You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

আতাউর রহমান খানের পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন
প্রেসিডেন্ট শাসন তুলে নিতে বাধ্য হলেন। আওয়ামী লীগকে আবার মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানানো হ’ল। আতাউর রহমান খান ২৫শে আগস্ট (’৫৮) পুনরায় পূর্ব বাংলার নবম মন্ত্রিসভা গঠন করলেন।

আইন-সভার অধিবেশন
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দল প্রাদেশিক আইন পরিষদের স্পিকার কৃষক-শ্রমিক দলভুক্ত জনাব আবদুল হাকিমের প্রতি বিশ্বাস রাখতেন না । তাই ২০শে সেপ্টেম্বর আইন-সভার অধিবেশন বসলে সরকারী দল তাঁকে অপসারণের চেষ্টায় ব্রতী হলেন। কিন্তু হাকিম সাহেব নিজের ভুলের জন্যই বিপদ ডেকে আনলেন। আইন-সভার অধিবেশনের প্রথম দিনেই মুসলিম লীগের হাশেম উদ্দিন ৬ জন আওয়ামী লীগ সদস্যের প্রতি স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে বললেন যে, এঁদের সভাগৃহে থাকার কোন অধিকার নেই। যাঁদের উদ্দেশ ক’রে কথাগুলো বলা হয়েছিল তাঁদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনয়ন করা হয় যে, বিগত নির্বাচনে নির্বাচনী কমিশন তাঁদের নির্বাচন বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন; কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চাপে পড়ে ফিরোজ খান নুন এক অর্ডিন্যান্স জারী করে নির্বাচনী কমিশনের সিদ্ধান্তকে বাতিল ক’রে দেন এবং ঐ ছয়জন আওয়ামী লীগ নেতাকে আইন-সভায় পুনর্বহাল করা হয়। হাশেম উদ্দিনের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে স্পীকার ২৩শে সেপ্টেম্বর রুলিং দেবেন বলে ঘোষণা করলেন; কিন্তু তাঁর এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সভায় তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। স্পীকার অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্যে কয়েকজন সদস্যকে সভাকক্ষ ছেড়ে যাবার নির্দেশ দিলেন।
ফল হ’ল বিপরীত। সদস্যরা স্পীকারের নির্দেশ তো মানলেনই না, বরং এর ফলে পরিষদে শুরু হ’ল তুমুল বিক্ষোভ ও হট্টগোল। স্পীকারের আহ্বানে ই. পি. আর-এর একটি বাহিনীও সভাকক্ষের বাইরে টহল দিতে লাগলো। সকল সদস্যই তা’ লক্ষ্য করলেন। ফলে উত্তেজনা বেড়েই চললো আর এই উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সদস্য দেওয়ান মাহবুব আলী স্পীকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন, কিন্তু স্পীকার তৎক্ষণাৎ প্রস্তাবটি নাকচ ক’রে দিলেন।
পৃষ্ঠা নং: ১৮৩

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে একদল সদস্য স্পীকারের আসনের দিকে ছুটে গিয়ে উত্তেজিতভাবে বলতে লাগলেন, স্পীকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে, অতএব কালবিলম্ব না ক’রে জনাব হাকিমকে সভাকক্ষ ছেড়ে চলে যেতে হবে। আইন-সভার কর্মচারীরা স্পীকারকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলে তাদের সঙ্গে উত্তেজিত সদস্যদের হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। হাতের সামনে যিনি যা পেলেন বিপক্ষের প্রতি তিনি তাই নিক্ষেপ করতে লাগলেন। চেয়ার, টেবিল, কালির দোয়াত, মাউথ পীচ সবকিছুই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগলো। শেখ মুজিবও এই সংঘর্ষ থেকে রেহাই পেলেন না। তিনিও আহত হলেন। অবস্থা আয়ত্তে আনতে না পেরে স্পীকার আবদুল হাকিম সভাকক্ষ ছেড়ে বাইরে গেলেন। ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী।
স্পীকারের অনুপস্থিতিতে তাঁরই অধিবেশন চালানোর কথা। আর সেই জন্যই তিনি স্পীকারের শূন্য আসনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণেই কি মনে ক’রে ফিরে এসে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের পাশে বসে তিনি সভার কাজ চালাতে লাগলেন। মনোরঞ্জন ধর গ্রুপের কংগ্রেস সদস্য পিটার পল গোমেজ স্পীকার আবদুল হাকিমকে বদ্ধ উন্মাদ বলে একটি প্রস্তাব আনলে সদস্যদের ভোটে তা’ গৃহীত হ’ল। এর পরই ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী পরদিন বিকেল ৪ টায় আবার অধিবেশন বসার কথা ঘোষণা করলে কৃষক-শ্রমিক দলের ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) তাঁর দিকে উত্তেজিতভাবে এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সরকার পক্ষের সদস্যরা ইউসুফ আলীর প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি তাল সামলাতে না পেরে ভূলুণ্ঠিত হন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার স্পীকার জনাব হাকিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে চার্জশীট দাখিল করলেন।
২১শে সেপ্টেম্বর আবদুল হাকিম ও শাহেদ আলী উভয়ের অনুপস্থিতিতে স্পীকারের প্যানেলভুক্ত কৃষক-শ্রমিক পার্টির সৈয়দ আজিজুল হক আইন-সভার কাজ পরিচালনা করেন। ইতিমধ্যে সদস্যদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল যে যতদিন স্পীকার সমস্যার সমাধান না হয়, ততদিন স্পীকার বা ডেপুটি স্পীকার কেউ অ্যাসেম্ববলীতে আসতে
পৃষ্ঠা নং: ১৮৪

পারবেন না। কিন্তু সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে কিছুতেই এ বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হ’ল না। বিরোধী দল অর্থাৎ কৃষক-শ্রমিক ও মুসলিম লীগপন্থীরা অবস্থা অনুকূল নয় দেখে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে বানচাল ক’রে দেবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। স্থির করলেন, পরদিন ২৩শে সেপ্টেম্বর অধিবেশনে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে দেবেন —এতে যদি প্রেসিডেন্টের শাসনও জারী হয় তাতেও কুণ্ঠিত হবেন না। আসলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য তাঁরা মনে মনে প্রেসিডেন্টের শাসনই কামনা করছিলেন।
২৩শে সেপ্টেম্বর এগিয়ে এলো। চারিদিকে থমথমে আবহাওয়া। সরকার দল বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন, সেজন্য শাহেদ আলী নার্ভাস হয়ে পড়লেন। আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করলেন। বেলা তিনটার সময় অধিবেশন বসলো। কিন্তু সভাকক্ষের প্রাঙ্গণে দেখা গেল ই. পি. আর. ও পুলিশ বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, ইস্কান্দার মীর্জার সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক পার্টির আগে থেকেই বেশ যোগসাজস ছিল। মুসলিম লীগ তো রয়েছেই। সুতরাং পুলিশ ও ই. পি. আর. বাহিনী যে তাঁর নির্দেশে মোতায়েন করা হয়েছিল এ বিষয়ে কারো কোন তথ্য জানা ছিল না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন কোন সাংবাদিকই অধিবেশনে যোগ দিতে সাহস পান নি। স্পীকার আবদুল হাকিম দেহরক্ষী নিয়ে সভাকক্ষে ঢুকবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁকে ঢুকতেই দেওয়া হ’ল না। বিকেল ৪টার সময় শাহেদ আলী অধিবেশন-কক্ষে যোগ দিয়ে স্পীকারের আসনে বসলেন। সরকার পক্ষ তাকে Acting Speaker হিসেবে স্বীকৃতি জানালেন।
কিন্তু বিরোধী দলের সদস্য জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, আবদুল লতিফ বিশ্বাস, আবদুল মতিন, গোলাম সারোয়ার, মুহম্মদ-উন-নবী চৌধুরী প্রমুখ সমস্বরে দাবী জানালেন যে, শাহেদ আলী যেন কালবিলম্ব না ক’রে স্পীকারের আসন ত্যাগ করেন।

আইন-সভায় বিশৃঙ্খলা
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কৃষক-শ্রমিক দলের নেতা জনাব আবু হোসেন সরকার ভদ্রতার সীমা লঘন করে চীৎকার করে বলে উঠলেন, “আপনি যদি এই মুহুর্তে বেরিয়ে না যান তা’ হ’লে আপনাকে আমরা খুন
পৃষ্ঠা নং: ১৮৫

করবো, আপনার বিবি ও বাচ্চারাসহ সারা পরিবার ধ্বংস হ’য়ে যাবে।” কিন্তু শাহেদ আলী এতটুকু বিচলিত হলেন না। তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ে স্পীকারের আসনে বসে রইলেন। বিরোধী দলের সদস্যরা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে তাঁকে আক্রমণ করলেন। শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড মারামারি। হাতের কাছে যা পাওয়া গেল তাই নিয়েই চললো প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণ। শাহেদ আলী এবার সত্যই শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তিনি কি যে করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। অকস্মাৎ তাঁর প্রতি কে যেন একটি কঠিন বস্তু নিক্ষেপ করলো। গুরুতর আহত হলেন তিনি। তার ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তপাত হতে লাগলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংজ্ঞা হারিয়ে স্পীকারের আসনেই লুটিয়ে পড়লেন শাহেদ আলী।
বিরোধী কৃষক-শ্রমিক দল সভ্যতার রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে যে চরম বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার প্রত্যক্ষ বিবরণ দিতে গিয়ে জনাব আবুল মনসুর আহমদ “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” গ্রন্থের ৫৫৬-৫৫৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ “ডেপুটি স্পীকারের সভাপতিত্বে হাউস শুরু হইল। হাউস শুরু হইল মানে অপজিশন দলের হট্টগোল শুরু হইল। শুধু মৌখিক নয়, কায়িক। শুধু খালি হাতে কায়িক নয়, সশস্ত্র কায়িক। পেপার ওয়েট, মাইকের মাথা, মাইকের ডাণ্ডা, চেয়ারের পায়া, হাতল ডিপুটি স্পীকারের দিকে মারা হইতে লাগিল। শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা করিয়া প্রচুর দেহরক্ষীর ব্যবস্থা ছিল। তাঁরা খালি হাতে চেয়ারে বসা ডিপুটি স্পীকারকে অস্ত্র-বৃষ্টির ঝাপ্টা হইতে রক্ষা করিতে লাগিলেন। অপজিশনের কেউ কেউ মঞ্চের দিকে ছুটিলেন। তাদের বাধা দিতে আমাদের পক্ষেরও স্বাস্থ্যবান শক্তিশালী দু’ চারজন আগ বাড়িলেন। আমার পা ভাংগা ছিল। তাই না যোগ দিতে পারিলাম মারামারিতে, না পারিলাম সাবধানীদের মত হাউসের বাহিরে চলিয়া যাইতে। নিজ জায়গায় অটল অচল বসিয়া বসিয়া সিনেমায় ফ্রি স্টাইল বক্সিং বা স্টেডিয়ামে ফাউল ফুটবল দেখার মত এই মারাত্মক খেলা দেখিতে লাগিলাম। খেলোয়াড়দের চেয়ে দর্শক খেলা অনেক ভাল দেখে ও বুঝে। আমি তাই দেখিতে ও বুঝিতে লাগিলাম। যা দেখিলাম তাতে ভদ্রের ইতরতায় যেমন
পৃষ্ঠা নং: ১৮৬

ব্যথিত হইলাম; বুদ্ধিমানের মুর্খতায় তেমন চিন্তিত হইলাম। গণপ্রতিনিধিরা বক্তৃতা ও ভোটের দ্বারা দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করিবার দায়িত্ব লইয়াই আইন সভায় আসিয়াছেন। গুণ্ডামী করিয়া কাজ হাসেল করিতে আসেন নাই, ভাল কাজ হইলেও না। শিক্ষিত ভদ্র ও সমাজের নেতৃস্থানীয় বয়স্ক লোকেরাও কেমন করিয়া ইতরের মত গুণ্ডামী করিতে পারেন, চেনা-জানা, সু-পরিচিত, সমাজের শিক্ষিত ভদ্র সহকর্মী, ডিপুটি স্পীকারের উপর সমবেতভাবে মারাত্মক অস্ত্রের শিলাবৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে পারেন তা’ দেখিয়া আমার সারা দেহ-মন ও মস্তিষ্ক বরফের মতো জমিয়া গিয়াছিল। সে বরফের যেন উত্তাপ ছিল। আমারও রাগ হইয়াছিল। সে অবস্থায় আমার হাতে রিভলভার থাকিলে আমি নিজের আসনে বসিয়া আক্রমণকারীদের গুলি করিয়া মারিতে পারিতাম। ওরা সবাই আমার সহকর্মী, শিক্ষিত ভদ্রলোক। অনেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু। তবু তাদের গুলি করিয়া মারিতে আমার হাত কাঁপিত না।”
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আহত শাহেদ আলীকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হ’ল। পরে সরকার পক্ষের প্যানেলভুক্ত জিয়াউল হাসানকে স্পীকারের চেয়ারে বসিয়ে সভার কাজ চালানোর চেষ্টা করা হ’ল। কিন্তু বিরোধী দলের লোকেরা তথাপি হাঙ্গামা চালিয়েই যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে পুলিশের আই. জি. জনাব ইসমাইল একদল শসস্ত্র বাহিনীসহ সভাকক্ষে ঢুকে পড়ে বিরোধী দলের সদস্যদের শান্ত করতে চেষ্টা করলে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে পুলিশ সৈয়দ আজিজুল হক, ইউসুফ আলী চৌধুরী, গোলাম সারোয়ার প্রমুখ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে বাহিরে নিয়ে যান। পরে অবশ্য তাঁদেরকে জামিনে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
পরদিন ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক গভর্নর এক আদেশবলে আইনসভার বৈঠক মুলতবী ঘোষণা করলেন।

ডেপুটি স্পীকারের মৃত্যু
২৬শে সেপ্টেম্বর (’৫৮) একটি শোকাবহ ঘটনা সবাইকে বিপদগ্রস্ত ক’রে তুললো। হাসপাতালে জনাব শাহেদ আলী মৃত্যুবরণ করলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক লজ্জার এবং করুণ অধ্যায় সংযোজিত হল। আর এই মর্মান্তিক ঘটনার পর কারো অবিদিত রইল না যে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের দিন ঘনিয়ে এসেছে।
পৃষ্ঠা নং: ১৮৭

তথাপি কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী যে-কোন মূল্যে এই গণতন্ত্রকে রক্ষা করা হবে ব’লে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিলেন।
তাঁর এই প্রতিশ্রুতি দানের কথা শুনে ওদিকে ইস্কান্দার মীর্জা বোধহয় মুচকি মুচকি হাসছিলেন; কেননা তাঁর হাতে সুবর্ণ সুযোগ সত্যি সত্যি এসে গেছে। পূর্ব বাংলার রক্তারক্তি ঘটনাকে উপলক্ষ ক’রে এই মুহর্তে ডিকটেটরশীপ কায়েম করা উচিত।
কিন্তু জনাব নুনকে সরাবেন কিসের অজুহাতে? উপায় তিনি স্থির করতে লাগলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিরোধ বাধিয়ে দেবার চেষ্টায় অতঃপর তিনি বিশেষভাবে তৎপর হয়ে উঠলেন। ফিরোজ খান নুনকে তিনি নির্দেশ দিলেন যে আওয়ামী লীগ থেকে মন্ত্রিসভায় লোক নিতেই হবে। ফিরোজ খান নুনের পক্ষে এই নির্দেশ না মেনে কোন গত্যন্তর ছিল না।
সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রীর আসন না দিলে জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের সদস্যরা প্রথমে মন্ত্রিত্ব নিতে রাজী হলেন না। তবে এতে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কা ক’রে কয়েক দিন পরে সোহরাওয়ার্দী সাহেব এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। শেখ মুজিব দলের কয়েকজন সদস্য নিয়ে এই উদ্দেশ্যে করাচী রওয়ানা হয়ে গেলেন। আওয়ামীলীগের জনাব জহির উদ্দিন, জনাব নূরুর রহমান, জনাব দিলদার আহমদ, জনাব আদেল উদ্দিন আহমদ, জনাব আবদুর রহমান খান এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক কংগ্রেসের পিটার পল গোমেজ কেন্দ্রের নয়া মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। কেন্দ্রের মন্ত্রিসভা স্ফীতকায় হয়ে তার সদস্যসংখ্যা দাঁড়াল ২৬ জন। অথচ জাতীয় পরিষদে তখন সদস্যসংখ্যা ছিল মোট ৮০ জন।
স্বাভাবিকভাবেই মালিক ফিরোজ খান নুন জাতীয় পরিষদে দুর্বল হয়ে পড়লেন। কৃষক-শ্রমিক পার্টির সৈয়দ আজিজুল হক-গোষ্ঠীর নেতা হামিদুল হক তাঁর পাশে দাঁড়াতে চাইলেন, তবে তিনি অর্থ, বাণিজ্য বা শিল্প—এই তিনটির যে কোন একটি দফতরের মন্ত্রিত্ব দাবী করলেন। নুন সাহেব দলের শক্তি বৃদ্ধির কথা ভেবে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই সঙ্গে সঙ্গে তাতে রাজী হয়ে গেলেন। তাঁকে দেয়া হ’ল অর্থ দফতরের ভার।
পৃষ্ঠা নং: ১৮৮

অথচ অর্থ দফতরের ভার আগে থেকেই সৈয়দ আমজাদ আলীকে দেয়া ছিল। ব্যাপারটা সুবিধাজনক হ’ল না ভেবে তিনি আবার মন্ত্রিসভা ভেঙে নতুন ক’রে গড়লেন। সেদিন ছিল ৭ই অক্টোবর। একই দিনে দু’দুবার ভাঙলেন আর গড়লেন। গড়লেন বটে, কিন্তু তাকে আর কোন দিন কাজে লাগাতে পারলেন না। পারলেন না তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে।
পৃষ্ঠা নং: ১৮৯

সংগ্রামী জীবনের তৃতীয় অধ্যায়
(১৯৫৮-১৯৬৫)

১৯৫৮ সালকে পাকিস্তানের ইতিহাসে এক ভাগ্য-বিপর্যয়ের কাল বলে চিহ্নিত করতে হয়। ভাগ্য-বিপর্যয় নেমে এলো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ললাটে।

নতুন-মন্ত্রিসভা গঠনে সংকট
সেদিন ছিলো ৭ই অক্টোবর। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুন তখন তাঁর মন্ত্রী-পরিষদের সদস্য নির্বাচন ও দফতর বন্টনের দুরূহ কাজে গলদঘর্ম। কিছুতেই তিনি শেষ মীমাংসায় উপনীত হ’তে পারছিলেন না। তার কারণ, তাঁর দলের এককভাবে কোনরূপ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। যুক্তফ্রন্টের অধীনে তাঁকে মন্ত্রীপরিষদ গঠন করতে হয়েছিল, কিন্তু কোয়ালিশন দলের প্রতিটি সদস্যই মন্ত্রী হতে চান। নুন সাহেবও কাউকে অসন্তুষ্ট করতে সাহস পাচ্ছেন না। আগেই বলা হয়েছে যে, বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় আইন-পরিষদের ৮০ জন সদস্যের ২৬ জনকেই মন্ত্রিত্বের পদ দিতে হয়েছিল। এমন কি একই দফতর দু’জনকে দেবার মত কেলেঙ্কারীও তিনি করেছিলেন। ফলে সেদিন সেই অক্টোবরে মালিক নুনকে দু’দু’বার মন্ত্রিসভার রদবদল করতে হয়েছে। এর কারণ এই যে, ঐদিন সকাল বেলায় প্রধান মন্ত্রী নুন তাঁর মন্ত্রিসভার যে দফতরগুলো পুনর্বণ্টন করেছিলেন তাতে
পৃষ্ঠা নং: ১৯০

আওয়ামী লীগ-পন্থী মন্ত্রীদের ভাগে কতকগুলো গুরুত্বহীন পদ দেয়া হয়েছিল। এবং এরই প্রতিবাদে তাঁরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
বাধ্য হয়ে সেদিনই সন্ধ্যেবেলায় আবার দফতরগুলোর রদবদল করতে হয়। কিন্তু এতেও আওয়ামী লীগের প্রতি সুবিচার করা হ’ল না। অবশ্য এবার আওয়ামীলীগ পন্থীরা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গণতন্ত্রের স্থায়িত্বের স্বার্থে,নুন-মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করলেন না। কারণ তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন, ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রিসভার যদি পতন ঘটে তাহলে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাগ্য-বিপর্যয় ঘটবে।

মন্ত্রিসভা গঠন সম্পর্কে শেখ মুজিব
সেদিন এই সংকটপূর্ণ মূহর্তে আওয়ামী লীগের কর্ণধার শেখ মুজিবুর রহমান করাচীতে বলেছিলেনঃ
“পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বন্টন নিয়ে প্রধান মন্ত্রী ফিরোজ খান নুন তাঁর নিজের দলের মধ্যে প্রচণ্ড বাধা ও চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই বাধা এত প্রবল এবং এমনই ধরনের যে, এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের আর মন্ত্রিসভায় থাকা নিরর্থক, কিন্তু এ সত্ত্বেও আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে নুন সরকার থেকে আমাদের সমর্থন প্রত্যাহার ক’রে নিয়ে আমরা দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কোন সুযোগ প্রতিক্রিয়াশীলদের দেবো না।”
[গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশঃ মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিবঃ অমিতাভ গুপ্ত, কলিকাতা, ১৯৭৩, পৃঃ ৩১৯]
কিন্তু এতদসত্ত্বেও নুন সাহেবের শেষরক্ষা হ’ল না। তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকবার দুর্বার লোভ ধ্বসে গেল। কারণ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন (Martial Law) জারী করে তাঁর মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেন। এবং সেই সঙ্গে চলতি সংবিধানও নাকচ ক’রে দিলেন তিনি। মীর্জা এর জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। আর মীর্জার পশ্চাতে একজন জাঁদরেল সৈনিক। সৈনিকের পশ্চাতে পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য। পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বিলুপ্ত হ’ল। সৃষ্টি হ’ল পাকিস্তানের ইতিহাসে এক জঘন্যতম এবং অন্ধকারময় অধ্যায়। সেদিন ছিল ৭ই অক্টোবর, ১৯৫৮ সাল।
পৃষ্ঠা নং: ১৯১

সেদিনের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মঞ্চস্থ নাটকেরও একটি নেপথ্য কাহিনী রয়েছে, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপদান করেছিলেন পাকিস্তানের কালো দশকের একচ্ছত্র অধিপতি জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান।
আইয়ুব খান কিভাবে নেপথ্যে থেকে ধীরে ধীরে এই নাটকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন তার ব্যাখ্যা তিনি আত্মজীবনীতেই দিয়েছেনঃ “দিনটি ছিল ৪ঠা অক্টোবর, ১৯৫৮ সাল। আমি আমার রেলগাড়ির সেলুনের মধ্যে যখন অবস্থান করছিলাম, তখন জানতাম যে, শীঘ্রই দেশে একটা যুগ শেষ হয়ে আসছে। আমি করাচী যাচ্ছিলাম। সেখানে একটি মর্মন্তুদ সুদীর্ঘ রাজনৈতিক প্রহসন ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছিল। মাত্র কয়েকদিন পূর্বে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, পরিস্থিতি অসহ্য হয়ে উঠেছে এবং তিনি কর্মপন্থা গ্রহণ করা স্থির করেছেন। বহু বৎসর ধরে আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে, দেশের রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের গুরুদায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হবেন। তাঁদের মধ্যে দেশপ্রেমিক লোক ছিলেন, গুণবান এবং দক্ষ ব্যক্তিও ছিলেন এবং কায়েদে আযমের সেই সব নিকট-সহচররাও ছিলেন যাঁরা দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং অনঢ় সংকল্প নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। পরবর্তীকালেও তাঁরা দেখেছিলেন, কি করে লিয়াকত আলী খান দৃঢ়তা এবং সাহসিকতার সাথে রাষ্ট্রীয় অর্ণবপোতকে অশান্ত স্রোতের মধ্য দিয়ে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছিলেন। সার্কাসের দড়াবাজদের মত এক এক সময় এক এক জন লাফ দিয়ে মধ্যের দোলনার আড়টিকে ধরে ফেলে একটু ঝুলে উজ্জ্বল বাতির আলোকের মধ্যে এসে উপস্থিত হচ্ছিলেন, আবার পর মূহূর্তে ষড়যন্ত্র ও সামর্থ্য হীনতার জালের মধ্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন।”
[ সৈয়দ আলী আহসান অনূদিত ‘প্রভু নয় বন্ধু’, ঢাকা, ১৯৬৮ পৃঃ ৯০]
এবং সেই সাথে সাথে আইয়ুব খান যে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল পরিকল্পনার ছবি মনে মনে আঁকছিলেন, তা’ না বললেও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেমণে তা’ ধরা পড়ে। আর সে পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার গোপন উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি পরদিন অর্থাৎ ৫ই অক্টোবর গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার নিকট। আইয়ুব খান নিজেই লিখেছেনঃ
পৃষ্ঠা নং: ১৯২

“I arrived in Karachi on 5th October. Yahya, Hamid and one or two other officers had proceeded me. I went to see General Iskandar Mirza. He was sitting on the lawn, brooding, bitter and desperate. I asked him, “Have you made up your mind, Sir?” “Yes,” he replied. “Do you think it is absolutely necessary?” “It is absolutely necessary”, he said, firmly. My reaction was that it was very unfortunate that such a desperate stage had been reached, necessitating drastic action. And it was not pleasant to get involved in it, but there was no escape. It was the last bid to save the country.”
Friends Not Masters: Mohammad Ayub Khan, Ox. Un. Press, 1967, P. 70.]

সামরিক আইন জারী
দু’জনে অনেক শলাপরামর্শ করলেন। তারপর দেশকে ‘রক্ষার’ খাতিরে ৭ই অক্টোবর রাত আটটায় নাটকীয়ভাবে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী ক’রে দিলেন। আইয়ুব খানকে নিযুক্ত করা হ’ল প্রধান সামরিক আইন পরিচালক (Chief Martial Law Administrator), পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন পরিচালক হলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জি. ও. সি মেজর জেনারেল ওমরাও খান।
অথচ সেদিনই—সামরিক আইন জারীর কিছু পূর্ব মুহূর্তে সন্ধ্যা বেলায় ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রিসভার সদস্যদের আপ্যায়নের জন্য মীর্জা তার করাচী বাসভবনে একটি রঙিন তরল পানীয়ের পার্টির আয়োজন করেছিলেন। আয়োজন করেছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে সুগম করবার জন্য। গণতন্ত্রকে নিয়ে কি নিষ্ঠুর পরিহাস!
আইয়ুব খান,আটঘাট বেঁধেই প্রধান সামরিক আইন পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন—যাতে ক’রে কোনরূপ সমালোচনার সম্মুখীন যেন তাঁকে না হতে হয়। এর জন্য তিনি মীর্জা সাহেবের কাছ থেকে লিখিতভাবে কয়েকটি শর্তও আদায় করে নেন। এই শর্তের মূল কথা হ’ল—সমস্ত ঘটনা যেন মীর্জা সাহেবের একক সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতি বলে ঘোষণা করা হয়—এতে তাঁর (আইয়ুবের কোন ভূমিকা নেই।
পৃষ্ঠা নং: ১৯৩

এইমর্মে আইয়ুব খান ফিরোজ খান নুনের কাছে ইস্কান্দার মীর্জাকে দিয়ে একটি চিঠিও লিখিয়ে নেন। চিঠিটি হুবহু এখানে উদ্ধৃত হলঃ
President’s House
Karachi,
7th October, 1958
My dear Sir Firoze,
After very careful searching of the heart, I have come to conclusion that the country cannot be sound unless I take full responsibility and take over the administration. The constitution of the 3rd March, 1956 is not only unworkable but dangerous to the integrity and solidarity of Pakistan. If we go on trying to work it, we will have to say good bye to Pakistan.
As head of the state, therefore, I have decided to abrogate the Constitution, take over all powers, dissolve the Assemblies, the Parliament and the central and provincial Cabinets. My only regret is that this drastic revolutionary action I have to take while you were Prime Minister. By the time you get this letter, Martial-Law will come into operation and General Ayub, whom I have appointed as the Chief Martial-Law Administrator, will be in position.
For you personally, I have great regard and will do all that is necessary for your personal happiness and well-being.
Yours sincerely,
Iskandar Mirza.
[ গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশঃ মুক্তি সৈনিক শেখ মুজিব, অমিতাভ গুপ্ত, পৃঃ ৩২৪]
সেদিন পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন করাচীতে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) প্রমুখ নুন-
পৃষ্ঠা নং: ১৯৪

মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচনের আলোচনা বৈঠকে যোগদানের জন্য ওখানে গিয়েছিলেন। আতাউর রহমানও কয়েকদিন আগে ইকোনমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ে যোগ দিতে গিয়ে করাচীতে অবস্থান করছিলেন। শুধুমাত্র নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কৃষক-শ্রমিক পার্টির হামিদুল হক চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের আবুল মনসুর আহমদ সাহেব ঢাকায় ছিলেন।
সামরিক আইন জারীর খবর পেয়ে সবাই হতচকিত হয়ে পড়লেন। মনসুর সাহেব দৌড়িয়ে গেলেন প্রাদেশিক গভর্নর সুলতান উদ্দিন আহমদ সাহেবের বাসায়। গভর্নর সাহেবও তাঁর পরিণাম সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। জানতেন না তাঁর ভাগ্যবিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথা।
শেখ মুজিব জানতে পারলেন ৮ই অক্টোবর ভোরবেলা। আগের দিন অর্থাৎ ৭ই অক্টোবর রাতে তিনি ঢাকার পথে আকাশে উড়েছিলেন। পরদিন তেজগাঁ বিমান বন্দরে নামতেই সহকর্মী বন্ধুরা সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্র তাঁর সামনে তুলে ধরলেন। কাগজ থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেখানে জমাট বাঁধা অন্ধকার মেঘ। আরো দেখলেন পূর্বদিক থেকে একটা ঝড়ের প্রচণ্ড বেগ সে অন্ধকার মেঘকে গ্রাস করার জন্য ছুটে আসছে। আপন অন্তরেও তিনি অনুভব করলেন এক সুউষ্ণ অথচ চঞ্চল গতিবেগ।
এরপর কি ঘটতে পারে শেখ সাহেবের তা’ অজানা ছিল না। তিনি জানতেন—অচিরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হবে। কারণ রাজনৈতিক নেতাদের কারাপ্রাচীরের বাইরে রেখে কোন দেশে নিশ্চিন্তে মিলিটারী ডিকটেটরশীপ চালানো সম্ভবপর নয়। অতএব, তাঁকেও কারাগারে যেতে হবে। তার আগে বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করার পালা শেষ করা দরকার। কে জানে আবার কতদিনের জন্যে তাঁকে সমাজসংসারের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে। অতএব বাড়ীর দিকেই রওয়ানা দিলেন তিনি।
যথাসময়ে প্রাদেশিক গভর্নর সুলতান উদ্দিন আহমদের ভাগ্যের পতন ঘটল। নতুন একজন গভর্নর হয়ে এলেন, নাম—জাকির হোসেন। ভদ্রলোক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর কৃপায় একদা প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের ডি.আই. জি. হতে পেরেছিলেন-যে পদ ব্রিটিশ
পৃষ্ঠা নং: ১৯৫

রাজত্বে ভারতীয়দের পক্ষে ছিল বিলাসী বাসনা। দেশ বিভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলার আই. জি. পুলিশ হয়েছিলেন। পরে সে পদ থেকে অবসর নেবার পর খাজা নাজিমুদ্দিনের হাতেপায়ে ধরে পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তার নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যখন তিনি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করছিলেন—সে সময় তাঁর হঠাৎ খায়েশ হয়েছিল যে, তিনি রাজনীতি করবেন। সে উদ্দেশ্যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের কাছে এসে তাঁকে গুরুজ্ঞানে আওয়ামী লীগে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ ক’রে আগামী ইলেকশনের নমিনেশনের পদপ্রার্থী হলেন। খান সাহেব সে বিষয়ে কোনরূপ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে সম্পূর্ণ অক্ষমতার কথা প্রকাশ করেছিলেন।
এই সেই জাকির হোসেন—যিনি কয়েক মাস আগে সংসদ সদস্যের নমিনেশনের জন্য আওয়ামী লীগের নিকট ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে গিয়েছিলেন—তিনি হলেন প্রদেশের হর্তা-কর্তা-বিধাতা।
তাঁর এই গভর্নর পদ প্রাপ্তিরও একটি কারণ আছে। জাকির হোসেন যখন পুলিশের আই. জি. ছিলেন, তখন আইয়ুব খানও ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের জি. ও. সি. । এ সময় এই দুই ভবিষ্যৎ নেতার মধ্যে বেশ দহরম-মহরম গড়ে উঠেছিল। আইয়ুব খান প্রধান সামরিক-প্রশাসক হয়েই পুরানো বন্ধুর কথা স্মরণ করলেন। তিনি যখন ইস্কান্দার মীর্জার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছিলেন, তখনই এই জাকির সাহেবকে তলব করেন। জাকির হোসেনই একমাত্র ভাগ্যবান বাঙালী যিনি আইয়ুব-ইস্কান্দারের গোপন চক্রান্ত সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন।
জাকির হোসেন গভর্নর হয়েই পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। এ নির্দেশ হয়তো তিনি আইয়ুব খানের কাছ থেকেই পেয়ে থাকবেন। যদিও প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা কয়েকদিন পরে এক প্রশ্নোত্তরে এ গ্রেফতারের জন্য প্রাদেশিক সরকারের ইচ্ছানুযায়ী হয়েছে বলে জানিয়েছেন। ঢাকায় পাইকারীভাবে এই গ্রেফতার চললো। ১০ই অক্টোবর রাত দশটার সময় আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের বাসায় গিয়ে তার সারা বাড়ী তছনচ করে বে-আইনীভাবে তাঁকে গ্রেফতার
পৃষ্ঠা নং: ১৯৬

করা হ’ল। গ্রেফতার করার সময় ভারপ্রাপ্ত অফিসার তাঁকে জানান যে, তাঁকে নিরাপত্তা আইনে নয়—দুর্নীতি দমন আইনে গ্রেফতার করা হচ্ছে ।

শেখ মুজিবসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার
মনসুর সাহেবের মত পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতাকেই গ্রেফতার করা হ’ল। বলা বাহুল্য, শেখ মুজিবও বাদ পড়লেন না। বাদ পড়লেন না বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানীও। মওলানা সাহেবকে গ্রেফতার করা হয় ৮ তারিখে। তিনি নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন, হামিদুল হক চৌধুরী, প্রাক্তন সোহরাওয়ার্দী ক্যাবিনেটের শ্রমমন্ত্রী জনাব আবদুল খালেক, শিল্প দফতরের সেক্রেটারী জনাব আসগর আলী শাহ সি.এস.পি., পি.ডব্লু.ডি. এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার জনাব মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, বাণিজ্য দফতরের আণ্ডার সেক্রেটারী জনাব আমিনুল ইসলাম সি.এস,পি, আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রাক্তন পরিষদ সদস্য জনাব নুরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
শেখ সাহেব ও মনসুর সাহেবসহ এদের সবাইকে এস. ডি. ও. সাহেবের এজলাসে হাজির করা হলে তাঁরা বে-আইনীভাবে আটকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জামিনের আবেদন পেশ করলেন। কিন্তু এস. ডি. ও. সাহেব সে আবেদন নাকচ করে দেন। ফলে সবাইকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের পুরোনো হাজতে বন্দী ক’রে রাখা হ’ল।
মার্শাল-ল’ জারী করার কয়েকদিন পরেই জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ঢাকায় এলেন। উদ্দেশ্য—সামরিক শাসন জারীর প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অবহিত হওয়া। তাঁর সম্মানে হোটেল শাহবাগে একটি নাগরিক সম্বর্ধনার আয়োজনও করা হয়েছিল।
ওদিকে আইয়ুবকে সামরিক প্রশাসক-এর প্রধান করার পর থেকে ইস্কান্দার মীর্জার চোখের ঘুম ছুটে গিয়েছিল। তিনি ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলেন, অবস্থাচক্র তত সহজে মোড় নিল না। আইয়ুব খানকে অনুগত রেখে পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হবার বাসনা ছিল তাঁর। কিন্তু আইয়ুব সব কিছুতেই হুকুমদারী শুরু ক’রে দিয়েছিলেন। তা’ ছাড়া তাঁর কার্যকলাপেও মীর্জা সাহেবের মনে সন্দেহের উদ্রেক হ’ল।
পৃষ্ঠা নং: ১৯৭

বাধ্য হয়ে আইয়ুব খানকে সরাবার মতলব আঁটলেন তিনি। বিমান বাহিনীর কমান্ডারের কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইলেন মীর্জা সাহেব। মতলবটা আইয়ুব খানের অগোচরে থাকল না। তিনি তখন ঢাকায় -তাড়াতাড়ি ছুটে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সামরিক বাহিনীর অফিসারেরাও মীর্জা সাহেবের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানকে উসকিয়ে দিলেন। আইয়ুব একবার ইস্কান্দার মীর্জার কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক ক’রে দিয়ে এলেন।

ইস্কান্দার মীর্জার মন্ত্রিসভা গঠন
অবস্থা বেগতিক দেখে মীর্জা সাহেব তাঁর শেষ চাল চাললেন। কতিপয় সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারকে হাত করার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁদেরকে মন্ত্রিত্বের পদের উৎকোচ দিয়ে ২৫শে অক্টোবর একটি মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, -রইলেন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তিনি এবং প্রধানমন্ত্রী করলেন জেনারেল আইয়ুবকে। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার সে মন্ত্রিসভায় যাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল তারা হলেনঃ
প্রধানমন্ত্রী—জেনারেল আইয়ুব খান
অন্যান্য মন্ত্রীঃ
১। পুনর্বাসন মন্ত্রী-লেঃ জেনারেল আযম খান।
২। স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী লেঃ জেনারেল এ. বাকী
৩। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী—লেঃ জেনারেল কে. এম. শেখ
৪। শিল্প ও পূর্ত মন্ত্রী—আবুল কাশেম খান
৫। শিক্ষা ও তথ্য মন্ত্রী হাবিবুর রহমান
৬। পররাষ্ট্র মন্ত্রী—মনজুর কাদির
৭। আইন মন্ত্রী—বিচারপতি মহম্মদ ইব্রাহীম
৮। যোগাযোগ মন্ত্রী-এফ. এম. খান
৯। অর্থ মন্ত্রী-মোহাম্মদ শোয়েব
১০। কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রী-হাফিজুর রহমান
১১। বাণিজ্য মন্ত্রী-জুলফিকার আলী ভুট্টো।
কিন্তু এতেও ইস্কান্দার মীর্জা শেষরক্ষা করতে পারলেন না। পারলেন না তাঁর প্রেসিডেন্টের পদকে টিকিয়ে রাখতে। ২৭শে অক্টোবর
পৃষ্ঠা নং: ১৯৮

ইস্কান্দার মীর্জার ভাগ্যবিপর্যয়
ইস্কান্দার মীর্জা আইয়ুব খান ও তাঁর মন্ত্রিসভাকে শপথ গ্রহণ করান। কিন্তু শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দুই ঘন্টা পর মীর্জা সাহেব দেখতে পেলেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আইয়ুব খানের তিন সৈনিক দূত। অতএব, ইস্কান্দার মীর্জাকে ক্ষমতা ছাড়তে হল। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হ’ল তাঁকে। দস্তখত লিখে দিতে হ’ল যে, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন। এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে আইয়ুব খানের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করছেন। শুধু পদত্যাগই নয়, আইয়ুবের নির্দেশে পরে সপরিবারে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন।

আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল
২৭শে অক্টোবর মধ্যরাত্রি থেকে আইয়ুব খান পাকিস্তানের স্বনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়ে বসলেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজেকে সামরিক বাহিনীরও সর্বাধিনায়ক বলে ঘোষণা করলেন। সারা দেশে তার সামরিক অবস্থানকে মজবুত করা হ’ল। আইয়ুব খান ক্ষমতায় গিয়েই রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোগার করতে শুরু ক’রে দিলেন। তাঁরা দুর্নীতিপরায়ণ তাঁরাই যে দেশটাকে সমূলে ধ্বংস করতে বসেছিলেন একথা তিনি জোরের সাথে চিৎকার ক’রে বলতে লাগলেন। এবং আরো বললেন, রাজনৈতিক নেতাদের নির্মূল না করলে দেশকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।
বলা বাহুল্য, এটা তাঁর ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবার একটা চাল মাত্র। এ ব্যাপারে জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য আইয়ুব খান কতকগুলো পদক্ষেপও গ্রহণ করলেনঃ
।। এক ।। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দোকানদার-ব্যবসায়ীদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত ক’রে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক করা হ’ল।
।। দুই ।। দুর্নীতি দমনের নামে মারপিট ও গ্রেফতার করা হ’ল। এই উদ্দেশ্যে আইন জারী ক’রে প্রশাসনিক ও ব্যবসায়ী ক্ষেত্রে কিছু রদবদল ঘটানো হ’ল।
।। তিন ।। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেন। বারবার বলতে লাগলেন-গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত ক’রে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবেন।
পৃষ্ঠা নং: ১৯৯

স্বভাবতঃই আইয়ুব খানের এইসব কার্যকলাপ ও প্রতিশ্রুতি প্রদানে জনগণ তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন ক’রে ফেলল। বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় তিনি প্রাথমিকভাবে বেশ কিছুটা জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন।
এর কারণও আছে। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক কোন্দল এ দেশের জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে যুক্তফ্রন্টের নেতাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এই মুহর্তে আইয়ুব খানের আকস্মিক কার্যকলাপেও তাঁর কথাবার্তায় বিশ্বাস ক’রে পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই অভিনন্দন জানাল। জনগণের একটি অংশ এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও দেশের বিবেকবান বুদ্ধিজীবী ভবিষ্যতের দুর্যোগময় দিনগুলোর কথা চিন্তা ক’রে শিউরে উঠলেন। যাহোক, সুযোগ বুঝে আইয়ুব খান তাঁর জাল ফেলতে শুরু করলেন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে আগেই নিষিদ্ধ ক’রে দেয়া হয়েছিল। এবার সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ ক’রে দেয়া হ’ল। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৫৯ সালের ৭ই আগস্ট দুটো আইনও জারী করলেন।
।। এক ।। পাডো (Public Office Disqualification Order)
।। দুই ।। এবডো (Elective Bodies Disqualification Order) ।
এই আইনের আওতাভুক্তদের মধ্যে জনাব হোসেন শহীদ সোহরীওয়ার্দীও ছিলেন।
এর পরবর্তী ঘটনাগুলোতে জনগণের তন্দ্রা ছুটে গেল। আস্তে আছে পরিষ্কার হতে থাকল যে, আইয়ুব খানের আসল উদ্দেশ্য কোন পথে।

মৌলিক গণতন্ত্র
২৬শে অক্টোবর (’৫৯) জেনারেল আইয়ুব খান নিজেকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে ঘোষণা করলেন। পরদিন অর্থাৎ ২৭শে অক্টোবর তিনি পালন করলেন তাঁর “বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী” । আর এই বার্ষিকী উপলক্ষে পেশ করলেন একটি মহান (?) পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাকে তিনি অভিহিত করেছেন Basic Democracy বা বুনিয়াদী গণতন্ত্র নামে। তিনি সদম্ভে ঘোষণা করলেন, ‘It has come to stay’ —অর্থাৎ এই গণতন্ত্র টিকে থাকতেই এসেছে।
পৃষ্ঠা নং: ২০০

আইয়ুবের এই নবপ্রবর্তিত গণতন্ত্রের প্রণয়নকারী হলেন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশিষ্ট অধ্যাপক। আইয়ুব খান তাঁর ক্ষমতাকে স্থায়ী ক’রে রাখবার জন্য উক্ত অধ্যাপকদের কাছে পরামর্শ চান—তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই অদ্ভুত গণতন্ত্র প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়।
নির্দিষ্ট সময়ে এই মৌলিক গণতন্ত্রের আদেশ জারী করা হ’ল। খান সাহেবের চেলারা এ আদেশকে স্বাগত জানিয়ে খুব হৈ-চৈ শুরু করে দিল। এই গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য হ’ল—যেহেতু পাকিস্তানের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত এবং যেহেতু পাকিস্তান একটি গরম ও গ্রীষ্মপ্রধান দেশ, সেহেতু এদেশের মানুষ সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের গুরুত্ব উপলবৃদ্ধি করতে অক্ষম। তারা শুধু স্থানীয় এলাকা থেকে একজন করে উভয় প্রদেশে মোট ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত করতে পারবেন। এবং ঐ আশি হাজার গণতন্ত্রীই নির্বাচিত করবেন দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য।
এই গণতন্ত্রের প্রবর্তনের ফলে বিভিন্ন প্রশাসন সংস্থা ও তার কর্মকর্তাদের পদের নাম পরিবর্তন করা হ’ল। যেমন, ইউনিয়ন বোর্ড হল ইউনিয়ন কাউন্সিল, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড-ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল, প্রেসিডেন্ট হলেন চেয়ারম্যান ইত্যাদি।
আইয়ুব খান ক্ষমতা হাতে নেয়ার সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি দেশে গণতন্ত্র দেবেন—তবে সে গণতন্ত্র কোন পদ্ধতির হবে সে বিষয় তিনি একবারও উচ্চারণ করেন নি। এক্ষণে তাঁর প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র (?) প্রদান করলেন।
ওয়াদা করেছিলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। সে উদ্দেশ্যে (!) তিনি ১৯৬০ সালের ১১ই জানুয়ারীতে একটি সাধারণ নির্বাচনও দিলেন। এতে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হ’ল। নিন্দুকেরা বলতে থাকলো ৮০ হাজার ফেরেশতা পয়দা করা হ’ল।
এর পর মৌলিক গণতন্ত্রীরা একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করলেন। কিন্তু কাকে? আইয়ুব সবিনয়ে বললেন, যদি আপত্তি না থাকে তা হলে আমিই ‘জনপ্রতিনিধিত্বশীল’ সরকারের প্রেসিডেন্ট হতে পারি।’ অর্থাৎ
পৃষ্ঠা নং: ২০১

তাঁর প্রতি আস্থা আছে কি-না তা’ জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে জানতে চাইলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি উভয় প্রদেশে ব্যাপক গণসংযোগ অভিযান চালালেন। ১৯৬০ সালের ২১শে জানুয়ারীতে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন।
আসলে আইয়ুব খানের এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল মৌলিক গণতন্ত্রীদেরকে বোঝানো যে, এই গণতন্ত্র তাঁদেরকে কি সুবিধা দিতে পারে। পরবর্তীকালে আইয়ুব খানের এই শাসন-ব্যবস্থা তাদেরকে কি সুবিধা দিয়েছিল তা’ যথাসময়ে আলোচনা করা যাবে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রহসন
১৪ই ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হ’ল! তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। ছিল না কারণ সে রকম কোন সুযোগ তিনি দেন নি। মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশ ছিল শুধুমাত্র তাঁর প্রতি আস্থা আছে কি-না তা ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’-সূচক ব্যালটের মাধ্যমে বক্তব্য রাখতে হবে।
স্বাভাবিকভাবেই ‘হ্যাঁ’ এর আস্থাভাজন হয়েছিলেন তিনি। মৌলিক গণতন্ত্রীরা জানতো, ‘না’ এর বাক্সে ভোট দিলেও আইয়ুব খানের কোন ক্ষতি হবে না। কারণ তাঁকে নির্বাচিত না করা হলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা থেকে সরাবার সাহস কারো হবে না, উপরন্তু তাঁরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। আইয়ুব খান এই নির্বাচন প্রহসনে শতকরা ৯৫ ভাগ ভোট পেলেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারীতে তিনি প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। পরদিন জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট দেশকে একটি শাসনতন্ত্র দেবার কথা ঘোষণা করলেন।
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি শাসনতন্ত্র কমিশন গঠন করা হ’ল। যার অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী। বিচারপতি চৌধুরী তখন ঢাকা হাইকোর্টের একজন প্রথিতযশা আইনজীবী ছিলেন।

আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন
আইয়ুব খানের এই নয়া শাসনতন্ত্র সম্পর্কে কিছু বলে রাখা ভাল। যদিও এই শাসনতন্ত্র তৈরীর জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল,
পৃষ্ঠা নং: ২০২

তবু কমিশনের সদস্যরা দেশ ও জাতির পক্ষে যা কল্যাণকর তার
উপযোগী শাসনতন্ত্র তৈরী করতে পারেন নি। কমিশন জনমত যাচাই ক’রে পার্লামেন্টারী ধরনের শাসন ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলেন। ১৯৬১ সালের ২৯শে এপ্রিল তাঁদের রিপোর্ট সই করে ৬ই মে তা’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের নিকট অনুমোদনের জন্য দেয়া হ’ল। কিন্তু আইয়ুবের তা’ মনঃপূত হ’ল না। না হবারই কথা। কারণ এতে তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাই শাসনতন্ত্র কমিশনের এই রিপোর্ট বানচালের উদ্দেশ্যে তিনি একটি ‘ক্যাবিনেট সাবকমিটি’ গঠন করলেন- যাতে ক’রে তাঁর একাধিপত্যকে বজায় রাখা যায়।
এই ক্যাবিনেট সাবকমিটির পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যবৃন্দ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ইচ্ছানুযায়ী প্রেসিডেন্সিয়াল ধরনের সরকারের পক্ষেই ওকালতি করতে লাগলেন। এঁদের মধ্যে বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো, মঞ্জুর কাদির ও মোহাম্মদ শোয়েব-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু উক্ত কমিটির অন্যতম সদস্য কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানবাসী বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম তীব্র মতপার্থক্যের সম্ভাবনাকে এড়ানোর জন্য উক্ত কমিটির বৈঠকে যোগ না দিয়ে রাওয়ালপিণ্ডি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন।
এ সময় (মে, ১৯৬১) পূর্ব বাংলায় এসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বাঙালীদের জন্য মুখে বেশ দরদ প্রকাশ করলেন। এবং তাদের যাবতীয় সমস্যাবলীর আশু প্রতিকারের জন্য পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করলেন। এরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। কারণ তিনি জানতেন যে, এ অঞ্চলের লোকেরা তাঁর প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসনতন্ত্র সহজভাবে গ্রহণ করবে না। আর গ্রহণ না করার অর্থই পূর্বাঞ্চলে আন্দোলন গড়ে ওঠা। বাঙালীদের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। কারণ ১৯৪৮ সালে কায়েদে আযমকে যখন চরমভাবে অপমান ক’রে বাঙালীরা ভাষার জন্য চারদিকে আগুন জ্বালিয়েছিল, আইয়ুব খান তখন ঢাকাতেই ছিলেন। বাঙালীর আন্দোলনকে তাঁর বড় ভয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আইয়ুব খান যখন ঢাকায় এলেন তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন লেঃ জেনারেল আযম খান—যিনি
পৃষ্ঠা নং: ২০৩

ইস্কান্দার মীর্জা কর্তৃক ঘোষিত আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন। জাকির হোসেন সাহেব হলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। গভর্নর থাকাকালীন আযম খান পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিকতা ও সহানুভূতিশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নিজে একজন উর্দুভাষী হয়েও বাঙালীদের সাথে তিনি একাত্ম হয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। আর এটাই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়াল। তাঁর জনপ্রিয়তায় আইয়ুব ঈর্ষান্বিত হলেন—ফলে তাঁকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হ’ল। তিনি ১৫ই এপ্রিল, ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬২ সালের ১১ই মে পর্যন্ত এই দু’বছর মাত্র পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। এই দু’বছরে তিনি বাঙালীর হৃদয় জয় করেছিলেন। এবং তাঁর বিদায়ের সময় জনগণ তাঁকে অশ্রুভারাক্রান্ত নেত্রে বিদায় দিয়েছিল।
আইয়ুব খান ঢাকায় এসে প্রাদেশিক গভর্নরদের একটি কনফারেন্সে শাসনতন্ত্রের চূড়ান্ত খসড়াটি অনুমোদন করলেন এবং ঘোষণা করলেন যে, ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ থেকে দেশের নয়া শাসনতন্ত্র চালু করা হবে। আরো ঘোষণা করা হ’ল যে এপ্রিল মাসে (১৯৬২) জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং জুন মাসে সামরিক আইন উঠে যাবে।
সোহরাওয়ার্দী তখনও জেলের বাইরে। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসেন হাইকোর্টে মামলা-মোকদ্দমার সওয়াল করতে। তবে ১৯৬০ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী তাঁর বিরুদ্ধে যে ‘এবডো’ নোটিশ জারী করা হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। শহীদ সাহেব প্রথমে এটাকে মেনে নিতে পারছিলেন না, ফলে তাঁকে ট্রাইব্যুনালের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যদিও ট্রাইব্যুনালে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন, তথাপি তাঁকে ‘এবডো’র আওতা থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হয় নি।

শেখ মুজিবের মুক্তি
ইতিমধ্যে ১৪ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করলেন। মুক্তি দেয়ার সময় তাঁর বিরুদ্ধে কতকগুলো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। যেমন ঢাকা ত্যাগ করলে তাঁকে গন্তব্য সম্পর্কে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে
পৃষ্ঠা নং: ২০৪

জানাতে হবে এবং প্রত্যাবর্তনের পরেও একইভাবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে।

শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা
তা’ ছাড়া গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশ সব সময় তাঁর পেছনে ছায়ার মত থাকতো। এ বিষয়ে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে সতর্ক করে দিলেও তিনি তা’ উড়িয়ে দিতেন। জনগণের কাছে শেখ মুজিবকে হেয় করার উদ্দেশ্যে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে অপমানজনক কয়েকটি মামলাও দাঁড় করালেন। শেখ মুজিব মন্ত্রী হিসেবে সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার বা নিজের পদমর্যাদার বলে আর্থিক সুবিধা অর্জন করেছেন, এই অভিযোগের ভিত্তিতে আনীত মামলা থেকে ঢাকা বিভাগের স্পেশাল জজ এ. এস. এম. রাশেদ তাঁকে অব্যাহতি দিলেন। এই মামলায় শেখের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তারিখটি ছিল ১৯৫৯ সালের ৩০শে মে।
এর পরে ১২ই জুলাই লেঃ কর্নেল আই. এ. শামিমের সভাপতিত্বে গঠিত চার নম্বর স্পেশাল মিলিটারী কোট শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি ও দুর্নীতিতে সহায়তা করার মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার অভিযোগে ঐ মামলার অন্যতম সাক্ষী আল আমিন ইণ্ডাস্ট্রির পার্টনার আনোয়ার আলী ও মুজিবর রহমান চৌধুরীকে যথামে চার ও দু’ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে আসামীরা স্বীকার করেন যে, পুলিশের প্রচণ্ড চাপে পড়েই তাঁরা শেখের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা বিচারপতির কাছে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে করুণা ভিক্ষাও করেছিলেন।
এরপরও শেখ মুজিব রেহাই পেলেন না। ১৯৫৯ সালের ২২শে আগস্ট ঢাকা জেলার ডিস্ট্রিক্ট এবং সেশান্স জজ আবদুল মওদুদের আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারী পদমর্যাদা অপব্যবহারের মামলা হয় এবং এই মামলায় জজ সাহেব ১২ই সেপ্টেম্বরে তাঁকে দু’বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানায় (অনাদায়ে আরো ছয় মাস জেল) দণ্ডিত করেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক তৎপরতা
এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব হাইকোর্টে আপীল পেশ সাপেক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন জানালে ২০শে সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের
পৃষ্ঠা নং: ২০৫

বিচারপতি জনাব ইদ্রিস অবকাশকালীন বেঞ্চে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। এর পরে ২১শে জুন (১৯৬১) ঢাকা হাইকোর্টে বিচারপতি আসির ও বিচারপতি আলীকে নিয়ে গঠিত এই মামলার শুনানী ডিভিশন বেঞ্চে আরম্ভ হয়। ঐদিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখের পক্ষে পাঁচ ঘন্টা ধরে সওয়াল করেন। আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র চালু, নির্বাচন ও মার্শাল-ল’ জারীর ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে সারা দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া বেশ গরম হতে শুরু করেছে। যদিও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল, তথাপি তাঁর পক্ষে আর নিস্ক্রিয় থাকা সম্ভবপর হ’ল না। তিনি আসন্ন রাজনৈতিক পটভূমিকায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বঙ্গের নেতাদেরকে এক গোপন বৈঠকের আহ্বান জানান। এই আহ্বানের ফলে ১৯৬২ সালে ২৪শে জানুয়ারী রাত্রে জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে শেখ মুজিবুর রহমান, হামিদুল হক, তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আবু হোসেন সরকার, মাহমুদ আলী, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) প্রমুখ উপস্থিত হয়ে আলোচনা শুরু করেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব এই বৈঠকে দলমত নির্বিশেষে সব বিভেদ-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এক আদর্শের ভিত্তিতে সংগ্রাম করার আহ্বান জানালে সকল নেতাই তা’ সমর্থন করলেন। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল যে গোপনে তাঁদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রচার করতে হবে।

সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে গণবিক্ষোভ
পরদিন সোহরাওয়ার্দী করাচী গেলেন। কথা ছিল, সাতদিন পর তিনি ঢাকায় ফিরে এসে এ ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে কাজ চালাবেন। কিন্ত তার আগেই ৩০শে জানুয়ারী (১৯৬২) তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে সারা প্রদেশে আগুন জ্বলে উঠল। সরকারী মহলে টনক নড়লো। স্বয়ং আইয়ুব খানকেও এই গ্রেফতারের সাফাই গাইতে হ’ল। তিনি বললেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেব নাকি পাকিস্তানের প্রতি শত্রু মনোভাবাপন্ন শক্তিদের সাহায্যে দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করছিলেন।
পৃষ্ঠা নং: ২০৬

আইয়ুবের ঢাকা আগমন ও ছাত্র বিক্ষোভ
কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ কোন কথাই শুনতে রাজী নয়। তরুণ ছাত্র-সমাজ রাস্তায় নেমে পড়লো। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তখন ঢাকায়। পহেলা ফেব্রুয়ারীতে তিনি এখানে এসেছেন। তাঁর উপস্থিতিতেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। এই প্রথম দেশে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠলো। বলা বাহুল্য, এই আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সোহরাওয়ার্দীরই সুযোগ্য শিষ্য শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুরের ওপর যে সকল বাধা-নিষেধ ছিল তিনি তাঁর কোন পরোয়াই করলেন না।
এই আন্দোলনের ফলে নিদিষ্ট সময়ের এক মাস আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রমজানের ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। ফেব্রুয়ারীর ৬ তারিখে ছাত্ররা এক সভা ক’রে এর প্রতিবাদ জানালো। প্রতিবাদ সভার পর ছাত্ররা সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল সহকারে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করলেন। শুধু তাই নয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ছবিকেও পদদলিত করলেন ও তাতে অগ্নি সংযোগ করলেন। পরদিন ৭ই ফেব্রুয়ারী ঢাকাসহ প্রদেশে পূর্ণ হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হ’ল।

শেখ মুজিব গ্রেফতার
কিন্তু শেখ মুজিব আর সে হরতালে নেতৃত্ব দিতে পারলেন না। তার আগেই অর্থাৎ ৬ই ফেব্রুয়ারীর গভীর রাতে ‘পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে’ তাঁকে আটক ক’রে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হ’ল। এটা যে আইয়ুব খানের নির্দেশেই হয়েছিল তা’ বলাই বাহুল্য।
শেখের সঙ্গে আর যাদেরকে গ্রেফতার করা হ’ল তাঁরা হলেনঃ জনাব আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন (বর্তমানে মোজাফফর ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট), জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), কোরবান আলী, শ্ৰী ফণীভূষণ মজুমদার, আবদুর রব সেরনিয়াবত প্রমুখ।
এর ফলে ৭ই ফেব্রুয়ারীর গণবিক্ষোভ আরো দানা বেঁধে উঠল। এক বিরাট মিছিলের পর হোলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে পুলিশ মিলিটারীর একটি বিরাট বাহিনী কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে ও লাঠি
পৃষ্ঠা নং: ২০৭

চার্জ করে। এতদসত্ত্বেও বিক্ষোভকারীরা দমে যান নি। তাঁরা তেজগাঁও এয়ারপোর্টে আইয়ুবের সম্মানে নির্মিত একটি তোরণও ভেঙে ফেলে দিয়েছিলেন।
এলো ২১শে ফেব্রুয়ারী। শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা জেলের ভিতর থেকেই ভাবগম্ভীর পরিবেশে শহীদ দিবস উদযাপন করলেন। যথা সময়েই ১লা মার্চে (১৯৬২) আইয়ুব খানের নয়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হ’ল। আতাউর রহমান খান লিখেছেনঃ “এক হাজার নয়শ’ বাষট্টি সালের পয়লা মার্চে হিজরী মোতাবেক এক হাজার তিনশ’ একাশি সনের তেইশে রমজান আইয়ুব খান প্রণীত শাসনতন্ত্র ভূমিষ্ঠ হ’ল।”
[ স্বৈরাচারের দশ বছরঃ আতাউর রহমান খান, পৃঃ ১৯৮]

আইয়ুবের নয়া শাসনতন্ত্র
আল্লাহর নামে শুরু ক’রে ও নিজের নামে শেষ ক’রে আইয়ুব ভুমিকা দান করেনঃ “এক হাজার নয়শ’ বাষট্টি সালের ফেব্রুয়ারী মাসের…তারিখে পাকিস্তানের জনগণ আমাকে যে ম্যান্ডেট দিয়েছে তারই বলে বলীয়ান হয়ে পাকিস্তানের উত্তরোত্তর অগ্রগতি লাভ, বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসন গ্রহণ, আন্তর্জাতিক শান্তি, মানবতার কল্যাণ সাধনে পাকিস্তানের জনগণের যথাযোগ্য সহায়তা প্রদান ইত্যাদি শুভ ইচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে আমি অমুক, হিলালে পাকিস্তান, হিলালে জুরঅত, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অদ্য তারিখে এই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিলাম।
এক ব্যক্তির দেওয়া শাসনতন্ত্র! পাকিস্তানের জনগণের উল্লেখ অবান্তর। তারা কোন ম্যান্ডেট দেয় নাই।”
[ স্বৈরাচারের দশ বছরঃ পূঃ ১৯৮]
এই শাসনতন্ত্রের প্রধান দু’টো বৈশিষ্ট্য হলঃ
(১) সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। দেশের সর্বময় কর্তা প্রেসিডেন্ট—তিনি সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী।
(২) জনগণের ওপর পূর্ণ অনাস্থা। তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে দেশের সর্বময় ক্ষমতাধিকারী প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনের অধিকার জনগণের নেই। সরকার কতিপয় দালাল সৃষ্টি ক’রে দেবে—তারাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে।
পৃষ্ঠা নং: ২০৮

আইয়ুবের এই শাসনতন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে আতাউর রহমান খান যথার্থই লিখেছেনঃ “গণতন্ত্রের বহির্বাস বহাল করা হয়েছে। অন্তর অসার। কেন্দ্রে ও প্রদেশে পরিষদ হবে। তাদের অধিবেশনও হবে। সেখানে বক্তৃতা, তর্কবিতর্ক, প্রশ্নোত্তর সবই হবে। তার জন্য আইন-কানুনও প্রণীত হবে। অর্থাৎ সংবাদপত্রের খাদ্য পুরোপুরি থাকবে। পরিষদে সব বিষয়ের আলোচনা হবে। এমনকি বাজেটেরও। কিন্তু তার উপর ভোটাভুটি চলবে না। স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ পরিষদ রবার স্ট্যাম্প, পঙ্গু ও ক্লীব। তবুও……সদস্যদের মান-মর্যাদা আছে। পদাধিকার আছে। বেতন আছে। ভাতা আছে। রাহা খরচও আছে। আপখোরাকী নয়। মন্ত্রিমণ্ডলীর থাকারও ব্যবস্থা আছে ……তাদের গাড়ী-বাড়ী থাকবে। আরদালী চাপরাশিও থাকবে। থাকবে না শুধু ক্ষমতা। ক্ষমতা থামবে প্রেসিডেন্টের হাতে এবং তাঁরই হুকুমে গভর্নর ও কর্মচারীরা ক্ষমতার অধিকারী হবেন।”
[ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৮-১৯৯]
স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরাচারী আইয়ুবের এই শাসনতন্ত্র পূর্ব বাংলার জনগণ মেনে নিতে পারলেন না। ১৫ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সমাজ এই শাসনতন্ত্রের প্রতিবাদে ধর্মঘট করলেন। মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত একটি সভায় এই শাসনতন্ত্রের দু’টি কপি ভস্মীভূত করা হ’ল। সরকার ও শাসনতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপে আইয়ুব খান পূর্ব বাংলাবাসীদের উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। এই প্রথম বাঙালীদের বিরুদ্ধে তিনি মুখ খুললেন।
২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মূল তিনদফা দাবীর ভিত্তিতে পুনরায় অনিদিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘট শুরু করলেন। দাবীগুলো হ’লঃ
(১) নয়া শাসনতন্ত্র অবিলম্বে বাতিল কর;
(২) দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম কর;
(৩) সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দাও। ছাত্ররা মিছিল করে যখন শহর প্রদক্ষিণ করছিলেন সে সময় পুলিশ তাঁদের উপর কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং দু’শ সাতজন ছাত্রকে আটক করা হয়। বারোদিন ধর্মঘট পালন করার পর ৪ঠা এপ্রিল ছাত্রগণ তা’ সাময়িকভাবে তুলে নেন। এপ্রিলের ১৪ তারিখে আতাউর রহমান খান,
পৃষ্ঠা নং: ২০৯

নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী প্রমুখ সাতজন নেতা একটি যুক্ত বিবৃতিতে আটককৃত রাজবন্দী ও ছাত্রদের মুক্তি দাবী করেন।

পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচন
ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, নয়া শাসনতন্ত্রের অধীনে ২৮শে এপ্রিল (১৯৬২) পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ছাত্র-সমাজ এই নয়া শাসনতন্ত্রের অধীনে নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দও এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রদেশের প্রতিক্রিয়াশীল কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা- যারা পরবর্তীকালে আইয়ুব খানের সাকরেদ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন—তাঁরা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলেন। এঁদের অধিকাংশই প্রাক্তন মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
প্রদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ অংশ গ্রহণ না করায় মুসলিম লীগের প্রার্থীরা সহজেই জয়লাভ করলেন। এদের মধ্যে বগুড়ার মোহম্মদ আলী, হাবিবুর রহমান, সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবুল কাশেম খান, আবদুল মোনেম খান প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

শেরে বাংলার মৃত্যু
নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগের দিন সারা বাংলার বুকে এক শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৭শে এপ্রিল (১৯৬২) শুক্রবারে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেরে বাংলা ফজলুল হক ৮৮ বৎসর ৫ মাস ২৮ দিন বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি নাকি প্রতি মুহূর্তে বিলাপ করে বলতেনঃ “আল্লাহ! যে দেশে আমার ভোট নেই, সে দেশে বাঁচার ইচ্ছা আমার নেই। আমাকে তুমি তুলে নাও।”

আইয়ুব খানের প্রথম মন্ত্রিসভা
নির্বাচনের পর ১৯৬২ সালের ৮ই জুন আইয়ুব খানের মার্শাল-ল’ উঠে গেল। ঐ একই দিনে মার্শাল-ল’ উঠে যাওয়ার পর-পরই জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ নয়া শাসনতন্ত্রের অধীনে শপথ গ্রহণ করলেন। এর কয়েকদিন পর অর্থাৎ ১৩ই জুন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করলেন। এতে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, আবদুস সবুর খান,
পৃষ্ঠা নং: ২১০

ফজলুল কাদের চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কালের কুখ্যাত গভর্নর আবদুল মোনেম খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে আইয়ুবের মন্ত্রিসভায় স্থান পেলেন।
মার্শাল-ল’ উঠে যাবার পর অবৈধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলগুলোর স্বভাবতঃই বৈধ হবার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যেই ছাত্রসমাজের আন্দোলন দিন দিন জোরালো হতে লাগল। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলো পুনরুত্থিত হ’লে তার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলন আরও জোরদার হবে—তার ফলে প্রেসিডেন্টের গদি থেকে তিনি স্থানচ্যুত হতে পারেন—এই আশঙ্কায় আইয়ুব ১০ই মে (১৯৬২) “The Political Organization (Prohibition of Unregulated Activities) Ordinance of 1962” নামে একটি অর্ডিন্যান্স জারী করলেন। এতে বলা হ’ল যে, আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত দেশে যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ থাকবে।

শেখ মুজিবসহ কয়েকজন বিশিষ্ট নেতার মুক্তি
১৯৬২ সালের ১৮ই জুনের সকালে শেখ মুজিব মুক্তি পেলেন। তার আগে তাজউদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমদ,
কে, জি, মোস্তফা প্রমুখ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক মুক্তি পেয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক নয় নেতার বিবৃতি
শেখ মুজিব মুক্তি পাওয়ার পর পরই আবার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অনিবার্য পতন থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য তিনি আতাউর রহমানসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। গভীর আলাপ আলোচনার পর পূর্ব বাংলার শীর্ষস্থানীয় কতিপয় নেতা সংবাদপত্রের মাধ্যমে এক জোরালো বিবৃতি দান করেন। এই বিবৃতি Nine Leader’s Statement বা নয় নেতার বিবৃতি নামে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৬২ সালের ২৪শে জুন এই বিবৃতি দেয়া হয়, পরদিন ২৫শে জুন তা’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর দানকারীদের অন্যতম আতাউর রহমান লিখেছিলেনঃ “এই বিবৃতিই ছিল তৎকালে পাকিস্তানী জনগণের আশা-আকাঙক্ষার প্রতিধ্বনি।”
বিবৃতিতে বলা হ’লঃ “সত্যিকার গণ-প্রতিনিধি ছাড়া কোন ব্যক্তি
পৃষ্ঠা নং: ২১১

শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার অধিকারী নয়। করলে তা’ স্থায়ী, সহজ ও কার্যকরী হতে পারে না। জনগণ সার্বভৌম—এই হচ্ছে গণতন্ত্রের সারকথা। জনগণই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। এই ইচ্ছার স্বতঃস্ফুর্ত বাধা-বিঘ্নমুক্ত ও অবাধ বিকাশের একান্ত প্রয়োজন।
শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় গণ-প্রতিনিধির লক্ষ্য থাকে যাতে কালের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য ক’রে শাসনতন্ত্র টিকে থাকতে পারে এবং সম্ভাব্য বাধা-বিপত্তি ও সঙ্কটমুক্ত হয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে- এমন একটি শাসনতন্ত্র রচনা করা।
শাসনতন্ত্রকে স্থায়িত্বের বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ও গুণসম্পন্ন হতে হ’লে সমগ্র জাতির ইচ্ছা ও বিচারবুদ্ধির প্রতিফলন অবশ্যই থাকতে হবে। এই পদ্ধতিতে প্রণীত বিধানগুলোই বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভাবী বংশধরদের মনে অকৃত্রিম আনুগত্য ও আবেগের প্রেরণা দিতে পারে। এই আনুগত্য ও আবেগই শাসনতন্ত্রের প্রধান অবলম্বন ও দুর্ভেদ্য বর্মবিশেষ। জনমতের উপর নির্ভর না ক’রে বাইরে থেকে চাপানো শাসনতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে জনসমর্থন লাভ করতে পারে না।
বর্তমান শাসনতন্ত্রে এই গুণাবলী না থাকায় এটা অন্তঃসারশূন্য। যতই প্রচার করা হোক না কেন, জনমতের প্রতি উপেক্ষা ও অনাস্থাই হচ্ছে এই নয়া শাসনতন্ত্রের ভিত্তিভূমি। আট কোটি (তখন যা ছিল) জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র আশি হাজারকে দেয়া হয়েছে ভোটের অধিকার। আবার এই অতি কমসংখ্যক ভোটারের ভোটে নির্বাচিত যে পরিষদ তাকে সত্যিকার কোন ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। মাত্র তিন সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, আমূল পরিবর্তন না করলে এই শাসনতন্ত্র কাজের অনুপযোগী।
সরকারী নীতি ও কার্যকলাপ নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতা সদস্যদের না থাকার ফলে শুধুমাত্র সরকারের তীব্র ও চরম সমালোচনার মাধ্যমে সদস্যরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে প্রলুদ্ধ হবে। যোগ্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিরা এই ধরনের সরকারে যোগ দিতে কোন আগ্রহবোধ করবে না। ফলে শাসন-ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিষ্প্রাণ আমলাতন্ত্রের হাতের মুঠোর মধ্যে গিয়ে পড়বে।
পৃষ্ঠা নং: ২১২

যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিশেষ সংস্থা গঠন ক’রে, দেশবাসী বিনাদ্বিধায় গ্রহণ করতে পারে, এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার আহবান আমরা জানাই। ছয় মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব বলে আমরা মনে করি। শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্সিয়াল না পার্লামেন্টারী হওয়া উচিত, সে প্রশ্নের জবাব আমরা এখন দিতে চাই না। তবে দেশের জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ পার্লামেন্টারী ধরনের সরকার কায়েমের পক্ষপাতী; কেননা বহুকাল ধরে ঐ ধরনের শাসন-পদ্ধতির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেছে এবং তার অভিজ্ঞতা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শাসনতন্ত্র ফেডারেল বা য়ুনিটারী হবে, এ প্রশ্নেরও জবাবের প্রয়োজন হবে না। বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ফেডারেল শাসনতন্ত্রই গ্রহণযোগ্য হবে; এতে সন্দেহের অবকাশ নাই। একটি জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান করা একান্ত কর্তব্য। সেটা হচ্ছে দুই অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও উন্নয়নমূলক বৈষম্য। উভয় অংশের জনগণের সদিচ্ছার অভাব নাই। তাই আমরা মনে করি গণপ্রতিনিধিদের সত্যিকার দায়িত্বভার দিলে, তারা সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কার্যে মনোযোগ দেবে আর অনুন্নত অঞ্চলগুলোর দিকে অধিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, এটা সুনিশ্চিত।
এতকাল ধরে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে জনগণের কোন কথা বলার সুযোগ না থাকায় সঙ্কীর্ণমনা ও শ্রেণী-স্বার্থের রক্ষকদের হাতে পড়ে দুই অংশের ভেতর উন্নয়ন ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে পড়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে একবার যদি রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমত প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে, তা’ হ’লে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও কায়েমী স্বার্থের দিন শেষ হয়ে যাবে। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক ব্যাপারে সত্যিকার রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ার সুযোগ পায় নাই বললেই চলে। এই সব কারণেই দুই অঞ্চলে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আজাদী লাভের পর সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার সমাবেশ হয়েছিল মুষ্টিমেয় সরকারী অফিসারদের হাতে। তার উপর দেশে একটিও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়ার ফলে জনগণ রাষ্ট্র চালানোর ব্যাপারে কথা বলার সুযোগই পায় নাই। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালে কি করণীয়, সেটাই হচ্ছে
পৃষ্ঠা নং: ২১৩

গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার ফলে দেশে যে সদিচ্ছার উদ্ভব হয়েছে, তাকে আরও জোরদার ক’রে তোলার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার। জনসাধারণ ও সরকারী শাসনতন্ত্রের ব্যবধানের প্রাচীর আর গড়ে উঠতে দেওয়া হবে না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের দায়িত্ব অপরিসীম। আমরা আশা করি, তিনি এটা বুঝতে অক্ষম নন।
আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতি মতে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়া সাপেক্ষে দেশের সরকার পরিচালনার কাজও চালিয়ে যেতে হবে।
তাই আমাদের প্রস্তাবঃ উনিশ শ’ ছাপান্ন সালের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো নয়া শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত করে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত করতে হবে।
যে পরিষদ বর্তমান বিধান অনুযায়ী গঠিত হয়েছে তার উপর সরকারের আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। লাভজনক পদবন্টন ক’রে ভাগ্যবান সদস্যদের দিয়ে পরিষদগৃহ ভর্তি করার আসক্তি বর্জন করতে হবে। তা’ না হ’লে যে ক্ষীণমাত্র স্বাধীনতা পরিষদের আছে তা’ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একথা ভুললে চলবে না যে, বিশ্বাসেই বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।
সরকারের উপর জনগণের আস্থা যাতে ফিরে আসে তার জন্য বিনা বিচারে আটক সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত যাবতীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বাতিল ক’রে দিতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু। দেশে অবাধে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার পথে যত কিছু বাধা অন্তরায় আছে তার অবসান ঘটাতে হবে। দেশের সকলকে সমবেতভাবে এইসব সমস্যা সমাধানের কাজে এগিয়ে আসতে হবে। দেশ একটি বিরাট পরীক্ষার মুখে। এক অস্থির অবস্থায় দেশ সম্মুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
আমাদের শেষ আহ্বান—আসুন, সকলে মিলে যতশীঘ্র সম্ভব শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ক’রে সমস্ত বিতর্ক বন্ধ করে দেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাবার এক দুর্জয় সংকল্প নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করি।”
[ স্বৈরাচারের দশ বছর, পৃঃ ২২০-২২৩]
এই বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন তাঁরা হলেন, আওয়ামী লীগ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রূহমান খান, কৃষক-শ্রমিক পার্টি থেকে
পৃষ্ঠা নং: ২১৪

হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক, পীর মোহসীন উদ্দিন আহমদ, মুসলিম লীগ থেকে ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), নুরুল আমীন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে মাহমুদ আলী।
এই নয় নেতার বিবৃতি সারা বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি করে। কায়েমী স্বার্থবাদী ও কুচক্রীদের জঘন্য হস্ত থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার আবেদন জানিয়ে দৈনিক হাজার হাজার অভিনন্দন বাণী বর্ষিত হতে থাকে। মানুষ আবার নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনায় উল্লসিত হয়ে ওঠে।
কায়েমী স্বার্থবাদীরা আতঙ্কিত না হয়ে পারলো না। তাদের মুখপাত্র ডন, মনিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে তারা নয় নেতার উদ্দেশে গালাগালি দিতে শুরু ক’রে দিল। উপহাস ও বিদ্রুপের বাণে জর্জরিত করতে চাইলো। সবুর খান তো নয় নেতার বিবৃতিকে ‘ব্যাবিলনের নয়জন জ্ঞানীর বিবৃতি’ বলে ব্যঙ্গোক্তি করতে লাগলেন। তাঁদের নেতা আইয়ুব খানও কম গেলেন না। বিবৃতি তাঁকে যথেষ্ট বিব্রত করলেও তিনি ‘ধিকৃত রাজনীতিক’দের উদ্দেশে ‘নিমকহারামী’র অভিযোগ এনে যাচ্ছে তাই গাল দিলেন। আতাউর রহমান লিখেছেন-“এটা স্বাভাবিক। ক্রোধের উচ্ছ্বাস, ভয়েরও। রাজনীতিকরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, দেশের জনগণ তাঁদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য। তা’ হলেই খাঁ সাহেবের স্বপ্ন ভেঙে যায়। নিরাপদে সিংহাসনে বসে দশকোটি মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেজে আছেন। এসব ভেঙে পড়ে ধুলিস্যাৎ না হয়ে যায় এই চিন্তায় তিনি অধীর হয়ে উঠলেন।”
[প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৪]
সরকারের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও এই বিবৃতির সমর্থনে নেতৃবৃন্দ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভা করলেন। সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানালেন। তারপর চট্টগ্রাম, বরিশাল, টাঙ্গাইল, সিলেট প্রভৃতি জায়গায় জনসভা ক’রে দেশবাসীকে আন্দোলনের আহবান জানালে- তারা অকুণ্ঠচিত্তে সাড়া দেয়। ভবিষ্যতের বিরাট সম্ভাবনাময় সুখ-সমৃদ্ধির রঙিন ছবি তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সোহরাওয়ার্দী তখন
পৃষ্ঠা নং: ২১৫

করাচীর কারাগারে নিঃসঙ্গ বন্দী অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছিলেন। দু’ একজন বন্ধুস্থানীয় নেতা তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে সাক্ষাৎ করলে তিনি আন্তরিক সমর্থন জ্ঞাপন করলেন। নেতৃবৃন্দের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল।
সরকার এই গণ-ঐক্য ভাঙ্গবার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। কিভাবে ভাঙ্গা যায়? চেলা-চামুণ্ডাদের কাছ থেকে আইয়ুব খান পরামর্শ চাইলেন। ওঁরা একবাক্যে পরামর্শ দিলেন—সরকার-বিরোধীদের বিরুদ্ধে একটা সংগঠন শক্তি গড়ে তোলা হোক। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক দল যে নিষিদ্ধ। তাতে কি? আবার পুনরুজ্জীবিত করা হোক। এতে যে ওরাই জেগে উঠতে পারে? ‘কুছ পরোয়া নেহি’। ওদের প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ একটি নতুন অর্ডিন্যান্স জারী করতে হবে।
অতএব, ৩০শে জুন সরকার রাজনৈতিক দল গঠন সম্পর্কে Political Parties Bill (1962) নামে একটি বিল জাতীয় পরিষদে উত্থাপন করেন। এই বিলে বলা হ’ল ইসলামী আদর্শ ও পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী মতামত প্রচার বা কার্যকলাপ চালানোর উদ্দেশ্যে কোন দল গঠন করা যাবে না। এবডো, প্রাডো আইনে বা অন্যায় কারণে অযোগ্য ঘোষিত রাজনীতিবিদরা কোন দল গঠন করতে বা দলের সদস্য হতে পারবেন না।
এই বিলটির মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত রাখবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এতে বিন্দুমাত্র দমলেন না। জুলাই মাসের ৮ তারিখে পল্টন ময়দানে নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে নেতৃবৃন্দ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। এই সভায় শেখ মুজিব আবেগময়ী ভাষায় সরকারের তীব্র সমালোচনা ক’রে বললেন, “স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যারা ইংরেজ-প্রভুদের গোলামী করেছিল, তারাই আজ দেশের ভাগ্যবিধাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।” শেখ মুজিব এবডোসহ সকল কালা-কানুন বাতিল ক’রে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী প্রমুখ রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দাবী করলেন। ঐ সভায় আতাউর রহমান খান বলেছিলেন, “এই শাসনতন্ত্র চাই না। এই শাসনতন্ত্র পুড়িয়ে ফেলতে হবে-
চাঁড়ালের হাত দিয়ে পোড়াও পুস্তিকা।
ভস্মরাশি ফেলে দাও কীর্তিনাশা জলে।”
পৃষ্ঠা নং: ২১৬

পরদিন ১ই জুলাই (১৯৬২) প্রকাশিত দৈনিক আজাদ এই জনসভা সম্পর্কে লিখেছেন—“প্রায় চার বছর পর অতীতের বিভিন্নমুখী দলীয় শক্তি-পরীক্ষার কেন্দ্রস্থল পল্টন ময়দান আবার বিপরীত নীতি ও মতবাদের সমর্থক বিভিন্ন সাবেক রাজনৈতিক দলের যৌথ সমাবেশে বক্তৃতার শব্দ সম্ভারে মুখরিত হয়ে উঠে।” ১৪ই জুলাই Political Parties Bill জাতীয় পরিষদে গৃহীত হ’লে এর পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব ২০শে জুলাই সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আবদুল গফফার খানের অনুপস্থিতিতে (তাঁরা সবাই তখন জেলে আটক ছিলেন) কোন রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত করা সমীচীন নয় বলে উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগপন্থী জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব কামরুজ্জামান সাহেব সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলোচনা করতে করাচী জেলে গেলে শহীদ সাহেবও Political Parties Bill-এর আওতায় এবং অগণতান্ত্রিক পরিবেশে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিপক্ষে মত দেন।

সোহরাওয়ার্দীর মুক্তিলাভ
১৯শে আগস্টের (১৯৬২) সন্ধ্যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচী সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি পান। এর আগে নাকি সরকার পক্ষের দু’একজন তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই দেখা করাকে নিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা অনেক আজগুবি কথা বলে বেড়াতে লাগলেন। তিনি নাকি আর রাজনীতি করবেন না, এরূপ দস্তখত লিখে দিয়েই মুক্তি পেয়েছিলেন। আরো বলে বেড়াতে লাগলেন যে, শহীদ সাহেব নাকি নয় নেতার বিরুদ্ধেও নানারূপ কটূক্তি করেছেন। এসব কথা তখন দালাল খবরের কাগজগুলোর মুখ্য বিষয়বস্তু।

ঢাকা বিমান বন্দরে সোহরাওয়ার্দীর ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা
এর সত্যতা সম্বন্ধে প্রমাণ পাওয়া গেল অচিরেই। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য প্রায় মাসখানেক করাচীতে বিশ্রামের পর ১৬ই সেপ্টেম্বর বেলা ১-৪৫ মিনিটের সময় তিনি ঢাকার মাটিতে পা দেন। বিমান ঘাঁটিতে তাঁকে যে অপূর্ব ও অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আতাউর রহমান খান লিখেছেন, “লক্ষ লক্ষ লোক পাঁচ-সাত ঘন্টা আগে থেকেই সমস্ত বিমানঘাঁটি দখল ক’রে বসে রইল। যখন প্লেন
পৃষ্ঠা নং: ২১৭

এলো—তখন প্লেনটি নির্ধারিত স্থানে নামতে না পেরে বহুদূরে অবতরণ করে। সেখান থেকে বিমানঘাঁটিরই একটা গাড়ী ক’রে তাঁকে নামিয়ে আনা হ’ল। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই তিনি ঘোষণা করলেন, নয় নেতার বিবৃতির ফলে দেশে নয় কোটি নেতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে তিনি খুব আনন্দিত। এত নেতা এককালে দুনিয়ার কোন দেশে দেখা যায় নাই। পশ্চিম পাকিস্তানেও অদ্ভুত সাড়া জেগেছে। তারা নেতৃত্বের জন্য চেয়ে আছে পূর্ব পাকিস্তানের দিকে। এটাই সূর্যোদয়ের দিক।
লক্ষ কণ্ঠের জিন্দাবাদে বিমান বন্দর ফেটে পড়ার মত হয়ে গেল। কথায় কথায় শহীদ সাহেব হেসে বললেন, “আমিও নয় নেতার সামিলে। আমার নম্বর দশ।”
[ স্বৈরাচারের দশ বছর, পৃঃ ২৩৫]
পরদিন ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সাল। এ দিনটি বাংলার রাজনীতিতে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী দিন। শিক্ষা সংস্কারের নামে তোগলকি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর উদ্দেশ্যে ছাত্র-সমাজ সেদিন সারা দেশে হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ঢাকার ছাত্ররা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল ও অন্যান্য কয়েকটি গণতান্ত্রিক দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। আইয়ুব খান তখন ঢাকায় ছিলেন। ঐ দিনই তিনি ঢাকা কার্জন হলে গেলেন ভাষণ দিতে। কিন্তু প্রচণ্ডভাবে তাড়িত হলেন তিনি। ছাত্ররা একযোগে তাঁর বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে উঠলো। ক্রুদ্ধ অপমানিত জেনারেল আইয়ুব কোন ভাষণ না দিয়েই হল থেকে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু ছাত্রদেরকে শায়েস্তা করার নির্দেশ দিতে ভুললেন না তিনি। পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো ছাত্রদের ওপর। প্রচণ্ড যুদ্ধ হ’ল। শেষে পুলিশ উপায়ান্তর না দেখে গুলী বর্ষণ করে। এতে তিনজন নিহত এবং দু’শতাধিক ছাত্র-জনতা আহত হন। অগণিত ছাত্র-জনতাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। তবুও অকুতোভয় ছেলেরা তা ভঙ্গ করে এবং আইয়ুবের কুশপুত্তলিকা দাহ ক’রে তার সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করে। এই রক্তঝরা দিনটিকে ছাত্ররা পরবর্তী কালেও ভুলে নি। প্রতি বৎসর এই দিনটির স্মরণে ছাত্র-সমাজ
পৃষ্ঠা নং: ২১৮

‘ছাত্র দিবস’ হিসেবে পালন ক’রে আসছেন। এই হামলার প্রতিবাদে ২৯শে সেপ্টেম্বর সারা প্রদেশে পালিত হ’ল সাধারণ ধর্মঘট ও দমননীতি দিবস। সরকারী পুলিশের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও গ্রেফতারের নিন্দা করেন মুজিব ও সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয়, শেখ মুজিব এবং অন্য আট নেতা তৎকালীন গভর্নর গোলাম ফারুকের কাছে গিয়ে এর তীব্র প্রতিবাদও জানিয়ে এলেন।

জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন
দেশের লুপ্ত গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ একটি দলহীন ঐক্য সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এর নাম হবে National Democratic Front বা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম পাকিস্তানে গেলেন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন।

শেখ মুজিবের লাহোর যাত্রা
কিছুদিন পর ২৪শে সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খানসহ পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জন নেতা একই উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে লাহোরে গেলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের আরো কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ তাঁরা গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের জন্য সেপ্টেম্বরের ২৫, ২৬ ও ২৮ তারিখে পর পর তিনটি জনসভার আয়োজন করেছিলেন।

সোহরাওয়ার্দীর প্রাণনাশের চেষ্টা
কিন্তু আইয়ুবের গুণ্ডাদের আক্রমণে তাঁরা সফলকাম হতে পারেন নি। শুধু তাই নয়, গুজরানওয়ালায় জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যখন সোহরাওয়ার্দী গাড়ী থেকে নামছিলেন, তখন আইয়ুবের কতিপয় ভাড়াটে গুণ্ডা তাঁর দিকে লক্ষ্য করে গুলী ও বোমা ছুঁড়ে মারলো। আকস্মিকভাবে সেদিন তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
অবশেষে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম ক’রে ১৯৬২ সালের ৪ঠা অক্টোবর, বৃহস্পতিবার জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এর ৫৪ জন নেতৃবৃন্দের নাম ঘোষণা করা হ’ল। এতে পাকিস্তানের দু’অংশের বিভিন্ন দল ও মতের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনঃ পূর্ব বাংলার- শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান, মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখ। দু’দিন পর নুরুল আমীনও যোগ দেন
পৃষ্ঠা নং: ২১৯

পশ্চিম পাকিস্তানের—মওলানা আবুল আলা মওদুদী, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, আইয়ুব খুরো, জেড. এইচ, লারী প্রমুখ। এই সংস্থায় যেসকল রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছিল, সেগুলো হল—আওয়ামী লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামাতে ইসলাম।
পাকিস্তানী শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রীকরণের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী অক্টোবরের ৬ তারিখে ঢাকায় এলেন। পরদিন নুরুল আমীনের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে সোহরাওয়ার্দীর জীবননাশের অপচেষ্টার প্রতিবাদে এক জনসভা হয়। এতে শহীদ সাহেব স্বয়ং উপস্থিত হয়ে এক স্মরণীয় ভাষণ দেন। সেদিন তিনি বিরাট জনসমুদ্রকে উদ্দেশ ক’রে প্রশ্ন করেন— “আপনারা গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা চান কি-না?” লক্ষ লক্ষ জনতা সমস্বরে গর্জে উঠেন— “চাই—চাই।”
১১ই অক্টোবর থেকে শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে অবিশ্রান্তভাবে প্রদেশের প্রতিটি জেলায় জনসভা ও বক্তৃতা দিয়ে বেড়ালেন।

মোনেম খানের আবির্ভাব
ঠিক এই মুহুর্তেই পূর্ব বাংলার ভাগ্যাকাশে অভিশাপের কালো ছায়া হয়ে আবির্ভূত হন মোনেম খান। আইয়ুব তাঁকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। দীর্ঘ সাতটি বছর প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনকে তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। জনগণের স্বার্থকে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপে পদদলিত করেন। বাংলার ইতিহাসে তিনি এক ধিকৃত ব্যক্তিত্ব।
আইয়ুবের নির্দেশিত প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যথন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন তখন এই কুখ্যাত মোনেম খান সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। সাধারণ বটতলার উকিল আইয়ুবের আশীর্বাদে হলেন একজন কীর্তিমান পুরুষ ‘—প্রথমে জাতীয় পরিষদের সদস্য। সদস্য হয়েই তিনি রাতারাতি একেবারে নেতা বনে গেলেন। সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করলেন।
পৃষ্ঠা নং: ২২০

তিনি সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবকে জাতির ও দেশের শত্রু বলে অভিহিত করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন। ফলে প্রথম জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার সময় ক্রুদ্ধ জনতা তাঁর উপর হামলা চালায়। কিন্তু এসবে দমবার পাত্র ছিলেন না মোনেম খান। পূর্ব বাংলার জনগণের প্রথম শ্রেণীর শত্রু বলেই আইয়ুবের নিকট তিনি পেলেন অপূর্ব স্বীকৃতি। প্রথমে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব এবং পরে গভর্নর। অবশ্য তাঁর পরবর্তী স্বীকৃতি এসেছে জনগণের হাত থেকে–সে কাহিনী বিপরীতমুখী। প্রথমে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা, পরে স্বাধীনতা সংগ্রামকালে মুক্তি বাহিনীর গুলীতে মৃত্যু।
যাহোক, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েই তিনি প্রভু আইয়ুবের নৈকট্য লাভের এবং অধিকতর খেদমতের সুযোগ পেলেন। সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখানোর জন্য তিনি আইয়ুবের কাছে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত থাকলেন। এমন কি আযম খানের মত উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানী লোককেও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদ থেকে সরানোর মূলে মোনেম-সবুর চক্রের কৃতিত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁরা আযম খানের বাঙালী-প্রীতি দেখে এবং তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে আইয়ুবের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে বারংবার বিষোদগার করতে লাগলেন। অবশেষে ১৯৬২ সালের ১০ই মে আযম খানকে বিদায় নিতে হ’ল।

গভর্নর গোলাম ফারুক
এরপর এলেন গোলাম ফারুক। গভর্নর ফারুক প্রথম দিকে বাঙালীর প্রতি বেশ কিছুটা সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা ক’রে তিনি সেই সহানুভূতিশীলতার পরিচয় দিতে পারেন নি। সেই ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্ব তার ছিল না। তবুও আন্তরিকভাবেই তিনি চেষ্টা করেছিলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার জনগণ তথা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া না হ’লে দেশের মঙ্গল সাধিত হবে না। গভর্নর ফারুক এ বিষয়ে এখানকার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অনেক আলাপ করেছেন। আতাউর রহমান খানকে তিনি বলেছিলেন-“আইয়ুব খান লোকটা নেহাত খারাপ নন। কতকগুলি
পৃষ্ঠা নং: ২২১
স্বার্থান্বেষী কর্মচারী দিনরাত তাঁর কানে গুনগুন ক’রে তাঁর স্ততিবাদ ক’রে আর ফাঁকে ফাঁকে দু’ একটি কাজ সেরে নেয়। তিনি অবশ্য তাঁদের মতামতের তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু অষ্টপ্রহর চাপলুসী করলে মানুষের মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। তাই অনুরোধ করি, আপনারা এসে একটু পরিবর্তন করুন। সরাসরি বিপ্লব তো আপনারা করতে পারছেন না। এই অবস্থায় ক্রমবিবর্তনের পথই আপনাদের গ্রহণ করতে হবে। দেশকে বাঁচাতে হবে। তিনি আরও বললেন, ধরুন প্রেসিডেন্ট যদি একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে চান আর আপনাদের যোগদান করার আহ্বান জানান, তা’ হ’লে আপনাদের যোগ দেওয়া উচিত হবে না?
—একদম বিনা শর্তে?
—না, না, বল্লামইত। কিছুটা মেনে নিলে বাকী সব ধীরে ধীরে আদায় করতে পারবেন। একেবারে আপোষহীন সংগ্রামের কথা বলে অটল হয়ে বসে থাকলে চলবে না। দেশের কল্যাণে আপোষ করতেই হয়। নেতার সাথে আলাপ করুন। আমি নিজে প্রেসিডেন্টের সাথে আলাপ করেছি। সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁকে আলাপ করতে বলেছি। তিনি আমাকেই আগে দেখা করতে বললেন। বিদেশ থেকে ফিরে এসে তিনি দেখা করবেন। তবে সাবধান! মন্ত্রীরা যেন টের না পায়। তা’ হ’লে সর্বনাশ। আপনাদের সাথে আপোষ হ’লে ওদের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠবে।”
[ প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩১-৪০]
কিন্তু মন্ত্রীরা কেমন ক’রে যেন এ কথা টের পেয়ে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা গভর্নর ফারুকের বিরুদ্ধে একথা সেকথা লাগিয়ে আইয়ুবের মন বিষিয়ে তুলতে চেষ্টা করলেন, ফলে আইয়ুব খান পিছু হটে গেলেন। শুধু তাই নয়, গভর্নরের উপর খাপ্পাও হলেন।
সে সময় ছাত্রজনতার প্রবল আন্দোলনের ফলে আইয়ুবশাহীর ভীতটা নড়ে উঠলো। ১৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় তাঁর উপস্থিতিতে ছাত্ররা যে অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন, গভর্নর ফারুক তার যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সামান্য কয়েকজন নিহত, আহত ৩ গ্রেফতারের সংবাদে আইয়ুব খান খুশী হতে পারেন নি। তিনি স্থির
পৃষ্ঠা নং: ২২২

করলেন বাঙালীকে দিয়ে বাঙালীদেরকে শায়েস্তা করতে হবে। এবং এর জন্য তিনি যাকে সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস করতে পারলেন, —তিনি আবদুল মোনেম খান।
২৮শে অক্টোবর (’৬২) পূর্ব বাংলার লাটবাহাদুর হিসেবে শপথ নিলেন মোনেম খান। দীর্ঘদিন পর বাংলার মাটিতে এলেন আরেক মীরজাফর।
ক্রমাগত কয়েক মাস ধরে গণসংযোগ সফরের ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব হঠাৎ হৃদপীড়ায় আক্রন্ত হ’লেন। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে করাচীর জিন্নাহ, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করানো হ’ল—সেখানে কিঞ্চিৎ সুস্থ হলে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিপূর্ণ বিশ্রামের ও সুচিকিৎসার জন্য ১৯৬৩ সালের ১৯শে মার্চ তিনি গেলেন বৈরুত।
ইতিমধ্যে মওলানা ভাসানীকেও বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। আইয়ুবের সাকরেদরাই তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁরা আইয়ুবকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, মওলানা ভাসানী সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবের ঘোর বিরোধী। সোহরাওয়ার্দী-মুজিবরা যে নীতি গ্রহণ করবেন, ভাসানী তার বিরোধিতা করবেনই। সে-সময় শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে সারা পূর্ব বাংলায় আগুন ঝরানো আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সে আগুন নেভাতে হ’লে ভাসানীর মত নেতাকে অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে মাঠে নামিয়ে দেয়া উচিত।

মওলানা ভাসানীর মুক্তিলাভ
মুক্তি পাবার পর প্রথমে ১৯৬৩ সালের ৩১শে মার্চ ভাসানী করাচীতে এক জনসভায় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে স্বাগত জানালেন। কিন্তু ২রা এপ্রিল ঢাকায় ফিরে এসে তিনি অন্য সুর ধরলেন। তিনি N.D.F.-কে কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে সমর্থন করতে পারেন বলে জানালেন। এগুলোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীর কথা থাকতে হবে। দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ‘সিয়াটো’ ‘সেন্টো’ বহির্ভূত একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির দাবী তুলতে হবে। এছাড়া তিনি আরও কয়েকটি কর্মসূচীর কথাও উল্লেখ করেন।
অথচ ভাসানীর এই কর্মসূচীর সঙ্গে N.D.F-এর কোন বিরোধ
পৃষ্ঠা নং: ২২৩

ছিল না। তবে N.D.F. প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনকেই মুখ্য হিসেবে গ্রহণ ক’রে এসেছেন। এমন সময়ে মওলানা সাহেবের এইসব শর্তের আরোপ যে উদ্দেশ্যমূলক একথা সত্বরই উপলব্ধি করা গেল। তিনি গণতন্ত্র হয়ত আন্তরিকভাবেই কামনা করেন, কিন্তু আসলে N. D. F.-এর অভূতপূর্ব জনসমর্থনে তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এবং এই সব কথা বলে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনই ছিল তাঁর আসল উদ্দেশ্য। তিনি প্রকাশ্যভাবে N. D. F.-এর বিরোধিতা করতে সাহস পান নি। তবে কৌশলে এই ঐক্যজোটকে তিনি দুর্বল করতে চেয়েছিলেন। অভিজ্ঞ ও ধূর্ত রাজনীতিবিদ ভাসানী ধীরে ধীরে তাঁর দাবার গুটি চালতে শুরু করলেন। সে গুটি যে আইয়ুব সরকারের প্রশাসন-যন্ত্র থেকে তৈরী হয়েছিল সেটা তাঁর পরবর্তী কার্যকলাপেই প্রমাণ করে দেয়।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ওয়াহিদুজ্জামান এ সময় প্রদেশের দুটো দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ ও ‘পাকিস্তান অবজারভার’-এর বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক উক্তি করায় শেখ মুজিব ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। এই পত্রিকা দুটো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করছিল। এই আক্রমণের প্রতিবাদে শেখ মুজিব ১৯৬৩ সালের ২৩শে এপ্রিল এক বিবৃতিতে ওয়াহিদুজ্জামানকে তাঁর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন-যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেনঃ “১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দশ হাজারেরও বেশী ভোটের ব্যবধানে ওয়াহিদুজামানকে পরাজিত ক’রে আমি জয়ী হয়েছিলাম। যদি জনাব জামান নিজেকে এতই জনপ্রিয় বলে মনে করেন তবে আমি তাকে আবার আমার সঙ্গে নির্বাচনে লড়বার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এবং আমি আশা করি, তিনি আমার এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। মন্ত্রী পদে ইস্তফা না দিয়েও সেই সুবিধাজনক পদে অধিষ্ঠিত থেকেই তিনি আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক’রে দেখুন। ইনশাল্লাহ, এবার আরও বিপুল ভোটাধিক্যে আমি তাঁকে হারাতে পারব।” কিন্তু জামান সাহেব তাঁর সেই নির্বাচনী যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন নি।
যাহোক, মওলানা সাহেব সম্পর্কে যা ভয় করা গিয়েছিল তাই সত্যে পরিণত হ’ল। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী খোলাখুলিভাবেই N.D.F.-এর
পৃষ্ঠা নং: ২২৪

বিরোধিতা শুরু ক’রে দিলেন। তিনি N.D.F. -কে ‘Nothing Doing Front’ বলেও ব্যঙ্গোক্তি করলেন। ভাসানী সাহেবের এই সকল উক্তির ফলে কাণ্ডারীবিহীন N.D.F.-এর ক্রিয়াকলাপ শিথিল হতে লাগলো। নুরুল আমীন ছিলেন এই ফ্রন্টের পূর্বাঞ্চল-প্রধান। শেখ মুজিবের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও শহীদ সাহেব ১৯৫২ সালের খুনী নুরুল আমীনকে আঞ্চলিক প্রধান মনোনীত করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ ছিল—গণতন্ত্র উদ্ধারের উদ্দেশ্যেই তিনি এই আপোষ করেছিলেন। কিন্তু শহীদ সাহেবের অনুপস্থিতিতে প্রতিক্রিয়াশীল নুরুল আমীন সাহেবের ভূমিকা মোটেই আন্দোলনমুখী ছিল না। উপরন্তু ভাসানীর প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করবার মত বুকের বল ও সৎ সাহস তাঁর ছিল না।
N.D.F.-এর এই অচল অবস্থার দরুন বাধ্য হয়ে শেখ মুজিব ভবিষ্যৎ কর্মসূচী গ্রহণের পরামর্শের জন্য নেতা সোহরাওয়ার্দীর কাছে গেলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন বৈরুত হয়ে লণ্ডনে অবস্থান করছিলেন। ১৯৬৩ সালের ৮ই আগস্ট রাতে শেখ মুজিব ঢাকা থেকে লণ্ডনের পথে করাচী যাত্রা করলেন। এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ নিয়ে ২৮শে আগষ্ট করাচীতে ফিরে এলেন। ঢাকায় এসে তিনি আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের বাসায় এক বৈঠকে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনার পূর্ণ বিবরণী পেশ করলেন।

নয়া প্রেস অর্ডিন্যান্সের প্রতিবাদে তোফাজ্জল হোসেন
২রা সেপ্টেম্বর (১৯৬৩) আইয়ুব সরকার এক নয়া অর্ডিন্যান্স জারী করলেন। এতে পাকিস্তানের সংবাদপত্র ও পত্রিকার ওপর কতকগুলো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এই অর্ডিন্যান্স জারীর ফলে উভয় অঞ্চলের সাংবাদিকরা ক্ষুদ্ধ হয়ে সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে এক হরতাল পালন করেন।
সেদিন বিকেলে প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের এক সমাবেশে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেনঃ “বর্তমানে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছে, তা শুধু সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার জীবন-মরণের সংগ্রামই নয়, সে সংগ্রামের সঙ্গে একটি স্বাধীন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইও বিজড়িত।”
পৃষ্ঠা নং: ২২৫

প্রদেশের উপনির্বাচন
এ সময় দেশের কয়েকটি অঞ্চলে জাতীয় পরিষদের সদস্যদের কয়েকটি পদের জন্য উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কেননা জাতীয় পরিষদের কয়েকজন সদস্য মন্ত্রীপদে যোগ দেয়ায় তাঁদের সদস্যপদ বাতিল হয়। এই পদগুলো যাতে বাতিল হয়ে না যায় তার জন্য তাঁরা এবং তাঁদের সরকার যথেষ্ট চেষ্টা করেন। কিন্তু ঢাকা হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টের রায় অনুযায়ী তাঁরা সদস্যপদ হারান। ফলে, তাঁদের স্ব-স্ব এলাকায় পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এই নির্বাচনে শেখ মুজিব N.D.F. প্রার্থীদের পক্ষে জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু দুর্নীতিবাজ আইয়ুব সরকারের অর্থের লোভে বশীভূত হয়ে মৌলিক গণতন্ত্রী’ নামধারী দালালরা জনগণের সমর্থনকে ও স্বার্থকে উপেক্ষা ক’রে সরকারী দলের প্রার্থীকেই নির্বাচিত করেন। তা’ ছাড়া সরকারী কর্মচারীরাও নিজেদের বিবেক-বিবেচনাকে বিসর্জন দিয়ে চাকরী রক্ষার খাতিরে সরকারের পক্ষে দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ চালায়। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় কাজ সেরে ১৮ই অক্টোবর শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন। এবং ২০শে অক্টোবর তাঁর বাসভবনে (ঢাকায়) এক সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারী কর্মচারীদের অন্যায় কার্যকলাপের বর্ণনা ক’রে তার কঠোর নিন্দা করেন। তিনি সাংবাদিকদেরকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন যে, পূর্ব বাংলার লোকেরা পিণ্ডির উপনিবেশে পরিণত হয়েছে।
শহীদ সাহেব তখন বৈরুতে। লণ্ডন থেকে পুনরায় বৈরুতে গিয়ে এক হোটেলে অবস্থান করছিলেন। ‘ইত্তেফাক’ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনের কাছে চিঠিতে তিনি দেশে ফেরার জন্য আকুল বাসনার কথা বার বার জানাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে দেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে চলেন।

সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু
কিন্তু বাঙালীর দুর্ভাগ্য। যে নেতার নির্দেশে তাঁরা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁকে আর কোনদিন নিজেদের মধ্যে তাঁরা ফিরে পেলেন না। ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার সময় হঠাৎ ঢাকায় মর্মান্তিক এক খবর ছড়িয়ে পড়লো। সেদিনই রাত তিনটে কুড়ি মিনিটে বৈরুতের কন্টিনেন্টাল হোটেলে বাংলার নির্ভীক নেতা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক
পৃষ্ঠা নং: ২২৬

গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অনাত্মীয় নিঃসঙ্গ অবস্থায় পরলোকগমন করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল সত্তর বছর দুই মাস সাতাশ দিন।
নেতার মৃত্যুর সংবাদে সারা বাংলাদেশ শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ল। ওই ডিসেম্বর (’৬৩) “দৈনিক ইত্তেফাক’ শিরোনামায় লিখলেনঃ “পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক-নিপীড়িত জনতার অকৃত্রিম সুহৃদ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মহাপ্রয়াণ।”
শহীদ সাহেবের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখলেন। অস্বাভাবিক এইজন্য যে, মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই তিনি শীঘ্র সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরছেন বলে জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ ধারণা করেন যে, আইয়ুব খানের নির্দেশে তাঁকে বিষের ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁকে যে মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছিল এ বিষয়ে বোধ হয় তিনি টের পেয়েছিলেন। ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন সাহেবের কাছে লেখা তাঁর একটি চিঠিতে এ আশঙ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেনঃ Of course, this is for you only. If I die. I shall be happy. There is no point in living. I am of no further use to anybody and if of use to myself then life is not worth it.
ডিসেম্বরের ৮ তারিখে নেতার মরদেহকে বৈরুত থেকে করাচী হয়ে ঢাকায় আনা হ’ল। তাঁকে ঢাকা বিমান বন্দরে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবসহ লক্ষ লক্ষ দর্শক কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পরে মরহুমকে শেখ মুজিবের নির্দেশে রমনা রেসকোর্সের কাছে শেরে বাংলা ফজলুল হকের পার্শ্বে কবর দেয়া হয়। শেখ মুজিব নেতার মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি ১৫ই ডিসেম্বর (’৬৩) জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট কর্তৃক আহূত এক শোকসভায় এর প্রতিশোধ নেবার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণকে আহ্বান জানালেন। তিনি শোকে মূহ্যমান হয়ে বললেনঃ “আমি জানি না, জনাব সোহরাওয়ার্দী মারা গিয়েছেন কি-না, কিন্তু আমি মনে করি—আমার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে জেলে পুরে আমার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার বাঙালী ভাইরা, ঐক্যবদ্ধ হোন এবং প্রতিশোধ নিন। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ন। যারা
পৃষ্ঠা নং: ২২৭

আমাদের নেতাকে হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিশোধ নিতে হবে।”
[গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশঃ মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিবঃ অমিতাভ গুপ্ত, কলিকাতা, ১৯৭৩, পৃঃ ৫২৪]

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাক সরকারের উস্কানি
পরে অবশ্যই শেখ মুজিবের এই বক্তৃতার জন্য তাঁকে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ক’রে হয়রানী করা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাস। সারা পূর্ব বাংলা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত হয়ে গেল। কাশ্মীরের এক মসজিদে রক্ষিত হযরত মুহম্মদ (দঃ)-এর কেশ অকস্মাৎ চুরি হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান সরকার সেটা হিন্দু কাফেরদের কীর্তি বলে অভিযোগ আনেন এবং দেশবাসী মুসলমানদেরকে তার প্রতিশোধ নেবার জন্য উস্কানি দিতে থাকেন। এই উস্কানির ফলে খুলনা থেকে আরম্ভ ক’রে সারা পূর্ব বাংলায় হিন্দু নিধনযজ্ঞ শুরু হয়।
এই সময় শেখ মুজিব দেশবাসীকে সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা ও ধর্মান্ধতার শিকারে পরিণত না হবার জন্য বার বার আহ্বান জানান। উক্ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ১৪ই জানুয়ারী ইত্তেফাক পত্রিকায় লেখা হ’লঃ সীমান্ত পারের ঘটনার নামে দেশ, জাতি ও মানবতার চিরদুশমন এবং সভ্যতার দুরপণেয় কলঙ্ক সমাজদ্রোহীরা নারায়ণগঞ্জের শিল্প-এলাকা ও ঢাকায় যেভাবে মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে তাহা সর্বশক্তি দিয়া প্রতিরোধের জন্য শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন দেশবাসীর কাছে আকুল আবেদন জানাইতেছি।”

দাঙ্গা প্রতিরোধে শেখ মুজিব
শেখ মুজিব নিজের জীবন তুচ্ছ ক’রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৪ই জানুয়ারী সকালে নারায়ণগঞ্জের মিলে দাঙ্গা বেধে যায়। শেখ মুজিব দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হাজার হাজার উত্তেজিত শ্রমিককে মানবতার বিরোধী এই জঘন্য কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য আকুল আবেদন জানান। এমন কি বাহ্যিক জ্ঞানশূন্য উত্তেজিত মুসলিম শ্রমিকদের সামনেই মিলের ভেতরে তিনি আহত হিন্দু শ্রমিকদেরকে দেখার জন্য গেলেন।
পৃষ্ঠা নং: ২২৮

পরদিন ঢাকার উয়ারী এলাকা থেকে হিন্দুদেরকে নিরাপদ স্থানে সরানোর সময় তিনি এক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। মুসলিম দাঙ্গাকারীরা তাঁর ওপর আক্রমণ চালায়। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। সেদিন ‘ইত্তেফাক’ অফিসেও হামলা করা হয়েছিল। কিন্তু গুণ্ডারা সুবিধা করতে পারে নি। ইত্তেফাককে আক্রমণ করার কারণ হ’ল এই প্রগতিবাদী পত্রিকা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর জন্য সরকারের তীব্র নিন্দা করেন এবং এর প্রতিরোধের জন্য দেশবাসীকে আকুল আবেদন জানাচ্ছিলেন। সেদিন অর্থাৎ ১৫ তারিখের সকালেই ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিলঃ “সীমান্তের অপর পারে যাহাই ঘটুক, আমাদের স্বদেশভূমিকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ও আত্মঘাতী রক্তপাত হইতে মুক্ত রাখিবার জন্য এ দেশের কৃষক, মজুর, মধ্যবিত্ত, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী সকলের প্রতি আমরা পুনর্বার আকুল আহ্বান জানাইতেছি।” সে আহ্বান দুষ্কৃতিকারীদের মনঃপুত হবার কথা নয়। তাই সেদিন সেই জঘন্য আক্রমণ। এখানে বলে রাখা ভাল যে, এই দাঙ্গাকারী মুসলমানরা ছিল অবাঙালী। এইসব অবাঙালীরা ছিল ভারতের বিহার অঞ্চল থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্তু। এরা বিহারী বলে সবার কাছে পরিচিত। ভারত থেকে এদের বিতাড়নেরও কারণ রয়েছে। পাক-ভারত স্বাধীনতার প্রাক্কালে মুসলমানদের আলাদা অস্তিত্ব নিরূপণের জন্য তৎকালীন মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এদেরকে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে। দেশ ভাগের পর এরা স্বভাবতঃই ভারতীয় হিন্দুদের কোপদৃষ্টিতে পড়ে। ফলে প্রাণের ভয়ে তারা পূর্ব বাংলায় পালিয়ে আসে। পাকিস্তান সরকারও এদেরকে সাদরে গ্রহণ করে। এবং ভবিষ্যতে এদেরকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে বাঙালী মুসলমানদের থেকে আলাদা ক’রে রেখে তালিম দিতে থাকে। এরা প্রকৃতিতে নির্ভীক এবং নিষ্ঠুর। বাইরে চাকুরী ও কুলী-শ্রমিকের খোলস পরে থাকলেও আসলে গুণ্ডামিই এদের মূল পেশা। তাই পাকিস্তান সরকার যথাসময়ে এদেরকে কাজে নামিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর সংবাদে পূর্ব বাংলার জনগণ আবার অধীরত্ত হয়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব এই জাগ্রত
পৃষ্ঠা নং: ২২৯

চেতনাকে ধীরে ধীরে বাঙালী জাতীয়তাবাদ উজ্জীবনের পক্ষে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হন। তাঁর সে প্রয়াস যেমন আন্তরিক, তেমনি নিরলস। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন গণতন্ত্রের একজন অতন্দ্র প্রহরী—শেখ মুজিব তাঁরই অনুসারী। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিব তাঁর আদর্শের অনুসরণে নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যদিও তখনো তিনি N. D. F.-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ফলে আইয়ুব-মোনেম চক্র শেখের গতিকে রুদ্ধ ক’রে দেবার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে লাগলেন। সুযোগও এল। একটা অজুহাতকে কেন্দ্র ক’রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়া হ’ল। উদ্দেশ্য, জনগণকে বোঝানো যে, মুসলমানরা হিন্দুদের চিরশত্রু। এবং তারা সব সময় মুসলমাদের ক্ষতি সাধনে সচেষ্ট। অতএব, মুসলমানদেরও উচিত হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা।
সাময়িকভাবে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ক’রে গণ-আন্দোলনকে দমিয়ে দেবার সকল প্রচেষ্টা অব্যাহতভাবে চলতে লাগল। আর ভবিষ্যতেও যাতে ক’রে শেখ মুজিব কখনও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চিন্তাধারার মাধ্যমে জনমত গঠন করতে না পারেন, তার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মনে সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু-বৌদ্ধদের সম্পর্কে একটা বৈষম্যমূলক ধারণার দেয়াল খাড়া ক’রে রাখার চেষ্টাকে শক্তিশালী ক’রে তোলা হ’ল।
এই দাঙ্গা যে সম্পূর্ণভাবে সরকারের প্ররোচনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল, দাঙ্গা প্রতিরোধ সম্পর্কে সরকারের সম্পূর্ণ উদাসীনতাই তার প্রমাণ দেয়। মানবতার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষমতাসীন চক্র ব্যক্তিগত স্বার্থের খড়্গের সাহায্যে ক্ষমতার স্তম্ভকে অটুট রাখবার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠল।
কিন্তু বাঙালী মুসলমান জনগণ সরকারের ইঙ্গিতকে বিন্দুমাত্র সমর্থন করেন নি। বরং এই বর্বরতাকে প্রতিরোধের জন্য জীবন দানের দৃষ্টান্তও বিদ্যমান রয়েছে। ঢাকার শাজাহানপুর নিবাসী বিশিষ্ট সমাজকর্মী, সংস্কৃতিসেবী ও সাহিত্যিক জনাব আমীর হোসেন চৌধুরী দাঙ্গাকারী মুসলমানদের মানবতার দোহাই দিয়ে বাধা দিতে গিয়ে শাহাদৎ বরণ করেন। দুর্বত্তরা তাঁকে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এইসব অবাঙালী দুষ্কৃতিকারীরা শুধু যে মানুষই খুন করেছে তাই নয়, তারা মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে, বাড়ী-ঘর লুট করেছে, আগুন
পৃষ্ঠা নং: ২৩০

ধরিয়ে দিয়েছে। আর এদের কার্যকলাপে সরকার ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। এই হ’ল মৌলিক গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার একটি উজ্জ্বল পদক্ষেপ।

দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন
জানুয়ারীর ১৬ তারিখে ইত্তেফাক অফিসে ঢাকায় সমাজের সর্বস্তরের ৯৯ জন নাগরিক নিয়ে একটি বেসরকারী ‘দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটির উদ্যোগী ছিলেন শেখ মুজিব ও তোফাজ্জল হোসেন। কমিটির আহ্বায়ক এবং সদস্য নিযুক্ত হন শেখ মুজিব। এর অফিস ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপিত হ’ল ঢাকার ৩৩ নং তোপখানা রোডে। সেদিনই অর্থাৎ জানুয়ারীর ১৬ তারিখেই শেখ মুজিবের উদ্যোগে ‘দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’ কর্তৃক “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাড়াও” শীর্ষক এক ইস্তাহার প্রচার করা হয়। এই ইস্তাহারে বলা হ’লঃ
“সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানের শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকের ছুরি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়া উঠিয়াছে। দুর্বৃত্তের হামলায় ঢাকার প্রতিটি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিঘ্ন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ী পোড়ান হইতেছে, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হইতেছে। এমন কি জনাব আমীর হোসেন চৌধুরীর মত শান্তিকামী মানুষদেরও দুর্বৃত্তের হাতে জীবন দিতে হইতেছে। তাহাঁদের অপরাধ কি ছিল একবার চিন্তা করিয়া দেখুন। গুণ্ডারা মুসলমান ছাত্রীনিবাসে হামলা করিয়াছে এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম আজ মুষ্টিমেয় গুণ্ডার কলুষ স্পর্শে লাঞ্ছিত হইতে চলিয়াছে।
এই সর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছিঃ
আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াই। শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি।
মনে রাখিবেন, আজ ঢাকা ও অন্যান্য শহরে যে জীবন ও সম্পত্তি বিনষ্ট হইতেছে উহা আমাদের নিজেদের সম্পত্তি এবং নিজেদের ভাই-বোনের জীবন। এই গুরুতর ক্ষতি পূর্ব বঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থার
পৃষ্ঠা নং: ২৩১

উপর গুরুতর আঘাত হানিবে। আরও মনে রাখিবেন, সীমান্তের অপর পারে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে উহাকে মূলধন করিয়া দুর্বৃত্তরা লুণ্ঠন ও অন্যান্য উপায়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার চক্রান্তে মাতিয়াছে। ইহাদের একটি বিশেষ কায়েমী স্বার্থবাদী মহল হইতে প্ররোচনা ও সাহায্য দেওয়া হইতেছে। সর্বশক্তি দ্বারা ঐক্যবদ্ধভাবে এই দুশমনদের আজ রুখিতে না পারিলে ভবিষ্যতে এই ঘাতকশ্রেণীর ছুরি আমাদের সকলের জীবন ও সম্পত্তির উপর উদ্যত হইবে। আমাদের চোখের সামনে আমাদের মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হইবে, পূর্ব বঙ্গের মানুষ নিজগৃহে পরবাসী হইবে।
পূর্ব বাংলার জীবনের উপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরা পূর্ব বাংলার সকল মানুষকে আহ্বান জানাইতেছিঃ
* প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন।
*গুণ্ডাদের শায়েস্তা করুন, নির্মূল করুন।
*পূর্ব পাকিস্তানের মা-বোনের ইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যতকে রক্ষা করুন।”
[ দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি, পূর্ব পাকিস্তান]

শেখ মুজিব-তাজউদ্দিনের গ্রেফতার ও মুক্তি
কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শীর্ষক এই প্রচারপত্র ছেড়ে দেবার অভিযোগে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হ’ল। অবশ্য পরে তাঁরা উভয়েই জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু পুলিশের আইন থেকে তাঁরা রেহাই পেলেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘প্রেস এ্যাণ্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স’ ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারার অপরাধ অনুষ্ঠানের চার্জ এনে মামলা দায়ের করা হ’ল।
শহীদ সাহেবের মৃত্যুর পর শেখ মুজিব জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের আর কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন না। তাই তিনি রাজনৈতিক জীবনের পুরাতন বন্ধু-বান্ধবদেরকে নিয়ে স্বীয় পার্টি ‘আওয়ামী লীগ’কেই পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জানুয়ারী ২৫ (’৬৪) তারিখে মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশের সভাপতিত্বে তাঁর নিজস্ব বাসভবনে সাবেক
পৃষ্ঠা নং: ২৩২

আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হ’ল। তবে এই সভায় জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা উপস্থিত হন নি। এই সভায় জনগণের সার্বভৌমত্বসহ পূর্ণ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরদিন পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে কয়েকটি রাজনৈতিক দাবী সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবাকারে গৃহীত হ’ল। যেমন-
(১) দেশে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তন।
(২) আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব।
(৩) পূর্ব পাকিস্তানকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করা।
(৪) পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদর দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা।
(৫) রাজবন্দীদের মুক্তি ইত্যাদি।
কিন্তু আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে সমর্থন জানালেন না। বরং এতে তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। তাঁর মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ক’রে যাওয়াই শ্রেয়ঃ।
অবশ্য পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বিরোধী ছিল না। বরং এন. ডি. এফ. এর একটি অঙ্গদল হিসেবেই আওয়ামী লীগ বাইরে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি ছিল।

আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন
আতাউর রহমান খানের সঙ্গে শেখ মুজিবের যে মতবিরোধ তা’ এখান থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ৬ই মার্চ ঢাকার গ্রীনরোডে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী এক কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগকেও পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। কাউন্সিলে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলের জাতীয় পরিষদ সদস্যসহ প্রায় এক হাজার কাউন্সিলার অংশ গ্রহণ করেন। সেদিন সমবেত প্রতিনিধিদের উদ্দেশে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এক গুরুত্বপূর্ণ লিখিত ভাষণ দান করেন। ভাষণে তিনি বলেছেনঃ “আওয়ামী লীগের
পৃষ্ঠা নং: ২৩৩

ইতিহাস আপনাদের সংগ্রামের ইতিহাস। আপনারা জানেন, কোন অবস্থায় কোন পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে এই প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হয়েছিল। আপনারা জানেন, সৃষ্টি থেকে আরম্ভ ক’রে আজ পর্যন্ত কত রকম প্রতিকূল অবস্থা ও বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে আপনারা আওয়ামী লীগকে দেশের সেরা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গণতন্ত্রের মূলনীতি যে দেশ থেকে যখন তখন মুষ্টিমেয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন মহলের ইঙ্গিতে নির্বাসন দেওয়া হয় যে দেশে কথায় কথায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা ও কর্মীদের জেলে আটক করা হয়, সে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করা এক বিরাট কাজ, সুকঠিন দায়িত্ব।”
[ অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫০৬-৫০৭]
এই সুকঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি তাঁর সহকর্মীদেরকে আকুল আবেদন জানালেন। তিনি বললেনঃ “আসুন, আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি যে, যতদিন না পাকিস্তানের বুক থেকে স্বার্থান্বেষী মহলের পরাজয় ঘটবে, যতদিন না এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পারব, যতদিন না দেশকে একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে পারব, যতদিন না সমাজ থেকে শোষণের মূলোৎপাটন হবে, যতদিন না দেশের প্রত্যেক নাগরিক দলমতধর্ম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক মুক্তি ও আর্থিক প্রাচুর্যের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে, যতদিন না শ্রেণী-বিশেষের অত্যাচার থেকে সমগ্র দেশ ও জাতিকে মুক্তি দেওয়া যাবে, ততদিন আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। ন্যায় আমাদের নীতি, আমাদের আদর্শ। জয় আমাদের অনিবার্য।”
[ ঐ, পৃঃ ৫০৮]
শেখ মুজিবের এই ভাষণ সেদিন কর্মীদের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করলেন।

সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি
১১ই মার্চ (’৬৪) ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার মুখ্য উদ্দেশ্য প্রাপ্তবয়স্কদের
পৃষ্ঠা নং: ২৩৪

ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি (All parties action committee) গঠন। এই সংগ্রাম কমিটির ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল যে আগামী ১৮ই ও ১৯শে মার্চ (’৬৪) সারা পূর্ব বাংলায় ‘প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন দিবস’ পালন করা হবে।

তাজউদ্দিন ও কোরবান আলীর গ্রেফতারের প্রতিবাদ মিছিলে শেখ মুজিব ও ভাসানী
১৮ই মার্চ ভোটাধিকার দাবী দিবসের প্রথম দিনেই শেখ মুজিবের অন্যতম দুই সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমদ ও কোরবান আলীকে পুলিশ গ্রেফতার করলো। এদিন ছাত্র-জনতার মিছিলের ওপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরদিন ঢাকায় হরতাল পালিত ও বিকেলে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন জনসভা শেষে এক বিশাল জনসমুদ্র মিছিলের আকারে ঢাকার রাজপথ নেমে পড়ে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব।
সেদিনের জনসভায় ভাসানী ও শেখ মুজিব উভয়েই হৃদয়স্পর্শী ভাষণ দান করেন। শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বলেনঃ “সভ্যতার কোন পর্যায়েই জন্মগত অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করতে পারে নি, ফেরাউন মানুষকে জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে নি, হিটলার পারে নি, আজ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীও পারবে না। একদিন দেশবাসী দুর্বার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাদের জন্মগত অধিকার ছিনিয়ে আনবেই আনবে।”
[ অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫১৩]
আগের দিনের মিছিলের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও গ্রেফতারের কঠোর সমালোচনা ক’রে শেখ মুজিব বলেনঃ “আজ জাতি যখন তাঁর দাবী নিয়ে সংগ্রামে নেমেছে তখন ঢাকা শহর পুলিশে পুলিশে ছেয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ এই সেদিন যখন দাঙ্গাবাজদের উচ্ছৃঙ্খলতা চরমে পৌছেছিল, তখন এই পুলিশ পুঙ্গবরা কোথায় ছিল?”
[ অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫১৩]
পৃষ্ঠা নং: ২৩৫

তিনি লক্ষ লক্ষ জনতাকে উদ্দেশ ক’রে আরো বললেনঃ “বাংলার ভায়েরা আমার, স্পষ্ট ক’রে আজ আপনাদের থেকে জেনে যেতে চাই আমরা যদি জেলে চলে যাই পারবেন কি আপনারা হৃত অধিকার ছিনিয়ে আনার জন্য গ্রামে গ্রামে দুর্বার আন্দোলন চালিয়ে যেতে? জেল-জুলুমের মুখে আপনাদের ছেলেরা আজ যেমন বুক পেতে দিয়েছে, পারবেন কি আপনারা তেমনি ক’রে ত্যাগ ও সাধনার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিতে? পারবেন কি আপনারা হাজারে হাজারে আইয়ূব সরকারের কারাগার ভরে তুলতে?”
লক্ষ লক্ষ কণ্ঠ সমস্বরে গর্জে উঠলো- “পারব,পারব।”
[ অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫১৪]
সেদিনের জনসভায় মওলানা ভাসানীও এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি আইয়ুব সরকারকে সতর্ক ক’রে বললেনঃ “বাঙালী সম্রাট অশোককে মানে নি। মোগল পাঠানেরও অনুগত হয় নি। ইংরাজের আনুগত্য স্বীকার করে নি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়ায় জনতার রুদ্ররোষে প্রবল ক্ষমতাশীল মুসলিম লীগ আজ কবরে শায়িত। এবারো সরকার যদি ভোটাধিকারের দাবী মেনে না নেন, তবে দেশে আর এক রাষ্ট্রভাষার ঘটনা ঘটবে।”
[ অমিতাভ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫১৪]
এই গণজাগরণের মুখেই রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ১৬ই মার্চে অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবের দিনে ছাত্ররা প্রবল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এর কয়েকদিন পর ২২শে মার্চ (’৬৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮তম সমাবর্তন উৎসবের কথা ছিল। পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের চ্যান্সেলর ছিলেন গভর্নর মোনেম খান। তিনি যখন ভাষণ দিতে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন ছাত্ররা চারিদিক থেকে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে দিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অপমানিত গভর্নরের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং তিনজন সাংবাদিকসহ ৩১৩ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে।
কয়েকদিন ধরে ব্যাপক ধর-পাকড় চলল। যাদেরকে গ্রেফতার করা
পৃষ্ঠা নং: ২৩৬

হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন সংগ্রামী যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও পাবনার ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। এঁদেরকে মার্চের ২৬ তারিখে গ্রেফতার করা হয়।
২৯শে মার্চ (’৬৪) সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালন করা হয়। এইদিন পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বক্তার ভাষণে শেখ মুজিব ভোটাধিকার না দিলে সরকারকে ট্যাক্স দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ার ক’রে দেন।
এর কয়েকদিন পর ২রা এপ্রিল ছাত্র আন্দোলন সংক্রান্ত সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশের দায়ে ‘দৈনিক সংবাদ’ ও ‘আজাদ’ থেকে ৩০,০০০ টাকা ক’রে জামানত তলব করলে পরদিন শেখ মুজিব সরকারকে আর এক দফা হুশিয়ারী ক’রে বলেন যে, গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে না দিলে জনগণ অগণতান্ত্রিক পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে।
শেখ মুজিব এপ্রিলে ও মে মাসে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জেলায় গণসংযোগ সফরে বেরিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য জনসমর্থন অর্জন করা।

জওয়াহেরলাল নেহেরুর মৃত্যু
১৯৬৪ সালের মে মাসের ২৭ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু অকস্মাৎ নয়াদিল্লীতে পরলোক গমন করেন। শেখ মুজিব গণতন্ত্রের দিশারী এই মহান দার্শনিক ও চিন্তানায়কের মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর অন্তরের অন্তস্থল থেকে নেহেরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব জানুয়ারী মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করলেন। অর্থের দ্বারা বশীভূত মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা আইয়ুব খান নিজেকে একবার বাজিয়ে নিতে চাইলেন। আর চাইলেন নিজের কর্তৃত্বকে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে।
কিন্তু নিজেদের আসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিরোধী দলের বিষদাঁত ভেঙে দেয়া একান্ত আবশ্যক। আর যার দাঁতের ধার সবচেয়ে বিষাক্ত ও তীক্ষ্ম তিনি হলেন শেখ মুজিব। এতএব তাঁকে শায়েস্তা করা প্রয়োজন।
পৃষ্ঠা নং: ২৩৭

শেখ মুজিবের গ্রেফতার
এই প্রয়োজনের খাতিরে ১৯৬৪ সালের ৩১শে মে বিকেল বেলায় শেখ মুজিবকে তাঁর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন থেকে পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনের ৭(৩) ধারা এবং পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ এ ধারা অনুযায়ী গ্রেফতার করা হ’ল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে পল্টনের এক শোকসভায় নেতার মৃত্যুর প্রতি সন্দেহ প্রকাশ ক’রে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। অবশ্য পরে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। জুলাইয়ের ৫ তারিখে আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এই বৈঠকে আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে কাকে দাঁড় করানো যায়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলের সাথে নিম্মতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার জন্য আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি তিনজন বিশিষ্ট নেতার ওপর ভার দিলেন। এঁরা হলেন-শেখ মুজিবুর রহমান, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ও জনাব আবদুস সালাম খান। যদিও শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ব্যতিরেকে মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে কোনরূপ নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিলেন না, তথাপি স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাতের প্রশ্নে এ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব এই নির্বাচনকে একটা যুদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। এ যুদ্ধ শোষিত নিপীড়িত মানুষের বাঁচা-মরার যুদ্ধ।

জুলুম প্রতিরোধ দিবস
স্বৈরাচারী সরকার আইয়ুবের জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার জন্য ১৯৬৪ সালের ১২ই জুলাই সারা পূর্ব পাকিস্তানে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ উদযাপিত হয়। ঐদিন পল্টন ময়দানে শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তা’ নানা দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নীচে দেয়া হ’লঃ
“সোনার বাংলার ভাইয়েরা আমার! স্বাধীনতার ১৭ বছর পরে আবার জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নামতে হবে-১৭ বছর পরে আবার ভোটের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেতে হবে-১৭ বছর পরে আবার রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হবে-একথা কোন
পৃষ্ঠা নং: ২৩৮

দিন ভাবি নি। নিজ দেশে নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধেও ব্রিটিশ আমলের মত জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে ভাবলে মন আমার শিউরে ওঠে।
গত ক’দিনে দিনাজপুরের পঞ্চগড় থেকে শুরু ক’রে চট্টগ্রামের কক্সবাজার পর্যন্ত সিলেটের সীমান্ত থেকে বরিশাল পর্যন্ত ঘুরেছি। অন্ততঃ ৬০টি জনসভায় বক্তৃতা করেছি-দাবী করেছি, প্রস্তাব পাশ করেছিঃ “জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দাও, বাঁচার মত বাঁচতে দাও।” কিন্তু ফল কিছুই হয় নি, সরকার কানে তুলো দিয়েছেন।
আজ জুলুম প্রতিরোধ দিবসের সভায় দাঁড়িয়ে মনে পড়ে সেই দিনটির কথা, যেদিন ১৯৫৮ সালে আল্লাহর রহমতে ইস্কান্দার মীর্জা আইয়ুব খানের হাতে বন্দুক দিয়ে ‘ধিকৃত রাজনীতিকদের’ হাত থেকে পাকিস্তানকে ‘রক্ষা’ করেছিলেন।
গতকাল এইখানে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীলীগের জনাব সবুর শাহেদ আলীর হত্যার প্রসঙ্গ তুলে দেশে সামরিক শাসন জারীর ‘মরতবা’ বিশ্লেষণ ক’রে গিয়েছেন। সামরিক শাসন জারীর কারণ ব্যাখ্যা ক’রে সবুর ভাই সেদিনকার সামরিক শাসনের যে প্রশস্তি গেয়েছেন, তা’ কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব, কেননা সামরিক শাসন জারীর পর, তাঁর প্রতি সামরিক শাসনকর্তার যে ‘নেক নজর’ পড়েছিল তার স্মৃতিই হয়ত তাঁকে এ প্রশস্তি গাইতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

শাহেদ আলীকে হত্যা করেছে কে?
আমার সবুর ভাই অভিযোগ করেছেন যে, জনাব শাহেদ আলীর হত্যার মধ্য দিয়ে ধিকৃত রাজনীতিকরাই এদেশে সামরিক শাসন ডেকে এনেছিল। জবাবে আমি বলব, মরহুম শাহেদ আলী আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। সুতরাং আওয়ামী সরকার নিশ্চয়ই তাঁকে হত্যা করেন নি। তা’ হ’লে তাঁকে হত্যা করলো কে?
মরহুম শাহেদ আলীর হত্যার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। দেশে সামরিক শাসন জারীর ক্ষেত্রে প্রস্তুতই ছিল সে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য। এই কারণেই সামরিক শাসন জারীর পর মরহুম শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বন্ধ করা হয়। জিজ্ঞাসা করি, ধিকৃত রাজনীতিকরাই যদি শাহেদ
পৃষ্ঠা নং: ২৩৯

আলীর হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন তবে সামরিক সরকার সে হত্যা-কাণ্ডের তদন্ত বন্ধ করলেন কেন? কেনই বা তাঁর হত্যাকারীদের বিচার করা হ’ল না। এ প্রশ্নের জবাবও আমাদের অজানা নাই। আমরা জানতাম শাহেদ আলীর হত্যার তদন্ত করা হ’লে অনেক রহস্যই ফাঁস হয়ে পড়তো। তাই ‘ন্যায়বিচারকের’ আসনে বসে সামরিক সরকার আমার মত অনেক অভাগার উপর বিভিন্ন অভিযোগে জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতনের বন্যা বইয়ে দিলেন, কিন্তু শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বা বিচারের প্রশ্নে টুঁ শব্দটিও করলেন না।

সামরিক শাসন জারীর কারণ কি এই নয়?
শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ড যদি দেশে সামরিক শাসন জারীর কারণ হয়ে থাকে, তবে জিজ্ঞাসা করতে পারি কি, আজ যেখানে আপনারা রাজধানী করেছেন, সেই রাওয়ালপিণ্ডির প্রকাশ্য জনসভায় দিনে দুপুরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে যখন হত্যা করা হ’ল, তখন কেন দেশে সামরিক শাসন জারী করা হ’ল না? জিজ্ঞাসা করতে পারি কি, ১৯৫২ সালের মজহাবী হাঙ্গামায় পশ্চিম পাকিস্তানে রক্তের বন্যা বয়ে গেল, তখন কেন সামরিক শাসন জারী করা হ’ল না? জিজ্ঞাসা করতে পারি কি, ১৯৫৩ সালে জনাব গোলাম মোহাম্মদ যখন পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত ক’রে দেশে মারাত্মক শাসনতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি করেছিলেন, তখন কেন সামরিক শাসন জারী করা হ’ল না? তাই বলি সামরিক শাসন জারীর কারণ জনাব শাহেদ আলীর হত্যাকাণ্ড নয়, অন্য কিছু। সামরিক শাসন জারীর কারণ কি এই নয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ১৫টি উপনির্বাচনে একের পর এক ১৪টি আসনেই আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত হতে দেখে এবং আওয়ামী লীগের গণস্বার্থমুখী ভূমিকা দৃষ্টে এদেশের উপরতলার এক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থ বাদী মহলের টনক নড়ে যায়। তাই, দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ৪ মাস বাকী থাকতে তাঁরা যখন আসন্ন নির্বাচনের ফলাফল আঁচ করতে পারেন, বিশেষ করে তাঁরা যখন বুঝতে পারেন যে, জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে তবে পূর্ব পাকিস্তানের পাওনা কড়ায়
পৃষ্ঠা নং: ২৪০
গণ্ডায় তারা আদায় ক’রে নেবে। তখনই তারা ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত হন। আর সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শেষ গুটি চালা হয় দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের মাত্র ৪ মাস আগে দেশে সামরিক শাসন জারীর মাধ্যমে। আর তারই প্রথম শিকার হন আওয়ামী লীগ ও তার নেতা দেশবরেণ্য জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

শয়তানও লা হাওলা পড়ে দেশ ছেড়ে পালাবে
গতকাল সবুর ভাই অতীতের রাজনৈতিক আমলের সরকারদের বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা অভিযোগ ক’রে গিয়েছেন তা’ শুনলে খোদ শয়তানও ‘লা হাওলা’ পড়ে দেশ ছেড়ে পালাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৮২৬ জন রাজবন্দী কারাগারে আটক ছিলেন, এমন কথা কেবল বেহায়ারাই বলতে পারে। একমাত্র আওয়ামী লীগই জেল থেকে সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দিয়েছিল একথা সবুর ভাইও জানেন, তবে এখন প্রয়োজনের খাতিরে তিনি ন্যাকা সেজেছেন। কেবল তাই নয়, আওয়ামী লীগ নিরাপত্তা আইনও সমূলে বাতিল করেছিল। আওয়ামী লীগ যদি নিরাপত্তা আইন বলবত রাখতো এবং সবুর ভাইদের যদি জেলে পুরে দুই দিনের জন্যও লাচ্ছি খাওয়াবার ব্যবস্থা করতো তবে আজ তাঁরা নিরাপত্তা আইনের নামও মুখে আনতেন না।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১০ বৎসর যাবত দেশে যে দল ক্ষমতাসীন ছিলেন, জনাব সবুর নিজেও সে দলের সদস্য ছিলেন। বৈষম্যের গোড়াপত্তনও তাঁদের আমলেই ঘটে। মাঝে মাত্র তের মাসের জন্য পরিষদে ১২ সদস্য বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ অন্যের কাঁধে ভর ক’রে ক্ষমতাসীন হয়। এই সামান্য সময়ে তাঁরা বৈষম্য নিরসনের জন্য চেষ্টা পান। কিন্তু কুচক্রী মহলের আঁতে ঘা লাগায় ক্ষমতার আসন হতে তাঁদের নেমে আসতে হয়।

এ কোন ধরণের ইনসাফ?
বর্তমান সরকারের আমলে একটি মাত্র নজির তুলে ধরে আমি জনাব সবুরের কাছে জানতে চাই যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের আমলে প্রণীত দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে পূর্ব পাকিস্তানে দেশের শতকরা ৫৬ জন লোকের বাস সেই পূর্ব পাকিস্তানকে মাত্র ৯৫০ কোটি টাকা দিয়ে যে পশ্চিম পাকিস্তানে দেশের শতকরা ৪৪ জনের বাস, সেই পশ্চিম পাকিস্তানকে ১,৩৫০ কোটি টাকা দেওয়া আর এই পরিকল্পনার বাইরে রেখে সিন্ধু
পৃষ্ঠা নং: ২৪১

অববাহিকা পরিকল্পনা ও লবণাক্ততা দূরীকরণের জন্য ১৫০০ কোটি টাকা ও ইসলামাবাদে রাজধানী নির্মাণের জন্য ৫০০ কোটি টাকা সর্বসাকুল্যে পশ্চিম পাকিস্তানকে ৩,৩৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা কোন ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা? পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এ কোন ধরণের সুবিচার? এরই পাশাপাশি আমি আরো জিজ্ঞাসা করতে চাই যে, বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ একর জমি নষ্ট হয়ে যায় অথচ এই অবস্থা নিরসনের জন্য ক্রুগ মিশনের প্রস্তাবিত ১০০ কোটি টাকা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করার মতো মানসিকতা ক্ষমতাসীনেরা পান না, কিন্তু পরিকল্পনার বাইরে রেখে ২,০০০ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা সম্ভব হয়। এ কোন ধরনের ইনসাফ!

দুঃখ আমার এইখানে
দুঃখ আমার এইখানে যে, বাংলাদেশের মানুষ প্রথমে বুঝতে পারে না। পরে যখন বোঝে তখন কেবল আক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই তাদের করার থাকে না। দেশে মার্শাল-ল’ জারী ক’রে শাসনতন্ত্র ছুড়ে ফেলে দেয়া হ’ল, নেতৃবৃন্দকে ধিকৃত রাজনীতিক আখ্যা দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হ’ল, অসংখ্য রাজনীতিক ও হাজার হাজার কর্মীকে জেলে ঠেলে দেওয়া হ’ল, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হ’ল, অত্যাচার-নির্যাতনের বন্যা বয়ে গেল, আর ভাইরা আমার ক্ষমতা দখলকারীর জিন্দাবাদে মশগুল হয়ে উঠলো।

বাঙালীর যা চরিত্র
বাঙালীর যা চরিত্র গতকাল পল্টন ময়দানে তারই আর একদফা পরিচয় পাওয়া গেল। গদীর মায়ায় সবুর ভাইয়ের মুখে কত মিথ্যারই না খৈ ফুটল। সবুর সাহেব বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে করতে নূরুল আমীন মন্ত্রীসভার কার্যকলাপেরও তীব্র সমালোচনা ক’রে গেলেন। ৪ হাজার লোকের ‘বিরাট জনসভা’র শ্রোতাদের তিনি ধারণা দিয়ে গেলেন যে, অতীতের সরকারই যত অনাসৃষ্টির মূল। আর তিনি নিজে ও গভর্নর মোনেম সাক্ষাৎ ফেরেশতা। গদির মোহে সবুর ভাইয়ের মুখে এমনিতর খৈ ফুটা স্বাভাবিক ।

জনাব সবুর নিজেই তখন সেই দলের প্রচার-সম্পাদক
চোখে যার ঠুলি বাঁধা, জনগণকে বোকা ঠাউরে আত্মপ্রসাদ লাভ করা কেবল তারই সাজে, এই জন্যই সবুর সাহেব হয়তো ভুলে যেতে চেয়েছেন
পৃষ্ঠা নং: ২৪২

যে, কালই পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে যে নূরুল আমীন সরকারের তিনি নিন্দা ক’রে গেলেন, সেদিন তিনি নিজেই ছিলেন সে দলের প্রচার-সম্পাদক। আর গভর্নর মোনেম ছিলেন তাঁদের ময়মনসিংহ জেলার কর্ণধার। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তাঁদের দল মুসলিম লীগই ক্ষমতায় ছিল। এই দীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত দেশবাসীর উপর যে অত্যাচার-অনাচার চালান হয়েছিল সবুর সাহেব কস্মিনকালেও তার প্রতিবাদ করেছিলেন কি? না, তিনি মুসলিম লীগের প্রচার-সম্পাদক হিসেবে তার প্রশস্তিই গেয়েছিলেন?

১৯৫৫ সালের আওয়ামী লীগ
সবুর সাহেব আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত প্রচারই করুন না কেন, খাতাপত্রে, জাতীয় পরিষদে প্রসিডিং বই-এর পাতায় পাতায় এই সত্যেরই প্রমাণ মিলবে যে, জনাব সবুর ও তাঁর মুরুব্বীর দল আজ যে বৈষম্যের কথা তুলে নিজেদের ফেরেশতা সাজাতে চাইছেন, সেই বৈষম্যের কথা জনাব সবুরের মুরুব্বীরা এই সেদিন পর্যন্তও স্বীকার করতে না চাইলেও ১৯৫৫ সালে মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে পার্লামেন্টে গিয়ে আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করা হয়েছে। কিভাবে তাকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

কায়েমী স্বার্থীদের আঁতে ঘা
আজ সবুর সাহেবেরা বড় গলায় যত কথাই বলুন না কেন, একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একমাত্র আওয়ামী লীগই কেন্দ্রীয় সরকারের একচোখা নীতি ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে অন্যদলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন ক’রে সর্বপ্রথম এই বৈষম্য রোধের চেষ্টা পেয়েছিলেন। সে দিনের সে আওয়ামী কোয়ালিশনের এই বৈষম্যবিরোধী প্রচেষ্টায় কায়েমী স্বার্থী মহলের আঁতে ঘা লাগে। তাই, ‘প্যালেস ক্লিকে’র টানাপোড়েনে সোহরাওয়ার্দী সরকারকে ক্ষমতার আসন থেকে নেমে আসতে বাধ্য করতে চাই যে, আওয়ামী লীগ আর যাই করুক, পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা তাঁরা
পৃষ্ঠা নং: ২৪৩

কোন কালেই করেনি বলেই জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের আজ নিত্য সহচর।

আওয়ামী লীগকে রোখো
১৯৫৮ সালের ইতিহাস বড় করুণ, বড়ই নির্মম। আওয়ামী লীগ তখন প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিল না। ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানের ১৫টি উপনির্বাচনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪টি আসন দখল করে। ফলে, উপরতলায় কুচক্রীমহলে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল চিন্তা ক’রে আতঙ্কের সঞ্চার হয়। সোহরাওয়ার্দী সরকারের ১৩ মাসের শাসনে এমনিই তাদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। এবার তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠলো কি ক’রে আওয়ামী লীগকে রোখা যায়। উপরতলায় দুর্নীতি-পরায়ণ অফিসার মহলও সক্রিয় হলেন। তাঁরা বোঝাতে লাগলেন, সাধারণ নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগকে আর রোখা যাবে না, আর তারা যদি একবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তবে আর নিস্তার নেই। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বঞ্চনার মাশুল তারা কড়ায় গণ্ডায় আদায় ক’রে নেবে। পশ্চিম পাকিস্তানের শতকরা ৩০টা কারখানা বাজারের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পূর্ব পাকিস্তানীদের নির্বাচনের প্রতিশ্রুত তারিখের মাত্র ৪ মাস আগে দেশে মার্শাল-ল’ জারী করা হ’ল। সারা দেশে চার হাজার রাজনীতিক ও কর্মীকে বন্দী করা হ’ল। এদেশের মানুষ সবই দেখলো কিন্তু আন্দোলন করতে সাহস পেল না। দেশবাসীর এই নির্জীব অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষের স্পর্ধা আরো বেড়ে গেল। একের পর এক দেশবাসীর অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সারা দেশে কবরের শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হ’ল।

সবুর সাহেব মিথ্যা বলেছেন
করাচী থেকে রাজধানীও আজ সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সবুর সাহেব দর্পভরে এলান ক’রে গিয়েছেন যে, করাচীর জন্য পূর্ব পাকিস্তানের একটি পয়সাও ব্যয় করা হয় নি। আমি বলি, তিনি মিথ্যাচার করেছেন। সে কয়-বছরে পূর্ব পাকিস্তান যে ১,২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছিল তার সিংহভাগই করাচীকে গড়ে তোলার কাজে ব্যয় করা হয়েছিল, একথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই।
পৃষ্ঠা নং: ২৪৪

কে-না জানে যে, দেশরক্ষা ও কেন্দ্রীয় চাকুরীতে গোটা দেশের বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভের পরে আজো কোথাও শতকরা ১০ জনের বেশী বাঙালী নেই।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ৫টি স্তম্ভ বনাম পূর্ব পাকিস্তান
মোটামুটি ৫টি স্তম্ভের উপর যে-কোন দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম থাকে, যথা-কেন্দ্রীয় সরকার, রাজধানী, প্রতিরক্ষা, মূলধন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বা পার্লামেন্ট। আজাদী অর্জনের পর থেকে এর প্রথম চারটি স্তম্ভ কোন কালেই পূর্ব পাকিস্তানীদের নাগালে ছিল না-ছিল কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এই রাজনৈতিক ক্ষমতার যথাসম্ভব সুব্যবহারের যে সুযোগটুকু আমাদের ছিল, তাও আজ কেড়ে নেয়া হয়েছে। পার্লামেন্টের হাতে আজ কোন ক্ষমতাই নেই। ‘কর্তার ইচ্ছার কীর্তন গেয়ে’ আসা ছাড়া পার্লামেন্টের সদস্যদের আজ আর অন্য কোন কাজ নেই। মূলধনের কথা না বলাই ভালো। মাত্র ২০টি ভাগ্যবান পরিবারের হাতে আজ এদেশের পুঁজি।
সামরিক শাসন জারী ক’রে যে ভেলকী দেখান হ’ল সে এক ইতিহাস। ৭ই অক্টোবর যিনি প্রধান সামরিক শাসনকর্তা, ২২শে অক্টোবর তিনি প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট তাঁকে করলো কে? তিনি নিজেই। তারপর গড়লেন তিনি মৌলিক গণতন্ত্রী। এঁরা কারা-তাঁর বশংবদ। তারপর করলেন কি? আস্থা ভোট। প্রার্থী কে কে? তিনি একলা। ভোটের ফলাফল যাচাইয়ের ব্যবস্থা কি? – ‘হ্যাঁ’ হলেও আমি, ‘না’ হলেও আমি।
তারপর বললেন, এবার আমি দেশকে এমন একটা শাসনতন্ত্র দেব যা দুনিয়ার কেউ কখনো দেখে নি। তার কথাই ঠিক-সত্যই দুনিয়ায় এমন শাসনতন্ত্র কেউ কখনো দেখে নি!

বাংলাদেশের মানুষ বড়ই ভুলো স্বভাবের
আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সোডা ওয়াটারের বোতল, তাই অল্প পরেই সবকিছু ভুলে যান। এদেশের ছাত্রদের ইতিহাস, শ্রমিক ইতিহাস, শিক্ষকদের ইতিহাস, আপনারা শুনেছেন, জানেনও। পশ্চিম পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষার ভার সরকার স্বহস্তে নিয়েছেন, আর পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষকরা আজো বাঁচার মত বেতনের দাবীতে ধর্মঘট করতে যান।
পৃষ্ঠা নং: ২৪৫

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কর
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বন্ধুরাও কম যান না। গভর্নর মোনেম খান যাবেন চ্যান্সেলর হিসেবে সমাবর্তন বক্তৃতা করতে। ছাত্ররা বললো, সমাবর্তন উৎসবে আমরা শিক্ষাবিদদের বক্তৃতা শুনব, রাজনীতিকের নয়। গভর্নর বললেন, আমার বক্তৃতাই তোমাদের শুনতে হবে। ছাত্ররা বিগড়ে বসলো। গভর্নর সাহেব সমাবর্তন মণ্ডপে পা দিলেন, দেখলেন-চেয়ার-টেবিল, ফুলের টব সবই বিধ্বস্ত, লণ্ডবণ্ড। তবু যে কথা সেই কাজ। বিধ্বস্ত সমাবর্তন মণ্ডপে টিয়ার গ্যাস সেল ছোঁড়ার শব্দ আর ছাত্রদের বিক্ষোভ ধ্বনির মধ্যে বক্তৃতা ক’রে কঠোর পুলিশ প্রহরায় সগর্বে তিনি বেরিয়ে এলেন। এসেই হুকুম দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কর! হল বন্ধ কর! ছাত্রদের তাড়াও! বশংবদের দল তৎপর হ’ল। এক ঘন্টার মধ্যে ইকবাল হলের তিনি শতাধিক ছাত্র রমনা থানার হাজতে স্থান পেল। ৭দিন পর সেখান থেকে জেলে।

নাবালক ছেলে ক’টির অপরাধ কি?
আমার বিরুদ্ধে এখনো তিনটা মামলা আছে। তার কারণ না হয় বুঝি। কিন্তু ছাগলনাইয়ায় ৭টি নাবালক স্কুল ছাত্র কি এমন অপরাধ করেছিল, যার জন্য দুইমাস পর্যন্ত তাদের হাজতে আটক রাখা হ’ল? হাইকোর্ট জামিন না দেওয়া পর্যন্ত দুইমাস যাবত তাদের জামিন দেওয়া হয় নি। নাবালক স্কুল ছাত্রদের এইভাবে শাস্তি দেওয়া বা হয়রান করার নজীর কোনও সভ্যদেশের ইতিহাসে নেই।

তেলা মাথায় তেল!
পে কমিশনের রিপোর্ট দিবালোকের মুখ দেখল না। তবু তারই রোয়েদাদ অনুযায়ী নাকি সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। বাড়ান হয়েছে ঠিকই, তবে কিনা উপরতলায়। আদতে গরীব কর্মচারীদের বেতন কিছুই বাড়ে নি। ২০ টাকার বেতনের কর্মচারীর ৫ টাকা বেড়েছে, কিন্তু ২,০০০ টাকা বেতনের কর্মচারীর বেতন বাড়িয়ে ৩,০০০ টাকা করা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করি, এই কি তোমাদের বিচার? নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির দরুন ২,০০০ টাকার কর্মচারীর জীবনে আদৌ কি কোনও বিপর্যয় ঘটেছিল? কুড়ি টাকার কর্মচারীর জীবনে যে বিপর্যয়
পৃষ্ঠা নং: ২৪৬

ঘটেছে-তার প্রতিবিধান কি ৫/৭ টাকা বেতন বৃদ্ধিতেই সম্ভব? তেলা মাথায় তেল না দিয়ে এদেশের গরীব কর্মচারীদের বেতন ন্যায়সঙ্গত পরিমাণে বাড়ান কি একেবারে অসম্ভব ছিল?

আইয়ুর সরকারের কমিশন!
গুরুতর কোন সমস্যা খতিয়ে দেখে তার প্রতিবিধানের পথনির্দেশের জন্যই দেশে দেশে কমিশন গঠন করা হয়ে থাকে। আর আমাদের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কত কমিশনই না নিয়োগ করলেন! কিন্তু তাঁর রিপোর্টের হ’ল কি? পে কমিশন, ভোটাধিকার কমিশন, শাসনতন্ত্র কমিশন কোনটির রিপোর্টই তিনি গ্রহণ করেন নি। বেছে বেছে নিজ পছন্দমত বিচক্ষণ লোক দিয়ে যে কমিশন তিনি গঠন করলেন, তাদের সুপারিশ যদি তিনি গ্রহণই না করেন, তা’ হ’লে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে লোক দেখানো এ কমিশন গঠনের অর্থ কি? এমন কি খাস ক’রে সরকারী অফিসারদের নিয়ে অর্থনৈতিক কমিশন গঠন করা হয়, তার রিপোর্ট ও গোপন করা হয়েছে। রিপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানকে কিভাবে শোষণ করা হয়েছে তার বিবরণ স্থান পেয়েছিল বলেই কি তা’ গোপন করা হয় নি!

এদেশের কৃষককুল বনাম সরকার
এদেশের কৃষককুল আজ ধ্বংসের মুখে। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমরা দাবী করেছিলাম ২৫ বিঘা পর্যন্ত যাদের জমি আছে তাদের খাজনা মওকুফ করা হোক। তাতে ক্ষমতাসীনরা হেসেছেন। কিন্তু সরকারী রিপোর্টের খোঁজ রাখা হয়তো তাঁরা প্রয়োজন মনে করেন নি। আমাদের কথা নয়, সরকারী রিপোর্টেই বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকরা ৯৩ কোটি টাকা ঋণগ্রস্থ। যে কৃষককুল দেশের সর্বোচ্চ পরিণাম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, তাদের বাঁচিয়ে রাখার কথা চিন্তা করার অবসর সরকারের নেই। ৯৩ কোটি টাকার এ ঋণ শোধ দেওয়া তো দূরের কথা, চক্রবৃদ্ধিহারে বৃদ্ধি পেতে পেতে অদূর ভবিষ্যতে তা’ যে তার সমগ্য সত্তাকেই গ্রাস করতে চলেছে, এ কথাও ভেবে দেখার সময় সরকারের নেই। জানি সরকারের সময় অত্যন্ত মূল্যবান। তবু দেশের স্বার্থে কৃষককুলকে বাঁচাবার জন্য খাজনা মওকুফ করা একান্ত অপরিহার্য। রাজস্ব ঘাটতির অমূলক আশঙ্কায় সরকার এ প্রস্তাবে সম্মত
পৃষ্ঠা নং: ২৪৭

হতে নারাজ- অথচ কোটিপতি শিল্প মালিকদের ১০ বছরের জন্য ট্যাক্স মওকুফের বেলায় তারা দরাজদিল। শিল্প ব্যাঙ্ক থেকে যে ভাগ্যবানের দল শতকরা ৭৫ ভাগ ঋণ পেয়ে রাতারাতি ধনকুবের বনে মুনাফার পাহাড় গড়েছেন, তাঁদেরকে ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি দিয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী, ঋণভারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এদেশের ভুখানাঙ্গা কৃষককুলকে খাজনা থেকে অন্ততঃ কয়েকটি বছরের জন্য অব্যাহতি দিলে নিশ্চয়ই আকাশ ভেঙে মাথায় পড়তো না। অথচ ওয়ার্কস প্রোগামের নামে বিনা হিসাবে বিনা অডিটে ২০/২৫ কোটি টাকা অনুতপাদনধর্মী কাজে ব্যয় ক’রে যে ফায়দা না উঠান যাচ্ছে, ৭ থেকে ৮ কোটি টাকার খাজনা মওকুফ করলে তার চেয়ে অনেক বেশী ফায়দা উঠান যেত। কৃষককুলকেও কৃতজ্ঞতার পাশে আবব্ধ করা সম্ভব হোত। এই কারণেই বলি, যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান এসেছিল সেই লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে, অন্যথায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচবার উপায় নাই।

আওয়ামী লীগ হালকা শ্লোগান দেয় না
ওঁরা বলেন, আওয়ামী লীগ হালকা শ্লোগান দেয় না। গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসী মানুষের অভাব-অনটন-অনাহার-অনশনের যে চিত্র আমরা দেখেছি, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে আমরা আমাদের দাবী তুলেছি। সোনার বাংলা আজ শ্মশানে পরিণত । একদিন ছিল যখন কবি, জারী, সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়ার সুরে এই বাংলার পথ-প্রান্তর, মাঠ-ঘাট ও নদীগুলি মুখরিত হয়ে থাকতো, আজ সে সুরের শেষ রেশটুকুও মুছে গেছে। সোনার পূর্ব বাংলা আজ ভুখানাঙ্গা। আর তারই যোগানো অর্থে আবার নতুন ক’রে আজ পিণ্ডিতে রাজধানী গড়ে উঠেছে।

আওয়ামী লীগ গণআন্দোলনে বিশ্বাসী
আওয়ামী লীগ গণআন্দোলনে বিশ্বাসী। জেল-জুলুমের তারা তোয়াক্কা করে না। জনসাধারণের দাবী আদায়ের সংগ্রামে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করবে না এমন নির্ভীক সংগ্রামশীল যে-কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জাতীয় সমস্যার সমাধানে এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সংগ্রামে হাত মিলিয়ে কাজ করতে আওয়ামী লীগ সর্বদাই প্রস্তুত। যেসব রাজনীতিক
পৃষ্ঠা নং: ২৪৮

রাষ্ট্রীয় সমস্যা নিয়ে আয়েশী রাজনীতি করেন বা জনসাধারণের দাবী নিয়ে আলাপ-আলোচনা বা দর কষাকষির মাধ্যমে আন্দোলন সংক্ষেপ করার পক্ষপাতি, আওয়ামী লীগ তাদের এখন দূরে থাকার পরামর্শ দেয়। জেল-জুলুমের ধকল সয়ে এদেশের নির্যাতিত জনতা যদি কোনদিন তাদের সংগ্রামে জয়ী হয় তখন এইসব রাজনীতিককে আমরা হাসিমুখে বরণ ক’রে নেব।

যে দলে খুশী যোগ দিন
কেউ যেন মনে না করেন যে, আমি জনগণকে আওয়ামী লীগে যোগদানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে পেতে হলে দেশবাসীর স্বার্থ নিয়ে সংগ্রাম করে এমন, অথবা, আওয়ামী লীগের চেয়ে অধিকতর ত্যাগী কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকলে, সেই প্রতিষ্ঠানে আপনারা যোগদান করুন, আমরা বিন্দুমাত্র দুঃখিত হব না। কারণ আমরা চাই, দেশবাসী তাদের হাতে অধিকার ফিরে পাক, সে যে দল থেকেই হোক। স্মরণ রাখবেন, আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী দল জয়লাভ করলেই বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না, কারণ এ সরকারের পিছনে দেশবাসীর সমর্থন না থাকলেও অন্য ধরনের ক্ষমতাবান শ্রেণীর সমর্থন আছে। আজকের এ সংগ্রামকে আওয়ামী লীগ সর্বাত্মক সংগ্রাম বলেই জানে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, এই আন্দোলনে জয়ী হতে হলে দেশবাসীকে চরম ঝুঁকি নেবার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। স্মরণ রাখবেন, এবারকার সংগ্রাম আমাদের সর্বাত্মক সংগ্রাম, এবারকার সংগ্রাম আমাদের বাঁচা বা মরবার সংগ্রাম, এবারকার সংগ্রাম আমাদের অধিকার পাব কি পাবনা-এর সংগ্রাম। এ সংগ্রামে অনেককে হয়তো ফাঁসিকাষ্ঠেও ঝুলতে হতে পারে।

এই বাংলা তিতুমীরের বাংলা
এই ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের অসম্মান ঘটিয়ে মাত্র ৪ হাজার লোকের বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে এক মন্ত্রী ভায়া বলেছেন, এদেশে বিরোধী দল কিছু আছে বলে তিনি জানেন না। জবাবে পল্টন ময়দানে আজকের এই বিশাল জনসভাকে সাক্ষী রেখে আমি বলব, মন্ত্রী ভায়া, বাংলার ইতিহাস আপনি জানেন না। এই বাংলা মীরজাফরের বাংলা। আবার এই
পৃষ্ঠা নং: ২৪৯

বাংলাই তিতুমীর সুভাষ-নজরুল-ফজলুল হক সোহরাওয়ার্দী-মওলানা-ইসলামাবাদীর বাংলা। এই বাংলা যদি একবার রুখে দাঁড়ায়, তবে আপনাদের সিপাই, বন্দুক, কামান, গোলা সবই স্রোতের শেওলার মত কোথায় ভেসে যাবে, হদিসও পাবেন না। মন্ত্রী ভায়াকে আজো বলি, জনগণের ভোট ফিরিয়ে দিয়ে আপনাদের নেতাকে নির্বাচনে নামান-যদি শতকরা ২০টা ভোটও আপনারা পান, তবে আজীবনের জন্য তাঁকে আমরা প্রেসিডেন্ট হিসাবে বরণ করব। আর তা’ যদি না পান, তবে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার মত ভাগ্যবরণের জন্য আপনাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
ভাইসব, কাল আমার দেশদ্রোহিতার মামলার দিন। আসামীর কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াবার পূর্ব মুহূর্তে পল্টনের এই জনসমুদ্রের মাঝে যে আশা-ভরসা আর দুর্দমনীয় প্রাণাবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখে গেলাম, তাই আমাদের আগামী দিনের একমাত্র সম্বল, একমাত্র পাথেয়। এই পাথেয় যাদের আছে, কোন শক্তিই তাদের গতিরোধ করতে পারবে না। জনগণের প্রাণবহ্নির সম্মুখে নমরুদ ফেরাউন যখন কেউ টিকে নাই, তখন লক্ষ কোটি নিরন্ন বুভুক্ষুর ক্রোধানলের সম্মুখে এদেশের ক্ষমতাসীনরাও টিকবে না।”
[ শেখ মুজিব ও বাঙলাদেশঃ শহীদ আশরাফ সম্পাদিত, ঢাকা, ১৯৭১, পৃঃ ৭৬-৯১]

সম্মিলিত বিরোধী দল গঠন
স্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর আমলে এমন নির্ভয় ও নিঃসংকোচ ভাষণ সেদিন শুধু উপস্থিত শ্রোতাদের মনকেই আলোড়িত করে নি, সারা দেশ এতে প্রচণ্ড আলোড়িত হয়েছিল। যাহোক, স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে দেশের পাঁচটি বিরোধী দল এই মর্মে জুলাইয়ের ২১ তারিখে (’৬৪) খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে ৪ দিনব্যাপি এক বৈঠকে মিলিত হয়। এই বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, জামাতে ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম পার্টি। ২৪ তারিখে এই পাঁচটি বিরোধী দল সর্বসম্মতভাবে একটি ৯-দফা নির্বাচনী কর্মসূচী স্বাক্ষর ক’রে এক যুক্ত ইস্তাহারে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদসহ
পৃষ্ঠা নং: ২৫০

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাদের সবার পক্ষ থেকে মাত্র একজনকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই নির্বাচনী ঐক্য-জোটকে নাম দেয়া হ’ল সম্মিলিত বিরোধী দল-ইংরেজীতে যাকে বলা হয় Combined Opposition Party সংক্ষেপে C. O. P.
C. O. P. -এর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড় করিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হ’ল মোহতারেমা মিস ফাতেমা জিন্নাহকে। ফাতেমা জিন্নাহ ছিলেন পাকিস্তানের ‘জাতির পিতা’ কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভগ্নী।

মিস ফাতেমা জিন্নাহ
মিস জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনোনীত করার পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। যদিও তিনি বিশেষ কোন রাজনৈতিক দল বিশেষের মতালম্বী ছিলেন না, তথাপি আইয়ুব শাসন-ব্যবস্থার তিনি কঠোর সমালোচক ছিলেন। ১৯৬৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে গভীর দুঃখের সাথে তিনি বলেছিলেন যে, রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে দেশবাসীকে স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেছিলেনঃ “গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত প্রাপ্ত-বয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে যে দেশের সৃষ্টি বা জন্ম, সেই দেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ ভোট দ্বারা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের যোগ্য বা অযোগ্য তা’ আজ পর্যন্ত অমীমাংসিত থাকা একান্তই নিন্দনীয়।”
মিস জিন্নাহর এই বিবৃতির ফলে আইয়ুব সরকারের মধ্যে যথেষ্ট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের সেক্রেটারী জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী আবদুল ওয়াহেদ খান মিস জিন্নাহর কঠোর সমালোচনা করেন।
C. O. P. -এর এই মনোনয়নকে পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণ স্বাগত জানান। কিন্তু মৌলিক গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থায় সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের আর মূল্য কতটুকু?

কনভেনশন মুসলিম লীগ
সরকার পক্ষ থেকে আইয়ুব খানকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড় করিয়ে দেয়া হ’ল। সরকার পক্ষ বলতে অবশ্য তিনি নিজেই ছিলেন তার চেয়ে
পৃষ্ঠা নং: ২৫১

বলা ভালো যে আইয়ুব খান নিজেই প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ালেন। ক্ষমতার লোভ তাঁকে আচ্ছন্ন ক’রে ফেলেছিল। আর এই লোভে তিনি স্বাভাবিক ঔদার্য, মানবতাবোধ, গণসহানুভূতি সব কিছুকেই বিসর্জন দিয়েছিলেন। তা’ ছাড়া বৃহৎ কয়েকটি পুঁজিপতি পরিবারের মনস্তুষ্টি করে তিনি যে-কোন উপায়ে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই পুঁজিপতিদেরও একটি রাজনৈতিক দল ছিল। বলা বাহুল্য, সেটা মুসলিম লীগ। পাকিস্তান সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই এই দলটির চরিত্র ছিল যেমন বুর্জোয়া তেমনি সাম্প্রদায়িক। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের শ্রেণী-চরিত্র সম্বন্ধে আইয়ুব ওয়াকিবহাল ছিলেন। সামরিক শাসনের আওতায় থেকে যখন তিনি দেখলেন যে, এভাবে পূর্ণভাবে ডিকটেটরশীপ চালানো বেশী দিন সম্ভব নয়, তখন তিনি তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বন্ধু-বান্ধবদের হাত করার চেষ্টা করলেন। ক্ষমতার লোভে অনেক মোসাহেব জুটে গেল। বিশেষ ক’রে মুসলিম লীগের এক বিরাট অংশ তাঁর ডাকে সাড়া দিল। ১৯৬২ সালের ৪ঠা ও ৫ই সেপ্টেম্বর তাদেরকে নিয়ে আইয়ুব খান একটি নতুন সরকারী রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। এই নবগঠিত রাজনৈতক দলের নাম হ’ল কনভেনশন মুসলিম লীগ।
আইয়ুব খান প্রথমে এই দলের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে থাকলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ২২শে মে তিনি নিজেই সে দলের সভাপতি হয়ে বসলেন। প্রাক্তন মুসলিম লীগেরই আরেকটি অংশ এই কনভেনশন থেকে দূরে সরে থাকলেন। প্রতিবাদস্বরূপ তাঁরা নিজেরাই একটি দল গঠন করলেন যার নাম হ’ল কাউন্সিল মুসলিম লীগ। পরে এই কাউন্সিল মুসলিম লীগও সম্মিলিত বিরোধী দলের অন্যতম অঙ্গদল হিসেবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে।

ছাত্র-দিবস
সম্মিলিত বিরোধী দল যখন তাঁদের প্রেসিডেন্টের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন অভিযানে নামবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে পূর্ব বাংলার ছাত্র-সমাজ ১৭ই সেপ্টেম্বর (১৯৬৪) ‘ছাত্র-দিবস’ পালন করার জন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। কিন্তু সরকার ছাত্র-দিবসকে ব্যর্থ ক’রে দেয়ার
পৃষ্ঠা নং: ২৫২

জন্য পূর্বেই ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ক’রে দেবার নির্দেশ দেন। কিন্তু তা’ সত্ত্বেও ছাত্রগণ নির্দিষ্ট দিনে সঙ্ঘবদ্ধভাবেই দিবসটি পালনে সচেষ্ট হয়। সরকারের ইঙ্গিতে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারী ক’রে হিংস্র জানোয়ারের মত তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বহু ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে।

জুলুম প্রতিরোধ দিবস
এই নির্যাতনের প্রতিবাদে সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯শে সেপ্টেম্বর সারা পাকিস্তানে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হরতাল, শোভাযাত্রা ও জনসভার মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে এই দিবসটি পালন করা হয়। লক্ষ লক্ষ জনতা সেদিন পল্টনে সমবেত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জুলুমবাজীর বিরুদ্ধে গর্জন ক’রে ওঠেন।
এদিনটিকে বানচাল করার জন্যও সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তারা গুণ্ডাও নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু দুর্জয় ও নির্ভীক সংগ্রামী মানুষের অগ্নিমিছিল দেখে গুণ্ডারা তাদের গায়ে হাত দেবার সাহস পায় নি।
সম্মিলিত বিরোধী দলে আর একটি ব্যক্তিত্ত্ব সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। তিনি লেঃ জেঃ আযম খান। আযম খান কোন দল বিশেষের সমর্থক ছিলেন না। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তিনি জানতেন যে, তাঁকে অন্যায়ভাবে গভর্নরের পদ থেকে অপসারিত ক’রে পূর্ব বাংলার মানুষকে সেবার সুযোগ দান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আইয়ুবের শাসনন্ত্র একটি ন্যায় ও আদর্শবর্জিত স্বৈরতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব তাকে উৎখাত করা একান্ত আবশ্যক। আর সেই জন্যই তিনি সম্মিলিত বিরোধী দলের নির্বাচনী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলেন।
শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও মিস ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে নির্বাচনী অভিযানে সারাদেশ পরিভ্রমণ করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা উভয়েই ১৫ই অক্টোবর (১৯৫৪) ঢাকায় এসে উপস্থিত হন।

নির্বাচনী প্রচারে শেখ মুজিব
ক্রমাগত কয়েকদিন সারা প্রদেশ নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দসহ মিস জিন্নাহ বক্তৃতা দিয়ে
পৃষ্ঠা নং: ২৫৩

বেড়ালেন। সর্বত্রই তাঁরা জনতার বিপুল সমর্থন পেলেন। তাঁদের সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য গ্রাম থেকে লোকজন বন্যার মত আসতে লাগলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে আইয়ুব সরকার নতুন পাঁয়তারা কষতে লাগলেন। ইসলামী রাষ্ট্রে নারী রাষ্ট্রপ্রধান শরীয়ত-বিরোধী। এই প্রচারণা চালিয়ে ধর্মান্ধ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে চাইলেন। এর জন্য মোল্লাহ-মুসল্লিও নিয়োগ ক’রে মসজিদে মসজিদে প্রচার চালানো হ’ল। শুধু তাই নয়, মিস জিন্নাহর চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করতেও সরকারী প্রচারকরা দ্বিধাবোধ করে নি। গভর্নর মোনেম নিজে এই সকল প্রচারণায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।
এতদসত্ত্বেও বিপুল জনসমর্থন কুড়িয়ে মিস জিন্নাহ অক্টোবরের ২৩ তারিখে করাচী ফিরে গেলেন।

আইয়ুবের নির্বাচনী প্রচার অভিযানের জবাবে বাংলার জনগণ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুবও তাঁর শাসন আমলে নিজের কৃতিত্ব জাহির ক’রে নির্বাচনী প্রচার চালাতে থাকেন। নিজের প্রশংসা জাহিরের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার বাঙালীদের প্রতি তিনি চরম অবমাননাও প্রদর্শন করতে থাকেন। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হতেও দেরী হয় নি। ২৮শে অক্টোবর যখন তিনি ঢাকায় এসে এক জনসভায় বক্তৃতা দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন চারিদিক থেকে তাঁর প্রতি ইষ্টক বর্ষণ শুরু হয়েছিল। সরকারী দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যভাবে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকলেন। তাঁরা জনগণকে বোঝাতে চাইলেন যে, মিস জিন্নাহকে ভোট দিলে তা’ শেখ মুজিব ও আবদুল গাফফার খানকেই দেয়ার নামান্তর হবে। তাঁরা আরও বোঝাতে চাইলেন যে, মুজিব ও গাফফার ভারতের দালাল, ফলে পরিণতিতে এদেশ ভারতের হাতে চলে যাবে। তাঁরা এই দু’জন নেতাকে পাকিস্তানের দুশমন বলে ফতোয়াও জারী করেছিলেন। আসলে পূর্ব বাংলার শেখ মুজিব ও সীমান্ত-গান্ধী আবদুল গাফফার খান দু’জনই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। আর এর জন্য তাঁরা বার বার সরকারকে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের অনুরোধও জানিয়ে এসেছেন।
পৃষ্ঠা নং: ২৫৪

শেখ মুজিবের গ্রেফতার ও জামিনে মুক্তি
নির্বাচনী প্রচারণায় আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালোচনার জন্য শেখ মুজিবকে ১৯৬৪ সালের ৭ই নভেম্বর তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ (ক) ধারা অনুযারী মামলা করা হ’ল। অবশ্য পরে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের প্রাথমিক পর্যায়ে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে এই নির্বাচন হয় ১৯৬৪ সালের ১৯শে নভেম্বর। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে তার দশ দিন আগেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দু’ প্রদেশে দুইদিন সময় দেবার পেছনে সরকারের যথেষ্ট ধূর্ত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না যে, পশ্চিমাঞ্চলে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবেন আর সেখানে জয়ী হতে পারলে পূর্ব বাংলায় তার প্রভাব ফলানো যেতে পারে।

শেখ মুজিব পুনরায় গ্রেফতার ও জামিনে মুক্তি
মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন সমাপ্ত হলে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন বিষয়ে মাদারে মিল্লাত মিস ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনার জন্য ২২শে নভেম্বর শেখ মুজিব করাচী যান। ৬ দিন পর ঢাকায় ফিরে এসে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঠান, বেলুচ ও সিন্ধিরা যে সম্পূর্ণ আইয়ুব-বিরোধী তা’ তিনি বেশ জোরের সাথে উল্লেখ করেন। এর কয়েকদিন পর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনে আবার গ্রেফতার করা হ’ল। অবশ্য পরে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়।

মিস জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচার অভিযান
মিস ফাতেমা জিন্নাহ দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্বাচনী প্রচার অভিযানে ১৮ই ডিসেম্বর পূর্ব বাংলায় আসেন এবং প্রদেশের বিভিন্ন অংশে আবার তাঁরা প্রচার চালাতে থাকেন। আইয়ুব খান সরকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের পরিচিতি সভার ব্যবস্থা করেছিলেন। সর্বত্রই মাদারে মিল্লাত অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন। ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়” -মাদারে মিল্লাতের এই উক্তি সারাদেশে শ্লোগানে পরিণত হ’ল। এই শ্লোগান জনগণের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানের নির্বাচনী কমিশনের
পৃষ্ঠা নং: ২৫৫

ঘোষণানুযায়ী ১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, অবস্থার বৈপরীত্যে সরকার ততই বেসামাল হয়ে পড়তে লাগলেন। তাঁরা ব্যাপকভাবে ধরপাকড় আরম্ভ করলেন। ২৪শে ডিসেম্বর (’৬৪) আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা এবং বিরোধী দলের নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী এবং কুমিল্লার প্রখ্যাত জননেতা ও মাদারে মিল্লাত প্রচার কমিটির সভাপতি শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হ’ল।
শুধু তাই নয়, প্রথম থেকেই পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যমগুলোকে সরকারদলীয় প্রার্থীর প্রচারের বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। এমন কি ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মচারীদেরকেও একই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল। আমলারা আইয়ুবী আমলে প্রাপ্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার বদৌলতে ব্যাপকভাবে সরকারের পক্ষে প্রচার চালায়। এই সব আমলা ও সরকারী দালালদের সহায়তায় আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রীদের হাত করার জন্য শেষ পর্যন্ত অসৎ পন্থা অবলম্বন করেন। তাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ ঢালা হতে থাকে। নগদ অর্থ ছাড়াও তাদের সামনে আরো কয়েকটা লোভের টোপ ফেলা হয়। এর আগে ওয়ার্কস প্রোগ্রামের নামে ১০০ কোটি টাকা তাদেরকে অবাধে খরচ করবার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এর জন্য কোন হিসেব পর্যন্ত চাওয়া হয় নি।
সুতরাং মৌলিক গণতন্ত্রীর পদ নিঃসন্দেহে লোভনীয়। কিন্তু সরকার এবং তার দালালরা প্রচার করতে লাগলো যে মিস ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট হলে সম্মিলিত বিরোধী দল মৌলিক গণতন্ত্র প্রথা সম্পূর্ণভাবে বাতিল ক’রে দেবে এবং তাদের সদস্যপদ নিশ্চয় বাতিল হয়ে যাবে।
মিস ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেবার প্রতিশ্রুতিতে জয়লাভ করলেও এই সকল গণতন্ত্রীর অনেকে লোভের বশবর্তী হয়ে নিজেদের বিবেক-বিবেচনাকে বিসর্জন দিয়ে ফেলে। ফলে নির্বাচনের ফলাফল যা হবার তাই হ’ল।

প্রেসিডেন্টর নির্বাচনী ফলাফল
নির্বাচনের দিন অর্থাৎ ২রা জানুয়ারীর রাতেই প্রধান নির্বাচনী কমিশনার জনাব জি. মঈনুদ্দিন প্রেসিডেন্ট হাউসে এক রেকর্ডকৃত বেতার
পৃষ্ঠা নং: ২৫৬

ভাষণে নয়া শাসনতন্ত্র অনুযায়ী আইয়ুব খানকে পুনরায় আগামী ৫ বৎসরের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করেন। এই নির্বাচনে আইয়ুব খানের স্বপক্ষে ভোট ছিল ৪৯,৯৫১ এবং মিস জিন্নাহর স্বপক্ষে ছিল ২৮,১৯১। নানা মহল থেকে অভিযোগ উত্থাপিত হতে থাকে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সরকার ব্যাপক দুর্নীতি ও অসাধুতার পথ অবলম্বন করেছিলেন, -পরাজয়ের পর মিস জিন্নাহও এই অভিযোগ করেন। তা’ ছাড়া এই ফলাফলকে শাসনতন্ত্র ও সরকারী নীতির অনুমোদন হিসেবে গ্রহণ করা যায় না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সম্মিলিত বিরোধী দল নির্বাচনে হেরে গেলেও শেখ মুজিব এতটুকুও ভেঙে পড়েন নি। তিনি জানতেন যে পরিণতি এমন হবেই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বসাধারণের ভোটের যেখানে কোন মূল্য নেই সেখানে এই নির্বাচনের ফলেরই বা মূল্য কতটুকু। অর্থ দ্বারা যে তথাকথিত গণতন্ত্রীদের ভোট কিনে নেওয়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়, একথাই অপ্রত্যক্ষ নির্বাচনে প্রমাণ হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল যে, প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে এবং সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যদি পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না করা যায় তবে দেশের কোন ভবিষ্যৎ নেই। তাই তিনি জানুয়ারীর ৪ তারিখে আইয়ুবের তথাকথিত বিজয় সম্পর্কে দেশবাসীকে বলেন, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলবেই।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বললেন, সংগ্রাম অব্যাহত রাখলে জনতা পরিণতিতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবেই।

আইয়ুবের বিজয় উৎসব
নির্বাচনে জয়লাভ ক’রে আইয়ুব বিজয় উৎসব পালনে মত্ত হলেন। উৎসবে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য বিরোধী দলের কয়েকজন কর্মীকে গ্রেফতার করলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আওয়ামী লীগের জনাব তাজউদ্দিন আহমদ। উৎসবের দিনে আইয়ুবের দালালরা নেশার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। করাচীর লিয়াকতাবাদ ও নাজিমাবাদে উন্মত্ত অবস্থায় তারা ব্যাপকহারে মানুষ হত্যা ও ঘরবাড়ী পুড়িয়ে ছারখার করে। এই নৃশংসতার কারণ হ’ল, এ সব এলাকায় আইয়ুব খানকে চরম পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। আর তারই প্রতিশোধ নিলো মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। ফাতেমা জিন্নাহ এই নির্যাতন ও গণহত্যার কঠোর
পৃষ্ঠা নং: ২৫৭

নিন্দা করেছেন। শেখ মুজিব জানুয়ারীর ৬ তারিখে এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে বলেছেন, “এটা হচ্ছে জাতির জন্য ভবিষ্যতের গর্ভে সঞ্চিত দুর্যোগের সূচনা মাত্র।” জানুয়ারীর ৮ তারিখে নির্বাচনী কমিশনার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ২১শে মার্চ (১৯৬৫) জাতীয় পরিষদের এবং ৫ই মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন সারা পাকিস্তানে একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে। ২২শে মে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের তারিখ হিসেবে নির্দ্দিষ্ট করা হয়।
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সম্মিলিত বিরোধী দলের সদস্যবৃন্দ নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য করাচীতে লাখাম হাউসে এক বৈঠকে মিলিত হলেন। অনেক সদস্য এই নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের নির্বাচনে পুনরায় অংশ গ্রহণের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এটা মেনে নিতে পারলেন না। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার নূন্যতম সুযোগকেও গ্রহণ করতে হবে এই নীতিতেই তাঁরা বিশ্বাসী।
শেষ পর্যন্ত ২৫শে মার্চ ঢাকায় এ বিষয়ে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিরোধী দল ঘোষণা করেন যে, N.D.F. এবং C.O.P. একই সঙ্গে সরকারের বিরোধী দল হিসেবে নির্বাচনে লড়বেন।
শেখ মুজিব কর্তব্যের ডাকে আবার নির্বাচনী অভিযানে বের হলেন। ২১শে মার্চে যথাসময়ে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’ল। ফলাফল পূর্ববৎ। এবারেও সরকারী দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে C. O. P. ১০টি, N. D. F. ৫টি এবং ৬টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। বলা বাহুল্য সরকারী দল এবারেও দুর্নীতি ও অসাধুতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখালেন।

আইয়ুব খানের শপথ গ্রহণ
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দু’দিন পর অর্থাৎ ২৩শে মার্চ তথাকথিত পাকিস্তান দিবসে আইয়ুব খান নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন এবং এক নয়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন ক’রে তার সদস্যদের নামও ঘোষণা করলেন। এই মন্ত্রিসভায় বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হলেন।
পৃষ্ঠা নং: ২৫৮

শেখ মুজিবের মামলা
এর দু’দিন পর অর্থাৎ ২৫শে মার্চ ঢাকা হাইকোর্ট থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত দেশদ্রোহিতা সম্পর্কিত একটি মামলার রায় দান করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনীত নিম্নকোর্টে বিচারাধীন দেশদ্রোহিতামূলক মামলাটিকে খারিজ করবার অথবা অন্য কোর্টে সুবিচারের জন্য স্থানান্তরের আবেদনকে বাতিল ক’রে দেয়া হয়। অবশ্য উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবকে সুপ্রীমকোর্টে আপীলের অনুমতি প্রদান করা হয়। পল্টন ময়দানে এক বক্তৃতাকে কেন্দ্র ক’রে সেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এই দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনয়ন করা হয় এবং ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ (ক) ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। আবেদনকারীর পক্ষে বলা হয় যে, তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দেশদ্রোহিতামূলক কোন কিছুই তিনি করেন নি। শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার বাকস্বাধীনতার ওপর ভিত্তি ক’রেই তিনি জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করেছেন। তা’ ছাড়া পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ (ক) ধারাটি শাসনতন্ত্রে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।

প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা
৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ঘোষণা করা হয় যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই জনসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

ভাষার ওপর পুনরায় হামলা চালাবার চেষ্টা
একই দিনে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জনাব মঞ্জুর কাদির ‘ভাষা প্রসঙ্গে’ এক অদ্ভুত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৭ বছর পর আবার মাতৃভাষার ওপর হামলা চালাবার ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেল। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দালাল জনাব মঞ্জুর কাদির সেদিন পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ফেডারেশনের অভিষেক অনুষ্ঠানে ভাষণ দান প্রসঙ্গে প্রস্তাব দেন যে, দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে সংযোগ সাধনের মাধ্যম
পৃষ্ঠা নং: ২৫৯

হিসেবে ব্যবহারের জন্যে দেশে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা ও ইংরেজীর সংমিশ্রণে একটা সাধারণ ভাষা গঠন করা উঠিত।

বন্দী মুক্তি দিবস
সারা দেশব্যাপী এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে ‘বন্দী মুক্তি দিবস’ পালন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন,পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রশক্তি কর্তৃক আহূত জনসভায় দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ বন্দী ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তির দাবীতে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার সংকল্প ঘোষণা করা হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের আগে ও পরে অনেক রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট কর্মী জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরীকে ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নিবর্তনমূলক আটক থেকে মুক্তি দেয়া হয় এবং ফরিদপুরের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা শ্রী ফণীভূষণ মজুমদারকে এপ্রিলের ৪ তারিখে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। শ্রী ফণীভূষণকে ফেব্রুয়ারীর ৬ তারিখে ফরিদপুর জেলার রাজৈরে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন
১৬ই মে (’৬৫) প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের দিন। জাতীয় পরিষদে ব্যর্থতা সত্ত্বেও শেখ মুজিব এতটুকুও নির্বাচন বিমুখ হন নি। তিনি আবার পূর্ণ উদ্যমে নির্বাচনী প্রচারের জন্য গ্রাম গ্রামান্তরে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। ঠিক এমনি এক পর্যায়ে মে’র ১১ তারিখে তাঁর জন্মস্থান এলাকায় এক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। এর ফলে তাঁকে সাতদিন ধরে বিশ্রাম গ্রহণ করতে হয়।
যথাসময়ে ভোট গ্রহণের পর দেখা গেলো এবারে সরকারী দল অনেকটা নাস্তানাবুদ হয়েছে। ১৪৯টি আসনের মধ্যে কনভেনশন মুসলিম লীগ পান ৬৬টি আসন। বিরোধী দল ২৫টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেন ৫৮টি আসনে। প্রকৃতপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকে ধরে বিরোধী দলই নির্বাচনে জয়লাভ করে। কিন্তু সরকারী দল নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানাভাবে প্রলুদ্ধ করে অনেক স্বতন্ত্র সদস্যকে নিজেদের দলে টেনে নিতে সমর্থ হন।
পৃষ্ঠা নং: ২৬০

এই হ’ল বুনিয়াদী গণতন্ত্রের পরিচয়-কায়েমী স্বার্থবাদীদের উদ্দেশ্য সফলের এ এক নতুন পন্থা। এই গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সমগ্র পাকিস্তানের মানুষকে শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট করা হয়েছে আর বিশেষভাবে পূর্ব বাংলার মানুষকে একটি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ ব্যবস্থার নিগড়ে আবদ্ধ করা হয়েছে। গভর্নর মোনেম খান বিপুল শক্তিতে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতিকে এবং প্রগতিবাদী চেতনাকে প্রতিরোধ ও নির্মূল করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু শোষিত ও নিপীড়িত মানবতার জ্বলন্ত প্রতীক শেখ মুজিব এ অন্যায় ও অত্যাচারকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। এত বড় পরাজয়ের মুখেও তিনি নতুন উদ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে পুনরায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কেননা তিনি জানেন সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। তাই এক সংগ্রাম শেষ হতে না হতেই নতুনতর সংগ্রামের জন্য তিনি পথ প্রস্তুত করেছেন সারাজীবন। এবারের সংগ্রাম আরো কঠিন, আরো দুর্বার, আরো বিপদসংকুল। এবার তিনি উপলদ্ধি করলেনঃ
বহ্নিবন্যাতরঙ্গের বেগ,
বিষশ্বাসঝটিকার মেঘ,
ভূতল-গগন-
মূর্ছিত-বিহ্বল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন-
ওরই মাঝে পথ চিরে চিরে
নূতন সমুদ্র তীরে
তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি,
পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচা-কেনা
আর চলিবে না
বঞ্চনা বাড়িয়া ওঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি,
এসেছে আদেশ বন্দরে বন্ধনকাল এবারের মতো হ’ল শেষ।
পৃষ্ঠা নং: ২৬১

সংগ্রামী জীবনের চতুর্থ অধ্যায়
(১৯৬৫-১৯৬৯)
শেখ মুজিব এবার আরো তীব্র রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করলেন। ১৯৬৫ সালের ৬ই ও ৭ই জুন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভার বৈঠক বসলো। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দুর্বার গণ-আন্দোলন চালিয়ে যাবার সংকল্প ঘোষণা করলেন। ঘোষণা করলেন যে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী ক্ষমতাসীনদের উৎখাত করতে হবে।
শেখ মুজিবের এই সংকল্পের কথায় সরকারী সচেতনা নতুন ক’রে জাগ্রত হয়ে উঠল। করাচী, লাহোর, পিণ্ডি ও ঢাকা যৌথভাবে শেখ মুজিবকে এবং গণঐক্যকে পর্যুদস্ত করতে কাজ শুরু করে দিল।
জুলাই-এর ৬ তারিখে ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার জনাব এম. বি. আলম বিগত ১৫ই ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দেবার জন্য শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগের খসড়া তৈরী করলেন।
কয়েকদিন পর ২০শে জুলাই শেখ মুজিব নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য করাচী যাত্রা করলেন। এই আলোচনা বৈঠকে তিনিই ছিলেন সভাপতি।
পৃষ্ঠা নং: ২৬২

সাংবাদিক নির্যাতনঃ শেখ মুজিবের নিন্দা
এর দু’দিন পর মোনেম খানের পুলিশ এক বর্বর আক্রমণে ঢাকার প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচার চালায়। সরকারের ইঙ্গিতে, প্রায় অকারণেই বলা যায়, অকস্মাৎ এক বিরাট পুলিশ বাহিনী ঢাকা প্রেসক্লাবে নৃশংসভাবে হামলা চালায় এবং টিয়ার গ্যাস সেল ছুঁড়ে সাংবাদিকদের এক শ্বাসরুদ্ধকর বীভৎস পরিবেশে নির্যাতন করে। শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরেই এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করলেন। তিনি এর বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবী জানালেন। কিন্তু সরকার তাঁর কথায় কোন কর্ণপাতই করলেন না।

সরকারী প্রচারণা
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শেখ মুজিবের সংগ্রামী ঘোষণা শুনে আইয়ুব-মোনেম চক্রের চক্রান্ত দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। লাহোর প্রস্তাবে স্টেটগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কথা উল্পেখ ছিল। শেখ মুজিব যদি এই আন্দোলনে সফল হন তা’ হ’লে পূর্ব বাংলা স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে সার্বভৌম ক্ষতার অধিকারী হয়ে পড়তে পারে এবং পাকিস্তানের ‘জন্মশত্রু’ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ক’রে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারে। অতএব আইয়ুব চক্রের অনেকগুলো কার্যক্রমের একটি কার্যক্রম স্থির হ’ল এই যে, ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের, বিশেষ ক’রে পূর্ব বাংলার জনগণের মনকে বিষিয়ে দিতে হবে। এই উদ্দেশ্যে সরকারী প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জাতীয় সংহতির কথা বারবার প্রচারিত হতে থাকল। এর দ্বারা সরকার আর একটি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চাইলেন। তা’ হ’ল শেখ মুজিবের প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণের ইমেজকে নষ্ট ক’রে দেয়া। একথা সবাই জানেন যে, শেখ মুজিব এবং তাঁর সহকর্মীরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াসী। তা’ ছাড়া আওয়ামী লীগ বরাবর অসাম্প্রদায়িক নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। তাঁদের এই নীতি ও আদর্শের অপব্যাখ্যা করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণকে
পৃষ্ঠা নং: ২৬৩

বোঝাতে চান যে, ওরা কাফেরদের বন্ধু, ভারতের দালাল। সুতরাং শেখ মুজিব ও তদীয় অনুসারীদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা যাবে না—তাঁদের ডাকে, কোন আন্দোলনে শরিক হলে দেশের অকল্যাণ হবে। শুধু এ পর্যন্তই নয়, কাশ্মীরকে নিয়ে পাকিস্তান সরকার এ সময় বড্ড বেশী নাচানাচি শুরু ক’রে দিলেন। বলতে লাগলেন, যেহেতু কাশ্মীর মুসলিম-প্রধান অঞ্চল সেহেতু তার ওপর ভারতের কোন অধিকার নেই।

পাক-ভারত যুদ্ধ বাধানোর জন্য আইয়ুবের পাঁয়তারা
নির্বাচনে জয়লাভ ক’রে আইয়ুবের মিলিটারী মেজাজ গরম হয়ে ওঠে। সুরার নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেন তিনি। আইয়ুব খান মুসা খান ও ইয়াহিয়া খানকে ‘ফিল্ড ওয়ার্কে’ মনোযোগ দিতে বলেন। ভুট্টো তো দু’হাতের তালু মেলেই ছিলেন—এবারে আইয়ুব প্রশংসাসূচক তালি মারলেন। শুরু হ’ল পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত এলাকা কচ্ছের রান ও কাশ্মীরে ঠোকাঠুকি। এই ঠোকাঠুকি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে। আইয়ুব যদিও প্রচার করেছিলেন যে ভারতই পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছে, কিন্তু একথা সত্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের প্রেরণ ক’রে সেখানে অঘোষিত যুদ্ধে যখন ভারতকে পর্যুদস্ত করতে তিনি ব্যস্ত, তখন ভারত উপায়ান্তর না দেখে লাহোর আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। ভারত প্রকাশ্য আক্রমণ করে, কিন্তু পাকিস্তানের গোপন আক্রমণই তার জন্য দায়ী।

পাক-ভারত যুদ্ধঃ কোসিগিনের মহৎ প্রচেষ্টা
সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে প্রকাশ্যভাবে এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৭ দিন এই যুদ্ধ চলে। জাতিসংঘের স্বস্তিপরিষদ (Security Council) ২০শে সেপ্টেম্বর এই যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিলে উভয় দেশই তা’ মেনে নেন। পরে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিকোসিগিনের আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিঃ লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মিলিত হন এবং “যুদ্ধ নয়” চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। ১৯৬৬ সালের ১০ই জানুয়ারী তারিখে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়।

পূর্ব বাংলার জনগণের অসহায়ত্বের নগ্ন-চিত্র
যদিও মাত্র সতের দিন যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল, তবু এই যুদ্ধের ফলে
পৃষ্ঠা নং: ২৬৪

পুর্ব বাংলার জনগণের চোখ খুলে যায়। তারা দেখল, বহিঃশত্রুর
আক্রমণের মুখে তাদেরকে রক্ষা করবার মত কোন সুনিশ্চিত ব্যবস্থাই করা হয় নি। এই যুদ্ধে বহির্বিশ্ব থেকে পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনকি, পাকিস্তানের অন্য অংশের সঙ্গে এই অংশের কোন যোগাযোগই ছিল না। উভয় অংশের মাঝখানে বিরাট রাষ্ট্র ভারতের অবস্থিতি। সেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে দুই অংশের মধ্যে যোগসূত্র যেমন বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য, তেমনি ভারতের দুরভিসন্ধি থাকলে যে কোন মুহূর্তে এই অরক্ষিত অঞ্চল বাংলাদেশকে অধিকার করা তাদের পক্ষে মোটেও কঠিন ছিল না। সৌভাগ্যের বিষয়, ভারত সরকার এত বড় একটি সুযোগের কোন সদ্ব্যবহারই করেন নি। বাংলাদেশের প্রতি বৈরী মনোভাব ভারত সরকারের কোন দিনই ছিল না। বরং এই অংশের মানুষের কল্যাণই তাঁরা কামনা করে এসেছেন। তাই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকার ও জনগণ যথেষ্ট মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। এই যুদ্ধের ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধ আরও বেশী চলতে থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতিক ও নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ত। একে তো পাকিস্তান আমলে কোনকালেই এখানে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য মজুত ক’রে রাখা হ’ত না, উপরন্তু বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় বাইরে থেকে কোন সাহায্য আনবার পথও খোলা ছিল না। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে এই অঞ্চলের মানুষকে ধীরে ধীরে ঠেলে দেয়া হ’ত। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় যে, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।
যাহোক, যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণের নিকট এই অঞ্চলের সার্বিক অসহায়ত্বের একটি নগ্নছবি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। তারা মর্মে মর্মে অনুভব করে যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ মনোভাব দিনে দিনে তাদেরকে গোলামীর কঠিন জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলছে এবং এক ভয়াবহ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার প্রতি কঠিন উপেক্ষা যেমন প্রকট হয়ে ওঠে, তেমনি আবার সচেতনভাবে এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবার
পৃষ্ঠা নং: ২৬৫

ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। রবীন্দ্র-সঙ্গীত বেতারে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ক’রে দেয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন (যদিও ব্রাহ্ম) এবং হিন্দুস্থান আমাদের শত্রু-অতএব তাঁর লেখা গান মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ হতে হবে। নজরুল ইসলাম যদিও মুসলমান—কিন্তু ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত, সে কারণেই তাঁর যে সব গানে হিন্দু ঐতিহ্যের ছাপ আছে সেগুলোকে বর্জন করা হয় এবং তাঁর ইসলামী গানগুলো থেকে শ্মশান, কৃষ্ণচূড়া, রামধনু এবং এই জাতীয় বহু শব্দ বাদ দেয়া হয়।
সংস্কৃতির ওপর এই আঘাত পূর্ব বাংলার জাগ্রত জনতাকে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল।
যুদ্ধের পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে জনমনে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতা ও বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতি অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে নতুন পথে জমাট বাঁধতে থকে। জনগণের সাথে যার প্রাণের যোগ সবচেয়ে নিবিড়, সেই গণনেতা শেখ মুজিব এই সুযোগের যথাযথ সদ্ব্যবহারের জন্য এগিয়ে আসতে থাকেন। তিনিই প্রথম এ ব্যাপারে সোচ্চার প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে চরম উদাসীনতা প্রদর্শনের জন্য সরকারকে প্রকাশ্য জনসভায় তিনি ধিক্কার প্রদান করেন। তিনি দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, মওলানা ভাসানী এবং N. D. F. এর নেতৃবৃন্দ নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ পূর্ব বাংলার অন্যান্য নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেয়ার পরিবর্তে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আইয়ুব খানের সঙ্গে ২৬শে ডিসেম্বর (১৯৬৫) তারিখে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর ভারতের নিন্দা প্রচারাভিযান চালাতে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। পরবর্তীকালে জনসভায় দাঁড়িয়ে এঁরা এই প্রতিশ্রুতি পালন করেছিলেন।
শেখ মুজিব ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা এবং আইয়ুব সরকারের মিথ্যা প্রশংসা—এই দুই জাতীয় কাজ থেকেই অনেক দূরে থাকতেন। পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মত ভারতীয় হামলার নিন্দা
পৃষ্ঠা নং: ২৬৬

করতে তিনি সোচ্চার হলেন না—এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সংযতবাক ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। ভারতীয় হামলার সমালোচনা তিনি যে করেন নি, তা’ নয়। তবে এই যুদ্ধে পাকিস্তানের দায়িত্বকেও তিনি অস্বীকার করেন নি। এ কথা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারীদের পাঠিয়ে আইয়ুব খান নিজেই যুদ্ধকে ডেকে এনেছেন। তাঁর মনে একটি প্রচ্ছন্ন কুমতলব কাজ করেছিল। পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে এবং কাশ্মীরে সুশৃঙ্খলভাবে অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে তিনি ভেবেছিলেন যে, এতে ভারত পূর্ব বাংলা দখল ক’রে নেবে এবং তিনিও কাশ্মীর হস্তগত করবেন। অর্থাৎ সরাসরি কাশ্মীরের সাথে পূর্ব বাংলার আদান-প্রদান, যাকে বলে বার্টার ডিল, সেটা না ক’রে আইয়ুব এই সুচতুর পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত তাসখন্দ বৈঠকের আলোচনায় তাঁর বক্তব্যই এই দুরভিসন্ধির সুস্পষ্ট প্রমাণ দেয়। কিন্তু ভারত তাঁর এই চালাকি বুঝতে পেরেই পূর্ব বাংলার দিকে ভ্রুক্ষেপ না ক’রে লাহোর আক্রমণ ক’রে বসলেন। আইয়ুবের গণনায় বড় ভুল হয়ে গেল। এ কথা বাঙালী নেতাদের মধ্যে একমাত্র শেখ মুজিবই যথার্থভাবে অনুভব করেছিলেন
তা’ ছাড়া যুদ্ধ যেদিক থেকেই আসুক, শেখ মুজিবের তা’ কাম্য ছিল না। তিনি যুদ্ধ কামনা করেন না—তিনি কামনা করেন শান্তি, ঐক্য, গ্ৰগতি, -এই হ’ল তাঁর অন্তরের চিরন্তন বাণী।

ঐতিহাসিক ছয়-দফার পটভূমিকা
কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারীদের পাঠিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া আর সেই সাথে পূর্ব বাংলাকে বলতে গেলে প্রায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় রাখা এবং তাসখন্দের বৈঠকে প্রায় চারদিন ধরে বাচাল পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ নিজে কাশ্মীর কাশ্মীর ক’রে গোঁ ধরা, আইয়ুবের এবম্বিধ কার্যকলাপ নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, তিনি বাংলাদেশের বিনিময়ে কাশ্মীর চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শেষরক্ষা করতে পারলেন না। আইয়ুবের এই দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য আর কারো নিকট ধরা না পড়লেও শেখ মুজিবের দৃষ্টি এড়াতে পারে নি। তাই ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর থেকে শেখ মুজিবের কার্যকলাপের প্রবাহ নতুন খাতে বইতে শুরু করলো। ছয়-দফা এই নতুন প্রবাহপথের প্রথম ফসল—পূর্ব বাংলার মুক্তিসনদ, তথা
পৃষ্ঠা নং: ২৬৭

স্বাধীন বাংলাদেশের পথে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এদিক থেকে স্বাধীন বাংলার স্বপ্নকে উজ্জীবিত ও ত্বরান্বিত করেছিল।
মহামতি লেনিনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সব সময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন ক’রে এসেছে। পাক-ভারত যুদ্ধ যখন ভয়াবহ রূপে মোড় নিতে যাচ্ছিল, তখন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিঃ কোসিগিন দুই দেশকেই শান্তি স্থাপনের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই আহ্বানে দুই দেশই সাড়া দিয়েছিল। মিঃ কোসিগিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে তাসখন্দে একটি বৈঠকে আমন্ত্রণ জানালেন। এই আমন্ত্রণে দুই পক্ষই সম্মতি জ্ঞাপন করলেন।
আইয়ুব খান যদিও অস্ত্রের বলে দেশের গণতন্ত্রকে হত্যা ক’রে একচ্ছত্র অধিপতি সেজেছিলেন, তথাপি জনগণের সমর্থন যে তাঁর পেছনে নেই এই ভয় সর্বদাই তাঁকে প্রেতাত্মার মত অনুসরণ করেছে। তাসখন্দ-এ যাবার পূর্বে তিনি তাই পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দের অনুভূতিকে যাচাই ক’রে দেখতে চাইলেন। আইয়ুবের মোসাহেব গভর্নর মোনেম খান পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্য আহ্বান করলেন। অনেকেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলে শেখ মুজিব স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে পশ্চিমা তল্পিবাহকের সাথে কোন আ্লোচনা হতে পারে না। আলোচনা যদি হতেই হয়, আইয়ুবের সাথেই হবে। শেখ মুজিব ব্যতিরেকে পূর্ব বাংলায় অন্য নেতৃবৃন্দের গুরুত্ব কতটুকু আছে এ কথা মোনেম খানও জানতেন, আইয়ুব খানও বুঝতে পারতেন। সুতরাং আইয়ুবকে ঢাকায় আসতে হল। ১৯৬৫ সালের ২৫শে ডিসেম্বরে বৈঠক বসল। নূরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী, ফরিদ আহমদ প্রভৃতির সাথে আওয়ামী লীগ থেকে বসলেন শেখ মুজিব, সালাম খান, তাজউদ্দিন আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং জহিরুদ্দিন। কিন্তু বৈঠকের প্রারম্ভেই গোলমাল দেখা দিল। আইয়ুব খান প্রথমেই প্রশ্ন ক’রে বসলেন—“বলুন আপনারা কেন এসেছেন, কি আপনাদের বক্তব্য।” শেখ মুজিব এতে বিস্মিত ও বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি সোজা দাঁড়িয়ে বললেন, “আমরা তো নিজে থেকে আসি নি—আপনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাই এসেছি—আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, কিন্তু এভাবে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে এসে অপমান করার
পৃষ্ঠা নং: ২৬৮

অধিকার আপনার নেই।” আইয়ুবের মুখের ওপর এভাবে কেউ কথা বলতে পারেন, সে বিষয়ে তাঁর এই প্রথম অভিজ্ঞতা। তিনি যেমন ক্ষুব্ধ হলেন, তেমনি অবাক না হয়েও পারলেন না।
যাহোক, সালাম খান মাঝখান থেকে দাঁড়িয়ে বিষয়টি সহজ ক’রে দিলেন। নুরুল আমীন অনেক স্তাবকতার পর গণতন্ত্র সম্পর্কে সামান্য কিছু বলতে লাগলেন। শেখ মুজিব তাঁকে বাধা দিয়ে পূর্ব বাংলাকে যুদ্ধের সময় কিভাবে অরক্ষিত রাখা হয়েছিল এবং কিভাবে পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এসব কথা বললেন। তিনি যদিও দফাওয়ারীভাবে ছয়-দফার বর্ণনা দেন নি, কিন্তু আভাসে-ইঙ্গিতে তিনি তাঁর ছয়-দফার সারমর্মই আইয়ুবের সামনে বিচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরেন। হামিদুল হক চৌধুরী শেখ মুজিবের এই বক্তব্যে বাধা দান করেন। কিন্তু শেখ মুজিবও তার সমুচিত জবাব দিতে কুণ্ঠিত হন নি।
যদিও কোন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই বৈঠক শেষ হয় নি, তবু আইয়ুব খান একথা অবগত হয়ে গেলেন যে পূর্ব বাংলায় যে সিংহপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁকে সহজে কাবু করা যাবে না, আর এই সিংহপুরুষের পশ্চাতে দেশের গণসমর্থন দিন দিন বিপুল থেকে বিপুলতর হতে যাচ্ছে।

ঐতিহাসিক তাসখন্দ চুক্তি
এবার তাসখন্দ বৈঠকের কথায় ফিরে আসা যাক। ১৯৬৬ সালের ৪ঠা জানুয়ারী দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে গত ১৮ বৎসরব্যাপী উত্তেজনার অবসানকল্পে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক উদ্যোগে তাসখন্দে যে ঐতিহাসিক সম্মেলন শুরু হয়, সেখানে পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ প্রথমে ৮ই জানুয়ারী তারিখে ভারত কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি সম্পন্ন করতে রাজী হন নি। আইয়ুব ও তদীয় করুণাপুষ্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া কোনরূপ চুক্তি করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তাঁরা প্রথম থেকেই গোঁ ধরলেন যে, “ন্যায় ও সম্মানজনক পন্থায় কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হলে, অথবা এ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা গ্রহণ করা না হলে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি অপ্রাসঙ্গিক হবে।”
অবশেষে তার দু’দিন পর অর্থাৎ ১০ই জানুয়ারী (’৬৬) উভয় দেশের
পৃষ্ঠা নং: ২৬৯

মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিকেই ঐতিহাসিক ‘তাসখন্দ চুক্তি’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই তাসখন্দ চুক্তির মর্মকথা হলঃ
(১) একের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অপরের হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ পথে সকল বিরোধের মীমাংস ও
দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধপূর্ব স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা।
(২) হাই কমিশনারদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রত্যার্বতন ও স্বাভাবিক কুটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃ প্রতিষ্ঠা।
(৩) ২৫শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে নিজ নিজ সৈন্য ৫ই আগস্টের (১৯৬৫) সীমানায় প্রত্যাহার।
(৪) যুদ্ধবন্দী প্রত্যর্পণের নির্দেশ দান।
(৫) পারস্পরিক অপপ্রচার হতে বিরত থাকা।
(৬) দু’দেশের মধ্যেকার যাবতীয় চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন।
(৭) বাস্তুত্যাগ বন্ধের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি।
(৮) শরণার্থী ও বহিরাগত উচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রশ্নে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।
(৯) পারস্পরিক স্বার্থসংক্রান্ত প্রশ্নে শীর্ষ বা অন্য পর্যায়ে বৈঠক।
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই জানুয়ারী, ১৯৬৬]

লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু
কিন্তু এই ঐতিহাসিক চুক্তির মাত্র নয় ঘন্টা পর ১১ই জানুয়ারী তারিখে গভীর রাতে (স্থানীয় সময় ১-১৫ মিনিট) আকস্মিকভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে। শেখ মুজিবও এক শোকবাণী পাঠিয়েছিলেন। বাণীতে তিনি বলেন যে, শাস্ত্রিজী দুই দশের শান্তি ও প্রগতির জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। ঐতিহাসিক ‘তাসখন্দ চুক্তি’ পূর্ব বাংলার সর্বত্রই বিশেষভাবে অভিনন্দিত হয়েছিল। কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনরূপ মনোমালিন্য নিয়ে বাংলার জনগণ বসবাস করতে চায় না।
পৃষ্ঠা নং: ২৭০

তাসখন্দ চুক্তিতে শাসকচক্রের প্রতিক্রিয়া
কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের নিকট শান্তির চেয়ে বড় কথা ছিল স্বার্থ। বাংলার বিনিময়ে কাশ্মীরকে পাওয়ার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় কাশ্মীর প্রশ্ন তাদের নিকট আরও বড় হয়ে দেখা দিল। তাই যে তাসখন্দ চুক্তিতে কাশ্মীর সমস্যার, কোন সমাধান নেই, সে চুক্তিকে তাঁরা অভিনন্দন জানাতে পারেন নি।
আসলে আইয়ুব-ভুট্টোও এই চুক্তিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বিশ্বের নেতৃবৃন্দের চাপে পড়েই তাঁদেরকে এ ধরনের চুক্তিকে মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু যা করেছেন তাদের তো আর সহজে বাতিল করা যায় না, ভবিষ্যতে আবার সুযোগমত প্রতিশোধ নেয়া যাবে—এই ভেবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে ব্যাপারটি আপাততঃ ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করলেন তাঁরা। কিন্তু উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন নেতারা আইয়ুবের এই অন্তগূঢ় রহস্যের কথা অনুধাবন করতে পারেন নি। ফলে, ধীরে ধীরে তাসখন্দ চুক্তি-বিরোধী একটি আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন পশ্চিম পাকিস্তানে এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে, সরকার ওখানকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। এমন কি, আইয়ুব খান নিজেও বাধ্য হয়ে তাসখন্দ চুক্তির প্রথম ধারাটি পর্যন্ত অস্বীকার করতে দ্বিধা করেন নি।
যা হোক, শেখ মুজিব এই সময় অত্যন্ত সাবধানে কথাবার্তা বলেছেন এবং তাসখন্দ চুক্তি অভিনন্দনের সাথে সাথে পূর্ব বাংলার স্বার্থই বড় ক’রে তুলেছেন। এই সময় তাঁর নামে আনীত বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রবিরোধীমূলক মামলা-মোকদ্দমা দায়ের ক’রে তাঁকে হয়রানী করা হতে থাকে।

শেখ মুজিবের হয়রানী
২৮শে জানুয়ারী (১৯৬৬) অর্থাৎ ১৫ই মাঘ (১৩৭২) শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহাত্মক বক্তৃতা দানের অভিযোগে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারা মতে এক বৎসর এবং আপত্তিকর বক্তৃতা দানের জন্য জননিরাপত্তা আইনের ৭(৩) ধারামতে আরো এক বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। জানুয়ারী মাসের ৪ তারিখে এই মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য ছিল। উক্ত তারিখে এবং পরবর্তী আরো দু’টি তারিখে-
পৃষ্ঠা নং: ২৭১

১০ই ও ১৭ই জানুয়ারী এই মামলার রায় প্রদান স্থগিত থাকে। দু’বছর কারাদণ্ডাদেশের রায় ঘোষিত হওয়ার পর পরই উক্ত কোর্টে হাইকোর্টে আপীল সাপেক্ষে শেখ মুজিবের অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন পেশ করা হলে কোট তা’ প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তাঁকে সরাসরি কোর্ট থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। শেখ সাহেবকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পরক্ষণেই হাইকোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল দায়ের এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন করা হলে বিচারপতি আর. টি. তালুকদার উক্ত আবেদন গ্রহণ ক’রে তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তির আদেশ প্রদান করেন। ফলে সেদিনই তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি দানের সময় শেখ সাহেবকে জেলগেটে বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়।
পরদিন অর্থাৎ ২৯শে জানুয়ারীতেও আবার শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনের ৭ (৩) ধারামতে অপর একটি অভিযোগ আনয়ন করা হয়।
ফেব্রুয়ারীর ৯ তারিখে “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও” শীর্ষক প্রচারপত্র মামলার শুনানী হবার কথা ছিল, কিন্তু ২৪শে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত শুনানী মুলতবী রাখা হয়। এই মামলাতেও শেখ মুজিব অন্যতম আসামী ছিলেন। তিনি ছাড়া অন্যান্য যারা এতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁরা হলেনঃ সর্বজনাব আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজুর রহমান এম. এন. এ., তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী, মাহমুদ আলী এম. এন. এ., ডঃ আলীম-আল-রাজী এম. এন. এ., অলি আহাদ, আলী আকসাদ (ইত্তেফাকের সহযোগী সম্পাদক) ও ওবায়দুর রহমান। এইভাবে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পর পর অনেকগুলো মামলার জাল বিস্তার ক’রে তাঁকে হয়রানী করা হচ্ছিল।
এদিকে তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র ক’রে কিছু সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ আবার রাজনীতির জুয়াখেলাকে জীবন্ত করবার জন্য কসরত শুরু করলেন। এঁরা ১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে একটি জাতীয় কনফারেন্স আহ্বান করলেন। শেখ মুজিব প্রথমতঃ এই সম্মেলনে যোগদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এই সময় আওয়ামী
পৃষ্ঠা নং: ২৭২

লীগের নিখিল পাকিস্তানী সভাপতি ছিলেন নসরুল্লাহ খান, সাধারণ সম্পাদক জহিরুদ্দিন। পূর্ব বাংলার সভাপতি ছিলেন আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আর সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু কার্যতঃ, যার স্থান যেখানেই হোক না কেন, আওয়ামী লীগের সমস্ত শক্তির উৎস শেখ মুজিব। লাহোর কনফারেন্সে যেতে শেখ মুজিব অস্বীকার করায় নসরুল্লাহ খান ছুটে এলেন পূর্ব বাংলায়। অনেক আলোচনার পর স্থির হ’ল যে, পূর্ব বাংলা থেকে প্রতিনিধি যোগদান করবেন। শাহ আজিজুর রহমান তখন আওয়ামী লীগে ছিলেন। শেখ মুজিব তাঁর নেতৃত্বে কয়েকজনকে পাঠানোর কথাই প্রথম দিকে ভাবছিলেন। কিন্তু ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া বললেন, “মুজিবর মিয়া (এই নামেই তিনি সব সময় ডাকতেন) যদি যেতেই হয়, আপনিই যান। আর আপনার মনে এতকাল যে কথাগুলো আছে সেগুলো লিখে নিয়ে যান। ওরা শুনুক না শুনুক, এতে কাজ হবে।”
শেখ মুজিব দ্বিতীয় চিন্তায় স্থির করলেন যে তিনি নিজেই যাবেন এবং এতকাল পূর্ব বাংলার স্বার্থ নিয়ে তিনি যে কথা ভেবেছেন, যে কথাগুলো অগোছালোভাবে বলে এসেছেন, সেগুলো লিখে নিয়েই যাবেন।

ছয়-দফার জন্ম
অতঃপর তিনি তাঁর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের কয়েকজন অনুরাগী নিয়ে আলফা ইনসিওরেন্সের কক্ষে বসে ছয়-দফার একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া প্রণয়ন করলেন। বাঙালীর মুক্তিসনদ ছয়-দফা এভাবেই প্রণীত হ’ল। এর সামগ্রিক প্রণেতা শেখ মুজিব নিজে। ছয়-দফা তাঁর সুদীর্ঘকাল রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা,ত্যাগ এবং প্রজ্ঞার ফসল। দীর্ঘকাল তিনি দেশ ও দেশের সমস্যা সম্পর্কে যে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন, ছয়-দফায় তার ফলশ্রুতি ঘটেছে। কোন কোন মহলকে এরূপ মন্তব্য করতে শুনেছি যে বিশেষ বিশেষ পণ্ডিতদের নিকট থেকে ছয়-দফার ধারণা ধার করা হয়েছে। কিন্ত তাদের অবগতির জন্য বলা দরকার যে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। একদিন হঠাৎ বসে কয় ঘন্টার মধ্যেই এমন বৈজ্ঞানিক বক্তব্যের বিকাশ ঘটতে পারে না। এর জন্য সুদীর্ঘকাল চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন, প্রয়োজন পরিপক্ক অভিজ্ঞতার। ১৯৪৫ সাল থেকে
পৃষ্ঠা নং: ২৭৩

ক্রমাগত রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত থেকে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য ক’রে যে অভিজ্ঞতা শেখ মুজিব সঞ্চয় করেছিলেন ছয়-দফায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ছয়-দফা প্রণয়নের পূর্বে বহু সভা-সমিতিতে তিনি এসব বক্তব্য ছাড়া ছাড়া বলেছেন। তাসখন্দ বৈঠকের পূর্বে আইয়ুব খান এলে তাঁর সামনেই এলোমেলোভাবে আসলে ছয়-দফার কথাই তিনি বলেছেন। আলফা ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কক্ষে যেদিন তিনি ছয়-দফা প্রণয়ন করলেন সেদিন তাঁর সুদীর্ঘকালের সুশৃংখল চিন্তা ও অবিন্যস্ত বক্তব্য ছয়-দফায় বিন্যস্ত রূপ ধারণ করলো। সুতরাং ছয়-দফার স্বাপ্নিক তিনি, প্রণেতাও তিনি নিজেই। আশা করি এতে ভ্রান্ত ধারণার নিরসন ঘটবে।
যাহোক, ছয়-দফা যদিও বিশেষ গোপনতার সঙ্গে প্রণীত হয়, তবু সেখানে একজন সাংবাদিক ছিলেন এবং তিনি টাইপ-করা একই কপি হস্তগত করেন। ইনি তৎকালীন তরুণ কথাশিল্পী এবং নবীন সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। অতঃপর ৪ঠা ফেব্রুয়ারী নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্সে যোগদানের জন্য তাজউদ্দিন আহমদ ও নূরুল ইসলাম চৌধুরীসহ শেখ মুজিব লাহোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পূর্ব বাংলার অন্যান্য দল থেকে যারা গেলেন তাঁদের সবাইকে নিয়ে যোগদানকারীর সংখ্যা ছিল ২১, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সদস্য ছিলেন ৬০০ এর ওপর।
এদিকে আলফা ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কক্ষ থেকে সাংবাদিক চৌধুরী খসড়া ছয়-দফার যে একটি কপি নিয়েছিলেন তিনি তা’ কাগজে প্রকাশ ক’রে দিলেন। ৩২, শরৎগুপ্ত রোডস্থ অনুপম মুদ্রণালয় থেকে প্রকাশিত সান্ধ্য-দৈনিক ‘আওয়াজ’-এ এই প্রথম ছয়-দফার খসড়া প্রকাশ পায়। এতে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বিরক্ত হয়েছিলেন। তবে এতে ক্ষতি না হয়ে লাভই হয়েছিল, কেননা রীতিমাফিক পদ্ধতিতে ছয়-দফা নেতার দ্বারা জনসমক্ষে উপস্থাপনের পূর্বেই একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে থাকলো।

লাহোরে বিরোধী দলের জাতীয় সম্মেলন
ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে যথাসময়ে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজলের সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির মিটিং-এ শেখ মুজিব তাঁর ছয়-দফা দাবী পেশ করেন। কিন্তু তা’ গৃহীত হয় না, এমন কি পূর্ব বাংলার
পৃষ্ঠা নং: ২৭৪

ফরিদ আহমদ জাতীয় নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত এতে আপত্তি করেন। ৬ই তারিখে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি পত্রিকা শেখ মুজিবের ছয়-দফা বিকৃত ক’রে প্রকাশ করে এবং শেখ মুজিব যে দেশের দুই অংশকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যোগী হয়েছেন এ কথাই জোরালো ভাষায় প্রচারিত হয়। পশ্চিম পাক নেতৃবৃন্দের অনমনীয় মনোভাব দৃষ্টে শেখ মুজিব জাতীয় কনফারেন্সে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। এদিকে কাগজে বিকৃত খবর প্রকাশের ফলে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে, বিশেষ করে লাহোরে শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গীদের জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে। তাঁরা গোপনে করাচী গিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যার বাসভবনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখান থেকে ট্রাঙ্ককলের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দকে অবস্থা অবহিত করানো হয় এবং তাঁরা করাচী থেকে কখন ফিরে আসছেন তাও জানিয়ে দেয়া হয়। ১১ই ফেরুয়ারী তারিখে শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গীদের সহ ঢাকায় ফিরে এলে বিমান বন্দরেই সাংবাদিকদের নিকট তিনি তাঁর ছয়-দফা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন এবং এই দাবীর প্রতি পশ্চিমপাক নেতৃবৃন্দের অনীহার কথাও উল্লেখ করেন। ‘এখন কথা নয়, সংগ্রাম শুরু করতে হবে’ এই ছিল তাঁর সেদিনকার সুস্পষ্ট বক্তব্য।

প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের দৃষ্টিতে জাতীয় সম্মেলন
উক্ত জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মী ব্যতীত পূর্ব বাংলার অধিকাংশ তথাকথিত নেতার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক যে ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। পূর্ব বাংলার স্বার্থ তাঁদের নিকট মোটেই প্রাধান্য লাভ করে নি। দৈনিক ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় পূর্ব বাংলার উক্ত তথাকথিত বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার দৃষ্টিতে লাহোরের জাতীয় সম্মেলনের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবরটি ছিল এইরূপঃ
“ফরিদ আহমদের দৃষ্টিতে লাহোরের জাতীয় সম্মেলনঃ
গতকল্য (বুধবার) নেজামে ইসলাম নেতা জনাব ফরিদ আহমদ ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, লাহোর জাতীয় সম্মেলনে গণতন্ত্র
পৃষ্ঠা নং: ২৭৫

পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে শীঘ্রই দেশব্যাপী এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সম্মেলনে অংশ গ্রহণকারী দেশের ৪টি বিরোধীদল ও দেশের নির্দলীয় বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ একই প্ল্যাটফরম হইতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু করিতে সম্মত হইয়াছেন।
জনাব ফরিদ আহমদ লাহোর জাতীয় সম্মেলনে যোগদানের পর গত মঙ্গলবার ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। পরদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, জাতীয় সম্মেলন সম্পূর্ণভাবে সফল হইয়াছে। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকা ছাড়া প্রতিটি তহশীল হইতে এই সম্মেলনে প্রতিনিধি যোগদান করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, সম্মেলনে মূলতঃ দুইটি প্রধান বিষয়ের উপর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রথমতঃ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করাকে সম্মেলনে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ জাতীয় সম্মেলনে তাসখন্দ ঘোষণাপত্র সম্পর্কেও আলোচনা করা হইয়াছে। সম্মেলন এই ঘোষণাপত্রকে সমর্থন করিতে পারে নাই। কারণ সম্মেলন মনে করে যে, তাসখন্দ ঘোষণাপত্রে কাশ্মীরের দাবীকে চিরতরে শিকায় তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং জাতীয় মর্যাদার বিনিময়ে এই ঘোষণাপত্র অর্জন করা হইয়াছে। এই পর্যায়ে জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, দুই দিবসব্যাপী সম্মেলনের যে অধিবেশনে তাসখন্দ ঘোষণা-বিরোধী প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয় সেই অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল যোগদান করে নাই। আওয়ামী লীগ দলের এই অধিবেশন বর্জনের কারণ জানিতে চাহিলে জনাব ফরিদ আহমদ বলেন যে, তাসখন্দ ঘোষণাপত্র সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির কোন সঠিক সিদ্ধান্ত না থাকায় তাঁহারা অধিবেশনে উপস্থিত হতে পারেন নাই।
তিনি বলেন যে, অচিরেই দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আওয়ামী লীগের নবাবজাদা নসরুল্লাহ, জামাতে ইসলামীর মওলানা মওদুদী, নেজামে ইসলামের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, কাউন্সিল মুসলিম লীগের সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল
পৃষ্ঠা নং: ২৭৬

এবং স্বতন্ত্র দলের পক্ষে এডভোকেট আনোয়ারকে লইয়া ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হইয়াছে। এই কমিটি শীঘ্রই পূর্ব পাকিস্তান সফর করিবেন বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬]
ফরিদ আহমদের এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, লাহোরের তথাকথিত জাতীয় সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য পূর্ব বাংলার জন্য কল্যাণকর ছিল না। আর এই সম্মেলনে শেখ মুজিব যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সে সম্পর্কে ফরিদ আহমদের ন্যায় অদূরদর্শী নেতা কটাক্ষ ক’রে তাচ্ছিল্যভাব প্রদর্শন করলেও জনগণ তাঁর ভূমিকায় সন্তুষ্ট হয়েছিল। তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতায় শেখ মুজিব অংশ নেন নি, এই কথাই শুধু এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ফরিদ আহমদ উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তিনি কেন অংশ নেন নি তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে ফরিদ আহমদ ব্যর্থ হয়েছেন।

জাতীয় সম্মেলন সম্পর্কে শেখ মুজিবের সাংবাদিক সম্মেলন
ওদিকে শেখ মুজিবও পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলন (১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬) আহ্বান করেন। সাংবাদিকদের নিকট তিনি জাতীয় সম্মেলন সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেন। দৈনিক ইত্তেফাক থেকে তাঁর সেই বক্তব্য নিম্নে উদ্ধৃত করছিঃ
“পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, সাম্প্রতিক পাক ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও দেশরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রশ্নটা বড় হইয়া দেখা দিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা বলেন যে, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটাকে প্রাদেশিকতা বলিয়া চিত্রিত করা উচিত নহে।
শেখ সাহেব বলেন যে, সাম্প্রতিক যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল এবং পাকিস্তানের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর অকৃত্রিম ভালবাসাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষার ব্যাপারে সুসংহত রাখিয়াছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানবাসী
পৃষ্ঠা নং: ২৭৭

দেশরক্ষা ব্যাপারে তাহাদের প্রদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে থাকে।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, দেশরক্ষা ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে উভয় প্রদেশ যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল হয় তাহা হইলে জাতি তাহাদের মাতৃভূমির সংহতির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যে কোন হামলা অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে সক্ষম হইবে।
তিনি বলেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন জাতি ও সংহতির কোন ক্ষতি তো করিবেই না বরং পাকিস্তানকে আরও বেশী শক্তিশালী করিবে।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকর সংসদ কর্তৃক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনার পূর্বে তাসখন্দ ঘোষণা সম্পর্কে এই পর্যায়ে তিনি কোন মতামত প্রকাশ করিবেন না। ……।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬]
যাহোক, লাহোরের জাতীয় সম্মেলন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর স্বার্থের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করে নি। তারা একতরফাভাবে ইসলামী গণতন্ত্র রক্ষার সংকল্প প্রকাশ ক’রে পূর্ব বাংলার দাবীকে ধামাচাপা দিয়েছে। এ বিষয়ে এখানকার তথাকথিত বিরোধী দলীয় কতিপয় নেতাও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, ফরিদ আহমদ-এর সাংবাদিক সম্মেলন থেকেই তা’ সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়।

জাতীয় সম্মেলনের সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্ক ছিন্নঃ বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের নিকট ব্যাখ্যা দান
কিন্তু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন নি। আর পারেন নি বলেই তিনি পূর্বোক্ত জাতীয় সম্মেলনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে লাহোর থেকে করাচী হয়ে ১১ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ফিরে আসেন। শেখ মুজিবের এই আপোষহীন সংগ্রামী ভূমিকার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিপুল ভাবে অভিনন্দন জানায়। ঢাকা বিমান বন্দরে যখন পৌঁছলেন—সাংবাদিকরা তখন তাঁকে ঘিরে ফেললেন। সেদিন সাংবাদিকদের নিকট তিনি লাহোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন প্রসঙ্গে যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন সে বিষয়ে পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছেনঃ “পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে
পৃষ্ঠা নং: ২৭৮

পাঁচ কোটি মানুষের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভবপর নহে। সে কারণে লাহোর সম্মেলনের সহিত সম্পর্কচ্ছেদের কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব দেশের উভয় অংশের মধ্যে অটুট ঐক্য ও সুদৃঢ় সংহতি গড়িয়া তোলার জন্য ৬-দফা কর্তব্য নির্দেশ করেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য শুক্রবার করাচী হইতে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া ঘোষণা করেন যে, লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী শিবিরের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাদিই নয়, গোটা সম্মেলনের সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে।
তেজগাঁও বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রায় একঘন্টাকাল আলাপ-আলোচনার সময় লাহোর সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে তিনি যে সব সুপারিশ পেশ করেন সেই প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, পাক-ভারতের মধ্যকার বিগত ১৭ দিনের যুদ্ধে যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে তাহাতে প্রশাসনিক দিক দিয়া জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের কথা বিবেচনা করিয়া দেশের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কে নতুন করিয়া চিন্তা করার প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। তিনি বলেন, বিগত অস্বাভাবিক ধরনের জরুরী দিনগুলিতে কেবল পূর্ব পাকিস্তানীদের ঐক্যবোধই দেশের দু’প্রদেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখিতে সমর্থ হইয়াছে, ঘটনাক্রমে নয়।
শেখ মুজিব সাংবাদিক সম্মেলনে আরো বলেন যে, জাতীয় সম্মেলনের ‘সাবজেক্ট কমিটি’তে তিনি সে সব বিষয়ে সুপারিশ করিয়াছেন তা’ পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চলকে একত্র ও একই রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে কায়েম রাখার জন্যই করিয়াছেন।
তিনি বলেন যে, এই উদ্দেশ্য লইয়াই তিনি লাহোর সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানে একটি শাসনতান্ত্রিক ফেডারেশন গঠনের সুপারিশ করিয়াছেন। সুপারিশকৃত এই শাসনতন্ত্রে বিশ্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার কায়েমের এবং আইন-পরিষদ সমূহের সার্বভৌমত্বের বিধান থাকিতে হইবে।
ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারাধীন যে সব বিষয় থাকিবে বলিয়া শেখ মুজিবুর সুপারিশ করিয়াছেন তাহা এই যে, ফেডারেল সরকার
পৃষ্ঠা নং: ২৭৯

দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব পালন করিবেন। এই দুইটি বিষয় ছাড়া আর বাকী যে সব বিষয় থাকিবে তার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকিবে ফেডারেল অন্তর্ভুক্ত স্টেটসমূহের হাতে।
দেশের মুদ্রা-ব্যবস্থা সম্পর্কে শেখ মুজিব সাবজেকট কমিটিতে অবাধে বিনিময়যোগ্য দুইটি পৃথক ধরনের মুদ্রার অথবা শর্তসাপেক্ষে একটি মুদ্রা-ব্যবস্থা কায়েম রাখার সুপারিশ করিয়াছেন।
তিনি সুপারিশ করিয়াছেন যে, ফেডারেশনের জন্য যদি একটি মুদ্রা-ব্যবস্থা কায়েম রাখিতে হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাঙ্কিং-ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে হইবে এবং এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইতে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকরী শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে। এ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।
কর ধার্য করা সম্পর্কে শেখ মুজিব যে সুপারিশ করিয়াছেন তাহাতে বলা হইয়াছে যে, সর্বপ্রকারের কর ও শুল্ক ধার্যের একচেটিয়া অধিকার ফেডারেশনের স্টেটসমূহের হাতেই থাকিবে। ফেডারেল সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের অধিকার থাকিবে না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যয়নির্বাহের জন্য স্টেটসমূহের করের একটা অংশ ফেডারেল সরকার পাবেন। স্টেটসমূহের সকল প্রকার করের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ দ্বারাই ফেভারেল সরকারের তহবিল গঠিত হইবে।
বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে শেখ মুজিব পাঁচ-দফা সুপারিশ করিয়াছেন। প্রথমতঃ, ফেডারেশনের প্রতিটি স্টেটের পৃথকভাবে বিদেশী বাণিজ্যের হিসাব রাখিতে হইবে। দ্বিতীয়তঃ বিদেশী বাণিজ্যের দ্বারা আহুত বিদেশী মুদ্রা স্টেটগুলির অধিকারে থাকিবে। তৃতীয়তঃ ফেডারেল সরকারের বিদেশী মুদ্রার চাহিদা সমান হারে বা সম্মত কোন একটা হারে স্টেটসমূহ মিটাইবে। চতুর্থতঃ প্রয়োজনীয় স্বদেশে প্রস্তুত সকল দ্রব্যই বিনা শুল্কে বা টেরিফের বিধানমুক্ত অবস্থায় স্টেটসমূহের মধ্যে যাতায়াত করবে। শেষতঃ শাসনতান্ত্রিক বিধান করিয়া স্টেটসমূহকে বিদেশে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণের এবং সংশ্লিষ্ট স্টেটের স্বার্থে বিদেশে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করার অধিকার দিতে হইবে।
পৃষ্ঠা নং: ২৮০

শেখ মুজিব শাসনতন্ত্র মতে স্টেটসমূহকে আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ‘প্যারা মিলিটারী’ বা আঞ্চলিক বাহিনী সংরক্ষণ অধিকার দানেরও সুপারিশ করেন। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, লাহোর সম্মেলনের উদ্যোক্তা প্রভাবশালী একটি মহল পূর্ব পাকিস্তানের দাবী-দাওয়া আলোচনা তো দূরের কথা, শুনিতে পর্যন্ত প্রস্তুত না থাকায় তিনি তাঁহার প্রতিনিধিদলসহ সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিতে বাধ্য হইয়াছেন।
তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবী-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল রহিয়াছে বলিয়াই তাঁহার বিশ্বাস।
তাসখন্দ ঘোষণা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক তাসখন্দ প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বে এই প্রশ্নে কোন মতামত দেওয়ার এখতিয়ার তাঁহার নাই এবং সেই জন্যই লাহোর সম্মেলনে এই প্রশ্নে তাঁহা্র কোন মতামত দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন আশা করা গিয়াছিল যে, এই সম্মেলনে জাতীয় সমস্যাটি পুংখানুপুংখভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হইবে এবং ভবিষ্যতের জন্য জাতির সামনে একটা সুস্পষ্ট কর্মসূচী তুলিয়া ধরা হইবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে, সম্মেলনের প্রভাবশালী উদ্যোক্তারা সব কিছুই পূর্বাহ্নে সাজাইয়া রাখিয়াছেন এবং দেশের প্রধান প্রধান সমস্যাদির কিছুই তাহারা বিচার বিবেচনা করিতে প্রস্তুত নন।
জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব আরো বলেন যে, লাহোর সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির কাছে তিনি যে ৬-দফা সুপারিশ করিয়াছেন, সেই ৬-দফা অন্তর্ভুক্ত করিয়া গণতান্ত্রিক কোন সংগ্রামের জন্য কোন প্ল্যাটফরম গঠন করা হলে তিনি সেই প্ল্যাটফরমের সঙ্গে থাকিবেন। তিনি অবশ্য স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন যে, রাজনৈতিক দল ভাঙিয়া দিয়া বিভিন্নমুখী মতবাদ সম্পন্ন দলসমূহের সঙ্গে মিলিয়া এক দল করা সম্ভব নহে এবং সেই প্রশ্নে তিনি সম্মতও নন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬)
পৃষ্ঠা নং: ২৮১

লক্ষণীয় যে, লাহোরের তথাকথিত জাতীয় সম্মেলনেই শেখ মুজিবর ঐতিহাসিক ৬-দফা প্রস্তাবটি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সম্মেলনের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাঁর এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করেন নি। তাঁদের মধ্যে বাঙালী নেতৃবন্দও ছিলেন যাদের অন্যতম মুখপাত্র ফরিদ আহমদ। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে সম্মেলনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে আসতে হয়েছিল। জাতীয় সম্মেলনে উপস্থাপিত তাঁর এই বক্তব্যকে শেখ মুজিব পরবর্তীকালে ৬-দফা সুপারিশের মাধ্যমে দেশবাসীর সম্মুখে যুক্তি ও তথ্যের সাহায্যে তুলে ধরেন। এই ৬-দফাকে বাঙালী তাঁদের মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ নামধারী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র শেখ মুজিবের এই স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার গন্ধ খুঁজে পান। অথচ তাঁর এই ৬-দফার মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মনোভাবেরই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবকে সামনে রেখে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ যেভাবে চিন্তা-ভাবনা ক’রে আসছিল, শেখ মুজিব ৬-দফা দাবীতে সেই মনোভাবকেই একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। এখানেই এর নতুনত্ব।
প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তের জন্যই যে দাবীগুলোকে তিনি এতদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি, এবার সত্যিকার রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি সেগুলোকে প্রকাশ করলেন। তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, বহু সমস্যায় জর্জরিত পূর্ব বাংলার জনগণ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা ফজলুল হকের মৃত্যুর পর তাঁর মুখের দিকেই চেয়ে রয়েছে। নেতাদের দিয়ে যেটুকু সম্ভব হবার তা’ হয়েছে কিন্তু যা কিছু অসম্পূর্ণ সেগুলো তাঁকেই করতে হবে। এজন্যই তিনি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাকে সামনে তুলে ধরেছেন। এই পরিকল্পনাই সেই ঐতিহাসিক ৬-দফা-বাংলার জনগণের মুক্তির সনদ-স্বাধীনতার সূর্য-সম্ভাবনাময় এক প্রত্যক্ষ প্রেরণা।
ছয়-দফা আন্দোলনের সামগ্রিক প্রস্তাব ও ব্যাপক কর্মসূচী শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে ১৯৬৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখে পেশ করেন। ওয়ার্কিং কমিটিতে ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন
পৃষ্ঠা নং: ২৮২

এবং আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দান করা হয়। যে একুশে ফেব্রুয়ারী থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই পবিত্র দিনে বাঙালী জাতির মুক্তির দলিল ৬-দফা গৃহীত হ’ল। ইতিহাসের দুটো প্রবল প্রবাহের ধারা এবার একই খাতে এসে যেন মিলিত হ’ল। এবার যিনি মহাকর্ণধার তিনি যথাসময়েই যথানিয়মেই তরণী ভাসিয়েছেন।

৬-দফার প্রস্তাবনা
এসময় পুস্তিকাকারে প্রথম যে ৬-দফা প্রকাশিত হয়েছিল তাতে তিনি একটি ছোট্ট ভূমিকা সংযোজন করেছিলেন। ভূমিকাটি ছিল এইরূপঃ
“ভারতের সাথে বিগত সতের দিনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা স্মরণ রেখে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো সম্পর্কে আজ নতুনভাবে চিন্তা ক’রে দেখা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শাসনকার্য নির্বাহের ক্ষেত্রে বাস্তব যে সব অসুবিধা দেখা দিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রশ্নটির কথা আজ অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, জাতীয় সংহতি অটুট রাখার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রগাঢ় আন্তরিকতা ও দৃঢ় সংকল্পই দেশকে এই অস্বাভাবিক জরুরী অবস্থাতে ও চরম বিশৃঙ্খলার হাত হতে রক্ষা করেছে।
এই অবস্থার আলোকে সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা ক’রে পাকিস্তানের দুটি অংশ যাতে ভবিষ্যতে আরো সুসংহত একক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে এই সংক্ষিপ্ত ইশতাহারটির লক্ষ্য তা-ই। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমি দেশবাসী জনসাধারণ ও রাষ্ট্রের আজিকার কর্ণধারদের কাছে নিম্নলিখিত ছয়-দফা কর্মসূচী পেশ করছি।
[ছয়-দফাঃ সম্পাদনায় নূরুল ইসলাল চৌধুরী, পৃঃ ৫]
উক্ত পুস্তিকায় পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ একটি ভূমিকায় এই ৬-দফা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য রেখেছেন। ৬-দফা কর্মসূচীর সঙ্গে তাঁর বক্তব্যও একটি উল্লেখযোগ্য দলিল বলে এখানে বক্তব্যটি দেয়া হ’লঃ
“একটি রাষ্ট্রের উন্নতি, অগ্রগতি, সংহতি ও নিরাপত্তা নির্ভর কর উহার আভ্যন্তরীণ শক্তির উপর। সেই শক্তির উৎস সন্তুষ্ট জনচিত্ত। আঠার বৎসর পূর্বে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।
পৃষ্ঠা নং: ২৮৩

আজও ইহার রাষ্ট্রীয় কাঠামো গণসমর্থনের মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়াইতে পারে নাই। পাকিস্তানের মূলভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান অর্জনের সংগ্রামে মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল, পরবর্তীকালে ঐ মূলভিত্তি হইতে বিচ্যুতিই এই অবস্থার আসল কারণ। এই বিচ্যুতি ঘটাইবার মূলে ছিল একটি কায়েমী স্বার্থবাদী শোষকদলের স্বার্থান্বেষী কারসাজি। ইহারা ইসলাম ও মুসলিমের নামে সারা পাকিস্তানের গোটা সমাজকে শোষণ করিয়া নিঃশেষ করিতেছে, অপরদিকে পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুযোগ গ্রহণ করিয়া এই বিশেষ মহলই পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের নামে অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাহাড় গড়িয়া পূর্ব পাকিস্তানে অবাধ শোষণ চালাইয়া যাইতেছে। ফলে একদিকে পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণ সর্বহারায় পরিণত হইতেছে, অপরদিকে জুলুমের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতিবাদ সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানে মারাত্মক ভুল বুঝাবুঝি ও তিক্ততার সৃষ্টি হইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে অবাধ শোষণ চালাইয়া যাইবার উদ্দেশ্যে এই বিশেষ মহল ঐক্য ও সংহতির জিগীর তুলিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে সম্পূর্ণ পঙ্গু করিয়া রাখিয়াছে। বিগত আঠার বৎসরব্যাপী আবেদন-নিবেদন ও আন্দোলনের মাধ্যমে উক্ত মহলকে অবস্থা উপলবিদ্ধ করিতে সম্মত করান সম্ভব হয় নাই। বরং নানারূপ সূক্ষ্ম কৌশলে ইহারা উভয় অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বৈরী ভাব সৃষ্টির প্রয়াস পাইয়া চলিয়াছেন।
সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে দেশের প্রকৃত অবস্থা, বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানীদের নাজুক অবস্থা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হইয়াছে এবং দেশের সংহতি, নিরাপত্তা ও পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে সকল কেন্দ্রীয় শক্তির কার্যকারিতার শ্লোগানী রূপের অসারতাও প্রমাণিত হইয়াছে। পাকিস্তানের কোন মঙ্গলকামীকে বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারবঞ্চিত অসহায় জনসাধারণকে আর সস্তা বুলিতে ধোঁকা দেওয়া চলিবে না। তাঁহারা আজ দেশের প্রকৃত সংহতি, নিরাপত্তা, শক্তি, উন্নতি ও অগ্রগতির সঠিক পন্থা নিরূপণ ও আশু বাস্তবায়নের দাবী করেন।
পৃষ্ঠা নং: ২৮৪

পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান সম্ভূত প্রশ্নে বিগত আঠার বৎসরব্যাপী সঞ্চিত প্রজ্ঞা ও সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের শিক্ষার আলোকে বিচার করিলে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের ৬-দফা কর্মসূচী উপরে উল্লেখিত গণদাবীর প্রশ্নে এক বাস্তব, সুষ্ঠ ও কার্যকরী উত্তর। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে এই ৬-দফা কর্মসূচীর প্রতিফলন উভয় অঞ্চলের জনসাধারণের ঈপ্সিত-কল্যাণ, প্রকৃত সংহতি ও কার্যকরী নিরাপত্তা বিধান করিবে বলিয়া সকল বাস্তব চিন্তাশীল মহলের বিশ্বাস। এই কর্মসূচীতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা প্রভৃতি অপরিহার্য মূল বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার বাস্তব কার্যকরী ব্যবস্থার সুস্পষ্ট নির্দেশ রহিয়াছে। এই ব্যবস্থা গৃহীত হইলে বর্তমানে নাজুক পূর্ব পাকিস্তান সকল বিষয়ে সবল ও শক্তিশালী হইয়া সারা পাকিস্তানকে অধিক শক্তিশালী ও সুসংহত করিবে এবং উভয় অঞ্চল সমতালে অগ্রসর হইয়া যে-কোন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম হইবে।
শেখ সাহেবের ছয়-দফা কর্মসূচী প্রকাশ পাইবার সঙ্গে সঙ্গে চিরাচরিত নিয়মানুসারে এক বিশেষ মহল সবিশেষ চঞ্চল হইয়া পড়িয়াছে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানকে ভালবাসেন এবং উভয় অঞ্চলের জনসাধারণের মঙ্গল ও নিরাপত্তা কামনা করেন এমন কেউ এই কর্মসূচীর পাইকারী বিরোধিতা করিতে পারেন, ইহা আমি বিশ্বাস করি না। তবে কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ও তাদের অনুগতদের কথা আলাদা। এই শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের স্বার্থ নিহিত নাই, এমন কোন ভাল কর্মসূচীকে কখনও সমর্থন দিয়াছে, তাহার নজীর বিশ্ব-ইতিহাসে নাই, বরং নিজ স্বার্থের পরিপন্থী হইলে ইহারা যে মরিয়া হইয়া উহার বিরোধিতা করিয়া থাকে তাহার দৃষ্টান্ত বহুল পরিমাণে বর্তমান। তাই আমি শেখ সাহেবের ছয়-দফা কর্মসূচী বস্তুনিষ্ঠভাবে বিচার করিয়া দেখিবার জন্য সাধারণ মানবাধিকারে আস্থাবান সকল মহলের প্রতি আবেদন জানাইতেছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই কর্মসূচীর ভিত্তিতেই পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসী প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তির সন্ধান পাইবেন এবং তাঁহাদের সুপ্ত শক্তির বিকাশ সাধন করিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে সকল বিষয়ে সুদৃঢ় তথা পাকিস্তানকে
পৃষ্ঠা নং: ২৮৫

আরো সুসংহত ও শক্তিশালী করতে সক্ষম হইবেন। এই প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের কাছে আমার আরজ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হইয়া তাহারা যেন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর জীবন-মরণ সমস্যাগুলি বাস্তবের আলোকে বিচার করিয়া দেখেন। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের ছয়-দফা কর্মসূচী পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী কোন কর্মসূচী নহে। একজন সাধারণ পূর্ব পাকিস্তানীর ন্যায় পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইগণও পাকিস্তানের উন্নতি, অগ্রগতি, সংহতি ও নিরাপত্তার অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের কথাও ভাবেন। তাই পূর্ব পাকিস্তানকে সকল বিষয়ে শক্তিশালী করিবার দাবী উঠিলে কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের মত আতঙ্কিত না হইয়া যৌক্তিকতার ভিত্তিতে তাঁহারা এই দাবীর প্রতি সমর্থন দিবেন, ইহাই স্বাভাবিক ও ইহাই বিশ্বাস করি।”
[প্রাগুক্ত, পৃঃ ১-৪]
এই পুস্তিকায় শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচী পেশ করেছিলেন কিছুদিন পর ১৮ই মার্চ’ (১৯৬৬) ঢাকার মতিঝিলে ইডেন হোটেল প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে ঐ প্রস্তাবগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা সহকারে “আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা কর্মসূচী” শীর্ষক পুস্তিকার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারার্থে পেশ করা হয়েছিল। শেখের এই কর্মসূচী তখন এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, পূর্ব বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরেই এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। এই পুস্তিকায় শেখ মুজিব যা বলেছেন তা’ হুবহু এখানে উদ্ধৃত হ’লঃ
আমাদের বাঁচার দাবী
৬-দফা কর্মসূচী
শেখ মুজিবুর রহমান
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা,
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও
পৃষ্ঠা নং: ২৮৬

গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবী যখন উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈ চৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তি সনদ একুশ-দফা দাবী, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবী, ছাত্র-তরুণদের সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষালাভের মাধ্যম করার দাবী ইত্যাদি সকল প্রকার দাবীর মধ্যেই এই শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতেও এরা তেমনিভাবে পাকিস্তানকে দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটী শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ৬-দফা দাবী অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬-দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমী স্বার্থবাদী শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এও জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম ও তাঁদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এদের অফুরন্তু, মুখ এদের দশটা, গলার সুর এদের শতাধিক। এরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারী দলে। আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায়, এঁরা সকলে একজোট। এঁরা নানা ছলাকলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এঁদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার-সচেতন দেশবাসী
পৃষ্ঠা নং: ২৮৭

যে বিভ্রান্ত হইবেন না, তাতেও আমার কোন সন্দেহ নাই। তথাপি ৬-দফা দাবীর তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গণতন্ত্রী, বিশেষতঃ আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবশ্য কর্তব্য। আশা করি তাঁরা সকলে অবিলম্বে ৬-দফা ব্যাখ্যায় দেশময় ছড়াইয়া পড়িবেন। কর্মী ভাইদের সুবিধার জন্য ও দেশবাসী জনসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে আমি ৬-দফার প্রতিটি দফার দফাওয়ারী সহজ সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এই পুস্তিকা প্রচার করিলাম। আওয়ামী লীগের তরফ হইতেও এ বিষয়ে আরো পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানী মাত্রই এইসব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।
।। ১ নং দফা ।।
এই দফায় বলা হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন-সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে। ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আযমসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোট দিয়াছিলেন, এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ-দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবী ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবী। মুসলিম লীগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সরকারী সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা লইয়া তাঁরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করিয়াছিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেই ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হইবে, এসব যুক্তি তখনও দেওয়া হইয়াছিল। তথাপি পূর্ব
পৃষ্ঠা নং: ২৮৮

বাংলার ভোটাররা এই প্রস্তাবসহ একুশ দফার পক্ষে ভোট দিয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষের কথা বলিতে গেলে এই প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসিত হইয়াই গিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবী করিয়া আমি কোন নতুন দাবী তুলি নাই, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরান দাবীরই পুনরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁহারা আতকিয়া উঠেন, তাঁহারা হয় পাকিস্তান সংগ্রামে আগ্রহী ছিলেন না, অথবা তাঁহারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবী-দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের দালালী করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।
এই দফায় পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার, সার্বজনীন ভোটে, সরাসরি নির্বাচন ও আইন-সভার সার্বভৌমত্বের যে দাবী করা হইয়াছে তাতে আপত্তির কারণ কি? আমার, প্রস্তাবই ভালো, না প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ও পরোক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতাহীন আইন-সভাই ভালো, এ বিচারের ভার জনগণের উপর ছাড়িয়া দেওয়াই কি উচিত নয়? তবে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতির এই তরফদারেরা এইসব প্রশ্নে রেফারেণ্ডামের মাধ্যমে জনমত যাচাই-এর প্রস্তাব না দিয়া আমার বিরুদ্ধে গালাগালি বর্ষণ করিতেছেন কেন? তাঁহারা যদি নিজেদের মতে এতই আস্থাবান, তবে আসুন এই প্রশ্নের উপরই গণভোট হইয়া যাক।

।। ২নং দফা ।।
এই দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবল মাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এই দুইটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্টেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে। এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশী চটিয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি ইহাদের এতই অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে যে, ইহারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলি পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। ইহারা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, ব্রিটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে ‘প্ল্যান’ দিয়াছিলেন এবং যে ‘প্ল্যান’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ
পৃষ্ঠা নং: ২৮৯

উভয়ই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এই তিনটি মাত্র বিষয় ছিল এবং বাকী সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল। ইহা হইতে এটাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলের মত এই যে, এই তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকিলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে পারে। অন্য কারণে কংগ্রেস চুক্তিভঙ্গ করায় ‘ক্যাবিনেট প্ল্যান’ পরিত্যক্ত হয়। তাহা না হইলে এই তিন বিষয় লইয়াই আজো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে থাকিত। আমি আমার প্রস্তাবে ক্যাবিনেট প্ল্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমি বাদ দিয়াছি সত্য, কিন্তু তাহার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। অখণ্ড ভারতের বেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও অখণ্ডতা ছিল। ফেডারেশন গঠনের রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক মূলনীতি এই যে, যে যে বিষয়ে ফেডারেটিং স্টেটসমূহের স্বার্থ এক ও অবিভাজ্য, কেবল সেই সেই বিষয়ই ফেডারেশনের এখতিয়ারে দেওয়া হয়। এই মূলনীতি অনুসারে অখণ্ড ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ছিল। পেশোয়ার হইতে চাটগাঁ পর্যন্ত একই রেল চলিতে পারিত। কিন্তু পাকিস্তানে তা’ নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য তো নয়ই, বরঞ্চ সম্পূর্ণ পৃথক। রেলওয়েকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ট্রান্সফার করিয়া বর্তমান সরকারও তা-ই স্বীকার করিয়াছেন। টেলিফোন, টেলিগ্রাম, পোস্ট অফিসের ব্যাপারেও এসত্য স্বীকার করিতেই হইবে।
তবে বলা যাইতে পারে যে, একুশ-দফায় যখন কেন্দ্রকে তিনটি বিষয় দেবার সুপারিশ ছিল, তখন আমি আমার বর্তমান প্রস্তাবে মাত্র দুইটি বিষয় দিলাম কেন? এ প্রশ্নের জবাব আমি তিন নম্বর দফায় ব্যাখ্যায় দিয়াছি। এখানে আর পুনরুক্তি করিলাম না। আর একটি ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হইতে পারে, আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে প্রদেশ না বলিয়া স্টেট বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থী শোষকরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, স্টেট অর্থে আমি ইণ্ডিপেণ্ডেটে স্টেট বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তা’ সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড়
পৃষ্ঠা নং: ২৯০
ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া স্টেটস বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানী, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশসমূহকে স্টেটস ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা প্রদেশ নয় স্টেট, এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া স্টেট হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেই বা কর্তাদের এত এলার্জি কেন?

।। ৩নং দফা ।।
এই দফায় আমি মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অলটারনেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি। এই দুইটি প্রস্তাবের যে-কোন একটি গ্রহণ করিলেই চলিবে।
(ক) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এই ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সী কেন্দ্রের হাতে থাকিবে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাঙ্ক থাকিবে।
(খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সী থাকিবে। এই ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে, দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকিবে। এই দুইটি বিকল্প প্রস্তাব হইতে দেখা যাইবে যে, মুদ্রাকে সরাসরি কেন্দ্রের হাত হইতে প্রদেশের হাতে আনিবার প্রস্তাব আমি করি নাই। যদি আমার দ্বিতীয় অলটারনেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। ঐ অবস্থায় আমি একুশ-দফা প্রস্তাবের খেলাফে কোন সুপারিশ করিয়াছি, এ কথা বলা চলে না।
যদি পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা আমার এই প্রস্তাবে রাজী না হন, তবেই শুধু প্রথম বিকল্প অর্থাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝির
পৃষ্ঠা নং: ২৯১

অবসান হইলে আমাদের এবং উভয় অঞ্চলের সুবিধার খাতিরে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই প্রস্তাবে রাজী হইবেন। আমরা তাঁদের খাতিরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ত্যাগ করিয়া সংখ্যাসাম্য মানিয়া লইয়াছি। তাঁরা কি আমাদের খাতিরে এইটুকু করিবেন না?
আর যদি অবস্থাগতিকে মুদ্রাকে প্রদেশের এলাকায় আনিতেও হয়, তবু তাতে কেন্দ্র দুর্বল হইবে না; পাকিস্তানের কোনও অনিষ্টও হইবে না। ‘ক্যাবিনেট প্ল্যানে’ নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল তাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। এ প্রস্তাব পেশ করিয়া ব্রিটিশ সরকার এবং ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়াও কেন্দ্র চলিতে পারে। কথাটা সত্য। রাষ্ট্রীয় অর্থবিজ্ঞানে এই ব্যবস্থার স্বীকৃতি আছে। কেন্দ্রের বদলে প্রদেশের হাতে অর্থনীতি রাখা এবং একই দেশে পৃথক পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকার নজির দুনিয়ার বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রেরও আছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মাধ্যমে, পৃথক পৃথক স্টেট ব্যাঙ্কের দ্বারা। এতে যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস হয় নাই, তাদের আর্থিক বুনিয়াদও ভাঙ্গিয়া পড়ে নাই। অত যে শক্তিশালী দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন, তাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর নাই। শুধু প্রাদেশিক সরকার অর্থাৎ স্টেট রিপাবলিকসমূহেরই অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও মন্ত্রী-দফতর দিয়াই মিটিয়া থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশেও আঞ্চলিক সুবিধার খাতিরে দুইটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বহুদিন আগে হইতেই চালু আছে।
আমার প্রস্তাবের মর্ম এই যে, উপরিউক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকিবে। সে অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমনি থাকিবে। পার্থক্য শুধু এই হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ইস্যু হইবে। এবং তাতে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘ঢাকা’ লিখা থাকিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ইস্যু হইবে এবং পশ্চিম
পৃষ্ঠা নং: ২৯২

পাকিস্তান’ বা সংক্ষেপে ‘লাহোর’ লেখা থাকিবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্প গৃহীত হয়, সে অবস্থাতেও উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকিবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শনস্বরূপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহযোগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা যাইবে।
একটু তলাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে যে, এই দুই ব্যবস্থার একটি গ্রহণ করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করার অন্য কোন উপায় নাই। সারা পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা হওয়ায় ও দুই অঞ্চলের মুদ্রার মধ্যে কোনও পৃথক চিহ্ন না থাকায় আঞ্চলিক কারেন্সী সার্কুলেশনে কোনও বিধিনিষেধ ও নির্ভুল হিসাব নাই। মুদ্রা ও অর্থনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকায় অতি সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে। সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং, ইনসিওরেন্স ও বৈদেশিক মিশনসমূহেব হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় প্রতি মিনিটে এই পাচারের কাজ অবিরাম গতিতে চলিতেছে। সকলেই জানেন সরকারী স্টেট ব্যাঙ্ক ও ন্যাশলান ব্যাঙ্ক সহ সমস্ত ব্যাঙ্কের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে। এই সেদিন মাত্র প্রতিষ্ঠিত ছোট দু’ একখানি ব্যাঙ্ক ইহার সাম্প্রতিক ব্যতিক্রম মাত্র। এইসব ব্যাঙ্কের ডিপোজিটের টাকা, শেয়ার মানি, সিকিউরিটি মানি, শিল্প-বাণিজ্যের আয়, মুনাফা ও শেয়ার মানি, এক কথায় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সমস্ত আর্থিক লেনদেনের টাকা বালুচরে ঢালা পানির মত একটানে তলদেশে হেড অফিসে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তান শুকনা বালুচর হইয়া থাকিতেছে। বালুচরে পানির দরকার হইলে টিউবঅয়েল খুদিয়া তলদেশ হইতে পানি তুলিতে হয়। অবশিষ্ট পানি তলদেশে জমা থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থও তেমনি চেকের টিউবঅয়েলের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আনিতে হয়। উদ্ধত আর্থিক সেভিং তলদেশেই অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানেই জমা থাকে। এই কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাপিটেল ফর্মেশন হইতে পারে নাই। সব ক্যাপিটেল ফর্মেশন পশ্চিমে হইয়াছে।
পৃষ্ঠা নং: ২৯৩

বর্তমান ব্যবস্থা চলিতে থাকিলে কোন দিন পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গঠন হইবেও না। কারণ সেভিং মানেই ক্যাপিটেল ফর্মেশন।
শুধু ফ্লাইট অব ক্যাপিটেল বা মুদ্রা পাচারই নয়, মুদ্রাস্ফীতিহেতু পূর্ব পাকিস্তানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দুর্মূল্যতা, জনগণের, বিশেষতঃ পাটচাষীদের দুর্দশা, সমস্তের জন্য দায়ী এই মুদ্রা-ব্যবস্থা ও অর্থনীতি। আমি পাঁচ নং দফার ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে, এই ফ্লাইট অব ক্যাপিটেল বন্ধ করিতে না পারিলে পূর্ব পাকিস্তানীরা নিজেরা শিল্প-বাণিজ্যে একপাও অগ্রসর হইতে পারিবে না। কারণ এই অবস্থায় মূলধন গড়িয়া উঠিতে পারে না।

।। ৪নং দফা ।।
এই দফায় আমি প্রস্তাব দিয়াছি যে, সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা করধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালি জমা হইয়া যাইবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাঙ্কসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে। এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।
আমার এই প্রভাবেই কায়েমী স্বার্থের কালোবাজারী ও মুনাফাখোর শোষকরা সবচেয়ে বেশী চমকিয়া উঠিয়াছে। তারা বলিতেছে, ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না থাকিলে সে সরকার চলিবে কি রূপে? কেন্দ্রীয় সরকার তাতে যে একেবারে খয়রাতি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে। খয়রাতের উপর নির্ভর করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার দেশরক্ষা করিবেন কেমনে? পররাষ্ট্র নীতিই বা চালাইবেন কি দিয়া? প্রয়োজনের সময় চাঁদা না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার তো অনাহারে মারা যাইবেন। অতএব এটা নিশ্চয়ই পাকিস্তান ধ্বংসেরই ষড়যন্ত্র। কায়েমী স্বার্থীরা এই ধরনের কত কথাই না বলিতেছেন। অথচ এর একটা আশঙ্কাও সত্য নয়। সত্য যে নয়, সেটা বুঝিবার বিদ্যাবুদ্ধি তাঁদের নিশ্চয়ই
পৃষ্ঠা নং: ২৯৪

আছে। তবু যে তাঁরা এসব কথা বলিতেছেন তার একমাত্র কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণীগত স্বার্থ। সে স্বার্থ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবাধে শোষণ ও লুণ্ঠন করিবার অধিকার। তাঁরা জানেন যে, আমার এই প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের দায়িত্ব দেওয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘ্নে চলার মত যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সেই ব্যবস্থা নিখুঁত করিবার শাসনতান্ত্রিক বিধান রচনার সুপারিশ করা হইয়াছে। এইটাই সরকারী তহবিলের সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তাঁরা এটাও জানেন যে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বীকৃত। তাঁরা এই খবরও রাখেন না যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান ব্রিটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল, কেন্দ্রকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। ৩নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখাইয়াছি যে, অর্থমন্ত্রী ও অর্থ-দফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী বা অর্থ-দফতর বলিয়া কোনও বস্তুর অস্তিত্বই নাই। তাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে? তার দেশরক্ষা বাহিনী, পররাষ্ট্র দফতর কি সেজন্য দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই। আমার প্রস্তাব কার্যকরী হইলেও তেমনি পাকিস্তানের দেশরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হইবে না। কারণ, আমার প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সে অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন যে খাতেই যে টাকা ট্যাক্স ধার্য ও আদায় করুন না কেন, শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত সেই টাকার হারের অংশ রিজার্ভ ব্যাঙ্কে কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হইয়া যাইবে। সে টাকায় আঞ্চলিক সরকারের কোনও হাত থাকিবে না। এই ব্যবস্থায় অনেক সুবিধা হইবে। প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স আদায়ের ঝামেলা পোহাইতে হইবে না। দ্বিতীয়তঃ ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের জন্য কোনও দফতর বা অফিসার
পৃষ্ঠা নং: ২৯৫

বাহিনী রাখিতে হইবে না। তৃতীয়তঃ অঞ্চলে ও কেন্দ্রের জন্য ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের মধ্যে ডুপ্লিকেশন হইবে না। তাতে আদায়ী খরচায় অপব্যয় ও অর্থের অপচয় বন্ধ হইবে। ঐভাবে সঞ্চিত টাকার দ্বারা গঠন ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করা যাইবে। অফিসার বাহিনীকেও উন্নততর সৎ কাজে নিয়োজিত করা যাইবে। চতুর্থতঃ ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের একীকরণ সহজতর হইবে। সকলেই জানেন, অর্থবিজ্ঞানীরা এখন ক্রমেই সিঙ্গল ট্যাক্সেশনের দিকে আকৃষ্ট হইতেছেন। সিঙ্গল ট্যাক্সেশনের নীতিকে সকলেই অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসূ বলিয়া অভিহিত করিতেছেন। ট্যাক্সেশনকে ফেডারেশনের এলাকা হইতে অঞ্চলের এখতিয়ারভুক্ত করা এই সর্বোত্তম ও সর্বশেষ আর্থিক নীতি গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যাইতে পারে।

।। ৫নং দফা ।।
এই দফায় আমি বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছিঃ
১। দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে,
২। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে,
৩। ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে,
৪। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানী রফতানী চলিবে,
৫। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানী-রফতানী করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।
পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এই ব্যবস্থা তিন নম্বর দফার মতই অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের
পৃষ্ঠা নং: ২৯৬

আঠারো বছরের আর্থিক ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলাইলেই দেখা যাইবে যে-
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্পজাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা বলা হইতেছে।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়িয়া না উঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নাই, এই অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিদেশী আয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না।
(গ) পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণে আয় করে সেই পরিমাণে ব্যয় করিতে পারে না। সকলেই জানেন, পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণ রফতানী করে, আমদানী করে সাধারণতঃ তার অর্ধেকেরও কম। ফলে, অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্ব পাকিস্তানে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মত লাগিয়াই আছে। এর ফলে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিরও দাম এত বেশী। বিদেশ হইতে আমদানী করা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী দামের তুলনা করিলেই এটা বুঝা যাইবে। বিদেশী মুদ্রা বন্টনের দায়িত্ব এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকার ফলেই আমাদের এই দুর্দশা।
(ঘ) পাকিস্তানের বিদেশী মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাটচাষীকে পাটের ন্যায্য মূল্য তো দূরের কথা, আবাদী খরচাটাও দেওয়া হয় না। ফলে পাটচাষীদের ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলার জিনিসে পরিণত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটের চাষ নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম দিতে পারেন না। এমন অদ্ভুত অর্থনীতি দুনিয়ার তার কোন দেশে নাই। যতদিন পাট থাকে চাষীর ঘরে, ততদিন পাটের দাম থাকে পনের বিশ টাকা। ব্যবসায়ীর গুদামে চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথে তার দাম হয় পঞ্চাশ। এ খেলা গরীব পাটচাষী চিরকাল দেখিয়া আসিতেছে। পাট
পৃষ্ঠা নং: ২৯৭

ব্যবসায় জাতীয়করণ করিয়া পাট রফতানীকে সরকারী আয়ত্তে আনা ছাড়া এর কোন প্রতিকার নাই, এ কথা আমরা বহুবার বলিয়াছি। এই উদ্দেশ্যে আমরা আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন গঠন করিয়াছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে পুঁজিপতিরা আমাদের সেই আরব্ধ কাজ ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।
(ঙ) পূর্ব পাকিস্থানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রাই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হইতেছে তাহা নয়, আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার জোরে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশী লোন ও এইড আসিতেছে, তাও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হইতেছে। কিন্তু সে লোনের সুদ বহন করিতে হইতেছে পূর্ব পাকিস্তানকেই। এই অবস্থার প্রতিকার করিয়া পাটচাষীকে পাটের ন্যায্য মূল্য দিতে হইলে, আমদানী-রফতানী সমান করিয়া জনসাধারণকে সস্তাদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করিয়া তাদের জীবন সুখময় করিতে হইলে এবং সর্বোপরি আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা দিয়া পূর্ব পাকিস্তানীর হাতে পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করিতে হইলে আমার প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থা ছাড়া উপায়ান্তর নাই।

।। ৬নং দফা ।।
এই দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষী বাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছি। এই দাবী অন্যায়ও নয়, নতুনও নয়। একুশ-দফার দাবীতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবী করিয়াছিলাম। তাহা তো করা হয়ই নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীন ই. পি. আর. বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেওয়া হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রকারখানা ও নৌবাহিনীর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করতঃ এই অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবী একুশ-দফার দাবী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বার বছরেও আমাদের একটি দাবীও পূরণ করেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানীর বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবী করিতে হইবে কেন? সরকার নিজে হইতে সে দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান
পৃষ্ঠা নং: ২৯৮

আগে বাঁচাইয়া সময় সুযোগ থাকিলে পরে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচান হইবে, ইহাই কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষাব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানেরই রহিয়াছে এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোন মুখে? মাত্র সতের দিনের পাক-ভারত যুদ্ধই কি প্রমাণ করে নাই, আমরা কত নিরুপায়? শত্রুর দয়া ও মর্জির উপর তো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যতঃ আমাদের তাই করিয়া রাখিয়াছে।
তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আত্মনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমাণ দেশরক্ষা বাহিনী গঠন করুন। অস্ত্র কারখানা স্থাপন করুন। নৌবাহিনীর দফতর এখানে নিয়া আসুন। এসব কাজ সরকার কবে করিবেন জানি না। কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা অল্প খরচে ছোটখাট অস্ত্রশস্ত্র দিয়া আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করিলেও পশ্চিমা ভাইদের এত আপত্তি কেন? পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র যুদ্ধ তহবিলে চাঁদা উঠিলে তাও কেন্দ্রীয় রক্ষা তহবিলে নিয়ে যাওয়া হয় কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাপারে অঞ্চলের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরাও চাই না। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যেমন করিয়া পারে গরীবী হালেই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিবে, এমন দাবী কি অন্যায়? এই দাবী করিলেই সেটা হইবে দেশদ্রোহিতা? এ প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইবোনদের খেদমতে আমার কয়েকটি আরজ আছেঃ
।। এক ।। তাঁরা মনে করিবেন না যে, আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের অধিকার দাবী করিতেছি। আমার ৬-দফা কর্মসূচীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দাবীও সমভাবেই রহিয়াছে। এই দাবী স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও সমভাবে উপকৃত হইবেন।
।। দুই ।। আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তূপীকৃত হইতেছে, তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এই বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা দায়ী নয়। আমি এও জানি যে, আমাদের মত দরিদ্র
পৃষ্ঠা নং: ২৯৯

পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছেন। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এই অসাম্য দূর হইবে না। কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে। এই আঞ্চলিক শোষণের জন্য দায়ী আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সে অবস্থানকে অগ্রাহ্য করিয়া যে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চালাইবার চেষ্টা চলিতেছে সেই ব্যবস্থা। ধরুন, যদি পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া পূর্ব পাকিস্তানে হইত, পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি দফতরই যদি পূর্ব পাকিস্তানে হইত, তবে কার কি অসুবিধা-সুবিধা হইত একটু বিচার করুন। পাকিস্তানের মোট রাজস্বের শতকরা ৬২ টাকা খরচ হয় দেশরক্ষা বাহিনীতে এবং শতকরা বত্রিশ টাকা খরচ হয় কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনায়। এই একুন শতকরা চুরানব্বই টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া তখন খরচ হইত পূর্ব পাকিস্তানে। আপনারা জানেন অর্থবিজ্ঞানের কথাঃ সরকারী আয় জনগণের ব্যয় এবং সরকারী ব্যয় জনগণের আয়, এই নিয়মে বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের গোটা আয়ের অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানের ব্যয় ঠিকই, কিন্তু সরকারী ব্যয়ের সবটুকুই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায়, সরকারী আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং বিদেশী মিশনসমূহ তাঁদের সমস্ত ব্যয় পশ্চিম পাকিস্তানেই করিতে বাধ্য হইতেছেন। এই ব্যয়ের সাকুল্যই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। ফলে প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান তার মোকাবিলায় ঐ পরিমাণ গরীব হইতেছে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের রাজধানী হইত, তবে এই সব খরচ পূর্ব পাকিস্তানে হইত। আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা এই পরিমাণে ধনী হইতাম। আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানীরা ঐ পরিমাণে গরীব হইতেন। তখন আপনারা কি করিতেন? যে সব দাবী করার জন্য আমাকে প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতার তহমত দিতেছেন, সেই সব দাবী আপনারা নিজেরাই করিতেন। আমাদের চেয়ে জোরেই করিতেন। অনেক আগেই করিতেন। আমাদের মত আঠার বছর বসিয়া থাকিতেন না। সেটা করা আপনাদের অন্যায়ও হইত না।
পৃষ্ঠা নং: ৩০০

।। তিন ।। আপনারা ঐসব দাবী করলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা কি করিতাম, জানেন? আপনাদের সব দাবী মানিয়া লইতাম। আপনাদিগকে প্রাদেশিকতাবাদী বলিয়া গালি দিতাম না। কারণ আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি যে, ঐসব আপনাদের হক পাওনা। নিজের হক পাওনা দাবী করা অন্যায় নয়, কর্তব্য। এ বিশ্বাস আমাদের এতই আন্তরিক যে, সে অবস্থা হইলে আপনাদের দাবী করিতে হইত না। আপনাদের দাবী করার আগেই আপনাদের হক আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতাম। আমরা নিজেদের হক দাবী করিতেছি বলিয়া আমাদের স্বার্থপর বলিতেছেন। কিন্তু আপনারা যে নিজেদের হকের সাথে সাথে আমাদের হকটাও খাইয়া ফেলিতেছেন, আপনাদেরে লোকে কি বলিবে? আমরা শুধু নিজেদের হকটাই চাই। আপনাদের হকটা আত্মসাৎ করিতে চাই না। আমাদের দিবার আওকাৎ থাকিলে বরঞ্চ পরকে কিছু দিয়াও দেই। দৃষ্টান্ত চান? শুনুন তবেঃ
(১) প্রথম গণপরিষদে আমাদের মেম্বর সংখ্যা ছিল ৪8; আর আপনাদের ছিল ২৮। আমরা ইচ্ছা করিলে গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী ও দেশরক্ষার সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে আনিতে পারিতাম। তা’ করি নাই।
(২) পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাল্পতা দেখিয়া ভাইয়ের দরদ লইয়া আমাদের ৪৪টা আসনের মধ্যে ৬টাতে পূর্ব পাকিস্তানীর ভোটে
পশ্চিম পাকিস্তানী মেম্বর নির্বাচন করিয়াছিলাম।
(৩) ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে পারিতাম। তা’ না করিয়া বাংলার সাথে উর্দুকেও
রাষ্ট্রভাষার দাবী করিয়াছিলাম।
(৪) ইচ্ছা করিলে ভোটের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাজনক শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিতাম।
(৫) আপনাদের মন হইতে মেজরিটি ভয় দূর করিয়া সে স্কুলে ভ্রাতৃত্ব ও সমতাবোধ সৃষ্টির জন্য উভয় অঞ্চলে সকল বিষয়ে সমতা বিধানের আশ্বাসে আমরা সংখ্যাগুরুত্ব ত্যাগ করিয়া সংখ্যাসাম্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।
সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানী ভাই সাহেবান! আপনারা দেখিতেছেন,
পৃষ্ঠা নং: ৩০১

যেখানে যেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল, আমরা দান করিয়াছি। আর কিছুই নাই দান করিবার। থাকিলে নিশ্চয়ই দিতাম। যদি পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইত তবে আপনাদের দাবী করিবার আগেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্য সত্যই দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করিতাম। দ্বিতীয় রাজধানীর নামে ধোঁকা দিতাম না। সে অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার ব্যয় যাতে উভয় অঞ্চলে সমান হয়, তার নিখুঁত ব্যবস্থা করিতাম। সকল ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে এবং প্রদেশসমূহকে পৃথকভাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতাম। আমরা দেখাইতাম, পূর্ব পাকিস্তানীরা মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের নয়, ছোট বড় নির্বিশেষে তা’ সকল পাকিস্তানীর। পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইলে তার সমযোগ লইয়া আমরা পূর্ব পাকিস্তানীরা সব অধিকার ও চাকুরী গ্রাস করিতাম না। পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসনভার পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতেই দিতাম। আপনাদের কটন বোর্ডে আমরা চেয়ারম্যান হইতে যাইতাম না। আপনাদের প্রদেশের আমরা গভর্নর হইতেও চাইতাম না। আপনাদের পি. আই. ডি. সি., আপনাদের ওয়াপদা, আপনাদের ডি. আই. টি., আপনাদের পোর্ট ট্রাস্ট, আপনাদের রেলওয়ে ইত্যাদির চেয়ারম্যানী আমরা দখল করিতাম না। আপনাদেরই করিতে দিতাম। সমস্ত অল পাকিস্তানী প্রতিষ্ঠানকে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত করিতাম না। ফলতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনীতিতে মোটা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সরু করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই মারাত্মক ডিসপ্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না।
এমনি উদারতা, এমন নিরপেক্ষতা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফবোধই পাকিস্তানী দেশপ্রেমের বুনিয়াদ। এটা যার মধ্যে আছে, কেবল তিনিই দেশপ্রেমিক। যে নেতার মধ্যে এই প্রেম আছে, কেবল তিনিই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উপর নেতৃত্বের যোগ্য। যে নেতা বিশ্বাস করেন, দুইটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেহের দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসিকা, দুই পাটি দাঁত, দুই হাত, দুই পা; যে নেতা বিশ্বাস করেন, পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে এইসব জোড়ার দুইটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালী করিতে হইবে; যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের এক অঙ্গ দুর্বল হইলে গোটা পাকিস্তানই দুর্বল হইয়া পড়ে, যে নেতা বিশ্বাস
পৃষ্ঠা নং: ৩০২

করেন ইচ্ছা করিয়া বা জানিয়া শুনিয়া যাহারা পাকিস্তানের এক অঙ্গকে দুর্বল করিতে চায়, তারা পাকিস্তানের দুশমন; যে নেতা দৃঢ় ও সবল হস্তে সেই দুশমনদেরে শায়েস্তা করিতে প্রস্তুত আছেন, কেবল তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী। কেবল তাঁরই নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঐক্য অটুট ও শক্তি অপরাজেয় হইবে। পাকিস্তানের মত বিশাল ও অসাধারণ রাষ্ট্রের নায়ক হইতে হইলে নায়কের অন্তরও হইতে হইবে বিশাল ও অসাধারণ। আশা করি, আমার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই মাপকাঠিতে আমার ৬-দফা কর্মসূচীর বিচার করিবেন। তা’ যদি তাঁহারা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমার এই ৬-দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানীদের বাঁচার দাবী নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবী।
আমার প্রিয় ভাই-বোনেরা, আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬-দফা দাবীতে একটিও অন্যায়, অসঙ্গত, পশ্চিম পাকিস্তান-বিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্কসহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশী শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমী স্বার্থের মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুনও নয়, বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ-দাদার মত মুরুব্বিরাই এদের কাছে গালি খাইয়াছেন, এদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছেন, আর আমি কোন্ ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়নমণি শেরে বাংলা ফজলুল হককে এঁরা দেশদ্রোহী বলিয়াছিলেন। দেশবাসী এও দেখিয়াছেন যে, পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করিতে হইয়াছিল এদেরই হাতে। অতএব দেখা গেল, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবীর কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেলজুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল-জুলুম ভুগিবার তকদির আমার হইয়াছে। মুরুব্বীদের দোওয়ায়, সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সে-সব সহ্য করিবার মত মনের বল আল্লাহ, আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানীর ভালবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এই কাজে যে-কোন
পৃষ্ঠা নং: ৩০৩

ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মত নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবীর জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তাঁর পায়ের তলে বসিয়াই এতকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই। আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছিয়াছি।
আমার দেশের প্রিয় ভাই-বোনেরা, আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকী জীবনটুকু আমি যেন আপনাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।
ইতি-
আপনাদের স্নেহধন্য খাদেম,
৪ঠা চৈত্র, ১৩৭২ শেখ মুজিবুর রহমান

পুস্তিকাটি “তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে ১৫ পুরানা পল্টন, ঢাকা হইতে প্রকাশিত” হয়। এর মূল্য ০.২৫ টাকা। পাইওনিয়ার প্রেস, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।

৬-দফা সম্পর্কে শাসগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া
শেখ মুজিব প্রথম যখন ৬-দফার দাবী সরকার এবং জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেন তখন থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের দৃষ্টিও তাঁর বিরুদ্ধে সুতীব্র হয়ে উঠলো। পূর্ব বাংলায় আইন ও পার্লামেন্টারী দফতরের মন্ত্রী আবদুল হাই চৌধুরী করাচীতে ১৪ই ফেব্রুয়ারী এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব কর্তৃক পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে নিয়ে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাবকে দেশদ্রোহিতার নামান্তর বলে অভিহিত করলেন।

৬-দফার সারবত্তা নিরূপণে শেখ মুজিবের সাংবাদিক সম্মেলন
বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৬-দফার সারবত্তা প্রমাণ করার জন্য শেখ মুজিব ১৭ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৬) এক সাংবাদিক সম্মেলনের আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগের ১৫ নং পুরানা পল্টন অফিসে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন দৈনিক ইত্তেফাকের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখের সংখ্যা থেকে উক্ত খবরের অংশবিশেষ তুলে ধরছিঃ
পৃষ্ঠা নং: ৩০৪

“গতকল্য বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, রাজনীতিতে মধ্যপন্থা আর বিশ্বাস করা চলে না। তাই দেশের বৃহত্তর কল্যাণের কথা চিন্তা করিয়াই তিনি জাতির সামনে ৬-দফা সুপারিশ তুলিয়া ধরিয়াছেন। এই ৬-দফা কোন রাজনৈতিক দর কষাকষি নয়, কোন রাজনৈতিক চালবাজীও নয়—এই ৬-দফার সহিত পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ অধিবাসীর জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত।
…১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব আজ গ্রহণযোগ্য নয় বলিয়া যাহারা যুক্তি দেখাইতেছেন তাঁহাদের উদ্দেশে শেখ মুজিব বলেন যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবই পাকিস্তানের ভিত্তি। এই প্রস্তাবভিত্তিক ভাবী পাকিস্তানের উপরই পাক-ভারতের জনসাধারণকে মতামত দানের জন্য সেদিন আহ্বান জানান হইয়াছিল। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পাকভারতের মুসলমানেরা এই লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়া দেশ বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান কায়েম করিয়াছিল। এই পর্যায়ে এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন যে, ১৯৪৬ সালে দিল্লীতে মুসলিম লীগের উদ্যোগে যে ‘লেজিসলেচরস কনভেনশন’ হয় তাহার পূর্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সে নির্বাচনে জনসাধারণ লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের পক্ষেই রায় দান করে। মুসলিম লীগ কাউন্সিলে গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং জনসাধারণ কর্তৃক অনুমোদন-স্বীকৃত সত্যকে বানচাল করিয়া দেওয়ার কোন এখতিয়ার দিল্লীর ‘লেজিসলেচরস্ কনভেনশনের’ ছিল না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, সাম্প্রতিক লাহোর সম্মেলনের সাথে পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ যেভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে সেভাবে ছিন্ন করার পূর্ণ গণতান্ত্রিক এখতিয়ার প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের আছে। তিনি বলেন যে, লাহোর সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে আওয়ামী লীগ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বলিয়া আখ্যায়িত করিতে পারেন কেবল তাহাঁরাই—আওয়ামী লীগের গঠনতান্ত্রিক সম্পর্কে যাঁহাদের সুস্পষ্ট ধারণা নাই। কেবল স্বকল্পিত ব্যাখ্যার দ্বারা ৬-দফার বিরুদ্ধাচরণ না করিয়া এই দফার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কি,গণভোটের মাধ্যমে তাহা যাচাই করিয়া দেখিবার
পৃষ্ঠা নং: ৩০৫

জন্য তিনি বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, দেশবাসী আপামর জনসাধারণ ৬-দফার পক্ষে আছে এবং বিগত যুদ্ধের স্মৃতি যাঁহারা স্পষ্টভাবে স্মরণ রেখেছেন, তাঁহাদের এই ৬-দফার বিরুদ্ধাচরণ করার কোন উপায় নাই।
কাউন্সিল লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে যাঁহারা আজ লাহোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধাচরণ করছেন, শেখ মুজিব তাঁহাদেরকে স্মরণ করিয়া দেন যে, ১৯৫৫ সালে যে একুশ দফার ভিত্তিতে মুসলিম লীগকে খতম করা হইয়াছিল, লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সেই একুশ-দফার অন্যতম প্রধান দাবী ছিল।
একটু চেষ্টা করিলেই ৬-দফার বিরুদ্ধাচারীরা নিশ্চয়ই স্মরণ করিতে পারিবেন যে, ১৯৫৪ সালের যে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে দেশবাসী জনসাধারণ লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী সম্বলিত একুশ দফার সমর্থকগণকেই শতকরা ৯৭টি আসনে জয়যুক্ত করিয়াছিল। আর তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিতে গিয়া তদানীন্তন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দলকে ভরাডুবি বরণ করিতে হইয়াছিল।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা লাহোর প্রস্তাবের ইস্যুটিকে যদি কেহ, বা কোন দল পুনরায় গণ-আদালতে উত্থাপন করিয়া আর একবার জনমত যাচাই করিয়া দেখিতে রাজী থাকেন, আমরা সানন্দে তাঁহাদের সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি।
তিনি বলেন, মুসলিম লীগের নামে এতকাল কায়েমী স্বার্থবাদী মহল যে গণবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করিয়া আসিতেছে আজ তাহা খতম হইয়াছে। তাই আজ তাহাদের কেহ কেহ নতুন উদ্যমে ইসলামের দোহাই দিয়া সমগোত্রীয়দের সাথে একীভূত হইয়া নতুন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়াছেন।
পূর্ব পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী জনাব আবদুল হাই’য়ের ৬-দফা সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে শেখ মুজিবের দেশপ্রেমের প্রতি যে কটাক্ষ করিয়াছেন শেখ মুজিব তাহার জবাব দিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, মৌলিক গণতন্ত্রের দেশে কেবল সৌজন্যের খাতিরেই মন্ত্রী বলা হয়। আসলে জনাব হাই কেবল নামেই মন্ত্রী। কারণ, তিনি যেমন দেশবাসীর
পৃষ্ঠা নং: ৩০৬

কারো প্রতিনিধি নহেন, তেমনি তাঁহার পলিসি নির্ধারণেরও কোন ক্ষমতা নাই।
শেখ মুজিব দলমত নির্বিশেষে দেশের সকল শান্তিকামী মানুষকে বিগত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডত্ব রক্ষার প্রশ্নটি পুনরায় গভীরভাবে বিবেচনা করিয়া দেখিবার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, ‘আমি সার্বিকভাবে অসাম্প্রদায়িক নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু তাই বলিয়া আমার দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিজয়ীর বেশে আসিয়া প্রবেশ করিবে, দেশের লক্ষ কোটি মানুষের মত, প্রাণ থাকিতেও আমি তাহা বরদাশত করিতে পারি না। পাকিস্তানের শক্তি তাহার এলাকা-বিশেষে নিহিত নয়। দেশের শক্তির আসল উৎস দেশের কন্দরে কন্দরে। একটা বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝা দরকার যে, কেন্দ্রের উপর ‘বিষয়ের হিমালয়’ চাপাইয়া দিলেই কেন্দ্র শক্তিশালী হয় না, অঙ্গসমূহের শক্তিই আসলে কেন্দ্রের শক্তি। কেন্দ্রকে যাঁহারা শক্তিশালী করিতে বা রাখিতে চান, তাঁহাদেরকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আজ সকল ক্ষমতার অধিকারী একটি মহাশক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার দেশে কায়েম থাকা সত্ত্বেও বিগত যুদ্ধের সময় অসীম শক্তিধর সে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানীদের চরম বিপদের দিনে তাহাদের কি সাহায্য করিতে পারিয়াছিল? খোদা না খাস্তা সীমান্ত পার হইতে পূর্ব পাকিস্তানের উপর যদি সর্বাত্মক কোন হামলা হইত তাহা হইলে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার কিভাবে তার এলাজ করিতেন, বিগত যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে শক্তিশালী কেন্দ্রের বিশ্বাসীদের নিকট হইতে এটাই আমার জিজ্ঞাস্য?”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রহৃত ও শেখ মুজিবের নিন্দা
ইতিমধ্যে ১৫ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের অরাজকতা ইতিহাসে এক জঘন্য অধ্যায় সংযোজন করে। সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ ওসমান গণি ও সিণ্ডিকেটের আট জন সদস্য উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ আবু মাহমুদের সঙ্গে জনৈক অধ্যাপককে অবৈধভাবে নিয়োগের বিষয় সম্পর্কিত মামলায় হাইকোর্টের রায়ে হেরে যান। ফলে মোনেম খানের
পৃষ্ঠা নং: ৩০৭

পোষা একশ্রেণীর ছাত্র নামধারী গুণ্ডা সরকারী ইঙ্গিতে ডক্টর মাহমুদের উপর জঘন্যভাবে হামলা চালায়। ফলে ডক্টর মাহমুদ গুরুতর আহত হন। এই জঘন্য ঘটনায় প্রদেশের বুদ্ধিজীবীসহ ছাত্র-জনতা প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। শেখ মুজিব কঠোর ভাষায় এই হামলার নিন্দা করেন। এমনকি তিনি বলেনঃ “ডঃ মাহমুদকে প্রহারকারী ছাত্রদল সম্ভবতঃ লাটভবনে আশ্রয় লইয়াছে।”
সরকারের নিকট অপ্রিয় হলেও শেখ মুজিবের এই সত্যভাষণ প্রকাশ করবার ‘ধৃষ্টতা প্রদর্শন করায়’ গভর্নরের নির্দেশ অনুসারে হোম পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের সেকশন অফিসার জনাব হাবিবুর রহমান ‘দৈনিক আজাদের’ ২০ হাজার টাকা জামানত তলবের নোটিশ দেন এবং দশ দিনের মধ্যে তার কারণ দর্শাবার নির্দেশ দান করেন।

৬ দফাঃ গণ-সংযোগ
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে ১৯৬৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ৬-দফা আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৬-দফা পাশ হবার পর শেখ মুজিব দেশের মানুষের কাছে তার তাৎপর্য তুলে ধরবার জন্য গণ-সংযোগ সফর শুরু করলেন। তিনি যেখানেই গেছেন, সেখানেই তাঁর বক্তব্য বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ২৫শে ফেব্রুয়ারী (’৬৬) এক বিশাল জনতা ৬-দফাকে সামনে রেখে “দেশ ও দশের বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে”—দাবী আদায়ের জন্য যে-কোন ত্যাগ স্বীকারের সংকল্প ঘোষণা করেন। ৬-দফা এই প্রথম একটি জনসভায় পেশ করা হ’ল এবং প্রথম যাত্রালগ্নেই এই পরিকল্পনা ব্যাপক গণসমর্থন অর্জন করলো। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান সেদিন থেকে একটি ঐতিহাসিক ময়দানে পরিণত হ’ল।
পরদিন আওয়ামী লীগ কর্মী সমাবেশে দলীয় কর্মসূচীর কি ও কেন ব্যাখ্যা ক’রে শেখ মুজিব বলেন যে, “দেশবাসী যাহাতে স্বাধীনতার সত্যিকার স্বাদ ভোগ করিতে পারে আওয়ামী লীগের ৬-দফা দেশবাসীর ঈপ্সিত সেই শক্তিশালী পাকিস্তানেরই সুস্পষ্ট রূপরেখা।”
২৭শে ফেব্রুয়ারী নোয়াখালী জেলার মাইজদী কোর্টে জেলা আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, “আমরা আর নেতাদের
পৃষ্ঠা নং: ৩০৮

ঐক্যে বিশ্বাস করি না। আমরা জনগণের ঐক্যে বিশ্বাসী এবং জনগণের ঐক্য কায়েমের প্রত্যাশী। আমরা চাই, তথাকথিত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান ঘটুক এবং রাজনীতি মানুষের অধিকারে আসুক। বিবেকের দংশন যিনি অনুভব করেন, আসুন আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচীকে সমুন্নত করিয়া তুলুন।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬]
শেখ মুজিব যখন প্রদেশের গ্রাম গ্রামান্তরে তাঁর মহান আদর্শ জনগণের সামনে তুলে ধরতে ব্যস্ত, তখন আইয়ুব খান সাত তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য, শেখের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগা। মার্চের ৭ তারিখে ঢাকা বিমান বন্দরে তিনি প্রদত্ত এক মানপত্রের জবাবে ‘এক শ্রেণীর’ রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে বললেনঃ “ওরা সুস্থ রাজনীতি শিখে নাই।” এর আগে রাওয়ালপিণ্ডিতে এক মাস-পয়লা বেতার ভাষণে দেশের ঐক্য ও সংহতির ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে ‘এক শ্রেণীর লোক’ যে-সব দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলেন তাঁদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ ক’রে বলেছিলেন যে, “উক্ত ব্যক্তিদের অসৎ উদ্দেশ্য অঙ্কুরে বিনষ্ট ক’রে দেওয়া হবে।” লক্ষণীয় যে, আইয়ুব খানের চেলারা অনেক আগে থেকেই একমাত্র শেখ মুজিবকেই দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্টকারী বলে চিৎকার ক’রে বেড়াচ্ছিলেন। আর তাদের প্রভু আইয়ুব এক শ্রেণীর লোক বলতে যাদেরকে বুঝাচ্ছেন তাঁরা যে শেখ মুজিব এবং তাঁর সহকর্মীবৃন্দ, তা’ বলাই বাহুল্য।

আইয়ুবের হুমকি
মার্চের ১৬ তারিখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব রাজশাহীতে প্রকাশ্যভাবে ৬-দফার বিরুদ্ধে সমালোচনা করলেন এবং বললেন— “ইহা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নেরই একটি পরিকল্পনা। তিনি এর বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ ক’রে বলেন, এই ‘জঘন্য স্বপ্ন’ বাস্তবায়িত হ’লে পাকিস্তানবাসী গোলামে পরিণত হবে, তাই এ কাজ তিনি কখনই সফল হতে দেবেন না।”
শুধু তাই নয়, ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান মুসলিম লীগের কনভেনশনের সমাপ্তি অধিবেশনে সভাপতির ভাষণদান প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট
পৃষ্ঠা নং: ৩০৯

আইয়ুব শেখ মুজিব ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ ক’রে গৃহযুদ্ধেরও হুমকি প্রদান করেন। তারিখটি ছিল সম্ভবতঃ ১৯ অথবা ২০শে মার্চ। আর একই দিনে শেখ মুজিবও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের সমাপ্তি দিবসে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দানকালে বলেনঃ “কোন হুমকিই বাংলার মানুষকে ৬-দফা দাবী থেকে নিবৃত্ত করতে পারবে না।”

আওয়ামী লীগ সভাপতি পদে শেখ মুজিব
১৮, ১৯ ও ২০শে মার্চ ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। পনেরো বৎসর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর তিনি তাঁর দায়িত্ব জনাব তাজউদ্দিন আহমদের হাতে অর্পণ করেন এবং নিজে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। তাঁর সহকর্মী হিসেবে যাঁরা পরবর্তী এক বৎসরের জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগে’র কর্মকর্তা নির্বাচিত হন তাঁরা হলেনঃ
সহ-সভাপতিঃ জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম
সহ-সভাপতিঃ জনাব হাফেজ হাবিবুর রহমান,
এবং
সহ-সভাপতিঃ জনাব মুজিবুর রহমান (রাজশাহী),
সাধারণ সম্পাদকঃ জনাব তাজউদ্দিন আহমদ,
সাংগঠনিক সম্পাদকঃ জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী,
শ্রম সম্পাদকঃ জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী,
প্রচার সম্পাদকঃ জনাব আবদুল মোমেন এডভোকেট,
মহিলা সম্পাদিকাঃ মিসেস আমেনা বেগম,
অফিস সম্পাদকঃ জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ,
সমাজকল্যাণ সম্পাদকঃ ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি জনাব কে. এম. ওবায়দুর রহমান,
কোষাধ্যক্ষঃ জনাব নুরুল ইসমাম চৌধুরী।

৬-দফার বিরুদ্ধে ভূট্টোর চ্যালেঞ্জ
প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের হুমকির জবাব শুধুমাত্র শেখ মুজিবই দেন নি। প্রদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদরাও ৬-দফার সমর্থনে
পৃষ্ঠা নং: ৩১০

তাঁর হুমকির কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করেন। আইয়ুবের এককালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী (যিনি মন্ত্রী থাকাকালীন আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থাকে মেনে নিতে না পারার দরুন পদত্যাগ করেছিলেন) বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ইব্রাহিম ২৬শে মার্চ (১৯৬৬) সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে আইয়ুবকে উদ্দেশ ক’রে বলেছিলেন যে, “অস্ত্রের ভাষা বিদেশী আক্রমণের জন্য রাখিয়া আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যুক্তির ভাষায় কথা বলুন। তাঁহার নিকট যদি ৬-দফা গ্রহণযোগ্য না হয় তাহা হইলে তাঁহার বিকল্প কর্মসূচী লইয়া তিনি যেন জনগণের সামনে হাজির হন।” তিনি আরো বলেন, “ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সহিত ৬-দফার কোন গরমিল নাই।” এই সময় আইয়ুব খানের বাকসর্বস্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোও প্রভুকে সন্তুষ্ট করার জন্য ৬-দফার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে তিনি পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ প্রধান জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ‘বাকযুদ্ধে’ অবতীর্ণ হওয়ার জন্য এক চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন।

শেখ মুজিব কর্তৃক ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ
শেখ সাহেবের তরফ থেকে সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ২১শে মার্চ উক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ক’রে পল্টন ময়দানে অথবা ভুট্টোরই পছন্দ মত কোন জায়গায় যে-কোনদিন তাঁর সঙ্গে বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে আহ্বান জানালেন। এই সঙ্গে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ জনাব ভুট্টোকে ৬-দফার প্রশ্নটি চিরতরে মীমাংসার জন্য তাঁর প্রভুকে পূর্ব বাংলাব্যাপী গণভোট অনুষ্ঠানে রাজী করবার প্রস্তাব দেন এবং উক্ত গণভোটে জনাব ভুট্টোর দল শতকরা ৩০টি ভোট পেলে আওয়ামী লীগ ৬-দফার প্রশ্নে স্বীয় নীতি পুনর্বিবেচনায় প্রস্তুত বলেও তিনি ঘোষণা করেন। পরে ১৩ই এপ্রিল শেখ মুজিব নিজেই ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ক’রে তাঁর সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অবশেষে ১৭ই এপ্রিল ‘সম্মুখ সমরের’ দিন ধার্য হয়। স্থান ও কর্মপদ্ধতি উভয়ের মধ্যে আলোচনা-সাপেক্ষে স্থির করা হবে বলে ভুট্টো মত প্রকাশ করেন।

সম্মুখ সমরে ভুট্টোর পৃষ্ঠপ্রদর্শন
কিন্তু এপ্রিলের ১৫ তারিখে ৬-দফার পেছনে জনতার বিপুল সমর্থন রয়েছে জেনে জনাব ভুট্টো ‘সম্মুখ সমরের’ উৎসুক দর্শকদের
পৃষ্ঠা নং: ৩১১

নিরাশ ক’রে রণে ভঙ্গ দিলেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, সময়ের স্বল্পতা হেতু মুসলিম লীগের নেতারা সভার আয়োজনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তা’ ছাড়া পাকিস্তানে সফররত গণচীনের চেয়ারম্যান লিও শাও চীর সম্বর্ধনার জন্য তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হবে বলে তিনি ‘সম্মুখ সমর’ সভায় উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
জনাব ভুট্টো কেটে পড়ায় শেখ মুজিব বলেন যে, এর ফলে “৬-দফার নৈতিক বিজয় সূচিত হইয়াছে।”

৬-দফা সম্পর্কে ভাসানীর প্রতিক্রিয়া
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ৬-দফার প্রতি বাঙালী জাতির বিপুল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বাঙালীর জাতীয় নেতা বলে কথিত মওলানা ভাসানী বাঙালীর এই মুক্তি সনদের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠেন। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাথে বেশ কিছুদিন ধরে অনেক শলাপরামর্শ ক’রে অবশেষে ভাসানী সাহেব ৭ই এপ্রিল (’৬৬) ঢাকায় যা বললেন ৮ই তারিখে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা থেকে তার রিপোর্ট তুলে ধরছিঃ
“ছয় দফা সম্পর্কে ভাসানী যাহা বলেনঃ
ঢাকা ৭ই এপ্রিল। ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অদ্য শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা দাবী বাতিল করিয়া দেন। সাম্রাজ্যবাদীদের অনুচরবর্গ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে শোষণ চালাইয়া যাইতেছে তার সমাধানের কোন পন্থাই উক্ত কর্মসূচীতে নাই বলিয়া তিনি তাহা বাতিল করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন যে, ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুসারে প্রদেশসমূহের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবীর প্রতি তাঁহার পূর্ণ সম্মতি রহিয়াছে। কিন্তু তাহাতে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাও প্রতিফলিত করিতে হইবে।”
[ দৈনিক আজাদ, ৮ই এপ্রিল, ১৯৬৬]
৬-দফা সম্পর্কে ভাসানীর এই মন্তব্য সত্যি দুঃখজনক। মওলানা ভাসানী সারাজীবন মজলুম মানুষের নেতা হবার চেষ্টা করেছেন। তিনি সারাটি জীবন জনগণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গীত করেছেন। কিন্তু জনগণের সত্যিকার সমস্যা অনুধাবন করতে হ’লে যে মনীষা ও
পৃষ্ঠা নং: ৩১২

প্রজ্ঞার প্রয়োজন, আমার মনে হয়, চিরদিন তিনি তা’ অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেও একথা বলা যায় যে, তাঁর ‘ভাসানী’ নামটি সার্থক হয়েছে। তিনি সারা জীবন শুধু পানির উপরিভাগে ভাসমান পদার্থের ন্যায় ভেসেই বেড়িয়েছেন, গভীরে প্রবেশের সামর্থ্য তাঁর হয় নি। সে কারণে চাঞ্চল্য ও বালখিল্য চাপল্যই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। গভীর ভারত্ব ও সংযমী সাধনা তাঁর মধ্যে কমই পরিলক্ষিত হয়েছে। আর এমনি ভাসমান বলেই, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি বারবার কিছুসংখ্যক তথাকথিত অতি প্রগতিবাদী রাজনীতিবিদদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। যখনই তিনি এই ব্যবহারের বলয় থেকে বাইরে এসেছেন তখনই তার নিজস্ব স্বরূপ অর্থাৎ আসল মওলানার যে চেহারা সেই চেহারায় তিনি ফিরে এসেছেন। সে কারণেই কখনো তিনি গণতন্ত্রের পূজারী, আবার কখনো আইয়ুবের প্রবর্তিত নীতি স্বৈরতন্ত্রের কখনো সমাজতন্ত্রের উপাসক, কখনো বা ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা-কখনো বলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই মুক্তির একমাত্র পথ, আবার কখনো বলেন কোরানে আল্লাহ যে সমাজতন্ত্র বেঁধে দিয়েছেন তার ওপর আর কিছু হতে পারে না- কখনো ৬-দফার মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ পেয়ে সোচ্চার ভাষায় বলবেন যে রোজকেয়ামততক পাকিস্তান তার দুই অংশ নিয়েই বেঁচে থাকবে, তা’ ধ্বংস করবার সাধ্য কারো নেই-আবার ১৯৭০-এর নির্বাচনে কোন একটি আসনেও যখন তাঁর দল গণ-সমর্থন লাভ করলো না তখন তিনি বললেন, “মুজিবের ৬-দফা ছাড়ো, এক দফায় নেমে এসো-বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই।” এই সব পরস্পর বিরোধী উক্তিই তাঁর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। আর তাঁর এই বৈপরীত্য মাঝে মাঝে বালকোচিত বলে মনে হতে পারে।
মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেবার প্রয়োজন অনুভব করছি। ১৯৬৩ সালের ৩১শে আগষ্ট আমি আমেরিকায় দুই বছর অধ্যয়নের পর দেশে ফিরবার পথে করাচী অবতরণ করি। মনে তখন অপরিসীম আশা-বাংলাদেশকে পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে মুক্ত করতে হবে। আমেরিকায় অবস্থান কালে
পৃষ্ঠা নং: ৩১৩

তরুন বন্ধুদের সাথে এটাই ছিল আমার মূল আলোচনার বিষয়। কিন্তু করাচী নেমেই অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, সেখানকার দৈনিক কাগজে আইয়ুব ও ভাসানীর আলিঙ্গনরত ছবি প্রকাশ পেয়েছে—ভাসানী আইয়ুবের সমগ্র নীতি সমর্থন করছেন। এমন একটি দৃশ্য ও সংবাদের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাই মুষড়ে পড়লাম। পরদিন ঢাকার পথে রওয়ানা হয়ে বিমানে উঠেই দেখি, মওলানা ভাসানী সেই একই বিমানে ঢাকা ফিরছেন। আমি এক সময় তাঁর পাশে বসে নিজের পরিচয় দিলাম এবং সবিনয়ে বললাম, “হুজুর, আপনার বয়স হয়েছে, বলতে গেলে কবরে এক পা দিয়েই আছেন, এই সময় আপনার নিকট থেকে আমরা আশা করেছিলাম যে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আপনার হাত দিয়েই আসবে। কিন্তু আপনি কিনা শেষ পর্যন্ত আইয়ুবের নিকট পূর্ব বাংলার স্বার্থকে বিক্রয় করলেন? কাল আপনি যখন মারা যাবেন, বাংলার মানুষ আপনার কবরের দিকে ফিরেও তাকাবে না।”
ভাসানী একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “দেখো বাপু, তোমাদের রক্ত এখনো গরম তাই বুঝতে পারো না। আইয়ুব খারাপটি কি করেছেন? তার ‘ফরেন পলিসিটি’ বিচার করে দেখেছো? কেমন চমৎকার ভারসাম্য রক্ষা করে চীনের সাথে তিনি মিতালী করেছেন। পেরেছে তোমাদের সোহরাওয়ার্দী? আমি ঐ সব বাংলা ফাংলা বুঝি না—বর্তমান দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কই হ’ল আসল। আমার কাছে বাংলাদেশ, পশ্চিম পাকিস্তান বা ভারত এসবের কোন মূল্য নাই। পৃথিবীর মজলুম মানুষ সবই এক, তারা যেখানেই বাস করুক। তা’ ছাড়া বেশী বাংলা বাংলা করলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। এটা আল্লাহর দেশ। পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র, এই দেশকে তোমরা ভাঙতে চাও? তা’ আমি হতে দেব না।”
এরপর মওলানার সাথে আর বাক্যব্যয়ের প্রয়োজন বোধ করি নি। বুঝতে পারলাম, ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে এন. ডি. এফ. -এর নেতৃবৃন্দ যখন দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় আইয়ুবের পক্ষে সরকারী প্রতিনিধি হিসেবে মওলানা ভাসানী চীনের প্রজাতন্ত্র দিবসে যোগদানের জন্য গিয়েছিলেন। ফিরে এসে
পৃষ্ঠা নং: ৩১৪

বললেন, “চীনে গিয়া আমার গোটা রাজনৈতিক জীবনটাই যেন বদলাইয়া গিয়াছে। চীনারা কথা কয় কম, কিন্তু কাজ করে বেশী। কিন্তু আমার দোষ হইতেছে আমি কথা কই বেশী, কাজ করি কম।” সুতরাং চীনা ফেরত মওলানা কথা কম বলে যে কাজ শুরু করলেন তার বেশীর ভাগই নিয়োজিত হ’ল আইয়ুবের স্বার্থে, বাংলার স্বাধিকার অর্জনের স্বপক্ষে নয়।
প্রগতিবাদী চিন্তায় শুধুমাত্র তাঁদের একচেটিয়া অধিকার—এই ধরনের ধারণা যাঁদের হৃদয়ে বদ্ধমূল, তাঁদের কেউ কেউ ভাববেন যে, আমি মওলানা ভাসানী সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছি তার মধ্যে মওলানার প্রতি আমার অশ্রদ্ধাই প্রকাশ পেয়েছে। আমি আবার বলছি, তাঁর বয়সকে, তিনি যে সুদীর্ঘকাল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে টিকে আছেন সেই অসাধারণ সামর্থ্যকে, রাজনৈতিক জীবনে তিনি অনেককে যে দীক্ষা দান করেছেন সেই মহানুভবতাকে, চলনে-বলনে আহারে-বিহারে তাঁর নিজস্ব একটি ক্ষমতাকে, অসম সাহসিকতাকে, জনগণের প্রতি তাঁর যে দরদ আছে সেই ঐকান্তিকতাকে আমি শ্রদ্ধা করি—কিন্তু তাঁর ভাসমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে, অপরের দ্বারা পরিচালিত রিক্ত মনীষাকে, অসার প্রজ্ঞাকে এবং শূন্যগর্ভ সাধনাকে আমি শ্রদ্ধা করতে পারি না। আমার এই অশ্রদ্ধা সম্পূর্ণভাবেই একাডেমিক বিশ্লেষণের ফলশ্রুতি। তাঁর জীবন থেকে বহু ঘটনার উল্লেখ ক’রে আমার বক্তব্যকে আমি প্রমাণ করতে পারি। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। শেখ মুজিবের জীবনে মওলানা ভাসানীর কোন প্রভাবই আমরা সন্ধান ক’রে পাই না, যদিও তাঁর প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনে মওলানার সান্নিধ্য তিনি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধাচরণ করেও তিনি মুজিবের কোন লাভ বা ক্ষতি সাধন করতে পারেন নি। সে কারণেই বলছিলাম, ৬-দফা সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর বক্তব্য দুঃখজনক। দুঃখজনক আমাদের জন্য, কেননা তাঁর নিকট থেকে ঠিক এমন প্রত্যাখ্যান আমরা আশা করি নি। দুঃখজনক তাঁর নিজের জন্যও, কেননা এর ফলে তিনি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রবাহ-পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। যদিও শেখ মুজিবের জন্য ভাসানীর কোন মন্তব্য, কার্যকলাপ বা হুমকি, কোনটিই দুঃখজনক নয়। কেননা
পৃষ্ঠা নং: ৩১৫

ভাসানীকে একটি শক্তি হিসেবে শেখ মুজিব কোন দিনই বিশেষ পরোয়া করেন নি। কেন করেন নি তার কারণ আমার এতক্ষণ প্রদত্ত মন্তব্যে মিলবে। অধিক বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
যাহোক বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬-দফা প্রসঙ্গে ভাসানী সাহেব কি বললেন না বললেন, অথবা আইয়ুব কি ভাবলেন না ভাবলেন ইত্যাদি নিয়ে শেখ মুজিব মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি তাঁর কর্মসূচী নিয়ে বাংলার পথেঘাটে নিরলস ঝটিকা সফর ক’রে বেড়াতে লাগলেন।

৬-দফার গণসংযোগ ও শেখ মুজিবের উত্তরাঞ্চল সফর
৬-দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিব তাঁর কয়েকজন সহকর্মীসহ উত্তরাঞ্চল সফর আরম্ভ করেন ৭ই এপ্রিল থেকে। ঐ দিন পাবনায় এক বিরাট জনসমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেন। অতঃপর ৮ তারিখে বগুড়ায়, ৯ তারিখে রংপুরে, ১০ তারিখে দিনাজপুরে, ১১ তারিখে রাজশাহীতে, ১৪ তারিখে ফরিদপুরে, ১৫ তারিখে কুষ্টিয়ায়, ১৬ তারিখে যশোহর এবং ১৭ তারিখে খুলনায় তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা ভাষণ দান করেন। রাজশাহীতে এলে আমি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমার গৃহে আমন্ত্রণ জানাই। উদ্দেশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ৬-দফা সম্পর্কে তাঁর একটি ঘরোয়া ও সংক্ষিপ্ত আলোচনার ব্যবস্থা করা। আজও সেকথা স্মরণ হতে আমার লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে যে, শেখ মুজিব সেদিন আমার বাড়ীতে যথাসময়ে এসেছিলেন। কিন্তু একজন অধ্যাপক বা বুদ্ধিজীবীও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সাহস সঞ্চয় করতে পারেন নি। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালের গ্রীষ্মে শেখ মুজিব রাজশাহী গেলে সেবারেও একই উদ্দেশ্যে, একইভাবে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আমার গৃহে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। এবারেও তিনি এসেছিলেন কিন্তু অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী অনেককেই অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও উপস্থিত হয়েছিলেন মাত্র তিনজন। দু’বারেই আমার বন্ধুরা বলেছেন যে কারণে আসতে পারেন নি সে হ’ল ভীতি। মোনেম খানের রাজত্বে মুজিবের সাথে আলোচনা ক’রে শেষে চাকুরীটি খোয়াবেন নাকি। এঁদের দু’ একজন পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের অনুগ্রহে প্রচুর তরককী করেছেন।
পৃষ্ঠা নং: ৩১৬

দিনে দিনে ৬-দফার দাবীর আন্দোলন এমন জোরদার হয়ে উঠল যে, আইয়ুব খান বেসামাল হয়ে দমননীতির প্রয়োগ শুরু ক’রে দিলেন। প্রথমেই শেখ মুজিবকে জেল-জুলুমের ভয় দেখাতে লাগলেন।
শেখ মুজিব তাচ্ছিল্যভরে তাঁদের সে স্পর্ধার জবাব দিয়ে বললেন, “ওরা এতই অর্বাচীন যে আমাকে জেলের ভয় দেখায়। ওদের আমি জানিয়ে দিতে চাই যে, অতীতে আমি জেল খেটেছি, মামলার আসামী হয়েছি। এবারেও জেল খাটতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য পাওনা বা দাবীর ব্যাপারে কোন আপোষ করতে মুজিবুর রহমান জানে না। কারো অস্ত্রের ভাষার জবাব যদি দিতে হয় তবে তা’ জনগণই দেবে—জনগণ অস্ত্রের ভাষার যথার্থ জবাব জানে।”

শেখ মুজিবের হয়রানী
এবার শেখ মুজিবের আপোষহীন যাত্রা শুরু হ’ল। জীবনে কোন বিপদ-বিপত্তিকেই তিনি পরোয়া করেন নি। এবারেও তাই হ’ল। বিপদ ঘনীভূত হয়ে এল। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি ক’রে শেখ মুজিবকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারীকৃত ওয়ারেন্ট বলে গ্রেফতার করা হ’ল।
১৭ই এপ্রিল রাত্রি ৪টায় খুলনায় একটি জনসভায় ভাষণ দান করার পর ঢাকা ফেরার পথে যশোরে তাঁকে ঢাকার রমনা থানা থেকে জারীকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারা বলে পুলিশ গ্রেফতার করে। যশোরে সদর দক্ষিণ মহকুমা হাকিমের এজলাস হতে তিনি জামিনে মুক্তিলাভ ক’রে সদলবলে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
যশোরের মহকুমা হাকিমের নির্দেশক্রমে শেখ মুজিব ২১শে এপ্রিল (’৬৬) ঢাকার দক্ষিণ মহকুমা হাকিমের আদালতে স্বইচ্ছায় উপস্থিত হ’লে আদালত তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেন। পরে ঢাকার সেশন জজের নিকট জামিনের আবেদন করা হ’লে তিনি উক্ত আবেদন মঞ্জুর করেন এবং তিনি মুক্তিলাভ করেন।
কিন্তু সেদিনই রাত ৯টায় সিলেট এস. ডি. ও. আদালতের এক পরোয়ানা বলে ঢাকার জনৈক অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বাধীনে একটি পুলিশ পার্টি তাঁর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন থেকে তাঁকে গ্রেফতার
পৃষ্ঠা নং: ৩১৭

ক’রে ঢাকার মহকুমা হাকিমের (দক্ষিণ) বাসভবনে হাজির করলে হাকিমের নির্দেশ অনুসারে তাঁকে পুলিশ প্রহরাধীনে সিলেট প্রেরণ করা হয়। তাঁর অনুরাগী বন্ধু আবদুল মোমেন তাঁর সঙ্গে গমন করেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, ১৪ই মার্চে (’৬৬) সিলেটের বিখ্যাত ময়দানে তিনি রাষ্ট্রবিরোধী বক্তৃতা দান করেন।
পরদিন সিলেট মহকুমা হাকিমের এজলাসে তিনি জামিনের আবেদন করলে তা’ নাকচ ক’রে দিয়ে হাকিম তাঁকে জেল-হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। ২৩শে এপ্রিল শনিবার সিলেটের জেলা দায়রা জজ তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামিন মঞ্জুর করলেন। কিন্তু তবুও পুলিশের হাত থেকে তাঁর আর নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব হয় নি। সেদিনই সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহ থেকে পাঠানো এক গ্রেফতারী পরোয়ানা বলে পুলিশ সিলেটের কারাগার থেকেই পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার ক’রে বেলা দু’টোর দিকে এক নাটকীয় পরিবেশে জেলগেটে সমবেত জনতার প্রবল বিক্ষোভ ধ্বনির মধ্যে তাঁকে সরাসরি স্টেশনে নিয়ে যায় এবং সেশন জজের আদালতে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন পেশের প্রস্তুতির পূর্বেই পুলিশ তাঁকে নিয়ে আখাউড়াগামী ট্রেনযোগে ময়মনসিংহের পথে পাড়ি দেয়। ট্রেনটি যদিও লোকাল ট্রেন ছিল, কিন্তু জনগণের মধ্যে খবর রটে যাওয়ায় স্টেশনে ষ্টেশনে অসংখ্য মানুষের সমাগম দেখে ট্রেনটি প্রায় কোন স্টেশনেই থামে না।
২৪শে এপ্রিল শেখ মুজিবকে ময়মনসিংহ সদর মহকুমা হাকিমের বাসভবনে হাজির করা হয়। বিজ্ঞ এস. ডি. ও. সাহেব যথারীতি তাঁর আবেদন বাতিল ক’রে দেন। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ ২৫শে এপ্রিল সোমবার ময়মনসিংহের জেলা ও দায়রা জজ জনাব গোলাম মওলা তাঁর জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন। জামিনে মুক্তিলাভের পর জেল থেকে শেখ সাহেব বেরিয়ে এলে সেখানে উপস্থিত বিরাট জনতা তাঁকে বীরোচিত সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
এর আগের দিন অর্থাৎ ২৪শে এপ্রিল (’৬৬) আওয়ামী লীগের উদ্যোগে পল্টনে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির আসনের জন্য নির্ণীত চেয়ারটি শুন্য রেখে সভার কাজ পরিচালনা করা হয়েছিল। এই
পৃষ্ঠা নং: ৩১৮

সভায় সর্বজনাব শাহ আজিজুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ৬-দফা দাবী আদায়ের জন্য আমরণ সংগ্রাম ক’রে যাবার কথা ঘোষণা করেন। সভায় নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে এভাবে হয়রানী ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় ধিক্কার বাণী উচ্চারণ করেন। কিন্তু সরকার এসব কথায় কর্ণপাত করলেন না। শেখ সাহেবকে হয়রানী ও নির্যাতন থেকে রেহাই দেয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা গেল না।
২৫শে এপ্রিল মুক্তি পাবার পর ৭ই মে পর্যন্ত শেখ মুজিব জেলের বাইরে ছিলেন। অতঃপর ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় মে দিবস স্মরণে শ্রমিক ও জনতার এক বিরাট সমাবেশে ভাষণ-দান শেষে শেখ মুজিব রাত ১টার সময় যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ক ধারার বিধানবলে তাঁকে এবং তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব খোন্দকার মোশতাক আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) ও চট্টগ্রামের এম. এ. আজিজ। সেই রাতেই তাঁদের সবাইকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
শেখ মুজিবের ওপর চূড়ান্ত নির্যাতনের পালা শুরু হ’ল। আইয়ুব ও মোনেম দু’জন মিলে এই দেশবরেণ্য নেতাকে মৃত্যুর পথে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলেন।
সাথে সাথে ছাত্র-জনতার মধ্যেও শুরু হ’ল সংগ্রামী প্রস্তুতির পালা। এবার শোষক ও শোষিতের মুখোমুখি হবার পালা। ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে জনগণের গলায় জয়মাল্য পরিয়েছে।
৮ই মে’র ঘটনা সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব মোস্তফা সারোয়ার ১৯৭৩ সালের ৭ই জুন ‘দৈনিক বাংলা’য় ‘বিক্ষুদ্ধ ৭ই জুন’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে যে স্মৃতিচারণ করেছেন তার থেকে কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছিঃ
“১৯৬৬ সালের ৮ই মে। আমি তখন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সৌভাগ্যবান সভাপতি। সেইদিন নারায়ণগঞ্জের এক ঐতিহাসিক জনসভা
পৃষ্ঠা নং: ৩১৯

হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম। মিছিলের পর মিছিল। জঙ্গী মিছিল। মিছিল আসছিল কলকারখানা থেকে। মিছিল আসছিল আদমজী জুটমিল থেকে। মিছিল আসছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল্লা-শাখা-প্রশাখা থেকে। মিছিল আসছিল ছাত্র-জনতার মাঝ থেকে। ওরা আসছিল মিলিটারীর দাপটওয়ালা প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর শুনতে। এসেছিল বাঙালীদের ভাগ্য ৬-দফার সমর্থনে। এই সভাতেই সর্বপ্রথম ৬-দফার ৬টি চিহ্নসহ শেখ মুজিবকে ৬-দফার প্রতীক স্বর্ণপদক উপহার দেওয়া হ’ল। ৬-দফার জন্য ৬টি শান্তির পায়রা আকাশে উড়িয়ে শুরু হ’ল সভা। রাত ৮টা পর্যন্ত অবিরত করতালি আর জঙ্গী শ্লোগানের মাঝখানে বক্তৃতা করলেন শেখ মুজিব। আর চ্যালেঞ্জ করলেন আইয়ুব-মোনেম খানকে।
বক্তৃতার শেষে লক্ষ লক্ষ কণ্ঠের গগনবিদারী ধ্বনি, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠলো শেখ মুজিবের ডাকে। হাত উঠিয়ে শপথ নিলেন তাঁরা। প্রতিজ্ঞা করলেন শেখ মুজিবের অবর্তমানে ৬-দফার সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। প্রয়োজন হ’লে প্রাণ দেবেন।
সেই বজ্রধ্বনিতে নারায়ণগঞ্জের ছোট্ট শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠল। অন্যদিকে প্রকম্পিত হ’ল মোনেম খানসহ প্রশাসনযন্ত্রের কিছু আমলার বুক। সভার শেষে বের হ’ল প্রায় দশ সহস্রাধিক জঙ্গী কর্মীর মশাল শোভাযাত্রা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, যশোরের জনাব মশিউর রহমান (স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ) প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ঢাকায় যাবার পথে আমার নবনির্মিত বাসভবনে একটু বসলেন কর্মীদের নিয়ে। বঙ্গবন্ধুই আমার নতুন বাড়ীর নাম রাখলেন ‘বাংলা ভবন’।
কর্মীদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত থাকার সময় বঙ্গবন্ধু হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন, ‘একটু দেখে আয় তো, তোর বাড়ীর আশেপাশে গোপনে কয়টা জীপ ফলো করছে? একটু হেসে গর্বিতভাবে বললেন, ‘সব সময় তো একটা থাকেই। তবে এখন কয়টা আছে, দেখ গিয়ে।’
বঙ্গবন্ধুর কথামতো গিয়ে দেখলাম রাস্তার অদূরে একটা জীপ, একটা ভ্যান তারপর আর একটা জীপ। সম্ভবতঃ ওয়্যারলেস ফিট করা ছিল।
পৃষ্ঠা নং: ৩২০

প্রমাণিত হ’ল, বঙ্গবন্ধুর অনুমান সঠিক। বঙ্গবন্ধু শুনে নিশ্চিত মনে বললেন, আজকের রাতটা পার হতে পারলে নারায়ণগঞ্জের মত আরও দু’চারটা জনসভা করতে পারবো। তারপর ধরে নিয়ে যায় যাক।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, সেদিনের জনসভার ভাষা ছিল অস্ত্রের ভাষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। মোনেম খানকে বহুবার তিনি প্রত্যক্ষভাবে গুণ্ডা বলে আখ্যায়িত করেছেন। মোনেম খানের ভাষাতেই প্রতিউত্তর ছিল ‘যে কথা বলার শক্তি কারো বাবার নেই, তা’ শেখ মুজিব বলেছেন।’
সেইদিন রাতেই বঙ্গবন্ধু আমার বাড়ী থেকে যাবার কয়েক ঘন্টা পরই গ্রেফতার হলেন। গ্রেফতার হলেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, চট্টগ্রামের এম. এ. আজিজ (মরহুম), জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। পরে পাবনার জনাব মনসুর আলী, মরহুম বগা মিয়া, ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভুঁইয়া, রাজশাহীর জনাব মজিবুর রহমান গ্রেফতার হলেন কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হ’ল।”
নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার ক’রে কারাগারে আটকের সংবাদে পরদিন রাজধানী ঢাকার সর্বমহলে যুগপৎ বিস্ময় ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সেদিনই অর্থাৎ ৯ই মে, ১৯৬৬ জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের নেতা জনাব নুরুল আমীন এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে গৃহীত এই ব্যবস্থাকে ‘চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতার উপর নয়া হামলা’ বলে অভিহিত ক’রে বলেন যে, যুদ্ধোত্তর কালেও দেশরক্ষা আইনবলে বিনা বিচারে নেতৃবৃন্দের এই আটক কেবল অসংগতই নয়, নীতিবিগর্হিতও।
জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের সহকারী নেতা শাহ আজিজুর রহমান এই গ্রেফতারকে ‘অযাচিত জবরদস্তিমূলক’ বলে অভিহিত ক’রে বলেন যে, ধৃত নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সার্বজনীন দাবীই ধ্বনিত হচ্ছিল।
‘নেজামে ইসলাম’ নেতা জনাব ফরিদ আহমদ এক বিবৃতিতে এই আটককে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেন।
১০ই মে দৈনিক ইত্তেফাকের মুসাফির তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে লিখলেনঃ
পৃষ্ঠা নং: ৩২১

“৬-দফার যে বিপুল জনসমর্থন রহিয়াছে, সেই প্রশ্ন এখানে না তুলিয়াও বলা চলে যে, নির্যাতনের পথে কোন সমস্যার সমাধান হয় না, বরং সমস্যা জটিল হয়। যারা রাজনৈতিক কারণে বিশেষতঃ জনগণের দাবী-দাওয়া তুলিতে গিয়া নির্যাতিত, নিগৃহীত হইতেছেন তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি রহিল। জাতির জন্য কোন ত্যাগই বৃথা যায় না, ইহাই আজিকার সান্ত্বনা ও প্রেরণা।”
[ দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই মে, ১৯৬৬]
শেখ মুজিবসহ তাঁর সহকর্মীদের মুক্তির দাবীতে সেদিন ঢাকা শহরে ও শ্রমিক এলাকায় চরম বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়।

হরতাল
১৩ই মে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। এইদিন প্রদেশের দিকে দিকে বিক্ষুদ্ধ মানুষের ক্রুদ্ধ গর্জনে সারাদেশ মুখরিত হয়। হাজার হাজার শ্রমিক তাদের কলকারখানার কাজে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হ’য়ে সরকারের দমন নীতির তীব্র প্রতিবাদ করে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গ্রেফতার হ’লে চাঁদপুরের জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর দায়িত্ব অস্থায়ীভাবে গ্রহণ করেন। ২০ মে (’৬৬), দলের ওয়ার্কিং কমিটির এক বৈঠক আহ্বান ক’রে আগামী ৭ই জুন সারা প্রদেশব্যাপী এক সর্বাত্মক হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এই উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ যে প্রচারপত্র ছাপিয়েছিলেন সরকারের নির্দেশে পুলিশ মুদ্রণ প্রেস থেকে তার তিন হাজার কপি আটক করে এবং দেয়ালে পোস্টার লাগানোর সময় কতিপয় আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এই আটকের তীব্র নিন্দা করেন।
শুধু তাই নয়, এই হরতাল যাতে সার্থক না হয় তার জন্য প্রাদেশিক গভর্নর মোনেম খান জুনের ৩ তারিখে কঠোর হুঁশিয়ারী বাক্য উচ্চারণ ক’রে ভাষণ দেন। তিনি বলেন যে, ‘অশুভ প্রচেষ্টার মোকাবিলার জন্য সরকার সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছেন।’
পৃষ্ঠা নং: ৩২২

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার
এর আগের দিন অর্থাৎ ২রা জুন তারিখে এই প্রস্তুতির প্রমাণ তিনি কিছুটা দেখিয়েছেন। তাঁর নির্দেশক্রমে পুলিশ আওয়ামী লীগের ৮ জন নেতাকে দেশরক্ষা আইনে এবং ১ জনকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারাবলে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত নেতৃবৃন্দ হলেনঃ
দেশরক্ষা আইনেঃ
(১) প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের প্রচার সচিব- জনাব আবদুল মোমেন (এডভোকেট)
(২) সমাজ সেবা সম্পাদক- জনাব ওবায়দুর রহমান
(৩) সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি- জনাব হাফেজ মোহাম্মদ মুসা
(8) সিটি আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি- জনাব শাহাবুদ্দিন চৌধুরী
(৫) রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি- জনাব হারুন-অর-রশিদ
(৬) ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক ও মৌলিক গণতন্ত্রী- জনাব রাশেদ মোশাররফ
(৭) পত্রিকা হকার- জনাব জাকির হোসেন
(৮) নারায়ণগঞ্জ সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি- জনাব মোস্তফা সারোয়ার
এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির বলে জনাব আবু তাহেরকে গ্রেফতার করা হয়।
পরদিন গভর্নরের হুঁশিয়ারির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব শামসুল হককেও গ্রেফতার করে।
নির্বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ৪ঠা জুন সরকারকে হুঁশিয়ারি ক’রে দিয়ে বললেনঃ “জেল-জুলুম আর নির্যাতন চালিয়ে এ আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না।”
পৃষ্ঠা নং: ৩২৩

জুনের ৬ তারিখে প্রাদেশিক পরিষদে এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে যায়। গভর্নর মোনেম খানের প্রতি বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলের সদস্যরা চরম অবমাননা প্রদর্শন করেন। পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হ’লে গভর্নর যখন বক্তৃতা দিতে থাকেন তখন উপরোক্ত সদস্যবৃন্দ প্রদেশব্যাপী বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ওপর বেপরোয়া নির্যাতন এবং গ্রেফতারের প্রতিবাদে পরিষদ কক্ষে অনুপস্থিত থাকেন। বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগের জনাব আবদুল মালেক উকিল এবং স্বতন্ত্র দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামান খান একটি মুক্ত বিবৃতিতে বলেন যে, “গণজীবনের পুঞ্জীভূত ফরিয়াদের অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্যই তাঁরা গভর্নরের ভাষণ বর্জন করেছেন।”
যাহোক, ইতিমধ্যে ২২শে মে খাদ্যের দাবীতে সারা পূর্ব বাংলায় ‘খাদ্য দাবী দিবস’ পালিত হয়। সে সময় প্রদেশে খাদ্য সমস্যা যে তীব্র রূপ ধারণ করেছিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘জনতা’ পত্রিকার মন্তব্য থেকে তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। “দেশময় আজ হা-অন্ন হা-অন্ন রব উঠিয়াছে, আজ হাহাকার উঠিয়াছে পূর্ব বাংলার সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের ঘরে ঘরে।”
শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হ’লে সারা পূর্ব বাংলায় অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে। দেশে এমনিতেই খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। বেকার সমস্যা, বস্ত্র সমস্যা ও শিক্ষা সমস্যা ইত্যাদি মানুষকে অহরহ পীড়া দিচ্ছিল। এ ঘটনার সাথে যুক্ত হ’ল নেতৃবৃন্দের ওপর, বিশেষ ক’রে জনগণের প্রাণের নেতা শেখ মুজিবের ওপর এই অত্যাচার। সুতরাং সারা পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভ ঘনীভূত হতে থাকে। ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ থেকে যখন ৭ই জুন হরতাল পালনের আহ্বান জানান হ’ল তা’ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমন্ত্রণ জানাল।

বিক্ষুব্ধ ৭ই জুন
সরকারের শত প্রকার নির্যাতনমূলক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ৭ই জুন সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হ’ল। ঐদিন কলকারখানা, গাড়ীর চাকা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব বাংলায় নাগরিক জীবন সম্পূর্ণ ভাবে স্তব্ধ হয়ে
পৃষ্ঠা নং: ৩২৪

পড়ে। সরকার এর জন্য প্রস্তুত ছিল। সমস্ত বর্বরশক্তি নিয়ে সরকারী শক্তি নিরস্ত্র লোকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ধর্মঘটী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলী বর্ষণ করে। এর ফলে মনু মিয়া, মজিবুল হক প্রমুখ শ্রমিক-জনতাসহ এগার জন শহীদ হন এবং আটশ’ লোককে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব তখন সেন্ট্রাল জেলে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে সময় অতিবাহিত করতে লাগলেন। পরদিন দৈনিক পত্রিকাসমূহে এই হরতালের রিপোর্ট বিশদভাবে পড়বেন বলে জনগণ উৎসুক ছিলেন। কিন্তু না, সরকার যথাসময়েই সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করেছেন। পত্রিকার পাতা খুলতেই দেখা গেল প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে লেখা সরকারী প্রেসনোট। তবে অনিবার্য কারণবশতঃ পত্রিকাগুলোতে যে স্টাফ রিপোর্টারদের হরতাল সংক্রান্ত বিবরণ ছাপানো সম্ভব হ’ল না, একথা সুস্পষ্টভাবে মুদ্রিত ক’রে পাঠকদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করা হ’ল। এই অনিবার্য কারণটা যে কি তা’ মূর্খেরও বুঝতে কষ্ট হয় নি।

সরকারী প্রেসনোট
সরকারী প্রেসনোটে অবশ্য দশ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে সাফাই গাওয়া হয়েছে যে, এতে পুলিশের কোন দোষ নেই। ৮ই জুন (‘৬৬) প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক থেকে এই সরকারী প্রেসনোটটির হুবহু অনুলিপি উদ্ধার করা যাচ্ছেঃ
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জেও পুলিশের গুলীতে ১০ জন নিহত (সরকারী প্রেসনোট) । “ঢাকা, ৭ই জুন—আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহুত হরতাল ৭-৬-৬৬ তারিখে অতি প্রত্যুষ হইতে পথচারী ও যানবাহনের ব্যাপক বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন এলাকায় ছোকরা ও গুণ্ডাদের লেলাইয়া দেওয়া হয়। ই. পি. আর. টি. সি. বাসগুলিতে ইট পাটকেল ছোঁড়া হয় এবং টায়ারের পাম্প ছাড়িয়া দিয়া সর্বপ্রকার যানবাহনে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়। নিরীহ জনসাধারণ ও অফিস যাত্রীদের অপমান ও হয়রান করা হয়। হাইকোর্টের সম্মুখে তিনটি গাড়ী পোড়াইয়া দেওয়া হয়। পুলিশ কার্জন হল, বাহাদুর শাহ পার্ক ও কাওরান বাজারের নিকট গুণ্ডাদের বাধা দান করে এবং টিয়ার
পৃষ্ঠা নং: ৩২৫

গ্যাস ব্যবহার করিয়া তাহাদিগকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। তেজগাঁওয়ে ২-ডাউন চট্টগ্রাম মেইল তেজগাঁও রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যালে আটক করিয়া লাইনচ্যুত করা হয়। ট্রেনখানা প্রহরাদানের জন্য একদল পুলিশ দ্রুত তথায় গমন করে। জনতা তাহাদের ঘিরিয়া ফেলে এবং তুমুলভাবে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। ফলে বহু পুলিশ কর্মচারী আহত হয়। যখন পুলিশ জনতার কবলে পড়িয়া যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন আত্মরক্ষার জন্য তাহারা গুলী বর্ষণ করে। ফলে ৪ ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
পূর্বাহ্নে ১০ ঘটিকায় প্রায় ৩০০ উচ্ছল জনতা কর্তৃক তেওগাঁও ল্যাণ্ড রেকর্ড ও সার্ভে ডিরেক্টরেট অফিস আক্রান্ত হয়। জনতা তুমুলভাবে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। ফলে অফিসের যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়। জনতা অতঃপর সেটেলমেন্ট প্রেসের দিকে অগ্রসর হইয়া প্রিন্টিং মেশিনসমূহের দারুণ ক্ষতি সাধন করে। আক্রমণের সময় প্রেসের তিনজন কর্মচারী আহত হয়।
নারায়ণগঞ্জে এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা সকাল ৬-৩০ মিনিটের সময় গলাচিপা রেলওয়ে ক্রসিং-এর নিকট ঢাকাগামী ট্রেন আটক করে। পরে জনতা নারায়ণগঞ্জগামী ৩৪ নং ডাউন ট্রেন আটকাইয়া উহার বিপুল ক্ষতি সাধন ও ড্রাইভারকে প্রহার করে। জনতা জোর করিয়া যাত্রীদের নামাইয়া দেয়। যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য আগত একটি পুলিশ দল আক্রান্ত এবং বহু সংখ্যক পুলিশ কর্মচারী আহত হয়। পুলিশ দল লাঠিচার্জের সাহায্যে জনতা ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। অতঃপর বন্দুকসহ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক জনতা নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করিয়া দারুণ ক্ষতি সাধন এবং বন্দুকের গুলীতে পুলিশ অফিসারদের জখম করে। উচ্ছৃঙ্খল জনতা থানা-ভবনে প্রবেশ করার পর পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলীবর্ষণ করার ফলে ছয় ব্যক্তি নিহত ও আরো ১৩ ব্যক্তি আহত হয়। ৪৫ জন পুলিশ আহত হন এবং তাহাদের মধ্যে কয়েকজনের আঘাত গুরুতর।
পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জনাব এম. এ. জাবেদের মোটর গাড়ী ভস্মীভূত ও তাঁহার বাড়ী লুণ্ঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জ ও চাষাড়ার মধ্যে রেলওয়ে সিগন্যালিং লাইন বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলা হয়।
পৃষ্ঠা নং: ৩২৬

টঙ্গীতে বিভিন্ন মিলের শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করে এবং একটি মিছিল বাহির করে। কাওরান বাজারের এক উচ্ছৃঙ্খল জনতা একজন সার্জেন্টকে প্রহার ও তাহার স্কুটারের ক্ষতি সাধন করে এবং রেলওয়ে ক্রসিং-এর নিকট একটি মালবাহী ট্রেন থামাইয়া দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর ছাত্র পিকেটিং করে এবং সেখানে আংশিক ধর্মঘট পালিত হয়।
ঢাকা হলও বাহিরের লোকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পুলিশ ও ই. পি. আর. দ্রুত ঘটনাস্থলে উপনীত হইয়া পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে।
দুপুরে আদমজী, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ডেমরা এলাকার শ্রমিকগণ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করিয়া শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। ঢাকা নগরীর দুই মাইল দূরে ই. পি. আর. বাহিনী একটি শোভাযাত্রার গতিরোধ করে। অপরাহ্ণে এক জনতা গেণ্ডারিয়ার নিকট একখানি ট্রেন আটক করে। চট্টগ্রামগামী গ্রীন এ্যারো ও ঢাকা অভিমুখে ৩৩-আপ ট্রেনখানিকে অপরাহ্ণের দিকে তেজগাঁও স্টেশনে আটক করা হয়। যা হউক, ট্রেন যোগাযোগ অল্পক্ষণ পরেই পুনরায় চালু করা হয়। সন্ধ্যার পর একটি উচ্ছল জনতা কালেক্টরেট ও পরে স্টেট ব্যাঙ্ক আক্রমণ করে। রক্ষিগণ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলী বর্ষণ করে। বেলা ১১টায় ৫ বা ততোধিক ব্যক্তির একত্র সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করিয়া ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। শহরের অন্যান্য স্থানে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক ছিল।”
(দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ই জুন, ১৯৬৬]
প্রেস রিপোর্টটিতে সরকার চমৎকার সাফাই গেয়েছেন। পত্র-পত্রিকার কণ্ঠরোধ ক’রে সরকার বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরেই পুলিশকে পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য গুলীবর্ষণ করতে হয়েছে আর তার ফলেই কয়েকজন ‘গুণ্ডাকে’ (সরকারের ভাষ্য অনুযাযী হরতালে অংশ গ্রহণকারীরা ছিল গুণ্ডা) মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। সেদিন ১০ জন নিহত হলেও পরের দিন আহতদের একজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে।
পৃষ্ঠা নং: ৩২৭

সেই দিনই অর্থাৎ জুনের ৮ তারিখে রাওয়ালপিণ্ডিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদে এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ সমর্থক সদস্যগণ পুলিশের এই গুলী বর্ষণের প্রতিবাদে পরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন। প্রাদেশিক পরিষদের বিরাধী দলের নেতা আওয়ামী লীগের আবদুল মালেক উকিল ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে গুলী বর্ষণের প্রতিবাদ ক’রে বলে ওঠেনঃ “আইয়ুবশাহীর নির্যাতন কঙ্গোর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।” কিন্তু এতে সরকারের বা সরকার সমর্থক পরিষদ সদস্যদের কোন মানসিক পরিবর্তন ঘটে নি।
১১ই জুন (‘৬৬) জাতীয় পরিষদে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ শোয়েব ১৯৬৬-৬৭ সালের আর্থিক বছরের বাজেট পেশ করেন। এতে ৩৬.৫৬ কোটি টাকা ঘাটতি দেখানো হয় এবং নতুন নতুন করধার্যের মাধ্যমে সে ঘাটতি পূরণের প্রস্তাব দেয়া হয়। এর কয়েক দিন পর ১৭ই জুন-এ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী জনাব এম. এন. হুদা এ ব্যাপারে আরো একডিগ্রী উপরে ওঠেন। অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত সমস্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে নিক্ষিপ্ত পূর্ব বাংলার কর ভারাক্রান্ত স্কন্ধের উপর ১ কোটি ১৬ লক্ষ টাকার ৬টি নয়া কর ধার্যের প্রস্তাব করেন। ডক্টর হুদা সেদিন প্রাদেশিক পরিষদে ১৯৬৬-৬৭ সালের বেসামরিক উদ্বৃত্ত বাজেট পেশ করেন। এই নয়া করের শতকরা ৬১ ভাগ সেচের পানি ব্যবহারকারী দরিদ্র চাষীদের নিকট থেকে আদায় করার প্রস্তাব করা হয়।

তোফাজ্জল হোসেনের গ্রেফতার
সংবাদ জগতের নির্ভীক সৈনিক পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সোচ্চার কণ্ঠ ইত্তেফাকের সবচেয়ে জনপ্রিয় অঙ্গ ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ লেখক মুসাফির জনাব তোফাজ্জল হোসেনের কণ্ঠকে স্তব্ধ ক’রে দেয়ার উদ্দেশ্যে আইয়ুব-মোনেম চক্রের নির্দেশে পুলিশ পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধির ৩২ (১) ‘খ’ ধারা অনুযায়ী ১৬ই জুন (১৯৬৬) তাঁর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন থেকে জনাব তোফাজ্জল হোসেনকে গ্রেফতার করে। সেদিন ইত্তেফাক অফিসের নিকট থেকে পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের জনাব এ. কে. এম. রফিকুল হোসেনকেও
পৃষ্ঠা নং: ৩২৮

গ্রেফতার করা হয়।

ইত্তেফাক প্রকাশনা বন্ধ
শুধু তাই নয় ঐ একই দিনে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর একটি আদেশ মারফৎ পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৫২ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারা মোতাবেক দৈনিক ইত্তেফাকের প্রেস ১নং রামকৃষ্ণ মিশন রোডস্থ ‘নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন।
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ই জুন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলের সদস্যগণ একটি মুলতবী প্রস্তাব এবং একটি অধিকার প্রস্তাব আনয়ন করলে স্পীকার তা’ বাতিল করে দেন। ফলে বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলের সদস্যগণ স্বল্পকালের জন্য ওয়াক আউট করেন।

ভুট্টোর পতন
সেদিনই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের কলঙ্কিত নায়ক আইয়ুবের বিশ্বস্ত গুণধর পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বিদায় নিতে হয়। তাঁর পদত্যাগ সম্পর্কে ক্রমাগত কয়েকদিন ধরে জোর গুজব চলছিল। অবশেষে চিকিৎসার জন্য ছুটির অজুহাতে তাঁকে বিদায় গ্রহণ করতে হয়।
কিন্তু মন্ত্রী পরিষদ থেকে ভুট্টো সাহেব বিতাড়িত হলেও রাজনৈতিক জীবন থেকে তিনি সরে দাঁড়ান নি। আইয়ুবের বিতাড়ন তাঁর পক্ষে শাপে বর হয়ে দেখা দিল। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর পরবর্তী ভূমিকা যথাসময়ে তুলে ধরা যাবে।
৭ই জুনের হরতাল পালনকারী নিরীহ জনতার ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলী বর্ষণ করে হত্যাযজ্ঞ চালানো সত্ত্বেও সরকারের দমননীতির স্পৃহা এতটুকুও শিথিল হয় নি। জুন মাসের ২২ তারিখে পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মীজানুর রহমানকে তার চাঁদপুরস্থ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার আগে শেখ ফজলুল হক মনি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মোল্লা জালালউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রনেতা শেখ শহীদুল ইসলামকেও আটক করা হয়।
মীজানুর রহমানের গ্রেফতারকে কেন্দ্র ক’রে ২৮শে জুন জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যগণ দু’বার ওয়াক আউট করেন। সেদিন
পৃষ্ঠা নং: ৩২৯

বিরোধী দলের সদস্য জনাব মাহমুদ আলী পরিষদে প্রশ্নোত্তরকালে স্পীকারের নিকট জানতে চান যে, জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী এম. এন. এ’র গ্রেফতারের বৈধতা সম্পর্কে তিনি যে নোটিশ দান করেছিলেন তার কি হয়েছে? স্পীকার জনাব অবদুল জব্বার খান তা’ নাকচ করে দেয়া হয়েছে বলে জানালে জনাব মাহমুদ আলী চীৎকার করতে থাকেন এবং স্পীকার নির্দেশ দান করলেও স্তব্ধ হতে অস্বীকার করেন। অতঃপর স্পীকার তাঁর উপর রুলিং জারী করলে নুরুল আমীনের নেতৃত্বে বিরোধী দলের সদস্যগণ ওয়াক আউট করেন। ইতিমধ্যে মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে কোন্দল দেখা দেয়ায় পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। মওলানা সাহেব নিজে আইয়ুব খানের গুণগ্রাহী। আইয়ুবের বদৌলতে তাঁর চীন সফরের সৌভাগ্য হয়েছিল-চীনে গিয়ে তাঁর চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে বলে তাঁর ও তার ভক্তদের ধারণা।

ন্যাপের ভাঙ্গন
অতএব চীনের সমাজতান্ত্রিক নীতিই তাঁর আদর্শ হয়ে দাঁড়ালো। অপর দল মস্কোপন্থী—তাঁরা রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক নীতির অনুসারী। চীন-রাশিয়ার মধ্যে এই সময় বিরোধ বেশ প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে। সেজন্য দুই দেশের অনুসারীদের মধ্যেও বিরোধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালো। ওয়ালীর নেতৃত্বে মস্কোপন্থীরা সরে দাঁড়ালেন তাঁরা বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন। ওয়ালীপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের ন্যাপ শাখা ৬-দফার প্রতি তাঁদের সমর্থন রাখলেন।
ভাসানী যে ৬-দফার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তা’ আগেই বলা হয়েছে। দল বিভক্ত হওয়ার পর তিনি ও তাঁর অনুসারীরা আইয়ুবের সমর্থনে সেই একই ভূমিকা পালন করে যেতে লাগলেন। ৭ই জুনে এই যে হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হ’ল—আওয়ামী লীগের ওপর দিয়ে গ্রেফতার ও নির্যাতনের ঝড় বয়ে গেল—ভাসানী সাহেবরা এর বিরুদ্ধে এতটুকুও প্রতিবাদ জানালেন না। উপরন্তু তাঁরা প্রচার করতে লাগলেন যে, যদি ন্যাপ (ভাসানী) ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে তাঁরাও ৬-দফা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের মতই ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
পৃষ্ঠা নং: ৩৩০

৭ই জুন (’৬৬) আন্দোলনের পর সরকারের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে আওয়ামী লীগ অনেকদিন প্রায় নেতৃত্বহীন অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। এর কারণ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাইকেই কারারুদ্ধ ক’রে রাখা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মীজানুর রহমানের গ্রেফতারের পর পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে কোনমতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু সরকার গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরার জন্য যত রকম ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব তার সবগুলোই প্রয়োগ করতে থাকেন।
অবশ্য এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি যে, মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে যাঁরা পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, নির্বাচনের পর এঁদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করেছেন এবং আওয়ামী লীগও নিজের মনে ক’রে তাঁদেরকে গ্রহণ করেছিল—আবার আওয়ামী লীগের বাইরে স্বতন্ত্র দলেও অনেকে ছিলেন—কিন্তু যেভাবেই থাকুন, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে এঁদের কিছু কিছু ব্যক্তির ভূমিকা প্রশংসাজনক ছিল না। সরকারী সমর্থকদের ভূমিকা যে ঘৃণিত ছিল, সেকথা উল্লেখের প্রয়োজন করে না। কিন্তু অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে, অনেকেই আছেন, যাঁরা রাজনীতিবিদ-সমাজে আজকে মর্যাদাসম্পন্ন আসনে বিরাজমান, সেদিন আওয়ামী লীগের বিপদের দিনে যে সাহস, নিষ্ঠা, ত্যাগ ও আন্তরিকতা দেশের জনগণ তাঁদের নিকট থেকে আশা করেহিলেন, তাঁদের কেউ কেউ সেই আশা যথাযথভাবে পূরণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেখ মুজিব ও তাঁর বিশিষ্ট অনুসারীবৃন্দ যখন কারাগারে, তখন স্বতন্ত্র সদস্যদের কথা স্বতন্ত্র, কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থক সদস্যদের কারো কারো আচরণ ছিল দুই নৌকায় পা রাখার আচরণ। তবে পরবর্তী কালে এঁরা দুগ্ধের মাখনের ভাগ ঠিকই ভোগ করেছেন।
শুধু মৌলিক গণতন্ত্রের আওতায় নির্বাচিত মুষ্টিমেয় আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যদের কারো কারো সম্পর্কেই যে এই কথা প্রযোজ্য ছিল তা’ নয়—রাজনীতিবিদদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও কেউ কেউ এই সময় জেল-জুলুমের ভয়ে যথার্থ সাহস প্রদর্শনে এবং নির্ভীক ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য গণ-আন্দোলন
পৃষ্ঠা নং: ৩৩১

যখন জোরালো হতে থেকেছে এবং ছাত্র-জনতা যখন সামনের কাতারে নেমে এসেছে, তখন এঁরা দুর্বলতার বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সোচ্চার হবার চেষ্টা করেছেন। শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে জনগণ যখন ছিনিয়ে নিয়ে আসলো, তখন এঁরা আরো সোচ্চার, আরো দুর্বার হয়ে অতীতের দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করেছেন। শেখ মুজিব তাঁর সহকর্মীদেরসহ যখন কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন তারপর থেকে, একজন শিক্ষাবিদ হয়েও, বাংলাদেশের স্বার্থে আমি সমগ্র উত্তরাঞ্চলে ছাত্র-জনতার মধ্যে ৬-দফা আন্দোলনকে জোরালো করবার জন্য নিরলস প্রয়াসে লিপ্ত ছিলাম। আত্মপ্রশংসা আমার উদ্দেশ্য নয়—কিন্তু প্রয়োজনের খাতিরেই এখানে নিজের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলতে হচ্ছে। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রফেসর ও অধ্যক্ষ-কলা অনুষদের ডীন-এর দায়িত্ব থেকে সবে মুক্ত হয়েছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি যে সে সময় অনেক নেতার সাহায্য প্রার্থনা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। ৬-দফা আন্দোলনকে মনেপ্রাণে সমর্থন করলেও প্রকাশ্য আন্দোলনে নামতে তাঁদের কারো কারো দ্বিধা ও সংকোচের অন্ত ছিল না। ১৯৬৭ সালের ১লা জুলাই তারিখ থেকে আমি শাহ মখদুম ছাত্রাবাসের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করি। তখন থেকে ছাত্রদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসবার ব্যাপক সুযোগ আমার এসেছিল এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সমগ্র উত্তরাঞ্চলে সেই সুযোগের যথার্থ সদ্ব্যবহার আমি করেছি। সেই সময় যদি এই নেতৃবৃন্দের আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতা আমি লাভ করতাম, তা’ হলে এন. এস. এফ. -এর দৌরাত্ম্য দমনে ও ৬-দফার প্রচারণায় উত্তরাঞ্চলে আরো অধিক সুফল পাওয়া যেত। কিন্তু থাক সেকথা। কথাগুলো আত্মশ্লাঘার মত শোনায়।
যাহোক, পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। দেশের পরিস্থিতি যখন এক নিদারুণ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করল সেই সময় এন. ডি. এফ-এর নেতা জনাব নূরুল আমীনের আহ্বানে তার বাসভবনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পন্থা উদ্ভাবন সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য ৩১শে জুলাই (’৬৬) সর্বদলীয় নেতৃবৃন্দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সভা শুধু আলোচনায়ই সীমাবদ্ধ থাকে। শেষে আর তার কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।
পৃষ্ঠা নং: ৩৩২

৮ই আগস্ট ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আফসার উদ্দিনের কোর্টে শেখ মুজিবের মামলার শুনানী হয়। ২০শে মার্চ তারিখে আউটার স্টেডিয়ামে প্রদত্ত বক্তৃতার জন্য পাকিস্তান রক্ষা বিধি বলে এই মামলা আনয়ন করা হয়েছিল।

শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মামলা
পরদিন ৯ই আগস্ট (’৬৬) পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ দফাবলে জনাব তোফাজ্জল হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁদের আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ ক’রে ঢাকা হাইকোর্টে এক আবেদন পেশ করেন। কিন্তু হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে তাঁদের আটক আইনসঙ্গত বলে অভিমত প্রকাশ করেন এবং পেশকৃত আবেদনসমূহ নাকচ ক’রে দেন।
সেদিনই বিচারপতি জনাব বি. এ. সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পাঁচজন বিচারপতির সমবায়ে গঠিত ঢাকা হাইকোর্টের এক বিশেষ বেঞ্চ সর্বসম্মত রায়ে সরকার কর্তৃক পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৫২(২)(খ) দফা বলে ইত্তেফাকের মুদ্রণালয় নিউ নেশান প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণকে অবৈধ ও আইনের দৃষ্টিতে মূল্যহীন বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু ১৭ই নভেম্বর প্রাদেশিক গভর্নর পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৫২ নং বিধির ২নং উপধারা অনুযায়ী উক্ত প্রেসকে পুনরায় বাজেয়াপ্ত করেন। তোফাজ্জল হোসেনের মামলাও অক্টোবরের ১০ তারিখে সেন্ট্রাল জেলের অভ্যন্তরে শুরু হয়। ঢাকা কোর্টের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিট্রেট জনাব এম. এ. রউফ এই মামলার বিচার করেন। ২৪শে অক্টোবর (’৬৬) শেখ মুজিবকে নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর কার্যকলাপের অভিযোগ থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অনুষ্ঠিত বিচারের রায়ে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৯৬৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর সম্মিলিত বিরোধী দলের জুলুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে পল্টন ময়দানে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের ৭/৩ ধারা অনুসারে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ক’রে এ মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং: ৩৩৩

ভুট্টোর ঢাকা আগমন
নভেম্বরের ১৫ তারিখে অকস্মাৎ পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। বিমান বন্দরে ওয়ালীপন্থী ন্যাপের নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও ছাত্র ইউনিয়নের কিছুসংখ্যক ছাত্র তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। এ সময় জনাব ভুট্টো রাজনীতিতে বিচিত্র চাল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ওয়ালী ন্যাপ তাঁকে দলে টানার জন্য চেষ্টা করছিলেন, কারণ ইতিমধ্যেই ভুট্টো বেশ আইয়ুব-বিরোধী কথাবার্তা বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ভুট্টোও ন্যাপের কাছে ধরা দিব কি দিব না’র মত মনোভাব নিয়ে চলছিলেন। কিন্তু সবাই একদিন সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো ৬-দফার অন্যতম শত্রু, ভুট্টো আওয়ামী লীগের সাথে হাত মেলাবার জন্য ঘোরাঘুরি করছেন। ১৮ই নভেম্বর, ১৯৬৬। শেখ মুজিব তখন জেলে। ভুট্টো কয়েকদিন ঢাকায় অবস্থানের পর সেইদিন অকস্মাৎ বেগম শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য শেখ মুজিবের বাসভবনে যান। বেগম মুজিব সে সময় ব্যক্তিগত কাজের জন্য বাইরে থাকার দরুন ভুট্টো তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন নি, ফলে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসেন।
এ সময় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলের সদস্যদের সংগ্রামী ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁদের কঠোর সমালোচনার মুখে সরকারের স্বীকারোক্তি থেকে আঞ্চলিক বৈষম্যের স্বরূপ ধরা পড়তে থাকে। কিন্তু সরকার বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলের সদস্যদের তীব্র সমালোচনায় কোনরূপ কর্ণপাত না ক’রে পূর্ব বাংলার মানুষকে শোষণের ও নির্যাতনের উদ্দেশ্যে একের পর এক বিল পাশ ক’রে যেতে লাগলেন। সরকার জনগণের অনুভূতির কোন খবর রাখবার প্রয়োজন বোধ করলেন না।
জাতীয় পরিষদের বিরোধী দলের সদস্য আওয়ামী লীগের জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরীর আটকের বৈধতার প্রশ্নে জনাব মাহমুদ আলীর উত্তেজনা প্রকাশের কথা আগেই বলা হয়েছে। ৮ই ডিসেম্বর তারিখে এ বিষয়ে তিনি ১৯২ ধারার উপর একটি সংশোধনী প্রস্তাবে ১৯২-ক ধারা নামে একটি নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব ক’রে দাবী করেন যে, যখন কোন পরিষদ সদস্যকে প্রশাসনিক আদেশে আটক
পৃষ্ঠা নং: ৩৩৪

রাখা হয়, সেই সদস্যকে পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের সুযোগ প্রদানের জন্য পরিষদের অধিবেশন চলাকালে এ বিষয়ে স্পীকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগ সদস্য কামরুজ্জামান এই প্রস্তাব সমর্থন ক’রে বলেন যে, “জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যকে দেশের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য অনিষ্টকর হিসেবে অভিহিত করা ভ্রান্তিজনক।”
[ দৈনিক আজাদ, ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৬৬]
ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে বিরোধী দলের সকল সমালোচনা উপেক্ষা ক’রে জাতীয় পরিষদে শাসনতন্ত্রের ৭ম সংশোধনী বিল গৃহীত হয়। বিরোধী দলের সদস্যগণ এই বিলের তীব্র সমালোচনা ক’রে বলেন, “দেশকে ধোঁকা দেবার জন্যই জাতীয় পরিষদে শাসনতন্ত্রের ৭ম সংশোধনী আনয়ন করা হয়েছে। এর ফলে পরিষদ একেবারে পঙ্গু হয়ে যাবে—জনগণের কোন কল্যাণের কাজেই তা’ (পরিষদ) আসবে না।” সে দিনই কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ জাফর জাতীয় পরিষদে ভাষণ দানকালে এক উদ্ভট মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, যারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চায়, তারা দেশের শত্রু। তিনি এই সব শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার হুমকিও প্রদর্শন করেন।
জাফরের এই মন্তব্যে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতি এই উক্তির নিন্দা ক’রে তা প্রত্যাহারের দাবী জানান। ২০শে ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় ছাত্র ও জনতা সম্মিলিতভাবে জাফরের উক্তির প্রতিবাদে প্রত্যক্ষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

আইয়ুবের ঢাকা আগমন ও হুমকী প্রদর্শন
এই সময় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব বাংলায় তসরিফ এনেছিলেন। ৭ই জুনের বিক্ষুদ্ধ জনতার ওপর পুলিশের পৈশাচিক হামলার ফলে এবং শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতাকে কারাগারে আবদ্ধ করবার ফলে এ দেশের জনগণ যে কিভাবে কোমর ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে আছে তা’ তিনি সকৌতুকে প্রত্যক্ষ করলেন এবং প্রতিটি জনসভায় এ বিষয়ে জনসাধারণকে সতর্ক ক’রে শেখ মুজিব
পৃষ্ঠা নং: ৩৩৫

দিয়ে বললেন যে, সরকারের বিরুদ্ধে কোন ‘অপচেষ্টা’ চালানোর প্রয়াসে লিপ্ত হলে তাদেরকে কঠিন শাস্তিই পেতে হবে। ১৭ই ডিসেম্বর (’৬৬) দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁয়ে তিনি এ ধরনের যে হুশিয়ারী জারী করেন, পরদিন প্রকাশিত ‘দৈনিক আজাদ-এর খবর থেকে তার কিছুটা নমুনা দেয়া যেতে পারেঃ
“বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করব”: আইয়ুব, ঠাকুরগাঁও (দিনাজপুর), ১৭ই ডিসেম্বর।
আজ এখানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করেন যে, যে সকল শক্তি দেশের উভয় অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বিরোধী বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে এবং তাহার দ্বারা দেশের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করিতেছে, তাহাদের সে চেষ্টাকে বানচাল করিবার জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করিয়া যাইবেন। তিনি বলেন, যতদিন আমি জীবিত থাকিব এবং যতদিন আমি রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসাবে থাকিব, ততদিন আমি তাহাদের জঘন্য কারসাজীকে সফল হইতে দেব না।”
পরবর্তীকালে অবশ্য জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম আইয়ুবের এই দাম্ভিকতাকে অসর প্রতিপন্ন করেছিল।
পূর্ব বাংলা সরেজমিনে তদন্ত ক’রে খান সাহেব যখন দেখলেন যে, পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভাবেই তাঁর করায়ত্ত, তখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি নিজের মহত্ব ও উদারতা প্রকাশ করার জন্য একটি বিস্ময়কর কাজ ক’রে ফেললেন। ১৯৬৭ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে মার্শাল-ল’ জারীর পরবর্তীকালে যে পাঁচ হাজার ব্যক্তির ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা’ থেকে তাঁদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। এঁদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ভোট দানের অধিকার থেকে আরম্ভ ক’রে সকল প্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগুলোর বিচার করার জন্যে দুটো প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় ট্রাইব্যুনাল থেকে যাদেরকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়—তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পূর্ব বাংলার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ, ফজলুর
পৃষ্ঠা নং: ৩৩৬

রহমান প্রমুখ। প্রাদেশিক ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক অযোগ্য ঘোষিতদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান খান, আবু হোসেন সরকার, বসন্ত কুমার দাস, দুর্গাদাস চন্দ্র লাহিড়ী, ত্ৰৈলক্ষনাথ চক্রবর্তী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, এম. মনসুর আলী, সৈয়দ আজিজুল হক, আবদুস সালাম, দেওয়ান মহিউদ্দিন, আবদুস সালাম খান, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ।

শেখ মুজিবের মামলা
এদিকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একের পর এক মামলার বিচার চলতে থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট জনাব এম. এস. খানের কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার বিচার শুরু হয়। ১৯৬৪ সালের ২৯শে মার্চ পল্টন ময়দানে আপত্তিকর বলে কথিত এক বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলার অভিযোগ আনা হয়।
১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চে আর একটি বক্তৃতা দানের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে যে বিচার চলছিল ১৯৬৭ সালের এপ্রিলের ২৮ তারিখে তার রায় প্রকাশ করা হয়। এই রায়ে তাঁকে ১ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

পি. ডি. এম. গঠন
গণদাবী আদায়ের ক্ষেত্রে N.D.F. ব্যর্থ হওয়ায় দেশের পাঁচটি বিরোধী দল ৮-দফার ভিত্তিতে ২৮শে ফেব্রুয়ারী পুনরায় ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট’ (P.D.M.) নামে একটি ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই মুভমেন্টের কর্মসূচীতে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, প্রাপ্তবয়স্কের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত পার্লামেন্টারী ও ফেডারেল ধরনের শাসন-ব্যবস্থা কায়েম, দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয়, মুদ্রা, ফেডারেল ফাইন্যান্স, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, বৈদেশিক বাণিজ্য, আন্তঃ-আঞ্চলিক যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয় বাদে অবশিষ্ট সকল বিষয়ের কর্তৃত্ব আঞ্চলিক সরকারসমূহের হাতে অর্পণ, দেশরক্ষা ব্যাপারে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলকে সমপর্যায়ে প্রস্তুত করা, নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব বাংলায় স্থানান্তর প্রভৃতি দাবী তাঁদের কার্যসূচীতে সন্নিবেশিত হয়। এদিকে শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মীদের কারাগারে আবদ্ধ করেই সরকার তার দায়িত্ব শেষ করে নি।
পৃষ্ঠা নং: ৩৩৭

৮ই মে থেকে ১৭ মাস শেখ মুজিবকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল-এর একটি সেল-এ নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হ’ল। তিনি বহির্বিশ্ব, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সবার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলেন। একটি ছোট্ট ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আবদ্ধ অবস্থায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মুক্তিদাতার দুর্বিষহ দিনগুলো কাটতে লাগলো। অসীম ধৈর্য, বাংলাদেশের জন্য কোন দুঃখ-কষ্টই বড় নয় এই একক অনুভূতি, অসাধারণ মনোবল, অনমনীয় চারিত্রিক শক্তি ইত্যাদির বলে তিনি কাল গণনা ক’রে যেতে লাগলেন। অতঃপর যখন তাঁর ঘরে অপর একজন আবদ্ধ বন্ধুকে সঙ্গী হিসেবে নেবার অনুমতি এল তখন কোন কোন ব্যাক্ত তাঁর ঘরে সঙ্গী হয়ে যেতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তাঁর দুর্দিনের সহযাত্রী বন্ধু আবদুল মোমেন (তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রচার-সম্পাদক) এই সংবাদে ব্যথিত হন এবং নিজে উপযাচক হয়ে তাঁর ঘরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারী মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ আগরতলা মামলার আসামী হিসেবে শেখ মুজিবকে নিয়ে যাবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আবদুল মোমেন একান্ত সুহৃদ হিসেবে শেখ সাহেবের ঘরে বন্দী জীবন যাপন করেন।

পুনরায় সংস্কৃতির ওপর আঘাত ও পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে আবার বাংলার সংস্কৃতির উপর আঘাত হানার চেষ্টা করলো। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তারা প্রথম এর সুযোগ নিয়েছিল। এখানকার বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট অংশকে সরকার দেশপ্রেমের নামে ভারতের বিরুদ্ধে প্রচারকার্যে নিয়োগ করিয়েছিলেন। যুদ্ধ থেমে গেলে আইয়ুব সরকার এক ঘোষণায় ভারত থেকে পুস্তক আমদানী নিষিদ্ধ ক’রে দেন এবং এক অর্ডিন্যান্স-এর দ্বারা ভারতীয় পুস্তকের পুনর্মুদ্রণ বন্ধ ক’রে দেয়া হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কতিপয় সুযোগসন্ধানী লেখক সাধুবাদ জানান। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকরা এর বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। সরকারী ঘোষণা সত্ত্বেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ভারতীয় বই সম্পাদিত হয়ে নব আঙ্গিকে পুনর্মুদ্রিত হতে থাকে।
পৃষ্ঠা নং: ৩৩৮

১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধ হলেও জনগণের দাবীর ফলে পরে পুনরায় তা’ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালের ২৩শে জুন জাতীয় পরিষদে এক প্রশ্নোত্তরে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঘোষণা করেন যে, জাতীয় আদর্শ ও ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র-সঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হবে।
‘রেডিও পাকিস্তান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার করা হবে না’—এই শিরোনামে পরদিন ২৪শে জুন (১৯৬৭) একটি সংবাদ প্রকাশ ক’রে ‘দৈনিক পাকিস্তানে’ লেখা হয়ঃ
কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন গতকাল জাতীয় পরিষদে বলেন যে, ভবিষ্যতে রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচার করা হবে না এবং এ ধরনের অন্যান্য গানের প্রচারও কমিয়ে দেওয়া হবে। রাজশাহী থেকে নির্বাচিত বিরোধী দলীয় সদস্য জনাব মুজিবুর রহমান চৌধুরীর এক অতিরিক্ত প্রশ্নের উত্তরে খাজা শাহাবুদ্দিন উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রদেশের বিভিন্ন শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, শিল্পীগোষ্ঠী, কবি-বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদসহ সকল শ্রেণীর নাগরিকের মধ্যে এক বিরাট প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ২৫শে জুন, ১৯৬৭ ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত-‘১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবাদমূলক বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়–“স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় ২৩শে জুন, ১৯৬৭ তারিখে মুদ্রিত একটি সংবাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এতে সরকারী মাধ্যম হতে রবীন্দ্র-সঙ্গীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তাঁর সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিতে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে তা’ রবীন্দ্রনাথকে ভাবী পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।
পৃষ্ঠা নং: ৩৩৯

সরকারী নীতি নির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।”
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী হিসেবে যাদের নাম উক্ত পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন—ডঃ মুহম্মদ কুদরত-ই-খোদা, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, জনাব জয়নুল আবেদীন, জনাব এম. এ. বারি, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডঃ খান সারওয়ার রশিদ, জনাব সিকান্দর আবু জাফর, জনাব মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডঃ আহমদ শরীফ, ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, জনাব শামসুর রাহমান, জনাব হাসান হাফিজুর রহমান, জনাব ফজল শাহাবুদ্দিন, ডঃ আনিসুজ্জামান, জনাব রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।
আমি নিজে অনুরূপ একটি বিবৃতিতে সরকারী নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে জনাব বদরুদ্দীন উমরের হাতে ঢাকার পত্রিকাগুলোতে প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিই। এতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিবাদী শিক্ষক প্রায় সকলেই দস্তখত করেছিলেন।
এইসব বিবৃতি ছাপার সঙ্গে সঙ্গে সরকার বে-সামাল হয়ে পড়লেন। বিভিন্ন স্থানে এই বিবৃতির সমর্থনে প্রতিবাদ-সভা ও গণমিছিল বের হতে থাকে। কিন্তু সরকারের গোপন নির্দেশে এইসব সংবাদ প্রকাশ নিষিদ্ধ ক’রে দেওয়া হয় এবং ভেতরে ভেতরে কিছুসংখ্যক শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীর সমর্থনও সরকারী প্রচেষ্টায় আদায় করা হয়।
২৯শে জুন, ১৯৬৭ সালের ‘দৈনিক পাকিস্তান’ এর পরিপ্রেক্ষিতে “১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি—বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন শিক্ষক কর্তৃক মতানৈক্য প্রকাশ”—এই শিরোনামে একটি এবং “৪০ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি—রবীন্দ্র-সঙ্গীত সম্পর্কে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি মারাত্মক” —এই শিরোনামে অপর একটি, মোট দু’টো বিবৃতি ছাপা হয়। প্রথমটিতে বলা হয়—“সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কতিপয় ব্যক্তির বিবৃতিতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে বলে আমরা মনে করি এবং এই বিবৃতি পাকিস্তান-বিরোধী প্রচারে ব্যবহৃত হতে পারে। বিবৃতির ভাষায় এই ধারণা জন্মে যে, স্বাক্ষরকারীরা বাংলাভাষী পাকিস্তানী ও বাংলাভাষী
পৃষ্ঠা নং: ৩৪০

ভারতীয়দের সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোন পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করেন না। বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এই ধারণার সাথে আমরা একমত নই বলেই এই বিবৃতি দিচ্ছি।”
এই বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যক্ষ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টির ডীন জনাব এম. শাহাবুদ্দিন, ইতিহাস বিভাগের রীডার জনাব মোহাম্মদ মোহর আলী, অংক বিভাগের রীডার জনাব এ. এফ. এম. আবদুর রহমান ও ইংরেজী বিভাগের সিনিয়র লেকচারার জনাব কে. এম. এ. মুনিম। ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ প্রকাশিত দ্বিতীয় বিবৃতিতে বলা হয়-“পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে ঘোষিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ক’রে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী মহলের যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে বলা হয়েছে রবীন্দ্র-সঙ্গীত বাংলা-ভাষী পাকিস্তানীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবচ্ছেদ্য অংশ। এই উক্তির প্রতিবাদ করতে আমরা বাধ্য হচ্ছি এই কারণে যে, এই উক্তি স্বীকার ক’রে নিলে পাকিস্তানী ও ভারতীয় সংস্কৃতি যে এক এবং অবিচ্ছেদ্য, এই কথাই মেনে নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ যে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক তা’ হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতি—যে সংস্কৃতির মূল কথা হ’ল ‘শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হ’ল লীন’। এবং যে সংস্কৃতি এই উপমহাদেশের মুসলমানদের অভিহিত করে ‘হিন্দু-মুসলমান’ বলে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম তাঁর এক প্রবন্ধে এই উপমহাদেশের মুসলমানদের ‘হিন্দু-মুসলমান’ বলে অভিহিত করেন। সংস্কৃতি সম্পর্কে এই যে ধারণা, এর সাথে পাকিস্তানী সাংস্কৃতিক ধারণার আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এবং বলা যেতে পারে একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত। যে তামুদ্দুনিক স্বাতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, উপরোক্ত বিবৃতি মেনে নিলে সে ভিত্তিই অস্বীকৃত হয়। এই কারণে উপরোক্ত বিবৃতিকে আমরা শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, অত্যন্ত মারাত্মক এবং পাকিস্তানের মূলনীতির বিরোধী বলেও মনে করি।” স্বাক্ষরকারী হিসেবে বিবৃতিতে যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছিল তারা হলেন মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ,
পৃষ্ঠা নং: ৩৪১

বিচারপতি আবদুল মওদুদ, মুজিবর রহমান খাঁ, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কবি আহসান হাবীব, কবি ফররুখ আহমদ, ডঃ কাজী দীন মোহাম্মদ, ডঃ হাসান জামান, ডঃ গোলাম সাকলায়েন, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, কবি বেনজীর আহমদ, কবি মঈনুদ্দীন, অধ্যক্ষ শেখ শরফুদ্দীন, জনাব আ. কা. মু. আদিম উদ্দীন, কবি তালিম হোসেন, শাহেদ আলী, আ. ন. ম. বজলুর রশীদ, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, সানাউল্লাহ নুরী, কবি আবদুস সাত্তার, কাজী আবুল কাসেম (শিল্পী), মুফাখখারুল ইসলাম, শামসুল হক, ওসমান গনি, মফিজউদ্দীন আহমদ, আনিসুল হক চৌধুরী, মোস্তফা কামাল, অধ্যাপক মোহাম্মদ মতিউর রহমান, জহুরুল হক, ফারুক মাহমুদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, এ. কে. এম. নূরুল ইসলাম, কবি জাহানারা আরজু, বেগম হোসনে আরা, বেগম মাফরুহা চৌধুরী, আবদুল ওয়াদুদ ও আখতার-উল-আলম।
জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সরকারী দলের নেতা আবদুস সবুর খান এ বিষয়ে বেশ পাণ্ডিত্য (?) প্রকাশ করতে থাকেন। তিনি এক বক্তৃতায় বললেন, একথা বলা হয়েছে যে, “ডঃ রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার প্রভূত উন্নতি সাধন করেছেন এবং তাঁর কাব্যবিহনে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা এতিম হয়ে পড়েছেন, এই শ্রেণীর মুর্খদের গলাবাজির প্রতি আমার কোন সহানুভূতি নেই।”
[ দৈনিক পাকিস্তান, ২রা জুলাই, ১৯৬৭]
এই উক্তি থেকেই বুঝা যায়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে সবুর খানদের অজ্ঞতা ও মূর্খতা কত লজ্জাজনক ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনেম খানও নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ জনাব আবদুল হাইকে ডেকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা বইয়া বইয়া করেন কি, রবীন্দ্র-সঙ্গীত লিখবার পারেন না?”
রবীন্দ্র-সঙ্গীত বর্জনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আস্তে আস্তে পূর্ব বাংলার রাজনীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। ২রা আগস্ট প্রদেশের ছাত্ররা সকল প্রকার রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে ‘বন্দী মুক্তি দিবস’ পালন করেন। ঐদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সভা ও শোভাযাত্রার ওপর
পৃষ্ঠা নং: ৩৪২

পুলিশ উপর্যুপরি কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং বেয়োনেট ও লাঠিচার্জ করে। এর ফলে অর্ধ শতাধিক লোক আহত হয়। পুলিশ ৪৫ জন ছাত্র ও হাসপাতাল স্টাফকেও গ্রেফতার করে।
ইতিমধ্যে শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ৮ই মে তারিখে এক বক্তৃতা দানের অভিযোগে আটকাদেশের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ ক’রে ঢাকা হাইকোর্টে এক রীট আবেদন করেছিলেন। আগস্টের ৯ তারিখে (১৯৬৭) উক্ত হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতিকে নিয়ে এক ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে তাঁর আটকাদেশ বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। অতঃপর সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করলে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট পুনর্বিবেচনার জন্য উক্ত আদালতকে নির্দেশ দান করেন।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর স্বীকারোক্তি
ওদিকে আইয়ুবের প্রাক্তন করুণার্থী জুলফিকার আলী ভুট্টো আস্তে আস্তে বেশ জনদরদী হবার কসরত চালাতে থাকেন। ঢাকায় এসে পূর্ব বাংলার জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সরকারের কাছে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী ক’রে তিনি বলেন যে, শেখ মুজিব একজন জাতীয় নেতা। ২৬শে মার্চ এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। ৬-দফার কথা উল্লেখ ক’রে জনাব ভুট্টো বলেন যে, “উক্ত কর্মসূচী আলোচনার উপযুক্ত। শেখ মুজিব সাহেবকে তাঁহার নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী বলিয়া আখ্যা প্রদান করা ঠিক নহে।”
[ দৈনিক আজাদ, ২৭শে অক্টোবর, ১৯৬৭]
১৯৬৭ সালের ১লা ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ক্ষমতাসীন সরকারী দল পার্লামেন্টের ইতিহাসে এক নয়া নজীর স্থাপন করেন। সেদিন অধিবেশন চলাকালে স্পীকারের নির্দেশে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বতন্ত্র ও বিরোধী দলীয় তিনজন সদস্য জনাব ডঃ আলীম-আল-রাজী (স্বতন্ত্র), জাতীয় পরিষদের সাবেক ডিপুটী স্পীকার জনাব আবুল কাসেম ও জনাব মোখলেসুজ্জামান খানকে (বিরোধী দল) পরিষদ কক্ষ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
আইয়ুব খানের আত্মজীবনী ‘ফ্রেণ্ডস্ নট মাস্টারস’ গ্রন্থ সম্পর্কে আনীত ডঃ আলীম-আল-রাজীর একটি বিধিসঙ্গত প্রশ্ন স্পীকার কর্তৃক
পৃষ্ঠা নং: ৩৪৩

বাতিল করার ফলে উত্থাপিত বৈধতার প্রশ্নে স্পীকার কর্ণপাত না করায় এবং বিরোধী দলের মতে “এইরূপ অবাঞ্ছিত শক্তি প্রয়োগের পূর্বে পার্লামেন্টারী কনভেনশন অনুযায়ী সকল পদ্ধতি অনুসৃত না হওয়ার” প্রতিবাদে স্বতন্ত্র ও বিরোধী দলের সদস্যবৃন্দ পরিষদ কক্ষ বর্জন করেন। ক্রমাগত কয়েকদিন ধরেই ঐ কারণে তাঁরা অধিবেশন বর্জন ক’রে চলেন। এমন কি ১১ই ডিসেম্বর বিরোধী দলের সদস্য জনাব মোখলেসুজ্জামান খান ও স্পীকার জনাব আবদুল জব্বার খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিশও প্রদান করেন।

আইয়ুব খানের ঢাকা আগমন ও পুনরায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ
আইয়ুব খান তখন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম ৬-দফা কর্মসূচীর অধীনে জনগণকে ইতিমধ্যেই সক্রিয় করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। জনগণের সমর্থন সর্বত্রই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিলক্ষিত হতে থাকে। জনগণ যে ভেতরে ভেতরে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছে আইয়ুব সরকার তা’ স্পষ্ট উপলদ্ধি করতে পারছিলেন। তাঁরা যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারেন তার জন্যই আইয়ুব খানের সফর এবং স্বৈরাচারী ভাষণ। এ প্রসঙ্গে খুলনার মঙ্গলায় ১২ই ডিসেম্বর তিনি যে বক্তৃতা দেন দৈনিক সংবাদের পাতা থেকে তার নমুনা দেয়া যেতে পারেঃ
“প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে বিরোধী দলের ‘বিভ্রান্তিপূর্ণ, নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দেন এবং আরও বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাষ্ট্রের ধ্বংস সাধনই বিরোধী দলের উদ্দেশ্য। প্রেসিডেন্ট বিরোধী দলগুলির তীব্র সমালোচনা করিয়া বলেন যে, তাহারা কেন্দ্রকে দুর্বল করিয়া দেশের জন্য ধ্বংস ডাকিয়া আনিতে চায়। প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার ও পার্লামেন্টারী সরকার কায়েমের দাবীর কথা উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, তাহাদের উদ্দেশ্য সফল হইলে দেশ ধ্বংস হইয়া যাইবে।”
[ দৈনিক সংবাদ, ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৬৭]
পৃষ্ঠা নং: ৩88

বলা বাহুল্য, বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যাদেরকে অভিহিত করেছেন—তাঁরা ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও কর্মীগণ। আওয়ামী লীগ ৬-দফা দেওয়ার পর থেকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তাঁদের বিরুদ্ধে এই জাতীয় অভিযোগ করতে থাকে। এদেশের প্রগতিবাদী শক্তিকে সব সময় ভারতের গুপ্তচর বলে উল্লেখ ক’রে জনগণকে সাবধান করতে সরকারী চক্র দ্বিধা করে নাই। শেখ মুজিবসহ তাঁর বিশিষ্ট কতিপয় সহকর্মীকে ঐ একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের ক’রে কারান্তরালে রাখা হয়েছিল। এই সময় পূর্ব বাংলার গভর্নর আবদুল মোনেম খান সদম্ভে বলেছিলেন, “যতদিন আমি ক্ষমতায় আছি শেখ মুজিবকে আর কারাগারের বাইরে আসতে হবে না।” তাই একের পর এক মিথ্যা ও বানোয়াট মোকদ্দমা চালিয়ে শেখ মুজিবকে অপদস্ত ও হয়রানী করা হতে থাকলো। কিন্তু বিচারের কষ্টিপাথরে সকল প্রকার মোকদ্দমাই অমূলক প্রমাণিত হয়। এর ফলে ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারীতে রাত্রি একটায় তাঁকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়।

জেলের অভ্যন্তরে শেখ মুজিব
শেখ মুজিব জেলের মধ্যে সারাদিন বই পড়তেন, মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান করতেন। রবীন্দ্র-সঙ্গীত তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। তাঁর প্রিয়তম গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার কোলে ঠেকাই মাথা’ এবং ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’। বই পড়তে পড়তে যখনই হাঁপিয়ে পড়তেন তখন জেলের সহ-সঙ্গী আবদুল মোমেন পড়তেন, তিনি শুনতেন। মাঝে মাঝে আবার তিনি পড়তেন, আবদুল মোমেন শুনতেন। সরবে বই পড়তে শেখ মুজিব ভালবাসেন।
এমনি করেই তাঁদের দিন যাচ্ছিল। ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারী দিনগত রাত্রি একটার দিকে হঠাৎ তাঁদের ঘরের দরজায় মৃদু আঘাত শোনা গেল। শেখ মুজিব তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। জনাব মোমেন একটি শব্দেই জেগে গেলেন। জিজ্ঞেস ক’রে তিনি জানলেন যে ডিপুটি জেলার তোজাম্মেল মিয়া বাইরে অপেক্ষা করছেন। তোজাম্মেল মিয়া শেখ মুজিবকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি মৃদু ও ভাঙা গলায়
পৃষ্ঠা নং: ৩৪৫

বললেন, ‘দরজা খুলতে হবে স্যার।’ মোমেন সাহেব দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলেন তোজাম্মেল মিয়া এবং সেপাই আম্বর আলী। শেখ সাহেব তখনো ঘুমুচ্ছেন। সাথে সাথেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেলে, তিনি চোখ কচলিয়ে বললেন, “দুঃসংবাদ নয়, সুসংবাদ—কোন খবরই খারাপ নয়। বলুন কি খবর।” তোজাম্মেল মিয়া একটি লিখিত আদেশ শেখ মুজিবের হাতে দিয়ে বললেন, “দেখুন স্যার, আপনাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।”
কয়েকদিন হ’ল নানা খবর বাতাসে কয়েদখানার মধ্যে শেখ মুজিবের কানেও পৌঁচেছে আগরতলা ষড়যন্ত্রে তাঁকে জড়ানোর চেষ্টা চলছে। শেখ মুজিব তাই নির্লিপ্তভাবেই প্রশ্ন করলেন, “আমাকে খালাস দেয়া হ’ল কি নতুন কোন ফাঁদে নেবার জন্য?”
ডিপুটি জেলার তোজাম্মেল মিয়া উত্তরে কোন কথা বললেন না, মাথা নীচু করে রইলেন। সেপাই আম্বর আলীরও একই অবস্থা।
শেখ মুজিব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের মনেই বলে উঠলেন, “বুঝলাম, সংগ্রাম ঘনিয়ে আসছে, মুক্তি এগিয়ে আসছে, বাংলার মুক্তি।”
বিদায়ের পূর্বে বন্ধু আবদুল মোমেনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বন্ধু! বাংলাদেশকে আপনাদের হাতে রেখে গেলাম। জানিনা, কোথায় এরা আমাকে নিয়ে যাবে—হয়তো বাংলার মাটি থেকে এই আমার শেষ যাত্রা। যাবার সময় আপনাকে শুধু একটি কথা বলে গেলাম বাংলাদেশের সাথে কোনদিন আমি বিশ্বাসঘাতকতা করি নি, কোনদিন করবো না। আপনারা রইলেন, বাংলাদেশ রইল। এই দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সার্বভৌম স্বাধীনতাই আমার স্বপ্ন, আমার লক্ষ্য।” শেখ মুজিবের দু’চোখ বেয়ে তপ্ত অশ্রু, গড়িয়ে পড়লো। সেই অশ্রু স্পর্শ করলো আবদুল মোমেনের গ্রীবাদেশ। অশ্রু নয়, বিপ্লব-বন্যার দুই ফোঁটা উজ্জ্বল পূর্বাভাস। পার্শ্বে দণ্ডায়মান কর্তব্যরত দুইজন পুলিশের গণ্ডদেশও এই দৃশ্যে অশ্রুর বন্যায় অভিসিক্ত হ’ল। বিশ্বস্ত সহচর আবদুল মোমেনের কণ্ঠে শিশুর কান্নার আবেগ।
অপসৃয়মান সূর্যের মত শেখ মুজিব ধীরে ধীরে জেলগেটের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
পৃষ্ঠা নং: ৩৪৬

আবার গ্রফতার
শেষ পর্যন্ত মোনেম খান তাঁর ওয়াদা রেখেছিলেন। শেখ মুজিবকে আর বাইরের মাটিতে বেশীক্ষণ পা রাখতে দেয়া হয় নি। জেলগেট থেকে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে একটি মিলিটারী ভ্যান সঙ্গীন উঁচিয়ে দাঁড়াল তাঁর সামনে। তাঁকে বিজাতীয় ভাষায় জানানো হ’ল— ‘তুমি আবার বন্দী, চল আমাদের সঙ্গে।’
-অপরাধ?
উত্তর নেই। শেখ মুজিবও জানেন উত্তর পাওয়া যাবে না। তিনি মিলিটারীর সামনে দাঁড়িয়ে শুধু একটি অনুরোধ জানালেনঃ ‘শুধু এক মুহূর্ত সময় দাও ভাই তোমরা আমাকে।’ তারপর কারাগারের সামনের পথ থেকে এক মুঠো ধুলো তুলে কপালে স্পর্শ ক’রে প্রার্থনা জানালেন–
‘এই দেশেতে জন্ম আমার,
যেন, এই দেশেতেই মরি।’
অতঃপর সেই একমুঠো মাটি নিজের কাছেই রেখে দিলেন। উদ্দেশ্য, যদি পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়, তা’ হ’লে মৃত্যুর সময় তাঁর প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে তিনি অনেক দূরে থাকবেন। তখন এই এক মুঠি মাটির স্পর্শে তাঁর মনে হবে যে, জননী জন্মভূমি মাটির পবিত্র স্পর্শ তাঁর অঙ্গে লেগে আছে। বাংলাদেশ, এই দেশের মাটি তাঁর নিকট কত প্রিয় এ থেকেই তা’ অনুধাবন করা যায়। যখনই সময় এসেছে, শেখ মুজিব সব নির্যাতন ও মৃত্যুকে প্রতি পদে পদে এমনি সহজভাবেই বরণ ক’রে নিয়েছেন। ভয়ে বা বেদনায় কখোনই মুষড়ে পড়েন নি তিনি। এবার অনিশ্চিতের পথে মৃত্যুকে সামনে রেখেই শুরু হ’ল তাঁর অকুতোভয় যাত্রা।
বন্দীশালায় গিয়ে দেখলেন, সেখানে পরিচিত অপরিচিত আরো কয়েকজন আগে থেকেই আবদ্ধ রয়েছেন। তিনি তাঁদের কাছ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে অবহিত হলেন।
বন্দীরা সবাই জানালেন যে, ভারতের সঙ্গে যোগসাজস করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার এক ব্যাপক ষড়যন্ত্রে নাকি তাঁরা সবাই লিপ্ত ছিলেন—আর তার পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেছেন শেখ মুজিব—এই অভিযোগে তাঁদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং: ৩৪৭

আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে প্রেসনোট
১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারী ২ জন সি. এস. পি. অফিসারসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত একটি প্রেসনোটে বলা হয় যে, “গতমাসে (ডিসেম্বর, ১৯৬৭) পূর্ব পাকিস্তানে উদঘাটিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাঁদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
প্রেসনোটে অভিযোগ করা হয়ঃ “গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ঢাকাস্থ ভারতীয় ডিপুটি হাই কমিশনারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ক’রে আসছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল।”
প্রেসনোটে বলা হয়, “আটক ব্যক্তিদের কয়েকজন ভারতীয় এলাকা সফর করে এবং লেঃ কর্নেল মিশ্র, মেজর মেনন প্রমুখ ভারতীয় সামরিক অফিসারদের সঙ্গে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করে।”
এছাড়াও প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, “তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের পরিকল্পনা সফল ক’রে তোলার জন্য প্রচুর অর্থ এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা। এই মর্মে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, মানিক চৌধুরীসহ আটক ব্যক্তিদের কয়েকজনের মাধ্যমে তারা ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করেছে।”
প্রেসনোটে বলা হয়, “এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তদন্তানুষ্ঠান সমাপ্ত-প্রায়! শীঘ্রই মামলার শুনানী শুরু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।”
প্রেসনোটে দাবী করা হয় যে, “তদন্তকালে আটক ব্যক্তিদের অধিকাংশই স্ব-স্ব ভূমিকা সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করেছেন। আগরতলার আলোচনার ফলশ্রুতি হিসেবে সংগৃহীতব্য অস্ত্রশস্ত্রের একটি তালিকাসহ বহুসংখ্যক দলিলপত্র আটক করা হয়েছে।”
সরকারী প্রেসনোটে আরও দাবী করা হয় যে, “এইসব লোক বিশৃঙখলা সৃষ্টির জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন, তা’ নস্যাৎ ক’রে দেয়া হয়েছে।”
বেতার ও পত্র-পত্রিকা মারফৎ এই সরকারী ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র পূর্ব বাংলায় এক নিদারুণ আতঙ্কের সঞ্চার হয়।
পৃষ্ঠা নং: ৩৪৮

১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কতিপয় সি. এস. পি. অফিসার, সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মচারী এবং বেসামরিক নাগরিকের গ্রেফতার সম্পর্কে কানাঘুষা চলে আসছিল। ঐ মাসের শেষার্ধে গ্রেফতারকৃত কামাল উদ্দিন আহমদ ও সুলতান উদ্দিন আহমদ নামক দু’জন সাবেক কর্মচারীর পক্ষ থেকে আটক কতৃপক্ষের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের অভিযোগ ক’রে ঢাকা হাইকোর্টে রীট মামলা পেশ করা হয়েছিল। মহামান্য হাইকোর্ট আটক ব্যক্তিদ্বয়কে অবিলম্বে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর এবং তাদের উপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ পরীক্ষা করার জন্য একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দান করেছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই সরকারের এইভাবে পাইকারী গ্রেফতারে জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে পারেন নি। কয়েকদিন পর ১৮ই জানুয়ারী (‘৬৮) সরকার আর একটি প্রেসনোট প্রকাশ করেন। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ‘পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভিযোগ আনয়ন করা হয়।’ প্রেসনোটটিতে শেখ মুজিব ছাড়াও জনাব শামসুর রহমান সি. এস. পি. সহ আরো কতিপয় ব্যক্তিকে কথিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।
সরকার এই ষড়যন্ত্রকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করেন। তথাকথিত এই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল তাঁরা হলেনঃ
১। শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর)
২। লেঃ কম্যাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (বরিশাল)
৩। স্টুয়ার্ড মজিবর রহমান (মাদারীপুর)
৪। প্রাক্তন এল. এস. সুলতান উদ্দিন আহমদ (নোয়াখালী)
৫। এল. এস. নূর মোহাম্মদ (ঢাকা)
৬। জনাব আহমদ ফজলুর রহমান সি. এস. পি. (ঢাকা)
৭। ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ (নোয়াখালী)
৮। প্রাক্তন কর্পোরাল এ. বি. সামাদ (বরিশাল)
৯। প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন (বরিশাল)
১০। জনাব রুহুল কুদ্দুস সি. এস. পি. (খুলনা)
পৃষ্ঠা নং: ৩৪৯

১১। ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (বরিশাল)
১২। ভূপতি ভূষণ (মানিক) চৌধুরী (চট্টগ্রাম)
১৩। বিধানকৃষ্ণ সেন (চট্টগ্রাম)
১৪। সুবেদার আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা)
১৫। মুজিবর রহমান ই.পি.আর.টি.সি. ক্লার্ক (কুমিল্লা)
১৬। সাবেক ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক (কুমিল্লা)
১৭। সার্জেন্ট জহুরুল হক (নোয়াখালী)
১৮। মোহাম্মদ খুরশীদ (ফরিদপুর)
১৯। কে. এম. শামসুর রহমান সি.এস.পি. (ঢাকা)
২০। রিসালদার শামসুল হক (ঢাকা)
২১। হাবিলদার আজিজুল হক (বরিশাল)
২২। এস. এ. সি. মাহফুজুল বারি (নোয়াখালী)
২৩। সার্জেন্ট শামসুল হক (নোয়াখালী)
২৪। মেজর শামসুল আলম (ঢাকা)
২৫। ক্যাপ্টেন মুত্তালিব (ময়মনসিংহ)
২৬। ক্যাপ্টেন শওকত আলী (ফরিদপুর)
২৭। ক্যাপ্টেন খন্দকার নজমুল হুদা (বরিশাল)
২৮। ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান
২৯। সার্জেন্ট আবদুল জলিল (ঢাকা)
৩০। মাহবুবুদ্দিন চৌধুরী (সিলেট)
৩১। লেঃ এম.এম.এম. রহমান (যশোর)
৩২। প্রাক্তন সুবেদার তাজুল ইসলাম (বরিশাল)
৩৩। মোহাম্মদ আলী রেজা (কুষ্টিয়া )
৩৪। ক্যাপ্টেন খুরশীদ (ময়মনসিংহ)
৩৫। লেঃ আবদুর রউফ (ময়মনসিংহ)
এছাড়া আরো ১১ জন অভিযুক্ত ছিলেন যাদেরকে পরে রাজসাক্ষী হতে রাজী হওয়ায় ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। এঁরা হলেনঃ
১। লেঃ মোজাম্মেল হোসেন (ময়মনসিংহ)
২। এক্স কর্পোরাল আমীর হোসেন মিয়া (মাদারীপুর)
পৃষ্ঠা নং: ৩৫০

৩। সার্জেন্ট শামসুদ্দিন আহমদ (ময়মনসিংহ)
৪। ডাঃ সাইদুর রহমান (চট্টগ্রাম)
৫। মীর্জা রমিজ (চট্টগ্রাম)
৬। ক্যাপ্টেন আবদুল আলীম ভূঁইয়া (কুমিল্লা)
৭। কর্পোরাল কামাল উদ্দিন (পাবনা)
৮। কর্পোরাল সিরাজুল ইসলাম (কুমিল্লা)
৯। মোঃ গোলাম আহমদ (মাদারীপুর)
১০। মোঃ ইউসুফ (বরিশাল)।
১১। সার্জেন্ট আবদুল হালিম (কুমিল্লা)
এই সকল অভিযুক্ত আসামীদেরকে দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে ১৮ই জানুয়ারী তাঁদেরকে দেশরক্ষা আইন থেকে মুক্তি দিয়ে আর্মি, নেভী এ্যাণ্ড এয়ারফোর্স এ্যাকটে পুনরায় গ্রেফতার ক’রে সেন্ট্রাল জেল থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তরিত করা হয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্রে শেখ মুজিবের নামে সরকারের মিথ্যা অভিযোগ আনার সাথে সাথে সারা বাংলাদেশে আগুন জ্বলে ওঠে। ১৯শে জানুয়ারী (১৯৬৮) ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্রগণ তাঁর মুক্তির দাবীতে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করেন।
২১শে জানুয়ারী আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওয়ার্কিং কমিটি শেখ মুজিবের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসহ সরকারের কাছে প্রকাশ্য বিচারের দাবী করেন।
এই দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস-এডমিরাল এ. আর. খান ২৬শে জানুয়ারী সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে জানানঃ
“পুর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত আটক ২৯ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তকার্য প্রায় সমাপ্ত হইয়াছে এবং শীঘ্রই দেশের আইন অনুসারে তাঁহাদের প্রকাশ্যে বিচার করা হইবে।”
[ দৈনিক সংবাদ, ২৭শে জানুয়ারী, ১৯৬৮]
অতঃপর ১৯৬৮ সালের ২১শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ‘ফৌজদারী আইন সংশোধনী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) ১৯৬৮ (অর্ডিন্যান্স নং ৫-১৯৬৮)’ বলে
পৃষ্ঠা নং: ৩৫১

সুপ্রীম কোর্টের সাবেক বিচারপতি জনাব এস এ রহমানের নেতৃত্বে বিচারপতি জনাব মজিবুর রহমান খান, বিচারপতি জনাব মকসুমুল হাকিমকে নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। এই ট্রাইব্যুনালের ওপর কুর্মিটোলা সেনানিবাসে আটক অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তির বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সংশ্লিষ্ট আইন মোতাবেক এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার কোন সুযোগ ছিল না।

ষড়যন্ত্র মামলার শুনানী
১৯৬৮ সালের ১৯শে জুন বিপুল সংখ্যক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও টেলিভিশন প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে ভারতের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যপুষ্ট হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আনীত রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের মামলার শুনানী শুরু হয়।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মঞ্জুর কাদিরসহ বেশ কিছু সংখ্যক আইনজীবী সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য উপস্থিত হন।
লণ্ডনে অবস্থানরত পাকিস্তানী ছাত্র-জনতা নিজেরা চাঁদা সংগ্রহ করে বিশ্ববিখ্যাত ষড়যন্ত্র মামলা বিশারদ ইংল্যান্ডের রানীর আইন বিষয়ক উপদেষ্টা টমাস উইলিয়মকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনজীবী হিসেবে ঢাকায় প্রেরণ করেন। এ ছাড়াও আসামীদের পক্ষে ছিলেন ডঃ আলীম-আল-রাজী, জনাব আবদুস সালাম খান, খানবাহাদুর ইসলাম, খানবাহাদুর নাজিরুদ্দিন, জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব জহিরুদ্দিন, জনাব জুলমত আলী, মোল্লা জালালউদ্দিনসহ বহু সংখ্যক আইনজীবী।
এই মামলার গোড়ায় ২২৭ জন সাক্ষীর তালিকা পেশ করা হলেও শেষ পর্যন্ত আড়াই শতাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে চাকরী-বাকরী, প্রমোশন-লাইসেন্স প্রভৃতির লোভ দেখিয়ে এসব সাক্ষী দাঁড় করানো হয়। সাক্ষ্য গ্রহণকারী একজন রাজসাক্ষী এ বি এম ইউসুফ এবং তিনজন সরকারী সাক্ষী বৈরী ঘোষিত হয়।
অত্যাচারের নির্মম পেষণে জর্জরিত হয়ে কামাল উদ্দিন শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিতে রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু সরকারী প্রধান কৌঁসুলি চিন্তা
পৃষ্ঠা নং: ৩৫২

করতেও পারেন নি যে সরকার যা শিখিয়ে দিয়েছিলেন কামাল উদ্দিন সাক্ষ্য দিতে এসে ঠিক তার বিপরীত কথা বলবেন।
কামাল উদ্দিন সাহেব ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সেনাবাহিনী কর্তৃক অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করলেন। তিনি তাঁর জবানবন্দীতে বললেনঃ
“বাড়ী থেকে ধরে প্রথমে আমাকে সিদ্ধেশ্বরীতে সিটি এস-বি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে ‘আই-বি’র ডি. এস. পি. এম. ইয়াসিন এবং ইন্সপেক্টর কে. আহমদ প্রায় সারা রাত ধরে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বলে, আমি নাকি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে জড়িত আছি। জোর ক’রে আমার কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করল। ইন্সপেক্টর কে. আহমদ আমায় বলল, ‘ভারতের সঙ্গে যোগসাজসে তোমরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে যারা জড়িত আছ সকলের নাম লিখে স্টেটমেন্ট ক’রে দিচ্ছি, সই ক’রে দিতে হবে।’
আমি বললাম, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না, আপনারা আমায় অযথা হয়রানী করছেন।’
কাজ হাসিল হ’ল না দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল সে। ঘাড় ধরে মাটিতে ফেলে দিল আমায়। পিঠে রুল দিয়ে কয়েকটা ঘা দিল। পরদিন আমাকে মিলিটারীর হাতে তুলে দিল। মিলিটারী ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন সুলতান এবং নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট শরীফ দিনের পর দিন আমাকে জেরা ক’রে ভয় দেখিয়ে অত্যাচার ক’রে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করল। ওরা এক ডিগ্রী থেকে পাঁচ ডিগ্রী পর্যন্ত নির্যাতন চালালো আমার ওপর।
একদিন তো কানের কাছে এমন প্রচণ্ড চড় কষালো যে, এখনও কানে ভাল শুনতে পাই না। কয়েকটা নখে সুই ঢুকিয়ে দিয়েছে কতবার, রুল দিয়ে মেরে মেরে আঙুল ভেঙে দিয়েছে। আঙুলগুলো আর নড়াতে পারি না। এতেও ওদের নির্যাতন শেষ হ’ল না। আমাকে উলঙ্গ করে গুহ্যদ্বারে ব্যাটন ঢুকিয়ে জোর করিয়ে হাঁটিয়েছে। সে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা কী বলব! কতোবার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছি।
পৃষ্ঠা নং: ৩৫৩

আর একদিন মাটিতে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে উপুড় ক’রে ফেলে রুল দিয়ে গুহ্যদ্বারে ঢুকিয়ে দিল বরফের কতকগুলো টুকরো। তারপর চললো জিজ্ঞাসাবাদঃ ‘বল তোদের নেতা কে? মুজিবুর রহমান? ইণ্ডিয়ায় কার সঙ্গে যোগসাজস আছে? ঢাকায় ইণ্ডিয়ান হাই কমিশন অফিসে কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে? কোথায় কোথায় তোদের ঘাঁটি আছে, বল?’
আমি জ্ঞান হারাতে হারাতে শুধু বলতে পেরেছি, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না।’
দিনের পর দিন ওরা নিত্য-নতুন নির্যাতন চালিয়েছে আমার ওপর। খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ছুরি দিয়ে শরীরের নানান স্থান কেটে কেটে কাটা জায়গায় নুন আর লঙ্কার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে। আমার যন্ত্রণাবিকৃত মুখ দেখে ওখানকার মিলিটারী অফিসাররা পৈশাচিক হাসিতে ভরিয়ে তুলেছে টর্চার-চেম্বার।
আর একবার খুটির সঙ্গে বেঁধে শরীর থেকে কাপড় খুলে নিল একজন সিপাই। তারপর আমার পুরুষাঙ্গ ধরে প্রবলভাবে টানা-হেঁচড়া করতে লাগল। অণ্ডকোষ দু’টি দু’হাতে রগড়ে পিষে দিতে লাগল। অসহ্য যন্ত্রণায় বিকট চীৎকার ক’রে উঠলাম। মাথা ঘুরে গেল। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরে এলে দেখলাম স্যাঁতসেঁতে একটা মেঝেতে পড়ে রয়েছি। শরীরে কোন কাপড় নেই। সারা শরীর তখনও অসহ্য ব্যথায় টনটন করছে।
ঐ দিনই কয়েক ঘন্টা বাদে আবার আমায় স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য নিয়ে গেল। ঢ্যাঙ্গা একজন মিলিটারী অফিসার বলল, ‘ভারতের সঙ্গে যোগসাজসে তোমরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিলে। তোমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আর আমরা যাদের কথা বলি তারাও তোমার সঙ্গে ছিল-এই স্বীকারোক্তি লিখে দিতে হবে। স্বীকারোক্তি লিখে দিলে তোমাকে ক্ষমা করা হবে। ভেবে দেখ। আর যদি স্টেটমেন্ট না দাও, তোমার স্ত্রী আর মেয়েদের এনে তোমার সামনে উলঙ্গ করে চাবুক দিয়ে শরীর কেটে কেটে লঙ্কানুন ছিটিয়ে দেবো। তোমার রূপসী স্ত্রীকে তোমার চোখের সামনে ন্যাংটা ক’রে সাধারণ সৈন্যদের লেলিয়ে দেবো তাকে ধর্ষণ করার জন্যে।’
পৃষ্ঠা নং: ৩৫৪

অফিসারটির কথা শুনে অদূরে দাঁড়ানো সৈন্যটির চোখ দুটো লোভে জুলজুল ক’রে উঠলো। জিভটা দিয়ে ঠোঁটটা একবার চেটে নিল।
এত অত্যাচারেও আমাকে দিয়ে যা করাতে পারে নি, এই একটি কথাতেই তা’ পারল। খুকি আর আমার ছেলেমেয়েদের ওপর নির্যাতনের কথা ভেবে শিউরে উঠলাম। ওদের ওপর বিন্দুমাত্র নির্যাতন আমি সইতে পারব না। কিছুতেই না। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘না, না, ওদের কিছু করবেন না, আমি স্টেটমেন্ট দেব। আপনারা যা বলবেন, তাই লিখে দেব।’
১৫ই ডিসেম্বর শুক্রবার ওরা আমাকে দিয়ে একটি দলিলে সই করিয়ে নিল। কয়েক সীট কাগজে আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ নিল। দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতনে আমার মাথা তখন শূন্য, হতচেতন অবস্থা। কি করল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বাধাও দিলাম না। সে শক্তিও ছিল না। তারপর কতগুলো ‘মিষ্টি কালো জাম’ ও এক গ্লাস ওষুধ খেতে বলল, ওষুধটার স্বাদ অনেকটা ‘রাম’-এর (এক জাতীয় মদ) মতো। তারপর আমার হাতে তুলে দিল কাগজ আর কলম। একজন একটা টাইপ-করা কাগজ দেখে দেখে ডিকটেশন দিচ্ছিলেন, আমাকে তা’ লিখে যেতে বলা হ’ল। সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর অনেকের, কয়েকজন সি.এস.পি. অফিসার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীর নাম লিখতে বলল। পঞ্চাশ জনের মতো হবে বোধহয়। তারপর একটা জবানবন্দী লিখতে বলল। নির্যাতনের ভয়ে তা’ লিখে দিলে তারপর থেকে আমার ওপর আর অত্যাচার করে নি।”
[ প্রাগুক্ত, কলহন, পৃঃ ১৯৪-১৯৭]
কিন্তু যাঁদের নাম কামাল উদ্দিন সাহেব টেটমেন্টে লিখেছিলেন তাঁদের অনেকেরই সাথে তাঁর মোটেই যোগাযোগ ছিল না। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সাক্ষীকে শত্রু, বলে ঘোষণা করলেন। পরদিন থেকে কামাল উদ্দিন সাহেবকে জেরা করতে শুরু করা হ’ল।
সালাম খান আসামী পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। তিনি কামাল উদ্দিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, মিঃ আহমদ, কাল যখন আপনি বলছিলেন যে, বন্দী থাকাকালে আপনার ওপর নৃশংস অত্যাচার
পৃষ্ঠা নং: ৩৫৫

করা হয়েছে, আপনি কি সেই সময় ভয়ে ভয়ে বলেছিলেন যে আদালতে তো মাত্র দশ মিনিট, তারপর আমার কী হবে?’
জেরার উত্তরে কামাল উদ্দিন বলেনঃ “যে অমানুষিক নির্যাতন আমার ওপর করেছে, আবার করলে আমি আর বাঁচব না। ভয়ে আমি মন খুলে সাক্ষ্য দিতে পারছি না।’
সালাম খান কামাল উদ্দিনের জবাব শুনে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির দিকে একবার তাকালেন। তারপর তাঁর সহকারীর নিকট থেকে এক চিরকুট নিয়ে বললেন, ‘জীপটা কি আপনার কেনা?
হ্যাঁ।’
‘সেটা কোন্ মডেলের?’
‘সিক্সটি ফাইভ মডেলের। একজন লোকের কাছ থেকে গাড়ীটা আমার কেনা।’
‘আচ্ছা, আপনি বলেছেন জীপটা কিছুদিন কে. জি. আহমদও ব্যবহার করেছেন। তাঁর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?
‘প্রথম দিকে তিন মাস তিনি আমাদের সেলভেশন কোম্পানীর চেয়ারম্যান ছিলেন।’
‘রক্সি হোটেল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ীর দূরত্ব কতখানি?’
‘রক্সি হোটেল মীরপুর রোডে। মুজিবুর রহমানের বাসা আমি চিনি না এবং তাঁকে আমি কখনো দেখিও নি।’
এক মুহূর্ত নীরব থেকে সালাম খান আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি বলেছেন করাচীতে যখন আপনি সুলতান উদ্দিনের বাসায় তখন একদিন সেখানে একটা সভা হয়েছিল। নক শুনে দরজা খুলে দাঁড়াতে আপনি কাকে দেখেছিলেন?
‘লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেল হোসেনকে।’
‘কতক্ষণ চলেছিল সভা?’
‘তিনটে থেকে চারটে। চারটের পর আমি বেরিয়ে যাই।’
‘আপনার উক্তি থেকে জানা যায়, ক্যান্টনমেন্ট মেসে মেজর হাসান এবং মেজর শরীফ আপনার কাছে প্রায়ই যেতেন?’
‘হ্যাঁ।’
পৃষ্ঠা নং: ৩৫৬

‘তাঁদের কেউ কি আপনাকে জবানবন্দী দিতে বলেছিলেন?’
‘লেফটেন্যান্ট শরীফ বলেছিলেন।’
‘জবানবন্দী লিখতে রাজী করানোর সময় তাঁরা কি আপনাকে অত্যাচার করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ করেছিলেন। আমি জবানবন্দী দিতে অসম্মত দেখে একজন সুবেদার বলে উঠল, স্যার, ভাল কথায় কাজ হবে না, ভাল ক’রে ‘বানালে’ ভাল ছেলের মত কথা শুনবে। পরে জেনেছিলাম, সুবেদারের নাম শফি। তারা আমার উপর তো অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল, তারপর আমার স্ত্রী ও মেয়েদের ওপর অত্যাচারের ভয় দেখালে আমি স্টেটমেন্ট লিখে দিতে রাজী হই। লেফটেন্যান্ট শরীফ কতকগুলো পয়েন্টের উপর স্টেটমেন্ট লিখতে বললেন।’
সালাম খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘পয়েন্টগুলো কী?’
শেখ মুজিবর রহমান এবং এ. এফ রহমান সি.এস.পি-কে আমার বন্ধু বলে উল্লেখ করতে বললেন।
‘আর কারও নাম লিখতে বলেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, বলেছিলেন। চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী আমার বিশেষ পরিচিত এবং তিনি একদিন আমার বাসায় এসে গোপনে জেনারেল আযম খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আরও কয়েকজনকে আমি চিনি—এসব লিখতে বলেছিলেন। সনাক্ত করতে অসুবিধা না হয় সেজন্য তারা আমাকে তাঁদের ফটো দেখাবে। মেজর হাসান জবানবন্দী বলে গিয়েছিলেন, আমি লিখেছি মাত্র।’
‘বলতে পারেন, মেজর হাসান কি আদালতে হাজির আছেন?’
কামাল উদ্দিন সাহেব আদালত কক্ষের চারিদিকে সকলের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘না, তিনি এখন এখানে নেই।’
সালাম খান জেরা সমাপ্ত করে চেয়ারে উপবিষ্ট হওয়া মাত্র সরকারী পক্ষের প্রধান কৌসুলী মঞ্জুর কাদির কামাল সাহেবকে প্রশ্ন করার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলি টমাস উইলিয়ম আপত্তি তুললে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মিস্টার টমাসের আপত্তি অগ্রাহ্য ক’রে মঞ্জুর কাদিরকে জেরা করার অনুমতি দেন।
পৃষ্ঠা নং: ৩৫৭

মঞ্জুর কাদির কামাল উদ্দিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার উপর নির্যাতন সম্পর্কে আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে যে চিঠি লিখেছিলেন তা’ হাইকোর্টে রীট আবেদন করার আগে না পরে?’
‘আগে লেখা।’
‘আপনার উপর নির্যাতন করা হয়েছে—পাঁচজন ডাক্তারের বোর্ড এ সম্বন্ধে কোন রিপোর্ট দিয়েছেন কি?’
তাঁরা কি রিপোর্ট দিয়েছেন তা’ আমার জানা নাই।’
‘ডাক্তাররা কি আপনার শরীরের উপর আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন?’
‘আমি আমার দেহে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়েছি। তারা কি দেখেছেন জানি না। তবে তাঁদের একজন বলেছিলেন, ‘দেখুন, আমাদের হাত-পা বাঁধা, যেন থেকেও নেই।’
মঞ্জুর কাদির জেরা সমাপ্ত করেন। কামাল উদ্দিনের নিরাপত্তার প্রশ্নে বিচারপতি এস. এ. রহমান কামাল উদ্দিনকে বলেন, ‘আপনি এখন মুক্ত মানুষ।’

আমীর হোসেনের জবানবন্দী
তারপর আদালত কক্ষে শুরু হয় প্রাক্তন কর্পোরাল আমীর হোসেনের জেরা। ইনি ফরিদপুরের লোক। ইনি প্রথমে বিমান বাহিনীর লোক ছিলেন। চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি করাচীর কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিসে যোগ দেন। আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি যে জবানবন্দী দেন এবং কৌঁসুলিদের জেরার সম্মুখীন হন-এর একটি ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে আবার আমি কলহনের উক্ত গ্রন্থের (পৃঃ ২০১-২২৩) শরণাপন্ন হচ্ছি।
সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আগরতলার ষড়যন্ত্রের উৎস সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে আমীর হোসেন জবাব দেন, ‘১৯৬৪ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৫ সালের গোড়ার দিকে স্টুয়ার্ট মুজিবরের সাথে আমার পরিচয় হয়। সে সময় লাডিং সীম্যান সুলতান উদ্দিনের সাথেও আমার পরিচয় হয়। লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেনকেও আমি তখন চিনি এবং পরিচয় হয়। এঁদের সাথে আলাপ হওয়ার কিছুদিন পর স্টুয়ার্ট মুজিবর এবং সুলতান উদ্দিন আমাকে পূর্ব ও
পৃষ্ঠা নং: ৩৫৮

পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে একটা বিরাট বৈষম্য চলছে, সে সম্পর্কে অনেক কথাই বলেন। তাঁরা আরো বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন না হলে এদেশ একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তাঁদের এসব কথায় আমল দিতাম না। তাই একদিন আমাকে লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় নিয়ে গেলেন। লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম তাঁদের কথায় বিশ্বাস রাখতে বলেন। তিনি বললেন, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ গঠন করতে হবে। প্রাক্তন এবং কার্যরত সৈনিকদের নিয়ে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’র জন্য সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হয়েছে। এসব কথা শোনার পর আমি তাঁদের দলে যোগ দিই। লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেমের বাসায় প্রায়ই গোপন বৈঠক বসত। আমিও সেখানে যেতাম। স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান এবং সুলতান উদ্দিন ছাড়া আরও অনেকেই উক্ত সভায় যোগ দিতেন। সেখানে গেরিলা বাহিনীর হাবিলদার দলিল উদ্দিনও যেতেন। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সুলতান উদ্দিন আহমদ ঢাকা গিয়েছিলেন আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে। সেখান থেকে তিনি আমাকে তিনখানি চিঠি লিখেন।
সরকারের তরফ থেকে তিনখানি চিঠি পেশ করা হ’ল। মঞ্জুর কাদির চিঠিগুলোর ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিঠিতে কি লিখা ছিল আপনার মনে আছে কি?’
আমীর হোসেন জানালেন, চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু ঠিক হবহু মনে নেই, তবে সুলতান উদ্দিন লিখেছিলেন, ঢাকার ছাত্র-সমাজের সাথে মিশে ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলার’ কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। চিঠিতে তিনি আরও লিখেছিলেন-স্টুয়ার্ড মুজিবরের ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি না যাওয়ায় আন্দোলনের ক্ষতি হচ্ছে; আমি যেন তাঁর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানাই। আর এক পত্রে তিনি লিখেছিলেন, শেখ মুজিবের বাসভবনে এক জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। আমি যেন উক্ত সভায় যোগদানের জন্য তৈরী থাকি। প্রথম পত্রের উল্টো পিঠে লিখা ছিল, আমি যেন তাঁর কাছে C/o. মোহাম্মদ মতিউর রহমান (এস) ‘পথিকাবাস’, ৪নং মোমেনগর, ঢাকা-৫ এই ঠিকানায় চিঠি লিখি। উক্ত ঠিকানায় ব্রাকেটের এস অবশ্যই লিখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।
পৃষ্ঠা নং: ৩৫৯

তৃতীয় পত্রে সুলতান উদ্দিন সম্ভবতঃ জানিয়েছিলেন, তিনি একটি গোপন প্রেস পেয়েছেন–সেই প্রেসের মাধ্যমে আন্দোলনের প্রচারপত্র ছাপানো যাবে। তিনি আরো লিখেছিলেন, আমি কয়েকদিনের মধ্যেই টাকা পাঠাচ্ছি। লীডিং সীম্যান নূর মোহাম্মদকে নিয়ে টাকা পাওয়া মাত্রই যেন ঢাকায় চলে আসি।
বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলি সাক্ষীর কথা বানোয়াট বলে আপত্তি তুললে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আমীর হোসেনকে তাঁর সাক্ষ্য চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন।
আমীর হোসেন তাঁর বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলেনঃ ঐ চিঠির সাথে একটি লিফলেটও পাই। কয়েকদিনের মধ্যে পনের শ’ টাকা পাই। নূর মোহাম্মদও তাঁর টাকা পেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের ২৮শে আগস্ট সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশ্যে করাচী ত্যাগ করি। কিন্তু নূর মোহাম্মদের ছুটি মঞ্জুর না হওয়ায় তিনি আমার সাথে যেতে পারেন নি।
ঢাকার বিমান বন্দরে নেমে দেখি স্টুয়ার্ড মুজিবর এবং সুলতান উদ্দিন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছেন। তাঁরা একটা জীপে ধানমণ্ডির ২নং রোডে একটা বাসায় নিয়ে গেলেন। বাড়ীটার সদর দরজায় ‘আলেয়া’ লিখা ছিল। পরে জেনেছি ওটা লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেমের আত্মীয় ডাঃ খালেকের বাড়ী। ওখান থেকে আমাকে নিয়ে গেল ঢাকা হোটেলে। স্টুয়ার্ড মুজিবর ও সুলতান উদ্দিন আমার সাথে হোটেলে উঠলেন।
পরদিন হোটেল থেকে উক্ত জীপে ধানমণ্ডির উক্ত বাড়ীতে গেলাম। সেদিন আমরা চারজন বেলা তিনটের সময় শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। শেখ সাহেব আমাদেরকে দোতলার একটা ঘরে নিয়ে বসলেন। উক্ত বৈঠকে রুহুল কুদ্দুস সি. এস. পি. -ও উপস্থিত ছিলেন। উক্ত বৈঠকে মোয়াজ্জেম হোসেন বললেনঃ ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ গঠনের জন্য শেখ সাহেব যে ডাক দিয়েছিলেন তাতে বিশেষ সাড়া জেগেছে। সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠেছে। কিন্তু আরও অর্থ ও অস্ত্রের প্রয়োজন।
উক্ত বৈঠকে শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, আমি যতদূর পারি ভারত থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টায় রয়েছি। আপাততঃ আপনাদিগকে কয়েকটি কিস্তিতে ১ লক্ষ ৪ হাজার টাকা দিচ্ছি। প্রয়োজন
পৃষ্ঠা নং: ৩৬০

হলে টাকাটা আপনারা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। আপনারা সশস্ত্র বাহিনী গঠনের কাজ চালিয়ে যান, টাকার জন্য চিন্তার কোন কারণ নেই।
বৈঠক শেষ হওয়ার পর ঢাকা হোটেলে ফিরে আসি। পরদিন লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন করাচী চলে যান। ১লা সেপ্টেম্বর খরচের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব আমার হাতে সাত’শ টাকা দেন।
৯ই সেপ্টেম্বর মুজিবুর সাহেবের বাসায় যাই। সেদিন তিনি আমার হাতে ৪ হাজার টাকা দিলেন। হোটেলের খরচ বাবদ কিছু টাকা স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান এবং সুলতান উদ্দিন আহমদের হাতে দিই। কিছুদিন পর ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়। চলে আসি করাচী। করাচীতে এসে সব টাকা মোয়াজ্জেম হোসেনের হাতে তুলে দেই। নভেম্বর মাসে করাচীতে কে. জি. আহমদ এবং ফজলুর রহমান সি. এস. পি. সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানে মোয়াজ্জেমের বাড়ীতে দু’টো বৈঠক বসেছিল। উক্ত সভায় প্রাক্তন কর্পোরাল সামাদও উপস্থিত ছিলেন। উক্ত বৈঠকে আলোচনাক্রমে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অভ্যুত্থানের গতি দ্রুত করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সামাদকে ঢাকায় পাঠাবেন।
উক্ত সভায় মোয়াজ্জেম হোসেন বলেনঃ ‘আমাদের ট্রানজিস্টার ট্রান্সমিটার প্রয়োজন।’ একথা শোনার পর ফজলুর রহমান সাহেব জানালেন, লণ্ডন থেকে ট্রান্সমিটার আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাঁর ছোট ভাই লণ্ডনে পড়াশোনা করছে। এসব জিনিস সে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে।’
উক্ত সভার দু’তিন দিন পরে ‘ইলাকো হাউজে’ বৈঠক বসে। সেখানে মোয়াজ্জেম হোসেন জানালেন স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান এবং সুলতান উদ্দিনের প্রচেষ্টায় পূর্ব বাংলায় আন্দোলনের গতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। তাঁদের পার্টির সদস্য সংখ্যা তিন হাজারের বেশী হয়ে গেছে।
আমীর হোসেন আদালতে জানালেন, ‘৮ই ফেব্রুয়ারী ঢাকার উদ্দেশ্যে আমি করাচী ত্যাগ করি। ঢাকায় এসে ‘হোটেল আরজু’তে উঠি।’
এ সময় মঞ্জুর কাদির একটি চিঠি সাক্ষীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘চিঠিটি কে কাকে লিখেছে?’
পৃষ্ঠা নং: ৩৬১

আমীর হোসেন জবাবে বললেন, এই পত্রে ‘আলো’ লিখছে ‘উল্কা’র কাছে অর্থাৎ লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন চিঠি লিখছেন আমার কাছে।’
তারপর সরকার পক্ষের কৌঁসুলি চিঠিতে বর্ণিত কতকগুলি সাংকেতিক শব্দের উত্তর ব্যাখ্যা করতে বলেনঃ
‘চিঠিতে ‘কনট্রাকটরী ব্যবস্থার’ কথা উল্লেখ রয়েছে, তা’ দিয়ে কি অর্থ প্রকাশ করে?’
‘সেটা আন্দোলন।’
‘মায়ের অসুখের’ অর্থ কী?’
‘পূর্ব পাকিস্তানের অস্বাভাবিক অবস্থার কথা বলা হয়েছে। এরপর মঞ্জুর কাদির চিঠিতে উল্লেখিত ‘ডাক্তার কে? আর ওষুধপত্রই বা কী?’ এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে আমীর হোসেন জবাবে বলেন ‘ডাক্তার শেখ মুজিবুর রহমান এবং ওষুধপত্র বলতে অস্ত্রশস্ত্রকে বুঝানো হয়েছে।’ মঞ্জুর কাদির তার পরের ঘটনা বর্ণনা করার নির্দেশ দিলে আমীর হোসেন তাঁর জবানীতে বলেনঃ
“১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেনের নিকট থেকে একটা নির্দেশ পাই। সে নির্দেশে বলা হয়েছে, এক্স কর্পোরাল সামাদকে আহমদ ফজলুর রহমানের কাছে নিয়ে গিয়ে যেন তাঁর চাকুরীর একটা ব্যবস্থা করি। আহমদ ফজলুর রহমান তাঁকে ধানমণ্ডি ‘গ্রীন ভিউ পেট্রোল পাম্প’-এ ম্যানেজারের একটি চাকরী দিলেন। কিন্তু পেট্রোল পাম্পের মালিক ছিলেন মিসেস ফজলুর রহমান। সেখানে সামাদের নিয়োগের উদ্দেশ্য হ’ল ভারতীয় দূতাবাসের কর্মচারী এবং আহমদ ফজলুর রহমানের মধ্যে যোগাযোগের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা।
মার্চ মাসেই মহাখালী এয়ারপোর্টের নিকটে এক গোপন স্থানে এক বৈঠক ডাকা হয়। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, কর্পোরাল সামাদ, সুবেদার আশরাফ আলী খান, ই. পি. আর. টি. সি-র ক্লার্ক মজিবর রহমান। ই. পি. আর. টি. সি-র সিকিউরিটি অফিসার রাজ্জাক, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কম্পাউন্ডার ইউসুফ, এডুকেশনাল ইন্সট্রাক্টর, ফ্লাইট সার্জেন্ট হক নওয়াজ, সার্জেন্ট মিয়া ও জি. টি. জেড. এ. চৌধুরী।
পৃষ্ঠা নং: ৩৬২

মঞ্জুর কাদির তাঁদের সনাক্ত করার নির্দেশ দিলে তাঁদের তিনি সনাক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘এই সভার একমাত্র উদ্দেশ্য আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি বিষয়ে আলোচনা করা।’
এরপর বারই মার্চ মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকায় ফিরে এলে সেদিন সন্ধ্যেবেলা তাজউদ্দিন সাহেবের বাসায় এক বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে মুজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
উক্ত বৈঠকে কি বিষয় আলোচিত হয়েছিল এই প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী আমীর হোসেন বলেনঃ লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষণে তিনি জানান যে, সামরিক ও বেসামরিক বহু লোককে তাঁদের দলে টানা হয়েছে। ভারতের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেলেই আন্দোলন গড়ে উঠবে। শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, শীঘ্রই হাবিলদার দলিল উদ্দিন এবং জয়দেবপুর থেকে একজন ক্যাপ্টেনকে অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে ভারতে পাঠানো হবে।
জনাব তাজউদ্দিন উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন কিনা, বাদীপক্ষের কৌঁসুলি একথা জিজ্ঞেস করলে আমির হোসেন ‘না’ উত্তর দেন।
তারপর বিবাদী পক্ষের খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী টমাস উইলিয়ম আমীর হোসেনকে জেরা করতে শুরু করেন।
‘মিয়া সাহেব, আপনি বিয়ে করেছেন?’
‘জী হ্যাঁ।’
‘ছেলে-পুলে কয়টি?’
‘ছেলেপুলে হয় নি।’
‘করাচীতে আপনি কোথায় থাকতেন?’
‘জাহাঙ্গীর রোডে।’
‘ঢাকায় আসার পর কোথায় ছিলেন?’
‘১৯৬৬ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আমি ‘ঢাকা হোটেলে’ ছিলাম। পরে হোটেল ‘আরজু’-তে গিয়েছিলাম।
‘আরজু হোটেল থেকে উঠে কোথায় গিয়েছিলেন?’
‘১০৭ দীননাথ সেন রোডে—ভাড়া বাড়ীতে গিয়ে উঠি।’
‘বাড়ীর মালিকের নাম কি?’
‘এ্যাসিসট্যান্ট সেসন জজ হারুন-অর-রশীদ’
পৃষ্ঠা নং: ৩৬৩
‘আগে তাকে চিনতেন?’
‘না।’
‘আপনি দলের সংগে সম্পর্ক ছিন্ন করেন কবে?’
‘১৯৬৬ সালের এপ্রিলের শেষে অথবা মে-এর প্রথম সপ্তাহে।’
মিস্টার উইলিয়ম একটু পরিষ্কার ভাষায় বলেনঃ ‘তার মানে, দীননাথ সেন রোডের বাসায় ওঠার কিছুদিন পরেই!’
‘হ্যাঁ।’
‘দল ছাড়ায় লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম আপনাকে ভয় দেখান নি?’
‘দেখিয়েছিলেন।’
‘কোন ক্ষতি করেছিলেন কী?’
‘না।’
তারপর মিস্টার উইলিয়াম PW 3/59 চিহ্নিত একটি দলিল দেখিয়ে বললেন, ‘এটা আপনি চিনতে পারেন কি? নিশ্চয়ই পারছেন? আপনাকে করাচীতে ডেকে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু কেন?’
আমীর হোসেন এ সওয়ালের জবাবে বলেনঃ ‘জানি না।’
‘আপনি কখন গ্রেফতার হয়েছিলেন?’
‘ওই বছরই ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকা এয়ারপোর্টে নামতেই দু’জন সাদা পোশাক পরা পুলিশ আমাকে ধরে সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গেল।’
‘আপনি যে গ্রেফতার হবেন সেটা কি আগে থেকেই জানতেন?’
‘না। তারপর সেন্ট্রাল জেল থেকে রাজারবাগে তিন চার ঘন্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।’
টমাস উইলিয়ম গলার স্বরটা একটু নীচে নামিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘মিয়া সাব, অত্যাচার হয় নি, কেবল চার ঘন্টা ধরে জেরার ফলেই কি আপনি বন্ধুদের সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন?’
আমির হোসেন একটু উষ্ণভাবে বলে উঠলেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতার প্রশ্নই উঠতে পারে না।’
‘কোন পুলিশ অফিসার আপনাকে জিঙ্গাসাবাদ করেছিলেন?’
‘ডি. এস. পি. মান্নাফ ও আর দু’ একজন।’
পৃষ্ঠা নং: ৩৬৪

‘ডাইরী দু’টো আনার চিরকুট কার হাতে দিয়েছিলেন?’
‘মান্নাফ সাহেবের হাতেই।’
‘পরে যে চিঠিগুলো দাখিল করেছিলেন সে সময় চিঠিগুলোর কথা বলেন নি কেন?’
‘মনে ছিল না।’
‘চিঠিগুলো আপনি নষ্ট না ক’রে রেখে দিয়েছিলেন কেন?’
আমীর হোসেন বেশ একটু ইতস্তত ক’রে বললেন, ‘বুড়া বয়সে আত্মজীবনী লিখব বলে।’
‘চিঠি ও ডাইরীগুলো পুলিশের হাতে পড়লে বিপদের আশঙ্কা -এ জেনেও আত্মজীবনী লিখবেন বলে রেখে দিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
টমাস সাহেব একটু হেসে বললেনঃ ‘মিয়া সাহেবের দেখি জীবনী লিখার খুবই সখ!’
টমাস সাহেবের এই বিদ্রুপাত্মক কথায় দর্শকের গ্যালারী থেকে মৃদু হাস্যের গুঞ্জন উঠেছিল। এ সময় মিঃ টমাস একটি টেলিগ্রাম দেখিয়ে বললেনঃ ‘১৯৬৫ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে কি আপনি ঢাকায় এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম সাহেবের নির্দেশমত ২৮শে আগস্ট আমি মিটিং-এ যোগ দেবার জন্য ঢাকায় আসি।’
‘আপনি কি সে সময় করাচী অফিসে টেলিগ্রাম করেছিলেন, ‘পি. আই. এ-র ফ্লাইট বন্ধ, পরামর্শ চাই।’
‘হ্যাঁ, লিখেছিলাম। ভারতের সাথে যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় ফ্লাইট বাতিল ক’রে দেওয়া হয়েছিল।’
আমীর হোসেনের হাতে টেলিগ্রামটি দিয়ে টমাস উইলিয়ম ঠিকানাটা জোরে জোরে পড়ার নির্দেশ দিলে সাক্ষী তা’ জোরে জোরে পড়লেন, ‘১০৭, ডি. এন. সেন রোড, ফরিদাবাদ, ঢাকা-8।’
‘পোস্ট-অফিসের স্ট্যাম্পের তারিখ কত?’
একটু বিব্রত হয়ে আমীর হোসেন বললেনঃ ‘১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫।’
সাক্ষীর এই জবাবের পর টমাস উইলিয়ম বললেনঃ ‘আপনি বলেছেন,
পৃষ্ঠা নং: ৩৬৫

১৯৬৬ সালের এপ্রিলে ওই বাসায় যান এবং বাড়ীর মালিককে আগে থেকে চিনতেন না—ব্যাপার কী?’
ধরা পড়ে গিয়ে আমীর হোসেন চুপ থাকেন। দর্শকদের গ্যালারীতে আবার গুঞ্জন ওঠে। টমাস উইলিয়ম এবার জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘আপনাকে তো ভারত, আমেরিকা ও চীনের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ ক’রে সাহায্য চাইতে বলা হয়েছিল? আপনি যোগাযোগ করেছিলেন কি?’
‘আমি নিজে যোগাযোগ করি নি। তবে ১৯৬৫ সালের জুন-জুলাই মাসে লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন করাচীস্থ মার্কিন দূতাবাসের এ্যাসিস্ট্যান্ট নৌ-এ্যাটাচি মিঃ নোবল-এর বাসায় আমায় নিয়ে যান। সেখানে তিনিই আমাদের পরিকল্পনার কথা বলেন।’
‘মোয়াজ্জেম সাহেব তো নিজেই যোগাযোগ করতে পারতেন—আপনাকে ভার দিয়েছিলেন কেন?’
‘জানি না। যাঁরা ভার দিয়েছিলেন তাঁদের জিজ্ঞেস করুন।’
টমাস উইলিয়াম একটু রসিকতা ক’রে বললেনঃ ‘ও, তাই নাকি!’
এরপর বিবাদী পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুস সালাম খান উঠে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘আপনার গায়ের শার্ট টা কি আপনার নিজের কেনা?’
আমীর হোসেন বেশ রাগান্বিত হয়েই উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ।’
‘কিসের কোর্ট? কত দাম?’
‘টেট্রনের। দাম ২২ টাকা।’
‘আচ্ছা মিয়া সাব, আপনার জুতো জোড়াও কি কেনা?’
এ প্রশ্ন শুনে সাক্ষী ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলেন, ‘রাবিশ! আপনার প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।’
সালাম খান জেদ ক’রেই বললেনঃ ‘প্রশ্নের জবাব আপনাকে দিতেই হবে।’
আমীর হোসেন রাগে চীৎকার ক’রে বলে উঠলেন, ‘না, দেবো না।’
তাঁর এ আচরণের জন্য তাঁকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।
… … … …
পৃষ্ঠা নং: ৩৬৬

তারপর সালাম খান তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘কে. জি. আহমদ কি আপনার দলের সদস্য ছিলেন?’
‘না।’
‘ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বলেছিলেন কে. জি. আহমদ দলের সদস্য ছিলেন, এখন আবার বলছেন না—দু’রকম কথা কেন?’
সাক্ষী নিরুত্তর।
‘১৯৬৫ সালের আগস্টের শেষে কতদিন আপনি ঢাকায় ছিলেন?’
‘২৬ দিন। ঢাকা হোটেলে ছিলাম।’
‘ঢাকা হোটেলের রেজিস্টারে আপনার নাম কি লিখা ছিল?’
‘নিজের নামে ছিলাম না, আবদুর রহিম নামে থাকতাম।’
‘সে সময় (১৯৬৫ সালের আগস্ট) ঢাকায় এসে লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেমের সাথে আপনার দেখা হয়েছিল কি?’
‘হ্যাঁ, ২৯শে আগস্ট ধানমণ্ডির ‘আলেয়া’তে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়।’
‘যুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন কোথায় ছিলেন?’
‘করাচীর নৌ-বাহিনীর সদর দফতরে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে কাজ করতেন।’
‘করাচীর নৌ-বাহিনীর সদর দফতরটি কোথায়?’
‘জানি না।’
‘সমুদ্রবক্ষে কি……?’
‘আমি জানি না।’
‘আপনি যখন ঢাকায় এসেছিলেন, যুদ্ধটা তখনি হয়েছিল, তা’ হ’লে মোয়াজ্জেম সাহেব ঢাকায় এলেন কি ক’রে?’
আমীর হোসেন নিরুত্তর থাকেন।
‘বিপ্লবের জন্য আপনারা কি অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন?’
‘আমি থাকা পর্যন্ত কিছুই হ’তে দেখি নি।
‘আপনাদের দলে নতুন লোক নিলে আপনি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। শপথের বয়ানটি কি ছিল?’
আমতা আমতা ক’রে সাক্ষী জবাব দিলঃ ‘পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের
পৃষ্ঠা নং: ৩৬৭

স্বাধীনতা চাই……পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে—এসব আর কি?’
‘এর অর্থ হচ্ছে, আপনি আর জানেন না।’
‘না, আরও আছে।’
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সেগুলো বলার জন্য সাক্ষীকে নির্দেশ দিলে সাক্ষী আমীর হোসেন হতচকিত হয়ে থেমে থেমে বলতে শুরু করলোঃ ‘পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হচ্ছে … …পূর্ব পাকিস্তান অপেক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানে বেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে… …এসব আর কি!’
সালাম খান উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শুধু এই?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
… … … …
আপনাকে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের ভার দেয়া হয়েছিল। সবুর খানের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল—সি. এস. পি. অফিসারদের দলে টানতে বলা হয়েছিল কোন কাজই তো করেন নি। তারপরও দলের নেতারা আপনার উপর আস্থা রেখেছিল? সমস্ত গোপন কথাই কি আপনাকে জানানো তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য? যেখানে যত গোপন বৈঠক বসেছে, প্রত্যেক টিতেই আপনি রয়েছেন—এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?’
‘আপনাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ওপর আমার হাত নেই।’
সেদিনের মত আদালতের অধিবেশন মুলতবী থাকে।

ডাঃ সাইদুর রহমানের জবানবন্দী
চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ডাঃ সাইদুর রহমানের সওয়াল-জবাবও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিক কলহন তাঁর ‘জয়বাংলা-মুক্তিফৌজ ও শেখ মুজিব’ গ্রন্থে (পৃঃ ২২৩-২৩৮) এ প্রসঙ্গে যা বর্ণনা করেছেন তা’ সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে তুলে ধরা হ’লঃ
প্রধান কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদিরের প্রশ্নের উত্তরে সাইদুর রহমান বলেনঃ ‘১৯৬৬ সালের জুন মাসে ১৫ দিন অন্তর আমার বাসায় দু’টো গোপন বৈঠক বসে। প্রথম বৈঠকটিতে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে
পৃষ্ঠা নং: ৩৬৮

লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন, সুলতান উদ্দিন, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান ও খুরশিদ। দ্বিতীয় বৈঠকটিতেও তাঁরা ছিলেন। উক্ত বৈঠক দু’টোতে পার্টির সদস্যদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান সেদিন দলীয় কার্যের অগ্রগতি সম্পর্কে এক রিপোর্ট পেশ করেন। উক্ত রিপোর্টে তিনি কোথায় কোথায় নতুন লোক নিয়োগ করেছেন, সামরিক ব্যক্তিদের সাথে তাঁর যোগাযোগ কেমন হয়েছে। ইত্যাদি বিষয় তিনি বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন। অর্থসংক্রান্ত বিষয় নিয়েও সেখানে আলোচনা চলে। তবে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির আর কোন উপায় নাই।
বোধ হয় জুলাই মাসে মোয়াজ্জেম হোসেন একটি অস্ত্ৰতালিকা দিয়ে আমাকে ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারী পি.এন. ওঝার সাথে দেখা করতে বলেন। তালিকাটি মানিক চৌধুরীর দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু ২১ তারিখে তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। উল্লেখযোগ্য যে, তিনি এর পূর্বে আমাকে সহ দু’ একবার পি. এন. ওঝার সাথে দেখা করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৮ই মে তারিখে গ্রেফতার হন। সে সময় আওয়ামী লীগের জরুরী বৈঠক বসে। বৈঠকে যোগদানের জন্যই আমি আর মানিক চৌধুরী ঢাকা গিয়েছিলাম। সে সময় মানিক চৌধুরী ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে মিটার ওঝার সাথে আমার আলাপ করিয়ে দেন। কিন্তু জুলাই মাসে অস্ত্রতালিকাটি আমি মিস্টার ওঝার হাতে দিতে সাহস পাই নি। কারণ শেখ সাহেবের ৬-দফাকে ভিত্তি ক’রে তখন আওয়ামী লীগের কর্মীদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছিল। জুলাই-এর শেষদিকে মিস্টার ওঝা চট্টগ্রামের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হন। সেদিন মানিক চৌধুরীর খোঁজ-খবর নেন এবং পরদিন সন্ধ্যায় রেলওয়ে রিফ্রেশমেন্ট রুমে তালিকাটি দিয়ে আসতে বলেন। তাঁর নির্দেশমত পরদিন সন্ধ্যায় আমি তালিকাটি মিস্টার ওঝার কাছে পৌঁছে দিই।
মিস্টার ওঝা আমাকে নির্দেশ দিলেন যে ঢাকায় গিয়ে কোন পাবলিক ফোনে সকাল ১০টা নাগাদ তাঁর সাথে যেন আমি কথা বলি। তিনি ফোনে
পৃষ্ঠা নং: ৩৬৯

আলাপের ব্যাপারে বললেন, ‘আমি সাঈদ বলছি। ভিসার বিষয়ে মিস্টার ওঝার সাথে আলাপ করতে চাই। যেই ফোন ধরুক, বুঝে নেবে।’
—এইভাবে নির্দেশ দিলেন।
আগস্টের প্রথম দিকে আমি মোয়াজ্জেম হোসেন সহ তাঁর গাড়ীতে ঢাকায় আসি। স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানও আমাদের সাথে ছিলেন। মিস্টার ওঝার নির্দেশ মাফিক সব ব্যবস্থা ঠিক ক’রে তাঁর সাথে একত্রিত হবার দিন ও স্থান ঠিক ক’রে নিই। ঢাকা আসার পথে মোয়াজ্জেম হোসেন ক্যাপ্টেন এস. আলমের বাড়ীতে যান এবং সেখানে আমার সাথে মিঃ আলমের পরিচয় ঘটে। ঢাকায় এসে আমি গ্রীন হোটেলে উঠি আর মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান ধানমণ্ডিতে তাঁর আত্মীয় ডাঃ খালেকের বাসায় ওঠেন।
মিঃ ওঝার সাথে আলোচনা করার পর আমরা ‘সাকুরা’র সামনে অপেক্ষা করি। তিনি একটি গাড়ীতে সেখান থেকে আমাদের তুলে নিয়ে ধানমণ্ডির এক বাসায় ওঠেন। অস্ত্রের তালিকা নিয়ে লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে মিস্টার ওঝার আলোচনা হয়। তিনি আমাদেরকে জানান যে, অস্ত্রের ব্যাপারে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করবেন। আমরা অর্থসংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ করলে তিনি তাঁর অক্ষমতার কথা বলেন। তবে অস্ত্রের বিষয়ে মাসখানেক পরে তাঁর সাথে যোগাযোগের কথা বলেন। আমাদেরকে দ্বিতীয় রাজধানীর নিকটে নামিয়ে তিনি চলে যান।
মিস্টার ওঝার নির্দেশমত সেপ্টেম্বরের দিকে পাবলিক টেলিফোনে তাঁর সাথে আলাপ করি। তিনি রাত ন’টায় সেরিমনিয়াল আর্চ-এর সামনে অপেক্ষা করতে বলেন। যথাসময়ে আমাদের দু’জনকে (আমি ও মোয়াজ্জেম হোসেন) গাড়ীতে তুলে নিজ বাসার দিকে চলে গেলেন। তিনি আমাদের বললেন যে, ভারত সরকার অস্ত্র সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছেন; কিন্তু নির্বাচন উপলক্ষে তাঁরা সকলেই ব্যস্ত, তাই অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে পরে আলোচনা করা হবে।
একটু থেমে ডাঃ সাইদুর রহমান আবার বলতে শুরু করলেনঃ মানিক চৌধুরী জেল থেকে ছাড়া পেলেন ১৯৬৭ সালের জানুয়ারীতে।
পৃষ্ঠা নং: ৩৭০

মোয়াজ্জেম সাহেব তখন চট্টগ্রামে। একদিন স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান আমার বাসায় গিয়ে জানালেন আমি যেন মানিককে নিয়ে শিগগীর ঢাকায় গিয়ে মিঃ ওঝার সাথে অস্ত্রের বিষয়টা ঠিক ক’রে ফেলি। আমি ৮ই মার্চ ঢাকা এসে গ্রীন হোটেলে উঠি। পরদিন মানিক চৌধুরী আসেন এবং আমার সাথেই উক্ত হোটেলে থাকেন। মিঃ ওঝা ১০ই মার্চ রাত ন’টার দিকে সেরিমনিয়াল আর্চের নিকট থেকে আমাদেরকে তাঁর গাড়ীতে ক’রে তাঁর বাসায় নিয়ে যান। মোয়াজ্জেম সাহেব তখন ঢাকায় ছিলেন এবং তিনিও আমাদের সাথে ছিলেন। সেখানে মিঃ ওঝা জানালেন যে, শ্রীমতি ইন্দিরা দেবী’র প্রধান মন্ত্রিত্বের নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মানিক চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেদিন পাঁচ হাজার টাকা দিলেন। তিনি তো প্রথমে টাকা সাহায্য দিতে অসম্মত হয়েছিলেন, পরে আবার সম্মত হয়েছিলেন কেন সেটা আমি জানি না।
শ্রীমতি ইন্দিরা দেবী প্রধানমন্ত্রীর পদে আবার অধিষ্ঠিত হয়েছেন, -এরপর ৩১শে মার্চ মিঃ ওঝার সাথে দেখা করি। তিনি জানালেন যে, তাঁদের সরকার ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ গঠনের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে প্রস্তুত আছেন। কথা পাকাপাকি করার জন্য ভারতের কয়েকজন পদস্থ কর্মচারী ও সামরিক অফিসারের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হতে হবে। এই বৈঠক আগরতলায় বসবে।
আগরতলা বৈঠকে স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান ও আলী রেজাও গিয়েছিলেন। আমি স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানের কাছ থেকে পরে জেনেছিলাম, আগরতলা বৈঠক সফল হয়েছে। মিঃ ওঝা পূর্বের পাঁচ হাজার টাকা ছাড়া আরও দশ হাজার টাকা মানিক চৌধুরীকে দিয়েছিলেন। এ খবর আমি পরে মানিক চৌধুরীর কাছ থেকে পাই। সব টাকাই লেঃ মোয়াজ্জেম সাহেবকে দেওয়া হয়।
বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলি খান বাহাদুর নাজির উদ্দীন সাহেবের এক প্রশ্নের জবাবে ডাঃ সাইদুর রহমান বলেন যে, ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে তাঁর চট্টগ্রামের বাসা থেকে রাত দু’টোয় গ্রেফতার ক’রে স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় সেখান থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। তারপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।
পৃষ্ঠা নং: ৩৭১

সে সময় সালাম খান বলে ওঠেনঃ আটক থাকাকালীন স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারীর কাছে লিখিত এক দরখাস্তে আপনি বলেছেন যে, আই-জি স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে নিয়ে গিয়ে আপনাকে এক কুঠরীতে আটক রাখা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় আপনাকে চেয়ারের হাতল দিয়ে মারে—চড়, ঘুষি ইত্যাদি মেরে আপনার দেহের নানা জায়গা জখম ক’রে দেয়। জ্ঞান থাকা পর্যন্ত এ ধরনের অমানুষিক অত্যাচার চলতে থাকে। তিন দিন ধরে এরূপ নির্যাতন চলতে থাকে এবং পরে জোর ক’রে ডিকটেশন দিয়ে স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নেয়।
এ প্রশ্নের জবাবে সাইদুর রহমান বলেনঃ ‘দরখাস্ত আমি ঠিকই লিখেছি, তবে আপনার কথা সত্য নয়।’
সালাম খান দরখাস্তের এক কপি সাক্ষীর হাতে দিয়ে জোর ক’রে পড়ে শোনাতে বললেন।
সাক্ষী সাইদুর রহমান অপারগতার কথা ঘোষণা করলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলে উঠলেনঃ ‘না, না, আপনি এক্ষুনি পড়ুন।’
ডাঃ সাইদুর রহমান অনিচ্ছা সত্ত্বেও জায়গা-জায়গা বাদ দিয়ে দরখাস্তখানি পড়ে শেষ ক’রে বললেন, ‘যা লিখা হয়েছে, তা’ সত্য নয়।’
সরকারী কৌঁসুলির নির্দেশক্রমে তিনি মানিক চৌধুরী, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, খুরশিদ, সুলতান উদ্দিন আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে সঠিকভাবে সনাক্ত করলেন।
তারপর আবদুস সালাম খান, বিবাদী পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি, উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আওয়ামী লীগে কতদিন থেকে আছেন?’
‘প্রায় সৃষ্টির পর থেকেই।’
‘মুজিবুর রহমানের ৬-দফা সম্বলিত পুস্তিকা কি আপনি পাঠ করেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কি জনসাধারণের মধ্যে সেগুলো প্রচার করেছিলেন?’
‘করেছি।’
‘আপনার নিশ্চয় মনে আছে, ৬-দফার মূল কথা ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আদায় করা।’
‘হ্যাঁ।’
পৃষ্ঠা নং: ৩৭২

‘আশা করি আপনি ভালভাবেই জানেন যে, ৬-দফার ২ দফায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা নির্দেশিত হয়েছে। উক্ত ২-দফায় দেশরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ স্টেট বা প্রদেশের হাতে থাকবে। এই দফায় আরো বলা হয় যে, দুটো পৃথক অথচ অবাধ বিনিময় মুদ্রা চালু কিংবা বর্তমানের মতোই দু’টো প্রদেশে একই মুদ্রা চালু থাকতে পারে। তবে শাসনতন্ত্রে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মুদ্রা পাচার হতে না পারে। এজন্য পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গঠন করতে হবে।
‘হ্যাঁ, এসব আমি পড়েছি।’
‘পঞ্চম দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা অঙ্গরাজ্যগুলোই সমানভাবে মিটাবে এবং আরও বলা হয়েছে যে, দেশে উৎপন্ন দ্রব্যাদি চলাচলে কোন রকম বাধানিষেধ থাকবে না।
কৌঁসুলির এই কথায় সাক্ষী সম্মতি জানাল।
সালাম খান আরও জিজ্ঞাসা করলেনঃ “৬ষ্ঠ দফায় যে আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর কথা বলা হয়েছে তাতে আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্যই যে পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারী গঠনের প্রয়োজন, তা’ ঠিক নয় কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘১৯৬৫ সালে লাহোরে শেখ মুজিবুর রহমান এই ৬-দফা ঘোষণা করেছিলেন—আপনি কি তা’ জানেন?’
‘আমার ঠিক স্মরণ নেই।’
৬-দফা প্রকাশের পর প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করেন—এই আন্দোলনের ফলে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী এবং তা’ দমনের জন্য অস্ত্র প্রয়োগের প্রয়োজন হবে- এ সমস্ত কথা কি আপনি জানেন?’
‘আমার মনে নেই।’
‘আপনি জানেন কি, ৬-দফা ঘোষণার পর বহু আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়?’
পৃষ্ঠা নং: ৩৭৬
‘হ্যাঁ।’ ১৯৬৬ সালের মে মাসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু আওয়ামী লীগ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।’
‘শেখ সাহেব ৬-দফার ব্যাখ্যা বহু জায়গায় বক্তৃতা দানকালে করেছিলেন —আপনি কি তা’ জানেন?’
‘চট্টগ্রামের এক জনসভায় তিনি ৬-দফা কর্মসূচীর ব্যাখ্যা দান করেন। কিন্তু অন্য জায়গার কথা আমি জানি না।’
‘১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দাবী তুলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান -সে খবর কি আপনি রাখেন?’
‘জী, হ্যাঁ।’
‘চট্টগ্রামে নৌ-বাহিনীর সদর দফতর স্থাপন, পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারী একাডেমী এবং অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী স্থাপনেরও দাবী তুলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান—আপনি কি তা’ জানেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘দাবীগুলো কি মেনে নেওয়া হয়েছিল?’
‘না, তবে জয়দেবপুরে নাকি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী তৈরী হচ্ছে—এ খবর শুনেছি।’
‘সমুদ্রের পানি থেকে যে লবণ মানুষ তৈরী করে—তার উপর কেন্দ্রীয় সরকার শুল্ক বসিয়েছেন—তা’ কি আপনি জানেন?’
‘হ্যাঁ।’
আপনার কি মনে হয় —পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লবণ আমদানী যাতে ব্যাহত না হয় -তাই এ শুল্ক বসানো হয়েছে?’
‘আমি ঠিক বলতে পারব না।’
এ সময় সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি উঠে বললেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়ে এসব প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক।
সালাম খান মুচকি হেসে বললেনঃ ‘এসব প্রশ্ন যথার্থ প্রাসঙ্গিক, তাই প্রমাণ করছি।
ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির নির্দেশে সালাম খান আবার সাক্ষীকে জেরা করতে শুরু করেন।
পৃষ্ঠা নং: ৩৭৪

‘চাকুরীর ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্যের দাবী এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবী পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য—আপনার কি মনে হয়?’
‘আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘ভারতীয় হাই কমিশনের মিস্টার ওঝার সাথে আপনাদের যে ষড়যন্ত্র তা’ সম্পূর্ণভাবে কল্পিত এবং এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং সংখ্যাসাম্যের দাবীকে বানচাল করার জন্যই এই কাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে—আপনার কি মত?’
‘আমি যা বলেছি তাই সত্য।’
‘মানিক চৌধুরী আপনাকে নাকি বলেছিলেনঃ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে— আপনার কি বিশ্বাস হয়, প্রতিষ্ঠিত সরকারের হাত থেকে শক্তি প্রয়োগে ক্ষমতাচ্যুত করা কি সম্ভব?’
‘মানিক চৌধুরীই আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কর্মচারীরা বিদ্রোহ করবে এবং সমস্ত সামরিক ছাউনি দখল ক’রে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন করবে।’
‘আচ্ছা বলুন তো পূর্ব পাকিস্তানী কত জন সেনাবাহিনীতে কাজ করেন?’
‘আমি জানি না।’
‘আপনি নিশ্চয় জানেন যে, সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানীরা কাজ করে শতকরা ৪ জন এবং প্রতি ৯০ জন অফিসারে একজনও পূর্ব পাকিস্তানী না?’
‘আমি ঠিক জানি না।’
সওয়ালের মোড় ঘুরিয়ে সালাম খান সাক্ষীকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেনঃ
‘ঢাকায় এসে আপনি কি ‘আরজু হোটেল’-এ উঠেছিলেন?
‘হ্যাঁ।’ ‘সেখানে কয়দিন ছিলেন?’
‘তিন দিন।’
‘হোটেল রেজিস্টারে আপনি নাম এন্ট্রি করেছিলেন?’
‘করেছিলাম।’
‘আপনি কবে ঢাকায় এসেছিলেন?’
‘১৯৬৬ সালের ১৯শে মে।’
পৃষ্ঠা নং: ৩৭৫

সালাম খান হোটেলের রেজিস্টারটি নিয়ে সাক্ষীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আপনার নাম কোথায় এনট্রি করা রয়েছে একটু দেখিয়ে দিন?’
ডাঃ সাইদুর রহমান রেজিস্টারখানা নিয়ে অনেক খোঁজার ভান ক’রে বললেন, ‘আমার নাম এখানে দেখতে পাচ্ছি না।’
আপনি লেঃ মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়ে যে গাড়ীতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন মিস্টার ওঝার সাথে দেখা করতে—সেই গাড়ীটি কি দুই দরজাওয়ালা অথবা চার দরজাওয়ালা?’
‘আমার মনে নেই।’
‘আপনি বললেন যে গাড়ীটি ছিলো হিলম্যান।’
‘হবেও বা।’
‘আপনি জানেন না হিলম্যান গাড়ির কয়টি দরজা?’
‘না।’
‘সেবার গ্রীন হোটেলে উঠে কি নাম এন্ট্রি করেছিলেন?’
‘জানি না।’
আমি বলছি, ১৯৬৬ সালের ১৯শে মে মোটেই আপনি ঢাকায় আসেন নি বা গ্রীন হোটেলে ওঠেন নি।’
‘তা’ সত্য নয়।’
‘তা’হলে হোটেল রেজিস্টারে নাম এনট্রি করা নেই কেন?’
‘মিঃ ওঝার সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলাম বলে হোটেলে নাম রেজেস্ট্রি করি নি।’
‘কিন্তু ১৯৬৭ সালে ৮ই মার্চ মিঃ ওঝার সাথে যখন গোপনে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন তখন তো নাম রেজিস্ট্রি করিয়েছিলেন?’
সাক্ষী নিরুত্তর থাকেন।
‘হোটেল সাকুরার নিকটেই সেরিমনিয়াল আর্চ থেকে কোন পথে মিঃ ওঝার বাড়িতে যেতে হয়?’
‘আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে সভাশেষে শেখ মুজিবুর রহমান কি আপনার বাসায় উঠেছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
পৃষ্ঠা নং: ৩৭৬

‘তাঁর সাথে আর কে কে ছিল?’
‘মানিক চৌধুরী।’
‘আপনার বাড়িতে সে সময় আর কেউ ছিলেন?’
‘না।’
‘মানিক চৌধুরী আর মুজিবুর রহমান ফিরেছিলেন কিসে?’
‘মানিক চৌধুরীর কারে।’
‘আমি জানি, মানিক চৌধুরীর কোন কার নেই।’
‘আছে। আমি বহুবার সে কারে ঘুরেছি।’
‘গাড়ির নাম কী?’
‘মনে নেই।’
‘তার নম্বর কতো?’
‘তাও মনে নেই।’
‘আমি হলপ ক’রে বলতে পারি, শেখ মুজিবকে এই ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানোর জন্যই একথা বলছেন। শেখ সাহেব আপনার বাসায় ওঠেন নি।’
‘না, একথা ঠিক নয়।’
… … … …

‘১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে আপনি কি ঢাকায় এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। আগস্টের ২৯ বা ৩০ তারিখে আমি ঢাকায় এসে ‘গ্রীন হোটেল’-এ উঠেছিলাম। মানিক চৌধুরী আমার সাথেই ছিলেন।’
‘মানিক চৌধুরী কি গ্রীন হোটেলেই উঠেছিলো?’
“না, তিনি উঠেছিলেন ‘হোটেল ক্যাসেরিনায়’।”
সালাম খান ক্যাসেরিনা হোটেলের রেজিস্টারখানা ডাঃ সাইদুর রহমানের হাতে দিয়ে মানিক চৌধুরীর নাম খুঁজে বের করতে বললেন। তিনি মানিক চৌধুরীর নাম খুঁজে পেলেন না।
‘আপনি জবানবন্দীতে বলেছেন যে, আপনি আর মানিক চৌধুরী। একই হোটেলে অর্থাৎ গ্রীন হোটেলে উঠেছিলেন?’
‘না, তা ঠিক নয়।’
আবদুস সালাম খান আর প্রশ্ন না ক’রে বসে পড়লেন। তারপর
পৃষ্ঠা নং: ৩৭৭

সওয়াল করার জন্য উঠে দাঁড়ালেন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান। তিনি সাক্ষীকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
‘আপনি কি আওয়ামী লীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পার্টিতে যোগ দিয়ে ছিলেন, না, এর পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কোন উদ্দেশ্য ছিল?’
‘না, আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম।’
‘আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে যে সব দাবী-দাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের বেশীর ভাগ লোকের মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে আপনি কি তা’ বিশ্বাস করেন?’
‘হ্যাঁ, বিশ্বাস করি।’
… … … …

‘আপনাকে রাজসাক্ষী হ’তে প্রথমে কে বলেন?’
‘আমার স্বীকারোক্তি দানের পর মেজর নাসের এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি রাজসাক্ষী হতে চাই কি না।’
‘আচ্ছা, বলুন তো, মিঃ ওঝার বাড়ী কী রকম?’
‘দোতলা বাড়ী।’
‘সেটা রাস্তার কোন পাশে?’
‘ঠিক মনে নেই।’
‘আপনি তার বাড়ীতে ক’বার গিয়েছেন?’
‘বোধ হয়—দু’বার।’
‘আপনারা কোথায় বসতেন?’
‘দোতলার ড্রয়িং রুমে।’
‘মিঃ ওঝার মাথায় কি টিকি ছিল?’
‘আমি লক্ষ্য করি নি।’
… … … …

আতাউর রহমান বসে পড়ার সাথে সাথেই বিবাদী পক্ষের কৌঁসুলি জুলমত আলী খান জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘১৯৬৬ সালের ১৮ই মে থেকে ২২শে মে আপনি কি আপনার শ্বশুর বাড়ী সীতাকুণ্ডে ছিলেন?’
‘আমি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে আপনি এখন যেতে পারেন।’
পৃষ্ঠা নং: ৩৭৮

এরপর যিনি সাক্ষ্য দেন তাঁর নাম মীর্জা রমিজ। তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যা বললেন সাংবাদিক কলহনের গ্রন্থ (পৃঃ ২৩৮ ২৪৯) থেকে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নীচে তুলে ধরছিঃ
“১৯৬৬ সালের জুন-জুলাই মাসে লেঃ মোয়াজ্জেম হোসেন এবং নূরুজ্জামানের সঙ্গে এক সভায় ‘স্বাধীন পূর্ব বাংলা’ গঠন সম্পর্কে আলোচনা হয়। উক্ত বছরেই এক গোপন সভায় কে. এম. এস. রহমান সি. এস. পি-র সাথে আলাপ হয়। তিনি তখন চিটাগাংয়ের উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। তিনি দু’একবার আমার বাসায়ও গিয়েছিলেন। এক সময় আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে কি টিকতে পারবে?’ তিনি দৃঢ়স্বরেই বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ’, এবং তার কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় আমার ফ্লাটে এক গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন, ক্যাপ্টেন আলম, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন মুতালেব, লীডিং সীম্যান সুলতান উদ্দিন, স্টুয়ার্ড আহমদ এবং স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় লীডিং সীম্যান সুলতান উদ্দিনকে সনাক্ত করতে বলায় সাক্ষী মীর্জা রমিজ সকলের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন এবং অবশেষে নূর মহম্মদকে দেখিয়ে বললেন, ইনি সুলতান উদ্দিন। এধারে দর্শকমণ্ডলীর ভেতরে মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি উত্থিত হয়েছে। সাক্ষী রমিজ বেশ বুঝতে পেরেছেন, তাঁর সনাক্তকরণ ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। তাঁর বিব্রত ভাবকে ঢাকার জন্য তিনি বলতে আরম্ভ করলেনঃ লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম জানালেন, ‘ভারত অর্থ সাহায্য করতে তৈরী। তবে এ আন্দোলন পরিচালনা করবে কে? কেউ কেউ মন্তব্য করলেন—সামরিক অফিসার আবার কেউ কেউ বললেন, রাজনৈতিক নেতাদের হাতেই এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া দরকার।’ তবে উক্ত সভায় এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নি। উক্ত সভায় আমি প্রশ্ন তুলেছিলামঃ ‘পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হ’লে কি অন্যান্য রাষ্ট্র আমাদের স্বীকৃতি দেবে?’ কে. এম. এস. রহমান সি. এস. পি. জানালেন, এ সম্পর্কে ভারতের সাথে আলাপ হয়ে গেছে। ভারত এবং তার সমর্থক রাষ্ট্রগুলো আমাদের স্বীকৃতি দেবে। আবার আমি জিজ্ঞেস
পৃষ্ঠা নং: ৩৭৯

করলাম, পরে ভারত যদি আমাদের আক্রমণ করে? আমার এই প্রশ্নের জবাবে রহমান সাহেব জানালেন, এ যুগে তা’ সম্ভব নয়। কারণ আন্তর্জাতিক অনেক বাধা-নিষেধ রয়েছে। উক্ত সভায় লেঃ মোয়াজ্জেম হোসেন ক্যাপ্টেন মুতালিবের ওপর প্রাক্তন সামরিক কর্মচারীদের সংঘবদ্ধ করার এবং অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন।
অক্টোবর মাসের এক বিকেলে লেঃ মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর ‘মস্কোভিচ’ গাড়ি ক’রে আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেলেন। সেখানে কর্নেল ওসমানী এবং কর্নেল শেখ-এর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ১৯৬৭ সালের মার্চ মাসে লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে আমার বাসায় দেখা করলেন। আমার বাসায় এক বৈঠক হ’ল। লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন, মিঃ ওঝার কাছ থেকে অনেক অর্থ সাহায্য পাওয়া গেছে। রুহুল কুদ্দুস ও আহমদ ফজলুর রহমান সাহেবও অর্থ সংগ্রহ করছেন। কিন্তু আরও টাকার প্রয়োজন। আমার মনে হয়, আমাদের এখন যা টাকা রয়েছে তা’ দিয়ে একটি বাড়ী ভাড়া ক’রে ব্যবসা করা যায়। এতে দলের সম্পদও বাড়বে এবং দলের কর্মীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মী বলেও চালানো যাবে।
ঠিক এই মুহর্তে বাদীপক্ষের কৌঁসুলি সাক্ষীর হাতে একখানা টেলিগ্রাম দিয়ে বলেন, দেখুন তো, এই টেলিগ্রামটা চিনতে পারেন কি না? টেলিগ্রামটির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে রমিজ সাহেব বলতে লাগলেনঃ ১৯৬৭ সালের ২৯শে মার্চ মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকায় আসছেন বলে এই টেলিগ্রামটি করেন। আমাকেও ঢাকায় যেতে বলেন। ঢাকায় আমার ফ্ল্যাটেই এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, সাবেক কর্পোরাল সামাদ, কে. এম. শামসুর রহমান, ক্যাপ্টেন মুতালিবও উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায় ওয়ারলেস সেট সংগ্রহ নিয়ে আলোচনা হয়। আমাকে পঁচিশ হাজার টাকা দেয়া হ’ল বাড়ী ভাড়া ও ব্যবসা করার জন্য। ১৩ নং গ্রীন স্কোয়ারে একটা বাড়ী ভাড়া নিলাম, ওখানেই আমাদের গোপন সভা বসত। সেখানে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও অস্ত্র সংগ্রহ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হ’তো। এ বাড়ীতে মে মাসে ছয়-সাতটি
পৃষ্ঠা নং: ৩৮০

সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বাড়ীতে বাস করতেন সুবেদার জে. ইউ. আহমদ, প্রাক্তন কর্পোরাল সামাদ, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, হাবিলদার দলিল উদ্দিন এবং লুৎফর হুদা। এই বাড়ীতেই আগরতলায় ভারতীয় সামরিক অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে যোগদানের জন্য যে প্রতিনিধিদল যাবেন তাঁদের নামের তালিকা এক সভায় ঠিক করা হয়। ফেনী হয়ে আগরতলা যাওয়ার কথাবার্তা এখানেই ঠিক হয়। ফেনী থেকে স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান আমাকে ট্রাঙ্ককল করেছিলেন। সেটা ছিল ১৯৬৭ সালের ১১ই জুলাই। ফেনীতে আমাকে যেতে বললেন। প্রতিনিধিদলটি ফেনীর ‘ডেনোফা হোটেল’-এ উঠবেন তা’ পূর্বেই ঠিক করা হয়েছিল। পি. আই. এ-র ‘ডজডার্ট’ নিয়ে চিটাগাং থেকে ফেনী গেলাম। ডজডার্টটা বেশি ব্যবহার আমিই করতাম। ফেনী থেকে ফিরতে রাত হবে ভেবে পি. আই. এ-র আনোয়ার হোসেনকে সাথে নিই। বিকেল ৬ টার দিকে ফেনী পৌঁছাই। ‘ডনোফা হোটেল’-এ গিয়ে দেখলাম, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, প্রাক্তন নায়েব সুবেদার জে. ইউ. আহমদ, আলী রেজা, প্রাক্তন কর্পোরাল সামাদ, হাবিলদার দলিল উদ্দিন আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এই প্রতিনিধি দলটি ভোর চারটায় সীমান্ত অতিক্রম করবে বলে ঠিক হয়েছিল। ডজডার্ট-এ ক’রে তাঁদের আমি বেলুনিয়ায় পৌঁছে দিলাম। তাঁরা সীমান্তের অপর পারে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। যে গাড়ি দিয়ে তাঁদের পৌছে দিয়েছিলাম তার নম্বর কে. এ. ই. ৩১৯৪। …………
……….আগরতলা বৈঠক শেষ ক’রে আলী রেজা আমার সাথে দেখা করেন। তাঁর কাছেই শুনেছি ভারতীয় এক ক্যাপ্টেন সীমান্ত থেকে গাড়ি ক’রে তাঁদের আগরতলায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারত সরকারের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন একজন কর্নেল এবং একজন মেজর। আমাদের প্রতিনিধি দল তাঁদের নিকট অস্ত্রশস্ত্রের এক তালিকা দেন। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল মেশিনগান, সাব মেশিনগান, হাতবোমা প্রভৃতি। ভারতীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন, অস্ত্র সাহায্যের ব্যাপারে তাঁরা বিবেচনা করবেন এবং সে খবর তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনারের মারফত জানাবেন। যে দু’ লক্ষ টাকা দেয়ার কথা হ’ল তাও নাকি ডেপুটি হাই কমিশনারের মাধ্যমে দেয়া হবে।
পৃষ্ঠা নং: ৩৮১

বাদী পক্ষের কৌঁসুলি মঞ্জুর কাদেরের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন, টাকা পাওয়ার বিষয়ে আমি লেঃ মোয়াজ্জেম সাহেবকে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আমার কৌতুহলে বিরক্ত হন। তবে, পার্টির টাকা দিয়ে একটা হিলম্যান গাড়ি ও একটা ফিয়াট গাড়ি কিনেছিলাম। অন্যান্য কাজের জন্যও আমাকে কয়েক হাজার টাকা দেয়া হয়েছিল। তাতে মনে হয়, টাকাটা ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল।
মীর্জা রমিজ-এর জবানবন্দী শেষ হ’লে বিবাদী পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুস সালাম খান উঠে জেরা করতে শুরু করেন।
‘আপনার হাতে পার্টির কাজের জন্য কত টাকা দেয়া হয়েছিল?’
‘পঁচিশ হাজার টাকা।’
‘তা’ থেকে নিজের জন্য আপনি কত খরচ করেছিলেন?’
‘দু’হাজার টাকা।’
‘স্কুটার কিনতে কয় হাজার টাকা দিয়েছিলেন?’
‘দুই হাজার টাকা।’
‘টাকাটা কি নগদ দিয়েছিলেন?’
‘না, চেকে।’
‘কি চেক-বীয়ারার না ক্রস?’
‘ক্রস-চেক।’
‘গোপন কাজের জন্য ক্রস-চেক উপযোগী?’
সাক্ষী নিরুত্তর থাকলেন।
‘আপনি পি. আই. এ-র কর্মচারী—মাসে কত টাকা বেতন পান?’
‘বারো শ’ টাকা।’
‘আপনি বলেছেন যে, ’৬৭ সালের মে মাসে গ্রীন স্কোয়ারের বাড়ীতে অনেকগুলো মিটিং হয়। ক্যাপ্টেন মোতালেবও সে সব সভায় উপস্থিত থাকতেন। আচ্ছা, ওই বছর এপ্রিল মাসে ক্যাপ্টেন মোতালেব কোথায় ছিলেন জানেন কি? কোনো হাসপাতালে ছিলেন কি?’
‘হ্যাঁ, মার্চের শেষ ভাগে ঢাকা মেডিক্যালে এবং এপ্রিলে কুমিল্লা হাসপাতালে ছিলেন।’
‘কিন্তু আমি যদি বলি তিনি ’৬৭ সালের ৩১শে মে পর্যন্ত ঢাকা
পৃষ্ঠা নং: ৩৮২

Previous               Next