You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ
কামরুদ্দীন আহমদ

রাজনৈতিক জীবনের প্রস্তুতি-পর্ব

আমার শিক্ষকতা জীবন অত্যন্ত অল্প দিনের। বাষট্টি বছরের জীবনে মােটে পাঁচ বছর। আর সে পাঁচ বছরও নির্ভেজাল শিক্ষকতা নয়। তার কারণ, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের ও মন্ত্রিসভা গঠনের পর বাংলার মুসলমান সমাজের মধ্যে একটা নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ দেখা দেয়। যে সমাজ এত দিন সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সে সমাজ সমস্যাসচেতন হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলাে। পণ্ডিত নেহরু বলেছিলেন :
Even the poorest peasant added to his feeling of self-respect and self-reliance. For the first time he felt that he counted and could not be ignored. Government was no longer an unknown and intangible monster, separated from him by innumerable layers of officials, whom he could not easily approach and much less influence, and who were bent on extracting as much out of him as possible. The seats of the mighty were now occupied by men he had often seen and heard and talked to.
পরিষদের সদস্যরা তাদেরই গাঁয়ের লােক, তাদের ভােটেই পরিষদের সদস্য কেউ কেউ মন্ত্রী বা অন্য কিছু আর তাদের হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী, যাকে সব জেলার লােকে দেখেছে—জেলা জজের কোর্টে ফৌজদারি মামলা করতে, গল্প করতে—লােক হাসাতে। ১৯৩৭ সালে সাধারণ লােক যারা বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অথচ যারা ছিল শােষিত, অবহেলিত, পদদলিত, নির্যাতিত, যারা জমিদারের খাজনার দায়ে জমিদারের কাছারিতে আটক রয়েছে, দৈহিক শাস্তি পেয়েছে, যারা মহাজনের চক্রবৃদ্ধি হারের সুদ কোনাে দিন শােধ করতে পারেনি বলে সর্বস্ব হারিয়েছে—যারা সারা বছর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ধান, পাট ঘরে তােলার আগে ক্ষুধার তাড়নায় অর্ধেক দামে
১১০
বিক্রি করেছে ব্যবসায়ীর কাছে—কারণ, ক্ষুধার জ্বালায় সে দাদন নিতে বাধ্য। হয়েছে। গায়ের দরিদ্র অনার্য হিন্দু ও সাধারণ মুসলমান যেন স্বর্গ হাতে পেল ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর। ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে সুরেন ব্যানার্জি ও দেশবন্ধুর নেতৃত্বে বর্ণ হিন্দু সমাজ যে সংগ্রাম করেছিল—যারা ১৯১১ সালের ব্রিটিশ সরকারের ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়েছিল, তারাই যখন দেখল যে রাজনৈতিক ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের হাতে গেল, তখন তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা ভুলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচারে ব্যস্ত হলেন। পণ্ডিত নেহরু লিখেছেন :
Thus the intelligentsia of Bengal, which had played such a notable part in Indian Politics and struggle for freedom, suddenly realized that it had very weak position in the Provincial Legislature fixed and limited by statute.
এ অবস্থা সৃষ্টির জন্য কংগ্রেসও কম দায়ী নয়। গভর্নর প্রথমে শরৎ বােসকেই ডেকেছিলেন মন্ত্রিসভা গঠন সম্বন্ধে আলােচনা করার জন্য, কারণ। তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। কিন্তু তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠন। করতে অস্বীকার করেন।
ফজলুল হকের প্রজা পার্টিকে তিনি ও তাঁর দল সমর্থন করতে রাজি হলেন—শর্ত দিলেন যে ফজলুল হককে তাঁদের পার্টির কর্মসূচি মেনে চলতে হবে। হক সাহেব রাজি হলেন। তিনি কৃষক-প্রজা পার্টির সদস্যদের এ সুসংবাদ দিলেন এবং আরও জানালেন যে কংগ্রেস মন্ত্রিসভায় যােগ দেবে।
—কিন্তু সম্পূর্ণ সমর্থন করবে একটা কর্মসূচির ভিত্তিতে। সে কর্মসূচির বিরুদ্ধে তাঁর দলের কেউ আপত্তি করলেন না—তবে তাঁদের মত হলাে যে প্রথম শর্তটি বিলম্বে কার্যকর করা হবে। প্রথম শর্তটি ছিল ‘সমস্ত রাজবন্দীর মুক্তি। তাদের যুক্তি হলাে যে এ শর্তটি কার্যকর করতে গভর্নর রাজি হবেন না। ফলে হক সাহেবকে মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিতে হবে, নয় সাহসের সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হতে হবে। কৃষকের জন্য কোনাে কাজ না করে মন্ত্রিত্বে। ইস্তফা দিলে তাতে মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। ফজলুল হক সাহেব এ যুক্তি মেনে নিলেন এবং কংগ্রেসের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে কোনাে ফল না পেয়ে রাত দশটার সময় শরত্যাবুর সঙ্গে আলােচনা করার জন্য তাঁর বাড়ি যান—কিন্তু শরত্যাবুর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হলাে না, যেহেতু তিনি তখন শুয়ে পড়েছেন। ফজলুল হক সাহেব তার দলের লোেকদের কাছে ছােট হয়ে গেলেন এবং বাড়ির পথে
১১১
পা বাড়ালেন, ঠিক তখনই মুসলিম লীগের কাছ থেকে তাঁর কাছে প্রস্তাব পাঠানাে হলাে যে মুসলিম লীগ তাঁকে নেতা বলে স্বীকার করতে রাজি আছে। এবং তিনিই কোয়ালিশন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হবেন। প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করলেন এবং পরের দিন গভর্নরের কাছে তার সমর্থনকারী সদস্যদের নামের তালিকা পেশ করলেন। দেখা গেল তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে—সুতরাং সরকার তাঁকেই মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আহ্বান করল।
শরত্যাবু এবং তাঁর দল ভুল করেছিলেন এই ভেবে যে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে কংগ্রেসের যা করা সম্ভব, তা বাংলাদেশে করা সম্ভব ছিল না। রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া উচিত কিন্তু যেখানে প্রধানমন্ত্রীর দলের আপত্তি রয়েছে, সেখানে এটা নিয়ে অতটা বাড়াবাড়ি না করলে হয়তাে বাংলার ইতিহাস ভিন্ন মােড় নিতে পারত।
অন্যদিকে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় কংগ্রেসের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করার যে কারণ উপস্থিত করল তাতে তাদের অন্তরে কংগ্রেসের প্রতি সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিল। ১৯৩৫ সালের ভারত আইনের মধ্যে গভর্নরকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল যে সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব তার। কংগ্রেস গোঁ ধরে বসল যে সরকারকে ঘােষণা করতে হবে যে মন্ত্রিসভার কোনাে কাজে গভর্নর হস্তক্ষেপ করবেন না । যে কথা সেই কাজ, তাঁরা মন্ত্রিসভা গঠন করলেন ১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে পরােক্ষভাবে বড়লাট তাঁদের দাবি মেনে নেওয়ার পর। মন্ত্রিসভা গঠনের পর তারা স্কুলকে বিদ্যামন্দির বলে অভিহিত করলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম’ সংগীতকে জাতীয় সংগীত ঘােষণা করে হিন্দু-মুসলমান সব ছাত্রকে গাইতে বাধ্য করলেন। রামরাজ্য গঠন করাই তাদের উদ্দেশ্য বলে ঘােষণা করলেন। সব রকম উৎসবাদিতে ‘আরতি আর হনুমানজির প্রতিমূর্তিকে উপাসনায় হিন্দু-মুসলমান সব ছেলেমেয়েকে যােগ দিতে বলা হলাে। ভারতের মধ্যপ্রদেশের নাম পরিবর্তন করে নাম করা হলাে মহাকোশল । আর আশ্চর্য ব্যাপার হলাে যে মুসলমান সম্প্রদায় যখন এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল, তখন বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ একজন হাইকোর্ট জজকে নিয়ে একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাব দিলেন। সংখ্যালঘুর ওপর কোনাে অত্যাচার হচ্ছে কি না, তা অনুসন্ধান করে রিপাের্ট পেশ করার জন্য। মুসলিম লীগ থেকে পীরপুরের রাজার সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করে রিপাের্ট দিতে বলা হলাে। তাদের রিপাের্ট ১৯৩১ সালে যখন বেরােল, তখন মুসলমানের এ ধারণা বদ্ধমূল হলাে যে হিন্দু ও মুসলমান কি অর্থনৈতিক, কি সাংস্কৃতিক, কি সামাজিক জীবনে একত্রে বাস করতে পারবে না। এর ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রথা বাংলায়, পাঞ্জাবে, সিন্ধুতে হিন্দুরা মানতে চাইল না।
১১২
ফজলুল হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রজা আন্দোলনে ভাটা পড়তে থাকে। আমার মনে আছে, ঢাকায় রেজাই করিম নামজাদা উকিল ও জিন্দাবাহারের জমিদার বংশের গােলাম কাদের চৌধুরী ও লায়ন সিনেমার মালিক কাদের সরদার সাহেবের প্রচেষ্টায় ঢাকা শহরে এক প্রজা কনফারেন্স হয়। কলকাতা থেকে যেসব নেতা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন জনাব এ কে ফজলুল হক ও ডা, আর আহমদ (বিখ্যাত দন্ত চিকিৎসক)। ঢাকার উপরিউক্ত নেতারা খাজা সাহেবদের জন্য ঢাকা জেলায় কোনাে নির্বাচনী এলাকায় মুসলিম লীগের প্রার্থীর মনােনীত হওয়ার আশা ছিল না। কাদের সরদার সাহেবকে ঢাকা শহরের বাইরে কেউ জানত না অথচ এখানে দাঁড়াবেন নবাব সাহেব নিজে, সদরে মুসলিম লীগের প্রার্থী হবেন গজনভি সাহেবের জামাতা রেজাউর রহমান সাহেব আর সেটাই ডা. আর আহমদের নির্বাচনী এলাকা—উত্তর ঢাকায় নাজিমুদ্দিন সাহেবের ভাই খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল হাফেজ। সুতরাং রেজাই করিম সাহেবের কোনাে নির্বাচনী এলাকা থাকল না। রেজাই করিম সাহেব উত্তরখান, বাড্ডা এলাকার বহু মামলা বিনা পয়সায় করে দিয়েছেন; কৃষক প্রজার মিটিংয়ে বক্তৃতা করেছেন; মিলাদে যােগ দিয়েছেন; তাই নির্বাচনের সময় সৈয়দ আবদুল হাফিজ সাহেবের প্রজাদরদি হয়ে উঠলেন। আদতে মুসলিম লীগ আর কৃষক প্রজা পার্টিদ্বয়ের মধ্যে বিরােধ আদর্শগত ছিল না—ছিল নেতৃত্বের কোন্দল । তাই ফজলুল হক মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রজা আন্দোলনে ভাটা পড়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকে আদর্শবান হয়তাে। ছিলেন কিন্তু তাঁরা ছিলেন নগণ্য, তা নইলে কৃষক-প্রজার নেতা ফজলুল হক সাহেব তখনকার দিনে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চায়ের ব্যবসায়ে যারা অজস্র টাকার মালিক হয়েছিলেন, তাঁদেরই দলের প্রধান নবাব মােশাররফ হােসেনকে মন্ত্রী করেছিলেন, কৃষক-প্রজা পার্টির সাধারণ সম্পাদক কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমদকে বাদ দিয়ে এ ঘটনাটা প্রজা পার্টি মেনে নিয়েছিল এবং জেনেশুনেও যে ফজলুল হক মিথ্যা অভিনয় করে শামসুদ্দীন সাহেবকে বাদ দিয়েছিলেন এ অজুহাতে যে তাঁকে মন্ত্রিত্বে গ্রহণ করতে গভর্নরের ঘাের আপত্তি আছে। এর বিরুদ্ধে কোনাে জোর প্রতিবাদ করেনি, যেখানে কংগ্রেসকে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য ভাইসরয় স্বয়ং মাথা নত করেছিলেন, সেখানে শামসুদ্দিন সাহেবকে মন্ত্রী হতে আপত্তি করবে গভর্নর—এটা যে অসম্ভব, তা তারা জানত কিন্তু এমন হাস্যাস্পদ কারণ দর্শাতে জনাব ফজলুল হক সাহেবের যেমন এতটুকু বাধেনি, তেমনি বাধেনি প্রজা পার্টির সেটা মেনে নিতে। আবার সেই ফজলুল হক সাহেবই কৃষক প্রজা আন্দোলনের শ্রদ্ধেয় নেতা নওশের আলী সাহেবের জনপ্রিয়তার অপরাধে মন্ত্রিসভা থেকে
১১৩
বাদ দিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ নিয়েও প্রজা পার্টি দেশজোড়া আন্দোলন গড়ে তােলেনি। নওশের আলী সাহেব খুব বেশি দিন মন্ত্রিত্ব করেননি—তবে তাঁর এ অহংকার ছিল যে যত দিন তিনি মন্ত্রিত্বে সমাসীন ছিলেন, তত দিন তিনি মুসলিম সমাজকে টেনে তুলতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর সময়ই’ যেসব মুসলমান ডাক্তারকে সরকারি খরচে বিদেশে পাঠানাে হয়েছিল, তারা প্রায় সবাই ফিরে এসে এটা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে সুযােগ দেওয়া হলে মুসলমান ডাক্তাররাও অন্য যেকোনাে ধর্মাবলম্বী ডাক্তারের মতােই তাঁদের উৎকৃষ্টতা প্রমাণ করতে পারেন। ফজলুল হক সাহেব যখন তাঁর নেতৃত্ব নিষ্কণ্টক করার ব্যবস্থা করছিলেন, অন্য কথায় যে মই দিয়ে তিনি ওপরে উঠেছিলেন, সে মই দূরে ঠেলে ফেলে দিলেন—যাতে তাঁকে নিজের কাছে বা সমাজের কাছে নিজেকে ঋণী মনে না করতে হয়, তখনাে প্রজা নেতারা দুঃখিত হননি। তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন তিনি তাঁর একমাত্র স্রষ্টা। তাঁর সাধে বাদ সাধলেন ফরিদপুরের মৌলভি তমিজুদ্দীন খান সাহেব, যিনি এত দিন মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির দ্বন্দ্বের তিক্ত লড়াই থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। এবারে, অর্থাৎ ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে সময় বুঝে তিনি তাঁর ইনডিপেনডেন্ট কৃষক-প্রজা পার্টি’ গঠন করলেন। অন্যদিকে শ্রমিকনেতা আফতাব আলী ও খুলনার আবদুল হাকিম, শ্রমিকনেতা জামান সাহেবদের নেতৃত্বে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে এক অনাস্থা প্রস্তাবের নােটিশ দেওয়া হয়। হক সাহেব ঘর সামলানাের জন্য মৌলভি তমিজুদ্দীন সাহেব ও শামসুদ্দীন সাহেবকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করলেন। কলকাতায় তখন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দোর্দণ্ড প্রতাপ, বিশেষভাবে অশিক্ষিত মহল্লাবাসী, বস্তি এলাকার নানা প্রকৃতির। মানুষের ওপর—তিনি তাদের কী বােঝালেন জানি না, পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব যাঁরা এনেছিলেন, তাঁরা আর পরিষদ কক্ষ থেকে বেরােতে পারলেন না। ফলে অনাস্থা প্রস্তাবগুলাে আর এগােলাে না—কোনাে বিতর্ক হওয়ার সুযােগ হলাে না। হুমায়ুন কবিরের ওপর হামলা হলাে। তিনি হিন্দু বিয়ে করেছেন, সুতরাং তিনি আর মুসলমান নেই—এ কথা সাধারণ লােক বিশ্বাস করল।
শহীদ সাহেব খেলাফত নেতাদের কাছ থেকে শিখেছিলেন রাজপথের রাজনীতি, বিলেতে শিখেছিলেন সংসদীয় রাজনীতি আর দেশবন্ধুর কাছ থেকে শিখেছিলেন ওই দুধরনের রাজনীতির সমন্বয় করে নেতৃত্বে সমাসীন হতে। সত্যি বলতে শহীদ সাহেব তখন কেবল আফতাব আলীকে কিছুটা সমীহ করতেন, কারণ তিনি খিদিরপুরের অসংখ্য সিলেটবাসী জাহাজির প্রিয় নেতা ছিলেন। আফতাব আলী শ্রমিক আন্দোলনে যােগ দেওয়ার আগে
১১৪
নিজেই ছিলেন একজন জাহাজি। কিন্তু যেহেতু আফতাব আলীই শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে পরিষদ কক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিলেন, তাই তিনিও তাঁর শ্রমিক নেতৃত্বের অবসানের জন্য ডাক্তার আবদুল মােত্তালিব মালিক ও ফয়েজ আহমদকে শ্রমিক আন্দোলনে যােগ দিতে এবং তাদের কাজের সহায়তার জন্য টাকাপয়সার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আফতাব আলীর মধ্যে আর মিল হয়নি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।
১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের অধিবেশন ডাকা হলাে। জিন্নাহ সাহেব সভাপতি—এ সভা এ কারণে ঐতিহাসিক যে এ অধিবেশনেই এ কে ফজলুল হক, স্যার সেকেন্দার হায়াত খান ও স্যার সাদুল্লাহ—তিন প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীত্রয় আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগে যােগদান করেন—এতে করে সর্বভারতে মুসলিম সংহতি দৃঢ়তর হলাে। ফজলুল হক সাহেব বাংলার একচ্ছত্র নেতা হলেন। ১৯৩৬ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদের জিন্নাহ সাহেব যেভাবে ভুলাভাই দেশাইয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সদস্যদের সাহায্যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন গ্রহণ ও সরকারি সদস্যদের সাহায্যে সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ গ্রহণ এবং কংগ্রেসের সদস্যদের সাহায্যে ফেডারেল অংশগ্রহণের অযােগ্য বলে পাস করিয়ে নিলেন, তাতে অনেকেই তাঁর নেতৃত্বের অজস্র প্রশংসা করেছিলেন। স্টেটসম্যান কাগজ জিন্নাহ সাহেবকে তুলনা করেছিল ‘পাইড পাইপার অব হ্যামিলিন’-এর সঙ্গে—একই বাঁশির সুরে ইদুর যেমন সে ধ্বংস করেছিল—আবার সেই বাঁশির সুরেই সে দেশের প্রিয় সন্তানদেরও ধ্বংস করেছিল। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরেও তেমনি করে জিন্নাহ সাহেব বাংলা কৃষক-প্রজা পার্টির ও পাঞ্জাবের ইউনিয়নিস্ট পার্টির কবর খুঁড়ে ফেললেন। অল্প সময়ের মধ্যে প্রজা পার্টি ও ইউনিয়নিস্ট পার্টি ভেঙে গেল বাংলায় ও আসামে আগে-পাঞ্জাবে কিছুকাল পরে। বাকি রইল শুধু সীমান্ত প্রদেশের খােদায়ে খেদমতগার—আবদুল গাফফার খানের নেতৃত্বে। সেখানে জিন্নাহকে বেগ পেতে হয়েছে এবং অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক বছর—ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত।
ফজলুল হক বাধ্য হয়ে শামসুদ্দীন সাহেবকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করলেও তার প্রতি সুবিচার না করায় ১৯৩৯ সালে শামসুদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করেন। আর তমিজুদ্দীন সাহেব তার পার্টি ভেঙে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগে যােগদান করে বাকি জীবন রাজনীতি করে গেছেন।
রাজনীতি যাঁরা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন সে যুগে, তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য—একজন খাজা শাহাবুদ্দীন, অন্যজন ফজলুল রহমান সাহেব। প্রথমােক্ত ব্যক্তি স্কুল-কলেজে লেখাপড়ার সুযােগ
১১৫
পেলেও রাজনীতি ক্ষেত্রে বিশেষ বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন। নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর ব্যক্তিগত সেক্রেটারির পদ থেকে মন্ত্রী, গভর্নর ও রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। আইয়ুব খানের পতনের পরই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকার নবাববাড়িতে জন্মালে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে কতগুলাে সুবিধা পাওয়া যেত, স্বাভাবিকভাবেই ফজলুর রহমান তা পাননি, তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছে তাঁর নিজের পথ। সে পথ সহজ ও মসৃণ ছিল না। আঁকাবাঁকা পথে উতরাই-চড়াই করে তাঁকে পৌছাতে হয়েছিল উচ্চশূঙ্গে—যেখান থেকে গােলাম মােহম্মদ তাকে তাড়াতে পেরেছিলেন গণপরিষদকে সেনাধ্যক্ষের সাহায্যে ভেঙে দিয়ে। এদের কারও কোনাে গণসংযােগ ছিল না, সুতরাং গণপরিষদে গঠনতন্ত্র তৈরির কাজে হাত না দিয়ে আশিজন সদস্যের নেতৃত্বে বহাল থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন। তাদের ক্ষমতার উৎস ছিল জিন্নাহ সাহেব।
ফজলুর রহমান সাহেব তাঁর দলের লোেকদের জন্য সবকিছুই করতে রাজি ছিলেন। তাঁদের ব্যবসার সুবিধা করে দেওয়া, চাকরির সুবিধা করে। দেওয়া বা অন্য কোনাে প্রকার সাহায্যের প্রয়ােজন হলে—তাই করার চেষ্টা করা। এটা তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল। কিন্তু তিনি শত্রুকে ক্ষমা করতে জানতেন না। একবার কারও সঙ্গে মতবিরােধ হলে তার ক্ষতি তিনি না করা পর্যন্ত অন্তরে স্বস্তি পেতেন না—এ প্রতিহিংসা মাঝেমধ্যে মাত্রা ছাড়িয়ে যেত। যেমন রেজাই করিম সাহেব ও খান সাহেব আবদুল খালেক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে তাঁর দলের বিরােধিতা করেছিলেন, সে জন্য খালেক সাহেবের শ্যালক মহীউদ্দীন সাহেব যখন ইতিহাসে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার নিযুক্ত হলেন—ফজলুর রহমান সাহেব সাত দিনের মধ্যেই তার চাকরি খতম করার ব্যবস্থা করলেন। এতে অবশ্যই মহীউদ্দীন সাহেবের শাপে বর হলাে—তিনি তাঁর বড় ভাই হাফিজুদ্দীন সাহেবের পরামর্শ নিয়ে ইম্পেরিয়াল পুলিশ সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হলেন—কিন্তু প্রথমবার ডাক্তারি পরীক্ষায় টিকলেন না, দ্বিতীয়বার আবার পরীক্ষা দিয়ে সফল হলেন।
এ কথাটা লিখতে গিয়ে আমার একটি পরশ্রীকাতরতার উদাহরণ মনে পড়ল। একদিন রাইপাড়ার নাগর মিঞা সাহেব এলেন আমার বাসায় আমার শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করতে। এর আগেই মহীউদ্দীন সাহেব তারযােগে তার পরীক্ষা পাসের খবরটা আমাকে দিয়েছিলেন এবং আমার শ্বশুরকে আমি সে কথাটা বলেছিলাম। আমার শ্বশুর সে কথাটা নাগর মিঞা সাহেবকে বলতেই তিনি বললেন, দূর, আপনি এ কথা বিশ্বাস করেন—সারা বাংলাদেশে এত ছেলে থাকতে সরকার বেছে বেছে কেবল কুদুস মিঞার
১১৬
ছেলেদের এসপি বানাবে, বােধ হয় ছেলের কোথাও বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই দারােগা এসপি হয়ে গেছে। নাগর মিঞা সাহেব ভদ্রলােক, প্রথম জীবনে করটিয়ার পন্নীদের জমিদারি দেখাশােনা করতেন কিন্তু ছেলে রশীদ (Raschid) সাহেব (পরবর্তীকালে স্টেট ব্যাংকের গভর্নর) ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পর বাড়িতেই থাকতেন।
আমি যখন বিএ দ্বিতীয় বর্ষে, তখন কাজী আনােয়ারুল হক সাহেব ও মহীউদ্দীন সাহেবের বড় ভাই হাফিজুদ্দীন সাহেব অনার্স পাস করে একই সঙ্গে আইপিএস পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হন। মহীউদ্দীন সাহেব যদিও আমার জুনিয়র ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তবু তাঁর সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব ছিল বেশি। এমনকি বিয়ে করে প্রথম যখন স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় আসেন, তখন তিনি আমারই অতিথি হয়েছিলেন। আইপিএস হওয়ার পরেও কাজী আনােয়ারুল হক সাহেব টেনিস খেলতে সলিমুল্লাহ হলে আসতেন এবং আমাদের সঙ্গে টেনিসের মাঠে দেখা হতাে। হাফিজুদ্দীন সাহেব যেহেতু আর হলে আসেননি—সুতরাং আমার সঙ্গে তার তেমন পরিচয়ও ছিল না। তাদের ভাইদের মধ্যে স্কলার হিসেবে শামসুদ্দিন সাহেবই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম করেছিলেন বেশি।
জিন্নাহ সাহেব কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযােগ পাননি। বড় কারণ ছিল অর্থাভাব। মুসলমান নেতাদের মধ্যে জিন্নাহই সবচেয়ে নিচের স্তরে অর্থাৎ বিত্তহীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরিচয় দেওয়ার মতাে তাঁর কিছুই ছিল না। তাঁর পিতামহ রাস্তার ফেরিওয়ালা, পিতা মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে কিছু ব্যবসা করেছিলেন—জিন্নাহ পুঞ্জাই প্রথম মুসলিম প্রথা অনুসারে তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন মােহাম্মদ আলী। মােহাম্মদ আলীর চেহারা ছিল সুন্দর-রাজপুত্রের মতাে। সুন্দর মুখই তাঁকে সৌভাগ্যের পথে এগিয়ে দিয়েছিল। স্কুলে যখন পড়ছিলেন, তখন এক ধনী ব্যবসায়ী তার কন্যাকে তার কাছে বিয়ে দিয়ে তাকে বিলেতে ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য পাঠানাের ব্যবস্থা করেছিলেন। জিন্নাহ বিলেতে যাওয়ার কিছুকাল পরেই তাঁর বালিকা স্ত্রীর মৃত্যু হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যারিস্টার হওয়ার খরচ তার শ্বশুরই বহন করেছিলেন।
বিলেতে গিয়ে জিন্নাহ দেখলেন যে ভারত থেকে যারা তখন বিলেতে যেতেন, তাঁরা সবাই অভিজাত সম্প্রদায়ের সন্তান। তাদের গল্পে, কথায়, চলাফেরায় আভিজাত্যের ছাপ। জিন্নাহ সেখানে বেমানান। জিন্নাহ নিজেকে ভুলতে চাইলেন। প্রথম প্রচেষ্টা চালালেন নিখুঁত সাহেব হওয়ার জন্য–পা থেকে মাথা পর্যন্ত মায় ‘মনােকল’ পর্যন্ত ‘অস্টিন চেম্বারলেন। নামটিও ইংরেজি করে ফেললেন—মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ হয়ে গেলেন এম
১১৭
এ জিন্নাহ। শেষােক্ত পদবিটা পিতার প্রথম নাম। তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এম এ জিন্নাহই রয়ে গেছেন—মােহাম্মদ আলী নামটা আর উল্লেখ করেননি, এমনকি যখন তিনি ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের একমাত্র নেতা এবং ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের স্রষ্টা। অন্যরা অনেকে শেষের দিকে তাকে কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ লিখলেও তিনি সই করতেন এম এ জিন্নাহ। সে যুগে ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য কোনাে আনুষ্ঠানিক পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং অবসর ছিল বিস্তর। সে অবসর তিনি কাটিয়েছেন থিয়েটার দেখে এবং অংশ নিয়ে, বিলিয়ার্ড খেলে, বল ডান্সে যােগ দিয়ে, শেক্সপিয়ার পড়ে আর পার্লামেন্টের বিতর্ক দেখে । সব কটি তার পরবর্তী জীবনে কাজে লেগেছিল। কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার অভাবকে ঢেকে রেখেছিলেন ইংরেজি বলা-কওয়ার মধ্য দিয়ে । তাঁর জীবনদর্শন বলে কিছু ছিল না বলেই তিনি ছিলেন প্র্যাকটিক্যাল রাজনীতিবিদ। পরিষদের বিতর্কে খোচা থাকত যথেষ্ট কিন্তু পাণ্ডিত্য থাকত । উদাহরণ, যেমন :
What then does the Government want me to do now? What does Mr. James want me to do? Mr. James has compared me to a film star. Mr. James Threatened me with dire consequences when the resolution terminating the Ottawa Agreement was passed. Mr. James has said that Japan is ready with its knife, and that Great Britain would be too glad to put an end to the agreement. I can only compare him with Marlene Dietrich (Laughter). He can only play tragic part, and that is a Tragedy. I do not follow him. Today what song is he singing? He says that this is an enormous improvement on Ottawa. The Government is also beckoning me. Cinderella is to be taken to the ballroom, to have her round with the Purace and then be sent to the kitchen. Greta Garbo is not going to be Cinderella. She is going to be a star artiste (more laughter). You cannot go on like that and ask me to walk into your parlour.
জিন্নাহ সাহেবের অন্তরে সাহিত্য বা সাহিত্যিক সম্বন্ধে কোনাে কিছু জানার বাসনা কখনাে তেমন জাগ্রত হতাে না, তার সম্পূর্ণ দৃষ্টি ছিল ভারতীয় রাজনীতির দিকে অথবা ওকালতির দিকে। শেক্সপিয়ার তিনি পড়েছেন কিন্তু সেটা অভিনয় করার প্রয়ােজনে—সাহিত্য হিসেবে নয়। তাঁর জীবনের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল অভিনেতা হওয়া কিন্তু কিছুতেই ভালাে ‘পার্ট’
১১৮
পাওয়াতে তার ধারণা হলাে যে যেহেতু সে ভারতীয়, তাই তাঁকে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় তাঁর ইংরেজবিদ্বেষ, যার ফলে দাদাভাই নওরােজির শিষ্যত্ব গ্রহণ। তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করতেন না। শেষের দিকে আর কোর্টে যেতেন না। বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের এবং দেশীয় রাজ্যের নরপতিদের আইনের পরামর্শ দিয়ে বিস্তর টাকা উপার্জন করতেন। বাংলাদেশে এক টেগাের ছাড়া আর কোনাে কবি ছিলেন, এটা তার জানা ছিল না ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। বাঙালি বলতে তিনি হিন্দুদেরই বুঝতেন, আর কলকাতার বাইরে গ্রামবাংলায় মুসলমান বলে যারা পরিচয় দিতেন, তাঁদের সম্বন্ধে ধারণা ছিল যে তারা হিন্দু ধর্মই পালন করতেন মুসলমান নামে। এ ধারণা অবশ্যই স্যার ফিরােজ খান নুনেরও ছিল। পূর্ব বাংলার গভর্নর থাকাকালীন তিনি একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন যে এখানকার মুসলমানরা সন্তান হলে ব্রাহ্মণ ডাকতেন। নামকরণের জন্য—কোষ্ঠী তৈরি করার জন্য। পূজা-অর্চনায় যােগ না দিলেও অনেক আচার-অনুষ্ঠানই ছিল হিন্দুয়ানি, এমনকি এখানকার মুসলমান ছেলেদের খতনাও করানাে হয় না। সুতরাং এটা যে কেবল জিন্নাহর অজ্ঞতা বা পণ্ডিত নেহরুর অজ্ঞতা, তা বলা যায় না, এটা বাংলার বাইরের লােকদের অজ্ঞতা। পণ্ডিত নেহরু লিখেছেন :
Probably 98 pc of the Muslims were converts from Hinduism, usually from the lowest stratum of society.
নেহরু তার কোনাে পুস্তকে বাংলার বৌদ্ধদের কী হলাে, সে সম্বন্ধে নির্বাক থেকেছেন, বাংলার সব বৌদ্ধ নিশ্চয় বাংলা ছেড়ে বার্মা চলে যায়নি। বাংলার মুসলমানদের কেন ‘নেড়ে বলা হয়, তারও কোনাে উত্তর দেননি তিনি। জিন্নাহ সম্বন্ধে নেহরু বলেছেন :
Mr. M A Jinnah himself was more advanced than most of his colleagues of the Muslim League. Indeed he stood head and shoulders above them and had therefore became indispensable leader.
তিনি বলেছেন
Of economics, which overshadow the world today, he appeared to be entirely ignorant. The extra ordinary occurrences that had taken place all over the world since World War I had apparently no effect on him.
১১৯
Mr. Jinnah is a lone figure even in the Muslim League, keeping apart from his closest co-workers, widely but distantly respected more feared than loved. About his ability as a politician there is no doubt, but somehow that ability is tied up with the peculiar condition of British rule in India today. He shines as a lawyer-politician, as a tactician, as one who thinks that he holds the balance between the nationalist India and the British power.
অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন :
Moslems were very poor in the quality of their leaders and were inclined to look to government service alone for advancement. Mr. Jinnah was a different type. He was able tenacious and not open to lure of office which had been such a failing of so many others.
তিনি আর এক স্থানে বলেছেন :
His idea of politics was of a superior variety, more suited to the legislative chamber or to a committee room.
জিন্নাহ যৌবনে তার বড় বােনের বিয়ের অনুমতির জন্য আগা খানের সঙ্গে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও সাক্ষাৎ পাননি। সে আগা খান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন :
Different in many superficial characteristics different in the success which attended the one and the failure of the other, these two-Mossolini and Jinnah both apparently inconsistent in many things, shared one impressive, life long quality of consistency. Each had one guiding light, whatever the policy, whatever the political philosophy underlying it, it would be successful and it would be normally justified, so long as he was the head of it and directing it. In neither of them can this be dismissed as mere ambition; each had a profound and unshakable conviction that he was superior to other men, and that if the conduct of affairs were in his hands, and the last word on all matters his, everything would be all right, regardless of any abstract theory (or lack of it) behind political
১২০
action. This belief was not pretentious conceit; it was no selfglorification or shallow variety. In each man its root was an absolute certainty of his own merit, an absolute certainty that, being endowed with greater wisdom than others, he owed it to his people, indeed to all mankind to be free to do what he thought best on other’s behalf.
In view of both Mussolini and Jinnah, opposition was not an opinion to be conciliated by compromise or negotiation; it was a challenge to be obliterated by their superior strength and capacity. Each seemed opportunist, because his selfconfidence and his inflexible will made him believe, at every need turn he took that he alone was right and supremely right. Neither bothered to confide in others or to be explicit.
Mussolini travelled the long road from Marxism not because of doctrinal doubts and disagreement, because, in the world of socialist politicians and theorists in which he spent his stormy youth as an exile in Lausanne, doctrines and theories were constant obstacles across the only path of political achievement in which Benito Mussolini was the leader.
Jinnah throughout his career displayed a similar characteristic. He would admit no superior to himself in intellect, authority or moral stature. He knew no limitation of theory or doctrine. The determined and young barrister who against all the omens, without influence, and without inherited wealth-triumphed within a few years despite entrenched opposition.
জনাব ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর সমকক্ষতার দাবি করতে পারত, যদি তাঁর সংগঠন করার ক্ষমতা থাকত। ফজলুল হক কোনাে সংগঠনকেই সহ্য করতে পারতেন না—কৃষক প্রজা পার্টিকে ১৯৩৮ সালে কবর দিতে যেমন ইতস্তত করেননি, তেমনি করেননি যখন মুসলিম লীগকে দূরে ফেলে দিতে–১৯৪২ সালে। বাংলার রাজনীতিতে ইতিমধ্যে যে পরিবর্তন এসেছিল, সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। তিনি নির্ভর করতেন বিশেষভাবে তাঁর ভাগনে মনজুর মােরশেদ এবং অন্য ভাইস্তা-ভাগনেদের ওপর। তিনি নিজেকে ‘ইনস্টিটিউশন’ বলে মনে করতেন। এ দুর্বলতাই তাঁর পতনের মূল কারণ হয়েছিল। অবশ্য এ
১২১
কথা ঠিক যে সে যুগে মনজুর মােরশেদ ও তাঁর অন্য আত্মীয়রা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত ছিলেন—কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের যােগাযােগ না থাকার জন্য তাদের উপদেশাবলি ফজলুল হক সাহেবকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল। এ ব্যাপারে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পথ ছিল ভিন্ন। রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেই তিনি বুঝলেন যে কলকাতার ওপর সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও বাংলার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট নয়। পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব বিস্তার না করতে পারলে তাকে সারা জীবন মন্ত্রিসভার একজন সাধারণ সদস্য হয়েই থাকতে হবে। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল উচ্চ—সুতরাং তাকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল পূর্ব বাংলার অন্তস্তলে প্রবেশের পথ। অসুবিধা তার ছিল অনেক। প্রথমত পূর্ব বাংলায় তাঁর কোনাে আত্মীয়স্বজন ছিল না; দ্বিতীয়ত, তার বাংলা ভাষা জানা ছিল না। এ দুটো বাধা অতিক্রম করতে তিনি সচেষ্ট হলেন। প্রথমে দৃষ্টি পড়ল ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার বন্ধন ঝালাই করা। যে কথা এর আগে তাদের বংশে আর কারও তেমনভাবে মনে হয়নি। ঢাকার নান্না সৈয়দ সাহেবের এক মেয়েকে বিয়ে করেন ফজলুল হক সাহেব আর এক কন্যা শহীদ সাহেবের আপন মামু কর্নেল হাসান সােহরাওয়ার্দী। সে মামুর সঙ্গে আবার শহীদ সাহেবের তেমন মধুর সম্পর্ক ছিল না—সুতরাং ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে যােগাযােগের সূত্র হয়ে দাঁড়াল কর্নেলের একমাত্র মেয়ে সসাগরা (বেগম ইকরামুল্লাহ), শহীদ সাহেব তাঁকে আপন বােনের মতােই স্নেহ করতেন, এমনকি নিজের কন্যা বেবির চেয়ে সােগরাকে যেন বেশি স্নেহ করতেন বলে মনে হতাে। অবশ্যই সসাগরার রাজনৈতিক চেতনাবােধ বেবির চেয়ে অনেক বেশি ছিল—তিনি সুবক্তা ছিলেন এবং উর্দু সাহিত্যে বেশ দখলও ছিল । ইংরেজি ভালাে বলতে পারতেন। বিয়ে হয়েছিল তার নাগপুরের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ইকরামুল্লাহর সঙ্গে। সােগরাও চিরদিনই শহীদ ভাই বলতে অজ্ঞান ছিলেন। এরপর কর্নেল হাসান সােহরাওয়ার্দীর পিতা ওবায়েদুল ওবায়েদী আল সােহরাওয়ার্দীকে দাফন করা হয়েছিল ঢাকার লালবাগে। ওই আত্মীয়তা সূত্রেই প্রথম সােহরাওয়ার্দী সাহেব পূর্ব বাংলায় ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রী হিসেবে ঘুরতেন। বাংলায় বক্তৃতা অভ্যাস করার জন্য ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লিখে তাই সভায় বলতেন বা পড়তেন। বছর দুয়েক তিনি ওই ভাবে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং ইংরেজি জানা লােকদের সঙ্গে সংযােগ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছেন। অসুবিধা হয়েছিল যে। ইংরেজি বলার ভঙ্গি ও উচ্চারণ ছিল আক্সোনিয়ান, যে অসুবিধাটা উর্দুভাষী খাজা নাজিমুদ্দিনের ছিল না। যেমন ছিল তাঁর উর্দু, তেমনি ছিল তার
১২২
ইংরেজি। তাঁর প্রকাশভঙ্গির ওপর ঢাকার ছাপ ছিল—সে জন্যই জেলার উকিল-মােক্তার-ডাক্তার, তাঁর যত নিকটে আসতে পারত, তা পারত না। শহীদ সাহেবের কাছে। তা ছাড়া ফজলুল হক সাহেবের প্রথমা বিবির সঙ্গে ফজলুল হক সাহেবের কোনাে দিন মিল ছিল না। ফজলুল হক সে বিয়ে ভেঙে দেননি এ জন্য যে সে বিবাহসূত্রেই তিনি কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত ঘরের সঙ্গে আত্মীয়তা দাবি করতে পারতেন। তাঁর প্রথম মন্ত্রিত্বের আমলে তাঁর স্ত্রীর আপন ভাই ডক্টর সৈয়দ হােসেন দীর্ঘকাল আমেরিকায় নির্বাসিত জীবন যাপন করার পর ভারতে এসেছিলেন। ফজলুল হক সাহেব তার সম্মানে মস্ত বড় ভােজের আয়ােজন করেন কলকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হােটেলে, যেখানে কংগ্রেসের অনেক নেতাই উপস্থিত ছিলেন। গল্প প্রচলিত ছিল যে মতিলাল নেহরুর ইনডিপেনডেন্ট কাগজের সম্পাদকীয়তা করার সময় বিজয় লক্ষ্মীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হতে যাচ্ছিল, সে বিবাহ গান্ধীজি নিজে এসে বন্ধ করে দেন। হােসেন সে দুঃখে দেশ থেকে চিরদিনের জন্য চলে যান। তাঁর মতাে সুন্দর স্বাস্থ্যবান সুবক্তা আমি খুব কমই দেখেছি। ঢাকার কার্জন হলে তিনি তিন দিন বক্তৃতা করেছিলেন। বিষয়বস্তু ছিল :
1. America-Today
2. Europe After the World War
3. Indian Renaissance
বক্তৃতা ঠিক দুঘণ্টা চলত প্রতিদিন—অথচ একবারও ঘড়ির দিকে তাকাতেন না।
এ পথে যখন খুব বেশি দূর এগােনাে গেল না, তখন শহীদ সাহেব খুঁজে বেড়াতে লাগলেন কলকাতার ছাত্রদের মধ্যে এমন একজন যুবক, যাকে তিনি গ্রহণ করতে পারবেন নিজের বলে এবং যার মধ্যে রাজনীতির নেশা আছে, যে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে তাঁর সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপােষকতা পেলে। তিনি খুঁজছিলেন একজন সাহসী ছেলে-রাজনৈতিক দল সংগঠনে যার প্রতিভা আছে অথচ তার সঙ্গে কাজ করবে আমরণ। ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত অনেককে তিনি পরীক্ষা করেছেন কিন্তু তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটি পাননি—যদিও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তিনি অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেছেন চিরদিন। এঁদের মধ্যে ছিলেন নুরুল হুদা, আনােয়ার, নুরুদ্দীন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর প্রমুখ।
১৯৪৩ সালে আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীতে ভাগ হলাে। মওলানা আকরম খাঁ, হাসান ইস্পাহানি ও খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অভিযান আরম্ভ হয়—এ অভিযান প্রতিক্রিয়াশীলদের
১২৩
বিরুদ্ধে, কিন্তু শহীদ সাহেবকে পরােক্ষভাবে সমর্থন দেওয়া হয়। কারণ, শহীদ সাহেব বুর্জোয়া কিন্তু তিনি শিল্পপতিও নন, জমিদারির মালিকও নন। এমনকি কলকাতায় তাঁর একখানা বাড়িও ছিল না। কলকাতার সাধারণ মানুষের সঙ্গেই ছিল তাঁর ওঠা-বসা, যার জন্য মফস্বল জেলার উকিল, মােক্তার, ডাক্তার যারা রাজনীতি করতেন, সম্মানিত ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা করে নিজেরা সম্মানিত হতেন, তাঁরা তাঁকে গুন্ডাদের নেতা আখ্যা দিয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে থাকতেন। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর রাজনীতি ক্ষেত্রে অনেক লােক সংসদে প্রবেশ করলেন, যারা তাদের জেলার অভিজাতদের প্রতি ঘৃণা পােষণ করতেন। তাঁরা শহীদ সাহেবকে জননেতা হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে শহীদ সাহেবকে প্রতিক্রিয়াশীল দলের মধ্যে ধরা হলাে না। ফলে আবুল হাশিমের আন্দোলনের পূর্ণ সুযােগ সংসদীয় রাজনীতিতে শহীদ সাহেবই গ্রহণ করেছিলেন।
বছর চারেক পরের একটি ঘটনা এখানে এসে পড়ছে ব্যাপারটা বােঝার জন্য। ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসে যখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল সভা ডাকা হলাে, তখন সােহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দিন ও মাওলানা আকরম খাঁ একত্রে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে আবুল হাশিম সাম্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত। সুতরাং মুসলিম লীগের সম্পাদক পদে তাঁকে রাখা যায় না। এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে অত্যন্ত গােপনে। এরপর শহীদ সাহেবের বাড়িতে অন্য নেতাদের, যেমন—খাজা শাহাবুদ্দীন, ফজলুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবদুস সবুর খান ও ডাক্তার মালিককে ডাকা হলাে এবং সেখানে স্থির হলাে যে আবুল হাশিমের স্থলে ডাক্তার আবদুল মােত্তালিব মালিককে সাধারণ সম্পাদক করা হবে। শহীদ সাহেব আবুল হাশিমকে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন এবং আবুল হাশিম কোনাে আপত্তি না করে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সকাল না হতেই এ খবর কাউন্সিলরদের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল, তখন আবুল হাশিমের অনুরাগীদের মধ্যে একটা ভয়ানক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল। নির্বাচনের পূর্বের দিন সন্ধ্যায় তাঁরা এ সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আন্দোলন আরম্ভ করলেন। সন্ধ্যার দিকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সম্মুখে ফজলুল কাদেরের নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন আরম্ভ হলাে—বক্তৃতা করলেন প্রথম নূরুদ্দীন, তারপর শেখ মুজিবুর রহমান। আমি, আবুল হাশিম ও হবীবুল্লাহ বাহার সাহেব তখন বাইরে পায়চারি করছিলাম—আমি ঘরে ঢুকলাম পরিস্থিতি দেখার জন্য আমি যখন ঢুকছি তখন নূরুদ্দীনের বক্তৃতা প্রায় শেষ—শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা আরম্ভ করেছেন। তাঁর বক্তৃতার
১২৪
মাঝখানে বর্ধমানের আজমিরী লাফিয়ে উঠলেন টেবিলের ওপর । মুজিবের বক্তৃতার সময় শহীদ সাহেব নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে হলাে ফজলুল কাদের তাঁর নেতৃত্ব কিছুক্ষণের জন্য মুজিবের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। মুজিবের বক্তৃতা জোরালাে হয়েছিল এবং যুক্তিপূর্ণও। ফলে শহীদ সাহেব কাউন্সিলের ওপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। আমার মনে হয়, সেদিন এমনকি সেই মুহূর্তেই শহীদ সাহেব বেছে নিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। অবশ্য এটা আমার অনুমান। হতে পারে যে শেখ মুজিব এ ঘটনার আগেই সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। আমি নিজেও তাঁর বক্তৃতা শুনে অভিভূত হয়েছিলাম। সেদিন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান আবুল হাশিমের বামপন্থীদের একজন হলেও শহীদ সাহেবের স্নেহ ও প্রীতিভাজন হলেন। এত দিনে যেন শহীদ সাহেব সন্ধান পেলেন তিনি যাকে খুঁজছিলেন, তাঁকে। শহীদ সাহেবের রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমি অনেক সম্মুখে এগিয়ে এসেছি। কারণ, এ ঘটনা লাহাের প্রস্তাব গ্রহণ করার চার বছর পরের ঘটনা। দ্বিতীয় খণ্ডে এটা সবিস্তারে সবিশেষ বর্ণনা করা হবে।
খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব ছিলেন অভিজাত ঘরের লােক—ঢাকা নবাববাড়ির ঘরজামাইয়ের ছেলে-ব্যবহারে ভদ্র। রাজনীতি করেছেন বহুকাল কিন্তু গণনির্বাচনে কোনাে দিন বিজয়ী হননি। প্রথম জীবনে ব্রিটিশ ও অবাঙালি ব্যবসায়ী মহলের পৃষ্ঠপােষকতা ও পরবর্তীকালে জিন্নাহ সাহেবের পৃষ্ঠপােষকতার ওপরই ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভরসা। আরও পরে ফজলুর রহমান ও খাজা শাহাবুদ্দীনই ছিল তাঁর বুদ্ধিদাতা। তিনি রাজনীতি ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল কোনাে নতুন নেতৃত্ব দিতে পারেননি এবং পরবর্তীকালে ফজলুর রহমানও তাকে ব্যবহার করেছেন। নাজিমুদ্দিনকে সর্বসমক্ষে সাধু, সত্যবাদী এবং ভালাে লােক বলে প্রমাণ করাই ছিল শাহাবুদ্দীনের সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক দক্ষতার একটা অঙ্গ। এ জন্য নিজে অন্যায় না করেও নাজিমুদ্দিনের পাপকে নিজের অপরাধ বলে স্বীকার করে ভাইকে ঊর্ধ্বে রাখতেন। কারণ, শাহাবুদ্দীনকে লােকে জানত ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ বলে—তাই কেউ বিশ্বাস করতে চাইত না। সত্যি বলতে সবাই তাকে ভয় পেত। সুতরাং তার প্রয়ােজনেই নাজিমুদ্দিনকে উর্ধ্বে রেখে তিনি তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার ব্যবস্থা করতেন। খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব ছিলেন সরল মানুষ। আবুল হাশিম তাঁর সম্বন্ধে বলতেন 67 agama ‘Was very simple and so simple that his simplicity could be measured in tons.’ অর্থাৎ ঘুরিয়ে বলা যায় যে তিনি ‘Simple নন, ‘Simpletion অর্থাৎ বােকা। এর কারণ মুসলিম লীগ সরকার যখন
১২৫
জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের কথা বলেছিল, তখন দিনাজপুরে ল্যান্ড হােল্ডারদের এক সভায় তিনি বললেন যে তাঁদের ভয় পাওয়ার কোনাে কারণ নেই—ক্ষুধার্ত কুকুরকে হাড়গােড় কিছু ছুড়ে না দিলে তারা হয়তাে সমস্ত মাংসটাই নিয়ে নেবে—ফ্লাউড কমিশনের কাজ তারা যেন সে দৃষ্টিতেই দেখে।
খাজা নাজিমুদ্দিন রাতে কিচ্ছা-কাহিনি বলতে ভালােবাসতেন—অফুরন্ত ছিল তার কিচ্ছার ভান্ডার, আর সে কিচ্ছা শােনার জন্য তাঁর পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন, সবাই তার ড্রয়িংরুমে জমা হতাে এবং গভীর রাত পর্যন্ত এ কিচ্ছা বলা চলত। দুর্ভাগ্যবশত এর ফলে জেনারেল ওয়াসিউদ্দীন তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। জেনারেলের স্ত্রী ছিলেন স্যার নাজিমের কন্যা। তিনি সময় পেলেই কাওয়ালির বৈঠক করতেন। ফজলুল হক, সােহরাওয়ার্দী ও নাজিমুদ্দিন মুরগি মােসাল্লেম ও জর্দা খেতে খুব ভালােবাসতেন। শহীদ সাহেব ভালােবাসতেন ঝাল খেতে আর ফজলুল হক সবকিছু খেতে ভালােবাসতেন বিশেষ করে ভাত, ডাল, মাংস, মাছ ও ফলমূল। আম খেতে আরম্ভ করলেন তাে এক ঝাকি আমই খেয়ে ফেলতেন। তবে আর দুজন যেমন সাহেবি কায়দায় খেতেন অর্থাৎ আঙুলের বদলে কাঁটাচামচ—ফজলুল হক আঙুল ব্যবহার করতেই ভালােবাসতেন।
১৯৩৭ সালের এপ্রিল কি মে মাস ঠিক মনে নেই আমার, এক প্রফেসর বন্ধু আমাকে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এম এন রায় সম্বন্ধে অনেক রকম কাহিনি আমার কানে এসেছিল–সন্ত্রাসবাদী, পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে মেক্সিকো গিয়ে সাম্যবাদ নীতি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি লেনিনের সঙ্গে রুশ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন। লেনিনের অনেক লেখায় কমরেড রায়ের নাম উল্লেখ আছে। কিন্তু ১৯৩০ সালের পর তিনি কমিউনিস্ট মতবাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকেন এবং কয়েক বছর পর ভারতে প্রত্যাবর্তন করে র্যাডিকেল ডেমােক্রেটিক পার্টি গঠন করেন।
আলােচনাকালে কমরেড রায় বলেছিলেন, রুশ দেশে সাম্যবাদী বিপ্লবের ফলে মেহনতি মানুষের জন্য যে স্বর্গ তৈরি হবে ভেবেছিলাম, তা সফল হয়নি। অবশ্যই এটা আমার বলার উদ্দেশ্য নয় যে সমস্ত বিপ্লবটাই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, The brutalities of progress are called revolutions but when they are ended, the fact is recognised, the human race has been chastised but it has moved onwards. The Utopia of today is flesh and bone tomorrow. তবু না বলে পারছি না যে রুশ দেশের সর্বহারারা আজও তাদের স্বর্গের সন্ধান পায়নি। অবশ্যই
১২৬
নেতাদের দিন ফিরে গেছে—সবাই বিরাট বাংলাে (Datcha) তৈরি করেছে। মুক্তবুদ্ধির স্থান সেখানে নেই। যারা স্তালিনের সঙ্গে আছে, সেখানে আজ তারা অভিজাত সম্প্রদায়। আজ সেখানকার মেহনতি মানুষ গাধার খাটুনি। খেটে চলেছে (Donkey work)। স্তালিনের নামে যে গঠনতন্ত্র রচনা করা হয়েছিল, তাতে মৌলিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে—কী সে অধিকার, কীভাবে আদায় করা যাবে তার কোনাে নিয়ম নেই। ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষে কত লাখ লাখ লােক মারা গেল কিন্তু কিছু করা গেল না। হিটলারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে—ভবিষ্যতে রুশ কমিউনিস্ট পার্টি এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। তারা ভাবছে গণতন্ত্রের ভিত ভেঙে দিতে পারলেই তারা নাৎসিদের শেষ করতে পারবে, কারণ জনতা ডিক্টেটরশিপে একবার অভ্যস্ত হলে দক্ষিণের স্বৈরাচারী সরকার ছেড়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ডিক্টেটরশিপ অব দ্য প্রলেতারিয়েত গ্রহণ করবেই। এটা একটা বিরাট ভুল, আমি স্তালিনকে এর ভবিষ্যৎ বােঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। ফলে আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নকে গলা টিপে মেরে ফেললাম। দুনিয়াজোড়া বিপ্লব’-এর আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে সেখানে আজ জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে। অতীতে। পশ্চিম ইউরােপীয় দেশসমূহে যেমন জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে সাম্রাজ্যবাদ গড়ে তুলেছিল, হয়তাে রুশ জাতীয়তাবাদের সেই হবে শেষ পরিণতি। সােভিয়েত সােশ্যালিস্ট রিপাবলিক আজ রুশ দেশ হয়ে যাচ্ছে—আমি তাই আমার স্বপ্নের দেশকে ছেড়ে এসেছি।
গণতন্ত্রের বুলি আবার কপচায় ইউরােপের তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলাে। তারা স্পেনে ‘পপুলার ফ্রন্ট’-এর বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়েছে—কিন্তু ফ্রন্টকে ধ্বংস করার জন্য মুসােলিনি ও হিটলার যখন অস্ত্র পাঠাতে লাগল, গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ তখন জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ‘কু’কে ঘরােয়া ব্যাপার বলে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে গেল। Policy of NonIntervention যে মানবতাবিরােধী তা গণতন্ত্রের ধ্বজাধররা যে বুঝতে চাইলে না সে বােধ হয় সত্য নয়। প্রস্তুতির অভাবেই বােধ হয় আদর্শকে বলি দিল একনায়কত্বের কাছে। অবশ্যই এ-ও হতে পারে যে যেহেতু সােভিয়েত ‘পপুলার ফ্রন্ট’কে সাহায্য করেছিল, তাই তারা ভাবছে ‘পপুলার ফ্রন্ট’কে সাহায্য করা মানে সাম্যবাদকে সাহায্য করা। আমি তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরােধী, কারণ সেখানে ব্যক্তিকে সমাজের উর্ধ্বে স্থান দেয়। আর আমি সাম্যবাদ থেকে সরে এসেছি যেহেতু, সেখানে ব্যক্তিকে অস্বীকার করে সমাজবাদ সৃষ্টি চাই। বাকি জীবনে ব্যক্তি ও সমাজ-এ দুটোকেই রক্ষা করা যায় কি না বা এ দুটোর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য স্থাপন
১২৭
করা যায় কি না, তারই চেষ্টা করে যাব। রােজার বেকন বলেছিলেন : *Cease to be ruled by dogmas and authorities, look at the world.’ আমার দৃষ্টিতে আধুনিক সভ্য জগতে যে হারে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে উঠছে না, সমাজবিজ্ঞানও সে অনুপাতে অগ্রসর হচ্ছে না। যে অনুপাতে বিজ্ঞানের চর্চা ও মারণাস্ত্র তৈরি হচ্ছে রীতিমতাে এবং হবে, সে হারে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসামঞ্জস্য কতটা প্রকট।
তারপর কমরেড রায় চীন-জাপানের যুদ্ধ, হিটলার ও মুসােলিনির মধ্যে প্রভেদ সম্বন্ধে অনেক আলােচনা করেছিলেন, যা আমার সবটা মনে নেই। তিনি বলেছিলেন, ‘সমাজকে গড়ে তুলতে হবে মানুষকে তার নিজের শক্তি দিয়ে—নিত্যনতুন আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে। শুধু অনেক দিন থেকে একটা কিছু চলছে বলে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে তার কোনাে অর্থ নেই। ১৮৪৭ সালের কমিউনিস্ট পার্টি ম্যানিফেস্টো শত বছর পরে অনেকটা অকেজো হয়ে যেতে বাধ্য। বিজ্ঞানের মতাে দর্শনেরও শেষ কথা নেই।’
আমার মনে হচ্ছিল যে কমরেড রায়ের অন্তরে ভট্টাচার্জি ব্রাহ্মণ–সুতরাং সে তার নিজের কাছ থেকে মুক্তি পাবে না। যেমন গৌতম বুদ্ধ সবকিছু থেকে পালিয়েও নিজের কাছ থেকে পালাতে পারেননি।
আমি রাজনীতির এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন বা যারা বাংলার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন, তাঁদের যেমন দেখেছি দর্শক হিসেবে, তারই একটা প্রতিচ্ছবি দিতে চেষ্টা করছি।
গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মূলত হিন্দু ‘শােভেনিজম’-এ অর্থাৎ যাকে বলে অন্ধ দেশপ্রেমে পরিণত হয়েছিল—যার বিরুদ্ধে দাঁড়াল জিন্নাহর মুসলিম লীগ। হিন্দুধর্মের সঙ্গে ভারতের ইতিহাস ও ভূগােলের মিশ্রণ। ভারতমাতা নিজেই একজন দেবী। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার ভেতর দিয়ে মুসলমানদের পরদেশি করে রাখা হয়েছিল। অবশ্যই এশিয়ার জাতীয়তাবাদের উন্মেষ সাধারণভাবে ধর্মভিত্তিক, যেমন বর্মা ও সিংহলে বৌদ্ধ শােভেনিজম, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলােতে মুসলিম শােভেনিজম, যদিও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলােতে আরবি ও আজমি ভাষাভিত্তিকও বটে। আমার সে যুগে মনে হতাে যে বাংলার মুসলমানের মধ্যে যত দিন এমন নেতার আবির্ভাব না হবে যে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে লজ্জিত হবে না, অর্থাৎ যত দিন বাংলা তার নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে না পারবে, তত দিন বাংলার মুক্তি অসম্ভব। জনাব ফজলুল হকের মধ্যে সে সম্ভাবনা ছিল—কিন্তু উর্দুভাষী
১২৮
অভিজাত ঘরের স্ত্রী থাকার ফলে তাঁর জীবনে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সে যুগে দেশমাতৃকার সেবায় যাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন সবাই বর্ণহিন্দু—অথচ বাংলার শােষিত জনগণের বেশির ভাগই ছিল মুসলমান, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মুসলমান, যারা বেশির ভাগই ছিল বর্ণহিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য। সুতরাং তাদের ব্যথা কোথায়, তা নেতারা বুঝতেন না। সুতরাং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল থেকে কোনাে মুসলমান নেতাঁর আবির্ভাব ঘটলেই বাংলার আপামর মুসলমান সম্প্রদায় রাজনৈতিক সচেতনতা লাভ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস ছিল।
১৯৪০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় যাদের নেতা বলা হতাে, তাদের কয়েকজন সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই আলােচনা করেছি—যেমন সর্বজনাব রেজাই করিম, ফজলুর রহমান, কফিলুদ্দীন চৌধুরী ও খাজা শাহাবুদ্দীন। এর মধ্যে রেজাই করিম সাহেব ও কফিলুদ্দিন সাহেব ছাড়া বাকি দুজন কলকাতাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় রাজনীতি করতেন। ফজলুর রহমান সাহেব স্কুল বাের্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচনে বলিয়াদীর লাবিবুদ্দিন সিদ্দিকীর কাছে পরজিত হওয়ার পর আর ঢাকার রাজনীতির সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক রাখেননি—তাঁর পক্ষে রাজনীতি করতেন জনাব এ কে ফজলুল হক (মাওলা মিঞা), খাজা শাহাবুদ্দীনের পক্ষে রাজনীতি করতেন প্রথমে সৈয়দ আবদুস সলিম, তারপরে সৈয়দ সাহেবে আলম। সৈয়দ আবদুল হাফিজের মৃত্যুর পর মুসলিম লীগের মনােনয়ন দেওয়া হলাে তাঁর ছােট ভাই সৈয়দ সাহেবে আলমকে। রেজাই করিম সাহেব এবার আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না—মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে মনােনয়নপত্র দাখিল করলেন। যখন সাহেবে আলমের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে দাঁড়াল, তখন মুখ্যমন্ত্রী জনাব ফজলুল হক সাহেব সাহেবে আলমের পক্ষে নির্বাচনী অভিযান আরম্ভ করলেন। রেজাই করিম ভেবেছিলেন যে সাহেবে আলমকে তিনি নিশ্চয়ই পরাজিত করবেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই ভাবতে পারেননি যে ফজলুল হক, যিনি তাঁর পিতার বন্ধু, যে তখনাে কৃষক-প্রজা পার্টির সভাপতি পদে ইস্তফা দেননি—তিনিই আসবেন সাহেবে আলমের পক্ষে ও তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনী অভিযান চালানাের জন্য। শেষ পর্যন্ত রেজাই করিমই পরাজিত হলেন সাহেবে আলমের কাছে, যে সাহেবে আলম কোনাে দিন স্কুলে পড়েননি, যার একমাত্র উপার্জনের উপায় ছিল ঘােড়ার দৌড়ের ‘জকিগিরি’। এর ফলে তিনি অন্তরে যে আঘাত পেলেন, তার ফলে জীবনে এল ফ্রাস্ট্রেশন বা নৈরাশ্য। রাজনীতিতে যাঁরা ফ্রাস্ট্রেশনে ভােগেন, তাঁরা আর জীবনে কখনাে শুদ্ধ বা কারেক্ট’ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে এল তার ওপর আর এক আঘাত। ফজলুর রহমানের দলের
১২৯
বিরুদ্ধে প্রায় সমান সমান ভােটের আয়ােজন করেছিলেন বহু কষ্টে। একটি ভােটের ওপর নির্ভর করছিল তার ভবিষ্যৎ সফলতা। সে ভােটটি ছিল কর্নেল হাসান সােহরাওয়ার্দীর। তিনি আসছিলেন কলকাতা থেকে স্টিমারে ঢাকায়। ভােটের আগে যাতে হাসান সােহরাওয়ার্দী ঢাকা এসে না পৌছাতে পারেন, তার জন্য নারায়ণগঞ্জ-গােয়ালন্দ জাহাজের সারেংয়ের সঙ্গে একটা চুক্তি করা হলাে যে জাহাজটা যদি সে পদ্মায় কোনাে চরে তুলে দিতে পারে, তাহলে তাকে দুই হাজার টাকা দেওয়া হবে। সারেং টাকাটা আগেই দেওয়ার কথা বললেন—এ টাকাটা অনেক দুয়ারে ধরনা দিয়েও জোগাড় করতে পারলেন না। ফলে জাহাজ সময়মতাে চলে এল আর তার দল এক ভােটেই হেরে গেল। তার ধারণা হলাে যে অজস্র টাকা না হলে এ সংসারে কিছুই পাওয়া যায় না। এরই ফলে তিনি পরবর্তীকালে বার্মা রিফিউজি’ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন।
নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ নামেমাত্রই নবাব হলেন। তাঁর পিতা স্যার সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরােধিতা করার জন্য চৌদ্দ লাখ টাকা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে সহজ সূত্রে ধার নিয়েছিলেন। কারণ, হিন্দু মহাজনেরাই পেত তার কাছে প্রায় বারাে লাখ টাকা। সরকার তাঁকে সহজ শর্তে এ ঋণ দিয়েছিল তাঁকে দলে ভেড়ানাের জন্য, ত্রিশ বছরে শােধ করতে হবে—সে ঋণ তিনি তাে শােধ করার কথা ভাবতে পারেননি। খাজা হাবিবুল্লাহ নবাব হলে সে ঋণের বােঝা তার ঘাড়ে চাপে। এ ঋণের ভার তাঁকে তেমন যাতনা দেয়নি, যত দিন তিনি মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তারপর যে অবস্থায় তার দিনগুলাে কেটেছে, তা যারা প্রত্যক্ষ করেনি তারা উপলব্ধি করতে পারবে না।
আর একজন ছিলেন শেফাউল মুলক হেকিম হাবিবুর রহমান। তার বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার, লেখাপড়াও জানতেন—হেকিম হিসেবেও তাঁর খুব সুখ্যাতি ছিল, কিন্তু তিনি যে কোন দলে ছিলেন, তা তাঁর শত্রু-মিত্র কেউ জানত না। তিনি পুরান ঢাকা সম্বন্ধে উর্দু ভাষায় এক পুস্তক লিখেছিলেন। যে তিনজন এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন—তাঁরা ছিলেন ভূতপূর্ব ডিপিআই খান বাহাদুর আওলাদ হােসেন, হেকিম সাহেব ও পরবর্তীকালে সৈয়দ মােহাম্মদ তাইফুর।
তখনকার দিনে মন্ত্রী হওয়ার প্রথম সােপান ছিল—মিউনিসিপ্যালিটি বা জেলা বাের্ড শাসনব্যবস্থার অভিজ্ঞতা। এ কে ফজলুল হক সাহেব ছিলেন মেয়র, সােহরাওয়ার্দী ডেপুটি মেয়র, খাজা নাজিমুদ্দিন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, খাজা শাহাবুদ্দীন জেলা বাের্ডের চেয়ারম্যান ইত্যাদি। অল্পসংখ্যক লােক সে যুগে এ সােপানে আরােহণ না করেই মন্ত্রিত্ব
১৩০
পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে নাম করা যায় ঢাকার নবাব বাহাদুর ও ফজলুর রহমান। অবশ্যই এখন আর সে ঐতিহ্য নেই।
এ সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও যুদ্ধের ঘনঘটা দেখা দেয়। হিটলারের ক্ষমতায় আসা, মুসােলিনির আবিসিনিয়া আক্রমণ—স্পেনে ফ্র্যাঙ্কোর আবির্ভাব। হিটলারের যুদ্ধ প্রস্তুতি। চারদিকে যেন আগুনের হলকা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভেলি চেম্বারলেন মিউনিখে গিয়ে হিটলারের কাছে নতিস্বীকার করে তার সঙ্গে এক চুক্তি সম্পাদন করলেন। ১৯৩৮ সালের ৬ অক্টোবর চেম্বারলেন বললেন :
What we did was to save her (Chezckoslovakia) from annihilation and give her a chance of new life as a new state which involves the loss of territory and fortification, but perhaps would enable her to enjoy in the future, and develop, a national existence under neutrality and security comparable to which we see in Switzerland today.
লিগ অব নেশনসের তদানীন্তন সভাপতি মাননীয় আগা খান মিউনিখ প্যাক্ট সম্বন্ধে তার আত্মচরিতে লিখেছেন :
And now, all these years later, after all the violent and troubles happenings since then, I say without hesitation that I thank God that we did not go to war in 1938. Apart altogether from any highly debatable question of military preparedness or lack of it, if great Britain had gone to war in 1938, the doubt about the moral justification of decision would have remained for ever.
১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে হিটলার স্তালিনের সঙ্গে যুদ্ধ নয়’ (NonAggression Pact) চুক্তি সই করে পূর্ব ইউরােপের ভাগ্য স্থির করে ফেলেন।
ঠিক এ সময় আমার জীবনে আসে এক মাহেন্দ্রক্ষণ। আরমানিটোলা সরকারি হাইস্কুলে হেকটর ডেনিয়েলের স্থলে চাকরিটা পেয়ে নানা কারণে খুশিই হয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন চাকরিতে যােগ দিয়েছি, তার দশ দিন পরেই অত্যন্ত অকস্মাভাবে আমাকে বিবাহ করতে হলাে—আগস্ট মাসের ২৬ তারিখে। যেহেতু আমার স্ত্রী তখনাে সাবালিকা হননি, তাই তাঁর পিতার “এজিনে” বিয়ে হলাে। আজও আমি বুঝতে পারিনি এমনি তাড়াহুড়া করে বিয়ের কাজটা সম্পন্ন করার প্রয়ােজন কেন হয়েছিল। ঠিক এমনি সময়
১৩১
এমনিভাবে বিয়ে করার জন্য আমার মন প্রস্তুত ছিল না। সুতরাং সমাজের একশ্রেণির পথপ্রদর্শকের ওপর আমি শ্রদ্ধা হারাই। অবশ্যই সাহিত্যিক আবুল ফজলের মতে বর্তমান শতকের তৃতীয় দশকে মেয়ের বাবারা ছেলে খুঁজে বেড়াতেন—পরবর্তীকালে তার পরিবর্তন হয়েছে চতুর্থ দশক থেকে। ছেলের বাবারাই এখন মেয়ে বেছে বেড়ান। আমার নাবালিকা স্ত্রীর মধ্যেও আমার বিরূপ মনের প্রতিক্রিয়া হলাে। বিয়ের অর্থটা তার বােঝার বয়স না হলেও আমার মানসিক বিরক্তি সে মনে মনে অনুভব করেছিল। তার অন্তরও স্বভাবিকভাবেই বিরূপ হয়েছিল আমার প্রতি। ফলে সে নিজের তৈরি খােসার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখল চিরদিন। কোনাে দিনই আর আমার সঙ্গে সহজ হতে পারল না। সংসার তাই তার কাছে বােঝাস্বরূপ হয়ে রইল। বৃহৎ সমাজের প্রতি তার কোনাে আকর্ষণ জন্মাল না। আমার কোনাে বাইরের অতিথির প্রতি তার মনােযােগ চেষ্টাপ্রসূত—আমার প্রতি কর্তব্যের নিদর্শন। সংসারটা ছেলেমেয়ে, পিতৃ ও মাতৃকুলের আত্মীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছে। এবং এখনাে চায়। এর জন্য তাকে দুঃখ পােহাতে হয়েছে বিস্তর—ঠকেছে, আঘাত পেয়েছে, তবু তাদের মধ্যেই সে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছে।
আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর কিন্তু আমার ধারণা, আমি তাকে কোনাে দিনই জানতে পারিনি। কারণ, বােধ হয় সে-ও কোনাে দিন নিজেকে আমার কাছে খুলে ধরেনি। আমাকেই কি সে বুঝেছে কোনাে দিন? তা-ও আমি জানি না। সারা জীবনটাকে সে নামাজ, রােজায়, ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠানে ভরে রেখেছে। কোনাে দিন স্বেচ্ছায় সাজগােজ করেনি, যেটুকু করেছে সেটা আমার প্রয়ােজনে। পার্টি রিসেপশনে আমার মান রাখার তাগিদে। যৌবনেও প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহার করেনি, কোনাে সিনেমা দেখতে চায়নি—এমনকি ১৯৫৩-৫৪ সালে ফিল্ম সেন্সর বাের্ডের সদস্য হিসেবে যখন সকালে অনেক দিন একাকী সেন্সরের কাজ সারতে হয়েছে, তখনাে আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারিনি। এ পৃথিবী তার কাছে। কোনাে দিনই একটা বাস্তব বলে কিছু মনে হয়নি। প্রথম জীবনেই সে ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছিল—বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পীর-দরবেশের সংস্পর্শে এসে সেটা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যালােপ্যাথিক ওষুধের ওপর তার বিশ্বাস কোনাে দিনই দেখিনি। সে আমাকে যা দিতে পেরেছে, আমি তা গ্রহণ, করেছি কিন্তু আমার কাছে সে কিছু চায়ওনি, পায়ওনি। তার আত্ম-অহংকার, আত্মমর্যাদাবােধ, স্পর্শকাতরতা তাকে বাধা দিয়েছে আমার কাছে কিছু চাইতে। তার নিজস্ব অধিকারেই যেন সে বেঁচে থাকতে চেয়েছে—কারও করুণার ওপর নয়। আমি ওকালতি, রাজনীতি বা কূটনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। সংসারে টাকাটা পৌঁছে দিয়েই সমস্ত দায়িত্ব থেকে রেহাই পেতে
১৩২
চাই আজও। তার আর আমার দুনিয়া যেন ভিন্ন। আমার আস্থা জীবনের ওপর। তার বিশ্বাস পরজগতের ওপর। তবু আমরা জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। আমার চরিত্র, আমার স্বভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি বেশি কথা বলি আর সে খুব কম কথা বলতে অভ্যস্ত। এমনকি অজু থাকা পর্যন্ত কোনাে কথা বলে না- আসর, মাগরিব ও এশা একই অজুতে আদায় করার পক্ষপাতী। আমি আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে থাকতে ভালােবাসি। বাইরের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব করতে ভালাে লাগে। আমি বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ হয়ে না পড়া পর্যন্ত একই জায়গায় বা একই কাজে পাঁচ-ছয় বছরের বেশি মনােনিবেশ করতে পারতাম না। সুতরাং আমাদের দুজনের যাত্রাপথ ছিল সমান্তরাল রেখার মতাে। আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন তার আকাঙ্ক্ষার বস্তু থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আমি একাকী থাকতে পারি না। মানুষের সঙ্গ না পেলে বইয়ের সঙ্গ আমার চাই-ই। অনেকটা Southey-এর ভাষায় বলতে পারি :
My days among the Dead are past
Around me I behold
Where’re their casual eyes are caste
The mighty minds of old
My never-failing friends are they
With whom I converse day by day.
যাক যা বলছিলাম—এমনি এক অকস্মাৎ বিবাহের পরের দিনই আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমার স্ত্রীকে নিয়ে তাদের দেশে চলে গেলেন।
আমার মনের মধ্যে একটা ঘােরতর দ্বন্দ্ব চলছিল। সমাজের ওপর আমার অশ্রদ্ধা এসে গিয়েছিল—আমি কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। একবার ভেবেছিলাম আর একবার গারাে পাহাড়ে যাই, এবার শিকারের জন্য নয়- বিশ্রাম নিতে, জনপদ ছেড়ে বনের দিকেই যেন মন টানছিল। এমন সময় আমার এক বােন জায়েদা আখতারের কাছ থেকে এক চিঠি পেলাম তার সঙ্গে কিছুদিন অতিবাহিত করার জন্য। আমি বরিশালে তার কাছে গেলাম। সে অন্তরের সমস্ত সহানুভূতি ও সমবেদনা ঢেলে দিয়ে আমাকে অনেকটা প্রকৃতিস্থ করল। ওই সময় আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন ছিল এমন সহানুভূতি, একটু মমত্ববােধ—আমি তার কাছ থেকে তা পেয়েছিলাম আমার জীবনের সেই সন্ধিক্ষণে। এ জন্য আমি তার কাছে আজও কৃতজ্ঞ রয়েছি।
আমাদের বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই গরম খবর। যুদ্ধ বেধে গেছে। ইউরােপে, হিটলার আক্রমণ করেছে পােল্যান্ড। এ আক্রমণের বিরুদ্ধে
১৩৩
ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল ৩ সেপ্টেম্বর। ভারতের ভাইসরয়ও ঘােষণা করলেন ভারতের এ যুদ্ধে যােগ দেওয়ার কথা। কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিল যে যেহেতু ভারতীয়দের সঙ্গে যােগাযােগ না করে ভারত সরকারকে যুদ্ধে লিপ্ত করেছে, সুতরাং কংগ্রেস প্রতিবাদে কংগ্রেসশাসিত প্রদেশসমূহের মন্ত্রিসভাগুলােকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিল। সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহ সাহেব ‘নাজাত দিবস’ ঘােষণা করলেন এবং সারা ভারতের মুসলমানরা নাজাত দিবস’ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করল। ফলে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পদত্যাগে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল তা আর হয়নি। জিন্নাহর এটা একটা মস্ত বড় দক্ষ রাজনৈতিক চাল—যেটা কংগ্রেসের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
জিন্নাহ সাহেব এক বিবৃতিতে বললেন, ‘এ যুদ্ধের ফলে আমাদের অবস্থা হয়েছে তরমুজের মতাে—ছুরি যদি তরমুজের ওপর পড়ে তাহলে তরমুজ কাটে। আবার তরমুজ যদি ছুরির ওপর পড়ে, তা-ও তরমুজই কাটে। আমরা বহু বর্ষব্যাপী সংগ্রাম করে ব্রিটিশ যে শিকল পরিয়েছে, আমাদের চেষ্টায় প্রায় তা আজ পুরােনাে হয়ে ভাঙার উপক্রম কিন্তু আমরা যদি জাপানের হাতে পড়ি, তবে সেটা হবে নতুন শৃঙ্খল—সেটা ভাঙতে লাগবে আরও দুই শ বছর।
আমার অবশ্যই একটি ব্যক্তিগত ভীতি হলাে সে হচ্ছে যদি হেকটর ডেনিয়েল লন্ডনে পৌছাতে না পারেন, তাঁর জাহাজ যদি ফিরে আসে বােম্বে, তবে আমার চাকরি নেই—আগে ছিল ভাইবোেন, এখন যােগ হয়েছে স্ত্রী। যাক, মাস দুয়েক পরে খবর পাওয়া গেল যে হেকটর ডেনিয়েল লন্ডনে পৌছে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে বিমানবাহিনীতে যােগ দিয়েছেন। যাক এদিকে নিশ্চিত হওয়া গেল।
১৯৩৯ সালে রুশ-জার্মান ‘যুদ্ধ নয় চুক্তি’ (Non-Aggression Pact) হওয়ার ফলে জার্মানি ইউরােপে বিনা বাধায় দেশের পর দেশে আক্রমণ চালাতে লাগল। ব্রিটেনে নেভেলি চেম্বারলেন পদত্যাগ করলেন। কারণ দেশময় ‘মিউনিখ প্যাক্ট’-এর বিরুদ্ধে প্রবল সমালােচনা চলছিল। তার ‘এপিজমেন্ট পলিসি’র বিরুদ্ধে সােচ্চার হলাে সাধারণ ইংরেজের কণ্ঠ। উইনস্টন চার্চিল প্রধানমন্ত্রী হলেন। ১৩ মে ১৯৪০ সালে চার্চিল দেশের উদ্দেশে বললেন, ‘I have nothing to offer but blood toil, tears and sweat. চার্চিল যেভাবে ইংল্যান্ডের মানুষকে অনুপ্রাণিত করলেন, তা কেউ পারত না। জার্মানির ভয়ানক ব্লিৎসক্ৰিগের মধ্যেও তারা নিরাশ হলাে না। এটাই বােধ হয় চার্চিলকে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখবে প্রতিটি ইংরেজের কাছে।
১৩৪
এদিকে নাজাত দিবস পালনের পর কংগ্রেস নতুন প্রােগ্রাম নেওয়ার কথা ঘােষণা করল, আর মুসলিম লীগকে আরও শক্তিশালী এবং সংহত করার জন্য জিন্নাহ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সাধারণ বার্ষিক সভা ডাকলেন লাহােরে-মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ নেতারা এটা লাহােরে অনুষ্ঠানের কথা বললেন। স্যার সেকেন্দার হায়াত খানের ‘ইউনিয়নিস্ট’ মন্ত্রিসভাকে মুসলিম লীগ কোয়ালিশন সরকারে পরিণত করতে যেমন বাংলায় ফজলুল হক চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তেমনি মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্যও চাপ দিচ্ছিলেন, আর জিন্নাহ সাহেব সভাস্থল লাহােরে চেয়েছিলেন এ জন্য যে যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর কেন্দ্রস্থল পাঞ্জাবকে আলােড়িত করতে পারলে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত করতে সাহস পাবে না।
স্যার সেকেন্দারের ইচ্ছা ছিল না যে লাহােরে এ অধিবেশন হােক। তার সুখী পরিবারকে উল্টাপাল্টা করার জন্যই যে তাঁর প্রতিপক্ষ ব্যবস্থা করেছে—এটা তার মনে হলাে। সুযােগও এসে গেল। খাকছাররা আন্দোলন শুরু করল। খাকছার নেতা আল্লামা এনায়েতুল্লা মােশরেকি গ্রেপ্তার হলেন। ফলে খাকছাররা হলাে ক্ষিপ্ত—স্যার সেকান্দর চালালেন গুলি—১৯ মার্চ। ১৪৪ ধারা জারি হলাে। স্যার সেকান্দর ও ম্যামদোতের নবাব দুজনেই দিল্লিতে জিন্নাহকে টেলিফোনে অবস্থা জানালেন এবং জানতে চাইলেন যে এ অবস্থায় বার্ষিক সাধারণ অধিবেশন করা ঠিক হবে কি না। জিন্নাহ প্রত্যুত্তরে বললেন, সভা হবেই- লাহােরে এবং ঠিক তারিখ মতােই। কেবল ১৪৪ ধারার জন্য কোনাে মিছিল হবে না। ২১ মার্চ সব প্রদেশের প্রতিনিধিরা এসে পৌছাল। এদিকে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং চলতে থাকল। ২৩ মার্চ সাধারণ সভার প্রস্তাব উপস্থিত করলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। প্রস্তাবটি হলাে :
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অত্র অধিবেশন এ মর্মে অত্যন্ত সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করিতেছে যে নিম্নোক্ত মৌলিক আদর্শসমূহকে ভিত্তি হিসেবে না ধরিয়া অপর যেকোনাে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকরী এবং মুসলমানদের জন্য গ্রহণযােগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবে না। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা এ দেশের কয়েক কোটি মুসলমান দাবি করিতেছে—যেসব এলাকা একান্তভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল প্রয়ােজনানুযায়ী সীমান্তের রদবদল করিয়া ওই সকল এলাকাকে ভৌগােলিক দিক দিয়া এরূপভাবে পুনর্গঠিত করা হউক, যাহাতে উহারা
১৩৫
স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসমূহের (States) রূপ পরিগ্রহ করিয়া সংশ্লিষ্ট ইউনিটদ্বয় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা লাভ করিতে পারে।
“নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এই অধিবেশন উপরােক্ত মূল আদর্শসমূহের ভিত্তিতে লীগ ওয়ার্কিং কমিটিকে শাসনতন্ত্রের একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করিতেছে। উক্ত শাসনতন্ত্রের পরিকল্পনাটি এরূপভাবে প্রণীত হইতে হইবে, যাহাতে সংশ্লিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলের চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশরক্ষা, যােগাযােগ, কাস্টমস এবং প্রয়ােজনবােধে যেকোনাে দপ্তরের দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে পারে।
উল্লেখ্য, উপরিউক্ত প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করার কোনাে কথা থাকল না—এর কারণ ফজলুল হক সাহেবের ক্ষমতা বাংলাদেশে একচেটিয়া করা। তার বক্তৃতার কিয়দংশ আমার A Socio-Political History of | Bengal -এ উদ্ধৃত করা হয়েছে। রাজনীতির ইতিহাসে নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সব সময়েই কাজ করে। এর থেকে মুক্তি পেতে আমার পরিচিত কোনাে রাজনৈতিক নেতাকে সে যুগে দেখিনি।
এ প্রস্তাব পাস হওয়ার পর মুসলমান যুবসমাজ এক নতুন প্রেরণা পেল। তারা আর একটা সম্প্রদায় নয়—তারা নিজেরাই একটা জাতি। সাম্প্রদায়িক রক্ষাকবচের জন্য যে সংগ্রাম করছিল প্রায় দুই শতাব্দী ধরে, তার যেন। পরিসমাপ্তি ঘটল। বয়ােজ্যেষ্ঠরা অবশ্যই এ প্রস্তাবকে সেভাবে গ্রহণ করেনি। তারা ভেবেছিল, তাদের দাবি দেখে কংগ্রেস তাদের সঙ্গে একটা সমঝােতায় পৌছাবে।
এদিকে ১৯৩৯ সালেই কমরেড রায় বলেছিলেন, এবারকার যুদ্ধ জনযুদ্ধ-স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের যুদ্ধ। প্রথমে যে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলে তাঁকে অভিহিত করল; সেই কমিউনিস্ট পার্টিই আবার সে যুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে অভিহিত করল—তখন জার্মানি রুশ দেশ আক্রমণ করল।
আমার দৃষ্টি তখনাে মানচিত্রের দিকে। প্রতি সন্ধ্যায় কাগজ দেখে, রেডিও শুনে মানচিত্রের ওপর রেখা আঁকছি।
মে মাসে রুশ দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া গ্রাস করল । জার্মানির প্যানজার ডিভিশন আশ্চর্য গতিতে ১০ মে বেলজিয়াম, ১৪ মে নেদারল্যান্ডস, জুন মাসে ফরাসি দখল করে নিল—যদিও মার্শা পেত্যার অধীনে একটি ভিসি সরকারের অস্তিত্ব রাখা হলাে। জাপান সেপ্টেম্বর মাসে জার্মান-ইতালিয়ান শক্তিদ্বয়ের সঙ্গে যােগ দিল—হিটলার রুমানিয়া আক্রমণ
১৩৬
করল সেপ্টেম্বর মাসে। যুক্তরাষ্ট্রে রুজভেল্ট ওয়েন্ডেল উইল্কিকে পরাজিত করে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। অপরদিকে জার্মানির এই অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে মুসােলিনিও গ্রিস আক্রমণ করল। কিন্তু ইতালিয়ান সৈন্যরা গ্রিক সৈন্যদের পাল্টা আক্রমণে পিছু হটতে লাগল। উপায়ান্তর না দেখে মুসােলিনি হিটলারের সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। এরপর আবার সবাইকে আশ্চর্য করে দিল যখন হিটলারের সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু রুডলফ হেস অকস্মাৎ একটি উড়ােজাহাজে চড়ে গ্রেট ব্রিটেনে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সমস্ত বিশ্ব যেন হতবাক হয়ে গেল। এর কারণ কেউ বুঝতে পারল না। যুদ্ধে অনেক কিছু ঘটে, যা সাধারণ ইতিহাসের ছাত্ররা বুঝে উঠতে পারে । হয়তাে হেস ভাবছিলেন :
Death is the end of life, ah!
Why Should life all labour be?
Let us alone, what is it that will last?
All things are taken from us, and become
Portions and parcels of the dreadful Past.
আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে-গ্রামে যে হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযােগ ও নানা প্রকার দৈহিক উৎপীড়নের সংবাদ মুখে মুখে আমাদের জেলখানায় এসে পৌছেছে, তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ আজ হােক কাল হােক স্বাধীনতা লাভ করবেই। তাই যদি হয়, তবে পাকিস্তানের আন্দোলন কি ভ্রান্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল? আমরা যারা সে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলাম, তারা কি ভুল পথে মানুষগুলােকে পরিচালিত করেছিলাম? ত্রিশ বছর আগের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত এ প্রশ্নের বিচার করতে হবে। আমার আজও ধারণা যে ইতিহাসের প্রয়ােজনেই পাকিস্তান এসেছিল। আবার ইতিহাসের প্রয়ােজনেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতাসংগ্রামে লিপ্ত।
আমি আমার ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ইতিহাস বইতে সে সময়কার অবস্থা বিশ্লেষণ করেছি—এই বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়ে আরও আলােচনা করব। এ পর্যন্ত যা এ বইয়ে লিখেছি, তা পাঠ করলে কয়েকটি প্রশ্ন মনে উদয় হওয়া স্বাভাবিক। আমরা মুসলমান ছেলেরা যেমন করে আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহের বিশ্লেষণ করেছিলাম বা হিটলার, মুসােলিনি, অষ্টম এডওয়ার্ড, রুজভেল্টের এমনকি লিন্ডবার্গের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি, কমনরুমে আলােচনা করেছি, আমাদের সমসাময়িক হিন্দু ছেলেদেরও দৃষ্টিভঙ্গি কি এসব ব্যাপারে একই রকম ছিল? আমার বিশ্বাস, কংগ্রেস দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘স্বরাজ’-এর জন্য এবং সন্ত্রাসবাদীরা
১৩৭
যে ভাবধারা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতার কথা ভাবছিল—সেসবের প্রতি হিন্দু ছাত্রদের দৃষ্টি এমনভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল যে আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহের বিশ্লেষণ স্বাভাবিকভাবেই তারা করেনি বা তার প্রতি তেমনভাবে তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি। আমি অবশ্যই দেশের নেতাদের কথা বলছি না, আমি আমাদের মতাে ছেলেদের কথা ভাবছি।
আমাদের হলে তখন মফস্বল কলেজ থেকে অনেক ছাত্র আসত, যারা বিদ্যুতের আলাে কীভাবে নেভাতে হয় তা জানত না-ট্রেনের শব্দকে ঝড়ের শব্দ ভেবে আজান দিতে আরম্ভ করত। হিন্দু ছেলেরা সে যুগ অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছিল। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ব্যাপারটা আমাদের পক্ষে খুব সহজ ছিল না। মুসলমান সমাজে তখন একটা জড়তা বিরাজ করছিল। এর ওপর পূর্ব থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের স্বার্থে নবাগত মুসলমান মধ্যবিত্তকে স্থান করে দিতে রাজি হয়নি। যার ফলে তাদের পক্ষে আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইতে নামতে হয়েছিল। এমনকি জিন্নাহ সাহেব যখন তাদের প্রিয় নেতা ফজলুল হককে রাজনীতি ছাড়তে বাধ্য করলেন, তখনাে তারা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিল। অটল হয়ে দাঁড়িয়েছিল নতুন জাতীয় ভূমি সৃষ্টি করতে—তা নইলে তার অস্তিত্বই বিপন্ন হতাে। হিন্দু ছাত্ররা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি যতটা আকৃষ্ট ছিল, আমরা তা ছিলাম না, কেবল ১৯৪০ সালের পর থেকে আমাদের মধ্যে সে অনুপ্রেরণা এসেছিল। সুতরাং আমাদের পথ ভ্রান্ত ছিল না বলে আজও আমি বিশ্বাস করি। যদিও আজ আমি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নির্যাতিত, কারাগারে আবদ্ধ-মৃত্যুর মুখােমুখি এসে দাঁড়িয়েছি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কেন জাতির জন্য আবাসভূমি চাই? জাতি অর্থে আমরা কী বুঝি? বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে বঙ্গভঙ্গ রহিত আন্দোলনের শুরু থেকে হিন্দু ও মুসলমান দুটো সম্প্রদায় দুটো পৃথক রাস্তা গ্রহণ করল, যদিও মুসলমান নেতা যেমন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল দি মােসলমান পত্রিকার সম্পাদক, বর্তমানে আবুল কাসেম সাহেব ও মুজিবুর রহমান। সাহেব, কহিনুর সম্পাদক রােওশন আলী চৌধুরী, সাহিত্যিক ডক্টর আবদুল গফুর সিদ্দিকী, সুবক্তা লিয়াকত হােসেন প্রভৃতি কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে সমর্থন করেছিলেন, তবু যেহেতু তাদের সবারই কর্মস্থল ছিল কলকাতা, যে শহর বৃহৎ মুসলিম বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তাই বাংলার হিন্দু সমাজ তাদের নেতৃত্বকে তেমন গুরুত্ব দিল না। তারা স্যার সলিমুল্লাহকে একচ্ছত্র নেতা বলে ধরে নিল। ফলে বাংলার সব বাঙালিই আর এক বাঙালি জাতি থাকল না, দুই সম্প্রদায় ভিন্নমুখী হয়ে আমরা’ ও ‘তারা হয়ে গেল—তারই ফলে দ্বিজাতিতত্ত্বের সৃষ্টি হলাে বাংলাদেশে।
১৩৮
জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ওই দুটি ধারণা। আমরা বলতে আমরা কী বুঝি—বর্তমান শতাব্দীর প্রথম থেকে তাে বটেই, এমনকি ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই হিন্দু ও মুসলমান—নিজেদের আমরা’ বলে ভাবতে পারেনি। তারই স্বাভাবিক পরিণতি ১৯৪০ সালের লাহের প্রস্তাব। আবার পঁচিশ বছর পর আজ যখন ‘পাঞ্জাবি’ ও ‘বাঙালি’ নিজেদের ‘আমরা’ শব্দের অন্তর্গত বলে ভাবতে পারল না—সেখানেও আবার সেই ‘আমরা’ ও ‘তােমরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, বিশেষ করে একদল প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক নেতা, একদল শােষক সম্প্রদায়, একদল সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ ও একদল আমরা বাংলাকে শােষণ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে ব্যস্ত। হলাে, ফলে যে কারণে পাকিস্তানের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিয়েছিল, সে কারণেই আজ বাংলার স্বাধীনতার প্রয়ােজন হয়েছে। এটা বাঁচা-মরার লড়াই—জিততে হবেই আমাদের এ সংগ্রামে—নইলে আমাদের অস্তিত্বই থাকবে না। এত দিন ভেবেছিলাম বাঙালির পক্ষে পাকিস্তানে থেকে তাদের মানসিক পরিপূর্ণতা লাভ করা অত্যন্ত কঠিন—২৫ মার্চের ভয়াল রাত থেকে মনে হয়েছে আমাদের সে পরিণতি অসম্ভব। তাই বােধ হয় নিজের সন্তানকেও মুক্তিসংগ্রামে পাঠাতে দ্বিধা করিনি।
আবার মনে প্রশ্ন জাগে—বাংলা স্বাধীন হলেই আমাদের পরিপূর্ণতা আসবে। আমরা স্বাধীন বাংলার জন্য চেষ্টা করেছি; আমরা ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন করেছি; আমরা ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের শাসনতান্ত্রিক মৌলিক নীতির বিরােধিতা করেছি; আমরা ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছি—কিন্তু আজ পর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারি সংকলনসমূহ ছাড়া আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকে তেমন বিশেষ কোনাে সৃষ্টিশীল সাহিত্য আমার দৃষ্টিগােচর হয়নি—একমাত্র স্লোগান চলছে পশ্চিম বাংলার পুস্তক আমদানি বন্ধ করাে। ইংরেজির বদলে বাংলা চালু করাে। মনে হয় যেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, নজরুল ইসলাম, সুকান্ত—এঁদের সাহিত্যসৃষ্টির পেছনে ছিল এমনই কোনাে বয়কট আন্দোলন। আমার রাজনৈতিক জীবন প্রথম শুরু, যখন সৈয়দ আবুল হুসেন মুসলমানদের জন্য শতকরা ৪৫ ভাগ আসন সংরক্ষণের বিরােধিতা করে বলেছিলেন যে এর ফলে মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হবে, কর্মক্ষেত্রে ভাটা পড়বে, মন সংকীর্ণ হবে, মস্তিষ্ক শ্রমবিমুখ হবে। তারা জীবন সমস্যার জন্য ক্ষমতা অর্জনে পরান্মুখ হবে। সমাজের মধ্যে বিভিন্ন দিক থেকে জীবনের স্রোত আনার সব চেষ্টা ক্রমে ক্রমে রুদ্ধ ও শিথিল হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস, যেসব সাহিত্যিকের মধ্যে আত্মসম্মানবােধ ও আত্মবিশ্বাস আছে, তারা এমন সব
১৩৯
স্লোগানের পৃষ্ঠপােষকতা কিছুতেই করবে না। আসন সংরক্ষণ সমস্যার ওপর সৈয়দ আবুল হুসেন তাঁর যে মতামত প্রকাশ করেছিলেন, তা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে দেশ স্বাধীন হলে। বাংলার মুসলমানদের জন্য বাংলা ভাষাই মাতৃভাষা হওয়া উচিত কি না, সে ব্যাপারে বিতর্ক বর্তমান শতাব্দীর গােড়া থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। কারণ, নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন উর্দু ভাষাভাষীরা–ঢাকার নবাব পরিবার আর তার ওপর বিহার ও উত্তর ভারতের সন্নিকটস্থ কলকাতা নগরীর বাসিন্দারা। ঢাকার নবাব পরিবারের আদি আবাসভূমি কাশ্মীর, পরে দিল্লি। দুই পুরুষ কাটিয়ে কার্পেটের ও চামড়ার ব্যবসা করতে আসাম, আরও পরে ঢাকায় প্রথম ব্যবসায়ী হিসেবে—পরে জমিদার হিসেবে উত্থান।
এমনকি ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে স্যার এ এফ রহমান অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিরূপে তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন :
একটা বিষম আন্দোলন শুনতে পাই যে বাংলাদেশে মুসলমানদের মাতৃভাষা কী? দুই উপায়ে তার নিষ্পত্তি হতে পারে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে যদি statistics নেওয়া যায়। অর্থৎ বাংলাদেশে কত মুসলমান আছে, কত পুরুষ, কত নারী কার কী ভাষা। তবে অঙ্কশাস্ত্রের সাহায্যে একটা নিষ্পত্তি হয়। তা না হলে মাতৃজাতিকে জিজ্ঞেস করতে হয় যে তাদের ভাষা কী? কিন্তু এ আন্দোলনের আর একটু অংশ আছে। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী হওয়া উচিত? আমার মনে হয় আমার যদিও বিশেষ জানা নেই, জাতি ও ধর্ম হিসেবে ভাষা হয়নি, দেশ হিসেবেই ভাষা হয়েছে। এক এক দেশের এক এক ভাষা। সুতরাং যে দেশে আমাদের বাস, তার ভাষাও আমাদের।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা কী বা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল—আর চতুর্থ দশকে আমাদের সমস্যা ছিল শিক্ষার বাহন ও অফিস-আদালতের ভাষা বাংলা হবে কি না এবং আরও পরে এ ভাষাকে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে কি না। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যে মাতৃভাষাই গ্রহণযােগ্য হওয়া উচিত তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন প্রবন্ধে বলেছেন—আমরা কেবল তার সঙ্গে যােগ করেছিলাম—একে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। ১৯৪৮ সালের আন্দোলন ছিল প্রতিবাদের ভিত্তিতে আর ১৯৫২ সালের আন্দোলন প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের ভিত্তিতে। ১৯৪৮ সালে ভীরু মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আমাদের প্রতিবাদ সহজেই
১৪০
মেনে নিলেন। কারণ, সম্মুখে ছিল গভর্নর জেনারেল ও জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমনের তারিখ। তাই তিনি আট দফা সই করে আন্দোলন প্রশমিত করলেন—যদিও সেটা ছিল চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের মতের বিরুদ্ধে। তবু নাজিমুদ্দিনের প্রতি আজিজ আহমদের একটা আন্তরিক শ্রদ্ধা ছিল বলে তিনি শেষ পর্যন্ত নাজিমুদ্দিনের সম্মান রক্ষার্থে বিরােধিতা পরিহার করেন। আজিজ আহমদের পরামর্শমতাে নাজিমুদ্দিন পরিষদে আট দফা ঘােষণা না করে দু-একটি দফা পড়েই বসে পড়লেন। এটা করেছিলেন যাতে পরিষদের প্রসিডিংয়ের ভেতর দফাগুলাে লিপিবদ্ধ না হয়। তিনি ঐকমত্যে পৌছেছিলেন রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি’ হিসেবে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে তাঁর ইচ্ছা ছিল না। তারপর যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন ঢাকা এসে ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভায় তার প্রতিশ্রুতির তওবা’ হিসেবে ঘােষণা করলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ অর্থাৎ জিন্নাহর ১৯৪৮ সালের বক্তৃতারই প্রতিধ্বনি। এবার তাই আন্দোলন কেবল প্রতিবাদেই সীমাবদ্ধ রাখা চলল না—সরকার এবার প্রস্তুত ছিল। তাই প্রতিবাদ আন্দোলন ঢাকায় সপ্তাহখানেকের মধ্যে পরিসমাপ্ত হলাে; কিন্তু প্রতিরােধ গড়ে উঠল জাতি হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ল—শহীদ মিনার হলাে প্রতীক, কবিতা, নাটক, গল্প লেখা আরম্ভ হলাে। প্রতিবছর সৃজনশীলতার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ তার আত্ম-আবিষ্কার করল। এবার আর ধর্মের দোহাই নেই। ১৯৪৮ সালেও কমিউনিস্টরা কাজ করেছে কিন্তু সংগ্রাম পরিষদে কোনাে হিন্দুকে সদস্য করা হয়নি। ১৯৫২ সালে সে ভয় ভেঙে গেল। তার কারণ বয়ােজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদেরা আন্দোলন শাসনতান্ত্রিক উপায়ে চালাতে চাইলেন। নবীনেরা, বিশেষ করে যুবলীগ ও ছাত্র সম্প্রদায় ও-রকম সীমারেখা টানতে অস্বীকার করল। ১৯৪৮ সালে বিরােধী দলের কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার সমর্থন পেয়েছিলেন—কারণ তারা ওই আন্দোলনের সুযােগে নাজিমুদ্দিনকে তাঁদের সঙ্গে সমঝােতায় আনতে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, ডক্টর মালিক ও তােফাজ্জল আলী—তারা অবশ্যই কেউ রাষ্ট্রদূত আর কেউ মন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৫২-তে তাই এঁদের বাদ দিয়ে চলতে হলাে, যদিও কয়েকজন পরিষদ সদস্য পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেছিলেন এবং একজন প্রতিবাদ করে তার পরিষদের আসনও ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ওই পর্যন্ত বাংলার আপামর জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলে দলমতনির্বিশেষে বাঙালি হয়ে যেতে চাইল না। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার পথে পা বাড়ানাে থেকে বিরত রইল। অর্থাৎ ১৯৫২ সালের প্রতিরােধ আন্দোলনের
১৪১
ভিত্তি হয়ে উঠল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এরই ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আওয়ামী লীগে পরিণত হলাে।
আসলে ভাষা পণ্ডিতদের কাছে একটা সদা-পরিবর্তনশীল বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করে পরিবর্ধিত। যারা ওই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের বিরােধিতা করে, তারা ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি, যে কারণে গ্রিক, লাতিন ও সংস্কৃত মৃত ভাষা। সে কারণেই যেকোনাে ভাষাই বদ্ধ জলাশয়ের মতাে হয়ে থাকলে কিছুকাল পরে সে ভাষা শুকিয়ে যেতে বাধ্য। ভাষা নদী ও কালের মতাে সদা গতিশীল ও বেগবতী হতে হবে—জাতীয় ভাষাকে আন্তর্জাতিক মানে তুলতে না পারলে সে ভাষা শিক্ষা করে কূপমণ্ডুক হতে হবে। জাতীয় ভাষা সমৃদ্ধিশালী করতে হলে বিশ্বের নানা ভাষায় ব্যুৎপত্তি থাকা প্রয়ােজন। জাতীয় ভাষার উত্তৰ্ষ ও সর্বক্ষেত্রে তার ব্যবহার করার প্রয়ােজন—জতির প্রতিটি লােককে মানুষের পর্যায়ে তােলার জন্য। পরাধীন দেশের বাসিন্দা, যারা সাধারণত অশিক্ষিত, অজ্ঞতারাই স্বাধীনতার পর মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধি করে—তার মধ্য দিয়েই সবাইকে বলতে হবে যে তারাও মানুষ। ব্যাপক অর্থে যাকে আমরা বলি মনুষ্যত্ব, বলি তার রূপায়ণ ও উদ্বোধন। আবুল ফজল সাহেব ঠিকই বলেছেন, আমার দেশ, আমার ধর্ম, আমার সভ্যতা, আমার জাতি জগতের সেরা এ মনােভাব অত্যন্ত হাস্যাস্পদ। স্বাধীন জাতি সৃষ্টির প্রয়ােজন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, অন্য অর্থে মানবতার অংশ হতে। বুদ্ধের মতাে মানুষের মুক্তি নির্বাণে—যেমন নদীর প্রবাহ সাগরের দিকে, তেমনি ভাষার প্রবাহ হবে উত্তরােত্তর জ্ঞান আহরণে পথে কেবল স্বসমাজের পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগের বা ভাব বিনিময়ের জন্যই নয়। আবুল ফজল সাহেব তার রাঙ্গা প্রভাত-এ লিখেছেন, ‘জীবনও হয়ত সামনের এই প্রবহমান শখেরই মত-কে জানে কোন দুর্গম গিরিগুহায় তার জন্ম, আঁকাবাঁকা তার পথ, কত ঘরবাড়ি, লােকালয় গ্রাস করে, কত দেশ-দেশান্তরকে ফলে-পুষ্পে সুশােভিত করে আপন মনে প্রবাহিত হয়ে চলেছে এ শঙ্খ—অথই সমুদ্রে তার নিলয়-নির্বাণ নয়। মুক্তি যেন তার কাম্য।
জ্ঞানই শক্তি। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Knowledge is power’—কারণ জ্ঞানই মানুষকে পশুত্ব থেকে দেবত্বে পৌছায়—একেই বলে বুদ্ধ অথবা জ্ঞানী। আমরা যতই স্লোগান দিই ‘তােমার আমার ঠিকানা—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; কিন্তু পদ্মা, মেঘনা বা যমুনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা চলেছে। সাগরের পানে আমাদের কখনাে উপকার করে, কখনাে ধ্বংস করে।
বর্মা দেশে প্রায় চার বছর অবস্থান করে আমার ধারণা হয়েছে যে বর্মা দেশ নিজেকে লৌহবর্মে আচ্ছাদন করে একটি দ্বীপে পরিণত হয়েছে। বৃহৎ
১৪২
মানবসমাজের সঙ্গে তার যেন সংযােগ নেই। আমি জানি, একদিন তারা জানতে পারবে মহাসাগরের দ্বীপসমূহ একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলেও তলাতে তাদের একই মাটি, যদি সে ভাসন্ত প্রবাল দ্বীপ না হয়, যার অস্তিত্ব যেকোনাে সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে। আমি আজও বিশ্বাস করি, যা আবুল হুসেন ও ‘শিখা গােষ্ঠীর চিন্তানায়কেরা বিশ্বাস করতেন ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’
বাংলার আজকের দুর্দিনে আমার মনে আসছে অতীতের নানান কথা। ভাবছি, ১৯৩৭ সালে শরৎ বসু যদি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে রাজি হতেন, যদি ফজলুল হক সাহেবকে শর্তাধীনে সমর্থন না দিতেন, যদি ফজলুল হক সাহেব তার নতুন প্রস্তাব নিয়ে গিয়ে শরত্যাবুর সঙ্গে দেখা না হওয়ায় নিরাশ হয়ে না ফিরে আসতেন, তবে বাংলার ইতিহাস কি ভিন্ন মােড় নিতে পারত? শরবাবু বলেছিলেন যে কংগ্রেস ফজলুল হকের কৃষকপ্রজা মন্ত্রিসভাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করবে, যদি রাজবন্দীদের সর্বপ্রথম মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁর দল এ শর্ত গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। কারণ, প্রথমেই ওই আদেশ দিলে গভর্নর মন্ত্রিসভা ভেঙে দেবেন। আবার নির্বাচন হলে তাদের পক্ষে মুসলিম লীগের অর্থভান্ডারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন না। ফলে সে নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়জয়কার হবে। ফজলুল হক সাহেব তার প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা করতে গেলেন যে তিনি কংগ্রেসকে প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি আছেন যে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা কংগ্রেস প্রদেশসমূহে যেদিন ওই আদেশ দেবেন, তিনিও সেদিন একই আদেশ দেবেন। কিন্তু শরত্যাবু রাত দশটায় বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। তাই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলাে না। মুসলিম লীগের কর্মীরা এ সুযােগ গ্রহণ করলেন এবং ফজলুল হক সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ণ সমর্থন দিতে প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইতিহাসও নেতাদের কাজের জন্য বিভিন্ন মুখে চালিত হয়।
পাকিস্তান দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হয়নি। মুসলমান জাতির ধর্মীয় নেতারা, যেমন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা হােসেন আহমেদ মাদানী—সত্যি বলতে বিশিষ্ট মাওলানারা বেশির ভাগই ছিলেন ‘জমাতে ওলামায়ে হিন্দু প্রতিষ্ঠানের সদস্য। তারা অখণ্ড ভারতের পক্ষে ছিলেন। তাঁরা সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করেননি—সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যেসব স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল—তারা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেনি। নতুন করে তার প্রমাণ দিতে হবে না। এমনকি পাঞ্জাবেও প্রথমে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব হয়নি—কেবল যেখানে মুসলমান সম্প্রদায় উচিত বিচার পায়নি, সেখানেই মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা হয়েছিল। এমনিভাবে আরও কত কথাই-না মনে পড়ে।
১৪৩
আমি ক্রমাগতই অসুস্থ হয়ে পড়ছি। হয়তাে সব কথা লিখে যেতে পারব । নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এসে মনে হচ্ছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। জানি না, আমাদের ভাগ্যে কী আছে।
ডিসেম্বর মাস-যুদ্ধ বেধেছে। বিমান থেকে ভারতের প্রধান সেনাপতির নামে কাগজ ফেলা হচ্ছে পাকিস্তানের সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে। আমাদের জেলখানায় এ কাগজ পড়ছে। আমার পক্ষে আর কিছু লেখা সম্ভব নয়। আপাতত তাই আমাকে লেখা সমাপ্ত করতে হলাে। যদি কোনাে দিন বাইরে যেতে পারি, তবেই আমার জীবনের বাকি কথা লিখব। রাজনীতি আর করব না—এ স্বাস্থ্য নিয়ে। যদিও রাজনীতি করে এটা জানতে পেরেছি। 67, ‘He who is silent is forgotten he who does not advance, falls back; he who ceases to become greater, becomes smaller. 159 SIA (1, ‘If you don’t kick at the world, you would be kicked around by the world.
তবু স্থির করেছি, নীরবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। ঘরের খেয়ে বনের মােষ তাড়ানাের মতাে মনের অবস্থা আর ফিরে আসবে না। দেশকে আমার যতখানি দেওয়ার ছিল তা দিয়েছি। আমার আর কিছু দেওয়ার নেই। নতুনের যুগ এসেছে। পুরােনাের বিদায় নেওয়ার পালা এখন। পুরােনাে যেন নতুনের বাধাস্বরূপ হয়ে না দাঁড়ায়—এ প্রার্থনাই করব বাকি জীবন, যদি অবশ্য জীবন্ত ঘরে ফিরে যাই। পুরােনাে ও নতুনের মধ্যে দূরত্ব সম্যক উপলব্ধি করেই এ সিদ্ধান্ত আজ আমি নিচ্ছি।
১৪৪

দ্বিতীয় খণ্ড

১৫৩
ভূমিকা

বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ (প্রথম খণ্ড) লেখা হয়েছিল যখন আমি ইয়াহিয়া সরকার কর্তৃক মার্শাল ল রেগুলেশনে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হই। দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। জেলগেট খুলে দেওয়া হয় ১৭ ডিসেম্বর। প্রথম খণ্ড লেখা সমাপ্ত হয় ১০ ডিসেম্বর। তারপর এক সপ্তাহ এমন ভীষণ মানসিক চাঞ্চল্যের মধ্যে কেটেছিল যে পাণ্ডুলিপিটা কোথায় পড়ে ছিল তা-ও মনে ছিল না। বাড়ি এসে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে ওটা ফেলে আসিনি অন্যান্য অনেক কিছুর মতাে। জেলগেট খােলার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সাড়ে চার হাজার কয়েদি চোর, ডাকাত, খুনি, লম্পট, ঠগবাজ, রাজনৈতিক বন্দী, মার্শাল ল রেগুলেশনে বন্দী সবাই সবকিছু ভুলে ছুটে চলেছে গেটের দিকে। সেপাইরা ভয়ে পলাতক, জেলাররা অফিস ছেড়ে কোনাে এক কামরায় গা ঢাকা দিয়েছে। জেলগেটে কার কী জমা আছে…কে দেবে। রাজনৈতিক বন্দীরা বেরােল সবার শেষে…কারণ আমার যুক্তি ছিল যে এত দিন যদি আমরা থাকতে পেরেছি, দু-এক দিন একটা সরকারি আদেশের জন্য আমরা কেন দেরি করতে পারব না। কিন্তু কে শােনে কার কথা। আমার একমাত্র অ্যাটাসি কেসটা ছাড়া আর সব, যেমন জুতা, স্যান্ডেল, কাপড়-জামা সবই দিলাম একজনের কাঁধে। বললাম, বাইরে পৌছে দিলে তাকে বকশিশ দেব। কারণ শীতের দিনের লেপ, চাদর, বালিশ ইত্যাদি ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য আমার পক্ষে বাইরে বয়ে আনা সম্ভব ছিল না—জেলখানার শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তাদের কোনাে সাহায্য পাওয়ারও উপায় ছিল না।
এই পুস্তকের প্রথম খণ্ড লেখা হয়েছিল এক বিশেষ পরিবেশে আর দ্বিতীয় খণ্ড লেখা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে—এখন আমি মুক্ত এবং স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই খণ্ডে যা লিখব তা অনেকটা আমার দেখা বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাস। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গে আমি এবং বেশির ভাগ মুসলমান সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় মধ্যবিত্তের
১৫৯
আত্মবিকাশ বলতে আমি মুসলিম সমাজের মধ্যবিত্তের কথাই বলতে চেয়েছি।
তা ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সময়ে কৃষকেরা জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই। কিন্তু সেসব বিদ্রোহ নেতৃত্বের অভাবে ও আদর্শের অভাবে কখনাে সর্ব-বাংলার রূপ নেয়নি। বর্তমান শতাব্দীর তৃতীয় দশকে কিছুসংখ্যক নেতা এসব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে নাম করা যায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, গফরগাঁওয়ের মাওলানা শামসুল হুদা, বগুড়ার রাজিবুদ্দীন তরফদার, দিনাজপুরের হাজী দানেশ, ময়মনসিংহের আবদুল ওয়াহেদ বােকাই নগরী, কুমিল্লার রমিজউদ্দীন। যারা গােড়াতে একটা ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাআন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করলেও মওলানা ভাসানী আসামে হিজরত করার পর এবং ফজলুল হক সাহেবের প্রজা-আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর তাঁদের ওই ধরনের আন্দোলনে ভাটা পড়ে যায়। কারণ, ফজলুল হক সাহেব সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত ও নিজেই সাটুরিয়া স্টেটের মােতােয়ালি সূত্রে একজন ছােটখাটো জমিদার—শহরে লেখাপড়া শিখেছেন বাল্যকাল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রি নিয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ গ্রহণ করেন, যা তখনকার দিনে বাংলাদেশীয় লােকদের জন্য সরকারি উচ্চ পদ। তিনি সে চাকরি ইস্তফা দিয়েছিলেন কারণ হিন্দু ওপরওয়ালাদের কাছ থেকে তিনি সুবিচারের আশা করতে পারেননি। স্বভাবতই তার আকাঙ্ক্ষা ছিল মুসলমান সমাজকে হিন্দু সমাজের সমকক্ষ করা। হিন্দুদের বুঝিয়ে দেওয়া যে দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে হেয় করে দেখা চলে না। জনাব ফজলুল হকের কাছে তাই কৃষকপ্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের মধ্যে কোনাে পার্থক্য ছিল না। একমাত্র শর্ত তাকে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে। তার ভাগ্যও ছিল ভালাে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের অবস্থা অনেকটা ভালাে হয়। তারা পাটের দাম পেয়ে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া শেখানাের জন্য ব্যস্ত হয়। ফজলুল হক দেশের অন্তরের খবর রাখতেন। সুতরাং জমিদার, জোতদার, মহাজনদের বিরােধিতা ছাড়াও তিনি শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিতে থাকেন।
আমার রাজনৈতিক জীবনে তেমন কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়নি আমাদের দেশে—একমাত্র ১৯৪৫-৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলন ছাড়া। তেভাগা আন্দোলন যতটা সাঁওতাল ও তফসিলি হিন্দু কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়েছিল, ততটা ছড়ায়নি মুসলমান কৃষকদের মধ্যে। তবে কমরেড মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে এ আন্দোলন সংক্রমিত হয়েছিল। অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে যে এ আন্দোলনে মুসলমান কৃষকেরা অংশগ্রহণ করেছিল—ফজলুল হক সাহেব ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর।
১৬০
আমার মতে, শেরেবাংলার কৃষক-প্রজা আন্দোলন এবং মুসলিম লীগ আন্দোলন ছিল সমপর্যায়ের আন্দোলন। দুটো আন্দোলনের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপায়িত করা ও হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে সমকক্ষতা দাবি করা এবং নিজেদের ভদ্রলােক হিসেবে বিকশিত করা। যার প্রয়ােজন ফুরিয়ে গিয়েছিল ১৯৫৩ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে। পাকিস্তান হওয়ার পরই কেবল নতুন বুর্জোয়া মধ্যবিত্তের সৃষ্টি হয়, যারা শিল্প বা পেশার ওপরে নির্ভরশীল।
কোনাে কৃষক বিদ্রোহই আমার এ পুস্তকের মধ্যে তেমন স্থান পায়নি। যেমন পায়নি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। (এ সম্বন্ধে আমার পূর্ব লিখিত পুস্তক। A Socio-Political History of Bengal And the Birth of Bangladesh দ্রষ্টব্য)।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশরাজের সমঝােতার ফলে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ হাউস অব কমনস’-এ আইন পাস করে ব্রিটিশ ভারতে ‘ভারত এবং পাকিস্তান’ দুটো রাষ্ট্র গঠিত হয়। কিন্তু দুটো দেশেই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীয় লােকেরা বিভিন্ন সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতে থাকে, সেদিক দিয়ে দেশ বিভাগে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়নি। ভারতে যদি দাঙ্গা বেশি হয়ে থাকে, তার কারণ ভারতভূমি। থেকে তার অংশবিশেষের বিচ্ছিন্নতা অন্তর দিয়ে কোনাে ভারতবাসীই মেনে নিতে পারেনি। এটা অস্বাভাবিক নয় তাদের পক্ষে। ধর্ম যত দিন জীবনকে ধারণ করবে, তত দিন এশিয়ায় এ সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।
অথচ ধর্মের বাঁধন না থাকলে অজ্ঞ, নিরক্ষর লােকদের মধ্যে সামাজিক শৃঙখলা কেবল আইন করে আনা যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। হয়তাে শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থায় সেটা হতে পারে, তবে শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কোনাে দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে এলেও সে দেশে বিশ থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে শ্রেণি পার্থক্য দেখা দেয়। এটা আমার অভিজ্ঞতা যে সম্পূর্ণ শ্রেণিহীন ব্যবস্থা যারা আজ পর্যন্ত বিপ্লবের মাধ্যমে করেছে, তারাও পার্টির সদস্যদের শ্রেণির ঊর্ধ্বে রেখেছে। শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা একটা জাতির পক্ষে সাময়িক চিত্র মাত্র হতে পারে। কিন্তু সর্বকালের জন্য কোনাে দেশ শ্রেণিহীন হয়ে থাকতে পারে না। কথাটা প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ বলে সবার মনে হবে কিন্তু সমাজবাদী। দেশগুলাে সম্বন্ধে আমার এ ধারণা জন্মেছে। আমরা সমস্ত উৎপাদনব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে পারি কিন্তু মানুষের বুদ্ধিশক্তির ধারক মস্তিষ্কের শক্তি, যার ওপর উৎপাদন বহুলাংশে নির্ভরশীল, তা জাতীয়করণ করতে পারি না। কলকারখানায়, মাঠে-ময়দানে, অফিসে বা প্রশাসনে আমার যে নেতৃত্ব বা
১৬১
কাডার সৃষ্টি করার প্রয়াস পাই—তার কারণই হচ্ছে ব্যক্তিত্বের মধ্যে যে মস্তিষ্ক শক্তির প্রয়ােজন তা মেনে নেওয়া।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত আমার পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি গ্রন্থে নয়া চীনের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চেন-ই-র একটি বিবৃতির উল্লেখ করেছিলাম। ১৯৭১ সালে সে বিবৃতিটির সারমর্ম আরও সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলাম। চেন-ই বলেছিলেন:
The blood baths, communal and racial conflicts we see in the new emergent nations of Asia and Africa are due to the conspiracy of the colonial powers who before giving independence saw to it that there remain the causes of conflict, so that they are asked to intervene.
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। তাই মানুষকে কোনাে এক মহাশক্তির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় বিপদে আশ্রয় খোঁজার জন্য। সুতরাং এখানে ধর্মের প্রতি টান মানুষের থাকবেই। এখানে ধর্ম খারাপ বলে কোনাে লাভ নেই। শুধু দেখতে হবে ধর্মের নামে যেন সাম্প্রদায়িকতা না প্রশ্রয় পায়। যে দেশে জনগণ সমস্যাসচেতন নয়, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ। অনেক সময়ই তাই গণতন্ত্র জনগণতন্ত্র না হয়ে শােষণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের শতকরা আশিজন যেখানে নিরক্ষর, সেখানে সমস্যাসচেতনতা সম্ভব বলে মনে হয় না।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র চালু হওয়া উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের কতগুলাে পূর্বশর্ত আছে, যা বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র করা যায় না। কেবল ওটাকে রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে স্বস্বার্থে ব্যবহার করা চলে।
জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে আমার মতামত আমার Socio-Political History of Bengal-এ লিখেছি, সুতরাং এখানে তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়ােজন।
মানবতাবাদে দীক্ষা না নিয়ে কোনাে মতবাদকে আদর্শ করে এগিয়ে যেতে চাইলে পথ হারাতে হবে। তা-ই হয়েছে অনেক সমাজবাদী দেশে, অনেক গণতান্ত্রিক দেশে, আর অনেক জাতীয়তাবাদী দেশে–অতীতে এবং বর্তমানে । মনে রাখতে হবে কার্ল মার্ক্সের একটি কথা :
Man is the root of mankind.
জীবনে আমি অনেক ভুল করেছি—কখনাে ইচ্ছায়, কখনাে অনিচ্ছায় । মানুষের ভালােবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং স্নেহও যেমন পেয়েছি, চরম ঘৃণা,
১৬২
তাচ্ছিল্যও পেয়েছি, অপমানিতও হয়েছি। সােহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে একদিন বলেছিলেন, তুমি তাে রাশি মানাে না, আমি অনেকটা মানি। কন্যা রাশিতে যার জন্ম, তার জীবনে তার প্রাপ্য সফলতা আসতে পারে না।’ হেসে বলতেন, ‘অর্ধশতাব্দী রাজনীতি করে আমি পনেরাে মাস বাংলার প্রধানমন্ত্রী আর চৌদ্দ মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছি—অথচ স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন চিরজীবনই সরকারি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। এটা ঈর্ষা করে বলছি না—এটা রাশির ফল। এখানে উল্লেখ করা যায় যে শহীদ সাহেব প্রতিবছরই ভৃগু পণ্ডিতের কাছ থেকে বছরের ফলাফল দুই শ টাকা দিয়ে গনাতেন। পরের বছর আবার ভণ্ড পণ্ডিতকে টাকা পাঠানাের সময় লিখে দিতেন যে গত বছরের গণনার কোনাে ফল পাইনি—কিন্তু ভালাে কথা শুনতে এবং ভাবতে ভালাে লাগে। তাই আবার নিষ্ফল ভাগ্য গণনার জন্য নতুন করে দুই শ টাকা পাঠাচ্ছি।’ ফটোগ্রাফির মততা, বলনাচার মতাে—ভাগ্য গণনাও ছিল তার একটা ‘হবি’।
জীবনের প্রথম থেকেই আমার মন আন্তর্জাতিকতাবাদ-বিলাসী—তাই জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব আমাকে যত আনন্দ দিয়েছে, তা আর কোথাও পাইনি।
বাঙালির জীবনে ষাট বছরের ঊর্ধ্বে বেঁচে থাকাই যেন একটা অভিশাপ। বাংলার আবহাওয়া ভালাে স্বাস্থ্য বহুদিন রক্ষার পক্ষে অনুপযােগী। তাই ষাটের ঊর্ধ্বে বাঙালিকে আমি চিরকালই দেশের ওপর একটা বােঝা বলে মনে করেছি—আজও করি। ষাটের পরে আর বাঙালির উৎপাদন শক্তি বা সৃষ্টিশীলতা থাকে না বলে আমার বিশ্বাস। সে শুধু গিলিত চর্বণ করে অতীতের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চায়।
তাই আমি ষাটের পরেই লিখছি অতীতের কথা।
কামরুদ্দীন আহমদ
১৬৩

প্রথম অধ্যায়

পাকিস্তান আন্দোলন

লাহােরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ যে প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহের নেতাদের নিকট গ্রহণযােগ্য করার জন্য মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র সংশােধন করা হয় এবং ২৮ক ধারা গঠনতন্ত্রে সন্নিবেশিত হয়। ওই ধারায় বলা হয় যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগসমূহের ওপর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। এর ফলে মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভাগুলাের ওপর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের ওপর, যেখানে সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহ থেকে বেশির ভাগ সদস্য গ্রহণ করা হতাে, তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপিত হলাে। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় কর্ম-পরিষদ প্রকৃতপক্ষে একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সমস্ত ক্ষমতা গ্রহণ করে। ফলে মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহের নেতৃবৃন্দ মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের নেতাদের ভাগ্যবিধাতা হন—এমনকি কোথায় কীভাবে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে, কে কে মন্ত্রিসভায় থাকবেন, তা-ও স্থির হতাে জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের ইচ্ছার ওপর। সংখ্যাগুরু প্রদেশের মুসলিম লীগের নেতারা প্রাদেশিক নেতায় পরিণত হলেন। বাংলার সাড়ে তিন কোটি মুসলমানদের নেতার ভাগ্য স্থির করার মালিক হলাে ভারতের উত্তর প্রদেশ, বােম্বে প্রভৃতি দেশের নেতৃবৃন্দ, যারা তাদের নিজ নিজ প্রদেশে কোনাে দিন কোনাে দায়িত্বপূর্ণ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের নেতাদের মধ্যে একটা তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ব্যবস্থাটা হলাে সাম্যবাদী রুশ দেশের মতাে। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা।
লাহাের প্রস্তাবকে পরবর্তী দিল্লি অধিবেশনে জিন্নাহ সাহেব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ বলে অভিহিত করেন। যদিও বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে হিন্দু
১৬৫
পরিচালিত সংবাদপত্রসমূহ লাহাের প্রস্তাব’কে পাকিস্তান বলে আখ্যায়িত করছে, অন্যদিকে আমরাও একটা নাম খুঁজছিলাম—তাই আমরা আজ থেকে লাহাের প্রস্তাব’কে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ বলে অভিহিত করব, কিন্তু সত্যিকার কারণ ছিল গঠনতন্ত্র সংশােধন করে একনায়কত্ব সৃষ্টির যে পথ করা হয়েছিল, আগের অধিবেশনে তারই ভিত আরও শক্ত করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। লাহােরে তাঁর বক্তৃতার যে অংশ লাখ লাখ অনুলিপি করে ভারতের প্রতিটি প্রদেশের মুসলিমদের কাছে পাঠানাে হয়েছিল, তার মুসাবিদা করেছিলেন পরবর্তীকালে ডন-এর সম্পাদক এবং আরও পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আলতাফ হােসেন। অংশটি ছিল নিম্নরূপ :
We maintain and hold that Muslims and Hindus are two major nations by any definition or test of a nation. We are a nation of hundred million, and what is more, we are a nation with our own distinctive culture and civilization, language and literature, art and architecture, names and nomenclature, sense of value and proportion, legal laws and moral codes, customs and calendar, history and traditions, aptitudes and ambitions, in short, we have our own distinctive outlook on life and of life. By all canons of international law we are a nation.
উপরিউক্ত বক্তব্যের উত্তরে গান্ধীজি বলেছিলেন :
If we accept the arguments of sree Jinnah the Muslims of Bengal and the Muslims of Punjab would become two distinct and separate nations.
পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে কি না, তা নিয়ে অনেক আলােচনা চলতে থাকে। প্রথম পুস্তক এ বিষয়ে লেখেন ডক্টর আম্বেদকার। তিনিই প্রথম পাকিস্তানের একটা ইন্টেলেকচুয়াল রূপদান করেন। আরও পরে সাংবাদিক মুজীবুর রহমান খা বাংলা ভাষায় পাকিস্তান পুস্তকটি লেখেন। তাঁর পুস্তকে বর্ধমানকে বাংলার মানচিত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়। আরও পরে পাকিস্তানের ওপর একখানা পুস্তক বেরােয় ইংরেজিতে। গ্রন্থকারের নামের স্থলে শুধু লেখা ছিল বাই এ পাঞ্জাবি। খুব সম্ভব বইখানা ইফতেখার হােসেন খান মামদোতের লেখা। ভবিষ্যতের পাকিস্তানের অর্থনীতির আলােচনা করে এক পুস্তক প্রকাশ করেন জনমাথাই।
এ সময়ে ঢাকায় আন্দোলনকে রূপ দেন ফজলুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বে শহীদ নজীর আহমদ ও তাঁর অনুগামী কিছুসংখ্যক ছেলে, যাদের মধ্যে নাম
১৬৬
করা যায় শামছুল হক, আজিজ আহম্মদ, গিয়াসউদ্দীন, খােন্দকার মােশতাক আহমদ এবং আরও অনেকে। এ কে ফজলুল হকের (মাওলা মিঞা) নাজিরাবাজারের বাসায় আলােচনা বৈঠক আরম্ভ হয়।
১৯৩৮ সালে রাজা সৈয়দ মােহাম্মদ মেহেদীকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করা হয় কংগ্রেস প্রদেশসমূহে মুসলমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে সকল অভিযােগ উত্থাপন করেছিল, তারই তদন্তের জন্য। ওই বছরেরই অক্টোবর মাসে কমিটি মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদের নিকট তাদের রিপাের্ট পেশ করে। ওই রিপাের্টই ‘পীরপুর রিপাের্ট’ নামে খ্যাত। ১৯৩৯ সালে এ কে ফজলুল হক সাহেব রিপাের্টটি বাংলাদেশে প্রকাশ করেন। মুসলিম লীগের ওই রিপাের্টের পরিপ্রেক্ষিতে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘােষণার পটভূমিতে ‘ডিফেন্স কমিটি গঠন করা হয়। ওই সংগঠনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন মামদোতের নওয়াব, কাজী ঈসা, চৌধুরী খালিকুজ্জামান, মাওলানা জামাল মিঞা প্রভৃতি। রেজাই করিম সাহেবের বাসায় কয়েক দিন বৈঠক বসেছিল। এঁদের সম্মুখে। বদরুদ্দিন সিদ্দিকী ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে হলি উৎসবের সময়। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত শহরে সকালের দিকে। গ্রামের নিরক্ষর মুসলমান, যারা সকালে শহরে আসছিল, মামলা-মােকদ্দমা বা ব্যবসার প্রয়ােজনে, তারা হলাে প্রথম শিকার। এর ফলে গ্রামের মধ্যেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। ১৯২৬ সাল থেকে ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবারে সেটা ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে, বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের রায়পুরা, মনােহরদী ও নরসিংদী এলাকাসমূহে। পূর্ব বাংলার গ্রামসমূহ যেহেতু মুসলিমপ্রধান, সেহেতু প্রথমেই হিন্দুবাড়িতে লুটপাট শুরু হয়—গ্রামগুলােতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য বন্দুকধারী গারােয়ালি স্পেশাল পুলিশ পাঠানাে হয়—যার ফলে মুসলমানদের ওপর এমন অত্যাচার শুরু হয় যে বেটাছেলেরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে—পুলিশ তাদের না পেয়ে গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দিতে থাকে; বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ রক্ষা করার জন্য তারা অনন্যোপায় হয়ে পুলিশের নিকট আত্মসমর্পণ করে। হাজার হাজার মুসলমান কৃষককে দড়ি বেঁধে ট্রেনে ঢাকায় চালান দেওয়া হয়। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে কোর্টে উপস্থিত করা হয়। তাদের জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য একটি ‘লিগ্যাল ডিফেন্স কমিটি গঠন করা হয়। মামলা পরিচালনার ভার নেন রেজাই করিম সাহেব, সুলতানউদ্দীন সাহেব, আতাউর রহমান খান সাহেব (পরবর্তীকালে চিফ মিনিস্টার), আলী আমজাদ খান (পরবর্তীকালে পরিষদ সদস্য), ওয়াছিহউদ্দীন সাহেব (পরবর্তীকালে জুডিশিয়াল সেক্রেটারি), এ টি মােজহারুল হক সাহেব (পরবর্তীকালে পরিষদ সদস্য) প্রমুখ মুসলমান
১৬৭
উকিল। এর মধ্যে এক সুলতানউদ্দীন সাহেব ছাড়া আর বাকি সবাই রেজাই করিম সাহেবের জুনিয়র ছিলেন। মােক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলেন শামসুল হক সহেব, হেমায়েতউদ্দীন সাহেব ও মােমতাজউদ্দীন সাহেব। যেহেতু প্রচুর টাকার প্রয়ােজন ছিল, তাই চান্দা তােলার জন্য কাদের সরদার সাহেবকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে কফিলুদ্দীন চৌধুরী সাহেবও ছিলেন। আমার কাজ ছিল এসব বিভিন্ন কমিটির সমন্বয় সাধন করা। আমাদের ছাত্র সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কখনাে যােগ দেয়নি বা তাদেরও আমরা ব্যবহার করিনি। মুসলিম লীগ সরকার একটি ইনকোয়েরি মিশন’ বসায়। মুসলিম লীগ, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা—সব রাজনৈতিক দল তাদের আরজি দাখিল করে। মুসলিম লীগের পক্ষে ছিলেন রেজাই করিম সাহেব এবং তাঁর সহকারীরা। মামলা পরিচালনা করতে ময়মনসিংহ থেকে নূরুল আমীন সাহেবকেও আনতে হয়েছে মাঝেমধ্যে, হিন্দু মহাসভার পক্ষে গিরীশ দাশ ও পংকজ ঘােষ, কংগ্রেসের পক্ষে শ্রীশ দাস তাঁদের স্বস্ব পার্টির পক্ষে উপস্থিত হন। কয়েক মাস পর ফজলুল হক সাহেব তার ভাগনে মাহবুব মাের্শেদ সাহেবকে স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল’ মনােনীত করেন সরকারি পক্ষে সওয়াল-জওয়াব করার জন্য। মাের্শেদ সাহেব তার কিছুদিন আগেই ব্যারিস্টার হয়ে আসেন। যদিও তার আগে তিনি অ্যাডভােকেট ছিলেন। পরিষদে তাই বিরােধী দল ওই মনােনয়নের বিরুদ্ধে তীব্র সমালােচনা করে। বিশেষ করে তাঁর ‘ফিস’ দৈনিক পাঁচ শ টাকা স্থির করায় ফজলুল হক সাহেবকে স্বজনপ্রীতির অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী পরিষদে জবাব দিতে উঠে বলেন যে অভিজ্ঞতা বা বয়স দেখেই কেবল গুণাগুণ বিবেচনা করা যায় না। মনােনীত কাউন্সেল তাঁর ভাগনে, সুতরাং এটা ধরে নিতে হবে যে সে অন্য সবার চেয়ে বেশি উপযুক্ত। আলােচনা এরপর আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।
ওই বছর চলছিল দেশে আদমশুমারি। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এক সভায় চ্যালেঞ্জ করেন যে বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। ব্রিটিশ সরকার। হিন্দুদের দাবিয়ে রাখার জন্য বাংলাকে মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশ বলে ঘােষণা করেছে। মুসলিম লীগ ওই চ্যালেঞ্জকে কোনাে গুরুত্বই দেয়নি, কিন্তু যখন লােক গণনার কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে, তখন মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক সাহেবের চৈতন্য উদয় হলাে এবং তিনি এক বিবৃতিতে বললেন যে হিন্দু উকিল, মােক্তার, ডাক্তার, ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ সবাই মিলে ওইবারের আদমশুমারিতে তাদের সংখ্যা বাড়ানাের জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের হলাে—পরে অবশ্যই মুখমন্ত্রী একটা মিটমাট করে ফেলেছিলেন। কিন্তু মুসলমানদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে
১৬৮
গেল। লােক গণনার ফলে দেখা গেল সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ পূর্ববঙ্গের লােকসংখ্যা ও অনুর্বর, পশ্চিমবঙ্গের লােকসংখ্যা সমান সমান। যার ফলে বাংলা যখন বিভক্ত হলাে, তখন ১৯৪১ সালের লােক গণনার ওপর ভিত্তি করেই জেলাগুলাে ভাগ হলাে। ফলে প্রেসিডেন্সি বিভাগের মুসলিম অধিকৃত অনেকাংশ চলে গেল বাংলাদেশের বাইরে।
ভারতের তদানীন্তন বড়লাট লর্ড ওয়াভেল বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের নেতাদের নিয়ে একটি জাতীয় দেশরক্ষা কাউন্সিল গঠন করার প্রয়ােজন বােধ করলেন। যেসব নেতা যােগ দিলেন, তাঁদের মধ্যে এ কে ফজলুল হক, স্যার সেকান্দার হায়াত খান, স্যার সাদুল্লাহ, বেগম শাহনেওয়াজ, স্যার মােহাম্মদ সােলেমান প্রভৃতির নাম খবরের কাগজে প্রকাশিত হলাে। জিন্নাহর মত ছাড়াই যেহেতু উপরােক্ত নেতারা দেশরক্ষা কাউন্সিলে যােগ দিয়েছিলেন, সেহেতু তাদের পদত্যাগ করার জন্য তিনি হুকুম জারি করলেন। সবাই পদত্যাগ করলেন, কিন্তু ফজলুল হক সাহেব এই সঙ্গে মুসলিম লীগ থেকেও পদত্যাগ করলেন এবং জিন্নাহ সাহেবকে এক চরম নিন্দাসূচক খােলা পত্র লিখে পাঠালেন এবং সেটা সংবাদপত্রেও প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। প্রত্যুত্তরে জিন্নাহ সাহেব বাংলার মন্ত্রিপরিষদের মুসলিম লীগ সদস্যদের পদত্যাগ করার আদেশ দিলেন। ২ ডিসেম্বর মুসলিম লীগ মন্ত্রীরা। পদতাগপত্র পেশ করেন এবং বিরােধী দলের জন্য নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করেন। ১৩ ডিসেম্বর ফজলুল হক সাহেব হিন্দু মহাসভার সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই মন্ত্রিসভা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা’ বলে পরিচিত হয়। হক সাহেব তাঁর নিজের দলকে প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ বলে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু ওই নাম আর কেউ গ্রহণ করেনি—হিন্দুরা করেনি, কারণ মুসলিম লীগ নামটাই তাদের নিকট অসহ্য। আর মুসলমানরা করেননি কারণ হিন্দু মহাসভার সঙ্গে মুসলিম লীগের সমঝােতা তাদের নিকট ছিল একটা হাস্যাস্পদ ব্যাপার। তবু ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশজন বাদে আর বাকি সকল মুসলিম লীগ পরিষদ সদস্যই সরকারি দলে যােগ দিল । ফলে পরিষদে মুসলিম লীগের পক্ষে ফলােৎপাদক বিরােধিতা করা সম্ভব হলাে না। যদিও জিন্নাহ সাহেব গর্বভরে বললেন:
I make a Christmas gift of Fazlul Haq to the viceroy of India and a New Years Day Present of Nawab of Dhaka to the Governor of Bengal.
মুসলিম লীগ নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন গণসংযােগের জন্য দেশের অভ্যন্তরে সভা-সমিতি করে বেড়াতে লাগলেন।
১৬৯
নাজিমুদ্দিন সাহেব কিছুদিন পরই পরিশ্রান্ত হয়ে কলকাতা ফিরে যান, কিন্তু শহীদ সাহেব ভয়ানক পেটের পীড়া নিয়েও সভা করতে থাকেন। তারা দুজনে মিলে প্রায় ৮০০ সভায় বক্তৃতা করেছিলেন। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রসমাজ প্রথমবারের মতাে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কলকাতার ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেক হক সাহেবের সঙ্গে থেকে যান। ফজলুল হক ছাত্রদের বিরুদ্ধে গুন্ডাদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিপ্রায়ে জেলা বাের্ডগুলােতে নিজের চেয়ারম্যান বসানাের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর স্থলে তাঁর পিতা নবাবজাদা আলতাফ আলীকে চেয়ারম্যান করতে সক্ষম হন।
সে যুগে অভিজাত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা রাজনীতি করতেন, তাঁরা বেশির ভাগই ছিলেন আধা-সামন্তবাদী সুযােগসন্ধানী লােক। সুতরাং প্রায় প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে সরকারি দল ও বিরােধী দলের সভ্য থাকত। যেমন পিতা আলতাফ আলী কৃষক-শ্রমিক, পুত্র মােহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ, খান বাহাদুর ফজলুল করিম কৃষক-শ্রমিক, পুত্র রেজাই করিম মুসলিম লীগ, ফরিদপুরের লাল মিঞা কংগ্রেস, তার ভাই মােহন মিঞা মুসলিম লীগ। ঢাকার নবাববাড়ির সৈয়দ আবদুল হাফিজ কৃষক-প্রজা, তাঁর ভাই সৈয়দ আবদুস সলিম মুসলিম লীগ। এর কারণ সরকার যে দল গঠন করুক না কেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের যেন তাদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতে কোনাে অসুবিধা না হয়, সেটার জন্যই ওই সুপরিকল্পনা।
১৯৪১ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র খােলাখুলিভাবে বিশ্বযুদ্ধে যােগদান করে। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের মস্কোতে কূটনৈতিক সাফল্যের কথা, যার ফলে যুদ্ধের পরিস্থিতি আরও ঘােরাল হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ কূটনীতির ব্যাকরণ চিরকালই যুদ্ধ বাধলে তারা প্রথম বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাদের দলে ভেড়ানাের চেষ্টা করে। আর যারা দলে আসতে চায় না, তাদের নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করে—তারপর শত্রুকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে। প্রথম মহাযুদ্ধেও ব্রিটিশ যে পন্থা গ্রহণ করেছিল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও তার পুনরাবৃত্তি করে। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস মস্কোতে যে সফলতা লাভ করেন, চার্চিল দীর্ঘদিন চেষ্টা করে রুজভেল্টকে সে পথেই নিয়ে আসতে সমর্থ হন।
১৯৪১ সালের একটা ঘটনা এখানে উল্লেখযােগ্য বলে মনে করি। ঢাকায়। যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরমে পৌছায়, তখন আমাদের বেচারাম দেউড়ীর বাড়ি ও বলিয়াদীর খানবাহাদুর কাজেমুদ্দীন সিদ্দিকী সাহেবের মৌলভীবাজারের বাড়ির মধ্যে একটিমাত্র বাড়ি ছিল। সেখানে ছিল মিনার্ভা প্রেসের হিন্দু মালিকেরা। তারাই ছিল আমাদের মহল্লায় একমাত্র হিন্দু
১৭০
পরিবার। দাঙ্গা এত আকস্মিকভাবে লেগেছিল যে তারা আরমানিটোলা পাড়ায় যেটা সম্পূর্ণ হিন্দুপাড়া ছিল, সেখানে যেতে পারেনি। তারা প্রাণের ভয়ে আমাদের বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে প্রবেশ করে। এ কথা মহল্লার লােকেরা অনুমান করেছিল এবং আমাদের বাড়িতে ঢুকে দেখার জন্য হইচই করেছিল—কিন্তু আমরা তাদের সে চেষ্টা সফল হতে দিইনি। বয়সে আমার বছর ছয়েকের ছােট ছেলেটি, যার নাম ছিল ‘সাইক্লোন’ (কারণ তার জন্ম হয়েছিল ১৯১৯ সালের প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে), তার বোেনদের এবং মাকে নিয়ে দোতলায় আমার ঘরে আশ্রয় নেয়। বাইরে যত চিঙ্কার হচ্ছিল, তারা ততই ভয়ে কাঁপছিল। আমি তাদের শব্দ করতে না করে গেটের লােকদের বােঝাতে সক্ষম হলাম যে তারা আমাদের বাড়ি আসেনি। প্রায় এক সপ্তাহ তাদের লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল।
১৯৪২ সালের ইতিহাস বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের একটি নতুন রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পরেই মুসলিম ছাত্রসমাজ সরকারবিরােধী শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিল।
জানুয়ারি মাসে ঢাকার নবাবকে ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েতের নিমন্ত্রণে ঢাকায় আনার সংকল্প ঘােষণা করা হয়। লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও সর্বশেষে ঢাকায় শহীদ নজীর আহমদ ও বদরুদ্দীন সিদ্দিকীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। কালাে নিশান, পচা ডিম ও টমেটো নিক্ষেপ মারফত এ বিক্ষোভ পরিচালনার সংকল্প নেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের ছাত্ররা প্রবল বিক্ষোভ চালায়। নবাব সাহেবকে যেসব স্থানে যেসব ভদ্রলােক স্বাগত জানাতে এসেছিলেন, তাঁরা প্ল্যাটফর্মের কাছেও এগােতে পারেননি। অন্যদিকে ঢাকায় তাকে বিরাট অভ্যর্থনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অভ্যর্থনা সমিতির নেতৃত্বে ছিলেন বেচারাম দেউড়ীর খান সাহেব আবুল হাসনাত, সাতরওজার খান বাহাদুর ফজলুল করিম শেফাউল মুলক হেকিম হাবিবুর রহমান এবং ঢাকার মহল্লা সরদারেরা। আগের দিন খবর পাওয়া গেল যে বিক্ষোভকারীদের ওপর চরম হামলা চালনা করা হবে। আমি আবুল হাসনাত সাহেবের বাড়ি সন্ধ্যাবেলা গিয়ে তাঁকে এবং খান বাহাদুর ফজলুল করিম, সাহেবকে নানাভাবে বােঝাতে চেষ্টা করলাম যে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করবে। কারণ, এটা রাজনীতির ক্ষেত্র। একটা গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য তাদের ওপর হামলা চালনা করা উচিত হবে না। খান বাহাদুর ফজলুল করিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম যে আপনাদের কারও কারও সন্তানও এ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করবে। আবুল হাসনাত সাহেব ছিলেন এ কে ফজলুল হক সাহেবের আত্মীয়-বৈবাহিক সূত্রে। তিনি আমাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে
১৭১
দিলেন যে কেউ যদি ঢাকা স্টেশনে কালাে নিশান নিয়ে যায়, তবে সে জীবন নিয়ে ফিরবে না—এ কথা যেন আমি ছাত্রনেতাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিই। ছাত্রনেতাদের আমার বিফল আলােচনার কথা জানিয়ে দিলাম। কিন্তু তারা দমবার পাত্র নয়। স্থির হলাে যে পচা ডিম ও টমেটো ব্যবহার করা হবে না। তবে ছেলেরা ভিড়ের মধ্যে কালাে কাপড় লুকিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করবে। এবং নবাব সাহেব নামার সঙ্গে সঙ্গে একযােগে কালাে রুমাল ওড়াবে—শহীদ নাজির প্ল্যাটফর্মে মুসলিম লীগ নিশান নিয়ে উপস্থিত হবে। নবাবজাদা খাজা নসরুল্লাহ, আবদুস সলিম ও সাহেবে আলম নবাববাড়ির ওই তিনজন বিক্ষোভকারী ছাত্রদের সম্মুখে থাকবে, যাতে ঢাকার পঞ্চায়েতের লােকেরা ছাত্রদের ওপর হামলা না চালায়। তখন পুলিশ সুপার ছিলেন খাজা শাহাবুদ্দীনের জামাতা আলমগীর কবীর। যদিও তিনি সরকারি চাকুরে, তবু তার ওপর আমাদের অনেকটা ভরসা ছিল। আমাদের এ-ও ধারণা ছিল যে তার পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের ওপর গুন্ডামি থেকে রক্ষা করবে।
আমরা স্টেশনে পৌছে দেখলাম হাজার হাজার ঢাকার আদি বাসিন্দা হিন্দুমুসলমান বড় বড় লাঠি নিয়ে অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষা করছে। বিক্ষোভকারী ছাত্রদের সংখ্যা শপাচেকের বেশি হবে না। কিন্তু ছাত্রদের সংকল্প ছিল দৃঢ়। যেইমাত্র ট্রেনটি নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা প্ল্যাটফর্মে এসে পৌছাল, তখনই একদিকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘নবাব বাহাদুর জিন্দাবাদ’ ধ্বনি আরম্ভ হলাে । ছাত্ররা তেমনি কালাে রুমাল উড়িয়ে মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ বলে উঠল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল শহীদ নজীর ও বদরুদ্দীন সিদ্দিকী। হঠাৎ আবুল হাসনাত সাহেব হুকুম দিলেন বিক্ষোভকারীদের মেরে স্টেশন থেকে বের করে দিতে আর অমনি লাঠির বাড়ি আরম্ভ হলাে। শহীদ নজীরের মাথা ফেটে গেল, কিন্তু সে নিশান হাত থেকে ছাড়ল না—অন্য ছাত্ররা কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে পালানাের সময় অনেকে আহত হলাে। খাজা নছরুল্লাহ এবং সাহেবে আলমও আহত হলাে। ছাত্রদের মধ্যে আহতদের সংখ্যা ছিল বায়ান্নজন। শহীদ নজীরকে হাসপাতালে নেওয়া হলাে—নবাবের মিছিল নবাবপুর রাস্তায় যাওয়ার পরে। শহীদ নজীর জ্ঞান হারাল হাসপাতালে যাওয়ার পথে। অনেক পরে তার জ্ঞান ফিরল। নবাব সাহেব বিকেলবেলা আহতদের দেখতে গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালে—নজীরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে নজীর তাকে ‘গুন্ডার রাজা’ বলে সম্বােধন করে বসল। নবাব সাহেবের মুখ-চক্ষু অপমানে রক্তিম হয়ে উঠেছিল। তিনি তাড়াতাড়ি ওই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সন্ধ্যাবেলা সলিমুল্লাহ হলে নবাবের দলের গুন্ডামির প্রতিবাদে সভা ডাকা হয়। রেজাই করিম সাহেব কথা দিয়েও রেলস্টেশনে না গিয়ে ওই সভায় বক্তৃতা করার জন্য উপস্থিত হলে ছাত্ররা হলঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে
১৭২
অন্ধকারে তার ওপর হামলা চালায়। বহু কষ্টে আমরা কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে প্রভােস্ট ডক্টর হাসানের বাড়িতে নিয়ে যাই। ঢাকার ছাত্রদের ওপরে এই হামলা সমস্ত দেশে যখন ছড়িয়ে পড়ল, তখন মফস্বলের ছাত্ররাও এর পাল্টা প্রতিবাদ করতে সচেষ্ট হলাে। নবাব সাহেব তার পরের দিন আহসান মঞ্জিলে এক সভায় শহরবাসীদের সম্বােধন করে বললেন যে ঢাকা শহরের লােকেরা তার মান রেখেছে। তার জন্য তিনি ‘শুকরিয়া জানালেন তাঁদের আর বললেন যে তাঁর বাবার তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ে কতগুলাে ‘দেহাতি’ ও ‘ক্ষেতুয়ারা’ জোট করেছিল তাঁকে অপমান করার জন্য। সুতরাং শহরে যেসব ‘দেহাতি এবং ‘ক্ষেতুয়া’ বাস করে—তাদের শহর থেকে উৎখাত করা প্রয়ােজন হতে পারে। কিছুসংখ্যক দেহাতি ভদ্রলােক তাকে অভ্যর্থনা জানালেও তাদের ছেলেরা ছাত্রদের দলে ছিল—তাই তাদের বিশ্বাস করা যায় না। ক্ষেতুয়া’ ‘দেহাতি শব্দ দুটো গালি হিসেবে ব্যবহার করায় মফস্বলের ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল—এরপর শ্যামাপ্রসাদ কুমিল্লা সফর করেন—সেখানেও ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখাল। কুমিল্লার তদানীন্তন পুলিশ সুপার জাকির হােসেন অনেক ছেলেকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পাঠালেন—তাদের মধ্যে ছােট ছােট বালকও ছিল। ঢাকার ছাত্রনেতা বদরুদ্দীন সিদ্দিকী তাদের জামিনের জন্য জাকির হুসেনের সঙ্গে দেখা করলে জাকির হুসেন তাঁর অধীন কর্মচারীদের সম্মুখে বললেন যে পাটখড়ির মাথায় সবুজ কাগজ উড়িয়ে পাঠশালার ছাত্ররা পাকিস্তান আনবে—আর সে পাকিস্তানে কোনাে ভদ্রলােক বাস করবে, এটা হতে পারে না। সুতরাং ওসব চ্যাংড়া ছােকরাকে সাজা পেতেই হবে। মুসলিম লীগ নেতারা ওইখানে না পৌছা পর্যন্ত ছাত্রদের জামিন হয়নি। এর পরে ফজলুল কাদেরকে ফরিদপুরে গ্রেপ্তার করলে বদরুদ্দীন সিদ্দিকী ঢাকা ছেড়ে যান।
বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের আমন্ত্রণে জিন্নাহ আসেন সিরাজগঞ্জে ১৯৪২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা থেকে অন্যরা ছাড়া শহীদ নজীরের অধীনে শ দুয়েক বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র নিয়ে ওই কনফারেন্সে যান। এই সময় শামসুল হক ও খােন্দকার মােশতাক আহমদ ছাত্রদের নেতৃত্ব দেন। সিরাজগঞ্জ কনফারেন্সের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন আবদুর রশীদ মাহমুদ ও সৈয়দ আকবর আলী। এই কনফারেন্সের মধ্যে প্রথম আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন নেতার দল ও উপদল গঠনের প্রচেষ্টা এবং কে জিন্নাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তারই একটা পরােক্ষ প্রচেষ্টা। ফরমুজুল হক ও আনােয়ার হােসেন শহীদ সাহেবের দলের; নজীর, শামসুল হক প্রমুখ ঢাকার ছাত্র ফজলুর রহমানের উপদলের। এই কনফারেন্সই শহীদ সাহেব বাংলা বক্তৃতা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কনফারেন্সের পর কলকাতায় সবাই ফিরে এলে যাদের নাম
১৭৩
দেওয়া হলাে কাগজে, তারা হলেন স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, আকরম খাঁ, খাজা শাহাবুদ্দীন, হাসান ইস্পাহানি, খাজা নুরুদ্দীন এবং অন্য নেতারা। শহীদ সাহেব মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও তার নাম স্টার অব ইন্ডিয়াকাগজে দেখা গেল না। শহীদ সাহেব কাগজের সম্পাদককে টেলিফোন করে রুষ্ট মেজাজে জিজ্ঞেস করলেন, ‘Am I etc?”তাঁর ওই কথাটা পরে বহুল প্রচার হয়ে গিয়েছিল মুসলিম লীগের লােকদের মধ্যে। কারণ, সম্পাদক পরদিন ছােট একটা খবরে ক্ষমা চাইবার নামে বাক্যটি লিখেছিলেন। সিরাজগঞ্জ কনফারেন্সে একটি বইস্টলে দেখা গেল একখানা নতুন বই পাকিস্তান সম্বন্ধে লিখেছেন হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। বাহার-নাহার ভাইবােন এর আগেই পরিচিত হয়েছিলেন সুধীমহলে বুলবুল-এর সম্পাদক হিসেবে। সুতরাং সবাই তার বই একখানা করে নিয়ে নিল। বাহার সাহেব ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বলে যেতে পারতেন—তাঁর সঙ্গে কেউ ট্রেনে একই কামরায় উঠতে চাইত না—কারণ সারা রাতেও তাঁর কথার শেষ হতাে না। তিনি জিন্নাহ সম্বন্ধে অনেক কাল্পনিক গল্প তৈরি করেছিলেন—যেমন জিন্নাহর মার্বেল খেলার প্রতি বিতৃষ্ণা এবং ক্রিকেট খেলার প্রতি আকর্ষণ। বাল্যকালে জিন্নাহর আর্থিক অবস্থা ক্রিকেট খেলার উপযােগী ছিল না। এসব অনর্থক গল্প সৃষ্টি করে সত্যিকার জিন্নাহকে কল্পনার রাজ্যে নিয়ে গেছে। তাঁর বাল্যকালের ইতিহাস একমাত্র আল্লানা সাহেব, যিনি ছিলেন বিশ্বাসী বন্ধু এবং অনুরাগী, কিছুটা আলােকপাত করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। শহীদ নজীর এ সময় বােধ হয় প্রথম বাহার সাহেবের সান্নিধ্যে আসেন এবং খবরের কাগজ চালানাে সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে বিস্তর আলাপ-আলােচনা করেন। শহীদ নজীরের ও বাহার সাহেবের মধ্যে আলােচনার সময় ঢাকার যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সবটা বুঝতে পারেননি। কারণ, দুজনই নােয়াখালী জেলার অধিবাসী বলে তারা তাদের ডায়েলেক্টে আলােচনা করছিলেন। এটা আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি যে সিলেট, চিটাগাং ও নােয়াখালী জেলার লােকেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে গিয়ে সাধারণ বাংলার পরিবর্তে নিজেদের ডায়েলেক্টে আলােচনা করতে ভালােবাসেন। সিরাজগঞ্জ কনফারেন্স থেকে ফিরে এসেই শহীদ নজীর একটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করার প্রস্তাব ফজলুর রহমান সাহেবের নিকট উল্লেখ করেন। ফজলুর রহমান সাহেবের সম্মতি লাভ করে অবাঙালি রফিক সাহেব ও এ কে ফজলুল হক (মাওলা মিঞার) আর্থিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। শহীদ নজীর পাকিস্তান কাগজটি বের করে। প্রথমেই সাপ্তাহিক কাগজে বের না করে দুসপ্তাহ পরপর কাগজখানা বেরােতে থাকে। লেখা জোগাড় করা, প্রেসে বসে প্রুফ দেখা, তারপর গ্রাহক সৃষ্টি করা, কাগজ জোগাড় করা ও পােস্ট করা বেশির ভাগ কাজই নজীরকে একাই করতে হয়েছে। অনেক দিন
১৭৪
গভীর রাতে দরজায় খটখট আওয়াজ হতাে। প্রায়ই খুলে দেখতাম নজীর। আমার স্ত্রীকে বলত খাওয়া হয়নি। আমাদের খাওয়া শেষ—একদিন তাে বাসি ভাত খেয়েই খুশি। তার জন্য আর শামসুল হকের জন্য ঘরে কিছু না কিছু খাবার রাখতে হতাে। তাদের আসার কোনাে স্থিরতা ছিল না—হঠাৎ কখন হুট করে আসবে বলা যেত না।
ওই পত্রিকায় আমার লেখায় একটিমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় থাকত—সে হচ্ছে ভারত কোনাে দিনই একটি দেশ ছিল না—মােগল ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি ভারতবর্ষের যে রূপটা, সে তৈরি হয়েছে বেয়নেটের জোরে, স্বেচ্ছায় নয়। আমার লেখা বেরােত তখনাে ‘শহীদ আহমদ’ নামে। শহীদ আমার বড় ছেলের। নাম। আমার বড় ছেলে ১৯৪১ সালের ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করে। আমি যেহেতু সরকারি চাকরি করি, সেহেতু তার নামেই আমাকে লিখতে হতাে। একদিন আমার এক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক উদ্ধৃতি ছিল। রবীন্দ্রনাথ। বলেছিলেন যে ভারতে একটা জাতি সৃষ্টি করার প্রয়াস অনেকটা সুইজারল্যান্ডের বিরাট নৌবাহিনী সৃষ্টির পরিকল্পনার মতােই অবাস্তব হতে বাধ্য। এ জন্য ফজলুর রহমান সাহেবও লেখাটা ছাপতে নিষেধ করেন। আমার যুক্তি ছিল যে লাহাের প্রস্তাব খণ্ড ভারতের প্রস্তাব-ইসলামিক রাষ্ট্রের নয়। কিন্তু ফজলুর রহমান সাহেব দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, ভারতে বহু জাতিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। না। এরপর পাকিস্তান কাগজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কমে গেল।
এরপর এল নাটোর ও বালুরঘাটের উপনির্বাচন—মুসলিম লীগের সংগ্রামের পরীক্ষা। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ল—কলকাতার ছাত্রদের মধ্যে যেমন দলাদলি ছিল, ঢাকায় তা ছিল না। ছাত্ররা বিয়াল্লিশ সাল পর্যন্ত মােটামুটিভাবে ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ছিল। নাটোর ও বালুরঘাট উপনির্বাচনে শেরেবাংলার বিরুদ্ধে কী কৌশল খাটানাে হবে, তা-ই হলাে আমাদের সমস্যা। স্থির হলাে যে শেরেবাংলাকে নানা প্রশ্ন করা হবে। যুদ্ধাবস্থার জন্য দেশে তখন আকাল আরম্ভ হয়েছে—কেরােসিন নেই, অনেক জিনিস দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। কোথাও শেরেবাংলার সভা হবে জানতে পারলেই ছাত্ররা তেঁড়া পিটিয়ে দিত যে ওই সভায় কেরােসিন দেওয়া হবে। সব লােক বােতল নিয়ে, টিন নিয়ে উপস্থিত কিন্তু কেরােসিন বিক্রির কোনাে ব্যবস্থা নেই। তাই সাধারণ মানুষ ওই সভা ছেড়ে এসে অদূরে যেখানে মুসলিম লীগ গ্রামােফোনে গানের ব্যবস্থা করেছে, সেখানে চলে যেত—আর সেই ফাঁকে মুসলিম লীগের পার্টির জন্য সােজা ক্যানভাস না করে শেরেবাংলা ও তার লােকেরা কত বড় ধাপ্পাবাজ এটাই তাদের বােঝানাে হতাে। প্রতি সভায় ক্রমাগত কৌশল পরিবর্তন করতে হতাে—কারণ শেরেবাংলা একবার যদি দেশের লােকদের তাঁর অফুরন্ত ভান্ডার
১৭৫
খুলে গল্প বলতে আরম্ভ করেন, তবে মুসলিম লীগের পরাজয় অনিবার্য। শেরেবাংলা কোনাে রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি বা আদর্শ সম্বন্ধে বক্তৃতা করতেন না—দেশের লােকদের তিনি গল্প বলে সব কথা বােঝাতেন। আজকালকার মতাে শ্রেণিসংগ্রামের কথা তখনাে নেতারা শােনেননি। যদিও ১৯১৯ সালের পরে এবং বিশেষ করে ১৯২৯ সালে শ্রেণিসংগ্রামের কথা তখনকার যুবকদের অজানা ছিল না—বিশেষ করে হিন্দু যুবকদের। আমাদের কৃষক সম্প্রদায় ১৯৪২ সালেও ভাগ্যলিপিতে বিশ্বাসী ছিল। সবকিছুর জন্যই খােদার ওপর নির্ভর করত। তারা ধর্মপরায়ণ না হলেও ধর্মকে বড় বলে মনে করত।
শেরেবাংলার গল্প আবার স্থানকালপাত্রভেদে বিভিন্ন রূপ নিত। যেমন রেজাই করিম সাহেব ও সাহেবে আলমের (কালু মিঞা) ঢাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় তিনি নিরেট মূর্খ কালু মিঞার পক্ষে বক্তৃতা করতে এসে বলেছিলেন, ‘দেশের নায়ের মাঝি আমিই আছি। আমার প্রয়ােজন মাল্লার। রেজাই করিমের মতাে এমন একজন বুদ্ধিমান ও নামকরা উকিলকে আমি মাল্লা হিসেবে ব্যবহার করতে পারব না। মাল্লা হতে পারে কালু মিঞা—আমি মাঝি, আমি দেশের হাল ধরি—এই যদি আপনারা চান, তবে কালু মিঞাকে ভােট দেন। আর যদি মনে করেন আপনাদের মাঝি বদলানাে প্রয়ােজন, তবে রেজাই করিমকে ভােট দেন। আমি হাতের বইঠা ছেড়ে আবার ওকালতি করব। অন্য এক সভায় বললেন, আমার মন্ত্রিত্ব রাখার বিপদ হচ্ছে যে বুদ্ধিমান পরিষদ সদস্যরা কেবলই লাফ দিয়ে অন্য নায় উঠতে চায়। আমার প্রয়ােজন এমন লােকের, যে পাথরের মতাে পকেটে থাকবে, ব্যাঙের মতাে লাফাবে না।
শেরেবাংলা এরপর মুর্শিদাবাদের উপনির্বাচনে সৈয়দ বদরুদ্দোজার জন্য বক্তৃতা করতে গেলেন। তাদের প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাইসব, আপনারা যখন হাটে বা বাজারে যান মাটির হাঁড়ি আমরা যাকে বলি রাইং কিনতে, তখন কেনার আগে বাজিয়ে নেন কি না? কেউ রুপার টাকা দিলে তা বাজিয়ে নেন কি না? সমস্বরে উত্তর এল, “জি হঁ্যা। হক সাহেব তখন বদরুদ্দোজাকে বললেন, ‘পাঁচ মিনিট বাংলায় বক্তৃতা কর তাে তুমি’, অমনি বদরুদ্দোজা তাঁর সেই কর্ডোভা, গ্রানাডা থেকে আজকের অবহেলিত, পদদলিত, নির্যাতিত মুসলমানদের ইতিহাস ওজস্বিনী ভাষায় বলতে লাগলেন। হক সাহেব আবার তাঁকে পাঁচ মিনিট উর্দুতে বলতে বললেন। একইভাবে একই কথা বদরুদ্দোজা। বলে গেলেন। হক সাহেব আবার তাঁকে বললেন, ইংরেজিতে এবার বলাে দেখি—অমনি বদরুদ্দোজা দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে একইভাবে বক্তৃতা করে গেলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে হক সাহেব বললেন, দেখুন আমি আপনাদের জন্য যে প্রার্থী এনেছি সে রুপার টাকার মতাে বাজে না, মেকি টাকার মতাে বােবা। গায়ের লোেক কি জানত যে রেজাই করিম ভালাে উকিল ও সুবক্তা।
১৭৬
তাই তিনি ব্যাঙ। আর বদরুদ্দোজা একই কারণে আসল রুপার টাকা।
সুতরাং শেরেবাংলাকে বক্তৃতার সুযােগ আমরা দিতে চাইনি। আমাদের কৌশল সফল হয়েছিল। এর ফলে তার সঙ্গে যেসব সদস্য চলে গিয়েছিল, তারা ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার দল ছেড়ে মুসলিম লীগে ফিরে আসতে আরম্ভ করল—তাদের সে জন্য মাঝেমধ্যে নগদ বিদায় করতে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাপানের যুদ্ধে যােগ দেওয়ার পর থেকে যুদ্ধ আমাদের বাড়ির কাছে চলে এল। এবং মার্চ মাসে রেঙ্গুন দখল করায়, বর্মার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ও যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সেনাপতি জেনারেল স্লিম (পরবর্তীকালে ‘ফিল্ড মার্শাল’) মাংডাে, বুমডিং ছেড়ে বাংলাদেশে তার সৈন্যদের সরিয়ে নিয়ে এলেন। ফলে জাপানি সৈন্যরা নাফ নদী পর্যন্ত তাদের দখল বিস্তার করতে পারল—বিরাটকায় যুদ্ধজাহাজ ‘প্রিন্স অব ওয়েলস ও ‘রিপালস’ ধ্বংস, সিঙ্গাপুরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব দেশ জাপানের অধীনে চলে এল। সুতরাং এবার বাংলাদেশের পালা। নেতাজি সুভাষ বসু ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ‘দিল্লি চলাে’ স্লোগান দিয়ে ভারত আক্রমণের পায়তারা আরম্ভ করল। জাপানিরা অতি অল্প সময়ে এত দেশ করায়ত্ত করে ফেলেছিল যে সেসব দেশে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করাই একটা বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছিল। তবু ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ও নেতাজিকে সাহায্য হকরার জন্য তাদের বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেয়; কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তখন * এত ভীত ও সন্ত্রস্ত যে তারা বাংলাদেশ’ খােয়া যাবে ধরে নিয়ে বিহারের রাচিতে তাদের রক্ষণঘাটি তৈরি করতে শুরু করে দিল। আর জেনারেল স্লিম তার সৈন্যদের ব্যারাকপুরে এনে নতুন করে জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য গড়ে তুলতে থাকেন।
এতকাল বর্মার চালের ওপরই ভারতবাসী নির্ভর করত—বিশেষ করে বাংলাদেশ। বর্মার পতনের সঙ্গে সঙ্গে রেঙ্গুন থেকে চাল আসা বন্ধ হয়ে গেল। আরাকানের চাল পাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার আরাকান অঞ্চলের মুসলমান যুবকদের নিয়ে একটি ‘মােজাহিদ বাহিনী গঠন করার ফলে সাম্পানে করে কিছু কিছু চাল সরবরাহ চলছিল। বর্মার লােকদের সঙ্গে আরাকানের মুসলমানদের সম্পর্ক চিরকালই তিক্ত ছিল—বর্মার লােকজন জেনারেল আউং সানের নেতৃত্বে জাপানিদের সমর্থন করলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘মােজাহিদ বাহিনী ব্রিটিশকে সাহায্য করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
রেঙ্গুনের পতনের পর ভারতবাসী দলে দলে বর্মা ত্যাগ করতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারের অনুগত লােকজন জাহাজে বা বিমানে ভারতে আসে। বাকি লাখ লাখ ভারতীয় উত্তর বর্মার ঘাের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রওনা হয়। ভারতবাসী তাদের ওপর যে শােষণ চালিয়েছিল, তার প্রতিশােধ এত দিনে
১৭৭
বর্মিরা নিতে আরম্ভ করল। ব্রিটিশ বেয়নেটের সাহায্যে ভারতীয়রা যে অত্যাচার করেছে অর্ধশতাব্দী ধরে—তা ক্ষমার অযােগ্য। তাই জাপানিরা বর্মা দখল করার পর জাপানিদের বাধা না দিয়ে ভারতীয়দের হত্যা করতে থাকে । সুতরাং তাদের পক্ষে পালানাে ছাড়া আর কোনাে উপায় ছিল না। পালানাের পথে রােগে-শােকে জর্জরিত হয়ে, অনাহারে হাত-পা ভেঙে হাজার হাজার লােক মৃত্যুমুখে পতিত হলাে—কত লােক গেল হিংস্র বাঘের পেটে—কত লােক মরল সর্পাঘাতে তার কোনাে হিসাব করা হয়নি। দিল্লিতে বর্মার নির্বাচিত সরকার এসব ছিন্নমূল ভারতীয়, যারা বেশির ভাগই বাংলার অধিবাসী, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামাে সৃষ্টি করল। প্রধান প্রশাসক নিযুক্ত হলেন এস কে ঘােষ (পেনশনপ্রাপ্ত ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের লােক) আর খান বাহাদুর ফজলুল করিম সাহেব হলেন অতিরিক্ত প্রশাসক। এই প্রশাসকেরা যেভাবে ছিন্নমূল বাস্তুহারা মানুষের দুঃখ-দৈন্যের সুযােগে বহু টাকার মালিক বনে গিয়েছিলেন, সে ইতিহাস কলঙ্কময়—যথাস্থানে সে সম্বন্ধে আরও আলােকপাত করা হবে।
মস্কোতে বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করার পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে পাঠালেন মার্চ মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির পরপরই। এমন অদ্ভুত সময়ে সমস্যা সমাধানের আলােচনার জন্য ব্রিটিশ সরকার কেন তাঁকে পাঠালেন, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি। অপরাজেয় জাপানি সেনাবাহিনী যখন দখল করতে করতে চলে এসেছে নাফ নদী পর্যন্ত, তখন নেতাজি সুভাষ বসু সায়গন রেডিও থেকে ভারতবাসীকে বিদ্রোহ করার জন্য ডাক দিয়ে যাচ্ছেন—হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য আজাদ হিন্দ ফৌজে যােগ দিয়ে আসামের ইম্ফলের দিকে এগিয়ে আসছে এবং ১৯৪০ সালে স্যার স্ট্যাফোর্ডের সঙ্গে জিন্নাহর যে ভুল-বােঝাবুঝি হয়েছিল, তা তখনাে তার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি, তখন কোন সমাধান কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে, তা ব্রিটিশ সরকার কী করে ভাবল বােঝা সত্যিই দুরূহ। ক্রিপসের প্রস্তাব ছিল, ভারতে একটি ফেডারেল ইউনিয়ন গঠন করা হবে কিন্তু কোনাে প্রদেশ যদি ওই ইউনিয়নে যােগ না দিয়ে বাইরে থাকতে চায়, তবে সেসব প্রদেশকে সে অধিকার দেওয়া হবে। এবং যুদ্ধ চলাকালীন সব পার্টির নেতাদের নিয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। কংগ্রেসের নিকট এ প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য হয়নি। কারণ, পরােক্ষভাবে এ প্রস্তাবে পাকিস্তানের বীজ নিহিত ছিল। কারণ, এতে সম্ভাবনা থাকল যে মুসলমান সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহ হয়তাে ফেডারেল ইউনিয়নের বাইরে থেকে যাবে। মুসলিম লীগের নিকট গ্রহণযােগ্য হয়নি, কারণ যেসব প্রদেশ বাইরে থেকে যাবে,
১৭৮
তারা কোনাে ইউনিয়ন গঠন করে প্রস্তাবিত ফেডারেল ইউনিয়নের মর্যাদা লাভ করার স্বীকৃতি প্রস্তাবে ছিল না। প্রস্তাবে তাদের ১৯৩৫ সালের আইনের আওতায় রাখার ব্যবস্থা কেবল থাকল। মুসলিম লীগের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় দলীয়ভাবে যােগ দিতে অস্বীকার করাই ছিল স্বাভাবিক। গান্ধীজি বললেন, ‘প্রস্তাবিত সমাধান যুদ্ধের পরে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। যুদ্ধে যখন ব্রিটিশ সরকারের জয়ী হওয়ার আশা খুব কম, তখন ক্রিপসের প্রস্তাব একটি ‘Post dated cheque of a crashing Bank’ ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং ওই প্রস্তাব কোনাে আলােচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না।
এরপর কংগ্রেসের পক্ষে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া পথ থাকল না। কারণ প্রথমত ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের ভিত্তি মেনে নিয়েছে, দ্বিতীয়ত, জাপানি বিমানবাহিনী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও কলকাতায় বােমাবর্ষণ আরম্ভ করেছে। তাই গান্ধীজির মতে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বিদ্রোহ করার। আগস্ট মাসে ‘ভারত ছাড়’ (Quit India) আন্দোলন শুরু হয়। মুসলিম লীগ নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করল। জিন্নাহর মতে, ব্রিটিশ সরকার ভারতকে বিভক্ত না করে পাততাড়ি গােটাতে পারে না। তাঁর মতে, ‘আগে ভাগ পরে স্বাধীনতা (Divide and Quit)। বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল ভারতের প্রতিটি প্রদেশে। মুসলমানরা বিদ্রোহে যােগ দিচ্ছে না বলে হিন্দুরা তাদের দেশের শত্রু ও ব্রিটিশের গােলাম বলে আখ্যায়িত করতে লাগল। ফলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। মুসলমানরা ভাবল, গান্ধীজির ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হলাে মুসলমানদের কোনাে দাবি না মেনে ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ক্ষমতা দখল।
বাংলাদেশে তখন শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা চলছিল। বিহার ও উড়িষ্যা সংলগ্ন এলাকা মেদিনীপুর জেলা, জয়প্রকাশের আদর্শে উদ্বুদ্ধ অনেক ভলান্টিয়ার ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় মেদিনীপুরে ঢুকে কৃষাণদের বিদ্রোহ করার জন্য পরামর্শ দেয়। অবশ্যই মেদিনীপুরে বহুদিন যাবৎই কৃষাণেরা নানা কারণে মাঝেমধ্যে সরকারবিরােধী আন্দোলন করেছে। মাহিষ্য সম্প্রদায় চিরদিনই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লােক। আমি আমার পূর্বপ্রকাশিত ইতিহাস বইতে বলেছি যে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই রাঢ় বা লাঢ় দেশের (অর্থাৎ বর্তমান বর্ধমান বিভাগ) লােকেরা ছিল রূঢ় স্বভাবের। বহুদিন পর্যন্ত অন্য কোনাে সভ্যতা সেখানে ঢুকতে পারেনি। তাদের সংস্কৃতির মিল হচ্ছে ছােট নাগপুরের নিষাদ সংস্কৃতির সঙ্গে। জৈন, বুদ্ধ ও ইসলাম পূর্ববঙ্গের মতাে সেখানে স্থান করতে পারেনি। ঘাের জঙ্গলাকীর্ণ ছিল ওই দেশ এবং বাইরের লােক ওখানে গেলে তাদের পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিত। মােটামুটিভাবে তারা ‘ট্রাইবাল ইনস্টিংটে’ চালিত মুক্ত স্বাধীনভাবে জীবন গড়ার পক্ষপাতী। মেদিনীপুরে লবণ
১৭৯
আইনভঙ্গের অপরাধে পুলিশের অত্যাচার ও বিদ্রোহের কথা বর্তমান শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও শােনা গেছে। সন্ত্রাসবাদীরা একে একে তিনজন শ্বেতাঙ্গ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেছে। সুতরাং ভারত ছাড়’ আন্দোলন এখানে হিংসাত্মক রূপ নেয়। তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে তারা স্বাধীনতা ঘােষণা করে। এন এম খান (নেয়াজ মােহাম্মদ খান) আইসিএস তখন মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। পুলিশ বাহিনী তার আদেশে বিদ্রোহীদের দমন করতে হিমশিম খেতে থাকে। তাই সেখানে সৈন্য ডাকা হয়। তারা বিদ্রোহ কঠিনভাবে দমন করে। মাতঙ্গিনী হাজরা বুলেটের আঘাতে প্রাণ ত্যাগ করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি মেদিনীপুরে যেতে চাইলে পাঞ্জাবি এবং মুসলিম লীগপন্থী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গভর্নরকে জানিয়ে দেন এ পরিস্থিতিতে শ্যামাপ্রসাদ মেদিনীপুর এলে অবস্থার অবনতি হতে পারে, তাই তাকে গ্রেপ্তার করা ছড়া উপায় থাকবে না। পরিষদে এর বিরুদ্ধে যখন তুমুল আলােচনা হয়, তখন ফজলুল হক সাহেব একটি ইনকোয়েরি কমিশন’ বসানাে হবে বলে ঘােষণা করেন। গভর্নর স্যার জন হারবার্ট ফজলুল হকের কৈফিয়ত চেয়ে পাঠান। ফজলুল হক কৈফিয়ত দিতে অস্বীকার করেন। শ্যামাপ্রসাদের পক্ষে একমাত্র পথ ছিল পদত্যাগ করা। বােধ হয় ফজলুল হকেরও তাই করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি গভর্নরকে কৈফিয়ত না দিয়ে এক খােলা চিঠি লিখে পাঠান। (আমার Socio-Political History দ্রষ্টব্য)।
১৯৪১ সাল থেকেই ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল। মাঝেমধ্যে শান্তি ফিরে এলেও একটা থমথমে ভাব সব সময় বিরাজ করছিল। ১৯৪২ সালে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে গুপ্তহত্যা ও স্থানে স্থানে দাঙ্গা সংঘটিত হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যেও ভয়ানক উত্তেজনা দেখা দেয়। মেয়েদের হােস্টেলে বন্দে মাতরম সংগীতের বিরুদ্ধে মুসলমান মেয়েরা প্রতিবাদ জানাতে গেলে তাদের হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয় হিন্দু মেয়েরা। কারণ, মুসলমান মেয়েদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে মাঝেমধ্যে হকিষ্টিক নিয়ে দলবদ্ধভাবে মারামারি চলতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম তারিখে একটা সমঝােতার চেষ্টা চালান শহীদ নজীর ও অন্য ছাত্রনেতারা। কিন্তু পরের দিন আবার ঘাের উত্তেজনা দেখা দিল। শহীদ নজীর আবার তাদের মধ্যে শান্তি আনয়নের জন্য হিন্দু ছাত্রনেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে গেলে একজন হিন্দু ছাত্র অতর্কিতে তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়। নজীর সেখানেই পড়ে যান এবং হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
১৮০
মার্চ মাসের ২৭ তারিখে গভর্নর ফজলুল হককে বাধ্য করলেন পদত্যাগ করতে। তার প্রায় এক মাস পরে ২৪ এপ্রিল স্যার খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করল। ঠিক এ সময় মুসলিম লীগ সরকার গঠন করা নিয়ে মুসলিম লীগ মহলে যথেষ্ট মতদ্বৈধতা ছিল। দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির খবর আসছে অনেক গাঁ-গ্রাম থেকে। মানুষ শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কলকাতা ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় অসংখ্য জনস্রোত ভাতের ফ্যানের জন্য কেঁদে কেঁদে গৃহস্থের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ বলল যে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করার অর্থ অজস্র মৃত্যুর জন্য দায়ী হওয়া, আর এক দলের মতে, যারা এই সংকট-মুহূর্তে দায়িত্ব এড়াতে চায়, তারা জনগণের নেতা হওয়ার অনুপযুক্ত এবং দল হিসেবেও তাদের বেঁচে থাকার কোনাে অধিকার থাকা উচিত নয়। হাজার হাজার লােক যখন মৃত্যুমুখে, তখন ঘরের জানালা থেকে সে বিয়ােগান্ত নাটক দেখার মধ্যে কোনাে পৌরুষ নেই। স্থির হলাে মন্ত্রিসভা গঠন করে দুঃখী মানুষের পাশে। দাড়িয়ে যতটা সাহায্য করা যেতে পারে, তা-ই করা মনুষ্যত্বের কাজ হবে।
১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই চালের দাম বৃদ্ধির আভাস আমরা পাচ্ছিলাম। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় চালের দাম হঠাৎ চার টাকা মণ থেকে আট টাকায় উঠে যায়। হঠাৎ এতটা বাড়ায় সাধারণ লােকের অত্যন্ত অসুবিধায় পড়তে হয়। মুসলিম লীগের অনুরােধে কলকাতা মুসলিম চেম্বার অব কমার্স’ থেকে ঢাকায় স্বল্পমূল্যে চাল বিতরণের জন্য হাজার দুয়েক মণ চাল এসে পৌছাল কিন্তু এরই মধ্যে চালের দাম তেরাে টাকায় উঠে গেল। বেচারাম দেউড়ির মহল্লার লােকদের মধ্যে চাল বিতরণের ভার আমাকে দেওয়া হলাে। চাল আসতে আসতে অক্টোবর—প্রতি সপ্তাহেই তখন দু-চার টাকা করে চালের দাম বৃদ্ধি পেতে লাগল। এত দিনে বর্মার পতনের অনিবার্য ফল ফলতে আরম্ভ করল। মহল্লার লােকেরা সবাই এল—চাল মাপা চলছে, কেউ কেউ নিয়েও গেছে। এমন সময় মহল্লার সরদার এসে তাদের চাল নিতে নিষেধ করল। আমি বললাম কেন কী হয়েছে? সরদার উত্তর দিল, শাহজাদা মিঞার (আবুল হাসনাত সাহেব) হুকুম। সবাই একে একে চলে গেল। চোখে তাদের পানি। যারা চাল নিয়ে গিয়েছিল, তারাও চাল ফেরত নিয়ে এল। আমি তখনই হাসনাত সাহেবের বাড়ি গেলাম তাকে বােঝাতে। কিন্তু তিনি বললেন, তার মহল্লায় বসে মুসলিম লীগের চাল দেওয়ার নামে মুসলিম লীগ’-এর প্রচার করতে আমি দেব না। আমার সমস্ত অনুরােধ ব্যর্থ হলাে। তিনি একেবারেই রাজি হলেন না এবং আমার এটা জানা ছিল, তাঁর মতের বিরুদ্ধে মহল্লার লােক না খেয়ে থাকলেও মুসলিম লীগের চাল নেবে—সে সাহস তাদের নেই। আমি চাল তুলে রেখে মুসলিম লীগ নেতাদের পরামর্শ চেয়ে
১৮১
পাঠালাম। নভেম্বরে চালের দাম বাইশ টাকায় দাঁড়াল। নভেম্বরে রাতের অন্ধকারে কেউ কেউ এসে আট টাকা দরে চাল নিতে লাগল। তা-ও পুরুষেরা আসতে সাহস পায়নি—এসেছে মেয়েরা বােরকাবৃত হয়ে। আশ্চর্য প্রভাব ছিল আবুল হাসনাত সাহেবের তাঁর মহল্লার লােকের ওপর।
১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে চালের দাম চল্লিশ টাকায় উঠল। এ অবস্থায় মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় ঢাকা থেকে স্যার নাজিমুদ্দিন তার ভাই খাজা শাহাবুদ্দীনকেও মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করেন। আমি আর শামসুল হক ফজলুর রহমান সাহেবকে খুব করে অনুরােধ করি যে তিনি যেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারির জন্য প্রার্থী হন। আমাদের দুজনেরই তার সংগঠন শক্তির ওপর বিশ্বাস ছিল এবং এটা আমি বিশ্বাস করতাম যে আহসান মঞ্জিলের নেতৃত্বের সমাধি রচনা করার একমাত্র উপায় মুসলিম লীগ সংগঠনকে মধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণে আনা। কিন্তু ফজলুর রহমান সাহেব আমাদের বােঝালেন যে মধ্যবিত্তের পক্ষে শাসনক্ষমতা দখল করা যেতে পারে কেবল অভিজাতশ্রেণির মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে এবং সেটা করা সম্ভব তাদের মধ্য থেকে—বাইরে থেকে তা পারা যাবে না। আহসান মঞ্জিলের নেতৃত্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনগণের পৃষ্ঠপােষকতায় নয়—সেটা তারা প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের রাজনৈতিক এজেন্সি মারফত। যেমন ময়মনসিংহে খান। বাহাদুর নুরুল আমিন ও খান বাহাদুর আবদুল হামিদ চৌধুরী, বরিশালে খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দীন, আজিজুদ্দীন, কুমিল্লায় খান বাহাদুর আবেদুর রেজা চৌধুরী ও খান সাহেব ফরিদউদ্দীন, চট্টগ্রামে নুর আহমদ ও রফিউদ্দীন সিদ্দিকী, ফরিদপুরে ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিঞা), নােয়াখালীতে রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। এমনিভাবে সারা বাংলায় তাদের এজেন্ট রয়েছে। নাজিমুদ্দিন সরকার জেলার কোনাে কাজই করবে না তার এজেন্টদের মারফত না এলে, তাই তাদের জেলায় তাদের নেতৃত্ব—তারাই জেলা বাের্ডের চেয়ারম্যান। ফলে তাদের যার যার জেলার ওপর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত আর তাদের সবাই আবার খাজা ভাইদের তাবেদার। ওই ব্যুহ কেবল মুসলিম লীগ সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করেই ভাঙা যাবে না, সবচেয়ে বড় প্রয়ােজন দাবার চালের ভেতর দিয়ে অভিজাত নেতাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করা। ওই প্রসঙ্গে তিনি আরও বললেন যে ফজলুল হক তার নেতৃত্ব অক্ষুন্ন রাখতে পারেননি, যদিও দেশের সাধারণ মুসলমান সমাজ মােটামুটিভাবে তাঁর পক্ষেই ছিল। তাই আমি শহীদ সাহেবকে অনেক বুঝিয়ে খাজা শাহাবুদ্দীনকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে রাজি করিয়েছি, যাতে শাহাবুদ্দীনের স্থানে আমার চিফ হুইপ হওয়া সম্ভব হয়। আমাদের এখন একমাত্র চিন্তা হচ্ছে এমন একজনকে জেনারেল সেক্রেটারি করা, যে আভিজাত্যও দাবি করতে পারে, আবার মধ্যবিত্তের সঙ্গেও কাজ করতে পারে।
১৮২
আমাদের মতের ঐক্য হলাে না। কারণ, আমরা বেশি পক্ষপাতী ছিলাম সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করার। ক্ষমতা পাওয়ার চেয়ে ক্ষমতাকে মধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণে আনা । আমাদের মনে হলাে যে তিনি মধ্যবিত্তের রাজনীতির প্রতি উদাসীন হয়ে গেছেন এবং অভিজাত শ্রেণিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প করেছেন। মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর সত্যিই তিনি চিফ হুইপ’ নিযুক্ত হলেন। তারপর আর এক ধাপ অগ্রসর হলেন সৈয়দ আতিকুল্লাহ সাহেবের কন্যাকে বিয়ে করে। আমাদের ধারণা ঠিকই হলাে এবং এরপর তাঁর সঙ্গে। আমাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগল। যদিও তখনাে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটেনি। সৈয়দ আতিকুল্লাহর কন্যার জামাতা হিসেবে তিনি প্রায় বাংলার সব অভিজাত ঘরের সঙ্গেই আত্মীয়তা দাবি করার অধিকার পেলেন। এমনকি তিনি নিজেকে নবাব আলী চৌধুরীর চেয়ে বড় মনে করেছিলেন। কারণ, সৈয়দ আতিকুল্লাহ সাহেবকে তাঁরই কুলীন জামাতা হিসেবে এনেছিলেন। ফজলুর রহমান সাহেবের ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু কোনাে ভাষার ওপর দখল না থাকার জন্য সমাজসেবার যে অসুবিধা হচ্ছিল, তাঁর স্ত্রী সেটা পরিপূর্ণ করতে সহায়তা করলেন।
মুসলিম লীগ সরকারের বেসামরিক সরবরাহমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ওপর ভার পড়ল দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করার । তিনি কলকাতা রেডিও থেকে শপথ নেওয়ার পরই এক বক্তৃতায় বললেন যে, আমরা আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। লাখ লাখ লােক অনাহারে মরার প্রচুর সম্ভাবনা। দেশে চাল নেই, চাল কেনার জন্য মুসলিম লীগ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু চাল যদি সংগ্রহ করা যায়, তবু এ যুদ্ধাবস্থায় চাল পৌছানাে সব। মহকুমায় সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আমরা চেষ্টা করব গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খুলতে, চাল সবাইকে দেওয়া যাবে না—আপনাদের আটা, বাজরা, ভুট্টাও খেতে হবে—জীবনটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। লােক যাতে বেশি না মরে, তার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। আপনাদের সহযােগিতা চাই। আল্লাহ আমাদের সহায়।
শহীদ সাহেবের প্রথম কাজ হলাে রাজধানী কলকাতা শহরে রেশনের ব্যবস্থা করা। এ সম্বন্ধে কারও কোনাে অভিজ্ঞতা ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরােধ করে দুজন দক্ষ লােক নিয়ে কলকাতার জন্য রেশনের একটি পরিকল্পনা তৈরি হলাে। তারপর ঢাকা, চিটাগাংয়ের পরিকল্পনা। রেশন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বিপদ সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখা। যেখানে সব জিনিসের অভাব, সেখানে এ সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা খুবই শক্ত। ওই সময় আমি দেখেছি শহীদ সাহেবকে দিনে আঠারাে ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে। তার যেন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য কী করে মানুষকে বাঁচাতে হবে। বাধা অনেক।
১৮৩
যখনই দেশে অভাব আসে, তখনই ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে—দুর্নীতি, কালােবাজারি, ঘুষ—সবই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার পতনের পর মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হয়েছে, সুতরাং হিন্দুদের খবরের কাগজে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিষােদগার অত্যন্ত স্বাভাবিক, কারণ শ্যামা-হক মন্ত্রিসভাই হিন্দু বুর্জোয়ার বাংলায় সরকারি ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার শেষ ব্যর্থ চেষ্টা। সুতরাং হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সহানুভূতি বা সহায়তা পাওয়া ছিল অসম্ভব। তার ওপর বাংলার মুসলমানদের খবরের কাগজ নবযুগ ও আজাদ—দুটো বাংলা কাগজ। আজাদ-এর লেখকেরা নবযুগ-এর লেখকদের সমকক্ষ ছিলেন না। নবযুগ এর শক্তিশালী লেখকদের সমাবেশ করেছিলেন শেরেবাংলা। সম্পাদক কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ, সহসম্পাদক দুজনেই তাদের শক্তিশালী কলম চালাচ্ছিলেন মুসলিম লীগ সরকার ও নেতাদের বিরুদ্ধে। কবি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। আবুল মনসুর সাহেব সাংবাদিকতার ভেতর দিয়ে মুসলিম লীগকে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত হন। তিনি তার ফুড কনফারেন্স পুস্তকে স্যার নাজিমুদ্দিনকে ‘মহিষে বাংলা’, শহীদ সাহেবকে কুত্তায়ে বাংলা’ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গ পুস্তক আয়না লিখে সুধীসমাজে যথেষ্ট নাম করেছিলেন—ফলে ফুড কনফারেন্স মুসলিম লীগ সরকারকে দেশের সাধারণ লােকের কাছে যথেষ্ট হেয় করতে সমর্থ হয়েছিল।
অন্যদিকে মুসলিম লীগের কাগজ আজাদও শহীদ সাহেবের পক্ষে ওকালতি করার জন্য ব্যস্ততা দেখায়নি ঘরােয়া দলাদলির কারণে। সত্যি বলতে মুসলিম লীগের অনেকেই মানুষের দুর্দশার জন্য শহীদ সাহেবকেই দায়ী (escape goat) করতে সচেষ্ট ছিলেন। এ সময় মুসলিম লীগের পরিষদ সদস্য আবুল হাশিম সাহেবও বেসরকারি সরবরাহমন্ত্রীর বেশ কড়া সমালােচনা করেন।
কিন্তু নভেম্বর মাসে যখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত করা প্রয়ােজন হলাে। কারণ, শহীদ সাহেব মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করায় তাঁকে সে পদ ছাড়তে হলাে, তখন আবুল হাশিম সাহেব তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাতক্ষীরার আবুল কাসেমকে বিপুল ভােটে পরাস্ত করে ৭ নভেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। পরদিন সাধারণ অধিবেশনে তিনি তার কার্যসূচি উপস্থিত করে যে বক্তৃতা করেন, তাতে অন্যান্য কথার মধ্যে বলেন যে মুসলিম লীগ তিন স্থানে বন্ধক রয়েছে, স্যার সলিমুল্লাহর সময় থেকে নেতৃত্ব বন্ধক আছে আহসান মঞ্জিলে, প্রচার বন্ধক রয়েছে দৈনিক আজাদএর মালিকের কাছে আর আর্থিক’ বন্ধক রয়েছে ইস্পাহানির
১৮৪
নিকট। আমি চেষ্টা করব ওই বন্ধকসমূহ থেকে মুসলিম লীগকে মুক্ত করতে এবং বাংলার মধ্যবিত্তকে তাদের যােগ্য স্থানে বসাতে। নেতারা অবশ্যই কেউ এসব কথাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি তখন এবং সবাই মনে করেছিল যে রাজনীতি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতার অভাবের জন্যই এমন সব কথা তার মুখ থেকে বেরিয়েছে। আমরা যারা ঢাকার রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম, আমাদের নিকট কিন্তু এ বক্তৃতা বিশেষ অর্থবহ বলে মনে হয়েছিল। তাই আমরা জনাব আবুল হাশিম সাহেবকে যত সত্বর ঢাকায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই।
কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে আরম্ভ হয় এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও অন্যান্য কয়েকটি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গে তেভাগা আন্দোলনের ঢেউ এসে পৌঁছায়নি। দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ লােক মরছে—অর্ধমৃত মানুষকে শিয়ালে খেয়েছে। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট নিয়ে মানুষেকুকুরে লড়াই হয়েছে। অন্যদিকে কালােবাজারি, মুনাফাখােরদের কারসাজির ফলে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফেঁপে উঠছে। সব রকম পাপ সমাজদেহে ঢুকেছে—সমস্ত দেশের কাঠামাে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এত দিন সাধারণের যা ধ্যানধারণা ছিল, তার ওপরে এল আঘাত। রায়ত-প্রজারা বিপদে পড়লে মনিবের সাহায্য পেয়েছে—এখন যখন ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির হয়ে দুটো চালের জন্য তাদের কাছে গেল, তখন দেখা গেল যে সে গােলাভরা ধান থেকে এতটুকুন সাহায্য তারা পেল না। কালােবাজারে তাই বিক্রি করে তারা পয়সা করছে। ঢাকার সিনেমা হলগুলাের সামনে যখন ভাত ভাত করে মানুষ মরে গেছে বা মরছে—তখনাে সিনেমা হল ভর্তি (House full) লেখা বাের্ড লটকে দিয়েছে। নতুন কন্ট্রাক্টররা পয়সা করেছে, দামি সিগারেটের টিন এক হাতে, অন্য হাতে ‘ব্রিফকেস’—যার মধ্যে নানা কোম্পানির নামের রাবার স্ট্যাম্প আর হিসাবপত্র। দেখতে দেখতে ১৯৪৪ সালের দিকে চালের দাম একশত টাকার কিছু ওপরে উঠে গেল । লঙ্গরখানায় খেয়ে খিচুড়ি গলায় আটকে লােক মরছে—অগণিত মানুষের কঙ্কাল শহরে হেঁটে চলেছে। মানুষ মানুষের ওপর সকল শ্রদ্ধা হারাল, সত্য ও ন্যায় বলে কোনাে কিছু আছে, এটা আর মৃত্যুপথযাত্রী লােকগুলাে ভাবতে পারল না—মেয়েরা সস্তায় দেহ বিক্রি করতে লাগল । আমার জীবনে এত মৃত্যু এর আগে আর দেখিনি।
আমার নিজের জীবনের ওপর ধিক্কার এল। নিজেকে এত অসহায় মনে হচ্ছিল। অথচ চাকরি ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণের জন্য মানবতার সেবার কাজে নিজেকে নিয়ােজিত করব, তারও জো নেই। কারণ, সরকারি চাকরি করি বলে এক মণ চার সের চাল বিশ টাকা দরে পাচ্ছি—চালের দাম যখন শতের কোঠায়, আর তাও পাওয়ার জন্য যখন হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়, কারণ সাদা বাজারে চাল বিক্রি হয় না। ওই পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরি ছাড়া
১৮৫
বিপজ্জনক। ঢাকায় আমরা এক রিলিফ কমিটি করলাম। খাজা শাহাবুদ্দীন ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি—তা ছাড়া শালিমার কোম্পানি করে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন—তাঁর কাছে চাঁদার জন্য গেলাম। দিলেন দশটি টাকা। সৈয়দ আবদুস সলিম ঢাকা মুসলিম লীগের সম্পাদক দিলেন পাঁচ টাকা। সুতরাং শামসুল হকের নেতৃত্বে একদল ছেলে পাঠানাে হলাে কলকাতায়, হাসান ইস্পাহানি দিলেন একশত টাকা। সবচেয়ে বেশি চাদা দিলেন পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী খিজির হায়াৎ খান তেওয়ানা-হাজার টাকা।
ডাক্তার করিম, ডাক্তার মান্নান, ডাক্তার সাবেদ আলী—এঁদের পাঠানাে হলাে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল থেকে বসন্তের টিকা আর কলেরার ইনজেকশন দিতে। টাকার প্রয়ােজন। বসন্তে দেশ ছেয়ে গেছে—কিন্তু এত টাকার জৌলুশের মধ্যে এসব কাজে কেউ টাকা দিতে চায়নি।
আবুল হাশিম সাহেব আমাদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য ১৯৪৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ আসার কথা। সুতরাং তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের সম্পাদক সেলিম সাহেবের বাড়ি গিয়ে তার জন্য কী ব্যবস্থা করা হবে জানতে চাইলে তিনি বললেন যে ঢাকা জেলা লীগ তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়নি। সুতরাং তাদের কোনাে দায়িত্ব নেই। আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। ডাক্তার মাইজুদ্দীন সাহেবকেই বললাম কথাটা। তিনি ঢাকা শহর মুসলিম লীগের সভাপতি। তাঁর বৈঠকখানায় হাশিম সাহেবের থাকার ব্যবস্থা হলাে। আমাদের দলের কর্মী শামসুদ্দীনের বাড়ি লৌহজং। তাঁকে ৪ ফেব্রুয়ারি খবর দেওয়া হলাে তারাপাশা (লৌহজং) ঘাটে আবুল হাশিম সাহেবের অভ্যর্থনার আয়ােজন করতে। শামসুল হক সে খবর নিয়ে শামসুদ্দীনের বাড়ি গেল। আমি ৩ তারিখে নারায়ণগঞ্জে আবুল হাশিম সাহেবের অভ্যর্থনার ব্যবস্থার জন্য যাই। খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়িতে সভা ডাকা হলাে—আবদুল আওয়াল, আলমাছ আলী, শামসুজ্জোহা কর্মীদের সভার আয়ােজন করে।
শামসুজ্জোহার পিতা খান সাহেব ওসমান আলী সাহেব প্রথম জীবনে পাটের ব্যবসা করে অজস্র টাকা উপার্জন করেন এবং নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন। চাষাঢ়া স্টেশনের নিকট তখনকার দিনে সুন্দর একখানা বাড়ি করেন। বাড়ির নাম রাখেন বায়তুল আমান’। ঢাকায় খাজা শাহাবুদ্দীনের বাড়ির নাম ছিল বায়তুল আমান। ভাবটা যেন ‘মারি তাে হাতি লুটি তাে ভান্ডার। বাড়ির নাম দিয়ে যার শুরু, ঢাকার নবাবকে পরবর্তীকালে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়ে তার পরিসমাপ্তি । সে বিজয়ের মধ্য দিয়ে পেয়েছিলেন তিনি জীবনের পরিপূর্ণতা, জীবনের তৃপ্তি, আকাঙ্ক্ষার সফলতা ও পরিসমাপ্তি ।
১৮৬
তাঁর বাড়ির দ্বার ছিল আমাদের জন্য অবারিত। কর্মীদের নানা রকম জুলুম হাসিমুখে সহ্য করেছেন। আমরা যারা আহসান মঞ্জিলের ধ্বংস কামনার মধ্য দিয়ে বাস্তিলের পতনের ছবি দেখতাম, তাদের পক্ষে খান সাহেব ওসমান আলীর মতাে আমাদের সাহায্য করার মতাে লােক অল্পই ছিলেন। আমাদের সংগ্রামের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। তাই আজও আমি তার নিকট কৃতজ্ঞ। শামসুল হক আজ আর নেই—শামসুদ্দীন পাকিস্তানি, আলমাছ আলী মৃত, আওয়াল কোথায় জানি না। আমার কর্মজীবনের অবসরের পর আজ আমিও মৃত্যুর দিন গুনছি।
খান সাহেব ওসমান আলীর কথা বলতে গিয়ে তখনকার দিনে যাঁরা আমাদের কর্মীদের সাহায্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুন্সিগঞ্জের তদানীন্তন মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট অশােক মিত্র, আইসিএস এবং তখনকার দিনে শ্রীনগর হাসপাতালের ডাক্তার নন্দী ও তার স্ত্রী। সত্যি বলতে, তাঁরা দুজনই কমিউনিস্টদের, বিশেষ করে মুসলমান কমিউনিস্টদের বুদ্ধি ও টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। শামসুদ্দীন ও মুন্সিগঞ্জের বেশ কিছুসংখ্যক মুসলমান। বামপন্থী ছাত্র তাদের সাহায্য পেত।
শামসুদ্দীন তখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও পার্টির সদস্য হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন, এ বিষয়ে আমার কোনাে সন্দেহ ছিল না। কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল । আবুল হাশিম সাহেবের ভাগনে মনসুর হাবিব সাহেবকেও শামসুদ্দীন আগে থেকেই জানত। তাই আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গলাভ করার সুযােগ তার ছাড়ার কথা নয়। লৌহজং স্টিমার ঘাট থেকে শামসুদ্দীন আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গেই ঢাকা আসে। শামসুদ্দীন ছাড়া বাকি যারা আবুল হাশিম সাহেবের আলােচনায় নারায়ণগঞ্জে যােগ দিয়েছিল, তাদের সবাই একসময় ফজলুর রহমান সাহেবের সঙ্গে কাজ করেছে। সুতরাং সংগঠন করার ব্যাপারে তাদের সবারই কিছু অভিজ্ঞতা ছিল। আলােচনা তাই অনেকটা অর্থপূর্ণ হয়েছিল ।
পরের দিন আবুল হাশিম সাহেবকে নিয়ে আমরা ঢাকা আসি। আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে ছিলেন কবি বেনজীর আহমদ। বেনজীর সাহেব একসময় নাকি সন্ত্রাসবাদীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং একবার ডাকাতি করে নাকি ধরাও পড়েন এবং পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে যান। সুতরাং তিনিও একজন। রােমান্টিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তার ওপর আবার কবি ও রাজনীতিবিদ।
ঢাকায় সিরাজ-উদ-দৌলাহ্ পার্কে এক জনসভায় আবুল হাশিম সাহেব বক্তৃতা করেন। তাঁর বক্তৃতার ধরন এতদিনকার মুসলিম লীগের নেতাদের বক্তৃতা থেকে অনেকটা ভিন্ন ধরনের হয়েছিল। ইসলাম তার কাছে একটা ধর্মই নয়—অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষার
১৮৭
ওপর তাঁর অপূর্ব দখল, বিশেষ করে বিশেষণের ব্যবহার। উচ্চারণভঙ্গি অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের যেমন ছিল কাজী নজরুল ইসলামের। পূর্ববঙ্গের বন্ধুদের ঠাট্টা করে কবি বলতেন যে যখনই আমি পূর্ববঙ্গে আসি, তখন পদ্মর গর্ভে কয়েকটা জিনিস ফেলে আসি—প্রথমত, ‘চন্দ্রবিন্দু’, দ্বিতীয়ত, বর্গীয় জ’-এর উচ্চারণ—তা নইলে তােমাদের সব কথা আমি বুঝতে পারি না। আবুল হাশিম সাহেব কবি ছিলেন না—তিনি ছিলেন চিন্তানায়ক রাজনীতিবিদ। প্রতিটি শব্দই তিনি ব্যবহার করতেন ভাষার মার্জিত রূপকে ফুটিয়ে তুলতে—যেমন করতেন চার্চিল তাঁর নিজস্ব ভাষায় বক্তৃতা করতে। মুসলিম ছাত্রসমাজের নিকট তিনি শিগগিরই জননেতা হয়ে উঠলেন—হয়ে উঠলেন প্রেরণার উৎস। কিন্তু তিনি শিক্ষিত ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্যাতি লাভ করে তাদের প্রিয় নেতা হলেন—তেমনি আবার বয়স্ক লােকের নিকট অনেকটা অপ্রিয় হতে লাগলেন। আমার মনে হয়, দুটো কারণে প্রথম সে যুগের বয়স্ক লােকেরা ইসলামকে বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাদের নিকট ইসলাম খােদার ধর্ম—তাকে মেনে নিতে হবে বিনা বাক্যব্যয়ে। তাই তাঁর বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে ইসলামের আলােচনা তাঁদের নিকট বেইমানি বলে মনে হতাে। দ্বিতীয়ত, দৃষ্টিহীনতার জন্য অনেক কথা শত্রুর অনুচরদের নিকট বলতেন, যা কোনাে কোনাে মহলে ভুল ব্যাখ্যা হতাে।
অনেক আলােচনার পরে স্থির হলাে যে মুসলিম লীগের মধ্যে একটা বামপন্থী দল গঠন করা প্রয়ােজন, তা নইলে মুসলমানের ওপর খাজারা ও ইস্পাহানিরা যে জগদ্দল পাথরের মতাে চেপে বসে আছে, তা থেকে বাংলার মুসলিম সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ঢাকায় যেহেতু খাজাদের একক নেতৃত্ব, সুতরাং লড়াই এখান থেকেই আরম্ভ করতে হবে। প্রথম পদক্ষেপ একটি পার্টি হাউস—তারপর সার্বক্ষণিক’ (whole time) কর্মী সংগ্রহ।
১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার শ্বশুর সাহেব এলেন আমার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ঢাকা রেলস্টেশনে এসে যখন পৌছালাম, তখন আমার স্ত্রীর প্রসবব্যথা আরম্ভ হয়ে গেছে। আশ্চর্য, হাজার হাজার মানুষ যখন মরছে, তখন নতুন এক শিশু জন্মাচ্ছে। আমি অনেকটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। একজন শ্বেতাঙ্গ ক্যাপ্টেন আমার অবস্থা দেখে নিজে থেকেই অ্যাম্বুলেন্স গাড়ির জন্য টেলিফোন করতে থাকলেন প্রতিটি হাসপাতালে, কিন্তু কোথাও কিছু জোগাড় হলাে না। সর্বশেষ সে তাদের কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে ফোন করে একটা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এল এবং সেই অ্যাম্বুলেন্সে উঠে আমি স্ত্রীকে নিয়ে এলাম মিটফোর্ড হাসপাতালে, সঙ্গে একজন পরিচারিকা। ওকে জেনারেল ওয়ার্ডে রেখে কেবিনের জন্য হাসপাতাল সুপারের নিকট গেলাম এবং বহু সাধ্যসাধনা করে একটা কেবিন পাওয়া গেল। গাইনােকোলজিস্ট ডাক্তার ধীরেন দত্ত, যার
১৮৮
চিকিৎসায় ছিলেন আমার স্ত্রী, সে খবর পেয়ে রাতেই ছুটে এলেন, কিন্তু পরীক্ষা করে বললেন যে আরও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সন্তান হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। রাতভর তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম। পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি—আমার মেজ ছেলের জন্ম হয়।
প্রথম সন্তান প্রসবের সময় অর্থাৎ ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে এমনি বিপদ হয়েছিল। চারদিকে হিন্দু-মুসলমান নিধনযজ্ঞ চলছে। নারায়ণগঞ্জ ট্রেনে যাওয়া অসম্ভব। গেন্ডারিয়াতে ট্রেনে উঠে গুন্ডারা মুসলমানদের হত্যা করছে। কোনাে মুসলমান ড্রাইভার ফরাশগঞ্জ এলাকা দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে সাহস করল না। আমাদের সরকারি উকিল ও আমার শিক্ষক ইব্রাহিম সাহেব (পরবর্তীকালে হাইকোর্টের জজ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) আমাকে বললেন যে তার ড্রাইভার আমাদের পৌছে দেবে। দুর্জয় সাহসী ড্রাইভার, সত্যি নারায়ণগঞ্জে আমাদের পৌছে দিয়েছিল। তারপর আমার শ্বশুরের সঙ্গে আমার স্ত্রী জাহাজে উঠল রাতদুপুরের সময় । ড্রাইভার আবার আমাকে রাত তিনটার দিকে ঢাকায় বাসায় এনে পৌছে দিয়েছিল। দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আমার সেই প্রথম সন্তানের জন্মের কথা মনে পড়েছিল।
আবুল হাশিম সাহেবের প্রেরণা পেয়ে পার্টি হাউস’ গঠন করা হলাে ১ এপ্রিল ১৯৪৪ সালে, ঢাকায় ১৫০ নং চক মােগলটুলীতে। তিনতলা বাড়ি—নিচের তলায় কাগজের দোকান হায়দার সাহেব নামের এক ভদ্রলােকের। দোতলায় আমাদের অফিস-তেতলায় সার্বক্ষণিক কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা এবং কনফারেন্স ঘর। সার্বক্ষণিক কর্মী চারজন—শামসুল হক, শামসুদ্দীন, তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ শওকত আলী। তাদের খাবারথাকার ব্যবস্থা ছাড়াও তাদের পার্টির কাজের জন্য যা খরচ হবে তার ব্যবস্থা করা। পার্ট-টাইম কর্মীদের মধ্যে ছিলেন মােহাম্মদ তােয়াহা, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, এ কে আর আহমদ, নইমুদ্দীন আহম্মদ ও ডাক্তার এম এ। করিম। এ ছাড়া যারা নানা কাজে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে নাম করা যায়—নজমুল করিম, মােহাম্মদ নুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রের। বাড়িটা ছিল একজন হিন্দুর । ১৯৪১ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে এ বাড়িটা ছিল পরিত্যক্ত। ভদ্রলােক আমাদের ভাড়া দিতে পেরে খুশি হলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল রাজনীতি ও ইসলামের ওপর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা পুস্তকসমূহ সংগ্রহ করা, বিশেষ করে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনীর বিভিন্ন দিক নিয়ে বিদেশিদের আলােচনা; মওলানা মওদুদীর লেখা ইংরেজি পুস্তকসমূহ, ইবনে খালদুন, ইবনে রুশদ, ইমাম গাজ্জালির ওপর লেখা—এবং সাম্যবাদের ওপর লিখিত যত পুস্তক।
১৮৯
আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলােচনার ওপর ভিত্তি করে আমার প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হয় Islamhe only solution. তারপর শামসুল হকের লেখা পাকিস্তান কী, কেন ও কোন পথে—এটাও আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে আলােচনার ফল। ওই পুস্তকে ‘অফিশিয়াল মুসলিম লীগের সঙ্গে পাকিস্তান প্রশ্নে আমাদের মতের পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছিল। তৃতীয় বই খণ্ড ভারত বনাম অখও ভারত—এটা আমাদের পার্টি হাউসে নিজেদের মধ্যে আলােচনার ফল। পুস্তক প্রকাশিত হয় নইমুদ্দীনের নামে। এরপর আমার পুস্তক Simla Conference and After, পূর্ব পাকিস্তান আর পার্টি সংগঠনের ওপর The way out। শেষের পুস্তকখানা প্রকাশিত হওয়ার পর খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব আমাকে ঠাট্টা করে ডাকতেন ‘অঢ়িকারী বাবু’। অর্থাৎ আমি পার্টির গংগাধর অধিকারী। যেহেতু ওই পুস্তকখানা প্রকাশিত হয় আমার চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার পরে, তাই ওটা আমার নিজের নামেই প্রকাশিত হয়।
এরপর মােহাম্মদ মােহসিনের কাছ থেকে হুশিয়ার সাপ্তাহিক কাগজ কিনে নিয়ে তা বহুদিন পার্টি পত্রিকা হিসেবে পরিচালনা করার দায়িত্ব আমরা। নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেযেছিলাম তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে। চিরদিনই সে নিজেকে পশ্চাতে রাখতে অভ্যস্ত ছিল বলে তার কর্মক্ষমতার কথা অনেকের কাছে জানা ছিল না। সে ছিল অনেকটা নির্বাক কর্মী। আমাকে বাদ দিলে সবচেয়ে বেশি কথা বলত শামসুল হক, মােহাম্মদ তােয়াহা, তারপর শামসুদ্দীন। কিন্তু আমাদের অফিসে অনর্গল কথা বলার ব্যাপারে আবুল হাশিম বা হবীবুল্লাহ বাহার সাহেবের কমকক্ষ কেউ ছিল না।
শেফাউল মুলক হেকিম হাবিবুর রহমান সাহেব দিয়েছিলেন চারখানা চারপায়া’ সর্বক্ষণ-কর্মীদের শয়নের জন্য। জনাব সৈয়দ মােহাম্মদ তাইফুর সাহেব দিয়েছিলেন কিছু পুস্তক। তখন তিনি সপরিবার মৌলভীবাজার ও মােগলটুলী রাস্তার মােড়ের বাড়িতে ভাড়ায় ছিলেন। ইলিয়াস সর্দার কিছু টাকা দিয়েছিলেন টেবিল-চেয়ার কেনার জন্য। গােলবদনের শাহ সাহেবের কাছ থেকে শামসুল হক বেশ কিছু চাদা নিয়ে বইয়ের জন্য আলমিরা কিনে ফেলেছিল এবং সেই সঙ্গে লাহােরের আশ্রাফ পাবলিকেশনের কিছু বই। এভাবে আমাদের পার্টি হাউস’ গড়ে উঠেছিল। সেকালে ঢাকায় ব্যবসাকেন্দ্র ছিল না—শিল্প এলাকা ছিল না। যা ছিল তা-ও হিন্দুদের কয়েকটি কাপড়ের মিল—তাও নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জে কিছু পাটের দালাল ও আড়তদার ছিল। নগদ টাকার শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সাহায্য আসত রেজাই করিম সাহেবের কাছ থেকে। আর বাকি পঞ্চাশ ভাগ খরচ চলত চাঁদা তুলে।
১৯০
১৯৪৪ সালের জুন মাসে স্যার নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী এলেন মােগলটুলী পার্টি হাউসে। অনেক আলােচনার পর স্থির হলাে যে যেহেতু খাজা শাহাবুদ্দীন ও সৈয়দ আবদুস সেলিম, যথাক্রমে জেলা লীগের সভাপতি ও সম্পাদক কলকাতায় থাকেন, সুতরাং ঢাকা জেলার জন্য অর্গানাইজিং কমিটি প্রয়ােজন। নূরুল আমিন সাহেব প্রস্তাব করলেন রেজাই করিম হবেন। চেয়ারম্যান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিঞা) প্রস্তাব করলেন সম্পাদক হবেন আসাদুল্লাহ। কমিটিতে থাকলেন সুলতান উদ্দীন সাহেব, ডাক্তার ময়েজউদ্দীন, আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, খানবাহাদুর আওলাদ হােসেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কমিটি হয়ে গেল। রেজাই করিম সাহেব বললেন যে শামসুল হক, শামসুদ্দীন ও আমি কমিটিতে আলােচনায় অংশগ্রহণ করব পার্টি হাউসের প্রতিনিধি হিসেবে। আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলাে যে এমনিভাবে চাদা তুলে পার্টি অফিস চালানাে অসম্ভব। সুতরাং প্রতিটি ইউনিয়নের সব সাবালক মুসলমানকে দুই আনার বিনিময়ে সদস্য করা হলে ইউনিয়ন লীগে করা হবে দুই পয়সা ও মহকুমা লীগের অফিসেরও সদস্য করা হবে দুই পয়সার। আর জেলা লীগের সদস্য করা হবে চার পয়সার বিনিময়ে । রেজাই করিম সাহেব বললেন যে গ্রামের লােকেরা পয়সা দিয়ে মেম্বার হতে চাইবে না। সুতরাং রসিদ বই ছাপানাের পয়সাটাই মারা যাবে—বিশেষ করে যুদ্ধের জন্য যেখানে কাগজ কিনতে হবে কালােবাজারে চার গুণ বেশি দামে—ছাপানাের জন্যও খরচ হবে বিস্তর। কিন্তু আমরা জেদ করতে লাগলাম। আমি বললাম এটা না করলে মুসলিম লীগ নেতাদের পকেটেই থেকে যাবে। দেশের লােকের মধ্যে চেতনা আসবে না। কমিটির সদস্যদের মধ্যে একমাত্র আসাদুল্লাহ সাহেব ঢাকা সদর মহকুমার ভার নিতে রাজি হলেন। বাকি মহকুমাসমূহের ও উত্তর সদরের ভার পড়ল আমাদের পার্টি অফিসের ওপর। শামসুদ্দীন মুন্সিগঞ্জের ভার নিলেন—তাজউদ্দীন আহমদ ভার নিলেন উত্তর সদরের। মানিকগঞ্জের ভার পড়ল মছিহউদ্দীনের (রাজা মিঞা) ওপর, নারায়ণগঞ্জ শহর—আলমাছ আলী আর শামসুজ্জোহার ওপর। মহকুমার ভার পড়ল আবদুল আওয়ালের ওপর। ঢাকা শহরের ভার নিল ইয়ার মােহাম্মদ ও মােহাম্মদ শওকত আলী। এমনভাবে ব্যবস্থা করা হলাে যে সব মহকুমারই ভার পড়ল আমাদের পার্টির লােকের হাতেই—কারা ইউনিয়ন। লীগের, শহর লীগের ও মহকুমা লীগের কর্মকর্তা হবে, তা স্থির করতে একমাত্র ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা ছাড়া, পার্টি অফিসের এক গােপন সভায় আমাদের পার্টির লােকদের বলে দেওয়া হলাে যে তারা যেন এমন কৌশলে কাজ করে, যাতে পুরােনাে জেলা নেতা বা অর্গানাইজিং কমিটির কোনাে সদস্য এমন কোনাে সন্দেহ না করে যে আমরা কেবল আমাদের লােকদেরই
১৯১
সদস্য করছি—বা ইউনিয়ন লীগ বা মহকুমা লীগ থেকে তাদের সবাইকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার এ-ও স্মরণ রাখতে হবে যে মহকুমার কাউন্সিল সদস্য যেন সব আমাদের লােক হয়। মহকুমার কমিটিগুলােতে কেবল আমাদের সংখ্যাগুরু সদস্য থাকলেই চলবে। আর আমাকে বা শামসুল হককে কাজের সাপ্তাহিক রিপাের্ট পাঠাতে হবে কিন্তু শামসুল হকের ওপর যেহেতু ময়মনসিংহের সংগঠনের ভার ছিল, কলকাতার সঙ্গেও যােগাযােগ রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে বিভিন্ন জেলার সংগঠনের কাজে তাকে যেতে হতাে—তাঁর পক্ষে রিপাের্টসমূহ পড়ার সময় হবে না। সুতরাং স্থির হলাে যে পনেরাে দিন অন্তর আমাদের পার্টির যে আত্মসমালােচনার সভা বসবে, তাতে ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সংগঠনের অগ্রগতির খবরাখবর আলােচনা করা হবে।
আমাদের কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলল। আসাদুল্লাহ সাহেবের মহকুমায় আমাদের লােকদের বলে দেওয়া হলাে তার কাজে যেন কোনাে বাধা না দেওয়া হয়। আসাদুল্লাহ সাহেব আবদুল ওয়াসেক, আকরাম আলী বেগ প্রমুখ লােককে নিয়ে সদর দক্ষিণে কাজ আরম্ভ করলেন। আমাদের ধারণা ছিল যে আবদুল ওয়াসেক সাহেব যেখানে আছেন, সেখানে বক্তৃতা হতে পারে, কিন্তু সংগঠন হবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে আসাদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করেছি। লােকটি ছিল নীরব কর্মী, রাজনীতির চিন্তা তাঁর মনে সব সময় জাগরূক থাকত। রাজনীতির বাইরে বড় বেশি কথা বলত না-তার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। সবার কথা শেষ না হলে কোনাে কথা বলত —আর যা বলার তা আবার সর্বসমক্ষে বলত না।
দুর্ভিক্ষের সময়ে সমাজসেবায় এবং বামপন্থী মুসলিম লীগ সংগঠনে জেলার পুরােনাে কৃষক সমিতির সাহায্য পেয়েছিলাম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে, জনগণকে সমস্যাসচেতন করার ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আমাদের একটা আপসের মনােভাব বিদ্যমান ছিল। এর ফলে বেশ কিছুসংখ্যক কৃষক সমিতির লােকও আমাদের সদস্য হয়েছিল। বেদনাবােধ করতাম যখন দেখতাম এম এন রায়ের মুসলমান শিষ্যবর্গ আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করত। যদিও রায়পন্থী হিন্দুরা আমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাত।
এমনি সময় শ্রী রাজাগােপালাচারী হিন্দু-মুসলমানের সমস্যার একটা সমাধান উপস্থিত করলেন। তার প্রস্তাব ছিল যে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে যেসব জেলার মুসলমান সংখ্যাগুরু, তাদের গণভােটের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হবে।
প্রস্তাবটি দেওয়া হলাে জিন্নাহ সাহেবের নিকট। জিন্নাহ বললেন যে তাঁর প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটিতে উপস্থিত করা হবে। রাজাগােপালাচারী
১৯২
জানতে চাইলেন—জিন্নাহ সাহেবের নিকট ওটা গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত কি না। জিন্নাহ উত্তরে বললেন তাঁর ভাষায় It was a shadow and a husk; maimed mutilated and moth-eaten Pakistan. সুতরাং তাঁর নিজের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। শ্রী রাজাগােপালাচারী তখন বললেন, তাহলে প্রস্তাবটি ওয়ার্কিং কমিটিতে যেন উপস্থিত না করা হয়।
১৯৪৪ সালের মে মাসে গান্ধীজি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৭ জুলাই তিনি জিন্নাহ সাহেবকে এক চিঠি লেখেন :
ভাই জিন্নাহ,
আমার মুক্তির পর আমি আপনাকে চিঠি লিখিনি—কিন্তু আজ আমার অন্তর বলছে আপনাকে আমার চিঠি লেখা উচিত। আপনার যখন সুবিধা হবে তখনই আমি আপনার সঙ্গে মিলবার বাসনা রাখছি। আমাকে ইসলামের বা এ দেশের মুসলমানদের শত্রু মনে করবেন না। আমি কেবল আপনারই সেবা করতে চাই না—সমস্ত বিশ্বজগতের সেবায় আত্মনিয়ােগ করতে চাই। আমাকে নিরাশ করবেন না বলে আশা করি।
ভবদীয়-
(এম কে গান্ধী)
জিন্নাহ তখন খুব অসুস্থ। ফুসফুসে তখন যক্ষ্মার বীজ। ডাক্তারের পরামর্শে তিনি কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে ‘হাউস বােটে’ বিশ্রাম নিচ্ছেন। তিনি উত্তরে লিখলেন :
আপনাকে আমার বােম্বের বাড়িতে দেখতে পেলে আনন্দিত হব। আমি আগস্টের মাঝামাঝি বােম্বে পৌছব বলে আশা করছি। আমার বিশ্বাস, এ সময়ের মধ্যে আপনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠবেন এবং বােম্বে ফিরে যাবেন। সাক্ষাতের আগে আর কোনাে কথা আমি বলতে চাই না। খবরের কাগজে আপনার স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে ভালাে হচ্ছে জেনে খুশি হয়েছি—আশা করি আপনি শীঘ্রই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন।
৯ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর বােম্বের মালাবার পাহাড়ের বাড়িতে গান্ধী-জিন্নাহ আলােচনা আরম্ভ হয়। এই আলােচনায় সাহায্যের জন্য গান্ধীজি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের বােম্বে উপস্থিত থাকতে বলেন; কিন্তু জিন্নাহ তাঁর ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের আমন্ত্রণ জানালেন না। কারণ, জিন্নাহর বােধ হয় ধারণা হয়েছিল যে আলােচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ, তাঁর দাবি কংগ্রেস কখনাে মেনে নেবে না।
১৯৩
বাংলাদেশে আমরা স্থির করলাম যে গান্ধী-জিন্নাহ আলােচনার সফলতার জন্য আমরা জনমত গঠন করব। আবুল হাশিম সাহেব, কংগ্রেসের নেতা জে সি গুপ্ত হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সভা আহ্বান করেন। কমিউনিস্ট পার্টিও এসব সভায় যােগ দেয়। আলােচনা প্রায় তিন সপ্তাহ চলার পর ভেঙে যায়—রাজাগােপালাচারীর মতাে গান্ধীজিও মুসলিম সংখ্যাগুরু গণভােটের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নেন। আলােচনা ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বাংলাদেশে এসব সম্মিলিত সভা-সমিতির মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার তীব্রতা কমে যায় এবং আমরা বেশ খানিকটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পথে অগ্রসর হই। কিন্তু অন্য কোনাে প্রদেশে এভাবে জনমত গঠনের চেষ্টা করা হয়নি। তাই সমঝােতার জন্য ও আলােচনার সফলতার জন্য নেতাদের ওপর জনতার কোনাে চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।
আগস্ট মাসের মধ্যে ইউনিয়ন লীগ ও মহুকুমা লীগের নির্বাচন শেষ হয়ে গেল। নারায়ণগঞ্জে সেলিম সাহেব একটু গােলমাল করার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবুল হাশিম সাহেবের দৃঢ়তার জন্য সে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সে দৃঢ়তা দেখানাের ফলে খাজা শাহাবুদ্দীনের টনক নড়ে এবং পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আগমন করেন। শাহাবুদ্দীন সাহেব অফিসে এসে কমিটির এক ঘরােয়া বৈঠকে আলােচনা করেন, কিন্তু আমাদের তিনজনের কাউকে সে আলােচনায় অংশগ্রহণ করতে বলা হলাে না। তারপর মহকুমার ও সদরের যারা নতুন সভাপতি বা সম্পাদক হয়েছেন, তাদের ডেকে আলােচনা করে জানতে চাইলেন যে তারা কাদের ২৪ সেপ্টেম্বর জেলা লীগের নির্বাচনে কর্মকর্তা নিযুক্ত করবেন। সবাই বললেন যে কে কে যে প্রার্থী হবেন তার কোনাে তালিকা তারা তখনাে পাননি।
২০ সেপ্টেম্বর রেজাই করিম সাহেবের ৩১ নম্বর দেওয়ান বাজারের বাড়িতে আহ্বান করা কমিটির বৈঠক হয়। আমাদের তিনজনকেও বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। কোন ইউনিয়নে কতজন মেম্বার হয়েছে, আছে—সেটাই আলােচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের হিসাবমতে ঢাকা জেলার সদস্যসংখ্যা প্রায় দুই লাখ—কিছু কমবেশি হতে পারে। রসিদ বইয়ের হিসাব চাইলেন। কাউন্টার ফাইলের সঙ্গে মিলিয়ে টাকার হিসাব তাঁর কাছে। ২২ তারিখ সকালে উপস্থিত করতে বলা হলাে। আমাদের হিসাব তৈরি ছিল। আমরা রাজি হলাম। আমরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হওয়ায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন অন্যান্য চাদা যা উঠেছে, তারও হিসাব তৈরি করার জন্য। আমরা বললাম যে সদস্য সংগ্রহ করার অভিযান শুরু হওয়ার পরে আমরা বাইরে থেকে কোনাে টাকা সংগ্রহ করিনি। কথাটা অবশ্যই পুরােপুরি সত্যি ছিল না। কারণ, রেজাই করিম সাহেবের কাছ থেকে শামসুল হকের ট্যুরের টাকা আদায় করেছি।
১৯৪
শামসুল হক যেহেতু সারা বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াতেন, তাই তাঁর খরচ একটু বেশি ছিল। অবশ্যই বেশির ভাগ ভ্রমণ তার বিনা টিকিটেই চলত। সেকালে লােকের হাতে পয়সা ছিল কম—সুতরাং কর্মীরাও হিসাব করে খরচ করতেন। কর্মীদের মধ্যে কখনাে আধুনিকতার অভিশাপ লাগেনি। রাজনীতি করতে এসে আমাদের সবাইকে বিভিন্ন স্তরের লােকদের সঙ্গে মিশতে হয়েছে—অভিজাত সম্প্রদায়, উচ্চ এবং নিম্নমধ্যবিত্ত অথবা একেবারে বিত্তহীন—কেউ বাদ যায়নি। ফলে জনগণের প্রতিক্রিয়া আমরা যতটা লক্ষ করতে পারতাম, তা যারা আভিজাত্যের ফলে নেতা হয়েছেন, তাঁরা তা বুঝতে পারতেন না। খাজা শাহাবুদ্দীনের মধ্যে আমরা সেটা লক্ষ করেছিলাম। তিনি নির্ভর করতেন তার বুদ্ধির মারপ্যাচের ওপর। জীবনে মধ্যবিত্তের সুযােগ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা, সর্বোপরি মধ্যবিত্তের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা, তা-ও দেখেছি। যেমন রেজাই করিম ও ফজলুর রহমান কেউ কাউকে নেতা বলে মানতেন না, কিন্তু নিরক্ষর সৈয়দ সাহেবে আলম (কালু মিঞা) প্রেসিডেন্ট হলে তাঁরা দুজনেই ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকতে আপত্তি করতেন না। আমার তাই ধারণা, বাংলার সাধারণ লােক যে পশ্চিমের নেতা খুঁজেছে বহুদিন এবং তার জন্য নিজের দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে—এর আসল কারণ পরশ্রীকাতরতা। আমরা যে আহসান মঞ্জিলের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলাম বর্তমান শতাব্দীর প্রথম থেকে, তার কারণ তারা এসেছিল কাশ্মীর থেকে দিল্লি হয়ে। ২২ তারিখে আমরা দুজন-আমি আর শামসুল হক সকালে তার পরিবাগের বাড়িতে গিয়ে খবর পাঠালাম। তিনি প্রস্তুত ছিলেন—চা-নাশতা এল । হিসাব দেখার কথা ভুলে গেলেন। হাসিমুখে আমাদের কর্মীদের কাজের খুব প্রশংসা করলেন। তিনি সভাপতির যে ভাষণ দেবেন, তাও আমাদের পড়ে শােনালেন। সেলিম সাহেব যে আমাদের খুব প্রশংসা করেছেন, তা-ও বললেন। সিগারেট কেস খুলে দিলেন। আমরা ঠিক এমন ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাইনি। তাই ভাবছিলাম এ আবার কোন চাল! আমাকে জিজ্ঞেস করলেন রেজাই করিম সম্বন্ধে আমার মতামত কী। আমি বললাম, তিনি মস্ত বড় ফৌজদারি উকিল। সুতরাং আমরা মনে করি সে খুব বুদ্ধিমান। আবার জিজ্ঞেস করলেন তাঁকে লীগের সভাপতি নির্বাচিত করলে কেমন হয়? আমরা শুধু বললাম, কেন, আপনিই তাে সভাপতি আছেন। তিনি বললেন, না আমি মন্ত্রী হওয়ার পর আর সংগঠনের সভাপতি থাকতে পারি না। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা যেন বিস্মিত হযেছি এমন ভাব দেখালাম। জিজ্ঞেস করলেন তাঁর ওপর আমাদের বিশ্বাস আছে কি না। আমরা বললাম, কেন এ প্রশ্ন করছেন? আপনার মনে কেন এ
১৯৫
প্রশ্ন জেগেছে? তিনি হেসে বললেন, এবার তাে কাউন্সিল লিস্টে যাদের নাম দেখলাম, তারা বেশির ভাগই আমার অপরিচিত। আমরাও বললাম, আমাদেরও প্রায় একই অবস্থা। অনেক কাউন্সিলরের মফস্বল থেকে কাল ও পরশু এসে পৌছার কথা। তাঁদের সঙ্গে তখনই আমাদের আলাপ হবে। তবে যেহেতু তাদের বেশির ভাগই নতুন, সেহেতু তারা কাউন্সিলে কোনাে গােলমাল করবে বলে মান হয় না, বিশেষ করে যেখানে আবদুস সেলিম, খান। বাহাদুর আওলাদ হােসেন, আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, আসাদুল্লাহ, আবদুল ওয়াসেক, সুলতানউদ্দীন, ফজলুর রহমান, রেজাই করিম প্রভৃতি গণ্যমান্য লােকজন কাউন্সিলের সদস্য রয়েছেন। এমনি হালকা আলাপ করে আমরা বিদায় নিলাম।
অফিসে ফিরে এসে আলােচনা করব ভেবেছি, তখন দেখলাম অনেক কাউন্সিলর ও বাইরের লােকজন ইতিমধ্যেই পার্টি হাউসে পৌছে গেছে। তাই স্থির হলাে ঢাকায় পার্টির আলােচনা না করে সন্ধ্যার পর নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়িতে আলােচনা বৈঠক বসবে। শওকত আলীকে বলা হলাে পার্টির সদস্যদের কানে কানে কথাটা বলে দেওয়া। আলমাসকে টেলিফোনে জানিয়ে দিলাম ব্যবস্থার কথা। খান সাহেবকে সােজাসুজি টেলিফোন না করার কারণ ছিল এই যে তার কাছে অনেক ব্যবসায়ী লােক আসত—কে সম্মুখে থাকবে বলা যায় না—হয়তাে শাহাবুদ্দীনের লােক ওখানে বসে আছে।
শামসুল হক বিকেলেই নারায়ণগঞ্জ চলে যায়—আর বাকি সব সন্ধ্যার পর ট্রেনে। ওসমান আলী সাহেবের বাড়িতে বদ্ধ দরজায় আমাদের আলােচনা শুরু হয়—বিশেষ ভূমিকা না করেই সবাইকে বলা হলাে যে আপনারা আগামী পরশু দুটোর সময় আহসান মঞ্জিলে কাউন্সিলরদের হুইপ করে নিয়ে যাবেন। আপনাদের কেবল আমাদের তিনজনকে (অর্থাৎ আমি, শামসুল হক ও শামসুদ্দীন) আগামী পরশুর নির্বাচনের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে যেতে হবে। কারণ এবারকার সংগ্রাম বাংলার মধ্যবিত্তের মরাবাঁচার সংগ্রাম। আর আমাদের প্রতিপক্ষ বহুকাল ধরে বাংলার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত, তার ওপর যার সঙ্গে বিশেষ করে লড়তে হবে, তিনি বাংলার রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি চতুর, ধূর্ত ও ধড়িবাজ রাজনীতিবিদ। তা ছাড়া তারাই সরকার—যে কাউকে যেকোনাে পুরস্কার দিয়ে আমাদের এত দিনের সংগ্রামকে বানচাল করে দিতে পারে। অর্ধঘণ্টা সভা চলেছিল—তারপর ওখানে আমরা খাওয়াদাওয়া করে সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা চলে আসি। সমস্ত রাত কাউন্সিলরদের সঙ্গে আমরা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে আলােচনা করি—বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামাের ওপরই আমি বিশেষ করে জোর দিই।
১৯৬
আমার কথা হলাে, বাংলার মুসলমান অর্থে বাংলার কৃষক—তারা ঋণের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে, ঋণ করেই কিছুদিন বেঁচে থাকে, তারপর সন্তানসন্ততিকে ঋণে জর্জরিত করে ইহলীলা পরিত্যাগ করে। তাদের পরনে কাপড় নেই, ঘরে চাল নেই, গরুর ঘর নেই—তার ওপর বছরের অর্ধেক সময় দেশ ডুবে থাকে। বর্ষায়, কোনাে কোনাে স্থানে দশ-বারাে হাত পানি উঠে গাঁয়ের বাড়িগুলােকে একেকটা দ্বীপে পরিণত করে। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, বসন্ত, আমাশয়ে গায়ের অর্ধেক লােক আক্রান্ত হয় এবং ধুকে ধুকে মরে। আমাদের দেশের নেতারা তাদের চেনে না—জানে না, চেনে কেবল গাঁয়ের টাউটদের, যারা তাদের কাছ থেকে দুপয়সা পেয়ে ভােট জোগাড় করে দেয়। তারাই দেশের নেতা—তাদের জন্য বাংলা সােনার বাংলা—আমাদের জন্য নয়। আমাদের জন্য অন্ধকার ভবিষ্যৎ-এ অবস্থার বিহিত করার জন্য জমিদার, নওয়াব, ব্রিটিশের তৈরি খেতাব পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে আজ সংঘবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে সত্যি বলতে কোনাে মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব। নেই—তাদের পেশা কেবল চাকরি। আজ যদি কৃষক সচেতন হতাে, তবে লাখ লাখ লােক এমন করে মৃত্যুবরণ করত না। জীবনপ্রদীপ নেভার আগে একবার জ্বলে উঠত। আমার পরে শামসুল হক রবুবিয়াৎ ও রব্বানিয়াৎ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বললেন যে ইসলামে মজহাব ও সিয়াসকে ভিন্ন করে দেখা যায় না। ইসলাম ধর্ম প্রত্যেক মানুষকে সম্পূর্ণ মানুষ সৃষ্টি করার জন্য, এর কোনাে অংশ বাদ দিলে মনুষ্যত্ব অপূর্ণ থেকে যাবে। সম্পত্তির ওপর কোনাে মানুষের মালিকানা নেই—মালিকানা খােদার। একজন মানুষ শুধু হতে পারে সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক। অর্থাৎ পরের প্রয়ােজনে তার কাছে গচ্ছিত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই সালাত কায়েম হয় না—সালাত কায়েম করার আগে তাঁর প্রাণ পরের জন্য উৎসর্গ করতে হবে। কিছু হাদিস থেকে তার প্রতিপাদ্য প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন। সালাত ও জাকাত কেন একই সঙ্গে কোরআনে নাজিল হয়েছে, তারও বৈজ্ঞানিক এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করলেন—এসব আদর্শের বক্তৃতায় প্রায় রাত শেষ হয়ে এলে প্রশ্ন ও উত্তর চলল—কিন্তু কারা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে, সে সম্বন্ধে কোনাে কথাই বলা হলাে না। আমরা ওটাকে শেষ মুহুর্তের জন্য রেখে দিলাম।
পরদিন আলমাছ আলীকে টেলিফোনে বলে দিলাম যে নারায়ণগঞ্জ কাউন্সিলরদের একত্র করে ২৪শে সেপ্টেম্বর সােজা আহসান মঞ্জিলে চলে আসে। মানিকগঞ্জের মছিহউদ্দীনকে (রাজা মিঞা) ২৩ তারিখ সন্ধ্যায় আসতে বলা হয়েছিল—আর বাকি সবার ২৩ তারিখে আসার কথা। সদর দক্ষিণের সদস্যরা ২২ তারিখেই এল—বিশেষ করে আবদুল ওয়াসেকের দল। ওয়াসেক কেবলই জানতে চাইল—প্রার্থীরা কে কোন পােস্টের জন্য। আমি
১৯৭
বললাম, সেটা এখনাে স্থির হয়নি। খাজা শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে আলােচনা না করে এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না। আমরা চাচ্ছিলাম, ওয়াসেক আমাদের ছেড়ে যাতে খাজা সাহেবের দুয়ারে ধরনা দেয়।
সদস্যদের খাওয়াদাওয়া ও শােবার ব্যবস্থা ঠিক হওয়ার পরে আমি বাসায় গেলাম একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য। কয়েক দিন ভালাে খাওয়া হয়নি, চিন্তায় ঘুম হয়নি—শেষ পর্যন্ত কী হবে—এই কথা ভাবতে গিয়ে। ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে যখন অফিসে গিয়ে লােকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করছি, তখন শওকত মিঞা আমাকে বলল যে রেজাই করিম সাহেব আমাকে টেলিফোনে খোজ করছিলেন। সন্ধ্যায় শওকত মিঞা পরােটা, কাবাব নিয়ে এল। তাই সবাই হইহই করে খাচ্ছি। এমন সময় রেজাই করিম সাহেব অফিসে এলেন। এবং আমাদের তিনজনকে বললেন, তাঁর বাড়িতে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে এবং তিনি আমাদের নিতে এসেছেন। আরও কিছু জরুরি আলােচনাও হবে। আমরা নিচে এসে দেখি রেজাই করিম সাহেব নিজেই তার হুড ফেলানাে সানবিম গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আমি তার পাশে বসলাম। শামসুল হক ও শামসুদ্দীন গাড়ির পেছনে বসল। গাড়ি ছেড়ে যখন তাঁর দেওয়ানবাজারের বাড়ির গেটে এসেছি, তখন সেখানে দাঁড়ানাে তিনটি গাড়ি ছেড়ে দিল। আর রেজাই করিম সাহেবের গাড়িও তাদের পেছনে চলল । আমি জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছি—উত্তরে বললেন, খাজা সাহেবের ওখানে কিছুক্ষণ আলােচনা করে আমরা ফিরে আসব খাওয়ার জন্য। খাজা সাহেবও আসবেন। আমার যেন একটু ভয় হলাে—কিডন্যাপড হচ্ছি না তাে? আগামীকাল নির্বাচন—আর আমরা তিনজনই আটকা পড়ব নাকি? খাজা সাহেব সবকিছুই করতে পারেন। কিন্তু উপায় নেই তখন আর। তাই চুপ করে থাকা ছাড়া পথ রইল না। পরিবাগে এসে দেখতে পেলাম যে আমাদের। সামনের গাড়িগুলাে থেকে নামল ডাক্তার মইজুদ্দীন, সৈয়দ আবদুস সেলিম, ফজলুর রহমান, আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, খানবাহাদুর আওলাদ হােসেন এবং আরও দু-চারজন। রেজাই করিমের সঙ্গে আমরা তিনজন ঢুকলাম। কিছুক্ষণ পরেই খাজা শাহাবুদ্দীন এলেন এবং দু-চার মিনিট কথা বলেই তাদের বললেন, আপনারা বসুন—আমাদের তিনজনকে নিয়ে তিনি পাশের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। তার চেয়ারের উল্টো দিকে আমাদের জন্য তিনখানা চেয়ার। আমাদের বসতে বললেন। আমার মনের মধ্যে যখন ঝড় বইছিল, তখন বােধ হয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। তাই আমি কিছুক্ষণ বসিনি। খাজা সাহেব বললেন, বসুন, চা আনতে বলেছি। আমার যেন সংবিৎ ফিরে এল। বসলাম। খাজা সাহেব তার খান্দানের ইতিহাসে—তাঁর নিজের জীবনের সংগ্রাম, তার ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা বলে।
১৯৮
আমাদের বােঝাতে চাইলেন যে রাজনীতি বড় কঠিন বস্তু। এর মতাে কঠিন সংগ্রাম আর নেই। রাজনীতিতে হঠাৎ ওপরে কেউ লাফ দিয়ে উঠতে পারে না। তার জন্য চাই ধৈর্য ও সহনশীলতা। আমার কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছিল যে আমরা আটকা পড়েছি। আমরা অপহৃত—কিডন্যাপড’ । বুঝলাম নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে আমাদের এখান থেকে বেরােতে দেওয়া হবে না। পরের দিন দুটোর সময় আহসান মঞ্জিলে নির্বাচন—আমাদের ওপর সম্পূর্ণ ভার পার্টি থেকে দেওয়া হয়েছে। সবাই এসে থাকবে—আমাদের নির্দেশের অপেক্ষায়। রেজাই করিম সাহেবের সঙ্গে এসেছি—সুতরাং তারা সেখানে খুঁজতে গেলেও কোনাে খবর পাবে না। অন্তত একজনকে বের করে দেওয়া আমাদের প্রথম স্ট্র্যাটেজি।
ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে পরের দিনের নির্বাচনে কাকে আমরা দাঁড় করছি। আমি বললাম, সে তাে এখনাে স্থির হয়নি—সব জায়গার কাউন্সিল সদস্যরা আজও সবাই এসে পৌছেনি। তাঁদের সঙ্গে আলাপ হবে। তারপর কমিটির সঙ্গে আলাপ হবে আপনার উপস্থিতিতে। তারপরেই একটি প্যানেল তৈরি হবে। আমরা তাে প্রার্থী নই—কারণ আমি সরকারি চাকরি করি, শামসুল হকের বাড়ি টাঙ্গাইল আর শামসুদ্দীন এখনাে ছেলেমানুষ। সুতরাং আমরা যেখানে প্রার্থী নই, সেখানে সবার মত নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করব বলেই আমরা স্থির করেছি। খাজা সাহেব বললেন, দেখুন, যেহেতু আমি প্রার্থী নই, তখন দেখা যাচ্ছে যে আমরা চারজনে মিলেই নিঃস্বার্থভাবে চিন্তা করে একটা সর্বজনগ্রাহ্য প্যানেল তৈরি করতে পারি। আমরা বললাম যে কাউন্সিলররা যে আমাদের তৈরি কর্মকর্তাদের লিস্ট মেনে নেবে তার কী প্রমাণ—খাজা সাহেব বললেন, আমি জানি যে নারায়ণগঞ্জের এক গােপন সভায় আপনাদের তিনজনের ওপর নির্বাচনের ব্যাপারে সমস্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা। হয়েছে। আমরা একটু অবাক হলাম তিনি কেমন করে এ খবর পেলেন। হতে পারে পার্টির কেউ কাউকে বিশ্বাস করে বলে ফেলেছে যে আমাদের তিনজনকেই তারা ক্ষমতা দিয়েছে, সে খবরটা খাজা সাহেবকে পৌছে দেওয়ার লােকের অভাব নেই, এমনকি সে হয়তাে আমাদের পেছনে সরকারি ইন্টেলিজেন্স লাগিয়েছে। কারণ, তিনি শুধু মন্ত্রী নন—প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাই ও একমাত্র বুদ্ধিদাতা। আমি বললাম যে আমাদের পার্টির বাইরের লােকই বেশির ভাগ কাউন্সিল সদস্য। তিনি সে কথায় কান দিলেন না।
রাত দশটা বাজে—অথচ তার মনের কথা বেরােচ্ছে না। আর খাবারের কথাও যেন ভুলে গেলেন। তখন আমি বললাম, আপনি তাদের জেলা লীগের কর্মকর্তা করতে ইচ্ছা করেন। এবার তিনি আর এক দফা ভূমিকা আরম্ভ করলেন। তিনি বললেন, আপনি গতকাল পার্টি অফিসে বক্তৃতায় তাে জমিদার
১৯৯
ও নবাবদের বিরুদ্ধে সবাইকে একজোট হওয়ার জন্য বলেছেন—সেখানে নবাববাড়ির কারও নাম বলতে দ্বিধাবােধ করছি—তবে আপনারা যদি রাজি হন তবে আমার প্রস্তাব যে সৈয়দ আবদুস সেলিমকে সভাপতি করা যায়—সে যদিও আমার খালাতাে ভাই এবং তার মা নবাব আহসানউল্লাহর মেয়ে, কিন্তু তার বাবা ছিলেন খাটি বাঙালি—মানিকগঞ্জের সৈয়দ আবিজুল্লাহ সাহেব। তার বড় ভাই মরহুম সৈয়দ আবদুল হাফিজও ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির ভক্ত। সুতরাং তিনি যেমন আপনাদের, তেমনি আমাদের দলের লােক এবং দুদলের একমাত্র গ্রহণযােগ্য লােক বলে আমি মনে করি। আমি বললাম, কিন্তু তিনিও তাে আজকাল বেশির ভাগই কলকাতা থাকেন—সুতরাং জেলার কাজে তিনি কি কোনাে সাহায্য করতে পারবেন? এত যে হাজার হাজার লােক মারা গেল বিগত কয়েক মাস ধরে অনাহারে, গুটি বসন্তে, আপনারা ঢাকায় থাকলে অন্তত কিছুসংখ্যক লােককে তাে বাঁচানাের চেষ্টা করা যেত—মৃত্যুর হার এখনাে কি গ্রামে কম? এখনাে লঙ্গরখানায়, অকজিলিয়ারি হাসপাতালে, ভ্যাগর্যান্টস হােমে লােক অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের পাশে যদি আজ মুসলিম লীগ না দাঁড়ায় তবে কি আগামী নির্বাচনে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে আমরা কথা বলতে পারব? তিনি বললেন, দেখুন আমার নিজের ধারণা—নারায়ণগঞ্জ থেকে যারা কাউন্সিল সদস্য হয়ে এসেছে, তাঁদের বেশির ভাগ রহিমাবাদ, রায়পুরা, মনােহরদীর চালাকচরের কমিউনিস্ট। এই বলে দেরাজ থেকে সেলিমের লেখা একখানা রিপাের্ট বের করে পড়তে থাকলেন। লম্বা রিপাের্টে আমাদের সবাইকে কমিউনিস্ট ও বেইমান বলা হয়েছে। খাজা সাহেব বললেন যে এ ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ-মানিকগঞ্জ সব জায়গা থেকেই রিপাের্ট এসেছে যে কোথাও কোনাে আইনানুগ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং এমতাবস্থায় আমার আগামীকালের নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এরপর আর কথা চলে না। বললাম, ঠিক আছে সেলিম সাহেবকে সভাপতি করলেই যদি আপনি খুশি হন—তবে সেলিম সাহেবকে আমরা গ্রহণ করতে রাজি আছি। তার প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম তিনি প্রস্তাব করলেন—ফজলুর রহমান সাহেবের নাম—যুক্তি দিলেন, একসময় আপনারা তাঁর সঙ্গেই কাজ করেছেন—তাঁর সংগঠন শক্তি সম্বন্ধে আপনারা ওয়াকিবহাল—তিনি নিজের চেষ্টায় আজ চিফ হুইপ হয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সে তাে আবার আপনার আত্মীয়।
এবার আমি বললাম যে আমাদের একজনের অন্তত অফিসে যাওয়া দরকার। কারণ, আমরা রাত এগারােটা পর্যন্ত ফিরছি না দেখে পার্টি অফিসের লােকজন নিশ্চয়ই আমাদের খোঁজাখুঁজি করছে—তারা জানে আমরা রেজাই করিম সাহেবের ওখানে খেতে গেছি—ওখানে গিয়ে যখন দেখেছে আমরা
২০০
ওখানে নেই এবং তার বাসারও কেউ হদিস দিতে পারে না, তখন ভয় পেয়ে হয়তাে থানা-পুলিশ করবে—ভাববে আমাদের হয়তােবা খুন করে ফেলা। হয়েছে। কে জানে। একজন অন্তত গিয়ে বলুক যে আমরা আগামীকাল নির্বাচনের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলােচনা করতে এসেছি এবং আলােচনা অনেকক্ষণ চলবে। আমরা কর্মকর্তাদের সবার গ্রহণযােগ্য একটা তালিকা তৈরি করতে পারলেই অফিসে চলে আসব। খাজা সাহেব যেন কী ভাবলেন। আমি আবার বললাম, আপনার যে দুজনকে খুশি রাখতে পারেন। অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন—আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন যে। আমরা কোনাে চাতুরী খেলছি কি না। অনেকক্ষণ পরে বললেন, আচ্ছা। শামসুদ্দীন যেতে পারে। তিনি কেবল বললেন যে তাঁকে বলে দিন তিনি যেন। আমাদের আলােচনা সম্বন্ধে সেখানে কোনাে কথা না বলেন। আমরা তাকে। তাই বললাম। শামসুদ্দীন রাজি হয়ে চলে গেল। এবার রইলাম আমি ও শামসুল হক। শামসুল হকের শরীরের উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছিল, মাথাব্যথা করছিল—তবু আমি তার নাম বললাম না পাছে শাহাবুদ্দীন সাহেব কোনাে সন্দেহ করেন।
তারপর আবার আলােচনা শুরু হলাে। আমি বললাম, আমরা দুজনেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি এবং তার ওপর আমাদের শ্রদ্ধাও আছে। অসুবিধা দুটো—প্রথমত, তিনি চিফ হুইপ, দ্বিতীয়ত, তিনি বক্তাও নন এবং জনগণের সঙ্গে তার কোনাে দিনই যােগাযােগ ছিল না—কিন্তু বিপদের দিনে। জনগণই দুটো কথা শুনতে চায় নেতাদের মুখ থেকে। খাজা সাহেব বললেন। যে আপনারা তাঁর মারফত যে সাহায্য আনতে পারবেন, তা নিজেরা চেষ্টা করে পাবেন না, এমনকি সেলিম সাহেবের মারফতও না। নানা বিতর্কের পর তাঁর নাম গৃহীত হলাে—এমনি করে ডাক্তার মইজুদ্দীন, সুলতানউদ্দীন, খানবাহাদুর আওলাদ হােসেন, আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী প্রত্যেকের ব্যাপারেই আমরা আপত্তি করি, পরে তার যুক্তি মেনে নিই। সম্পাদক হিসেবে আসাদুল্লাহর নামটা নিয়ে আমরা কোনাে আপত্তি করিনি। তারপর এল কমিটি সদস্যদের নাম—সেখানেও আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি, যখন তাঁদের নাম শেষ হলাে অর্থাৎ খাজা সাহেবের লিস্টই আমাদের মেনে নিতে হলাে, তখন ভাের হয়েছে। পাখির ডাক শুনতে পেয়ে আমি বললাম, শামসুল হকের ভীষণ জ্বর উঠেছে। সত্যি শামসুল হক ভীষণভাবে কাঁপছিল—মনে হচ্ছিল ম্যালেরিয়া ধরেছে। খাজা সাহেব নিজে হাত দিয়ে দেখে বললেন, তাই তাে, আমার গাড়ি না হয় আপনাদের দিয়ে আসবে। আমি বললাম, সভায় সভাপতিত্ব কে করবে তা তাে কিছু বললেন না। তিনি কিছু না ভেবেই বললেন, কেন, রেজাই করিম। অথচ কর্মকর্তাদের যে তালিকা প্রণীত হলাে,
২০১
তার মধ্যে রেজাই করিমের নাম নেই। সভাপতিত্ব করবেন অথচ ওয়ার্কিং কমিটিতে তার নামটাও থাকবে না, এটা কি বিসদৃশ দেখাবে না? তার উত্তরে তিনি বললেন যে না তাকে আমরা প্রাদেশিক কাউন্সিলের সদস্য করে নেব এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে নিয়ে নেওয়া হবে। রেজাই। করিম সাহেব ইতিমধ্যেই কলকাতাকে তার কর্মক্ষেত্র করার জন্য কলকাতাব্রিটিশ-ইন্ডিয়া রােডে একখানা বাড়ি ভাড়া করেছেন।
আমরা উঠব এমন সময় তিনি বললেন, আপনারা দুজনে এই প্যানেলটি সই করে দিয়ে যান। আমরা বললাম, কাউন্সিলরদের না বুঝিয়ে ‘প্যানেলে সই করলে হয়তাে তাঁরা প্যানেল মানবে না। তিনি বললেন, আপনারা যদি সই না করেন, তবে আমি আগামীকালের নির্বাচন বন্ধ করে দেব। কী আর করি, সই করলাম দুজনেই। তারপর যখন পার্টি হাউসে এলাম, তখন শামসুল হকের খুব জ্বর। ডাক্তার ডাকা হলাে। তাঁকে আহসান মঞ্জিলে দুটোর সময় নিতেই হবে। পার্টির লােকদের বলে দিলাম যে শামসুদ্দীন যে প্যানেল প্রস্তাব করবে, সেইটে আমাদের । শামসুল হক যে প্যানেল প্রস্তাব করবে, সেটা খাজা সাহেবের প্যানেল। এ সম্বন্ধে আর কোনাে আলােচনা হবে না নির্বাচনের আগে। পরে সবাইকে সব জানানাে হবে।
বেলা পৌনে দুইটার সময় শামসুল হককে বহু কষ্টে গাড়িতে তােলা হলাে। আমরা সবাই আহসান মঞ্জিলে উপস্থিত হলাম। কোরআন তিলাওয়াতের পর দুটোর সময় সভা আরম্ভ হলাে।
এর আগে সকালবেলা অফিসে ফিরেই আমি প্রথম গেলাম কফিলুদ্দিন চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে। তাঁকে অনুরােধ করলাম, আপনি আজকের সভায় সভাপতিত্ব করবেন। কারণ, আমরা রেজাই করিম সাহেবের ওপর আর আস্থা রাখতে পারি না।’ তিনি বললেন, আপনারা যখন রেজাই করিমের নাম স্বীকার করে এসেছেন, তখন আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি না। বিশেষ করে সে আমার বহুদিনের বন্ধু । আমি নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। হঠাৎ মনে পড়ল এটি মােজহারুল হকের নাম। তিনি অ্যাডভােকেট। একসময় রেজাই করিম। সাহেবের বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন; কিন্তু ইদানীং বার্মা ইভাকুইজের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মনােমালিন্য চলছে। তাই তাঁর নিকট গেলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হলেন। শামসুদ্দীনকে সেটা জানিয়ে দেওয়া হলাে।
খাজা শাহাবুদ্দীন সেলিম সাহেবকে তাঁর লিখিত সেক্রেটারি রিপাের্ট পাঠ করার জন্য দিলেন এবং তার সাইক্লোস্টাইল কপি সবাইকে দেওয়া হলাে। তার মধ্যে বিশেষ করে আমাদের পার্টি হাউসের এবং খাস করে সংগঠনের কাজে আমাদের তিনজনের প্রশংসা করা হয়েছিল। তারপর খাজা শাহাবুদ্দীনের বক্তৃতাও পড়া হলাে। তাঁর বক্তৃতাও সাইক্লোস্টাইল করে বিলি
২০২
করা হলাে। তিনিও আমাদের ধৈর্য, সহ্য, পরিশ্রম ও বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। তারপর তিনি উঠে গেলেন আসন ছেড়ে নতুন সভাপতির জন্য। রেজাই করিম সাহেবের নামটা বললেন। শামসুল হক দাঁড়িয়ে রেজাই করিম সাহেবের নাম প্রস্তাব করেন। তৎক্ষণাৎ শামসুদ্দীন এ টি মােজহারুল হকের নাম প্রস্তাব করেন। শামসুল হকের প্রস্তাবের ওপর পঁয়ত্রিশ ভােট আর শামসুদ্দীনের প্রস্তাবের ওপর পড়ল দেড় শর ওপরে ভােট। ফজলুর রহমান আমার সম্মুখে এসে চিৎকার করে শাহাবুদ্দীনকে বললেন, ‘We are betrayed. শাহাবুদ্দীন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্যানেলের প্রস্তাবে অবস্থা একই রকম হলাে, শামসুল হকের প্রস্তাবের প্যানেল হেরে গেল। আর শামসুদ্দীনের প্রস্তাব বিপুল ভােটে গৃহীত হলাে। মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’ দিয়ে আমরা মিছিল করে বেরিয়ে এলাম। আহসান মঞ্জিলের ঘর থেকে রাজনীতির বিদায় সমাপ্ত হলাে ১৯৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
রাতে নতুন সভাপতি খান বাহাদুর আওলাদ হােসেনের বাসা থেকে আবুল হাশিম সাহেবকে খবরটি দেওয়ামাত্র তিনি বললেন, খােদাকে অশেষ ধন্যবাদ। আমাদের তিনজনকে কলকাতা যাওয়ার জন্য বললেন যত সত্বর সম্ভব। এরপর যে আমার ওপর একটা বিপদ নেমে আসতে পারে, তাই মনে করে আমি ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপালের মারফত শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের কাছে চাকরিতে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দিলাম। কারণ তা নইলে সরকারি চাকরি করে কেন রাজনীতি করি তার জন্য আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ (চার্জশিট) তৈরি হবে এবং হয়তাে আমাকে বরখাস্ত করবে। যদিও মুসলিম লীগ সরকার জানত যে সরকারি চাকুরেরা শতকরা পঁচানব্বই জন পেছন থেকে লীগের কাজকর্ম করেন। যেমন করতেন বেশির ভাগ হিন্দু কর্মচারী কংগ্রেসের।
কলকাতায় দিন দুই পরেই পৌছালাম। আমার স্ত্রী, দুটো সন্তান, তাদের কী হবে সেটা আমার মনে একবারও আসেনি। কী একটা নেশায় যেন পেয়ে বসেছিল । খাজা সাহেবদের এত দিনের নেতৃত্বকে সমাধিস্থ করতে পেরে আনন্দের সঙ্গে বিগত জীবনের অনেক কথাই মনে এল। আমার রাজনৈতিক আদর্শে যিনি প্রথম প্রেরণা জুগিয়েছিলেন, সেই সৈয়দ আবুল হােসেন এমএএমএল সাহেবের অপমানের প্রতিশােধ, কাজী আবদুল অদুদের জামাতা আমার বন্ধু শামসুল হুদা সাহেবের ওপর অত্যাচার ও দৈহিক নির্যাতন, শহীদ নজীরের মাথা ফাটানাে, ছাত্রদের ওপর গুন্ডাদের হামলা, সুলতানউদ্দীন সাহেবকে উচ্চ পরিষদে মুসলিম লীগের টিকিট দিয়ে তা বাতিল করার আগে খাজা শাহাবুদ্দীনের গালিগালাজ, নির্বাচনের আগে আমাদের সমস্ত রাত আটকে রাখা। মনে হলাে ঢাকার মধ্যবিত্তের ওপর আর তাদের কর্তৃত্ব চলবে । ওপরের রাজনীতিও যাতে না করতে পারে, তারই প্রচেষ্টা চালানােও যেন
২০৩
আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। কলকাতা গিয়ে দেখলাম অমৃতবাজার-এ বিরাট হেডলাইন খাজা নাজিমুদ্দিনের পরাজয়’—অন্যান্য কাগজে দেখলাম আহসান মঞ্জিলের নেতৃত্বের অবসান। শিয়ালদহ স্টেশনে খবরের কাগজের রিপাের্টাররা ভিড় করে আছেন আমাদের আসার কথা শুনে। তাঁদের বললাম যে আবুল হাশিম সাহেব প্রেস কনফারেন্সে আপনাদের যা বলার তা বলবেন, আমরা এসেছি তার কাছে সমস্ত ঘটনা বলতে। তবে আমরা দেশবন্ধু, শেরেবাংলা বা নেতাজির মতাে দল ছাড়ব না যদি আমরা আগামী নভেম্বরে প্রাদেশিক নির্বাচনে হেরেও যাই। এ সংগঠন একদিন জনসাধারণের আয়ত্তে আসবে। তার সঙ্গে আসবে পরিষদ। কেন্দ্রীয় সংগঠন অন্যান্য প্রদেশের ওপর নির্ভর করবে, তারা কতটা প্রগতির পথে চলবে। রহমান
কলকাতার প্রগতিবাদী যুবক নেতাদের সঙ্গে দেখা হলাে—তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, জহীরুদ্দীন, নুরুদ্দীন, আবদুল জলিল, মােয়াজ্জেম, শাহ আবদুল বারী, মাহবুব আনােয়ার, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল হাকিম, শফিকুল ইসলাম, সালেহ আহমদ, রাজশাহীর আতাউর রহমান, শাহ আবদুল বারী, দবীরুল ইসলাম, আবদুল হাই, মাহবুবুল হকসহ আরও অনেকেই। সবার কথা এখন আর মনে নেই। বায়রনের কথা মনে পড়ল I woke up one mornig and found myself famous.’
৩ নম্বর ওয়েলেসলিতে মুসলিম লীগ অফিসে একদিন ফজলুর রহমান সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি অন্যদিকে চলে যেতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনি আমাকে ডেকে বলে দিলেন যে তিনি ঢাকায় নতুন ছাত্রনেতা তৈরি করে আমাদের কোণঠাসা করবেনই। এর কিছুদিন পরেই ঢাকায় এসে দেখলাম চারজন নেতা কমিউনিস্টদের মুণ্ডুপাত করছেন—আর ১৫০ নম্বর মােগলটুলী পার্টি হাউসকে কমিউনিস্টদের গুহা বলে ঢাকায় বক্তৃতা করছেন। বিশেষ করে মিলাদ মাহফিলে। তাঁরা হলেন শাহ আজিজুর রহমান—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খােন্দকার মােশতাক সাহেবের সহপাঠী, আবদুস সালেক, ইব্রাহিম, আলাউদ্দিন। শাহ আজিজুর রহমান সাহেবের পিতা আমার শিক্ষক ছিলেন। ইব্রাহিমের বাড়ি নােয়াখালী কিন্তু তার মা আমাদের দেশের এবং ওয়াসেক সাহেবের আত্মীয়। আবদুস সালেকের বাড়ি চট্টগ্রাম আর আলাউদ্দীন আমাদের ঢাকা শহরেরই ছেলে। আমার যেকোনাে সভায় তারা গােলমাল করার জন্য প্রস্তুত থাকত। মুন্সিগঞ্জে মােক্তারবারের এক সভায় গােলমাল করার জন্য উপস্থিত হলে একটি যুবক তখন ছাত্র কি না জানি না—সে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। পরিচয় হলাে সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে কোরবান আলী সাহেবের। ফজলুল কাদের চৌধুরীকে আগে থেকেই চিনতাম আমার ছােট ভাইয়ের সহপাঠী। বরিশালে তারা একত্রে পড়ত।
২০৪
দলীয় নেতারা-কর্মীদের নিয়ে আবুল হাশিম সাহেব বেরিয়ে পড়লেন লম্বা টুরে। নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বার্ষিক সভায় কর্মকর্তা নির্বাচিত হবে। ইতিমধ্যেই মুসলিম লীগের মধ্যে আকরম খাঁ ও স্যার নাজিমুদ্দিনের দলের দক্ষিণপন্থীদের ভিড়। তার বিরুদ্ধে আবুল হাশিম। সাহেবের দল প্রতিযােগিতার জন্য দেশময় অভিযান চালিয়েছে। শহীদ সাহেব নিজেকে দুটো দলের উর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আবুল হাশিম সাহেবের বিরুদ্ধে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা হচ্ছেন সর্বজনাব ফজলুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিঞা), আবদুস সবুর খান, ডাক্তার আবদুল মােত্তালিব মালিক, মওলানা আবদুল্লাহিল-বাকী, খাজা শাহাবুদ্দীন প্রভৃতি। আর আবুল হাশিম সাহেবের দলে থাকলেন কেবল নাম না জানা কর্মীরা। নাজিমুদ্দিন অতঃপর সােহরাওয়ার্দীকে দলে টানার চেষ্টা করলেন। তারা শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন যে আবুল হাশিম কমিউনিস্ট, তাঁর ভাগনেরা সবই কমিউনিস্ট, সুতরাং গতবারে আমাদের ভুল হয়েছে তাঁকে জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচন করে। ঢাকা পার্টি হাউস সর্বক্ষণ। কর্মী দ্বারা ভর্তি। তাদের দিয়ে আবুল হাশিম মুসলিম লীগের কাজ করান—তাঁরা তাঁদের মতবাদ স্বাধীনভাবে প্রচার করে, প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতাদের বিরােধিতা করে করে গায়ে-গ্রামে ‘সেল’ গঠন—এসব থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে সে কাদের স্বার্থে কাজ করছে। ইসলামকে সে ব্যবহার করছে মুসলিম লীগ প্ল্যাটফর্ম’কে নিজেদের জন্য ব্যবহার করতে। তাঁর ইসলামের ব্যাখ্যা কার্ল মার্ক্সের কাছ থেকে ধার করা। ইবনে খালদুন ছাড়া অন্য কোনাে মুসলমানের লেখা তাঁর কর্মীরা পড়ে না। তারা বললেন, ডাক্তার মালিক একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা—সে বহুদিন মেহনতি শ্রমিকের জন্য কাজ করছে, তার নাম প্রস্তাব করলে সকল যুবক কাউন্সিল সদস্যের কাছেই প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য হবে। ১৯৩৮ সালে আফতাব আলীকে শ্রমিক আন্দোলনে কোণঠাসা করার জন্য শহীদ সাহেব ডাক্তার মালিককে নিযুক্ত করেছিলেন। তাই শহীদ সাহেবের কাছে তিনি বিশ্বস্ত লােক। শহীদ সাহেব জালে পড়লেন এবং নেতাদের মধ্যে একটা আপস-নিষ্পত্তি হয়ে গেল। নভেম্বরের ১৬ তারিখে এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন কর্মীরা, যদিও আবুল হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সবাই যদি সে একমত হয়, তবে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
খবর যখন ছড়িয়ে পড়ল, তখন কর্মীরা বিক্ষোভ আরম্ভ করলেন। আন্দোলনে বিশেষ করে নেতৃত্ব দেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান ও নূরুদ্দীন। সেদিনই আমি প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনি, যদিও আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আরও দুমাস আগে। এ বিক্ষোভের ফলে
২০৫
পূর্ব রাতের ষড়যন্ত্র ভেঙে যায় এবং আবুল হাশিম সাহেব আবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নবীন নেতাদের পক্ষে এটা একটা মস্ত বড় বিজয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল নেতারা আঘাত খেলেন বটে, কিন্তু পর্যদস্ত হলেন না। কারণ, প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটিতে স্যার নাজিমুদ্দিন ও আকরম খাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে গেল—তার কারণ নতুন নেতা কোনাে কোনাে জেলায়। তাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে থাকলেও প্রাদেশিক নেতৃত্ব দাবি করার মতাে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। যাই হােক, আমরা খুশি মনে ঢাকায় ফিরলাম।
ডিসেম্বর মাসে আবুল হাশিম সাহেব একটি ম্যানিফেস্টোর খসড়া প্রস্তুত করেন। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে সেটা পুস্তকাকারে তিনি প্রকাশ করেন। প্রতিক্রিয়াশীল দলের পক্ষে এটি একটি হাতিয়ার হলাে। তারা এবার আরও একটি স্পষ্ট প্রমাণ পেলেন যে আবুল হাশিম সাহেব কমিউনিস্ট। সত্যি কথা বলতে এ ধরনের ম্যানিফেস্টো কমিউনিস্ট পার্টির আবিষ্কার। ম্যানিফেস্টো শব্দটির মধ্যেও কমিউনিজমের গন্ধ পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে ঢাকায় পার্টির সদস্যদের জন্য আমার The way out স্বনামে প্রকাশিত হলাে। বইখানা পড়ে আর কারও সন্দেহ রইল না যে আমাদের পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির অনুকরণে তৈরি। প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটি সেই খসড়া ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করল না।
ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ কনফারেন্স করার সিদ্ধান্ত করা হলাে এবং জেলা লীগের সম্পাদক শামসুদ্দীনের ওপর ভার দেওয়া হলাে স্থান মনােনয়ন করার জন্য। শামসুদ্দীনের মত হচ্ছে সৈয়দ আবদুস সেলিমের প্রভাব যেখানে বেশি, সেখানেই আমাদের আঘাত হানতে হবে। দুটো স্থানের কথা শামসুদ্দীন উল্লেখ করল, একটি রায়পুরা থানায় রহিমাবাদ, অন্যটি মনােহরদী থানার চালাকচর। দুটোই কৃষক সমিতির ঘাঁটি। সেলিম সাহেব তার নির্বাচনী এলাকায় বেশ শক্তিশালী—সুতরাং শামসুদ্দীন কৃষক সমিতির সাহায্য নিয়ে সেলিমের বিরুদ্ধে জয়েন্ট ফ্রন্ট করার পক্ষপাতী। শেষ পর্যন্ত স্থির হলাে যে চালাকচরেই অধিবেশন হবে। আবুল হাশিম সাহেব প্রধান বক্তা।
চালাকচরের কৃষক সমিতির নেতা ছিলেন কমরেড অন্নদা পাল। একসময় ছিলেন সন্ত্রাসবাদী দলে। ধনী ও তালুকদার বংশের ছেলে হয়ে জন্মেছিলেন । পাকিস্তান হওয়ার পর সন্ত্রাসবাদ ছেড়ে কৃষক সমিতির নেতা হয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। সেলিম সাহেবও পান্ডাদের নিয়ে কনফারেন্স ভাঙবার ব্যবস্থা করতে মনস্থ করলেন। শামসুদ্দীন এবং অন্নদা পালও তাদের লােকজনকে প্রস্তুত রাখলেন। ফলে কনফারেন্সে তুমুল মারামারি হবে, এটা আমরা সবাই আশা করেছিলাম। আবুল হাশিম সাহেব চালাকচরে পৌছার আগেই বেশ মারামারি হয়ে গেছে—সেলিমের দল অন্নদা পাল ও শামসুদ্দীনের দলের সঙ্গে মারামারিতে এঁটে উঠতে না পেরে সেলিম
২০৬
সাহেব তার দলবল নিয়ে চালাকচর ছেড়ে গেলেন। অন্নদা বাবু ও শামসুদ্দীনসহ আরও অনেকে আহত হয়েছিলেন। অধিবেশন চলাকালীন আর গােলমাল হয়নি।
১৯৪৪ সালের বার্ষিক অধিবেশনে আমাদের যে দুর্বলতার দিক দেখা গেল সেটা হলাে দলে যথেষ্ট অভিজ্ঞ পুরােনাে রাজনীতিবিদের অভাব। এ দুর্বলতা ঢাকার জন্য স্থির হলাে যেসব পুরােনাে মুসলমান নেতা বহুদিন ধরে কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা পার্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের মুসলিম লীগের সদস্য করতে পারলে আমাদের সে দুর্বলতা আর থাকবে না। তাই মাওলানা আবদুল্লাহ-হিল-বাকী, আশ্রাফউদ্দীন চৌধুরী, নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী, আবুল মনসুর আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ প্রমুখ নেতাকে আমন্ত্রণ জানানাে হলাে। যারা এলেন, তাঁরা হলেন আবুল মনসুর আহমদ, মাওলানা আবদুল্লাহ-হিল-বাকী, শামসুদ্দীন আহমদ, নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী। হুমায়ুন কবির, আশ্রাফউদ্দীন চৌধুরী প্রভৃতি কংগ্রেসে যােগ দিলেন। কিন্তু আমরা তাদের কাছ থেকে যে আশা করেছিলাম, তা হয়নি। নেতারা নেতাদের সঙ্গেই মিলে গেলেন—কেউ শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দলে, কেউ আকরম খাঁর দলে ভিড়ে গেলেন।
এদিকে বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটল ইউরােপে। জার্মানি পরাজয় মেনে নিল। হিটলার আত্মহত্যা করল। আইসেনহাওয়ারের নেতৃত্বে ইংলিশ চ্যানেলের মহাদেশের উপকূলে যে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খােলা হয়েছিল, জার্মানি তাদের ঠেকাতে পারল না। পূর্ব দিকে রুশ সৈন্যও এগিয়ে আসতে লাগল । স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের পর সমস্ত যুদ্ধের মােড় ঘুরে গেল—জার্মান সৈন্যরা বরফে বাঁধা পড়ল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলাে নেপােলিয়ান বােনাপার্টকে যে কারণে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল, হিটলারের অদৃষ্টেও তাই ঘটল। তার বিখ্যাত প্যাঞ্জার ডিভিশন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। একই সময়ে পশ্চিমা শক্তিসমূহ ও রুশ বাহিনী বার্লিনে প্রবেশ করে শহরটাকে ভাগ করে নিল–পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন। নাৎসিবাদের অবসান হলাে। অর্ধযুগের যুদ্ধে ১৯৪৫ সালের মে মাসে কেবল জার্মানিই পরাজিত হলাে তাই নয়, ইউরােপের যেসব শক্তি বিজয়ী হলাে, তারা এমন গুরুতরভাবে আহত হলাে যে তাদের কারও পক্ষে আর তাদের কলােনি বা সাম্রাজ্য রক্ষা করা সম্ভব হলাে না। ইউরােপের এত দিনের নেতৃত্ব গেল মার্কিন মুলুকের নিকট। জাপান কিন্তু অত সহজে পরাজয় স্বীকার করল না। আমরা বহুদিন ধরে শুনে আসছিলাম যে জার্মানি এক ভীষণ মারণাস্ত্র তৈরি করছে—কেউ বলল জার্মানির নতুন আবিষ্কার ডেথ রে (Death Ray) থেকে আলাে যেখানে বিচ্ছুরিত হবে সেখানকার সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল সে অস্ত্র হিটলারের বৈজ্ঞানিকেরা
২০৭
তৈরি করার আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। এটা কি ইহুদি বিতাড়নের ফল? কে জানে। আমাদের অবাক করে দিয়ে প্রকাশ হলাে যে মার্কিন বৈজ্ঞানিকেরা ‘অ্যাটম বােমা’ আবিষ্কার করেছেন। সত্যিই জাপানের হিরােশিমা এবং নাগাসাকি শহরে ১৯৪৫ সালের ৫ আগস্ট ও ৯ আগস্ট ‘অ্যাটম বােমা’ অনেক উঁচু বিমান থেকে ফেলা হলাে—দুটি শহর ছারখার হয়ে গেল—কী নিষ্ঠুর যে সেই মৃত্যু! ওই বােমা তাে জার্মানির ওপর ফেলা হয়নি। কারণ, বােধ হয় শত অপরাধ করলেও তারা শ্বেতাঙ্গ। ধ্বংসলীলা এমন ভয়ংকর হয়েছিল, যে মার্কিন পাইলট ওই বােমা ফেলেছিল, সে নিজের কৃতকর্ম ও ধ্বংসলীলা দেখে নিজেই উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। এরপর জাপানের পরাজয় স্বীকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছিল—১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাপান আত্মসমর্পণ করল মিত্রশক্তির কাছে। পার্ল হারবারের প্রতিশােধ ভয়ানক নিষ্ঠুরভাবেই আমেরিকা গ্রহণ করল এবং জাপানকে মােটামুটিভাবে আমেরিকা তার কলােনিতে পরিণত করল।
১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে চার্চিল ব্যক্তিগতভাবে বিপুল ভােটাধিক্যে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দিলেও শ্রমিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠ লাভ করে এবং ক্লেমেন্ট এটলি ব্রিটেনে সরকার গঠন করেন। এটা মুসলিম লীগের জন্য বিপদ হয়ে দাড়ায়। কারণ, ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বহু সদস্য বহুকাল যাবৎ ভারত ও কংগ্রেসের নেতাদের বন্ধু ছিল—জওহরলাল নেহরু, কৃষ্ণমেনন প্রভৃতি অনেক রাজনীতিবিদের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন তাঁরা। গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু এবং ভারতের অন্য মনীষীদের প্রতি তাদের বেশ শ্রদ্ধা ছিল, যে সুবিধাটা পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাদের ছিল না।
ঢাকায় প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম শেষ হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানও তার জেলার প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের যেমন ইউসুফ আলী চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান, আবদুস সালাম খান তাদের নেতৃত্বের অবসান ঘটানাের প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফরিদপুরে তাঁর নিজস্ব থানা গােপালগঞ্জে এক কনফারেন্স ডাকেন এবং হােসেন সােহরাওয়ার্দীকে সভাপতিত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। গােপালগঞ্জের আবদুস সালাম খানের দলের সঙ্গে তাঁর দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গােপালগঞ্জ থানার হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই খুব সাহসী। এমনকি অন্যান্য জেলার জমিদারেরাও চর দখল, ডিক্রি জারি দখল ইত্যাদি ব্যাপারে গােপালগঞ্জ থেকে নমশূদ্র সরদার ভাড়া করে আনত। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেকে জমি জোর-দখলের জন্য সেখান থেকে ওইসব সরদারের সাহায্য চাইত। এমতাবস্থায় দুই দলেরই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মিছিল করে আসা স্বাভাবিক
২০৮
ছিল এবং যথেষ্ট পুলিশের প্রয়ােজন হয়ে পড়ত তাদের শান্ত রাখার জন্য। সে সভায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সে সভায় এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে আবদুস সালাম খানের চেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান গােপালগঞ্জে বেশি শক্তিশালী।
গােড়াতে আমরা ভেবেছিলাম যে প্রদেশের পার্লামেন্টারি বাের্ডের সদস্য কাউন্সিলরদের ভােটেই হবে, কিন্তু জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান এমন ব্যবস্থা করতে চাইলেন, যাতে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং অবাঙালি ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব বাংলাদেশে বজায় থাকে। তাদের সিদ্ধান্ত হলাে যে মুসলিম লীগের সভাপতি এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা পদাধিকারবলে বাের্ডের সদস্য হবেন। অর্থাৎ মাওলানা আকরম খাঁ ও খাজা নাজিমুদ্দিন নির্বাচনের সম্মুখীন না হয়েই বাের্ডে এসে গেলেন। তারপর স্থির হলাে যে মুসলিম লীগের সদস্যের নিম্ন পরিষদ ও উচ্চ পরিষদ থেকে ওই দুই পরিষদের সদস্যরা দুজন নির্বাচন করবেন। অর্থাৎ ওই দুজনই হবে খাজা নাজিমুদ্দিনের মনােনীত ব্যক্তি। নেতা হিসেবে মনােনয়ন দেওয়ার ক্ষমতা তারই আর তার মনােনীত প্রার্থীকে ভােট না দিলে বা কেউ তার মনােনীত প্রার্থীর বিরােধিতা করলে পরিষদ নেতার ওপরে অনাস্থা প্রকাশ পাবে, তাই এ ব্যবস্থায়ও সে দলের লােককে বাের্ডে আনার ব্যবস্থা হলাে। উচ্চ পরিষদে প্রার্থী হলেন খানবাহাদুর আবদুল মােমেন ও খানবাহাদুর নূরুল আমীন আর নিম্ন পরিষদের প্রার্থী হলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও ফজলুর রহমান। খাজা সাহেব মনােনীত করলেন নূরুল আমীন ও ফজলুর রহমানকে। ফলে খানবাহাদুর মােমেন ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগ সদস্যদের পার্টি মিটিংয়ে যার যার বিবৃতি দিয়ে বের হয়ে এলেন। সাকল্যে নয়জন বাের্ড সদস্য হবেন, তন্মধ্যে বাের্ডে প্রতিক্রিয়াশীল দল কেন্দ্রীয় ফয়সালায় চারজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চলে এলেন। তাঁদের প্রয়ােজন ছিল মােটে একটি আসনে জেতা।
এ অপমান ও পরাজয় শহীদ সাহেবকে সত্যি খুব বিপদাপন্ন অবস্থায় ফেলল। কারণ, দক্ষিণ ও বামপন্থীদের এ সংগ্রামে তিনি নিজেকে না জড়ানাের চেষ্টা করেছেন। ফলে আবুল হাশিম যে তাঁকে পাঁচজনের মধ্যে স্থান দেবেন— আর দিলেও যে আবুল হাশিমের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে, অন্তর দিয়ে তিনি তা বিশ্বাস করতে পারেননি। এখন খাজা নাজিমুদ্দিন, যাকে পটুয়াখালীতে শেরেবাংলার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পর্যুদস্ত হওয়ার পর নিজের আসনই কেবল ছেড়ে দেননি, শেরেবাংলা যেন আবার যাতে তাঁর বিরুদ্ধে না দাড়ান, তার জন্য সে নির্বাচন কেন্দ্রকে প্রস্তুত রেখেছিলেন, সে নাজিমুদ্দিনই যখন তাঁকে মনােনীত করলেন না, তখন তাঁর আর আবুল হাশিমের দলে যােগ দেওয়া ছাড়া পথ ছিল না। অনেক কথার পর আবুল হাশিমের দলের মনােনীত ব্যক্তির নাম ঘােষিত হলাে। দলের প্রার্থীরা ছিলেন :১. শহীদ সােহরাওয়ার্দী,
২০৯
২. আহমদ হুসেন, ৩. মােয়াজ্জেম হােসেন চৌধুরী (লাল মিঞা), ৪. আল্লামা রাগিব আহসান ও ৫. আবুল হাশিম। প্রার্থীদের নাম ঘােষিত হওয়ার পর নাজিমুদ্দিন সাহেবরাও পাঁচজনের নাম ঘােষণা করলেন—তার মধ্যে শহীদ সাহেব একজন। এ নিয়ে আবুল হাশিমের দলের মধ্যে সন্দেহ জাগল। শহীদ সাহেব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন যে তিনি আবুল হাশিমের মনােনীত প্রার্থী—নাজিমুদ্দিনের দলের নন।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলাে খুব গােলমালের মধ্যে। আজমিরি মফিজুদ্দীন সাহেবকে মেরে বসলেন, মােহন মিঞা ঢাকার শামসুদ্দীনকে ঘুষি মেরে ফেলে দিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ইউসুফ আলী চৌধুরীর (মােহন মিঞা) গলা টিপে ধরলেন এবং ধাক্কা দিয়ে দেয়ালের ওপর ফেলে দিলেন। শেষ পর্যন্ত জনাব তমিজউদ্দীন খানকে ‘পােলিং অফিসার’ করে দুদলের ভােট গণনা হলাে। আবুল হাশিম সাহেবের দলের পাঁচজনই বিজয়ী—অর্থাৎ পার্লামেন্টারি বাের্ডে সংখ্যাগুরুত্ব লাভ করেন। এর আগে সিন্ধুতে জিন্নাহর মনমতাে পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠিত না হওয়ায় সে বাের্ড ভেঙে দিয়ে জিন্নাহ নিজেই বাের্ড মনােনীত করেন। একজন খবরের কাগজের রিপাের্টার আবুল হাশিম সাহেবকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি উত্তরে বললেন, বাংলাদেশ সিন্ধু দেশ না। যাহােক, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও নির্বাচনের বিরুদ্ধে সাক্ষাভাবে কোনাে হস্তক্ষেপ করেনি, যদিও পরবর্তীকালে পরােক্ষভাবে করেছিল।
পার্লামেন্টারি বাের্ডের সম্পাদক নিযুক্ত হন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। তিনি আবুল মনসুর আহমদ সাহেবকে পাবলিসিটি সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন। এটা ছিল শহীদ সাহেবের মহানুভবতা। অন্য কোনাে নেতাই ফুড কনফারেন্স-এর মতাে ব্যঙ্গ রচনার পর তাঁকে পাবলিসিটি সেক্রেটারি নিযুক্ত করার কথা চিন্তাও করত কি না সন্দেহ। আবুল মনসুর সাহেবও তার কাজ সুষ্ঠুভাবেই সম্পাদন করেছিলেন।
নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহ জেলায় সর্বভারতীয় কৃষক সমিতির অধিবেশন ডাকা হয়। কমরেড মুজাফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন। আমাদের ঢাকা পার্টি হাউস থেকে ফ্রাটারনেল ডেলিগেট’ হিসেবে আমি, শামসুল হক ও শামসুদ্দীন তিন দিনের জন্য ওই অধিবেশনে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকি। কমরেড মুজাফফর আহমদ স্বল্পভাষী লােক ছিলেন, যদিও সাহিত্যিকসাংবাদিক এবং বিপ্লবী দলের নেতা হিসেবে নির্যাতিত ব্যক্তি। সাম্রাজ্যবাদ পূর্ববঙ্গে কেন এগিয়ে যাচ্ছে না কতগুলাে বিশেষ স্থান ছাড়া, সে প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কারা আছেন দেখতে হবে। একজন ওই জেলার মহারাজকুমার, আর একজন রাজা না হলেও সামন্তবাদী ঘরের সন্তান। কথার কথায় বললাম, মহারাজকুমার, মণি সিংহ, আমাদের ঢাকায়
২১০
অন্নদা পাল—এঁদের নেতৃত্বে দরিদ্র মুসলমান কী প্রেরণা পেতে পারে? ফলে এঁদের প্রভাব সাঁওতাল, হাজং, গারােদের অথবা নীচ স্তরের তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যতটা, ততটা নয় মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ের ওপর। যদিও কিছুসংখ্যক স্কুল বা পাঠশালার মুসলমান শিক্ষক এঁদের সঙ্গে কাজ করেন। মুসলমান মধ্যবিত্তরা মনে করে, এরা পাকিস্তানবিরােধী এবং বাংলাকে ভারতের সঙ্গে রাখতে চায়। গ্রাম্য মুসলমান সমাজে এখনাে ধর্মের প্রতি একটা টান আছে এবং সেটা জাগিয়ে রাখে জুমার নামাজ, ঈদের উৎসব—ছুত-অচ্ছতের প্রভাব। কমরেড কোনাে উত্তর দিলেন না। আমি বললাম, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কবি নজরুল ইসলাম ও কলকাতায় খাজা নাজিমুদ্দিনের উপনির্বাচনে কবি জসীমউদ্দীন নির্বাচনে দাঁড়িয়েও কি মুসলমানদের ভােট পেয়েছেন—তাঁদের যে সম্মান, সে তাে গুটিকয়েক লেখাপড়া জানা লােকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই কবি নজরুল ইসলাম পীর বাদশাহ মিঞার চিঠি নিয়েও নির্বাচনে জামানতের টাকা বাঁচাতে পারেননি। কারণ, নজরুল মৌলভিদের মতে কাফের—হিন্দু মেয়ে তার স্ত্রী। হুমায়ুন কবির দাঁড়ালেও সে অবস্থা হবে। এ কথা অবশ্য সত্য যে সংসদীয় নির্বাচন দিয়ে জনমত যাচাই করা যায় না—তবু এটাও সত্যি যে জনমতকে অগ্রাহ্য। করে ভােটাররা ভােট একজনকে দিতে সাহস পায় না। কমরেড সেদিন নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে আমি মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী।
নভেম্বরের ১৬ তারিখে আবুল হাশিম সাহেব সাপ্তাহিক মিল্লাত বের করেন। তিনি নিজে কাগজের পৃষ্ঠায় যদিও সম্পাদক, কিন্তু সত্যিকার সম্পাদক ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী ইদ্রিস। ওই রকম একখানা বাংলা সাপ্তাহিক এর আগে মুসলমান সমাজ থেকে বেরােয়নি, এ কথা যারা মিল্লাত পড়েছেন সে যুগে, তারা স্বীকার করবেন। মিল্লাত-এর গ্রাহক বেড়ে যাচ্ছিল দিন দিন। এবার মাওলানা আকরম খাঁ বুঝলেন আহসান মঞ্জিলের কাছ থেকে যেমন নেতৃত্বের মর্টগেজ’ ছাড়িয়েছেন তিনি, সেখানেই এবার প্রচারের যে একচেটিয়া অধিকার তাঁর ছিল, তার সমাপ্তি ঘটাতে তিনি সচেষ্ট হয়েছেন। এর ফলে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে উঠতে লাগল।
নভেম্বরের ১৫ থেকে ২০ তারিখে পার্লামেন্টারি বাের্ডের সম্পাদক শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগের সম্পাদক আলােচনা করে স্থির করলেন যে প্রতিটি জেলায় একটি করে নির্বাচনী অফিস প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং একজন করে বিশ্বস্ত লােককে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করা হবে। আমি কলকাতা থাকা পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জন্য যে নামগুলাে আলােচনা হলাে তা হলাে, শেখ মুজিবুর রহমান-ফরিদপুর, আমি—ঢাকা, শামসুল হক-ময়মনসিংহ, খােন্দকার মােশতাক আহমদ—কুমিল্লা, আবদুর রহমান চৌধুরী-বরিশাল। তখনকার
২১১
ঢাকা বিভাগের জেলাসমূহের নির্বাচন অফিসের সম্পাদক নিযুক্তির পরই আমি। ঢাকা ফিরে আসি।
ডিসেম্বর মাসের ১০ ও ১২ তারিখে কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন। বাংলাদেশে পাঁচটি আসন মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত। মনােনয়ন পেলেন সর্বজনাব আবদুর রহমান সিদ্দিকী, স্যার হাসান সােহরাওয়ার্দী, তমিজুদ্দীন খান, রফিউদ্দীন সিদ্দিকী, আবদুল হামিদ শাহ। ঢাকা-ময়মনসিংহ নির্বাচনী কেন্দ্রে মনােনীত হলেন মৌলভি তমিজউদ্দীন খান। তমিজুদ্দীন সাহেব তাঁর জেলায় পরিচিত খুবই-কলকাতায় পরিচিত হয়েছেন ১৯৩৭ সালের পর থেকে। কিন্তু ঢাকা-ময়মনসিংহ জেলায় তাকে তখন কেউ চেনে না। নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ফজলুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি এলেন আমাদের ১৫০ নম্বর মােগলটুলী পার্টি অফিসে। সেটার দোতলাটি তখন সাময়িকভাবে ঢাকা জেলার নির্বাচন অফিসে পরিণত হয়েছিল। তা ছাড়া পূর্ব বাংলার জেলাগুলােতে পার্টি হাউস এত দিন যেভাবে সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, তা-ও অনেকটা নির্বাচন অফিসের ওপর এসে চাপল। দুঃখের বিষয়, বরিশালে নির্বাচন অফিসে গােলমাল দেখা দেওয়ায় আবদুর রহমান চৌধুরীর স্থলে শামসের আলীকে নিযুক্ত করা হলাে। কুমিল্লায় খােন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের পক্ষে খানবাহাদুর আবেদুর রেজা ও খান সাহেব ফরিদুদ্দীন এবং অন্য কয়েকজন উকিলের জন্য সুষ্ঠুভাবে কাজ করা সম্ভব হয়নি। কয়েকটি স্থানে পুরােনা মুসলিম লীগ এ সুযােগে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল।
তমিজুদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন ময়মনসিংহের দেলদুয়ারের জমিদার এবং কেন্দ্রীয় পরিষদের একজন পুরােনাে নেতা স্যার আবদুল হালিম গজনভী। এর ওপর তার পক্ষে রয়েছেন শেরেবাংলা ও ঢাকার নবাববাহাদুর। তাঁরা তিনজনে একসঙ্গে দুই জেলায় নির্বাচনী অভিযান চালিয়েছেন। তমিজুদ্দীন সাহেব স্বাভাবিকভাবেই খুব ঘাবড়ে গেছেন। আমি ফজলুর রহমান সাহেবকে বললাম যে স্যার আবদুল হালিমের বাড়ি ময়মনসিংহ। সুতরাং তমিজুদ্দীন সাহেবের ময়মনসিংহে কাজ করা দরকার। ঢাকা জেলায় যেহেতু তমিজুদ্দীন সাহেব বা স্যার আবদুল হালিম কারও বাড়ি নয়, সুতরাং এখানে। মুসলিম লীগের নামে ভােট হবে। তমিজুদ্দীন সাহেব স্বস্তি পাচ্ছিলেন না—আমি তাকে বললাম যে ময়মনসিংহে যে আপনার নির্বাচনের কাজে থাকবে, তার ওপর আপনি সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারেন। শামসুল হকের কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে আপনি ততটা না জানলেও ফজলুর রহমান সাহেব জানেন। আপনি নিশ্চিন্ত মনে তার ওপর আস্থা রেখে কাজ করে যাবেন। সময় পেলে ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে দু-চার দিনের জন্য একবার আসবেন।
সেদিন ফজলুর রহমান সাহেব অনেক রাতে আমার সঙ্গে আমার বাসায়।
২১২
এলেন। খাওয়া দাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আপনি কী আপনার মতামত পার্লামেন্টারি বাের্ডকে জানাবেন?’ বদরুদ্দীন সিদ্দিকী তখন কলকাতায় ওকালতি শুরু করেছেন। অ্যাডভােকেট নুরুল হুদা সাহেবকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন কেন্দ্র থেকে তাকে মনােনয়ন দেওয়ার জন্য হাশিম সাহেব ও শহীদ সাহেবকে বলতে। আমি সিদ্দিকীকে বলেছিলাম, ফজলুর রহমান সাহেব বাের্ডের সদস্য, তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ যদি অন্য কাউকে মনােনীত করে, তবে সবাই বলবে যে তার ওপর আমরা প্রতিহিংসাপরায়ণতা দেখিয়েছি। শহীদ সাহেব এবং হাশিম সাহেবেরও বদনাম হবে। সুতরাং আমার রিপাের্টে এতটুকু বলতে পারি যে যেহেতু ওটা বিশেষ নির্বাচনী কেন্দ্র, সুতরাং ওখানে মুসলিম লীগের কোনাে মনােনয়ন দেওয়া উচিত নয়। নূরুল হুদা সাহেব খুব খুশি হননি। তবু এ ছাড়া আমার অন্য কোনাে পথ ছিল না।
ফজলুর রহমান সাহেব যখন সে কথাটা তুললেন, তখন আমি বললাম, ওটা তাে আপনাদের ব্যাপার। তবে আমার ধারণা, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে যুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেহেতু মুসলিম লীগের সেখানে কোনাে প্রার্থী দেওয়া উচিত নয়। ফজলুর রহমান সাহেব আমাকে বােঝাতে চেষ্টা করলেন যে যেহেতু ওই নির্বাচন কেন্দ্রে হারার প্রশ্ন নেই, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতাও না হতে পারে, সে অবস্থায় মুসলিম লীগের সাফল্যের গণনায় কেন এটাকে যােগ দেওয়া হবে না, সেটাই ভাবার বিষয়। আমি আর কথা বাড়ালাম না। অনেক রাতে তিনি বাড়ি ফিরলেন ।
এরপরেই খবর এল যে স্যার আবদুল হালিম গজনভী শেরেবাংলা ও ঢাকার নবাব সমভিব্যাহারে ঢাকা আসছেন কলকাতা থেকে। নারায়ণগঞ্জে এমন বিক্ষোভের ব্যবস্থা করল আউয়াল, আলমাছ ও শামসুজ্জোহা, যার ফলে শেরেবাংলা ঢাকায় আমার অফিসে টেলিফোন করলেন তাঁকে সসম্মানে জাহাজ থেকে অবতরণ করার সুযােগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে। আমি তক্ষুনি লােক পাঠালাম-বহু কষ্টে তাদের নামিয়ে আনা হলাে। কিন্তু তার ফলে তারা ঢাকায় তিন নেতার অভিযান বন্ধ করলেন। লােক লাগিয়ে টাকা দিয়ে এদিকে-ওদিকে কিছু ভােট সংগ্রহ করার জন্য চেষ্টা করতে থাকলেন। আমি একবার ময়মনসিংহ গিয়ে শামসুল হকের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে। বুঝলাম, ময়মনসিংহে আমাদের অবস্থার ক্রমােন্নতি হচ্ছে। তমিজুদ্দীন সাহেব গ্রামে গ্রামে ঘুরে বক্তৃতা করছেন জমিদারদের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তৃতায় একটি কথার ওপরই সাধারণ মানুষের মন আকৃষ্ট হয়েছিল—সে তাঁর আত্মজীবনী । কত কষ্ট স্বীকার করে তাকে পড়াশােনা করতে হয়েছে—খেলাফত আন্দোলনে পুলিশের ব্যাটনচার্জ সহ্য করতে হয়েছে—তারপর আজীবন জমিদারি
২১৩
উৎখাতের চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং নির্বাচিত হলে জমিদারি অত্যাচার থেকে প্রজাদের কেবল রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করবেন না—প্রজারাই যাতে জমির মালিক হয়, তারও চেষ্টা করবেন। বক্তৃতা করতেন সহজ-সরলভাবে সাধারণ লােকের বােধগম্য করে।
কিন্তু জিন্নাহ সাহেব এ নির্বাচন কেন্দ্র সম্বন্ধে সন্দেহ পােষণ করতেন। বিশেষ করে এটা তাঁর আত্মসম্মানেরও প্রশ্ন। স্যার আবদুল হালিমের বিজয় তার যেন নিজস্ব পরাজয়, যখন তার নির্বাচনী অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেরেবাংলা ও ঢাকার নবাব, যে দুজনকে তিনি মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেছেন। তিনি কলকাতা এসেছেন সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করতে। হঠাৎ রাতে আমি টেলিফোন পেলাম হাসান ইস্পাহানির কাছ থেকে, তিনি অনেক সময় খবর নিতেন নির্বাচনের সম্ভবনা সম্পর্কে জিন্নাহ সাহেবকে জানানাের জন্য। আমি টেলিফোন ধরতেই বললেন, কায়েদে আজম কথা বলবেন। তাঁর কথায় বুঝলাম, তিনি যেন স্বস্তি পাচ্ছেন না—একটা অস্থিরতা। আমি তাকে বললাম যে স্যার আবদুল হালিমের জয়ের প্রশ্ন নেই—প্রশ্ন হচ্ছে তার জামানত বাজেয়াপ্ত করা যাবে কি না। তিনি কেবল বললেন, Don’t be so sure and don’t be complacent and don’t spare yourself. 515915 COCIPA কেটে দিলেন।
নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়জয়কার। বাংলাদেশে শতকরা ১০০ টি আসনই মুসলিম লীগ দখল করেছে। ২৭ ডিসেম্বর শুকরিয়া দিবস’ পালন হবে কলকাতার অক্টারলনি মনুমেন্টের পাদদেশে। আমি ২৪ তারিখে কলকাতা গিয়ে দেখি হই হুল্লোড় কাণ্ড। আমাদের ঢাকার শামসুদ্দীন স্লোগান দিচ্ছে মিছিলের পুরােভাবে থেকে। সব স্লোগান উর্দুতে। কয়েকটি এখনাে মনে পড়ছে। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, ‘ছিনকে লেঙ্গে পাকিস্তান’, ‘সিনামে গুলি লেঙ্গে পাকিস্তান। বানায়েঙ্গে’ আর রাস্তার ছােকড়ারা বলছে, কানমে বিড়ি মুমে পান/ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। সমস্ত সমাজটা যেন পাগল হয়ে গেছে।
২৭ তারিখ দুপুর থেকেই মানুষ আসছে, কত লােক আর কত নিশান। কলকাতায় যে এত মুসলমান বাস করত তা আমার ধারণার অতীত ছিল । লাখ লাখ লােকের সমাগম। বেলা চারটায় নেতারা এলেন—প্রথম এলেন। মাওলানা আকরম খাঁ, তারপর খাজা নাজিমুদ্দিন, আবুল হাশিম এলেন; কিন্তু শহীদ সাহেবের দেখা নেই। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। খবর এল, কে বা কারা তাঁর গাড়ি বারান্দা থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তাই তিনি আসতে পারছেন না। সবাই গাড়ি পাঠাতে চায়; কিন্তু তিনি পরের গাড়িতে উঠবেন না। কী করা যায়? এত বড় সভা অথচ তিনি এমন ছেলেমি করছেন! পরে শােনা গেল যে তাঁর পিতা জাহেদ সাহেবের প্যাকার্ড গাড়ি না হলে তিনি
২১৪
সভায় যাবেন না। সবাই মিলে তখন অসুস্থ জাহেদ সাহেবকে অনুরােধ। করলেন। জাহেদ সাহেব বললেন, ওকে গাড়ি দিলে তা কোনাে দিন ফেরত দেবে না—ও জীবনে যখন যা নেয় তা আর কোনাে দিন আমাকে ফিরিয়ে দেয় না। তবু সবার অনুরােধে তিনি রাজি হলেন এবং সে গাড়িতে চড়ে এলেন। সভায়। এ ধরনের আবদার বৃদ্ধ বয়সেও তার পিতার সঙ্গে চলত। আবুল। হাশিম সাহেব বিপ্লবী বক্তৃতা করলেন বাংলায়, শহীদ সাহেব উর্দুতে। শহীদ সাহেব খুব ভালাে বক্তৃতা করছিলেন আর কলকাতাবাসীর কাছ থেকে খুব হাততালি পাচ্ছিলেন। বক্তৃতা শেষ করলেন এই বলে যে তাঁর ২০০০ নম্বরের সফেদ গাড়ি খােয়া গেছে। কলকাতার লােকদের সে গাড়ি খুঁজে বের করে দিতে হবে। আমি অবাক হলাম। বাবার সঙ্গে নাহয় আবদার করা চলে, কিন্তু জনগণের কাছে এটা কোন ধরনের আবদার যে তারা খুঁজে দেবে তার গাড়ি। গাড়ি অবশ্যই পরদিন পাওয়া গেল ডায়মন্ড হারবারের কাছে—মাতাল অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান ছােকরা কয়েকজন গাড়ি চুরি করে ওখানে ফেলে গেছে।
এরপর এক সপ্তাহ ধরে আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে সাংগঠনিক আলােচনা, মিল্লাত-এর সম্বন্ধে আলােচনা এবং শহীদ সাহেবকে কীভাবে চাপ দিয়ে একটি দৈনিক কাগজ বের করানাে যায়, সে সম্বন্ধে আলােচনা ও প্রার্থী মনােনয়নের ব্যাপারে আমাদের করণীয় কী, তা-ও বিবেচিত হলাে।
আবুল হাশিম সাহেব আমাদের বললেন, একটা কথা নিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব শহীদ সাহেবকে চাপ দিচ্ছেন। সেটা হচ্ছে যে যেসব। পরিষদ সদস্য শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর সরকারি দলে যােগ না দিয়ে মুসলিম লীগের প্রতি অনুরক্ত ছিল, তাদের মনােনয়ন দেওয়া উচিত। আর যেহেতু নাজিমুদ্দিন সাহেব নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না—তাই আগামী পাঁচ বছরে নেতৃত্ব নিয়ে শহীদ সাহেবের সঙ্গে তার কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না। সুতরাং তারা তাঁর দলের বলেই তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত হবে না। তারা নাজিমুদ্দিন সাহেবের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, যেহেতু তিনি নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন যখন শহীদ সাহেব নেতা নির্বাচিত হবেন, তখন তারা তাঁরই অনুরক্ত থাকবে। শহীদ সাহেব খাজা সাহেবের যুক্তি গ্রহণ করতে খুবই ইচ্ছুক, কিন্তু আবুল হাশিম সাহেবের মন সায় দিচ্ছে না। কারণ, ওই চল্লিশজনের যেসব প্রতিদ্বন্দ্বীকে আমরা প্রস্তুত করেছিলাম দাঁড় করানাের জন্য, তারা নিরাশ হবেন পার্টির কাজ করেও। এটা নিয়ে এখনাে নিতর্ক চলছে দুজনের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত কী হবে বলা যায় না ।
১৯৪৬ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝির দিকে একদিন বেগম সুলতানউদ্দীন আমাকে সকালে নাশতা খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। আমি সে নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য তার বাসায় যাই এবং খাওয়াদাওয়া করি। বেগম সাহেবা আমার
২১৫
আত্মীয়াও। তাই তাঁকে আমি খােলাখুলি বললাম যে তার বিরুদ্ধে যারা প্রার্থী হয়েছে তার মধ্যে আনােয়ারা খাতুনকে বাের্ডের সদস্য লাল মিঞা সাহেব কথা দিয়েছেন। বেগম সুলতানউদ্দীনকে আমি বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে তবু। আমার মনে হয় না যে কোনাে অসুবিধা হবে।
আনােয়ারা খাতুনের বিগত জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। সে যখন ময়মনসিংহে নবম শ্রেণির ছাত্রী, তখন একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পণ্ডিতপাড়ার কতগুলাে দুষ্টু ছােকরা তাকে কিডন্যাপ করে এবং পরের দিন তাকে প্রায়। অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যায়। এ ঘটনায় যারা মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পক্ষপাতী ছিল তারা সবাই খুব দুঃখিত হয়। কারণ, ওই ধরনের ঘটনা ঘটলে মুসলমান ভদ্রলােকদের তাদের মেয়েদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে, ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। ঘটনাটাকে হালকা করে দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলী আমজাদ খান তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। সুলতানউদ্দীন, সাহেব সে বিয়েতে কেবল উপস্থিত ছিলেন না, আতাউর রহমান সাহেব ও অন্য বন্ধুদের মত, তিনি মেয়ের উকিল বাপ’ হয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাস, আজ সেই আনােয়ারা খাতুনই বেগম সুলতানউদ্দীনের প্রতিদ্বন্দ্বী।
সুলতানউদ্দীন সাহেবের বাসা থেকে বের হয়ে আমি আমার বাসায় পৌছেছি—বাথরুমে ঢুকছি, এমন সময় খবর এল যে আমার অফিসের সম্মুখে লােকজন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে এবং চেয়ার-টেবিল ভাঙছে। অফিসে তখন শওকত আলী ছাড়া অন্য কেউ উপস্থিত ছিল না। যেহেতু সবাই মনােনয়নদানের অপেক্ষা করছে, সুতরাং নির্বাচন অফিসে তেমন কাজকর্ম ছিল না। আমি অফিসে এসে শুনলাম যে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সুলতানউদ্দীন সাহেব, আতাউর রহমান খান সাহেব, আবদুল ওয়াসেক সাহেব প্রমুখ নেতা। চেয়ার-টেবিল ভেঙে ফেলেছে, টেলিফোনের তার ছিড়ে ফেলেছে। পােস্টার দেয়াল থেকে তুলে ফেলেছে। হিসাবের কাগজপত্র সব বাইরে ফেলে দিয়েছে। আমি খানবাহাদুর আওলাদ হােসেন সাহেবের বাসায় গিয়ে তাঁকে সব কথা বললাম এবং তাঁর মত নিয়ে টেলিফোনে আবুল হাশিম সাহেবকে সব কথা জানালাম। তিনি আমাকে বললেন, এটা ঠিক যে শহীদ সাহেবের সঙ্গে ওই ৪০ জনের সম্বন্ধে একটা আপসরফা হয়েছে এবং ৩৫ জনকে শহীদ সাহেব মনােনীত করতে রাজি হয়েছেন, তবে তার মধ্যে বেগম সুলতানউদ্দীন বা আবদুল ওয়াসেক ও আতাউর রহমান সাহেবদের কোনাে ক্ষতি হতাে না। আমি লাল মিঞা সাহেবকে বেগম সুলতানউদ্দীনের সম্বন্ধে আপনার কথা বলেছিলাম এবং তিনি অনেকটা রাজি হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে পরে অবস্থা একেবারেই পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করলেন আবদুল ওয়াসেকের ওখানে আপনি কাকে মনােনয়নের জন্য
২১৬
অনুরােধ করবেন। আমি বিনা দ্বিধায় বলে দিলাম খানবাহাদুর আবদুল খালিক সাহেবের নাম, যিনি সবে ‘ইন্সপেক্টর অব স্কুলস’ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। এবং আরও বললাম, আমি কলকাতা এসে তাঁর সম্বন্ধে আপনার সঙ্গে আরও আলাপ করব।’ হাশিম সাহেব আমাকে জানালেন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের ‘লিস্ট তৈরি হয়ে যাবে, তার আগেই যেন একবার দেখা করি।
ইতিমধ্যে চান্দিনা (কুমিল্লা) থেকে আমার স্ত্রীর তার এল আমাকে শিগগিরই সেখানে যেতে । আমার স্ত্রী তখন তাঁর মামা মােশাররফ হােসেন সাহেবের ওখানে বেড়াতে গেছেন। তিনি চান্দিনার মহকুমা হাকিম। পরদিনই সেখানে গিয়ে দেখলাম যে আমার স্ত্রী টেলিগ্রাম সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। তার করেছে তার এক মামাতাে ভাই। আমাকে নিয়ে গেছেন মফিজুদ্দীন সাহেবের নমিনেশন’-এর কথা বলার জন্য। আমার মামাশ্বশুর ও মফিজুদ্দীন সাহেব একত্রে খেতে বসলাম। মামা বললেন, মফিজুদ্দীন সাহেব তার আত্মীয় ও ভায়রা ভাই। শুধু ওই কারণে আমাকে চান্দিনা থেকে আনার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। ওখান থেকে ফিরে এসে কলকাতায় গেলাম। ইতিমধ্যে কে যেন খানবাহাদুর শহীদুল হকের পক্ষে এক বিরাট চিঠি লিখেছে আবুল। হাশিম সাহেবের কাছে। তার মধ্যে তােফাজ্জল আলী (টি আলী) সাহেবের বিরুদ্ধেও অনেক কিছু বলা হয়েছে। ইংরেজি বেশ ভালাে, নির্বাচন কেন্দ্র সাহেব আমার এক বন্ধুকে বলেছিলেন যে আমি কিছুদিন আগেই কুমিল্লা গিয়েছিলাম এবং আমিই ওই চিঠি লিখেছি। অদ্ভুত যুক্তি। হাশিম সাহেবের সঙ্গে বা সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে আমার রাজনীতির ভেতর দিয়ে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাতে বেনামি চিঠি তাদের কাছে আমার যে পাঠানাের প্রয়ােজন নেই তা তার বােঝা উচিত ছিল। এমন সব ভুল-বােঝাবুঝি তখন নানা জায়গায় সৃষ্টি হয়েছিল ।
আবুল হাশিম সাহেবকে ঘটনার মােটামুটি বিবরণ দিলাম। কুমিল্লা সম্বন্ধে আলােচনা হলাে, বিশেষ করে আমাদের নির্বাচন অফিস নিয়ে। বলা হলাে খােন্দকার মােশতাক সাহেবের অসুবিধাসমূহের কথা। কুমিল্লায় আমাদের ভিত শক্ত নয় এবং এখনাে খাজাদের এজেন্টদের প্রভাব বিস্তর। আমি সে মাসেই খােন্দকার মােশতাক সাহেবদের দশপাড়া বাড়ি যাই এবং তাঁর পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি । সুন্দর চেহারা, সফেদ দাড়ি, পীর মানুষ। মােশতাক সাহেবের ভাইদের মধ্যে তখন নাসিম আহমদ সাহেবকে সবাই জানত খুব ভালাে ফুটবল খেলােয়াড় হিসেবে—তারপরে আরও জানল লােকে যখন তার স্ত্রীর আত্মহত্যার কথা খবরের কাগজে বেরােল। তার বড় ভাই ছিলেন
২১৭
কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভােকেট জনাব মােসলেহউদ্দীন সাহেব। মােশতাক সাহেব যেমন ছাত্ররাজনীতি করার সময় থেকে সাধারণ লােকের সঙ্গে মিশতে পারতেন, মােসলেহউদ্দীন সাহেব তা পারতেন না—যদিও তাঁরও রাজনীতি করার বাসনা ছিল। খানদানি মনােভাবের রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে। যে একটা দেশময় জনমত গড়ে উঠেছে বলতে গেলে ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের পর থেকেই, সে সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন না। তিনি পরে ঢাকা জেলার আবদুল করিম পেশকার সাহেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা আলতাফুন্নেছাকে বিয়ে করেন। আলতাফুন্নেছা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব সম্ভব ১৯৩৬ সালে ইংরেজিতে এমএ পাস করে স্কুল ইন্সপেক্টর হয়েছিলেন। তার ছােট বােন আখতার ইমাম পরবর্তীকালে ঢাকা মেয়েদের হলের প্রভােস্ট হয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি বাের্ড তাঁদের ১১৯টি আসনের মনােনয়ন সম্পন্ন করেন। কিন্তু অনেকেই ওই মনােনয়নের বিরুদ্ধে আপিল করলেন এই বলে-খাজা সাহেবদের দলের লােক বলে অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বাের্ডের পক্ষ থেকে চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও হাসান ইমাম সাহেব আপিল শুনলেন। তাঁরা ২২ জনের আপিল গ্রহণ করলেন। ফলে দাঁড়াল যে পরিষদে খাজা সাহেবদের একটি ভালাে ব্লক তৈরি হলাে—প্রথম ৩৫ জন। শহীদ সাহেবের সঙ্গে নাজিমুদ্দিন সাহেবের চুক্তির ফলে, আরও ২২ জন আপিলের ফলে। অর্থাৎ ১১৯ জনের মধ্যে ৫৭ জন রইলেন খাজা ব্লকের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে কোনাে মনােনয়ন দেওয়া হলাে না। সর্বজনাব আবদুল জব্বার খদ্দর, আবুল মনসুর আহমদ হামিদ এমএসসির মনােনয়ন বাতিল করে আপিল বাের্ড হবীবুল্লাহ বাহার, আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং সৈয়দ আবদুস সেলিমকে মনােনয়ন দিলেন। ৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস হয়ে গেলেন।
সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঠিক হলাে ১৯ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত। ঢাকার নির্বাচনের আলােচনা করার আগে বাংলার সাধারণ নির্বাচনের পটভূমি যা দেওয়া হলাে, তা হচ্ছে সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম সাহেবদ্বয়ের জিন্নাহর প্রতি বিরূপ মনােভাব। পার্লামেন্টারি বাের্ডের পক্ষ থেকে জিন্নাহ সাহেবকে মুসলিম লীগের পক্ষে নির্বাচন অভিযানে অংশগ্রহণ করতে বলা হলাে না, যদিও হাসান ইস্পাহানি ব্যক্তিগত একটা চিঠিতে জিন্নাহকে লিখেছিলেন সে যেন বাংলাদেশটাকে একেবারেই ভুলে না যায়। এটা বােধ হয় সিন্ধুদেশে জিন্নাহ নির্বাচিত পার্লামেন্টারি বাের্ডের ওপর হস্তক্ষেপের ফলে এবং কেন্দ্রীয় নির্বাচনে কেবল নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের নির্বাচন কেন্দ্রে এক পক্ষকাল কাটিয়ে অন্য সব প্রদেশকে অবহেলা করার জন্য। জিন্নাহর পক্ষে
২১৮
বলে যায় যে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন কাজেমি সাহেব, যে শরিয়ত বিল এনেছিলেন কেন্দ্রীয় পরিষদে এবং জিন্নাহ সে বিলের বিরােধিতা করেছিলেন। পরে আপস হয়েছিল এই বলে যে শরিয়ত আইন বােম্বেতে বা ইসমাইলি, মেমন, কাচ্চিমেমন প্রভৃতির ওপর প্রযােজ্য হবে না। যে মুসলিম লীগ শরিয়তের আইনের বিরােধিতা করে তাদের ইসলামের নামে নির্বাচনের অধিকার যুক্ত প্রদেশের মুসলমানদের কাছে সহজে গ্রহণযােগ্য হয়নি। জিন্নাহ সাহেব তাই আলীগড়ের সব ছাত্রকে নিয়ে এবং বিশিষ্ট আলেমদের যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাফর আহমদ ওসমানী সাহেব প্রমুখকে নিয়ে অভিযান চালিয়েও মােট আট শ ভােটের তফাতে লিয়াকত আলীকে পাস করানাে সম্ভব হয়েছিল। যে কারণেই হােক, জিন্নাহ সাহেবকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। আকরম খাঁ অসুস্থতার ভান করে মধুপুরে স্বাস্থ্য পরিবর্তন করার জন্য চলে গেলেন। আর জিন্নাহ সাহেব খাজা নাজিমুদ্দিনকে লন্ডন পাঠালেন ব্রিটিশ সরকারের মনােভাব লক্ষ করতে—তাকে পাঠানাে হলাে কারণ বাংলার সাবেক গভর্নর এবং নাজিমুদ্দিন সাহেবের পরম বন্ধু স্যার জন অ্যান্ডারসন তখন ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রী। ওই দলের বাকি দুই নেতা ফজলুর রহমান সাহেব ও নুরুল আমিনকে তাদের নিজেদের নির্বাচন কেন্দ্রে ব্যস্ত থাকতে হলাে। ফজলুর রহমান মুসলিম লীগের নমিনেশন পাননি, সুতরাং তিনি কোনাে রকম অবহেলা করতে পারেন না তাঁর ভােটারদের—নুরুল হুদা তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং বদরুদ্দীন সিদ্দিকী ও মােহাম্মদ হােসেন (ঠান্ডা) তার অভিযান পরিচালনা করছেন। ঠান্ডা মিঞা ছিলেন ফজলুর রহমান সাহেবের ভাগনে। অন্যদিকে নূরুল আমীন সাহেব ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাঠশালার শিক্ষক কৃষক-শ্রমিক পার্টির আবদুল ওয়াহেদ বােকাই নগরীর নিকট যেভাবে পরাজয় বরণ করেছিলেন, তারপর তিনিও নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের ওপরই ভার পড়েছিল বাংলাদেশে কর্মীদের নিয়ে অভিযান চালনা করার। আলীগড় থেকে এ টি এম মােস্তফা একদল ছাত্র নিয়ে কলকাতা এলেন নির্বাচন অভিযানে সাহায্য করার জন্য। আবুল হাশিম সাহেবের ঘরে আমার সঙ্গে তাঁদের দেখা। আমি বললাম, আলীগড়ের ছাত্ররা যেহেতু বাংলায় বক্তৃতা করতে পারে না, তাই এখানে তাদের প্রয়ােজন নেই। কলকাতার দক্ষিণ থেকে খাজা নুরুদ্দীন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করেছেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব চব্বিশ পরগনা কেন্দ্র থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং কলকাতা উত্তর থেকেও বিশেষ কেউ তার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না। ঢাকা শহরের নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ প্রার্থী নন, সুতরাং যেসব জায়গায় উর্দু বলতে পারে বা বুঝতে পারে, সেখানে কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। তারা বরং
২১৯
বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিশেষ করে পাঞ্জাবে এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কাজ করলে ভালাে হবে।
এদিকে সিলেট থেকে আবদুল মতিন চৌধুরী ও মনােয়ার আলী সাহেব জিন্নাহকে নিমন্ত্রণ করলেন। জিন্নাহ সে আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য কলকাতা এলেন। তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হলাে। বাংলার কোনাে জেলায় তাঁর জন্য কোনাে সভা অনুষ্ঠান করা হয়নি। তাই স্থির হলাে যে কলকাতা থেকে ট্রেনে সিলেট যাবেন। আমাকে আর শামসুল হককে বলা হলাে তার সঙ্গে থাকার জন্য, যদি পথিমধ্যে কোথাও তাঁর বক্তৃতা বাংলা করার প্রয়ােজন হয়। তার জন্য—হাসান ইস্পাহানি, খাজা নুরুদ্দীনসহ অন্য কয়েকজন কলকাতার নেতাও সঙ্গে চললেন। জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে এটাই আমার দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী দেখা। আমাদের সিলেট পৌছাতে প্রায় একটানা ২৬ ঘণ্টা লেগেছিল। অনেক স্টেশনে প্রচণ্ড ভিড় করে আছে লােকজন—জিন্নাহ সাহেবকে দেখার জন্য। অথচ জিন্নাহ সাহেব কিছুতেই তাঁর সেলুনের দরজা খুলবেন না। স্যুট পরে আছেন, শুধু ট্রেনে উঠে জ্যাকেটটা খুলে ব্রাকেটে ঝুলিয়ে রাখলেন। আমরা ভাবলাম যে তিনি আমাদের উপস্থিতির জন্য শােবার পাজামা পরতে পারছেন না। তাই আমরা এক স্টেশনে নেমে কয়েক স্টেশন পার হয়ে যখন আবার উঠলাম, দেখলাম আমাদের ভুল—তিনি কাপড় ছাড়েননি, এমনকি শার্টের ভাঁজ (ক্রিজ) ভাঙতে পারে—তাই সহজভাবে দেহটাকে এলিয়ে দেননি। আমরা বললাম যে তিনি কিছু খাবেন কি না জানার জন্য ইস্পাহানি সাহেব আমাদের পাঠিয়েছেন। তিনি বললেন, না আমি বিস্কুট-কফি খেয়ে নিয়েছি। বুঝলাম খাবেন না। কারণ মিটারগেজের ট্রেনের সেলুনে যে ল্যাভেটরি, তিনি তা ব্যবহার করতে চান না। সে জন্য ক্ষুধাকে প্রশ্রয় দিতে চান না। শামসুল হক তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ফোল্ডিং চেয়ারটাকে একটু পিছে টেনে বসতে গেলে তিনি অমনি বলে উঠলেন যেখানে চেয়ার আছে সেখানে রাখাে। তার নিজের সাজানাে ঘরে যেন কোথাও পান থেকে চুন খসারও উপায় নেই। তাঁর সঙ্গে কোনাে আলােচনা করা যায় না, শুধু নীরবে নেতাকে অবলােকন করা যায়। আমাদের বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে কত তফাত। আমাদের নেতারা কি শেরেবাংলা, কি শহীদ সােহরাওয়ার্দী, কি আবুল হাশিম একা থাকতে পারেন না—সর্বদাই লােকজন দ্বারা বেষ্টিত থাকতে চান, এমনকি খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের বৈঠকখানায়ও লােকের ভিড় থাকত। শহীদ সাহেব ও ফজলুল হক সাহেবের, এমনকি আবুল হাশিম সাহেবেরও ‘প্রাইভেসি’ বেশি ছিল না। লােকজন যেকোনাে সময় তাঁদের সবার ঘরে ঢুকে পড়তেন, কিন্তু নাজিমুদ্দিনের বৈঠকখানা ভর্তি হলে চাকর গিয়ে খবর দিত—তখন তিনি নেমে আসতেন তার চুড়িদার-পাজামা ও আঙ্গারাখা পরে ।
২২০
তারপর সবাইকে একে একে কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করতেন—কারও কারও সঙ্গে আলাপ করতেন। তারপর যাওয়ার সময় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতেন ঝুঁকে আদাব-আরজ করে। এর ফলে সবার সঙ্গে দেখা হতাে—সবাই খুশি হতাে, কিন্তু মনের কথা কেউ বলতে পারত না। ফজলুল হক সাহেব ও সােহরাওয়ার্দী সাহেব কানকথা শুনতেন এবং সে ভিত্তিতে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিতেন, খাজা নাজিমুদ্দিনের সেটা ছিল না—তিনি কান দুটো রেখেছিলেন কেবল খাজা শাহাবুদ্দীন ও ফজলুর রহমানের জন্য। মাঝেমধ্যে হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, নূরুল আমীন প্রমুখ কয়েকজন ভাবতেন যে তাঁদের কথা নাজিমুদ্দীন শুনতেন—কিন্তু আমার ধারণা, তাঁদের কথা শােনার পর খাজা শাহাবুদ্দীন বা ফজলুর রহমানের সঙ্গে তিনি ওই সব বিষয়ে পরামর্শ না করে কোনাে সিদ্ধান্ত নিতেন না। খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব কখনাে কখনাে খুব কঠোর হতে পারতেন। যেমন ১৯৪৩ সালে সুলতানউদ্দীন সাহেবকে উচ্চ পরিষদে লীগের মনােনয়নের পর যখন সেটা কেটে দেওয়া হলাে, তখন আমরা কয়েকজন তাকে ধরলাম তার মনােনয়ন বহাল রাখতে। প্রথমে তাে কিছুতেই রাজি নন। পরে যখন বললাম যে, নমিনেশন ফাইল’ করার সময় পেরিয়ে গেছে। সুতরাং ওই কাটার অর্থ দাঁড়াবে—ফজলুল হক সাহেবের মনােনীত প্রার্থী ইব্রাহিম সাহেবের নিশ্চিত জয়—তাতে পাকিস্তান দাবির ক্ষতি। তখন তিনি রাজি হলেন এই শর্তে যে তাকে নির্বাচনের আগেই তারিখবিহীন পদত্যাগপত্র তাঁর হাতে দিতে হবে। এটা যে অপমানজনক প্রস্তাব তা তাঁকে আর বােঝাতে পারলাম না। অগত্যা পদত্যাগপত্র দাখিল করতে হলাে তাঁর কাছে। অন্যদিকে ফজলুল হক সাহেব ও শহীদ সাহেবের মধ্যেও অনেক ব্যাপারে পার্থক্য দেখা যেত। শহীদ সাহেব কারও নাম সহজে মনে রাখতে পারতেন না। আমার বিশ্বাস, সারা বাংলায় শহীদ সাহেব দুই শর বেশি লােকের নাম ঠিকমতাে মনে রাখতে পারতেন কি না সন্দেহ। অন্যদিকে ফজলুল হক সাহেব অনেক দিন পরে দেখা হলেও নাম ধরে ডাকতে ভুল করতেন না। যারাই তাঁর সাহচর্যে এসেছিলেন, তাঁরাই দেখেছেন নাম মনে রাখার স্মরণশক্তি তাঁর অপূর্ব। আমি নিজেই অনেক সময় বিস্মিত হতাম। ফলে সবার কাছে তিনি খুব আপন হয়ে উঠতেন। আমার আজও ধারণা যে পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কোনাে রাজনৈতিক নেতা শেরেবাংলার সে গুণ পায়নি। অপরদিকে শহীদ সাহেব যদি সরলভাবে তাঁর ওই দুর্বলতার কথা স্বীকার করতেন, তাহলে এত ক্ষতি হতাে না তাঁর, যা হয়েছে সে দুর্বলতা ঢেকে রাখতে গিয়ে। তার ফলে কোনাে পরিচিত কর্মী তার ঘরে ঢুকতে দেখলেই তিনি চক্ষু বন্ধ করে—ভাবতে থাকতেন ‘লােকটি কে, কী নাম তার’, যদিও খুব চেনা মনে হচ্ছে। বেশির
২২১
ভাগ সময়ই তিনি চোখ বন্ধ অবস্থায় বাথরুমে গিয়ে চোখ খুলে চিন্তা করতেন। যদি তারপরও মনে না হতাে তখন তিনি নাটকীয় ব্যবহার করতেন। খুব জোরে চিৎকার করে বলে উঠতেন একটা কিছু, ফল দাঁড়াত যে সে লােক তাকে রূঢ় প্রকৃতির লােক বলে তার কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। মনে করতেন তিনি তার ভক্তদেরও সম্মান রাখতে জানেন না। অনেক সময় নামগুলাে বিকৃত করে উচ্চারণ করে নাটকীয় ভঙ্গিতে চেয়ে দেখতেন তার ফলে কী হয়। যেমন আতাউর রহমান সাহেবকে তিনি কখনাে ডাকতেন খান মােহাম্মদ আতা, আতা মােহাম্মদ খান বলে। এসব করতেন। মনের ভেতরে নামের একটি ছাপ ফেলানাের জন্য। যাতে ধীরে ধীরে নামটি তার অন্তরে গেঁথে যায়। মামলা পরিচালনার সময় আসামি ও সাক্ষীদের নাম ছােট খাতায় বারবার লিখতেন এবং এ ব্যাপারে জুনিয়র অ্যাডভােকেটের ওপর খুব নির্ভর করতেন, অন্যদিকে ফজলুল হক মামলার ঘটনা অনেক সময়। ওলট-পালট করে ফেলতেন—সে আসামিপক্ষে না বাদীপক্ষে তা ভুল করে বসতেন, কিন্তু কোন মামলায় কার পক্ষ সমর্থন করছেন, এটা ঠিক হয়ে গেলে সে মামলায় জড়িত লােকদের নাম নিয়ে কোনাে অসুবিধা হতাে না। তিনি নথিপত্র পড়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তার জুনিয়রের ওপর ছেড়ে দিতেন কিন্তু একটি গুণ দেখেছি তার মধ্যে, তা হচ্ছে মামলার ঠিক আসল বস্তুকে নথি একবার পড়লেই ধরে ফেলতেন। তাঁর জুনিয়র হিসেবে কাজ করার খুব বেশি সুবিধা আমার হয়নি, তবে নারায়ণগঞ্জের ‘কোল কন্ট্রোলার’ ভূতপূর্ব মুনসেফ আবদুল ওয়াহাব সাহেবের মামলায় গােয়ালন্দ থেকে আসার সময় আতাউর রহমান খানও আমার সঙ্গে নথি পড়তে গিয়ে প্রথমেই মামলার যেখানে আমাদের দুর্বলতা, সেটা ঠিক ধরে ফেললেন এবং মামলা পরিচালনার সময় দেখা গেল আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। আর একটা পার্থক্য হচ্ছে যে যদিও দুই নেতাই ভােজনবিলাসী ছিলেন কিন্তু ফজলুল হক যেমন অবলীলাক্রমে খাবার জিনিস চেয়ে নিতেন, শহীদ সাহেবের আভিজাত্যে তা বাধত। যেমন কেউ ভালাে পিঠা তৈরি করেন, তাঁর কাছে সহজভাবে তিনি বলতেন, তােমার পিঠা কিন্তু এবার শীতে খাওয়া হয়নি। মুন্সিগঞ্জে পৌছালে পরিচিত লােকের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন মুন্সিগঞ্জের অমৃতসাগর নিয়ে এসাে বা মুলা নিয়ে এসাে। নৈড়া স্টেশনে এলে বলতেন সন্দেশ আনাে। প্রথম শ্রেণির যাত্রী ইংরেজ সাহেব থাকলেও অবলীলাক্রমে তাকে দেশি পিঠা খেতে বলতে দ্বিধা করতেন না। কুমিল্লার ভূতপূর্ব মন্ত্রী আবদুল করিম সাহেব ছাড়া আর কাউকে কয়েক টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে চলতে দেখিনি। শহীদ সাহেব এসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ সাহেবি-ভাব বজায় রাখতেন।
যাক যা বলছিলাম, জিন্নাহ সাহেবকে নিয়ে যখন ময়মনসিংহ সিংজানী।
২২২
স্টেশনে পৌছালাম, তখন লাখ লাখ লােক দুদিন আগে থেকে চিড়া-মুড়ি নিয়ে দিন কাটাচ্ছে জিন্নাহ সাহেবকে একনজর দেখার জন্য। রেললাইনের ওপর কলাগাছ ফেলে রেখেছে। যেহেতু এটা শামসুল হকের জেলা। সুতরাং সে জেদ করতে শুরু করল যে জিন্নাহকে একবার বাইরে এসে ‘ওভারহেড ব্রিজের ওপর দাঁড়াতে হবে দর্শন দেওয়ার জন্য। জিন্নাহ বেঁকে বসলেন। তিনি কিছুতেই সেলুন থেকে বেরােবেন না। অগত্যা আমি বললাম, আপনি একটু গেটের কাছে দাঁড়ান বা জানালাটা খুলে দিন। তিনি বললেন, না। কারণ, তার যুক্তি যে জনসমুদ্র তাঁকে দেখার জন্য সবাই ট্রেনের দিকে চলে আসবে। ফলে ‘স্ট্যাম্পিডে’ বহু লােক পিষে মারা যাবে। হয়তােবা ট্রেনটাই উল্টে যাবে। এবং সবাই আমরা প্রাণ হারাব। শামসুল হক জোর দিয়ে বললেন যে সে ব্যবস্থা তার লােকেরা করবে। তারা লাইন করে হেঁটে যাবে এবং যাওয়ার সময় একটা করে সালাম দিয়ে যাবে। জিন্নাহ যত বড় নেতাই হােন, তার মন কখনাে জনতাকে হাসিমুখে স্বাগত জানাতে পারত না। যাক। শেষ পর্যন্ত উনি রাজি হলেন শামসুল হকের কথায় এবং তাঁকে সেভাবে লােকদের বুঝিয়ে দিতে বললেন। শামসুল হক মাইকযােগে কীভাবে জনতা দেখতে পারবে তা প্রায় আধঘণ্টা ধরে বুঝিয়ে দিয়ে পুলিশ এবং ভলান্টিয়ারদের দাঁড় করিয়ে সেলুনে এসে জানালা খুলে দেওয়ার অনুমতি চাইলেন। জানালা খুলে জিন্নাহ হাত নাড়িয়ে বললেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। সঙ্গে সঙ্গে কেবল জিন্দাবাদ ধ্বনি হলাে না, মানুষ যারা সম্মুখে ছিল আবার তাদের ঠেলে যারা পেছনে ছিল, তারা সবাই এগিয়ে আসতে লাগল কামরার দিকে। ভলান্টিয়ার ও পুলিশের চেষ্টা, শামসুল হকের মাইকে বক্তৃতাঅনুরােধে কোনাে কাজ হলাে না। জিন্নাহ সাহেব জানালা বন্ধ করে দিলেন। পুলিশ লাঠিচার্জ ও ফাঁকা আওয়াজ করল। তারপর কলাগাছ সরিয়ে দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল । জিন্নাহ সাহেব বললেন, ‘Young man, you have still lots of things to learn about mob. You have shown an indisciplined Bengali mob. Let me expect in future disciplined people here.’
শামসুল হক খুব বিচলিত হলেন। এরপর বাকি পথে আর তাঁকে অমন অনুরােধ করা হয়নি যদিও ভৈরবে এক বৃদ্ধ এক ঘটি দুধ জিন্নাহকে নিজ হাতে দেওয়ার জন্য অনেক অনুনয় করল। হাসান ইস্পাহানি তার পক্ষ থেকে দুধটা গ্রহণ করলেন। এভাবেই তিনি বাংলার ওপর দিয়ে আসামে গেলেন। আমরা যদি বিশেষ কয়েকটি স্থানে জিন্নাহ বক্তৃতা করবেন বলে আগেই ঘােষণা করে দিতাম এবং সেভাবে মিটিংয়ের ব্যবস্থা থাকত এবং লােকেরা জানতে পারত কোথায় তারা দাঁড়াবে, তাহলে এ অবস্থাটা হতাে না। আসল ব্যাপার আমরা তাঁকে মওকা দিতে চাইনি।
২২৩
দিল্লিতে ফিরে গিয়ে তিনি লিয়াকত আলী খানকে পাঠালেন বাংলার নির্বাচন তদারক করতে। আবুল হাশিম সাহেব বুদ্ধি করে তার জন্য সবচেয়ে বড় জেলা ময়মনসিংহে মুসলিম লীগের কনফারেন্স করে তাঁকে সেখানে সভাপতিত্ব করতে বললেন। আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের ওপর ভার পড়ল গফরগাঁওয়ে কনফারেন্সের আয়ােজন করতে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনী কেন্দ্রে গিয়েছিলেন জিন্নাহ সাহেব। কিন্তু তিনি তাঁর মাথা থেকে সােলার হ্যাটটি পর্যন্ত নামাতে অস্বীকার করলেন। ফলে ইব্রাহিম সাহেব ভােট পেলেন না। এবারও ময়মনসিংহে এক গিয়াসউদ্দীন পাঠান ছাড়া আর কেউ নবাবজাদাকে নিমন্ত্রণ করতে চাইলেন না। শামসুল হক ও আবুল মনসুর সাহেব তাঁদের ভলান্টিয়ারদের নিয়ে গফরগাঁও গেলেন। কিন্তু তারা খুব বেশি এগােতে পারলেন না। আমাকে তার করলেন ঢাকা থেকে খুব জাদরেল সাহসী যারা খুনােখুনিতে ওস্তাদ এবং কাউকে ভয় করে না, এমন কয়েক শ লােক নিয়ে। গফরগাঁও যেতে। আমি ঢাকা শহরের মুসলিম লীগের নতুন নেতাদের নিয়ে আলােচনায় বসি। আলােচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা শহর সভাপতি কাজী মােহাম্মদ বশীর। সেক্রেটারি, কলতাবাজারের হাবিবুর রহমান এবং ট্রেজারার ইয়ার মােহাম্মদ খান, শওকত আলী, ডাক্তার মেছবাহউদ্দীন প্রমুখ। তাঁদের পছন্দ করা ঢাকার দেড় শ ডাকসাইটে লােক নিয়ে আমি এবং তাজউদ্দীন রওনা হলাম। স্টেশনে এসে যা দেখলাম, তাতে আমার অন্তর। কেঁপে উঠল। মস্ত বড় বড় রামদা নিয়ে হাজার হাজার লােকের মিছিল। আমাদের ক্যাম্পে যাওয়ার পথে, আমাদের দুপাশে তারা রামদা, বর্শা উঁচু করে লাফাচ্ছে আর চিৎকার করছে এমারত পার্টি জিন্দাবাদ, মাওলানা শামসুল হুদা জিন্দাবাদ’ বলে। আমি কী যে করব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ দেখলাম তাজউদ্দীন সমানভাবে স্লোগান দিচ্ছে ‘লাঙল যার জমি তার’, ‘জমিদার নিপাত যাও’, ‘জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করাে’–একবারও বলছে না ‘মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’। এ স্লোগানে কাজ হলাে। তাদের চিৎকার থেমে গেল এবং আমাদের স্লোগান শুনে তারা যেন অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেল।
আমরা ক্যাম্পে পৌছে প্রথম দেখা পেলাম বাহাউদ্দীন চৌধুরীর। সে কোনাে রকমে প্রাণে বেঁচে মশাখালী থেকে এসেছে। তার খবর অনুযায়ী শামসুল হককে মাওলানা ধরে নিয়ে গেছে। আজাদ-এর রিপাের্টার আবুজাফর শামসুদ্দীনকে মেরেছে, তার সাইকেল পানিতে ফেলে দিয়েছে—ইত্যাদি নানা রকমের খবর। আমার ঢাকার সাহসী বীরপুরুষেরা সেখানে থাকতে রাজি নয়। তারা ছুরি মেরে অনেক মানুষ মেরেছে তাদের জীবনে, কিন্তু অত বড় রামদার সঙ্গে ছুরি চালানাে অসম্ভব ব্যাপার। পরের দিন তাদের ট্রেনে তুলে দিতেই হলাে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নূরুন্নবী চৌধুরী-ময়মনসিংহের পুলিশ
২২৪
বাহিনী পর্যাপ্ত নয় বলে ঢাকায় তার করেছেন—আরও বন্দুকধারী পুলিশের জন্য। কারণ তার ধারণা যে নেতারা যেদিন আসবেন, সেদিন একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যাবে।
নেতারা এলেন। নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা আজাদ সােবহানী, আবুল হাশিম। আমরা স্টেশনে গিয়েছি বন্দুকধারী পুলিশ সমভিব্যাহারে তাদের আনতে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নুরুন্নবী সাহেব ও পুলিশ সুপার নিজেরা উপস্থিত। দূরে দেখা গেল যে রামদার মিছিল আসছে—পুলিশ কর্ডন ভেদ করে কিছুসংখ্যক লােক প্ল্যাটফর্মে চলে এসেছে। লিয়াকত আলী খানের ‘ভেলে’ (দেখাশােনা করার। লােক) যেইমাত্র দরজা খুলছে, অমনি এক পাথর এসে লাগল তার মুখে। একটা দাঁত ভেঙে রক্ত পড়তে লাগল। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে তারা দূরে সরে গেল । বন্দুকধারী পুলিশরা পজিশন নিয়ে রাইফেল তাক করে ফেলল। শহীদ সাহেব নেমে এলেন প্রথম, তারপর আবুল হাশিম সাহেব, এরপর নাজিমুদ্দিন সাহেবকে দেখা গেল। বেঁটেখাটো মােটা মানুষটির আচকানের, নিচে টাইপ চুড়িদার পাজামা। তাঁর দুই হাঁটু এমনভাবে কাঁপছে যে তিনি আর কিছুতেই নামতে পারছেন না। নূরুন্নবী সাহেব তাঁকে হাত ধরে নামালেন। তারপর । নামলেন নবাবজাদা। ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সভার প্যান্ডেল পর্যন্ত পুলিশ তাঁদের পৌঁছে দিয়ে গেল। প্যান্ডেলের চারপাশে বন্দুকধারী পুলিশ। ছেলেরা, ভলান্টিয়াররা খড়ের ওপর শুয়ে আছে। তাদের খাবারদাবারের। তেমন ব্যবস্থা নেই। বক্তৃতা করলেন মিনিট দশেক খাজা নাজিমুদ্দিন, শহীদ সাহেব আধঘণ্টা। শহীদ সাহেব একটা কথা বললেন যে শামসুল হক বা অন্য কারও যদি কোনাে ক্ষতি হয়, তবে তার প্রতিশােধ মাওলানার ওপর উঠবেই—যখন তিনি পরিষদ সদস্য হয়ে কলকাতা যাবেন। আবুল হাশিম সাহেব তার বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, আমি মাওলানা শামসুল হুদাকে তুলনা করব না মীরজাফরের সঙ্গে, আমি তাকে তুলনা করব মােহাম্মদী বেগের সঙ্গে, যে সিজদারত সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করেছিল। তারপর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন আবুল মনসুর আহমদ সাহেব। অনেক প্রস্তাবের মধ্যে একটি প্রস্তাব তিনি উত্থাপন করলেন ‘বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’ বিষয়ে। ওই পরিস্থিতিতে ওখানে কেউ ‘বিনা খেসারত’ কথাটা নিয়ে কোনাে তর্ক উপস্থিত করেনি। কারণ ওটা প্রজা আন্দোলনের পুরােনাে শক্ত ঘাঁটি। নবাবজাদা বােধ হয় কিছু বােঝেননি। তাড়াতাড়ি সভা শেষ করে শেষের ট্রেনে তারা নবাবজাদা ও খাজা সাহেব ময়মনসিংহ চলে যাবেন—এ ছিল ব্যবস্থা। তারা খাস উর্দুতে বক্তৃতা করেছিলেন, যা মুসলিম লীগের লােকেরও কারও বােধগম্য হয়নি। ইংরেজিতে বললে হয়তাে অন্তত ছাত্ররা বুঝত ।
২২৫
আমাদের অধিবেশন শেষ হলাে। এখানে গিয়াসউদ্দিন পাঠানের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা হয়েছিল, যদিও তা হয়নি। অধিবেশনের রাতেই শামসুল হক সুস্থ শরীরে ফিরে এলেন। শুনলাম যে তিনি মাওলানার সঙ্গে স্বেচ্ছায় বাহাস (ধর্মীয় বিতর্ক) করতে গিয়েছিলেন।
মাওলানা শামসুল হুদার সংগঠনশক্তি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। তাঁর নিজস্ব একটি প্রেস ছিল। সেই ‘সেতারা প্রেস’ থেকে ট্রেডেল মেশিনে যে ছােট ছােট ছাপানাে বিজ্ঞপ্তি বেরােত, তাই লােকে বিশ্বাস করে ফেলত। ধর্ম এবং প্রজা-আন্দোলনের মধ্যে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য এনে মানুষগুলােকে সংগঠিত করেছে যারা মরতে ভয় পায় না। আমি শরীয়তুল্লাহ বা দুদু মিঞার ফরায়েজি আন্দোলন চোখে দেখিনি—কিন্তু এমারত পার্টির আমির মাওলানা শামসুল হুদার ক্ষমতা দেখে মনে হলাে—সে গফরগাঁওয়ে যেটা করতে পেরেছে সেটাই একটু বৃহৎ আকারে তিতুমীর বা হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং তাঁর ছেলে দুদু মিঞা করেছিলেন।
ঢাকায় ফিরে এসে শুনলাম যে শেখ মুজিবুর রহমান ইউসুফ আলী চৌধুরীর (মােহন মিঞা) নির্বাচন কেন্দ্রে কোনাে ভলান্টিয়ার বা ছাত্র পাঠাননি—কোনাে সাইকেল বা মাইক বা কোনাে পােস্টার বা বিজ্ঞপ্তি দেননি—তাই আমাকে চিঠি লিখেছেন ঢাকা থেকে তাকে ওসব পাঠাতে। আমি সে চিঠি কলকাতা পাঠিয়ে দিই। কারণ আমার মনে হচ্ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমান বুঝিবা তাঁর জেলার সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়াশীল নেতার নেতৃত্ব খতমের ব্যবস্থা নিয়েছেন। শেখ সাহেবকে কলকাতা থেকে যখন এ ব্যাপারে সত্যতা সম্পর্কে জানাতে বলা হলাে, তখন তিনি জবাব দিয়ে দিলেন, ‘মােহন মিঞা জমিদার, জেলা বাের্ড ও স্কুল বাের্ডের চেয়ারম্যান। তাঁর টাকার অভাব নেই। তার জন্য ব্যবস্থা করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। শুধু শুধু শেখ সাহেবের বদনাম করার জন্য ওই সব চিঠি। শেষে যখন নির্বাচনের ফল বেরােল, তখন বাংলাদেশে আমরা সর্বমােট ৬টি আসন হারিয়েছিলাম—তার মধ্যে মােহন মিঞার আসন একটি।
আর একটি ছােট ঘটনার কথা বলেই আমি ঢাকা জেলার নির্বাচনের কথায় আসব। নির্বাচনের দিন সাতেক আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাচন কেন্দ্রে প্রার্থী আলী আহমদ মােক্তার সাহেবের ছেলে সারওয়ার মাের্শেদ এসে আমাকে বলল যে তার বাবার পােলিং বুথের জন্য দুই হাজার টাকা স্যাংশন করা ছিল, তা এ যাবৎ আসেনি। এখুনি টাকাটা না হলে সব পণ্ড হয়ে যাবে। আমি জানতাম যে তার জন্য টাকা স্যাংশন আছে, কিন্তু টেলিফোন করে অর্থ কমিটির তিনজন সদস্যের মধ্যে কাউকে পেলাম না। সৈয়দ মােয়াজ্জেম উদ্দীন হােসেন চৌধুরী সাহেব বেরিয়েছেন সব অফিসের হিসাব পরীক্ষা করতে। তিনি পূর্ববঙ্গে
২২৬
জেলাসমূহে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রাজ্জাক সাহেব উত্তরবঙ্গে ও আহমদ ইস্পাহানি সাহেব গেছেন দিল্লি। কী করা যায়—প্রার্থীর ছেলেকে বসিয়ে রাখা যায় না। তাই আমার অফিস থেকেই দুই হাজার টাকা দিয়ে দিলাম। পরের দিনই সৈয়দ মােয়াজ্জেম উদ্দীন হােসেন সাহেব ঢাকা এলেন। তাঁকে আমি কথাটা বললাম। তিনি বললেন যে কালই তাে আলী আহমদ সাহেব আমার সঙ্গে কুমিল্লা দেখা করে দুই হাজার টাকা নিয়ে গেছেন। পরে কলকাতা গিয়ে। শুনলাম যে শহীদ সাহেবকে আলী আহমদ সাহেব তার করেছিলেন টাকার জন্য। শহীদ সাহেবও দুই হাজার টাকা টেলিগ্রাম মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আলী আহমদ সাহেব কোনাে সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকি নিতে চাননি। সবদিকেই খবর দিয়েছেন—ফলে দুই হাজার টাকার স্থলে ছয় হাজার টাকা পেয়ে গেলেন। এমনি অনেক ঘটনা হয়েছে। আমার মনে হয় চেষ্টা করলেও সারধারণ নির্বাচনে এসব সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
ঢাকা জেলায় দুটো নির্বাচন কেন্দ্র নিয়েই বিপদ হলাে। অন্যগুলাে তেমন শক্ত হবে বলে মনে হলাে না। আবদুল খালেক সাহেব কোনাে দিন রাজনীতি করেননি। তাই সেখানে কিছু ভালাে কর্মী পাঠানাে হলাে। আমি একবার গিয়ে দেখলাম বিপদ তেমন নেই। বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেসের আশ্রাফ আলী বেগ। তার সঙ্গে দেশের কারও তেমন সম্বন্ধ নেই। মুসলমানরা তখন কংগ্রেসকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। আপিলে আবদুস সেলিম উত্তর নারায়ণগঞ্জ থেকে মনােনয়ন পেয়েছেন। তার জমিদারি—কাজেই ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু হঠাৎ টেলিগ্রাম এল—Please send badges, ভাবলাম নির্বাচনে দাড়িয়ে ব্যাজটার জন্যও নির্বাচন অফিসের ওপর নির্ভর করতে হবে—এটা কেমন কথা। যাক আমি হাজারখানেক ব্যাজ তৈরি করে পাঠিয়ে দিলাম। পরে তার লােক এসে বলল যে তাঁর ভলান্টিয়ার নেই, কোনাে ছাত্র-কর্মী নেই। সে তাই চেয়েছে। আমি তাকে টেলিগ্রাম দেখালাম। পরে বুঝলাম, সে বলতে চেয়েছিল ‘ব্যাচেজ’ হয়ে গেছে ব্যাজেজ। শওকত মিঞা বললেন শেখ মুজিবুর রহমান যে কারণে মােহন মিঞাকে একঘরে করেছে, আমাদেরও সেলিম সম্বন্ধে তাই করা উচিত। আমি তার কথা শুনিনি। কারণ, সেলিম সাহেব শাহাবুদ্দীন নন, আর খাজা নসরুল্লাহ ও নবাব খাজা হাবীবুল্লাহও নন। নসরুল্লাহ নবাবের বিরুদ্ধে ছাত্রদের পক্ষ সমর্থন করে—সরদারদের হাতে মার খেয়েছে। তাই ঢাকা শহরে তাঁকে আমরা মনােনয়ন দিয়েছি। সেলিম সাহেবের ওখানেও কর্মী পাঠানাে হলাে। যে দুটো নির্বাচন কেন্দ্রে আমাদের অবস্থা গুরুতর হলাে প্রথম দিকটায়—সেগুলাে হলাে যে দুটো আসনে নবাব সাহেব প্রার্থী হয়েছেন। একটা নারায়ণগঞ্জ দক্ষিণ আর একটি ঢাকা উত্তর। আমাদের প্রার্থী যথাক্রমে খান সাহেব ওসমান আলী আর এ টি মাজহারুল
২২৭
হক। এদিকে আমার ধারণা ছিল গােড়াতে যে তিনি দাঁড়াবেন ঢাকা শহরে। ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েতের সরদারেরা তার লােক। তাই বহু পরিশ্রমে প্রতিটি মহল্লায় ঢাকার নব্য শিক্ষিত যুবকদের নিয়ে ক্লাব গঠন করতে থাকি। তারপর সব ক্লাবকে একত্র করে গঠন করি একটি কেন্দ্রীয় ক্লাব কমিটি। সভাপতি ডাক্তার নূরুর রহমান আর সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বংশালের শামসুল হুদা। এরা বাইশ পঞ্চায়েতের প্রতিদ্বন্দ্বী—এদের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে তারা আহসান মঞ্জিলকে তাদের বাপ-দাদার মতাে মানতে চাইল না। আমার সে পরিশ্রম ব্যর্থ হলাে।
খান সাহেব ওসমান আলী নারায়ণগঞ্জের লােক নন, এমনকি ঢাকা জেলায়ও তাঁর বাড়ি নয়। তাঁর দেশ কুমিল্লা। নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায়ী, তাই চাষাঢ়ায় বাড়িঘর করেছে। গাঁয়ের লােক তখনাে নবাবের বিরুদ্ধে এসব মধ্যবিত্ত লােকের কথা ভাবতে পারছে না। আবার ঢাকার উত্তরে উত্তরখান, বাড়া প্রভৃতি স্থানে ঢাকার নবাবের খুব প্রতাপ। নিজেদের জমিদারি। আর এ.টি মাজহারুল হক নবীন উকিল—তার ওপর আবার বার্মা ইকুইজ’-এর ব্যাপারটি জড়িত। নবাবপুত্র খাজা হাসান আসকারীও এ কেন্দ্রের প্রার্থী। নবাব সাহেব ভেবেছিলেন নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁর অবস্থা ভালাে হবে—ঢাকা উত্তরটা তার ছেলেকে ছেড়ে দেবেন। আমাদের ছেলেরা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের যে নবাব সাহেব ‘ক্ষেতুয়া’ বলে, ‘দেহাতি’ বলে ঘৃণা করে এটা গ্রামময় ছড়িয়ে দেওয়া হলাে ঢাকা শহরের গুন্ডারা কীভাবে গ্রামের ছেলেদের মেরেছে—মাথা ফাটিয়েছে, তুলে ধরা হলাে তার ফিরিস্তি। তবু তিন সপ্তাহ পরেই কেবল আমরা দুটো কেন্দ্রেই শক্তিশালী কয়েকটি ঘাঁটি তৈরি করতে পেরেছিলাম। বিশেষ করে বৈদ্যেরবাজারে ও রূপগঞ্জে। চতুর্থ সপ্তাহে একদিন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে দেখি খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেব আমার অফিসে বসে আছেন। আমাকে বললেন আমি আজই এসেছি। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন কেন্দ্র ছিল আমার জেলা বাের্ডের কেন্দ্র। আমার নিজের তৈরি লােকজন রয়েছে। আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি? আমি বললাম, নিশ্চয়ই, আসুন আমরা একত্রে কাজ করি। তিনি দু-তিন দিন ঘুরে এসে রিপাের্ট দিলেন, মানচিত্রে আমাদের কোথায় কী অবস্থা দেখানাে হয়েছে। নীল পেনসিলে আমাদের ঘাঁটি আর লাল পেনসিলে আমাদের বিপদ। দেখলাম, আমার কর্মীদের খবরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। বুঝলাম, সত্যি তার বিশ্বস্ত লােক রয়েছে ওই এলাকায়।
এর কিছুদিন পরে এক সভায় আমরা দুজনই বক্তা। একটি বৃদ্ধ লােক আমার বক্তৃতার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করল যে, আমরা বিপদে পড়লে কার কাছে যাব?’ আমি উত্তরে বললাম, প্রথমে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াবেন,
২২৮
তারপর গাঁয়ের লােক মিলে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কী করা যায়, তারই বুদ্ধি বের করার চেষ্টা করবেন। তা-ও যদি না হয়, ঢাকায় মুসলিম লীগ অফিসে যাবেন। তারা ব্যবস্থা করবে। সভার পর যখন গাড়িতে ঢাকা আসছিলাম, তখন খাজা সাহেব আমাকে বললেন, আপনার জবাবটার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। আজ যদি ওদের বলেন নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে, তবে আপনার নেতৃত্ব বেশি দিন চলবে না। ওরা একজনের ওপর নির্ভর করতে চায়—আর সেখানেই আমাদের স্থান। আমি তর্ক করলাম না; কিন্তু ভাবলাম, এ করেই এরা এতকাল নেতৃত্ব বজায় রেখেছে। খাজা নাজিমুদ্দিন ও খাজা হাবিবুল্লাহর মধ্যে ঝগড়ায় তাঁদের কথা হচ্ছে। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন।
ঢাকার উত্তরে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছিলাম কাদের সরদার সাহেবের। কাদের সরদারের এখনকার ধানমন্ডি, গুলশান, বাড়ায়, উত্তরখানে অনেক সম্পত্তি ছিল। তাঁর বিচার সবাই মেনে নিত। তিনি হঠাৎ নবাব সাহেবের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। এমনকি আমি নিজে ও খাজা শাহাবুদ্দীন তাঁর বাড়িতে গিয়ে মাজহারুল হককে কীভাবে পাস করানাে যায়, তা নিয়ে পরামর্শ করতাম। পরে বুঝলাম, নবাব সাহেব তাঁর পুত্রকে ওখানে দাঁড় করানাের ব্যাপারে তিনি আশা করেছিলেন যে নবাব যদি দুই জায়গা থেকেই পাস করেন, তবে নবাব সাহেব নারায়ণগঞ্জ আসন রেখে ঢাকা উত্তর তাকে ছেড়ে দিতে পারেন কিন্তু এখন বুঝলেন নবাবরা খানদানের বাইরে যেতে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন শেষ হলাে। ঢাকার সব কটি আসনই মুসলিম লীগ দখল করেছে। চারদিক থেকে কেবল বিজয়ের খবর।
কেবল বরিশালে আমরা তিনটি আসন হারালাম। শেরেবাংলা এবং তাঁর ডানে ও বায়ের কেন্দ্র দুটো। একটায় পাস করছেন হাতেম আলী জমাদার আর একজন মােহাম্মদ আফজল মােক্তার সাহেব। তা ছাড়া শেরেবাংলা খুলনার একটি আসন দখল করেছেন, ফরিদপুরে একটি আর মুর্শিদাবাদে একটি। ফজলুল হক খুলনার আসন ছেড়ে দিলেন। উপনির্বাচনে অবশ্যই আমরা জয়ী হলাম। অর্থাৎ ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৪টি। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শ্রমিকদের জন্য বিশেষ আসনে আমরা পেলাম ফজলুর রহমান সাহেব ও ডাক্তার আবদুল মােত্তালেব মালিককে।
এপ্রিল মাসের ২ তারিখে পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে নেতা নির্বাচন করার সঙ্গে সঙ্গেই গভর্নর তাঁকে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য কমিশন দিলেন। ইতিমধ্যে জিন্নাহ সাহেব ৯ এপ্রিল দিল্লিতে নির্বাচিত সব সদস্যের একটি কনভেনশন ডাকলেন।
২২৯
কনভেনশনে লাহাের প্রস্তাবের কোনাে সংশােধন করা হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। বিভিন্ন পুস্তকে (আমার A Socio-Political History of Bengal দ্রষ্টব্য)। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সে সম্বন্ধে আলােচনার প্রয়ােজন ছিল এবং সেটা তখন করাও হয়েছে, আমি তাই এখানে সে আলােচনা নতুন করে পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে চাই যে জিন্নাহ সাহেবের লাহাের প্রস্তাবকে কাউন্সিলের সঙ্গে পরামর্শ না করে পাকিস্তান নাম দেওয়া, মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে সংশােধনী এনে মুসলিম সংখ্যাগুরু প্রদেশসমূহের নেতাদের সংখ্যালঘু মুসলিম প্রদেশের নেতৃত্বের অধীনে আনা এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিকে লাগামহীন ক্ষমতা দেওয়া এবং কনভেনশন’ করে দুটো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলকে একটি দেশে পরিণত করার অপচেষ্টা শুধু ইসমাইলি, মেমন ও অন্য ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্যই তিনি করেছিলেন বলে আমার মনে হয়। প্রথম জীবনে দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত ও পরে পারিবারিক জীবনে নিষ্ফলতা এবং শেষ জীবনে শারীরিক অসুস্থতা—সব মিলে তাঁর দূরদৃষ্টির অভাব ঘটিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। স্ত্রী রতন বাঈয়ের সঙ্গে চার বছরের বেশি বন্ধন থাকেনি। তারপর একমাত্র কন্যা “ডিনা’কে পরিত্যাগ করতে হলাে কেবল এই কারণে যে ডিনা একজন পারসিকে বিয়ে করেছিল। ১৯৩৭-৩৮ সাল পর্যন্ত ইন্দিরা যেমন নেহরুকে রাজনীতি ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন, তেমনি করেছেন ডিনা জিন্নাহকে। কিন্তু যে কারণে বর্ণ-শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নেহরু ইন্দিরা গান্ধীর বিবাহে আশীর্বাদ করলেন, সে একই কারণে জিন্নাহ ডিনাকে ত্যাজ্য-কন্যা করলেন এবং মৃত্যুর সময় তার মুখদর্শন করেননি। অথচ ডিনার মা রতন বাঈ পার্সি আর ইন্দিরার মা ব্রাহ্মণ। ১৯৫৩ সালে যখন ডিনার সঙ্গে আমার লন্ডনে দেখা, তখন কথায় কথায় বললেন যে পিতার জন্য তার খুব দুঃখ হয়—জীবনে সে যে কত নিঃসঙ্গ! অথচ ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষবারের মতাে যখন। পিতা লন্ডনে এসেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ডাকে, তখন পিতার সঙ্গে যাতে দেখা না হয় সে জন্য ডিন প্যারিস চলে গিয়েছিল। ডিনা জানত তার পিতার কাছে ডিনার ক্ষমা নেই। যদিও সে একমাত্র মেয়ে তার। কনভেনশন থেকে ফেরার পরে আবুল হাশিম সাহেব তার নিজ গ্রামে প্রদেশের সব কর্মীর এক সভা আহ্বান করেন। তাঁর গ্রাম কাশীয়ারায়। বর্ধমান থেকে আমরা সকালে জিপে করে কাশীয়ারায় গেলাম। প্রথম দিন ছিল পান্তার ব্যবস্থা। আগের দিন থেকেই তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়েছে, শুকনাে ডাল, ভাজা মাছ, নানা ধরনের মাংসের রান্না আরও কত-কী! প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী শামসুদ্দিন সাহেবই কেবল বড়দের মধ্যে এসেছিলেন সে উপলক্ষে। আবুল হাশিম সাহেব রাতের সভায় বললেন যে কেউ যেন কোনাে মন্ত্রীকে কোনাে ব্যক্তিগত অনুরােধ না করে।
২৩০
কেবল সাধারণ মানুষের ভালাের জন্য যা করা প্রয়ােজন, তাই যেন করে তারা মুসলিম লীগের মারফত। তিনি আরও বললেন যে সমাজের জন্য আমাদের ত্যাগী কর্মী প্রয়ােজন। আর সংগঠনের জন্য তাে বটেই।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে সে সভায় এবং আলােচনায় যত কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলাে, তার কোনােটাই কর্মীরা যারা তখন নেতা হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই সেটা গ্রহণ করেননি। কলকাতা ফিরে এসে আর তারা যার যার জেলায় গেলেন না। কিছুদিন পরে ঢাকায় খবর এল যে আমাদের শামসুল হকও ইসলামিক সিন্ডিকেট’ বলে এক পকেট ফার্ম খুলেছে। ‘পারমিটের ব্যবসার জন্য। অন্যদের কথা নাই-বা বললাম—আর দুঃখ এখানে, সবাই একই কথা বলছে যে তারা ওটা করছেন পার্টির অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করতে। কোথায় গেল আদর্শ, দেশসেবা ও পরােপকার।
বাংলার মুসলমান পরিশ্রম করে ভাগ্য পরিবর্তন করতে শিখল না। এর আগে শহীদ সাহেব বেসরকারি সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী থাকাকালীন একদল পরিষদ সদস্য ‘পারমিট’, ‘লাইসেন্স’-এর ব্যবসা করে হঠাৎ বড়লােক হয়ে গিয়েছিল—আমাদের দল সে কথা বলেই মুসলিম লীগ সংগঠন দখল করেছিল। আজ দেখা গেল মানুষ ‘লােভের দাস। সুযােগ পেলে প্রলােভনকে চরিতার্থ করার জন্য সচেষ্ট হন না এমন লােকের অভাব দেখলাম যথেষ্ট । তারপর যা হওয়ার তাই হলাে। সবাই কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বেসরকারি সরবরাহমন্ত্রী গােফরান সাহেবের বাসায় ও অফিসে ঘােরাঘুরি করতে লাগলেন। আবুল মনসুর আহমদ সাহেব তার এক বইতে লিখেছিলেন যে বাঙালির চরিত্র এমন যে তারা বেহেশতে গিয়েও পাচার ব্যবসা না করে পারবেন না’–তাই বাঙালি যেখানে জন্মাচ্ছে, সেখানে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দিতে। অবশ্যই তিনি যাঁরা ওই ‘পারমিট-লাইসেন্সের ব্যবসা করেছিলেন, তাঁদের উদ্দেশেই উপরিউক্ত মন্তব্য করেছিলেন। বাঙালি একবার ক্ষমতায় এলে টাকা করা ছাড়া আর কোনাে আদর্শ থাকে না। এর কারণ বােধ হয় শহীদ সাহেবের সময়ই মুসলমানদের জন্য এই সহজ ব্যবসাটির দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। আরও দেখলাম যে অত সহজে টাকা করার ব্যবস্থা পেয়ে কেউ কষ্ট করে ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি হয়ে উঠল না। কোনাে কাজেই বােধ হয় বাঙালি ধরে রাখতে পারে না—নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দীর্ঘ পথ না বেছে সবচেয়ে সহজ উপায় খুঁজতে থাকে এবং সেটাকে সমর্থনীয় বলে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যুক্তির আশ্রয় নিতে পারে।
পরের মাসে শহীদ সাহেব ঢাকায় এলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই তাঁর প্রথম ঢাকা ভ্রমণ। তাঁর প্রথম কাজ হলাে আজীবন সাজা পাওয়া আন্দামানের আসামিদের ঢাকা জেল থেকে মুক্তি দেওয়া। সঙ্গে ছিলাম। অনেক নামকরা
২৩১
সন্ত্রাসবাদী বেরিয়ে এলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে হাত মেলালেন। সবার মুখেই হাসি। অবশ্যই তাদের মধ্যে আমার পরিচিত কেউ ছিলেন না।
৬ জুন মুসলিম লীগ মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করল অর্থাৎ ভারত বিভাগ ছাড়া কিছু মানব না, সেখান থেকে কনফেডারেশনের প্রস্তাব গ্রহণ করল মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের জুন মাসে। কিন্তু কংগ্রেস কনফেডারেশনের বিরােধী—তারা চায় ফেডারেশনের নামে মােটামুটিভাবে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার। এর বড় কারণ মাওলানা আজাদের স্থলে নেহরুর কংগ্রেসের সভাপতিত্ব গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, গান্ধীজির জিন্নাহকে সন্দেহ। এটা জিন্নাহ ও গান্ধী দুজনের মধ্যেই সমভাবে বিদ্যমান ছিল। এ মনােবৃত্তি আমার ওকালতি জীবনে দেখেছি অনেক জজের মধ্যে, ভালাে উকিল দেখলেই সন্দেহ হয় যে তাকে বুঝি ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাবে। ফলে গােড়াতেই কঠিন মন নিয়ে বসেন। এবং সহজ ব্যাপারটা গ্রহণ করতে ভয় পান। গান্ধী-জিন্নাহর মধ্যে ছিল সে ভাব। জিন্নাহর চৌদ্দ দফা সম্বন্ধে গান্ধীর যে মনােভাব ছিল—মিশন প্ল্যান গ্রহণের মধ্যেও সে মনােভাব দেখা দিল। গান্ধীজি ভাবলেন, জিন্নাহ মনে মনে দাবার ঘুটি চাল দিয়েছেন। তাকে ঠেকাতে হবে। তাই আসামের প্রধানমন্ত্রী বরদলইকে দিয়ে এক বিবৃতি দেওয়ালেন যে গ্রুপের মধ্যে যদি কেউ না থাকতে চায়, তবে তাকে জোর করে রাখা চলবে না। গান্ধীজি অমনি সে বিবৃতি সমর্থন করে বসলেন। এদিকে পণ্ডিত নেহরু বােম্বেতে বলে ফেললেন যে কংগ্রেস গণপরিষদে যাবে মুক্ত স্বাধীন সদস্য হিসেবে, কোনাে পরিকল্পনা দ্বারা তারা বাধ্য থাকবে না। ১৫ ডিসেম্বর বেনারসে আবার বললেন :
Whatever form of constitution we may decide in the Constituent Assembly will become the constitution of free India whether Britain accepts it or not. The British Government are thinking that the Constituent Assembly decisions are not binding on her. But we have not entered the Constituent Assembly in order to place our decisions on a silver plate and dance attendance on the British Government for their acceptance. We have now altogether stopped looking towards London… We cannot and will not tolerate any outside interference.
কংগ্রেসের অন্যান্য সদস্য তাঁর সঙ্গে একমত হলেন না এবং তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা ডেকে ওই ঘােষণাকে তার নিজস্ব ব্যক্তিগত মত বলে ঘােষণা করলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ নেতারা ভয় পেয়ে গেলেন এবং জিন্নাহ ২৮ জুলাই মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভা ডাকলেন নেহরুর বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করার জন্য।
২৩২
এ সময় বার্মা ইকুইজ ক্যাম্পের খবর প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং পুলিশ উপস্থিত কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করে। খান বাহাদুর ফজলুল করিম সাহেব ও তাঁর প্রায় সব ছেলেই কমবেশি এ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন, বিশেষ করে রেজাই করিম সাহেব। অথচ এর কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় উচ্চ পরিষদে (Council of State) মুসলিম লীগ মনােনীত প্রার্থী নূরুল হক চৌধুরী সাহেবকে বসিয়ে দিয়ে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য হন। সদস্য হয়েই তিনি মুসলিম লীগে যােগ দেন এবং তার গ্রেপ্তারকে রাজনৈতিক কারণ বলে বিবৃতি দেন কোর্টে যখন জামিনের জন্য আবেদন করেন।
২৮ তারিখে মুসলিম লীগের অধিবেশন আরম্ভ হয়। সারা দিন আলােচনা চলে। এ-ও প্রস্তাব করা হয় যে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া খেতাব ও উপাধি সবাই ত্যাগ করবেন। স্যার আজিজুল হক কী করে তার নাইটহুড’ ছাড়বেন—বিশেষ করে তিনি যখন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর । তাই তিনি রাতে পালিয়ে দিল্লি চলে গেলেন—বােধ হয় ভাইসরয়ের মত জানার জন্য। পরের দিন এসে তিনি প্রথম প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর তাঁর ‘নাইটহুড’ পরিত্যাগ করলেন। প্রথম প্রস্তাব ছিল ‘মিশন প্ল্যান প্রত্যাখ্যান’ এবং দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল খেতাব বর্জন। এক একজন মাইকের সম্মুখে উপস্থিত হন এবং খেতাব বর্জন করতে থাকেন, দেখা গেল শতকরা পঞ্চাশজন কাউন্সিল সদস্যের খেতাব ছিল। বাংলাদেশে যেহেতু খেতাবি লােক সংখ্যায় কম, তাই আমাদের ভয়ানক সংখ্যালঘু বলে মনে হলাে মঞ্চে মাইকের সম্মুখে। বােধ হয় তার জন্য নবাবজাদা খাজা নসরুল্লাহ মঞ্চে গিয়ে তাঁর নবাবজাদা উপাধি বর্জন করলেন। বলে ঘােষণা করে নিচে নেমে এসে বসতেই আবুল হাশিম সাহেব বললেন, “হারামজাদা’ নসরুল্লাহ। নসরুল্লাহ ভীষণ খেপে গেলেন। হাশিম সাহেব বললেন, ‘চট কেন।’ নবাবজাদা তােমার ব্রিটিশের দেওয়া খেতাব নয়, তােমার পিতা মরহুম নবাব সলিমুল্লাহর ছেলে বলেই তুমি নবাবজাদা’। সেই ‘নবাবজাদা’-কে তুমি যদি অস্বীকার করাে—তবে তুমি পিতাকে অস্বীকার করলে। ফলে তুমি হলে ‘হারামজাদা। সবাই হেসে উঠলেন। আনােয়ারা খাতুন ও খয়রাত হােসেন সমুদ্রপাড়ে গিয়ে পানিতে ঢেউ তুলে বললেন, “হে ঢেউ ওপারে আরবদেশের উপকূলে গিয়ে আমাদের ছোঁয়াইছ, সেখানে পৌঁছে। দিয়াে।”
৮ আগস্ট নেহরু অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করলেন মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে। ১১ আগস্ট ও ১২ আগস্ট খাজা নুরুদ্দীন, খাজা নাজিমুদ্দিন ও পাঞ্জাবের রাজা গজনফর আলী বক্তৃতা করলেন যে তাদের সংগ্রাম ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং দিল্লি সরকারের বিরুদ্ধে। ১৩ তারিখে আবুল হাশিম পরিষ্কার ভাষায় বিবৃতি দিলেন মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ দিবস’ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে,
২৩৩
যারা দুটো সম্প্রদায়কে বিভক্ত রেখে তাদের রাজত্ব আবার কায়েম করতে চায় ।
ঢাকা শহরে আমি আর শামসুদ্দীন ঘােড়ার গাড়ি করে ওই কথাই বললাম এবং কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের সহযােগিতা চাইলাম। কলকাতায় ১৬ তারিখে দাঙ্গা বেঁধে গেল—অথচ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পীঠস্থান ঢাকায় কোনাে দাঙ্গা সংঘটিত হলাে না। কমিউনিস্ট পার্টির জ্ঞান চক্রবর্তী ও কংগ্রেস সম্পাদক বীরেন পােদ্দার আমাকে আগেই বলেছিলেন যে গােলমাল করতে পারে শহরের মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডরা। কারণ ন্যাশনাল গার্ডরা খাজা নূরুদ্দীনের ভাষায় কথা বলছে। আমি হাশিম সাহেবকে টেলিফোনে বললাম নায়েবে সালারে সুবা জহীরুদ্দীন সাহেবকে ঢাকা পাঠাতে । জহির সাহেব এলেন এবং আমরা দুজনে মােটরযােগে মিছিলের অগ্রভাগে থাকলাম। চকবাজার থেকে বেরােনাের সময় সৈয়দ আবদুর রহিম পরিচালিত খাকছার বাহিনী তাদের বেলচা নিয়ে সম্মুখের সারিতে দাঁড়াবে, এটা মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডরা মেনে নিতে পারল না। যাকগে, কোনাে দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমরা তাদের বললাম যে ন্যাশনাল গার্ড থাকবে আমাদের গাড়ির ডানে আর খাকছার থাকবে বায়ে। দুই দলই মেনে নিল । মিছিল ইসলামপুর ছেড়ে পাটুয়াটুলী ঢুকেছে, তখন জ্ঞানবাবু আমার গাড়ির কাছে এসে বললেন যে কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। আমি তখনই স্থির করলাম যে সমস্ত শহর ঘােরা উচিত হবে না। সােজা সিরাজ-উদ-দৌলা পার্কে প্রসেশন নিয়ে গিয়ে ওখানেই সভা শেষ করে সবাইকে বাড়ি যেতে বলব। সভার সভাপতি আমি আর প্রধান বক্তা জহিরউদ্দীন। কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরাও বক্তৃতা করলেন। ভালােয়-ভালােয় দিনটা কেটে গেল। অফিসে এসে পৌছেছি সন্ধ্যার পর। এসেই শুনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে খুব উত্তেজনা চলছে। কারণ, সৈয়দ সাহেবে আলম গাড়িতে ঘুরে ঘুরে বলে বেড়াচ্ছেন যে শহীদ সাহেবের গাড়িতে বােমা মেরেছে—ইস্পাহানি ভয়ানকভাবে আহত হয়েছে। আমি অনেক কষ্টে কলকাতার লাইন পেলাম। শহীদ সাহেব বললেন, সব মিছে, আমি ভালােই আছি। হাসানও আমার ঘরে আছে। টেলিফোনে কথা শেষ করে আমি সলিমুল্লাহ হলে গেলাম এবং আমার সঙ্গে শহীদ সাহেবের কথাবার্তার কথা বললাম। কিছু দুষ্ট ছেলে যারা গােলমাল করতে চায়, তারা আমাকে মিথ্যেবাদী বলে উঠল। ফলে গােলমালের সৃষ্টি হলাে। যাকগে বেশির ভাগ ছেলেই আমার কথা বিশ্বাস করল, যার ফলে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলাে। আশ্চর্য, ১৯২৬ সালে দাঙ্গায় ইন্ধন জোগাতে দেখেছিলাম খানবাহাদুর সৈয়দ আবদুল হাফিজকে আর ১৯৪৬ সালে দেখলাম তার আপন ছােট ভাই একই কাজ করছে। এরা কাদের দালালি করছিল আজও বুঝলাম না। ১৭ ও ১৮ আগস্ট ভালােই কাটল, তবে শহরে থমথমে ভাব। হিন্দুরা মুসলমান অঞ্চল
২৩৪
থেকে সরে যাচ্ছে, মুসলমানরাও তাই করছে। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, মুসলিম লীগ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে দাঙ্গা বন্ধের জন্য। ১৮ তারিখে সকালবেলা ফরওয়ার্ড ব্লকের অফিস ৩ নম্বর জনসন রােড (এখন লিয়াকত অ্যাভিনিউ) থেকে টেলিফোন পেলাম যে কংগ্রেস কমিউনিস্ট পার্টি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতারা ওখানে বসেছেন এবং হিন্দু মহাসভার পঙ্কজবাবু ও গিরিশবাবুকে ডাকা হয়েছে। আমি যদি যেতে পারি ভালাে হয়। কারণ কোর্টের কাজ রয়েছে, অনেকের পক্ষে তাই ১৫০ নম্বর মােগলটুলী যাওয়া অসুবিধা। আসল কারণ হচ্ছে যে কলকাতা থেকে এমন ভয়ানক খবর আসছে। যে এখন সবাই একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। তাই হিন্দু নেতারা চকবাজারের কাছে আসতে চায় না।
আমি ৩ নম্বর জনসন রােডের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সবাই উপস্থিত—বৃদ্ধ শ্ৰীশ চ্যাটার্জি, বীরেন পােদ্দার, জ্ঞান চক্রবর্তী, পঙ্কজ ঘােষ, গিরিশ দাশ, অনীল রায়, তার স্ত্রী লীলা রায়, জগন্নাথ কলেজের লেকচারার সমর গুহ—শেষের তিনজন ফরওয়ার্ড ব্লকের। অনীল রায় স্বল্পভাষী, অন্যদিকে লীলা রায়ের (বিয়ের আগে ছিলেন লীলা নাগ। ঢাকার লােক তাকে সে নামেই বেশি জানত।) ছিল বহির্মুখী চিন্তাধারা। আলােচনার শেষে আমার এ ধারণা জন্মাল যে তাদের মধ্যে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে আমরা হাজার চেষ্টা করেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধ করতে পারব না। লীলা রায় আমাকে বললেন, ‘ধরুন, যদি দাঙ্গা লেগেই যায়, তবে আমাদের কর্তব্য কী হবে সে সম্বন্ধে আপনি কোনাে চিন্তা করেছেন কি? আমি বললাম, আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আমরা সবাই মিলে কাজ করলে প্রতিরােধ করা যাবে। তবে আপনি বললেন, আমি চিন্তা করব। প্রথম কথা আমাদের দেখাশােনা বন্ধ হয়ে যাবে। কেবল টেলিফোন মারফত শান্তি আলােচনা চালানাে যাবে না। লীলা রায় বললেন যে ‘আপনি সরকারি দলের লােক। সুতরাং আপনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কক্ষে আমাদের মিটিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি বললাম, আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করে দেখব। আমি খুব নিরাশ হয়ে পার্টি অফিসে ফিরলাম। নিজেদের মধ্যে আলােচনা করলাম এবং কর্মীদের সাবধান দৃষ্টি রাখতে বলা হলাে। ১৯ তারিখে সন্ধ্যাবেলা খবর এল যে নবাবপুর রেলক্রসিংয়ের ওপর একজন গ্রামের লােক ছুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে। ১৯ তারিখ রাতে বেশ কিছুসংখ্যক মৃত ও অর্ধমৃত লােককে হাসপাতালে আনা হলাে। মাঝরাত থেকে শুরু হলাে শহরের চারদিকে বন্দে মাতরম’ ও ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগানের প্রতিযােগিতা। দুদলেরই ধারণা, তারা আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। ১৯ তারিখ রাতে বহু চেষ্টা করেও শহীদ সাহেবকে ফোনে পেলাম না।
২৩৫
২০ তারিখে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেবের ঘরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মনজুর মাের্শেদ ও এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ সুপার বৈঠকে বসলেন। স্থির হলাে যে একটি শান্তি কমিটি গঠন করা প্রয়ােজন। শ্ৰীশ চ্যাটার্জি সভাপতি, আমি সম্পাদক, বীরেনবাবু যুগ্ম সম্পাদক আর অন্য নেতারা কমিটির সদস্য। আমাদের অর্থাৎ মুসলমানদের আলােচনা বৈঠক হলাে কাদের সরদার সাহেবের বাড়িতে। ওখানে কফিলুদ্দীন চৌধুরী সাহেব, আতাউর রহমান সাহেব, আসাদুল্লাহ সাহেব এবং অন্য সবাই একত্র হয়ে কী করা যায় তার পরিকল্পনা হতাে এবং এ ব্যাপারে কাদের সরদার সাহেব, জুম্মন ব্যাপারী সাহেব, মতি সরদার সাহেব—এঁদের সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল যথেষ্ট। জুম্মন ব্যাপারীর গাড়িখানা প্রায়ই আমাদের কাজেই ব্যবহৃত হতাে। অবস্থা ক্রমেই গুরুতর হতে শুরু করল। শান্তি কমিটি নানা প্রকার বিপদের সম্মুখীন হতে লাগল। আমাদের জন্য দুটো বন্দুকধারী পাঠান পুলিশ দেওয়া হলাে। তা সত্ত্বেও উর্দু রােডে আমরা গুন্ডা দ্বারা আক্রান্ত হলাম । ভাগ্য ভালাে, ঠিক তখনই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খবর পেয়ে পুলিশ পাঠিয়ে আমাদের উদ্ধার করল। আর এক দিন জগন্নাথ সাহা রােডে আমরা সভা করছি, এমন সময় একজন হিন্দু ভদ্রলােক দা নিয়ে হঠাৎ ঢুকে পড়ল আমাকে খুন করার জন্য। সমর গুহ তাকে ধরার চেষ্টা করে আহত হলাে এবং শেষ পর্যন্ত লীলা রায় অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দাখানা ধরে। ফেলল। পরে বুঝলাম যে কিছুক্ষণ আগেই সে খবর পেয়েছে যে তার ছেলেকে মুসলমানরা মেরে ফেলেছে। তাই আমার ওপর প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য এসেছে। আমার মনে হয় লীলা রায়ের সাহস এবং সুবুদ্ধির জন্যই সে যাত্রা রক্ষা পেলাম।
সম্মুখ-লড়াই হতাে ভিক্টোরিয়া পার্কের মােড়ে। কলতাবাজার, রায় সাহেবের বাজারের মুসলমানরা একদিকে, অন্যদিকে শাঁখারীপট্টি, তাঁতীবাজার ও বাংলাবাজার এলাকার হিন্দুরা। দক্ষিণ মৈশুণ্ডি, পুরানা মােগলটুলী, পাটুয়াটুলী ও ইসলামপুরের সংগমস্থলে, আরমানিটোলা ও বেচারাম দেউড়ী, মিটফোর্ড ও চক মােগলটুলী প্রভৃতি কতগুলাে স্থানে প্রায়ই মুখােমুখি মারামারি চলত। সরদার সাহেবের বাড়িতে অনেক দিন আলােচনার পর কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা হলাে। এক. মিটফোর্ডের সব ডাক্তারই হিন্দু; সুতরাং মুসলমান আহতরা রক্তপাতের জন্যই বেশির ভাগ মারা যাচ্ছে। তাই একজন মুসলমান সিভিল সার্জন চাই। দুই, বন্দুকধারী পুলিশের সবাই যেহেতু গাড়ােয়ালি বা গুর্খা, সুতরাং গরিব মুসলমানদের ওপরই অত্যাচারটা বেশি চলছিল। তাই একজন মুসলমান পুলিশ সুপার চাই। তিন ‘পিউনিটিভ ট্যাক্স মিউনিসিপ্যালিটি ট্যাক্সের অনুপাতে হতে হবে, নইলে
২৩৬
মুসলমানরা বাড়িঘর বিক্রি করেও ওই ট্যাক্স দিতে পারবে না। সুতরাং ট্যাক্সের দায়ে তাদের জেল খাটতে হবে।
কলকাতা গিয়ে শহীদ সাহেবকে এসব কথা বলা হলাে। তিনি মনােযােগ দিয়ে শুনলেন। আমাকে পরের দিন আবার দেখা করতে বললেন। পরের দিন তাঁর দেখা পেলাম না। বাড়িতে খেতেও আসেননি। কেউ বলল লালবাজার, কেউ বলল রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। কোনাে স্থানেই পেলাম না। তৃতীয় দিবসে সাক্ষাৎ পেলাম। তিনি বললেন, ‘আইজি টেলরকে অনেক বােঝাতে হয়েছে। কারণ, মুসলমান পুলিশ সুপার হওয়ার মতাে কোনাে সিনিয়র অফিসার নেই। জাকির হােসেনের সিনিয়রিটি আছে, তবে সে “কনডেমড” হয়ে আছে, তার নিচের লােক প্রমােশন পেয়ে গেছে। তাকে কলকাতা বন্দরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত টেইলর রাজি হয়েছেন জাকিরকে ঢাকার পুলিশ সুপার করতে। ঢাকার পুলিশ সুপার ডিআইজি হবে। আর ডিআইজি হডসনকে বদলি করে আনা হবে কলকাতায়। ঢাকার সিভিল সার্জনও চিরকালই ঢাকায় শ্বেতাঙ্গ অফিসার হয়ে আসছে। এখানেও মুসলমান সিনিয়র ডাক্তার নেই। দু-একজন যা আছে তাদেরও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই। মােহাম্মদ আলীকে (তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী) বলে দেখাে রেফাতুল্লাহকে নিতে পারাে কি না। আমি মােহাম্মদ আলীকে বলেছি।’ মােহাম্মদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। বিশেষ কোনাে কাজ হলাে না। আবার শহীদ সাহেবকে বললাম। তিনি ব্যবস্থা করলেন। পিউনিটিভ ট্যাক্সের ব্যাপারেও তিনি ব্যবস্থা করতে রাজি হলেন।
একদিন আমি ছিলাম আবুল হাশিম সাহেবের ওখানে অর্থাৎ ৩৭ নম্বর রিপন স্ট্রিটে, সাপ্তাহিক মিল্লাত অফিসে। মনুজান হােস্টেল থেকে উদ্ধার করা মুসলমান মেয়েদের এবং তাদের সুপারিনটেনডেন্ট নূরজাহান বেগমও ওখানে আছেন। আমাদের ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ তাদের সংস্পর্শে এসে নিজেদের জীবনযাত্রা স্থির করে ফেলেছেন।
২৪ আগস্ট লর্ড ওয়াভেল কলকাতা এসেছিলেন। তাঁকে আমাদের নেতারা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, এ দাঙ্গার জন্য তিনিই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। কংগ্রেসকে একতরফাভাবে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে হিন্দুদের মুসলমান-নিধনে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমাকে বলা হলাে, ওয়াভেল পূর্ববঙ্গের খবর নেওয়ার জন্য শিগগিরই ঢাকা যেতে পারেন। বিশেষ করে ২৯ আগস্ট নােয়াখালীতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁর পক্ষে পূর্ববঙ্গে যাওয়া স্বাভাবিক। কী ধরনের কথা মুসলিম লীগ নেতারা বলেছেন, তাও বলে দিলেন। আমাদের বক্তব্যও যাতে সেদিকে লক্ষ করে উপস্থিত করা হয়, তাও বলে দিলেন। কে কে প্রতিনিধিত্ব করবেন জিজ্ঞাসা করলে আমি বললাম, সর্বজনাব কফিলউদ্দীন চৌধুরী এবং
২৩৭
আতাউর রহমান খানদের নেওয়া উচিত। কারণ, তারা দাঙ্গায় খেটেছেন। শহীদ সাহেব বললেন, “তােমরা তিনজনই “দেহাতি”, শহর থেকে শেফাউলমুলক হেকিম হাবিবুর রহমান সাহেব এবং সরকারি পক্ষ থেকে আমার পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি খাজা নসরুল্লাহ থাকবেন। আমি সেভাবেই কমিশনার হল্যান্ডকে ইনস্ট্রাকশন দেব। শহীদ সাহেব আরও বললেন, আরও কিছুদিন থেকে যাও। জাকিরকে ও রেফাতুল্লাহকে যদি সঙ্গে না নিয়ে যাও, তবে আবার ফাইলচাপা পড়বে। আমার সব দিকে তাকানাের সময় নেই। আমার প্রায় সপ্তাহখানেক সময় নষ্ট হলাে দপ্তরের খবর নিতে।
২৯ আগস্ট নােয়াখালীতে দাঙ্গা আরম্ভ হলাে। দাঙ্গায় খুনখারাবির চেয়ে বেশি চলল মুসলমান মৌলভিদের বেহেশতে স্থান করার চেষ্টা। হিন্দুদের মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করা। তাদের পরে গােমাংস খাইয়ে দেওয়া। ক্ষমতাশালী কলকাতার হিন্দু মালিকানাধীন সংবাদপত্রসমূহ নােয়াখালীকে ভীষণ আকারে ফুটিয়ে তুলল। তিন সপ্তাহ পরে যখন অবস্থা আয়ত্তে এসে গেছে, তখন গান্ধীজি নােয়াখালীর পথে কলকাতা এসে পৌছালেন। তিনি কলকাতা এসে পৌছার তিন-চার দিন আগে বিহারে ভীষণ দাঙ্গা আরম্ভ হলাে। গান্ধীজিকে বলা হলাে যে তার পাটনা যাওয়া উচিত। এ-ও বলা হলাে যে তিনি নােয়াখালীতে যাচ্ছেন বিশ্বের দৃষ্টিকে বিহারের অমানুষিক হত্যাকাণ্ডকে ছােট করে দেখাতে। গান্ধীজি অটল। এক কথা, তিনি যখন নােয়াখালীর উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন, তখন বিহারে দাঙ্গা ছিল না। তিনি মাঝপথে তার গন্তব্যস্থল পরিবর্তন করে নতুন জায়গায় যেতে পারেন না। নােয়াখালীতে যেমন তিনি সরকারকে তিন সপ্তাহের বেশি সময় দিয়েছেন, তেমনি বিহার সরকারকেও দিতে চান।
এদিকে ১৯৪৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর শেরেবাংলা জিন্নাহকে এক চিঠি লেখেন তার অতীতের দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে এবং অদ্ভুত ব্যাপার, জিন্নাহও এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করলেন এবং তাঁকে আবার মুসলিম লীগের সদস্য হওয়ার অধিকার দিলেন। অনেকেই মনে করলেন, এটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্যই সম্ভব হয়েছে। ফজলুল হক মনে করেছেন, এমন বিপদের দিনে মুসলমানদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। হয়তাে জিন্নাহও তাই ভেবে এবার আর তার সঙ্গে অপমানসূচক ব্যবহার করেননি। অন্যদিকে কেউ কেউ ভাবলেন এটা খাজা সাহেবদের চাল। আবুল হাশিমকে শেষ আঘাত হানার কৌশল মাত্র।
১৫ অক্টোবর মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তীকালের কেন্দ্রীয় সরকারে যােগদান করে। জিন্নাহর মনােনীত মন্ত্রীদের নাম হলাে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, রাজা গজনফর আলী, আই আই চন্দ্ৰীগড়, আবদুর রব নিশতার ও বাংলা
২৩৮
থেকে যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। যােগেন মণ্ডলকে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কেন বেছে নিলেন, তা কারও মাথায় যায়নি। কেউ বললে সংখ্যালঘুদের অভয় দিতে, কেউ বললে, বিশ্বকে জানাতে যে মুসলিম লীগের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনােবৃত্তি নেই।
লর্ড ওয়াভেল ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা এসে পৌছালেন এবং কমিশনারের কাছ থেকে আমাদের অফিসে চিঠি দিলেন তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় জানিয়ে । অফিস থেকে শেফাউল মুলক, হেকিম হাবিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান সাহেব, কফিলুদ্দীন চৌধুরী সাহেব ও নবাবজাদা নসরুল্লাহকে যথাসময়ে জানিয়ে দেওয়া হলাে। দ্বিতীয় কাজ হলাে ‘মেমােরেন্ডাম’ তৈরি করা। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মনজুর মাের্শেদের শরণাপন্ন হলাম এবং তাকে কলকাতা মুসলিম লীগ ‘মেমােরেন্ডামের সারমর্ম বলে দেওয়া হলাে এবং তিনি খুব সুন্দর একটি খসড়া তৈরি করে দিলেন। আমরা সেই মেমােরেন্ডাম। প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবেই সুন্দর কাগজে টাইপ করে তৈরি করে ফেললাম। আমরা কে কী বলব তা-ও ঠিক হলাে মেমােরেন্ডামের পরিপ্রেক্ষিতে।
১৯ ডিসেম্বর শহীদ সাহেব শেষ পর্যন্ত দৈনিক কাগজ ইত্তেহাদ বের করলেন। সম্পাদক হলেন জনাব আবুল মনসুর আহমদ। ম্যানেজার হলেন। নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী এবং সুপারিনটেনডেন্ট হলেন জনাব তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া।
প্রথম দুজন বাংলার মুসলমানদের কাছে সুপরিচিত ছিলেন রাজনীতিবিদ হিসেবে। আবুল মনসুর সাহেবের সাংবাদিক, সাহিত্যিক হিসেবে তাে নাম ছিল খুব। সেদিক থেকে মানিক মিয়া তখন পর্যন্ত কি সাংবাদিকতায় কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছিলেন অপরিচিত। বিএ পাস করার পর পিরােজপুরে মুনসেফ কোর্টে একটি চাকরি গ্রহণ করেন। তাঁর ওই চাকরির সময় তিনি শহীদ সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হন। সে পরিচয়ের ফলে মুসলিম লীগ সরকার গঠন হওয়ার পর বাংলাদেশে তথ্যমন্ত্রীর বিভাগীয় দপ্তরে তার চাকরি হয়। সে চাকরিতে তিনি বহাল ছিলেন বহুদিন পর্যন্ত। তারপর শহীদ সাহেব তাঁকে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ অফিসের সহকারী দপ্তর সম্পাদক পদে বহাল করেন। তখন দপ্তর সম্পাদক ফরমুজুল হক সাহেব। ইত্তেহাদ বের হলে তাঁকে অফিস সুপারিনটেনডেন্টের পদে বহাল করা হয়। পাকিস্তান হওয়ার বছরাধিক কাল পর শহীদ সাহেব পাকিস্তানে চলে আসেন, দৈনিক ইত্তেহাদও বন্ধ হয়ে যায়। মানিক মিয়াও ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৫০ নম্বর মােগলটুলী পার্টি অফিসে অবস্থান করতে থাকেন। আমাদের সেই পার্টি অফিসটি-কলকাতা থেকে আগত ছাত্র-কর্মী সবারই প্রথম পান্থশালা হিসেবে পাকিস্তান হওয়ার পরে ব্যবহার করা হয়েছে।
২৩৯
ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট এটলি ঘােষণা করেন যে ভারতবর্ষকে ১৯৪৮ সালের জুন মাসের আগেই পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন :
As a whole to some form of central Government for British India or in some areas to the existing provincial Governments, or in such other way as may seem most reasonable in the interest of Indian People.
ওই স্বাধীনতা কার কাছে হস্তান্তর করা হবে তা বলতে গিয়ে এটলি তিনটি সম্ভাব্য সরকারের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমে কোনাে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সম্ভব না হলে প্রাদেশিক সরকারসমূহের কাছে অথবা যদি অন্য সরকার। সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তার কাছে। ওই বিবৃতির ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল চার মাস পরে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন। স্যার স্ট্যাফর্ড ১৯৪২ সালে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন কিন্তু সেটা স্বাধীন বাংলা গঠন করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। এটলির এ বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতেই লর্ড ওয়াভেল তাঁর প্রধান উপদেষ্টা জর্জ এবেলের সাহায্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, যেটাকে তারা নাম দিয়েছিলেন ‘Opperation Ebb-Tide। এই পরিকল্পনার আসল কথা হলাে, যে প্রদেশের পক্ষে সম্ভব হবে সরকারের দায়িত্ব নেওয়া, তাদের স্বাধীনতা দিয়ে সৈন্যদের সেখান থেকে তুলে নেওয়া। এমনি করে সৈন্যদল বিভক্ত না করে শৃঙ্খলার সঙ্গে ব্রিটিশ রাজ ভারত ত্যাগ করবে। লর্ড এটলি অবশ্যই ওই পরিকল্পনা নাকচ করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে লর্ড ওয়াভেলের পরিকল্পনা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, এ যেন সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণের এবং শেষ পর্যন্ত ঘাঁটি পরিত্যাগ করার পরিকল্পনা। অর্থাৎ “The plan submitted by lord Wavell for transferring power looked like a scheme of military retreat and evacuation.’
লর্ড ওয়াভেলের ওই পরিকল্পনার আভাস পেয়ে যায় প্রথম শরৎ বােস, যদিও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে, তবু ভাইসরয়ের উপদেষ্টাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বজায় ছিল। এ খবর ভি পি মেননের মারফত কংগ্রেসও পেয়েছিল। বলদেও সিং এ খবরটা শিখ সম্প্রদায়ের কাছে পৌছালে সেখানেই প্রথম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং মাস্টার তারা সিং শিখদের জন্য পাঞ্জাবে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি জানান (a homeland for the Sikhs)। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যত দিন রণজিৎ সিং জীবিত ছিলেন, তত দিন পর্যন্ত তাদের আধিপত্য ছিল সমস্ত পাঞ্জাবের ওপর। ব্রিটিশ শাসনামলে ধীরে ধীরে সে ক্ষমতা মুসলমানদের
২৪০
হাতে যেতে থাকে এবং পাঞ্জাবের স্বাধীনতা অর্থে শিখরা মনে করল পাঞ্জাবি মুসলমানদের শাসন কায়েম । এটা তাদের কাছে একেবারেই গ্রহণীয় ছিল না। তাই ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখে শিখরা পাঞ্জাবকে ভাগ করার জন্য আন্দোলন আরম্ভ করে।
এদিকে ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি পদের জন্য প্রার্থী হন। যদিও তখনাে মাওলানা আকরম খাঁর পদত্যাগপত্র সরকারিভাবে মুসলিম লীগের সম্পাদকের কাছে এসে পৌঁছায়নি। এরপরেই মাওলানা সাহেবের পদত্যাগপত্র আবুল হাশিম সাহেবের কাছে পৌছায় এবং আবুল হাশিম সাহেবও ওই পদের জন্য প্রার্থী হন। আবুল হাশিম সাহেব সভাপতির ইস্তফাপত্র বিবেচনা ও পদত্যাগপত্র গৃহীত হলে সভাপতি নির্বাচনের জন্য ৯ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভা আহ্বান করেন। ফজলুল হক সাহেব ছাত্রদের সমর্থন আদায় করার জন্য কলকাতায় একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য আরও ছাত্রাবাস তৈরি করার পরিকল্পনা ছাত্রদের সম্মুখে পেশ করেছেন। তার জন্য ইসলামিয়া কলেজের তৎকালীন উত্তর প্রদেশবাসী অধ্যক্ষ জুবেরী সাহেব ফজলুল হক সাহেবের । পক্ষে নির্বাচনী অভিযান চালাতে থাকেন। অপর পক্ষে আবুল হাশিম সাহেবের পক্ষে যারা ছাত্রনেতা ছিলেন, তাঁদের তাে বেশির ভাগ জুবেরী সাহেবের ছাত্র। ঢাকার কাউন্সিলরদের নিয়ে আমরা যখন কলকাতা পৌছালাম, তখনই আমার মনে হলাে যে যুব জনমত আমাদের বিপক্ষে। আমি আর শামসুল হক শহীদ সাহেবের বাসায় গেলাম রাতে। গিয়ে দেখি তার ওখানে ফজলুর রহমান সাহেব রয়েছেন। আমরা শহীদ সাহেবকে বললাম যে পরিস্থিতি এমন ঘােরালাে হয়ে গেছে অথচ কলকাতার কাউন্সিলররা আমাদের বললেন যে আপনি এ ব্যাপারে কোনাে পক্ষই সমর্থন করতে চান না। সুতরাং কলকাতার কাউন্সিলররা নিরপেক্ষ থাকবেন। তিনি উত্তর দেওয়ার আগেই ফজলুর রহমান সাহেব তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বললেন :
Prime Minister has taken a very laudable attitude and he should not mix himself up with this politics of the mother-organization. Any one who mould be elected would be welcomed by him and members of his cabinet.
আমি একটু অবাক হলাম। বললাম যে যদি ফজলুল হক আজ মুসলিম লীগের সভাপতি হন, তবে আগামীকাল তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। শহীদ সাহেব কোনাে কথার মধ্যেই এলেন না। সুতরাং আমাদের আর কিছু করার
২৪১
থাকল না। ৯ তারিখে ছাত্ররা ভীষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগল মুসলিম ইনস্টিটিউটের সম্মুখে। রাস্তায় আবুল হাশিম সাহেবের ওপর হামলার চেষ্টা করল। মনে হলাে যেন লােহার রেলিং এবং গেট ভেঙে বিক্ষোভকারীরা হলে ঢুকে পড়বে। ঠিক এ সময় কোথা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব একাই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ালেন। আমি অবাক হলাম তার সাহস দেখে। অন্য ছাত্রনেতারা দোতলার সিঁড়ি এবং ঘরে বসে বিক্ষোভ দেখছে। আমার ভয় হলাে যে বিক্ষোভকারীরা শেষ পর্যন্ত গেট ভেঙে ঢুকে পড়বে এবং সবাই ঝাপিয়ে পড়বে মুজিবুর রহমানের ওপর। যাক ইতিমধ্যে মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডস সালারে-সুবা আইআই মােহাজের ও নায়েবে সালারে-সুবা জহিরুদ্দীন সাহেব তাঁদের গার্ডদের নিয়ে ঢুকে পড়ে পজিশন নিয়ে নিল। ভেতরেও গােলমালের আশঙ্কা দেখা দিত যদি এরই মধ্যে খবর পাওয়া না যেত যে মাওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে অনুরােধ করা হয়েছে তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে। বােঝা গেল সবটাই ছিল অভিনয়। প্রতিক্রিয়াশীল দলের ষড়যন্ত্র । বিশেষ করে খাজা শাহাবুদ্দীনের একটি চাল। এক গুলিতে দুটো বাঘ শিকার। এ কে ফজলুল হক সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিভক্ত হলাে বামপন্থী যুব সম্প্রদায়। ফজলুল হক সাহেব আবার বছর সাতেকের জন্য রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হলেন আর আবুল হাশিম সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। যেহেতু তিনি মনে করলেন যে শহীদ সাহেব প্রথম থেকেই ষড়যন্ত্রের কথা জ্ঞাত ছিলেন। এবং এ ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও পরােক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাই তিনি স্থির করলেন যে তিনি আর মুসলিম লীগের সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক রাখবেন না। আমরা তাঁকে বােঝাতে চেষ্টা করলাম যে রাজনীতিতে অভিমানের স্থান নেই। অভিমান করে দূরে সরে গেলে সবাই কালক্রমে তাকে ভুলে যাবে, এমনকি তার বিগত তিন বছরে মুসলিম রাজনীতিতে যে দান, তাও লােকে মনে রাখবে না। আমরা আরও বললাম যে তাঁর ওই অভিমানের ফলে যে কেবল তারই ক্ষতি হবে, তা নয়। শহীদ সাহেব হবেন খাজা পরিবারের পরবর্তী শিকার। আমরাও কতটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব, তা-ও বলা যায় না। কিন্তু তিনি আমাদের কোনাে যুক্তিই মানলেন না এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি আকরম খাঁর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে বর্ধমান চলে গেলেন। আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম নিরাশ হয়ে।
২ মার্চ শিখ সম্প্রদায় তাদের একটি নিজস্ব আবাসভূমি দাবি করল ।
ওদিকে মওলানা ভাসানী ‘লাইনপ্রথার বিরুদ্ধে আসামে আন্দোলন আরম্ভ করে বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। ৩ মার্চ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নির্দেশে আসাম দিবস পালন করা হয়। ঢাকায়
২৪২
তখন ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। তবু আমরা স্থির করলাম যে আমরা ওই দিন সিরাজ-উদ-দৌলা পার্কে এক সভা করে আসাম দিবস পালন করব। আমাকেই সভাপতিত্ব করতে হলাে। প্রস্তাব গৃহীত হলাে। আমি অফিসে ফিরে এসেই শুনলাম যে জেলা সরকার ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযােগে পরদিন আমাকে গ্রেপ্তার করবে। ওপরে শহীদ সাহেব প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর আমাকে তারই সরকার গ্রেপ্তার করবে, যেহেতু আমি যে পার্টির হাতে শাসনভার, তাঁরই নির্দেশ মানতে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযােগে অভিযুক্ত। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট তাই নিজের দায়িত্বে কিছু না করে ব্যাপারটা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেবের কাঁধে চাপিয়ে দিলেন। বেল সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই গেলাম। আমাকে বসতে বলে স্বরাষ্ট্রসচিব মার্টিন সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করার জন্য ট্রাঙ্ককল বুক করলেন কলকাতায়। মার্টিন সাহেব ধরলেন বেল সাহেব আমার সম্মুখেই সব খুলে বললেন। মার্টিন সাহেব তার সিদ্ধান্ত ঘণ্টাখানেক পরে জানাবেন। বলে টেলিফোন কেটে দিলেন। ঘণ্টাখানেক পরে সিদ্ধান্ত এল যে মার্চ মাসের ১ তারিখ থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা বলবৎ নেই।
৮ এপ্রিল তারিখে রংপুরের খয়রাত হােসেন প্রায় ৪০ জন ন্যাশনাল গার্ডসহ আসাম সরকারের পুলিশের হাতে বন্দী হলেন।
১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তাদের এক প্রস্তাবে বলে, হিন্দুরা যারা স্বাধীন বাংলায় থাকতে চায় না এবং ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়, তাদের ইচ্ছার প্রতি দৃষ্টি রেখে তাদের সে সুবিধা দিতে হবে। প্রস্তাবটি ছিল :
If His Majesty’s Government contemplate handing over its power to the existing Government to Bengal which is determined on the formation of Bengal into a separate soverign state such portions of Bengla as desirous of remaining within the Union of India should be allowed to remain so and be formed into a separate province within the Union of India.
কংগ্রেসের উপরিউক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করার পরই ১৭ এপ্রিল কারকেশ্বরে হিন্দু মহাসভার এক সভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে বাংলাদেশ বিভক্ত করার জন্য অভিযান আরম্ভ করার পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। শরৎ বসু ও কিরণ শঙ্কর রায় বাংলাকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভাগ করার বিরােধিতা করতে থাকেন। কিন্তু উত্তর ভারতের দাঙ্গা ভীষণ রূপ ধারণ করে। গৃহযুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অবস্থা যখন আয়ত্তের বাইরে চলে গেল, তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৪
২৪৩
এপ্রিল গান্ধী ও জিন্নাহর সহিযুক্ত শান্তির জন্য লাখ লাখ আবেদনপত্র ছেপে বিমান থেকে ফেলতে লাগলেন। ২৩ এপ্রিল জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের মধ্যে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা হলাে। মাউন্টব্যাটেন স্বীকার করলেন যে বাংলায় যদিও ভাগ বন্ধ হতে পারে, কিন্তু পাঞ্জাবে শিখ ও মুসলমানরা আলােচনা করতেও রাজি নয়। বাংলায় এটা সম্ভব হতে পারে একটি শর্তে যে বাংলা পাকিস্তান বা ভারতে যােগ দেবে না। সে কথার উত্তরে জিন্নাহ মাউন্টব্যাটেনকে বলেছিলেন যে তিনি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলাকে স্বাগত জানাবেন, কারণ কলকাতা না পেলে বাংলাদেশের বাকি অংশ নিয়ে কী লাভ হবে। তার ভাষায় :
I should be delighted, what is the use of Bengal without Calcutta. They had much better remain united and independent. I am sure they would be on friendly terms with Pakistan.
২৭ এপ্রিল শরৎ বসু ও কিরণ শঙ্করের সঙ্গে শহীদ সাহেবের আলােচনা হয় এবং সে সভায় স্থির হয় যে আবুল হাশিম সাহেবের জন্য বর্ধমানে শরত্যাবু লােক পাঠালে হয়তাে তিনি আসবেন এবং তাঁর কর্মীদের আবার একত্র করে এক বিরাট আন্দোলন সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন। শরৎবাবু সেদিনই বর্ধমানে লােক পাঠালেন আবুল হাশিম সাহেবকে আনার জন্য। শহীদ সাহেবও সেদিন। স্বাধীন বাংলার পক্ষে এক বিবৃতি প্রদান করেন। আবুল হাশিম সাহেব ২৮ এপ্রিল কলকাতা এসে এক বিবৃতি দেন এবং আমরা তার পাই তার কাছ থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য। আমি, শামসুল হক ও শামসুদ্দীন সেদিনই কলকাতা রওনা হয়ে যাই। আবুল হাশিম সাহেবের বিবৃতি ২৯ তারিখে অমৃতবাজার ও অন্যান্য কাগজে প্রকাশিত হয়।
শরৎ বােস ও আবুল হাশিমের মধ্যে স্বাধীন বাংলার একটা নীলনকশা নিয়ে ঘরােয়া আলােচনা হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আবুল হাশেম সাহেব একা চলতে পারতেন না, তাকে ধরে নেওয়ার জন্য শামসুদ্দীনকে নিয়ে শরত্যাবুর উডবার্ন পার্কের বাড়ি যান। আবুল হাশিম সাহেব শামসুদ্দীনকে খুব বিশ্বাস করতেন এবং ভালােবাসতেন। তাঁর জানা ছিল না যে শামসুদ্দীন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। এ আলােচনার একদিন পরে কমিউনিস্টদের মুখপত্র স্বাধীনতায় স্বাধীন বৃহত্তর বাংলার নীলনকশা সম্বন্ধে আলােচনার বিষয়বস্তু সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগের কর্ণধারদের মধ্যে এক আশঙ্কা জেগে ওঠে। তারা ধরে নেয় যে বাংলা অভিবক্ত থাকলে আবার আবুল হাশিম ও সােহরাওয়ার্দীর রাজত্ব কায়েম হবে। এদিকে শরত্যাবুর ইচ্ছা শহীদ সাহেবকে একটু পেছনে রেখে আবুল হাশিম সাহেবকে সম্মুখে রাখা—কারণ
২৪৪
শহীদ সাহেবের প্রতি হিন্দুদের চরম বিরূপ মনােভাব ছিল।
১২ মে শহীদ সাহেব গান্ধীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৪ মে জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ-আলােচনা করেন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলার সব মুসলিম লীগ নেতা ও এর সংবাদপত্র সবাই স্বাধীন বাংলার প্রতি সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছিলেন। মাউন্টব্যাটেন শহীদ সাহেবকে শেষ কথা বলে দিলেন যে বাংলার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যদি ঐকমত্যে পৌছাতে পারে, তবে স্বাধীন বাংলার জন্য একটি ভিন্ন গণপরিষদ গঠন করা হবে।
১৭ মে তারিখে ভাইসরয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখদের নেতাদের সঙ্গে এক আলােচনায় বসেন এবং ভারতের অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয় নিয়ে আলােচনা করেন। মাউন্টব্যাটেন বলেন যে যদিও প্রধানমন্ত্রী এটলি ১৯৪৮ সালের জুনের আগে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু ১৯৪৭ সালেই ক্ষমতা হস্তান্তর করার তিনি পক্ষপাতী। কারণ, গৃহযুদ্ধ অফিসে-আদালত ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে যে সুশৃঙ্খলভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হবে না আরও দেরি হলে। ১৮ মে শহীদ সাহেব ও কিরণ শঙ্কর রায় আবার ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভিপি মেনন কিরণবাবুকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে বাংলা ও পাঞ্জাবের বিভক্তিকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে এবং মাউন্টব্যাটেন লন্ডন যাচ্ছেন। পরের দিন সে পরিকল্পনা নিয়ে এর পরেই দেখা গেল কিরণবাবুর বাসস্থানের সম্মুখে মেয়েদের এক বিক্ষোভ, আর সে বিক্ষোভকারীদের কাছে তিনি কথা দেন যে তিনি আর অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার জন্য কোনাে কাজ করবেন না।
আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করে স্থির হলাে যে কমিউনিস্ট পার্টির যােগাযােগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিম্পােজিয়ামের আয়ােজন করবেন, যেখানে আবুল হাশিম সাহেব নিজে বক্তৃতা করবেন। শামসুদ্দীন তার ব্যবস্থা করবেন। অন্যদিকে মফস্বলেও একটি সভার আয়ােজন করবেন শামসুল হক, আমি সে সভায় সভাপতিত্ব করব। শামসুল হক নেত্রকোনায় সভার আয়ােজন করলেন। শামসুল হক ওই সভা উদ্বোধন করবেন, আমি সভাপতিত্ব করব আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থকে লুলু বিলকিস বানু প্রধান অতিথি হবেন।
কলকাতার সিম্পােজিয়ামে আবুল হাশিম সাহেব তার বক্তৃতায় বলেন যে মােগল সম্রাটরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে বিক্ষিপ্ত রাষ্ট্রসমূহ একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আনার জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিল, তখন মােগলদের বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেছিল—যারা ভারতের
২৪৫
অখণ্ডতা মেনে নেয়নি, যেমন প্রতাপ সিংহ, শিবাজী, চঁাদসুলতানা, রানি অহল্যা বাই, ঈশা খান বা কেদার রায়, তাঁরাই ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আর যারা মােগল বাদশাহদের সাহায্য করেছেন, তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে, তাদের দেশের শত্রু আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তেমনি ব্রিটিশরাজ যখন ভারতে রাজ্য বিস্তার করছিল, তখন যারা বাধা দিয়েছিলেন, যেমন হায়দার আলী, টিপু সুলতান, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, রণজিৎ সিং, তারাই ইতিহাসে বরেণ্য হয়ে আছেন। সেদিন অখণ্ড ভারতের পক্ষে যাঁরা ছিলেন, আমরা তাঁদের বিরােধী ছিলাম। আর আজ আমরা সেই সাম্রাজ্যবাদকেই সমর্থন করছি, যে সমর্থনের ফলে আজ পর্যন্ত যারা দেশপ্রেমিক বলে পরিচিত, তাঁদেরই আমরা দেশের শত্রু বলে চিহ্নিত করব। ‘অখণ্ড ভারত’-এর মােগল সম্রাট আকবর ও আওরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে ব্রিটিশ-রাজের সৃষ্টি।
নেত্রকোনায় আমরা তিনজনই একই সুরে বক্তৃতা করি। লুলু বিলকিস বানু বক্তৃতা করতে উঠলে কয়েকজন মৌলভি সাহেব আপত্তি করেন। ফলে স্থির হয় যে ‘ডােয়াস’ থেকে বক্তৃতা না করে স্কুলঘরের ভেতরে মাইক নিয়ে বক্তৃতা করবেন। তার মা সারাতাইফুর তার পাশেই বসেছিলেন। আমি এর আগে লুলু বিলকিস বানুর বক্তৃতা শুনিনি, ফারসি বয়েৎ ও বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে সুললিত ভাষায় তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। একবারও তার স্বর কাঁপেনি। আমি আশ্চর্য হলাম মুসলমানদের মধ্যেও সে যুগে এমন মেয়ের আবির্ভাবেই। সেই থেকে আমি তাকে প্রশংসার চোখে দেখে এসেছি। দুঃখের বিষয়, পরের দিন কলকাতা গিয়ে দেখলাম—দৈনিক ইত্তেহাদএ আমার বক্তৃতা দুটো কলামে আর—তাঁর বক্তৃতা, যেটা আমার বক্তৃতার চেয়ে ভালাে হয়েছিল তা বিশেষভাবে উল্লেখই করা হয়নি। সাংবাদিকেরা মনে হয় মানুষের মুখ দেখে বক্তৃতা ছাপে অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যার নেতৃত্ব আছে, তার বক্তৃতা যেসব ভালাে কথা বলেনি, তাও তার মুখ দিয়ে বলিয়ে ছাড়ে। আবদুর রহমান সিদ্দিকী প্রায়ই বলতেন যে জিন্নাহ সাহেব যত বাজে কথা ভুল ভাষায় বলবেন আর আমার কাজ হচ্ছে তাই শুদ্ধ করে দেওয়া এবং তাঁকে মহান নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করা। এসব কথা বলার জন্য তিনি কলকাতা করপােরেশনে নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তবু তাঁর মুখ বন্ধ হয়নি। কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনের পর আলিগড়ের ছাত্ররা স্থির করল যে নতুন মুসলিম লীগ নির্বাচিত সদস্যরা সবাই জিন্নাহ টুপি পরে ও ছােট একটি মুসলিম লীগের নিশান হাতে নিয়ে পরিষদে একত্রে প্রবেশ করবেন, কিন্তু আবদুর রহমান সিদ্দিকীকে যখন তাঁর ফেজ রেখে জিন্নাহ টুপি পরতে বলা হলাে, তখন তিনি খেপে গিয়ে বললেন, আমার ফেজ জিন্নাহর সােলার হ্যাট থেকেও পুরােনাে—তাঁর টুপি
২৪৬
তাে সে হ্যাটেরই বাচ্চা। তিনি মুসলিম লীগের সব কাউন্সিল সভায় প্যালেস্টাইন সম্বন্ধে একটা প্রস্তাব উপস্থাপন করতেন। সাধারণ প্রস্তাবটি একটু হদীর্ঘ করে লেখা হতাে, ফলে সবাই অধৈর্য হয়ে উঠতেন আর গুঞ্জনধ্বনি শােনা যেত, তিনি বিরক্তির সুরে বলতেন, ভাইসব, এটা আপনাদের “আল্লাহ আকবরি” প্রস্তাব নয়। এটা ছিল জিন্নাহর প্রতি কটাক্ষ। কারণ জিন্নাহ যেকোনাে প্রস্তাব উত্থাপন করতেন, সেটাই সবাই আল্লাহু আকবর’ বলে পাস করে দিতেন। আলােচনা হতাে না তার ওপর।
মে মাসের ১৯ তারিখে মাউন্টব্যাটেন লন্ডন চলে গেলেন ভারত বিভক্তি সম্বন্ধে আলােচনা করতে। ১৭ মে তারিখে মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে ভারতের দুই প্রান্তে দুটো দেশ কী করে তিনি এক রাষ্ট্র করবেন? জিন্নাহর মনে হলাে এটা মাউন্টব্যাটেন যেমন অসম্ভব মনে করছেন, তেমনি হয়তাে ব্রিটিশ সরকারও মনে করবে। তাই ২১ মে যেদিন। মাউন্টব্যাটেন লন্ডন পৌছালেন, সেদিনই জিন্নাহ ভারতের মধ্য দিয়ে একটা করিডরের দাবি উপস্থাপন করলেন।
এরপর থেকেই বাংলার মুসলিম লীগ নেতা ও সংবাদপত্র স্বাধীন বাংলার বিরােধিতা করতে আরম্ভ করেন এবং আবুল হাশিমের মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার যে কোনাে অধিকার নেই, সবাই এ কথা বলতে আরম্ভ করলেন। চুনােপুঁটিরাও বিবৃতি দিতে আরম্ভ করলেন। হবীবুল্লাহ বাহার সাহেব, যিনি হাশিম সাহেবের স্থলে সেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা ডাকলেন ৩১ মে অর্থাৎ মাউন্টব্যাটেনের ফিরে আসার দিন পর্যন্ত। সে সভায় স্বাধীন বাংলার মৃত্যুর বিজ্ঞাপন মুসলিম লীগ রচনা করল। জুন মাসেও শরৎ বসু, আবুল হাশিম সাহেব ও শহীদ সাহেব ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রচেষ্টা বন্ধ করল।
জুন মাসের ২ তারিখে মাউন্টব্যাটেন সব দলের নেতাদের সঙ্গেই আলাপ করলেন এবং ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা তাদের গ্রহণ করতে বললেন। নেহরু জিন্নাহ ও সরদার বলদেও সিং মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রেডিও থেকে বক্তৃতা করেন। স্থির হলাে যে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হবে।
স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের হাতে সময় ছিল না। মাউন্টব্যাটেন অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হতে লাগলেন। শহীদ সাহেবের ওপর হিন্দুদের ব্যক্তিগত আক্রোশ ও ঘৃণা, আবুল হাশিম সাহেবের অভিমান করে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ—যার ফলে তাঁর পদমর্যাদা ক্ষুন্ন হলাে আর বাহার সাহেব তাঁর কথায় গুরুত্ব না দিতে দেশবাসীর কাছে আবেদন করতে
২৪৭
পারলেন। তা ছাড়া আবুল হাশিম সাহেবের স্বাধীন বাংলার নীলনকশাটি তাঁর বিরুদ্ধে খাজা সাহেবদের জনমত সৃষ্টি করতে সাহায্য করল। কলকাতা, নােয়াখালী ও বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি বহু কারণে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন মুছে গেল।
৫ জুন তারিখে মুসলিম লীগ কাউন্সিল মাউন্টব্যাটেনের দান দুহাত পেতে গ্রহণ করল । কংগ্রেস, মুসলিম লীগ দুটো প্রতিষ্ঠানই শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছিল। তাদের উপকারের জন্যই বাংলাকে বিভাগ করার প্রয়ােজন হয়েছিল। পশ্চিম বাংলার প্রয়ােজন ছিল বিড়লা, ডালমিয়াদের আর পূর্ব বাংলার বাজার দরকার ছিল আদমজি, ইস্পাহানিদের জন্য।
জুন মাসের মুসলিম লীগ অধিবেশনে জিন্নাহর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আবুল হাশিম সাহেব ও হসরত মােহানী বক্তৃতা করতে চাইলে জিন্নাহ সাহেব তাঁদের বক্তৃতা করতে দিতে অস্বীকার করলেন। ভােটে দিলেন তিনি তার প্রস্তাব। পক্ষে সব আল্লাহু আকবর—বিপক্ষে আবুল হাশিমের সঙ্গে মিঞা ইফতেখারউদ্দীন ও হসরত মােহানীকে বাদ দিলে ৯টি ভােট বাংলা থেকে। প্রস্তাব পাস হয়ে গেল।
জুন মাসের প্রথম দিকে গান্ধীজি শরবাবুকে বাংলা বিভক্তির বিরােধিতা করতে নিষেধ করলেন। জুলাই মাসে আবুল হাশিম সাহেবও পূর্ব বাংলার কর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য কলকাতা ডেকে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে শুনলাম যে বাংলায় কে পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা হবেন সেটাও পাকিস্তান হওয়ার আগেই ঠিক হয়ে যাবে। শহীদ সাহেব আমাদের বললেন যে তিনি ওই গুজবে বিশ্বাস করেন না। তবু আমরা হাশিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “লিডার নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত হয়, তবে আমাদের করণীয় কী? তিনি বললেন, আমাদের কিছু করার নেই। আমার নির্বাচনে শহীদ সাহেব যেমন নিরপেক্ষ ছিলেন, তাঁর নির্বাচনেও আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখব। আমার মনে হয় আবুল হাশিম সাহেবের ওই সিদ্ধান্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হােসেন। মানিক মিয়া মেনে নেননি। আর সেদিন থেকেই তাদের সঙ্গে আবুল হাশিম সাহেবের সব সম্পর্কই কেবল ছিন্ন হয়নি, শেষ পর্যন্ত তিক্ততায় পৌছেছিল।
৫ আগস্ট নেতা নির্বাচন-পর্ব শেষ হলাে। সিলেটে ১৭ জন পরিষদ সদস্যই খাজা নাজিমুদ্দিনের দলে গেল। এমনকি ভূতপূর্ব প্রজানেতা শামসুদ্দীন সাহেবও খাজাদের সঙ্গে ভিড়লেন। নাজিমুদ্দিন সিলেট থেকে তিনজন ও শামসুদ্দীনকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শহীদ সাহেব অনেক ভােটের ব্যবধানে হেরে গেলেন।
অথচ এর কিছুদিন আগে ফজলুর রহমান সাহেব ঢাকায় এলে কফিলুদ্দীন চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে এক ঘরােয়া চায়ের পার্টিতে আমাদের বললেন যে
২৪৮
খাজা নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সাহেব দুজনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যােগ দেবেন। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর জন্য প্রার্থী হবেন তািন নিজে, নূরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী ও বগুড়ার মােহাম্মদ আলী।
১৩ আগস্ট পশ্চিম বাংলার চার্জ প্রফুল্ল ঘােষকে ও পূর্ব বাংলার চার্জ খাজা নাজিমুদ্দিনকে বুঝিয়ে দিয়ে শহীদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন গান্ধীজির সঙ্গে হিন্দুমুসলমান মিলনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। আর তিনি হিন্দুস্তানেই থেকে যাবেন। সে জন্য তিনি পশ্চিম বাংলার মুসলিম লীগ দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পরিষদে বিরােধী দলের আসনে বসার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তিনি তখনাে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য থাকলেন।

২৪৯

দ্বিতীয় অধ্যায়

পাকিস্তান ও বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজ

পাকিস্তানের জন্ম হলাে রক্তস্নান করে। গান্ধীজি বলেছিলেন :
I have not asked the British to handover India to the Congress or to the Hindus. Let them entrust India to God in modern parlance to anarchy. Then all parities will fight one another like dogs, or will, when real responsibility faces them, come to a reasonable agreement.
ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজির কথাই যত দূর সম্ভব রেখেছে—ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে আর্যাবর্তে যে হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযােগ, ব্যভিচার, ধর্ষণ হয়েছে, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। মৃত্যুর সংখ্যা কেউ নির্ণয় করেনি। ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কেউ সঠিকভাবে হিসাব করেনি। পুরাে একটা বছর এই উপমহাদেশের মানুষগুলাে সব পশু হয়ে গিয়েছিল। যারা অন্তরে মানুষ ছিল, তাদের সংখ্যা এত অল্প যে হাতে গােনা যেত। প্রায় এক কোটি লােক বাস্তুহারা হয়েছিল, তারা সবাই আজও পুনর্বাসিত হয়েছে কি না জানি না।
ভারতের হিন্দু সম্প্রদায় ‘জয় হিন্দ’ ও পাকিস্তানে মুসলমান সম্প্রদায় ‘জিন্দাবাদ’ করছে। একদিকে ‘জয় হিন্দ’ আর অন্যদিকে পাকিস্তান। জিন্দাবাদ’—কিন্তু কাদের এ ‘ভিক্টরি’, ‘কিসের ভিক্টরি’! যদি মানুষের জয় হতাে তবে তাকে সবাই মিলে স্বাগত জানাত। কিন্তু সীমানার দুপারে সংখ্যালঘুদের পক্ষে কি স্বাধীনতা এসেছিল? এসেছিল জীবনের নিরাপত্তা?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু বললেন :
Long years ago we made tryst with destiny, and now the same comes when we shall redeem our pledge. The service of India
২৫০
means the service of the millions who suffer. It means ending of poverty and ignorance and disease and inequality of opportunity. The ambition of the greatest man of our generation has been to wipe out every tear from every eye.
এ বােধ হয় জিন্নাহরও মনে ছিল যদিও কোনােকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বা মহাবিদ্যালয়ের দ্বারপ্রান্তে না পৌছাতে পারায় কাব্য করে বলতে পারেননি। কিন্তু দীর্ঘ পঁচিশ বছর পরে নেহরুর সে স্বপ্ন, সে সাধ কি ভারতে পূরণ হয়েছে? আর পাকিস্তানের স্রষ্টা বলেছিলেন :
The first observation that I would like to make is this, you will no doubt agree with me that the first duty of a government is to maintain law and order. So that the life property and religious beliefs of its subjects are fully protected by the State.
১৯৭১ সালে তাঁর সে স্বপ্নের প্রতিফলন আমরা দেখেছি। যার ফলে পাকিস্তান ভেঙে দুখণ্ড হয়ে গেল।
‘ক্ষমতা বস্তুটাই এক অদ্ভুত নেশা। লাগাম বা শাসন না থাকলে নেশা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তখন কোনাে যুক্তির ধার ধারে না তারা, তােয়াক্কা করে না ইতিহাসের পাতার লেখা। ক্ষমতার মনােভাব হলাে—আমি যা ভালাে মনে করি তা-ই একমাত্র ভালাে, অদ্বিতীয় ভালাে, জনসাধারণ তা মেনে নিতে বাধ্য।’ বলেছেন আমাদের দেশের এক বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। মােটে ২৫ বছর আগে যে রক্তস্নান আমরা স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করেছি, তা ভুলে গেলাম। পাকিস্তান বাংলার ইতিহাসের আর একটি কলঙ্কময় অধ্যায় সংযােজন করার পর স্বাভাবিকভাবেই আশা করা গিয়েছিল পাকিস্তানের রক্তপিপাসা কমেছে। কিন্তু যেসব খবরের ছিটেফোঁটা বাংলায় এসে পৌছেছে, তাতে মনে হয় পাকিস্তানের রক্তের তৃষ্ণা এখনাে মেটেনি।
১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে স্বাগত জানানাের জন্য ঢাকার নবাব বাহাদুরকে সভাপতি করে এক শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। স্যার সলিমুল্লাহ ১৯০৫ সালে ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী করার জন্য সবকিছুই করেছিলেন। ব্রিটিশকে খুশি করার জন্য। কিন্তু মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দুদের আন্দোলনের ফলে তার সে স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। আর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তাঁরই বােনের ছেলে খাজা নাজিমুদ্দিন মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দুর সাহায্যে ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী করার জন্য আগমন করছেন। সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে স্যার সলিমুল্লাহর পুত্র খাজা হাবিবুল্লাহ তাঁকে ফুলচন্দন দিয়ে বরণ করবেন। কিন্তু আমরা অবাক হয়েছিলাম দুটো নাম সে
২৫১
অভ্যর্থনা কমিটিতে দেখে। সে দুজন হলেন সর্বজনাব কফিলুদ্দীন চৌধুরী ও আতাউর রহমান খান। অবশ্যই ঢাকা রেলস্টেশনে দাড়িয়ে অভ্যর্থনা করার পরে আর কোনাে অনুষ্ঠানে তাদের ডাক পড়েনি, এমনকি সে রাতে আহসান মঞ্জিলের নৈশভােজেও নয়।
নবাব আবদুল গণির পিতা–খাজা আলিমুল্লাহ ঢাকায় এসেছিলেন আসামে কার্পেট ব্যবসায় সুবিধা না করতে পেরে চামড়ার ব্যবসা করার জন্য। তার পুত্র নবাব আবদুল গণি পূর্বপুরুষের ব্যবসায়ী প্রতিভা না থাকার জন্যই হােক বা জমিদারির মালিক হওয়া (চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দেশে) বেশি লাভজনক বলে মনে হওয়ার জন্যই হােক, নিলামে তিনি জমিদারি খরিদ করতে থাকেন। এবং ব্যবসায়ী বুদ্ধি খাটিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার বড় জমিদার শ্রেণিতে উন্নীত হন। তারপর ভাগ্যগুণে ঢাকায় লালবাগে এবং নদীর অপর পারে জিঞ্জিরায় কালাে-গােরার লড়াই শুরু হয়—সর্বভারতীয় সিপাহি বিদ্রোহের ফলে। বুদ্ধিমান নবাব সাহেব, পাশা খেলার মতােই ভবিষ্যতে বিপদের আশঙ্কা। থাকলেও এক বড় ঝুঁকি নিলেন। কালাে সৈন্যদের অস্ত্র জমা দেওয়ালেন। তাদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝােলালেন। সিপাহি বিদ্রোহ বৎসরাধিক কালের মধ্যেই দমন হলাে। আর যারা গােরাদের সাহায্য করেছিল, বিপদের দিনে তারা মহামান্য ভিক্টোরিয়া কর্তৃক নাইট, নবাব, রাজা, রাজাধিরাজ খেতাবে ভূষিত হলেন। খাজা আবদুল গণি নাইট ও নবাব দুটোই হলেন। সুতরাং তার একটা প্রাসাদ তৈরি করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ল। সে প্রাসাদই তাঁর পুত্রের নামানুসারে ‘আহসান মঞ্জিল’ নামে খ্যাতি লাভ করল। যে আহসান মঞ্জিলে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের ভাইসরয় লর্ড কার্জন রাত কাটিয়েছেন। ব্রিটিশের দেওয়া চৌদ্দ লাখ টাকার জৌলুশও লর্ড কার্জন। দেখেছেন আর দেখেছে ঢাকার রইছ, কুট্টি, শাঁখারি, তাঁতি আর বসাকরা।
আহসান মঞ্জিলের ছেলেরা ঢাকার আদিবাসীদের মতােই পড়াশােনার ধার ধারতেন না। ওই পরিবারে শহর বানুর বড় ছেলে খাজা সালাহউদ্দীন এবং খাজা নাজিমুদ্দিন বিলেতে পড়তে গিয়েছিলেন। খাজা হাবিবুল্লাহকেও পাঠানাে হয়েছিল। কিন্তু নবাব সলিমুল্লাহর পুত্র ভবিষ্যৎ নবাব—পড়ার কথা চিন্তা করতে পারেনি। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গেল, আর তার ভাগ্যেও চাকরি জুটে গেল। বড় ভাই খাজা সালাহউদ্দীন বিলেতে বিয়ে করে থেকে গেলেন। আর কোনাে দিন ঢাকায় আসেননি। আর তাঁর ঢাকার সম্পত্তি এবং ওয়াকফের বৃত্তির মালিকানা খাজা শাহাবুদ্দীনকে লিখে দিলেন। খাজা শাহাবুদ্দীন পিতার মৃত্যুর নয় মাস পরে জন্মগ্রহণ করে বলে পিতার কাছ থেকে কিছু পাননি। আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার যে নবাব সলিমুল্লাহর সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের চেহারার অপূর্ব মিল। একজন এক চক্ষু কানা আর
২৫২
একজনের বাঁ চোখ ট্যারা। অবশ্যই খাজা শাহাবুদ্দীনের মতাে অত ট্যারা ছিল না।
ব্রিটিশ সরকার টাকা দিয়ে আবার সবটাই যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, তার জন্য ঋণগ্রস্ত নবাবের জমিদারিকে ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডস’-এ ভূক্ত করে সেটা চালানাের জন্য শ্বেতাঙ্গ আইসিএসকে জেনারেল ম্যানেজার করে দিলেন। আর ওই ইংরেজ ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলার জন্য আহসান মঞ্জিলের সবাইকে ইংরেজি ও উর্দু ভাষা শেখানাের ব্যবস্থা হলাে। খাজা সাহেবদের বংশে আমাদের যুগ থেকে লেখাপড়া শুরু হয়। খাজা আতিকুল্লাহ সাহেবের পুত্র খাজা আজাদ ও আমি একই সালে বিএ পাস করি। তারপর এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে খাজা ইদ্রিস, খাজা কায়সার। কলেজে পড়েছে খাজা শাহাবুদ্দীনের ছেলে খাজা ওয়াছিহ উদ্দীন, খাজা জাকিউদ্দীন, খাজা নাজিমুদ্দিনের ছেলে খাজা মহিউদ্দীন। এক খাজা আজাদ ও খাজা কায়সারই নাজিমুদ্দিনের মতাে ডিগ্রি পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। খাজা শাহাবুদ্দীনের ছােট ছেলে লেফটেন্যান্ট খাজা সাঈদ শাহাবুদ্দীন গ্র্যাজুয়েট না হলেও তার লেখা To him I owe my life একটি চমৎকার বই। ১৯৪২ সালে জাপানি ডুবােজাহাজ তাদের জাহাজ ‘চিল্কা ডুবিয়ে দেয়। আহত অবস্থায় একটি জীবন-তরিতে (লাইফ বােটে) ছয় দিন ভেসে থাকার পর—সুমাত্রার আশি মাইল পশ্চিমে এক দ্বীপে অবতরণ করেন। সেখানেও জাপানিরা এসে পড়ে এবং তিনি যুদ্ধবন্দী হন। ১৯৪৫ সালে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসেন ও তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বইখানা লেখেন এবং লাহােরে ফিরােজ সন্স সে বই। ১৯৫২ সালে প্রকাশ করে। যুদ্ধের পর থেকেই ওই বাড়ির ছেলেরা বিভিন্ন ব্রিটিশ ফার্মে ভালাে বেতনে চাকরি পেতে থাকেন। সৈয়দ সাহেবে আলমের। ছেলে সৈয়দ ফৈয়াজ আলমও কেমব্রিজের গ্র্যাজুয়েট এবং এখন পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য বিভাগের যুগ্ম সম্পাদক পদে বহাল হয়েছেন বলে শুনেছি। বিয়ে করেছেন আমার শিক্ষক ড. হাসানের মেয়ে রিফাতকে।
মােটামুটিভাবে এই-ই আহসান মঞ্জিল খানদানের ইতিহাস। আজ তারা এখানে কেউ নেই বললেই চলে। কেবল খাজা ওয়াছিহউদ্দীন এবং খাজা কায়সার বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত পদে বহাল আছেন।
খাজা নাজিমুদ্দিনের পূর্ব বাংলা সরকারের কর্ণধার হয়ে আসায় ঢাকার মধ্যবিত্তের কী অবস্থা হলাে, তা-ই আমরা পরীক্ষা করব এবার। মনে রাখতে হবে-খাজা নাজিমুদ্দিন এলেও খাজা শাহাবুদ্দীন আর ঢাকার রাজধানীতে ফিরে এলেন না। ফজলুর রহমান সাহেব কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব পেয়ে গেছেন। ভাগ্যবান ফজলুর রহমান সাহেব, যা আশা করেননি তাই পেয়ে ঢাকার রাজনীতির কথা ভুলে গেলেন। খাজা নাজিমুদ্দিন জানতেন ঢাকা শহরের
২৫৩
লােকের এমনকি সরদারদেরও তার ওপর কোনাে আস্থা নেই। তারা নবাববাহাদুরকে যতটা সম্মান করেন, তা তাঁকে করেন না। তাই তিনি নবাব বাহাদুরের ছেলে ক্যাপ্টেন খাজা হাসান আসকারীকে তার এডিসি করে নিলেন। চিফ মিনিস্টারের এডিসি—শুনতেও অদ্ভুত লাগে। তবু তাঁকে করতে হলাে। কারণ ওপরে আল্লাহ, নিচে কায়েদে আজম—দুজনই দৃষ্টির বাইরে। কার সঙ্গে পরামর্শ করবেন—স্বাভাবিকভাবেই আমলাপ্রধান আজিজ আহমদের ওপরই একমাত্র ভরসা রেখে মন্ত্রীত্বের গদিতে বসলেন। আর তাঁর বাঁ হাত হিসেবে রইলেন আইজি জাকির হুসেন।
৭ আগস্ট জিন্নাহ সাহেব, দিল্লি থেকে করাচি রওনা হয়ে গেলেন। মাউন্টব্যাটেনের ধারণা ছিল যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্ত সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিনিই দুটো রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল থাকবেন। শেষ মুহুর্তে জিন্নাহ সাহেব তাঁকে জানিয়ে দিলেন যে একই গভর্নর জেনারেল হলে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যা আরও গভীরতর হবে। কারণ কেউ তার ওপর আস্থা রাখতে পারবে না। তারপর অনেক নাম আলােচনা হলাে—রাজপুত্র ডিউক অব কেন্ট এবং রাজপরিবারের অন্য দু-চারজনের । সবাই বলছে এমন কেউ হতে হবে, যে মাউন্টব্যাটেনের সমকক্ষ। নইলে ভাগাভাগির সময় সব পাওনা পাওয়া যাবে না। কিন্তু জুলাই মাসের শেষে জিন্নাহ তাঁর নিজের নামই পাঠিয়ে দিলেন সম্রাটের কাছ থেকে নিয়ােগপত্র পাওয়ার জন্য। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগল, তিনি কেন গভর্নর জেনারেল হলেন? কেন বুঝলেন না যে তার পক্ষে পাকিস্তানের ভাগ-বাটোয়ারা আদায় করা সম্ভব হবে না? কেন তিনি বুঝলেন না তার গভর্নর জেনারেল হওয়া অর্থ পাকিস্তানে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়া? কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এটা তাঁর অজ্ঞান মনের ইচ্ছা। ছােটবেলায় বিশেষ করে বিলেতে পড়ার সময় থেকে অভিজাত সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা তাকে যে দৃষ্টিতে দেখেছে, তারই প্রতিশােধ নিয়েছেন নিজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করার পর থেকে। অবশ্যই আমি মনস্তত্ত্ববিদ নই, তবু যত তাঁর প্রহেলিকাময় জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে চেয়েছি, ততই মন হয়েছে তিনি মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত। নইলে চল্লিশ বেবছর বয়সে আঠারাে বছরের মেয়ে রতন বাঈকে কেন বিয়ে করেছিলেন তিনি? স্যার ডিন শ পেটিট যা নিয়ে জিন্নাহর বিরুদ্ধে কোর্টের ইনজাংশন’ পর্যন্ত জারি করেছিলেন। এটা কি শুধু ভালােবাসা না একটা ধনী নাইট’ পার্সিকে অপদস্থ করার অজানা মানসিক আকাঙ্ক্ষা? মুসলিম লীগ করায়ত্ত করার জন্য বড় বড় ব্যবসায়ী, যেমন আদমজি, ইস্পাহানিদের পৃষ্ঠপােষকতা আদায় করে দেশের নবাব, নাইট, জায়গিরদার, জমিদারদের দ্বারা বেষ্টিত থাকার জন্য ওয়ার্কিং কমিটিতে তাঁদের মনােনয়ন দান করা, আবার যখন খুশি তাঁদের ক্রিসমাসের ‘প্রেজেন্ট হিসেবে গভর্নর জেনারেলকে দেওয়া, দুই প্রদেশের দুই মুখ্যমন্ত্রীদ্বয়ের
২৫৪
মুসলিম লীগ সদস্যপদ খারিজ করা, তারপর নিজেকে গভর্নর জেনারেল মনােনীত করা—সবটাই যেন সামাজিক অবিচারের ওপর প্রতিশােধ।
জিন্নাহ কি সত্যিই পাকিস্তান চেয়েছিলেন, না রাজকোটের দেওয়ানের পুত্র গান্ধীজিও কাশ্মীরি বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নেহরুর ওপর একই প্রতিশােধ নিয়েছিলেন? আমার মনে হয়, মনস্তত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের পণ্ডিতদের এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান চালানাে উচিত। রাজনীতির ছাত্রদের এটা ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। প্রসিদ্ধ সাংবাদিক গান্থারের মতে, একজন অস্বাভাবিক (abnormal) লােকের পক্ষেই একনায়ক (dictator) হওয়া সম্ভব। স্বাভাবিক লােক নিজেকে একমাত্র বুদ্ধিমান সবজান্তা বলে ভাবতে পারে না। জিন্নাহর ব্যাপারে অবশ্য এ-ও হতে পারে যে যখন পাকিস্তান হলাে, তখন তিনি কঠিন রােগাক্রান্ত। কিন্তু আমার চিন্তা সেদিকে যায়নি, তাঁর কঠিন রােগ ধরা পড়েছে ১৯৪৪ সালে। কিন্তু বাকি তিন বছর তিনি কোনাে বিশ্রাম নিতে চাননি। এমনকি ‘পার্টিশন কাউন্সিলের তিনটি কমিটিতে তিনি নিজেকে, নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানকে ও আবদুর রব নিশতারকে মনােনীত করেন। দুদিন পরে। নিশতারকে সরিয়ে নিজেই দুটি কমিটিতে বসতে লাগলেন। আর সপ্তাহখানেক পরে নবাবজাদাকে সরিয়ে দিয়ে তিনটি কমিটিতেই নিজে থাকলেন। যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা বুঝবেন যে কমিটির কাজে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। গভর্নর জেনারেল হয়েও তিনি নিজে মন্ত্রী নিযুক্ত করেছেন। যার ফলে পরবর্তীকালে লিয়াকত আলী খান সেসব মন্ত্রীকে আয়ত্তাধীন করতে পারেননি। জিন্নাহ সাহেব যে কারণ দেখিয়ে নিজে গভর্নর জেনারেল হলেন, সেই একই কারণে ফিল্ড মার্শাল অকিনলেকের ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীদের অধিনায়কত্ব মেনে নেওয়া উচিত ছিল না। অকিনলেককে না মানলে হয়তাে কাশ্মীর না-ও হারাতে পারত। অবশ্যই এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
করাচিতে পৌছে তাঁর এডিসি লেফটেন্যান্ট আহসানকে বলেছিলেন, ‘Do you know, I never expected to see Pakistan in my life time.’
মাননীয় আগা খান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন :
I myself am convinced that even as late as 1946 Jinnah had no clear and final idea of his goal, no awareness that he would, within twelve months, be the founder of a new nation, a Muslim great power such as the world has not seen for centuries.
আমার মনে হয় যে তিনি যদি ঠিক বুঝতে পারতেন যে পাকিস্তান আসছেই, তাহলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও স্থলবাহিনীর প্রধান
২৫৫
ও প্রদেশের গভর্নর হওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে তালিকা প্রদান করতেন না। নিজেদের মধ্য থেকেই সেসব চাকরির জন্য লােক প্রস্তুত রাখতেন। তাঁর দুজন মিলিটারি সেক্রেটারি ছাড়াও তিনি জেনারেল ডগলাস প্রেসি, স্যার আরবিল্ড রােনাল্ডস, স্যার জর্জ ক্যানিংহ্যাম, স্যার ফ্রান্সিস মুড়ি, স্যার জন বারােজ প্রমুখের সাহায্যে জন্য লর্ড ইসমের কাছে যে তালিকা প্রদান করেন, তা থেকেই বােঝা যায় জাতির জনক হওয়ার জন্য তার প্রস্তুতি ছিল না। যদি তিনি জানতেন পাকিস্তান হবেই, তাহলে পাকিস্তানের প্রদেশসমূহ অর্থাৎ বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত ও বেলুচিস্তানের লােক দিয়েই গণপরিষদ তৈরি হতাে। মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশসমূহ থেকে এত লােক গণপরিষদে স্থান পেত না। আমার মনে হয়, মিশন প্ল্যান গ্রহণ করার দিন। অর্থাৎ ১৯৪৬ সালের ৬ জুন পর্যন্ত তার ভারতে একটা কনফেডারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কংগ্রেস সভাপতি হয়েই জওহরলালজির ঔদ্ধত্য ও অহংকারপূর্ণ বিবৃতি তার সে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল। তারপর ৮ আগস্ট নেহরুজির মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝােতা না করেই সরকার গঠনের পর যে পরিস্থিতি হলাে, সেখান থেকে আর পেছনে ফেরার উপায় ছিল না (The situation reached a point of no return)। ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তাব গ্রহণ এবং খেতাব বর্জনের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে সকল সংযােগ বিচ্ছিন্ন করার কথা তিনি বােধ হয় স্থির করেছিলেন। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানই তার কাছে পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল। পাকিস্তান হওয়ার পর কাশ্মীর পাওয়ার প্রচেষ্টা, উর্দু ভাষাকে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এবং পার্টিশন ট্রাইব্যুনালে যাতে বাংলাদেশ কলকাতা পাওয়ার জন্য এমন কোনাে যুক্তিতর্ক উপস্থিত না করে—যার ফলে লাহাের হারানাের প্রশ্ন ওঠে, তার জন্য বাংলার পক্ষে সওয়াল-জওয়াব করার জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশের অ্যাডভােকেট ওয়াসিম সাহেবকে তিনি পূর্ব বাংলার পক্ষে নিযুক্ত করেন, যার বাংলার ভৌগােলিক অবস্থান সম্বন্ধে কোনাে ধারণাই ছিল না। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী যে কাগজপত্র তৈরি করে। দিয়েছিলেন যুক্তিতর্কে সাহায্য করার জন্য, তা ওয়াসিম সাহেব কোনাে দিন ব্যবহার করেননি। অথচ খুলনার পক্ষে শেরেবাংলা সেসব মানচিত্র এবং কাগজপত্র ব্যবহার করে যে খুলনা মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনার ভাগাভাগিতে ভারতের দিকে পড়েছিল, তা পূর্ব বাংলায় ফিরে এসেছিল। জিন্নাহ বলেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে আমি দশ মাইল পেলে পূর্ব বাংলায় বিশ মাইল ছেড়ে দিতে রাজি। কারণ, ওই দশ মাইলের পেছনে রয়েছে বিরাট মুসলিম জগৎ, যা পূর্ব বাংলার পেছনে ছিল না। আগরতলার রানি সাত দিন খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে থেকেও আগরতলাকে ভুক্ত করার ব্যাপারে কিছু করতে পারলেন না। অথচ
২৫৬
শেখ আবদুল্লাহর বিরােধিতা সত্ত্বেও কাশ্মীর পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পাঞ্জাব বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পার্লামেন্টারি পার্টির নতুন নেতা নির্বাচনের প্রয়ােজন হয়নি, কিন্তু বাংলাদেশে তার প্রয়ােজন হয়েছিল । কারণ, খাজা নাজিমুদ্দিন না থাকলে ‘পার্টিশন কাউন্সিলে বাংলাদেশের পশ্চিম বাংলার কাছে পাওনা পূর্ব পাঞ্জাবের পশ্চিম পাঞ্জাবের কাছে পাওনার বৈষম্য প্রদর্শন করে কারও কাছে কারও কিছু পাওনা নেই—এ সমাধানে আসা হয়তাে সম্ভব হয়ে উঠত না।
পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগ ভেঙে দেওয়া উচিত ছিল। এমনকি গণপরিষদের একটি বিল পাস করে নতুন গণপরিষদ গঠন করাও উচিত ছিল। কারণ, ভারতীয় গণপরিষদের সদস্যদের সবাই ভারতীয় আর পাকিস্তান গণপরিষদের বেশির ভাগ সদস্যই বহিরাগত—ভারতীয়, যাদের পাকিস্তানের কোনাে নির্বাচন কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব ছিল। দু-চারজন ছাড়া। নতুন গণপরিষদ ইচ্ছা করেই করেনি। বরঞ্চ তারা আশিজন দীর্ঘ সাত বছর ধরে একটি ‘অলিগার্কি’ অর্থাৎ কতিপয় লােক দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশের নেতারা যাতে গণপরিষদ মেনে নেন, সে জন্য বাংলা থেকে যাদের মন্ত্রী করা হলাে, তারা হলেন ফজলুর রহমান, গিয়াসুদ্দীন পাঠান, আজিমুদ্দীন আহমদ প্রমুখ, যারা হামিদুল হক চৌধুরী এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের মতােই কোনাে সাধারণ নির্বাচনে কোনােকালে নির্বাচিত হতে পারেননি। তাই তাঁরাও ভারতীয় গণপরিষদ সদস্যদের সঙ্গে সংবিধান না দেওয়ার ব্যাপারে একমত হলেন। তা ছাড়া যেকোনাে সংবিধান হলেই নির্বাচন দিতে হয়। সে নির্বাচনের পর পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব রাখা শক্ত হওয়াই সম্ভব। ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দিলেন। এর বিরােধিতা করার অপরাধে নায়েবে সালারে-সুবা জহিরুদ্দীনের ছমাসের জেল হয়ে গেল। অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠানে নাজিমুদ্দিনের লােক নেই সেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিতে হবে। তাদের হয়রান করতে হবে। এমনকি পরবর্তীকালে নূরুদ্দীন সাহেব ভূগােলের অধ্যাপক নিযুক্ত হওয়ার পরেই তাঁর সরকারি চাকরি খতম হয়ে যায়। কারণ, সে শহীদ সাহেবের লােক । এ রকম ব্যক্তিগতভাবেও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালের জুন মাসে যেদিন স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল, সেদিন আমরা ঢাকা এবং পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলার কর্মীরা আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। কারণ, তিনি স্থিরই করেছিলেন যে তিনি পাকিস্তানে আসবেন না। আমাদের অতঃপর করণীয় কী, সে সম্বন্ধে আলােচনাকালে তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন যে পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের একটা যুক্তফ্রন্ট সৃষ্টি করার মধ্য দিয়েই কেবল আমরা ফ্যাসিবাদী মুসলিম
২৫৭
সরকারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে পারব। ঢাকায় ফিরে এসেই আমরা আমাদের পার্টির লােকদের আমার বাসায় ডাকি এবং সেখানে গণ-আজাদী লীগ (Peoples Freedom League) গঠন করা হয়—এবং একটি ম্যানিফেস্টো তৈরি করে পার্টির কর্মীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সব কর্মীর দ্বারা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমাকে কনভেনর নিযুক্ত করা হয়। যারা প্রথম কমিটিতে ছিলেন, তাঁরা হলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাসাদুক আহমদ, সৈয়দ মােহাম্মদ আলী প্রমুখ। শামসুল হক আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে বর্ধমান চলে গেলেন। শামসুল হক তখন আল্লামা আজাদ সােবহানী ও আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে রুবুবিয়াৎ ও রব্বানিয়াতের তত্ত্ববিষয়ক আলােচনায় অংশগ্রহণ করছেন। এরই প্রভাবে পরে তিনি পূর্ববঙ্গে এসে তার পুস্তক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ইসলাম প্রকাশ করেন। তিনি গণ-আজাদী লীগের ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে একমত হননি। তাই আমাদের সঙ্গে যােগ দেননি। যার ফলে তাঁর নিজস্ব কর্মী বন্ধুরাও আমাদের সঙ্গে যােগ দেননি। আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলাে। অর্থাৎ আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অর্থনৈতিক ভিত্তিতে পার্টি গড়ার চেষ্টা করেছিলাম পাকিস্তান হওয়ার দুমাস আগেই।
২৫ আগস্ট হঠাৎ আমার বাড়ি সরকার ‘রিকুইজিশন’ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি খালি করে দিতে বলল। সরকার এটা বুঝল না যে স্ত্রী-পুত্র, সংসারওকালতি সবে আরম্ভ করলেও ছােটখাটো একটা লাইব্রেরি ও অন্যান্য মালপত্রসহ এত অল্প সময়ের মধ্যে যাওয়া সম্ভব কি না। আমি গেলাম ‘অ্যাকোমােডেশন অফিসে, সেখানে ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন আফতাব আহমদ খান, আইসিএস (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি) ও দ্বিতীয় অফিসার ছিলেন কামালুদ্দীন আহমদ (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত)। তারা দুজনেই বললেন যে তাঁদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। কারণ, এটা মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের নির্দেশ। তবু বলে-কয়ে এক সপ্তাহের সময় নিয়ে এলাম। কিন্তু আমি যুক্ত বাংলার পক্ষপাতী, সুতরাং আমি সরকারের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়েছি। তাই আমাকে কেউ শহরে বাসা ভাড়া দিতে রাজি নয়। অথচ ব্যবসা আমার ওকালতি। জেলা কোর্টের কাছাকাছি অমার থাকা প্রয়ােজন। তা ছাড়া ১৯৩৯ সাল থেকে রেডিও থেকে আমার একটা। ভালাে আয় হচ্ছিল—সে টাকাটা তখন প্রয়ােজনও ছিল। সাপ্তাহিক সমসাময়িক ঘটনার ওপর—১৫ থেকে ২০ মিনিট এবং ইতিহাসের ওপর ধারাবাহিক বক্তৃতা করতে হতাে এবং ওই সময়ে যে সিরিজের ওপর সাপ্তাহিক লেখা পাঠ করেছিলাম, সে হচ্ছে ‘ভুলে যাওয়া মােগল সম্রাটদের কাহিনি’ (Forgotten Mughal emperors-Zahandar Shah to Bahadur Shah II)। তা ছাড়া।
২৫৮
নতুন উকিল হিসেবে সিনিয়রের চেম্বারেও কাজ করতে হতাে। আমি যেমনই হােক একটা বাসা খুঁজেছি, এমন সময় অ্যাকোমােডেশন অফিস থেকে ২৮ আগস্ট তারিখে চিঠি এল যে আমাকে সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করা হলাে এবং আমাকে ২৯ আগস্টের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে। প্রথমে সীতানাথ মােক্তারের একটা ছােট বাড়ি জুমারাইল লেনে উঠলাম। সেখানে নিচে দুটো ঘর আর ওপরে একটি ঘর। এরপর জিন্দাবাহারের বলরাম সাহা উকিলের বাড়ি খালি হলে আমি সে বাড়িতে উঠলাম। পরদিন কাদের সরদার সাহেব আমাকে বললেন, আমি যেন কাউকে ভাড়া না দিই অথবা নিজে ক্রয় না করি। কারণ তিনি ওই বাড়িটা নিতে চান। আমি রাজি হলাম। আমার তখন একটি বাড়ির দরকার। সে বাড়িতে আমি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেছি। অর্থাৎ কূটনৈতিক চাকরিতে যােগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত।
পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কর্মীদের ওপর এমনি নানা রকমের বিপদ নেমে আসতে লাগল। শহীদ সাহেব এলেন না অভিমান করে। আবুল হাশিম সাহেব এলেন না। শামসুল হক বর্ধমানে থেকে গেলেন তার পুস্তকের বিষয়বস্তু নিয়ে আলােচনা করার জন্য। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব, নূরুদ্দীন সাহেব তাঁদের পড়াশােনা সমাপ্ত না করে আসতে পারেন না। আবুল মনসুর আহমদ সাহেব শহীদ সাহেবের ইত্তেহাদ নিয়ে রইলেন। এদিকে আমাদের বিরুদ্ধে সৈয়দ সাহেবে আলম (কালু মিঞা) ও মাজেদ সরদার সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলেন যে আমরা পাকিস্তানবিরােধী ও ইসলামবিরােধী কমিউনিস্ট।
খাজা নাজিমুদ্দিন তার ক্ষমতার অপব্যবহার যেভাবে করতে আরম্ভ করেছিলেন, হামিদুল হক চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরীর (মােহন মিঞা) পরামর্শে, তাতে আমাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে যেত যদি না ঢাকা শহরের লােকেরা নাজিমুদ্দিন সাহেবের ওপর খুব তাড়াতাড়ি বিরূপ না হয়ে উঠত। খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব বুঝতে পারেননি যে স্যার সলিমুল্লাহর দিন আর ছিল না। আহসান মঞ্জিলের মেরুদণ্ড ভাঙা, সােজা হয়ে তাদের দাঁড়ানাের উপায় নেই। আমাদের কেবল প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিতে হবে।
এমন সময় রাজশাহীর মাহবুবুল হক মারফত নূরুদ্দীন সাহেবের একখানা চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন বামপন্থী যুবকদের একত্র করে একটি গণতান্ত্রিক যুব সংস্থা করার জন্য—তাঁরা কলকাতায় বসে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং আরও স্থির করেছেন যে ঢাকায় সে কনফারেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ তখন সাহেবে আলম ঢাকার ভাড়াটে গুন্ডাদের নিয়ে আমাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করছেন। এমনকি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল সাহেব নিরাপত্তার জন্য কাদের সরদার সাহেবের একটি ঘরে বাস করছেন।
২৫৯
এবং সেখানে বসেই ওকালতি করছেন। তা সত্ত্বেও সৈয়দ সাহেবে আলম ট্রাকে করে একদিন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়লেন তাকে অপমান করার জন্য। কারণ তিনি নাকি অনেক লােকের এক বৈঠকে জিন্নাহ সাহেবকে খরাদজ্জালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কথাটা হয়তাে সত্য। কারণ, ফজলুল হক সাহেব প্রায়ই ওই রকম কথা বলতেন। উকিল লাইব্রেরিতে বসে একদিন বলেছিলেন, ‘খরা-দজ্জালের চেহারা কেমন হবে তা তােমরা জানাে? তারপর তিনিই উত্তর দিলেন, তার এক চোখ কানা—স্বর্গে এক পা আর মর্তে এক পা। নাম বলেননি তবে আমরা বুঝেছিলাম যে জিন্নাহর এটা মনােকল অর্থাৎ একচোখা ব্যবহার আর তার পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে দুপায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত। এমনকি একবার পকেট থেকে আট শ টাকা হারিয়ে গেলে নােটখাতায় লিখে রাখলেন আটশ টাকা—জিন্নাহ ফান্ড। রিকশাওয়ালা হাইকোর্টে যাওয়ার ভাড়া ঠিক করল বারাে আনা—হাইকোর্টে পৌছে দিয়েই চাইল এক টাকা। তিনি দিলেন টাকাটা—বাড়ি এসে নােট করলেন—বারাে আনা রিকশা ভাড়া, চার আনা জিন্নাহ ফান্ড। একদিন হঠাৎ নােটবইটা আমার। হাতে পড়ল—অনেক পৃষ্ঠাতেই দেখলাম তিনি প্রায়ই জিন্নাহ ফান্ডে চাঁদা দিয়েছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নানা, আপনি জিন্নাহকে গালি দেন অনবরত অথচ জিন্নাহ ফান্ডে চাদাও দেন দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘যে টাকার হিসাব মেলে না—যে টাকা লােকে আমাকে ঠকিয়ে নেয়, যে টাকা চুরি হয়, সে তাে সবই জিন্নাহ ফান্ডেই যায়, নইলে যায় কোথায়। এই যে প্রতিটি ওকালতনামার ওপর “কায়েদে আজম রিলিফ ফান্ডে” পয়সা দিয়ে যাচ্ছ—তার হিসাব কি কোনাে দিন কোনাে কাগজে দেখেছ?’ তার কথার মধ্যে ব্যঙ্গ ও খেদ দুটোই মিশ্রিত থাকত। তাই বলে যে মানুষটি স্যার সলিমুল্লাহর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁকেই সলিমুল্লাহর বােন আমিনা বিবির ছেলে গুন্ডা দিয়ে অপমান করছে—আর মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন অন্তরে। আনন্দ পাচ্ছেন—এ যেন দশ বছর আগে পটুয়াখালীর নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশােধ।
নূরুদ্দীন সাহেবের চিঠি পাওয়ার কয়েক দিন পরেই রাজশাহীর আতাউর রহমান এলেন ঢাকায় পরামর্শ করতে—সভার স্থান কোথায় হবে। কলকাতার কর্মীরা ধরে নিয়েছিলেন যে আমরা জেলা বার লাইব্রেরিতে করতে পারব। আমি তাকে, তাসাদুক আহমদ, সৈয়দ মােহাম্মদ আলী, তােয়াহা সাহেব ও তাজউদ্দীন সাহেবের উপস্থিতিতে অবস্থাটা বিশ্লেষণ করলাম। একমাত্র স্থান আমি বললাম যেখানে গুন্ডারা মারামারি করতে পারবে না, সে হলাে আবুল হাসনাত সাহেবের বাড়ি, তাঁর ‘লন’ প্রকাণ্ড—নানা ফুলে-ফলে সাজানাে। সুতরাং তিনি রাজি হবেন কি না, তাঁর সঙ্গে আলাপ না করে বলা যাবে না।
২৬০
আমার যত দূর মনে পড়ে আমি ও শামসুল হক তার বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বেশ সহজেই রাজি হলেন। কারণ বহু বছর পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান—খাজা নাজিমুদ্দিনের তখন ইচ্ছা হয়েছে সৈয়দ সাহেবে আলমকে ভাইস চেয়ারম্যান করবেন—এবং সেটা হাসনাত সাহেবকে বলা হয়েছে। তিনি কোনাে তর্ক করেননি খাজা সাহেবের সঙ্গে, কিন্তু অন্তর তার জ্বলে যাচ্ছিল। সুতরাং আমাদের চেয়ে দেখলাম তিনিও কম ক্ষিপ্ত নন আহসান মঞ্জিলের প্রতি। তার একটু দুর্বলতা ছিল খাজা হাবিবুল্লাহর জন্য; কিন্তু তিনি অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হওয়ার পরে আর সে দুর্বলতা রইল না। এভাবেই স্থান সম্বন্ধে আমরা অনেকটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌছালাম। এরপর ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে আমাদের পুরােনাে পার্টি অফিসে এক বৈঠকে বসে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আমি ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলাম, যেহেতু এককালে ওই পার্টি হাউসের নেতৃত্বের ভার আমার ওপর ছিল। যুবক’ বলতে কী বােঝাবে, সে সম্বন্ধে আলােচনা করে ঠিক হলাে যে যারা ত্রিশ বছর বয়স পেরােয়নি—তাদেরই যুবক’ বলে চিহ্নিত করা হবে। অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা সাম্প্রদায়িকতার সমর্থক, তাদের বাদ দেওয়া হবে। ১৯৪৩ সালে আমার ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে—সুতরাং আমি কেবল তাদের সমর্থন করতে পারি, সাহায্য করতে পারি কিন্তু তাদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে পারি না। স্থির হলাে অধিবেশন বসবে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে আর তার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ভার নিলেন সর্বজনাব তাসাদ্দক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা ও আবদুল আউয়াল।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে প্রফেসর আবুল কাসেম তমদুন মজলিস নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। নূরুল হক ভূইঞা সাহেব ওই সংস্থার কনভেনর নিযুক্ত হন। সংস্থাটি ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রথম থেকেই ওই সংগঠন বাংলা ভাষা সর্বত্র প্রচলন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা সভা, ‘সিম্পােজিয়াম করে, পুস্তিকা প্রকাশ ও খবরের কাগজের মাধ্যমে তাদের আন্দোলন এগিয়ে নিতে চাইছিল। পরে তাদের ধারণা হয় যে ছাত্র এবং রাজনীতিবিদদের সাহায্যের প্রয়ােজন আন্দোলনে সফলতা লাভ করার জন্য।
বেহ ওই সময় শাহ আজিজুর রহমান সাহেবের নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল একমাত্র মুসলমান ছাত্র প্রতিষ্ঠান। শাহ্ আজিজুর রহমান সাহেব খাজা সাহেবদের দলে—সুতরাং শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের দলীয় ছাত্রনেতারা স্থির করেন যে অন্য একটি ছাত্রসংগঠন করা প্রয়ােজন। বিভিন্ন জেলার কয়েকজন ছাত্রনেতা সেপ্টেম্বর মাসে একত্র হয়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে। নইমুদ্দীন সাহেব ওই সংস্থার কনভেনর’ হন এবং অলি আহাদ সাহেব শহর ছাত্রলীগের কনভেনর হন।
২৬১
সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে অনেক ছাত্র এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে থাকে এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খােন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবদের নেতৃত্বে মােগলটুলী অফিসে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠিত হয়। শামসুল হক সাহেব ওই ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কনভেনর হন। ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ সেসব যুবককে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়, যাঁরা শহীদ সাহেব অথবা আবুল হাশিম সাহেবের জন্য মুসলিম লীগে কাজ করেছেন, তাঁরা সবাই পুনরায় মুসলিম লীগ দখল করার প্রচেষ্টা চালানাের জন্যই ওই ক্যাম্প’ গঠন। করেছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা বােকা বনলাম—কারণ আবুল হাশিম সাহেবের শেষ উপদেশ ছিল—১৯৪৭ সালের জুন মাসে বামপন্থীদের একতা গড়ে তুলতে হবে। তাই আমি ঢাকায় এসে গণ-আজাদী লীগ গঠন করি। যার ভিত্তি সেই লাহাের প্রস্তাব–পূর্ব পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং দুটো পাকিস্তানকে একত্রে থাকতে হলে কী ভিত্তিতে থাকবে, তা পরে নিরূপণ করবে দুদেশের লােকেরা। তাই আমরা বললাম, বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, তা তারাই স্থির করবেন। আবার যদি কেন্দ্র গঠিত হয়, তবে দুদেশের রাষ্ট্রভাষাই কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা হবে। যেমনটা বেলজিয়াম, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পরে যারা ঢাকা এলেন, তাঁদের মধ্যে দেখলাম যত সত্বর সম্ভব ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্টাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার মনে হলাে ৬ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হওয়ার পর বামপন্থী ঐক্যের প্রশ্নটাও যেন তার বিশেষত্ব হারাল। এরপর বাকি রইল যে পরের বছর কারা কলকাতা যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যুব সম্মেলনে যােগ দিতে।
ওই সময় খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল খুবই দ্রুত। কারণ, সরকার খাদ্যে ঘাটতি জেলাগুলাের জন্য কোনাে রকম ব্যবস্থা না করেই খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলাগুলাে কর্ডন করে ধান ক্রয় করতে আরম্ভ করে। ফলে ঘাটতি জেলাগুলােতে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। ওই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী পীরজাদা আবদুস সাত্তারের গাড়ির ওপর কার্জন হলের সম্মুখে ছাত্ররা হামলা করে। ওই নিয়ে তােফাজ্জল আলী (টি আলী) সাহেবের জয়নাগ রােডের বাড়িতে এক সভা হয়। সেখানে বগুড়ার মােহাম্মদ আলী ও আরও কয়েকজন পরিষদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
কলকাতার কাজ সম্পন্ন করে গান্ধীজি ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে দিল্লিতে পৌছান। দিল্লিতে চলছিল তখন হত্যা, লুট, উৎপীড়ন এবং ধর্ষণ। গান্ধীজি বিড়লার বাড়ি গিয়ে দিল্লি তথা ভারতে মানবতাবােধ জাগানাের জন্য সচেষ্ট হন। প্রতিদিন তার প্রার্থনা সভায় হাজার হাজার লােক যােগ দিত।
২৬২
দলীয় কর্মীদের ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা গ্রহণ করতে দেখে আমি যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এমনি সময় ডাক্তার মালেক আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন একটি ট্রেড ইউনিয়ন সভায়। আমার যত দূর মনে পড়ে সভাটি ছিল ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। আমার কাছে শ্রমিক আন্দোলন একেবারে নতুন ছিল। কারণ প্রফেসর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, যিনি আমাকে ১৯৩৭ সালে এম এন। রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই তিনিই আমাকে ১৯৪৫ সালে পােস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের ঢাকা ব্রাঞ্চের সভাপতির পদ গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে বছরই ঢাকার আরএমএস কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হই। এরপর পূর্ব বাংলা ব্যাংকিং কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতির পদ গ্রহণ করতে আমাকে বলা হয়। কিন্তু আমার সম্পর্ক ছিল। কেবল কেরানিকুলের সঙ্গে। ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের ভাষায় ‘হােয়াইট কলার’ শ্রমিকদের সঙ্গে কেবল পরিচয় হয়েছিল। সত্যিকার মেহনতি মানুষের সঙ্গে তখনাে আমার দেখা হয়নি। অথচ ওই সময় নারায়ণগঞ্জ সুতাকলের শ্রমিকদের একটা জীবন-মরণ সংগ্রাম চলছিল।
ঢাকায় সন্ত্রাসবাদীদের এককালের নেতা অনুশীলন পার্টি প্রতুল গাঙ্গুলী ঢাকায় বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টি (Revolutionary socialist Party of India=RSPI) গঠন করেন। তারই বন্ধু গােপাল বসাক, নেপাল নাগ ও অনীল মুখার্জি নিজেদের ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (CPI.) সদস্য বলে। ঘােষণা করেন এবং কংগ্রেস সােশ্যালিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন । কয়েকজন ভারতীয় বলশেভিক পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। প্রতুল গাঙ্গুলীর মৃত্যুর পর অমর ব্যানার্জি ও নেপাল নাগ আরএসপিআই’-এ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং নারায়ণগঞ্জে ঢাকেশ্বরী মিলের (১ নং) শ্রমিকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। নারায়ণগঞ্জের অন্য মিলশ্রমিকদের সংগঠিত করে সিপিআই। বলশেভিক পার্টির দীনেন সেন ও গৌর বর্মণ ঢাকা বিদ্যুৎ কর্মচারী এবং মিউনিসিপ্যালিটির ধাঙড়দের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৪৬ সালের জুন মাসের পূর্ব পর্যন্ত আমি মুসলিম লীগ রাজনীতিতে। এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম যে শ্রমিকদের সমস্যা বা শ্রেণিসংগ্রামের প্রতি আমার দৃষ্টি একেবারেই আকৃষ্ট হয়নি। আমার একমাত্র দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আহসান মঞ্জিলের প্রতি। আহসান মঞ্জিলের পতনের মধ্য দিয়ে আমি বাস্তিল দুর্গ ধ্বংসের স্বপ্নই দেখেছিলাম । আমার মতে, ১৯৪৪-৪৫ সালেই আহসান মঞ্জিলের নেতৃত্বের অবসান হয়ে গিয়েছিল—খাজা নাজিমুদ্দিনকে ১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এসে আত্মরক্ষার জন্যই ব্যস্ত থাকতে হলাে। আগের দিনের মতাে গুন্ডাদের দ্বারা কাউকে আহসান মঞ্জিলে ধরে নিয়ে দৈহিক উৎপীড়ন ও মানী লােকদের অপমান করার ক্ষমতা আর ছিল না। ছাত্রদের
২৬৩
আন্দোলন ও সেক্রেটারিয়েটের কেরানিদের ধর্মঘট তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। নতুন সংগ্রামের প্রয়ােজন। হলাে তাদের বিরুদ্ধে, যারা মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে ওপরে উঠে নিজেদের উচ্চ মধ্যবিত্ত বলে জাহির করতে লাগলেন। কারণ, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ও আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল অভিজাত ঘরের লােকদের। তাদের সঙ্গে তুলনা। করা যায়—ময়ূরপুচ্ছে ঢাকা দাঁড়কাকের সঙ্গে। তাঁরা যেহেতু মধ্যবিত্তের মধ্য থেকেই উঠে এসেছিলেন, সুতরাং তারা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের দুর্বল দিকটার কথা জানতেন। বাংলায় এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন নুরুল আমীন, ফজলুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী। আমার নিজের মনে হলাে যে এঁদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ছাড়াও শ্রমিকদের সাহায্য প্রয়ােজন হবে।
১৯৪৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কেবল এন.এম যােশী কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন—১৯৪৬ সালে চারজন সদস্য কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচিত হন। তাঁরা হলেন ১. এন এম যােশী, ২. আফতাব আলী, ৩. মনিবেন বেরা ও ৪. গুরুস্বামী। তাদের সম্মিলিত চেষ্টায় ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল। ডিসপিউটস অ্যাক্ট ১৯৪৭ সালে কেন্দ্রীয় পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়—তখন এআইটিইউসি (All India Trade Union Congress) সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শ্রমিক সংস্থা, তারপরেই বােধ হয় এম এন রায়ের আইএফএল (Indian Federation of Labour)। আমি শ্রমিক আন্দোলনে রায়পন্থী আর ডাক্তার মালিক, আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ এআইটিইউসির নেতা। এর মধ্যে একমাত্র আফতাব আলী সাধারণ শ্রমিক হিসেবে জীবন আরম্ভ করেছিলেন এবং পরে ডাঙ্গে ১৯২৬ সালে যখন এআইটিইউসির সেক্রেটারি হয়েছিলেন, তখন আফতাব আলী সাহেব সহকারী সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। আফতাব আলী সাহেবই এশিয়া থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) গভর্নিং বডির তখন একমাত্র সদস্য।
২৮ সেপ্টেম্বরের সভায় ইস্টার্ন পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন। (EPTUF) গঠিত হয়। সভায় উপস্থিত করা হয় AITUC-র একটি প্রস্তাব, যাতে বলা হয়েছিল :
In view of the division of India into two States and the problems arising from it, the General Council permits the affiliated trade unions from Pakistan areas to form a separate central trade union organization if they do so wish and appoints a provisional Committee of the following with powers to co-opt, to examine, and dicide the questions-as they think proper:
২৬৪
East Bengal-Comrade A M Malik, Faiz Ahmad, Md. Ismail, Nepal Nag and Dinen Sen.
West Punjab–Comrade Fazal Elahi Qurban, Mirza Ibrahim and Ramesh Chandra.
Sind-Comrade Narayan Das Bechar, Sobo and J. Bukhari.
The General Council is confident that if it decided to form a separate organization, machinery will be provided for pooling common experience of Indian and Pakistani Trade Unions and rendering help to each other in common matters.
যাঁরা ওই সভায় আলােচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা হলেন ডাক্তার মালিক, কমরেড মারুফ হােসেন, নেপাল নাগ, দীনেন সেন, সমর ঘােষ, অশ্বিনী দেব, অমৃতেন্দু মুখার্জি, মােহাম্মদ ইসমাইল, অনীল বসাক, রাধাগােবিন্দ সরকার, সুনীল সরকার, আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদ, সুলতান আহমদ ও প্রফেসর শিবদাস গাঙ্গুলি।
EPTUF-এর সভাপতি হন ডাক্তার মালিক। আফতাব আলী ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে ইস্তফা দিয়ে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য। হন এবং তার জায়গায় ডাক্তার মালিক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য থাকাকালীনই আফতাব আলী ILO-এর গভর্নিং বডির সদস্য হয়ে যান। তিনি জেনেভায় এবং লন্ডনেই থাকতেন। সহ সভাপতি হলেন নেপাল নাগ, মােহাম্মদ ইসমাইল, মােহন জমাদার। সেক্রেটারি হলেন ফয়েজ আহমদ সাহেব এবং অনীল মুখার্জি ও গৌর বর্মণ হলেন সহকারী সম্পাদক।
EPTUF ডাক্তার মালিককে, এশিয়ার সদস্যদেশগুলাের দিল্লি কনফারেন্সের প্রতিনিধি মনােনীত করে। কনফারেন্সের অধিবেশন হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। পাকিস্তান সরকার ডাক্তার মালিকের নামই ILO-তে পাঠাল। তার পরামর্শদাতা হয়ে গেলেন নেপাল নাগ। যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল তখন পাকিস্তানের শ্রমমন্ত্রী।
১৯৪৬ সালে নারায়ণগঞ্জ শ্রমিক আন্দোলনের কথা সে সভায় আলােচনা হলাে—সেখানে ৯ হাজার সুতাকলশ্রমিক তিন মাস ধরে কীভাবে ধর্মঘট চালিয়েছিলেন। ধর্মঘটের কারণ ছিল কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক পিসি যােশী মিল কর্মীদের সভায় বক্তৃতা দিতে চাইলে মিল কর্তৃপক্ষ তাঁকে বক্তৃতা করতে দিতে অস্বীকার করে। ফলে ১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শ্রমিকেরা ধর্মঘট করলে ২১ জন শ্রমিকনেতাকে বরখাস্ত করা হয়। শ্রমিকেরা দাবি তােলেন—বরখাস্ত শ্রমিকদের পুনরায় কাজে নিয়ােগ করতে
২৬৫
হবে আর দশ টাকা মণ দরে শ্রমিকদের চাল সরবরাহ করতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি শ্রমিকদের ওপর পুলিশ লাঠি চালায়। মার্চ মাসের ২৫ মিলে ভয়ানক উত্তেজনা দেখা দেয়। যার ফলে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়। দুজন ঘটনাস্থলেই প্রাণত্যাগ করেন আর ৭০ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু ধর্মঘট চলতে থাকে। ৭ মে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। ঘটনাটা আমার মনে গভীর রেখাপাত করে এবং আমি শ্রমিক আন্দোলনে যােগ দেওয়ার কথা ভাবি। কিন্তু ডাক্তার মালিকের ইচ্ছা সত্ত্বেও আমি এক ডাক্তার মালিক ও আফতাব আলীকে ছাড়া কাউকে জানতাম না বলে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে যােগ দেওয়া উচিত কি না, তা ভেবে দেখার সময় নিই।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে নিখিল পাকিস্তান পােস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের সভাপতি করা হয় এবং ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের ঢাকা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হই। ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের সভাপতি তখন অ্যাডভােকেট নূরুল হুদা। সেই সময় টেলিগ্রাফ ইউনিয়ন গঠিত হয়। সভাপতি বি এ সিদ্দিকী এবং সেক্রেটারি এ আর সুন্নামত। পােস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক প্রথমে আবু তাহের সাহেব, পরে গােলাম মর্তুজা সাহেব।
ডাক্তার মালিকের ইচ্ছার কথা এবং ILO-এ গঠনের কথা আমি নূরুল হুদা ও বদরুদ্দীন সিদ্দিকী সাহেবকে বলি। কারণ, আমরা তিনজনই একই ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলাম। অর্থাৎ ওকালতি। সুতরাং আমাদের মধ্যে হৃদ্যতা যত বেশি ছিল, তত ছিল না EPTUF-এর নেতাদের সঙ্গে। কয়েকটি বৈঠক হওয়ার পর স্থির হয় যে আমরা ভিন্ন ফেডারেশন করব। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে আমরা একটি একমতের ইউনিয়নগুলাের এক সভা ডাকি। সে সভায় পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (TUFP) গঠন করা হয়। নূরুল হুদা সাহেব সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক এবং বদরুদ্দীন সিদ্দিকী সাহেব কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। আমাদের সঙ্গে থাকে রেলওয়ে এমপ্লয়িজ, পােস্টাল এমপ্লয়িজ, টেলিগ্রাফ এমপ্লয়িজ, টেলিফোন এমপ্লয়িজ, দোকানদার কর্মচারী প্রভৃতি। অর্থাৎ আমরা নেতা হলাম ‘হােয়াইট কলার’ শ্রমিকদের আর EPTUF মেহেনতি শ্রমিকদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। এভাবেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেবার ও অফিস লেবার দুভাগে বিভক্ত হয়ে থাকল। এটা শ্রমিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হলেও নেতাদের স্বার্থে সাময়িকভাবে আমরা ওই পদ্ধতি গ্রহণ করলাম।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে বার্মা ও সিলােন (শ্রীলঙ্কা) স্বাধীন হলাে। ব্রিটিশ ভারতে আমরা একত্রে ছিলাম। ১৯৩৫ সালের ভারতীয় আইনের পর
২৬৬
বার্মা ভারত থেকে ভাগ হয়ে যায়, কিন্তু শ্রীলঙ্কা আমাদের সঙ্গেই ছিল স্বাধীনতা পর্যন্ত। বার্মা প্রথম থেকেই ব্রিটিশবিরােধী নীতি গ্রহণ করে এবং কমনওয়েলথ’-এ যােগ দিতে অস্বীকার করে। তার অবশ্যই অনেক কারণ ছিল। বার্মাবাসীর ওপর যে কেবল ব্রিটিশরাজই উৎপীড়ন চালিয়েছিল তা নয়, ভারতীয় উপনিবেশবাদীরা বার্মাকে যথেষ্ট শােষণ করছিল। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা কোনাে ক্ষেত্রেই বার্মার লােকদের স্থান ছিল না। তাদের সম্পদ সবাই মিলে লুট করেছে। আর তাদের রেখেছিল অনভিজ্ঞ, স্বপ্নচারী জাত করে। সব ব্যাপারেই তাদের অজ্ঞ করে রাখা হয়েছিল। অথচ শােষকদের মুখ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রচার চলছিল যে তারা অলস প্রভৃতির লােক, স্ত্রীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিজেরা চুরুট খায়। যেমন নয়া চীন সরকার গঠিত হওয়ার আগে চীনাদের চণ্ডুখাের, ডাকাত এবং খুনি বলে চিত্রিত করা হতাে। সিলােনেও ভারতীয় উপনিবেশবাদ দৃষ্টিগােচর হয়। তবে সিলােনের লােকেরা ছিল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অনন্তকুমার স্বামীর সময় থেকে আন্তর্জাতিক ব্যাপারে আগ্রহী।
এর কিছুদিন পরেই ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইনে। বেলফোর ঘােষণার পর থেকেই ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা চলছিল প্যালেস্টাইনে। কিন্তু পরে ব্রিটিশ সরকার নানা দিকে চিন্তা করে। হঠাৎ প্যালেস্টাইন থেকে নিজেদের শাসনব্যবস্থা তুলে নেয়। ফলে প্যালেস্টাইনে দেখা দেয় এক চরম অরাজকতা, আমার মনে হয় সেই অরাজকতার তুলনা মেলে ব্রিটিশের একই উপায়ে সাইপ্রাস থেকে চলে যাওয়ার পর সেখানে। প্যালেস্টাইনে হয় আরব-ইহুদি সংঘর্ষ। আর সাইপ্রাসে চলছিল গুন্ডার রাজত্ব। তারপর প্যালেস্টাইনের সমস্যাটা জাতিসংঘে উপস্থিত করা হয়। আমেরিকা প্রথম ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। পরে মার্কিন সরকারও ঢিলে দিতে থাকে। তখন সােভিয়েত হঠাৎ ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লাগে—কী বুঝে তা আমার কোনাে দিনই বােধগম্য হয়নি। জাতিসংঘের প্রথম সেক্রেটারি ট্রিগভিলাই অবসর গ্রহণ করার পর এ সম্বন্ধে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে’ ঢাকা ও কলকাতা ছাত্রদের মধ্যে ক্যাম্পের নেতৃত্ব সম্বন্ধে মতবিরােধ দেখা দিতে শুরু করল। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে যারা কাজ করেছেন—কি কর্মী কি ছাত্র—তারা, ফজলুল কাদের ব্যবসার দিকে মন দেওয়ার পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হলাে। এদিকে শামসুল হক সাহেবও ভালাে সংগঠক এবং বেশ কয়েক বছর আগেই ছাত্রজীবন সমাপ্ত করে বড়দের সঙ্গে রাজনীতি করে তার নেতৃত্ব সুদৃঢ় করার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। শামসুল হক সাহেব
২৬৭
আর কর্মী নন, তিনি নেতৃত্বের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন ক্রমাগত। শামসুল হক ও শেখ মুজিব স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রিয়তায় বিশ্বাস করতেন না। লােকে কাউকে ভালােবাসলেই তার ডাকে সাড়া দেবে বা তার নেতৃত্ব মেনে নেবে—একে তারা মনে করতেন অস্বাভাবিক এবং জনসাধারণের প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন বলে। তাদের মতে সবকিছুই সংগঠন করতে হয়। স্টেশনে অভ্যর্থনা কেউ করে না, যদি না সেখানকার কর্মীদের দিয়ে তার ব্যবস্থা করা যায়। সভায় লােক জোগাড় করা বা তার বক্তৃতার সময় হাততালির ব্যবস্থা করা—সবকিছুর জন্যই তিনি পূর্ব থেকে ব্যবস্থা করে রাখতেন। এমনকি, আমি যখন স্বাধীন বাংলার সমর্থন পাওয়ার জন্য নেত্রকোনার সভায় শামসুল হকের সঙ্গে গিয়েছিলাম ১৯৪৬ সালে, তখন দেখেছিলাম বিভিন্ন স্টেশনে তার জন্য ফুলের মালার ব্যবস্থা এবং নেত্রকোনায় গিয়ে দেখলাম স্টেশনে কয়েক শ ছাত্র আমাদের অভ্যর্থনার জন্য এসেছে এবং স্লোগান দিচ্ছে স্বাধীন বাংলা। জিন্দাবাদ’। আমি অবাক হলাম—কারণ আমার ধারণা ছিল যে সেখানকার লােকদের কাছ থেকে আমরা প্রতিরােধের সম্মুখীন হব এবং আমি অনেক ইতিহাস ঘেঁটে আমাদের লক্ষ্যের সমর্থনে নানা যুক্তি স্থির করে এসেছিলাম। যার প্রয়ােজনীয়তা সত্যিই ছিল না। সাধারণত তিনি লােকের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতেন। কিন্তু প্রয়ােজন হলে নির্মম হতে পারতেন। ভবিষ্যতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে, এমন লােকের বিরুদ্ধে অন্য লােককে টেনে ওপরে তুলতে দ্বিধা করতেন না। আর কোনাে কর্মী যদি ভুলেও আনুগত্য স্বীকার না করত, তবে তাকে ক্ষমার চোখে কোনাে দিন দেখেননি। অন্যদিকে তিনি যাকে নেতা বলে মানতেন, তাঁর প্রতি তাঁর আনুগত্য থাকত অপরিসীম। আমি সেটা দেখেছি যখন তিনি ফজলুর রহমান সাহেবের সঙ্গে কাজ করতেন। আবার দেখেছি যখন আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে কাজ করতেন। নিজের ওপর তার ভীষণ বিশ্বাস ছিল এবং কাউকে তিনি তার চেয়ে বড় বা বেশি বুদ্ধিমান মনে করতেন না। আমার মনে হয়, ওই সব গুণ যেমন তাঁকে রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আবার এগুলাের জন্যই শেষ পর্যন্ত ‘মেগালােমেনিয়া’ হয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন, কেউ জানে না। আমি তখন বিদেশে, ফিরে এসে তার খোঁজ করেছি, কিন্তু পাইনি। লােকমুখে শুনলাম যে শেষের দিকে তিনি মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। সাধারণ ঘরে জন্ম নিয়ে অবিভক্ত বাংলার নেতাদের তাঁর কথা শুনতে বাধ্য করেছিলেন—তখন। বুঝতে পারেননি মানুষের শক্তি এবং ক্ষমতারও একটা সীমা আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে অসুস্থ হওয়ার আগে তাঁর আদর্শ ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রাজনৈতিক নেতৃত্ব। নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যদি তার কয়েকজন বিশ্বাসী অনুচর (আসহাব) থাকে, থাকবে একটি পুস্তক—যা অনুচরদের
২৬৮
পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে (আল-কোরআন)। থাকবে এমন স্ত্রী, যে তার রাজনৈতিক জীবনে অর্থ সাহায্য করবে এবং তাঁকে অর্থের কথা ভাবতে হবে না (বিবি খাদিজা রা.) এবং স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি দ্বারা সমস্যার সমাধান (এলহাম) করা। শামসুল হক সাহেব যদি কোনাে ক্ষুদ্রতর রাজনৈতিক নেতাকে আদর্শরূপে গ্রহণ করতেন, তবে তাঁর যেসব গুণের সমন্বয় ছিল, তাতে দেশের নেতৃত্বে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন।
তাঁর সঙ্গে যার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে যাচ্ছিল, তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব। শেখ সাহেব শামসুল হকের তুলনায় সে যুগে বেশি বাস্তবধর্মী ছিলেন—তিনি প্লেটোর আকাশে তাকিয়ে থাকা প্রতিমূর্তি ছিলেন না—তিনি সেই যুবক বয়সেও অ্যারিস্টটলের মাটির দিকে তাকিয়ে থাকা প্রতিমূর্তির মতাে ছিলেন। সত্যি বলতে আমি অ্যাথেন্সে দুটি মূর্তি যখন প্রথম দেখি বে১৯৫৩ সালে, তখন কেন যেন তাদের দুজনের কথা আমার মনে হয়েছিল। আদর্শের চাইতে দৈনন্দিন জীবনের পক্ষে প্রয়ােজনীয় বিষয়ের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল বেশি। শেখ সাহেব তত্ত্বের বা মতবাদ প্রচারের চেয়ে বাস্তব জীবনের সংগ্রামে বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। তাত্ত্বিক আলােচনায় সময় ব্যয় না করে কর্মরত থাকায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর চোখে-মুখে একটা দীপ্তি ছিল। কর্মীদের মধ্যে, ভবিষ্যতে যে তাঁর মুঠার মধ্যে আসতে বাধ্য, সে বিশ্বাস জন্মানাের ক্ষমতা তাঁর ছিল, যেসব কর্মী তাঁর সান্নিধ্যে যেত, তাদের মনে একটা কল্পনার সুখী সমাজের স্বপ্ন সৃষ্টি করার শক্তি ছিল তার। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতৃত্বে। ওঠার জন্য অন্য যেসব পন্থা শামসুল হক সাহেব গ্রহণ করেছিলেন, তা-ও ঢাকায় এসে তিনি রপ্ত করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখে যখন ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের মাহুতটুলীর বাড়িতে রেডিওর খবর শুনছিলাম, তখন হঠাৎ একটা খবর ফ্ল্যাশ করা হলাে যে—গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দুশ্চিন্তা হলাে, যদি কোনাে মাথা খারাপ মুসলমান যুবক এ কাজ করে থাকে, তবে ভারতে ভীষণ মুসলমান-নিধন চলবে আর লাখ লাখ লােক আমাদের দেশে আসার চেষ্টা করবে। অনেকটা নিশ্চিত হলাম যখন নয়টার খবরে জানা গেল যে তাঁকে হত্যা করেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের এক যুবক–নাথুরাম গডসে। আমরা কলকাতা স্টেশন ধরলাম এবং ভারতের নেতাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি শুনলাম। গভীর দুঃখের সঙ্গে একটি দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। হঠাৎ খবর পেলাম গান্ধীজির জন্য ঢাকা রেডিও এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে কয়েকজন মেয়ে আর্টিস্টকে’ স্টেশনে আনেন। তাদের গান শেষ হওয়ার পর রেডিওর পিকআপ গাড়িতে করে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চারজনের মধ্যে দুজনকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি যখন সােয়ারীঘাট
২৬৯
থেকে আর দুজনকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন গাড়ি থামিয়ে চারজন মাতাল ছুরি দেখিয়ে দুটো মেয়েকেই গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে নদীর তীরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। মেয়েরা চিল্কার করে সাহায্য চাইছিল, কিন্তু অনেক লােক জমে গেলেও, কেউ সাহস করে গুন্ডাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল না। আমি খবর পেয়ে মােগলটুলী অফিসে গিয়ে কর্মীদের নিয়ে মেয়েদের উদ্ধার করার জন্য গেলাম। পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেওয়া হলাে। আমরা যখন পৌছেছি, তখন তাদের একেবারে নদীর পাড়ে নিয়ে গেছে এবং তাদের কাপড়-জামা খুলে ফেলেছে। মেয়েরা মরণপণ করে ছুটতে চেষ্টা করছে। সমস্ত দেহ, বিশেষ করে মুখ-বুক ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লােক সাহস করে লাঠি, ইট-পাটকেল নিয়ে তাদের ঘিরে ফেলে এবং পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। যখন বিশ্ববাসী সবাই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে খবর শােনার প্রতীক্ষায়, তখন গুন্ডাদের হাতে মেয়েদের এ লাঞ্ছনা বিশ্বাস করা ছিল অসম্ভব। তবু মাঝরাতে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল। গান্ধীজি কলকাতার মুসলমানদের জন্য অনশন এবং জীবনের শেষ পাদে পাকিস্তানের পাওনা টাকা দেওয়ার জন্য অনশন করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে নতিস্বীকার করানাের পরে সেই পাকিস্তানের মুসলমান গুন্ডারা এত বড় পৈশাচিক কাণ্ড করে ফেলল, ভাবতেই পারি না। শত শত মানুষের সম্মুখে—এ লজ্জা ঢাকার কোনাে স্থান ছিল না আমাদের। সে রাতে ঘুমের ঘােরে স্বপ্নে দেখলাম গান্ধীজিকে—সেই আশ্রমে আমাদের ফোকলা দাঁত বের করে হেসে বলছেন, ভবিষ্যৎ ইতিহাসই স্থির করবে যে আমি কপট, মােনাফেক কি না। তােমাদের কথায়ই আমার নােয়াখালী যাওয়া বন্ধ হবে না—আমি যখন নােয়াখালী যাওয়ার কথা স্থির করে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম, তখন বিহারে দাঙ্গা আরম্ভ হয়নি। আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম অসন্তুষ্ট হয়ে অবজ্ঞাভরে, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে মনে হলাে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়া আর হলাে না। এ দুঃখ আমার বাকি জীবন আমার বিবেককে দংশন করবে।
পরদিন বােম্বে থেকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের বিবৃতি দেখলাম ‘Weep weep India Weep: If you have tears shed them now.’
এদিকে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হামিদুল হক চৌধুরী পরিষদ সদস্য ছিলেন না। ১৯৩৫ সালের আইনে তাঁরা ছয় মাসের বেশি মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন না। তাই প্রথম টাঙ্গাইল দক্ষিণ নির্বাচনী এলাকায় আসন খালি হওয়ায় তিনি সেখানে প্রার্থী হলেন। ওই সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কিছুদিনের জন্য কাগমারী এসেছিলেন। সবাই ধরে তাঁকে প্রার্থী করে দিলেন। নাজিমুদ্দিন সাহেব ভয় পেয়ে সেখান থেকে তার নাম প্রত্যাহার করলেন। ফলে মওলানা সাহেব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিষদে
২৭০
নির্বাচিত হলেন। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে তার কোনাে আকর্ষণ না থাকায় তিনি আসাম চলে যান। ওখানে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আসাম সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজবন্দী করে রাখে। ওদিকে দুই মাসের মধ্যেও কোনাে নির্বাচনী হিসাব (Election Return) দাখিল না করায় ইলেকশন কমিশনার তাঁকে দুবছরের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযােগ্য বলে ঘােষণা করেন।
এদিকে নাজিমুদ্দিন সাহেব টাঙ্গাইলে নাম প্রত্যাহার করার পর ফরিদপুরের আহমদ আলী মৃধাকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য মনােনয়ন করে তার আসন খালি ঘােষণা করান। কিন্তু সেখানেও বিপদ এল । কর্মীদের সবাই সেখানে গিয়ে উপস্থিত। তাই তিনি আর ওখানে না দাঁড়িয়ে হামিদুল হক সাহেবকে প্রার্থী করলেন। কিন্তু হামিদুল হক সাহেব সে নির্বাচন কেন্দ্রে গেলে ছেলেরা এমন বিক্ষোভ দেখাল যে হামিদুল হক আর প্রার্থী হতে সাহস পেলেন না।
এরপর খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ সাহেবকে সেক্রেটারি এডুকেশন বাের্ডের চেয়ারম্যান করে তার ভূঞাপুর আসন খালি করে সেখানে যে প্রার্থী তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন রিটার্নিং অফিসার তাঁর দরখাস্ত নাকচ করে দেন কি একটা টেকনিক্যাল ভুলের জন্য। ফলে নাজিমুদ্দিন সাহেব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেব্রুয়ারি মাসেই পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
কিন্তু তখনাে হামিদুল হকের জন্য কোনাে আসন পাওয়া গেল না। এদিকে ছমাস পার হয়ে যাচ্ছে। গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ সাহেবকে বলেকয়ে ১৯৩৫ সালের আইনের ওই বিশেষ ধারা অর্ডিন্যান্স পাস করে সংশােধন করে ছমাসের জায়গায় নমাস করে নিলেন। কিন্তু তবু তার আসনের জোগাড় হলাে না। শেষ পর্যন্ত নাজিমুদ্দিন ফজলুর রহমান সাহেবকে ধরলেন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসনের পদে ইস্তফা দিতে। ফজলুর রহমান সাহেব রাজি হলেন না। নাজিমুদ্দিন সাহেব জিন্নাহ সাহেবকে ধরলেন এবং জিন্নাহর আদেশে ফজলুর রহমান সাহেব ওই আসন থেকে পদত্যাগ করেন আর হামিদুল হক সেই আসন থেকে নির্বাচিত হন ১৯৪৮ সালের মে মাসে।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকায় আগমন করেন এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের অতিথি হন। তার সঙ্গে দুদেশের বাস্তুহারাদের সমস্যা সম্বন্ধে আলােচনা করেন। তিনি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে বলেন যে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে দাঁড়াবে। দুই বাংলারই অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙে পড়বে বিরাটসংখ্যক বাস্তুহারাকে পুনর্বাসন করতে গিয়ে। তিনি স্থির করেছেন যে তিনি উভয় বঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করবেন। সন্ধ্যায়
২৭১
অ্যাডভােকেট আলী আমজাদ খান সাহেবের বাসায় শান্তি মিশনের কাজ কীভাবে চলবে তা বিশদভাবে কর্মীদের বুঝিয়ে দেন। অনেক পরিষদ সদস্য তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি পরিষ্কারভাবে তাঁদের বলেন যে গান্ধীজি তাঁকে বাংলাদেশে তার অসমাপ্ত কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন- যত দিন না উভয় বাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সরকারের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে । শহীদ সাহেব কলকাতা ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পরেই জিন্নাহ সাহেব তাঁকে পাকিস্তান সরকারের পুনর্বাসনমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যােগ দিতে অনুরােধ করেন। শহীদ সাহেব জিন্নাহ সাহেবকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি যে কাজের ভার নিয়েছেন, তা ছেড়ে তখন তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। তাঁর মতে, তিনি পুনর্বাসনের কাজ বাইরে থেকে যতটা করতে পারবেন, মন্ত্রী হয়ে তা পারবেন না।
মার্চ মাসের ২ তারিখে প্রফেসর আবুল কাসেম সাহেব আমাকে খবর দিলেন যে সেদিন ফজলুল হক হলে বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও কোর্টকাচারির ভাষা কীভাবে করা যায়, সে সম্বন্ধে আলােচনা হবে। আমি যেন সে সভায় যােগদান করি। আমি বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখলাম বেশ কিছুসংখ্যক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী উপস্থিত হয়েছেন। সভায়। আমাকে সভাপতিত্ব করার জন্য অনুরােধ করা হয়। তারপর সভার কাজ আরম্ভ হয়। একটি নতুন সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা এবং শিক্ষার বাহন বা কোর্ট-কাচারিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি না করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের জন্য দাবি করাই যুক্তিসংগত বলে স্থির করা হলাে। নতুন সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদে দুজন গণ-আজাদী লীগ থেকে, দুজন গণতান্ত্রিক যুবলীগ থেকে, দুজন তমদ্দুন মজলিস থেকে আর সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে চারজন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে দুজন প্রতিনিধি ছাড়াও ইনসাফ, জিন্দেগী ও দেশের দাবীর পক্ষ থেকে তিনজন প্রতিনিধি নিয়ে ওই সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। অন্য একটি প্রস্তাবে ৭ মার্চ ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট ও ১১ মার্চ বাংলার প্রতিটি স্থানে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানান হয়। অনেক আলােচনার পর দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরিষদ সদস্য ও হিন্দুদের কোনাে প্রতিনিধি সংগ্রাম পরিষদে গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এটাতে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পেয়েছিলেন কিন্তু ১৯৫২ সালে যেটা সম্ভব ছিল, ১৯৪৮ সালে সেটা সম্ভব ছিল না। যেকোনাে আন্দোলনে ট্যাকটিকসের প্রশ্নটা সর্বপ্রথম বিবেচ্য। আন্দোলন ধাপে ধাপে এগােয় এবং যেকোনাে আন্দোলন করার আগে জনগণের মানসিকতার কথা ভুলে গেলে আন্দোলনে সফলতা লাভ করা যায় ; বরং আন্দোলনের ওপর যে আঘাত আসে, তাতে অন্তত সাময়িকভাবে
২৭২
প্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সংগ্রাম পরিষদ অনেকগুলাে সাব-কমিটি করে দেয় এবং সেখানে সবার সাহায্যই নিতে বলা হয়েছিল । সংগ্রাম পরিষদের সব প্রতিনিধির সভা আবার ১০ মার্চ বসে এবং সেখানে মােটামুটিভাবে কী কী করা হয়েছে এবং পরের দিন কী করা হবে, তা স্থির করা হয়। এটা স্থির হয় যে অফিস-আদালতেও পিকেটিং চালাতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কর্মীদের নিয়ে সেক্রেটারিয়েট গেটে পিকেটিং করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমার অনুরােধ ছিল তাঁর কাছে যে তিনি নিজে পিকেটিং না করে সংগঠনের কাজ হাতে নিলে ভালাে হয়। কারণ কলকাতা থেকে যেসব ছাত্র এসেছিলেন, তাঁদের সবার কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে আমাদের সম্যক জ্ঞান ছিল না। পরিচালনার ভার নিলে তিনি সঠিক কর্মীকে সঠিক স্থানে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মত ছিল ভিন্ন। তার ধারণা ছিল যে তিনি নিজে নেতৃত্ব না দিলে কর্মীরা সাহস হারিয়ে ফেলতে পারে। সেও হয়তাে সত্য। তাঁর আর আমার মধ্যে ওই পার্থক্যটা বরাবরই ছিল, যে কারণে তাঁর মতে আমি ছিলাম, ‘আরম চেয়ার পলিটিশিয়ান’। পরদিন নেতৃস্থানীয় যাঁরা গ্রেপ্তার হলেন, তাঁরা সর্বজনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ এবং আরও অনেক কর্মী। লাঠিচার্জের ফলে বহু ছাত্র ও কর্মী আহত হয়। আন্দোলন, চলতে থাকে। আমার এখনাে ধারণা, নেতারা প্রথম দিন গ্রেপ্তার না হয়ে পরিচালনার দায়িত্ব নিলে আন্দোলন আরও জোরদার হতাে।
১১ মার্চের পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৩ মার্চ সরকার কলকাতার সব খবরের কাগজ আটক করে এবং সেসব সংবাদপত্র পূর্ববঙ্গে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলন প্রতিদিনই দানা বাঁধতে লাগল।
এরপর স্থির হয় যে ১৫ মার্চের ধর্মঘটকে বিশেষভাবে সাফল্যমণ্ডিত করতে হবে। কারণ, সেদিন পরিষদের অধিবেশন বসবে। যারা পরিচালনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সর্বজনাব মােহাম্মদ তােয়াহা, তাজউদ্দীন এবং ডাক্তার করিম উল্লেখযােগ্য।
ঢাকা শহরে যথেষ্ট ভুল-বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। ছাত্রদের পক্ষে পুরােনাে শহরে আসা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল। ঢাকার সরদার ও সাধারণ লােক পাকিস্তান হওয়ার পরেই এ আন্দোলনকে তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। ফজলুল হক বা সলিমুল্লাহ হল থেকে আমার বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যেত। এবং প্রতিদিনই বাসায় এসে শুনতাম যে হয় সরদার সাহেব বা ঢাকা ক্লাবস কমিটির লােকেরা আমাকে খুঁজে গেছে। ১২ তারিখে তাদের কারও কারও সঙ্গে দেখা হলে আমি তাদের বলি যে, পাকিস্তান সৃষ্টির ব্যাপারে আপনারা আমার সঙ্গে ছিলেন। কারণ আপনাদের ধারণা ছিল যে আমি ঢাকার
২৭৩
লােকের কোনাে ক্ষতি করতে পারি না। আজও আপনাদের জানিয়ে দিচ্ছি যে আপনাদের ক্ষতি হয় সে কাজ আমি কোনাে দিনই করব না বা কাউকে করতে দেব না। কেউ কেউ আমার আশ্বাসবাণী সরলভাবে গ্রহণ করল। আবার অনেকের মনে সন্দেহ থেকে গেল। আমি তাদের বললাম যে ১৩ তারিখে। তাদের সন্দেহের নিরসন হবে। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় তারা এল আমার বাসায়। আমি তাদের প্রথমে বললাম, “বিগত ছয় মাস ধরে কী দেখছেন আপনারা। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ বিহারের লােক—তিনি যে কেবল একেকজন মােহাজেরের মধ্যে দুটো-তিনটে করে হিন্দু বাড়ি বণ্টন করেছেন, তা নয়, নতুন যত রেশনশপ হয়েছে, তা-ও তাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে, হিন্দুর যত বন্দুক বাজেয়াপ্ত হয়েছে, সবই বণ্টন করা হয়েছে বিহারিদের মধ্যে, যত ট্যাক্সি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে—সবই বিহারিরা পেয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট, কমিশনার, সব সেক্রেটারি অবাঙালি; সুতরাং তাদের কাছ থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা করা বাতুলতা। মােহাজেরদের ছেলেমেয়েদের জন্য সরকার স্কুল করে দিচ্ছে। বিহার থেকে যত লােক আসছে, তারা একটু লেখাপড়া জানলেই রেল বিভাগে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। কারণ, তারা সবাই বলছে যে তারা কেউ ছিল স্টেশনমাস্টার, কেউবা ক্রু, কেউবা গার্ড। হিন্দুস্তান থেকে তারা কিছুই আনতে পারেনি। সুতরাং শেষ বেতনের সার্টিফিকেটও ফেলে এসেছে। আমাদের হিসাবে ভারত থেকে সর্বসুদ্ধ ১৪ হাজার লােক রেলের চাকরিতে আসবে—এবং এখানকার সমসংখ্যক হিন্দু রেল কর্মচারী ভারতে চলে যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে ৪৩ হাজার লােক এসে দাবি করছে যে তারা সবাই ভারতে রেলগাড়িতে চাকরি করত। এসব দেখেও বুঝতে পারছেন না আপনারা যে। একদিন তাদের চাপে শহর ছাড়তে বাধ্য হবেন। কারণ, তাদের দাবি হলাে যে পাকিস্তানের জন্য তারাই কেবল জীবন দান করেছে।’ আরও দু-চারটি প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হলাে। মনে হলাে তারা সব শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা যা চোখে দেখেছে তার সারমর্মও তারা বুঝতে পারেনি। তাদের বােধ হয় বােঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করলেই এদের। প্রভাবমুক্ত হওয়া যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত বাংলার কোনাে সম্পর্ক নেই।
এর ফলে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলাে। সেন্ট্রাল ক্লাবস কমিটির সেক্রেটারি শামসুল হুদা এক লিফলেট ছাপিয়ে দিলেন যে আমি বলেছি যে শিক্ষার বাহনই বাংলা হবে—রাষ্ট্রভাষা হবে বলে আমি তাদের সভায় কিছু বলিনি। ওই লিফলেটের একটা কপি নিয়ে বাহাউদ্দীন চৌধুরী আমার বাসায় এসে উপস্থিত। আমি লিফলেটটা পড়ে দেখলাম ওটার বিরুদ্ধে আমার নিজের নামে একটা লিফলেট না দিলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তাই করা হলাে এবং বিকেলের মধ্যেই বলিয়াদী প্রেস থেকে আমার স্বাক্ষরে ওই লিফলেটের
২৭৪
বিরুদ্ধে অন্য লিফলেট ছেড়ে দেওয়া হলাে। ওটার জন্য আমি বলিয়াদী প্রেসের কমলা ডাক্তারের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম। তার প্রচেষ্টা ছাড়া অত তাড়াতাড়ি আমার দস্তখতযুক্ত লিফলেট বের করা সম্ভব হতাে না—যার ফলে হয়তাে আন্দোলনের ক্ষতি হতাে।
১৪ তারিখে অনেক রাতে ফিরে আসি। সুতরাং সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। ঘুম থেকে উঠেই শুনি বগুড়ার মােহাম্মদ আলী ও খাজা নসরুল্লাহ আমার স্যাতসেঁতে চেম্বারে বসে আছেন ভাের থেকেই। আমি নিচে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম তারা খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের দূত হিসেবে এসেছেন একটা মিটমাট করার জন্য। কারণ, জিন্নাহ সাহেব আসবেন ১৯ তারিখে। তার আগেই তিনি মােটামুটিভাবে একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চান। আমি বললাম যে আমি ফজলুল হক হলে যাচ্ছি, নেতারা যারা বাইরে আছেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করি—যদি মিটমাট সম্ভব হয় তবে বারােটার আগেই আমরা খাজা সাহেবের বাড়ি যাব, আর যদি না যাই তবে যেন বুঝে নেন যে নেতারা মিটমাটের বিরুদ্ধে। আমি তাদের বিদায় করে আমার ছােট টাইপরাইটার নিয়ে বসে দাবিগুলাে লিখে ফেললাম। তারপর গােসল করে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফজলুল হক হলে তােয়াহা সাহেবের ঘরে তাজউদ্দীন সাহেবকে পেলাম—একটি ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে কাসেম সাহেবকে ডাকতে ও সংগ্রাম পরিষদের যাদের পাওয়া যায় তাদের খবর দিতে। যারা বাইরে ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই এলেন। তখন আমি নাজিমুদ্দিন সাহেবের মিটমাটের ইচ্ছার কথা বললাম এবং মােহাম্মদ আলীর সঙ্গে কী কী কথাবার্তা হয়েছে, তা-ও বললাম। কাসেম সাহেব বললেন যে আমরা আন্দোলনের জন্যই আন্দোলন করছি। না—আমরা আমাদের দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে আলাপ করতে রাজি আছি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কথাও তাই—একমাত্র তােয়াহা সাহেব বললেন, আন্দোলন ক্রমাগতই জোরদার হচ্ছে—এমন সময় আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলে কর্মীদের ওপর সুবিচার করা হবে না—কারণ, আন্দোলন এখন কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়—সব মফস্বল শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জের কর্মীরা সেদিন আসবে। অনেক আলােচনার পর দাবিদাওয়ার ওপর আমি যে ড্রাফট করছিলাম, সেটা উপস্থিত করি। এবার তােয়াহা সাহেব ও তাজউদ্দীন সাহেব রাজি হলেন, অবশ্য কিছু রদবদল করে। কারণ, তাদের ধারণা ছিল অত সব দাবি সরকার মেনে নেবে না—সুতরাং ফয়সালাও হবে না। মাঝখান থেকে নাজিমুদ্দিন সাহেব আর বলতে পারবেন না যে আমরা পাকিস্তান ভাঙার জন্য এবং যুক্ত বাংলার জন্য আন্দোলন করছিলাম।
২৭৫
আমরা বেলা সাড়ে এগারােটার দিকে বর্ধমান হাউসে গেলাম। নাজিমুদ্দিন সাহেবের সেক্রেটারি এস এন বাকের, আইসিএস আমাদের তার ঘরে নিয়ে বসালেন এবং খাজা সাহেবকে খবর দিলেন। খাজা সাহেব নিচে নেমে এলে আমরা তার ঘরে গেলাম। খাজা সাহেব কিছুক্ষণ ভূমিকা করে বললেন যে তিনি বাংলার বিরুদ্ধে না। তিনি জিন্নাহ সাহেবকে বাংলা ভাষার জন্য যে তাঁর দরদ আছে তা জানাবেন। আমরা বললাম, আমাদের দাবিগুলাে যদি তিনি মেনে নেন, তবে আমরা আন্দোলন বন্ধ করতে রাজি আছি—তবে তা কার্যকর হবে যদি যারা আজ বাংলা ভাষার জন্য ঢাকা জেলে বন্দী হয়ে আছেন তাদের যদি মত হয়। খাজা সাহেবের কাছে আমাদের দাবিগুলাে উপস্থিত করা হলে তাঁর মুখ ছাইয়ের মতাে সাদা হয়ে গেল। বললেন, তিনি এসব দাবি মেনে নিলে পাকিস্তান থাকবে না। আমরাও বললাম, দাবিগুলাে যদি আপনি না মেনে নেন, তবে আমরা বিদায় হই। তিনি আমাদের বসিয়ে রেখে বাকেরের ঘরে গিয়ে আজিজ আহমদের সঙ্গে টেলিফোনে দাবির কথা বলে তাঁকে আসতে বললেন। আজিজ আহমদ বােধ হয় রাজি হননি। আবার আমাদের চা খাওয়াতে বলে তিনি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, বলে গেলেন, দশ মিনিটের মধ্যে তিনি ফিরবেন। আমরা বুঝলাম চিফ মিনিস্টার চিফ সেক্রেটারির বাড়ি যাচ্ছেন। মিনিট পনেরাে পরে তিনি এলেন এবং বললেন যে তিনটি ব্যাপারে তাঁর আপত্তি আছে। একটি হচ্ছে সব রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে, তবে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তাদের ছাড়া যাবে না। দ্বিতীয়, পুলিশের বিরুদ্ধে কমিশন না বসিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ‘ডিপার্টমেন্টাল ইনকোয়ারি’ করা হবে আর কলকাতার যেসব খবরের কাগজ পাকিস্তানবিরােধী, সেগুলাের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে না। আমরা বললাম, আমাদের দাবি নিম্নতম-এর মধ্যে কোনাে রদবদল হবে না। মনে হলাে তিনি যেন চুক্তিপত্রে সই করতে রাজি হবেন, ঠিক তখন তােয়াহা সাহেব বললেন যে চুক্তিপত্রে যা লেখা আছে তা ছাড়াও তাঁকে লিখে দিতে হবে যে তিনি দেশবাসীর কাছে যেসব অসত্য বিবৃতি দিয়েছিলেন, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন। তােয়াহা সাহেব আলােচনা ভেঙে দেওয়ার জন্য শেষ বাণ নিক্ষেপ করলেন, কিন্তু খাজা সাহেব তখন ভেঙে পড়েছেন—সুতরাং তাও মেনে নিলেন। চুক্তিপত্রে আমি ও খাজা সাহেব সই করলাম। আগের কথামতাে আমরা জেলখানায় গেলাম। জেলার বললেন, আপনাদের ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না—এক একজন করে ডেকে দেব, কারণ ওটা জেলগাইডে বারণ করা রয়েছে। আমি জেলারের ঘর থেকে খাজা সাহেবকে টেলিফোন করলাম, ধরলেন এস এন বাকের। তাকে বললাম যে জেলার যা বলছেন তাতে চুক্তি বাতিল করা ছাড়া আমাদের অন্য কোনাে উপায় নেই।
২৭৬
বাকের গেলেন মুখ্যমন্ত্রীকে খবর দিতে—কিছুক্ষণ পরে বাকের আমাকে টেলিফোন জেলারকে দিতে বললেন। আমি জেলারের হাতে ‘রিসিভার’ দিলাম। কিছুক্ষণ কী কথা হলাে, তারপর জেলার বললেন—আপনারা ভেতরে যেতে পারেন—এ কথা বলে সুবেদারকে পাঠালেন আমাদের দোতলায় নিতে যেতে। এদিকে আমাকে ঢুকতে দেখে শওকত আলী সাহেব ভেবেছেন আমাকে বুঝি পুলিশ গ্রেপ্তার করে এনেছে—তার কি স্ফুর্তি—আমার কাছে এসেই স্লোগান দিলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ভারি ভালাে লাগল! দোতলায় গিয়ে দেখলাম সবাই সেখানে আছেন। ছােটখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম। তারপর চুক্তির কথা বললাম, তারা রাজি হলেন। আমরা খাজা সাহেবকে জানিয়ে দিলাম। সব ঠিক আছে—তবে রাজবন্দীদের তক্ষুনি ছেড়ে না দিলে সেদিনের বিক্ষোভ থামানাে যাবে না। খাজা সাহেব বললেন তখনই ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রফেসর আবুল কাসেম চেষ্টা করতে লাগলেন বিক্ষোভকারীদের ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কে শােনে কার কথা। ও কাজটার জন্য প্রয়ােজন মাইক ফিটিং’ গলার আওয়াজ, যেটা কাসেম সাহেবের ছিল না। শেখ সাহেব বা শামসুল হক সাহেবের অনুপস্থিতির অসুবিধাটা বােঝা গেল ।
আমার ১৬ তারিখে সিরাজগঞ্জ কলেজে বক্তৃতা দেওয়ার কথা। তাই আমি চুক্তি হওয়ার পরেই বাসায় ফিরে কাপড় ছেড়ে সিরাজগঞ্জ রওনা হয়ে যাই। সিরাজগঞ্জ নেমে দেখি ডাক্তার জসিমুদ্দীন ও বেশ কিছু ছাত্র স্টেশনে উপস্থিত। আমি জসিমুদ্দীনের সঙ্গে কলেজে আসার আগে তার ওখানে চা খেলাম। আবদুল্লাহ হিল-মাহমুদ—কলকাতায় আমাদের প্রথম ডেপুটি হাইকমিশনার—তখন সিরাজগঞ্জে। রাতে তাঁর ওখানে খাওয়ার জন্য দাওয়াত গ্রহণ করলাম। দুপুরে কলেজে বক্তৃতা করার সময় একটি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী আমাকে তাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করলে আমি বললাম যে বিকেলে তাদের বাড়ি চা খাব, দুপুরে হােস্টেলের ছেলেদের সঙ্গেই খাব। বক্তৃতা হলাে ঘণ্টাখানেক। অনেক সমস্যার ওপর আলােচনা হলাে। পরে বুঝলাম যে আবদুল্লাহ হিল-মাহমুদের দাওয়াত গ্রহণ করায়। ছেলেরা একটু বিব্রত হয়েছে। কারণ, তাদের ধারণা যে দুর্ভিক্ষের সময় সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রীর পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি হিসেবে অনেক টাকা করে যিনি বাড়ি বানিয়েছেন, সে বাড়িতে আমার খাওয়া উচিত নয়। যাক, বিকেলে সে মেয়েটি অর্থাৎ আমিনা (পরবর্তীকালে আমার ছাত্র বাহাউদ্দীন চৌধুরীর স্ত্রী মীনা চৌধুরী) তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। তার পিতা সিরাজগঞ্জে ওকালতি করতেন। মীনার ওখান থেকে আমার বন্ধু সৈয়দ আকবর আলীর বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি আর এক-দফা চা খাই। তারপর ঢাকার পথে রওনা
২৭৭
হই। ১৮ তারিখে ঢাকায় ফিরে শুনলাম যে চুক্তিপত্র দুই পক্ষের এক পক্ষও ঠিক প্রতিপালন করেননি। খাজা সাহেব পুরাে চুক্তিপত্র পরিষদে উপস্থিত করেননি—আন্দোলনের নেতারাও ওই সুযােগে যার যার দলের বা নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৮ তারিখেও গােলমাল করেছেন। আর খাজা সাহেব আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন।
১৯ মার্চ জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এলেন। বিমানবন্দরে বিরাট অভ্যর্থনা হলাে। কারণ, জিন্নাহ সাহেব যদিও ১৯৩৬ সালে ঢাকা এসেছিলেন, কিন্তু তখন ঢাকার সাধারণ লােক তাঁকে দেখেনি—এমনকি নামও শােনেনি। পাকিস্তান হওয়ার পর এই তার ঢাকায় প্রথম আগমন। সুতরাং হাজার হাজার লােক বিমানবন্দরে এবং পথিপার্শ্বে দাড়িয়ে ছিল। তিনি রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তীকালে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) বক্তৃতা করেন। উর্দু যে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, সে কথা উল্লেখ করলে ছাত্ররা সভা ত্যাগ করে—তবে সেটা দেখা যেত না যদি না তখনই ‘মাইক ফেল করত এবং অনেক লােক কিছু শুনতে না পেয়ে সভা ত্যাগ করতে থাকত। এতে আমাদের সুবিধা হলাে যদিও ঘটনাটা ঝড়ে কাক মরল ফকিরের কেরামতি বাড়ল’-বহুদিনের পুরােনাে এই প্রবাদটিকে সত্য বলে প্রমাণিত করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনেও তিনি একই কথা বললেন। তখন কনভােকেশন হলেই নইমুদ্দীন এবং আরও কয়েকজন ‘না’ ‘না’ করে উঠল।
২৪ মার্চ কমিটি অব অ্যাকশনের সঙ্গে জিন্নাহ আলােচনা করবেন বলে আজিজ আহমদ সাহেব খবর দিলেন। আমার কাজ ছিল মেমােরেন্ডাম ড্রাফট করা। সেটা করা হলাে এবং সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সম্মুখে উপস্থিত করা হলাে। তাদের আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে রদবদলও করা হলাে। পরে ভালাে কাগজে ওটাকে টাইপ করা হলাে। সরকার জানাল সবার ঘর ছােট বলে আমরা যেন সাতজনের বেশি না যাই। আমরা আপত্তি করলাম যে ওভাবে সংখ্যা বেঁধে দিলে আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না। আজিজ আহমদ সাহেব বললেন ঠিক সাতজন না হতে পারে—তবে যত কমসংখ্যা হয় তাই যেন আমরা চেষ্টা করি। তা ছাড়া আরও জানানাে হলাে যে গভর্নরজেনারেল সাহেব অসুস্থ। যাক, আমরা বােধ হয় শেষ পর্যন্ত দশ-বারােজন গিয়েছিলাম। পরবর্তী ঘটনা অন্যান্য বইয়ে এর আগেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। (লেখকের A Socio-Political History of Bengalদ্রষ্টব্য)। জিন্নাহ সাহেবের কাছে মেমােরেন্ডামটা আমরা দিলে তিনি ওটা পেগ টেবিলের ওপর রাখলেন। অসুস্থ মনে হলাে। খিটখিটে মনে হলাে। আর মনে হলাে যে তিনি ওই রকম স্বাস্থ্য নিয়ে একটার পর একটা গােল্ডফ্লেক সিগারেট খেয়ে যাচ্ছেন। আর কথার সময় হাত নাড়াচ্ছেন অনেকবার। আমার যেন কেন মনে হলাে যে তার
২৭৮
যুক্তিকে ফলপ্রসূ করার জন্য সুন্দর হাতের আঙুলগুলাে কাজে লাগানাের চেষ্টা করছিলেন।
আমাদের এসব আন্দোলন নতুন শহরে অর্থাৎ রমনা, লালবাগ ও তেজগাঁও থানাসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কোতােয়ালি, সূত্রাপুর থানায় আমরা শহরবাসীকে নিরপেক্ষ করতে পারলেও দলে টানতে পারিনি। তাই ঢাকা শহরে জনসভা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বরে সিরাজ-উদ-দৌলা পার্কে শেরেবাংলার জনসভা করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমরা আর জনসভা ডাকতে চেষ্টা করিনি। শেরেবাংলার সে সভা থেকে তাঁবু তাে দূরের কথা, একখানা চেয়ারও আগুন থেকে কাদের সরদার সাহেবের লােকেরা রক্ষা করতে পারেনি। ফজলুল হক সাহেবকে কোনাে রকমে অক্ষত অবস্থায় এক হাজার গজ দূরে কাদের সরদার সাহেবের বাড়ি পৌঁছানাে সম্ভব হয়েছিল।
চারদিকে আটঘাট না বেঁধে আর জনসভা করার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমাদের এক সুবর্ণ সুযােগ এসে উপস্থিত হলাে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের। বাজেট অধিবেশনের ফলে। বিক্রয় করের (Sales Tax) হার সাধারণ ব্যবসায়ীর ওপর এসে পড়ায় চকবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজার, মােগলটুলী প্রভৃতি এলাকার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। এবার তাদের পক্ষ থেকে। অনুরােধ এল জনসভা করার জন্য। এ সময় সাখাওয়াৎ হােসেন ঢাকা চেম্বার। অব কমার্সের সভাপতি। তিনি আর চকবাজারের ফজলুল হক সাহেব এলেন। আরমানিটোলা ময়দানে সভার ব্যবস্থা করতে। তারা নিরাপত্তার সব দায়িত্ব নিলেন। সভা ডাকা হলাে। ইতিমধ্যে মােহন মিঞা ও সাহেবে আলম সাহেব নিশ্চিত বসে ছিলেন না—তারা বাদামতলীর গুন্ডার সরদারকে হাজার কয়েক টাকা দিলেন সভা ভেঙে দেওয়ার জন্য।
সভার দিন এক অপূর্ব কাণ্ড ঘটে গেল। বাদামতলীর বাদশাহ একগাদা টাকার নােট ছড়িয়ে দিল সভায় এবং ঘােষণা করল যে ওই টাকা তাকে দিয়েছেন মােহন মিঞা ও কালু মিয়া মিটিং ভাঙার জন্য। পরে সে বুঝেছিল যে ঢাকার মানুষের ক্ষতি করার জন্যই তারা ওই টাকা দিয়েছিলেন। সেদিন থেকে বাদশাহ মিঞা জনগণের পক্ষে চলে এল। সভায় প্রায় দশ হাজার লােক হয়েছিল। শামসুল হক দীর্ঘতম বক্তৃতা করেছিলেন। আমার বক্তৃতা স্বাভাবিকভাবেই খুবই ছােট হয়েছিল।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি শহীদ সাহেব ঢাকা এলেন তাঁর শান্তি মিশন। নিয়ে। করােনেশন (সদরঘাট) পার্কে সভা হলাে—এবার উঠলেন খাজা নসরুল্লাহর বাড়িতে। বক্তৃতা যখন হচ্ছে, তখন শাহ আজিজুর রহমান। সাহেবের দলের ইব্রাহিম নামের একটি ছেলে ছুরি নিয়ে রেলিংয়ের ওপর দিয়ে শহীদ সাহেবের পেছনে লাফিয়ে পড়ল। ভাগ্য ভালাে আমাদের কর্মীরা
২৭৯
সেখানে থাকায় শহীদ সাহেবের জীবন সে যাত্রা রক্ষা পেল । এপ্রিল মাসেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে পাকিস্তান হওয়ার পর শহীদ সাহেবের প্রথম সাক্ষাৎ এবং তাঁদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে খাজা নসরুল্লাহর দিলকুশা বাড়ির বারান্দায় অনেক আলােচনা হলাে। আমাদের বললেন যে পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ সভাপতি মিঞা ইফতেখারউদ্দীন ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলিম লীগের সভাপতি মানকি শরীফের পীর সাহেবকে বাংলায় নিমন্ত্রণ করে তারা কবে আসতে পারবেন সেটা জেনে যেন শহীদ সাহেবকে জানানাে হয়। তাঁদের নিমন্ত্রণ করা হলাে এবং দুজনেই মে মাসের। মাঝামাঝি পূর্ববঙ্গে আসতে রাজি হলেন। ইফতেখারউদ্দীন সাহেব এর আগে যখন ঢাকায় এসেছেন, তখনই তিনি তাঁর শ্যালিকার স্বামী ওয়াজির আলী শেখ, আইসিএসের বাড়িতে থাকতেন। মে মাসের মাঝামাঝি খবর নিয়ে। জানলাম যে ওয়াজির আলী সাহেব তার কোনাে খবরই জানেন না। দুএকদিনের মধ্যেই কিন্তু ইফতেখারউদ্দীন সাহেব এলেন আমাদের তার করে। লিখেছিলেন যে আমরা যদি ‘সার্কিট হাউসে জায়গা না পাই, তবে যেন অন্যত্র থাকার এবং যানবাহনের ব্যবস্থা করি। সত্যিই সার্কিট হাউসে জায়গা পাওয়া গেল না, সুতরাং বলিয়াদির জমিদার চৌধুরী লাবিবউদ্দীন সিদ্দিকী সাহেবকে, বললাম। তিনি তাঁর গাড়ি দিতে ও থাকার ব্যবস্থা তার বাড়িতেই করতে রাজি হলেন। লাবু শৌখিন লােক ছিলেন—সিগারেট ও তাঁর মনােগ্রাম’ বিলেতের উইলস কোম্পানি থেকে তৈরি করিয়ে আনতেন। গাড়ি ছিল একাধিক। শহীদ সাহেবও এসে পৌছালেন। খাজা নসরুল্লাহর বাড়িতে মিঞা ইফতেখার ও শহীদ সাহেবের মধ্যে আলােচনায় স্থির হলাে যে মুসলিম লীগ দখলের প্রচেষ্টাই প্রথমে চালানাে দরকার। কারণ, তা নইলে লােকে বলতে পারে যে নেতারা পকেট লীগকে জনসাধারণের লীগে পরিণত করার চেষ্টা না করেই নাজুক সময়ে বিরােধী দলের সৃষ্টি করেছে। শহীদ সাহেব খয়রাত হােসেন, আলী আহমদ খান ও আনােয়ারা খাতুন তিনজন বিরােধী দলের পরিষদ সদস্য-সদস্যাকে প্রথমে আকরম খাঁকে রদি বই দিতে—আর সেখানে সফল না হলে করাচিতে চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে অনুরােধ করতে বলে গেলেন। আকরম খাঁকে এর আগেই ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ রসিদ বইয়ের জন্য অনুরােধ জানালে তিনি তাঁদের রসিদ বই দিতে অস্বীকার করেন। ফলে করাচি যাওয়াই স্থির হলাে। খয়রাত হােসেন টাকাপয়সার অভাবের অজুহাত দিলেন—আলী আহমদ খান সাহেব বাড়ির কাজে আটকা পড়ায় আতাউর রহমান খান এবং আনােয়ারা খাতুন দুজনেই করাচি গেলেন চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। মিঞা ইফতেখারউদ্দীন সাহেব পাঞ্জাবে ফিরে গিয়ে মানকি শরীফের পীর সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করে চৌধুরী সাহেবকে মওলানা ভাসানী
২৮০
সাহেবের মতামত জানিয়েছিলেন। তারা তিনজনেই তিনটি প্রদেশের মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। আতাউর রহমান সাহেব ও আনােয়ারা খাতুনের সঙ্গে কথা বলার জন্য খালিকুজ্জামান তাই প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। ভণিতার দরকার হয়নি। চৌধুরী সাহেব তাঁদের পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ (All India Muslim League) ছিল সংগ্রামের জন্য—তাই এখন সেটাকে ভেঙে দিয়ে সরকারের সব কাজকে সমর্থন করার জন্যই কেবল একটি নতুন পার্টির দরকার। দুনিয়াকে দেখাতে হবে সরকারের পেছনে জনসমর্থন রয়েছে এবং সরকার একটি গণতান্ত্রিক সরকার। জিন্নাহ সাহেব সরকারে যােগ না দিলে এটার প্রয়ােজন ছিল না। কিন্তু যেহেতু তিনি জাতির পিতা এবং স্রষ্টা, সুতরাং লােকে ভাবতে পারে তার কথাই বেদবাক্য (Gospel truth) বলে দেশের জনসাধারণ মেনে নেয়। তাদের কথা বলার কোনাে অধিকার নেই। আমরা সেসব লােককে দিয়েই পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠন। করব, যারা সরকারের সব কাজকেই সমর্থন করবে। আতাউর রহমান সাহেব এবং আনােয়ারা খাতুন বিফল মনােরথ হয়ে ফিরে এলেন।
ইতিমধ্যে স্যার জাফরুল্লাহ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, কিন্তু কাশ্মীরের ব্যাপার অত্যন্ত ঘােরালাে হয়ে পড়ায় স্যার জাফরুল্লাহকে নিউইয়র্কেই সব সময় থাকতে হচ্ছিল। এ সময় জিন্নাহ সাহেব আবার শহীদ সাহেবকে জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূতের (কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর র্যাংক দিয়ে) পদটি গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু শহীদ সাহেবের কাছে ওই অনুরােধ গ্রহণযােগ্য হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুর রহমান। সাহেবের পরিত্যক্ত আসন থেকে হামিদুল হক চৌধুরী পরিষদ সদস্য হয়ে গেলেন এবং মন্ত্রিত্বের আসনে আরও শক্ত করে বসেছেন। তাই এবার তিনি শহীদ সাহেবের বাংলাদেশে বারবার আসা বন্ধ করার জন্য খাজা সাহেবকে উপদেশ দিলেন। এদিকে মানিকগঞ্জ থেকে শহীদ সাহেবকে শান্তি কমিটির এক সভায় নিমন্ত্রণ করা হলাে এবং তিনিও রাজি হলেন। মানিকগঞ্জে জুন মাসের ৪ তারিখের সভায় যােগ দেওয়ার জন্য ৩ তারিখে সকালে এসে পৌছালেন ঢাকা বিমানবন্দরে। আমরা কয়েকজন ছাড়া বিমানবন্দরে কেউ নেই। নসরুল্লাহ সাহেবকে তার করে এসেছেন—অথচ গাড়ি আসেনি। বিমানবন্দর থেকে টেলিফোন করলাম নসরুল্লাহকে। তিনি বললেন যে তাঁর বাড়িতে অনেক অতিথি আছে। সুতরাং তাঁর বাসায় জায়গা হবে না। কথাটা যেন শহীদ সাহেব বিশ্বাস করতে পারলেন না। বললেন, আমি কথা বলব। আমরা বললাম, সেটা কি ভালাে হবে? কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়। স্থির হলাে আনােয়ারা খাতুনের বাড়িতেই যাবেন। আমি আমজাদ খান সাহেবের জয়নাগ রােডের বাড়িতে গেলাম। তারাও জায়গা দিতে রাজি হলেন না। অগত্যা আমি ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের বাড়ি গেলাম। শাহজাহান সাহেব বাড়ি নেই। তাঁর স্ত্রী
২৮১
নূরজাহান তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে বললাম যে তােমার ক্লাসে যাওয়া হবে না। শহীদ সাহেব তােমার এখানে আসছেন। পাকের জোগাড় করাে। আমি তাঁকে আনতে চললাম। নূরজাহান রিকশা ছেড়ে দিল। অবাক হলাে এ কথা ভেবে, যে শহীদ সাহেব বাংলার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী, যার সম্বন্ধে এত কিছু শুনেছে—তিনি কিনা তার বাড়িতে অতিথি হবেন! নূরজাহানের পাক এত ভালাে ছিল যে আমি তার ওখানে যেচে খেতে চাইতাম । আমার ওপরও তার শ্রদ্ধা ছিল—তাই তার মনে কোনাে সন্দেহ হয়নি যে আমি মিছে করে বলতে পারি। যদিও আমি কোনাে ভূমিকা না করেই কথাটা সােজাসুজি বলে ফেলেছিলাম—তবু দ্বিতীয়বার প্রশ্ন না করেই সে পাকের আয়ােজনে চলে গেল ।
আমি আমজাদ সাহেবের বাড়ি এসে শহীদ সাহেবকে বললাম, চলুন, খাবার ব্যবস্থা হয়েছে।’ তিনি বললেন, “কোথায়? আমি বললাম, ‘প্রশ্ন নয়—চিরকাল আপনি নেতৃত্ব করেছেন, এবার আমাদের নেতৃত্ব, মেনে নিন। কথা না বাড়িয়ে তিনি ঘােড়ার গাড়িতে উঠে এলেন এবং শাহজাহান সাহেবের বাড়ি গিয়ে পৌছালাম। খাবারের বিরাট ব্যবস্থা। শাহজাহান সাহেব ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের শােবার ঘরটাই তার জন্য ছেড়ে দিলেন। অনেক লােকের জন্য খাবার ব্যবস্থা ছিল—আমাদের সবারই খাবারের ব্যবস্থা হলাে। সন্ধ্যায় বাদামতলী স্টিমার স্টেশনে শহীদ সাহেবের সঙ্গে আমরা গেলাম । মানিকগঞ্জের স্টিমার ছাড়ার কথা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়, অথচ সাড়ে আটটা বেজে গেল। স্টিমার ছাড়ার নাম নেই। সারেংকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, ‘পুলিশ সাহেব’ বলে গেছেন তাঁর আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত জাহাজ না ছাড়তে । বুঝলাম শহীদ সাহেব বিপদের সম্মুখীন।
তারপরে চারদিকে টেলিফোন করে জানলাম যে, কেবিনেট মিটিং চলছে, এবং মুখ্যমন্ত্রী করাচিতে টেলিফোন বুক’ করেছেন এবং সেখান থেকে একটি কলের অপেক্ষা করছেন।
রাত সাড়ে নয়টায় দুটো জিপ এসে থামল বাদামতলী ঘাটে। প্রথম জিপ থেকে নেমে এলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ, ইন্সপেক্টর জেনারেল জাকির হুসেন আর ডিআইজি ওবায়েদুল্লাহ। পেছনের গাড়িতে উচ্চ পুলিশ কর্মচারীরা। আমরা জাহাজের সম্মুখের ডেকে বসে আছি। ওবায়েদুল্লাহ শহীদ সাহেবের হাতে একটি সরকারি আদেশপত্র দিলেন। শহীদ সাহেব বললেন, এ ছােট সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি! আর এতগুলাে যাত্রীকে হয়রানি করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। আমরা উঠে এলাম জাহাজ থেকে। জাকির হােসেন শহীদ সাহেবকে বললেন, আপনি আজ রাতে আমার বাসায় অতিথি হলে সুখী হব।’ শহীদ সাহেবের ধৈর্যচ্যুতি হওয়ার পথে। তিনি উত্তরে বললেন, ‘Thanks. If I am not under arrest I would prefer to remain with my host.’
২৮২
জাকির হুসেন বললেন, না আপনি যেখানে খুশি রাতটা কাটাতে পারেন। শহীদ সাহেব বললেন, ‘Tell your Nazimuddin that Suhrawardy is not yet dead.’
এই জাকির হুসেনকে তিনি একদিন ঢাকার পুলিশ সুপার করেছিলেন। তারপর ১৯৪৬ সালে হাডসন সাহেবের আবার যখন ডিআইজি হয়ে আসার কথা উঠল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তদানীন্তন ডিআইজি-ই পুলিশ সুপার হবেন এবং জাকির হুসেন অতিরিক্ত সুপার হবেন। জাকির হুসেন মনজুর মাের্শেদ সাহেবকে ধরলেন এর বিহিত করার জন্য। মনজুর মাের্শেদ সাহেব কলকাতায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কল বুক করে আমার জন্য পার্টি অফিসে গাড়ি পাঠালেন। আমি গিয়ে দেখি মনজুর মাের্শেদ সাহেব ও জাকির হােসেন সাহেব লনে বসে আছেন। আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চা আনতে বলে মাের্শেদ সাহেব আমাকে। সব কথা বলে বললেন যে শহীদ সাহেবকে বলে হাডসনের ট্রান্সফারটা ক্যানসেল করাতে হবে। আমি বললাম, আচ্ছা আমি রাতে তাকে ধরার চেষ্টা করব। তিনি বললেন যে তিনি প্রায়ােরিটি কল বুক’ করেছেন, কল’ এখনই এসে যাবে। সত্যিই কল’ এল এবং আমি তাকে সব কথা বললাম। তিনি বললেন, “ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি টেইলরকে বলে দিচ্ছি। তার পরের দিনই দেখা গেল হাডসন সাহেব আসছেন না আর ঢাকায়। দেশ বিভক্ত হওয়ার সময়ও তিনি তাকেই আইজি হিসেবে নিযুক্ত করেছেন কলকাতা মুসলিম লীগ কর্মীদের মতের বিরুদ্ধে।
রাজনীতিতে উত্থান-পতন আছে এবং ওটা মেনে নেওয়া রাজনীতিবিদদের উচিত। আমরা শাহজাহান সাহেবের বাড়ি এসে দেখি তার বাড়ির চারপাশে পুলিশ দাঁড়ানাে। ভেতরে গিয়ে দেখি ইন্টেলিজেন্স বিভাগের একজন ডিএসপি আর একজন ইন্সপেক্টর। ইন্সপেক্টর আনােয়ার উদ্দীন সাহেব ও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ক্লাসের ছাত্র ছিলাম।
শহীদ সাহেব এসে খুব বােকা বনে গেলেন। তিনি অতটা আশা করেননি। তাঁর ভয় হলাে পাছে শাহজাহান সাহেবদের ওপর কোনাে বিপদ নেমে আসে। আমি মনে মনে নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে করছিলাম। ধীরে ধীরে কর্মীরা সবাই চলে গেল। শাহাজাহান সহেব আমাকে থেকে যেতে বললেন। শহীদ সাহেবের জন্য খাটখানা ফ্যানের ঠিক নিচে নিয়ে আসা। হলাে। নেটের মশারি খুলে ফেলে পাখা ছেড়ে দিলে তিনি শুতে গেলেন। আমরা তিনজন সারা রাত বসে রইলাম। কারও ঘুম এল না। বােঝা গেল। শহীদ সাহেব নজরবন্দী যদিও আদেশপত্রে তার উল্লেখ ছিল না। পরের দিন সকালে উঠেই চোখ বুজে বলতে লাগলেন, নাগিণীরা চারদিকে ফেলতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/ শান্তির ললিতবাণী শােনাবে ব্যর্থ পরিহাস/ যাবার আগে
২৮৩
তাই ডাক দিয়ে যাই/ দানবের সঙ্গে সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছে যারা ঘরে ঘরে। নূরজাহান এমএ ক্লাসের বাংলার ছাত্রী। অবাক হয়ে গেলেন শহীদ সাহেব নােটবই থেকে বাংলা কবিতা পড়ছেন দেখে। আমরা ঘরে ঢুকতেই তিনি নােটবই বন্ধ করলেন। নূরজাহানকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তাে বাংলার ছাত্রী—আমাকে বােঝাও দেখি—মধুমাখা আঁখিজল অর্থ কী? লবণাক্ত আঁখিজল কি মধুমাখা হতে পারে?’ নূরজাহান সারা রাতের জাগরণের কথা, ভবিষ্যৎ বিপদ-আপদের কথা এক মিনিটে ভুলে গেল । জিজ্ঞেস করল, ‘শহীদ সাহেব আপনি বাংলা সাহিত্য পড়েন? কবিতা পড়েন?’ শহীদ সাহেব জবাব না দিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে বাথরুমে যাওয়ার পথে কেবল বললেন, ‘দুঃখিত, লজ্জিত। এমনি করে নানা কথার ভেতর দিয়ে দিনটি কাটল। খবরের কাগজের রিপাের্টাররা আসল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এখনাে যুক্ত বাংলায় বিশ্বাস করেন কি না? তিনি উত্তরে বললেন, তিনি কোনাে দিনও যুক্ত বাংলায় বিশ্বাস করেননি। রিপাের্টার তবু ঘুরেফিরে জিজ্ঞেস করল, আপনি বাংলা বিভক্ত না হওয়ার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন কি না—পাকিস্তান হওয়ার পূর্ব দিন পর্যন্ত? আপনি, শরৎ বসু ও আবুল হাশিম চেষ্টা করেছিলেন কি না যুক্ত বাংলা করতে? তিনি উত্তরে বললেন, ‘মিছে কথা—আমি, শরৎ বসু বা আবুল হাশিম কেউ যুক্ত বাংলার পক্ষে বিবৃতি দিইনি বা করার প্রচেষ্টা চালাইনি। রিপাের্টাররা তাকে আবার জিজ্ঞেস করল যে, আপনি একসময় দেশের নেতা ছিলেন, আপনার কাছে আমরা সত্য ভাষণ আশা করব। এ বিষয়ে আপনার অনেক বিবৃতি বেরিয়েছে আপনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। আপনি কি সেসবই অস্বীকার করতে চান? তিনি গম্ভীরভাবে বললেন যে তাঁর কোনাে বিবৃতিতেই যুক্ত বাংলার কথা নেই, থাকতে পারে না। কারণ, তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নিখিল বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাংলা বিভক্ত হওয়ার পর তিনি আর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না। আর তাঁর বিবৃতি দেওয়ার কোনাে কারণ ঘটেনি। বিভক্ত হওয়ার পরেই কেবল যুক্ত করার কথা ওঠে। বিভক্ত হওয়ার আগে যুক্ত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এ সাধারণ কথাটা যাদের জানা নেই, তাদের সঙ্গে আমি বৃথা আলাপ করতে রাজি নই। বাংলা বিভক্তির বিরুদ্ধে আমরা সবাই বিবৃতি দিয়েছি এবং কায়েদে আজমের আদেশে আমরা সব মুসলমান সদস্যই বাংলাকে ভাগ করার বিরুদ্ধে ভােট দিয়েছি। কেবল হিন্দু সদস্যরাই বিভক্তির পক্ষে ভােট দিয়েছে। তা-ও কংগ্রেস ও অন্যান্য হিন্দু প্রতিষ্ঠানের আদেশে। এখানেই ‘প্রেস কনফারেন্সের পরিসমাপ্তির ঘােষণা করে তিনি তাঁদের বিদায় দিলেন।
বিকেলে ডিএসপি সিদ্দিক দেওয়ান সাহেব তাঁকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গিয়ে গােয়ালন্দগামী জাহাজে তুলে দিলেন। এর কিছুদিন পরেই গণপরিষদে এক
২৮৪
আইন পাস করা হলাে যে পাকিস্তানে যেসব সদস্যের বাড়ি নেই বা সরকারের কাছ থেকে বাড়ি ‘অ্যালটমেন্ট’ নেননি, তাঁদের গণপরিষদের সদস্য থাকতে দেওয়া হবে না। শহীদ সাহেব ‘বিলের বিরােধিতা করলেন। বললেন, কেবল তাঁকেই বের করার জন্য ওই ‘বিল’ আনা হয়েছে। তার বা তাঁর পিতা বা পিতামহের কোনাে বাড়ি কোথাও নেই, কি ভারতে কি পাকিস্তানে। তাই বলে সেটা একটা অপরাধ হতে পারে না।
পরিষদে ওই আইন পাস হওয়ার পরই দেখি একদিন ফরমুজুল হক সাহেব আমার বাসায় এসে উপস্থিত । আমাকে বললেন, ‘আমার আড়াই শ টাকার প্রয়ােজন। আমার কাছে এখন টাকাটা নেই।’ বললাম, কী করবেন টাকা দিয়ে? তিনি বললেন, আমার শান্তিনগরের বাড়িখানা শহীদ সাহেবের নামে দানপত্র করে দিব-রেজিস্ট্রি করে। সেই রেজিস্ট্রেশনের খরচটা ঠিক এখনই আমার কাছে নেই। আর আপনাকে একজন সাক্ষী হতে হবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, আপনার পরিবারের সবাই রাজি হয়েছেন। তিনি বললেন, “এসব আলােচনা নিষ্প্রয়ােজন। আমার স্ত্রীর কাছে থেকে মাসিক খরচের টাকা থেকে টাকাটা নিয়ে গেলাম সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে, দলিল প্রস্তুত ছিল। রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। শহীদ সাহেবকে তার করে দেওয়া হলাে যে ঢাকায় তাঁর জন্য বাড়ি নেওয়া হয়েছে। তার একটা কপি জিন্নাহ সাহেবকে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে।
১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট আমার তৃতীয় পুত্র নিজামউদ্দীন আজাদ জন্মগ্রহণ করে। আমাদের আরও দুটো ছেলে ছিল, তাই আমরা একটি মেয়ে চেয়েছিলাম কায়মনােবাক্যে। কিন্তু এবারও আমাদের ছেলে হওয়ায় আমরা। স্থির করলাম আমাদের আর সন্তানের প্রয়ােজন নেই। বিবাহের নয় বছরে তিনটি ছেলেই যথেষ্ট বলে আমরা মনে করলাম। অন্য দুটো ছেলের সম্বন্ধে এতটা লিখিনি, এটা বিশেষ করে লিখলাম। যেহেতু আমার এই ছেলেটি ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর মুক্তিসংগ্রামে শহীদ হয়।
ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার পর আরও জিন্নাহ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারদের অনুরােধে তিনি জিয়ারতে যেতে রাজি হন। তাঁর শেষ সরকারি কাজ ছিল স্টেট ব্যাংকের উদ্বোধন। জুলাই মাসে তার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। আগস্ট মাসে তাঁকে জিয়ারত থেকে কোয়েটা নিয়ে যেতে হলাে। ৫ সেপ্টেম্বর নিউমােনিয়ায় আক্রান্ত হলেন তিনি। তাঁর আয়ু শেষ হয়ে এসেছিল। তাই স্থির করা হলাে যে ১১ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর ভাইকিং নামের উড়ােজাহাজে চেপে করাচি যাবেন। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত একাকী ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি সে বেদনা অনুভব করেছেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী। খান জিয়ারতে তাঁকে একবার দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁর শােয়ার পাজামার
২৮৫
সবই ছিল সিল্কের। ডাক্তার করাচিতে ভায়েলার তৈরি পাজামার জন্য খবর দিলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে পাজামা তাঁর কাছে পৌঁছায়নি। জীবনভর যারা তাঁর কাছছাড়া হয়নি, মরণের কাছাকাছি এসে তিনি তাদের কাউকে দেখেননি। সত্যি বলতে প্রধানমন্ত্রী অন্তর দিয়ে তার মৃত্যু কামনা করেছিলেন। কারণ, যার সঙ্গে তর্ক করা যায় না, যার মতই একমাত্র মত বলে ধরে নিতে হবে, তাকে কেউ আপন বলে ভাবতে পারে না। জিন্নাহও তাই কারও আপন। হননি। সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে তার ভাইকিং করাচি এসে পৌছাল। তার আগমনবার্তা গােপন রাখার জন্য গভর্নর-জেনারেলের নিশান ঢেকে দেওয়া হলাে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানও বিমানবন্দরে আসেননি—অন্য মন্ত্রীরা তাে দূরের কথা। তাঁকে যখন স্ট্রেচারে নামানাে হলাে, তখন তার চোখের ওপর বহু কষ্টে নিজের হাত রাখলেন ছায়া দেওয়ার জন্য। সেনাবাহিনীর একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হলাে তাকে। কিছু দূর চলার পরই অ্যাম্বুলেন্সটি ভেঙে পড়ল। ছিন্নমূল মানুষের যেখানে বাস, সেই নােংরা স্থানে অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে—মাছি জিন্নাহর মুখে-চোখে এসে পড়ছে। আর সে মাছি তাড়ানাের জন্য কিছু নেই। সিস্টার ডানহাম একটা কার্ড দিয়ে সে মাছি তাড়াতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পরে আর একটা অ্যাম্বুলেন্স আনা হলাে আর তাতে চড়িয়ে তাঁকে গভর্নমেন্ট হাউস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলাে। রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি মরণের কোলে ঢলে পড়লেন।
খাজা নাজিমুদ্দিন তার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েই করাচি রওনা হয়ে গেলেন। লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রিসভা নাজিমুদ্দিনকেই গভর্নর জেনারেল হিসেবে মনােনীত করল এবং খাজা সাহেবই পাকিস্তানের দ্বিতীয় বড়লাট হলেন। এই সঙ্গে বাংলাদেশে খাজা বংশের রাজনীতির পরিসমাপ্তি ঘটল। পরবর্তীকালে অবশ্যই আইয়ুব খান আবার খাজা হাসান আসকারীকে পাগড়ি পরিয়ে নবাব বানিয়েছিলেন এবং খাজা সাহেবদের রাজনীতিতে টেনে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁকে জমিদারির ক্ষতিপূরণের নামে প্রায় ত্রিশ লাখ টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে করে তিনি মিল মালিক হয়েছিলেন, কিছুটা রাজনীতিও করেছিলেন; কিন্তু ভাঙা কুলায় আর চাল ঝাড়া যায়! তারপর আইয়ুব সাহেবের দৃষ্টি পড়েছিল সে বাড়ির কন্যাবংশের সৈয়দ আলাউদ্দীনের ছেলে সৈয়দ খায়েরুদ্দীনের ওপর। তিনি নিজেকে খাজা খায়েরুদ্দীন বলতেন। তিনি কন্যাপক্ষেরও দ্বিতীয় তরফের। তিনি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছিলেন—শেষে আর তাল সামলাতে পারেননি।
নূরুল আমীন সাহেব ছিলেন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন অভিজাত ঘরের। নূরুল আমীন সাহেব মধ্যবিত্ত পরিবারের লােক। অবশ্যই পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে উচ্চ
২৮৬
মধ্যবিত্তের লােক বলে চিন্তা করতেন। তবু আমার ধারণা, নূরুল আমীন। সাহেবের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্তি পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্তের জাগরণে একটি বড় ঘটনা।
১৯৪৮ সালের অক্টোবর মাসে ডাক্তার মালিক বিরােধী দল ছেড়ে মন্ত্রিত্ব। গ্রহণ করলেই ইপিটিইউএফের ওয়ার্কিং কমিটি ডাক্তার মালিকের সভাপতি পদে থাকা উচিত কি অনুচিত, তাই নিয়ে আলােচনা করেন। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা তাঁর সভাপতি পদে ইস্তফা দাবি করেন। অন্যদিকে ফয়েজ আহমদ তার বিরােধিতা করেন। শেষ পর্যন্ত ভােট নেওয়া হয় এবং ফয়েজ আহমদ অল্পসংখ্যক ভােটে জিতে যান। বামপন্থীরা সভা থেকে বেরিয়ে যান। তারা কিন্তু তাদের সদস্যপদে ইস্তফা দেননি। কিন্তু ১৯৪৮ সালে রেল রােড ওয়ার্কার্সরা যখন ধর্মঘটের নােটিশ দিল, তখন ডাক্তার মালিক-ফয়েজ আহমদের দল রেল রােড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নকে ফেডারেশন থেকে বের করে দেন। এর ফলে কমিউনিস্ট সদস্যদের সবাই ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করেন। ফলে ফেডারেশন থেকে ঢাকা জেলা সুতাকল শ্রমিক সংস্থা, ঢাকার। রিকশা ইউনিয়ন, বরিশাল বিড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন এবং অভ্যন্তরীণ জাহাজ চলাচল কর্মচারী ইউনিয়নও ফেডারেশনের বাইরে চলে যায়।
১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানে প্রথম ‘ট্রি পার্টটাইম লেবার কনফারেন্স’ হয়। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা এবং পূর্ব বাংলার ইপিটিইউএফের নেতারা একটি সংস্থা গঠন করেন। নতুন সংগঠনের নাম হয় পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (এপিটিইউএফ)।
১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে ফজলুর রহমান সাহেব আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ফজলুর রহমান সাহেব নতুন রাষ্ট্রে মন্ত্রী হয়েই নিত্যনতুন পরিকল্পনা ঘােষণা করতে থাকেন। প্রথমে তিনি স্থির করলেন, পাকিস্তানে ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখার প্রয়ােজন সীমাবদ্ধ—সুতরাং ইংরেজি পড়া ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আরম্ভ করলেই চলবে। তৃতীয় শ্রেণিতে পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু ও আরবি এবং পূর্ববঙ্গে উর্দু, আরবি ও বাংলা ভাষা শেখানাে বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে ছেলেমেয়েদের ওপর। কেবল তিনটি ভাষা শেখার চাপই পড়ল না— ইংরেজি নিচে থেকে না পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে গিয়ে চার বছরে ইংরেজিতে যে জ্ঞান লাভ করল, তা দিয়ে। কলেজের শিক্ষকদের কথা বুঝতে অসুবিধা হলাে। সবচেয়ে অসুবিধা হলাে যারা বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়তে গেল, তাদের। ফলে তারা কী করে ক্লাস না করে পারা যায়, তারই বুদ্ধি বের করতে সচেষ্ট হলাে। কথায়। কথায় ধর্মঘট দেখা দিল। ভুল যখন ধরা পড়ল, তখন আবার তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হলাে এবং এতগুলাে ভাষা শেখা যখন ছােটদের জন্য সম্ভব নয়, তখন প্রথমে আরবি বাদ পড়ল দুই পাকিস্তান
২৮৭
থেকেই। পরে পূর্ববঙ্গ থেকে উর্দুও উঠে গেল। মাঝখান থেকে পাঁচ বছর কতগুলাে অর্ধশিক্ষিত লােক কলেজ থেকে বেরিয়ে এল।
এরপর এল আরবি হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা এর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন আরম্ভ করল। বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ফজলুর রহমান সাহেব ভারতে রপ্তানির জন্য পাটের ওপর বিশেষ রপ্তানি কর বসিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য ভারতের পাটকলসমূহের চাকা বন্ধ করা। ফলে ভারত নিজেরাই পাটের চাষ আরম্ভ করল এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাট রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে পরিণত হলাে। এমনি করে নিত্যনতুন পরিকল্পনায় হাত দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে তুলল।
১৯৪৯ সালে ইন্দোনেশিয়ায় রিপাবলিক গঠিত হলাে জাতিসংঘের সাহায্যে। নয়া চীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলাে মাও সে-তুংয়ের নেতৃত্বে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ৮ জানুয়ারি ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালন করল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ৩ মার্চ ধর্মঘট করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ওই ধর্মঘটকে সমর্থন করে এবং তাদের দাবি গ্রহণ না করায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছাত্রদের ধর্মঘট আহ্বান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ জন ছাত্রকে কমবেশি শাস্তি দেওয়া হয় জরিমানা থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত। যারা বহিষ্কৃত হলাে, তারা তাে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে যেতে পারল না—যাদের শুধু জরিমানা হয়েছিল—তারা হয় জরিমানা দিয়ে বা ক্ষমা চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার পড়াশােনা আরম্ভ করল। বহিষ্কৃত ছেলেদের মধ্যে ছিল দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ, আবদুল মান্নান প্রভৃতি। যাদের জরিমানা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব। তিনি জরিমানা দিতে অস্বীকার করায় তাঁর আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হলাে না। আমার নিজের ধারণা, তার ওই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বাস্তব ও সময়ােপযােগী হয়েছিল । তিনি তখন জননেতা হওয়ার পথে—তাঁর আর ছাত্র থাকা শােভা পাচ্ছিল না। নিজে থেকে পড়াশােনা ছেড়ে না দিয়ে একটা ইস্যুর ওপর পড়াশােনা ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। একইভাবে তিনি গণতান্ত্রিক যুবলীগকে অগ্রসর হতে না। দিয়ে যুবকের দল থেকে বড়দের দলে শামিল হলেন। পরবর্তীকালে তােয়াহা সাহেব ও অলি আহাদ সাহেব যুবলীগ করে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব করেছিলেন বটে, কিন্তু কর্মী পর্যায়ে থেকে জাতীয় নেতা হিসেবে গৃহীত হননি। এখানে শেখ সাহেবের সঙ্গে গান্ধীজির কিছু মিল দেখা যায়। গান্ধীজিও হােমরুল লীগ অমন করেই ভেঙে দিয়েছিলেন।
২৮৮
আমার যত দূর মনে পড়ে ওই বছরই ছাত্র ফেডারেশনের শেষ অধিবেশন হয়। ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য তখন ছিলেন ভালাে লেখাপড়া জানা ছেলেরা—যেমন সরদার ফজলুল করিম, আখলাকুর রহমান, মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার। আমার মনে হয় খান মােহাম্মদ শামসুর রহমান, এনায়েত করিম, বাহাউদ্দীন চৌধুরীও ছাত্র ফেডারেশন করতেন।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আসন শূন্য হলে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে মুসলিম লীগ মনােনয়ন দেয়। সেই নির্বাচন কেন্দ্রে শামসুল হক খুররমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মাঠে নামেন। পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগের এটাই প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতা—খুররম খান। পন্নী জমিদার । শামসুল হক সাধারণ কৃষকের ছেলে—পন্নীদেরই প্রজা। নূরুল আমীন সাহেব মুখ্যমন্ত্রী এবং উপনির্বাচন তাঁরই জেলায়। শামসুল হকের পেছনে কোনাে রাজনৈতিক দল নেই—নেই টাকাপয়সা। ১৫০ নম্বর মােগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা ছিল কেবল তার পক্ষে। টাকার জন্য আলমাস ৮০০ টাকা ও আমি কয়েকজনের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে টাঙ্গাইল পৌছি। এ ছাড়া নির্বাচনী ক্যাম্পের জন্য শামসুল হকের বাড়ি থেকে কয়েক মণ চাল দিয়ে গিয়েছিল তাঁর ছােট ভাই নুরুল হক । সর্বজনাব আলমাছ। আলী, আউয়াল, শামসুজ্জোহা, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, তাজউদ্দীন। আহমদ, শওকত আলী, হজরত আলী শিকদার ও আজিজ আহমদ—সবাই নির্বাচনে দিনরাত না খেয়েদেয়ে খেটেছেন। খােদাবক্স মােক্তার সাহেব সবার দেখাশােনা করতেন। আমার একটা ভরসা ছিল বাবু রণদাপ্রসাদ সাহার সাহায্য। কিন্তু হামিদুল হক চৌধুরী আগে থেকেই তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তা ছাড়া মুসলিম লীগ সে বাড়িতে ক্যাম্প করে বসে আছে। সুতরাং সেদিক থেকে যে সাহায্যটা আমি আদায় করতে পারতাম তা আর হলাে না। নূরুল আমীন সাহেব নিজে নির্বাচনী অভিযানের ভার নিয়েছিলেন।
কিন্তু ওই নির্বাচনে আমাদের পক্ষে সুবিধা করে দেন খুররমের স্ত্রী। তিনি স্বামী খুররমের বিরুদ্ধে একটি ইশতেহার বের করেন এই বলে যে তিনি তার স্ত্রী হলেও তার সঙ্গে সহবাস না করে তিনি তার আপন বােনের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করছেন। আর একটি সুবিধা হলাে খাজা নুরুদ্দীন সাহেব তাঁর সাপ্তাহিক মর্নিং নিউজ-এ বড় বড় অক্ষরে ছাপিয়ে দিলেন যে হামিদুল হক চৌধুরী ভারতের ডালমিয়ার কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে ডালমিয়ার ড্রামগুলাে ভারতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। তাতে পাকিস্তানের লাখ লাখ টাকা লােকসান হয়েছিল। এ ছাড়া ওই নির্বাচনে ভােট পাওয়ার জন্য নুরুল আমীন সাহেব গরুর গাড়িবােঝাই চাল ওই দুই থানায় পাঠাতে থাকেন। অথচ তার আগে তারা বহুদিন সরকারি চাল দেখেননি। ফলে লােকের ধারণা হলাে যে সরকার
২৮৯
এত চাল থাকা সত্ত্বেও এত দিন সেখানে চাল সরবরাহ না করে তাদের না খাইয়ে রেখেছে। তা ছাড়া শামসুল হক ওই যে প্রথম দিন সাইকেলে উঠেছিলেন, সে সাইকেলে চেপে প্রতি ঘরে ঘরে লােকের কাছে গিয়েছেন।
১৯ মার্চ তারিখে হযরত আলী আসাম গিয়ে মাওলানা সাহেবের সঙ্গে জেলে দেখা করে তার কাছ থেকে শামসুল হককে ভােট দেওয়ার জন্য একটি আবেদনপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। আমি দেখলাম যে সেখানে জেলের সিকিউরিটি অফিসারের কোনাে সিল নেই। আমি ওটাকে ছাপতে নিষেধ করলাম। ২৩ মার্চ আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। আমার একটা খুব বড় সেসন মামলা ২৯ মার্চ তারিখে। মানিকগঞ্জে চর দখল ও জমি নিয়ে দুই জমিদারের মধ্যে ঝগড়া হয়। দুপক্ষে ১৯ জন খুন হয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে আমার নিষেধ সত্ত্বেও আমার ঢাকা আসার পর অল্প কয়েক দিন আগে ওই আবেদনপত্রটি ছেপে বিলি করা হয়।
নির্বাচনে শামসুল হকের জয় হয়। ফলে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ফাটল ধরে। তা ছাড়া শামসুল হকের বিজয়ের পর শহীদ সাহেব এপ্রিল মাসে পাকিস্তানে চলে আসেন। আরও কারণ ছিল যে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু কিরণশঙ্করের মৃত্যুর পর তাঁর কলকাতা থাকা বিপৎসংকুল হয়ে পড়েছিল। ইত্তেহাদও নানা কারণে আর চালানাে সম্ভব না হওয়ায় সেটাও বিক্রি করে দিতে হলাে। নবাবজাদা হাসান আলী, আবুল মনসুর আহমদ সাহেব ও মানিক মিয়া পূর্ব বঙ্গে চলে এলেন। আবুল মনসুর সাহেব ময়মনসিংহে বাসা নিয়ে আবার ওকালতি আরম্ভ করলেন। নবাবজাদা দেশে ফিরলেন। মানিক মিয়া ঢাকায় এলেন। ওই সময় মওলানা ভাসানী সাহেবও আসাম জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেষবারের মতাে দেশে ফিরে এলেন। শহীদ সাহেব ও মওলানা সাহেবের মধ্যে আলােচনা হলাে। তারপর শহীদ সাহেব লাহাের গেলেন মিঞা ইফতেখারউদ্দীন ও মানকি শরীফের পীর সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে। মানকি শরীফ ইতিমধ্যেই আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং মামদোতের নবাব পাঞ্জাবে জিন্নাহ মুসলিম লীগের পত্তন করেছেন : মামদোত। মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে PRODA মামলা খাড়া করা হয়। শহীদ সাহেব মামদোতের পক্ষে আদালতে উপস্থিত হন। মামলা বহুদিন ধরে চলে এবং শহীদ সাহেব বহু টাকা উপার্জন করেন ওই মামলায়। ওই বছরই পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার নির্বাচন কেন্দ্র থেকে শরৎ বসু উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে হারিয়ে বহু ভােটাধিক্যে জয়লাভ করে প্রমাণ করেন যে জনগণ স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ছিল না। পূর্ব বাংলার শামসুল হক ও পশ্চিম বাংলার শরৎ বসুর বিরুদ্ধে একই কথা—কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ প্রচার করে ব্যর্থ হয়েছিল।
২৯০
শহীদ সাহেবের পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। সুতরাং সেখানে তিনি নিচে থেকে সংগঠন করার আশা ছেড়ে দিয়ে ওপর (Top) থেকে একটি সংগঠন ড্রয়িংরুমে বসে তৈরি করে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা চালান। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে জিন্নাহ-আওয়ামী মুসলিম লীগের একটা কাঠামাে সৃষ্টি করা হয়। সীমান্ত প্রদেশ এবং পাঞ্জাবের ‘ওপুরের চক্র থেকে কিছু লােক জোগাড় করতে সচেষ্ট হন। মামদোতের মামলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইয়ুব খুরাের PRODA মামলা শুরু হয়। খুরাের মামলায় শহীদ সাহেব খুরাের পক্ষ সমর্থন করেন। সেই সুযােগে তিনি পয়সা। আয় ছাড়াও সিন্ধুতে-নইলে অন্তত করাচিতে কোনাে সংগঠন করা যায় কি না, তার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু দুটো কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। প্রথমত, করাচি সম্পূর্ণভাবে মােহাজেরদের দখলে—যাদের বলা হয় নই-সিন্ধি (new Sindhis) আর যারা পুরােনাে বাসিন্দা, তাদের বলা হয় ‘আসলি সিন্ধি (Original Sindhis)। এদের মধ্যে এত তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল যে মােহাজেরদের সঙ্গে কথা বললে আসলি সিন্ধিরা তার বিরুদ্ধে যাবে আর যদি তাদের কথা না বলেন, তবে খুরাে, তালপুর প্রভৃতি বড় বড় জমিদারের দয়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে ‘ছিন্নমূল মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার যে বাসনা—তার প্রতিও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। তা ছাড়া করাচি রাজধানী বিধায় সরকারের প্রশাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাতে কোনাে বিরােধী ভাব না গড়ে উঠতে পারে, সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখা হতাে। অন্যদিকে চৌধুরী খালিকুজ্জামান, ইউসুফ হারুন, চুন্দ্রীগড়—সব নেতাই মােহাজের । বলতে গেলে জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী খানও মােহাজের। লিয়াকত পূর্ববঙ্গ থেকে গণপরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন। শহীদ সাহেবও মােহাজের আর এককালে জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের বিরােধিতা করেছিলেন বলে তিনি তখন মােহাজের, সমাজজীবন থেকেও বিচ্ছিন্ন। শহীদ সাহেব করাচিতে তাই কিছু সুবিধা করে উঠতে পারলেন না। তবু শহীদ সাহেব পাকিস্তানে এসে করাচিকেই তার রাজনৈতিক কর্মশীলতার কেন্দ্র হিসেবে স্থির করলেন। মওলানা ভাসানী সাহেব তাকে ঢাকায় তাঁর কর্মস্থল করতে বললেন। কারণ তাঁর মতে, শহীদ সাহেব করাচিতে পাত্তা পাবেন না, মাঝখান থেকে পূর্ব বাংলাও হারাবেন। আমার মনে হয়, শহীদ সাহেবের সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল তার উচ্চাভিলাষ। পূর্ববঙ্গ কর্মস্থল করলে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়া কখনাে সম্ভব হবে না, দ্বিতীয়ত, তাঁর যে ধরনের জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছিল, প্রথম মহাযুদ্ধের সময় বিলেত থাকাকালীন সে জীবনের সঙ্গে কলকাতার কিছু মিল থাকলেও পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কোনাে মিল ছিল না। পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজ স্বাধীনতার সময় অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং সামন্ত যুগের ধ্যানধারণা তাদের মধ্যে
২৯১
ছিল প্রকট। ক্লাবজীবন, নাচ-গান প্রভৃতি সম্বন্ধে তাদের ধারণার সঙ্গে শহীদ সাহেবের ধারণার কোনাে মিল ছিল না। তা ছাড়া করাচিতে আইন ব্যবসা আরম্ভ করলে ঢাকা হাইকোর্টে ‘সিনিয়র কাউন্সিলর নিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। অন্যদিকে ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প গড়ে উঠেছিল করাচিতে তখন। সুতরাং আইনের ব্যবসায় করাচিতে প্রসার হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।
টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পর জুন মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভা ডাকা হয়। পুরােনাে নিয়মে মওলানা আকরম খা সভাপতি পদে ইস্তফা দেন—সেই ইস্তফাপত্র বিবেচনার ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত দেখা দিল। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব যে পন্থায় নূরুল আমীন সাহেবকে মুখ্যমন্ত্রী মনােনীত করা হয়েছিল তা মেনে নিতে পারেননি। তার ধারণা হলাে যে ফজলুর রহমান ও নূরুল আমীন সাহেবদ্বয় তাঁকে মুসলিম লীগ রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়। শেষ পর্যন্ত আবার মওলানা আকরম খাঁকে অনুরােধ করে তার ইস্তফাপত্র প্রত্যাহার করালেন। এতে ইউসুফ আলী চৌধুরীর মুসলিম লীগ করায়ত্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।
বিরােধী দলের নেতা এবং কর্মীদের উদ্যোগে কাজী মােহাম্মদ বশীর (হুমায়ুন) সাহেবের রােজ গার্ডেনের বাড়িতে শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের দলীয় লােকদের এক সভা ডাকা হলাে। মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা ফজলুল হক দুজনকেই ডাকা হলাে এবং তারা দুজনেই উপস্থিত ছিলেন। শামসুল হক তার ম্যানিফেস্টো তৈরি করে রেখেছিলেন—সেটাই তিনি উপস্থিত করলেন। শেখ সাহেব সভায় উপস্থিত ছিলেন না। যারা নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া), খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান, কফিলউদ্দীন চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, খােন্দকার মােশতাক আহমদ, ইয়ার মােহাম্মদ খান, আলমাছ আলী, আবদুল আউয়াল, শামসুজ্জোহা, সৈয়দ আবদুর রহিম ও আবদুল জব্বার খদ্দর। তা ছাড়া মােগলটুলী ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’-এর সব কর্মী শামসুল হক সাহেবের নেতৃত্বে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমিও শামসুল হক সাহেবের একটি দাওয়াত পেয়েছিলাম এবং উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আলােচনার পর মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হক সাহেবকে সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব ও খােন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবকে যুগ্ম সম্পাদক করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়।
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই গণপরিষদে মূলনীতি নির্ধারণ কমিটির রিপোের্ট প্রধানমন্ত্রী গণপরিষদে উপস্থিত করেন।
২৯২
এর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। পাকিস্তান অবজারভার-এর সম্পাদক ও সহসম্পাদক আবদুস সালাম এবং জহুর হােসেন চৌধুরী মূলনীতি নির্ধারণ কমিটির রিপাের্ট আলােচনা করার জন্য মুসলিম লীগ ছাড়া বাকি সব পার্টির লােককেই নিমন্ত্রণ করেন। অবজারভার অফিসে সবাই বসেন। যারা খুব উৎসাহী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে নাম করা যায় সর্বজনাব তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, সাখাওয়াত হােসেন, আবদুল ওয়াদুদ, সৈয়দ মােহাম্মদ আলী, তাসাদুক আহমদ, আবদুল মতিন প্রমুখ। সভায় আমাকে কনভেনর’ করে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটির নাম দেওয়া হলাে কমিটি অব অ্যাকশন ফর ডেমােক্রেটিক ফেডারেশন।
মুসলিম লীগ তাদের একটি কমিটি গঠন করল ময়মনসিংহে মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে উপস্থিত করার জন্য। সেখানে হামিদুল হক চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখকে নিয়ে কমিটি গঠিত হলাে। আওয়ামী লীগেও তেমনি একটি কমিটি গঠিত হলাে। তার মধ্যে থাকলেন আতাউর রহমান খান, রফিকুল হােসেন, মানিক মিয়া, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। তিনটি স্ব স্ব কমিটির আলােচনা বৈঠক চলার পর দেখা গেল সবাই একমত হয়েছিলেন যে মূলনীতি নির্ধারণ কমিটি গণপরিষদে যে রিপাের্ট পেশ করেছিল, তা পূর্ব বাংলার কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। কিন্তু সবিশেষ পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় তাদের মধ্যে মতভেদ রইল যথেষ্ট। তবে আমাদের কমিটির সঙ্গে আওয়ামী মুসলিম লীগের মিল অনেক বেশি। অমিল হলাে তিনটি বিষয়ে :১. প্রেডিসেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি, ২. কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ ও ৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যসংখ্যার মূলনীতি ও ভিত্তি।
আওয়ামী লীগ সমস্ত দেশের গণভােটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার পক্ষপাতী আর আমরা তাকে পার্লামেন্টের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে নির্বাচন করার পক্ষপাতী। আমাদের যুক্তি ছিল যে প্রেসিডেন্ট থাকবেন ক্ষমতাহীন, তাঁকে গণভােটে নির্বাচন করলে গণতান্ত্রিক ফেডারেশন চলবে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন বিশেষ একটি কেন্দ্র থেকে। সুতরাং তার পক্ষে দেশের সকল মানুষের ভােটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাহীন করে রাখা সম্ভব হবে না। যার ফলে দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল প্রথা কায়েম হবে এবং একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা হবে। আমাদের মতে, কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিভাগদ্বয়ের পরিকল্পনা করার অধিকার তাঁদের ওপর ন্যস্ত থাকবে—বাকি সব বিষয় আঞ্চলিক স্টেটের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আওয়ামী লীগ দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রাব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রের হাতে রাখার প্রস্তাব করে। আমাদের মতে, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ
২৯৩
পৃথক রাষ্ট্র। সুতরাং জাতিসংঘ বা ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মতাে দুটো দেশের প্রতিনিধি সংখ্যা সমান সমান হবে। কারণ, এক লােক এক ভােট ব্যবস্থা করলে সম্পূর্ণ দেশকে একটা স্টেট মেনে নিতে হয় আর দুটো রাষ্ট্রই লােকগণনার সময় মিথ্যা করে মানুষের সংখ্যা বাড়ানাের চেষ্টা করবে। ফলে ভারতে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে যে রকম লােকগণনা হয়েছে, এখানেও তাই হবে। আওয়ামী লীগ ‘এক লােক এক ভােটের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
আমি কমিটি অব অ্যাকশনের পক্ষ থেকে আন্দোলন সৃষ্টি করার জন্য সব জেলায় যাই এবং সেই সঙ্গে জেলা পােস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়ন ও ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন সংগঠনের কাজও করার চেষ্টা করি। সমস্ত জেলা সংগঠিত হওয়ার পর আমার এ ধারণা হয় যে সবারই মত যে কেবল মূলনীতি নির্ধারণ কমিটির প্রস্তাবসমূহ আমাদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয় বলেই কাজ শেষ না করে আমাদের মতে সংবিধানের কাঠামাে কি হবে তাও দেশবাসীর সম্মুখে উপস্থিত করে সেটি একটি কনভেনশনে পাস করিয়ে দেশের জনমত গঠন করা প্রয়ােজন। ওই সব আলােচনার ভিত্তির ওপর আমরা একটি শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরি করে সব জেলায় ও অন্যান্য পার্টির নেতাদের কাছে পাঠিয়ে দিই এবং ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে একটি গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন’ ডাকা স্থির করি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের জনাব আতাউর রহমান খানের কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছিলাম। সেই কারণে যদিও তিনি আওয়ামী লীগের নেতা, তবু তাঁকেই গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে সভাপতিত্ব করার জন্য আমরা আমন্ত্রণ জানাই। স্থির হয় যে সভাপতির বক্তৃতা তিনিই করবেন, কিন্তু মূলনীতির খসড়া আমি কনভেনশনে উপস্থিত করব। প্রতিটি ধারা দুদিন ধরে আলােচনা হবে এবং কোনাে সংশােধনী গৃহীত হলে খসড়াটিও সংশােধন করা হবে।
গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে সভাপতির লিখিত ভাষণ পাঠ করার সময় আতাউর রহমান সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। সুতরাং তার অসমাপ্ত বক্তৃতা আমিই সভায় পাঠ করি। দুদিন ধরে বাগ্‌বিতণ্ডার পর শেষ সন্ধ্যায় খসড়া গৃহীত হয়। সিলেট জেলার পক্ষ থেকে আবদুস সামাদ আজাদ সাহেবের একটি সংশােধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেটি হচ্ছে, ‘3 AUnited States of Pakistan shall be a sovereign socialist Republic.’ (আমার A Socio-Politcal History of Bengal, Appendix দ্রষ্টব্য)।
কনভেনশনের কাজ শেষ করে আমি খাবারের জন্য বাইরে যাচ্ছিলাম। কারণ, ওই দুই দিনের খাটুনিতে আমি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ অলি আহাদ সাহেব এসে আমাকে ধরে বার-লাইব্রেরি হলে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায়। হলে ঢুকে দেখলাম এক অদ্ভুত কাণ্ড। বরিশালের নুরুল ইসলাম
২৯৪
সাহেব নতুন কনভেনর নির্বাচনের জন্য আতাউর রহমান সাহেবের নাম প্রস্তাব করেছে এবং আবদুল ওয়াদুদ সেটা সমর্থন করেছে। অলি আহাদ আমার নাম প্রস্তাব করে ফেলল আর তাজউদ্দীন সাহেব ও জহুর হােসেন সাহেব সমর্থন করলে ভােট সবই আমার পক্ষে এল। যারা বেরিয়ে গেলেন, তাঁরা হলেন আতাউর রহমান সাহেব, মানিক মিয়া, রফিকুল হােসেন, নুরুল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ—সবাই আওয়ামী লীগের। এমন একটা দুঃখজনক ঘটনা তারা যে কী মনে করে ঘটিয়েছিল, তা আমি অনেক পরে বুঝেছিলাম।
১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলায় দুটো দুর্ঘটনা হয়। প্রথমটি সাঁওতাল কৃষকদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার পুলিশ বাহিনীর সংঘর্ষ এবং কয়েকজন পুলিশের জীবন্ত সমাধি। কৃষাণদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইলা মিত্র। তিনি শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েন। পুলিশ তার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করে।
দ্বিতীয় ঘটনা রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালানাে হয় ও সাতজন রাজবন্দী ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং অনেকে আহত হন। এর কিছুদিন আগেই ঢাকা জেলে শিবেন রায় অনশন করে প্রাণত্যাগ করেন। নূরুল আমীন সাহেবের মন্ত্রিত্বের আমলে ভীষণ ত্রাসের সৃষ্টি হয়, হাজার হাজার কর্মী গ্রেপ্তার হন। শামসুল হক সাহেব, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব, মওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতা ছাড়াও বহু কর্মী বছরের পর বছর ধরে বন্দী জীবন যাপন করেন। নূরুল আমীন সাহেব এর জন্য কতখানি দায়ী আর কতখানি দায়ী চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদ এবং আইজি জাকির হােসেন, তা বলা দুঃসাধ্য। তবে শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীর কাঁধেই চাপতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে দুটো ঘটনার কথা মনে পড়ে। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইল। নির্বাচনে জয়ী হলেও তিনি কোনাে দিন পরিষদে বসতে পারেননি। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে নূরুল আমীন তাঁর লােক দিয়ে ওই নির্বাচনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করালেন। নির্বাচন বাতিল করার কারণ দুটো দেওয়া হলাে। প্রথম তিনি নির্বাচনের প্রতীকের ঘরে লিখেছিলেন ‘লাঙল অথবা ধানের আঁটি’। দ্বিতীয়ত, মওলানা সাহেবের নাম জাল করে মিথ্যা আবেদনপত্র—যেটা তিনি জেল থেকে পাঠাতে পারেন না। ট্রাইব্যুনালে যাদের সদস্য করা হলাে—তার মধ্যে একজন হাইকোর্টের জজ আর দুজন জেলা জজ। হাইকোর্টের জজ রায় দিলেন নির্বাচন বাতিলযােগ্য নয়। দুই জেলা জজ, যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে, তাঁদের দুজনেই বললেন নির্বাচন বাতিল বলে গণ্য হবে। শামসুল হক সাহেব। নির্বাচনের পরেই ইডেন কলেজের ইংরেজির প্রফেসর আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন এবং অর্থনৈতিক অসুবিধা থেকে মুক্তি পান। বিয়ে পড়ান ড. শহীদুল্লাহ এবং ওই বিবাহ মজলিসেই আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের সঙ্গে আতাউর রহমান খান সাহেবের প্রথম পরিচয় হয়। অবশ্য এর আগেই আবুল মনসুর
২৯৫
সাহেব আতাউর রহমান সাহেবের নাম শুনেছেন। তাই আমাকে বললেন, তাদের মধ্যে আলাপ করিয়ে দিতে। পরবর্তীকালে তারা দুজন খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু। হয়েছিলেন।
এর কিছুদিন পরেই শামসুল হক সাহেবকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৫২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে জেলে বন্দী করে রাখা হয়। আমার বিশ্বাস, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবও তাঁর জীবনে দীর্ঘ কারাবাস তার সময়েই করেছিলেন। অবশ্যই শেখ সাহেব একমাত্র যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রিত্বের সময় ছাড়া আর সব মন্ত্রিত্বের সময়ই কারাবাস করেছেন।
টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন বাতিল ঘােষণা ও বিবাহের পরে পরেই শামসুল হক সাহেব দুবার গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন জেলে অবস্থান করার ফলে তার অন্তরে যে আঘাত পান, তার ফলে মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে থাকেন এবং তার মধ্যে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দেয়। আফিয়া খাতুনের অনুরােধে আতাউর রহমান সাহেব এবং আমি নূরুল আমীন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে সব ঘটনা তাঁকে বলি এবং শামসুল হক সাহেবের চিকিৎসার জন্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরােধ করি। তিনি পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে আমাদের কথা শুনলেন, সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ফাইলও দেখছিলেন। তারপর বললেন যে আপনাদের কথায় তার মুক্তি হবে না। এ সম্বন্ধে আইজি প্রিজনস আমাকে কিছু জানাননি। আমরা বললাম যে আপনি আইজি প্রিজনসকে আমাদের। কথার ভিত্তিতে রিপাের্ট চাইতে পারেন, তা নইলে তার পক্ষে মুখ্যমন্ত্রীকে রিপাের্ট দেওয়া সম্ভব হবে না। তিনি উত্তরে বললেন, আপনাদের কথামতাে কাজ করলে সরকার চালানাে সম্ভব হবে না। এর পরে আর কথা চলে না। তাই চলে এলাম।
আর এক দিন দেওয়ান মাহবুব আলীর স্ত্রী জানালেন যে দেওয়ান সাহেব খুবই অসুস্থ, বাঁচে কি না সন্দেহ। আমরা তাকে বােঝানাের চেষ্টা করলাম যে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে কোনাে লাভ নেই। কিন্তু কে শােনে! তাই আমরা দুজন আবার গেলাম তার কাছে। ওই একই ব্যবহার। কেবল বললেন যে দেওয়ান মাহবুব আলী ভদ্রলােকের ছেলে হয়ে কমিউনিস্ট হয়ে গেছে—আরও বললেন, দেওয়ান সাহেব তার আত্মীয়। সুতরাং আমাদের চেয়েও তিনি দেওয়ান সাহেবকে বেশি চেনেন। তিনি বললেন, যদি বন্ড’ দেন যে আর কোনাে দিন রাজনীতি করবে না, তবে ছাড়া পেতে পারে কি না তিনি তা দেখবেন। নইলে তাকে ছাড়া হবে না। অবশ্যই তিনি পরবর্তীকালে দুজনকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। শামসুল হক তখন বিকৃত মস্তিষ্ক এবং চিকিৎসার বাইরে আর দেওয়ান মাহবুব আলীর স্বাস্থ্য এত ভেঙে পড়েছিল যে তিনি আর তার জীবদ্দশায় তাঁর স্বাস্থ্য ফিরে পাননি।
২৯৬
জানুয়ারিতেই লিয়াকত আলী খান এলেন ময়মনসিংহে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সেশনে যােগ দিতে। মুসলিম লীগ কাউন্সিলে মূলনীতি নির্ধারণ কমিটির রিপাের্টের আলােচনা শুনলেন। ঢাকায় এলে আমাদের কমিটি অব। অ্যাকশন’-এর তরফ থেকে চারজন তার সঙ্গে দেখা করে আমাদের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন গৃহীত মূলনীতি তাঁর হাতে দিই এবং তার সঙ্গে কেন আমরা ওই মূলনীতি গ্রহণ করেছি, তারও কারণসমূহ ব্যক্ত করে একটা রিপ্রেজেন্টেশন তাকে দিয়ে আমাদের বক্তব্য পেশ করি। আতাউর রহমান সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিন্নভাবে দেখা করেও আওয়ামী লীগের বক্তব্য পেশ করে।
প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারলেন যে গণপরিষদের মূলনীতি নির্ধারণ কমিটির। প্রস্তাবসমূহ পূর্ব বাংলার কোনাে পার্টি বা ব্যক্তির কাছে গ্রহণযােগ্য নয়।
এ সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এশিয়ার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় । এশিয়ার সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র চীনদেশের নেতা মাও সে-তুং তার পার্টি সরকার প্রতিষ্ঠা করে স্তালিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সােভিয়েত রাজধানী মস্কোতে গিয়ে দুমাস ধরে আলােচনা চালান। কী আলােচনা হয়েছে তা বহির্বিশ্বের জানার কথা নয়। যেটুকুন খবর এসে পৌছাল, সে হচ্ছে যে সােভিয়েত এবং চীন দেশ ত্রিশ বছরের এক চুক্তি সম্পাদন করেছে। চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে যে আগামী ত্রিশ বছরে জাপান বা অন্য কেউ যদি চীন বা সােভিয়েত রুশ আক্রমণ করে, তবে উভয় দেশই একত্র হয়ে যুদ্ধ করবে শত্রুর বিরুদ্ধে। তা ছাড়া সােভিয়েত চীন দেশকে পাঁচ বছরে ত্রিশ কোটি টাকা দেবে শিল্পসামগ্রী ও রেলের সরঞ্জাম ক্রয় করার জন্য।
জুলাই মাসে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে এবং সে আক্রমণের মুখে দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করে এবং সে আক্রমণের মুখে দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্যবাহিনী পিছু হটতে আরম্ভ করল। জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত গ্রস নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা ডাকার জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ট্রিগভিলাইকে অনুরােধ করেন। পরের দিন বিকেল বেলা নিরাপত্তা পরিষদের সভা আহুত হলাে এবং মার্কিন প্রতিনিধি এক প্রস্তাব উপস্থিত করলেন যে নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে নির্দেশ দিচ্ছে যে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সীমানার উত্তরে চলে যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ আলােচনার পর ৯-০ ভােটে প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। সােভিয়েত রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সভায় যােগ দেয়নি। জেনারেল ম্যাক আর্থার জাপান থেকে মার্কিন সাঁজোয়া বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ানদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। ম্যাক আর্থার দক্ষিণ কোরিয়া এলে প্রেসিডেন্ট সিংম্যানরি তাকে অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু জেনারেল ম্যাক আর্থার অবস্থা বুঝে
২৯৭
আট ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে জাপান চলে যান। আমেরিকান সৈন্যরা উত্তর কোরিয়ানদের হাতে মার খেয়ে পিছু হটতে লাগল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকা এই প্রথম অস্ত্র ধরে এমন নাজেহাল হলাে যে মার্কিন সৈন্যদের ওপর সবাই আস্থা হারাতে বসল। আমেরিকা চল্লিশটি ট্যাংক নিয়ে পলাতক মার্কিন সৈন্যদের সাহায্যে এগিয়ে এলে উত্তর কোরিয়ার ট্যাংক বাহিনী চল্লিশটার মধ্যে আটত্রিশটা ট্যাংক সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। জাপান থেকে যে দেড় শ মার্কিন সৈন্য এসেছিল, তার মধ্যে জনাত্রিশেককে আহত অবস্থায় জাপানে নিয়ে যেতে পারা গেল। বাকি সব উত্তর কোরিয়ানদের গুলিতে প্রাণ দিল। নতুন মার্কিন সেনাবাহিনী যারা এল, তারা আত্মরক্ষা করে চলতে লাগল আরও সৈন্যের জন্য। জাতিসংঘের অনুরােধে অন্যান্য দেশ থেকে সৈন্য পাঠানাে হলাে। কারণ, অপমান কেবল আমেরিকার নয়, নিরাপত্তা পরিষদের। এবার সম্মান রক্ষা পেল। ব্রিটিশ সৈন্য এল তিন হাজার। দশ হাজার কানাডিয়ান সৈন্য, ডাচ সৈন্য হাজারখানেক—দক্ষিণ আফ্রিকার এক স্কোয়াড্রন বিমানবাহিনী।
জেনারেল ম্যাক আর্থার নতুন ভুল করল। উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা যখন জাতিসংঘ বাহিনীর চাপে ফিরে যাচ্ছিল, তখন চীনের সীমানা লঙ্ঘন করার আদেশ দিল মার্কিন সৈন্যদের । ইয়ালাে নদীর ওপারে যেতে চীনা সেনাবাহিনী ঝাপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। চীনাদের সম্মুখে দাঁড়ানাের ক্ষমতা কারও থাকল না। তুর্কি সৈন্যরা প্রথম তাদের সফল বাধা সৃষ্টি করল এবং বেয়নেট চার্জ করে দুই শ চীনা সৈন্যকে হত্যা করার ফলে যুদ্ধের মােড় ফিরল। পাঁচ হাজার তুর্কি সৈন্য তুমুল যুদ্ধ করে চলল। তাদের সাহায্য করার জন্য আমেরিকার ট্যাংকবাহিনী এগিয়ে এলে চীনা সেনাবাহিনী তাদের এমনি মার দিল যে আমেরিকানরা কেবল নিজেরাই পালাল না—তুর্কি সৈন্যদের হটে আসতে অনুরােধ জানালে তুর্কি সেনাধ্যক্ষ উত্তরে বলল, ‘যুদ্ধটা সবে জমে উঠেছে। মার্কিন সৈন্যরা দেখল যে তাদের আধুনিক যন্ত্র, ট্যাংক বাহিনী, বিমানবাহিনী চীনা পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেত যদি না তুর্কি ও অন্য সৈন্যরা তাদের রক্ষা করত।
এদিকে হাে চি মিন ভিয়েতনামে ফরাসি সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করে। তুলেছেন। এতকাল ইউরােপের সৈন্যদের মনে করা হতাে অজেয়। অথচ এশিয়ায় তাদের অবস্থা দেখে বােঝা গেল যে বহুদিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ ধনে-জনে, আরাম-আয়েশে অধঃপতনে গেছে। শুধু প্রয়ােজন একটা চরম ধাক্কা—তবেই সাম্রাজ্যবাদীরা পাততাড়ি গােটাবে এশিয়া থেকে।
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হলাে ভারতে দাঙ্গার ফলে। স্বাধীনতার আগে দাঙ্গার মধ্যে কিছুটা বীরত্ব
২৯৮
ছিল—কিন্তু স্বাধীনতার পরে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অর্থে দাড়াল সংখ্যালঘু হত্যা—চরম কাপুরুষতা। খুব শীত পড়েছিল সেদিন। আমার বাড়ির সম্মুখে একটি ছােট হারমােনিয়াম মেরামত করার দোকান ছিল এক হিন্দু ভদ্রলােকের। তার কেউ ছিল না। কয়েক দিন আগে তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই এসেছিল বেড়াতে। হঠাৎ দাঙ্গা লেগে গেল—তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই সকালে এক ফাঁকে রাস্তা পার হয়ে আমার বাসায় এল। মহল্লার রসিক দাসের সবাই ছিল বন্ধু। তাই সে ভয় পেল না। গুন্ডারা তার বাড়ি আক্রমণ করলে সে দরজা লাগিয়ে চিৎকার করতে থাকে—কয়েক মিনিটের মধ্যেই গুন্ডারা দরজা ভেঙে ফেলে। তখন সে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। আমি চিঙ্কার শুনে দোতলার জানালা খুলে দেখি যে একটা গুন্ডা তার পেটে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। আমি ওই মহল্লায় অল্প দিন—লােকটাকে চিনতে পারলাম না। আমি তখনাে জানি না—তার জামাই ও মেয়ে আমাদের নিচের তলায় একটা ঘরে লুকিয়ে আছে। গুন্ডারা অনুমান করেছিল ঠিকই। আমাকে গেটের দরজা খুলে দিতে বলল। আমি কোনাে উত্তর দিলাম না। ওরা ছুরি উঁচিয়ে কী যেন বলল। ইতিমধ্যে রসিকের মেয়ে আমার স্ত্রীর কাছে এসে কেঁদে বলছে—গেট খুলে দিলে আমাদের হত্যা করবে। গুন্ডারা রাস্তায় ঘােরাঘুরি করতে লাগল। এমনি করে ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেল। মহল্লার কোনাে লােককে জানালা থেকে দেখলাম না। ঘণ্টাখানেক পরেই অলি আহাদ সাহেব এসে উপস্থিত। দাঙ্গার ব্যাপারে আলােচনা করতে এসেছেন ও কর্তব্য কী তাই ঠিক করতে। তাকে পেয়ে আমি অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। দাঙ্গা প্রতিরােধের আগে প্রথম কাজ হলাে ওদের কোনাে প্রকারে পার করে দেওয়া। অলি আহাদ সাহেব আমাকে বললেন, তার সঙ্গে পার্টি অফিসে যেতে। আমার ভয় হলাে আমি বেরিয়ে গেলে গুন্ডারা দরজা ভেঙে ঢুকতে পারে। আমি তাই বললাম, আমি পরে যাব। কয়েকজন লােক পাঠাতে বললাম ওদের একটা হিল্লে করতে। বিশ্বস্ত লােক প্রয়ােজন। দুপুরের পর কয়েকজন লােকের সাহায্যে পেছনের দেয়াল ভেঙে-কিছুদূর হিন্দুপাড়ায় তাদের পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। ১৫ তারিখে দাঙ্গা প্রতিরােধের কাজে আমি আর বেরােতে সাহস পেলাম না। মনে হলাে—হয়তাে গুন্ডারা আমার ওপর প্রতিশােধ নিতে ছাড়বে না। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল অনেক জেলায়—বিশেষ করে বরিশালে। বরিশালের মুসলিম লীগের তদানীন্তন। সেক্রেটারিকে গ্রেপ্তার করা হলাে। পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে ভীষণ পরিবর্তন এসেছিল। বােধ হয় শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে থাকার ফলে। পরবর্তীকালে তিনি শেখ সাহেবের পরম বন্ধুও হয়েছিলেন।
২৯৯
লিয়াকত আলী খান ছুটে এলেন ঢাকায়। সব দেখে তিনি সরকারি কাজের প্রশংসা করতে পারলেন না। আরও অবাক হলেন দেখে যে দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিচ্ছে মুসলিম লীগের একশ্রেণির গুন্ডা আর বিহারি মােহাজেররা। তারা বাড়ি দখল করার জন্যই হিন্দুদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে আমরা সরকারের আইন রক্ষার ক্ষেত্রে চরম অবহেলার কথা উল্লেখ করলাম। লিয়াকত আলী খান ভয় পেলেন যে এর ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেবে। তাই তিনি নেহরুর সঙ্গে সংখ্যালঘু সমস্যা সম্বন্ধে আলােচনা করতে চাইলেন। এক মাস পরে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে লিয়াকত আলী খান দিল্লি পৌছান এবং লিয়াকত-নেহরু প্যাক্ট সই হয় ৮ এপ্রিল।
মুসলিম লীগ সরকার ইনকোয়েরি কমিশন গঠন করে। মুসলিম লীগ কমিশনের পক্ষে ছিলেন সর্বজনাব রেজাই করিম সাহেব, জহিরুদ্দীন সাহেব। ও জমিরউদ্দীন সাহেব।
পাকিস্তানে লিয়াকত আলী খান এবং তার মুসলিম লীগ শেখ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে মুসলমান সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতে আরম্ভ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে উত্তেজিত জনতা মিছিল করতে আরম্ভ করে, কিন্তু পূর্ববঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা কোনাে দিনই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।
১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখে অনেক দিন আলােচনার পর এপিটিইউএফ এবং টিইউএফপির মধ্যে একটা সমঝােতা হয়। ওই সমঝােতার ফলে ফেডারেশন নতুনভাবে সংগঠিত হয়। নুরুল হুদা সাহেব প্রেসিডেন্ট, আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট, ফয়েজ আহমদ সাধারণ সম্পাদক, আফতাব আলী কোষাধ্যক্ষ ও জহুর আহমদ চৌধুরী সহসম্পাদক নিযুক্ত হন।
ফেব্রুয়ারি মাসের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ভারতে চলে যান এবং তাঁর স্থলে ডাক্তার মালিক পাকিস্তানের শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হন। যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তার তফসিলি হিন্দুদের কোনাে সাহায্য করতে পারেননি—এমনকি লিয়াকত আলী খান যখনই যেকোনাে সিদ্ধান্ত নিতেন, যােগেনবাবুকে ডাকা হতাে না। লিয়াকত আলী খানের কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে হলে যাদের ডাকতেন—তাঁরা হলেন গােলাম মােহাম্মদ ও ফজলুর রহমান সাহেবদ্বয় আর উপস্থিত থাকতেন সেক্রেটারি জেনারেল চৌধুরী মােহাম্মদ আলী। কিন্তু যােগেন মণ্ডলের ধারণা ছিল যে প্রধানমন্ত্রী কেবল তাঁকেই বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। সিলেট রেফারেন্ডামে তাঁর দান ছিল অনস্বীকার্য এবং তার জন্যই আমরা তফসিলি সম্প্রদায়ের ভােট পেয়েছিলাম সেই রেফারেন্ডামে, যখন অনেক মুসলিম নেতা, যেমন স্যার সাদুল্লাহ এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রেফারেন্ডামে কোনাে সাহায্যই করেননি।
৩০০
যােগেন মণ্ডল চলে যাওয়ায় ১৯৫০ সালে সর্বপ্রথম তফসিলি সম্প্রদায়—বিশেষ করে তাদের মধ্যে কৃষকশ্রেণি পূর্ব বাংলা ত্যাগ করতে আরম্ভ করে। ভারত সরকার ১৯৪৭ সালে যারা দেশত্যাগ করে কলকাতা গিয়েছিল, তাদের প্রতি ধর্মের দিক থেকে সহানুভূতি থাকলেও অর্থনৈতিক প্রয়ােজনের দিক থেকে তারা কেবল বােঝা হয়ে রইল। তারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে ঘােলাটে করেছে, ওই দেশের কোনাে উপকার করেনি। কিন্তু ১৯৫০ সালে যারা দেশত্যাগ করে ভারতে গেল, তাদের ভারত সরকার স্বাগত জানাল—তাদের জমি দিল, হালের বলদ দিল পাট বােনার জন্য এবং তাদের প্রচেষ্টায়ই ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাট চাষ আরম্ভ হয়—এবং ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাট রপ্তানিকারী। দেশে পরিণত হয়। তা ছাড়া ১৯৫০ সালে দেশত্যাগের হিড়িক পড়ার আরও কারণ ছিল—সেটা সামাজিক। হিন্দুসমাজ ১৯৪৭ সাল থেকেই গোঁসাইব্রাহ্মণের অভাব অনুভব করছিল। কারণ পূজা দেওয়ার জন্য ঠাকুর পাওয়া যাচ্ছিল না। ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার অসুবিধা তারা অনুভব করছিল—কিন্তু তবু তারা মাটির আকর্ষণে দেশ ছাড়েনি। গ্রামের ইউনিয়ন বাের্ডের সদস্যরা নানাভাবে তাদের ওপর অত্যাচার আরম্ভ করল হিন্দুদের জমি দখলের জন্য। শহরে বিহারিদের যে উদ্দেশ্য ছিল দাঙ্গা বাধানাের পেছনে—ঠিক একই উদ্দেশ্যে, যােগেন মণ্ডলের যাওয়ার পরে, গাঁয়ের মুসলমান মােড়লদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ দেখা দিল। লােভ তাদের পেয়ে বসল—যার ফলে সাময়িক লাভ হলেও পরবর্তীকালে সব বাঙালিকে তার খেসারত দিতে হয়েছে এবং দিতে হবে। তফসিলি কৃষক যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুমার, কামার, স্বর্ণকার, কাঠমিস্ত্রি, জেলে প্রভৃতি দেশ ছাড়তে আরম্ভ করে। পূর্ব বাংলার মেরুদণ্ড ভাঙায় ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভূত সাহায্য করেছে।
যােগেন মণ্ডল ভারতে চলে যাওয়ার পর ডা. মালিক কেন্দ্রে শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। তারই প্রচেষ্টায় একটি জাতির ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গড়ে উঠল। করাচি রায়পন্থী খতিব সভাপতি এবং ফয়েজ আহমদকে সেক্রেটারি করে ১৯৫০ সালে (All Pakistan Confederation of Labour=APCOL) গঠিত হলাে। ওয়ার্কিং কমিটিতে ২১ জন সদস্য নেওয়া হলাে। পূর্ব বাংলা থেকে থাকলেন ডা. মালিক, মােহাম্মদ সােলেমান, গােলাম মর্তুজা, জহুর হআহমদ চৌধুরী, আফতাব আলী আর আমি। ডা. মালিকের ইচ্ছা ছিল ফেডারেশন করার কিন্তু আমি বললাম, দুই পাকিস্তানের মধ্যে কেবল কনফেডারেশনই হতে পারে। পরিশেষে স্থির হলাে যে পশ্চিম পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার ও পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার সব ব্যাপারেই স্বাধীন থাকবে, কেবল বিদেশে কে যাবে সেটা স্থির করবেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডা. মালিক—APCOL-এর প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি।
৩০১
করাচি থেকে ফিরে এসে আমরা দেখলাম যে নূরুল হুদা সাহেবকে ট্রিপারটাইট লেবার কনফারেন্সে ডাকা হয়নি বলে তিনি ফয়েজ আহমদের বিরুদ্ধে কেবল কুৎসা রটনা করেই ক্ষান্ত হননি, নারায়ণগঞ্জে সুতাকলের শ্রমিকদের এক সভায় ফয়েজ আহমদের বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করেছেন। সুতাকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ আহমদ। ফয়েজ আহমদ কাউন্সিল সভা ডেকে নূরুল হুদা সাহেবকে ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করার প্রস্তাব পাস করেন। সে কাউন্সিল অধিবেশনে আমাকে পূর্ব পাকিস্তান। ফেডারেশন অব লেবারের সভাপতি নির্বাচন করেন। ফয়েজ আহমদ সাহেব সেক্রেটারি, আফতাব আলী ভাইস প্রেমিডেন্ট, জহুর আহমদ চৌধুরী সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সভাপতির বক্তৃতায় আমি যা বলেছিলাম তার একটা মােটামুটি বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলাে :
“পূর্ব পাকিস্তানে সত্যি বলতে এখনাে কোনাে শিল্প গড়ে ওঠেনি। ডজনখানেক সুতাকল আছে সারা বাংলাদেশে, তার বেশির ভাগই নারায়ণগঞ্জে। চা-বাগানের লক্ষাধিক শ্রমিক আছে, যারা সিলেট জেলায়ই মােটামুটি সীমাবদ্ধ। অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল শ্রমিকদের মধ্যে অনেক শ্রমিক রয়েছে তাদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামের বাসিন্দা। আমাদের দেশে জাহাজি শ্রমিক প্রায় দুই লাখ, কিন্তু জাহাজি শ্রমিকদের তালিকাভুক্তির জন্য বাণিজ্যিক জাহাজ কোম্পানির কোনাে ব্যবস্থা না থাকায় তাদের চরম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কলকাতা এখন আর যাওয়া চলে না-করাচি বহু দূরে অবস্থিত। কলকাতা থেকে মাদ্রাজি জাহাজি শ্রমিক তালিকাভুক্ত হচ্ছে আর করাচি থেকে মাকরানিদের তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। বাংলার লাখ লাখ জাহাজির জন্য অবিলম্বে কোনাে ব্যবস্থা না করতে পারলে বাংলাদেশের বিস্তর ক্ষতি হবে। জাহাজি শ্রমিকেরা প্রায় সবই সিলেট জেলাবাসী। এরা সবাই বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে।
কলকাতার পাটকলে, জামসেদপুরে ইস্পাত কারখানায়, আসামের তেলের খনিতে যারা কাজ করত এখনাে করছে, তাদের বেশির ভাগই নােয়াখালীর অধিবাসী। কলকাতা পাের্টের মেরিনার্সদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামের বাসিন্দা হলেও নােয়াখালীর লােকও রয়েছে। কলকাতার হােটেলগুলােতে যারা টেবিল বয়ের কাজ করছে, তাদের বেশির ভাগই ঢাকার লােক। ছাতার কাজ ফরিদপুরের লােক, দরজির এবং পুস্তক বাঁধানাের কাজ ঢাকার লােকেরাই করত। কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর তারা অনেকেই দেশে ফিরে এসে বেকার জীবন যাপন করছে।
পাকিস্তান হওয়ার পর যেহেতু প্রায় ৭০ লাখ বাস্তুহারা ভারত থেকে করাচি গেছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার স্থির করেছে করাচিকেই
৩০২
প্রথম শিল্পায়িত করতে হবে। আমাদের পূর্ববঙ্গে কয়েক লাখ বাস্তুহারা। এসেছে—তাদের জন্য আদমজি, বাওয়ানি ও ইস্পাহানিরা পাটশিল্পের প্রতি মনােযােগ দিচ্ছে। এসব কারখানায় বাঙালি শ্রমিকদের খুবই কষ্ট হচ্ছে—তার কারণ তারা মােহাজেরদের পুনর্বাসনের জন্য প্রথম তালিকাভুক্ত করে—তা। ছাড়া তাদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে প্রথম কাজ। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থার জন্যই সরকার এসব কারখানার মালিকদের বৈদেশিক মুদ্রা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এসব কারখানায় তাই বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করা অসুবিধাজনক হয়ে উঠেছে। এখন ওই সব কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করার প্রচেষ্টা সফল হবে না—যদিও দেওয়ান মাহবুব আলী ও তােয়াহা সাহেবরা ওই সব কারখানায় ইউনিয়ন গঠন করার চেষ্টা করছেন। আমরা তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে চাই না।
আমাদের কারখানাগুলােতে জমিহারা কৃষক, পেশাচ্যুত হস্তশিল্পী, বেকার শহুরে যুবকেরা চাকরি নিতে আসে। আমাদের দেশে জমিহারা কৃষক খুবই বেশি। তাই তারা শহরে বেশি সংখ্যায় চাকরিপ্রার্থী। সুতরাং বেতনের জন্য। তারা দর-কষাকষি করতে পারে না। বিগত চার বছরে শ্রমিকদের জন্য কোনাে আইনই করা হয়নি। ভারত বিভক্তির সময় যেসব শ্রম আইন ভারতের। ছিল, আমরা তাও উপভােগ করতে পারছি না। ইউনিয়ন করার অসুবিধা হচ্ছে—মালিকেরা যারা ইউনিয়ন করতে চায়, তাদেরই বরখাস্ত করে দেয়। নতুন দেশ, তাই জনসাধারণ উৎপাদন চায়, শ্রমিকদের কোনাে আন্দোলন পছন্দ করে না। শ্রমিকেরা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এসেছে। তাই শ্রমিকদের শিক্ষিত করতে, সংগঠন করতে বাইরের শ্রমিকনেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। বাইরের শ্রমিক নেতাদের প্রয়ােজন সেদিনই ফুরিয়ে যাবে, যেদিন শ্রমিক সমস্যা-সচেতন হবে ও শ্রেণি হিসেবে গড়ে উঠবে।
আমরা আশা করছি যে মিলমালিকদের মধ্যে প্রতিযােগিতা সৃষ্টি হবে এবং বড় বড় মিল—তাদের লাভের অঙ্ক বাড়ানাের জন্য বেশি করে শ্রমিক নিয়ােগ করবে এবং অনেক মজুর একত্রে থেকে কাজের মধ্য দিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলতে সমর্থ হবে । APCOL-এর কাজ হবে ক্রমাগত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে শ্রমিকদের বেঁচে থাকার মতাে আইনানুগ ব্যবস্থা সরকার করে, কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান কোনাে চাপই সৃষ্টি করতে পারবে না, যদি আঞ্চলিক ফেডারেশনগুলাে শক্তিশালী না হয়। আবার আঞ্চলিক ফেডারেশনগুলাে শক্তিশালী হতে পারে না, যদি তাদের সদস্য ইউনিয়নগুলাে ভালােভাবে সংগঠিত না হয়। এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে একমাত্র মজুর শ্রেণিই সমাজতন্ত্র আনতে পারে না, কারণ সমাজতন্ত্র।
৩০৩
প্রতিষ্ঠা করার পূর্বশর্ত সদবুদ্ধিসম্পন্ন বিপ্লবী নেতৃত্ব এবং যথেষ্ট শিক্ষা-দীক্ষা থাকলে সে নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে না—সে জন্যই মেহনতি জনতার জন্য আমরা দেখি কার্ল মার্ক্স, লেনিন, মাও সে-তুংয়ের তাত্ত্বিক চর্চা। তাঁদের লেখা পড়লেই বােঝা যায় অবস্থার বিশ্লেষণ ও কার্যপ্রণালির পরিকল্পনা ও সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য তারা তাদের জ্ঞান ও ক্ষুরধার বুদ্ধির ব্যবহার করেছেন। শ্রমিকেরা আন্দোলন করতে পারে, প্রয়ােজন হলে প্রাণ দিতে পারে—কিন্তু তাই বলে সফল বিপ্লবের পথে মেহেনতি শ্রমিক সমাজকে সঠিক পথে চালিয়ে নিতে পারে না। তাই দেখা যায় যথেষ্ট প্রাণ দিয়ে ও মহান আদর্শ সম্মুখে রেখেও ফরাসি বিপ্লব সফল হয়নি—অথচ লেনিন ও মাও সে -তুং সফল বিপ্লব সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন।
আমাদের দেশ কৃষিভিত্তিক। শিল্পায়িত হতে অনেক বিলম্ব হবে—এখনাে আমরা শ্রমিক বলতে কেরানি সম্প্রদায়কেই মনে করছি—অথচ সত্যিকার শ্রমিক তাঁরা নন। সত্যিকার শ্রমিক যে স্বহস্তে কাজ করে উৎপাদন করে। ট্রেড ইউনিয়নের প্রধান কাজ হচ্ছে মজুরদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ রাখা। তবু তাদের একটা সামাজিক চেতনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া প্রয়ােজন।
মালিকের সঙ্গে শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কোনাে বিরােধ উপস্থিত হলে যাতে উভয় পক্ষ আলাপ-আলােচনা করে তার সমাধান করতে পারে, এ অধিকার অর্জন করা শ্রমিক ইউনিয়নের প্রথম ধাপ। এক কথায় যৌথ দর-কষাকষির অধিকার। ওই দর-কষাকষি সম্ভব নয় যদি কারখানার লাভ-লােকসানের সমস্ত সংবাদ পেতে শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার না থাকে। আর সর্বোপরি ইউনিয়নের প্রয়ােজন সর্ববিষয়ে মালিক এবং শ্রমিক একত্রে বসে কারখানার ভবিষ্যৎ ও শ্রমিক-মালিকের মধ্যে সম্পর্ক কী হওয়া উচিত, সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অংশীদার হওয়ার অধিকার। সমাজতান্ত্রিক দেশে সেটা আছে বলেই যৌথ দর-কষাকষির ব্যবস্থা সেখানে নেই।
আমাদের স্বাধীনতা এসেছে সবে চার বছর। নতুন শিল্প গড়ে উঠতে সময়ের প্রয়ােজন। কাজেই ট্রেড ইউনিয়ন করতে গিয়ে যদি এমন দাবি। উপস্থিত করা হয় যে মালিকদের সে দাবি পূরণ করলে আর কারখানা চালানাে সম্ভব হবে না—যার ফলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, তবে শ্রমিকের ক্ষতি তাে হবেই—জনসাধারণেরও ক্ষতি হবে এবং তাদের সহানুভূতি শ্রমিকেরা হারাবে। এমন অবস্থায় শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইউনিয়নের শক্তি অনেকটা নির্ভর করবে তার সভ্য সংখ্যার ওপর এবং তারা হবে চাঁদাদাতা সভ্য । হিসাবে যেন কোনাে দিন গরমিল না হয়—প্রতিটি পয়সার হিসাব সংরক্ষণ করতে না পারলে নেতা তার নেতৃত্বই হারাবে না, ইউনিয়নও ভেঙে যাবে। সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে ধর্মঘট। তাই সকল
৩০৪
প্রকার চেষ্টা না চালিয়ে যেসব শ্রমিক ধর্মঘটে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারা দেশের ক্ষতি করে, দশের ক্ষতি করে। অনেক নেতা পাবেন যাদের ধারণা ঘরের দরজার কাছে বিপ্লব অপেক্ষা করে আছে। দরজা জোর করে খুলে দিলেই বিপ্লব হয়ে যাবে—তারা আপনাদের ভুল পথেই চালাতে পারে—সত্যিকার শ্রমিকদরদি তারা নয়। কারণ, বিপ্লব আসার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে না।
অনেক সময় মালিক ধর্মঘট করার জন্য শ্রমিকদের উত্তেজিত করে। কারও ওপর অবিচার অথবা অনর্থক অত্যাচার করে ধর্মঘট হওয়ার জন্য, কারণ তখন হয়তাে তার উৎপাদিত মাল গুদামভর্তি। ধর্মঘটের সময় উৎপাদন হ্রাস করে বাজারে গুদামের মাল বেশি দামে ছাড়তে পারে। অনেক সময় তাদের এজেন্টরা ধর্মঘটে সাহায্য করে তাদের হাতের মাল বেশি দামে বিক্রি করার জন্য। তাই ধর্মঘটগুলােকে কখনাে হালকাভাবে গ্রহণ করা উচিত নয় ।
আমি ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশনের সভাপতি ছিলাম। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগে যােগদান করার সিদ্ধান্ত নিলে আমি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ করি।
১৯৪৮ সালের শেষের দিকে খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল হওয়ার পরেই তাঁরই অনুরােধে লিয়াকত আলী খান পূর্ব বাংলার জেনারেল অফিসার কমান্ডিং আইয়ুব খানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল নিযুক্ত করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব ভাষা আন্দোলনের সময় বর্ধমান হাউস ছেড়ে আইয়ুব খানের অতিথি হয়েছিলেন নিরাপত্তার প্রয়ােজনে। বাংলাদেশের লােকেরা এ সম্বন্ধে কোনাে মনােযােগ দেখায়নি। তবে তাঁর ওই নিযুক্তি উপলক্ষে বাবু রণদাপ্রসাদ সাহা এবং আরফান খান সাহেব আইয়ুব খানকে ঢাকা ক্লাবে এক নৈশভােজে আপ্যায়িত করেন। ওই দিনই শহীদ সাহেব এসেছিলেন ঢাকায় একটি সামাজিক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। খাজা নসরুল্লাহর মেয়ের বিয়ে কাদেরী সাহেবের (আইসিএস) সঙ্গে। খবর পেয়ে রণদাবাবু ও আরফান খান সাহেব দুজনেই তাকে নৈশভােজে যােগ দেওয়ার জন্য ধরেন। ১৯৪৩ সাল থেকেই বাবু রণদা সাহার সঙ্গে শহীদ সাহেবের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং রণদাপ্রসাদ বাবু যখন কুমুদিনী হাসপাতাল উদ্বোধন করার জন্য গভর্নরকে আমন্ত্রণ করার কথা শহীদ সাহেবকে বলেন, তখন শহীদ সাহেবই তার ব্যবস্থা করে দেন। রণদাবাবু তাঁর ‘মির্জাপুর বােটে করে গভর্নর ও শহীদ সাহেবকে মির্জাপুর নিয়ে যান। রণদাবাবু অপূর্ব করে সাজিয়েছিল মির্জাপুরকে, সে উপলক্ষে যারা উপস্থিত ছিল, তারা অনেক দিন তা ভুলবে না। শহীদ সাহেব রণদাবাবুর নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। সবাই ঢাকা ক্লাবে এসে গেছেন, মন্ত্রীরা সবাই এসেছেন, সবাই বসেছেন, এমন সময় সবার পরে শহীদ সাহেব এলেন—সাদা প্যান্ট ও বুশশার্ট পরে। এক কোনার টেবিলে বসতে
৩০৫
যাচ্ছিলেন, কিন্তু রণদাবাবু তাঁকে ‘মেইন টেবিলে’ নিয়ে এসে আইয়ুব খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শহীদ সাহেব বললেন, Nice to meet you General, আইয়ুব তার শান্তি মিশনের ব্যাপারটা জানতেন। তাই তিনি শুধু বললেন, হ্যালাে। অন্য কোনাে কথা না বলেই তিনি মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। হবীবুল্লাহ বাহার সাহেব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কথার মধ্যে বাংলায় বলে ফেললেন, ‘পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ ধরবে অসি আর পূর্বাংশ ধরবে মসি। পূর্ব বাংলার লােকেরা যুদ্ধ করতে জানে না, কিন্তু কবিতা লিখে বীরের প্রশংসা সাহিত্য, ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করতে জানে। আপনারা আমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন আর আমরা আপনাদের ইতিহাসে, সাহিত্যে অমর করে রাখব। বাংলা বলে আবার ইংরেজিতে তার অনুবাদ করে দিলেন। শহীদ সাহেব হঠাৎ মুখ খুলে বললেন :
Dear Minister, your statements need amendments. Bengalees are courageous enough to protect themselves. As a Prime Minister when I visited Dacca, in 1946 I was impressed when I learnt that a Dacca boy of fifteen years had the courage to stab a Sikh in broad-daylight in the market.
সবাই তার দিকে তাকালেন। বাহার সাহেব অপ্রস্তুত হলেন। আর আইয়ুব খান, আজিজ আহমদ প্রমুখ মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়ে রইলেন—কিন্তু কেউ তাঁকে ঘাটালেন না। নৈশভােজটা জমল না আর।
হামিদুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে PRODA মামলা আনা হলাে। হামিদুল হক নিজেই তার মামলা পরিচালনা করেছিলেন। সেই মামলায় চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদ সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বললেন যে তিনি মন্ত্রীদের কার্যকলাপও নােট করেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রিপাের্ট পাঠান। ওই মামলায় এটাই প্রমাণিত হলাে যে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের নামে আমলাতন্ত্র চলছিল। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আমলারাই পরিচালনা করত। ১৯৫০ সালে হামিদুল হক চৌধুরীকে সরকারের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকার বিষয়টি অযােগ্য বলে বিবেচিত হলাে।
সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম পাকিস্তানি কমান্ডার-ইন-চিফের পদে নিযুক্ত হন। আইয়ুবের এ পদোন্নতি সম্পূর্ণ খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের বদৌলতে। জিন্নাহ সাহেব আইয়ুব বাউন্ডারি কমিশনে থাকতে যেসব অপকর্ম করেছিলেন, তার জন্য তাঁকে কোর্ট মার্শাল করতে চাইলে খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবই তাকে বাঁচিয়ে পূর্ব বাংলায় GOC করে নিয়ে আসেন। খাজা সাহেব গভর্নর জেনারেল
৩০৬
হওয়ার পর লিয়াকত সাহেবকে বলে তাঁকে Adjutant General করে পিন্ডি নিয়ে যান—এবং পরে তাঁকেই লিয়াকত আলী খান অনেক সিনিয়র অফিসারকে ডিঙিয়ে সিএনসি নিযুক্ত করেন। অল্প বয়সে এত দ্রুত প্রমােশন পাওয়ার ফলে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি হতে পারেনি—যার ফলে পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক হওয়ার জন্য তার প্রস্তুতি চলতে থাকে।
এদিকে শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরে গণভােটে গণপরিষদ গঠন করার সংকল্প ঘােষণা করাতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তাঁকে সাবধান করে দেন যে যদি ওই ধরনের কোনাে পরিকল্পনা তার থাকে, আর যদি তা অবিলম্বে শেখ সাহেব পরিহার না করেন, তবে পাকিস্তান তার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু যখন গণপরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল, তখন লিয়াকত আলী খান নির্বাক হয়ে গেলেন। সেই সাবধানবাণীর পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কোনাে পরিকল্পনার ব্যাপারে আর কোনাে উচ্চবাচ্য করেন না। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ও তৎসঙ্গে পাকিস্তানের মান কমে গেল। লিয়াকত আলী খানের ওভাবে বড় বড় কথা বলা এবং সে অনুসারে কাজ না করা তাঁর একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বজ্রমুষ্টি দেখাত সবাইকে এবং সেই। বজ্রমুষ্টির ছবি কাগজে কাগজে ছাপা হতাে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সবার কাছে তাঁর অভিনয় অনেকটা হাসির খােরাক জোটাত।
১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কিছুদিন পরেই আবুল হাশিম সাহেবের। কাছ থেকে তার পেলাম। তিনি ঢাকায় চলে আসছিলেন সবাইকে নিয়ে। বুঝলাম তাকে শেষ পর্যন্ত বর্ধমান ছাড়তে হলাে। বাপ-দাদার বাড়িঘর ছেড়ে। আসা, বিশেষ করে আবুল হাশিম সাহেবের পক্ষে, যার বংশের রয়েছে একটা ঐতিহ্য—যার পিতার নামানুসারে তাদের গ্রাম কাশিয়ারার নাম হয়েছে কাশিমনগর—সে গ্রাম ছেড়ে আসা। সহায়, সম্পদ, আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জন সবকিছু ফেলে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের হাত ধরে নিঃসহায় অবস্থায় ঢাকায় আসছেন—কে আছে তার এখানে, কোথায় উঠবেন, কোথায় থাকবেন! কী করবেন। এই কি আজাদি—এই কি স্বাধীনতা, এই কি রাজনীতির শেষ পরিণতি?
জলিল সাহেবও তার পেয়েছেন। জলিল সাহেব ও তাঁর স্ত্রী আমাকে বললেন যে তাঁদের বাড়িতেই আবুল হাশিম সাহেব থাকবেন যত দিন না অন্য কোনাে ব্যবস্থা করা যায়।
আবুল হাশিম সাহেবের বর্ধমানের বাড়িতে হিন্দুরা আগুন লাগিয়ে দেয়। তিনি অন্ধ, সে অবস্থায় ছেলেমেয়েদের হাত ধরে শহরে তার পরিচিত অনেক বন্ধুর বাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেন। হিন্দু-ব্যক্তিগত বন্ধু ও কমিউনিস্ট—যারা তাঁর কাছ থেকে উপকার পেয়েছে এককালে, তারা কেউ সাহায্য করতে
৩০৭
এগিয়ে এল না। একদিন যে অজস্র যুবক প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেই তিনি আজ অসহায়। কতটা অসহায় যে তিনি সেটা বুঝলেন যখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে বর্ধমান শহর থেকে গাঁয়ের বাড়ি গেলেন। যখন অন্য ধর্মের প্রজারা তাঁকে বললেন যে তাঁর কোনাে ভয় নেই, আমরা জীবিত থাকতে আপনাদের কেউ কিছু করতে পারবে না, এটাই তাঁকে সবচেয়ে বড় আঘাত করেছে। যুগ যুগ। ধরে যারা মনিবের ওপর ভরসা করে বেঁচেছে, তাদেরই ভরসায় আজ বাঁচতে হবে—এ ছিল সামন্ত অভিজাত বংশের মানুষের ওপর নিষ্ঠুরতম আঘাত। তখনই স্থির করলেন তিনি পাকিস্তানে আসবেন।
আমার ভয় হলাে নূরুল আমীন সাহেব কি ব্যবহার করবেন তাঁর সঙ্গে। নূরুল আমীন সাহেবের সরকার ১৯৪৮ সালের দিক ক্ষমতায় আসার পর যে অত্যাচারের স্টিম রােলার চালিয়েছে, তা থেকে ওই অন্ধ, অসহায়, কপর্দকহীন লােকটি কি রক্ষা পাবে?
আমরা কিছুদিন আগেই আমাদের গণ-আজাদী লীগ (People Freedom League)-কে সিভিল লিবার্টিজ লীগে পরিণত করেছি কোর্টে রাজনৈতিক কর্মীদের পক্ষ সমর্থন করতে, জামিনের ব্যবস্থা করতে, ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য জনমত সৃষ্টি করতে। কিন্তু আমরা কতটা সাহায্য করতে পেরেছি! ১৯৫১ সালের ১৭ জানুয়ারি আইয়ুব খান জেনারেল এ্যাসির কাছ থেকে কার্যভার গ্রহণ করেন। তাঁর ওই নিযুক্তি সিনিয়র অফিসাররা আন্তরিকভাবে সমর্থন করতে পারেননি। ফলে আইয়ুব ও দেশরক্ষাসচিব ইস্কান্দার মীর্জা একযােগে ষড়যন্ত্র করে যাদের আনুগত্যের প্রতি তাদের সন্দেহ হয়েছিল, তাদেরই সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন। ওই সময় কাশ্মীরে হানাদার ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে লড়াই চলছিল—জেনারেল আকবর খান ছুটি নিয়ে জেনারেল তারিক ছদ্মনামে হানাদারদের পরামর্শ দিয়েই কেবল সাহায্য করেননি, পাকিস্তান সৈন্যদের ছুটি দিয়ে—হানাদারদের পক্ষে যুদ্ধের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন এবং নিজেই যুদ্ধ পরিচালনা করে সৈন্যদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
আইয়ুব তার লােকপ্রিয়তায় ভীত ও চঞ্চল হয়ে উঠলেন এবং ইস্কান্দার মীর্জার সঙ্গে এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন আকবর খানকে বিপদে ফেলার জন্য। তার সুযােগও এসে যায়। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়ন’-এর (ডব্লিউএফটিইউ) এক প্রতিনিধিদল তখন পিণ্ডিতে এসেছিল এবং ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও সাজ্জাদ জহিরের সঙ্গে এক নৈশভােজে মিলিত হয়েছিল । সেখানে কাশ্মীরের ব্যাপার নিয়ে আলােচনা করার জন্য ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, জেনারেল আকবর খান এবং অন্যান্য জেনারেল যারা তখন ছুটিতে থেকে আকবর খানের সঙ্গে কাশ্মীর লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদেরও
৩০৮
নিমন্ত্রণ করেন। ইস্কান্দার ও আইয়ুব প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন যে আর্মি ইন্টেলিজেন্সের খবর হচ্ছে যে রুশ সাম্যবাদীদের সঙ্গে আকবর খানের একটা সমঝােতা হয়ে গেছে এবং আকবর খান সরকার উৎখাত করার জন্য এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। লিয়াকত আলী খানের বিশ্বাস হলাে এ জন্য যে নেহরু আমেরিকা থেকে ইতিমধ্যে সরকারিভাবে নিমন্ত্রিত হয়েছেন; কিন্তু তিনি কোনাে নিমন্ত্রণ পাননি। সাজ্জাদ জহীরকে এ কথা বলতেই সাজ্জাদ তার জন্য মস্কো থেকে নিমন্ত্রণপত্র আনার ব্যবস্থা করলেন। এখানে উল্লেখ করা যায় ভারতের ইন্টেরিম সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে লিয়াকত যে বাজেট বক্তৃতা করেছিলেন তা সাজ্জাদ জহীরের খসড়া। মস্কো থেকে সত্যিই নিমন্ত্রণপত্র এল। আমেরিকা খবর পেয়েই লিয়াকত আলীকে নিমন্ত্রণ করে পাঠায়। সুতরাং তার বিশ্বাস হলাে যে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও সাজ্জাদ জহিরের মস্কোর প্রথম সারির লােকদের সঙ্গে নিশ্চয়ই নিবিড় বন্ধুত্ব আছে।
ওই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান ও পুলিশ কর্ণধার কোরবান আলীর সঙ্গে পরামর্শ করে আইয়ুবের তালিকায় যাদের নাম ছিল, তাদের গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা করেন এবং পরে তাদের একটি ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে হাজির করা হয়। সেনাবাহিনীর অফিসাররা সাক্ষী আর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা, সুতরাং পাঞ্জাবের কেউ মামলায় আসামিপক্ষকে সমর্থন করতে রাজি হলেন না। করাচির এ কে ব্রোহি সাহেব সরকারি পক্ষে। আকবর খানের স্ত্রী নাসিমা খান। শহীদ সাহেবকে ধরে পড়লেন। শহীদ সাহেবের বন্ধুরা তাকে ওই মামলার ব্রিফ গ্রহণ না করার জন্য অনুরােধ জানালেন। কিন্তু শহীদ সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। চিফ জাস্টিস আবদুর রশীদ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন।
জেরায় কতগুলাে কথা বের হলাে। প্রথমত, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন রেজিমেন্ট থেকে এসেছে, তাই সবার ওপর সুবিচার হচ্ছে না, হয়তাে হওয়াও সম্ভব নয়। কায়েদে আজমের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে কোনাে পরিকল্পনা ছিল না এবং লিয়াকত আলীকেই ওই ব্যাপারে সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছিলেন। লিয়াকত আলী সাহেবের ওই ব্যাপারে কোনাে অভিজ্ঞতা না থাকায় ডিফেন্স সেক্রেটারি ইস্কান্দার মির্জার কথামতােই কাজ করতেন। ফলে সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছিল। অনেক নিচের লােককে দ্রুত প্রমােশন দেওয়ায় তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে গিয়েছিল। অনেক অফিসারই মনে করতেন যে লিয়াকত আলী সরকার কোনাে সিদ্ধান্তই নিতে পারে না। কারণ তারা সব ব্যাপারেই অনভিজ্ঞ ।
আইয়ুব খান জেরার সময় প্রথম বলেছিলেন যে খাজা শাহাবুদ্দীন প্রথম খবর দেন প্রধানমন্ত্রীকে—কারণ, শাহাবুদ্দীন তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—পরে আবার যখন প্রশ্ন করা হলাে যে সরকারের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বেশি ‘এফিশিয়েন্ট’, না আর্মি
৩০৯
ইন্টেলিজেন্স’? উত্তর দিলেন যে আর্মি ইন্টেলিজেন্স’। শহীদ সাহেব বললেন, তাহলে তাে সর্বাগ্রে কমান্ডার-ইন-চিফের কাছেই প্রথম খবর আসা উচিত। আইয়ুব উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি খবরটা আগেই পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আরও ‘চেক’ করছিলেন। এমন সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গভর্নর চুন্দ্রীগড় খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন। জাস্টিস রশীদ তাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কিছুক্ষণ আগেই বলেছেন খাজা শাহাবুদ্দীন প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম খবর দিয়েছেন। আইয়ুব বিরক্ত হয়ে বললেন যে তাঁরা দুজনেই খবর দিয়েছেন—তবে কে আগে, কে পরে তা তার তখন ঠিক স্মরণ পড়ছে না। ওই অবস্থায় শহীদ সাহেব তাঁকে জিজ্ঞেস করেন যে যারা দ্রুত প্রমােশন পেয়েছে, তারাই ওই মামলাটি সাজিয়েছে—তাদের ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করার জন্য। আইয়ুব ওই প্রশ্নে তেলেবেগুনে খেপে গেলেন এবং জবাব দিতে অস্বীকার করলেন। জজ সাহেব বললেন যে ওটা আসামির সাজেশনে’ আপনি বলতে পারেন যে ওটা সত্যি নয়—কিন্তু আপনাকে হা’-‘না’ একটা কিছু বলতে হবে। আইয়ুব শুধু বললেন যে আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান, আমাকে এমন প্রশ্ন করা ধৃষ্টতা এবং রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। জজ সাহেব তাঁকে উকিলের কর্তব্য সম্বন্ধে বােঝাতে অনেক চেষ্টা করেও তাঁর কাছ থেকে জবাব পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেন না। আইয়ুব সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে নেমে এলেন এবং বাইরে চলে গেলেন।
পরবর্তীকালে আইয়ুব খান তাঁর পুস্তক FRIENDS NOT MASTERS-এ বলেছেন :
Suhrawardy was a complex character, a man who loved the gay life of night-clubs and had tremendous energy and drive. He took great delight in attacking the army officers who appeared as witnesses and I felt he far over-stepped the mark in his crossexamination. The Court, however, remained passive. There was nothing I could do about it at the time. The conspirators were convicted and sentenced. Some years later Suhrawardy and his supporters prevailed on the government to release them. That was the prerogative of the government and I could not object, but what I could not forgive was Suhrawardy’s unnecessarily harsh and undignified cross-examination of the army officers. তিনি তাঁর পুস্তকে এ ব্যাপারে আরও লিখেছেন :
The Rawalpindi conspiracy had deep roots; it grew in the soil of discontent and distrust and it was able to develop for several
৩১০
reasons. There was considerable unrest among the officers caused by a spate of swift promotions from junior to senior ranks. This raised expectations to unwarranted heights. Every officer felt that unless he was made Commander-in-Chief no one would believe that he had done well in life…
But I think the main reason for this discontent was that we had a government which failed to discharge its functions properly. When Akbar Khan’s papers were seized we found among them a thesis in which he had accused the Prime Minister and everybody else in the government of inefficiency and inability to give decisions. Akbar Khan’s aim was to establish a tidier form of government. He was a brave officer enjoying considerable prestige in the service, but ambitious and a very persuasive talker. He knew how to influence people and he had cast his net widely and unobtrusively.
ওপরের বিশ্লেষণ দেখে মনে হয়, আইয়ুব পাঁচ বছর পর ওই কাজটিই করেছেন—তবে তার আগে ইস্কান্দার মির্জাকে দিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক নেতাকে দেশের কাছে হেয়প্রতিপন্ন করে, তারপর ইস্কান্দার মির্জাকেই তিন সপ্তাহ পরে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পিন্ডিতে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা ঢাকায় এসেছিলেন এবং আমাদের অতিথি হয়েছিলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ককওয়ালিস আমাদের সে উপলক্ষে এক নৈশভােজের ব্যবস্থা করেন। ১৬ তারিখে আমাদের নৈশভােজে নিমন্ত্রণ ছিল চিফ সেক্রেটারি আজিজ আহমদের বাড়ি। ১৬ তারিখে বিটিইউসির নেতাদের নিয়ে আমরা দুপুরে লাঞ্চ খাই গ্রিন হােটেলে। পিন্ডির সংবাদ ঢাকায় তখনাে এসে পৌঁছায়নি। রাতে আজিজ আহমদ সাহেবের বাড়ির সম্মুখে দেখলাম সাইনবাের্ডে লেখা ‘ডিনার ক্যানসেলড’। আমরা তাে অবাক, তখন অতিথিদের নিয়ে আবার কোথায় যাই। একজন লােক এসে খবর দিল যে আজিজ আহমদ সাহেব গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর বাসায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুসংবাদ পেয়েই। কাল ভােরে তিনি ও মুখ্যমন্ত্রী চলে যাচ্ছেন করাচি। আজিজ আহমদের প্রাইভেট সেক্রেটারি বলে নিজের পরিচয় দিলেন। আমরা সবাই খবর শুনে খুব ‘শকড’ হলাম। পরে অতিথিদের নিয়ে হােটেলে এসে খাওয়াদাওয়ার পর আমরা বিদায় নিলাম দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে।
৩১১
পরের দিন কাগজে খব বেরােল। আমরা অবাক হলাম যখন খাজা। সাহেবের বিবৃতি দেখলাম। তিনি বলেছেন, ‘The Cabinet today has given me the onerous responsibility of being Pakistan’s Prime minister.’
লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আর তার মন্ত্রিসভার অস্তিত্ব ছিল । সুতরাং তারা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করতে পারেন না। খাজা সাহেবের উচিত ছিল মুসলিম লীগ পার্টির সভা ডেকে তাদের নেতা নির্বাচন করতে বলা এবং নির্বাচিত নেতাকেই মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলা-বড়জোর তিনি পুরােনাে মন্ত্রিসভার সদস্যদের ইতিমধ্যে কাজ চালিয়ে যেতে বলতে পারতেন। ফজলুর রহমান সাহেব ভাবলেন যে নাজিমুদ্দিনকে সম্মুখে রেখে তিনি রাষ্ট্র চালাবেন। পাঞ্জাবি সদস্যদের অমত ছিল না—কারণ পূর্ব বাংলা থেকে যখন প্রধানমন্ত্রী করতেই হবে, তখন তিনিই সবচেয়ে সােজা লােক—তা ছাড়া গােলাম মােহাম্মদ যখন গভর্নর জেনারেল হচ্ছেন। চৌধুরী মােহাম্মদ আলীও নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন এবং অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। কিছুদিন তিনি সেক্রেটারি জেনারেল ও অর্থমন্ত্রী দুটো পদই দখল করে রাখলেন পরে স্থির হলাে যে তার পরে আর কেউ সেক্রেটারি জেনারেল হবেন না।
১৯৫১ সালেই ইয়ুথ লীগ’ গঠিত হয়। তােয়াহা সাহেব প্রেসিডেন্ট ও অলি আহাদ সাহেব সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ইয়ুথ লীগ’ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একটি অঙ্গবিশেষ ছিল। বেশ কিছুসংখ্যক ছেলে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেউড়ি পার হয়ে গেছে অথচ রাজনৈতিক কারণে চাকরির আশা নেই, তার সবাই ওই সংস্থায় যােগ দিতে আরম্ভ করে। তা ছাড়া অলি আহাদ সাহেব নিজে তখন ভালাে কর্মী বলে সুপরিচিত ছিলেন।
আগস্ট মাসে সরকারি অফিসের কেরানি সম্প্রদায় ১৯৫১ সালে ইপিএফএলের বাইরে গিয়ে ইউনাইটেড কাউন্সিল অব অ্যাসােসিয়েশন্স অব সিভিল এমপ্লয়িজ অব পাকিস্তান (UCACEP) গঠন করেন। সরকারি কর্মচারীদের সর্বসুদ্ধ এগারােটি ইউনিয়ন ওই সংস্থায় যােগদান করে। তাদের আন্দোলনের ফলে বিশেষ বেতন কমিশন গঠিত হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২৩টি কনভেনশন সরকার গ্রহণ করেছিল—কিন্তু কনভেনশনের পরিপ্রেক্ষিতে কোনাে আইন করা হয়নি ১৯৫৯ পর্যন্ত। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য ৮৭ নম্বর কনভেনশন ও কনভেনশন নম্বর ৯৮। কনভেনশন নম্বর ৮৭-এ বলা হয়েছে :
Freedom of Association and Protection of the Right to organize. The Convention guarantees :
(a) The right of workers and employers to establish and join organizations of their own choosing.
৩১২
(b) The right of workers and employers organizations to draw up their own constitution and rules, select their representatives in full freedom and organize their activities.
(c) The proection of workers and employers organizations from dissolution and suspension by administrative authority.
(d) The right to establish and join federations and confederations and affiliate them with international organizations of workers and employers, and
(e) The protection of the free exercise of the right to organize.
কনভেনশন নম্বর ৯৮ নিম্নরূপ :
Workers shall enjoy adequate protection against acts of antiunion discrimination in respect of their employment. Workers and Employers Organizations shall enjoy adequate protection against interference by each other in their establishment, functioning or administration. Machinery shall be established, when necessary, for the purpose of ensuring respect for the right to organize. The convention does not deal with the positions of public servants and the extent to which its provisions shall apply to the armed forces and the police shall be determined by national regulations.
শ্রমিকনেতাদের জন্য উপরিউক্ত দুটো কনভেনশন শ্রমিক আন্দোলন এগিয়ে নিতে আমাদের দেশে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরের আগপর্যন্ত শ্রমিকদের পক্ষে তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরার জন্য অনেক খড়কুটো পােড়াতে হয়েছে। ৮৭ নম্বর কনভেনশনে আমাদের অধিকার দেওয়া হয়েছিল সংগঠন করার আর ৯৮ নম্বর কনভেনশনে আমরা পেয়েছিলাম যৌথ দর-কষাকষির ক্ষমতা। শ্রমিকদের শােষণ ও শাসনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ছিল এক ভয়ানক বিপদ।
একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ঢাকার টেলিগ্রাফ কর্মচারীদের পক্ষে অনেক আবেদন-নিবেদন করেও তাদের বেঁচে থাকার মতাে বেতন ও অন্যান্য সুযােগ পাওয়া সম্ভব হলাে না। তখন তারা স্থির করল যে কাজের দ্রুততা কমিয়ে দেবে—কারণ তাদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই আগের মতাে পরিশ্রম করা সম্ভব ছিল না। যােগাযােগ বিভাগ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল—নেতৃস্থানীয় যারা, যেমন তাদের সেক্রেটারি এ আর সুন্নামত সাহেব ও অন্যান্য ইউনিয়ন সদস্যদের বিরুদ্ধে
৩১৩
চার্জশিট দেওয়া হলাে, কেন তাদের ‘গাে-স্লো’ অভিযােগে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না কারণ দেখাতে বলা হলাে— সঙ্গে সঙ্গে তাদের ‘সাসপেন্ড করা হলাে। এখানেই শেষ নয়, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের অভিযােগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে স্পেশাল ফি দিয়ে ঢাকার সেরা ফৌজদারি উকিল রেজাই করিম সাহেবকে নিযুক্ত করল। মামলা সেশনে এল । গােলাম মাওলা সাহেবের কোর্টে মামলা এল বিচারের জন্য। আমি ইউনিয়নের পক্ষ সমর্থন করি। দায়রা মামলা পঁয়তাল্লিশ দিন ধরে চলেছিল। আমার ওকালতি জীবনে ওটাই আমার দীর্ঘতম ফৌজদারি মামলা। শাহ আজিজুর রহমান সাহেব তখন সবে আইন ব্যবসায় যােগদান করেছেন—তাকে রাখা হলাে আমার সহকারী হিসেবে। রেজাই করিম সাহেব ইচ্ছে করেই মামলা দীর্ঘতর করেছিলেন—যাতে পয়সার অভাবে ওরা আমার ফিস না দিতে পারে এবং আমি মামলা চালাতে অস্বীকার করি। একটা জিনিস সরকার বুঝতে পারেনি—ওকালতি ছাড়াও শ্রমিকনেতা হিসেবে আমার একটা কর্তব্য ছিল তাদের প্রতি। পঁয়তাল্লিশ দিন পরে আমাদের ছওয়াল-জওয়াব শেষ হওয়ার পরে জজ সাহেব জুরিদের দুদিন ধরে মামলার বিষয়বস্তু এবং আইনের ধারাগুলাে বুঝিয়ে দিলেন—জুরি নিজেদের মধ্যে আলােচনা করার জন্য পাশের ঘরে ঘণ্টাখানেক পরে এসে মত দিলেন যে আসামিরা নির্দোষ । সরকার এরপরে হাইকোর্টে গেল—আমি উপস্থিত ছিলাম দেখতে কী হয় । হাইকোর্টে আপিল গৃহীত হলাে না। সুতরাং আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। রাজনৈতিক মামলাগুলােও অমনি দীর্ঘদিন চালানাের চেষ্টা চালাত সরকার । আমার অমনি একটি মামলা করা এ প্রসঙ্গে মনে আসছে। তাজউদ্দীন সাহেব ফকির আবদুল মান্নান সাহেবের নির্বাচন কেন্দ্রে তখন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। হঠাৎ একদিন তাঁর বিরুদ্ধে ফরেস্ট অফিসারের বাড়িতে ডাকাতি করার অভিযােগে অভিযুক্ত করে। সে মামলায় আতাউর রহমান সাহেব ও আমি স্থির করি যে মামলা যাতে সেশনে না যায় তার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কমিটিং কোর্টেই পূর্ণ জেরা করা হবে। হলােও তাই-কয়েক সপ্তাহ এবং কয়েক তারিখে মামলা শুনানির পর তাজউদ্দীন সাহেব বেকসুর খালাস হয়ে। গেলেন। পাকিস্তান হওয়ার পরপরই সরকারের হুকুমে শ্রমিকনেতাদের ও বিরােধী দলের কর্মীদের পুলিশ কেবল জেলেই নিয়ে যায়নি, হাজার রকমের হয়রানি করেছে।
শ্রমিকনেতাদের প্রথম কাজ ছিল মালিকদের সমকক্ষতার ভিত্তিতে দাবিসমূহের ওপর আলােচনা করা। এরই জন্য আমরা বছরের পর বছর ধরে পরিশ্রম করেছি। রেলওয়েতে ধর্মঘট করে অনেক ইউনিয়ন সদস্য তাদের চাকরি হারিয়েছে। ১৯৬৮ সালে অবশ্যই অবস্থা সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হয়ে
৩১৪
গেল। আমার চিরকালই এ ধারণা ছিল এবং আজও আছে যে মেহেনতি মানুষ একদিন তাদের ভাগ্যনিয়ন্তা হবে। এ না হয়ে পারে না। কারণ, মেহেনতি মানুষই দেশের মেরুদণ্ড। তবে সেদিন যত দিন না আসে, তত দিন আমাদের তাদের আসার পথে যত বাধাবিঘ্ন আছে, তা দূর করতে হবে। অভিজাতদের সরিয়ে দিলেই পথ পরিষ্কার হবে না—তাদের পরে আসবে উচ্চ মধ্যবিত্ত, আবার উচ্চমধ্যবিত্তের স্থান দখল করবে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত । প্রত্যেক ধাপেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে—যত দিনে না বিত্তহীন কৃষক-শ্রমিকদের ভাগ্য তারা নিজেরাই গড়ে তুলতে পারে। সেটা কি ইতিহাসের ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়েই হবে, না বিপ্লবের মধ্য দিয়ে হবে, তা আমার জানা নেই। হয়তাে জীবনসায়াহ্নে আমি তা দেখেও যাব না। আমার কাজ শুধু তাদের আগমনটাকে যতটা সম্ভব সহজ করে রাখা। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ববঙ্গে এসেই তাঁর সততা ও সাধুতার খােলস খুলে ফেললেন। ২৬ জানুয়ারি তারিখে পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগ আয়ােজিত এক জনসভায় পরিষ্কার ঘােষণা করলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ ১৯৪৮ সালে এই খাজা নাজিমুদ্দিন ওয়াদা করেছিলেন যে বাংলা ও উর্দু দুটো ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য পরিষদ থেকে গণপরিষদে প্রস্তাব পাঠাবেন।
ওই বক্তৃতার পরই শহরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। মওলানা আবদুল হামিদ খান সাহেব ঢাকা মােক্তার লাইব্রেরিতে মুসলিম লীগ ছাড়া সব পার্টিকে, সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে, সব ট্রেড ইউনিয়নকে ডেকে পাঠালেন। ঢাকায় যে কত রকম সংঘ ছিল, সেদিন আমি দেখেছিলাম। ১৯৫২ সাল ১৯৪৮ সাল নয়। এবার আর হিন্দু কে, কমিউনিস্ট কে, কংগ্রেসকে—এ নিয়ে কথা উঠল না। এবারে সব বাঙালি যেন এক হয়ে দাঁড়াল। এবার আর আহসান মঞ্জিল বা তাদের খয়ের খাঁ উচ্চমধ্যবিত্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়—এবারকার আন্দোলন বাংলার সব স্তরের সমুদয় মানুষের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এবারের সংগ্রামের কোনাে প্রস্তুতিপর্ব নেই, দীর্ঘদিন ধরে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার প্রয়ােজন নেই। এবারকার সংগ্রাম যেন আগুনের শিখার মতাে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। সভায় মওলানা ভাসানী বক্তৃতা করলেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে এক একজন প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক বসবে ১৫০ নম্বর মােগলটুলী অফিসে ৭ ফেব্রুয়ারি। সে সভায় কমিটি অব অ্যাকশনের কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হবে বলে ঘােষণা করেন মওলানা সাহেব। ওটাই আমারও ইচ্ছে ছিল—কারণ শ তিনেক লােকের মধ্যে কোনাে আন্দোলনের ব্যাপার নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলােচনা করা বােকামি। মওলানা সাহেব এমনই কঠোর ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। ৭ তারিখে মওলানা
৩১৫
ভাসানীকে সভাপতি, কে জি মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ছােট একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন খেলাফতে রব্বানী পার্টির আবুল হাশিম সাহেব, আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে সভাপতি ছাড়া এলেন শামসুল হক সাহেব ও আতাউর রহমান খান সাহেব, যুবলীগের মােহাম্মদ তােয়াহা ও অলি আহাদ সাহেব, ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমি আর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন—তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য মতিন, কে জি মুস্তাফা প্রমুখ। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষে কে জি মাহবুব ছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, মােল্লা জালালউদ্দিন। প্রস্তাব গ্রহণ করা হলাে যে ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হবে। তার জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য কর্মীদের ওপর নির্দেশ দেওয়া হলাে।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব তার নিজস্ব সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে দীর্ঘদিন ধরে কারাজীবন যাপন করছিলেন। তাই আমাদের সংবিধান-সংক্রান্ত আন্দোলনে বা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে পাইনি। তবে তাঁর পরােক্ষ প্রভাব আমরা অনুভব করেছি।
আবুল হাশিম সাহেব বর্ধমান থেকে আসার পর আমার মনে হলাে যে ভারতে দুই বছর বাস করে এবং তিনি নিজে সর্বহারা হয়ে তার মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তাধারার অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। তিনি আল্লামা আজাদ সােবহানীর আদর্শে আরও উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তাঁর মধ্যে যে মার্ক্সীয় প্রভাব ছিল ১৯৪৪-৪৬ সালে, তা আর তার মধ্যে নেই—তবে প্রগতিবাদী রয়ে গেছেন। ঢাকা এসে তমদুন মজলিসের কর্মীদের সঙ্গে আলােচনা করে নতুন পার্টি গঠন করেন। পার্টির নাম দেন ‘খেলাফতে রব্বানী’ পার্টি। আমার সঙ্গে কয়েক দিন আলাপ হয়েছিল, কিন্তু আমি তার মত ও আদর্শ গ্রহণ করতে পারিনি। অবশ্যই এতে তিনি বেশ দুঃখ পেয়েছিলেন। বর্ধমান তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়ার পর স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের হাত ধরে যখন ভিন্ন দেশের পথে যাত্রা করলেন, তখন তিনি প্রগতিবাদী হিন্দু সমাজ ও সাম্যবাদীদের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। অথচ সে অবস্থায় তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বদরুদ্দীন উমরের ওপর সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। বদরুদ্দীন উমর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ভারতে ও পাকিস্তানে যা কিছু ঘটেছে, ১৯৪৬ সালের পর থেকে, তার জন্য দায়ী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প এবং ছাত্রজীবন শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করলেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে। তাঁর প্রথম পুস্তক ছিল সাম্প্রদায়িকতা, বইটি কি ভারত কি পাকিস্তান দুদেশেই আদৃত হয়েছিল; কিন্তু পাকিস্তান সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে দেয়। রাজনীতিতে সে বামপন্থী। তার
৩১৬
সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাসমূহের বিশ্লেষণের জন্য সমাজে সমাদৃত। রবীন্দ্রনাথের গান পাকিস্তান সরকার যখন এ দেশে বন্ধ করে দিল, তখন কিন্তু পিতা-পুত্র একই সভায় তার বিরােধিতা করেছেন। তেমনি ভাষা আন্দোলনেও দুজনার বাংলা ভাষার প্রতি সমান সমর্থন ছিল।
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগঠনের নেতৃত্বে বৃদ্ধ। মওলানা ভাসানীকে বাদ দিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকল শামসুল হক সাহেব ও শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের মধ্যে। দুজনেই কর্মজীবনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দুজনেরই বাংলাদেশের কর্মীদের ওপর প্রভাব ছিল বিস্তর। দুজনেই নির্যাতিত হয়েছেন মুসলিম লীগ সরকারের শাসনামলে। শামসুল হকের পরাজিত হওয়ার পেছনে আমার মতে দুটি কারণ—একটি বাস্তব রাজনীতিতে আধ্যাত্মিকভাবে সংমিশ্রণ। অপরটি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের আদর্শের ও কাজের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পূর্ণ সহযােগিতার অভাব।
অন্যদিকে শেখ সাহেবের স্ত্রী পরম ধৈর্যশীলা এবং শেখ সাহেবের রাজনীতির প্রতি পূর্ণ অস্থাশীল ছিলেন। শামসুল হক সাহেব স্ত্রীকে অনুপ্রাণিত করতে পরেননি, কারণ বােধ হয় শামসুল হকের স্ত্রী আফিয়া খাতুন ভালাে ছাত্রী, ভালাে চাকুরে আর শামসুল হককে বিয়ে করেছিলেন শামসুল হক। পরিষদ সদস্য হওয়ার পর। অন্যদিকে শেখ সাহেবের স্ত্রী বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তাঁর স্বামীর জীবনধারার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে নিতে পেরেছিলেন। কারণ বিয়ে হয়েছিল শেখ সাহেবের সঙ্গে যখন তিনি ছােট বালিকা। তাই বাল্যে, কৈশােরে এবং যৌবনে স্বামীর সব কাজের সঙ্গে নিজেকে অংশীদার করে ফেলেছিলেন। তাই শামসুল হক জেলে গেলে আফিয়া খাতুন তাঁকে ছাড়িয়ে আনার জন্য নূরুল আমীনকে ‘বন্ড’ দিতে দ্বিধা করেননি। অন্যদিকে শেখ সাহেবের স্ত্রী শেখ সাহেবের জেলে যাওয়া, নির্যাতিত হওয়া এবং জীবন বিপন্ন করাকে তার কর্মসূচির অন্তর্গত বলে গ্রহণ করে কোনাে দিন ভেঙে পড়েননি। আফিয়া খাতুন চাইতেন শামসুল হক সাহেব উকিল হবেন। হাজারখানেক টাকার আইনের বইও তার জন্য ক্রয় করে ফেলেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন আফিয়া খাতুন এবং পরে প্রফেসর সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন, জেলের কয়েদির সঙ্গে জীবন কাটানাের জন্য নয়।
শামসুল হক সাহেব দীর্ঘকাল কারাবাসের পর ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে কারাগার থেকে মুক্তি পান। দুমাস বিশ্রাম নেওয়ার সময়ও পেলেন না। এল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। শামসুল হক সাহেব আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। সুতরাং ইচ্ছা করলেই তিনি পিছিয়ে থাকতে পারেন না—যেখান থেকেই ডাক এসেছে আওয়ামী মুসলিম লীগের
৩১৭
সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর তরফ থেকে। অবশ্যই ওই ডাক দিয়ে ৭ জানুয়ারির পর মওলানা সাহেব তার গ্রামে চলে যান।
১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ৯৮ নং নবাবপুর সড়কে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রাদেশিক অফিসে কমিটি অব অ্যাকশনের শেষ সভায় জনাব আবুল হাশিম সাহেব সভাপতিত্ব করেছিলেন। অন্যান্য আলােচনার পর স্থির হয় যে আন্দোলন আইন মােতাবেক চালানাে হবে। আইন অমান্য করা হবে না। যদি আইন অমান্য করা হয়, তবে কমিটি আপনা থেকেই ভেঙে যাবে। ওই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন যুবলীগের অলি আহাদ সাহেব। মওলানা সাহেব। অনুপস্থিত, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব কারারুদ্ধ—শামসুল হক সাহেব পরিশ্রান্ত—জীবনযুদ্ধে আর সম্মুখ সারিতে থেকে লড়াই করার আকাঙ্ক্ষা নিস্তেজ হয়ে গেছে—তার ওপর তার স্ত্রীর অসহযােগ এবং প্রথম কন্যা শাহীন তাকে পেছন থেকে টানছে। দ্বিতীয় কন্যা সাকু সবে জন্মগ্রহণ করেছে। ওই অবস্থায় তাঁর কাছে সংগ্রামী নেতৃত্ব আশা করা বাতুলতা। আবুল হাশিম সাহেবের খেলাফতে রব্বানী পার্টি তখনাে সংগঠিত হয়নি—তা ছাড়া তিনি। তখন সর্বহারা। সুতরাং প্রস্তাবের পক্ষেই বেশি ভােট। যুবলীগ সভা ত্যাগ করল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংবাদ পৌছালে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কমিটি অব অ্যাকশনের প্রস্তাবের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করল। তারা নিজেরা সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করল। কমিটি অব অ্যাকশনের সদস্য বা পরিস্থিতির ওপর চোখ রাখার জন্য সবাই আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে জমায়েত হলাে এবং সকাল নয়টায় অলি আহাদ সাহেব এসে খবর দিলেন যে কয়েকজন পিকেটারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র কর্মীদের সভা ডাকা হয়েছে। স্থির হলাে শামসুল হক সাহেব, আজিজ আহমদ ও কে জি মাহবুব সাহেব যাবেন ছাত্রদের সভায় এবং সেখানে কমিটি অব অ্যাকশনের প্রস্তাবের সমর্থনে যুক্তি উপস্থিত করবেন। তারা গেলেন সেখানে, কিন্তু তারা মুখ খুলতে পারেননি ছাত্ররা তখন উত্তেজিত বলে। যুবলীগ ও নতুন করে গঠিত ছাত্র ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই ছাত্রদের নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে এবং তারা স্লোগান দিচ্ছেন ১৪৪ ধারা মানব না—চল, চল পরিষদ ভবনে। সর্বস্তরের ছাত্ররা একত্র হয়েছে—মেয়েরাও এবার এগিয়ে এসেছে। দশজন করে এক এক ব্যাচ ছাত্রছাত্রী আইন অমান্য করে পরিষদ ভবনের দিকে যাত্রা করে আর পুলিশ তাদের ধরে পুলিশ-ট্রাকে তােলে-তাদের বেশির ভাগকেই কুর্মিটোলা বা টঙ্গীতে ফেলে আসে। আবার কাউকে কাউকে জেলে আটক করে। এমনি করে বেলা একটার সময় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে টিয়ার গ্যাস ছাড়া হলাে। টিয়ার গ্যাসের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ঢিল ও ইট ছােড়া শুরু হলাে পুলিশের প্রতি। পুলিশও তখন ক্লান্ত, অধৈর্য। তাই টিয়ার গ্যাসে কাজ না হওয়ায়
৩১৮
পুলিশ সুপার ইদ্রিস সাহেব গুলি চালানাের হুকুম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকধারী পুলিশ পজিশন নিল। তারপর কয়েক রাউন্ড গুলি বেরিয়ে গেল। কতজন মারা গেল! কতজন মারা গেল, তা নিয়ে অনেক প্রকার সংবাদ শহরে পৌছাতে লাগল। কমিটির সদস্যরা ফজলুল হক সাহেবের বাড়িতে নতুন পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য উপস্থিত হলেন। সেখানে খবর এসে পৌছাল যে বদরুদ্দীন উমর গুলিতে আহত বা নিহত হয়েছে। গাড়িঘােড়া বা রিকশা কিছুই চলছে না। আবুল হাশিম সাহেবকে একটি লােক সাইকেলের সামনে বসিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমি গেলাম হাসপাতালে সব খবর সংগ্রহ করতে। তারপর বিকেলে আবার ফজলুল হক সাহেবের বাসায়। গেলাম—পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের কী করণীয় তাই স্থির করতে। ‘কমিটি অব অ্যাকশন’ আর নেই। সুতরাং স্থির হলাে যে, ‘সিভিল লিবার্টিজ লীগ’কে ‘সিভিল লিবার্টিজ কো-অর্ডিনেশন কমিটিতে পরিবর্তিত করে আমরা আইনের সাহায্যে যতটা ছেলেদের সাহায্য করতে পারি ততটাই করব। আর্মড ফোর্সের সাহায্য চাওয়া হলাে—তারা হলগুলােকে ঘেরাও করলেন এবং ধীরে ধীরে আই জি জাকির হােসেন, ডিআইজি হাফিজুদ্দীন, পুলিশ সুপার ইদ্রিস ও শহর সুপার মাসুদের পরিচালনায় ছাত্রদের মাইক ছিনিয়ে নিলেন—অনেক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করলেন। শামসুল হক, কে জি মাহবুব বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হওয়ার পরেই পলাতক হলেন। যুবলীগের নেতা সর্বজনাব মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, মাহবুব জামাল জাহেদী ও অন্য কয়েকজন পুরানা পল্টনের এক বাড়ি থেকে ধরা পড়েন। তবু একটা কমিটি দাঁড় করিয়ে রাখা হলাে আতাউর রহমান খান সাহেবকে ‘কনভেনর’ করে। ১৯৪৮ সালের মতাে সরকার এবার পরাভব স্বীকার করল না। তার ফলে কোনাে সমঝােতা হলাে না। কোনাে আলােচনাই হলাে না। ছাত্ররা শহীদ মিনার তৈরি হতে লাগল আর পুলিশ তাই ভাঙতে লাগল। আন্দোলন ক্রমাগত বামপন্থীদের হাতে চলে গেল। সরকারের বর্বরতার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা সােচ্চার হয়ে উঠল। কবিতা, লেখা, নাটক একুশকে রূপ দিল ধর্মনিরপেক্ষভাবে। প্রতিবাদ যখন বিফল হলাে প্রতিরােধ আরও জোরদার হলাে—বাংলার বুদ্ধিজীবীরা সৃজনশীলতার ভেতর দিয়ে তাদের বাঙালিত্ব ফিরে পেল—আন্দোলনের বিফলতার মধ্য দিয়েই আত্ম-আবিষ্কারের পথ পেল বাঙালি জাতি হিসেবে—এবার আর মুসলিম হিসেবে নয়—এ যেন একটি নতুন চেতনা। বাংলার মাটি, বাংলার নদী, বাংলার প্রকৃতি বাঙালিকে আকৃষ্ট করল । ভুলে গেল তারা পশ্চিমে আজ খুলিয়াছে দ্বার/ সেথা হতে সবে আনে উপহার। এখন থেকে যে সংস্কৃতির সৃষ্টি হলাে, তা বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালি কৃষ্টি। পাকিস্তান ধ্বংসের বীজ দেশের প্রতিটি গ্রামে বপন করা হয়ে গেল।
৩১৯
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। খাজা নাজিমুদ্দিন কপালে জয়টীকা নিয়ে করাচি ফিরে গেলেন বাংলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে—বােঝেননি তখন হনুমানের লেজের আগুন এবার সােনার লঙ্কা পুড়িয়ে শেষ করবে।
নাজিমুদ্দিনের পতনের ওই প্রথম ধাপের পরে এল দেশে খাদ্যাভাব। পাকিস্তানে তার নাম দেওয়া হলাে কায়েদে কিল্লাত’। তার ওপর কোরিয়ার যুদ্ধ সাময়িকভাবে শেষ হলাে, ফলে পাটের দাম পড়ে গেল, তার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে এল।
কমনওয়েলথের প্রধান ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসন আরােহণ করলেন।
পাঞ্জাবে কাদিয়ানি ও সুন্নি মুসলমানের মধ্যে তিক্ততা ক্রমেই বাড়তে লাগল। এর পেছনে ছিল পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মােমতাজ দৌলতানার নেতৃত্বের খেলা। স্যার জাফরুল্লাহকে তিনি কোনােকালেই সহ্য করতে পারতেন না। সে নেতৃত্বের কোন্দল এসে দাঁড়াল কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবি সুন্নি মুসলমানদের উত্তেজিত করা। আবার ওই পরিস্থিতির সুযােগ নিলেন জামাতে ইসলামের মওলানা মওদুদী। ফলে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। সেনাবাহিনী পাঠানাে হলাে জেনারেল আজমের নেতৃত্বে। মার্শাল ল জারি করা হলাে লাহােরে। পাকিস্তানের সর্বত্র হতাশা দেখা দিল।
১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ভাষা আন্দোলন। নিয়ে খুব তর্ক হচ্ছিল। বন্ধুর ধারণা, বাংলা ভাষা আন্দোলনে সবাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যােগদান করেনি। তারা এসেছে ওই সুযােগে পাকিস্তানকে ভাঙার ব্যবস্থা করতে, আবার কেউ এসেছে সমস্ত ভারতকে এক করে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। প্রথম দলে আছে কংগ্রেসের নেতারা, দ্বিতীয়টিতে আছে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। তারা একদিন। সােভিয়েত সােশ্যালিস্ট রাষ্ট্রের আদর্শে ভারতীয় উপমহাদেশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র করার পক্ষপাতী। আর এক দল আছে, যারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। আমি বললাম আমার কথা হচ্ছে কে কী উদ্দেশ্যে যােগ দিয়েছে, সেটা বড় কথা নয়—দাবিটা যুক্তিযুক্ত কি না, সেটাই হচ্ছে আমাদের বিচার্য বিষয়।
আমরা যখন আলােচনায় ব্যস্ত, সে তখন ডাকল, সিনথিয়া, ঘরে চা দেবে । তার স্ত্রী ট্রের ওপর কিছু খাবার ও চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। মুসলমান মেয়ের নাম সিনথিয়া’—কেমন করে হলাে! আদাব দিয়ে দাঁড়ালাম। বললেন, ‘বসুন। বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এই আমার ‘Joy forever’. আমি ওকে “জয়” বলেও ডাকি।’ কেমন যেন একটা গােলমালে পড়ে গেলাম। তাহলে এসব বানানাে নাম। আসল নামটা তাে জানা হলাে না—আর ঠিক ওই প্রশ্নটা করাও
৩২০
সমীচীন মনে করলাম না। ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, আপনি আমাকে “জয়” বলেই ডাকলেন। বন্ধু বললেন, আপনার সঙ্গে মিলবে ভালােবাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন। তারপর জয়কে বললেন, এবার তােমার লেখা শােনানাের একটা লােক জোগাড় হলাে—সপ্তাহে সপ্তাহে ওকে চায়ের নিমন্ত্রণ করবে, অবশ্যই শনিবার সন্ধ্যায়, নইলে আসতে পারবে না। কারণ অন্য সব সন্ধ্যা মক্কেলের কাছে বাধা। জয় বলল, ‘আসবেন কিন্তু আগামী শনিবার সন্ধ্যায়।’ বললাম, আসব।’ জিজ্ঞেস করলাম, কী লিখছেন এখন। বলল, হার্ডির টেস অব দ্য ডারবারভাইলস-এর অনুবাদ করছি—আপনাকে শনিবার খানিকটা শােনাব—কেমন হচ্ছে বলতে হবে কিন্তু।’ আমি দু-একটি কথা বলে বিদায় হলাম। ১৯৩৫-৩৬ সালের পরে আর সাহিত্যচর্চা করা হয়নি। লেখাপড়া যা করেছিলাম ছাত্র হিসেবে, তারপর আর নতুন কোনাে বই পড়িনি—ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস কোনাে বিষয় আর পড়া হয়নি। চার-পাঁচ বছর যখন শিক্ষকতা করেছি, তখনাে নতুন কিছু পড়া হয়নি—যে জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জন করেছিলাম, তাই যথেষ্ট ছিল ছাত্রদের জন্য। তারপর ১৯৪৪ থেকে একটানা ১৯৫৩–খবরের কাগজও সবটা পড়া হয়নি। আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয় যে বই পড়ার কথাটা একেবারেই মনে আসে না। রাজনীতির বেশির ভাগ কাজই অনর্থক। কর্মীরা যেকোনাে সময় আসতে পারে—সে ঘুম থেকে ওঠার আগেই হােক আর দুপুর রাতেই হােক। বিশ্রাম নেই, চিন্তা করার অবসর নেই। যেসব সংবাদ কর্মীরা দিয়ে যায়, তারই ওপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে যাই। ফলে মানবতাবােধ ক্রমাগতই অন্তর থেকে কমে যেতে থাকে। অন্য রকম ভাবনা—আমাদের সহ্য করার কথা নয়। এ জন্যই যারা যত বড় রাজনৈতিক নেতা, তারা ততই ‘ইনটেলেকচুয়াল’দের ওপর বিরক্ত। ফজলুল হক সাহেব বলতেন, ‘যারা খবরের কাগজ পড়ে, তাদের ভােট আমি চাই না। কারণ তারা কোনাে দিনই আমাকে ভােট দেয়নি। কি জিন্নাহ, কি হক সাহেব, কি শহীদ সাহেব—কাউকে আমি ‘ইনটেলেকচুয়াল’দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে দেখিনি। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ যেদিন আমাদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ দান করেন, সেদিন বলেছিলেন, I am a man of strong common sense and I belive in common sense alone.’
সুতরাং যে চিন্তাধারা একটু ‘Uncommon’, সেটা তার কাছে পরিত্যাজ্য। এর কারণ বােধ হয় রাজনীতিবিদেরা বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত, বর্তমানই তার কাছে বাস্তব–বর্তমান বলতে বড়জোর পরের পাঁচ বছর। ইনটেলেকচুয়ালরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন—বর্তমান তাদের কাছে সাময়িক’– Temporary Phase’, রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতায় গিয়ে তাদের কর্মসূচি অনুসারে কাজ
৩২১
করতে চান—যা বলেন তা কার্যকর করার দায়িত্ব তাদের। অন্যদিকে ইনটেলেকচুয়াল’রা স্বপ্নবাদী হতে পারেন, কারণ তারা ক্ষমতায় যাবেন না বলে তাদের সে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব তাঁদের ওপর যেহেতু বর্তাবে
, সে জন্য তারা দায়িত্বহীন কথাও বলতে পারেন। রাজনীতিবিদেরাও দায়িত্বহীন কথা বলেন, বিশেষ করে নির্বাচনের সময়—সেটা ক্ষমতায় পৌছার জন্য। তবে সেটা মারাত্মক হয় না। কারণ সবাই জানে নির্বাচনে যা বলা হয়—তা নিতান্তই বক্তৃতাকে মানুষের মনে দাগ কাটাবার জন্য—অর্থাৎ জনগণের সমর্থন লাভের জন্য। জনগণও সেটা জানে—তাই তারাও ওই সব কথা ভুলে যায়—কতকটা ক্ষমার চোখে দেখে। কিন্তু ইনটেলেকচুয়ালরা নির্বাচনকালীন ‘ওয়াদা’কে এত পবিত্র মনে করে যে তারা রাজনীতিবিদদের কথা ও কাজের মধ্যে কোনাে মিল দেখতে পান না। ফলে ‘ইনটেলেকচুয়াল’দের কাছে রাজনীতিবিদেরা অভিনয় মঞ্চের অভিনেতা। তাদের কথার মূল্য ওই মঞ্চেই সত্যি হয়ে থাকে।
আমিও ছােটখাটো রাজনীতিবিদ, সুতরাং ‘জয়ের সঙ্গে পরিচয়ে আমার ভেতরে কী প্রতিক্রিয়া হবে তা স্থির করতে পারলাম না। সুতরাং যাব কি যাব না কয়েক দিন ভাবলাম—কিন্তু শনিবার দিন সত্যিই তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হলাম। জিজ্ঞেস করলেন আমি ‘টেস’ পড়েছি কি না। উত্তরে বললাম, না। একমাত্র হার্ডির ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড ছাড়া আর কোনাে লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। তিনি তাে শুনে খুব খুশি, বললেন, ভালােই হলাে। অনুবাদ পড়ার আগেই বইটাই পড়া যাক। পাশেই একটা চেয়ার টেনে পড়তে বসলেন। চাকর এসে চা দিয়ে গেল। আমি চা খেলাম, কিন্তু তাঁর চা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি সাহিত্যিক নই। তাই কিছুক্ষণ শােনার পরে আমার অসােয়াস্তি লাগছিল। ধরে ফেললেন তিনি মনের অবস্থা। হঠাৎ কবিতার বই খুলে পড়তে লাগলেন কিটসের ‘এন্ডিসিয়ন’। ছন্দটা শুনলাম। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের কথা মনে আসতে লাগল। সে কী জীবন ছিল—আর আজ কী জীবন! খুব যে ভালাে লাগছিল তা নয়। তবু ওঠার সময় বললাম, “I enjoyed the evening so much.’ বললেন, শনিবার আবার আসবেন। কিন্তু।’ বললাম, আপনার হাতের পাক এত ভালাে যে না এসে কি পারব? তিনি খুব খুশি হলেন না। বললেন, আমি আপনার মুখের স্বাদ নিয়ে ব্যস্ত নই, আমি চাই আপনার শ্রবণ-ইন্দ্রিয়কে সজাগ করতে, যাতে কানের ভেতর আমার পড়া আপনার অন্তরে গিয়ে পৌছে। বাইরে এসে ভাবলাম, কথাটা আমার ঠিক হয়নি। মেয়েরা পাকের প্রশংসা শুনতে ভালােবাসে, তাই জানা ছিল এত দিন। এখন দেখলাম সেটা সব মেয়ের জন্য সত্য নয়। পরের সপ্তাহে ‘বনলতা সেন’ কবিতাটা পড়ছিলেন। সত্যি বলতে ছন্দ যেন আমার
৩২২
ভালাে লাগল না। আমার মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পেরে আবার পড়ে চললেন—এবার যেন ভালাে লাগল। তৃতীয়বারে কবিতাটা আমার মনে একটা অপূর্ব ছবির সৃষ্টি করল। বুঝলাম কবিতা বােঝার জন্য কানের ‘ট্রেনিং’-এর প্রয়ােজন আছে। নভেম্বর থেকে ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে শনিবার সন্ধ্যায় সেখানে গেছি অনেক সময়—অনেক কাজ ফেলেও। রাজনৈতিক জীবন যেন বৃথা সময়ের অপচয় বলে মনে হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জয়’ বা ‘সিনথিয়া বিদেশে চলে যান, কিন্তু ইতিমধ্যেই জয় ‘ইনটেলেকচুয়াল কম্পেনি’ হিসেবে আমার অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি—কিন্তু প্রায় দশ বছর প্রতি সপ্তাহে চিঠিপত্র লেখা চলেছিল। ধীরে ধীরে কমে গেছে—পরে থেমে গেছে।
তার যাওয়ার দুপ্তাহ আগেই আমাকে করাচি যেতে হয়েছিল ত্রিদলীয় শ্রমিক সম্মেলনে যােগদানের জন্য। সেখানে গিয়ে জানলাম আমাকে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে কিউবার রাজধানী হাভানায় যেতে হবে আইএলওর ‘প্ল্যান্টেশন কমিটির সভায় চা-বাগানের শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে আলােচনা করার জন্য।
১৯৫৩ সালের ১০ মার্চ হাভানা রওনা হলাম। তখনকার দিনে বােয়িং বিমান হয়নি। সুতরাং আমাদের থামতে হয়েছে বিস্তর দেশের রাজধানী শহরে। করাচি পর্যন্ত গেলাম ‘ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজে’, বিমান থামল কলকাতা ঘণ্টাকয়েকের জন্য, আবার থামল দিল্লি, শেষ পর্যন্ত করাচি। যেদিন গেলাম, সেদিনই খতিব সাহেব এসে বললেন, ভালাে হয়েছে আপনি এসে গেছেন—আজ রাতেই ওয়েস্ট পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার অ্যানুরিন বিভানকে নৈশভােজে আপ্যায়িত করছে। বিচ লাক্সারি’ হােটেলে সন্ধ্যায় গাড়ি এসে আমাকে হােটেল মেট্রোপােল’ নিয়ে গেল। ইস্ট পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবারের সভাপতি বলে আমাকে বিভানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অনেক আলােচনার পরে বিভান আমাকে বললেন, ফেরার পথে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে যেন দেখা করি। বাড়ির ঠিকানা দিলেন। টেলিফোন নম্বরও।
ঢাকা ছাড়ার আগের দিন বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। পাসপাের্ট চাই—বিদেশে যাবেন চিকিৎসার জন্য। আমি যদি কিছু সাহায্য করতে পারি। পাসপাের্ট অফিসারকে বলেছিলাম কিন্তু এটা জানতাম না যে সেটাই বুলবুলের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ। মুসলমান সমাজে মেয়েদের গজল ছেড়ে গানের আসরে স্থান হয়েছিল কিছুদিন আগে, কিন্তু নৃত্যশিল্পে মুসলমান সমাজ বহুকাল পেছনে পড়ে ছিল। বুলবুল চৌধুরী প্রথম নৃত্যকলায় যে মুসলমান সমাজ পারদর্শিতা দেখাতে পারে, তাই প্রমাণ করেছিলেন। আমাদের দেশের একজন চিন্তাবিদের মতে, “আমাদের সাহিত্যে যা ছিলেন নজরুল ইসলাম, সংগীতে যা
৩২৩
ছিলেন আব্বাসউদ্দীন, চিত্রশিল্পে জয়নুল আবেদিন, নৃত্যশিল্পে বুলবুল চৌধুরী ছিলেন ঠিক তা-ই।
১৪ মার্চ করাচি থেকে হাভানা রওনা হলাম ‘প্যান আমেরিকান বিমানে। সঙ্গে আবদুল মান্নান চৌধুরী। তার বাড়ি সিলেট। আমার পরামর্শদাতা হিসেবে চললেন। তিনি চা-বাগানের খবর আমার চেয়ে বেশি জানতেন। তাই ওই ব্যবস্থা।
অধিবেশন আরম্ভ হবে ১৯৫৩ সালের ১৬ মার্চ। সুতরাং যাওয়ার পথে যদিও বৈরুত, রােম, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লন্ডনে প্লেন থেমেছে, কিন্তু বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার কোনাে প্রশ্ন ওঠেনি। নিউইয়র্কেও ‘আইডল ওয়াইল্ড’ বিমানবন্দরের বাইরে যাইনি যদিও কয়েক ঘণ্টা থাকতে হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও ছিল। আইডল ওয়াইল্ড থেকে আমেরিকার একটা ন্যাশনাল এয়ারওয়েজ’-এ কিউবা রওনা হয়ে গেলাম। হাভানা বিমানবন্দর হাভানা শহর থেকে প্রায় বিশ মাইল দূরে। হাভানা এসেই দুটো বিপদের সম্মুখীন হলাম—প্রথম আমাদের মালপত্র (লাগেজ) ওই বিমানে আসেনি। আমাদের লাগেজ টিকিটগুলাে নিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মালপত্রের কোনাে সন্ধান পাওয়া গেল না। দ্বিতীয়, প্রায় এক ঘণ্টা পর্যন্ত একজন ইংরেজি জানা লােক পাওয়া গেল না। আমরা যখন বিমানবন্দরে পৌছেছি, রাত তখন। দুটো বাজে। সুতরাং ইন্টারপ্রেটারের জন্য টেলিফোন করেও কাউকে তখন পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাব আমরা। বললাম ‘হােটেলে। আমরা ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। প্রায় রাত তিনটার দিকে হােটেল বিল্টমােরে’ নামিয়ে দিল। আমাদের কাছে হাভানার কোনাে মুদ্রা ছিল না সে কথা হােটেলের “রিসেপশনিস্ট’কে বললাম। তিনি আমাদের ট্রাভেলারস চেক’ দেখে হােটেল থেকেই ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। আমাদের দুটো রুম ঠিক করে চাবি দিয়ে দিলেন। প্রশ্ন করলেন যে আমাদের লাগেজ’ কোথায়? বললাম আসেনি। হােটেল ম্যানেজার এয়ারপাের্টে টেলিফোন করলেন বােধ হয় আমাদের কথা সত্যি কি না তাই পরীক্ষা করতে। টেলিফোনে কথা হলাে স্প্যানিশে। সুতরাং আমাদের বােঝার উপায় ছিল না। আমাদের যার যার রুমে যেতে বলে বললেন যে আমাদের মালপত্র আগামীকাল এসে পৌছাবে। পরদিন সকালে অধিবেশনের স্থান খুঁজতে বেরােলাম। অনেক লােককে জিজ্ঞেস করে হতাশ হলাম। শেষ পর্যন্ত একটা সুরাহা হলাে এবং আমরা হাভানার কনফারেন্স হলে পৌছে গেলাম সময়মতােই। সেখানে গিয়ে আফতাব আলী সাহেব ও তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলাে। তারা সব শুনে আমাদের যে হােটেলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানে নিয়ে এল। ইতিমধ্যে আমাদের মালপত্র
৩২৪
আসার সংবাদ পেয়ে আইএলও থেকেই মালপত্র আনার ও হােটেল বিল্টমােরের দেনা-পাওনা মেটানাের ব্যবস্থা করা হলাে। হােটেল ইংলেতেরিয়ায় আমাদের যার যার রুমে কাপড় ছেড়ে কনফারেন্সে যােগদান করি। হাভানা যেহেতু স্প্যানিশ শহর, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সকলেই আনন্দমুখর। দেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল বাতিস্তা। সিআইএর সাহায্যে কর্নেল থাকাকালীন কুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিল। স্বৈরাচারী সরকার—কোনাে প্রকার আন্দোলনে বিশ্বাস করে না জেনারেল বাতিস্তা। মার্কিন নৌবাহিনীর কর্মচারীদের ফুর্তি করার জন্য সরকার সকল প্রকার ব্যবস্থা করেছে। আমাদের জন্য অনেক নাইট ক্লাবের ব্যবস্থা করা হলাে—“Open Air night club-TROPCIANA’. প্রথম নাচে তুলে ধরা হলাে দক্ষিণ ইতালির গ্রামের কৃষকদের জীবন, যারা ভূতে বিশ্বাস করে। দ্বিতীয়টি প্রায় একই চেহারার মেয়েদের বিভিন্ন দেশ থেকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন ধরনের নাচ। তারপরে এল এক মেয়ে—যে বিবস্ত্র হওয়ার অভিনয় দেখাল। তারপরে পূর্ব ইউরােপের একটি ব্যালে নাচ। কিউবার আবহাওয়া আমাদের পূর্ব বাংলার মতােই অনেকটা। তাই স্যুট পরার চেয়ে হাউই শার্টের ব্যবহার বেশি। ‘সুগারক্যান প্ল্যান্টেশন’ দেখতে গেলাম একদিন—অত আখ যে একটা স্থানে হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আখগুলাের জাত ভালাে—বেশ মােটা ও খুব মিষ্টি স্বাদ। পিকনিক করতে গিয়ে সবাই খাবার রেখে আখ চিবাতে লেগে গেল—মেয়ে-পুরুষ সবারই কী আনন্দ। আর একদিন বাসে করে সমস্ত দেশটাই প্রায় ঘুরিয়ে আনার ব্যবস্থা হলাে। অপরূপ সুন্দর দেশটায় কালাে পাথরের পাহাড়-পর্বতের মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা পিচের রাস্তা। দেশের চারধারেই সাগরের ঢেউ এসে লাগছে, এমনকি ড্রাইভওয়ে’ দিয়ে যাওয়ার সময় উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে ভেঙে পড়ছে আমাদের গাড়ির ওপর।
হােটেলের বড় অসুবিধা হলাে কেউ কথা বােঝে না। তাই ডিকশনারি হাতে করে রুটি, কফি, চিনি, দুধ প্রভৃতি ইংরেজি শব্দের যে স্প্যানিশ দেওয়া আছে, তাতেই হাত দিয়ে দেখিয়ে দিই। সপ্তাহখানেক পরে অবশ্যই অনেকগুলাে শব্দ মােটামুটি শিখে ফেললাম। জেনারেল বাতিস্তা একদিন সন্ধ্যায় ‘ড্রিংকস’-এর নিমন্ত্রণ করলেন। যাকে বলে রিসেপশন। তৃতীয় সপ্তাহে আমরা প্রথম জানলাম যে দূরে পাহাড় অঞ্চলে দুষ্কৃতকারীরা লুকিয়ে থাকে এবং মাঝেমধ্যে একেকটা শহর আক্রমণ করে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমরা থাকতেই একদিন হাভানায় বােমা ফাটল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তখন আমরা শুনেছিলাম ক্যাস্ট্রোর নাম—ছাত্রদের মুখে।
অধিবেশনে সবচেয়ে ভালাে লাগল ড. কিনিম্যানের বক্তৃতা। শ্রীলঙ্কার সবাই ভালাে ইংরেজি বক্তৃতা করে। ড. কিনিম্যান কমিউনিস্ট শ্রমিকনেতা।
৩২৫
তাঁর পিতা ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস। স্ত্রী ইংল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল হ্যারি পােলিটের কন্যা। তিন সপ্তাহ কনফারেন্স চলার পর অধিবেশন শেষ হলাে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলাে—তাঁরা সবাই নিমন্ত্রণ করলেন আমাদের। ভারতীয় দলের নেতৃত্ব করছিলেন ত্রিপতি। কংগ্রেসি পােশাক পরিধান করতেন মায় খদ্দরের টুপিটি পর্যন্ত।
আমরা প্রথম এলাম নিউইয়র্কে। সঙ্গে ছিলেন আইএলও-র লিয়াজো অফিসার মিস্টার ঘটক। অদ্ভুত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্রদূত মােহাম্মদ আলীকে (বগুড়া) টেলিফোনে জানালাম যে এক দিনের জন্য ওয়াশিংটনে বেড়াতে আসতে পারি যদি সময় হয়। তিনি বললেন, গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন আমার জন্য। খুব ভালাে লাগল। মনে হলাে দেশের কথা এখনাে ভােলেননি।
আমেরিকায় নতুন এসেছি আর যতই দেখছি ততই মনে হচ্ছে এটা সত্যিই নতুন দেশ। যুবক-বৃদ্ধ কারও পােশাকেই কোনাে তফাত নেই। শার্টের কাপড়টা হয়তাে কড়া লাল, তার মধ্যে বড় বড় কালাে চেক অথবা বিচিত্র রঙের ওপর হালকা বড় বড় প্রজাপতির ছাপ, অথবা গাঢ় নীল রঙের শার্টের ওপর বাদামি রঙের বড় মাছের ছাপ। আর গলায় টাই—যেমন চওড়া তেমনি রং। তার মধ্যে আবার উলঙ্গ মেয়ের ছবি বা কাউবয়ের ছবি বা রেডইন্ডিয়ানদের ছবি। গরমের সময় শার্টের হাতা গুটিয়ে রাখে সবাই কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত ।
মনে হলাে আমেরিকানরা ছােট জিনিস নিয়ে ভাবতে পারে না। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এক শ তলারও বেশি। তা ছাড়া অন্য অট্টালিকাগুলােও কম যায় না। রেস্তোরায় বসলে তাে অবাক হয়ে যেতে হয়। একটি চিনি রাখার পট এত বড় এবং ভারী যে সেটা তুলে চায়ে চিনি দিতেই হাঁপিয়ে উঠতে হয়। একটা ম্যাচ এগিয়ে দিল তাে সেটা যেন ছােটদের খেলনার মােটরকার। খাবার চাইলে সালাদ অর্থে একটা গরুর খাবার। মুরগির ফ্রাই চাইলে মনে হয় আস্ত একটা টার্কি সম্মুখে এসে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা কিনলে মনে হয় এক ভলিউম এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকানিয়ে এলাম। কারণ পরে বুঝলাম। আমেরিকানদের খবরের কাগজ পড়ার রীতি আলাদা ধরনের। বহু লােক আছে কেবল স্পাের্টস কলামস পড়বে, আর কিছু নয়। অনেকে কেবল স্টক এক্সচেঞ্জের খবর পড়বে, অনেকে কেবল কমিক পড়বে, এমনি করে বিভিন্ন রকমের পাঠক। রাজনীতির যে খবর তাতে সেই স্টেটের রাজনীতিই থাকে। অবশ্যই বিশ্বের খবরও পাওয়া যায় কিছু কিছু, কেবল পাওয়া যায় না আমেরিকার অন্যান্য স্থানে কী হচ্ছে। শুনলাম—পলিটিক্যাল অংশ ছাপা হয় কেবল বিদেশিদের জন্য। বেশি লােকে পড়ে ‘ডাইজেস্ট। আবার যার সময়
৩২৬
আরও কম, সে পড়ে ‘ডাইজেস্ট অব ডাইজেস্টস’। যত ডাইজেস্ট আছে, তার মধ্যে রিডার্স ডাইজেস্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় ।
কিচেনে ঢুকলে বােঝা যায় যে জাতটা টেকনােলজিতে কত এগিয়ে গেছে। কত রকম গ্যাজেট যে তৈরি হয়েছে কাজের সুবিধার জন্য এবং অল্প সময়ে কাজ সমাধা করার জন্য, তা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। গ্যাজেটগুলাে সবই বিদ্যুৎ-শক্তিতে চলে-বার্নার বা চুলা জ্বালাতে ম্যাচবাতির প্রয়ােজন হয় না । নবটা ঘােরালেই জ্বলে ওঠে। বার্নারের পাশেই হয়তাে রয়েছে আরেকটা ছােট বৈদ্যুতিক গ্যাজেট। কমলা, টমেটো প্রভৃতির রস করার জন্য।
আমেরিকানরা কথা বলতে ভালােবাসে—অল্প পরিচয়েই জানতে চাইবে—কী করা হয়, কত বেতন-ব্যবসা হলে কত আয়, আয়কর ফাঁকি দেওয়া যায় কি না ইত্যাদি। রেখে ঢেকে কথা বলতে জানে না-ইংরেজ যেমন ভূমিকা করে কথা আরম্ভ করে, I believe, may be I am wrong.or “I am afraid, you sound a bit unorthodox, and other people have other opinions on this subject.’ আমেরিকানদের সে বালাই নেই। ঝরঝর করে বলে যায় যা খাটি তাই। আমেরিকায় এত গ্যাজেট বেরােনাের ফলে মেয়েদের বিস্তর সময় হাতে থেকে যায়—তাই চিঠি লেখার ব্যাপারে। আমেরিকান মেয়েদের জুড়ি নেই। টাইপরাইটারে বড় চিঠি লিখতে সময় বেশি লাগে, তাই বৈদ্যুতিক টাইপরাইটার ব্যবহার করবে—নানা ঢঙে রঙিন ছবি তুলে প্রতি সপ্তাহেই পাঠাবে। তার ওপর ফাদারস ডে, মাদারস ডে থেকে আরম্ভ করে নিউইয়ার্স ডে পর্যন্ত হাজারাে কার্ড, যার মধ্যে ছাপানাে কবিতা রয়েছে, তাও পাঠাবে।
আমার প্রথমে মনে হয়েছিল ম্যানহাটান ও নিউইয়র্ক একই কথা—ম্যানহাটান দ্বীপটার নাম আর তার ওপর শহরটাই নিউইয়র্ক। বেশ কিছুদিন পরে বুঝলাম আমার ধারণা ভুল। ম্যানহাটান তেরাে মাইল লম্বা। দুই মাইল পাশে হাডসন নদীর মুখে একটা দ্বীপ। এর আগে ইস্ট রিভার। আর ওই ইস্ট রিভারের অপর পাড়ে লং আইল্যান্ড । একদিন ব্রোঞ্জ চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়ে শুনলাম ওটাও নিউইয়র্ক। সুতরাং একদিন ব্রুকলিন পুল পার হয়ে ব্রুকলিনটা দেখলাম। রিচমন্ডে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিউইয়র্ক অর্থে বােঝা যায় বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকাসমূহ—এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, রকফেলার সেন্টার, টাইমস স্কয়ার আর হারলেম। আর ওগুলাের সবটাই ম্যানহাটানে। তাই আমাদের মতাে বিদেশির পক্ষে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। ট্যুরিস্টদের লঞ্চে করে নিউইয়র্কের চারদিকে ঘুরে দেখানাের ব্যবস্থা আছে। স্ট্যাচু অব লিবার্টি পেরিয়ে গেলে বাঁয়ে একটা অট্টালিকা। তার কয়েক তলা প্রবেশপথ ছাদের ওপর দিয়ে। লিফটে উঠে যায় ছাদে। সেখান থেকে তরতর করে যার যার
৩২৭
অ্যাপার্টমেন্টে চলে যায়। যে লােকটা মাইক ধরে সব চিনিয়ে দিচ্ছিল, সে বলল আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের কোথাও থাকার এমন বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা নেই। ম্যানহাটানের রাস্তাগুলাে অদ্ভুত। উত্তর-দক্ষিণের রাস্তাগুলাে সব অ্যাভিনিউ আর পূর্ব-পশ্চিমের রাস্তাগুলাে সব স্ট্রিট—নাম নেই, সবই কেবল নম্বর।
ড্রাগ স্টোরসে ড্রাগ ছাড়া আর সবই পাওয়া যায়। স্টেশনারি, চকলেট, চুইংগাম, বাচ্চাদের খেলনা, ঝরনা কলম ইত্যাদি হরেক রকম জিনিস। তার সঙ্গে পরিশ্রান্ত ক্রেতাদের জন্য খাবার ব্যবস্থাও আছে। ফলের রস, চা, কফি, আইসক্রিম, স্যান্ডউইচ, অমলেট, মামুলেট, স্ক্র্যাম্বলড আন্ডা, মাখনে পােচড ডিম (Sunny side up)—এমনই সব খাবার। আমেরিকায় ছােট গাড়ি নেই—মস্ত বড় বড় গাড়ি চাই। শােরুমে লন্ডন থেকে বা জার্মানি থেকে আসা ছােট গাড়ি দেখার জন্য আমেরিকান ছেলেমেয়ে, বুড়ােদের ভিড় হয়। তাদের গাড়িতে থাকতে হবে রেডিও, সিগারেট লাইটার, ইলেকট্রিক হিটার, এয়ারকন্ডিশনার—এমন সব জিনিস।
বড় রাস্তায় ক্রসিং থাকে না—ক্রসিং হয় মাথার ওপর দিয়ে, নয় মাটির নিচ দিয়ে। নদীর নিচ দিয়ে টানেলে গাড়ি চলছে, ঠিক তখনই টানেলের ওপর জাহাজ চলছে। অসুবিধা একমাত্র দেখলাম গাড়ি পার্ক করা। কয়েক ব্লক দূরে রাস্তার পাড়ে হয়তাে গাড়ি রাখতে হয়। নানা পরিকল্পনার কথা অবশ্যই শুনলাম।
আমেরিকানদের বিশ্বের সংখ্যালঘুদের প্রতি খুব দরদ। ভারতের মুসলমান, পাকিস্তানের হিন্দু, ফিলিপাইনসে মুসলমান, বার্মায় মুসলমান, সিংকিয়াঙে মুসলমান, রাশিয়ার ইহুদি, জাপানের কোরিয়ান, যুগােস্লাভিয়ার ইতালিয়ান, চেকোস্লোভাকিয়ার হাঙ্গেরিয়ান—এমন সব সংখ্যালঘুদের সমস্যা সম্বন্ধে তারা খুব ভাবে, কিন্তু তার নিজের দেশের সংখ্যালঘু নিগ্রোদের জন্য কোনাে ভাবনা নেই। স্বাধীনতায় শ্বেতাঙ্গদের অনন্ত বিশ্বাস—তাদের স্বাধীনতা যে কতখানি তা বুঝতে কষ্ট হয় না—শ্বেতাঙ্গদের জন্য পার্ক, চলাচলের রাস্তা, স্কুল, বাড়ির স্থান নির্বাচন, বেঞ্চ, এমনকি নিগ্রোদের স্বাধীনভাবে মারধর করার অধিকার—সব রকম স্বাধীনতা আছে। দেশটা যেহেতু নিগ্রোদের নয়—তারা বহিরাগত, সুতরাং আমেরিকানদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে নিগ্রোদের স্বাধীনতা বােঝায় না।
কোনাে স্টেটের আইনের সঙ্গে অন্য স্টেটের সম্পূর্ণ মিল হতে পারে না। সেখানেও প্রত্যেক স্টেটের স্বাধীনতা রয়েছে নিজেদের ইচ্ছামতাে আইন করা ও প্রয়ােগ করায়। তাদের দেশে সবচেয়ে সম্মানিত লােক মন্ত্রী। তার আদর্শ কী, সে মিথ্যাবাদী কি না, আয়কর ফাঁকি দেয় কি না—মাতাল কি না, এমনকি নিষিদ্ধ এলাকায় বা নাইট ক্লাবে যায় কি না—সে তাদের দেখার প্রয়ােজন।
৩২৮
নেই, যদি না কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। সে মন্ত্রী তাই বড় হওয়ার জন্য যথেষ্ট—আবার মন্ত্রিত্ব চলে গেলেই সে ছােট হয়ে গেল। নির্বাচনের সময় সেসব প্রার্থীই সাফল্য লাভ করে, যারা মেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয় এবং ছােট শিশুদের বিনা দ্বিধায় চুমাে খেয়ে যেতে পারে।
আমেরিকানদের ধারণা যে জগৎট্টা তাদের অধীনে। কথাটা অনেকটা ঠিক। ছেলেবেলায় গল্প শুনেছিলাম—কাকে কাকে খেলায় নেওয়া—কে কোথায় দাঁড়াবে—তার জন্য বাছাই হয়, কিন্তু বল যার তার সম্বন্ধে। বাছাইয়েরও প্রশ্ন ওঠে না—আর মাঠে তার স্থান সে নিজেই ঠিক করে নেয়—কারণ, বলের মালিক সে। আমেরিকার ডলার আছে, ঐশ্বর্য আছে—সবাই তার মুখাপেক্ষী, তাই তার মনে অমন চিন্তা আসা স্বাভাবিক।
আমেরিকানদের দেশটাই নতুন নয়, তারা জাতি হিসেবেই নতুন নয়—তারা এখনাে চরিত্রে ও স্বভাবে কৈশােরের অভ্যাস কাটাতে পারেনি। ছােট শিশুর যেমন মায়ের স্তনের প্রতি নিরবধি দৃষ্টি—আমেরিকানদেরও তাই–বাস্ট’ পাগল তারা। চুইংগামের ভেতরে যেন স্তনের মাধুর্য লেগেই আছে—ছেলে-বুড়াে, মেয়ে সবার মুখেই চুইংগাম। খাবার সময় ছােট ছেলেমেয়েদের মাংস কেটে হাতে কাটা দিয়ে দেয় তুলে খাবার জন্য—তেমনি আমেরিকানরাও আগে দুহাত ব্যবহার করে মাংস কেটে নেয়—তারপর ছুরি রেখে দিয়ে ডান হাতে কাটা নিয়ে খাওয়া আরম্ভ করে। বিলেতে যে কাঁটাচামচ, ছুরি সবই ব্যবহার করে আর কাটা বা হাতে ধরে উপুড় করে তার ওপর ছুরি দিয়ে খাবার তুলে খাওয়াটাও আমার কাছে মনে হয় রানি ভিক্টোরিয়ার যুগকে লম্বা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আমার কাছে। শিক্ষিত সংস্কৃতিমান লােককে অনেক বেশি ভালাে লাগে ওই ধরনের ম্যানারস কনশাস’ লােকের চেয়ে। আমেরিকান মেয়েরা কিন্তু গলার স্বর সম্বন্ধে খুব সজাগ। বিরাট বপুর মেয়েরাও কিশােরীদের স্বরে কথা বলার চেষ্টা করে। মেয়েদের স্বাভাবিক চেহারা আমার ভালাে লাগে—‘মেকআপ করা মেয়েদের দেখলে আমার মনে হয় যে অসুন্দরকে ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। মেয়েদের চেহারা যত ভালাে হবে, তার ‘মেকআপ’-এর প্রয়ােজন তত কম। তাই সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আমেরিকান মেয়েদের দেখলে তাদের বীভৎসতা ধরা পড়ে। তাই তাদের দেশে স্বামীরা স্ত্রীর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। আমেরিকান মেয়েরা অন্য মেয়েকে যত প্রশংসা করতে পারে—তা আর কোনাে দেশে পারে কি না সন্দেহ, সে বলবে, “She is such a dear. she is the sweetest women I have ever met. She is so cute I would love to have you meet her.’
আমেরিকার মেয়েদের ধারণা যে ছুটিতে বেড়াতে গেলে স্বামী-স্ত্রীর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যাওয়া উচিত, তাতে বিছানায় প্রতিদিন স্বামীর একই মুখ, তার একই মুখ খাবার টেবিলে, বেখেয়াল কাপড়-জামায় দেখা থেকে মুক্তি পায়।
৩২৯
কিছুদিনের জন্য। এতে করে অনেক ভালাে ফল পাওয়া যায়—একই জায়গায় বেড়াতে গেলে সে নতুনত্ব পাওয়া যায় না। কূটনৈতিক চাকুরেদের মধ্যে একটা কথা আছে—সিগারেট কেসের শেষ সিগারেট খেতে নেই, একাধিক গ্লাস পানীয় পান করা উচিত নয়—মেয়েরা যখন প্রশংসা পাওয়ার জন্য অস্থিরচিত্তে তােমার চারপাশে ঘােরে, তখন তাকে প্রশংসা করতে নেই। সবার প্রশংসা কুড়ানাের পরে যখন সবাই তাকে ফেলে যায়, তখন প্রশংসা করা উচিত। আমেরিকায় ওটা খাটে না—সিগারেট সবটা খেয়ে চেয়ে খাও, মাতাল হওয়া পর্যন্ত মদ গেল, আর মেয়েদের দেখলে অসীম প্রশংসা চালিয়ে যাও।
সুরাপানের ব্যাপারে আমার ধারণা, লাজুক মানুষ, কম সাহসী লােক, এদের পক্ষে একটু-আধটু সুরাপান করলে মন্দ হয় না। কিন্তু যাদের বুদ্ধি খাটিয়ে, শান্ত ও স্থিরচিত্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাদের পক্ষে সুরাপান। একেবারেই নিষিদ্ধ করা উচিত। আমেরিকানরা এসব মতামতের ধার ধারে না। যা ভালাে লাগবে তাই করাে। ছুটির দিনে যত দ্রুত মন চায় গাড়ি চালাও—সামনের গাড়িটাকে ভাঙতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে তুমিও মরাে। শুক্রবার বিকেলে গাড়ি নিয়ে ছুটে যায় আর সােমবার অফিসে যাওয়া হয় না—সােমবার কেন জীবনেও আর অফিস করা হয় না; কিন্তু এরই মধ্যে তার আনন্দ। ছুটি অর্থে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করা। তাই ক্রিসমাসের ছুটিতে কোন শহরে কত লােক রাস্তায় ‘এক্সিডেন্ট করে মরবে, তার একটা মােটামুটি হিসাব আগে থেকেই কাগজে বেরিয়ে যায়।
একদিন হােটেলের রিসেপশনিস্ট খবর দিল যে ওয়াশিংটন থেকে আপনার গাড়ি এসেছে। কাপড়-জামা পরে প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে এলাম। তারপর আড়াই শ মাইল ড্রাইভ করে ওয়াশিংটন। এখানে আবার রাস্তাগুলাে অন্য রকম অ্যাভিনিউ ও স্ট্রিটের ক্রসিং নয়, এবার ইংরেজি অক্ষরের সঙ্গে ইংরেজি সংখ্যার ক্রসিং। স্কাইস্ক্র্যাপার নেই—সুন্দর লে-আউট শহরের, শুনলাম—লেআউট প্যারিস মডেলে তৈরি।
মােহাম্মদ আলী আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। যেন বহুদিন পরে দেশের গন্ধ পেলেন। বললেন, দেশে যেতে খুব ইচ্ছে করে—কতকাল বিদেশে পড়ে আছি। মাঝেমধ্যে ভাবি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার দেশে গিয়ে রাজনীতি করব। আমার মত জানতে চাইলে আমি তাকে বললাম, গত বছর ভাষা আন্দোলনের পর দেশে রাজনীতির গতিধারায় এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে। ওই রাজনীতির পরিবেশে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হবে। একটি ঘটনার কথা মনে এল তখন। ফেব্রুয়ারি মাসের ত্রিদলীয় শ্রমিক অধিবেশনের পর ডাক্তার মালিকের বাড়িতে ছিল মালিক এবং শ্রমিকনেতাদের নৈশভােজ। সেই ভােজের পর সৈয়দ ওয়াজিদ আলী শাহ্ আমাকে পাশে
৩৩০
ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নাজিমুদ্দিন সাহেবের পর বাংলা থেকে কে প্রধানমন্ত্রী হতে পারে বলে আমার ধারণা। আমি বলেছিলাম, কেন সে প্রশ্ন? খাজা সাহেব বহাল তবিয়তে আছেন আর তিনি ছুটি নিলে তার গদিতে খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবকে বসিয়ে যাবেন। সেটাই যে খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের বিগত জীবনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সে ঘটনাটা মােহাম্মদ আলীকে বললাম । এমনি করে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হলাে। পরের দিন আবার নিউইয়র্ক। তারপর লন্ডনের পথে । লন্ডন থেকে আসার দিন আইসল্যান্ডের কেলাভিকে কেন বাইটিং ফ্রস্ট’ বলে তা বুঝেছিলাম। তেমনি ফেরার দিন কানাডার নিউগ্যান্ডারে শীত কাকে বলে বুঝেছিলাম।
এপ্রিল মাসে আমি যেদিন লন্ডনে এসে পৌছালাম, সেদিন সূর্যের আলাে প্রথম দেখা গেল। হােটেলের রিসেপশনিস্ট বললে, ‘You are so welcome you have brought with you sunshine of the Spring.’
কেনসিংটন প্যালেস হােটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলাে। সে হােটেলেই আবদুল মােন্তাকিম চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তারপর এলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী—দুজনেই আবদুল মান্নান চৌধুরী সাহেবের আত্মীয় এবং তাঁরা তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলেন—আমার সঙ্গে তিনিই পরিচয় করিয়ে দিলেন।
পরের দিন তাসাদুক আহমদ এবং সৈয়দ মােহাম্মদ আলী এলেন—দুজনেই খবরের কাগজে চাকরি করার জন্য চেষ্টা করছেন। খান মােহাম্মদ শামসুর রহমান তখন সিএসপি ট্রেনিংয়ে আছেন। তাকে বললাম যে আমার সঙ্গে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যেতে হবে। শামসুর রহমান তখন ওয়ার্কিং এনসাইক্লোপিডিয়া বলে পরিচিত। সত্যিই ওর সঙ্গে দুদিন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যে আনন্দ পেয়েছি, তা আর কোনাে লােকের সঙ্গে পেতাম কি না সন্দেহ।
এরপর অ্যানুরিন বিভানের সেক্রেটারি আমাকে টেলিফোন করলেন—সময়ও নির্দিষ্ট করে দিলেন। বিভান তখন শ্যাডাে ক্যাবিনেটের মন্ত্রী আর শ্রমিক দলের কোষাধ্যক্ষ। তাঁর বাড়ি গেলাম বেলা এগারােটায়। ব্রিটিশ ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট, শ্রমিক দলের কর্মসূচি, পাকিস্তানের শ্রমিক আন্দোলনের ধারা—এসব বিষয়ে কিছুক্ষণ আলােচনা হলাে। আমাকে নিয়ে গেলেন তার লাইব্রেরি ঘরে। ঢুকেই দেয়ালে চোখ পড়ল বিশ্বের বিরাট মানচিত্র। লাইব্রেরিতে বইগুলাে সাজানাে হয়েছে মানচিত্র দেখে। ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রন্থ সব এক জায়গায়, তেমনি পশ্চিম ইউরােপ, সােভিয়েত রাশা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্য প্রভৃতি দেশ বা অঞ্চলের বই বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা আছে। আমার ধারণা ছিল, বিভান কয়লাখনির শ্রমিক-লেখাপড়ার সুযােগ হয়নি জীবনে—তাই সােশ্যালিজমের
৩৩১
নামে আন্দোলনের রাজনীতিই করেন। লাইব্রেরিতে কিছুক্ষণ থেকে আমার সে ভুল ভাঙল। বিভান অনুন্নত দেশের রাজনীতিবিদ নন। তাঁর সদ্য লেখা একখানা বই In Place of Fear আমাকে উপহার দিলেন।
তাঁর কাছেই প্রথম শুনলাম মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে স্তালিনের মৃত্যুর পর কীভাবে বেরিয়া নিজে উপস্থিত থেকে পূর্ব জার্মানির শ্রমিকদের ওপর গুলি চালিয়েছে। তারপর বললেন ডাক্তারদের মুক্তি পাওয়ার কথা, চেকোস্লোভাকিয়ার সেক্রেটারির কথা—এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ‘রেজিমেন্টেড সােসাইটি’ সম্বন্ধে তার মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ খেয়ে হােটেলে ফিরে এলাম। মনে হলাে অনেক কিছু শিখলাম সেদিন।
লন্ডন থাকতেই খবর এল যে গােলাম মােহাম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করেছেন। গােলাম মােহাম্মদ তার প্রক্লামেশনে বলেছেন :
I have been driven to the conclusion that the Cabinet of Khaja Nazim-uddin has proved entirely inadequate to grapple with the difficulties facing the country. In the emergency which has arisen I have felt incumbent upon my asking the Cabinet to relinquish office so that a new Cabinet, better fitted to discharge its obligation towards Pakistan, may be formed.
ওয়াশিংটন থেকে রাষ্ট্রদূত মােহাম্মদ আলীকে করাচি ডেকে পাঠানাে হলাে এবং তাঁকেই সরকার গঠনের ভার দেওয়া হলাে। হামিদা মােহাম্মদ আলী ঢাকার জামদানি শাড়ি কিনে পাঠানাের জন্য আমাকে যে ডলারগুলাে দিয়েছিলেন, তা তাঁকে এখন টাকায় দিলেই চলবে—কারণ, শাড়ি কেনার আর প্রয়ােজন হবে না।
নাজিমুদ্দিনের পতনের সংবাদে আমি খুশিই হয়েছিলাম—যদিও গােলাম মােহাম্মদের কাজটা একেবারেই অগণতান্ত্রিক ছিল। আমি অবশ্য ছােট পরিধি থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর পতনটা দেখেছিলাম তখন। তার সঙ্গে সঙ্গে আহসান মঞ্জিলের কবর তৈরি হলাে। দেশ যেন রাজনৈতিক মুক্তি পেল। মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের পথ খুলে গেল।
এরপরে থাকল যে দুজন অভিজাত নেতা, তাঁরা হলেন এ কে ফজলুল হক সাহেব ও শহীদ সাহেব। একজন বৈবাহিকসূত্রে আভিজাত্যের দাবিদার—অন্যজন পরিবারে শিক্ষা, কৃষ্টি এবং বংশমর্যাদায় আভিজাত্যের দাবিদার—কিন্তু কেউ বড় জমিদারও নন, শিল্পপতিও নন। আর দুজনার কেউ ব্রিটিশের খেতাবপ্রাপ্ত নেতাও নন। আর তাঁরা কেউ মধ্যবিত্তের সাহায্য ছাড়া রাজনীতির আসর গরম করতে পারবেন না। মােটামুটিভাবে উচ্চমধ্যবিত্তেরা
৩৩২
যেমন ইউসুফ আলী চৌধুরী, হামিদুল হক চৌধুরী, রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, আশ্রাফউদ্দীন চৌধুরী প্রমুখ ফজলুল হক সাহেবের দলে ভিড়ে গেলেন। শহীদ সাহেব সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হলেন শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব ও মানিক মিয়া সাহেবের ওপর। শেখ সাহেব বর্তমান শতাব্দীর চতুর্থ দশক থেকেই রাজনীতি আরম্ভ করেছিলেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বেশ কিছু কন্ট্রাক্ট’ জোগাড় করে বিস্তর টাকা করে ফেলেন। সে সময় তাঁর নিজের লােক যেমন চিটাগাংয়ের আজিজ, জহুর আহমদ এমনি অন্যান্য জেলার অনেক যুবকর্মী ও ছাত্র যারা কলকাতায় পড়াশােনা করছিল, তারা শেখ সাহেবের নেতৃত্ব মেনে নেন। পাকিস্তান হওয়ার পর ইস্ট পাকিস্তান। মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের কর্মীদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে শেখ সাহেব যুবকর্মী সৃষ্টি করে তাদের আন্দোলনের হাতিয়ার করে জীবনের জয়যাত্রা শুরু করেন।
মানিক মিয়া সাহেব রাজনীতি করেননি কোনাে দিন। চাকরি করেছেন। কিন্তু প্রথম থেকেই শহীদ সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। শহীদ সাহেব প্রথম তাঁকে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ অফিসের সহকারী অফিস সেক্রেটারি, পরে ইত্তেহাদ পত্রিকার সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত করেন। ইত্তেহাদ বন্ধ হয়ে গেল ১৯৪৯ সালে। শহীদ সাহেব পাকিস্তানে এলেন, সঙ্গে এলেন মানিক মিয়া সাহেব।
আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার কিছুদিন পরেই মওলানা ভাসানী সাপ্তাহিক ইত্তেফাক কাগজ করেন। ইয়ার মােহাম্মদ খান প্রিন্টার ও পাবলিশার । দুজনের মধ্যে কারও কাগজ চালানাের কোনাে অভিজ্ঞতা ছিল না—তাই সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রথম কয়েক মাস পরে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে লাগল। শেষে দুই পাতা—মাসে একবার। কেবল ‘ডিক্লারেশন’টা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। মানিক মিয়া কলকাতা থেকে এসে—তাঁর ইত্তেহাদ-এর অভিজ্ঞতা থেকে ভাবলেন যে তিনি সাপ্তাহিক ইত্তেফাককে দাঁড় করাতে পারবেন। মওলানা সাহেবের সঙ্গে আলাপের পর তিনি সাপ্তাহিক ইত্তেফাক এর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সঙ্গে তাঁর আর দুজন কর্মী। আবদুল ওয়াদুদ এবং আবদুল আউয়াল। বছরখানেক কী যে কষ্ট গেছে তাঁদের ওপর দিয়ে, তা আতাউর রহমান সাহেব ও আমি জানতাম। আতাউর রহমান সাহেব অ্যাডভার্টাইজমেন্টের জন্য মাঝেমধ্যে তাঁর মক্কেলদের কাছে তাঁর ‘ফিস’ কম। নিয়ে ইত্তেফাক-এ অ্যাডভার্টাইজমেন্ট জোগাড় করে দিয়েছেন। শহীদ সাহেব এন এম খান ও আসগর আলী শাহকেও বলে দিয়েছিলেন সাহায্য করতে। অন্যদিকে হানিফ ব্রাদার্স ও বাবু রণদাপ্রসাদ সাহা এদেরও যতদূর সম্ভব সাহায্য করতে বলেছিলেন।
৩৩৩
কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে যে মানিক মিয়া যেভাবে কাগজটাকে দাঁড় করিয়েছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক মঞ্চ যেভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল, তা আমাদের দেশের সাংবাদিকদের বিস্মিত করেছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে আর কেউ এমন করে বিনে পয়সায় একটা কাগজ হাতে নিয়ে শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিকে পরিণত করার কথা ভাবতে পারেনি, আর পারবেও কি না সন্দেহ। একসময় এক মুসলিম লীগ ছাড়া অন্য সকল পার্টির রাজনৈতিক নেতারা তাঁকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন—রাজনীতির ওপর তাঁর প্রভাব ছিল বিস্তর। এমনকি শেখ সাহেব যখন ১৯৫৭ সালে বাণিজ্য-শিল্পশ্রমমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন আমি বিদেশে জাতিসংঘে। সামান্য একটা ভুলবােঝাবুঝির জন্য তিনি শেখ সাহেবকে জনগণ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের প্রচেষ্টায় তাদের মধ্যে ভুল-বােঝাবুঝির অবসান হয় এবং দুজনে আবার একযােগে সংগ্রাম করতে থাকেন।
দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের নির্বাচনে বদরুদ্দীন সিদ্দিকী, সফিউল্লাহ, ঠাণ্ডা মিঞা আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমরা ফজলুর রহমান। সাহেবের দলকে প্রথমবারের মতাে ভােটে পরাজিত করে কোর্টের সদস্য নির্বাচিত হই। ১৯৫৯ সালে মার্শাল ল দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্ট ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের আমি সদস্য ছিলাম।
নাজিমুদ্দিনের পতন, শাহাবুদ্দীনের রাষ্ট্রদূত পদে নিযুক্তি, ফজলুর রহমান সাহেবের বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির পরিসমাপ্তি—সবই মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের পথে অগ্রাভিযান।
নুরুল আমীন সাহেবের পক্ষে আর নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হলাে না। শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পর বত্রিশটা উপনির্বাচন বন্ধ করে রেখেছিলেন—শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন ঘােষিত হলাে। নির্বাচন ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে। আমাদের শপথ ওই নির্বাচনে জয়ী হতেই হবে। কারণ, মুসলিম লীগের পরাজয় মানে পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাত ও শিল্পপতিদের এজেন্টদের পরাজয়। তারপর দিন আসবে যেদিন পূর্ববঙ্গ থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরম্ভ হবে।
লন্ডন থেকে জেনেভায় এসে বেশ কিছুদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলাম, তারপর কায়রাে হয়ে দেশে ফিরব বলে স্থির করলাম।
১৯৫৩ সাল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ঘটনা আমার জীবনের ওপর রেখাপাত করেছিল। রুশ দেশে স্তালিনের মৃত্যুর পর লন্ডনে বসে শুনেছিলাম যে বেরিয়াকে সচফ, বুলগানিন, কাগানােভিচ, মার্শাল জুকফ, ম্যালেনকফ প্রমুখ সবাই মিলে তাঁকে গলা টিপে হত্যা করেছেন—তারপর ম্যালেনকফকে
৩৩৪
নেতৃত্বে বসিয়েছেন। জেনেভায় এসে অবশ্য শুনলাম যে তাঁকে গুলি করে। হত্যা করা হয়েছে।
ওই বছরই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক রােজেনবার্গ এবং তাঁর পত্নীকে যুক্তরাষ্ট্রের বিচারকেরা আণবিক শক্তির গােপনীয় তথ্য রুশ দেশকে সরবরাহ করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে এবং বহু লােকের আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাদের প্রাণভিক্ষা দেননি। যার ফলে বৈদ্যুতিক চেয়ারে তারা মৃত্যুবরণ করেন। আমরাও অনেকে কিউবা থাকাকালীন ওই রকম আবেদনপত্রে সই করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞানের পূজারি অথচ তাদের দেশেই হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার হওয়ার ভয়ে যে রােজেনবার্গরা আশ্রয় নিয়েছিলেন মার্কিন মুল্লুকে, সেখানেই তাদের মৃত্যু। এটা ভাগ্যের পরিহাস ছাড়া আর কী।
১৯৫৩ সাল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের করােনেশনের বছর—সুতরাং আমরা যারা কমনওয়েলথের নাগরিক, তাদের প্রতি লন্ডনের বাস কন্ডাক্টর ও কাস্টমস অফিসারদের ভালাে ব্যবহার পেয়ে এসেছি—যুক্তরাজ্যের গৌরব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কান্ডারি চার্চিলের সাহিত্যে নােবেল পুরস্কার লাভ এক অপূর্ব। আনন্দ এনে দিয়েছে। অবশ্যই আবার সেই বছরই একসময় লন্ডনের এক অতি সাধারণ নাগরিক যে পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়াছবিতে অপূর্ব হাস্যরসের সৃষ্টি করেছিলেন সেই চার্লি চ্যাপলিনকে সাম্যবাদী সন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি অবশ্যই লন্ডনে ফিরে না গিয়ে সুইজারল্যান্ডেই বাস করা স্থির করলেন। পরবর্তীকালে অর্থাৎ বাইশ বছর পর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। গুণের আদর হয়েছিল—তবে সময় লেগেছিল বিস্তর।
কায়রােতে যাব কি যাব না ভাবছিলাম। কারণ, জেনারেল নগীবের অধিনায়কত্বে রাজা ফারুককে ইজিপশিয়ান সেনাবাহিনী ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে সিংহাসনচ্যুত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করে এবং সামরিক আইন জারি করে। ১৯৫৩ সালে অবশ্য কর্নেল গামাল আবদুল নাসের নগীবকে নজরবন্দী করে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণ করেন। আশ্চর্য ক্ষমতার খেলা। জেনেভায় থাকতেই গাড়িতে প্যারিস, পশ্চিম জার্মানি ও অন্য কয়েকটি দেশে ঘুরে ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করলেন সেসব দেশের আইএলওর মেহনতি-মজদুর। প্রতিনিধিরা। অনেক ভেবেও শেষ পর্যন্ত কায়রাে দুদিন থাকার আকাঙ্ক্ষা দমন করতে পারিনি। নেপথ্য কারণ ‘পিরামিড। সেটা ছিল আমার স্বপ্নের-ছােটবেলার সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দ্বিতীয় রেমেসিসের বিরাট মূর্তি দেখে অভিভূত হওয়ার পর এবং মিসরের পুরােনাে মমি’ দেখার পর ‘পিরামিড’ দেখার ইচ্ছা আরও প্রবল হয়েছিল। যদিও
৩৩৫
পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন বেড়ানাের অনুকূলে ছিল না। ইরানের প্রধানমন্ত্রী মােসাদ্দেক দেশ আমার তেল আমার’ স্লোগান তুলে তেলের জাতীয়করণ পরিকল্পনার ভিত্তিতে দেশে এমন ভীষণ আন্দোলন সৃষ্টি করলেন যে শেষ পর্যন্ত যুবক রেজাশাহ তাঁর সিংহাসন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সাহায্যে পালিয়ে জনতার রুদ্ররােষ থেকে প্রাণ রক্ষা করলেন। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সাহায্যে সেনাপতি জেনারেল জায়েদি শেষ পর্যন্ত মােসাদ্দেককে দমন করে অন্তরীণ করে রেখেছেন।
জেনেভা ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। ওখানে অনেকেই জানাশােনা—দেশি, বিদেশি এবং স্থানীয়। তা ছাড়া সুইজারল্যান্ডের প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। স্বাভাবিক হ্রদ, সুন্দর পাহাড়ের ছায়া, বৈদ্যুতিক রেলগাড়িতে ও রজ্জুতে ঝােলানাে চেয়ারে বসে পাহাড়ের পর পাহাড় ঘুরে—আবার সন্ধ্যায়। রবসপিয়ারের সমাধি দ্বীপে বসে জালালি কবুতরগুলােকে গম ছিটিয়ে মজা করে খেতে দেখে দিন কাটছিল যদিও সুইসবাসীর পয়সার লােভ ওই আনন্দটাকে মাটি করে দিত। অমন একটি দেশ থেকে বিপদসংকুল দেশে যেতে খুব ভালাে লাগার কথা নয়।
তারপর একদিন রােম হয়ে কায়রাে এলাম। এসে বুঝলাম, না আসাই ভালাে ছিল। চারদিকে তখনাে সৈনিকদের পাহারা-বন্দুক নিয়ে রাস্তায় ‘প্যারেড। কোনাে রকমে গিজার পিরামিড এবং কয়েকটি স্ফিংক্স দেখে দেশের পথে যাত্রা। করাচি এসেও মনে হলাে না দেশে এসেছি। যদিও সেখানে অনেক বন্ধুবান্ধব বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। কেমন যেন এবার মনে হলাে করাচি মধ্যপ্রাচ্যের অংশ, মরুভূমি, উট, দুম্বা, চেহারা সবই যেন মধ্যপ্রাচ্যের। বাংলাদেশের লােকের পক্ষে তাদের সঙ্গে একাত্মবােধ হওয়ার মধ্যে প্রাকৃতিক বাধা রয়েছে।
দেশে এসেই শুনলাম সাধারণ নির্বাচনের আলােচনা শুরু হয়ে গেছে। বৃদ্ধ ফজলুল হক সাহেব সরকারের অ্যাডভােকেট জেনারেল পদে ইস্তফা দিয়ে মুসলিম লীগে যােগ দিয়েছেন। সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী সাহেব তাঁদের আওয়ামী মুসলিম লীগকে সজাগ করে তুলছেন। আবুল হাশিম সাহেবও তাঁর সেই দুর্দিনে নির্বাচনের কথা ভাবছেন। সাধারণ নির্বাচনের মুখে মওলানা আকরম খাঁ পদত্যাগ করলেন। অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভা ডাকা হলাে তার পদত্যাগপত্র বিবেচনা করার জন্য। মােহন। মিঞা ও হামিদুল হক চৌধুরী ফজলুল হক সাহেবকে সভাপতি করতে চাইলেন। সভায় আকরম খাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হলাে আর মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন সাহেবের নাম ফকির আবদুল মান্নান সাহেব প্রস্তাব করলেন। ফজলুল হক সাহেব তাঁর দলের অবস্থা দেখে পদত্যাগ করেন। পরে তাঁর বাড়িতে
৩৩৬
বসে নতুন পাটি গঠন করার প্রস্তাব করেন এবং তার পুরােনাে কৃষক-প্রজা। পার্টি পুনর্গঠিত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মােহন মিঞা ও হামিদুল হক চৌধুরী মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করে হক সাহেবের সঙ্গে যােগদান করেন। মােহন মিঞা ভালাে সংগঠক আর হামিদুল হকের শক্তি, তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি ছাড়াও তাঁর ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার হক সাহেবের শক্তি বৃদ্ধি করল। মুসলিম লীগের সংবাদপত্র রইল খাজা নূরুদ্দীনের মর্নিং নিউজ। আর মােহন মিঞার কাগজ দৈনিক মিল্লাত। দৈনিক মিল্লাত-এর সম্পাদক প্রথমে মােতাহার হােসেন সিদ্দিকী এবং পরে হন কবি ও সাহিত্যিক মরহুম সিকান্দার আবু জাফর। দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদক খায়রুল কবির, নূরুল আমীন সাহেবের আত্মীয়–অর্থের জোগাড় করলেন রেজাই করিম সাহেব। তার মাথার ওপর তখন খড়গ ঝুলছে—বর্মা রিফিউজি ক্যাম্পের টাকা আত্মসাতের অপরাধে ধাবলে ট্রাইব্যুনাল তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে তিন বছর জেল ও পঁয়তাল্লিশ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। তাঁর ভাগ্য ভালাে। তখনই পাকিস্তান হয়ে গেল এবং তিনি তাঁর পিতা ও ভ্রাতাদেরসহ ঢাকায় পালিয়ে আসেন। এসেই চট্টগ্রামের মুনসিফ ইউসুফ সাহেবের আদালতে একটি ডিক্লারেটরি সুট করে এক রায় পেয়ে যান যে ‘বিদেশি কোর্টের রায় তাঁর ওপর জারি করা যাবে না। সে রায়ের বিরুদ্ধে। সরকারের পক্ষ থেকে যাতে আপিল না হয়—তার জন্য দিনরাত তিনি নূরুল আমীন সাহেবের বাসায় থাকেন। নূরুল আমীন সাহেবও সুযােগ বুঝে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সংবাদ-এর জন্য একটা খুব মােটা অর্থ চাঁদা দিতে বলেন। রেজাই করিম সাহেব রাজি হয়ে গেলেন। খায়রুল কবির (পরবর্তীকালে জনতা ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর) সাহেবকে সাহায্য করতে এলেন অবজারভার থেকে সর্বজনাব জহুর হােসেন (রায়পন্থী) আর কে জি মুস্তাফা (সাম্যবাদী ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রদূত)।
এদিক থেকে আওয়ামী লীগের অবস্থা বেশি ভালাে নয়—একখানা সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া সাহেব। শহীদ সাহেব প্রচেষ্টা চালিয়েছেন নির্বাচনের আগে ইত্তেফাককে দৈনিকে পরিবর্তিত করতে।
এখানে মুসলিম লীগবিরােধী দলসমূহের নেতাদের বিশ্লেষণ প্রয়ােজন। তার আগে আর একটু পেছনে যেতে হয়। আমি মধ্যবিত্ত শব্দটি ব্যবহার করে যাচ্ছি—কিন্তু তার একটা ঐতিহাসিক পর্যালােচনা করা হয়নি। সে জন্য মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটভূমি আলােচনা করা প্রয়ােজন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার সঙ্গে সংযুক্ত থেকে কলকাতার অনেক সাধারণ লােক অজস্র টাকা উপার্জন করে দেশ-বিদেশে খ্যাতি লাভ করেন। উদাহরণস্বরূপ নাম করা যায় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। যিনি কোম্পানির
৩৩৭
‘এজেন্সি’ নিয়ে কেবল ধনী হননি, নতুন সামন্তবাদ সৃষ্টি করেন এবং ওই মুৎসুদ্দি শ্রেণির স্বার্থেই ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসােসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরাই কলকাতার প্রথম মধ্যবিত্ত। জাতিতে হিন্দু—প্রথম ভদ্রলােক শ্রেণি। ভদ্রলােক শ্রেণিতে স্থান কেবল ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যদের। ব্রাহ্মণ হিন্দু সমাজের মাথার মণিকায়স্থের কাজ লেখা। কেরানি থেকে উকিল, মােক্তার, ব্যারিস্টার, কোম্পানির গােমস্তা পর্যন্ত। বৈদ্য সাধারণত ডাক্তার, তবে কায়স্থের কাজ করতে বাধা নেই। এই তিনে মিলে ‘ভদ্রলােক’ শ্রেণি । এদের মতে, অন্য কোনাে লােক ভদ্রলােক বলে দাবি করতে পারে না। এরা কোম্পানির সৃষ্টি এবং লর্ড মেকলের ভাষায় ভদ্রলােক অর্থেই ক্লার্ক’। এরা কলকাতার নাগরিক বা শহুরে। গাঁয়ের সঙ্গে এদের কোনাে সম্পর্ক ছিল না। এ শ্রেণির মধ্যে স্বাভাবিক কারণেই যখন লােকসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল, তখন ভদ্রলােকদের দৃষ্টি পড়ল গ্রামের সম্পদের ওপর । ফলে জাগল জমিদারি করার আকাঙ্ক্ষা।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসােসিয়েশন তাল সামলাতে পারছিল না। তারপর এল পাবনা জেলায় কৃষক বিদ্রোহ-খাজনা বন্ধের আন্দোলন। সুরেন ব্যানার্জি ভদ্রলােকদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসােসিয়েশন থেকে বেরিয়ে ইন্ডিয়া অ্যাসােসিয়েশন গঠন করে গ্রামভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তােলেন। ১৯৮৫ সালে বেঙ্গল টেনেনসি আইন পাস হলাে। প্রজারা অন্তত বুঝতে পারল যে সমাজে তাদের স্থান কত দূর এবং কোথায় সে সীমানা টানা হয়েছে। তিনি পূর্ববঙ্গের মফস্বল শহরে এসে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা আরম্ভ করেন। জনতার সে সভায় দুস্থ মানুষের সম্বন্ধে দু-একটি ভালাে কথা বলেই শহুরে ভদ্রলােকদের সমস্যা যেন জনতার বিশেষ সমস্যা, তাই বুঝিয়ে যেতেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল সাংবাদিকের স্বাধীনতা, পরিষদের দেশীয় প্রতিনিধির স্থান করা, আমলাদের গঠনপদ্ধতি নতুন করে সাজানাে, যাতে দেশি লােক শাসনকার্যের কাঠামােতে কর্তৃত্ব করতে পারে। তার বক্তৃতার শেষ কথা যে জনতার সমস্যার সমাধান—এসব না হওয়া পর্যন্ত করা যাবে না। কিন্তু এগুলাে ভদ্রলােকদের সমস্যা আর সে জন্য শক্তি সঞ্চয় করার অস্ত্র ওই জনতা। এমনি করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশনের শাসনতান্ত্রিক শুকনাে প্রস্তাবসমূহ থেকে তাঁর পন্থা অনেক প্রগতিশীল পদক্ষেপ। শহুরে মানুষের স্বার্থে জনগণের শক্তি জাগিয়ে তুলে তিনি ভবিষ্যতে জনগণকে সমস্যাসচেতন করে তুলতে সাহায্য করলেন।
ঠিক ওই যুগেই জনাব ফজলুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাই প্রথম জীবনে সরকারি চাকরি গ্রহণ করে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সরকারি চাকুরে হয়েও রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়তে
৩৩৮
থাকেন। পথ ও পদ্ধতিতে সুরেন ব্যানার্জির। গাঁয়ের কৃষককে নতুন শহরের মুসলমানদের সমস্যার সঙ্গে একাত্ম করে শক্তি সঞ্চয় করা। শহরের নতুন মুসলমান উকিল, শিক্ষক, সাংবাদিক এবং চাকরিজীবীদের ‘ভদ্রলােকের’ আসনে সমাসীন করা। ওই ভিত্তিতেই তাঁর কৃষক-প্রজা আন্দোলন। ব্রিটিশের কারখানায় তৈরি নবাব, নাইট, খানবাহাদুরদের নেতৃত্বের তুলনা করা যায় এক পুরুষ আগে হিন্দু মুৎসুদ্দিদের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশনের। আর ফজলুল হক সাহেবের প্রজা পার্টির তুলনা করা যায় সুরেন ব্যানার্জির ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশনের। সুরেনবাবু ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে যে ক্ষমতা দেশের লােকদের জন্য চাইতেন, ফজলুল হক সাহেব হিন্দু ভদ্রলােকদের কাছ থেকে তাই মুসলমানদের জন্য চাইতেন। মুসলমানদের জন্য বেশি আসন, বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা, মুসলমানদের জন্য চাকরি ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ আর তার সঙ্গে প্রজাদের জন্য সুবিধা আদায়। তিনি প্রজাদের জন্য কী করেছেন তার চেয়ে তিনি কী দাবি করেছেন, সেটাই বিবেচ্য। যেমন ১৯৩৭ সালে ক্ষমতায় আসার আগেই খাজা নাজিমুদ্দিন ফ্রি প্রাইমারি এডুকেশন বিল (Free Primary Education Bill), prauitat pa (Bengal Agricultural Debtors Act) পাস করেন। কিন্তু বাংলার জনগণের কাছে ওই সব আইন হক সাহেবের। হক সাহেবই এসবের জন্য প্রশংসার পাত্র। যে-ই ইসলামিয়া কলেজ করে থাকুক, সাখাওয়াত মেমােরিয়াল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যার প্রচেষ্টায়ই হােক না কেন, গ্রামবাংলার জনগণের সব প্রশংসাই হক সাহেবের প্রাপ্য, কারণ হক সাহেবই মুসলমানদের শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তার কথা ঘরে ঘরে পৌছে দিয়েছিলেন। হক সাহেব একাই নিপীড়িত, শােষিত গ্রামবাংলার প্রতিনিধি। তিনি শহরের শিক্ষিত মুসলমানদের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছেন জনগণের পৃষ্ঠপােষকতা নিয়ে। এখানেই সুরেন ব্যানার্জি ও হক সাহেবের নেতৃত্বের বিশেষত্ব।
মধ্যবিত্ত ভদ্রলােক বলতে আমাদের সমাজে যারা শহরে কাজ করে, যেমন শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, কেরানি, ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কর্মচারী, অফিসের কর্মচারী, উকিল বা ডাক্তারদের বােঝায়। এরা কাজের চেয়ে কথা বলে বেশি, রাজা-উজির মারে চা-খানায়। রাজনীতির আলােচনা করে এবং রাজনীতিতে যারা পারে অংশগ্রহণ করে, যারা সংসারের চাপে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না, তারা রাজনীতিবিদদের কুৎসা করে সময় কাটায়। সবার বিরুদ্ধে তাদের অভিযােগ। তারা অবশ্যই শহরের কারখানার শ্রমিক বা মেহনতি লােককে গাঁয়ের মেহনতি লােকের সঙ্গে একপর্যায়ে ফেলে রাখে। গাড়ির চালক, ওয়ার্কশপের বড় মিস্ত্রি এরা যত টাকাই উপার্জন করুক না কেন, তারা মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে—তাদের
৩৩৯
নিম্নমধ্যবিত্ত বলে মানতেও উপরিউক্ত স্কুল-কলেজে পড়া স্বল্প বেতনভােগী লােকেরা নারাজ। যদিও তাদের বিত্তহীনও তারা বলতে পারে না। অন্যদিকে ওই মধ্যবিত্তের মধ্যে কেউ যদি মন্ত্রী, হাইকোর্ট জজ, রাষ্ট্রদূত, সুরিপিয়র সার্ভিসের লােক, দেশরক্ষা বিভাগের উপরস্থ কর্মচারী, মিল বা ফার্মের মালিক হয়, তখনই সে উচ্চমধ্যবিত্তের আসনে সমাসীন হয়—অবশ্যই তাদের লেখাপড়া জানতে হবে। আর যেইমাত্র সে আসনে বসা, অমনি তারা মধ্যবিত্তের কুৎসার পাত্র হয়ে ওঠে।
১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পরে সত্যি কোনাে স্থিতিশীল মধ্যবিত্ত গড়ে উঠেছে কি না এবং তারা কোন পটভূমি থেকে এসেছে, তা এখনাে সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয়নি। বিত্তহীন দিনমজুরি করে জমির মালিক হয়ে হাল কিনে কৃষক হয়েই সে বিত্তহীনের পর্যায় থেকে ওপরে উঠেছে—ছেলে স্কুলের পড়া শেষে শহরে চাকরি পেয়ে হয়ে গেছে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি আর সেখান থেকে কিছুটা উপরে উঠতে পারলেই মধ্যবিত্ত। এমনি করেই উচ্চমধ্যবিত্তের জন্মও হতে পারে—অবশ্য শহরের বাসিন্দা হতে হবে—গাঁয়ে থাকলে উচ্চমধ্যবিত্তের আসন পায় না। আবার এদেরই সন্তানসন্ততি সাধারণ মধ্যবিত্ত হয়ে—কেউবা সর্বস্বান্ত হয়ে—সর্বহারার দলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মধ্যবিত্তের রাজনীতি তাই সদা পরিবর্তনশীল এবং সে কারণেই সমাজে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার অভাব দেখা দেয়—কেউ কঠিন পরিশ্রম করে জীবনযাপন করতে বড় একটা চায় না। আবার অসৎ উপায়ে উপার্জনের টাকার সঙ্গে ছয়টি রিপুর তাড়নায় তাদের চিত্ত অস্থির হয়ে ওঠে। তারা ক্রমাগতই কাম, ক্রোধ, লােভ, মােহ, মদ ও মাৎসর্যের ফাঁদে পড়ে। পার্টি ও রিসেপশনে, বিশেষ করে বিদেশিদের ইন্দ্রজালে ও সৌন্দর্যের ঝলমল আবহাওয়ায় জড়িয়ে পড়তে চায়। তারা হুইস্কি, শ্যাম্পেন, কোনিয়াকের ভক্ত হয়ে ওঠে এবং যে হারে তাদের চরিত্রের পতন হয়, সে হারেই জীবনের দূষিত মান রক্ষা করার জন্য অন্ধকার পথে পয়সার জন্য পা বাড়িয়ে দেয়। এসব মধ্যবিত্তের স্বার্থেই এখন পর্যন্ত আমাদের নেতৃত্বের উৎপত্তি। তাই ক্ষমতা গ্রহণ করার পর যাদের উপকার করার জন্য নির্বাচন চালানাে হয়েছিল, তাদের কথা ভুলে শুধু নিজেদের কথাই ভেবে মরে। অবশ্যই এটা যে কেবল আমাদের দেশের জন্যই সত্য, তা নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। অ্যানুরিন বিভান বলেছেন : নির্বাচনের সময়ই কেবল দেশের দরিদ্র শ্রেণি ‘এজেন্ডাভুক্ত হয়, নির্বাচনের শেষে ওই এজেন্ডা’ আবার পাঁচ বছরের জন্য ‘পােস্টপন্ড করা হয়ে থাকে। বামপন্থীদের মধ্যে মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব সাম্রাজ্যবাদের সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য শাসনকাঠামাে ঠিক রাখার জন্য।
৩৪০
নেতাদের মধ্যে হক সাহেবেরই বাংলার মানুষের চেহারা ও নাম মনে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। যার সঙ্গে তিনি কিছুদিনও কাজ করেছেন, অনেক বছর পরেও তাকে নাম ধরে ডেকে কাছে বসাতে অসুবিধা হয়নি। ফলে সবাই তাঁর স্নেহে মুগ্ধ হতাে এবং তাঁকে আত্মীয় বলে ভাবতে অসুবিধা হতাে না। অন্য পক্ষে সােহরাওয়ার্দী সাহেব সারা বাংলায় প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল রাজনীতি করেও পাঁচ শ লােকের নাম মনে রাখতে পারেননি। ফলে তাঁর কাছ থেকে সাধারণ লােকেরা কোনাে স্নেহের বা অন্তরের স্পর্শ পায়নি কেবল কয়েক শ লােক ছাড়া। ফলে তাঁকে নির্ভর করতে হয়েছে বিশেষ শিষ্যদের ওপর, যা কতকটা বিশেষ ধরনের এজেন্সি সিস্টেমের মতাে। তাই ফজলুল হক সাহেব। যেকোনাে প্ল্যাটফর্ম’ পেলেই ওটাকে নিজস্ব করে নিতে পারতেন। শহীদ সাহেবের জন্য প্রয়ােজন হতাে তাঁর বিশেষ শিষ্যদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান—সেটা মুসলিম লীগই হােক বা আওয়ামী লীগই হােক। এদিক দিয়ে ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মিল শহীদ সাহেবের তুলনায় অনেক বেশি। আবুল হাশিম সাহেবের ক্ষমতা দখলের পদ্ধতি অনেকটা অন্য ধরনের। তিনি রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে চাইতেন নিজস্ব পার্টি, যাদের থাকবে একটা আদর্শ, যারা হবে নিঃস্বার্থ কর্মী এবং বিশেষ কয়েকজন সর্বক্ষণের কর্মী। তাদের খরচ পার্টি বহন করবে। এটা অনেকটা লেনিনের বলশেভিক পার্টি থেকে বােধ হয় ধার করা। তিনি ১৯৪৪ সালে রাজনীতি ক্ষেত্রে ওই পথেই দুবছরের মধ্যে সারা বাংলার একচ্ছত্র নেতা হতে পেরেছিলেন। বিরােধী দলসমূহের চারজন নেতার মধ্যে এক আবুল হাশিম সাহেব ছাড়া আর কারও রাজনীতি ক্ষেত্রে কোনাে আদর্শ ছিল না বা কারও সামাজিক বা রাজনৈতিক তত্ত্বজ্ঞানও ছিল না, তবে অনেক কারণে তাঁর রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত স্বল্পায়ু হয়েছিল বাকি তিনজনের তুলনায়।
১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে বামপন্থী ছাত্ররা এবং যুব সম্প্রদায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। সেই ছাত্ররা নির্বাচনের আগে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি ‘যুক্তফ্রন্ট গঠন করার জন্য আন্দোলন। চালালেন। ফজলুল হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী যথাক্রমে কৃষক-প্রজা পার্টি ও আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি একটি ‘যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে রাজি হলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরােধিতা করছিলেন। শহীদ সাহেব ঢাকায় এলেন এবং তিনিও যুক্তফ্রন্টের বিরােধিতা করলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বামপন্থীরা ও হামিদুল হক, মােহন মিঞা, আবদুস সালাম খান প্রমুখ কৃষক-প্রজা ও আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা যুক্তফ্রন্ট গঠনের ওপর জোর দিলেন—শেষ।
৩৪১
পর্যন্ত শহীদ সাহেব ও শেখ মুজিবুর রহমান রাজি হলেন এবং হক সাহেব ও মওলানা সাহেব ‘যুক্তফ্রন্ট’ চুক্তিটি সই করেন। শহীদ সাহেব বললেন যে দুটো প্রতিষ্ঠানের সভাপতিরা যখন সই করেছেন, তখন আর কোনাে সইয়ের প্রয়ােজন নেই। যুক্তফ্রন্ট’ শেখ সাহেবের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফরিদপুরের যে নেতাদের তিনি স্থানীয় রাজনীতি ক্ষেত্র থেকে প্রায় বহিষ্কার করে ফেলেছিলেন, তারাই আবার প্রাদেশিক রাজনীতিতে যুক্তফ্রন্টের বদৌলতে নেতা হয়ে বসলেন।
শেখ সাহেব জনাব হক সাহেবের মতােই তাঁর কর্মীদের সবার নাম মনে রাখতে পারতেন এবং হক সাহেবের মতােই তাঁর দলের সবার সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিবেশ গড়ে তুলতে পারতেন। হক সাহেবের মতােই শেখ সাহেব খাটি বাঙালি পরিবেশে বেশি আনন্দ পেতেন—আবার হক সাহেবের মতােই তাঁর পূর্ববর্তীরা বা সমসাময়িক নেতারা দেশবাসীর স্বার্থে যে কাজটুকু করেছেন, তার সম্পূর্ণ প্রশংসার অধিকারী হতে পারতেন। তাদের দুজনের এ ধারণা ছিল যে স্যার আবদুর রহিম ইসলামিয়া কলেজের জন্য বা নাজিমুদ্দিন শিক্ষকদের বা কৃষকদের জন্য কী করেছেন, তা কাগজে বা সরকারি দলিল-দস্তাবেজে যাই থাকুক, দেশের শতকরা নব্বইজন নিরক্ষর লােকের কাছে সেসব কাজ কার দান বলে পৌছেছে সেটাই বড় কথা। শেখ সাহেব ফজলুল হক সাহেবের মতােই সাধারণ বাঙালির তুলনায় দীর্ঘ দেহের এবং ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন—সত্যি বলতে তারা দুজনই দক্ষিণ বাংলার লােক এবং অনেক ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে মিল ছিল।
শেখ সাহেব অন্যদিকে শহীদ সাহেবের মতােই সংগঠনকে শক্তিশালী করে ক্ষমতা দখল করার পক্ষপাতী ছিলেন এবং যাতে তাঁর নিজস্ব লােকের নেতৃত্বে সে সংগঠন গঠিত হয়, তার দিকে লক্ষ রাখতেন। শহীদ সাহেব রাজনৈতিক মঞ্চ ও রঙ্গমঞ্চের মধ্যে কোনাে তফাত আছে বলে মনে করতেন না—মঞ্চের অভিনেতা যেমন সব সময় স্মরণ রাখে যে সবার দৃষ্টি রয়েছে তার প্রতি, তেমনিভাবে রাজনৈতিক নেতা শহীদ সাহেব রাজনীতি ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতেন যে তাঁর দিকে সবার দৃষ্টি আছে কি না। তাই চলাফেরায়, কথাবার্তায়, বক্তৃতা মঞ্চে তিনি ছিলেন অভিনেতা, এখানে নেতা এবং অভিনেতার মধ্যে কোনাে প্রভেদ নেই। কেবল যখন ক্ষমতায় আসতেন, তখন কঠিন মানুষ হতেন—শেখ সাহেবও তাঁর কাছ থেকে অভিনয়ের ভাবভঙ্গি আয়ত্ত করাকে প্রয়ােজন মনে। করতেন। তারপর শেখ সাহেব আবুল হাশিম সাহেবের কাছ থেকে শিখেছিলেন সংগঠনের মধ্যে তার প্রতি সম্পূর্ণভাবে অনুগত এবং আস্থাশীল দল গড়ে তােলা এবং তাঁদের নেতৃত্বে সংগঠনকে সংহত করা। তারপর শহীদ সাহেবের পদ্ধতি অনুসারে একেবারে নিজস্ব এজেন্ট সৃষ্টি করে তাদের
৩৪২
কথামতােই রাজনীতি পরিচালনা করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া। তবে শহীদ সাহেব তার আত্মীয়স্বজনকে রাজনীতির মধ্যে কোনাে দিন স্থান দেননি, শেখ সাহেব এ ব্যাপারে জনাব হক সাহেবকে অনুসরণ করেছেন। শেখ সাহেব শহীদ সাহেবের শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। কারণ, শহীদ সাহেব সংগঠনের সকল প্রকার অর্থের প্রয়ােজন মেটাতেন। কিন্তু তিনি হক সাহেব, শহীদ সাহেব বা আবুল হাশিম সাহেবের মতাে লেখাপড়ার দিকে খেয়াল না করায় তাদের গুণাবলির উত্তরাধিকারী হননি। আমার জানামতে, জেলজীবনে রবীন্দ্রনাথের কবিতাই ছিল তার একমাত্র নিত্য সহচর।
যুক্তফ্রন্ট গঠন করার পর বড় সমস্যা হলাে সেক্রেটারিয়েট কীভাবে গঠন করা হবে। কোনাে পার্টি কোনাে পার্টিকে বিশ্বাস করে না—সুতরাং দুজন যুগ্ন সম্পাদক নিযুক্ত করা হলাে—কৃষক-প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে জনাব কফিলুদ্দীন চৌধুরী ও আওয়ামী লীগ পার্টির পক্ষ থেকে জনাব আতাউর রহমান খান। সাহেব। কিন্তু এভাবে সেক্রেটারিয়েট চালনা করা সম্ভব নয়, তাই শহীদ সাহেব ও হক সাহেব আমাকে ডেকে বললেন যে আমি সেক্রেটারিয়েটের ভার নিতে পারি কি না। কারণ, আমি দুটোর কোনাে পার্টিরই সদস্য নই। আমি শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম, যদিও কাজটি ছিল দুরূহ। আমরা নভেম্বর মাসে সদরঘাট সিম্পসন রােডে অফিস খুলে বসলাম। আমার একার পক্ষে যেহেতু অত বড় অফিস চালানাে অসম্ভব হয়ে উঠছিল, সে জন্য জমিরুদ্দীন সাহেবকে (তখন তিনি আতাউর রহমান সাহেবের জুনিয়র হিসেবে কাজ করছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের লােক কিন্তু ঢাকায় তাঁর চাকরিতে ‘অপসন’ দিয়ে পরে ওকালতি ব্যবসা আরম্ভ করেন) সহকারী সেক্রেটারি করে নেওয়া হলাে এবং হিসাব রক্ষার কাজ তাঁকে দেওয়া হলাে, কারণ ট্রেজারার আবদুস সাত্তার সাহেবের (অ্যাডভােকেট, পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং পরে জাস্টিস) পক্ষে সম্ভব ছিল না দৈনন্দিন হিসাব রক্ষা করা। কিন্তু এ খবর যখন কৃষক-প্রজা পার্টি অফিসে পৌছাল, তখন জমিরুদ্দীন সাহেব আওয়ামী লীগের লােক, সেই অজুহাতে সােলেমান সাহেবকে পাবলিসিটি সেক্রেটারি করে পাঠিয়ে দিলেন। একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হলাে মনােনয়ন দেওয়ার জন্য, তার চেয়ারম্যান করা হলাে শহীদ সাহেবকে এবং সমসংখ্যক প্রতিনিধি দুপক্ষ থেকে সেখানে স্থান পাবে বলে স্থির হলাে। একটি আপিল বাের্ড হলাে ফজলুল হক সাহেব, মওলানা ভাসানী ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে নিয়ে। অর্থাৎ ১৯৫৩ সালের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের সেক্রেটারিয়েটের কাঠামাে ঠিক হলাে।
ইত্তেফাককে দৈনিকে পরিণত করা হলাে এবং ইত্তেফাককে বলা হলাে যুক্তফ্রন্ট-এর মুখপত্র হিসেবে কাজ করতে। কারণ, জনাব তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) সাহেবও কোনাে পার্টির লােক ছিলেন না। মােহন মিঞার
৩৪৩
মিল্লাত ও হামিদুল হকের পাকিস্তান অবজারভার কৃষক-শ্রমিক পার্টির সদস্যদের কাগজ। সুতরাং তাঁদের কাগজকে যুক্তফ্রন্টের মুখপত্র বলে গ্রহণ করা যাচ্ছিল না। ইত্তেফাক আমার সই করা চিঠি, বিবৃতি বা নির্দেশই ছাপত, অন্য কোনাে বিশেষ নেতাদের নির্দেশ ছাপাত না। ফলে পর বৎসর নির্বাচনের আগে অনেক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি থেকে যুক্তফ্রন্ট রক্ষা পেয়েছে।

৩৪৪

——————————-