে ইসলামীর কুখ্যাত লোকেরা এই বধ্যভূমিতে বাঙালী নিধনযজ্ঞে
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩৭

প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। বাঙালী যুবকদের তারা ধরে নিয়ে যেত এবং উক্ত বধ্যভূমিতে জড়ো ক’রে অর্ধেক গলা কেটে ছেড়ে দিত। শ্বাসনালী কাটা যুবকরা রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করতো ও চৈতন্য হারিয়ে ঢলে পড়তো। তাদের গলা থেকে ঘরঘর শব্দ হ’ত। নরপশুরা তখন পৈশাচিক উল্লাসে ও হাসিতে ফেটে পড়তো।
[ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ফজলুর রহমান, মুক্তধারা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ২, ২৭, ২৮]

বাংলাদেশের সর্বত্র এই নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কোন কোন স্থানে একদল ধৃত বাঙালীকে অপর আরেক দল বাঙালীর সামনে বড় বড় ছুরি দিয়ে জবাই করা হ’ত। এই নির্মম প্রক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষকারী কিছুসংখ্যক ধৃত বাঙালীকে ছেড়ে দে’য়া হ’ত। ফলে সৈন্যদের এই নৃশংসতার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তো এবং সেনাবাহিনীর নামে সর্বত্র আতঙ্কের সৃষ্টি হ’ত। এটি ছিল পাষণ্ডদের একটি নিষ্ঠুর পদ্ধতি, যার মাধ্যমে তারা জানিয়ে দিত যে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিংবা পাকিস্তান-বিরোধী কাজ করলে সেই সব ব্যক্তির এই হ’ল প্রাপ্য শাস্তি।

বাঙালী মুক্তি-পাগল সৈন্যদের ওপর নির্যাতন
বর্বর পাক-সেনারা দীর্ঘ ন’ মাসব্যাপী বহু বাঙালী সৈনিকের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা সেনাবাহিনীর হাতে আটক ছিলেন তাঁদের কাছ থেকে ভয়াবহ নির্যাতনের বিবরণ জানা যায়। বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জি. এইচ. মীর্জাকে সামরিক জান্তার দল ১০ই মে (১৯৭১) গ্রেফতার করে। সৈন্যরা তাঁর ইউনিফরম কেড়ে নেয়। বৈদ্যুতিক চাবুক দিয়ে প্রহার করে, হান্টার, ক্রিকেট স্ট্যাম্প, লোহার রড, মোটা দড়ি ও ধারালো ছুরি সামনে এনে এগুলো তারই জন্য আনা হয়েছে বলে জানায়। তিনি যা করেছেন, দেখেছেন, শুনেছেন, ভেবেছেন, এবং সহকর্মীদের সম্পর্কে যা জানেন তা’ লিখে দেবার জন্য নির্দেশ দে’য়া হয়। তাঁকে বাধ্য করার জন্য পার্শ্ববর্তী দরজা খুলে জনৈক উলঙ্গ হতভাগ্য বাঙালীকে লোহার রড দিয়ে পেটানো অবস্থায় দেখানো হয়। প্রতিটি আঘাতে লোকটি প্রাণফাটা চীৎকার করছিল। তার মাথা কেটে গিয়েছিল, মুখ দিয়ে ফেনা উঠছিল এবং এক সময় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মীর্জাকে জানানো হয়,
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩৮

তাদের কথা না শুনলে তাঁরও একই পরিণতি ঘটবে। লেঃ মীর্জা দেখতে পান বাঙালী সৈনিকদের তারা মারধোর ছাড়াও বুটের লাথি মারতো, জ্বলন্ত সিগারেট শরীরে চেপে ধরতো, চাবুক মেরে সমস্ত শরীর রক্তাক্ত ক’রে দিত। তিনি দেখতে পান, স্কোয়াড্রন লীডার হাবীবুর রহমানকে সৈন্যরা চোখ বেঁধে হাত পিঠমোড়া ক’রে বসিয়ে রাখতে। সৈন্যদের যারাই সেস্থান দিয়ে যাওয়া-আসা করতো, তারাই জ্বলন্ত সিগারেট তাঁর মাথায় চেপে ধরতো। এভাবে সারাদিন ধরে তারা তাঁকে এ্যাসট্রে হিসেবে ব্যবহার করতো।
ফ্লাইট সার্জেন্ট টি. আহমদ সহ বিমান বাহিনীর আরো ছয়জন অফিসার সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছিলেন। ১৯শে এপ্রিল রাতে উক্ত ছয়জন অফিসারকে সৈন্যরা পাশের কামরায় নিয়ে সমস্ত কাপড় খুলে নিয়ে চোখ বেঁধে হাত পিঠমোড়া ক’রে দাঁড় করিয়ে রাখে। তারপর বেয়নেট বিদ্ধ ক’রে তাঁদের হত্যা করে। আরো ভয়াবহ এবং বীভৎসভাবে বন্দীদের ওপর চলতো নির্মম নির্যাতন। বন্দী সৈন্যদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরম সিক চেপে ধরা হ’ত। মাংস পুড়ে ঝলসে হাড় বেরিয়ে আসতো। ধারালো চাকু দিয়ে মাংস কেটে নিয়ে মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেয়া হত। সাঁড়াশী দিয়ে শরীরের চামড়া ছিঁড়ে ফেলে তারপর পায়ে দড়ি বেঁধে টাঙিয়ে চাবকাতে চাবকাতে রক্তাক্ত ক’রে ফেলা হ’ত সমস্ত শরীর।
হানাদার বাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে যখন মুক্তিযোদ্ধারা ধরা পড়তো, উল্লেখিত পদ্ধতিগুলো ছাড়াও আরো নজীরহীন নিষ্ঠুরতা তাদের উপর বর্বর সৈন্যরা চালিয়ে যেত।

গেস্টাপো পদ্ধতিতে হত্যা
গণহত্যার জন্য হানাদার বাহিনীর আরেকটি পদ্ধতি ছিল গেস্টাপো উপায়ে বাঙালীদের অপহরণ। সন্দেহভাজন বাঙালীদের তারা প্রকাশ্যভাবে গ্রেফতার করতো এবং ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ী ও অস্থায়ী ঘাঁটিগুলোতে নিয়ে
নির্মমভাবে হত্যা করতো। এই পদ্ধতিতে হত্যাকাণ্ডের সহায়ক ছিল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং অবাঙালী (বিহারী) মুসলমানগণ। উল্লেখিত ধর্মান্ধ বিশ্বাসঘাতকরা বাঙালীদের দুষ্কৃতিকারী হিসেবে সনাক্ত ক’রে সেনাবাহিনীর নিকট ধরিয়ে দিত কিংবা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৩৯

নিজেরাই অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালীদেরকে সৈন্যদের ছাউনীতে নিয়ে যেত। গ্রেফতারকৃত বাঙালীরা আর ফিরে আসতো না।

রাজাকার
রাজাকাররা ছিল সামরিক জান্তার সৃষ্ট অশিক্ষিত এবং অমার্জিত লোকদের একটি দল। হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংস-যজ্ঞের ক্ষেত্রে তারা ছিল বর্বর সৈন্যদের সহায়ক বাহিনী। এ ছাড়া অর্থের প্রলোভনে বহু বাঙালী যুবতীকে ধরে ধরে তারা উচ্চপদস্থ অফিসারদের ঘাঁটিতে সরবরাহ করেছে। বহু ঘরবাড়ি থেকে মূল্যবান সামগ্রী তারা লুট করেছে।

আল-বদর ও আল-শামস
ধর্মান্ধ তরুণদের নিয়ে আল-বদর এবং আল-শামস নামে অপর দুটো দলও গঠিত হয়েছিল। এদের অধিকাংশই ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘের বা প্রাক্তন এন. এস. এফ-এর সদস্য। সামরিক জান্তা কর্তৃক তালিকা প্রস্তুতের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আল-বদর নামে ধর্মান্ধ এই তরুণ দলটি সেনাবাহিনীর সহায়তা করে। ঢাকাসহ বাংলাদেশের সর্বত্র অস্ত্র উঁচিয়ে তারা বহু বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে যায়। বহু বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের লাশ পাওয়া গেছে।

লুণ্ঠন ও ধ্বংস-যজ্ঞ
প্রথম পর্যায়ে নির্বিচারে বাঙালী হত্যাই ছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের অন্ধ উন্মাদনা। দ্বিতীয় পর্যায়ের নিয়ন্ত্রিত অভিযানে সৈন্যরা বিশেষ ক’রে বাঙালী হিন্দু নিধন-যজ্ঞে লিপ্ত হয়। প্রতিটি অভিযানে সৈন্যরা হিন্দুদের খুঁজে খুঁজে বের করতো এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতো। অগ্নিসংযোগে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত; মূল্যবান সামগ্রী লুট ক’রে নিয়ে যেত। কখনও কখনও হিন্দুদের সম্পত্তি ও সম্পদ লুট করার জন্য বাঙালী মুসলমানদের প্ররোচিত করতো। হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাসস্থান ও সম্পত্তি অবাঙালী মুসলমান এবং বিশ্বাসঘাতক বাঙালীদের মধ্যে বন্টন ক’রে দেবার জন্য শান্তি কমিটিকে ঢালাও সুযোগ তারা দিয়েছিল।

হিন্দু হত্যা ও বিতাড়নের লক্ষ্য
হিন্দুদেরকে নির্বিচারে হত্যা এবং ভীত-সন্ত্রস্ত ক’রে ভারতে ঠেলে দেবার পেছনে ছিল সামরিক জান্তার পরিকল্পিত রাজনৈতিক চক্রান্ত।
এ চক্রান্তের পেছনে দু’টো উদ্দেশ্য ছিল। (এক) অসংখ্য হিন্দুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা এবং বিপুলসংখ্যক হিন্দুকে ভারতে ঠেলে দিয়ে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হোক, এটা তারা কামনা করেছিল; (দুই) লক্ষ লক্ষ বাঙালী হিন্দু
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪০

ও মুসলমানকে ভারতে ঠেলে দিয়ে ভারতের অর্থনীতি বিপর্যস্ত ক’রে দে’য়া তাদের অপর উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সামরিক জান্তার সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় নি। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালী শরণার্থীকে ভারতীয় জনগণ সাহায্য করেছেন। ভারত সরকার শরণার্থীদের জন্য সাধ্যমত সবকিছুই করেছেন। পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের হাত থেকে বাংলাদেশের খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকগণও রেহাই পান নি। সৈন্যরা ঢাকার নিকটবর্তী লুদাবিঘা নলছাটা এবং পরিপাড়া এই তিনটি খ্রীস্টান অধ্যুষিত গ্রাম ধ্বংস ক’রে দেয়। তিন থেকে চার হাজার খ্রীস্টান গৃহহারা হয় এবং কয়েক শত খ্রীস্টানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়।
[ ‘সানডে টেলিগ্রাফ’, লণ্ডন, ১লা আগষ্ট, ১৯৭১]

হিন্দু ভেবে পাকিস্তানী সৈন্যরা বরিশাল জেলার পাদ্রী-শিবপুর গ্রামের বাঙালী খ্রীষ্টানদের নির্বিচারে হত্যা করে। পরে তারা ব্যাপারটি বুঝতে পারে। অতঃপর পাক-বাহিনীর স্থানীয় কম্যাণ্ডার খ্রীষ্টানদের গলায় ক্রস ঝুলিয়ে চলাফেরার নির্দেশ দেয়। ঢাকার রাজপথে ক্রস ঝুলানো পথচারীদের চলাফেরা করতে দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়।
[ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে বাংলাদেশ’, সোমেন পাল সম্পাদিত, পৃঃ ৩৩]

খ্রীস্টানদের ওপর নির্যাতন ও হত্যা
২৪শে এপ্রিল দিনাজপুর জেলার রুহিয়া মিশনের পুরোহিত ফাদার লুকাস মারাণ্ডি পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের গুলীতে নিহত হন। ঐ দিন সৈন্যরা ফাদার লুকাস মারাণ্ডির রুহিয়াস্থ মিশন বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং তাঁকে গুলীবিদ্ধ ক’রে চলে যায়।
[ ‘প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে বাংলাদেশ’, সোমেন পাল সম্পাদিত, পৃঃ ২৬]

রংপুর শ্মশানঘাটে যে বারজন বাঙালী সেনাবাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াডের শিকার হয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন ক্ষিতীশ হালদার নামে জনৈক বাঙালী খ্রীস্টান। ২৩শে এপ্রিল বর্বর সৈন্যরা মেহেরপুরের একটি খ্রীস্টান মিশনারী হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দেয়।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, ২০শে ও ২৬শে এপ্রিল, ১৯৭১]

হানাদাররা চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকার বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে এবং হত্যা করে। সৈন্যরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মঠগুলো
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪১

ধ্বংস ক’রে দেয়। চৌমুহনীর পাহাড়তলী গ্রামের একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ বর্বর সৈন্যরা অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত ক’রে দেয় এবং মঠের মূল্যবান ও পবিত্র সামগ্রী লুঠ ক’রে নিয়ে যায়।

বৌদ্ধ-দলন ও হত্যা
সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিঃ ধর্মভীরু (Dharma Viryu) পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বৌদ্ধ হত্যার মারাত্মক অভিযোগ আনেন। তিনি বলেন, সামরিক জান্তার নিষ্ঠুর কার্যকলাপ সমর্থন ক’রে পাকিস্তানী বৌদ্ধ সমিতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সমিতিতে প্রতিনিধিদল পাঠাতে অস্বীকার করলে তাদের উপর নির্মম নির্যাতন নেমে আসে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তিনি নিম্নলিখিত অভিযোগগুলো আনেনঃ
(ক) বিশ্ব বৌদ্ধ ভ্রাতৃসংঘের পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক মিঃ ডি. পি. বড়ুয়া এবং তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সৈন্যরা হত্যা করেছে।
(খ) সৈন্যরা চট্টগ্রামের সাতপারিয়া বৌদ্ধ মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করেছে এবং একটি বুদ্ধ মূর্তিসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুঠ করেছে।
(গ) ‘একশ’ বছরের বৃদ্ধ পাকিস্তান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান Abayatissa Mahathero সৈন্যদের দ্বারা নির্মমভাবে প্রহৃত হয়েছেন।
[ ‘দি স্টেটসম্যান’, ৪ঠা অক্টোবর, ১৯৭১]

ঢাকা শহরতলীর কমলাপুর বৌদ্ধ মঠের ভিক্ষুরা গলায় কাগজ ঝুলিয়ে রাখতো। উর্দু ভাষায় কাগজে লেখা থাকতোঃ ‘আমি বৌদ্ধ-হিন্দু নই, দয়া ক’রে আমাকে হত্যা করবেন না’। এপ্রিল এবং মে মাসের দিকে নাম পরিবর্তনের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল।
‘পাকিস্তান অবজারভার’-এ প্রকাশিত এমনি একটি বিজ্ঞাপনঃ আমার নাম অঞ্জলি দাস নয় ‘এঞ্জেলিক ডায়াস’ এবং আমি হিন্দু নই দেশী খ্রীস্টান।
[ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে বাংলাদেশ’, সোমেন পাল সম্পাদিত, পৃঃ ৩৪]

নির্মম পদ্ধতিতে শিশুদের নির্যাতন ও হত্যা
বাংলাদেশে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশুও বর্বর বাহিনীর রোষানল থেকে রেহাই পায়নি। ‘নিউজ উইক’ পত্রিকার সাংবাদিক টনি ক্লিফটন গুলী ক’রে
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪২

হত্যা করা হয়েছে এমন বহু শিশুকে দেখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন। বহু শিশুকে নির্দয়ভাবে প্রহার ক’রে পিঠ রক্তাক্ত ক’রে দে’য়া হয়েছে। নরপশুরা অতর্কিতে হানা দিয়ে শিশুদের ধরে তাদের মা-বাবার সামনে শূন্যে ছুড়ে মেরে নীচে বেয়নেট ধরে গেঁথে ফেলতো ধারালো ছুরি দিয়ে কসাইরা যেমন মাংস টুকরো টুকরো করে, সৈন্যরা তেমনি শিশুদেরকে টুকরো টুকরো ক’রে ফেলতো। তারা শিশুদের দু’পা ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতো এবং নির্মমভাবে আছড়ে মারতো।
কুমিল্লা শহরে স্বামী-স্ত্রী এবং দুই শিশুপুত্র নিয়ে ছিল একটি ছোট্ট সংসার। একদিন নর-পশুরা বেয়নেট উঁচিয়ে তাদের সামনে আসে। নিষ্পাপ শিশু দুটোর দু’পা ধরে মা-বাবার সামনে তারা দু’ভাগ ক’রে ফেলে। এই ভয়াবহ নিষ্ঠুরতায় মহিলাটি সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। স্বামী বেচারা জীবন্মৃত অবস্থায় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন খণ্ডিত সন্তানদের প্রতি।
[ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ফজলুর রহমান, মুক্তধারা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ ৩৪]

সৈন্যরা শিশুদের হত্যা করছে কেন? জনৈক ব্রিটিশ মহিলা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে জানান, শিশুদের অনাথ ক’রে রাখলে তারা বড় হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী হবে। তাই তাদের হত্যা করলে তারা প্রতিশোধ নিতে পারবে না।
[ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে বাংলাদেশ’, সোমেন পাল সম্পাদিত, পৃঃ ১২]

নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা
নারী ধর্ষণ ও হত্যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন নয়; কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তার পশু-সৈন্যদের নারী ধর্ষণ ও হত্যার লীলা মানব সভ্যতার সকল যুগের নজীরকে ম্লান ক’রে দিয়েছে। পশু-সৈন্যরা বাংলাদেশের সাত বছরের কিশোরী থেকে সত্তুর বছরের বৃদ্ধা নারীকেও ধর্ষণ করেছে। অসংখ্য বাঙালী নারীকে ধর্ষণের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিতা ছাত্রী থেকে শুরু ক’রে দিনমজুরের স্ত্রী ও মেয়েরা সৈন্যদের পাশবিক ক্ষুধার শিকার হয়েছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলাদেশে নারী ধর্ষণের লোমহর্ষক কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতায় সারা বিশ্বের মানুষ দারুণ ঘৃণা প্রকাশ করেছে এবং কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪৩

১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল বিকেলবেলা পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রী আবাস রোকেয়া হলে ঢুকে পড়ে। তারা মেয়েদের টেনে বের করে, মারধোর করে, পরনের শাড়ী, স্কার্ট, সালওয়ার টেনে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মেয়েরা হাত দিয়ে তাদের লজ্জা ঢাকতে চাইলে নর-পশুরা তাদের গোপনাঙ্গে ভারী বুটের লাথি মারে, বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে এবং জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। নর-পশুদের ক্রমাগত পাশবিক অত্যাচারে ধর্ষিতা মেয়েরা জ্ঞান হারায়। বর্বর সৈন্যদের কাছে লাঞ্ছিতা হবার পূর্বেই বহু ছাত্রী হলের উপর তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করে। রোকেয়া হলে ছাত্রীদের দেখতে এসে একটি বারো বছরের কিশোরী মেয়ে জনৈক পশু-সৈন্যের কবলিত হয়। সৈন্যটি তার উপর উপগত হয়। চীৎকার করেই মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে যায়। পাশবিক অত্যাচার চালানোর পর সৈন্যটি তার গোপনাঙ্গে বুটের লাথি মারে। কিন্তু মেয়েটি আগেই মারা যায়। ঢাকা ত্যাগকারী এ. স্যাণ্ডার্স নামে জনৈক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী তাঁর স্বাক্ষরযুক্ত এই প্রত্যক্ষ বিবরণ বোম্বের ‘ব্লিৎস’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দিয়েছিলেন।
[ ‘ব্লিৎস’, ৬ই এপ্রিল, ১৯৭১]

লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক জনাব আজিজুল হক ভূঁইয়া ‘রেপ এ্যাট রোকেয়া হল’ নামে একখানা স্মারকলিপি বের করেন। স্মারকলিপিটি নিয়ে পড়তে শুরু করেই একজন ব্রিটিশ মহিলা চীৎকার ক’রে বলতে থাকেন, “না, না, আমি আর পড়তে পারছি না। একি সত্য যে, কেউ এ অত্যাচার বন্ধ করতে পারে না। হায় প্রভু! এ যে নাৎসীদের চেয়েও ঘৃণ্য।”

পুত্রের সম্মুখে মায়ের উপর, পিতার সম্মুখে কন্যার উপর পাশবিক অত্যাচার
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-সহায়ক-সমিতি ‘বাংলাদেশ থ্রু ইটস লেন্স’ নামে একখানা আলোকচিত্র সম্বলিত পুস্তক প্রকাশ করেন। স্বামী সোহাগিনী জোহরা নাম্নী এক নারীকে পশু-সৈন্যরা একদিন অতর্কিতে ধরে নিয়ে যায়। বর্বর সৈন্যদের সম্মুখে পাশবিক অত্যাচারে জোহরা মারা যায়। নর-পশুরা তার নিষ্পেষিত দেহকে জঙ্গলের পাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শিয়াল-কুকুর তার দেহ ভক্ষণ ক’রে। ‘বাংলাদেশ থ্রু ইটস লেন্স’-এ জোহরা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪৪

নাম্নী এই নারীর মর্মস্পশী ছবি দেখানো হয়েছে। ‘নিউজ উইক’ পত্রিকার সাংবাদিক টনি ক্লিফটনের লিখিত একটি বিবরণ ২৮শে জুন প্রকাশিত হয়। তিনি জানান, বর্বর সৈন্যরা ছেলেমেয়েদেরকে তাদের মা-বাবার সামনে হত্যা করেছে মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। এই নৃশংস ও বর্বরতার দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে বহু লোক বোবা হয়ে গেছে। এ-প্রসঙ্গে রাজশাহী জেলার গৌরীপুর গ্রামের একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা আমি (লেখক) ভুলতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে একদিন সৈন্যরা অতর্কিতে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। একজন বাঙালী মহিলাকে তার দুই যুবক ছেলের সামনেই তারা পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করে। এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে যুবকদ্বয়ের একজন আত্মহত্যা করে, অপর যুবকটি পাগল হয়ে যায়। বাংলাদেশের শহর, বন্দরে, গ্রামে সর্বত্র এমন ঘটনা ঘটেছে। পুত্রের সম্মুখে মায়ের, পিতার সম্মুখে কন্যা, ভাইয়ের সম্মুখে বোনের, এবং স্বামীর সম্মুখে স্ত্রীর ওপর বলাৎকার করা হয়েছে এবং বহু ক্ষেত্রে একই নারীর ওপর অনেক সৈন্যের বলাৎকারের মাধ্যমে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এমন নিদারুণ ঘটনার বর্ণনা দিতেও হৃদয় কম্পিত হয়।
নরপশুরা মেয়েদেরকে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে যেতো এবং শহরে বা গ্রামে স্থায়ী ও অস্থায়ী ছাউনি বা ঘাঁটিগুলোতে তাদের ইন্দ্রিয়জ ক্ষুধা মেটানোর জন্য এদেরকে রেখে দিত। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অবস্থান ও পরিখাগুলোতে মেয়েদের আটক রেখে প্রতিদিন এই বর্বরগুলো তাদের পাশবিক ক্ষুধা মিটিয়েছে। মিত্র এবং মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে পাকিস্তানী সৈন্যরা পালাতে শুরু করলে তাদের অবস্থানগুলোর মধ্যে শত শত মৃত, জীবন্মৃত ও জীবিত নারীকে পাওয়া গেছে। এইসব হতভাগিনী নারীদের বিবরণ থেকে জানা যায়, সৈন্যরা তাদের শুকনো রুটি খেতে দিতো। পিপাসায় পানির জন্য চিৎকার করলে তারা তাদের মুখ তুলে প্রসাব ক’রে দিতো। বর্বর সৈন্যরা ধৃত বাঙালী নারীদের উলঙ্গ অবস্থায় রাখতো, তাদের চিবুক, ঠোঁট, বুক কামড়ে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করতো। কখনও মহিলাদের স্তন কেটে দিতো। অসহ্য যন্ত্রণায় তারা ককিয়ে উঠলে পশুরা পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়তো। হতভাগিনী মহিলারা দুর্বল হয়ে পড়তো এবং পশুদের পাশবিক ক্ষুধা মেটাতে অস্বীকার বা প্রতিবাদ করলে
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪৫

তীক্ষ্ণ ও বিষাক্ত বেয়নেটের খোঁচা, চাবুকের আঘাত এবং জ্বলন্ত সিগারেটের তীব্র জ্বালা সহ্য করতে হ’ত।

গর্ভবতী মহিলার ওপর নৃশংস অত্যাচার
গর্ভধারিণী মহিলারাও বর্বর সৈন্যদের নিকট থেকে রক্ষা পায় নি। তাদের ওপরও সৈন্যরা পাশবিক অত্যাচার চালাতো। নরপশুরা বেয়নেট দিয়ে গর্ভবতী মহিলাদের তলপেট দু’ভাগ ক’রে কেটে ফেলতো এবং গর্ভস্থ সন্তান বের ক’রে মুমূর্ষ মায়েদের চোখের সামনে তুলে ধরতো।

নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক পদ্ধতিতে নারী নির্যাতন
কখনও কখনও মহিলাদের দু’হাত উপরে তুলে বেঁধে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখে চামড়ায় মোড়ানো চার ইঞ্চি পুরু ও প্রায় এক হাত লম্বা শক্ত দণ্ড তৈলপাত্রে ভিজিয়ে নিয়ে তাদের গুপ্ত অঙ্গে আমূল বিদ্ধ ক’রে দিয়ে হত্যা করেছে। ধৃত বাঙালী মহিলাদের স্তন কেটে দেবার কথা আমি উল্লেখ করেছি। পশুরা তাতেও সন্তুষ্ট হয় নি। তারা মহিলাদের স্তন কেটে নিয়ে তা’ দিয়ে বল খেলতো। পাশবিক ক্ষুধা মেটাবার পর যাতে মহিলারা প্রস্রাব করতে না পারে সেজন্য তাদের লজ্জাস্থান বেঁধে রাখা হ’ত। উলঙ্গ মহিলাদেরকে পুরুষ বন্দীদের সামনে আনা হ’ত এবং মহিলাদের অনেকেরই মা-বাবা ও স্বামী বন্দী পুরুষদের মধ্যে থাকতেন। নরপশুরা তাঁদের সামনেই তাঁদের মেয়ে, বোন এবং স্ত্রীদের মুখে কামড় দিয়ে বলতোঃ “আগার জরুরত হ্যায় তো একঠো লে যাও।”
[ ‘বাংলাদেশে গণহত্যা’, ফজলুর রহমান, মুক্তধারা, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃঃ ৩৬, ৪৪]

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে
বাঙালীদের জাতীয়-চেতনাকে ধ্বংস করতে শাসকগোষ্ঠীর জঘন্য ষড়যন্ত্রের কথা বিষয়াস্তরে উল্লেখ করেছি। এ কথাও বলেছি যে, এদেশের বুদ্ধিজীবীরা বার বার পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন বলে তাঁদের অনেকেই এদের রোষানলে পতিত হন। তাঁদের প্রতি শাসকগোষ্ঠী বহুদিন থেকেই আক্রোশ পোষণ ক’রে আসছিল। ২৫শে মার্চের রাতেই প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কয়েকজন বুদ্বিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যার কথা আগেই বলেছি। ১৩ই এপ্রিল কর্নেল তাজের নেতৃত্বে একটি পাকিস্তানী ব্রিগেড রাজশাহীতে প্রবেশ ক’রে মতিহারে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ শামসুজ্জোহা ছাত্রাবাসে সামরিক ঘাঁটি গেড়ে বসে এবং কতিপয় অনুচরের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশিষ্ট
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪৬

অধ্যাপককে হত্যা করে। সাহায্যকারী অনুচরদের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন এবং ডঃ মতিয়ুর রহমানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কয়েকজন বাঙালী-অবাঙালী অধ্যাপকও তাদেরকে সাহায্য করে।
অবাঙালী গাইডদের সহায়তায় হানাদারেরা ২৬শে মার্চের প্রত্যুষেই প্রথমে আমার বিশ্ববিদ্যালয়স্থিত বাসভবন ঘেরাও ক’রে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে তখন আমি রাজশাহীতে ছিলাম না। আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েসহ স্নানাগারে আত্মগোপন করেন। কিন্তু জনৈক মেজরের নেতৃত্বে হানাদারেরা সে ঘরের দরজা ভাঙার উপক্রম করলে আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েসহ বেরিয়ে আসেন। মেজর আমার ছেলেমেয়েদের প্রতি ভদ্র আচরণ করে, কেননা, শিকার হাওয়া হয়ে গেছে জেনে তারা খুবই নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। পূর্বেই বলেছি, ২৫শে মার্চ রাত্রিতে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলাম। যা হোক, সৈন্যরা আমার বাড়ীর আসবাবপত্র তছনছ ক’রে ফিরে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তখন বাঙালী অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন অঙ্ক বিভাগের প্রধান জনাব হাবিবুর রহমান ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক বাবু সুখরঞ্জন সমাদ্দার।
জনাব হাবিবুর রহমানের বাড়ীতে কালো পতাকা উড়ছিল। সামরিক কর্তা তা’ নামাতে বললে, তিনি তাতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। আর এটাই হ’ল তাঁর কাল। তিনি চিহ্নিত হয়ে রইলেন।
কয়েকদিন পর হানাদাররা যখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লুণ্ঠন কাজ চালাচ্ছিল, তখন তিনি সোচ্চার কণ্ঠে তার প্রতিবাদ করেন। ফলে এর মাশুল হিসেবে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিণতিতে তাঁর ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা’ বলাই বাহুল্য। তিনি শহীদ হন। একই সময়ে অর্থাৎ এপ্রিলের ১৬/১৭ তারিখের দিকে সুখরঞ্জন সমাদ্দারকেও হানাদারেরা ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাঁর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি।
দেশ শত্রু মুক্ত হওয়ার মাত্র ২২ দিন আগে মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুমকে নরঘাতকদের হাতে প্রাণ হারাতে হয়। বস্তুতঃ উক্ত বিভাগের অধ্যক্ষ অবাঙালী মতিয়ুর রহমানের কোপদৃষ্টিতে পতিত হওয়ার ফলেই তাঁকে স্বাধীনতার বলী হতে হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪৭

বুদ্ধিজীবী হত্যা
ডিসেম্বরের যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ঢাকায় ঘেরাও হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান-বিরোধী বুদ্ধিজীবীদেরকে নিশ্চিহ্ন ক’রে দেয়ার প্রচেষ্টায় মেতে ওঠে। আগেই বলেছি, এ কাজে কুখ্যাত আল-বদর বাহিনীকে নিয়োগ করা হয়েছিল। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর যে সমস্ত দলিলপত্র বাংলাদেশ সরকারের হস্তগত হয়েছে, তার মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী জল্লাদ আল-বদর বাহিনীর কমাণ্ডার আশরাফুজ্জামান খানের ডাইরীটি উল্লেখযোগ্য। ২৭শে পৌষ, ১৩৭৮ সালের ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-এ প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে, এই ডাইরীতে কিছু প্রামাণ্য দলিল ও চাঞ্চল্যকর তথ্য আছে। এই জল্লাদ স্বহস্তে গুলী ক’রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ জন শিক্ষককে হত্যা করেছে। উক্ত ডাইরীর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকা ও চিকিৎসকের নাম এবং তাঁদের ঠিকানা লেখা আছে। এই ১৯ জনের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ৮ জন নিখোঁজ হন। এঁরা হলেনঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আবুল খায়ের, সন্তোষ ভট্টাচার্য ও গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক রশিদুল হাসান, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ডঃ ফয়জুল মহী ও সিরাজুল হক খান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডাঃ মর্তুজা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছাড়াও সুপরিকল্পিত উপায়ে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিকদেরকে হত্যা করা হয়। বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদ, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নজমুল হক, নিজামুদ্দিন আহমদ, আ. ন. ম. গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভিন, সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, চক্ষু চিকিৎসক ডক্টর আলীম চৌধুরী, ডঃ ফজলে রাব্বি, কবি মেহেরুন্নেসা প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এঁরা আলবদর ও আলশামস দলের নরপশুদের হাতে শহীদ হন। স্বাধীনতার পর মীরপুর বধ্যভূমিতে কিছুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর লাশ দেখে তাঁদের সনাক্ত করা হয়। অনেকেরই লাশের চিহ্ন পর্যন্ত এরা অবশিষ্ট রাখে নি।
বাংলাদেশে পাকিস্তানী বর্বর সেনাদের ও বাঙালী রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং তাদের সমর্থকদের গণহত্যার ব্যাপকতা, বিভৎসতা,
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪৮

নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতা এতই বহুধাবিস্তৃত এবং বিচিত্র যে, এখানে একটি ক্ষুদ্র অধ্যায়ে তার সঠিক বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। শুধু এটুকু স্মরণে রাখলেই এই গণহত্যা সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলা সম্ভব যে, বাংলাদেশের প্রায় ত্রিশ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া শরণার্থী হিসেবেও ভারতের ঘাঁটিতে অসংখ্য মানুষের জীবনাবসান ঘটেছে। সম্পদ ও সম্পত্তির যে কি পরিমাণ ধ্বংস সাধন হয়েছে, তা’ নির্ণয় করা এক দুরূহ কার্য।
মোটের ওপর, ধর্মের নামে ও একই আদর্শের একটি ধ্বজা সামনে রেখে শোষণের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতার এত বড় অবমাননা মানব সভ্যতার ইতিহাসে আর বোধ করি সংঘটিত হয় নি। তবে ত্যাগ ও রক্তের মাধ্যমেই বাঙালী প্রমাণ করেছে—
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি
বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৪৯

সংগ্রামী জীবনের ষষ্ঠ অধ্যায়
জনাব ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবার পর বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্ত ক’রে রাওয়ালপিণ্ডির একটি গৃহে অন্তরীণ রাখেন। ইয়াহিয়া খান পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেবার আয়োজন করছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই ভুট্টোর হস্তক্ষেপের ফলে ইয়াহিয়ার হীন উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। ভুট্টোকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক চাপে, কেননা শেখ মুজিব বিশ্বের সর্বত্র শ্রদ্ধেয় গণনেতা।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তি
বাংলাদেশ রাহুমুক্ত হবার পর এদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে প্রবল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বিশ্ববিবেকের কাছে আকুল আবেদন জানালো তাদের প্রিয় নেতা বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। অবশেষে বিশ্ববিবেকের প্রবল চাপে জল্লাদ ইয়াহিয়ার দোসর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭২ সালের ৩রা জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের কথা ঘোষণা করেন। সেদিন রাতে বি. বি. সি’র খবরে জানা যায় যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো করাচীর এক জনসভায় বক্তৃতা করার আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঐ সময় বঙ্গবন্ধু তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কি মুক্ত?’ জবাবে ভুট্টো জানান, ‘হ্যাঁ’, আপনি মুক্ত, আপনি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫০

ঐদিনই করাচীর জনসভায় বক্তৃতাদান কালে ভুট্টো সাহেব শোতৃমণ্ডলীকে জিজ্ঞেস করেন যে, তারা কি শেখ মুজিবের মুক্তিদানের সঙ্গে একমত? জনতা এক বাক্যে সায় দেয়, ‘আমরা একমত।’ এরপর ভুট্টো বলেন, ‘আমি এখন বিরাট ভারমুক্ত হলাম। শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দেওয়া হবে।’
কিন্তু এতদসত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে বেশ গড়িমসি করা হয়। বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ আর টালবাহানা না করার জন্য ভুট্টোকে হুঁশিয়ার করে দেন। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধুকে পি. আই. এ’র একটি বিশেষ বিমানে ক’রে লণ্ডন অভিমুখে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সময় দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিট এবং গ্রীনউইচ সময় ৬টা ৩৬ মিনিটে লণ্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে তাঁর বিমান অবতরণ করে। সেখানে ভি. আই. পি’র লাউঞ্জে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, আমি বেঁচে আছি। আমি সুস্থ রয়েছি। তখন তাঁর পরনে ছিল একটা সাদা খোলা শার্ট ও ধূসর রংয়ের স্যুট। পরে ওখান থেকে লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তারা তাঁকে ‘ক্লারিজেস’ হোটেলে থাকার জন্য নিয়ে যান।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ব্রিটেন তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নি। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে ভারত ও রাশিয়াই কেবলমাত্র স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর লণ্ডন উপস্থিতি বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলার পক্ষে সহায়ক ছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। জানুয়ারীর শেষের দিকে ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
১০ই জানুয়ারী (১৯৭২) তারিখে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিনায়ক, বিশ্বের নিপীড়িত জনতার বিশ্বস্ত মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রয়াল এয়ার ফোর্সের একখানি ‘কমেট’ বিমানযোগে লণ্ডন থেকে নয়াদিল্লী পৌঁছেন। সেখানে পালাম বিমান বন্দরে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও অন্যান্য মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং ২৪ জনেরও বেশী বিদেশী কূটনৈতিক প্রতিনিধি
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫১

তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। পরে দিল্লীর প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি এক বিশাল জনসমাবেশে বাংলায় মর্মস্পর্শী ভাষণ দান করেন। ভাষণে তিনি ভারতের জনগণ ও ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ঐ একই দিনে বিমানযোগ বঙ্গবন্ধু সেদিন ১টা ৪১ মিনিটে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। তাঁকে শুধু এক নজর দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেদিন ঢাকা বিমান বন্দরে জমায়েত হয়েছিল। এ দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘দৈনিক বাংলা’ লিখেছেনঃ
“রূপোলী ডানার মুক্ত বাংলাদেশের রদ্দুর। জনসমুদ্রে উল্লাসের গর্জন। বিরামহীন করতালি, শ্লোগান আর শ্লোগান। আকাশে আন্দোলিত হচ্ছে যেন এক ঝাঁক পাখি। উন্মুখ আগ্রহের মুহূর্তগুলো দুরন্ত আবেগে ছুটে চলেছে। আর তর সইছে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছেন রক্তস্মাত বাংলার রাজধানী ঢাকা নগরীতে দখলদার শক্তির কারা প্রাচীর পেরিয়ে।—–আমার সোনার বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি, হৃদয়ের রক্ত-গোলাপ শেখ মুজিব এসে দাঁড়ালেন। আমাদের প্রত্যয়, আমাদের সংগ্রাম, শৌর্য, বিজয় আর শপথের প্রতীক বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন তাঁর স্বজনের মাঝে। চারধারে উল্লাস, করতালি, আকাশে নিক্ষিপ্ত বদ্ধ-মুঠি, আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়া পরিবেশ—যা অভূতপূর্ব, শুধু অভূতপূর্ব। এই প্রাণাবেগ অবর্ণনীয়।”…
জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে ৪ ঘন্টাব্যাপী সাঁতার কেটে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছেন। পঞ্চাশ লক্ষের অধিক জনসমাবেশের দিকে তাকিয়ে তিনি শিশুর মত কেঁদে ফেলেন। সেদিন তিনি কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা’ যেমন হৃদয়-বিদারক, তেমনি মর্মস্পর্শী। তিনি তাঁর ভাষণে বলেনঃ
“আজকের এই শুভলগ্নে আমি সর্বপ্রথম আমার দেশের সংগ্রামী কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সেই বীর শহীদদের কথা স্মরণ করছি, যারা গত নয় মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। আমি তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার সোনার বাংলা আজ স্বাধীন
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫২

ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার উদ্দেশে আমি সালাম জানাই।
ইয়াহিয়া খাঁর কারাগারে আমি প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছি। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্ত হবে, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না, তবে, এই মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হ’ল, তা’ কল্পনারও অতীত। আমার বিশ্বাস, পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশের মুক্তিসংগ্রামে এত লোকের প্রাণহানির নজীর নেই। আমার দেশের নিরীহ মানুষদের হত্যা ক’রে তারা কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে, আমার মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন ক’রে তারা জঘন্য বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে, সোনার বাংলার অসংখ্য গ্রাম পুড়িয়ে তারা ছারখার ক’রে দিয়েছে। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীশালায় থেকে আমি জানতাম, তারা আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু তাদের কাছে আমার অনুরোধ ছিল, আমার লাশটা তারা যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়, বাংলার পবিত্র মাটি আমি পাই। আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলাম, তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে বাংলার মানুষদের মাথা নিচু করব না।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙ্গালী ক’রে মানুষ কর নি।’ কিন্তু আজ আর কবিগুরুর সে কথা বাংলার মানুষের বেলায় খাটে না—তাঁর প্রত্যাশাকে আমরা বাস্তবায়িত করেছি। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে, তারা বীরের জাতি, তারা নিজেদের অধিকার অর্জন ক’রে মানুষের মত বাঁচতে জানে। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক ভাইয়েরা আমার, আপনারা কত অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন, গেরিলা হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, রক্ত দিয়েছেন দেশমাতার মুক্তির জন্য। আপনাদের এ রক্তদান বৃথা যাবে না।
আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার জনসাধারণের প্রতি আমাদের এই মুক্তি-সংগ্রামে সমর্থন দানের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। বর্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমার দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ ক’রে ভারতে আশ্রয়
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫৩

নিয়েছিল। ভারত সরকার ও ভারতের জনসাধারণ নিজেদের অনেক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই ছিন্নমূল মানুষদের দীর্ঘ নয়মাস ধরে আশ্রয় দিয়েছেন, খাদ্য দিয়েছেন। এজন্য আমি ভারত সরকার ও ভারতের জনসাধারণকে আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমার অন্তরের অন্তস্থল হতে ধন্যবাদ জানাই।
গত ৭ই মার্চ এই ঘোড়দৌড় ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম—এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয় নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালীর প্রাণ থাকতেও আমরা এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে, এমন কোন শক্তি নেই।
আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি আমার এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য দানের জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি।
নেতা হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, তা’ হ’লে আমাদের এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে—পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে সেগুলো মেরামত করতে হবে। আপনারা নিজেরাই সেসব রাস্তা মেরামত করতে শুরু করে দিন। যার যা কাজ, ঠিকমত ক’রে যান। কর্মচারীদের বলছি, আপনারা ঘুষ খাবেন না। এদেশে আর কোন দুর্নীতি চলতে দেয়া হবে না। প্রায় চার লাখ বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানে আছে। আমাদের অবশ্যই তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। বাংলাভাষী নয়, এমন যারা বাংলাদেশে আছে, তাদের বাঙালীদের সাথে মিশে যেতে হবে । কারও প্রতি আমার হিংসা নেই। অবাঙালীদের প্রতি কেউ হাত তুলবেন না। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। অবশ্য যেসব লোক পাকিস্তান সৈন্যদের সমর্থন করেছে, আমাদের লোকদের হত্যা করতে
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫৪

সাহায্য করেছে, তাদের ক্ষমা করা হবে না। সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে।
আপনারা জানেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা দাঁড় করানো হয়েছিল এবং অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে, আমি তাদের জানি। আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার জেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাদের বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হ’লে আমি এখানেই মরব। তাজউদ্দিন এবং আমার অন্যান্য সহকর্মীরা তখন কাঁদতে শুরু করেন।
আমার পাকিস্তানী ভাইয়েরা, আপনাদের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই। আমি চাই, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী অমাদের অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে, আমাদের মা-বোনদের মর্যাদাহানি করেছে, আমাদের গ্রামগুলো বিধ্বস্ত করেছে। তবুও আপনাদের প্রতি আমার কোন আক্রোশ নেই। আপনারা স্বাধীন থাকুন, আমরাও স্বাধীন থাকি। বিশ্বের অন্য যেকোন দেশের সাথে আমাদের যে ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে, আপনাদের সাথেও আমাদের শুধুমাত্র সেই ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে। কিন্তু যারা অন্যায়ভাবে আমাদের মানুষদের মেরেছে, তাদের অবশ্যই বিচার হবে। বাংলাদেশে এমন পরিবার খুব কমই আছে, যে পরিবারের কোন লোক মারা যায় নি।
বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরেই এর স্থান। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের স্থান তৃতীয় ও পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ইসলামের নামে এদেশের মুসলমানদের হত্যা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫৫

করেছে আমাদের নারীদের বেইজ্জত করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না, আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।
আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে শ্রদ্ধা করি। তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ রাজনীতি করছেন। তিনি শুধু ভারতের মহান সন্তান পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কন্যাই নন, পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নাতনীও। তাঁর সাথে আমি দিল্লীতে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেছি। আমি যখনই চাইব, ভারত বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী তখনই ফিরিয়ে নেবে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় সৈন্যের একটা বিরাট অংশ বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।
আমার দেশের জনসাধারণের জন্য শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী যা করেছেন, তার জন্য আমি তাঁকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আমার মুক্তির জন্য বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন, তাঁরা যেন আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানান। আমি তার নিকট চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব।
প্রায় এক কোটি লোক যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল এবং বাকী যারা দেশে রয়ে গিয়েছিল, তারা সবাই অশেষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছে। আমাদের এই মুক্তি-সংগ্রামে যারা রক্ত দিয়েছে সেই বীর মুক্তিবাহিনী, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক সমাজ, বাংলার হিন্দু-মুসলমান, ই. পি. আর. পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্য আর সবাইকে আমার সালাম জানাই। আমার সহকর্মীরা, আপনারা মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার ব্যাপারে যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন, তার জন্য আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আপনাদের মুজিব ভাই আহ্বান জানিয়েছিলেন আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন, তাঁর নির্দেশ মেনে চলেছেন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।
পাকিস্তানী কারাগার থেকে আমি যখন মুক্ত হই, তখন জনাব ভুট্টো আমাকে অনু্রোধ করেছিলেন-সম্ভব হ’লে আমি যেন দু’দেশের মধ্যে একটা
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫৬

শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমার জনসাধারণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ-ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। এখন আমি বলতে চাই, জনাব ভুট্টো সাহেব, আপনারা শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তা’ হ’লে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে নির্বিচারে গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি।
আমি বিশ্বের সকল মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন এবং সত্বর বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য ক’রে নেয়ার জন্য সাহায্য করুন।
জয় বাংলা।

অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ জারী
পরদিন রাতে প্রেসিডেন্টের এক নির্দেশবলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারী করা হয়। এই আদেশে অবিলম্বে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করার কথা বলা হয়েছিল। এই আদেশ সমগ্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।
এই আদেশ সম্পর্কে ঢাকায় এক সরকারী প্রেসনোটে বলা হয়ঃ “যেহেতু ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পরিচালনার জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থাবলী গ্রহণ করা হয়; এবং যেহেতু উক্ত ঘোষণায় প্রেসিডেন্টকে সকল শাসনকার্য পরিচালনা ও বিধানগত কর্তৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা প্রদত্ত হয়; এবং যেহেতু উক্ত ঘোষণায় উল্লেখিত অন্যায় ও প্রতারণামূলক যুদ্ধের বর্তমানে অবসান ঘটেছে; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের সুস্পষ্ট আশা-আকাঙ্ক্ষা হ’ল যে বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছে; এবং যেহেতু উক্ত লক্ষ্য অনুসরণে উক্ত ব্যাপারে অবিলম্বে কতিপয় ব্যবস্থাবলী গ্রহণ প্রয়োজন হয়েছে, তাই বর্তমানে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫৭

তারিখের স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা এবং সে ক্ষেত্রে তার এখতিয়ারাধীন অপর সকল ক্ষমতা অনুসারে প্রেসিডেন্ট নিম্নলিখিত আদেশ প্রণয়ন ও জারী করেছেনঃ
(১) এ আদেশ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ বলে অভিহিত হবে।
(২) এ আদেশ সমগ্র বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে।
(৩) অবিলম্বে এ আদেশ কার্যকর হবে।
(8) সংজ্ঞাঃ
এ আদেশে উল্লেখিত গণপরিষদ অর্থে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের জানুয়ারী ৩ মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এন-ই ও পি-ই আসনে নির্বাচিত ও অন্য কোন কারণে বা আইনে অযোগ্য ঘোষিত নয়, বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত এমন প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থা বুঝাবে।
(৫) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রী পরিষদ থাকবে।
(৬) প্রেসিডেন্ট তাঁর সকল কার্য পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ মোতাবেক কাজ করবেন।
(৭) গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন প্রেসিডেন্ট গণপরিষদের এমন একজন সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব অর্পণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ মোতাবেক প্রেসিডেন্ট অপর সকল মন্ত্রী, স্টেট মন্ত্রী ও ডেপুটি মন্ত্রী নিয়োগ করবেন।
(৮) গণপরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পূর্বে যে-কোন সময়ে প্রেসিডেন্টের পদ শূন্য হ’লে বাংলাদেশের একজন নাগরিককে মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিয়োগ করবেন। তিনি গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত শাসনতন্ত্র মোতাবেক অপর একজন প্রেসিডেন্ট কার্যভার গ্রহণ না করা অবধি প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
(৯) একজন প্রধান বিচারপতি ও বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ করা হবে এমন অন্যান্য বিচারপতিদের সমন্বয়ে একটা বাংলাদেশ হাইকোর্টও থাকবে।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫৮

(১০) বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন এবং প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, স্টেট মন্ত্রী ও ডেপুটি মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। মন্ত্রিসভা শপথের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করবেন।”

সংসদীয় গণতন্ত্র পরিচালনা কমিটি
পরদিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে প্রথম সংসদীয় গণতন্ত্র পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। এতে প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপ্রধানরূপে মনোনীত হন বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী।

প্রধানমন্ত্রী পদে বঙ্গবন্ধু
রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতার অধিকারী। এই অধিকারবলে তিনি একই দিনে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তাঁকে নয়া সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানান।
উল্লেখযোগ্য যে, ইতিমধ্যে অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ ঘোষণার ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ ও তাঁর মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন। নয়া রাষ্ট্রপতির আহ্বানে বঙ্গবন্ধু এক নতুন মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে গঠিত এই মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ হলেনঃ
জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম,
জনাব তাজউদ্দিন আহমদ,
জনাব মনসুর আলী,
জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমদ,
জনাব আবদুস সামাদ,
জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান,
শেখ আবদুল আজীজ,
অধ্যাপক ইউসুফ আলী,
আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী,
শ্ৰী ফণীভূষণ মজুমদার,
ও ডক্টর কামাল হোসেন।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৫৯

সেদিন ছিল বুধবার। অপরাহ্নে বঙ্গভবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নয়া মন্ত্রিসভার অপর ১১জন সদস্যও রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর নিকট শপথ গ্রহণ করেন। এর আগে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি জনাব এ. এস. এম. সায়েমের নিকট রাষ্ট্রপতিও শপথ গ্রহণ করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই জনৈক সাংবাদিক যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি? জবাবে চিরাচরিত হাস্যমুখে তিনি বলেনঃ
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই,
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
আপন অভিজ্ঞতাসঞ্জাত গভীর উপলদ্ধি থেকে যে সত্যকে সারা জীবন বঙ্গবন্ধু আবিষ্কার করেছেন, কবিগুরুর বাণীর মধ্যে দিয়ে তিনি তা’ স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রকাশ করেছেন। জাতির নিকট থেকে এক বিরাট দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি এবার মনোসংযোগ করলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলার কঙ্কালকে পুনরুজ্জীবিত করতে। তিনি ভুলে গেলেন যে জল্লাদের বধ্যভূমিতে থেকে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে গেছে—আগের চেয়ে ওজন ৪২ পাউণ্ড কমে গেছে—এখন তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন। মুমূর্ষ বাংলা মায়ের আর্তনাদ আর হাহাকার তাঁকে উন্মাদ ক’রে তুলল। দায়িত্ব তিনি নিতে চান নি, কিন্তু না নিয়েও পারলেন না। এতদিন তিনি ছিলেন শুধু বঙ্গবন্ধু আর মুজিব ভাই, এখন হয়েছেন ‘জাতির পিতা’। সন্তানের প্রতি তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন তাঁকে করতেই হবে। তাই আহার-নিদ্রা বিসর্জন দিয়ে আবার তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন কর্মক্ষেত্রে।

মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক
১৩ই জানুয়ারী (১৯৭১) বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বীরোচিত অংশ গ্রহণকারী কৃষকদের বাঁচার সংগ্রাম, গ্রামাঞ্চলে বর্বর বাহিনীর ধ্বংসলীলা এবং লক্ষ লক্ষ লোকের গৃহহারা হওয়ার কথা চিন্তা করে’ ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৬০

পর্যন্ত বকেয়া ও সুদ সমেত কৃষি জমির সব রকম খাজনা মওকুফ করায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
উক্ত বৈঠকে জাতীয় পতাকার নক্সা সংশোধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে জাতীয় পতাকা স্থির করা হয়েছিল, উহাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা থাকবে, তবে পতাকার মধ্যবর্তী মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হবে।’ সেখানে থাকবে সূর্যের ন্যায় একটি রক্তপিণ্ড।
এই বৈঠকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রখ্যাত গান, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’-এর প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। এছাড়া জাতীয় কুচকাওয়াজ সঙ্গীত হিসেবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্’ গানটিকে নির্বাচিত করা হয়।

সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর প্রথম নীতি-নির্ধারণী ভাষণ
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ১৪ই জানুয়ারী প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে এক নীতি-নির্ধারণী ভাষণ দেন। তাঁর সরকারী বাসভবনে আয়োজিত উক্ত সম্মেলনে ভাষণ দান প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ “ইয়াহিয়া খানের দস্যুবাহিনী বাংলাদেশে ধ্বংসের যে চিহ্ন রেখে গেছে, তার ওপরই একটি নতুন সমাজ-ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা হবে।”
বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সরকারী নীতি ব্যাখ্যা ক’রে বলেন যে, সরকার দেশে নতুন অর্থনীতি সৃষ্টির জন্য একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছেন এবং সে কাজে অত্যন্ত দক্ষ পেশাদার অর্থনীতিবিদদের নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি উক্ত সম্মেলনে আরো জানান যে, দেশের নতুন খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজও শুরু করা হয়েছে।

অস্ত্র সমর্পণের জন্য বঙ্গবন্ধুর আহ্বান
বাংলার দামাল ছেলেদের হাতে তখনও অস্ত্র ছিল। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর তাদের অস্ত্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে—ইতিমধ্যে তারা দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেছে। বঙ্গবন্ধু তাই আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে গণবাহিনীকে ও সকল মুক্তিযোদ্ধাকে আগামী দশ দিনের মধ্যে অস্ত্র সমর্পণের জন্য আহ্বান জানান। ১৭ই
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৬১

জানুয়ারী এক বিবৃতিতে তিনি এই আহ্বান করেন ও গণবাহিনীর সদস্যদের ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবার দেশপ্রেম, সাহসিকতা ও শৌর্য-বীর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পরদিন এক ঘোষণায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা উৎসব উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলে দণ্ডপ্রাপ্ত কতিপয় শ্রেণীর কয়েদীদের ক্ষমা প্রদর্শন করেন।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া
জানুয়ারীর ২৪ তারিখে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে একটি অনাড়ম্বর আকর্ষনীয় কিন্তু আবেগঘন অনুষ্ঠানে “কাদেরিয়া বাহিনী” নামে পরিচিত টাঙ্গাইলের ১৬ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর নিকট অস্ত্র সমর্পণ করে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা মুক্ত হওয়ার অনেক আগেই টাঙ্গাইল জেলা থেকে শত্রু সৈন্যকে হটিয়ে বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা চালু করেছিল।
টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উক্ত বাহিনীর নেতা জনাব আবদুল কাদের সিদ্দিকী (যিনি ‘বাঘা সিদ্দিকী’ নামে পরিচিত) অস্ত্র সমর্পণের সময় ঘোষণা করেন, ‘যে নেতার আদেশে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম, সে অস্ত্র নেতার হাতেই ফিরিয়ে দিলাম।’
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “এদের খালি হাতে রেখে গিয়েছিলাম, হাতিয়ার দিতে পারি নি। হাতিয়ার ছাড়া যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আদেশ করেছিলাম। বলেছিলাম, আমি যদি নাও থাকি, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যা।”
সেদিন তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে অকপটে স্বীকার করেন যে, হানাদার বাহিনীর কারাগারে মৃত্যু প্রতীক্ষায় থাকার সময়ে তাঁর চোখে পানি আসে নি, কিন্তু বাংলার মাটিতে পা দে’য়ার পর থেকে দেশের মানুষের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার পর চোখের পানি তাঁর পক্ষে রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
৩১শে জানুয়ারী ঢাকা স্টেডিয়ামে ‘মুজিব বাহিনী’ কর্তৃক আরেকটি আত্ম সমর্পণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু সবার প্রতি সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানান।
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৬২

বাংলাদেশের দুর্দিনের সাথী ও আশ্রয়দাতা ভারতের মহান জনগণ ও সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে কোলকাতায় যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, তাঁর মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ও বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং লক্ষ লক্ষ জনতা তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কোলকাতার বুকে এত লোকের সমাবেশ বোধকরি আর কোনদিন কোন জনসভায় হয় নি।
বঙ্গবন্ধুর ভারত সফর
সেদিনই কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে ভারতের ইতিহাসের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোন শক্তিই পারবে না এ মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে। ঐদিন বিশাল জনসমুদ্রের গগণবিদারী বিপুল করতালির মাঝে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে যে কাব্যময়ী ভাষায় বক্তৃতা দেন, তা’ ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের চিরদিন স্মরণ থাকবে। তাঁর সে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা যাকঃ
“লাখো লাখো জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বিশ্বের কোন শক্তিই আর এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বিশ্বের ইতিহাসে আমাদের মত এত বড় মূল্য দিয়ে আর কেউ স্বাধীনতা অর্জন করে নি। বহু কষ্টে অর্জিত এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের শেষ মানুষটিও প্রাণপণে সংগ্রাম করবে। আমার বাংলা—তিতুমীরের বাংলা, আমার বাংলা—সূর্যসেনের বাংলা, আমার বাংলা সুভাষ বসুর বাংলা, ফজলুল হকের বাংলা, সোহরাওয়ার্দীর বাংলা। এ বাংলার মাটি পলি দিয়ে গড়া, বড়ো নরম মাটি। কিন্তু চৈত্রের কাঠফাটা রৌদ্রে এই মাটিই কঠিন শিলায় পরিণত হয়। আমার দেশের মানুষটিও ঠিক এই মাটিরই মত। তারা শান্ত। তারা শান্তিপ্রিয়। কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে তারাই আবার ইস্পাতদৃঢ় কঠিন।
ভারতের মহান জনগণ, ভারত সরকার, ভারতের সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ ক’রে ভারতের মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। হানাদার বাহিনী আমার দেশের এক কোটি মানুষকে তাদের ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত করেছে। এই
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৬৩

নিরাশ্রয় মানুষদের আশ্রয় দিয়ে, অন্ন দিয়ে, বস্ত্র দিয়ে, সর্বোপরি সান্ত্বনা দিয়ে আপনারা যে উপকার করেছেন, তা’ অতুলনীয়। আপনাদের এই দান পরিশোধের সাধ্য আমাদের নেই। কবিগুরুর ভাষায় বলতে পারিঃ
নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি
দেবার কিছু নাই,
আছে শুধু ভালবাসা
দিলাম আমি তাই।
পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসামের জনগণের প্রতিও আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সুদৃঢ় সমর্থন দে’য়ার জন্য আমি সোভিয়েট ইউনিয়নের সরকার ও জনগণের প্রতিও গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি যুক্তরাজ্য সরকার ও তার জনগণকে। ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমেরিকান জনগণ ও সংবাদপত্রকে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন সরকারের নীতির আমি প্রশংসা করতে পারছি না। কারণ, খুনী ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে জেনেও নিক্সন সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছেন। তাঁরা সাহায্য বন্ধ ক’রে দিয়েছেন ভারতকে। কেননা মহান ভারত আমাদের মুক্তি-সংগ্রামের প্রতি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন প্রদান করেছিলেন। আমি তাদের হুঁশিয়ার ক’রে দিচ্ছি, সাম্রাজ্যবাদের দিন শেষ হয়ে গেছে। এই ভূখণ্ডে সাম্রাজ্যবাদের খেলা আর চলবে না। ভারতের জনগণকে উদ্দেশ ক’রে আমি বলছি, এদেশের মাটি থেকে আপনারা সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প নিশ্চিহ্ন করুন। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র আমাদের দুই দেশেরই আদর্শ। এই আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে আমাদের দুই দেশের মৈত্রী। এই মৈত্রীতে ফাটল ধরানোর ক্ষমতা বিশ্বের কোন শক্তিরই নেই।
ভারতে দু’দিনব্যাপী সফরের পর বঙ্গবন্ধু ৮ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ভারতে অবস্থান কালে শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে তিনি পারস্পরিক
পৃষ্ঠা নং ~ ৯৬৪

সম্পর্ক-সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা উভয়েই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জোটনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িকতা ও উপনিবেশবাদ-বিরোধী নীতির আদর্শে বাংলাদেশ ও ভারতের সাধারণ মানুষের ন্যায্য ও গভীর আশা-আকাক্ষার বাস্তব রূপ দে’য়ার সঙ্কল্প ঘোষণা করেন।
পরিশেষে এক যুক্ত বিবৃতিতে ১৯৭২ সালের ২৫শে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা মোতাবেক ১২ই মার্চ মিত্র-বাহিনী অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেন। এই বিদায়ী কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, উপমহাদেশে শান্তি রক্ষা ও পৃথিবীর সর্বত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে সব রকম সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ও ভারত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে।

বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েট সফর
ভারত সফরের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের আরেক বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েট ইউনিয়নে সরকারীভাবে সফর করেন। ১৯৭২ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারী তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পরদিন অর্থাৎ ১লা মার্চে স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় মস্কোর ডানকোভা বিমান বন্দরে পৌঁছেন। সোভিয়েট প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য, বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী, অপেক্ষমান হাজার হাজার জনতা বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানান। রাশিয়ায় অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু রুশ-নেতৃবর্গের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন। ২রা মার্চ উভয় দেশের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ঐদিন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের হল মিলনায়তনে বক্তৃতা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এক ঘোষণায় বলেন যে, বিশ্বের যে-কোন অংশের মুক্তি-সংগ্রামের সমর্থনে বাংলাদেশের মানুষ সোভিয়েট জনগণের পাশে থাকবে।
—X—

Previous

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!