You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

ভাষাশহীদ আবুল বরকত
পাপড়ি রহমান

শৈশব
গ্রামের নাম বাবলা। এই অঞ্চলে বাবলা খুবই সাধারণ গাছ। যদিও বাংলার এই অঞ্চলে গাছ থাকে কদাচিৎ। আছে কেবল মাঠ। চারদিকে ফাঁকা খাখা মাঠ। বাবলা গ্রামের পূর্ব আর পশ্চিমের মাঠ এত বড় যে দিগন্তরেখাকে শিশুর চোখের কাজলরেখার চেয়েও ক্ষীণ দেখায়। এই অঞ্চলে এই রকমের মাঠকে বলে ছাতিফাটা মাঠ। অর্থাৎ, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যের গ্রীষ্মে খরদুপুরে ওই মাঠ পেরিয়ে যদি কেউ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যায়, তৃষ্ণায় তার ছাতি অর্থাৎ বুক ফেটে যায়। সব গ্রামের কোল ঘেঁষে ঘুটিং ভরা অনাবাদি জমি, ন্যাড়া টিপি কি ঘােলা জলের সেচের পুকুরের পাড়ে এই বেঁটেকালাে গাছালি রয়েছে, তার কোনাে কোনােটি কুঁজো, হয়তাে যখন শিশু ছিল বৈশাখি ঝড়ে মাজা ভেঙে গিয়েছিল। ওই গাছ যে কোন কাজে লাগে কে জানে? একটুখানি সৌন্দর্য আছে ঝিরিঝিরি পাতায়, কিন্তু সেও কঠিন কাটায় আকীর্ণ। ওই গাছের তলা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে গেলে বড় সাবধানে আঙুল টিপেটিপে হাঁটতে হয়, মাটিতে কাটা থিকথিক করে। তাহলে যদি ওই গাছ কোনাে কাজেই না লাগে তাে ওর তলায় কেউ যায় কেন? যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কোনাে রাখালের গরুর পালে দুএকটা ঠ্যাটা গরু থাকে। সে মাঠের শ্যামল আলের কোমল ঘাস ফেলে ওই ন্যাড়া বাবলাতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দু-একবার মাথা তুলে লম্বা জিভ বের করে বাবলার পাতা ছোঁয়ার চেষ্টা করে, আবার কখনও কখনও মাথা নামিয়ে মাটিতে নাক ঠেকিয়ে ফোস ফোস করে শ্বাস ছাড়ে, কিন্তু ওখান থেকে নড়ে না। রাখাল ওটাকে মুখ খারাপ করে ডাকে, কিন্তু মনে ওর কী ভাব জাগে কে জানে হয়তাে গরুদের মধ্যেও কবি থাকে। একটু নড়ে-চড়ে হয়তাে গিয়ে গাছের গুঁড়িতে ঘষে পিঠটা একটু চুলকে নেয় কিন্তু ওখান থেকে সে নড়ে । ঝিরঝিরে হাওয়ায় জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা! ওই হাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ওই গরু কি উদাস হয়ে গেছে! তখন রাখাল পাঁচন-উঁচিয়ে ছুটে যায়। হ্যা, তাকে ওই বাবলাতলার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়, কারণ হয়তাে বাবলার কাঁটা ওখানে থিকথিক করছে।
বাবলার গাছ রাঢ়-বঙ্গ জুড়ে অসংখ্য রয়েছে যত্রতত্র। কিন্তু বাবলা নামে গ্রাম এই একটিই। ঘােট, সামান্য একটি গ্রাম। এমন কিছুই নেই ওখানে। হাট বসে না, স্কুল নেই, ডাকঘর নেই। নিম্নমধ্যবিত্ত কয়েক ঘর মুসলিম পরিবার আছে। ওরই মধ্যে দুচারটি ঘর হয়তাে একটু বেশি সঙ্গতিওয়ালা, একটু বেশি তাদের জমিজমা আছে। আর বেশিরভাগই পরের জমিতে খেটেখাওয়া নিম্নশ্রেণির খেত-মজুর।
এই বাবলা গ্রামেই ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন জন্মগ্রহণ করে আবাই। আবাইয়ের পুরাে নাম আবুল বরকত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার
১০

ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামের সন্তান আবাই। তার পিতা মৌলভী শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু মিয়া, মাতা হাজি হাসিনা বিবি।
আবুল বরকতের গ্রাম বাবলা। বাবলা গ্রামে অন্যসব ছেলেদের চাইতে লম্বা হয়ে ওঠা আবাই। একটু অস্বাভাবিক লম্বা।
হলুদ রঙের ছােটছােট গােলগােল ফুলভরা বাবলা গাছের নিচে দিয়ে এলােপাতাড়ি দৌড়ে যায় আবাই।।
গায়ে ধুলাবালি মেখে বড় হতে থাকেন।
মুসলমান ছেলেরা কেষ্টযাত্রার দল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবলা গ্রামকে ধুলায় ধুলাকার করে দিলে আবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কেষ্টযাত্রার দল থেকে যে ছেলেটি রাই বিনােদিনী সাজে সে গেয়ে ওঠে,
‘মরিলে ঝুলায়ে রেখাে তমালেরই ডালে গাে। বাবলা গ্রামে তমালের গাছও আছে বৈকি! তমালের মাথায় ঈদের চাঁদ দেখা গেলে আবাই আত্নাদিত হয়ে ওঠে।
আহা! নতুন কেনা জামাটা কালই পরা যাবে। আর চাদরাতে গায়েনরা হারমােনিয়াম বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় গেয়ে ফেরে
‘ও মন, রমজানের ওই রােজার শেষে এলাে খুশীর ঈদ।
অস্বাভাবিক লম্বা আবাই। বয়সের তুলনায় এত বেশি লম্বা যে সে লজ্জিত হয়ে হাঁটে। মাটির দিকে একটু বেশি ঝুঁকে হাঁটে। মাটির দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে মাটিকে চিনে বড় হতে থাকে…১
১৪

কৈশাের-যৌবন
তিন বােন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে আবুল বরকত সবার বড়। ছােট ভাইয়ের নাম আবুল হাসনাত। বরকতকে মা-বাবা ডাকে আবাই। বাবলা গ্রামেও সে ‘আবাই।
আবাই সব সময় চুপচাপ। গম্ভীর। বেশি বেশি কথা বলা তার স্বভাব নয়। আবাই মনােযােগ দিয়ে পড়ে শুধু বই। আর কি যেন ভাবে। লেখাপড়ায় তার দারুণ উৎসাহ। বাবলা গাছের ছায়াঘেরা যে গ্রাম সেই গ্রামের কিছু ছেলে পড়ে কাগ্রামের স্কুলে। বেশিরভাগ ছেলেই যায় তালিবপুর স্কুলে। তালিবপুরের ফুটবলের মাঠটি বাবলা থেকে দেখা যায় গ্রামের উপান্তে। ওখানে বাবলার কেউ কেউ খেলতেও যায়। খেলতে যায়। আবাইও। খেলতে খেলতেই আবাই আনমনা হয়। আবাইয়ের মনে বড় দুঃখ, চাপা বেদনা।
দক্ষিণে কাগ্রামে খুব উল্লাস, তারা উড়াে উড়াে শুনছে মুর্শিদাবাদ হিন্দুস্থানে পড়েছে। উত্তরে তালিবপুরে গভীর বিষাদের ছায়া, মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে পড়েনি। | নবাবদের স্থান মুর্শিদাবাদ, মুসলিম কৃষ্টির এক পীঠস্থান মুর্শিদাবাদ, সে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তান হলাে না! আবাই শুনেছিল এক নবাবপুত্র প্লেন ভাড়া করে উড়ে গিয়েছিলেন। করাচি, গিয়ে বলেছিলেন, আপনি এ-কী করলেন জিন্না সাহেব?
আগস্টের পর ক’মাস গেছে, শীত পড়েছে। পরীক্ষা চলছে। শেষ দিনের পরীক্ষা। আবাই খুব পড়ছে, কদিন রাত জেগেছে। শরীরের ছিপছিপে কাঠামােটিতে মাংস তাে খুব নেই, মাথা বেশ বড়। সরু গলা বুঝি আরাে সরু হয়ে গেছে। মা কইমাছ যােগাড় করে সুন্দর ঝােল রান্না করে রেখেছেন। মা বলছিলেন, ওরে পানি গরম করে দি, ঘরে গােসল কর। শােন আবাই, বড় ঠাণ্ডা, পুকুরে যাসনে বাবা।
আবাই এমনিতেই শান্ত। মনে হয়, নিরীহই বুঝি। কিন্তু মনে যা ভাববে তাই করবে। বলে, না মা, পড়তে পড়তে মাথাটা গরম হয়ে আছে। ঠাণ্ডা করে আসি।
গায়ে সরষের তেল মাখলাে, মাথার চাঁদিতে নারকেল তেল ঘষলাে। সময় নেই। পুকুর সামান্য দূরে। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাপুস-হুপুস কটা ডুব দিয়ে উঠে এলাে। ঠাণ্ডায় শরীর যেন জমে গেল। যাক, মনে হচ্ছে, আমার যত স্মৃতি, যত অনুভব, যত বিদ্যা এবং কল্পনা, সেটা বরফের মতাে শক্ত প্রকোষ্ঠে এখন বন্দি রয়েছে। পরীক্ষার খাতায় এখন আমি ওদের যেমন খুশি বের করবাে আর পুতুলনাচ নাচাবাে।
কিন্তু খেতে বসে কইমাছ দেখে অমনি হাত গুটিয়ে বসে রইলাে। বলল, মা, এখন কি আমার কইমাছের কাঁটা বাছার সময় আছে? মা তাড়াতাড়ি কাছে এসে বসে বললেন, আবাই তুই ভাতে ঝােল মাখা। কপি-ভাজাটা দিয়ে শুরু কর। আমি কাঁটা। বেছে দিচ্ছি। একলহমার বেশি লাগবে না।
১৫

কিন্তু আবাই যে ডিম বড় ভালােবাসে। ডিম খেতে না পাওয়ার দুঃখ সে ভুলতেই পারছিল না। আবাই হঠাৎ বললাে হ্যা মা, তােমার ওই মামলা করতে যাওয়া আর গরিব মানুষের জমি কিনে বেড়ানাে, এগুলাে বুঝি খুব ভালাে কাজ?
মা বললেন, হ্যারে, তাের চোদ্দপুরুষ কিনে রেখে গিয়েছিল বলেই তাে আজ যা হয় চাট্টি খাচ্ছিস। তখন আবাই হঠাৎ করেই সেই কথাটা বলে ফেললাে
মা, পাকিস্তান হলে আমি পাকিস্তান যাবাে। পাকিস্তান! হ্যা, পাকিস্তান শব্দটা কদিন হলাে মাথার ভেতর ঢুকে রয়েছে। ঢুকবে । সবাই যে বলচে পাকিস্তান হয়ে গেল রে।।
হাসমতের বড় ভাইটা তার চাচাকে নিয়ে এই না হওয়া পাকিস্তান গেল। ওখানে সব ব্যবস্থা করে তারপর সবাই মিলে চলে যাবে।
আবাইয়ের মাথায়ও ঢুকেছে চিন্তাটা। পাকিস্তান হলে তা হবে এক স্বপ্নের দেশ, যে স্বপ্নটাকে এ-দেশে তার হাত থেকে হঠাৎ কেড়ে নেয়া হয়েছে। সে আগে ভাবতে পারতাে না এমন হয়, এক মাটির স্বপ্নের তরু অন্য মাটিতে তুলে নিয়ে গিয়ে রােপণ করা যায়।
এ-কী কাণ্ড ঘটে গেল! সে কী করবে! পাকিস্তান হলে কি সে যাবে পাকিস্তান? হ্যা যাবেই তাে। কেন যাবে না। এরকম ভাবতে ভাবতেই আবাই পরীক্ষা শেষ করে ফেরে। পথের ধারে কে একজন গলা চড়িয়ে বলে ওঠে
‘গাে আবাই মিয়া, এতক্ষণে আপনের স্কুল শেষ হলাে?
আবাই দাঁড়ালাে। বলল, হ্যা আজ টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলাে। এবার ম্যাট্রিক দেব কি না। তােমরা দোয়া করাে, বুঝলে রমাই চাচা।।
রমাইচাচা লােকটা আধ-বুড়া। পাতলা ছিপছিপে দেহ, কাঁচা-পাকা খানিকটা দাঁড়ি আছে। বলল, আরে, বড় মিয়া, সে কথা বলতে হবে? দোয়া আমরা সব সময়ই করি। কিন্তু হ্যা, বুঝলেন কিনা, একটা আবদার আছে।
কী?
খালি ম্যাটরিক পাশ দিলে চলবে না, হঁ্যা বিএ পাশ দিতে হবে। এই যে কাগ্রাম, তালিবপুর ঘরে-ঘরে কত আইএ, বিএ পাশ। আমাদের বাবলা গাঁয়েরও নাম ছড়িয়ে দিতে হবে ।
তখন আবাই বলল, ও রমাইচাচা এদিকে যে শুনছি পাকিস্তান হয়ে যাবে গাে! মুসলমানের দেশ পাকিস্তান! |
রমাই চাচা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মুসলমানের দেশ পাকিস্তান? আবাই বললাে, হ্যা। শুনেছি তাে আমরাও, কিন্তু সেটা কোনদিকে হবে বলেন দেখি আবাই মিয়া?
হতে পায়ে খানিকটা আছে আমাদের এই পূর্ব দিকে। খানিকটা আছে পশ্চিমে, অনেক দূরে।
১৬

রমাইচাচা আবার জিজ্ঞেস করলাে । গঙ্গাপারের ওইদিকে নাকি?
আবাই বলল, না, ঠিক গঙ্গা না। গঙ্গা তাে গেছে মুর্শিদাবাদের মাঝখান দিয়ে। পদ্মার ওই পারে।
রমাইচাচা বলল, ওই হলাে একই কথা।
আবাই বলল, কিন্তু আমাদের এই দেশ হয়ে যাবে হিন্দুস্থান। হিন্দুর দেশ হিন্দুস্থান।
রমাইচাচা অবাক হয়ে বলল, হিন্দুর দেশ হিন্দুস্থান? হ্যা?
কেন গাে, এ দেশে কি মুসলমান থাকবে না? মুসলমান যাবে কোথা? আমাদের বাবলায় হিন্দুই নাই, সব মুসলমান তারা সব যাবে কোথা?
আবাই বলল, যে থাকতে চায় সে হিন্দুস্থানে থাকবে, যে যেতে চায় সে পাকিস্তানে যাবে।।
রমাইচাচা বলল, না বাপু, আমরা কোথাও যাবাে না। কিন্তু পাকিস্তান যদি হয় আমরা তাে যাওয়ার কথা ভাবছি। রমাইচাচা অবাক হয়ে বলল, বলেন কী গাে, আবাই মিয়া? আবাই বলল, হ্যা, কী করবাে বলাে। কষ্ট করে লেখাপড়া করছি, এখানে চাকরি জুটবে না। রমাইচাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, হায় রে খােদা, কী জমানা পড়ল।
আবাই বলল, ও চাচা, কিন্তু পাকিস্তান যদি হয় তােমরা যাবে না কেন? সেটা মুসলমানের দেশ না?
পাশ থেকে তখন কুদ্দুস উঠে দাঁড়ালাে, বলল, ও আবাই মিয়া আমরাকি চাকরি করি, না জমিদারি করি যে পাকিস্তানে যাব? যে যাবে সে যাবে, এই জমি কি পাকিস্তানে যাবে? | কুদ্স হঠাৎ হেঁট হয়ে একমুঠো মাটি তুলে নিল, তারপর সেগুলাে ফেলে দিয়ে পাছার গামছায় হাত মুছলাে। বলল, এই মাটি পাকিস্তানে যাবে?
আবাইয়ের বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব চলল, চলতে থাকলাে। পাকিস্তান হলে যাবে কি যাবে না। নিজের সঙ্গে নিজের তর্ক হয়। কখনাে পাকিস্তান জেতে কখনাে হিন্দুস্থান। যখন হিন্দুস্থান জেতে তখন সেটাকে সে আর হিন্দুস্থান বলে না, বলে স্বদেশ। ওই স্বদেশপ্রেম তার মাঝে-মাঝে প্রবল হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথাটা হচ্ছে, মা রাজি হন। হায়, তিনি পাকিস্তান ব্যাপারটার মানেই বুঝতে পারেন না! যাকগে। পাকিস্তান এখনাে হয় নি।
১৯৪৬ সন।
আবাইয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষা হয়ে গেল। ভাল মতাে পাশ করে মাকে বলে, এখনাে সময় আছে, চলাে পাকিস্তানে হলে সেখানে যাই।
১৭
=

মা বলেন, না।।
ম্যাট্রিক পাশ বলে কথা। বড় উক্রান্তি। ভাইবােনদের ডেকে সে ভােট লাগিয়ে দেয়। বলে, বল কে কোন্ দিকে? পাকিস্তান হলে পাকিস্তানে যাবি, না হিন্দুস্থানে পড়ে থাকবি।
ভােটে পাকিস্তান জেতে। কিন্তু তবু মা বলেন না। বলেন, হারে বাপ, হিন্দুদের সঙ্গে বলছিস বিনিময় করবি। আমার এইসব ঘরবাড়িতে এসে তারা উঠবে । কোথাকার কোন্ দেশের মানুষ। হিন্দু, আচ্ছা না হয় উঠল, না হয় হলাে হিন্দু, হিন্দুরাও মানুষ, আল্লাই তাদের বানিয়েছেন, তাের চোদ্দপুরুষের কবর আছে কবরস্থানে। তারা হয়তাে সেগুলাের বেইজ্জতি করবে। হারে বাপ, পাকিস্তান হলে সেখানে গিয়ে সুখী হতে পারবি? তােদের উপর তাদের লানৎ পড়বে না? বল?
ম্যাট্রিক পাশ করার পর আবাই বহরমপুর কলেজে গিয়ে ভর্তি হলাে।
আবাইয়ের দুই মামা। এই বাবলাতেই তাদের বাড়ি। বড়মামা বড় অফিসার। তিনি প্রথমে একটু অন্যরকম ভেবেছিলেন, আহা, চোদ্দপুরুষের ভিটে, জমি-জিরেত, আত্মীয়-পরিজন, চেনাজানা মানুষ সব ফেলে যাওয়া। কিন্তু যখন পাকিস্তান হলাে মন শক্ত করে চলে গিয়ে ওখানে ঢাকায় বড় চাকরিতে ঢুকে পড়লেন। তার বড় ছেলেটাও গেল প্রথমে। তারপর আর সবাই গেল। ওর সেই মামাতাে ভাই খুব আবেগ আর দরদ মাখানাে চিঠি লিখেছিল আবাইকে। আবাই সেই চিঠি পড়ে কেমন একরকম করে হাসলাে। বলল, আরে দূর, এক বাংলা থেকে যাব আর এক বাংলায়। আরে কিসের তােমার ভারত-পাকিস্তান? আমি ভারতে থাকলেই ভারতীয় নাকি? আর পাকিস্তানে গেলেই কি পাকিস্তানি নাকি?
ইদানীং কলেজে ভর্তি হয়ে সে রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে রাষ্ট্রতত্ত্বে অনার্স পড়বে। এমএ পড়বে। সে বলে, এখন জাতিতত্ত্বের মীমাংসা কে করে দেবে দাও। পাকিস্তান যদি মুসলমান রাষ্ট্র হয়, ইসলামে তাে জাতিতত্ত্ব নেই।।
মুসলমান হচ্ছে বিশ্বনিখিল জাতি।। ১৯৪৮ সনে আইএ পরীক্ষা দিল আবাই।
পরীক্ষা শেষ হলে মাকে বললাে, মা, এখনতাে পাকিস্তান হয়েছে। তুমি কি ভেবেছ। পাকিস্তান খুব দূরে? এই তাে রাজশাহী। একবার ঘুরে আসি। তুমি থাকো।
ঘুরে আসতে গিয়ে ঢাকার মায়ায় জড়িয়ে গেল আবাই। ফরিদপুর থেকে কই আসে এই এত বড়-বড় ঢাকার বাজারে। ভাবে এই কইমাছকে কতই না ভয় করতাম এ সেদিনও। কিন্তু কইমাছকে চুষে চিবিয়ে খেতে জানতে হয়। আবাইয়ের ভাইগুলােও এক এক করে ঢাকায় চলে এলাে। মা সেই বাবলা পল্লীতে বসে ধূসর চোখে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, তােরা সুখে থাক্‌, বাছারা!
১৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
আবুল বরকতের মামা আবদুল মালেক। আবদুল মালেকের বাড়ি পুরানা পল্টন লাইনের ‘বিষ্ণুপ্রিয়াভবন’। আবুল বরকত সত্যি সত্যি পাকিস্তান চলে এলেন। এসে উঠলেন মামা মালেক সাহেবের বাসায়।
১৯৪৮ সন।
এই সনেই বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
বরকত ‘বিষ্ণুপ্রিয়াভবনে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ছিলেন। বরকত ছিলেন অত্যন্ত। মনােযােগী ছাত্র। শুধু মনােযােগী ছাত্র নন, তিনি ছিলেন অতি ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও চরিত্রবান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র বরকতের শান্ত-শ্রীময় পদচারণা ছিল। অস্বাভাবিক রকম লম্বা হওয়ার সুবাদে তাকে অনেকের মধ্যেও চোখে পড়তাে।।
কোনাে ভিড়ভাট্টায় লম্বা মানুষটিকে দেখে সহপাঠিরা বলতাে, “ঐ যে বরকতকে দেখা যায়।
ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ-গাছালি, ইট-পাথর, মাটি, সবই বরকতের প্রিয় হয়ে ওঠে । প্রিয় হয়ে ওঠে এদেশের মানুষ। নিজের কুশলবার্তা জানিয়ে তিনি পিতা শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু মিয়াকে লেখেন চিঠি। পিতা ভুলু মিয়াও সেসব চিঠির জবাব দেন। বই কেনার টাকা চেয়ে চিঠি পাঠায় বাবলায়। উত্তর ফিরে আসে ঢাকায়। এভাবেই চলে যায় দিন-মাস-বছর।।
বরকত পিতাকে লেখেন, গত দেড় বৎসরে বানানাে একখানা মাত্র শার্ট, তাও ছিড়ে গেছে। কাপড় যে আর না বানালেই নয়। কাপড় বানাতে গেলেও ৬০-৭০ টাকা। লেগে যাবে।
১৯৫১ সন।।
আবুল বরকতের অনার্স পরীক্ষা শেষ হলাে ।
সেই ছােট্ট আবাই। এখন টগবগে তরুণ। আবুল বরকত দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ স্থান অধিকার করলেন।
১৯

ঢাকা
2.7.49
পাকজোনাবেষু,
বাবাজান, আমার হাজার ২ সালাম গ্রহণ করিবেন। আশা করি আপনারা এখন খােদার ফজলে ভাল আছেন। অদ্য আপনার পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম। গতকল্য মামুজিদের একজন নূতন চাকর মামুজির ম্যানিব্যাগ বিছানার তলা হইতে সন্ধ্যার একটু পরে চুরি করিয়া লইয়া পালাইয়াছে। ঐ ব্যাগে ২১৮৭ টাকা ছিল। গতকল্য মাহিনা পাইয়াছিলেন। মাহিনার সমস্ত টাকা ঐ ব্যাগে ছিল। মাত্র ৫০ টাকা উহা হইতে কাসেম মিয়াকে দিয়াছিলেন। এখন মামুজিদের কাছে খরচের একটি পয়সাও নাই। আমাদের মন বিশেষ ভাল নাই। আপনি যেন অতি অবশ্য ২ মামুজিদের নামে ৫০টি টাকা মানিঅর্ডার করিয়া যত শীঘ্ৰ পারেন পাঠাইয়া দিবেন। আমার শরীর বিশেষ ভাল নাই । কয়েকদিন হইতে সামান্য ২ জ্বর হইতেছে ও খুব শর্দি হইয়াছে। আমি ভাইকে। আগামিকল্য আলাইমিয়ার নিকট পাঠাইব ও যাহা হয় পরে জানাইব। আপনার যে চিঠি। ৩/৪ দিন হইল ভাই পাইয়াছেন। শরফুর চিঠি কাল তাহাকে যাইয়া দিয়া আসিব। চাদপুর, ভাই ও রুবি ভাল আছেন। মাকে এখন কাগ্রামেই ধৌয্য ধরিয়া থাকিতে বলিবেন। এত শীঘ্র অধৈৰ্য্য হইলে কি করিয়া চলিবে? আর যদি একান্তই মন খারাপ হইয়া থাকে তাহা হইলে বরং কোথাও ২/৪ দিন বেড়াইয়া আসিলে ভাল হয়। মাকে আমার সালাম ও হাসনাতকে আমার দোয়া দিবেন। ইতি-
আবাই।
২১

ঢাকা
8.8.49
পাকজোনাবেষু,
আমার হাজার ২ সালাম গ্রহণ করিবেন। আশাকরি আপনারা সকলে খােদার ফজলে ভাল আছেন। আমার শরীর ভাল নাই। কয়েকদিন গলার বেদনা লইয়া কষ্ট পাইলাম। | এখন একটু কম পড়িয়াছে। কয়েকদিন হইল আপনার একখানি পত্র পাইয়াছি। ইউনিভার্সিটিতে ২ মাসের বেতন প্রভৃতি লইয়া ৩৫ টাকা ৭/৮ দিনের মধ্যে লাগিবে। আপনি ঐ টাকা যত শীঘ্ৰ পারেন পাঠাইয়া দিবেন। গতকল্য মফু আসিয়াছে। তাহার কাছে জানিলাম আপনারা ২/১ দিনের গ্রামে যাইবেন। এখন কাগ্রামে থাকিবেন কি গ্রামে যাইবেন জানাইবেন। মাকে আমার সালাম ও জমসাতকে আমার স্নেহ দিবেন। | এখানে সকলে ভাল আছেন। আপনার কানের বেদনা এখন কিরূপ আছে জানাইবেন। শীঘ্র পত্রের উত্তর দানে সুখী করিবেন। ইতি-
স্নেহের
আবাই
২৫

Dacca
4.1.50
পাকজোনাবেষু,
আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। আশাকরি আপনারা সকলে খােদার ফজলে ভাল আছেন। কয়েকদিন পূর্বে আপনার একখানি পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইলাম। আপনি টাকা আগে যে ভাবে বহড়ার সিয়াদমিয়াকে পাঠাইতে দিয়াছিলেন ঐভাবে পাঠাইবেন কিংম্বা আমি বহরমপুরের যে ছেলেটির কথা বলিয়াছিলাম তাহাদের বাড়িতে টাকা দিলে আমি এখান হইতে তাহার কাছ হইতে ১০০ টাকা লইব। যাহা হউক আপনি যে ভাবে পারেন পাঠাইবেন। কাপড় চোপড় সব একরকম সব ছিড়িয়া গিয়াছে। এখানে আমার প্রায় দেড় বৎসর আসা হইল তাহার মধ্যে এখানে একটি সার্ট তৌয়ারি করাইয়াছিলাম এবং এবার বাড়ি হইতে আসার সময় বহরমপুর হইতে ২টা পায়জামা মাত্র তৌয়ারি করাইয়া আনাইয়াছিলাম। লুঙ্গি, সাট, পায়জামা সবই একরকম ছেড়া অবস্থা। এখানে কাপড় বানাইতে হইলে কমপক্ষে ৬০/৭০ টাকার কম হইবে না যাহা হােক আপনি আমার খরচ ও বেতনের জন্য ৪০ টাকা এবং কাপড়ের জন্য ৬০ টাকা পাঠাইবেন। সর্বসমেত ১০০ টাকার কম হইবে না। আপনি খােকা ভাইকে লিখিয়াছেন যে ৯০ টাকা আমি কি করিয়া খরচ করিয়াছি। আমার বাড়ি থেকে আসা প্রায় আড়াই মাস হইল। এই সময়ের মধ্যে আপনি ৪০ টাকা সিয়াদতের দ্বারা পাঠাইয়াছিলেন এবং খােকা ভাইয়ের নিকট হইতে ৫০ টাকা লইতে বলিয়াছিলেন। এই ৯০ টাকার মধ্যে আমি ইউনিভার্সিটির ২ মাসের বেতন ২৪ টাকা দিয়াছি, ১৫ টাকা লেপ ও বালিশ বানাইতে খরচ হইয়াছে, ১০ টাকার বই ও ৫ টাকার কাগজ কালি কিনিয়াছি। ১০/১২ টাকা ডাক্তারকে দিয়াছি। এই মােটামুটি হইল ৬৫ টাকা খরচ হইয়াছে আর থাকে ২৫ টাকা। এই টাকা ২ আড়াই মাসে খরচ হইয়াছে। আপনি হয়ত মনে করেন আমি টাকা বেশী খরচ করি। আমি যতদূর সম্ভব পারি কম খরচ করিয়া চলি। আপনি বরং এই মাস হইতে আমার বেতনের জন্য ১২ টাকা এবং হাত খরচের জন্য ১৮ টাকা এই সর্বসমেত ৩০ টাকা প্রত্যেক মাসে দিয়া দিবেন। ইহার বেশি আপনাকে দিতে হইবে না। হাসনাত কিরূপ পড়াশুনা করিতেছে জানাইবেন এবং এবার প্রমােশন পাইল কিনা জানাইবেন। মায়ের শরীর এখন কেমন আছে জানাইবেন। আপনি বইয়ের লিস্ট পাঠাইতে বলিয়াছিলেন। নিচে List দিলাম। এই বই আপনি যত শীঘ্ৰ পারেন শরফু কিংবা আর কাহারও দ্বারা পাঠাইয়া দিবেন। ডাকে এখন হিন্দুস্থান হইতে পাকিস্তানে বই আসিবে না ।
List
(1) Political Science and govt by Garner.
(2) An examination of the nature of the State by Willoughby.
(3) The new Soviet Constitution by Strong.
(4) The Politics of Aristotle by Welldon or by Tower.
২৮

(4) The Social Contract of Rousseau Translated by Tozer.
(5) The economic function of the State by Soltau.
(6) Modern Political theory by Road.
(7) Cabinet govt by Jennengs.
(8) The govt of England (Volume 1) by Lowen.
(9) The govt of U.S.A by Munro
এই বইগুলি এখন পাঠাইবেন। পরে আর কিছু বই কিনিয়া লইতে হইবে। এখন এই বইগুলি হইলে চলিবে। বই পুরাতন হইলে কোন ক্ষতি নাই। তবে যেন ছেড়া ন হয়। যাহাকে এই বই কিনিতে দিবেন তাহাকে College Street- এর সমস্ত নূতন এবং পুরাতন দোকানগুলি দেখিতে বলিবেন। কারণ আজকাল বই সব সময় সব দোকানে পাওয়া যায় না। এই বইগুলি কিনিতে ১২৫/৩০ টাকা লাগিবে। এই বইগুলির মধে কিছু নূতন বই এবং কিছু পুরাতন হইলে ভাল হয়। কারণ বই আবার খুব বেশী পুরাতন হইলে অসুবিধা হয়। তবে যে সব বই নূতন পাওয়া যাইবে না সেগুলি পূরাতন কিনিতে বলিবেন। আমি এখন খােদার ফজলে ভাল আছি। আপনর হাতের বেদনার ভালভাবে চিকিৎসা করাইবেন। যেন অবহেলা করিয়া রােগ পুষিয়া রাখিয়া দিবেন না। মাবে আমার সালাম দিবেন। রুবি এখন কেমন আছে জানাইবেন। শীঘ্ন পত্রের উত্তর দিবেন।ইতি –
আপনার স্নেহের
আবাই
২৯

আবুল বরকত শহীদ হলেন : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের নূরুল আমিন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে দেন। ছাত্ররা স্থির করে তারা আইন অমান্য করবে, ১৪৪ ধারা ভাঙবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন বর্তমান মেডিক্যাল কলেজের দক্ষিণ অংশে ছিল) সভা করে ছাত্ররা পাচ-সাত-দশ জনের ছােট ছােট দলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান। দিতে দিতে গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে ১৪৪ ধারা ভেঙে সত্যাগ্রহ শুরু করলে তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে থাকে। তারপর পুলিশ লাঠি চালায়। কাঁদানে গ্যাস ছাড়ে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ছাত্ররা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। সেদিন ছিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের অধিবেশন। বিক্ষোভ মিছিল যাতে পরিষদ ভবনের দিকে যেতে না পারে তার জন্য পুলিশ, ইপিআর ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছিল। ছাত্র-জনতার মিছিল মেডিক্যাল হােস্টেল থেকে বেরিয়ে বারবার ব্যারিকেড ডিঙিয়ে পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদ আর বাংলাভাষার দাবি পেশ করার জন্য পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
তখন বেলা ৩টার মতাে হবে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ তীব্র হয়ে ওঠে। পুলিশ এঁটে উঠতে পারে না। তাদের একবার পিছুও হটে যেতে হয়। তখন তারা হঠাৎ কোনাে সতর্কবাণী উচ্চারণ না করে গুলি শুরু করে। গুলি চালিয়েছিল রাস্তায়, বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে, মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে।
তখন মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে ছাত্রদের হােস্টেল ছিল ছাপড়ার তৈরি কতকগুলি ব্যারাকের মতাে ঘর। ২০ নম্বর ব্যারাকের বারান্দায় ঘটল ঘটনাটা। পুলিশ হাস্টেলের গেট ঘেরাও করে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ চলছে। ছাত্ররা গিয়ে ব্যারাকগুলির ভিতরে বারান্দায় উঠে কেউ আত্মরক্ষা করতে, কেউ প্রতিরােধ করতে জমা হয়। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়ছে। চোখের জ্বালা থেকে বাঁচার জন্য হাঁড়ি লিসিতে পানি এনে রাখা হয়েছে, তাতে রুমাল ভিজিয়ে নিয়ে চোখে দেয়া হচ্ছে। ত্রিরা রয়েছে-কলা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ইত্যাদির।
ছাত্ররা আর বয়-বাবুর্চিরা ইট ভেঙে জমা করে রেখেছে যাতে পুলিশ ভিতরে ঢুকতে না পারে। ব্যারাকে কাঁদানে গ্যাসের শেল পড়ছিল। কেউ আবার শেল ফাটবার আগেই তুলে নিয়ে পুলিশের দিকে ছুঁড়ে মারছিল। ঘণ্টা দু’তিন ধরে এই চলছিল। হােস্টেল প্রাঙ্গণে অনেক ছাত্র। বুলেট আর ইটের লড়াই চলছে। কারাে কোন ভয় নেই, আছে উন্মাদনা।
৩৫

আর শ্লোগান আর শ্লোগান-
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”।
ছাত্ররা লড়ছে ইট-পাটকেল দিয়ে। পুলিশকে কিছুতেই হােস্টেল চত্বরে আসতে দেয়া হবে না। তারা প্রতিরােধ ভাঙার চেষ্টা করছে আর বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ’র ছাত্র আবুল বরকত এক বন্ধুকে দেখে এগিয়ে এলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলেন। পুলিশ ঢুকে পড়েছে। ঢুকেই সােজা গুলি চালিয়েছে। প্রথমে কেউ বুঝতে পারেনি কী হয়েছে। ততক্ষণে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। তলপেটে লেগেছে গুলি। গায়ে ছিল নীলরঙের হাওয়াই হাফ-শার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট। পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল। একজন আবুল বরকতের দুই পা কাঁধে তুলে নিলেন, একজন মাথা নিলেন তাঁর কাঁধে। দৌড়াতে লাগলেন তারা তার লম্বা সুঠাম দেহটা নিয়ে। নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। তার কোমর ঝুলে গেছে, যেখান থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। পানি চাইলেন, কিন্তু কোথায় পানি? পুলিশ দেখলে কেড়ে নিতে পারে, তাই পড়িমরি করে তারা ছুঁটছেন। একটা ভেজা রুমাল তাকে চুষতে দেয়া হলাে। তখন দু’তিন জন এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে। একজন তার কোমরে কাঁধ দিলেন। বরকত বললেন‘খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচবাে না। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টনে খবর পৌঁছে দেবেন।’ তাঁকে নিয়ে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নামানাে হলাে। কেউ কেউ কেঁদে ফেললেন।
একজন নার্স ‘কাপুরুষ’ বলে গালাগালি দিয়ে প্রতিশােধ নেবার জন্য আবার গেটে যেতে বললেন।
আবুল বরকত মারা যান রাত আটটার দিকে। ডাক্তাররা তাকে বাঁচানাের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায় নি।
৩৬

শহীদ বরকতের লাশ উদ্ধার
আবুল বরকতের এক আত্মীয় ছিলেন এসএমজি বিভাগের সেক্রেটারি, এ কাসেম। তার মামা ছিলেন আবদুল মালেক, পানি উন্নয়ন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্টস অফিসার। তাঁরা তদবির করে পুলিশের কাছ থেকে লাশ উদ্ধার করেন। তারা কথা দেন রাত্রির মধ্যেই লাশ দাফন করবেন।
২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে আবুল বরকতের লাশ হাসপাতাল থেকে কড়া পুলিশ পাহারায় আজিমপুর পুরাতন গােরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
বরকতের মামা মালেক সাহেব পরিবারের পক্ষ থেকে কবরের জায়গা কেনার টাকা। এবং কাফনের খরচ দেন।
আজিমপুর মসজিদের ইমাম হাফেজ মােহাম্মদ আবদুল গফুর তার জানাজার নামাজ পড়ান। তাঁর উক্ত দুই আত্মীয় ছাড়া কিছু মহিলা আত্মীয়ও উপস্থিত ছিলেন।
প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট মােহাম্মদ ইউসুফও উপস্থিত ছিলেন। কবর দিয়ে যখন সবাই বাড়ি ফেরেন তখন ভাের হয়ে গেছে।
আবুল বরকতের কবর তার পরিবার থেকেই পাকা করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশ সরকার বালি-সিমেন্ট দিয়ে রক্ত লাল রঙে কবরটিকে নতুন করে বাঁধিয়ে দেন।
আবুল বরকতের সমাধিলিপিতে লেখা হয় :
২১ ফেব্রুয়ারী
ভাষা আন্দোলনে শহীদ
আবুল বরকত (এম. এ. ক্লাশ)
বাব্ লা- মুর্শিদাবাদ
জন্ম- ১৬-৬-২৭ইং
৩৭

২৫ মার্চ ১৯৫২ ছােটভাই আবুল হাসনাতের মামলা করার চেষ্টা
২৫ মার্চ, ১৯৫২ শহীদ আবুল বরকতের ছােটভাই হাসনাত ঢাকা সদর মহকুমার হাকিম এন আহমদের এজলাসে একটা মামলা দায়ের করার চেষ্টা করেন। আবুল বরকতকে গুলি করে হত্যা করার অপরাধের জন্য তিনি ঢাকার জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশী, সিটিএসপি মাসুদ মাহমুদ, ডিআইজি এজেড ওবায়দুল্লাহ ও জনাকয়েক পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেন।
আবেদনে বলা হয়,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২য় বর্ষ এমএ ক্লাসের ছাত্র আবুল বরকত ২১শে ফেব্রুয়ারি অপরাঙ্কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলে তার বন্ধু মােরশেদ নেওয়াজের সঙ্গে দেখা করতে যান। মােরশেদ নেওয়াজ ১২নং শেডের একটি ঘরে থাকতেন। সেখানে উভয়ের সাক্ষাতের সময় বাইরে নানারূপ শ্লোগান উচ্চারিত হয়। তাই শুনে বরকত শেডের বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ান এবং কয়েকজন বন্দুকধারী পুলিশকে হােস্টেল এলাকায় প্রবেশ করতে দেখেন। দেখে তিনি আবার ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পড়ে যান। তখন কয়েক ব্যক্তি তাকে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে যান।
সেখানে ডা. নুরুল হক সরকার তার চিকিৎসা করেন ।
আহত অবস্থায় আবুল বরকত হাসপাতালে কর্তব্যরত মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ও অন্যান্য ব্যক্তির নিকট তাঁর আঘাতের বিবরণ দেন এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ওই আঘাতের ফলে মারা যান।
পুলিশ আবেদনকারীর অনুরােধ সত্ত্বেও মৃতের আত্মীয়স্বজনের আগমনের অপেক্ষা করে ও ময়না তদন্ত না করিয়ে ওই রাতেই লাশ দাফন করে। মহকুমা হাকিম বিচারের জন্য মামলা গ্রহণ করতেই রাজি হন না।
তিনি বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সকলেই সরকারি অফিসার। ঘটনার পূর্বদিন যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল তা কার্যকর করার জন্যই তারা ঘটনার সময় কর্তব্যে নিযুক্ত ছিলেন। সুতরাং অভিযােগের বিবরণ অনুযায়ী তারা যা কিছু করেছেন তা নিজ নিজ কর্তব্য হিসাবে করেছেন এবং ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৩৭ ও ১৩২ ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের অনুমতি ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে বিচারের জন্য কোনাে অভিযােগ গ্রহণ করা যায় না।
আবেদনকারী তার অভিযােগের সঙ্গে অনুরূপ কোনাে অনুমতিপত্র দাখিল করতে পারেন নি বলে অভিযােগটি খারিজ করে দেয়া হয়।
আবেদনকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন আলী আমজাদ খান, আতাউর রহমান খান, এম রহিম, কামরুদ্দিন আহমদ, জমিরুদ্দিন, নূরুল ইসলাম, সৈয়দ শাহুদুল হক ও শামসুল হক। সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন কোর্ট ইন্সপেক্টর কাজী জহুরুল হক।
৩৮

গভীর আবেগের ২১শে ফেব্রুয়ারি
১৯৫২ সালের পর প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি শােকদিবস হিসেবে পালিত হতাে গভীর আবেগে। তার মধ্যে স্বৈরাচারী গভর্নরি শাসনের অধীন উদযাপিত ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির শােকদিবস বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সরকার ২১শে উদযাপনে বাধা দেন। বহু ছাত্র গ্রেফতার বরণ করেন।
১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিও বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তখন আবার যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছে। আগের বছর এই সরকার যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর যে বর্ধমান ভবন মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ছিল সে ভবনে বাংলা একাডেমী স্থাপন করেন। অন্য একটি প্রতিশ্রুতি ছিল ভাষা-আন্দোলনের শহীদ মিনার নির্মাণ। তার ভিত্তিপ্রস্তর এ-বছর স্থাপিত হয়। তাছাড়া, ১৯৫৬ সালেই বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা স্বীকৃত হয়।
১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ঢাকা ও প্রদেশের সর্বত্র গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে ও যােগ্য মর্যাদার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। এইদিন পূর্বঘােষণা অনুযায়ী, পূর্ববঙ্গ সরকারের তরফ থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলের ১২নং শেডের কাছে (যেখানে ১৯৫২ সালে ভাষাআন্দোলনের অন্যতম শহীদ বরকতকে মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ গুলিবিদ্ধ করেছিল) একটি শহীদ মিনার স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পূর্ববঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার, পূর্ববাংলার ‘অদ্বিতীয় গণনেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শহীদ বরকতের মা একত্রে এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
শহীদদের অমর আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ওইদিন পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন ৫ মিনিট-কাল স্থগিত রাখা হয়।
ঢাকায় অপরাহ্নে দুটি সভা হয়। একটি সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের তরফ থেকে আরমানিটোলা ময়দানে, অন্যটি কৃষক-শ্রমিক পার্টির তরফ থেকে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। আরমানিটোলা ময়দানে মওলানা ভাসানি এবং পল্টন ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার সভাপতিত্ব করেন। আরমানিটোলা ময়দানের সভাশেষে এক বিরাট মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। এই মিছিলের উপর পথের উভয় পার্শ্বের বাড়ির ছাদ ও বারান্দা থেকে পুষ্পবৃষ্টি করা হয়। পল্টনের সভায় তেমন জনসমাগম হয় নি।
ঘরে-ঘরে উড্ডীয়মান কালাে পতাকা, শহীদদের সংগ্রাম ও আদর্শের উত্তরাধিকারী ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের বাহুতে সন্নিবিষ্ট কালাে ব্যাজ ও নীরবে নগ্নপদে শােকপ্রকাশ, শিক্ষায়তন ও ছাত্রাবাসসমূহের সম্মুখে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, সা-নেত্রে দলে-দলে নাগরিকদের শহীদ-মাজার জিয়ারত ও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং পূর্ণ হরতালের মধ্য দিয়ে শােকবিহ্বল মহানগরী ঢাকা ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করে।
৩৯

প্রভাতের সঙ্গে সঙ্গে শহরে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। অতি প্রত্যুষ থেকেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ছাত্র ও জনতা নগ্নপদে প্রভাতফেরীর গান গাইতে গাইতে মিছিল করে আজিমপুর গােরস্থানে শহীদদের মাজার জিয়ারত করতে যান। বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীগণ নগ্নপদে অশ্রুসজল নয়নে মাজারে উপস্থিত হন।
শহীদ বরকতের মাতা ও ভগ্নীর উপস্থিতি গােরস্থানে উপস্থিত সহস্র জনতার আত্মসংবরণের বাঁধ ভেঙে দেয়। কারাে পক্ষে এই সময় অঞসংবরণ সম্ভব হয় নি। একদিকে চোখে বেদনা-অশ্রু, অন্যদিকে ওঠে বিজয়ের হাসি, সে এক অপূর্ব দৃশ্য। বহু মহিলাকে কালাে কাপড় পরে কবর জিয়ারত করতে দেখা যায়।
গােরস্থানে মওলানা ভাসানী শহীদ বরকতের মাকে সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে বাংলার সাড়ে চার কোটি সন্তানের জননী বলে উল্লেখ করেন।
এইদিন সমগ্র শহরে সর্বপ্রকার কাজকর্ম স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ থাকলেও একমাত্র আদমজী পরিচালিত মর্নিং নিউজ’ ও মুসলিম লীগের ‘আজাদ’ পত্রিকার অফিসদুটির কাজ চালু থাকে এবং ওই প্রতিষ্ঠানদুটির মালিকগণ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাদের কাজ বন্ধ রাখা থেকে বিরত থাকেন।
রাজধানীর কর্মময় জীবন সম্পূর্ণরূপে নিস্তেজ হয়ে যায়। একমাত্র পুলিশ ও সরকারি যানবাহন ছাড়া আর কোনাে প্রকার যানবাহন দেখা যায় নি। সিনেমা হলের মালিকগণ বেলা ৩টার শাে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদনের জন্য বন্ধ রাখেন।
সকাল ৯টায় পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের পর মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলের পাশে মওলানা ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা যুক্তভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এই উপলক্ষে বক্তৃতা প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে গুলি চালানাের জন্য সরকারের নিকট তদন্ত দাবি করেন। বলেন, উক্ত গুলিচালনায় ৭ ব্যক্তি শহীদ হলেছিলেন, তা প্রমাণ করার মতাে যথেষ্ট তথ্য তার কাছে আছে।
মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার বাংলাভাষার উন্নতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। বলে আশ্বাস প্রদান করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও ভাষা-আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহরের ছাত্রছাত্রীদের এক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভা হয়। আরমানিটোলা ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে এই সভা হয় বেলা ২টায়। ওই সময়ের বহু পূর্বেই সভাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত এত লােক হয় যে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ময়দানের পাশের রাস্তাগুলিও পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বাড়ির ছাদে ও বারান্দায় অসংখ্য লােক শ্রদ্ধাপুত নয়নে জনসভার বক্তৃতা শ্রবণ করেন। সমাজতন্ত্রী নেতা পুলিন দে (এমএলএ), যুবনেতা মােহাম্মদ তােয়াহা, আওয়ামী লীগের প্রচার-সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল হাই, মহীউদ্দিন আহমদ, আবদুল আওয়াল, আবদুস সাত্তার,
৪০

কামরুজ্জামান (এমএলএ), গণতন্ত্রী দলের আলী আশরাফ, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের রুহুল আমীন, খেলাফতে রব্বানী পার্টির আবদুল গফুর, মহিলা সমিতির শামসুন্নাহার, বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আবদুল মােমিন তালুকদার, তমদুন মজলিসের হাসান ইকবাল ও রিকশা ইউনিয়নের সেলিম বক্তৃতা করেন।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের গুলি চালনা সম্পর্কে নতুন করে তদন্তের দাবি করা হয়। অন্য প্রস্তাবে মেডিক্যাল কলেজ ক্রসিঙের নাম শহীদ এভিনিউ ও শহীদদের নাম-অনুসারে তার চারদিকের রাস্তাগুলির নামকরণের জন্য পৌরকর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন দপ্তরের নিকট দাবি করা হয়।
এছাড়া, বাংলাভাষার প্রতি সহানুভূতিশীল নন এমন সব প্রতিক্রিয়াশীলদের খেয়ালখুশির উপর বাংলা একাডেমির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে পূর্ববঙ্গ সরকার যেভাবে জনসাধারণের দাবির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন সভায় তার তীব্র নিন্দা জানানাে হয়।
অন্যান্য প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, কালাকানুন বাতিল, সকল রাজবন্দির অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানানাে হয়।
সভা-শেষে বিরাট মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। মওলানা ভাসানী তা পরিচালনা করেন। আরমানিটোলা ময়দানে সন্ধ্যায় গণনাট্য সংঘের উদ্যোগে মনােজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। | ১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ-দিবস উদযাপনের এই বিবরণ থেকে আজকের মানুষ তকালের আবেগের কিছু স্পর্শ লাভ করবেন।
১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে ঢাকার রাজপথে প্রভাতফেরীর গান। হিসাবে তােফাজ্জল হােসেনের গান গাওয়া হয়। তার প্রথম চার ছত্র এইরূপ :
শহিদী খুন ডাক দিয়েছে
আজকে ঘুমের ঘােরে
আর রক্তপথের যাত্রী মােরা
নূতন আলাের ভােরে।।
শহীদ আবুল বরকত, যতদূর জানা যায়, প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তিনি একেবারে রাজনীতি অসচেতনও ছিলেন না। ভাষা-আন্দোলন এবং গণআন্দোলন সম্পর্কে তাঁর একটি সুস্থ গণমুখী চেতনা ছিল। তাকে এইসব আন্দোলনে যােগ দিতে দেখা গেছে।
৪১

আবুল বরকত প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ
হাসান হাফিজুর রহমান
‘সে সময় কিছুসংখ্যক লােক আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে পুলিশের ইনফরমার হিসেবে কাজ করলেও করতে পারে। প্রায় সব আন্দোলনেই এ ধরনের কিছু কিছু লােক থাকে যাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে কিছু সুযােগ-সুবিধা আদায় করে নেয়া। তবে কিছুদিন আগে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় বরকতকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। আমি যতটুকু জানি, বরকত নন-পলিটিক্যাল ছাত্র ছিল। বরকত আমার বন্ধুস্থানীয় ছিল। আমার সাথে সেও পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। বরকত অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে বরকত জড়িত ছিল বলে আমার জানা নেই। সূত্র : একুশে সঙ্কলন ‘৮০ : স্মৃতিচারণ
গাজীউল হক
‘মেডিকেল কলেজের গেট দিয়ে ছাত্ররা বেরােবার চেষ্টা করলে সেখানে পুলিশের বাধা এলাে। লাঠিচার্জ হলাে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের প্রায় খণ্ডযুদ্ধ শুরু হলাে। এ সময়ে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে এবং পুলিশের গুলিতে বরকত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যায়। বরকত ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ শেষবর্ষের ছাত্র। দীর্ঘদেহী, বােধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘদেহী। শ্যামলা ছিপছিপে একহারা গড়নের। মুখটা শিশুর মতাে সরল। আমাদের সঙ্গে বিশেষ করে হাসান হাফিজুর রহমান, আবু নাসের ওয়াহেদ প্রমুখের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা ছিল। রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে খুব সক্রিয় ছিলেন বলে জানি না। তবে ঐদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং শামসুল হক যখন রেস্তোরায় বসে তার বক্তব্য পেশ করছিলেন তখন বরকতও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। পরে বন্ধু ড. রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে বরকতের গুলি খাওয়ার ঘটনা শুনেছিলাম। পুলিশ সরাসরি গুলি চালিয়েছিল এবং বরকত গুলীবিদ্ধ হয়েছিল। বরকতকে ছেলেরা ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ড. রফিকুল ইসলাম (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক) বরকত যে বাসায় থাকতেন সেখানে খবর দেন।
সূত্র : একুশের সঙ্কলন ‘৮০ : স্মৃতিচারণ।
শামসুল বারী মিয়া (মিয়া মােহন)
‘২০ নং ব্যারাকের মাঝামাঝি কামরায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিরােচ্ছিলাম। আমার দিকে এগিয়ে এলেন বরকত, ডাকলাম আবাই। বীরভূম জেলার সিউড়ির সৈয়দ জাকির সাহেবের আত্মীয়, জাকির সাহেবের ফরিদপুরের চাকুরীকালে আবাই মামুর সাথে পরিচয়। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন কিন্তু পড়ে গেলেন সাথে সাথে আমার হাত
৪২

খানেক দূরে। পুলিশ ঢুকে পূর্ব থেকে সােজা গুলি ছুঁড়েছে। শফিকুর রহমান ১৭ নম্বরে থাকতেন, দৌড়ে এসে পানি ঢেলে দিলেন। ভেবেছিলেন টিয়ার গ্যাসের প্রতিক্রিয়া। আমি গুলির কথা বললাম, ততক্ষণে পানির সাথে সাথে রক্ত দেখা দিয়েছে বারান্দার মেঝেতে। তলপেটে লেগেছে গুলি। গায়ে ছিল তার নীল রঙের ফ্লাইং হাফ শার্ট, পরনে খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবুলী স্যান্ডেল। তখন তার দুই ঠ্যাং শফিকুর রহমান কাঁধে তুলে নিলেন আর মাথা নিলাম আমার কাঁধে। আমরা পশ্চিম দিক দিয়ে একটু ঘুরে দৌড়াতে লাগলাম তার দীর্ঘ সুঠাম দেহটা নিয়ে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, তারও কোমর নিচের দিকে ঝুলে দুমড়ে টপটপ করে রক্ত ঝরছিল। আমার কাছে পানি চাইল কিন্তু কোথায় পানি, সময় নাই, ভেজা রুমালটা দিলাম চুষতে। হােস্টেলের পায়খানাগুলাের কাছ দিয়ে হাসপাতালে যাবার যে ছােট গেটটা ছিল তার কাছে আসতে দুতিনজন এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে, আমার কাধ দিলাম তার কোমরে। সে বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে, বাঁচব না, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টনে সংবাদ পৌঁছে দেন। তাকে নিয়ে ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডে নামালাম। কেউ কেউ কেঁদে ফেলল। একজন নার্স ‘কাপুরুষবলে গালাগালি দিয়ে প্রতিশােধ নেবার জন্য গেটে যেতে বল্লেন।
আমি দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই স্ট্রেচারে করে একজনের মৃতদেহ আনতে দেখলাম। মাথার খুলি উড়ে গেছে। নিচের দিকে খানিকটা ঘিলু ঝুলছে। আবুল বরকতকে অপারেশন করা হয়েছিলাে কিন্তু বাঁচানাে যায় নি। সূত্র : শহীদ মিনার- রফিকুল ইসলাম
মােহাম্মদ সুলতান
‘মিছিলকারীরা কতজন গ্রেফতার হলেন, কতজন আহত হয়েছিলেন তার হিসাব দেয়া আজ আর সম্ভব নয় তবে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী সেদিন গ্রেফতার হয়েছিল। পুলিশ ভ্যানে, ট্রাকে বা বাসে তাদের তুলে নিয়ে গেছে। টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের সময় বিশ্ববিদ্যালয় গেটও মুক্ত থাকে নি। শেলের আঘাতে আমার হাতের খাতা কলম কখন কোথায় উড়ে গেছে তা নিজেও জানি না। সেদিন দেড় ঘণ্টার মধ্যে অন্ততঃ দু’হাজার ছাত্রী পুলিশের উদ্যত সঙ্গীনের খোঁচা ও লাঠির আঘাতে রমনার রাস্তা অভিশাপমুক্ত করতে চেয়েছিলেন তার মূর্তি আমি আজো ভুলতে পারি না। ভুলবার নয়। ভুলতে পারি না বরকতের কথা। সকাল নয়টায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শেষবর্ষের দীর্ঘদেহী ছাত্র আবুল বরকত মধুর রেস্তোরার বারান্দায় (পুরােটাই অবশ্য তখন বারান্দা ছিল) বগলে একতাড়া পােস্টার নিয়ে ছুটোছুটি করছে। তখনাে সে কেন পােস্টার নিয়ে ঘুরছে জানতে চাইলে উত্তর দিয়েছিল, আর কটা তাে পােস্টার রয়েছে এই বেলা লাগিয়ে দিই। কাজে লাগবে। এটাই ছিল তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ। জনারণ্যে মিছিলকারীদের মাঝে সে মিশে গিয়েছিল। বিকেল চারটায় জানতে পারলাম মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ১ নং শেডের বারান্দায় তলপেটে গুলি খেয়ে বরকত মারা গেছেন। বরকত লাল রক্তে স্নাত হয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেলেন। বরকত যেখানে শহীদ হন, ঠিক সেখানেই এখন উদ্ধত গর্বে মাথাতুলে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনার। এর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন আর এক শহীদের মাতা।
সূত্র : একুশের সঙ্কলন ‘৮০ : স্মৃতিচারণ
৪৩

ভাষাশহীদ আবুল বরকত
ড. রফিকুল ইসলাম। “শহীদ বরকত গুলিবিদ্ধ হলে তাঁর বন্ধু মিয়া মােহন (এখন ঢাকা হাইকোর্টে ওকালতি করেন) তাকে বহন করে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান। তখন মিয়া মােহন আমাকে বলেছিলেন বরকতের বাড়িতে খবর দিতে, তিনি আমাকে বরকতের বাড়ির ঠিকানাও দিয়েছিলেন। আমরা বরকতের বাড়িতে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে গুলি চলার পরপরই হাসান হাফিজুর রহমান, বােরহানুদ্দীন খান জাহাঙ্গীর এবং আমি তিনজনে বেগম বাজারের এক প্রেসে গিয়ে একটি লিফলেট ছাপানাের। ব্যবস্থা করি। সে লিফলেট আমরা প্রচার করেছিলাম।
বরকত সম্পর্কে যে কুৎসা একটি পত্রিকায় উঠেছিল সে বিষয়ে আমি ইতিমধ্যে লিখেছি। নূরুল আমিনের সময়ও বলা হয়েছিল- যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে তারা কালপ্রিট, ইন্ডিয়ার এজেন্ট, কমিউনিস্ট, দেশের দুশমন ইত্যাদি। ফলতঃ বরকতের বিষয়ে যা যা বলা হয়েছিল তা সবই উদ্দেশ্যপ্রণােদিত এবং বানােয়াট। ভাষাআন্দোলনের শহীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করাই ঐ প্রচারণার উদ্দেশ্য।
সূত্র : একুশের সঙ্কলন ১৯৮১ : স্মৃতিচারণ।
৪৪
কালাে টিনের বাক্সে একটা রুমাল : মুর্তজা বশীর

স্টুডিওর এককোণে চারটে ইটের ওপর রাখা ছিল কালাে বাক্সটা। কিছু কাগজের ক্লিপিং, বন্ধুদের চিঠি, একটা কমলা রঙের মলাট দেয়া খাতা (পঞ্চাশ সনের ছ’মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিচারাধীন থাকাকালীন কিছু কবিতা, বন্দি সঙ্গী আলী আকসাদ, আবদুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন, কৃষক ও শ্রমিক নেতা মনু মিয়া ও বারী সাহেবের প্রতিকৃতির স্কেচসহ জেল জীবনের দৈনন্দিন ঘটনার ড্রয়িং। আর কয়েকটি গল্প), কয়েকটা বুনাে পাখির রঙিন পালক আর একটা রুমাল। এই ছিল বাক্সটার ভেতরে, আর কিছু নয়। তবু তালা লাগানাে ছিল।
এবং সেটা ছিল ঐ রুমালটার জন্যে। রুমালটা রাখা ছিল একটা লেফাফায়। যত্নে চার ভাজ করে। খুবই অমূল্য স্মৃতি, তাই ব্যবহার হতাে না। রুমালটি যদিও এককালে সাদা ছিল, তার এক কোণের ছােট লাল ফুলটি যদিও কোন একসময়ে উজ্জ্বল ছিল কিন্তু তখন তা হারিয়ে গিয়েছিল আরাে গাঢ় লালবর্ণে। সেই রং ছিল রক্তের। সেই রক্ত ছিল আবুল বরকতের।
তখন দুপুর গড়িয়েছে
বিরামহীন কাঁদুনে গ্যাস ছােড়ার পালা শেষ। তবু থমথমে ভাব। এদিক সেদিক ঘাসের উপর খালি শেল, আর সেটিকে ঘিরে পানির ভেজা দাগে এই খররৌদ্রে হঠাৎ করে শিশিরস্নাত দু’একটি শুকনাে ঘাস। যদিও আমরা তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সারি সারি ব্যারাকের সম্মুখের ঘাসে বসে, আকাশের দিকে তাকিয়ে আধশােয়া কেউ, দু’একজন মাঝে মাঝে কাশছিল। কয়েক রাত বিদ্রি থাকার মত চোখে জ্বালা, কাঁদুনে গ্যাসের ঝাজ বাতাসে তখনাে রয়েছে। কেমন এক গতিহীন সময়। হঠাৎ করে একটা উৎকণ্ঠা মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল- মৃত্যুর আশঙ্কা, জীবনের জন্যে ব্যাকুলতা। দ্বৈরথযুদ্ধে এরপর কি হবে তা জানিনে, তবে কিছু যে একটা হবে বা হতে যাবে তাই উৎসুক চোখজোড়া। আমি এবং হাসান হাফিজুর রহমান দুজন বসেছিলাম চার/পাঁচটা ব্যারাক পেরিয়ে, লাল খােয়া রাস্তার একধারে। হাসান উত্তেজিত কণ্ঠে অনেক কথা বলছিল। কিছু কানে যাচ্ছিল আর কিছু যাচ্ছিল না, কিন্তু কি যে বলছিল তা শুনতে পাচ্ছিলাম না মােটেই। ফাল্গুনের মরা ঘাসে দল বেঁধে পিঁপড়ের সারি চিনেবাদামের খােসা ঘিরে হাঁটছিল, তাই দেখছিলাম।
একটা চাপা গুঞ্জন শুনে রাস্তার দিকে তাকালাম। কাঁটাতার ঘেরা সীমানা পেরিয়ে, কালাে পিচঢালা পথে সবুজ হেলমেট মাথায় অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ সূর্যের বেসুমার প্রতিফলন একটা ক্ষীপ্ত অজগরের কালাে কালাে চক্রের আঁশ জ্বলজ্বল করছে। একজন অফিসার হাত নেড়ে ইশারা করে ডাকছে ছাত্রদের। কিছুমাত্র এগিয়ে গেলাে, গেট পর্যন্ত ও তখনাে কেউ যায় নি গুলির শব্দ হলাে আচমকা। ঝাঁকে ঝাঁকে ভয়ার্ত পাখির মত
৪৫

ছড়িয়ে গেলাে ছাত্ররা। দৌড়াদৌড়ি, কিছু আতঙ্কিত নাম, তারপর সব চুপ । আমরা যে কয়েকজন দূরে ছিলাম আত্মরক্ষার জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এই আত্যয়িক মুহূর্ত কেটে যাবার পর আবার যে যার যায়গায় এসে বসেছি। প্রত্যেকেই নিজ মনােভাবে কিছু কিছু লজ্জিত, তাই আপনভােলা ভাব। আমরা যারা এখানে জড়াে হয়েছি তারা সবাই’ত আত্মোৎসর্গিত প্রাণ, তবু এই কিছুক্ষণ আগে আপনি ও পর এই চিন্তা, তাই বন্ধু স্বজনের সঙ্গে এক পথে দাঁড়িয়েও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এক প্রয়াস। এবং পরমুহূর্তে এটা যখন প্রকাশ হয়ে যায় হঠাৎ তখন হাসি। এই মুহূর্তে হাসির কোন এমন। ঘটনা ঘটে নি, যে হাসতে হবে, তবু হাসি। এই মুখােশের আড়ালে নিজের কাপুরুষতা, স্বার্থপর মনকে আড়াল করে বলি, দুৎ ভয় দেখাচ্ছে। আবার গল্প করছি। কেউ তার বান্ধবীর সঙ্গে গত সন্ধের কথােপকথন কেউ তার পিতার সাথে গতরাতের কথান্তর, হাসান বলছিল নতুন কবিতার কথা। আমার তৈলচিত্রগুলাের কথা। হঠাৎ দেখলাম, ব্যারাকগুলাের দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা চলন্ত জটলা। দৌড়ে গেলাম। বেশ লম্বা, শ্যামবর্ণ, মুখমণ্ডল পরিষ্কারভাবে কামানাে, সারা চেহারায় বিষ্টির বড় বড় ফোটায় ভরে যাওয়া ঘাস আর পরনের প্যান্টের পেটের নিচে থেকে কল ছেড়ে দেয়ার মত অঝােরে রক্তের ঢল। সবার সঙ্গে আমিও তাকে ধরেছি, আমার সাদা পায়জামায় কে যেন আবীরের রং পিচকারী দিয়ে ছড়িয়ে রাঙিয়ে দিলাে। আমি তাকে ধরেছি বুকের কাছে, আমার মাথা তার মুখের নিকট। এক সময় সে চোখ তুলে তাকাল। একটা ছােট শিশুর মত জড়সড় করে নামতা পড়ল, আমার বাড়িতে খবর দেবেন… আমার নাম আবুল বরকত… পল্টন লাইন…
পর মুহূর্তে জবাই করা মুরগীর মত হাঁ করে জিভ কাপিয়ে ফিসফিস করে বলল, পানি। পানি।।
যে হাত দিয়ে মৃদুভাবে ধরেছি তার পিঠ, ডান হাতখানা তার বুকের ওপর। যে হাতে রুমালখানা রেখেছি ধরে। কাদুনে গ্যাস থেকে বাচার জন্য ভেজানাে মুখের ঘাম মােছার জন্য নােংরা। ভাবলাম, কি করবাে। জিভ কাপছে অনবরত খােলা মুখের ভিতর। একটু ইতস্ততঃ করলাম। মনে দ্বিধা, এক ধরনের অপরাধ বােধ। কিন্তু, তা ক্ষণিকের জন্য। জিভটা বারবার নড়ছে। পরমুহূর্তেই নিংড়িয়ে দিলাম হাতের রুমাল।
হাসপাতালের ভেতর যখন তাকে নিয়ে গেলাম তখন সবাই চমকে উঠল। যে সব ছাত্র গ্যাস বা লাঠির আঘাতে আহত তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেল। বলল, ওকে দেখুন। আগে। ওকে দেখুন।
ডাক্তার আর নার্স ছুটে এলাে। তারা এই প্রথম গুলিতে আহত দেখছে, তাই কে আগে কিভাবে তার সাধ্যমত সব সেবা ঢেলে তাকে বাঁচাতে পারে তারই চেষ্টায় নিজেদের করল ব্যস্ত। চেনামুখের একজনকে তাকে আবুল বরকতের নাম জানিয়ে বেরুবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি, চোখে পড়লাে ক্যানভাসের স্ট্রেচারে একজনকে, মাথার খুলির ওপরটা একবারেই নেই। একপাশে শুকনাে ঘাস জড়ানাে মগজ মৃদু হাতে একজন। পাশ থেকে কে যেন ডুকরে কেঁদে উঠলাে, অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিল সরকারকে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, শিল্পী ইমদাদ হােসেন। ওকে ধরে বার করে নিয়ে
৪৬

এসেছি, আরেকটা স্ট্রেচারে এলাে আরেকজন পায়ের গড়ালি ফাটা বাঁশের মত অসংখ্য তীক্ষ মাথা তুলে।
আমরা দু’জন তাড়াতাড়ি যাদুঘরের দিকে এগুলাম। পথে যেন এই সময়ে হঠাৎ । করে আশুরার মিছিল বেরিয়েছে। সবাই চলেছে কারবালার ময়দানে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন প্রাদেশিক গভর্নরপত্নী লেডি ভিকারুন্নেছা নুন। এই দিনটির জন্য কত বিনিদ্র রাত গেছে, প্রথম প্রেমের মত এসেছে হৃদয়ে এক আবেগ, এক ধরনের অসংযত উচ্ছ্বাস। হঠাৎ অনুভব করলাম সে উচ্ছ্বাস ভেসে গেছে বেদনার স্রোতে। না, কিছুতেই আজ প্রদর্শনী শুরু হতে পারে না।
যাদুঘরে আমরা যখন পৌছলাম, তখন বিশিষ্ট কর্মকর্তা ব্যক্তিদের অনেকেই এসেছেন। আমাকে দেখে চমকে গেলেন, শােকাহত হলেন। তবে প্রদর্শনী বন্ধের পক্ষে শামিল হলেন না। বরং যুক্তি তুললেন, গভর্নরপত্নী আসছেন তাই উদ্বোধন করে বন্ধ করে দেয়া হােক।
আমরা রাজী হলাম না। শিল্পী কামরুল হাসান আমাদের সপক্ষে রায় দিলেন। আমি, ইমদাদ, আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ জাহাঙ্গীর ও আরাে কয়েকজন (নাম সঠিক মনে নেই) প্রদর্শনীকক্ষে ঢুকে নিজেদের ছবি হাতে করে নিয়ে এলাম বাইরে।
প্রদর্শনী হােক। কিন্তু আমরা নেই। না। নেই ।
ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় প্রদর্শনী শেষ পর্যন্ত বন্ধ হলাে।
বাসায় যখন এলাম তখন বিকেল। রিকশা করে আমাকে নিয়ে এলাে শিল্পী আবদুর রাজ্জাক। পরনের সাদা পায়জামা শােণিতাক্ত, চকোলেট রঙের জামার বুকের কাছে রক্ত জমে আরাে কালাে হয়ে গেছে। সারা পথে জনতা। বৃদ্ধ, যুবক আর কিশাের। সবাইর মুখে একটি প্রশ্ন, গুলি বলে চলেছে?
রেকর্ডের ভাঙ্গা যায়গায় পিন আটকে যেমন একই সুর তােলে বারবার, তেমনি আমি বলে চলেছি, হা মেডিকেলে ।
নিজের ঘরে চুপিচুপি ঢুকছি, মা ডাকলেন। বললেন, বাবু ডাকছে। শুনে যা।
– আমি রাজনীতি করি, বাবু অর্থাৎ আমার পিতা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পছন্দ করতেন না। এমন দিনও গেছে বেশিরাতে ঘরে ফেরার সাজা হিসেবে বাসায় ঢুকতে দেন নি। তিনি বলতেন, নেতার পিছনে হুকুমবাহী কেন হবে তুমি। হলে নেতা হও।
তার সুমুখে ভীতগ্রস্ত পায়ে দাঁড়ালাম। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ তিনি, ধমক দিলেন। কেন আজ তাঁর নিষেধ সত্ত্বেও বাইরে বেরিয়েছি। ঠিক আজকে, এই বিশেষ দিনে আমাকে ধমক দেয়ার জন্য অভিমান হলাে। আমি আমার হাতের মুঠিতে ঢেকে রাখা শােণিতাক্ত রুমালখানা তুলে ধরলাম। একটু চাপা রাগে বললাম, ওরা, ওরা গুলি করেছে। এই দ্যাখেন রক্ত। অনেক দূর থেকে যেন একটা স্বর ভেসে এলাে, মারা গেছে কেউ?
মাথা নাড়ালাম।
৪৭

ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, ডাক দিলেন।
দাঁড়াও।
মাকে জিগগেস করলেন, আমার কালাে আচকানটা কই।
মা চামড়ার সুটকেশ থেকে বের করলেন ধােপা বাড়ি থেকে ধােয়ানাে তার আচকান। তিনি হাত বাড়িয়ে নিলেন। টেবিলের ওপর হ’তে তুলে নিলেন তাঁর দাড়ি ছাঁটার ছােট কাঁচি। তারপর আচকানের নিচের দিক থেকে কেটে বের করলেন একখানি কাপড়।
কালাে কাপড়টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার হাতে বেঁধে দাও।
আমি স্থিরচোখে তাঁকে দেখলাম। সাদা শ্মশ্রুময় যে চেহারা আজীবন দেখে আসছি শান্ত ও সৌম্য, হঠাৎ দেখলাম ঘৃণায় আচ্ছন্ন।
চকবাজারের মােড় থেকে বেগমবাজারে ঢুকলেই ডান হাতে একটা অপরিসর গলি। গলির মুখেই কিছু ঠেলাগাড়ি, তাই সাবধানে এগুতে হয়। সদর দরােজা দিয়ে ঢুকলেই একটা সরু বারান্দা, ভেতরে যাবার পথ। দরােজার বাঁ পাশে একটু উপরে গােটা তিনেক ইলেকট্রিকের মেইন সুইচ আর মিটার। তার ধারে আমার স্টুডিও-র দোর। একটু মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়, কয়েকটা তার বাঁকা হয়ে ঝুলে থাকে। সঠিক যায়গায় ঠিক করে দিলেও আবার কিছুদিন পর আগের যায়গায় ফিরে আসে। কয়েক বছর পর একদিন দুপুরে বাসায় ঢুকতেই চোখে পড়ল স্টুডিও-র বন্ধ দোরের তালা নেই। অবাক হলাম। কেননা, এ ঘর সবসময় কাজের সমাপ্তিতে বন্ধ থাকে এবং এর চাবি আমার কাছেই।
হাত দিয়ে মৃদু ঠেলা দিতেই কপাট জোড়া খুলে গেলাে দু’ধারে। আমি সেই ফাক দিয়ে দেখলাম। পশ্চিম দিকের দেওয়ালের হেলান দিয়ে রাখা ক্যানভাসের সারির এককোণে একটা শূন্যতা। আগে যদি কখনাে ওদিকে তাকিয়েছি, চোখে পড়েছে সবসময়ই মেঝ থেকে সাদা দেয়ালে এক ফুট অংশ কালাে। কিন্তু আজ চোখে এসে আঘাত করলাে চারটে পাংশুটে লাল ইট।
ঘরে ঢুকলাম। চারিদিকে তাকালাম। সব আছে তেমনি। পশ্চিমের দেয়ালতাকে স্টিল লাইফের জন্য রাখা কুকুরের করােটি, ছােট বড় কয়েকটি নানা বর্ণের বােতল, মেরুন রঙের ছবির অ্যালবাম, বাবুই পাখির বাসা।
পূর্বদিকের দেয়ালে সুইচবাের্ডের পাশে ঠিক তেমনি রয়েছে পেরেকে টাংগানাে আমার ধূসর কালাে এ্যাপ্রােন। শুধু নেই কালাে বাক্সটা। টিনের বাক্সটা।
নেই সেই সঙ্গে তার ভেতরের কাগজের ক্লিপিং, বন্ধুদের চিঠি, কমলা রঙের মলাট দেয়া খাতা, কয়েকটা বুনাে পাখির রঙিন পালক। আর নেই রুমালটাও।
আবুল বরকতের রক্তের দাগ ছিল যেখানে। গন্ধ ছিল যেখানে।
৪৮

শহীদ মিনার
শহীদ মিনার আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভাষা আন্দোলনের সাহসী ঘটনাবলী, বাঙালির স্বদেশ চেতনার প্রথম রক্তাক্ত পদক্ষেপের ইতিহাস। বাহান্নর ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর স্মৃতি নিয়ে আবেগে, অনুভবে, এক জ্বলন্ত বিশ্বাসে গড়া মিনার। ভাষার অধিকার রক্ষার শপথ নিয়ে এ মিনার সাহসের সংগ্রামের ও প্রেরণার প্রতীক।
বাহান্ন সালের তেইশে ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেল ছাত্রদের হাতে গড়ে ওঠে প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। সেই কাঁটাতারে ঘেরা, বাঁশ কাঠ ইট সিমেন্টে তৈরি মেডিকেল ব্যারাক যেমন নেই, তেমনি নেই প্রথম শহীদ মিনারটিও।
আজ যেখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ, ডিসপেনসারি এবং সেবিকাসদন- এই বিরাট প্রাঙ্গণে এক সময় দাঁড়িয়েছিল মেডিকেল হােস্টেল। বাঁশ, কাঠ, ইট, সিমেন্টে তৈরি কুড়িটি শেড। এর মধ্যে সতেরটিতে বাঁশের ছাউনি, বাকি তিনটের মাথায় টিন। দেয়ালের অর্ধেকটা ইট-গাঁথা, বাকিটা বেড়ার, দেখতে অনেকটা সেনা ছাউনির মত বলেই এই হােস্টেল মেডিকেল ব্যারাক’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।
এখন যেখানে বহির্বিভাগের প্রবেশপথ, তার পশ্চিম পাশেই ছিল তখনকার ব্যারাকে ঢােকার গেট। কাঠ ও কাঁটাতারে তৈরি এবং নড়বড়ে। এই গেট থেকে ছাত্রাবাসের বুক চিরে অপরদিকে অর্থাৎ বকশীবাজারের দিককার গেট পর্যন্ত প্রসারিত লাল সুরকির রাস্তা- দুই ধারে সারি সারি ব্যারাক- বাঁদিকে এক, দুই, তিন, চার করে এগারাে পর্যন্ত এবং ডানদিকে ফুলার রােডের কিছুটা সমান্তরাল অবস্থান নিয়ে বারাে নম্বর ব্যারাক; এরপর তেরাে, চৌদ্দ, পনেরাে, ষােল, সতেরাে নম্বর পর্যন্ত একের পর এক। এর পরের সারিতে পশ্চিম দিকে ফুলার রােডের গা-ঘেঁষে বিশ নম্বর ব্যারাক, এর দক্ষিণে পর পর উনিশ এবং আঠারাে নম্বর।
প্রতিটি ব্যারাকের সঙ্গে লম্বা টানা বারান্দা যেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে আড্ডা দেবার সুযােগ থাকলেও পড়াশােনার সিরিয়াস ছেলেদেরই বরং দেখা যেতাে চেয়ার বা মাদুর পেতে জোড়ায় জোড়ায় ঢাউস বই মেলে পড়াশােনা করতে। শেষ বিকালে অবশ্য অনেককেই দেখা গেছে প্রাঙ্গণে সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে গল্পে মশগুল হতে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি থেকে পাঠ্যক্রম নিয়ে যত সরস আলােচনা।
বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলা মাসের হিসাবে ৮ ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার আন্দোলনের সূচনা। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে গড়ে-ওঠা এই আন্দোলনকে শুরুতেই গুঁড়িয়ে দিতে সরকার ছাত্র অছাত্র জনতার উপর গুলি চালানাের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
পাকিস্তানি শাসকের বুলেটে-ঝরা রক্ত সেদিন ক্রুদ্ধ ডাক পাঠিয়েছিল জনমানসের উদ্দেশ্যে, এবং সে ডাক বৃথা যায় নি। বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকে কয়েকটি দিন ঢাকার রাজপথ স্পন্দিত হয়েছে ছাত্রজনতার ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে।
৪৯

ফলে রাজপথে আবার রক্ত ঝরেছে। সেই জানা-অজানা শহীদের স্মৃতি ধরে রাখতে গড়ে উঠেছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ, পরে যা ‘শহীদ মিনার’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। বাইশ তারিখ থেকেই মিছিলে-জমায়েতে অযুত কণ্ঠে নতুন একটি স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক।
আন্দোলনের সেই তুঙ্গ পর্যায়ে প্রতিবাদী মানুষের শাহাদাত বরণের কারণে আবেগতাড়িত মেডিকেল কলেজের সংগ্রামী ছাত্রগণ উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন তাদের প্রাঙ্গণে রক্ত-ভেজা ঘাসের বুকে শহীদ স্মৃতি অমর করে তুলতে। মেডিকেল হােস্টেলের রাজনীতি-সচেতন সংগ্রামী ছাত্রদের তাৎক্ষণিক পরিকল্পনার এবং যৌথ শ্রমের ফসল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি সম্পূর্ণ হয় একরাতে তেইশে ফেব্রুয়ারি শনিবারে। পরদিন রবিবার ছুটির সকালে সবাই অবক হয়ে দেখেছে মেডিকেল ছাত্রদের হাতে-গড়া এই অভাবনীয় স্থাপত্য। এবং অই একদিনের মধ্যে দেখা গেল, ব্যারাক প্রাঙ্গণে দাঁড়ানাে শহীদ মিনার মাজারের মর্যাদা অর্জন করে ফেলেছে।
এই প্রথম শহীদ মিনারের কাজ শুরু তেইশে ফেব্রুয়ারি রাতে, কাজ শেষ হয় ভােরের দিকে। কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য স্থূপীকৃত ইট, বালি সে রাতে এই মহতী কাজে অংশ নিতে পেরেছিল। সারি বেঁধে দাড়ানাে ছেলেদের হাতে হাতে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে ইট চলে এসেছে হােস্টেল প্রাঙ্গণে রক্ত-শুকনাে স্থানটির পাশে। ঘাম ঝরেছে, হাত কেটে রক্ত পড়েছে, তবু কারাে মুখে কোন অভিযােগ নেই। শীতের রাত আরামদায়ক হয়ে উঠেছে স্বেদাক্ত শ্রমের বিনিময়ে।
মিনারের নকশা আগেই তৈরি হয়েছিল বদরুল আলম এবং সাঈদ হায়দারের হাতে। রাজমিস্ত্রী যােগাড় করা হল। সিমেন্টের অভাব হল না কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সর্দারের কল্যাণে। গুদামের চাবি এসে গেল ছেলেদের হাতে, আর সিমেন্ট পরিবহনের জন্য হাসপাতালের স্ট্রেচার। এনজিনিয়ার নামে পরিচিত দীর্ঘদেহী ছাত্রটি তার আধােঅভিজ্ঞতা নিয়েই সে রাতে এই স্থাপত্য কাজের তদারকি করেছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে শহীদ মিনার।
চব্বিশে ফেব্রুয়ারি। বারাে নম্বর ব্যারাক থেকে সামান্য দূরে, হােস্টেলের বুক-চেরা সুরকি-রাস্তার পাশে বাঁশের-ছাউনি ব্যারাকের পশ্চাদপট নিয়ে ভােরের আলােয় জেগে। উঠল প্রথম শহীদ মিনার। এর গায়ে সযত্নে আঁটা ফলকটিতে লেখা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। মিনারের পাদদেশ ঘিরে দড়ির বেষ্টনী পােস্টারে ছাওয়া। সেখানে নানা স্লোগানের মধ্যে ‘রাষ্ট্রভাষা তহবিলে মুক্তহস্তে দান করুন’ কথা কয়টিও ছিল। ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং সর্বস্তরে বাংলা চালু করার দাবি।
চব্বিশ-পঁচিশ-ছাব্বিশ-১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এই তিন দিন ঢাকা। শহরের সব পথের নিশানা শেষ হয়েছে শহীদ মিনারে এসে। পুরনাে ঢাকা নতুন ঢাকা একাকার হয়ে গেছে। শহরের ছােটবড় ছেলেমেয়ে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ, গৃতকর্তা-গৃহবধূ সবাই ক্ষণিকের জন্য হলেও শহীদ মিনারের সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছেন। আবেগের উত্তাল ঢেউ, কান্নার করুণ স্রোত নিঃশব্দে বয়ে গেছে। কারাে হাতে ফুল, কারাে হাতে দুটো সবুজ পাতার ডাঁটি।
৫০

লক্ষ্মীবাজার এলাকা থেকে শহীদ সফিউর রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমানকে ডেকে এনে প্রথম শহীদ মিনারের অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। সবকিছু দেখে শুনে ভয় পেয়ে যায় সরকার। ভক্তিপথের দুর্বার স্রোতের একমুখী গতি তাদের ভালােভাবেই জানা। মধ্যপন্থীরাও তখন এদিকে মাথা নুইয়ে দিয়েছে, এমনকি দক্ষিণপন্থী দৈনিক ‘আজাদ’ পর্যন্ত। শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন দৈনিক আজাদ-সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি সকাল প্রায় এগারােটার দিকে শামসুদ্দিন সাহেব উদ্বোধনের কাজ বেশ ধীরেসুস্থেই সম্পন্ন করলেন। অনুষ্ঠানের কয়েকটি ছবিও তােলা হল।
কিন্তু শহীদ মিনারের নিহিত শক্তি ও নীরব চ্যালেঞ্জ মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র এবং অবাঙালি-প্রধান সেই আমলাতন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত এ দেশীয় পুতুল সরকারের নেতৃবৃন্দ। তাই ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি বিকালে হঠাৎ করেই পুলিশ ঘেরাও করে মিডিকেল ব্যারাক। ভেতরে ঢােকে সশস্ত্র পুলিশ, সঙ্গে ট্রাক এবং কোদাল-শাবলগাঁইতি হাতে ঘাতক স্কোয়াড। আঘাত পড়ে শহীদ মিনারের পাঁজরে। বেশ কষ্ট করেই ভাঙ্গতে হয় মিনারের স্থাপত্য।
ওরা চলে যায়। যাবার আগে টুকরা-টুকরা করে ভাঙ্গা শহীদ মিনারের ইটসিমেন্টের শেষ খণ্ডটি ট্রাকে তুলে নেয়। না, ওদের বাধা দেবার মত কেউ সেখানে ছিল, বাধা দেবার কোন চেষ্টাও করা হয় নি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শহীদ মিনারের শূন্যস্থানটির দিকে শেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওরা দ্রুত অকুস্থল ত্যাগ করে। পেছনে রেখে যায় কিছু ধুলা আর পােড়া জ্বালানির উৎকট গন্ধ; সেই সঙ্গে মিনারের নির্বাক বেদনা। দূর থেকে কয়েকজন ছাত্র অসহ বেদনার এই করুণ দৃশ্যটি দেখে, আর স্মৃতিতে ধরে রাখে।
স্মৃতিস্তম্ভ গুড়িয়ে ফেলা সম্ভব হলেও স্মৃতির মিনার নিশ্চিহ্ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। কবির ভাষায় : ‘স্মৃতি যে দুরন্ত লােহার’-বৈশাখী রােদে, কি শ্রাবণের ধারাজলেও সে টিকে থাকে অফুরন্ত আয়ুর শক্তি নিয়ে। শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেবার পর সেই স্মৃতি ছড়িয়ে গেল দেশময়। সর্বত্র মাথা তুলে দাঁড়াল ছােটবড় নানা আকারের শহীদ মিনার, বিশেষ করে স্কুল, কলেজ বা প্রতিষ্ঠানের চত্বরে। মিনিয়েচার’ মিনারে ছেয়ে গেল সারাদেশ। শহীদ মিনার দেশ ও জাতির জন্য হয়ে উঠল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রেরণা, জাতীয় সংগ্রামের ধারাবহনকারী উৎস।
ভেঙ্গে ফেলার পর সে বছর শহীদ মিনার নতুন করে আর গড়ে তােলা হয় নি; ওরা আবারও সেই স্থাপত্য ভেঙ্গে ফেলবে এই আশংকায়। তাই তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন সালে শহীদ মিনারের অনুপস্থিতিতেই একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়েছে। পুরনাে শহীদ মিনারের স্থানটিতে লাল কাগজে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভের অবিকল ছােটখাট প্রতিকৃতি তৈরি করে কালাে কাপড়ে ঘিরে দেওয়া হয়। পূরণ করা হয় শহীদ মিনারের শূন্যতা। বদরুল আলম, জিয়া হাসান, নুরুল ইসলাম প্রমুখ মেডিকেল ছাত্র এ-কাজটি সম্পন্ন করেন। এখান থেকেই একুশের প্রভাতফেরির যাত্রা শুরু হয়। কার্জন হলের প্রাঙ্গণেও একটি ছােট প্রতীকী মিনার গড়ে ওঠে, যেখান থেকে ঢাকা হল এবং ফজলুল হক হলের ছাত্ররা প্রভাতফেরির মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসেন। সে বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজ এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীগণ মিলে কলেজ প্রাঙ্গণে মিনার তৈরির চেষ্টা করেন,
৫১

কিন্তু এক বছর পরও মিনার-বিদ্বেষী কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের বাধায় তাদের উদ্দেশ্য সফল হয় নি।
যতদূর জানা যায়, মফস্বলে এবং দেশের দূরদূরান্তে গ্রামাঞ্চলের স্কুলকলেজগুলােতে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ শহীদ মিনার তৈরি করে অথবা ইতােমধ্যে প্রতিষ্ঠিত শহীদ মিনার কেন্দ্র করেই একুশের কর্মসূচি অর্থাৎ প্রভাতফেরির মিছিল, সমাবেশ, আলােচনাসভা ইত্যাদি অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছে। শহীদ মিনার যথেষ্ট সংগ্রামী উৎসাহ ও উদ্দীপনা যুগিয়েছে, যদিও শহর ঢাকা এদিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। এমনি করে শহীদ মিনার দেশের ছাত্র-যুব-জনতার মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। চিরন্তনীর মর্যাদা নিয়ে শহীদ মিনার পরিণত হয়েছে স্মৃতির মিনারে।।
ছাপ্পান্ন সালের পূর্ব পর্যন্ত ঢাকায় এভাবেই অস্থায়ী শহীদ মিনার একুশে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি পালনে নিশ্চিহ্ন শহীদ মিনারের শূন্যস্থান পূরণ করেছে, প্রতিবাদী চেতনার শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে স্থানীয় সরকার শহীদ স্মৃতি রক্ষার চেষ্টায় এগিয়ে আসেন। ফুলার রােডের সমান্তরাল অবস্থানে দাঁড়ানাে বিশ নম্বর এবং বারাে নম্বর ব্যারাকের অংশবিশেষ নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
তখন কৃষক-শ্রমিক পার্টির সরকার ক্ষমতায়। মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকারের উদ্যোগে সরকারিভাবে মিনার গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ঠিক ছিল সেবছর (১৯৫৬ সালে) একুশে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। সেই প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে সরকারিভাবে ‘শহীদ দিবস’ হিসাবে ঘােষণা করা হয় এবং সেটি সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালিত হয়।
নানা কারণে সেবছর শহীদ দিবস ঘিরে জনমানস এতটাই আলােড়িত হয়ে ওঠে যে, ছাত্র-জনতা একুশে ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষা না করে বিশে ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদ আবদুল আউয়ালের ছােট্ট মেয়ে বসিরনকে দিয়ে প্রস্তাবিত শহীদ মিনারের ভিত্তিস্থাপন করায়। পরদিন অবশ্য সে কাজটিই আবার আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন করেন মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি এবং শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।
এরপর ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। এবং ১৯৫৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি নাগাদ মিনারের মঞ্চ ও স্তম্ভ এবং নিচে মুরালের কিছু কাজও শেষ হয়। মিনারের কাজে শিল্পী হামিদুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন ভাস্কর নােভেরা আহমেদ। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন এবং দেশের রাজনেতিক পটপরিবর্তনের কারণে মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
আবার ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর লে. জেনারেল আজম খানের উদ্যোগে শহীদ মিনারের অসম্পূর্ণ কাজ শুরু করা হয়। মূল নকশা ও পরিকল্পনার অনেকটা কাটছাট করে নিয়ে সংক্ষেপে মিনারের কাজ শেষ করা হয়। এবং ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।
৫২

সংবাদ শিরােনামে শহীদ বরকতের মা
বরকত জননীর ঢাকা আগমন
(ইউনিভার্সিটি রিপাের্টার)
ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শরীক হওয়ার জন্য অন্যতম শহীদ আবুল বরকতের বৃদ্ধা মাতা হাসিনা বেগম গতকল্য বুধবার স্বগ্রাম হইতে ঢাকা আগমন করিয়াছেন।
অদ্য সকালে এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হইবে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে খুব সম্ভবতঃ বরকত জননীই মিনারটির উদ্বোধন করিবেন। শহীদ বরকতের জননী হাসিনা বেগম গতকল্য ঢাকায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের মঙ্গল কামনা করিয়াছেন।
শহীদ দিবস পালনােপলক্ষে এখানে আগমনের পর তিনি বলেন, মাতৃভাষা আন্দোলনের ফলে আমি আমার একটি পুত্র হারাইলেও পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ ছাত্রই আমার পুত্রের স্থান দখল করিয়া আছে।
শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য তিনি প্রাদেশিক সরকারকে ধন্যবাদ জানাইয়া বলেন যে, যাহাদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার অধিকার লাভ করিয়াছে, তাহারা চিরদিন অমর থাকিবে। তিনি শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
আজাদ
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩
৮ ফাল্গন ১৩৬৯

যিনি আজ কোটি কোটি বরকতের মা
মায়ের মুখের ভাষার স্বীকতি আদায় করতে গিয়ে যে সব তরুণপ্রাণ সেদিন অকালে ঝরে পড়েছিল, তাদের অন্যতম এক-বরকতকে হারিয়ে যে হাসিনা বেগম আজ এদেশের কোটি কোটি বরকতের মায়ের আসনে অধিষ্ঠিতা, প্রতি বছরের ন্যায় এবারের অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠানাদিতেও শরীক হওয়ার জন্য এই বৃদ্ধ বয়সেও (৭৩ বৎসর) তিনি ছােট ভাই জনাব আব্দুল কাদেরের (৭০ বৎসর) হাত ধরে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন।
ইত্তেফাক
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫
৯ ফাল্গন ১৩৭১

৫৪

বরকত জননী কর্তৃক শহীদ মিনারের উদ্বোধন : অমর ২১শে স্মরণে ছাত্র জনতার অপূর্ব মিছিল।
বাংলা ভাষা ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের বজ্রকঠোর সঙ্কল্প গ্রহণ।
অফিস-আদালতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাতৃভাষার স্বীকৃতি দাবী।
(ইউনিভার্সিটি রিপাের্টার)

গতকল্য বৃহস্পতিবার ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য নব-নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ বরকতের ৭২ বৎসর বয়স্কা জননী হাসিনা বেগম এই মিনারের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনের পর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির চেয়ারম্যান এবং প্রাক্তন উজিরে আলা জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত এক সভায় মােট আটজন বক্তা বক্তৃতা করেন। বক্তাগণ অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ এবং অন্যান্য সকল সরকারী পর্যায়ে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের দাবী জানান।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারীভাবে শহীদ দিবস ঘােষণা করার দাবী জানানাে হয়।
বিভিন্ন বক্তা তাঁহাদেব বক্তৃতায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করিয়া বলেন যে, বর্তমান সরকার কর্তৃক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করার দ্বারা জনসাধারণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আর এক দফা জয় সূচিত হইল।।
গতকাল সহস্র তাজা প্রাণ এবং জনসাধারণের বিরাট মিছিলটি অত্যন্ত শৃংখলার সহিত ক্রমে ক্রমে ঢাকেশ্বরী রােড, মেডিকেল কলেজ হােস্টেল, বকশী বাজার, টি.বি. ক্লিনিক, রেলওয়ে হাসপাতাল, জিন্নাহ্ এ্যাভিনিউ, আব্দুল গনি রােড, কার্জন হল প্রভৃতি প্রদক্ষিণ করিয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে নব-নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে আসিয়া জমায়েত হয়। এই মিছিলে প্রাক্তন উজিরে আলা জনাব আতাউর রহমান খান, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় উজীর জনাব জহীরুদ্দীন, শাহ আজিজুর রহমান, সৈয়দ আজিজুল হক, শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দও অংশগ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে শহীদ বরকতের বৃদ্ধা মাতা হাসিনা বেগম কবর জেয়ারত করিয়া শহীদ তরুণ ছাত্রছাত্রীর কণ্ঠনিঃসৃত সঙ্গীত কাকলীতে রক্তস্নাত অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর বেদনাময় ইতিহাসের প্রতিধ্বনি বহন করিয়া আনে আর একটি সকাল। প্রাণের ভাষা বাংলার মৰ্য্যাদা রক্ষায় ১১ বৎসর পূর্বে যে সকল বীরের বুকের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হইয়াছিল, সেই শহীদদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি হৃদয়ের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য গতকল্য (বৃহস্পতিবার) সঙ্গীতমুখর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এবং জনসাধারণ সূর্যোদয়ের বহু পূর্ব হইতেই প্রভাতফেরী বাহির করিয়া গান গাহিতে গাহিতে আজিমপুর কবরস্তানে আগমন করেন। অতঃপর তাঁহারা শহীদ বরকত ও সালামের কবর জেয়ারতের পর পুষ্পমাল্য প্রদান করেন।
৫৫

ভাবগম্ভীর পরিবেশে কবর জিয়ারতের পর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী মিনারে উপস্থিত হইয়াছিলেন।
পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি হাজার হাজার ছাত্র-জনতার আবেগ-আকুল দৃষ্টির সম্মুখে কালাে ফিতা কাটিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে মিনারের উদ্বোধন করেন।
অসংখ্য পুষ্প এবং লতাপাতা সজ্জিত মিনারের ধাপগুলি অতিক্রম করিয়া বরকত জননী একগুচ্ছ পুষ্প প্রদান করেন।
অতঃপর জনাব আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে শহীদ মিনারের পাদদেশে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মােট আট জন বক্তা বক্তৃতা করেন।
ছাত্রনেতা জনাব ওবায়দুর রহমান বলেন, এইদিন শপথ গ্রহণের দিন। ভাষা আন্দোলনের মূলে যে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী, তাহা আদায়ের সংগ্রাম আজও অব্যাহত।
তিনি মায়ের মুখের ভাষাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছাত্র ও জনসমাজের প্রতি কঠোর ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানান এবং প্রাদেশিক পরিষদে বাংলা ভাষা চালু করার দাবী জানান।
কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জনাব মােহাম্মদ আনীস বলেন, আমাদের বিচার করা উচিত, আমরা বাংলা ভাষাকে কতটুকু মৰ্য্যাদা দিতে পেরেছি। কতটুকু আমাদের আচার ব্যবহারে, কাজে-কর্মে ব্যবহার করতে পেরেছি। তিনি বন্দি ছাত্রদের মুক্তি এবং সর্বপ্রকার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবী জানাইয়া দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরাইয়া দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান।
জনাব সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যারা শহীদ হইয়াছেন তাহাদের প্রতিটি রক্তকণার মূল্য সেইদিন আদায় হইবে যেদিন আমরা বাংলা ভাষার পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইব। তিনি অর্থনৈতিক অবহেলা ও সৰ্ব্বপ্রকার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। জনাব হায়দার আকবর খান বলেন, আজিকার এই দিন দাবী আদায়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের দিন। ভাষা আন্দোলনের মূলে যে গণতান্ত্রিক অধিকার চির জাগ্রত তাহা এখনাে মানিয়া লওয়া হয় নাই। বক্তৃতায় ছাত্রনেতা জনাব আবুল হাসনাত এবং মীজানুর রহমান শেলী শহীদদের প্রতি তাঁহাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া দেশের গণতান্ত্রিক দাবী আদায়ের সংগ্রাম জোরদার করার আহ্বান জানান। রিক্সা চালক সমিতির পক্ষ হইতে বক্তৃতা করেন। জনাব সুলতান আহমদ। এছাড়াও ছাত্রনেতা জনাব শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ ও জনাব সিরাজুল আলম সভায় বক্তৃতা করেন।
সভাপতির ভাষণ। জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় রক্তদান ব্যতীত কোনাে মহৎ কাজ সিদ্ধ হয় না। এইদিনের আন্দোলনের মধ্য দিয়া আমরা যে শক্তি সঞ্চয় করিয়াছি। তাহার নিকট আগামী সকল চক্রান্ত ধূলিসাৎ হইতে বাধ্য। বক্তৃতা শেষে তিনি হাত তুলিয়া শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
৫৬

আতাউর রহমানের প্রতি
জনতার ক্ষোভ প্রকাশ
তাহার ওজারতির আমলে কেন রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে যথােপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয় নাই এবং বর্তমান সরকার কর্তৃক সমাপ্তির জন্য শহীদ মিনারের নির্মাণকাৰ্য্য তাহারা, কেন অসমাপ্ত রাখিয়াছিলেন, সে সম্পর্কে জনতার পক্ষ হইতে জনাব আতাউর রহমান খানকে প্রশ্ন করা হইলে সভায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ইহাতে শহীদ মিনারের ভাবগম্ভীর পরিবেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়।

শহীদ বরকতের মায়ের
শুভেচ্ছা বাণী
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে শহীদ বরকতের মায়ের শুভেচ্ছা বাণী
আজ থেকে ১৭ বছর আগে এই অমর একুশে ফেব্রুয়ারীতে আমি আমার প্রিয় সন্তান আবুল বরকতকে হারিয়েছি। বরকতকে হারিয়ে আমি যেমন দুঃখ পেয়েছি তেমনি আনন্দও পেয়েছি। আনন্দ পেয়েছি এইজন্য যে, আমার বরকত প্রাণ উৎসর্গ করেছে নিজের মাতৃভাষার জন্য। এবং আমি এক বরকতকে হারিয়ে পেয়েছি পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীদের যারা আমার কাছে বরকতের মতই সমান প্রিয়। আমি আজ লক্ষ লক্ষ বরকতের মা এবং সেই খুশীতে আমার বুক ভরে আছে। তাই প্রতি বছর আমি তােমাদের ডাকে এই দিনের শােভাযাত্রায় যােগ দেয়ার জন্য সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা আসি। এবারও তােমাদের ডাকে আমার ঢাকা আসার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য এবং পাসপাের্ট ভিসার কড়াকড়ির জন্য আমি এবার আসতে পারছি না। তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।
আমার শুভেচ্ছা রইল তােমাদের জন্য। তােমরা যেভাবে মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছ তার জন্য আমি খুবই আনন্দিত। আমি খুবই আশান্বিত যে, তােমরা তােমাদের সংগ্রাম আরও সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাবে এবং তােমরা সফল হবে যেদিন পাকিস্তানের সমস্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারী অফিস-আদালত প্রভৃতিতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা যথাযথ মর্যাদা পাবে। একুশে ফেব্রুয়ারি অমর হােক। বাংলা ভাষা অমর হােক।
হাসিনা বেগম
গ্রাম : বাবলা
পাে: তালিবপুর
জেলা: মুর্শিদাবাদ
৫-২-৬৯
দৈনিক পাকিস্তান
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
৯ ফাল্গন ১৩৭৫
৫৭

আবুল বরকতকে নিয়ে সাহিত্য

এবার আমরা তােমার
হাসান হাফিজুর রহমান

আম্মা তার নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?
ঘূর্ণিঝড়ের মতাে সেই নাম উন্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে, ডাকবে,
দুটো ঠোটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতাে গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না?

কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতােদিন?

আবুল বরকত নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে-ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতে যে তাকে ডেকো না;
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার-কি বিষণা থােকা থােকা নাম;
এই একসারি নাম তার বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতাে এখন হৃদয়কে হানে;

বিচ্ছেদের জন্যে তৈরি হওয়ার আগেই আমরা ওদেরকে হারিয়েছি
কেননা, প্রতিক্রিয়ার গ্রাস জীবন ও মনুষ্যত্বকে সমীহ করে না;
ভেবে ওঠার আগেই আমরা ওদেরকে হারিয়েছি
কেননা প্রতিক্রিয়ার কৌশল এক মৃত্যু দিয়ে হাজার মৃত্যুকে ডেকে আনে।

আর এবার আমরা হারিয়েছি এমন কয়জনকে
যারা কোনােদিন মন থেকে মুছবে না,
কোনদিন কাউকেও শান্ত হতে দেবে না
যাদের হারালাম তারা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে
আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষ নাম! একসার জ্বলন্ত নাম।১০
৫৮

ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯
শামসুর রাহমান

আবার ফুটেছে দ্যাখাে কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনাে মিছিলে কখনাে-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদেরই চেতনারই রঙ।

আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তােলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে ।

দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মত
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে।
এখনাে বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিত উপত্যকায়।
সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।১১
৫৯

বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে
বশীর আলহেলাল
… আবাইয়ের দুই মামা। এই বাবলাতেই তাঁদের বাড়ি। বড়মামা বড় অফিসার। তিনি প্রথমে একটু অন্যরকম ভেবেছিলেন, আহা, চোদ্দ-পুরুষের ভিটে, জমি-জিরেত, আত্মীয়-পরিজন, চেনাজানা মানুষ, সব ফেলে যাওয়া! কিন্তু তারপর হঠাৎ মন শক্ত করে চলে গিয়ে ওখানে ঢাকায় বড় চাকরিতে ঢুকে পড়লেন। তাঁর বড় ছেলেটাও গেল প্রথমে, তারপর আর সবাই গেল। ওদিকে ঢাকায় আটচল্লিশ সালে হলাে ভাষা আন্দোলন। ওর সেই মামাতাে ভাই খুব একখানা বাংলাভাষার আবেগ আর দরদমাখানাে চিঠি লিখেছিল আবাইকে। আবাই সেই চিঠি পড়ে কেমন একরকম করে হাসল। বলল, আরে দূর, এক বাংলা থেকে যাব আর-এক বাংলায়। আরে, কিসের তােমার ভারত-পাকিস্তান। আমি ভারতে থাকলেই কি ভারতীয় নাকি? আর পাকিস্তানে গেলেই কি পাকিস্তানী নাকি? ইদানীং কলেজে ভর্তি হয়ে সে রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রতি কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে, রাষ্ট্রতত্ত্বে অনার্স পড়বে, এমএ পড়বে। সে বলে, এখন জাতিতত্ত্বের মীমাংসা কে করে দেবে দাও। পাকিস্তান যদি মুসলমান রাষ্ট্র হয়, ইসলামে তাে জাতিতত্ত্ব নাই। মুসলমান হচ্ছে বিশ্ব-নিখিল জাতি। তাহলে লাহাের প্রস্তাবের আন্দোলন একটা শুরু হতে ওখানে বাধ্য।
আইএ পরীক্ষা দিয়ে মা-কে বলল, মা, তুমি কি ভেবেছ পাকিস্তান খুব দূরে? এই তাে রাজশাহী। একবার ঘুরে আসি। তুমি থাকো।
ঘুরে আসতে গিয়ে সে ঢাকার মায়ায় জড়িয়ে গেল। ফরিদপুর থেকে কই আসে এই এত বড়-বড় ঢাকার বাজারে। ভাবে এই কইমাছকে কত ভয় করতাম এই সেদিনও। কিন্তু কইমাছকে চুষে-চিবিয়ে খেতে জানতে হয়। ওর ভাইগুলােও এক এক করে ঢাকা এসেছিল। মা সেই বাবলার পল্লীতে বসে ধূসর চোখে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, তােরা সুখে থাক, বাছারা।
যখন উনিশশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজের হােস্টেলের বারান্দায় পুলিশের রাইফেলের গুলি ওকে আঘাত করেছিল, একটু কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এখন সে সুখেই আছে। না, আজিমপুরের কবরে নয়, বাংলার মানুষের হৃদয়ে, তাদের বিবেকে, স্মৃতিতে আর কল্পনায়।
৬০

ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, সার্বভৌম। আমরা গান গাই : ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি। কিন্তু এ-দেশ চিরকাল স্বাধীন ছিল না। বারবার এই সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলার উপর হামলে পড়েছে বিদেশি শাসকশােষক, বিদেশি ইংরেজ প্রায় দু’শ বছর পরাধীন করে রেখেছে এ-দেশকে। তখন একটা গােটা দেশ ছিল ভারতবর্ষ, তার প্রদেশ ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই লড়ে ইংরেজকে তাড়িয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন করা হয়। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সে লড়াই ঐক্যবদ্ধভাবে একপ্রাণ হয়ে লড়তে পারে নি। ১৯৪৭ সালে জঘন্য সাম্প্রদায়িক হানাহানির মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলাে। কিন্তু দেশটা দুই ভাগ হয়ে গেল : ভারত আর পাকিস্তান। পাকিস্তানের আবার দুই অংশ : পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান। এই দুই অংশের মাঝখানে হাজার মাইলের ব্যবধান। সেই পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা আমাদের আজকের বাংলাদেশ।
যখন পাকিস্তান হলাে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ, তারা বাঙালি, আশা করল এবার সুখ-শান্তি হবে, শােষণ-অত্যাচার বন্ধ হবে। কিন্তু কই, মানুষের স্বপ্ন আশা সব ভেঙে খানখান হয়ে গেল। অন্ন বস্ত্র শিক্ষা সংস্কৃতি সবদিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে দাবিয়ে রাখল। এক খুলনাতেই বিশ হাজারের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গেল।
ওই যে সংস্কৃতির কথা বলেছি, বাঙালির ওই সংস্কৃতিকেই ওরা ধ্বংস করে দিতে চাইল। সংস্কৃতি হচ্ছে একটা জাতির ভাষা সাহিত্য শিক্ষা জ্ঞানচর্চা সঙ্গীত শিল্প অভ্যাস ঐতিহ্য সংস্কার এইসব। এই সংস্কৃতি দিয়েই তাে একটা জাতির, তার মানুষের পরিচয়। তাছাড়া সংস্কৃতি না থাকলে অর্থ-বিত্তও হয় না। যার শিক্ষা নেই, সংস্কৃতি নেই তাকে শােষণ করা সােজা।
সংস্কৃতির প্রধান অবলম্বন ভাষা, মাতৃভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ আর তাদের দোসররা কৌশল করল বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকেই ওরা খতম করে দেবে। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান নামে নতুন রাষ্ট্র হলাে তখনি প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে দেশের প্রধান ভাষা, যে-ভাষায় দেশের সব কাজ হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ওরা বলল, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা হতে পারে। ওই ভাষা রাষ্ট্রভাষা হলে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালির কী হবে? উর্দু তাে তাদের ভাষা নয়, তাদের ভাষা বাংলা ; তাছাড়া, বাংলা কত পুরনাে ভাষা, কত ভালাে ভাষা। এই ভাষায় হাজার বছর ধরে কত সাহিত্য কাব্য গল্প গাথা লেখা হয়েছে। বাঙালির ঘুমপাড়ানাে ঘুমভাঙানাে গান এই ভাষায়। মায়ের কোলে বাঙালি শিশু কোন ভাষায় প্রথম কথা বলে, মায়ের মুখে তারা
৬৪

কোন্ ভাষা শোনে? সে বাংলাভাষা। তারপর লেখাপড়া? লেখাপড়া কি নিজের ভাষা বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় ভালাে হয়? আমার ভাষায় আমি সব কাজকর্ম করতে পারব না এ কেমন কথা? কবি বলেছেন : ‘মােদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা!’ সেই ভাষাকেই ওরা খতম করতে চায়?
সারা পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বাংলাভাষাভাষীর লােকসংখ্যাই কিন্তু ছিল বেশি, ৫৬ শতাংশ। আর পশ্চিম পাকিস্তানের সব মানুষের ভাষা উর্দু তাও নয়। সেখানে সিন্ধুর ভাষা সিন্ধি, পাঞ্জাবের ভাষা পাঞ্জাবি, বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচি, সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পশতু। অথচ বাঙালির ভাষা বাষ্ট্রভাষা হবে না : উহু যাদের ভাষা তারা চাকরি-বাকরিতে কত সুযােগ-সুবিধা পাবে। সেইসব সুযােগ-সুবিধা পেতে হলে বাঙালিকে শিখতে হবে উর্দু ভাষা। বাঙালি বুঝল তাদের কী সর্বনাশ হতে চলেছে। তারা প্রতিবাদ করে উঠল। গড়ে উঠল আন্দোলন। এই আন্দোলন ভাষা-আন্দোলন নামে বিখ্যাত।
তখন তাে নতুন দেশ পাকিস্তান। নতুন আশা, নতুন উৎসাহ। তাছাড়া, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তাই প্রথম প্রথম সবাই বুঝতে পারে নি বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাঙালির কী ক্ষতি হবে। কিন্তু কিছু লােক ও সংগঠন ঠিকই বুঝেছিল ।
যখন বলা হলাে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা তখন সেই ১৯৪৭ সালেই গণ আজাদী লীগ বাংলার দাবি তুলে ধরেছিলেন। তখন দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হতাে কলকাতা থেকে। এই কাগজে আবদুল হক, মাহবুব জামাল জাহেদী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং আরাে অনেকে প্রবন্ধ লিখে দেখালেন উর্দুর চেয়ে বাংলার দাবি কম তাে নয়, বরং বেশি ।
তমদুন মজলিস এবং এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম এই সময় এগিয়ে আসেন। তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রচার করতে থাকেন, বাঙালিদের মধ্যেও যারা এই প্রশ্নের গুরুত্ব বুঝতেন না, এমনকি এমন বাঙালিও ছিলেন যারা মনে করতেন উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত, তাদের বােঝাতে থাকেন। নভেম্বর মাসে আবুল কাসেম ও অন্যেরা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিলেন। এতে শত শত ব্যক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু সরকার এতে কান দিলেন না। ঢাকায় খবর এল যে, করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষাসম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের প্রদেশগুলির শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব নেয়া হয়েছে। ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। ৬ই ডিসেম্বর (১৯৪৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হলাে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাঙ্গণে এই প্রথম সভা। এতে সভাপতিত্ব করেন আবুল কাসেম। যাঁরা বক্তৃতা করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ.কে.এম. আহসান, এস.আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ফরিদ আহমদ যে প্রস্তাবগুলি পেশ করেন তাতে স্পষ্টভাবে দাবি করা হয়, বাংলাকে পাকিস্তান ডমিনিয়নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার বাহন করতে হবে। সভা-শেষে ছাত্ররা মিছিল করে শিক্ষামন্ত্রীকে ঘেরাও করল।
৬৫

১৯৪৭ সালেই এইভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল । ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তমদুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে। এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন নুরুল হক ভূঁইয়া। সদস্য ছিলেন আবুল কাসেম, মােহাম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দীন আহমেদ, শওকত আলী, ফরিদ আহমদ, শামসুল আলম, আবুল খায়ের, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ এবং আরাে কেউ কেউ। এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল প্রধানত ছাত্ররা, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আন্দোলনের উপর বিরােধীপক্ষ হামলাও করেছিল।
তারপর এল ১৯৪৮ সাল। একটা ঘটনা ঘটে। ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন হয়। তাতে প্রস্তাব করা হয় যে, পরিষদের কাজ চলবে, সদস্যরা পরিষদে বক্তৃতা করতে পারবেন ইংরেজিতে আর উর্দুতে। পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বললেন, না, বাংলাকেও গণপরিষদের কাজের ভাষা করতে হবে। কিন্তু তার কথা শােনা হলাে না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বিরােধিতা করলেন। তারা বলতে চাইলেন ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে এটাই স্বাভাবিক। খাজা নাজিমুদ্দিন একটা ডাহা মিথ্যা বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে পেতে চায়। এই খবর ঢাকায় এসে পৌছালে যেন আগুনে ঘি পড়ল। ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা ভয়ানক প্রতিবাদ করলেন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ধর্মঘট করল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা হলাে, সভাপতিত্ব করেন আবুল কাসেম। নঈমুদ্দীন আহমেদ, মােহাম্মদ তােয়াহা তীব্র বক্তৃতা করেন। কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করে খাজা নাজিমুদ্দিনের নিন্দা করা হয় ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানানাে হয়। আজাদ পত্রিকা লিখল, এ বাংলাভাষার অপমান! নতুন করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে ২রা মার্চ। এই পরিষদে বিভিন্ন সংগঠনের দুজন করে প্রতিনিধি গৃহীত হন। আহ্বায়ক মনােনীত হন শামসুল আলম।।
তারপর ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে একটা দিন বিখ্যাত হয়ে রইল। সে-দিনটি ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ওই দিন সাধারণ ধর্মঘট হলাে। ঢাকা শহরে তােলপাড় চলল। প্রধানত ছাত্ররাই বিক্ষোভ সংগঠিত করল, তাতে যােগ দিল অফিস-আদালতের কর্মচারী, রেল-শ্রমিক। সেদিন ঢাকায় মফস্বল থেকে ছাত্ররা এসেছিল মাতৃভাষার দাবির প্রতি সমর্থন জানাতে। শহরের রাজপথগুলাে বিক্ষোভ মিছিলে আর রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে কেঁপে উঠল। তার উপর আক্রমণ নেমে এল। সেক্রেটারিয়েট ঘেরাও করা হলাে। একদিকে পুলিশের বেটন বেয়নেট বুট চলল, অন্য দিকে মুসলিম লীগের কিছু নেতার গুণ্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। বহু ছাত্র আহত হলাে, জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে গেল । কয়েকশ গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেন। তাঁদের কজনের আর নাম বলা যায়। তাঁদের মধ্যে পরবর্তীকালে বিখ্যাত নেতা হয়েছিলেন এমন কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যায়। তারা হলেন শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব, শামসুল হক, অলি আহাদ, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, আবদুল মতিন, আবদুল মালেক উকিল, গােলাম আযম, শেখ মুজিবুর রহমান। এদের সকলেই ভােগ করেন নির্যাতন ও কারাযন্ত্রণা। মােহাম্মদ তােয়াহা আহত হয়ে হাসপাতালে যান।
৬৬

জুলুমের প্রতিবাদে ছাত্র-ধর্মঘট ও সাধারণ ধর্মঘট চলে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বিক্ষোভের এই রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে আপােসের জন্য সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আলােচনায় বসেন। উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ছেড়ে দেয়া হয়। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষারূপে তিনি মেনে নেন। কিন্তু একটা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। পাকিস্তান সরকারের কাছে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাবেন বলে তিনি কথা দিয়েছিলেন। তার খেলাপ করেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রধান নেতা এবং গভর্নর-জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ (যাকে বলা হতাে কায়েদে আজম এবং জাতির পিতা) ১৯শে মার্চ ঢাকা এসেছিলেন। তিনি বাঙালির দাবি, তাদের মনের কথা বুঝতে পারলেন না। বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা তার মুখের উপরেই প্রতিবাদ করে বলল, না, , না।
ফল কি হলাে? ঘটল ১৯৫২ সালের ঘটনা।
এর মধ্যে জিন্নাহ সাহেব মারা গেলেন, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে গুলি করে মেরে ফেলা হলাে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। তার জায়গায় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হলেন মুসলিম লীগের নুরুল আমিন। এই মুসলিম লীগ সংগ্রাম করে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল । কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার তাে দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারল না। বরং মানুষের ন্যায্য দাবিকে তারা গায়ের জোরে নস্যাৎ করে দিতে লাগল। পূর্ব বাংলায় ভয়ানক অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিল। সােনার বাংলাকে শােষণ করে অর্থ-সম্পদ নিয়ে যেতে লাগল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলার সােনার আঁশ পাট কৃষকের কাছ থেকে অল্প দামে কিনে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা কোটিপতি হতে লাগল। পাকিস্তান সরকার কেন্দ্রীয় বাজেটের বেশির ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের কাজে ব্যয় করতে লাগলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে জুটল সামান্য। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পেল সামান্য। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মতাে অবস্থা হলাে। ঘনঘন দুর্ভিক্ষ দেখা দিল । এমনকি ওরা বলতে লাগল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমান, মুসলমান হিসাবে নিকৃষ্ট। দুঃখের কথা, পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালি নেতা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে থাকল। তাই মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরাে কত কত নেতা, কর্মী মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন বিরােধী পার্টি গঠন করলেন আওয়ামী লীগ।
আবার একটা ঘটনা ঘটল। প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি করাচি থেকে ঢাকা এলেন। পল্টন ময়দানের সভায় দাড়িয়ে আবার বললেন সেই পুরনাে কথা। বললেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সঙ্গে সঙ্গে আবার আগুন জ্বলে উঠল । আবার বিক্ষোভ সভা সমাবেশ মিছিল। আবার ছাত্ররা এগিয়ে এল, শ্লোগান তুলল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’! ৩০শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট হলো।
৬৭

সবাই বুঝলেন এবার আরাে বড় আন্দোলন করতে হবে । জোট বাঁধতে হবে। ছাত্রনেতা আর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলের নেতাদের সভা হলাে ৩১শে জানুয়ারি। এতে সভাপতিত্ব করলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী। আবার ভালাে করে গঠিত হলাে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’। কর্মপরিষদে প্রতিনিধি নেয়া হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দল, ছাত্র-সংগঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-হল থেকে, আরাে থাকেন পূর্ববঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য, ছাত্রনেতা ইত্যাদি। কর্মপরিষদে ৪০-৪২ জন প্রতিনিধি ছিলেন বলে জানা যায়, কিন্তু সব নাম আজ আর পাওয়া যায় না নিচের এই ২৮টি নাম পাওয়া যায় : মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, শামসুল হক, আবদুল গফুর, আবুল কাশেম, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন আহমদ, খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন, আলমাস আলী, আবদুল আওয়াল, সৈয়দ আবদুর রহিম, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, শামসুল হক চৌধুরী, খালেক নেওয়াজ খান, কাজী গােলাম মাহবুব, মীর্জা গােলাম হাফিজ, মজিবুল হক, হেদায়েত হােসেন চৌধুরী, শামসুল আলম, আনােয়ারুল হক খান, গােলাম মাওলা, সৈয়দ নূরুল আলম, নুরুল হুদা, শওকত আলী, আবদুল মতিন, আখতার উদ্দিন আহমদ। কর্মপরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন কাজী গােলাম মাহবুব।
কর্মপরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, সভা ও বিক্ষোভ-মিছিল হবে। তখন বাঙালির দাবি হচ্ছে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হােক, কিন্তু তার সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে আর একটা দাবিও করা হয়েছিল। মুসলিম লীগ সরকার তখন তার একটা চক্রান্ত চালাচ্ছিলেন। বাংলাভাষা আরবি হরফে লেখা হােক এই চেষ্টা করা হচ্ছিল। তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করা হচ্ছিল ভাষা-আন্দোলনে ।
২১শে ফেব্রুয়ারির প্রস্তুতি চলল। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-ধর্মঘট হলাে, বিরাট বিরাট মিছিল হচ্ছে, দেয়ালে দেয়ালে পােস্টার লাগানাে হচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। তাতে নাজিমুদ্দিন সাহেবের ব্যঙ্গচিত্রও থাকছে। ১১, ১২ আর ১৩ই ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালন করা হলাে, অর্থাৎ ছােট-ছােট পতাকা বিক্রি করে আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হলাে আর উদ্দীপনা সৃষ্টি করা হলাে।
অন্যান্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমানও তখন জেলখানায়। জেল (থকে চিকিৎসার জন্য শেখ মুজিবর রহমানকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে থেকে মানিক মিয়া নামক জনৈক পুলিশ সাব-ইনস্পেক্টরের সাহায্যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলেন তিনি। শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করেই তারা ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই শেখ মুজিবর রহমান ১৪ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করেন অনশন ধর্মঘট। সেই অনশন ধর্মঘট তিনি চালিয়ে যান ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এরই মাঝে চলে এলাে ইতিহাসের সেই বিখ্যাত দিন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, সেই করুণ-কঠিন দিন।
৬৮

মুসলিম লীগের নুরুল আমিন সরকার কী করলেন, ভয় দেখাবার জন্য, আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য আগের দিন ১৪৪ ধারা জারি করে দিলেন। ওই আইন জারি করলে একসঙ্গে চারজনের বেশি রাস্তায় নামা যায় না, সভা-সমাবেশ-মিছিল করা যায় না। ওই আইন ভাঙলে জেল, জরিমানা হতে পারে।
২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভা বসল কী করা যায়? একদল বললেন, আমরা আইন মানব, ১৪৪ ধারা ভাঙব না। আর একদল বললেন, না, সেটা ঠিক হবে না। আন্দোলন তাে চালাচ্ছে প্রধানত ছাত্ররা। তারা স্থির করল ১৪৪ ধারা ভাঙবে।
২০ তারিখের কর্মপরিষদের সভায় যে ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে বেশির ভাগ মত দেখা দিয়েছিল তার একটা কারণ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােতে ব্যবস্থাপরিষদের নির্বাচন ঠিকই হয়েছে, কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপরিষদের নির্বাচন কিছুতেই করছিলেন না, কারণ ততদিনে জনসাধারণের মধ্যে তাদের সমর্থন পড়ে গিয়েছিল। ১৪৪ ধারা ভেঙে আইন অমান্য করা হলে যে পরিস্থিতি দেখা দেবে তাতে সরকার নির্বাচন না করার আরাে অজুহাত পেয়ে যাবেন। যাইহােক, ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে, আন্দোলন দমন করার সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়া হবে ।
এল ২১শে ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা জ্বলন্ত দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা সভা করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিল আজকের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একটা অংশে। তুমুল উত্তেজনা, কোলাহল, তর্কাতর্কি। আওয়ামী লীগের শামসুল হক এসে বক্তৃতা করলেন, বােঝাতে চাইলেন কেন ১৪৪ ধারা ভাঙা ঠিক হবে না। উপাচার্য সৈয়দ মােয়াজ্জম হােসেন ও কয়েকজন অধ্যাপক এসে ছাত্রদের অনুরােধ করলেন, তােমরা ১৪৪ ধারা ভেঙো না। কিন্তু আবদুল মতিন, গাজীউল হক এদের বক্তৃতায় দ্বিধা, ভয় কোথায় চলে গেল। ততক্ষণে বেলা দুপুর হয়েছে। ফাল্গুনের মিষ্টি সকাল রােদে ধুলােয় উত্তেজনায় তেতে উঠেছে। ওদিকে গেটের বাইরে রাস্তায়, বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে সশস্ত্র সব পুলিশ প্রস্তুত হয়ে আছে।
গর্জে উঠলাে শ্লোগান, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। তারপর ছাত্ররা কোমর বাঁধল। পাঁচজন সাতজন দশজন করে ছােট-ছােট দলে গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে ১৪৪ ধারা অমান্য করতে লাগল। মুখে শ্লোগান রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পুলিশ তাদের ধরে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যেতে লাগল। কে আগে যাবে এই নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে হুড়ােহুড়ি পড়ে গেল। পুলিশ হিমসিম খেয়ে গেল। কত আর তারা গ্রেপ্তার করবে, থানায় আর কত জায়গা হবে। সত্যাগ্রহীদের অনেককে গাড়িতে তুলে ঢাকার বাইরে দূরে ছেড়ে দিয়ে আসতে লাগল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে তখন আইন-অমান্যকারী সত্যাগ্রহীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ লাঠি চালাল। লাঠির ঘায়ে পথে লুটিয়ে পড়তে লাগল ছাত্ররা। মেয়েদের দল পাঠানাে হতে লাগলাে, যাতে পুলিশ থমকে যায়, তাদের মনে দয়া হয়। কিন্তু মেয়েদের মাথায়ও পড়ল লাঠি। পুলিশ তখন কাঁদানে-গ্যাসের শেল ছাড়ল, কেবল পথে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে। মানুষ আর কতক্ষণ সহ্য করে, বিশেষ করে ছাত্ররা! পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছুঁড়তে লাগল । চলল পুলিশের সঙ্গে
৬৯

ছাত্র-জনতার খণ্ডযুদ্ধ। ছাত্রদের সঙ্গে বিক্ষোভে যােগ দিয়েছিল এলাকার রেস্টুরেন্টের বয়, অফিসের পিয়ন-কর্মচারী, রিকশাওয়ালারা। পুলিশ তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারল না। তখন ঘটল সেই মর্মান্তিক ঘটনা। পুলিশ গুলি চালাল। কেবল রাস্তায় নয়, মেডিক্যাল কলেজের ভিতরেও। পথের উপরেই শহীদ হলেন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের আইকম এর ছাত্র রফিকউদ্দীন আহমদ, আবদুল জব্বার। রফিকের মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল, মগজ বেরিয়ে পড়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ এর ছাত্র আবুল বরকত শহীদ হন মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে। অসংখ্য আহত হয়ে হাসপাতালের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লাগলেন। ডাক্তার নার্সরা অক্লান্তভাবে তাদের চিকিৎসা অপারেশন সেবা করে চললেন। আহতদের মধ্যে সেক্রেটারিয়েটের পিয়ন আবদুস সালাম পরে মারা যান। অহিউল্লাহ নামে আট-নয় বছরের এক কিশােরও শহীদ হন। মেডিক্যাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনার খবর আগুনের মতাে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সােনার ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার মান রাখতে প্রাণ দিয়েছে এই খবর শুনে সবাই শশাকে দুঃখে রাগে ঘৃণায় অস্থির হয়ে উঠল। মানুষের স্রোত ছুটে এল মেডিক্যাল কলেজের দিকে। তারা আহতদের খবর নিতে লাগল, তাদের প্রাণরক্ষার জন্য ছাত্রদের আবেদনে সাড়া দিয়ে রক্ত দিতে লাগল। আর সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। কদিন যেন আর সরকারই রইল না। ছাত্ররা মাইকে অনলবর্ষী ভাষায় বক্তৃতা করছে মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেল, এসএম হল থেকে। কদিন তারা যা বলেছে, যা নির্দেশ দিয়েছে লােকে তাই শুনেছে। যেন তারাই সরকার। সবাই ধিক্কার দিচ্ছে নুরুল আমিনকে আর তার মুসলিম লীগ সরকারকে।
পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারিও গুলি চলল। ঐ দিন মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদদের লাশের জানাজার নামাজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি লাশও পাওয়া গেল। পূর্ব-রাত্রে পুলিশ মর্গ থেকে লাশ সরিয়ে গায়েব করে দিয়েছে। তাই গায়েবানা জানাজা নামাজ হলাে। মর্মস্পর্শী ভাষায় ইমাম সাহেব মােনাজাত করলেন, হে আল্লাহ, যে জালেমরা আমাদের মাসুম বাচ্চাদের উপর গুলি চালিয়েছে তাদের ধ্বংস করে দাও।
গায়েবানা জানাজার পর লক্ষ-লােকের শােক-মিছিল বেরিয়েছিল । মিছিলে উড়ছে শহীদদের রক্তমাখা জামা। এই মিছিলের উপর আবার শহরের নানা জায়গায় গুলি চলল, এমনকি বেয়নেট-চার্জ করা হয়েছিল। এদিন শহীদ হলেন শফিউর রহমান। আরাে কত সংগ্রামী শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাদের লাশ গুম করে ফেলে। অবশ্য রাতের আঁধারে গােপনে পুলিশ আজিমপুর পুরাতন গােরস্তানে কয়েকজন শহীদের লাশ কবর দিয়েছিল। তাদের মধ্যে এখন কেবল শহীদ আবুল বরকত আর শহীদ শফিউর রহমানের কবর দুটি রয়েছে।
ওদিকে ২১শে আর ২২শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের অভ্যন্তরে চলল তুমুল আলােচনা বিতর্ক বিক্ষোভ | সদস্যরা ছাত্রহত্যার তদন্ত আর অপরাধীদের বিচার দাবি করলেন, নুরুল আমিনের পদত্যাগ দাবি করলেন। সেই স্মরণীয় বিতর্কে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলাভাষার দাবি তুলেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ খােন্দকার,
৭০

ভােলানাথ বিশ্বাস, খয়রাত হােসেন, আলী আহমেদ কান, আনােয়ারা খাতুন, প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তী, মুনীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, সুরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত।
আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মওলানা তর্কবাগীশ এবং পরে আরাে কেউ কেউ ছাত্রদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে পরিষদ থেকে পদত্যাগ করলেন।
প্রতিবাদের যে ঝড় বয়ে চলল তাতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করল অধিকাংশ পত্রপত্রিকা, যেমন, দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক সৈনিক, দৈনিক ইনসাফ, সাপ্তাহিক নও-বেলাল ইত্যাদি। দৈনিক মর্নিং নিউজ ভাষা-আন্দোলনের বিরােধী ভূমিকা পালন করায় জনগণ তার অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আন্দোলন চলল। চলল লাগতার হরতাল আর বিক্ষোভ, কেবল ঢাকা শহরে নয়, সারা পূর্ব পাকিস্তানে, সমস্ত শহরে, এমনকি বহু গ্রাম পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকায় কারফিউ জারি হলাে ! নেতারা ছাত্রদের কাছে এসে একাত্মতা ঘােষণা করলেন। আবুল বরকত যেখানে শহীদ হয়েছিলেন সেই জায়গায় ছাত্ররা ২৩শে ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত্রে কারফিউয়ের মধ্যে একরাত্রে বেশ উঁচু এক শহীদ মিনার গড়ে তােলেন। যত মানুষ, নারীপুরুষ এসে সেখানে অশ্রু ফেলে, টাকা-পয়সা দেয়, এমনকি কোনাে কোনাে মেয়ে গায়ের অলঙ্কার রেখে যায়। কিন্তু পুলিশ এসে একদিন শহীদ মিনার ভেঙে দিয়ে যায়। কবি লেখেন :
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তােমার?
ভয় কি বন্ধু,
আমরা রয়েছি চার কোটি পরিবার,..
তারপর আরাে জেল-জুলুম নেমে আসে। ভাষা-আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। অনেকে আত্মগােপন করেন।
কিন্তু তাতে কী লাভ হলাে? মানুষের বিক্ষোভ, সংগ্রাম আর অধিকার কি ওরা দমন করতে পারল? পূর্ব পাকিস্তানে সেই নির্বাচন হলাে ১৯৫৪ সালে। তাতে মুসলিম লীগ হেরে একেবারে প্রায় শেষ হয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এক তরুণ ছাত্রনেতার কাছে হেরে গেলেন। ভাষা-আন্দোলন চলেছিল ১৯৫৬ পর্যন্ত। ওই বছর পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলে স্বীকার করতে হলাে। কেবল তাই নয়, সেই যে বাঙালি জাতীয়তার চেতনা মাথা তুলল, তাই ক্রমে ক্রমে ১৯৭১ সালে গিয়ে পাকিস্তানি শাসক-শােষকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ের, মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলাে। তাই আমরা এখনাে গাই ।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
আমাদের ভাষা-আন্দোলনের শিক্ষা হলাে : সকল ভাষার সমান মর্যাদা। আর মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে কখনাে শাসন-ত্রাসন দিয়ে দমন করা যায় না।১৪
৭১

সূত্র-নির্দেশ

১. বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে, বশীর আলহেলাল, পৃ. ৭২
একুশের গল্প, সম্পাদক : রশীদ হায়দার, প্রকাশক বাংলা একাডেমী, ফারুন ১৩৯০
২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮, ৮৪
৩. শহীদ আবুল বরকতের পরিবার
৪. ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, বশীর আলহেলাল, ফারুন ১৩৯৭, বাংলা একাডেমী,
ঢাকা।
৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯
৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ২১
৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩
৮. গণসাহিত্য পত্রিকা, ৪র্থ বর্ষ, সংখ্যা ১৩৮২, পৃ. ৯-১৪
৯. ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা, আহমদ রফিক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, মাঘ
১৩৯৯, পৃ. ৭৫-৮১
১০. বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সম্পাদক গাজীউল হক, এম আর আখতার মুকুল, হাক্কানী
পাবলিশার্স, ফাঙ্গুন ১৩৯১, পৃ. ৮১
১১. নিজবাসভূমে- শামসুর রাহমান, পৃ. ১৩-১৪, ২৬ মার্চ ১৯৭৪, নওরােজ কিতাবিস্তান,
বাংলা বাজার, ঢাকা।
১২, একুশের গল্প, সম্পাদক রশীদ হায়দার, বাংলা একাডেমী, ঢাকা পৃ. ৮৪
১৩. উত্তরাধিকার, সাহিত্য সম্মেলন সংখ্যা, ১৯৭৪, বাংলা একাডেমী।
১৪. বশীর আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা,
ফাঙ্গুন ১৩৯৭, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ১-১৫।

সহায়ক গ্রন্থ

১. ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, বশীর আলহেলাল, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
২. ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা, আহমদ রফিক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা ।
৩. ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র, সম্পাদনা : রতন লাল চক্রবর্তী, বাংলা একাডেমী,
৪. ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কয়েকটি দলিল, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৫. একুশের কবিতা, বাংলা একাডেমী,
৬. ঢাকা একুশের গল্প, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৭. ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৮. গণসাহিত্য পত্রিকা, ৪র্থ বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, ১৩৮২ \
৯. ভাষা আন্দোলন ও শহীদ রফিক, সৈকত আসগর, উপজেলা পরিষদ, সিঙ্গাইর, মানিকগঞ্জ ১০. একুশে ফেব্রুয়ারী, হাসান হাফিজুর রহমান, পুঁথিপত্র প্রকাশনী
১১. বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, সম্পাদক : গাজীউল হক, এম আর আখতার মুকুল,
হাক্কানী পাবলিশার্স।
১২. নিজ বাসভূমে, শামসুর রাহমান, নওরােজ কিতাবিস্তান
১৩. উত্তরাধিকার, সাহিত্য সম্মেলন সংখ্যা, ১৯৭৪, বাংলা একাডেমী।
৭২