You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

ভাষা শহীদ আবদুস সালাম
শাহীদা আখতার

জীবন-কথা
জন্ম, জন্মস্থান ও পারিবারিক পরিচয়
ফেনী জেলার দাগনভূইয়া থানার মাতুভূইয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মণপুর একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম । গ্রামটির অবস্থান জেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলােমিটার পশ্চিমে ফেনী-মাইজদী সড়কের মাতুভূইয়া ব্রিজের কাছে। এই গ্রামেই ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর ভাষাশহীদ আবদুস সালাম জন্মগ্রহণ করেন ।
সালামের পিতার নাম মুনশি আবদুল ফাজেল মিয়া এবং মায়ের নাম দৌলতের নেছা। সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান ফাজেল মিয়ার পিতাও ছিলেন কৃষিজীবী। সামান্য জমি ও বর্গা চাষাবাদ করে অভাব-অনটনের মধ্যেই ফাজেল মিয়া সংসার চালাতেন । তিনি কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়াশােনা করেন, তাই গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে খতম পড়ানাে এবং কোরান তেলাওয়াতের কাজ করতেন। এ কারণে সবার কাছে তিনি মুনশি হিসেবে পরিচিত হন। এ ছাড়া স্থানীয় লােকজন তাকে ফাজিল মিয়া বলে সম্বােধন করত। –
সালামের প্রতিবেশী ও আত্মীয় ফেনীর মুক্তিযােদ্ধা নূর আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’-এ । তখন তাঁর বয়স ৭৯ বছর। সালামকে তিনি কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সালামের পিতা মুনশি আবদুল ফাজেল মিয়া সৈনিক হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যােগ দেন এবং তার কর্মস্থল ছিল ইরাকের বসরা। এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি তথ্য দিতে পারেন নি নূর। আহমদ। আবদুল ফাজেল মিয়ার চার পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে সালাম ছিলেন সবার বড় ।
বর্তমানে সালামের ভাইবােনদের মধ্যে জীবিত আছেন তাঁর ছােট ভাই আবদুল করিম। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন এবং সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার এক ছেলে ও তিন মেয়ে । সালামের পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আছেন তার ভাই সাহাবউদ্দীনের একটি মেয়ে, আবদুস সােবহানের স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলে, বোেন কুরফুলের নেসার দুই ছেলে, এক মেয়ে এবং বােন বলকিয়তের নেসার এক ছেলে, এক মেয়ে । সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানা যায় যে, আবদুল করিম সালামের ব্যাপারে কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না। এমনকি সেনাবাহিনীতে নিয়ােজিত থাকার সময় কখনাে কাউকে

জানতে দেন নি, তিনি যে সালামের ভাই। এর কারণ, ভাষাশহীদের পরিবার হিসেবে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কেউ কখনাে তাদের খোঁজখবর নেন নি । ১৯৫২ সালে শহীদ হওয়ার আগে পর্যন্ত সালামই ছিলেন তাঁর পিতার একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান। তার মৃত্যুর পর পরিবারটি বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একজন শহীদের পিতা হিসেবে ফাজেল মিয়া বিশেষ কোনাে সম্মান বা আর্থিক সাহায্য পান নি । অভাব-অনটনের মধ্যেই তার জীবন কেটে গেছে। অনেকটা অভিমান ও কষ্ট থেকেই করিম এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। তদুপরি ভাষাশহীদের পরিবার হিসেবে সালামের পরিবারের সদস্যগণ কখনাে নিজেদের জনসমক্ষে জাহির করে কোনাে রকম সুযােগ-সুবিধা নিতে চান নি । করিমকে প্রশ্ন করে জানা যায় যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তার বয়স ছিল ৬ বছর। তার সাক্ষাৎকার থেকে আরও জানা যায়, সবার বড় হিসেবে সালাম পিতামাতার প্রিয় সন্তান ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক ছিল। এসব কথা তিনি তাঁর পিতার কাছে শুনেছেন। ১৯৫৬ সাল থেকে তাঁর পিতা পাকিস্তান সরকারের নিকট থেকে প্রতি মাসে ভাতা হিসেবে কিছু টাকা পেতেন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭৬ সালে সালামের পিতা মুনশি আবদুল ফাজেল মিয়া মারা যান। তারপর একে একে ১৯৮২ সালে মা দৌলতের নেছা, ভাই সাহাবউদ্দীন, ১৯৯৯ সালে বােন কুরফুলের নেসা, ২০০২ সালে ভাই আবদুস সােবহান এবং ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি ছােট বােন বলকিয়তের নেসা মারা যান।
যে ঘরটিতে সালাম জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর স্মৃতিবিজড়িত সেই ঘরটি এখন নেই। সে স্থানে আবদুল করিম একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে নাম দিয়েছেন “সালাম ভবন” ।
শৈশব, শিক্ষা ও কর্মজীবন ভাষাশহীদ আবদুস সালামের শৈশব অতিবাহিত হয় জন্মস্থান লক্ষ্মণপুর গ্রামে। তার জ্যেঠতুতাে ভাই মাহমুদুর রহমানের বর্ণনা অনুযায়ী সালাম ছিলেন একহারা লম্বাটে গড়নের। গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা। আবদুস সালামের শিক্ষাজীবন আরম্ভ হয় লক্ষ্মণপুরের কৃষ্ণরামপুর প্রাইমারি স্কুলে । লেখাপড়ায় তিনি ভালােই ছিলেন । পাশাপাশি খেলাধুলায়ও আগ্রহী ছিলেন। স্কুলের বিভিন্ন খেলার প্রতিযােগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করতেন ।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর সালাম ভর্তি হন আতাতুর্ক হাই স্কুলে। বর্তমানে স্কুলটির নাম দাগনভূঁইয়া আতাতুর্ক মডেল হাই স্কুল । সালামের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ৩ কিলােমিটার। তিনি নিয়মিত হেঁটে স্কুলে যেতেন এবং কখনাে ক্লাশে ফাঁকি দিতেন না। তাই শিক্ষকদেরও প্রিয় ছাত্র ছিলেন। কিন্তু দশম শ্রেণিতে ওঠার পর আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।

সালাম শান্ত স্বভাবের এবং দায়িত্বশীল মানুষ ছিলেন। লেখাপড়া শেষে নিজে রােজগার করে সংসারের দৈন্যদশা লাঘবের স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু অভাবের কারণে পড়াশােনা করতে না পারায় তার মনে খুব কষ্ট ছিল । তাই বাড়ির কাউকে না জানিয়ে একদিন গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে কলকাতা চলে যান জীবিকার সন্ধানে । সেখানে তাঁর জ্যেঠতুতাে বােনের স্বামী আবদুল কাদের বাস করতেন মেটিয়াবুরুজ এলাকায় এবং কলকাতা বন্দরে কাজ করতেন । সালাম তার আশ্রয়ে ছিলেন। জানা যায় যে, আবদুল কাদের তাকে একটি কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন। আবদুল করিমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সালাম প্রায় পাঁচ বছর কলকাতায় ছিলেন। সেখান থেকে তিনি নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। তার ছােট বােন বলকিয়তের নেসার স্বামী সানু মিয়াও তাঁর সঙ্গে কলকাতা পাের্টে কাজ করতেন এবং তারা একই জায়গায় থাকতেন।
তবে যে স্বপ্ন নিয়ে সালাম কলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন, তা সফল করার সুযােগ খুব বেশি পান নি। কারণ সে সময় কলকাতার পরিস্থিতিও তাঁর অনুকূলে ছিল না। একদিকে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, অন্যদিকে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন ও ভারতবিভাগ সব মিলে তাঁর পক্ষে আর কলকাতায় থাকা সম্ভব হলাে না। ১৯৪৭ সালে ভারতবিভাগের পরপরই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে সালামকে চলে আসতে হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে । কিছুদিন বাড়িতে থাকার পর তিনি ঢাকায় এসে চাকরির চেষ্টা করেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই মিন্টো রােডে অবস্থিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প দপ্তরে রেকর্ড কিপারের পদে যােগ দেন। জানা যায়, চাকরি পেয়ে সালাম নিয়মিত বাড়িতে টাকা পাঠাতেন এবং পরিবারের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন । বাড়িতে গেলে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করতেন। তিনি ঢাকার আজিমপুর অঞ্চলে একটি মেসে থাকতেন। এটি নীলক্ষেত ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল ।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
বাঙালির আত্মচেতনা ও স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে প্রথম সােচ্চার প্রতিবাদ বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে পরিচালিত হয় অন্যান্য আন্দোলন এবং সবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
মূলত ১৯৪৭ সালে ভারতবিভাগের অব্যবহিত পর থেকেই নবগঠিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র ও বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের অনুরূপ পদক্ষেপ হিসেবে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। সে সময় বাংলা ভাষার পক্ষের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । তিনি ড. জিয়াউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান এবং পাকিস্তানের ভাষাসমস্যা’ শিরােনামে একটি নিবন্ধ রচনা করেন। এতে তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন

যে, বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হলে বাঙালির জন্য তা হবে রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর। এ ধরনের পদক্ষেপকে তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতির পরিপন্থী হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেন ।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য সমকালীন পূর্ববাংলার সচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে শিক্ষিত সমাজকে অবহিত করার লক্ষ্যে তিনি নিবন্ধটি ইংরেজি ভাষায় ভারতের কমরেড পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট কমরেড পত্রিকায় প্রকাশিত সে প্রবন্ধের শিরােনাম ছিল : “The Language Problems of Pakistan’. সুতরাং লক্ষ করা যায় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই এ দেশের ভাষাসমস্যার সূত্রপাত এবং এ নিয়ে শিক্ষিত ও সচেতন বাঙালি সমাজে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে তৎকালীন শাসকগণ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে কেবল উর্দু ও ইংরেজিতে যাবতীয় কাজকর্ম চালু করেন । রাজনৈতিক দিক থেকে সে সময় পূর্বপাকিস্তানে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজমান ছিল । এরকম পরিস্থিতিতে কয়েকজন বাঙালি শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য একজোট হন। তারা ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তমদুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তােলেন। সংগঠন প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম । প্রাথমিক পর্যায়ে উক্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক ড. নূরুল হক ভূইয়া, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শামসুল আলম, এ.কে.এম, আহসান, কবি মােফাখখারুল ইসলাম, আবদুল খালেক, ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হুদা প্রমুখ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তমদুন মজলিস-এর নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ সংগঠনকে সমর্থন এবং সার্বিক সহযােগিতা করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, ড. কাজী মােতাহার হােসেন, কবি ফররুখ আহমদ এবং আরও অনেক সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ।
অন্যদিকে তৎকালীন পশ্চিমপাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সভায় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন । পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে থাকে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ স্বরূপ ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভার পরও মিছিল-প্রতিবাদ চলতে থাকে ।
ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার তমদুন মজলিসের প্রথম অফিস ছিল অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসভবন ১৯ নম্বর আজিমপুর । এ অফিসকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয় ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের যাবতীয় কর্মকাণ্ড । ভাষা আন্দোলনের চেতনায়

উদ্বুদ্ধ ছাত্র-জনতা এ অফিস থেকে প্রয়ােজনীয় দিক-নির্দেশনা নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে ভাষার দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তােলে। এ ছাড়া তমদুন মজলিসের নেতৃবৃন্দ সরকারের রাষ্ট্রভাষা নীতির বিপক্ষে প্রচারণার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নির্ভীক কর্মীদল গঠন করেন । তাই প্রাথমিক পর্যায়ে তমদুন মজলিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯ নম্বর আজিমপুরের অফিসটি অপেক্ষাকৃত দূরে হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে তৎকালীন আমতলার নিকট (বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের পূর্বদিকে) তমদুন মজলিসের অফিস স্থানান্তরিত হয় ১৯৪৭ সালের ১ নভেম্বর। রশিদ বিল্ডিং-এর অফিস থেকেই ক্রমশ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ অফিসেই ১৯৪৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ । এর আহ্বায়ক ছিলেন তমদুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া। তারপর থেকে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নেতৃবৃন্দ, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্ররা রশিদ বিল্ডিং-এ নিয়মিত সমবেত হতেন । কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তমদুন মজলিসের কার্যক্রমের ওপর সরকারি নজরদারি শুরু হয় এবং অচিরেই এর নগ্ন প্রকাশ ঘটে। ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি একদল সন্ত্রাসী তমদ্দুন মজলিসের অফিসে আক্রমণ চালিয়ে দরকারি কাগজপত্র নষ্ট করে। শুধু তাই নয়, তারা ভাষা আন্দোলনের কয়েকজন কর্মীকে মারধর করে। এক পর্যায়ে। অফিসটিতে পুলিশ তালা ঝুলিয়ে দেয়।
ক্ষমতাসীন সরকারের রােষানলের শিকার হওয়ায় তৎকালীন ফজলুল হক হলের ভিপি ও তমদুন মজলিস নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির অফিস ফজলুল হক হলে স্থানান্তরের প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব অনুসারে ১৯৪৮ সালের ২৫ জানুয়ারি ভাষা আন্দোলন অফিস ফজলুল হক হলে এবং তমদুন মজলিসের কেন্দ্রীয়। দফতর রশিদ বিল্ডিং থেকে পুনরায় অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসভবনে স্থানান্তর করা হয়। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অফিস ফজলুল হক হলে স্থানান্তরিত হলেও এর সাংগঠনিক কার্যক্রম, আয়-ব্যয় এবং সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্ব তমদুন মজলিসের কেন্দ্রীয় দফতরের নিয়ন্ত্রণে ছিল ।
ভাষা আন্দোলন অফিস ফজলুল হক হলে স্থানান্তরের পর থেকে এই হলই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম ক্ষেত্র। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সুযােগ সৃষ্টি হয়। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় রশিদ বিল্ডিং-এ এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ফজলুল হক হলে । এই হলেই তমদুন মজলিস এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভাষা আন্দোলনকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় । ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা চুক্তির পূর্বের সকল আলােচনা-পর্যালােচনা এবং যােগাযােগের মূল ক্ষেত্র ছিল ফজলুল হক হলের ভাষা আন্দোলন অফিস।

তমদুন মজলিসের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের সূচনার অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্যদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয় এবং গণপরিষদের কয়েকজন সদস্য বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সমর্থন করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত । ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু অথবা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবে সংশােধনী এনে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি দাবি জানান যে, তৎকালীন পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। ২৫ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে প্রস্তাবটি আলােচনায় আসে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন প্রস্তাবটির বিরােধিতা করলে দাবিটি স্পিকার কর্তৃক বাতিল হয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তমদুন মজলিস ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘট চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম হরতাল বা ধর্মঘট পালিত হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ । হরতাল কর্মসূচি সফল করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল থেকে । ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তারিখটি বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় মাইলফলক। গণপরিষদের ভাষার তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া ছাড়াও পাকিস্ত [নের মুদ্রা ও ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীতে নিয়ােগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে কেবল উর্দুকে রাখার প্রতিবাদ স্বরূপ সেদিন ঢাকা শহরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ মার্চের এই ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। এ আন্দোলন সেদিন গণআন্দোলনে পরিণত হয় । ধর্মঘটের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘােষণা করা। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে ধর্মঘটের পক্ষে রাজপথে মিছিল নামে। এই মিছিলে যারা অংশ নেন, তাঁদের মধ্যে শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও আবদুল ওয়াহেদ গ্রেপ্তার হন । মিছিলে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মতিন, আবদুল মালেক উকিল এবং বহু ছাত্রনেতা । সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক বিশাল সভা হয়। এক পর্যায়ে একজন পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার সময় পুলিশের আঘাতে মােহাম্মদ তােয়াহা গুরুতর আহত হন। এসব ঘটনার প্রতিবাদে ১২ থেকে ১৫ মার্চ আবারও ধর্মঘট পালিত হয়। এভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হতে থাকে ।

আন্দোলন জোরালাে হলে সরকারের মনােভাবের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন । কিন্তু চুক্তির বেশ কিছু শর্তের সঙ্গে একমত হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তিনি মেনে নিতে পারেন নি।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সর্বস্তরের বাঙালি যখন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে, সে সময় ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফর করেন । ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে তিনি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরালাে ভাষায় নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। জিন্নাহর বক্তব্যে ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েন। অতঃপর ২২ মার্চ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুক্তরাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির পক্ষে একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাত দফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন । কিন্তু মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং পাকিস্ত গনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষার দাবিকে অগ্রাহ্য করেন।
২৪ মার্চ কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে জিন্নাহ সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । সমাবর্তনে উপস্থিত ছাত্র ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ‘না’, ‘না’, বলে প্রতিবাদ জানান। এ প্রসঙ্গে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের কিছু অংশ নিম্নরূপ :
“ঢাকা ২৪ মার্চ। কায়েদে আজম জিন্নাহ গত সােমবার এখানে যে ধরনের বক্তৃতা দিয়েছেন আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও ঠিক সেই সুরেই বক্তৃতা করেছেন। … মি. জিন্নাহ যখন পুনরায় ঘােষণা করেন যে, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে আর কোনাে ভাষা নহে, তখন কতিপয় গ্রাজুয়েট, যাদেরকে কিছুক্ষণ পূর্বে ডিপ্লোমা প্রদান করা হয়েছে তারা ‘না’ ‘না’ বলে প্রতিবাদ করে উঠেন । ছাত্রদের মধ্য হতে এ অপ্রত্যাশিত প্রতিবাদে সমগ্র সভামণ্ডপের মধ্যে কিছুক্ষণ যাবৎ গুঞ্জন চলে । সমাবর্তনের পর কায়েদে আজম যখন সমাবর্তন মণ্ডপ ত্যাগ করেন, ছাত্ররা ওই সময়। “উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে আমরা রাষ্ট্রভাষা করতে চাই বলে চিৎকার করতে থাকেন।”
(সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫ মার্চ ১৯৪৮)

জিন্নাহর সমাবর্তন ভাষণের পর অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল পুনরায় তার সঙ্গে আলােচনায় বসেন। এ প্রতিনিধিদলে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দিন, নূরুল হক ভূঁইয়া, কামরুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, নূরুল হুদা এবং লিলি খান । কিন্তু জিন্নাহর একগুঁয়ে মনােভাবের কারণে এ আলােচনাও ফলপ্রসূ হয় নি ।
তমদুন মজলিসের নেতৃবৃন্দ ভাষার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের ওপর চাপ প্রয়ােগ করেন। ১৯৪৮ সালের ৩০ মার্চ

পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে পূর্বে সম্পাদিত রাষ্ট্রভাষা চুক্তি অনুযায়ী খাজা নাজিমউদ্দীনকে প্রয়ােজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য তমদুন মজলিসের নেতৃবৃন্দ অনুরােধ করেন। অবশেষে তিনি ৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশনে বাংলাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করার জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল প্রস্তাবটি সামান্য সংশােধনের পর গৃহীত হয় ।
পরবর্তী সময়ে দেখা যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে খাজা নাজিমউদ্দীনের প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট কোনােরূপ সুপারিশ পাঠানাে হয় নি। সরকারের ক্রমাগত অসহযােগিতার কারণে বাঙালির ভাষা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে । তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমউদ্দীন । দেশের রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থারও অবনতি ঘটতে থাকে । এর পরিণতিস্বরূপ এখানকার মানুষ মুসলিম লীগের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। এই পটভূমিতে ১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। এর ফলে বাঙালির ভাষা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যােগ হয়। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হয় দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ; যার আহ্বায়ক ছিলেন আবদুল মতিন।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে খাজা নাজিমউদ্দীন ঘােষণা করেন যে, “উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এ ঘােষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি ঢাকায়। প্রতিবাদ দিবস পালিত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির উদ্যোগে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় । ৩১ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই সভায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং এর আহ্বায়ক ছিলেন কাজী গােলাম মাহবুব ।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন যখন ব্যাপকভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, সরকারের পক্ষ থেকে তখন আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানাে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সমাবেশ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট, বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং ২১

ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল পালনের ঘােষণা দেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল কর্মসূচি বানচালের জন্য সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা, সমাবেশ ও মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে । এই পরিস্থিতিতে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় । ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কিনা এ নিয়ে আলােচনায় দ্বিমত দেখা দেয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এতে রাজী ছিলেন না। তবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে অবস্থান নেয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছে। পুলিশ মােতায়েন করা হয়। নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমবেত হয়। সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (মেডিকেল কলেজের একাংশে অবস্থিত) ছাত্রদের এক সভা হয়। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার অনুরােধ জানান। কিন্তু ছাত্র নেতাগণ নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল মতিন ও গাজীউল হক। ছাত্রদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের সমর্থন দেয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয় । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাত থেকে দশ জনের ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই শ্লোগান দিয়ে ছাত্ররা রাস্তায় বের হয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে লাঠিচার্জ করে । এমনকি ছাত্রীরাও এ আক্রমণ থেকে রেহাই পায় নি। উল্লেখ্য, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীরাও যােগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডা.সাফিয়া, সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহার, ড. হালিমা খাতুন প্রমুখ। বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে ছাত্রদের মিছিল গণপরিষদ ভবনের দিকে ধাবিত হলে পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে ঘটনাস্থলেই বহু নিরপরাধ ছাত্র ও পথচারী নিহত এবং অসংখ্য আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন রফিকউদ্দীন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত এবং নাম না জানা আরও অনেকে, যাদের লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। আহতদের একজন ছিলেন আবদুস সালাম। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
মাতৃভাষা বাংলার জন্য ছাত্র-জনতার রক্তে ঢাকার রাজপথ যখন রঞ্জিত, সে সময় গণপরিষদের অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছিল । ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলি চালানাের খবর পৌছে যায় পরিষদ ভবনে । তখনই গণপরিষদ সদস্য মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আবুল কালাম শামসুদ্দীনসহ বিরােধী দলের আরও কয়েকজন সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান। পূর্ব পাকিস্ত নের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন তখনও বাংলা ভাষার দাবির বিরােধিতা করে বক্তব্য দেন ।

সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালানাের ঘটনার প্রতিবাদ করেন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পী ও কর্মচারীগণ । ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর তারা ধর্মঘট পালন করেন । রেডিওর সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয় । তাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে শুধু রেকর্ডের গান বাজানাে হয় ।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ভাষাশহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সর্বস্তরের কয়েক হাজার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে বিশাল এক শােকমিছিল বের হয়। মিছিলে সবার হাতে ছিল কালাে পতাকা। এ ছাড়া শহীদদের রক্তমাখা কাপড় দিয়ে পতাকা বানিয়ে কেউ কেউ মিছিলে যােগ দেয়। সেই মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ ও গুলি চালায় পুলিশ ও মিলিটারি । গুলিতে নিহত হন শফিউর রহমান, রিকশাচালক আবদুল আউয়াল, কিশাের অহিউল্লাহসহ আরও অনেকে। এ ঘটনার পর থেকে সারা দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। একদিকে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ, হরতাল আর অন্যদিকে চলে পুলিশের নির্যাতন এবং গ্রেফতার । ১৪৪ ধারার পাশাপাশি সান্ধ্য আইন জারি হয়। ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি চালানাের তীব্র প্রতিবাদ জানান মওলানা ভাসানী । ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানাে হয় ।
২৩ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল পালন করা হয়। দোকানপাট বন্ধ থাকে, কোনাে যানবাহন চলে না, দেশের সব জায়গার মানুষ এই হরতালে সমর্থন দেয় । এভাবে ছাত্রদের আন্দোলন রূপ নেয় জনতার আন্দোলনে। ২৪ ফেব্রুয়ারিও আন্দোলন, হরতাল অব্যাহত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ জরুরি সভা ডেকে পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান। সেদিন কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এর দু’দিন পর পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয় । পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীদের জোর করে হল থেকে বের করে দেয়। আরও কয়েকজন ছাত্রনেতা সে সময় গ্রেফতার হন । এর ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে।
১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত থাকে । অবশেষে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাস করা হয় । ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদে বাংলা ভাষা নিয়ে। বিতর্কের এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য আদেলউদ্দিন আহমদ এক সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন এবং সে অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয়ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়।
১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির ভাষা আন্দোলনের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘােষণা করার দাবি জানায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
১০

১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গে আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘােষণা করে এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৫৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়।
কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে ১৯৫৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির এই ছুটিদিবস সরকার বাতিল করে দেয়। তারপর ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার দাবির মুখে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে পুনরায় ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা করে। ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতি বছর যথাযােগ্য মর্যাদায় ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন এবং শহীদ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে ।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদেরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম শহীদের স্বীকৃতি লাভ করেন ।
ভাষা আন্দোলনে যােগদান এবং শাহাদাত বরণ সালামের প্রতিবেশী নূর আহমদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সালাম কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যান এবং ছুটি কাটিয়ে আবার ঢাকায় তার কর্মস্থলে ফিরে আসেন। সেই তার শেষবারের মতাে বাড়ি যাওয়া । এদিকে তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকা উত্তাল । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছিল ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশপ্রেমিক বাঙালি ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের সামনের রাস্তায় সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে । সেদিন ছাত্রদের বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন সর্বস্তরের মানুষ । অফিস আদালত বর্জন করে সবাই যােগ দেন বিক্ষোভ-মিছিলে । সেই মিছিলে দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতার সারিতে শিল্প দপ্তরের রেকর্ড কিপার আবদুস সালামও ছিলেন। সেদিন আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ বর্বরােচিতভাবে গুলিবর্ষণ করে।
আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দীন আহমদ, শফিউর রহমানসহ জানাঅজানা অনেকের সঙ্গে সালামও গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন ফেব্রুয়ারির ২১
১১

তারিখে । বিকেল সাড়ে তিনটায় মেডিকেল কলেজের সামনে সালাম গুলিবিদ্ধ হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ।
হাসপাতালে প্রায় দেড় মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৭ এপ্রিল আনুমানিক বেলা সাড়ে এগারটায় সালাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিয়েও মতভেদ রয়েছে বলে জানা যায়। অবশ্য সরকারিভাবে ৭ এপ্রিলই এখনাে পর্যন্ত বহাল আছে ।
সালামের চিকিৎসা এবং তার পরবর্তী ঘটনা প্রসঙ্গে জহিরউদ্দীন বাবরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হাসপাতালে পুলিশের পাহারায় রেখে সালামের চিকিৎসা চলেছিল ।
সালাম গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় আজিমপুর মেসের বাসিন্দা তার এক আত্মীয় ফাজেল মিয়াকে ডাকযােগে একটি চিঠি পাঠিয়ে খবরটি জানান । সালাম যে গুলিবিদ্ধ হন, এ খবর তখনাে পর্যন্ত তাঁর বাড়ির কেউ জানত না। পােস্টকার্ডে লেখা সে চিঠি তাঁর গ্রামের বাড়িতে দেরিতে পৌঁছায়। তা ছাড়া চিঠি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার পিতা ছেলেকে দেখতে আসতে পারেন নি। কারণ তার হাতে তখন ঢাকায় আসার মতাে টাকা-পয়সা ছিল না । আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে আবদুল ফাজেল মিয়া ছেলেকে দেখতে ঢাকায় আসেন ৮ এপ্রিল তারিখে। কিন্তু তিনি আসার আগের দিন সালাম মারা যান এবং হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে পুলিশ কোথায় কবর দেয় তা সেখানকার কেউ তাঁকে জানাতে পারে নি। তবে ধারণা করা হয় যে, আজিমপুর কবরস্থানেই ভাষা আন্দোলনের এই শহীদকে দাফন করা হয় । করিমের কাছ থেকে জানা যায় যে, সালামের পিতার সঙ্গে তাঁর ভাই সােবহান ও এক মামাতাে ভাই ঢাকায় এসেছিলেন। ভাস্কর রাসা জানান, সালামের ভাই সােবহান তাঁকে বলেছিলেন, আজিমপুর কবরস্থানে অন্যান্য ভাষাশহীদদের কবরের পাশেই সালামের কবর । তবে তা এখনাে পর্যন্ত শনাক্ত করা হয় নি। ১৯৫২ সালে আবদুস সালামের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর । ভাষা আন্দোলনে যােগদানের জন্যই তাকে অকালে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন নার্স সালামের রক্তমাখা কাপড়গুলাে সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর পিতা ঢাকায় আসার পর তিনি কাপড়গুলাে ফাজেল মিয়ার হাতে তুলে দেন । শােকাহত পিতা পুত্রের রক্তে ভেজা শার্ট ও পায়জামা বাড়িতে নিয়ে যান এবং অতি যত্নে সংরক্ষণ করে রাখেন বছরের পর বছর । তবে একসময় সেগুলাে তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ এ গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে । সালাম ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়ার পর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁর পরিবারকে নগদ দু’হাজার টাকা ও দুই বান্ডিল ঢেউ টিন প্রদান করে ।
১২

কবরের ইতিহাস ও স্মৃতিচিহ্ন
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও ভাষাশহীদ সালামের কবরটি অচিহ্নিত রয়ে গেছে। কেন তার কবরটি শনাক্ত করে সংরক্ষণ করা গেল না, সে ঘটনা এখনাে প্রায় প্রচ্ছন্ন । এ ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে কোনাে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি ।
বিষয়টি নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলাে, ১৯৫২ সালে আজিমপুর কবরস্থানের একটি কবরের জায়গার দাম ছিল ১০১ টাকা । তৎকালীন ঢাকা পৌরসভা আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত শহীদ পরিবারদের চিঠি দিয়েছিল ১০১ টাকা জমির দাম পরিশােধ করলে তাদের কবর সংরক্ষণ করা হবে। যেসব শহীদ পরিবার কবরের জমির দাম পরিশােধ করেছিলেন, তাঁদের কবর সংরক্ষণ করা হয় । কিন্তু শহীদ সালাম ও শহীদ রফিকের পরিবারের ১০১ টাকা দেবার সামর্থ্য ছিল না। তাই এ দু’জন ভাষাশহীদের কবর সংরক্ষণ করা হয় নি। এমনকি তাদের কবরগুলাে কোথায় তাও শনাক্ত করার মতাে কেউ আর বেঁচে নেই।
বর্তমানে সালামের জীবিত ভাই করিমের ভাষ্য অনুসারে, তাদের ভাই সােবহান জানতেন সালামের কবর কোথায় ছিল। ভাস্কর রাসার কাছ থেকে জানা যায় যে, ২০০০ সালে সােবহান তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সালামের কবরের স্থানটি দেখান । স্থানটির অবস্থান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যান্য শহীদদের কবরের পাশেই। ভাস্কর রাসাকে সােবহান বলেছিলেন যে, ১৯৫৪ সালে তাঁরা পৌরসভা থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন সালামের কবরের জায়গা সংরক্ষণের জন্য ১০১ টাকা পরিশােধ করতে । কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অভাবের কারণে তারা সেই টাকা দিতে পারেন নি ।
রক্তমাখা পােশাক ও ছবির কথা
মুনশি আবদুল ফাজেল মিয়া ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাসে হাসপাতাল থেকে শহীদ। সালামের গুলিবিদ্ধ রক্তমাখা শার্ট ও পায়জামা নিয়ে গিয়ে অতি যত্নে রেখে দিয়েছিলেন। সালামের ছােট ভাই করিমের কাছ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমদ চৌধুরী ভাষাশহীদের সেই রক্তমাখা কাপড়গুলাে ও একটি ছবি নিয়ে আসেন। তিনি বলেছিলেন, সালামের এই স্মৃতিচিহ্ন জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য দেবেন। কিন্তু তারপর সেগুলাের কী হলাে এ তথ্য অজানাই থেকে যায়। এ বিষয়ে ফেনীর কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে কোনাে সন্তোষজনক তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি । কেউ বলতে পারে নি সালামের স্মৃতিচিহ্ন সেই রক্তমাখা কাপড় ও ছবি কোথায়! সংসদ
১৩

সদস্য খাজা আহমদও বেঁচে নেই। তাই বিষয়টি সম্পর্কে জানার আর কোনাে অবকাশ রইল না।
ভাষাশহীদ সালামের আরও ছবি ছিল । একটি ছবি ফেনীর প্রাক্তন সংসদ সদস্য তালেব আলী নিয়ে এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন আবদুল করিম। তালেব আলীর নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী (মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক) তাঁকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে সালামের বাড়িতে যান । জনাব তালেব আলী সালামের যে ছবিটি এনেছিলেন তা জেনারেল ওসমানী নিয়ে যান। তারপর ছবিটির কী হলাে তা তিনি জানেন না। বর্তমানে জেনারেল ওসমানীও বেঁচে নেই। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, আমাদের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম একজন শহীদের স্মৃতিচিহ্ন ও ছবিগুলাে যথাযথভাবে সংরক্ষণের দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত ছিল, তারা তা পালন করতে ব্যর্থ হন । কেন সালামের সেই কাপড়গুলাে জাদুঘরে রাখা হলাে না, এ প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গেল। রক্তমাখা শার্ট-পায়জামা ও ছবিগুলাে যদি সালামের বাড়িতেও থাকত, তাহলে সেগুলাে এভাবে হারিয়ে যেত না। যারা বাঙালি জাতির অহংকার, যাদের প্রাণের বিনিময়ে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তাদেরই একজনের স্মৃতিচিহ্ন যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে, এ ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। সালামের ব্যবহৃত আরও কিছু জিনিস তার বাড়িতে একটি ট্রাংকের ভিতর রাখা ছিল । কিন্তু সেগুলােও চুরি হয়ে যায় ।
১৪

সমকালীন প্রতিক্রিয়া
ভাষাশহীদ আবদুস সালাম সম্পর্কে ১৯৫৭ সালের ২৯ মার্চ শুক্রবার
সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপাের্ট
ভাষা আন্দোলনে শহীদ পিয়ন সালাম
ক্ষতিপূরণ দানে সরকারের গড়িমসি
১৯৫২ সালের মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যাহারা পুলিশের গুলিতে শােচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে সরকারি অফিসের পিয়ন আবদুস সালামও অন্যতম। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টোরেট অব ইন্ডাসট্রিজ বিভাগে ইডেন বিল্ডিংএ সালাম পিয়নের কাজ করিতেন। ঢাকায় জনাব সালাম ২৬ বি, নীলক্ষেত ব্যারাকে বাস করিতেন ।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আজ পর্যন্ত জনাব আবদুস সালামের পরিবারকে সরকারের তরফ হইতে কোন ক্ষতিপূরণ দান করা হয় নাই। অথচ অন্য কয়েকটি শহীদ পরিবারকে যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইয়াছে বলিয়া সরকারের তরফ হইতে ঘােষণা করা হইয়াছে।
জনাব সালাম ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বেলা সাড়ে তিন ঘটিকায় মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হন এবং ১৯৫২ সনের ৭ই এপ্রিল বেলা সাড়ে এগারটায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
জনাব সালাম নােয়াখালী জিলার ফেনী মহকুমাস্থ লক্ষ্মণপুর গ্রামের অধিবাসী । তাঁর পিতার নাম মােহাম্মদ ফাজিল মিয়া। তিনি ফেনীর দাগনভূঁইয়া থানার অধিবাসী।
আমরা শহীদ সালামের পরিবারকে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ দানের জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানাইতেছি ।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা (সংকলন), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ৭০

১৫
১৯৬৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদন
একুশের অনুষ্ঠানে শহীদ সালামের পিতা
সমগ্র প্রদেশে শহীদ দিবস উদযাপিত
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
প্রভাত ফেরীর পর ছাত্র-জনতা দলে দলে বিভিন্ন প্রকার শ্লোগান করিতে করিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসিয়া জমায়েত হইতে থাকে। ইহার পর ডাকসুর সহসভাপতি জনাব ফেরদৌস কোরেশীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় ।
• উক্ত সভায় শহীদ সালামের পিতা জনাব ফাজিল মিয়াকে পরিচয় করাইয়া দেওয়া হয়। প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধ এই বয়সে সুদূর নােয়াখালী হইতে ছুটিয়া আসিয়াছেন তাহার হাজার হাজার সালামের মধ্যে। তিনি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন যে, তাহার বুক আজ গর্বে ভরিয়া উঠিয়াছে। কেননা এদেশের ছাত্র-জনতা সালাম, বরকত, জব্বারের রক্তকে বৃথা যাইতে দেয় নাই। জনতার সম্মুখে তাঁহাকে যখন পরিচয় করাইয়া দেওয়া হইতেছিল, সেই সময় ৭০ বছরের বৃদ্ধ যেন যুবকের রূপলাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার চোখে নতুন উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হইতেছিল । ভাষণদানকালে জনাব ফেরদৌস আহমদ কোরেশী অভিযােগের সুরে বলেন যে, এখনাে পর্যন্ত অফিসআদালতে বাংলা ভাষা চালু করা যাইতেছেনা কেন ইহাই আজ সরকারের নিকট এদেশের মানুষের জিজ্ঞাস্য। তিনি বলেন, আজ জনসাধারণকেই সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহারের জন্য আগাইয়া আসিতে হইবে ।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা (সংকলন), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ৭১

১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ
রাষ্ট্রভাষা শহীদদের জন্য সরকারি সাহায্য
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলীবর্ষণের ফলে নিহত জনাব রফিক, জনাব আবুল বরকত, জনাব আবদুল জব্বার এবং জনাব আবদুস সালামের পরিবারবর্গের জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ২ হাজার টাকা করিয়া সাহায্য মঞ্জুর করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে ।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা (সংকলন), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ১০৪-১০৫
১৬

জহিরউদ্দীন বাবরের স্মৃতিচারণ
ফেনী জেলা ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক (১৯৭০-৭২) জহিরউদ্দীন বাবরের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার উত্তর আলীপুর । ছাত্রজীবনে তিনি ফেনী কলেজে পড়াশােনা করেন এবং ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন । ফেনীতে অবস্থানের সময় ভাষাশহীদ সালামের পিতার সঙ্গে তার বেশ কয়েকবার সাক্ষাতের সুযােগ ঘটে। সে সময় একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আবদুল ফাজেল মিয়াকে ফেনী শহরে আমন্ত্রণ জানানাে হতাে। মানুষ তাঁর কাছ থেকে সালামের কথা শুনতে চাইতেন । এ প্রসঙ্গে জহিরউদ্দীন বাবর কয়েকটি ঘটনার কথা বলেন।
১৯৬৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ যৌথভাবে ফেনীতে একটি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। সে অনুষ্ঠানে শহীদ সালামের পিতা মুনশি। আবদুল ফাজেল মিয়াকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন ছাত্রলীগ কর্মী জহিরউদ্দীন বাবরকে। তিনি সালামের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পিতাকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসেন। আসার সময় ফাজেল মিয়া একটি কাপড়ের পুটলি সঙ্গে নেন। তাতে ছিল সালামের রক্তমাখা সাদা পায়জামা আর সম্পূর্ণ রক্তে ভেজা শার্ট। ফেনী ট্রাঙ্ক রােডে অনুষ্ঠিত সেই জনসভায় সালামের পিতা তাঁর পুত্রের রক্তমাখা স্মৃতিচিহ্ন জনসমক্ষে দেখানাের জন্যই নিয়ে যান । উক্ত অনুষ্ঠানে তকালীন ছাত্রনেতা জয়নাল হাজারীর বক্তৃতার সময় সালামের রক্তে ভেজা কাপড়গুলাে মানুষকে দেখানাে হয়। ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক । ভাষাশহীদের রক্তমাখা কাপড় দেখে অনুষ্ঠানে উপস্থিত জনতা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। সবাই মিলে তখন সালামের পিতার হাতে কিছু টাকা তুলে দেয়।
১৯৭০-৭১ সাল পর্যন্ত সালামের পিতাকে ফেনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানাে হতাে। মুনশি আবদুল ফাজেল মিয়া মাঝে মাঝে ফেনীর প্রাক্তন আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং জহিরউদ্দীন বাবরকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। জানা যায়, খাজা আহমদ ব্যক্তিগতভাবে তাকে কিছু আর্থিক সাহায্য দিতেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সালামের পিতার সাক্ষাৎ ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার মাতুভূঁইয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মােহাম্মদ ইসরাফিলের নিকট থেকে জানা যায় যে, সালামের পিতা ফাজেল মিয়া স্বাধীনতার পর ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং এই সাক্ষাতের ব্যাপারে জহিরউদ্দীন বাবর তাকে সবরকম সহযােগিতা করেন। এ সম্পর্কে জহিরউদ্দীন বাবরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৭২ সালের এপ্রিল বা মে মাসে ভাষাশহীদ সালামের পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকায় আসেন । জহিরউদ্দীন বাবর তখন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্র এবং মাঝে মাঝে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে অবস্থান করতেন । সালামের পিতা ঢাকায় আসার
১৭

আগে সাপ্তাহিক ফেনী’ পত্রিকার সম্পাদক কাজী আবদুল মালেক এবং প্রকাশক রফিকুর রহমান ভূঁইয়ার নিকট থেকে জহিরউদ্দীন বাবরের ঠিকানা জোগাড় করেন । তারপর ঢাকায় এসে জহুরুল হক হলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে জানান যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই তার ঢাকায় আসা। জহিরউদ্দীন বাবর এ বিষয়টি তৎকালীন ছাত্রনেতা আ.স.ম. আবদুর রবকে অবহিত করেন। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় রাজনৈতিক সচিব মােহাম্মদ হানিফ তাঁর সঙ্গে সালামের পিতার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন ।।
জহিরউদ্দীন বাবর সাক্ষাতের সঠিক তারিখটি স্মরণ করতে পারেন নি। তবে তিনিই সালামের পিতাকে নিয়ে যান গণভবনে । বঙ্গবন্ধু তখন অফিসের বাইরে ছিলেন । তাই ফাজেল মিয়া গণভবনের গেটের পাশে অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু আসেন এবং অপেক্ষমাণ সালামের পিতাকে দেখে গেটের কাছেই গাড়ি থেকে নেমে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেন । তারপর তাকে নিজের কক্ষে নিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন । সালামের পিতার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের সকল শহীদ এবং তাদের পরিবারের জন্য স্থায়ীভাবে কিছু করার আশ্বাস দেন । ফাজেল মিয়া বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার আগে তিনি পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে তার হাতে গুঁজে দেন । জগন্নাথ হলে ফিরে এসে তিনি গুনে দেখেন বঙ্গবন্ধু তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন ।

সালামের একুশে পদক লাভ
আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা এ দেশে দীর্ঘকাল উপেক্ষিত ছিলেন, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না । আবদুস সালাম ও রফিকউদ্দীনের কবরগুলাে শনাক্ত করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের । কিন্তু এ ব্যাপারে চরম অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সরকারি ও বেসরকারিভাবে একুশের শহীদদের ব্যাপারে ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করা যায়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপিত হয় এবং তারপর থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষাশহীদ আবদুস সালামকে সরকারিভাবে মরণােত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। সে সময় অন্যান্য ভাষাশহীদ পরিবারের সঙ্গে সালামের পরিবারকেও ঢাকায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া আর কোনাে সম্মান পান নি এই ভাষাশহীদ পরিবার । একুশে পদকের সার্টিফিকেট ও রেপ্লিকা দুটি ফ্রেমে বাধাই করে সালামের ছােট ভাই আবদুল করিম তার বাসগৃহ ‘সালাম ভবন’-এর দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছেন ।
১৮

সালামের প্রতিকৃতির প্রেক্ষাপট
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভাষাশহীদ আবদুস সালামের ছবি সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনাে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি । সালামের যে ছবিটি সর্বত্র দেখা যায়, তা তাঁর আসল ছবি নয়। এটি শিল্পীর তুলিতে আঁকা প্রতিকৃতি । সালামের ছবিগুলাে কিভাবে তাঁর বাড়ি থেকে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে খােয়া গেছে তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাস্কর রাসা ভাষাশহীদ সালামের প্রতিকৃতি তৈরির পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেন । তিনি এ পরিকল্পনার নাম দেন অস্তিত্বের শেকড়ে আলাে। এ কাজে তাকে আর্থিক ও অন্যান্যভাবে সহযােগিতা করেন তার শিল্পানুরাগী বন্ধু খন্দকার জামিলউদ্দিন। সে সময় শহীদ সালামের পরিবারের জীবিত সদস্যদের ঢাকায় আনা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সালামের সেজ ভাই আবদুস সােবহান, ছােট ভাই আবদুল করিম এবং ছােট বােন বলকিয়তের নেসা। সালাম দেখতে কেমন ছিলেন জানতে চাওয়া হলে ভাই-বােনেরা তার বিবরণ দেন এবং তাঁর ছােট বােন বলেন যে, ভাই আবদুল করিমের সঙ্গে সালামের চেহারার মিল রয়েছে। তবে সালামের গায়ের রং কিছুটা উজ্জ্বল ছিল ।
আবদুল করিমকে সামনে রেখে ভাস্কর রাসার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পীকে দিয়ে সালামের প্রতিকৃতি ও একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয় । যূথবদ্ধ এই কর্মযজ্ঞের কারিগরদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী আবদুল মান্নান, শিল্পী অলকেশ ঘােষ, শিল্পী আহামেদ শামসুদ্দোহা, শিল্পী সাজাহান আহামেদ বিকাশ, শিল্পী শেখ আফজাল ও ভাস্কর রাজিব সিদ্দিকী।
২০০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সুইমিং পুলে সালামের ছবি আঁকার এই স্মরণীয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বাংলা ভাষা সংগ্রামের অন্যতম যােদ্ধা ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। এ ছাড়া ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, কবি শামসুর রাহমানসহ বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ছবি আঁকার সময় এখানে উপস্থিত ছিলেন । শিল্পীগণ সালামের ভাই-বােনদের দেওয়া বিবরণ, ছােট ভাই করিমের চেহারার আদল এবং তাঁদের আবেগ-অনুভূতির সমন্বয়ে কয়েকটি ছবি আঁকেন ।
ভাষাশহীদ সালামের প্রতিকৃতি তৈরির পর তার অবয়বের সঙ্গে যে ছবিটির মিল বেশি দেখা যায়, তা শনাক্ত করেন তাঁর ছােট দুই ভাই ও বােন । শিল্পী সাজাহান আহামেদ বিকাশের আঁকা ছবির সঙ্গেই সালামের মিল খুঁজে পান তাঁরা। এ ছবিটিই বর্তমানে সালামের অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে আছে তাঁর পরিবার এবং এদেশের মানুষের কাছে। এ ছাড়া রাজিব সিদ্দিকীর তৈরি ভাস্কর্যটি সবার কাছে গ্রহণযােগ্য হয়। কেবল
১৯

বিবরণ শুনে এবং শিল্পীদের আবেগ আর কল্পনা মিশিয়ে ছবি আঁকা ও ভাস্কর্য নির্মাণের দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে এটাই প্রথম। যুগ যুগ ধরে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে । পরবর্তী পর্যায়ে ২০০৩ সালে ভাস্কর রাসার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও পরিচালনায় পাঁচ জন ভাষাশহীদকে নিয়ে একটি তথ্যবহুল প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা হয় । শিরােনাম বিশ্ব তােরণে বাংলা। সে সময় ভাষাশহীদদের জন্মস্থানে গিয়ে পরিবারের সদস্য, তাদের ঘনিষ্ঠজন এবং বিশিষ্ট ভাষাসৈনিকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয় । এমনকি ভাষাশহীদদের জন্মস্থানের মাটিও রাসা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। পাঁচজন ভাষাশহীদের পরিবারকে ঢাকায় এনে একত্রিত করে সংবর্ধনা দেওয়া হয় । ভাস্কর রাসা এবং পাঁচজন তরুণ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেন । এরা হলেন ইজেল প্রােডাকশনের স্বত্ত্বাধিকারী শহীদুল কবির তুহিন এবং আমান, রুমী, সােহেল ও সফর ।
স্থানীয়ভাবে সালামের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ ও
ভাষাশহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি পরিষদ গঠন
ভাষাশহীদ সালামের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ‘দৈনিক ফেনীর সময় পত্রিকার সম্পাদক মােহাম্মদ শাহাদাত হােসেনের উদ্যোগে ফেনী জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ২০০০ সালে গঠিত হয় “ভাষাশহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি পরিষদ” । সালামের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এ পরিষদ নানাভাবে কাজ করে আসছে। পূর্বে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে পরিবারের সদস্যরা ঘরােয়াভাবে সালামের স্মরণে মিলাদ ও দোয়া আয়ােজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপন করতেন।
“ভাষাশহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি পরিষদ” প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এই পরিষদই সালামের গ্রামে তাঁর বাড়ির নিকটবর্তী লক্ষ্মণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়-প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির আয়ােজন করে আসছে । সালামের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ফেনী জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে এখানে। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছ থেকে জানা যায়, ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফেনীর প্রাক্তন সংসদ-সদস্য জয়নাল আবেদিন হাজারীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও অর্থায়নে স্কুলের পাশে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। সেদিনই শহীদ মিনারের উদ্বোধন হয় এবং তখন থেকে প্রতি বছর সালাম স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে এখানে শহীদ দিবস পালিত হয়ে আসছে । ক্রমাগত এ আয়ােজনের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে সালাম স্মৃতি পরিষদ আয়ােজিত মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ফেনীবাসী ভাষাশহীদ সালামকে স্মরণ করে ।
২০০২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম স্মৃতি পরিষদ আয়ােজিত অনুষ্ঠানের আয়ােজকগণ সালামের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সরকারের নিকট পাঁচ দফা দাবি পেশ করেন । দাবিগুলাের মধ্যে ছিল :
২০

১. সালামের নামে দাগনভূইয়া উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের নামকরণ
২. সালামের বাড়ি পর্যন্ত সড়কটি পাকা করা
৩. সালামের নামে লক্ষ্মণপুর গ্রামের নামকরণ
৪. সালামের নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ
৫. লক্ষ্মণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সালামের নামে নামকরণ করে জাতীয়করণ
এসব দাবির মধ্যে এ পর্যন্ত তিনটি দাবি পূরণ হয়। ২০০০ সালে ভাষাশহীদ সালাম একুশে পদক লাভ করার পর থেকেই স্থানীয় জনগণের নিকট লক্ষ্মণপুর গ্রাম ‘সালাম নগর’ নামে পরিচিতি লাভ করে । স্থানীয় গ্রামবাসী এবং সালাম স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা-মাইজদী মহাসড়কের পাশে সালামের বাড়ির রাস্তায় “সালাম নগর” নামে একটি সাইনবাের্ড টাঙানাে হয় ।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সেখানে “সালাম নগর” লেখা পাকা সাইনবাের্ড স্থাপন করা হয়। ২০০৯ সালে গ্রামটি সরকারিভাবে “সালাম নগর” নামে স্বীকৃতি লাভ করে । একই সময়ে সরকারি উদ্যোগে শহীদ সালামের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তাটি পাকা করা হয় । দাগনভূইয়া উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের নামকরণ হয় “ভাষাশহীদ সালাম। মিলনায়তন”।
২০০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তা উদ্বোধন করা হয় এবং তকালীন জেলা প্রশাসক মােঃ মাসুম খান এর ফলক উন্মােচন করেন। সালাম স্মৃতি পরিষদের বাকি দুটো দাবি এখনাে পূরণ করা হয় নি।
স্থানীয়ভাবে ভাষাশহীদ সালামের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আরও কিছু উদ্যোগ গৃহীত হয়। তার মধ্যে রয়েছে ফেনী জেলা স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে “ভাষাশহীদ সালাম স্টেডিয়াম নামকরণ। এ ছাড়া জেলা পরিষদের উদ্যোগে ফেনী শহরের মিজান রােডে সালামের নামে একটি ক্যুনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
পরিতাপের বিষয় যে, সালামের পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দাগনভূইয়া উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের নাম পরিবর্তন করে ‘ভাষাশহীদ সালাম মিলনায়তন’ নামকরণ হলেও মাত্র দু’বছরের মধ্যেই ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। পরিত্যক্ত ভবনটি ২০০৮ সালের মে মাসে নিলামে বিক্রি করা হয়। নােয়াখালী জেলার সুধারামের ঠিকাদার মােঃ মামুন ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় ভবনটি ক্রয় করার পর তা ভেঙ্গে নিয়ে যান । তারপর তিন বছরের মধ্যেও সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। এ ছাড়া সালামের বাড়িতে যাওয়ার পাকা রাস্তাটি নদীর ভাঙনে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। সেটিও সংস্কার বা মেরামতের কোনাে উদ্যোগ গৃহীত হয় নি।
২১

ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর
২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাষাশহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে প্রত্যেক শহীদের জন্মস্থানে একটি করে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করে। সেই প্রকল্পের আওতায় সরকারী উদ্যোগে ভাষাশহীদ সালামের গ্রামে তাঁর বাড়ির নিকটে একটি গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় । তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মােঃ আনােয়ারুল ইকবালের সক্রিয় সহযােগিতায় সালাম নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয় “ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর” । এ প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি দান করেন সালামের গ্রামের বাসিন্দা জনাব আবুল কালাম, জনাব শহীদ আলম এবং জনাব কবির আহম্মদ। প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে ফেনী জেলা পরিষদ। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের নির্মাণব্যয় ছিল প্রায় ৬৩ লাখ টাকা। এর কারিগরি নির্দেশনায় ছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ।
২০০৮ সালের ২৬ মে (১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৫ সন) “ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর”-এর উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জনাব মাহবুব জামিল। এ ছাড়া প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ফেনীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সালামের নামে এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ এটি পরিচালনার জন্য কোনাে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ােগ দেওয়া হয় নি । প্রতিষ্ঠানটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন একজন কেয়ারটেকার । সুজাপুর ডাকবাংলাে থেকে তাঁকে অস্থায়ীভাবে এখানে আনা হয়। তাঁর নাম মােহাম্মদ জামালউদ্দিন, পিতা মুক্তিযােদ্ধা মরহুম আবদুল হক। সম্প্রতি জানা যায়, ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সালামের ভাই করিমের কন্যা খাদিজা বেগমকে গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান পদে অস্থায়ীভাবে নিয়ােগ দেওয়া হয়।
ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর যেখানে স্থাপন করা হয়, তার পাশেই রয়েছে ছােট ফেনী নদী । ২০০৯ সাল থেকে নদীটির ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। ফলে ঝুঁকির মুখে রয়েছে সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর । ইতােমধ্যে সালাম নগরের রাস্তার প্রায় ৩০ ফুট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে । নদীর ভাঙন রােধ করার জন্য কিছু ব্লক ফেলা হলেও পরিকল্পনার ত্রুটির কারণে সেগুলাে নদীতে তলিয়ে যায় । এদিকে নদীর স্রোত ক্রমশ ধেয়ে আসছে এবং শহীদ সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে প্রবেশপথের অনেকটাই নদীতে ভেঙে পড়েছে। যানবাহন তাে দূরে থাক, পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি দ্রুত রাস্তাটির সংস্কার এবং নদীর ভাঙন রােধ করা না হলে ভাষাশহীদ সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের অস্তিত্ব বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে ।
২২

লক্ষ্মণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রসঙ্গ
সালামের স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর পরিবার ও এলাকাবাসী সম্মিলিতভাবে ১৯৮৮ সালে লক্ষ্মণপুরে সালামের বাড়ির কাছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে। ১৯৯১ সালে এটি লক্ষ্মণপুর ক্যুনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে রেজিস্ট্রিভুক্ত হয়। এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সালামের নামে বিদ্যালয়ের নামকরণের জন্য দাগনভূইয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে ১৯৯৯ সালের ২৪ মে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে একটি প্রস্তাব পাঠানাে হয় । কিন্তু এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনাে সাড়া পাওয়া যায় নি।
২০০৯ সালের শেষদিকে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের লােকেরা এসে লক্ষ্মণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি সাইনবাের্ড টাঙিয়ে দেয়। এ স্কুলের পাশেই ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের অবস্থান । সালাম নগর গ্রামের মানুষ জেলা প্রশাসনের নিকট দাবি জানিয়ে আসছেন, স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে ‘ভাষাশহীদ সালাম প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামকরণ এবং এর জাতীয়করণের জন্য । স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা নুরজাহান বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, স্থানীয় প্রশাসন থেকে জানানাে হয়, কোনাে ব্যক্তির নামে স্কুলের নামকরণ করতে হলে সরকারকে ৩ লক্ষ টাকা দিতে হবে ।
এ ছাড়া স্কুলের জাতীয়করণের জন্যও বেশ মােটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। সালাম নগরের মানুষের প্রশ্ন : ভাষাশহীদ সালামকে কি একজন ব্যক্তি হিসেবেই গণ্য করা হবে? একজন ভাষাশহীদের নামে তাঁর গ্রামের বিদ্যালয়ের নামকরণ স্বাভাবিকভাবেই হওয়ার কথা।
স্কুলটি আরও নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। বিগত কয়েক বছর যাবত ছােট ফেনী নদীর ভাঙনের ফলে সালাম নগরের নদীর বাঁক সংলগ্ন রাস্তাটি স্রোতের টানে। ক্রমাগত ভেঙে চলেছে। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানানাে হলে নদীর ভাঙন রােধ করার জন্য শত শত ব্লক তৈরি করে স্কুলের সামনের খেলার মাঠে ফেলে রাখা হয় । কিন্তু দু’বছর পার হয়ে গেলেও ব্লকগুলাে স্কুলের মাঠে পড়ে আছে । ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা খেলার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ।
তদুপরি ব্লকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে অনেকে আহত হয়। সাংবাদিক আবদুল্লাহ আলমামুনের কাছ থেকে জানা যায়, ভাঙন রােধের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ না হওয়ার কারণে ব্লকগুলাে নদীর ভাঙনস্থলে ফেলা হয় নি। এ বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে সমস্যাটির কোনাে সমাধান হয় নি ।
২৩

সালামের পরিবার ও ফেনীবাসীর দাবি
বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর ৬০ বছর পার হয়ে গেছে। ভাষাশহীদ সালামের পরিবার এতকাল কোনাে দাবি জানায় নি কারও কাছে। এমনকি ফেনীবাসীর দাবিও খুব বেশি নয়। এ যাবৎ স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে সালামের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যথাযথ তদারকির অভাবে সেগুলাে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। জেলা প্রশাসন সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সমস্যাগুলাের সমাধান সম্ভব ।
বর্তমানে সালামের পরিবার ও ফেনীবাসীর অন্যান্য দাবির মধ্যে আছে :
১. আজিমপুর কবরস্থানে সালামের কবর চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণ
২. লক্ষ্মণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম সালামের নামে পরিবর্তন করে তা সরকারিকরণ
৩.ফেনী নদীর ভাঙন থেকে সালামের বাড়ি পর্যন্ত সড়কের সংস্কার
৪. সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরকে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করা
৫.দাগনভূঁইয়া বাজারের জিরাে পয়েন্টকে সালাম চত্বর নামকরণ
৬. ফেনী-দাগনভূঁইয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক সালামের নামে নামকরণ
৭. ভাষাশহীদদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা
৮. সালামের বাড়িতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ। উপরিউক্ত দাবি পূরণ করা খুব কঠিন কাজ বলে মনে হয় না। সরকার ভাষা আন্দোলনের শহীদদের ব্যাপারে সচেতন হলে এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সহজেই দাবিগুলাে পূরণ সম্ভব এবং এর মাধ্যমেই ভাষাশহীদের স্মৃতির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে।
২৪

শিল্প-সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ও
ভাষাশহীদদের প্রতিফলন
বা!লাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর গড়ে ওঠে বাংলা একাডেমী। বলা যায়, আমাদের ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলা একাডেমী । একুশের চেতনাকে বাঙালির জীবনে, সাহিত্যে এবং সকল কাজের ভিতর দিয়ে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় নিরন্তর কাজ করে চলেছে বাংলা একাডেমী ।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষাশহীদদের স্মরণে বাংলা একাডেমী নানা অনুষ্ঠনের আয়ােজন করে আসছে। এর মধ্যে আছে আলােচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বইমেলা। এ অনুষ্ঠানে দেশের বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ আলােচনা করেন। আলােচনা হয় আমাদের ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শহীদ দিবস উদযাপন করা হতাে কেবল একুশে ফেব্রুয়ারিতে একদিন। ১৯৭১ সালের পর থেকে এই অনুষ্ঠান প্রথমে এক সপ্তাহ ধরে চলত। তারপর চলত যথাক্রমে পনের দিন ও একুশ দিন । ১৯৯২ সাল থেকে বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানমালা এক মাস ব্যাপী উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বাংলা একাডেমীর বইমেলা একুশের উৎসবের সবচেয়ে বড় দিক । ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম একুশের বইমেলা শুরু হয়। সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারি মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমীর উন্মুক্ত মাঠে অনাড়ম্বরভাবে বইমেলাটি প্রথম আরম্ভ করেন। তাঁর এ উদ্যোগ অন্যান্য প্রকাশকদের উদ্বুদ্ধ করে এবং পরবর্তী পর্যায়ে বেশ কিছু প্রকাশক বইমেলায় অংশগ্রহণ করে। বাংলা একাডেমী কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলার প্রচলন ঘটে ১৯৭৮ সালে । তখন থেকে বাংলা একাডেমী বইমেলার আয়ােজকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এর পর প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে মাসব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। একুশের বইমেলা এখন আর কেবল নিছক বইমেলা নয়, এটি এখন বাঙালির অন্যতম সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ বইমেলায় দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলাে অংশগ্রহণ করে এবং তাদের বই নিয়ে আসে। এ ছাড়া অন্যান্য সংগঠনও তাদের প্রকাশিত গ্রন্থ বইমেলায়
২৫

প্রদর্শন এবং বিক্রির সুযােগ পায়। এভাবে মেলাতে বছর বছর বইয়ের দোকানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ক্রমশ বেড়ে যায় বইমেলার সীমানা। বর্তমানে একুশের অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে বাংলা একাডেমী চত্বরের বইমেলা । সারা বছর লেখক ও প্রকাশকগণ অপেক্ষা করেন এই মাসটির জন্য। বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয় বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ । দেশের নবীন-প্রবীণ সব লেখকের নতুন বই আসে মেলায়। লেখক, কবি, সাংস্কৃতিক কর্মী, পাঠক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী, দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের সমাবেশে বইমেলা পরিণত হয় এক মিলনমেলায়। লেখক ও প্রকাশকদের উদ্যোগে মেলাপ্রাঙ্গণের নজরুল মঞ্চে নতুন বইয়ের মােড়ক উন্মােচনের অনাড়ম্বর আয়ােজন মেলার একটি বাড়তি আকর্ষণ । বিগত কয়েক বছর যাবৎ বইমেলায় শিশুদের জন্য পৃথক কর্নারের ব্যবস্থা করা হয় যাতে শিশুরা নির্বিঘ্নে নিজেদের পছন্দের বই দেখতে ও কিনতে পারে। শিশুদের জন্যও বাংলা হাতের লেখা, কবিতা, গানের প্রতিযােগিতা প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান থাকে।
যথাযােগ্য মর্যাদায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের অংশ হিসেবে পুরাে মাসব্যাপী বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ আলােচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে থাকে। ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান ও বইমেলা আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মারক এবং বাঙালির জাতীয় উৎসব হিসেবে পরিগণিত। গানের অনুষ্ঠানে সারা দেশ থেকে শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানাে হয় । দেশাত্মবােধক গান থেকে শুরু করে বাউল গান, জারি গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি সব ধরনের গানের জমজমাট অনুষ্ঠান হয়ে থাকে । সকল ধর্মের, সব বয়সের মানুষ বাংলা একডেমীর অনুষ্ঠান উপভােগ করেন।
একশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে শহীদ মিনারের সামনে জমে ওঠে নাটক, গান ও কবিতা পাঠের আসর । বাংলা একাডেমী ছাড়া অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে শহীদদের স্মরণে অনুষ্ঠান হয় বিভিন্ন জায়গায় । ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে শহীদ দিবস পালন করা হয় আলােচনা, গান ও কবিতা পাঠের ভিতর দিয়ে। এভাবে সারা দেশের মানুষ ভাষাশহীদদের স্মরণ করে।
১৯৫২ সালের পর থেকে আরম্ভ করে বর্তমান সময় পর্যন্ত একুশের চেতনা, ভাষা আন্দোলন এবং ভাষাশহীদদের আত্মদানের প্রসঙ্গ নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। কবিতা, সঙ্গীত, নাটক, কথাসাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, গবেষণা, সংকলন এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রেরণা হিসেবে মহিমান্বিত হয়ে আছে ভাষা আন্দোলনের ঘটনা এবং ভাষাশহীদদের কথা । গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা প্রভৃতিতে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সরাসরি উপস্থাপিত হলেও শহীদদের প্রসঙ্গ এসেছে অনেকটা পরােক্ষভাবে । তবে ভাষাশহীদ আবুল বরকত, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান, রফিকউদ্দীন আহমদের ভাষার জন্য জীবনদানের অমর গাথা সরাসরি উঠে এসেছে
২৬

বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি ও গীতিকারদের কবিতায় আর গানে । ভাষাশহীদদের প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পীগণ । সেসব রয়েছে বাংলা একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর এবং অন্যান্য স্থানে।
একুশের প্রথম কবিতা : রচনার প্রেক্ষাপট একুশের ঘটনা নিয়ে প্রথম লেখা হয় একটি কবিতা। কবিতাটির নাম কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংগ্রামী ছাত্রজনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের জনাব মাহবুব উল আলম চৌধুরী কবিতাটি লেখেন । সে সময় তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক । এ ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তিনি ছিলেন প্রথম সারির নেতা ও সংগঠক। সে সময় তিনি চট্টগ্রাম থেকে সীমান্ত’ নামে একটি প্রগতিশীল মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে তিনি হঠাৎ জলবসন্ত রােগে আক্রান্ত হন। ঢাকায় ছাত্রহত্যার খবর পেয়ে রােগশয্যায় থেকেই মাহবুব উল আলম চৌধুরী এই দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। সেদিন রাতেই কবিতাটি মুদ্রিত হয় এবং পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদিঘির মাঠে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় তা পাঠ করা হয়। কবিতাটি প্রকাশের সময়ের কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনার বিবরণ জানা যায় খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াসের লেখায় :
“জলবসন্তে আক্রান্ত সুশ্রী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সুদীপ্ত দুটি চোখে ঝরছিল আগুন । তাঁর কলম দিয়ে বেরিয়ে আসে আগ্নেয়গিরির লাভার মতাে জ্বলন্ত এক দীর্ঘ কবিতা, “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” । আন্দরকিল্লায় অবস্থিত একটি প্রেসে কবিতাটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশের দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। ব্যবস্থা হয় সারা রাত প্রেসে কাজ চালিয়ে পরদিন সকাল বেলার মধ্যে গােপনে প্রকাশ করতে হবে অমর একুশের প্রথম সাহিত্য সৃষ্টি, প্রথম সাহিত্য সংকলন।
…রাতের শেষ প্রহরে কম্পােজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্তপ্রায়, হঠাৎ একদল সশস্ত্র পুলিশ হামলা করে উক্ত ছাপাখানায়। প্রেসের সংগ্রামী কর্মচারীদের উপস্থিতবুদ্ধি ও ক্ষিপ্রতার মধ্যে দ্রুত লুকিয়ে ফেলা হয় আমাকেসহ সম্পূর্ণ কম্পােজ ম্যাটার । তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ যখন খালি হাতে ফিরে চলে যায়, শ্রমিক কর্মচারীরা পুনরায় শুরু করেন তাঁদের অসমাপ্ত কাজ। শ্রমিক শ্ৰেণী যে ভাষায় যে দেশে যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, তার সংগ্রামী চেতনা যে অসাধারণ তার প্রমাণ সেদিন হাতে হাতে পেয়েছিলাম চট্টগ্রামে। দুপুরের মধ্যে মুদ্রিত ও বাধাই হয়ে প্রকাশিত হয় “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি”।
২৭

অপরাহের লালদীঘির ময়দানের জনসমুদ্রে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করলেন। চট্টগ্রামের মুসলিম লীগ নেতা জনাব রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। …সভার কর্মসূচির এক পর্যায়ে ছিল মাহবুব উল আলম চৌধুরীর “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” পাঠ । কবিতার যেমন ভাষা, তেমনি তার ভাব, তেমনি ছন্দ। শ্রোতৃবৃন্দ একেকবার উত্তেজিত হয়ে ফেটে পড়ছেন আর আওয়াজ তুলছেন ‘চল চল ঢাকা চল’ ।”
সেদিনের সভায় দীর্ঘ সতের পৃষ্ঠার কবিতাটি পাঠ শেষে প্রচারপত্রের মতাে সকলের মধ্যে বিলি করা হয়। এ ঘটনার পরপরই সরকার পুস্তিকাটি নিষিদ্ধ ঘােষণা করে । কিন্তু ততক্ষণে একুশের প্রথম কবিতা জনতার হাতে হাতে পূর্ব বাংলার সকল প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। একুশের প্রথম কবিতা রচনা, তার প্রকাশ এবং তা বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । একুশের প্রথম কবিতা হিসেবে এর ঐতিহাসিক মূল্য অন্যান্য কবিতার চেয়ে অনেক বেশি। আর এ কবিতায় ভাষাশহীদ সালামের প্রসঙ্গ সরাসরি উঠে এসেছে অন্যান্য ভাষাশহীদদের সঙ্গে। কবিতাটিতে একুশে ফেব্রুয়ারির চল্লিশ জন শহীদের কথা উল্লেখ করা হয়। বস্তুত তখন এরকমই ধারণা করা হয়েছিল । মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একাধিক কবিতায় সালামের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ।

একুশের কবিতায় ভাষাশহীদ সালাম
একুশ : ১৯৭০
মাহবুব উল আলম চৌধুরী

আমি আর লিখবাে না
একুশের বিষন্ন কবিতা
তােমাদের আনন্দিত শােকের মিছিলে
জ্বালব না যন্ত্রণার চিন্তা।
…….
সাম্যের স্বদেশভূমি গড়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে-
যারা আজ নেমে গেছে দুরন্ত সংগ্রামে
আসাদের রক্তমাখা ছেড়া শার্ট বুকে চেপে
চলে গেছে দূরান্তর গ্রামে
তাহাদের সাথে আমি হাঁটিতেছি পথ
যেখানে কাস্তের মুখে
কিষাণের তীব্রতর ঘৃণা
২৮

দেখিতেছি সেইখানে
সালামের গুলিবিদ্ধ কলজেটা খুঁজে পাই কিনা ।।
কাঁদতে আসি নি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি / পৃষ্ঠা ৫০
এমন আশ্চর্য দিন
সুফিয়া কামাল

আশ্চর্য এমন দিন! মৃত্যুতে করে না কেহ শােক,
……….
এরা যেন করেছে স্বাক্ষর
মৃত্যুর পরওয়ানা পরে বাংলা ভাষার লিখি নাম :
আমার মায়েরে আমি মাটি থেকে বুকে মাের তুলিয়া নিলাম
সালাম, বরকত ছিল, আরও ছিল নাম নাহি জানা কতােজন
পিতার অন্তিম আশা, জননীর বুক-জোড়া ধন,
কাহারও জীবন সাথী, বােনদের একমাত্র ভাই-
তারা আজ নাই!
নাই? আছে, আছে।

অমর একুশে
অজেয় হয়েছে বাংলা ভাষা রক্তে মিশে!
একুশের কবিতা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৯
ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
শামসুর রাহমান

এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?
…………
আমি
রাজস্ব দফতরের করুণ কেরানী, মাছি-মারা তাড়া-খাওয়া,
আমি ছাত্র, উজ্জ্বল তরুণ,
আমি নব্য কালের লেখক,
……
আবার ফুটেছে দ্যাখাে কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
২৯

কেমন নিবিড় হয়ে । কখনাে মিছিলে কখনাে-বা
একা হেটে যেতে যেতে মনে হয়— ফুল নয়, ওরা
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর ।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।
….
বুঝি তাই উনিশশাে ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তােলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে ।
সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা,
সালামের চোখ আজ আলােকিত ঢাকা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই
জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতাে
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনাে বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায় । সেই ফুল আমাদের প্রাণ,
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায় ।
শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা, ঢাকা, ১৯৮৮
অমর একুশে
হাসান হাফিজুর রহমান
আম্মা তার নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?
ঘূর্ণিঝড়ের মতাে সেই নাম উন্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে, ডাকবে,
দুটি ঠোটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতাে গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না?
কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতােদিন?
আবুল বরকত নেই, সেই অস্বাভাবিক বেড়ে-ওঠা।
……
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার-কি বিষন্ন থােকা থােকা নাম;
৩০

এই এক সারি নাম তার বর্ষার তীক্ষ্ণ ফলার মতাে এখন হৃদয়কে হানে;
….
যাদের হারালাম তারা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।
আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষন্ন নাম। একসার জ্বলন্ত নাম ।

একুশের প্রেরণা
বেলাল মােহাম্মদ

মা তুমি বলাে-না, কি হয়েছে আজ
বলাে-না, মা!
ঘুম থেকে উঠে সারা পথেঘাটে দেখি যে কেবল ঝড়
রক্তের বুঝি-বা বান ডেকেছিলাে
সারা রাজধানী লাল
লালে লাল ।
……
এই রক্তে তাের হাত নয়, বাছা
সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত
আরাে অনেকের তাের দাদাদের বুক রাঙা হলাে এতে।

একুশের গানে ভাষাশহীদ সালাম
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে রচিত প্রথম গান – ভুলবাে না, ভুলবাে না, ভুলবাে না সে একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবাে না। গানটি রচনা করেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক । ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় গান – আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। গানটির রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী। এতে সুর দিয়েছেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করে। প্রতি বছর একুশের শহীদদের স্মরণে প্রভাত ফেরীর মিছিলে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি গাওয়া হয় এবং সব জায়গায় একুশের অনুষ্ঠান আরম্ভ হয় এ গানটি গেয়ে। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাবার সময় সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় এ গানটি। আমাদের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মতাে গানটিও অমর হয়ে আছে । পৃথিবীর সর্বত্র একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে এ গানটি
৩১

গাওয়া হয়। বাংলা ভাষাভাষী ছাড়া অন্যান্য ভাষার মানুষেরাও গানটি গেয়ে থাকে । স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত সকল আন্দোলনে-সংগ্রামে ভাষা আন্দোলন ও ভাষাশহীদদের নিয়ে রচিত গানগুলাে মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছে । এমন বহু গানে সালামের প্রসঙ্গ এসেছে।

একুশের গান
মহিন শাহ
স্বাধীনের ইতিকথা বলতে পাই ব্যথা
মনে করাে না, নয়নের জল মানা মানবে না ॥
…..
ঢাকায় বঙ্গবাণীর গান গাহিয়া গাে
পুলিশের মার খেল মাফ পেল না ॥
ছাত্রদল সব খেপিয়া গেল
তারা জোর প্রতিবাদ জানাতে এল-মরি হায় রে
সালাম, বরকত, রফিক, শফিক গাে
জীবন দিল তবু ফিরল না ॥
উনিশ শত বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি
শহর বন্দরে হলাে কারফিউ জারি-মরি হায় রে
ভাষা আন্দোলন করলে গুলি হবে গাে
বাংলার স্বাধীনতার সেই প্রথম চেতনা ৷৷
সুর : মহিন শাহ, আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত মহিন শাহের পদাবলী
বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩

একুশের গান
কবিয়াল বিজয় সরকার

বাংলাদেশের মানুষ, ফেব্রুয়ারি একুশে ভুলিতে পারবে না জীবনে,
ভাষা আন্দোলনের জন্য জনসমাজ হলাে বিপন্ন কুখ্যাত সরকারের শাসনে।
…..
মােদের সালাম, রফিক, বরকত, শফিক আরও যত দেশপ্রেমিক,
বিজয়ী বীর বিদিত ভুবনে;
জানিল এই বিশ্ববাসী বাঙালি নয় পরপ্রত্যাশী
মরতে জানে উদ্দেশ্য সাধনে ।।
সুর : কবিয়াল বিজয় সরকার, মহসিন হােসাইন সম্পাদিত কবিয়াল বিজয় সরকারের জীবন ও
সংগীতসমগ্র, জ্যোতিপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮
৩২

একুশের গান
গাজীউল হক

ভুলবাে না, ভুলবাে না, ভুলবাে না
সে একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবাে না ।

লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, মিলিটারি আর মিলিটারি
ভুলবাে না।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই— এই দাবিতে ধর্মঘট,
বরকত সালামের খুনে লাল ঢাকার রাজপথ,
ভুলবাে না।
স্মৃতিসৌধ ভাঙিয়াছে।
জেগেছে পাষাণে প্রাণ,
মােরা কি ভুলিতে পারি
খুনরাঙা জয়নিশান খুনরাঙা জয়নিশান, ভুলবাে না ।
সুর : নিজামউল হক, বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল
বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫

একুশের গান
আবদুল হালিম বয়াতি

এদিক ওদিক বলতে আমার অনেক হবে দেরি
মন দিয়া শােনেন ভাষা আন্দোলেনের জারি…।
গুলি চলে চলে রে আমার ভাইয়ের বুকে গুলি চলে
সােনার টুকরা ছেলেরা সব পড়ল ঢলে ঢলে রে…।
…..
বরকত, সালাম, শফিউদ্দিন শহীদ হইয়া গেল
আরও একজন রিকশাচালক বুকের রক্ত দিল
নাম না জানা আরও কত মানুষ মরে…
…..
বরকত, সালাম, জব্বার, রফিক ভাষা চেয়েছিল
গুলির সামনে বুক পাতিয়া চিরবিদায় নিল
দিয়া গেল পথের সন্ধান প্রতি ঘরে ঘরে
(এখন) বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা তাদের রক্তের জোরে রে…।
একুশের গান, সম্পাদনা : মােবারক হােসেন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০
৩৩

একুশের গান
আবদুল লতিফ

আবার যে রে সর্বনাশা আইলাে ফেব্রুয়ারি
এই দিনেতে বাছারা মাের গেছে মােরে ছাড়ি ॥

জ্বালাইয়া নিভা আগুন আইলাে রে সেই আটই ফাগুন
এইদিন জল্লাদেরা গেছে আমার কলিজায় তীর মারি ॥

‘মন সে চেনে গহিন গম্ভীর পঙ্খি চেনে ডাল,
মায় যে জানে পুতের বেদনা কলিজার লাল,

এই তাে মাগাে আসি বলে
বাছারা মাের গেল চলে
সেই যে গেল আর না তারা ফিরা আইলাে বাড়ি ॥

‘গােয়ালের বড় দুঃখ মরলে গােহাল গাই,
তারও চেয়ে অধিক দুঃখ যার মরে জোড়ের ভাই’
আমার ভাই যে সালাউদ্দীন
জব্বার রফিক শফিউদ্দীন
আমি-সালাম ভাইয়ের মুখখানা যে ভুলতে না পারি ॥
সুর: আবদুল লতিফ, আবদুল লতিফ, ভাষার গান দেশের গান,
বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫

একুশের গান
শাহ আবদুল করিম

সালাম আমার শহীদ স্মরণে ।
দেশের দাবি নিয়া দেশপ্রেমে মজিয়া
প্রাণ দিলেন যেসব বীর সন্তানে ॥

ভাষার দাবি লইয়া, আপনহারা হইয়া
স্মৃতি গেলেন রাখিয়া, বাঙালির মনে ।
সালাম-বরকত-জব্বার, প্রিয় সন্তান বাংলার
ভুলিবার নয়, ভুলি কেমনে ॥
৩৪

জন্ম নিলে পরে, সবাই তাে মরে
স্বাভাবিক মরা এই ভুবনে ।
দেশের জন্য প্রাণ, যারা করে দান
স্মরণ করি আজ ব্যথিত মনে ॥

লভিব অধিকার, ঘুচাব আঁধার
শপথ বারে বার-মনপ্রাণে ।
আবদুল করিম বলে, শােষণমুক্ত হলে
হাসি ফুটিবে সবার বদনে ॥
সুর : শাহ আবদুল করিম, একুশের গান, সম্পাদনা: মােবারক হােসেন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০

একুশের গান
আবুবকর সিদ্দিক

একুশে নিয়েছি শপথ ভাই
রক্তে চোখের জলে
মুখের বুলিরে রাখবই মােরা
বিপুল বুকের বলে ।

তপ্ত শােনিতে পিছল পথ
তারই পরে চলে জীবন রথ
আমরা মানি না শঙ্কা হার
কাফেলা এগিয়ে চলে ॥

চিত্তে নিত্য দিয়েছ বিত্ত
মধুর বাংলা ভাষা
প্রেম দিই যারে প্রাণ দিই তারে
এরই নাম ভালােবাসা ।

মানি না শঙ্কা তুফান ক্ষয়
পরাজয় ভয় করেছি জয়
মিলেছি সালাম-বরকতে
মিছিলে সবার দলে ৷
সুর : সাধন সরকার, নাজিম সেলিম বুলবুল, আমাদের মুক্তি সংগ্রামে গণ-সঙ্গীতের ভূমিকা
ঢাকা বুক সােসাইটি, ১৯৭৯
৩৫

একুশের গান
কাজী রােজী

বাংলা আমার অহংকারের ভাষা
বাবুই পাখির বাসার মতাে
গভীর বুনােট ঠাসা।
স্বরব্যঞ্জন বর্ণমালার ডাকে
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি রাখে
হাজার ছাত্র-জনতা।

সেদিন ছিল ১৯৫২ সাল
কৃষ্ণচূড়ার লালের মতাে
রাজপথ হয়েছিল লাল
মায়ের ছেলেরা মায়ের বুকে ফিরল না।
জীবন দিতে এতটুকু দ্বিধা করল না।
ফাগুনের আট ফেব্রুয়ারির সেই একুশ থেকে
শুরু হলাে প্রতিটি বছর প্রভাত ফেরীর নীরবতা ॥

রফিক সালাম বরকত আরও কত নাম
সেদিন থেকে অমর হয়ে
দিয়ে গেল বর্ণের দাম
মায়ের ভাষায় কথা বলবার দিন এলাে
মাতৃভাষা আন্তর্জাতিকতা পেলাে।
সারা বিশ্বের সকল ভাষার মানুষ সবে
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ ভাষা দিবস মেনে নিলাে তা ॥
সুর: কাজী মিজানুর রহমান
ভাষার গান দেশের গান
ফজল-এ-খােদা

আটই ফাল্গুন তের শ আটান্ন সাল
ভাষার জন্য দেশের জন্য শহীদ হওয়ার কাল—
ভুলি নাই ভুলি নাই, কি করে
ভুলে যাই ভুলি নাই ভুলি নাই, ভুলতে পারি না ভাই ॥
৩৬

জব্বার বরকত রফিক সালাম
ভাষাশহীদ বীর বাঙালির নাম
ভুলি নাই ভুলি নাই আমরা
রক্ত দিয়ে আনলাে যারা।
মুক্তির প্রথম সকাল ॥

বাংলা ভাষার সেই প্রতিবাদ
হীন দাসত্বের ভেঙেছে বাঁধ।
ভুলি নাই ভুলি নাই আমরা
রক্তের সেই ভিত্তি ‘পরে
উঠেছে সূর্য লাল ॥
সুর : আবদুল লতিফ, সমবেত, ১৯৭৪

ইতিহাস
ফজল-এ-খােদা

শােনাে ইতিহাস…..
বাংলা ভাষার ইতিহাস
রক্তে ভেজা রক্তে লেখা রক্তে রাঙা ইতিহাস
সেই ইতিহাস, বিজয়ের
ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস।
শােন ইতিহাস ……
আজ সেইদিন আটই ফাল্গুন,
একুশে ফেব্রুয়ারি;
এইদিন আমরা কি করে ভুলি
ভুলিতে কি পারি?

ভুলবাে না ভুলবাে না তােমাদের
হে শহীদ বরকত রফিক সালাম!
তােমরা আমাদের উষ্ণ হৃদয়ের
লহ সালাম।
লহ সালাম।
সুরকার ও গায়ক : শেখ লুত্যর রহমান
ভাষার গান

ও কোকিল রে …
তুই ফাগুন মাসে কুহু কুহু ডাকিস না রে আর
তাের ডাক শুনে মাের ভাইয়ের কথা
মনে পড়ে বার বার ॥

ভাইরা আমার প্রাণ সঁপেছে মায়ের ভাষার তরে
এই ফাগুনে তাদের লাগি সবার আঁখি ঝরে,
তুই কুহু ডাকে স্মৃতির আগুন
দ্বিগুণ জ্বালাস না রে আর,
ভাইকে আমার মনে পড়ে বার বার ॥

এই ফাগুনে ভাইরা আমার ভাষার আগুন জ্বেলে
হাসিমুখে কচি বুকের রক্ত গেছে ঢেলে ।।

ভাইরা আমার বেঁচে রবে হাজার বছর ধরে
কে বলে ভাই সালাম বরকত শহীদ হলাে মরে !
তারা মায়ের মুখের ভাষা হয়ে।
আমায় ডাক দেয় বার বার;
কোকিল তুই কুহু কুহু ডাকিস না রে আর ॥
সুরকার: শেখ লুৎফুর রহমান, শিল্পী: মহুয়া হক

দেশের গান

একটি কণ্ঠ হাজার কণ্ঠে কণ্ঠে
দিকে দিকে তােলে ধ্বনি, লক্ষ প্রতিধ্বনি
-বাংলাদেশে
জাগ্রত চির নতুন বাংলাদেশ ।
একটি কণ্ঠ ……
রফিক সালাম জব্বার বরকতের ভাষা
নজরুলের স্বপ্ন আশা-বাংলাদেশ।
কবি জসীমের নকশি কাথা।
জয়নুলের তুলির ব্যথা-বাংলাদেশ।
একটি কণ্ঠ হাজার কণ্ঠে কণ্ঠে…।
সুরকার ও গায়ক: বশীর আহমেদ
৩৮

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার সংগ্রাম এবং জীবনদান পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। বাঙালির এই আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত বিশ্বসভায় মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘােষণা করে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য এক গৌরবময় অধ্যায় রচিত হয়। এর ফলে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের ভাষাশহীদদের আত্মদান বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করে এবং পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় । ইউনেস্কোর এই ঘােষণা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির বিলুপ্ত ও প্রায় বিলীয়মান ভাষাগুলাের পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ এবং ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার পথ সুগম করেছে। ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের সকল প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষীসহ অন্যান্য দেশের মানুষও ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবাই বাংলাদেশের ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পেছনে বাংলাদেশের বাইরে বসবাসরত কয়েকজন মাতৃভাষাপ্রেমিকের অবদান স্মরণযােগ্য । কানাডা প্রবাসী বিভিন্ন ভাষাভাষীর বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গ সম্মিলিতভাবে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন । তাদের মধ্যে ছিলেন রফিকুল ইসলাম (বাংলাদেশ), আবদুস সালাম (বাংলাদেশ), অ্যালবার্ট ভিনসন (ফিলিপিনাে), কারমেন ক্রিস্টোবাল (ফিলিপিনাে), জেসন মরিন (ইংলিশ), সুজান হজগিনস (ইংলিশ), ড. কেলভিন চাও (ক্যানটোনিজ), নাজনীন ইসলাম (কোচ), রেনেটা মার্টিনস (জার্মান) এবং করুণা যােশী (হিন্দি)।
উপরিউক্ত ব্যক্তিগণ ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘােষণার জন্য ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নিকট একটি আবেদনপত্র পাঠান । আবেদনপত্রে তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে বাঙালির রক্তদানের পটভূমি বিবৃত করেন। মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার এই ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত । বহু দেশেই
৩৯

সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফলে সে দেশের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে । এ ধরনের আগ্রাসনের কবলে পড়ে মাতৃভাষার বিলােপ পৃথিবীর ভাষাবৈচিত্র্য ও . সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকি স্বরূপ । আবেদনপত্রে এসব বিষয়ও তুলে ধরা হয়। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ বরাবর একটি প্রস্তাব পাঠানাে হয়। একটি দেশ ও জাতির সংস্কৃতির ধারক তার ভাষা। সকল জাতির সকল ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবস পালন তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিষয়গুলাের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর ভিতর দিয়ে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের ঘটনা পৃথিবীর সব দেশে মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করা হয় । ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে যেসব দেশ বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহযােগিতা প্রদান করে, তাদের মধ্যে রয়েছে : আইভােরি কোস্ট, ইটালি, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, ওমান, ক্যামেরুন, গাম্বিয়া, চিলি, ডােমিনিক রিপাবলিক, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, প্যারাগুয়ে, ফিলিপাইন, বেনিন, বাহামা, বেলারুশ, ভারত, মাইক্রোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিশর, রাশিয়ান ফেডারেশন, লিথুয়ানিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুরিনাম, সৌদী আরব, স্লোভাকিয়া, হন্ডুরাস প্রভৃতি দেশ ।
৪০

উপসংহার
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্ণ হলাে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে ১৯৫৬ সালে । ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জোরালাে হয়ে উঠেছে। অথচ ভাষাশহীদ সালাম ও রফিকের কবরগুলাে আজও অচিহ্নিত রয়ে গেছে। এবারের বাংলা একাডেমী আয়ােজিত ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের আলােচনায় প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়। আলােচকগণ ভাষাশহীদ সালাম ও রফিকের কবর শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ পরীক্ষার প্রস্তাব করেন । এতাে বছর পর তা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে আজিমপুর কবরস্থানে অন্যান্য ভাষাশহীদদের কবরের পাশে আবদুস সালাম ও রফিকউদ্দীনের স্মরণে দুটো সৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা যায়। এ ছাড়া ফেনীবাসীর দাবিগুলাে পূরণ করা খুব কঠিন ব্যাপার নয়।
ফেনীতে সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের সামনে সালামের স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা যেতে পারে। স্মৃতি জাদুঘরের পাশে অবস্থিত শহীদ মিনারটি অনাদরে অবহেলায় মলিন হয়ে আছে । এটিরও যথাযথ সংস্কার প্রয়ােজন। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন এবং এলাকাবাসীর সচেতন হওয়া উচিত। কেবল বছরে একদিন একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করলেই শহীদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন হয় না। কথাটি ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সকল শহীদ মিনারের বেলায় প্রযােজ্য। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তেমনি শহীদ মিনার সংরক্ষণ করে ভাষাশহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারও নিশ্চিত হয় নি। বরঞ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার প্রতি অবজ্ঞা, উচ্চশিক্ষা থেকে বাংলাকে প্রায় বিসর্জন, বাংলা ভাষার বিকৃত প্রয়ােগ ইত্যাদি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এসব সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরি।
৪২

পরিশিষ্ট
ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ

১৭ মে ১৯৪৭ হায়দ্রাবাদে এক ভাষণে মুসলিম লীগের নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান বলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে ।
জুন ১৯৪৭ কলকাতার ইত্তেহাদ পত্রিকায় বাংলার পক্ষে আবদুল হকের বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ ।
জুন ১৯৪৭ কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখের নেতৃত্বে নবগঠিত গণআজাদী লীগ তার দলীয় ইশতেহারে ঘােষণা করল, মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে’ এবং বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
জুলাই ১৯৪৭ আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
২৯ জুলাই ১৯৪৭ ড. জিয়াউদ্দীনের বিবৃতির প্রতিবাদে দৈনিক আজাদ-এ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশ ।
২৭ নভেম্বর ১৯৪৭ করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে সুপারিশ করা হয় ।
৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে গিয়ে শিক্ষা সম্মেলনের সুপারিশের বিরুদ্ধে ঢাকার ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ প্রদর্শন ।
৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭ শিক্ষা সম্মেলনের সুপারিশের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভ।
১২ ডিসেম্বর ১৯৪৭ বাস ও ট্রাকে চড়ে উর্দুর পক্ষে ধ্বনি দিতে দিতে এক দল লােকের মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রাবাসে হামলা।
ডিসেম্বর ১৯৪৭ তমদুন মজলিসের নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন ।
ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ বাংলাভাষার পক্ষে সহস্র ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করে । স্মারকলিপি দেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি।
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে সংশােধনী প্রস্তাব আনলে মুসলিম লীগ সদস্যদের সম্মিলি বিরােধিতায় তা বাতিল হয়ে যায়। রাজশাহীতে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে ধর্মঘট করে ।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ বরিশালের জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে বাংলার পক্ষে জনসভা আয়ােজিত হয় । রাজশাহীর নওগাঁয় সারা মহকুমায় আন্দোলন পরিচালনার জন্য। সর্বদলীয় কমিটি গড়ে ওঠে ।২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তমদুন মজলিস ও পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগ যৌথভাবে ১১মার্চকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
খুলনা, পাবনা, মুন্সিগঞ্জ ও দিনাজপুর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২ মার্চ ১৯৪৮ গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা-সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ ১৯৪৮ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা-সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট পালিত হয়। আহত হন ২০০, জেলবন্দি হন৬৯ জন । ১৩ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।
১৪ মার্চ ১৯৪৮ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়।
১৫ মার্চ ১৯৪৮ এদিনও সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয় ।
১৬-১৭ মার্চ ১৯৪৮ সভা, মিছিল, পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলিতে ঢাকা
প্রকম্পিত থাকে ।
২১ মার্চ ১৯৪৮ রমনা রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনায় পাকি
স্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে
আপনাদের বলে দিতে চাই যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনাে ভাষা
নয়। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে এবং ‘না, না’ চিৎকার শােনা যায় ।
২৩ মার্চ ১৯৪৮ জিন্নাহর রেসকোর্সের বক্তৃতার সমালােচনা করে এ কে ফজলুল
হকের বিবৃতি প্রচার ।
২৪ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কার্জন হলে) বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে।
জিন্নাহ আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘােষণা করেন । আবদুল মতিনসহ অন্য ছাত্ররা ‘নাে, নাে’ বলে প্রতিবাদ করেন । সর্বদলীয় রাষ্ট্রাভাষা-সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিরা জিন্নাহর সঙ্গে আলােচনায় বসেন। তাতে তীব্র বাকবিতণ্ডা ও চেঁচামেচি হয় ।
৪৬

৫ এপ্রিল ১৯৪৮ মওলানা আকরম খাঁ বলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র
রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।
১১ মার্চ ১৯৪৯ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত ।
১১ মার্চ ১৯৫০ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত ।
৪-৫ মার্চ ১৯৫০ পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির উর্দু রাষ্ট্রভাষা সুপারিশের
বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের লক্ষ্যে সংগঠিত সংগ্রাম কমিটি এক
সম্মেলনের আয়ােজন করে।
১২ নভেম্বর ১৯৫০ সারা দেশে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় ।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী
নূরুল আমিনকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ইব্রাহিম খাঁ ও ড. কাজী মােতাহার হােসেনসহ অনেক
বুদ্ধিজীবী স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রদান।
১১ মার্চ ১৯৫১ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত ।।
১৬ মার্চ ১৯৫১ কুমিল্লায় পূর্ববঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ অধ্যাপক সম্মেলনে
সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বাংলাভাষা
অবহেলিত হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করব ।
২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ ঢাকায় পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের ভাষণে
প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে
উর্দু এবং উর্দু হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়ে উঠছে।
২৯ জানুয়ারি ১৯৫২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে
প্রতিবাদসভা আয়ােজনের মাধ্যমে খাজা নাজিমউদ্দীনের
বক্তব্যের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিক্ষোভের সূচনা করে।
৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ কাজী গােলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক মনােনীত করে ঢাকা বার
লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন ।
৪ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বানে এবং সর্বদলীয়
সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে সকল শিক্ষায়তনে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলের
মাধ্যমে সারা দেশে প্রতিবাদ দিবস পালন।
১২ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৫২ পাকিস্তান অবজারভার-এ খাজা নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে ছদ্ম
ফ্যাসিজম’ শিরােনামে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ আপত্তিকর নিবন্ধ প্রকাশের অভিযােগ তুলে পাকিস্তান অবজারভার-এর
ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ মুক্তির দাবিতে জেলবন্দি আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ
মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের অনশন ধর্মঘট শুরু ।
৪৭

১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ অনশনরত শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর ।
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে ‘জনসভা, শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ।
সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠকে ‘১৪৪ ধারা
ভঙ্গ করা হবে কি হবে না তা নিয়ে পর্যালােচনা ।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সকাল ৭টা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার। বাইরে পুলিশ বাহিনীর অবস্থান
গ্রহণ। নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়চত্বরে
(বর্তমান মেডিকেল কলেজের ভেতরে) স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের
জমায়েত শুরু । গাজীউল হকের নেতৃত্বে সকাল ১১টার কাছাকাছি সময়ে
আমতলায় ছাত্রসভা আরম্ভ । সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রের মত অনুসারে ১৪৪ ধারা
ভাঙার সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ জনের একেকটি দলে বিভক্ত হয়ে
ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়-চত্বর থেকে বেরুনাে মাত্র পুলিশ হামলা চালায় । পুরাে
এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুপুর জুড়ে চলতে থাকে। এ দক্ষযজ্ঞ । বিকেল
৩টা ১০ মিনিটে ছাত্রদের উপর পুলিশ দু দফায় ২৭ রাউন্ড গুলি চালায়। ২১
জন হতাহত হন। শহীদ হন কমপক্ষে চারজন । প্রথম শহীদ এমএ দ্বিতীয়
পর্বের ছাত্র আবুল বরকত । বাকিরা হলেন আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দীন।
পরে আবদুস সালাম নামে আরাে একজন মারা যান ।। মেডিকেল কলেজ
হােস্টেল থেকে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান
জানানাে হয়। আইনসভায় প্রতিবাদী বক্তৃতা দিয়ে মওলানা আবদুর রশীদ
তর্কবাগীশ কক্ষ ত্যাগ করেন।। সন্ধ্যা নাগাদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দোকানপাট বন্ধ
হয়ে যায়। শহরে শােকের ছায়া নেমে আসে। রাজশাহীতে রাজশাহী কলেজের
নিউ হােস্টেল প্রাঙ্গণে রাতের বেলা গঠিত হয় দেশের প্রথম শহীদ মিনার ।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ হরতাল । আগের রাতের ছাত্রবৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী সকালে মেডিকেল হােস্টেল
প্রাঙ্গণে ভাষা শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বস্তরের প্রায় ৩০
হাজার লােক এ জানাজায় অংশ নেন । জানাজার পর জমায়েত থেকে
গণবিক্ষোভ স্ফুরিত হয়ে ওঠে । সারা রাস্তা তপ্ত হয়ে পড়ে । ট্রেনসহ সকল
যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের পাশাপাশি রাস্তায় নামানাে হয় ইপিআর
৪৮

ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের । ঢাকার নানা স্থানে জনতার ওপর পুলিশ-ইপিআর-সেনাবাহিনীর
হামলা । গুলিতে শফিউর রহমান, রিকশাচালক আবদুল আউয়াল, কিশাের অহিউল্লাহসহ
অজ্ঞাতসংখ্যক লােক শহীদ হন। উত্তেজিত ঢাকার আদিবাসিন্দারা মর্নিং নিউজ পত্রিকার
ছাপাখানা জুবিলি প্রেসে আগুন লাগিয়ে দেয় । পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদ থেকে আজাদ-সম্পাদক
আবুল কালাম শামসুদ্দীনের পদত্যাগ । ১৪৪ ধারার পাশাপাশি রাত ১০টা থেকে ভাের ৫টা পর্যন্ত
সান্ধ্য আইন জারি করা হয় । সকালে রাজশাহীতে দেশের প্রথম শহীদ মিনারটি পুলিশ গুড়িয়ে
দেয় ।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ হরতাল । ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে রাজপথে জনতার ঢল । সকলের
কালাে ব্যাজ ধারণ । বাড়িতে বাড়িতে কালাে পতাকা। দেশে সর্বত্র পূর্ণ
হরতাল পালিত । দুপুর ২টায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে প্রায় ৪ হাজার
লােকের অংশগ্রহণে ভাষা শহীদদের গায়েবানা জানাজা। বিকেলে
সলিমুল্লাহ হলের গায়েবানা জানাজা । সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রদের সঙ্গে
মিলিত হয়ে এ কে ফজলুল হকের একাত্মতা প্রকাশ । মেডিকেল
কলেজ হােস্টেলের ১২ নম্বর শেডের কাছে ছাত্ররা রাতের বেলা
ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার গড়ে তােলেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ হরতাল । মেডিকেল কলেজের শহীদ মিনারটি
অনানুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ হরতাল ।
২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ পুলিশ জননিরাপত্তা আইনে শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেপ্তার করতে থাকে। ভােরে গ্রেপ্তার করা হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পি সি চক্রবর্তী, মােজাফফর আহমদ, মুনীর
চৌধুরী এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহকে। সকালে আবুল কালাম
শামসুদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে মেডিকেল কলেজের শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন ।
বিকেলে পুলিশ এসে শহীদ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। অনশন ধর্মঘটের কারণে
বাধ্য হয়ে ফরিদপুর জেল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান ।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা।
৪৯

পাকিস্তান মুসলিম লীগ ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কিছু নেতা এক যুক্তবিবৃতিতে বলেন,
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রাদেশিক প্রস্তাব গণপরিষদে গৃহীত হওয়ার সমস্ত চেষ্টা
চালানাে হবে, বিচারপতির মাধ্যমে তদন্ত কমিটি গঠন এবং দোষীদের শাস্তি ও নিহতদের
পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে ।
৭ এপ্রিল ১৯৫২ একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলিবিদ্ধ আবদুস সালাম মৃত্যুবরণ করেন ।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ অত্যন্ত আবেগঘনভাবে প্রথম শহীদ দিবস পালন। ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের
বিলুপ্ত স্মৃতিস্তম্ভের জায়গায় কালাে কাপড় ও কাগজ দিয়ে প্রতীকী শহীদ মিনার
বানায়। কার্জন হলেও আরেকটি প্রতীকী শহীদ মিনার বানানাে হয়।
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সন্ধ্যায় শহীদ রিকশাচালক আবদুল আউয়ালের শিশুকন্যা বশিরনকে
দিয়ে শহীদ মিনারের অনানুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সরকারিভাবে প্রথম শহীদ দিবস পালন। একুশের দিনে সরকারি ছুটি ঘােষণা ।
কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। কিন্তু ছাত্রজনতার চাপে পূর্ব পাকিস্তান
আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী শহীদ আবুল বরকতের মা
হাসিনা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে বাধ্য হন।
৫০

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জি

আবদুল করিম (সালামের ছােট ভাই)
মাহমুদুল হক (সালামের জেঠাতাে ভাই)
নূর আহমদ (সালামের আত্মীয় ও প্রতিবেশী)
মােহাম্মদ শাহাদাত হােসেন, সভাপতি, ভাষাশহীদ আবদুস সালাম স্মৃতি পরিষদ, সম্পাদক, দৈনিক ফেনীর সময়, ফেনী
আবদুল্লাহ আল-মামুন, বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ফেনীর সময়, ফেনী মােহাম্মদ জামালউদ্দিন, কেয়ারটেকার, আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নুরজাহান বেগম, প্রধান শিক্ষিকা, লক্ষ্মণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়
মনজুর তাজিম, সম্পাদক, মাসিক আনন্দ ভৈরবী, ফেনী
ভাস্কর রাসা, ঢাকা আসাদুজ্জামান দারা, ফেনীর প্রতিনিধি, কালের কণ্ঠ
মােহাম্মদ ইসরাফিল, সভাপতি, মাতুভূইয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ জহিরউদ্দীন বাবর, প্রাক্তন সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার

অন্যান্য সূত্র

এম এ হান্নান চৌধুরী, পরিচালক, ক্লাসিক কম্পােজিট লিমিটেড, গাজীপুর মিসেস সেলিনা পারভীন, ঢাকা
তালেব আলী, প্রাক্তন সংসদ সদস্য, ফেনী
শহীদুল কবির তুহিন, স্বত্বাধীকারী, ইজেল প্রােডাকশন, ঢাকা
আবদুল্লাহ-বিন আহমেদ, ফেনী ।
ফজল-এ-খােদা, ঢাকা কাজী রােজী, ঢাকা
কল্যাণী ঘােষ, ঢাকা।
মােবারক হােসেন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
নূর হােসেন তালুকদার, পরিচালক, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, ঢাকা
মােহাম্মদ রেজাউল আলম, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, ঢাকা
৫১

গ্রন্থপঞ্জি
নাজিম সেলিম বুলবুল, আমাদের মুক্তি সংগ্রামে গণ-সঙ্গীতের ভূমিকা’, ঢাকা বুক
সােসাইটি, ১৯৭৯
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস : কয়েকটি দলিল, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৩
আবদুল লতিফ, ভাষার গান দেশের গান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫
মাহবুব উল আলম চৌধুরী, কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’, ঢাকা, ১৯৮৮ শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক কবিতা, ঢাকা, ১৯৮৮
ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯১
আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত মহিন শাহের পদাবলী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা,
১৯৯৩
বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল বাংলা একাডেমী, ঢাকা,
১৯৯৫
একুশের কবিতা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৯।
একুশের ঘটনাপঞ্জি, ৫০তম, একুশে, সম্পাদনা : রফিকুল ইসলাম, মুহম্মদ নূরুল হুদা,
নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা ২০০১
প্রামাণ্যচিত্র “বিশ্ব তােরণে বাংলা”, ভাস্কর রাসা (পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও পরিচালনা),
ঢাকা ২০০৩
একুশের পটভূমি একুশের স্মৃতি, সম্পাদক : মতিউর রহমান, পার্ল পাবলিকেশন্স, প্রথম
আলাে, ঢাকা ২০০৩
মহসিন হােসাইন সম্পাদিত কবিয়াল বিজয় সরকারের জীবন ও সংগীতসমগ্র,
জ্যোতিপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮
এম এ বর্ণিক, ভাষা আন্দোলন স্মারকগ্রন্থ, ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম, চারুলিপি
প্রকাশন, ঢাকা ২০০৯
একুশের গান, সম্পাদনা: মােবারক হােসেন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০
৫২